ভারতের প্ল্যাটফর্ম শ্রমিক তথা অনলাইন ডেলিভারি শ্রমিক

ভারতের প্ল্যাটফর্ম শ্রমিক তথা অনলাইন ডেলিভারি শ্রমিক

সুমন চৌধুরী

বাঁচার মত মজুরির দাবিতে ২০২২ এ কলকাতায় সুইগির কর্মীদের আন্দোলন, ছবি: NurPhoto

বিশ্বজুড়ে অস্থায়ী, চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকের অনুপাত দিনে দিনে বাড়ছে। এর সঙ্গে প্রযুক্তির প্রাপ্যতায় এবং করোনা পরিস্থিতিতে এক নতুন ধরনের শ্রমিক সংখ্যা প্রায় সব দেশেই বাড়তে থাকে। করোনা পরবর্তী কালেও অনলাইন শ্রমিক বৃদ্ধির এই ধারা জোরদার ভাবে অব্যাহত থাকে। এনিয়ে এখনও যথেষ্ট গবেষণা হয়নি, শ্রম আইনেও এই ধারার শ্রমিকদের সুরক্ষা নাই, ট্রেড ইউনিয়ন বা সংগঠিত রূপও খুবই দুর্বল। এই অবস্থায় আমাদের মনোযোগ দরকার। এই বিবেচনায় কলকাতার অনীকে প্রকাশিত এই লেখায় সেখানকার অনলাইন শ্রমিকদের সর্বশেষ পরিস্থিতি অনুসন্ধান করা হয়েছে, এখানে তা পুনপ্রকাশ করা হলো। পাশাপাশি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই শ্রমিকদের ওপর অনুসন্ধান পরিচালনা করে তার ভিত্তিতে একটি লেখা এই সংখ্যায় প্রকাশ করা হলো।  

সকাল ১২টায় “ডিউটি” শুরু। ঠিক তার ৫ মিনিট আগে পৌঁছে যেতে হয় “জোনে”। একটু একটু করে নির্দিষ্ট ভিড় জমতে থাকে জোনের বড়ো রেস্তোরাঁর সামনে। অনেকটা বিভিন্ন দলের জার্সির বা রংবেরঙের পোশাক পরা মানুষগুলোর মতো। দু’চাকার যান আর ঢাউস ব্যাগ তাদের সঙ্গী। স্মার্ট ফোনে নির্দিষ্ট সময়ে “লগ-ইন” বা “ডিউটি অন” করে বসে থাকতে হয়। ফোনে অ্যালার্ম বেজে ওঠা মানে অর্ডার ঢুকেছে। অর্ডার “অ্যাক্সেপ্ট” করে নির্দিষ্ট রেস্টুরেন্টের সামনে পৌঁছে যেতে হয় অর্ডার তোলার জন্য। তারপর সেই অর্ডার পৌঁছে দেওয়া কাস্টমারের বাড়ি।

এটা একটা উদাহরণ। কোনও এক বিশেষ অনলাইন ডেলিভারি পরিষেবা ক্ষেত্রের শ্রমিকের একদিনের জীবনের খণ্ডচিত্র। অ্যাপ-নির্ভর ডেলিভারি সংস্থার ডেলিভারির কাজ করেন যে শ্রমিকরা, তাঁদের রোজনামচা একটু অন্যরকমও হতে পারে। শুরুতে তাই এই কাজের প্রকারভেদ এবং তার বিশেষ শ্রমপ্রক্রিয়ার বিষয়ে একটা আলোচনা করবো। সেই আলোচনার সূত্র ধরেই খুলবে এই কাজের সাথে যুক্ত শ্রমিকদের শোষণের মূর্ত রূপ, তাদের সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধের সম্ভাবনার কিছু দিক— সারা বিশ্ব জুড়েই যা শ্রমিক আন্দোলনের নতুন স্পন্দনের হদিশ দিতে পারে।  

“গিগ”— এই শব্দটি দিয়ে দুনিয়াজুড়ে নতুন গড়ে ওঠা পরিষেবা শ্রমক্ষেত্রের একটা বিরাট অংশকে চিহ্নিত করা হচ্ছে, সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী যে অংশটি ক্রমবর্ধমান। ভারত সরকারের নীতি আয়োগ গত জুন ২০২২-এ একটি বিশেষ রিপোর্ট বের করে যার শিরোনাম— “India’s Booming Gig and Platform Economy: Perspectives and Recommendations on the Future of Work”। সেখানে উল্লিখিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৯-২০ সালে সারা দেশের গিগ শ্রমিকের আনুমানিক সংখ্যা ছিল ৬৮ লক্ষ, ২০২০-২১-এ যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭ লক্ষে এবং অনুমান করা হচ্ছে ২০২৯-৩০-এ গিয়ে সংখ্যাটা দাঁড়াবে ২.৩৫ কোটি। এই রিপোর্টে গিগ শ্রমিকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে— যে ধরণের শ্রমিকরা “সাবেকি শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক তথা নিয়োগকারী ও নিযুক্ত কর্মীর সম্পর্কের কাঠামোর বাইরে গিয়ে কাজ করছেন” তাদের সাধারণভাবে গিগ শ্রমিক বলা যায়। উল্লেখ্য, চার শ্রম কোডের মধ্যে এক শ্রম কোড “সামাজিক সুরক্ষা বিষয়ক কোড ২০২০”-তেও প্রায় একই সুরে গিগ শ্রমিকদের বিষয়ে বলা হয়েছে। আদপে গিগ শ্রমিক কারা তা বোঝার জন্য এই সংজ্ঞাটি যথেষ্ট তো নয়ই, বরং কী অর্থে গিগ শ্রমিকদের সমগ্র শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে তার তাৎপর্যও এর থেকে পরিষ্কার হয় না। ঠিক কী কী বৈশিষ্ট্য “সাবেকি শ্রমিক-মালিক” সম্পর্কের থেকে গিগ শ্রমিককে আলাদা করে, তার একটি আলোচনা ব্যতিরেকে এই সম্পর্কের তাৎপর্য বুঝে ওঠা মুশকিলও বটে। এই বিষয়ে আলাদাভাবে আমরা মনোযোগ দেব এই লেখার অন্যত্র। আপাতত, গিগ শ্রমিক বিষয়টি কী আমরা তা জানি বা বুঝি বলে ধরে নিয়েই এগোনো যাক।

“গিগ”— এই শব্দটি দিয়ে দুনিয়াজুড়ে নতুন গড়ে ওঠা পরিষেবা শ্রমক্ষেত্রের একটা বিরাট অংশকে চিহ্নিত করা হচ্ছে, সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী যে অংশটি ক্রমবর্ধমান।

গিগ শ্রমিকদের একাংশ তাঁদের কাজ সম্পন্ন করেন মূলত বিভিন্ন অ্যাপ তথা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মধ্যস্থতায়। বলা যায় এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোই তাঁদের কাজের মাধ্যম। গিগ শ্রমিকদের এই বিশেষ অংশটিকে নামকরণ করা হয় “প্ল্যাটফর্ম শ্রমিক” বলে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অনলাইন বিভিন্ন ওয়েবসাইট, যা পড়াশোনার কোচিং, ছাত্রছাত্রীদের হোমওয়ার্ক করে দেওয়া, কোডিং সহ নানান দক্ষতা অর্জন করার জন্য ব্যবসা করে সেরকম কোনও ওয়েবসাইটের হয়ে ‘খেপ খাটা’ (যার পোশাকি নাম “ফ্রিল্যান্সিং”) বা অ্যাপের মাধ্যমে খাবার, সবজি বা অন্য কোনও পণ্যের পরিবহন করছেন যে শ্রমিক– তাঁরা সব প্ল্যাটফর্ম শ্রমিক। এদের মধ্যে অ্যাপনির্ভর ব্যবসার ক্ষেত্রের ডেলিভারির কাজের সাথে যুক্ত শ্রমিকরা যেকোনো শহরে সবচেয়ে দৃশ্যমান এবং এই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার মাপকাঠি বিচার করে বলা যায় এই অংশই সংখ্যাগরিষ্ঠ। গিগ শ্রমিক তথা প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকদের এই অংশকে কেন্দ্রবিন্দু করেই আমরা গিগ শ্রমিকের কিছু বৈশিষ্ট্য তাদের সামগ্রিকতায় বোঝার চেষ্টা করবো। 

গিগ শ্রমিকদের এই বিশেষ অংশটিকে নামকরণ করা হয় “প্ল্যাটফর্ম শ্রমিক” বলে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অনলাইন বিভিন্ন ওয়েবসাইট, যা পড়াশোনার কোচিং, ছাত্রছাত্রীদের হোমওয়ার্ক করে দেওয়া, কোডিং সহ নানান দক্ষতা অর্জন করার জন্য ব্যবসা করে সেরকম কোনও ওয়েবসাইটের হয়ে ‘খেপ খাটা’ (যার পোশাকি নাম “ফ্রিল্যান্সিং”) বা অ্যাপের মাধ্যমে খাবার, সবজি বা অন্য কোনও পণ্যের পরিবহন করছেন যে শ্রমিক– তাঁরা সব প্ল্যাটফর্ম শ্রমিক। এদের মধ্যে অ্যাপনির্ভর ব্যবসার ক্ষেত্রের ডেলিভারির কাজের সাথে যুক্ত শ্রমিকরা যেকোনো শহরে সবচেয়ে দৃশ্যমান

অনলাইন ডেলিভারির বিভিন্ন মডেল

যে উদাহরণটা দিয়ে লেখা শুরু হয়েছিল সেখানে ফিরে আসা যাক। উদাহরণটি থেকে এই কাজের একটি সাধারণ বিন্যাস (প্যাটার্ন) সামনে আসে। অ্যাপনির্ভর ডেলিভারির কাজে যুক্ত একজন শ্রমিককে এখানে কাজে নামার আগে কিছু পূর্বশর্ত পূরণ করতে হয়। কাজের যোগ্যতা হিসাবে তাকে দু’চাকার কোনও একটি যান (সাইকেল বা মোটরসাইকেল) চালানো ও স্মার্ট ফোন ব্যবহার করতে জানতে হয়। এই দুই যোগ্যতার সাথে থাকতে হয় এই দুই বস্তুর মালিকানাও। ন্যুনতম এই পুঁজি নিয়েই একজন ডেলিভারি শ্রমিককে কাজে নামতে হয়। অ্যাপনির্ভর ডেলিভারি ব্যবসার ক্ষেত্রটিতে ডেলিভারির মূলত তিনটি মডেল দেখা যায়। ফুড ডেলিভারি, ই-কমার্স ও কুইক-কমার্স। সুইগি, জোমাটো, উবের ইটস ইত্যাদি সংস্থা ফুড ডেলিভারি মডেলে ব্যবসা করে। এর মধ্যে শুধু সুইগি ও জোমাটো, এই দুই কোম্পানিই প্রায় ৮০ শতাংশ অনলাইন ফুড ডেলিভারি ব্যবসার ক্ষেত্রটিকে ধরে ফেলেছে।

কাজের যোগ্যতা হিসাবে তাকে দু’চাকার কোনও একটি যান (সাইকেল বা মোটরসাইকেল) চালানো ও স্মার্ট ফোন ব্যবহার করতে জানতে হয়।

ফুড ডেলিভারি মডেল

এই মডেলে একজন ডেলিভারি শ্রমিক কোনও একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক ঘেরাটোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলে এবং তার অ্যাপে “অন ডিউটি” থাকলে তার কাছে অ্যাপের মাধ্যমে অর্ডার আসে। নির্দিষ্ট দূরত্বের (এই দূরত্বের টেকনিকাল নাম “ফার্স্ট মাইল”) একটি রেস্তোরাঁ বা ক্লাউড কিচেন (অর্থাৎ যাতে শুধু অনলাইন ব্যবসার জন্যই খাবার তৈরি হয়) থেকে খাবার সংগ্রহ করে সেই শ্রমিককে খাবার উপভোক্তা বা কাস্টমারকে ডেলিভারি করতে হয় কাস্টমারের বাড়ি (যেখান থেকে খাবার তোলা হল সেখান থেকে কাস্টমারের বাড়ির দূরত্বের নাম “লাস্ট মাইল”)। ডেলিভারির এই মডেল ডায়নামিক মডেল, এখানে প্রতি পদে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে অ্যালগরিদমের বা একটি অদৃশ্য কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি। একজন কাস্টমারকে তার পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার পর, অন্য কোন কাস্টমারকে পরবর্তী ডেলিভারিটি দেওয়া সবচেয়ে দ্রুত করা সম্ভব, তা অ্যাপটি প্রতিমুহূর্তে ঠিক করে ডেলিভারি শ্রমিককে জানিয়ে দেয়। সর্বদা পরিবর্তনশীল অবস্থায় কাজ করতে হচ্ছে বলে এই মডেলটিকে ‘ডায়নামিক’ মডেল বলা হয়। 

ই কমার্স মডেল

অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট (তথা ই-কার্ট) এই জাতীয় সংস্থাগুলো অনলাইনে পণ্য কেনাবেচার প্ল্যাটফর্ম হিসাবে যে ব্যবসা করে তার ডেলিভারির কাজ হয় এই মডেলে। এখানে কোনও একটি শহরে এক বা একাধিক ওয়্যারহাউস (Warehouse) তথা হাব বা পণ্য রাখার গুদামঘর থাকে যেখানে কাস্টমারের অর্ডার করা পণ্যগুলো প্রতিদিন জমা হয় এবং দিনের কিছু নির্দিষ্ট সময়ে সেগুলো ঠিকানা অনুযায়ী ভাগাভাগি (sorting) হয়ে ডেলিভারি শ্রমিকদের দায়িত্বে এসে যেগুলো পড়ে সেই ভাগগুলো সেগুলো তাকে নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দিতে হয়। এই কাজে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে একজন ডেলিভারি শ্রমিক জেনে যাচ্ছেন তাঁর সারাদিনের কাজ তথা ঘোরাঘুরির ফিরিস্তি। এই অর্থে এই মডেলটি স্ট্যাটিক, কেননা সেই ফিরিস্তি সময়ের সঙ্গে আর পরিবর্তিত হচ্ছে না। 

কুইক কমার্স মডেল

আগে থেকেই কিছু অনলাইন ব্যবসা-সংস্থা বাড়ি বাড়ি মুদিখানার পণ্য পৌঁছে দেওয়ার ব্যবসা করত। সাবেকি সেই মডেল অনেকটা ই-কমার্সের সাথেই তুলনীয় ছিল। বিশেষ করে লকডাউনের সময় থেকেই এই ব্যবসার ক্ষেত্রটি অনেকটা প্রসারিত হয়। বাড়ি বাড়ি দ্রুত জিনিস পৌঁছে দেওয়ার একটা চাহিদা তৈরি হয় ক্রেতাদের দিক থেকেও। এই চাহিদাকে ধরেই ব্যবসার নতুন ক্ষেত্র হিসাবে উঠে আসে স্বল্পসময়ে পণ্য ডেলিভারির এই মডেল। আগে থেকে যারা এই কাজ করতো সেই সব সংস্থা নিজেদের ভোল বদল করে এই পর্যায়ে দ্রুত পণ্য ডেলিভারির উপযোগী করে। কীভাবে তা সম্ভব? পুরনো মডেলে শুধুমাত্র বাইক বা সাইকেলের গতি বাড়িয়েই তা হয় না। এক্ষেত্রে প্রয়োজন হল ই-কমার্স ও ফুড ডেলিভারি— এই দুই মডেলের মিশেল। একইসাথে স্থির (স্ট্যাটিক) কাঠামোও থাকবে, আবার অর্ডার অনুযায়ী ডেলিভারির গতিশীল (ডায়নামিক) ধরণও থাকবে। ভৌগোলিকভাবে একটি ছোট (অর্থাৎ, ৪-৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের) এলাকার মধ্যে একটি মাইক্রো-ওয়্যারহাউস বা ক্ষুদে গুদাম বা স্টোর থাকবে যাতে ওই এলাকার কাস্টমারদের সম্ভাব্য চাহিদার হিসেব অনুযায়ী (ক্রমপরিবর্তনশীল বিন্যাস অনুযায়ী) পণ্যের জোগান থাকবে। একইসাথে ওই স্টোরটি থেকে পণ্য পরিবহনের জন্য ডেলিভারি শ্রমিকরা থাকবেন, যাঁরা ওই নির্দিষ্ট ভৌগোলিক বৃত্তের মধ্যেই ডেলিভারির কাজ করবেন।

একজন ডেলিভারি শ্রমিক এক্ষেত্রে তার কাজের শিফটের একটা বড়ো সময় স্টোরটির আশেপাশেই থাকছেন। এই ক্ষেত্রটিতে ব্যবসা করে এ’রকম কিছু সংস্থা হল জেপ্টো (Zepto), ব্লিংকিট (Blinkit) ইত্যাদি। এর মধ্যে জেপ্টো নতুন সংস্থা। জেপ্টো নামটিও তাৎপর্যপূর্ণ— সময়ের ক্ষুদ্রতম একক!

একটি শহর বা অঞ্চল এইভাবেই ছোট ছোট বৃত্তের ভৌগোলিক এলাকায় ভাগ হয়ে যাচ্ছে যার প্রতিটাতে একটা করে স্টোর, সেই স্টোরের অভ্যন্তরে কর্মরত শ্রমিক এবং স্টোর থেকে পণ্য ডেলিভারির জন্য ডেলিভারি শ্রমিকরা থাকছেন। একজন ডেলিভারি শ্রমিক এক্ষেত্রে তার কাজের শিফটের একটা বড়ো সময় স্টোরটির আশেপাশেই থাকছেন। এই ক্ষেত্রটিতে ব্যবসা করে এ’রকম কিছু সংস্থা হল জেপ্টো (Zepto), ব্লিংকিট (Blinkit) ইত্যাদি। এর মধ্যে জেপ্টো নতুন সংস্থা। জেপ্টো নামটিও তাৎপর্যপূর্ণ— সময়ের ক্ষুদ্রতম একক! গ্রফারস (Grofers) বলে একটা পুরনো গ্রসারি ডেলিভারি সংস্থার শেয়ার কিনে নেয় জোমাটো কোম্পানি ২০২২ সালের জুন মাসে এবং তার নতুন নামকরণ হয় ব্লিংকিট। একইভাবে সুইগিও তার কুইক-ডেলিভারি শাখা হিসাবে ইন্সটামার্ট চালু করে, টাটা অধিকৃত বিগ বাস্কেট চালু করে bbnow। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে চটজলদি ডেলিভারির এই প্রবণতাটি খুবই নতুন এবং অনলাইন ব্যবসার একটি উঠতি ক্ষেত্র। সুইগি-জোমাটোর মতো ফুড ডেলিভারি সংস্থাও এই ব্যবসায় সামিল। অর্ডার করার ১০ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে কাস্টমারের হাতে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছে সংস্থাগুলো। তাৎক্ষণিক চাহিদা তথা উদগ্র বাসনাকে বিজ্ঞাপনের মূলধন করে বাজার ধরার খেলায় মেতেছে কর্পোরেট স্টার্ট-আপগুলো। ইন্সট্যান্ট নুডলসের ইন্সট্যান্ট ডেলিভারি থেকে ডকুমেন্টের প্রিন্ট-আউট সবকিছু মুহূর্তের মধ্যে স্মার্টফোনে আঙুলের স্পর্শ মারফত পৌঁছে দেওয়ার এক অদ্ভুত খেলার নেশায় কাস্টমারদের মেতে ওঠার ডাক দেওয়া হচ্ছে। 

তাৎক্ষণিক চাহিদা তথা উদগ্র বাসনাকে বিজ্ঞাপনের মূলধন করে বাজার ধরার খেলায় মেতেছে কর্পোরেট স্টার্ট-আপগুলো। ইন্সট্যান্ট নুডলসের ইন্সট্যান্ট ডেলিভারি থেকে ডকুমেন্টের প্রিন্ট-আউট সবকিছু মুহূর্তের মধ্যে স্মার্টফোনে আঙুলের স্পর্শ মারফত পৌঁছে দেওয়ার এক অদ্ভুত খেলার নেশায় কাস্টমারদের মেতে ওঠার ডাক দেওয়া হচ্ছে।

অদৃশ্য সুতোর টানে দিনভর ছুটে চলা…

প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতিতে পুঁজির সাথে শ্রমের সম্পর্কের মূল যোগসূত্রই হল মোবাইল “অ্যাপ”, বা আরো ভেঙে বললে  অ্যালগরিদম। শ্রম প্রক্রিয়ার ওপর অ্যালগরিদমের এই নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই এখানে কার্যকর হয় পুঁজির শাসন।

অ্যালগরিদমীয় নিয়ন্ত্রণ যেখানে শোষণের ভিত্তি

অ্যালগরিদম মানে কোন গণনা বা গাণিতিক সমস্যার সমাধান করার জন্য নির্দিষ্ট নির্দেশের একটি ক্রম। এটি একটি সাধারণ পরিভাষা যার বিশেষ রূপ আমরা কম্পিউটার কোডে বা তার প্রয়োগ মোবাইল অ্যাপে দেখতে পাই। অনলাইন ব্যবসার সংস্থাগুলোর বিনিয়োগের প্রধান উপজীব্য বিষয় হলো অ্যালগরিদমের বিকাশ ও গবেষণার (R&D) কাজ। এখানে খেয়াল রাখতে হবে যে, কোনও একটি (ফুড ডেলিভারি) সংস্থাকে অনলাইনে পণ্য ডেলিভারির ব্যবসা করার জন্য একইসাথে ক্রেতাদের সাথে, ডেলিভারি শ্রমিকদের সাথে এবং বিভিন্ন রেস্তোরাঁর সাথে সম্পর্ক রাখতে হয়। সেই কাজ মূলত তিনটে মধ্যস্থতাকারী বা ইন্টারফেস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়— ক্রেতাদের জন্য অ্যাপ, রেস্তোরাঁর জন্য অ্যাপ ও ডেলিভারি শ্রমিকদের জন্য অ্যাপ। এই তিনটে মধ্যস্থতাকারী বা ইন্টারফেসের ওপরই সংস্থাগুলোর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানা থাকে।

এই তিন ইন্টারফেস থেকেই প্রাপ্ত এবং উদ্ভূত তথ্য মোতাবেক অভ্যন্তরীণ কোনও (এক বা একাধিক) অ্যালগরিদম চালিয়ে সংস্থাটি প্রতি মুহূর্তে ক্রেতা, রেস্তোরাঁ ও ডেলিভারি শ্রমিকদের যোগাযোগ ঘটিয়ে চলার কাজ করে যায়। সমস্ত ক্রেতার দিক থেকে গতিশীল (ডায়নামিক) চাহিদার সাথে মেলাতে হয় সেই স্থান ও কাল বিশেষে ডেলিভারি শ্রমিকের জোগান। এখানে নানা জটিল হিসেব কষে দুই তরফের (ক্রেতা ও ডেলিভারি শ্রমিকের) অভিজ্ঞতার সামঞ্জস্যবিধান বা optimization-এর মাধ্যমেই দীর্ঘমেয়াদি মুনাফার লাগামহীন বৃদ্ধির (maximization) কৌশল অবলম্বন করতে হয় কোনও একটি সংস্থাকে। সংস্থাগুলোর সাধারণ নীতি (principle) হল ব্যবসা একবার দাঁড়িয়ে গেলে, অর্থাৎ যথেষ্ট পরিমাণে ডেলিভারি শ্রমিক সংস্থাটিতে কাজ করতে শুরু করলে এবং উপভোক্তার পরিমাণও একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছে গেলে এই সংস্থাগুলোর ডেলিভারি পার্টনার অ্যাপের অ্যালগরিদম ক্রমশ আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধাগুলো একতরফাভাবে ক্রেতা তথা উপভোক্তাদের পক্ষে, এবং ডেলিভারি শ্রমিকদের বিপক্ষে সরে যেতে থাকে। মুনাফার এই অসম বণ্টন ক্রমাগত ডেলিভারি শ্রমিকদের মজুরি প্রদানের ক্ষেত্রে বঞ্চনার জন্ম দেয়। উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানো যায়। শুরুতে ডেলিভারি শ্রমিকদের নানা লোভ দেখিয়ে, এই দক্ষতার কাজের জন্য বাজারে চালু (গড়) মজুরির থেকে বেশি মজুরি দিলেও একটা সময়ের পর কোনও একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট দোকান থেকে অর্ডারের জন্য কত কম (minimal) টাকা (মজুরি) দিলে একজন ডেলিভারি শ্রমিক কাজ করবেন— সেটা নির্ধারণ করাটাই হয়ে ওঠে অ্যালগরিদমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে পৌঁছানো এক ধাপে সম্ভব নয়। মজুরির পরিমাণ যদি খুব কম হয়ে যায়, তাহলে ডেলিভারি শ্রমিকেরা সেই অর্ডার পৌঁছানোর ব্যাপারে ঢিলেমি করতে পারেন। তাতে আবার বেড়ে যাবে “গড় ডেলিভারি টাইম”। যা বেড়ে গেলে ক্রেতাদের দিক থেকে নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কারণে সেই অর্ডারটির চাহিদা কমবে। ফলে এখানে অ্যালগরিদম ক্রমে ক্রমে শিখতে থাকে (“learning”) সর্বনিম্ন মজুরিটি কত হলে ক্রেতাও খুশি থাকবেন, আবার একটু কম মজুরি পেলেও ডেলিভারি শ্রমিকেরাও অর্ডারটি ঠিকঠাক তুলে জায়গামতো পৌঁছে দেবেন। অবিরাম বাজার ধরার জন্য ক্রেতাকে তৃপ্ত করার এই একপেশে তাড়নায় বলি করা হয় ডেলিভারি শ্রমিকদের। তাদের ঠেলে দেওয়া হয় এক মনুষ্যেতর পরিস্থিতিতে কাজের জন্য। অ্যালগরিদমের কারসাজিতে দিন দিন একই অর্ডারের জন্য মজুরির পরিমাণ কমে যায়, কিম্বা “টার্গেটেড ডেলিভারি টাইম” কমে যায় একজন ডেলিভারি শ্রমিকের। কারণ জানা বা প্রতিকার পাওয়া তার ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমরা দেখেছি যে যথাসময়ে ডেলিভারি দেওয়ার তাড়নায় ডেলিভারি শ্রমিকদের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

অ্যালগরিদমের কারসাজিতে দিন দিন একই অর্ডারের জন্য মজুরির পরিমাণ কমে যায়, কিম্বা “টার্গেটেড ডেলিভারি টাইম” কমে যায় একজন ডেলিভারি শ্রমিকের। কারণ জানা বা প্রতিকার পাওয়া তার ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমরা দেখেছি যে যথাসময়ে ডেলিভারি দেওয়ার তাড়নায় ডেলিভারি শ্রমিকদের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

শ্রম ও ভোগের নতুন রূপ

ঊনবিংশ শতকের ইউরোপের কোনও কারখানায় আগুনের সামনে ১৪-১৬ ঘণ্টা কাজের যে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে একজন শ্রমিককে যেতে হত, একবিংশ শতকের অত্যাধুনিক শহরের রাস্তায় দু’চাকার যানে দিনরাত দৌড়ে চলা ডেলিভারি শ্রমিকদের জীবনটা তার চেয়ে কতটা বদলেছে? মানবসম্পদ-ব্যবস্থাপনা থেকে কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা-ব্যবস্থাপনার শাসন-শোষণ যেন আরো বেশি পোক্ত ও তীব্র। তার চাবুকের আঘাতগুলো পিঠে দাগ রেখে যায় না, কিন্তু পুঁজির স্বার্থে কাজ হাসিল করতে, শ্রমিককে ক্ষতবিক্ষত করতে সেগুলো যেন আরো নিখুঁত!

ঊনবিংশ, বিংশ শতক জুড়ে পুঁজি কর্তৃক শ্রম-সংগঠনের রূপ নানা অদলবদল হতে হতে গেছে। ফোর্ডিজম, টেলরিজম ইত্যাদি নানা নামে চিহ্নিত করা হয় বিভিন্ন কাল পর্বে উত্থান হওয়া শ্রম-সংগঠনের এই ধারাগুলোকে। কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা তথা অ্যালগরিদম-নির্ভর নিয়ন্ত্রণ শ্রম-পুঁজির সম্পর্কে কি নতুন কোনও ধারার সূচনা করছে?

শ্রম-পুঁজির এই বদলে যাওয়া সম্পর্কের সাথেই যেমন জন্ম হচ্ছে নতুন শ্রমিকের, তেমন নতুন উপভোক্তারও। মোবাইলের স্ক্রিনে একটি আঙুলের ছোঁয়ায় মুহূর্তের মধ্যে অর্ডার হয়ে যাচ্ছে সুস্বাদু খাবার! ১৫-২০ কিলোমিটার দূর থেকে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বহু মূর্ত শ্রম প্রক্রিয়ার চৌকাঠ ডিঙিয়ে তা হাজির হচ্ছে সোজা উপভোক্তার বাড়ির দোরগোড়ায়। অর্ডার করা থেকে শুরু করে বাড়ি অব্দি খাবার এসে পৌঁছনোর প্রতি পদে ক্রেতা দেখতে পাচ্ছেন ডেলিভারি শ্রমিকটির গতিবিধি। মোবাইল গেমের একজন বিমূর্ত চরিত্রের মতোই দেখতে লাগে সেখানে ডেলিভারি শ্রমিকটিকে।

একজন ডেলিভারি শ্রমিকের কাছেও অর্ডার আসা, খুব অল্প সময়ের মধ্যে তা গ্রহণ করার সুযোগ পাওয়া (সময় পেরিয়ে গেলে অর্ডার নিজে নিজেই ক্যান্সেল হয়ে গিয়ে পেনাল্টি চার্জ হয়), অর্ডার গ্রহণ করে নির্দিষ্ট ম্যাপ ধরে এগিয়ে চলা, পদে পদে ব্যাগ ও ইউনিফর্মের ছবি তুলে পাঠানো, সমস্যা হলে চ্যাট করা— এই পুরো অভিজ্ঞতাটার মধ্যেই একটা ভিডিও গেম-সুলভ  ব্যাপার আছে। আছে উত্তেজনা, আছে হতাশা, আছে পরের বারে আরও ভালো করার (“Try Again!”) বাসনা। সব মিলিয়ে শাস্তি এবং পুরস্কারের নির্ভুল থেকে নির্ভুলতর মিশেলের মাধ্যমে একজন শ্রমিকের সময়, পরিসর এবং কাজকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা নির্ভর ম্যানেজমেন্ট যেন অনেক বেশি দক্ষ।

একজন ডেলিভারি শ্রমিকের কাছেও অর্ডার আসা, খুব অল্প সময়ের মধ্যে তা গ্রহণ করার সুযোগ পাওয়া (সময় পেরিয়ে গেলে অর্ডার নিজে নিজেই ক্যান্সেল হয়ে গিয়ে পেনাল্টি চার্জ হয়), অর্ডার গ্রহণ করে নির্দিষ্ট ম্যাপ ধরে এগিয়ে চলা, পদে পদে ব্যাগ ও ইউনিফর্মের ছবি তুলে পাঠানো, সমস্যা হলে চ্যাট করা— এই পুরো অভিজ্ঞতাটার মধ্যেই একটা ভিডিও গেম-সুলভ  ব্যাপার আছে।

বিশ্ব জুড়ে লকডাউনের অভিঘাত শ্রম ও ভোগের এই নতুন রূপের গড়নে অনেকটা ভূমিকা নিয়েছে। মধ্যম তথা নিম্ন দক্ষতার বহু শ্রমিক লকডাউনে কাজ হারিয়ে যোগ দিয়েছেন অনলাইন ডেলিভারি ক্ষেত্রের শ্রমিকের সারিতে। একই সাথে দেখা যাবে ওয়ার্ক-ফ্রম-হোমে কাজ করা আইটি ক্ষেত্রের কর্মী সহ একটা বড়ো অংশের উপভোক্তার স্বাভাবিক ভোগের অভ্যাসের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে অনলাইনে খাবার, মুদিখানার জিনিস বা অন্য পণ্য অর্ডার করা। অনলাইন বাজারে ক্রমবর্ধমান পণ্যের চাহিদা, শ্রমিকের জোগান এগুলোর দিকে তাকিয়ে বলা যায় এই ক্ষেত্রটির বিকাশ কোনও সাময়িক, বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিভিন্ন উপায়ে অনলাইন ডেলিভারি নামক এই পরিষেবা বেচার নিত্যনতুন পন্থা কোম্পানিগুলো নেবে। এর জন্য নতুন চাহিদা তৈরিও করা হবে। স্বল্প সময়ে ডেলিভারি সহ ইতিমধ্যেই তৈরি হওয়া বিভিন্ন চাহিদা স্থায়ী ভোগের অভ্যাস হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাবে। নয়া-উদারনীতিবাদী সংস্কৃতি ও অর্থনীতির একটি বৈশিষ্ট্য হল শ্রমিক ও উপভোক্তার মধ্যে সম্পর্কের বিমূর্তায়ন। তাই সব মিলিয়ে অনলাইন ডেলিভারি নয়া-উদারবাদী সংস্কৃতির একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবেই ভবিষ্যতে পাকাপোক্ত জায়গা করে নিতে চলেছে বোঝা যায়।    

ডেলিভারি শ্রমিক থেকে ক্রেতা: অদৃশ্য শোষণের জালে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা

ডেলিভারি শ্রমিকরা যে অ্যাপের মাধ্যমে কাজ করেন সেই অ্যাপ চূড়ান্তভাবে একপেশে। এখানে ক্রেতা যদি কম রেটিং দেন একজনকে, কিম্বা কোনও ভুল কারণে কাউকে শাস্তি দেওয়া হয় তার আইডি ডিঅ্যাক্টিভেট করে (অর্থাৎ ছাঁটাই, লে-অফ বা সাসপেনশন-এর সমতুল্য ব্যবস্থা নিয়ে) বা টাকা কেটে নিয়ে, কোনও ক্ষেত্রেই ডেলিভারি শ্রমিকের আত্মপক্ষ সমর্থন করে কথা বলার কোনও যথার্থ জায়গা না রেখে সাধারণ ন্যায়বিচার-বিরোধী একটি প্রক্রিয়া নেওয়া হয়। শুধুমাত্র চ্যাট করে কথা বলতে হয়, অথবা অনির্দিষ্ট সময় ধরে কাজ বন্ধ রেখে হেল্পলাইনের কলের প্রত্যাশায় বসে থাকতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শ্রমিকের পক্ষে সমস্যার সুরাহা হয় না। এছাড়া অ্যাপে যেভাবে কম কিলোমিটার দেখিয়ে বেশি কিলোমিটার দৌড় করানো হয়, বা দিনের শেষে অর্ডার-সংখ্যার হিসেব যায় কমে— এই সমস্ত কিছুই প্রমাণ করে অ্যাপের পিছনে থাকা অ্যালগরিদম উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই “চুরি” করে। অ্যাপ যা দূরত্ব এবং ডেলিভারি সংখ্যা দেখায়, তা নিয়ে দরাদরি বা নেগোশিয়েট করার কোনো ব্যবস্থা ডেলিভারি শ্রমিকের কাছে নেই। অর্থাৎ, সংস্থাগুলো এই অ্যালগরিদমগুলো বানায় এবং ডেভেলপ করেই এমনভাবে, যাতে বিভিন্ন কৌশলে ডেলিভারি শ্রমিকদের সবচেয়ে কম মজুরি দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। সংস্থাগুলো কাজে নেওয়ার সময় যে গালভরা প্রতিশ্রুতি দেয় শ্রমিকদের, অ্যাপের দুর্ভেদ্য বেড়া ডিঙিয়ে, সেইসব বাস্তবে পাওয়া একজন শ্রমিকের পক্ষে প্রায় অসম্ভব করেই রেখে দেওয়া হয়।

একই কোম্পানির ডেলিভারি শ্রমিকদের আলাদা আলাদা ইনসেনটিভের বা উৎসাহ ভাতার ধাপ বা স্ল্যাবে কাজ করানো, বিভিন্ন জায়গা অনুযায়ী আলাদা বোনাস, একই কাজ অন্য কোনও তৃতীয় কোনো কোম্পানিকে দিয়ে করিয়ে নেওয়া বা আউটসোর্স করা— এ’রকম বিভিন্ন পন্থায় অনলাইন ডেলিভারি শ্রমিকদের মধ্যে বিভাজনের নীতিকে কার্যকর করছে সংস্থাগুলো। এই বিভাজন নানা স্তরে নানা ভাবে করা হচ্ছে। সাইকেল রাইডার ও বাইক রাইডারের মধ্যে বিভাজন, একই কোম্পানির ফুড ডেলিভারির কাজ করা শ্রমিক ও কুইক-ডেলিভারির কাজ করা শ্রমিকদের মধ্যে বিভাজন (যেমন, সুইগি কোম্পানির ফুড ও ইন্সটামার্ট, জোমাটো কোম্পানির ফুড ও জোমাটো অধিকৃত ব্লিংকিটের শ্রমিক ইত্যাদি), একই কাজ করার জন্য একই সংস্থার দু’জন ডেলিভারি শ্রমিককে দু’রকম মজুরি দেওয়া— বিভাজনের নিত্যনতুন উপায় বের করেই চলেছে কোম্পানিগুলো গবেষণা করে। কোম্পানির নিজস্ব অভ্যন্তরীণ পদ্ধতি মারফত (যা ডেলিভারি শ্রমিকদের একেবারেই অজানা) প্রত্যেক ডেলিভারি শ্রমিককে আলাদা আলাদাভাবে দক্ষতার পরিমাপে সাজানো বা ব়্যাংকিং, ও সেই মোতাবেক তাদের কাজ ও রোজগার নির্ধারণ করার প্রক্রিয়া অ্যালগরিদমের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের অন্যতম কারসাজি।

একই কোম্পানির ডেলিভারি শ্রমিকদের আলাদা আলাদা ইনসেনটিভের বা উৎসাহ ভাতার ধাপ বা স্ল্যাবে কাজ করানো, বিভিন্ন জায়গা অনুযায়ী আলাদা বোনাস, একই কাজ অন্য কোনও তৃতীয় কোনো কোম্পানিকে দিয়ে করিয়ে নেওয়া বা আউটসোর্স করা— এ’রকম বিভিন্ন পন্থায় অনলাইন ডেলিভারি শ্রমিকদের মধ্যে বিভাজনের নীতিকে কার্যকর করছে সংস্থাগুলো।

এখানে উল্লেখ্য যে, শুধু ডেলিভারি শ্রমিকরাই এখানে মাত্রাছাড়া শোষণের শিকার হচ্ছেন তা নয়। বিভিন্ন বড়ো রেস্তোরাঁর (আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড বা রেস্তোরাঁর চেন) সাথে “বিশেষ চুক্তি” করছে ফুড ডেলিভারি সংস্থারা, যাতে দু’পক্ষেরই স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। আর অন্যদিকে ছোট-মাঝারি রেস্তোরাঁর ওপর কমিশনের বোঝা বাড়ছে। বড়ো রেস্তোরাঁর অব্যবস্থার শিকার হয়েও ডেলিভারি শ্রমিকদের অন্যত্র যাওয়ার কোনও জায়গা থাকছে না। তাঁরা জানতেই পারছেন না সেই রেস্তোরাঁর সাথে কোম্পানির কী বিশেষ চুক্তি হয়েছে। অথচ সেই চুক্তির ফল ভুগতে হচ্ছে তাঁদেরই। ক্রেতাদের অ্যাপ থেকেও তাঁদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের “ডেটা” নিয়ে কী ব্যবসা করছে কোম্পানিগুলো, তার তথ্যও ক্রেতাদের কাছ থেকে যাচ্ছে গোপন।   

এভাবেই কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর ম্যানেজমেন্ট তথা ডিজিটাল মাধ্যমকে ঢাল করে মেঘের আড়াল থেকে শোষণযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে পুঁজির রক্তমাংসের মালিকেরাই। শুধুমাত্র পণ্যের সঞ্চালন সুগম করার জন্য এক কার্যকরী ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম— যা দৃশ্যত (in manifestation) “স্বাধীন” দু’চাকার যানের মালিক, ক্রেতা ও রেস্তোরাঁর মধ্যে যোগাযোগ ঘটিয়ে দেওয়ার কথা বলে, আদতে (in essence) তা নানান মাত্রায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে বিস্তার করছে তার শোষণের জাল।     

গিগঃ এক নতুন কাজের পদ্ধতির নাম

কাজের “নমনীয়তা” (flexibility), শ্রমিকের “স্বাধীনতা” (freedom)— গালভরা এই বুলির আড়ালে পুঁজিবাদ নিয়ে এসেছে শ্রমিক শোষণের সাম্প্রতিকতম রূপকে। “পছন্দ” (choice) ও “স্বাধীনতা” (freedom)-র মোড়কে পুঁজির শাসনকে পেশ করার এই ধরন অবশ্য নতুন কিছু নয়। পুঁজিবাদ তথা আধুনিক শ্রমিকশ্রেণীর জন্মলগ্ন থেকেই এই স্বাধীনতার ধারণা নানাভাবে উপস্থিত রয়েছে— বাজারে পণ্য ক্রয়বিক্রয়ের সাপেক্ষে যা মূলত আবর্তিত হয়েছে। আধুনিক শ্রমিকশ্রেণীর প্রসঙ্গে কার্ল মার্ক্সের বিখ্যাত উক্তি স্মরণীয়— “শ্রমিকশ্রেণী দুই অর্থে মুক্ত। এক, পুরনো সমাজের বন্ধন থেকে। দুই, উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা থেকে”। এই “মুক্ত” অবস্থা (আনুষ্ঠানিকভাবে) শ্রমশক্তির স্বাধীন বিক্রেতা হিসাবে শ্রমিককে প্রতিষ্ঠিত করে। “স্বাধীনতা”র সাথে “প্রয়োজনীয়তা” তথা “বাধ্যবাধকতা”র প্রসঙ্গটিও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। মার্ক্স বর্ণিত “স্বাধীনতা”র পরিপূরক ধারণা হিসাবে তাঁরই বর্ণনায় আবার উপস্থিত হয় “মজুরি দাসত্বে”র কথা। খেটে খাওয়ার বা ভুখা মরার— পুঁজিবাদে এই দুইয়ের মধ্যে কোনও এক স্বাধীনতাকে বেছে নিতে বাধ্য শ্রমিকরা।

স্বাধীনতা-বাধ্যবাধকতার এই দ্বৈততা নানা রূপে হাজির হয়েছে পুঁজিবাদের বিভিন্ন পর্যায়ে। পুঁজিবাদের বর্তমান পর্যায়কাল, যার পোশাকি নাম নয়া-উদারবাদ, সেখানে শ্রমিকের “স্বাধীনতা”র অপর নাম মালিকের দায়হীনতা! শ্রমিকেরা আরও আরও স্বাধীন হয়ে ওঠার বিজ্ঞাপনের আড়ালে আসলে লুকিয়ে আছে মালিকের আরও আরও দায়হীন হয়ে ওঠার বাস্তবতা। এখানে Flexibility means Precarity বা নমনীয়তার আসল অর্থ এক্ষেত্রে দাঁড়াচ্ছে শ্রমিকদের জন্য অনিশ্চয়তা। “গিগ সিস্টেম” আসলে এই অনিশ্চিত বাস্তবতারই সাম্প্রতিকতম নিদর্শন। এখানে কাজের জন্য অপেক্ষমান শ্রমিকের এক মজুদ বাহিনীকে বহাল রাখা হবে এবং সেখান থেকে প্রয়োজনমতো কোনও একজন শ্রমিককে খাটিয়ে নেওয়া হবে। ন্যূনতম মজুরি তো দুরস্ত, কাজটুকু দেওয়ার দায় অব্দি নেবে না কোম্পানি। যেমন, কিছু অনলাইন ফুড ডেলিভারি অ্যাপে “আগে থেকে স্লট-বুকিং” পদ্ধতিতে কাজ করতে হয় ডেলিভারি শ্রমিকদের। অর্থাৎ, সপ্তাহের কোনও এক নির্দিষ্ট দিনে আগামী এক সপ্তাহে কোন কোন স্লটে যদি কেউ কাজ করতে চায় তা “পছন্দ” করার “স্বাধীনতা” আছে ডেলিভারি শ্রমিকের। আপাতভাবে শুনতে খুব ভালো। কিন্তু বাস্তবে নিজের কাজ নিজে খুঁজে নেওয়ার দৌড়ে শ্রমিকদের আরও বেশি প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এখানে, যা আসলে মজুরি কমানোর বাস্তব ভিত্তি তৈরি করে।

সপ্তাহের কোনও এক নির্দিষ্ট দিনে আগামী এক সপ্তাহে কোন কোন স্লটে যদি কেউ কাজ করতে চায় তা “পছন্দ” করার “স্বাধীনতা” আছে ডেলিভারি শ্রমিকের। আপাতভাবে শুনতে খুব ভালো। কিন্তু বাস্তবে নিজের কাজ নিজে খুঁজে নেওয়ার দৌড়ে শ্রমিকদের আরও বেশি প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এখানে, যা আসলে মজুরি কমানোর বাস্তব ভিত্তি তৈরি করে।

সপ্তাহের সাতটা দিন একরকম নয়, আবার একটা গোটা দিনের ২৪ ঘন্টাও কখনো একরকম নয়। তাছাড়া বছরের বিভিন্ন উৎসব বা ছুটির দিনগুলোতে অনলাইন অর্ডার বেশি হয়। এর একটা পরিচিত বিন্যাস (প্যাটার্ন) অনলাইন ডেলিভারির কাজের সাথে যুক্ত সকলেরই কমবেশি জানা। ফলে কিছু নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট স্লট বুক করার প্রতি ডেলিভারি শ্রমিকদের আকর্ষণ স্বাভাবিকভাবেই বেশি হবে। কেউ তা বুক করতে পারবেন, বেশিরভাগ শ্রমিকই সেই লোভনীয় স্লটে কাজ করতে পারবেন না। কাজ পাওয়াকে ঘিরে এই প্রতিযোগিতা ও তজ্জনিত অনিশ্চয়তা একটা সদা-বিরাজমান অবস্থা হিসাবে থাকবে প্রতিটা ডেলিভারি শ্রমিকের জীবনে। স্থায়ী কাজ বা ঠিকা কাজের বিভিন্ন প্রকারভেদের বাইরে এটা এক নতুন বাস্তবতা। এর সাথে যুক্ত হচ্ছে মজুরির ক্ষেত্রে অত্যন্ত জটিল এবং পুরোপুরি মালিকের (পড়ুন অ্যাপের অ্যালগরিদমের) নিয়ন্ত্রণাধীন এক পদ্ধতি। এখানে নির্দিষ্ট পরিমাণ “টার্গেট”-এর জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ “ইনসেনটিভ” হল মজুরির মূল ভিত্তি। মজুরির অন্য উপাদানগুলো এখানে ক্রম-তাৎপর্যহীন হয়ে উঠছে।

সাবেক নিয়মে দুই ধরনের পদ্ধতিতে মজুরি নির্ধারণ হতো— শ্রম সময়ের হিসাবে এবং ফুরন তথা পিস-রেট হিসাবে। আপাতভাবে অনলাইন ডেলিভারির কাজেও মজুরি হয় ফুরন প্রথায়। কিন্তু টার্গেট-ইনসেনটিভের খুড়োর কল একে করে দিয়েছে ফুরনেরও ফুরন! সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল বোনাস, ইনসেনটিভ ইত্যাদি যে উপাদানগুলো মজুরির প্রধান অংশ হয়ে উঠছে, সেগুলো পুরোটাই কোম্পানির গৃহীত অ্যালগরিদমের নিয়ন্ত্রণাধীন। ফলে দিনে ১৩তম অর্ডার ডেলিভারি করলে যদি ডেলিভারি শ্রমিকটির সেদিনের রোজগারে কিছু ইনসেনটিভের পয়সা জমার সম্ভাবনা থাকে, তবে তাকে ১১তম বা ১২তম অর্ডারে এনে অনির্দিষ্টকালের জন্য বসিয়ে রেখে দিতে পারে অ্যালগরিদম। বাস্তবে এটাই ঘটে। অজানা কারণে ডেলিভারি শ্রমিকদের রেটিং কমে যায়, যার কোপ পড়ে তাদের সপ্তাহান্তের রোজগারে, এমনকি দুর্ঘটনা বীমার ঘোষিত সুযোগসুবিধার ক্ষেত্রেও! আপাত স্বাধীনতা, নমনীয়তার মোড়কে কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তার চরম নিয়ন্ত্রণে কাজ, এমনকি রোজগারও নিয়ন্ত্রণ করা, তার মধ্যে দিয়ে একজন শ্রমিকের কাজ-পাওয়ার অনিশ্চয়তাকে সারাক্ষণ টিকিয়ে রাখা, মজুরির ক্ষেত্রে নাকের ডগা থেকে বারবার দূরে সরে যাওয়া গাজর ঝুলিয়ে রাখা— এই সব মিলিয়েই গিগ ব্যবস্থা।

প্ল্যাটফর্ম তথা অনলাইন ডেলিভারি শ্রমিকদের “শ্রমিক” স্বীকৃতির প্রশ্ন:

পার্টনারশিপের ভাঁওতা

“পার্টনার” বা “এক্সিকিউটিভ”— অনলাইন ডেলিভারি শ্রমিকদের গালভরা নাম। তাদের যে চুক্তিপত্র মেনে কাজ করতে ঢুকতে হয় সংস্থাগুলোয়, তাতে পরিষ্কার করে লিখে দেওয়া থাকে ডেলিভারির কাজ যারা করবেন তারা স্বাধীন পরিষেবা-দাতা (independent service provider)। নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্ম তথা অ্যাপের মাধ্যমে সংস্থাটি এই স্বাধীন পরিষেবা-দাতাদের সঙ্গে কেবলমাত্র যোগাযোগ ঘটিয়ে দিচ্ছে ক্রেতাদের। ব্যবসাটা আসলে হচ্ছে ক্রেতা এবং এই ডেলিভারি পার্টনার তথা এক্সিকিউটিভদের মধ্যে। অ্যাপের মালিক যে সংস্থা তাদের ভূমিকা এখানে এই যোগাযোগের কাজটিকে সহজতর করা (as facilitators)। এভাবে শুরুতেই জানান দিয়ে দেওয়া হয় একজন ডেলিভারি শ্রমিকের শ্রমিক বা কর্মী হিসাবে কোনও অধিকার দিতে সংস্থাগুলো দায়বদ্ধ নয়। অবশ্য অ্যাপের কারসাজির দৌলতে অনেকক্ষেত্রেই এই আনুষ্ঠানিক চুক্তিপত্র কোনদিন চোখেও দেখতে পান না একজন ডেলিভারি শ্রমিক। মজার বিষয় হলো, চুক্তিপত্রগুলোর এই আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পরের লাইনগুলো পড়লেই পরিষ্কার বোঝা যায় একজন তথাকথিত ডেলিভারি পার্টনার বা এক্সিকিউটিভ কীভাবে কাজ করবেন, কত টাকা পাবেন, কী কী উপাদান বা চলরাশির ওপর তার রোজগারের অংক নির্ভর করবে, কীভাবে করবে, ক্রেতা কতো টাকা দেবেন— এই সমস্ত কিছুরই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটির হাতেই থাকে এবং তা একজন “পার্টনার”-এর জানার কোনও জায়গা নেই। সংস্থাগুলো ঘোষণা করে রেখে দিয়েছে ক্রেতাদের থেকে টাকা নিয়ে তারা নিজেদের কাছেই জমা রাখবে এবং নির্দিষ্ট সময়ান্তরে সেই টাকা তারা “পার্টনার”-এর হাতে তুলে দেবে। এখানেও যেটা মজার বিষয় সেটা হলো ক্রেতাদের থেকে “ডেলিভারি চার্জ” নিয়ে তা থেকে কত টাকা কেটে নিয়ে বাকিটা “পার্টনার”-কে দেবে তাও জানা যায় না, এবং জানা গেলেও তা নিয়ন্ত্রণের বা সেই বিষয়ে দরকষাকষি করারও কোনও উপায় নেই একজন ডেলিভারি শ্রমিকের। এই আনুষ্ঠানিক চুক্তিপত্রগুলো চূড়ান্তভাবে একপেশে ও অগণতান্ত্রিক— বাস্তবে যা একজন ডেলিভারি শ্রমিকের সাথে সংস্থার সম্পর্কের স্বল্প ঝলক মাত্র।

শ্রমিক স্বীকৃতির আইনি প্রশ্ন

আইনের চোখে কাকে বলা হবে শিল্প (industry) তার প্রাথমিক সংজ্ঞা Industrial Disputes Act 1947এ বলা আছে। এই সংজ্ঞার ব্যাখ্যা হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ রায়কে মাইলস্টোন ধরা হয়। ১৯৭৮ সালে Bangalore Water Supply and Sewerage Board v. R. Rajappa-র কেসের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়

  • Any activity will be industry if it fulfills the ‘triple test’, as under:

   Systematic and organized activity

   With the cooperation between employers and employees

   For the production and distribution of goods and services whether or not capital has been invested for this activity.”

এই তিনটি উল্লিখিত মানদণ্ড মেনেই বলা যায় অনলাইন ডেলিভারি সংস্থাকে শিল্প হিসেবেই ধরতে হবে।

এর সাথে যদি শিল্প বিবাদ আইনে (Industrial Disputes Act 1947) বর্ণিত শ্রমিক তথা Workman-এর সংজ্ঞা দেখি, তাহলে বলা যায় ডেলিভারি “পার্টনার”রা আসলে শ্রমিকই। কোনও কাগুজে চুক্তিপত্র নয়, অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর সাথে সেখানকার ডেলিভারি শ্রমিকদের বাস্তব সম্পর্কই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কোম্পানিগুলো এদের যে গালভরা নামেই ডাকুক না কেন, আসলে এখানে সম্পর্কটা শ্রমিক-মালিকের সম্পর্কই। বুঝতে অসুবিধা হয় না কেন কোম্পানিগুলো তাদের চুক্তিপত্রে পার্টনারশিপের নামে এতো কথা লিখে রেখেছে, কোন সম্পর্ককে আড়াল করতে এতো আনুষ্ঠানিকতা!

প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকদের শ্রমিক স্বীকৃতি বিষয়ক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শীর্ষ আদালতের রায় উল্লেখযোগ্য। ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ যুক্তরাজ্যের (UK) সুপ্রিম কোর্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু উক্তি করে উবারের বিরুদ্ধে করা এক কর্মীর মামলার পরিপ্রেক্ষিতে। বলা হয়— শ্রম আদালতে কোম্পানির দিক থেকে তৈরি করা চুক্তিপত্র ধরে আলোচনা এগোনো উচিত নয়। কারণ সেই চুক্তিপত্রে একজন ব্যক্তি শ্রমিকের প্রায় বা একেবারেই কোনও জায়গা নেই চুক্তির শর্তগুলোকে প্রভাবিত করার। এই রায়ে একজন প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকের কাজের ক্ষেত্রে কোম্পানির চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণকে ধরেই যুক্তি দেওয়া হয়েছে কেন এখানে শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক উপস্থিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে ২০২০ সালে বলবৎ হওয়া একটি অ্যাসেম্বলি বিলে প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকদের অনুকূলে কিছু সুরক্ষা আনা হয়। তিনটে মানদণ্ড স্থির করে বলা হয় কোন কোন ক্ষেত্রে প্ল্যাটফর্ম সংস্থাগুলো তাদের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের কর্মী না বলে স্বাধীন ঠিকাদার/পরিষেবাদাতা বলতে পারবে। এর মাধ্যমে প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকদের একটা বড়ো অংশ আইনীভাবে শ্রমিক স্বীকৃতি পেতে সক্ষম হয়। এছাড়া, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্সের শীর্ষ আদালতেও প্ল্যাটফর্ম শ্রমিক তথা অনলাইন ডেলিভারি সংস্থার শ্রমিকদের সংস্থাগুলোর সাথে অধীনতার সম্পর্ককে বিশ্লেষণের ভিত্তি করে শ্রমিক স্বীকৃতির পক্ষে রায় দেওয়া হয়। 

১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ যুক্তরাজ্যের (UK) সুপ্রিম কোর্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু উক্তি করে উবারের বিরুদ্ধে করা এক কর্মীর মামলার পরিপ্রেক্ষিতে। বলা হয়— শ্রম আদালতে কোম্পানির দিক থেকে তৈরি করা চুক্তিপত্র ধরে আলোচনা এগোনো উচিত নয়। কারণ সেই চুক্তিপত্রে একজন ব্যক্তি শ্রমিকের প্রায় বা একেবারেই কোনও জায়গা নেই চুক্তির শর্তগুলোকে প্রভাবিত করার। এই রায়ে একজন প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকের কাজের ক্ষেত্রে কোম্পানির চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণকে ধরেই যুক্তি দেওয়া হয়েছে কেন এখানে শ্রমিক-মালিকের সম্পর্ক উপস্থিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে ২০২০ সালে বলবৎ হওয়া একটি অ্যাসেম্বলি বিলে প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকদের অনুকূলে কিছু সুরক্ষা আনা হয়।

শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি ও অধিকারের লড়াই

ডেলিভারি শ্রমিকদের অধিকারের লড়াইয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দাবি হল তাদের শ্রমিক স্বীকৃতির লড়াই। আরো নির্দিষ্টভাবে বললে একজন সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক তথা workman-এর যে অধিকারগুলো পাওয়ার কথা তার সপক্ষে সওয়াল করা অন্যতম ন্যায্য দাবি। কোম্পানিগুলোর তৈরি করে দেওয়া ভাবনার ছকের বিপরীতে গিয়ে সমষ্টিগত দরকষাকষির অধিকারের পক্ষে, কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা নির্ভর ম্যানেজমেন্টের আড়ালে দায়হীনতার চূড়ায় বসে থাকা কোম্পানিগুলোকে ন্যূনতম দায়বদ্ধ হতে বাধ্য করা ছাড়া ডেলিভারি শ্রমিকদের সামনে অন্য রাস্তা নেই। কিছু অসরকারি সংস্থা (NGO), এমনকি কিছু কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নও এই অংশের শ্রমিকদের যেভাবে অসংগঠিত শ্রমিক হিসাবে চিহ্নিত করার দাবিকে সামনে নিয়ে আসছে তা রাজনৈতিকভাবে সঠিক বলে মনে হয় না। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য আইনি অধিকারের যে কাঠামো রয়েছে তাতে রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তি শ্রমিকের সুবিধাদাতা ও সুবিধাভোগীর সম্পর্কের অক্ষেই যাবতীয় নির্মাণ। মালিকের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ ও সংগঠিত হওয়ার মাধ্যমে শ্রমিকদের সমষ্টিগত দরকষাকষি-র জোরের জায়গাগুলো এখানে গরহাজির। দীর্ঘ শ্রমিক আন্দোলনের প্রাপ্তি এই অধিকারগুলো যদিও চারটি শ্রম কোড ২০২০-এর মাধ্যমে অনেকটাই মুছে ফেলার পথ পরিষ্কার করে ফেলেছে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন মোদী সরকার, তবুও এই ভাবনা-কাঠামো থেকে লড়াইয়ের নির্যাস গ্রহণ করে প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকদের অধিকার আন্দোলনকে দেখা ও নির্মাণ করার প্রয়োজন আজকের শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীদের সামনে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।  

কোম্পানিগুলোর তৈরি করে দেওয়া ভাবনার ছকের বিপরীতে গিয়ে সমষ্টিগত দরকষাকষির অধিকারের পক্ষে, কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা নির্ভর ম্যানেজমেন্টের আড়ালে দায়হীনতার চূড়ায় বসে থাকা কোম্পানিগুলোকে ন্যূনতম দায়বদ্ধ হতে বাধ্য করা ছাড়া ডেলিভারি শ্রমিকদের সামনে অন্য রাস্তা নেই।

প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকদের অধিকারের লড়াই দানা বাঁধছে

বিশ্বজুড়েই প্ল্যাটফর্ম তথা অনলাইন ডেলিভারি শ্রমিকদের ওপর শোষণের জোয়াল যেভাবে সজোরে চেপে বসছে, তার প্রতিরোধে শ্রমিকদের পালটা লড়াইয়ের স্পন্দনও বেশ চোখে পড়ার মতো। বিভিন্ন সংস্থার শোষণের রূপগুলো আপাতভাবে ভিন্ন হলেও, একটি সাধারণ বিন্যাস সেখানে চোখে পড়ে। চোখের সামনে আমাদের দেশের অনলাইন ডেলিভারি সেক্টরের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবো ক্রেতাদের তাৎক্ষণিক চাহিদা তৈরি করার চেষ্টা, উপভোক্তাদের অতি দ্রুত ভোগের ব্যবস্থা করে দেওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া, পণ্যের পসার বাড়িয়ে চলা— ইত্যাদি নানাভাবে নতুন উপভোক্তা তৈরি করে, বিদ্যমান উপভোক্তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ বাজার দখল করার দৌড়েই এই সংস্থাগুলোর বিশেষ নজর। উল্টোদিকে বিভিন্ন সংস্থার শ্রমিকদের জীবনের সংকটগুলোও একটা সাধারণ বিন্দুর দিকে ক্রমশ মিলতে চলেছে। টার্গেট-নির্ভর ইনসেনটিভের ওপর রোজগার, স্লট-বুকিং পদ্ধতিতে কাজ— এগুলো বলা যায় প্রায় সব সংস্থার ডেলিভারি শ্রমিকদেরই সাধারণ ভবিতব্য হতে চলেছে। যেহেতু এর ফলে বাড়ছে শ্রমিকদের আয় এবং কাজ এই দুইয়ের ওপরই অ্যালগরিদমের নিয়ন্ত্রণ, ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের রোজগার এবং কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা আরো কমে যাবে। বিগত কয়েক মাসে প্রায় সমস্ত সংস্থার ডেলিভারি শ্রমিকের ক্ষেত্রেই যা ঘটতে দেখা যাচ্ছে।

নীচে একটি বিশেষ ডেলিভারি কোম্পানির এক ডেলিভারি শ্রমিকের মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে সাপ্তাহিক আয়ের তারতম্য তুলে ধরা হল। উল্লেখ্য, এখানে আয়ের মধ্যে গাড়ির তেলের খরচ, রক্ষণাবেক্ষণের খরচ, স্মার্টফোন রিচার্জের খরচ ইত্যাদি সবই ধরা আছে।

৫ মাসের ব্যবধানে অ্যাপ শ্রমিকদের আয় হ্রাস

 

অর্ডার

সংখ্যা

কাজের সময়

(ঘন্টা)

মোট

রোজগার*

(টাকা)

অর্ডারপিছু রোজগার (টাকা)

দৈনিক

ন্যুনতম

আয়

এপ্রিল (১৮-২৪) ২০২২

১৬

১১

৫৪০০

৩৩৭.৫

৯০০

সেপ্টেম্বর

(১৯-২৫) ২০২২

৭৪

অনির্দিষ্ট

৪৬০৫

৬২.২

নিশ্চিত

কোনও

আয় নেই

 *সপ্তাহে ৬ দিন হিসাবে

(সূত্র: The Morning Context, ‘Blinkit, Dunzo, Swiggy and Zepto are squeezing delivery partners’ https://themorningcontext.com/chaos/blinkit-dunzo-swiggy-and-zepto-are-squeezing-delivery-partners)

এই হিসাবটি একটি বিশেষ শহরে কর্মরত বিশেষ কোম্পানির শ্রমিকের হলেও, এখানে অনলাইন ডেলিভারি শ্রমিকদের জীবনের বাস্তব অবস্থার এক সার্বজনীন ছবি পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কলকাতার মতো শহরে দৈনিক ১২-১৪ ঘন্টা কাজ করেও ১২০০০ টাকা রোজগার (Net income) করা ক্রমশ দুরূহ হয়ে উঠছে একজন অনলাইন ডেলিভারি শ্রমিকের ক্ষেত্রে।

এই ধাক্কাগুলোর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় শ্রমিক ধর্মঘট, বিক্ষোভের সাক্ষী থেকেছে দেশের প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ শহরই। জম্মু থেকে তামিলনাড়ু, বেঙ্গালুরু থেকে দিল্লি, গাজিয়াবাদ থেকে মুম্বাই, গুয়াহাটি, কলকাতা, রাঁচি— শ্রমিক বিক্ষোভের তালিকা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

এই ধাক্কাগুলোর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় শ্রমিক ধর্মঘট, বিক্ষোভের সাক্ষী থেকেছে দেশের প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ শহরই। জম্মু থেকে তামিলনাড়ু, বেঙ্গালুরু থেকে দিল্লি, গাজিয়াবাদ থেকে মুম্বাই, গুয়াহাটি, কলকাতা, রাঁচি— শ্রমিক বিক্ষোভের তালিকা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। শুধু আমাদের দেশের শহরগুলোই নয়, সারা বিশ্বজুড়েই প্ল্যাটফর্ম তথা অনলাইন ডেলিভারি শ্রমিকদের আন্দোলনের জোয়ার অব্যাহত। কোথাও কোম্পানির নজরদারি এড়িয়ে, কোথাও প্রতিবাদীদের ধরে ধরে ছাঁটাই, মামলা বা গ্রেপ্তারির চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করেই প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকরা বিশ্বজুড়ে সংগঠিত হচ্ছেন। নানা অভিনব পদ্ধতিতে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করে, সরাসরি পুঁজির উল্টোদিকে একজোট হচ্ছেন তাঁরা। এই লড়াইগুলো তার স্থানিকতার বেড়া ডিঙিয়ে বৃহত্তর কোন্‌ ঐক্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারে সেটাই দেখার। সেই লক্ষ্যে উদ্যোগ গড়ে তোলা, ট্রেড ইউনিয়ন লড়াইয়ের পাশাপাশি উপভোক্তাদের মধ্যেও সচেতনতা তৈরি করে গিগ শ্রমিকদের অধিকারের প্রশ্নে ব্যাপকতর সামাজিক আন্দোলনের পরিসরকে বিস্তৃত করা আজ সময়ের দাবি।   

প্রথম প্রকাশ: অনীক, কলকাতা, ডিসেম্বর ২০২২

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •