অর্থনৈতিক সংকটের কারণ: অতীত ও বর্তমান

অর্থনৈতিক সংকটের কারণ: অতীত ও বর্তমান

মোশাহিদা সুলতানা

ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশে সামষ্টিক, ব্যষ্টিক বিভিন্ন পর্যায়ে অর্থনৈতিক-সংকট চলছে। তার সাথে নিশ্চিতভাবে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থারও সম্পর্ক আছে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সংকটে দিশেহারা হলেও সরকার তার সাফল্য ছাড়া আর কিছুই স্বীকার করতে রাজী নয়। আর এই সংকটের সুবিধাভোগী গোষ্ঠী সরকারের প্রশ্রয়েই ক্ষমতাবান।  সব সংকটের পেছনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করলেও আসল কারণ কি তাই? সমাধানের আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক পথ কি আসলে কোনো সমাধান? প্রকৃতপক্ষে সংকটের কারণ সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করলে সমাধানের পথও পাওয়া যাবে। অনেক প্রচারণার ঘোর থেকে বের হয়ে এই লেখায় সেই কারণগুলোই অনুসন্ধান করা হয়েছে।

১। ভূমিকা

গত পঞ্চাশ বছরে তেলের দাম অনেকবার ওঠানামা করেছে। অনেকবার মূল্যস্ফীতি ও মন্দা হয়েছে বিভিন্ন দেশে। সত্তরের দশকের ইয়ম কুপ্পীর যুদ্ধ, আশির দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধ, নব্বইয়ের দশকে গালফ ওয়ার। সত্তরের দশকের তেল সংকটের পর জ্বালানি নিরাপত্তা প্রশ্নটিকে আবার নতুন করে দেখতে হয়েছে পুরো বিশ্বকে। যদিও সত্তরের দশকের আগে থেকেই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আধিপত্য ও প্রযুক্তি নির্ভরশীলতা সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। সত্তরের দশকের পর থেকে দেশীয় জ্বালানি সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানোর তাগিদ অনুভব করে দেশগুলো। আগে প্রভাবশালী দেশগুলো জ্বালানিকে কৌশলগত খাত হিসেবে বিবেচনা করত। কিন্তু সত্তরের সংকটের পর থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোও এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। খাদ্যসংকট কখন কীভাবে আসে তা পর্যালোচনা করে এই খাতকেও কৌশলগত খাত হিসেবে বিবেচনা করতে শিখে গেছে নীতিনির্ধারকরা।

এরপর আসছে কর্মসংস্থানের প্রশ্ন। কৃষিখাতের পাশাপাশি শিল্পখাত ও সেবাখাতে কর্মসংস্থানের গুরুত্ব অনুধাবন করে এর ওপর গুরুত্ব দিয়েছে বিশ্বের নীতিনির্ধারকরা। এ কারণে শিল্পদ্রব্য ও সেবা এখন শুধু পণ্য হিসেবে দেখা হয় না, মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এর গুরুত্ব অনুধাবন করেছে পৃথিবীর তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদরা। সারা বিশ্বে মানুষ জেনেছে শ্রমিকের মজুরি কম দিয়ে দেশে উন্নয়ন করা যায় না, বড়জোর লুটপাটের মাধ্যমে একটি বৈষম্যের অর্থনীতি দাঁড় করানো যায়, যার ভিত্তি দুর্বল ও ঠুনকো। সে কারণে উন্নত দেশগুলো নিজেদের অর্থনীতির ভিত মজবুত করেছে। যত সংকটই হোক না কেন, মানুষের জীবনযাপনে মিতব্যয়িতা হয়তো আসে, কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তার কারণে তারা চালিয়ে নিতে পারে মন্দাকালীন সময়। কিন্তু আমরা উন্নয়নশীল দেশগুলো পিছিয়ে থাকি।

প্রশ্ন হচ্ছে: সংকট শুরু হলে আমরা এত বেশি নাজুক কেন? কারণ, আমরা ইতিহাস থেকে শিখি না, বা শিখলেও গুটিকয়েকের বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য তাদের মুনাফা করার সুযোগ তৈরি করে দেয় গোটা সিস্টেম। আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে যেমন বহিঃশক্তি নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় দেশের নানান স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। প্রতিবার যুদ্ধ লাগলে দেখানো হয় এবারই প্রথম এই সংকট হয়েছে।

এই প্রবন্ধে প্রথমে সাম্প্রতিক বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণ বিশ্লেষণ করব। এর সূত্র ধরে আলোচনা করব এই অর্থনৈতিক সংকটে বৈশ্বিক পরিস্থিতির ভূমিকা আসলে কতটুকু। এবং সবশেষে সরকার কেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, তা নিয়ে একটি পর্যালোচনা হাজির করব।

২। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক পরিস্থিতি

মূল্যস্ফীতি ও ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের মূলে রয়েছে তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলারের সংকট। যুক্তরাষ্ট্রে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, অর্থাৎ সুদ বাড়ানোর কারণে ডলারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রথমে তেলের দাম বাড়া ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সেই অনুযায়ী তেলের দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে থাকে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০২৩-এর মার্চে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯.৩৩ শতাংশ। তবে ধারণা করা হয়, ২০০৫-০৬-কে ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতি গণনা করায় এই মূল্যস্ফীতি কম দেখানো হয়েছে। আসলে মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। দেশের অভ্যন্তরে তেলের দাম বৃদ্ধি আর ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি দ্রব্যের দাম বেড়েছে। যেহেতু বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ, আগে থেকেই টাকার দাম কমিয়ে রাখার নীতি গ্রহণ করে আসছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ডলারের সংকট তৈরি হওয়ায় এবং এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেলের দাম বাড়ায়–দুটো একসঙ্গে ঘটায় জ্বালানির দাম ডলারে পরিশোধ করতে গিয়ে আমাদের বেশি খরচ হচ্ছে। কাজেই সামনের দিনগুলোতে কী হতে যাচ্ছে, এটা এখন আমাদের মূল উদ্বেগের বিষয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কী অবস্থায় আছে? সম্প্রতি বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে রাশিয়া। মার্চে শি জিনপিং পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং শান্তি আলোচনা করতে গিয়েছিলেন এবং একই সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা গেছেন ইউক্রেনকে সাহস দিতে। পুতিন বলেছেন, যুদ্ধ বন্ধের এই প্রস্তাব সফল হবে যদি পশ্চিম ও ইউক্রেন চায়। যুদ্ধ বন্ধে স্থিতাবস্থা আগের মতোই আছে। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও আমরা দেখলাম, বিশ্বে জ্বালানি তেল ও খাদ্যসামগ্রীর দাম আগের তুলনায় অনেক কমেছে। এপ্রিলে ওপেক প্লাস সহসা তাদের সরবরাহ কমানোর ঘোষণা দেওয়ায় তেলের মূল্য যদিও কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু তা আগের অতি উচ্চমূল্যে যাওয়ার আশঙ্কা আপাতত নেই। কিন্তু যেই যুদ্ধকে দায়ী করা হচ্ছে সেই যুদ্ধের কারণে যে বলা হচ্ছিল সাপ্লাই চেইন বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে খাদ্যের দাম বেড়েছে, এবং তেলের দাম বেড়েছে–সেই পরিস্থিতি আসলে এখন আর আগের মতো নেই। দাম কমেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলংকা মার্চে তেলের দাম কমিয়েছে ৮-২৬ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী তেলের দাম বাড়ানোর সময় সমন্বয়ের প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন দাম কমায় সমন্বয় করছেন না।

যেই যুদ্ধকে দায়ী করা হচ্ছে সেই যুদ্ধের কারণে যে বলা হচ্ছিল সাপ্লাই চেইন বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে খাদ্যের দাম বেড়েছে, এবং তেলের দাম বেড়েছে–সেই পরিস্থিতি আসলে এখন আর আগের মতো নেই। দাম কমেছে।

ডলারের দাম কি কমবে? যুক্তরাষ্ট্রে যদিও সুদের হার কমায় মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে কিছুটা, অন্যদিকে অন্য সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ফেডারেল রিজার্ভ মনে করছে, সুদের হার বাড়ানোর সঙ্গে মার্চে সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাংক কলাপসের সম্পর্ক নেই। তাই আবার নতুন করে সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। (Sherman 2023) অনেক বিশেষজ্ঞ যেমন নুরিএল রোবিন (যিনি ২০০৮-এর ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস নিয়ে আগাম প্রেডিকশন করেছিলেন) সম্প্রতি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এদিক থেকে বার্তা হলো, ডলারের দাম কমার সম্ভাবনা নেই।

এলএনজির দাম কি আবার বাড়বে? ইউরোপের জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে মন্দা চলছে। যদিও ইউরোপের মূল্যস্ফীতির দরুন সাধারণ মানুষ ভুক্তভোগী হয়েছে। এ বছর শীত কম থাকায় জ্বালানির ওপর যে ধরনের চাপ আশা করা হয়েছিল তা হয়নি। এবারের শীতও পার করেছে ইউরোপ। শীত কমার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসের দামও কমেছে। বাংলাদেশে এর প্রভাব হিসেবে দেখছি বাংলাদেশ স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কেনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এদিকে বাংলাদেশকে রাশিয়া প্রস্তাব দিয়েছে এলএনজি কেনার। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেনে নানান বাধা-বিপত্তি থাকায় এ নিয়ে বাংলাদেশ পড়েছে বিপদে। আবার রাশিয়ার মন্দা ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। রাশিয়ার সঙ্গে রূপপুর নিয়ে লেনদেন সমস্যা রয়েছে। এলএনজি আমদানির কোনো সহজ পথ এখনো বের হয়নি। আবার অন্যদিকে তেলের দাম বাড়ায় গ্যাসের ওপর চাপ বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে চাহিদা বাড়লে গ্যাসের দাম আবারও বাড়তে পারে।

৩। সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির প্রভাব

বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি গত বছর থেকেই শুরু হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি ও ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে এ মাসে। মানুষ সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে। ধারদেনা করছে। স্বাস্থ্য-শিক্ষায় খরচ কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। সানেমের একটি জরিপে উঠে এসেছে, সঞ্চয় ভাঙিয়ে ব্যবহার করেছে ৩৫.৩ শতাংশ পরিবার , সন্তানের পড়ালেখার খরচ কমিয়েছে ১০.৪ শতাংশ পরিবার, মাংস খাওয়া কমিয়েছে ৯৬.৪ শতাংশ পরিবার, মাছ খাওয়া কমিয়েছে ৮৮.২২ শতাংশ পরিবার, ডিম খাওয়া কমিয়েছে ৭৭ শতাংশ পরিবার। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের ৩৭ শতাংশ পরিবার তিন বেলার মধ্যে এক বেলা খেতে পারছে না। ৪০ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এমন অনেক দিন তাদের ঘরে কোনো খাবার ছিল না। এ সময় এমনও দিন গেছে, পুরো দিন না খেয়ে কেটেছে ১৮ শতাংশ পরিবারের। (নিজস্ব প্রতিবেদক ২০২৩)

সঞ্চয় ভাঙিয়ে ব্যবহার করেছে ৩৫.৩ শতাংশ পরিবার , সন্তানের পড়ালেখার খরচ কমিয়েছে ১০.৪ শতাংশ পরিবার, মাংস খাওয়া কমিয়েছে ৯৬.৪ শতাংশ পরিবার, মাছ খাওয়া কমিয়েছে ৮৮.২২ শতাংশ পরিবার, ডিম খাওয়া কমিয়েছে ৭৭ শতাংশ পরিবার। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের ৩৭ শতাংশ পরিবার তিন বেলার মধ্যে এক বেলা খেতে পারছে না। ৪০ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এমন অনেক দিন তাদের ঘরে কোনো খাবার ছিল না। এ সময় এমনও দিন গেছে, পুরো দিন না খেয়ে কেটেছে ১৮ শতাংশ পরিবারের।

৪। ইউক্রেন যুদ্ধকে কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু আসলেই কি যুদ্ধ মূল কারণ?

প্রথমত, আজ আমাদের সংকটের সূত্রপাত জ্বালানির ভুল নীতির কারণে। নব্বইয়ের দশক থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে তথাকথিত উদারীকরণের পথে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর মানে প্রথমে বেসরকারি আইপিপি ও পরে রেন্টাল কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের কাছে দেয়া হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দায়িত্ব। ২০০০-এর দশক পর্যন্ত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অংশগ্রহণ চলেছে, ২০১০-এর দশকে এসে এই বেসরকারি খাতে উৎপাদন বাড়াতে আমাদের জ্বালানি আমদানি নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদেশি ঋণনির্ভর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং রূপপুর নিউক্লিয়ার প্রকল্প। যেগুলো উৎপাদনে এলে উৎপাদন খরচ ও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতেই জনগণের ওপর বাড়তি আর্থিক বোঝা চাপানো হবে। এর মধ্যে লক্ষ করলে দেখা যাবে, প্রকল্পগুলোতে চীন, জাপান, রাশিয়া ও ভারতের ঋণ রয়েছে। যদিও প্রকল্পগুলো যৌথ মালিকানায় হচ্ছে, ঋণ পরিশোধের দায় পুরোপুরি বাংলাদেশের। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণে রাশিয়ান কনট্রাক্টর দেরি করলেও এর জন্য নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ দিতে হয় বাংলাদেশকেই। এ রকম বিবিধ উপায়ে বাংলাদেশ যেসব চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে, দিনে দিনে দেখা যাচ্ছে বিদ্যুৎ খাত একটা বোঝা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অথচ এর আগের সংকট থেকে পুরো বিশ্ব শিখেছে যে এ ধরনের সংকট থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে দেশীয় জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে। যেসব দেশে জ্বালানি সম্পদের প্রাচুর্য নেই, তারা কৌশলগতভাবে জ্বালানি আমদানির নির্ভরযোগ্য মাধ্যম খুঁজেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গ্যাস ছিল আশীর্বাদ। কিন্তু এই সেক্টরই সবচেয়ে অবহেলিত ছিল এতদিন। ডেনমার্কের প্রকৌশল ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান র‍্যাম্বল বাংলাদেশের গ্যাস সেক্টরের মাস্টার প্ল্যান করেছিল। সেখানে তাদের সুপারিশ ছিল, ২০২১ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করে গ্যাস আমদানি না করে দেশীয় গ্যাস উত্তোলনে বিনিয়োগ করা উত্তম। সরকারের কমিশন করা প্রতিষ্ঠান নিজেই যখন এ রকম প্রস্তাব দেয়, তখনও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে এগোয়নি।

উৎপাদন খরচ ও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতেই জনগণের ওপর বাড়তি আর্থিক বোঝা চাপানো হবে। এর মধ্যে লক্ষ করলে দেখা যাবে, প্রকল্পগুলোতে চীন, জাপান, রাশিয়া ও ভারতের ঋণ রয়েছে। যদিও প্রকল্পগুলো যৌথ মালিকানায় হচ্ছে, ঋণ পরিশোধের দায় পুরোপুরি বাংলাদেশের।

গত এক বছরে বাপেক্সের নড়েচড়ে ওঠা লক্ষণীয়। গত এক বছরে বাপেক্স নয়টি কূপে কাজ করে নতুন করে ৭২৩ দশমিক ৬৫ বিসিএফ গ্যাসের মজুত আবিষ্কার করেছে। হিসাব করে দেখা গেছে, এসব কূপে মাত্র ৮১২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ১ লাখ কোটি টাকার এলএনজি আমদানি সাশ্রয় করেছে বাপেক্স। (তাহের, ২০২৩)  যেই উদ্যোগ আগেই নেওয়া যেত, সেই উদ্যোগ সংকটের সময় নেওয়ায় উদ্ভূত সংকট পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়নি। বিদ্যুতের তেল ও বিদ্যুতের দাম এর আগেই বেড়ে গিয়েছে।

গত এক বছরে বাপেক্স নয়টি কূপে কাজ করে নতুন করে ৭২৩ দশমিক ৬৫ বিসিএফ গ্যাসের মজুত আবিষ্কার করেছে। হিসাব করে দেখা গেছে, এসব কূপে মাত্র ৮১২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ১ লাখ কোটি টাকার এলএনজি আমদানি সাশ্রয় করেছে বাপেক্স।

এখন সরকারের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে দায় পরিশোধ করা। সম্প্রতি নতুন নতুন প্রকল্প (রামপাল, আদানি ও পায়রা) গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করেছে, আরও প্রকল্প সরবরাহ শুরু করবে সামনে। এর জন্য জ্বালানি কিনতে হলে ডলারে পরিশোধ করতে হবে। আমাদের নিজেদের দেশীয় গ্যাস কিনতে শেভরনকে ডলারে পরিশোধ করতে হয়। সরকার সংকট শুরু হওয়ার পর এই অর্থ পরিশোধেও দেরি করছে। ডলার পরিশোধ না করলে নিজের দেশের গ্যাসের ওপর নিজেদের অধিকারই ক্ষুণ্ন হতে চলেছে। এর মধ্যে আমরা জেনেছি, রিজার্ভের পরিমাণ ৩১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যা গত ছয় বছরে সর্বনিম্ন। ২০২২-এর মার্চে রিজার্ভ ছিল ৪৬ বিলিয়ন ডলার। এক বছরে গ্রস রিজার্ভ কমেছে ১৫ বিলিয়ন ডলার। যদিও বলা হচ্ছে, আমাদের এ বছর ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে, গত এক বছরে ১৫ বিলিয়ন ডলার কমে যাওয়ায় সামনের বছরগুলোতে গ্রস রিজার্ভ কত কমবে, তা আমরা এখনো জানি না। শুধু জানি, এমন অবস্থায় সরকার আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছে। এবং আইএমএফের শর্ত মেনে, জনজীবনের ওপর আরও চাপ তৈরি করে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে আমাদের। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল ও রূপপুর নিউক্লিয়ার প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হলে রিজার্ভের ওপড় চাপ আরও বাড়বে। রিজার্ভ দ্রুত কমে যাওয়ার মূল কারণ আমাদের অর্থনীতির আমদানি নির্ভরতা এবং ঋণনির্ভর প্রকল্প। এদিকে আমরা আমাদের এলএনজি সক্ষমতাই পুরো ব্যবহার করতে পারছি না। দাম বাড়ার জন্য আমদানিই যখন ব্যাহত হচ্ছে, তখন নতুন এলএনজি প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এসব দিক থেকে দেখলে আমাদের অতিরিক্ত আমদানি নির্ভরতাই আমাদেরকে এখন সংকটে পতিত করেছে।

দাম বাড়ার জন্য আমদানিই যখন ব্যাহত হচ্ছে, তখন নতুন এলএনজি প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এসব দিক থেকে দেখলে আমাদের অতিরিক্ত আমদানি নির্ভরতাই আমাদেরকে এখন সংকটে পতিত করেছে।

এদিকে আরেকটি সংকট সৃষ্টি হতে যাচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভারত নির্ভরতা নিয়ে। বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ১৫২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন ২৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। ২০২২ সালের ১৬ এপ্রিল সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। এর মধ্যে বর্তমানে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি হয় সর্বোচ্চ উৎপাদনের প্রায় ৮ শতাংশ (১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট)। ভারতীয় প্রকল্পগুলো (বাংলাদেশ ও ভারতে) বাস্তবায়ন হলে এই নির্ভরশীলতা বেড়ে হবে প্রায় ৪ হাজার ৮৬০ মেগাওয়াট। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে ভারতের অংশগ্রহণ দাঁড়াবে প্রায় ১৬ শতাংশ। এর সঙ্গে নির্মিতব্য পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল আমদানিতে জ্বালানি খাতে ভারতের অংশগ্রহণ ২০ শতাংশের বেশি হয়ে যাবে। বাংলাদেশের নিজস্ব রিফাইনারি সক্ষমতা না বাড়িয়ে পাইপলাইনে এই পরিশোধিত তেল আমদানি ভবিষ্যতে সক্ষমতা তৈরির পথে বাধা সৃষ্টি করবে। দেশের ভেতরে রিফাইনারি হলে দেশে কিছু কর্মসংস্থান হতো। কিন্তু এখন আমদানিকৃত পরিশোধিত তেলও আমাদের বেশি দামে কিনে আনতে হবে। অর্থাৎ, ডলারের ওপর যেই চাপ এরই মধ্যে রয়েছে তা দিনে দিনে আমরা বাড়িয়েই চলেছি।

আদানির সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি যে অসম তা উন্মোচিত হয়েছে চুক্তি প্রকাশের পর। কয়লার দাম নির্ধারণ, বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ, ক্যাপাসিটি চার্জের শর্ত, কয়লা পরিবহণের খরচ, কোনো কিছুই এই চুক্তিতে বাংলাদেশের অনুকূলে যায়নি। বরং চুক্তির শর্ত পড়ে মনে হয়েছে, এ রকম অসম চুক্তি একটা দেশে কীভাবে করা সম্ভব? মার্চে ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে আদানির বিদ্যুৎ গ্রিডে যুক্ত হয়। কয়লার দামভেদে বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের দাম পড়বে ১৫ থেকে ২০ টাকা। কয়লার দাম আরও বেশি হলে তা ২০ টাকার বেশিও হতে পারে। আদানির চুক্তিতে দেশের স্বার্থ এভাবে জলাঞ্জলি দেওয়ার পরও, এত সমালোচিত হওয়ার পরও নতুন করে বাংলাদেশ ১০০ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কেনার পরিকল্পনা করছে। যেন দ্বিগুণেরও বেশি দামে আদানির গোড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ কিনে ভারতকে যথেষ্ট সন্তুষ্ট করা যায়নি। এখন আরও বেশি দেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে। এই গভীর সংকটের মাঝে যখন এ বছরের শুরুতে প্রতি মাসে ৫ শতাংশ করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে, জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেছে, তখন নতুন প্রকল্প গ্রহণের এই উদ্যোগ দেখে মনে হচ্ছে, সরকারের জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই।

আদানির সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি যে অসম তা উন্মোচিত হয়েছে চুক্তি প্রকাশের পর। কয়লার দাম নির্ধারণ, বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ, ক্যাপাসিটি চার্জের শর্ত, কয়লা পরিবহণের খরচ, কোনো কিছুই এই চুক্তিতে বাংলাদেশের অনুকূলে যায়নি। বরং চুক্তির শর্ত পড়ে মনে হয়েছে, এ রকম অসম চুক্তি একটা দেশে কীভাবে করা সম্ভব?

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সময় এর দাম বলা হয়েছিল ৮ টাকা। এই নিয়ে বিতর্ক ছিল। কয়লা বিদ্যুতের বিরোধিতা করেনি অনেকেই। কারণ, কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সস্তা বলে। কিন্তু গত মাসে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরুর সময় জানা গেল, প্রতি ইউনিটের দাম ১৪ টাকার ওপরে। আমাদের জানানো হয় এক, বাস্তবে হয় আরেক। কোনো প্রশ্ন ছাড়াই এই দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে সেই ইউক্রেন যুদ্ধের দ্বারস্থ হতে হলো? যেন কেউ জানতই না বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভরশীল হলে কী হয়? যেন এর আগে কোনো ঘটনা ঘটেনি।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশ ৬-৭ বিলিয়ন ডলার খাদ্যদ্রব্য আমদানি করে। (Bangladesh Bank 2023)  গত এক বছরে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শুনেছি, সরিষার তেল, বাদামের তেল, তিসির টেলের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর কথা। অথচ লক্ষ করলে দেখা যাবে, আমাদের দেশেই একসময় ভোজ্যতেল উৎপাদন হতো। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানও ছিল। চিনি ও খাদ্যশিল্প প্রতিষ্ঠানের অধীনেই তেল উৎপাদন হতো। আমি বলছি না চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামাল না থাকলেও সব ভোজ্যতেল দেশে উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের যতটুকু ছিল তা দিয়ে কিছু হলেও উৎপাদন করা সম্ভব ছিল। আর চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন নিজেই তেল কিনে দেশের বাজারে তেলের দাম সামর্থ্যের মধ্যে রাখতে পারত। কিন্তু বিদেশ থেকে আমদানি করার জন্য যখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখন তেলের বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পায়। ফলে সরকার ধীরে ধীরে দামের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে।

খাদ্যপণ্যের প্রায় সব সেক্টরে আমরা সিন্ডিকেটের ভূমিকা সক্রিয় হতে দেখি। ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ১৩০-১৪০ টাকা হলেও বিক্রি হয়েছে ২৫০ টাকা বা তার ওপরে। পরে কমে গেলেও আগের দামে ফিরে আসেনি। সাধারণ মানুষ বাজারে গিয়ে মুরগির এই বর্ধিত দাম দেখে কেউ কেউ না কিনেই ফিরে এসেছেন। কেউ কেউ মুরগির পা, গিলা, কলিজা, চামড়া কিনে ফিরে এসেছেন। সাধারণ মানুষ এখন আস্ত মুরগি কিনতে পারছে না বলে পিস হিসেবে মুরগি বিক্রি হচ্ছে। এদিকে মুরগির দাম নাকি অদৃশ্য উৎস থেকে আসা এসএমএসের মাধ্যমে নির্ধারিত হচ্ছে বাজারে। বড় উৎপাদকরা যেই দামে বিক্রি করেন, অন্যরাও সেই দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন। উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছেন না ক্ষুদ্র উৎপাদকরা। না পেরে সক্রিয় হচ্ছে অদৃশ্য সিন্ডিকেট। কাজেই আমরা দেখছি, সরকার বাজারের ওপর সব ছেড়ে দেওয়ায় ধীরে ধীরে মানুষের প্রধান খাদ্য উৎস মুরগি ও ডিমের দামের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। যেই সরকারের কথা ছিল বাজারকে অসাধু তৎপরতা থেকে রক্ষা করা, খাদ্যপণ্যের দাম মানুষের সামর্থ্যের মধ্যে রাখা, সেই সরকার তা না করে সুবিধা করে দিচ্ছে গুটিকয়েক বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীকে। সরকার এমন পরিবেশ তৈরি করেছে যে, এই শোষণের মাত্রায় একাধিক পক্ষ লাভ করে যাচ্ছে। একদিকে তেলের দাম বাড়িয়ে, পরিবহণ খরচ বৃদ্ধি করে, উৎপাদন খরচ বাড়ানো হয়েছে; অন্যদিকে এই উৎপাদন খরচের অজুহাত দেখিয়ে সরকার ব্যবসায়ীদের বেশি দামে খাদ্যপণ্য বিক্রির পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছে।

চিনির বাজারে গত এক বছরে কী হয়েছে তা দেখলেও বোঝা যাবে আমদানি নির্ভরতা বাড়িয়ে এবং দেশীয় ৬টি চিনিকল বন্ধ করে সরকার কীভাবে বেসরকারি রিফাইনারি মালিকদের সুবিধা দিয়েছে। ঢাকার বাজারে এখন প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। অর্থাৎ, গত এক বছরে চিনির দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। রোজার মাস সামনে রেখে সরকার নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কমিয়েছে এবং আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু তাতেও দাম কমেনি। ধারণা করা হয়েছিল, রমজান মাসে চিনির দাম কমাতে সরকার এই সুবিধা দেবে আমদানিকারকদের। কিন্তু আমদানিকারকরা সুবিধা পেলেও চিনির দাম এখনো কমেনি। অথচ সেদিনও টিভিতে দেখছিলাম ৬টি চিনিকল বন্ধ করার পর কীভাবে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। এই শুল্ক তো রাজস্ব আয়। এই সুবিধা দিয়ে সরকারের রাজস্ব আয় কমছে, এই আয় তো জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করার কথা। কিন্তু তার বিনিময়ে কী পাচ্ছে জনগণ? চিনির দাম তো কমছে না। তাহলে এত সুবিধা দিয়েও জনগণের কাছে যে কোনো সুফল পৌঁছাচ্ছে না, এর পেছনে কারণ কী? আবারও বলতে হয়, পেছনের দিকে তাকিয়ে খাদ্যসংকট মোকাবিলায় যেসব পদক্ষেপ পৃথিবীব্যাপী নীতিনির্ধারকরা শিখেছে, তা আমরা জেনেও না জানার ভান করছি। খাদ্যপণ্য যে একটি কৌশলগত খাত, আর এর নিয়ন্ত্রণ যে পুরোপুরি বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে হবে না, এই মৌলিক জ্ঞান আমরা পূর্ববর্তী সংকটের সময়ই উপলব্ধি করেছি। কিন্তু সেই জ্ঞানের চর্চা আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত। তাহলে এই দোষ কার? নিশ্চয়ই ইউক্রেন যুদ্ধের নয়। দোষ আমাদের অভ্যন্তরীণ ভুল খাদ্য ও শিল্পনীতির।

দেশে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে সার আমদানি করা হয়েছে তিন গুণ। (Bangladesh Bank 2023) সরকারের সার বাবদ কৃষিতে ভর্তুকি দিতে হয়েছে বেশি। কিছুদিনের মধ্যে দেখা যাবে বিদ্যুতের পেছনে ভর্তুকি দিতে না পেরে হয়তো সরকার বলবে কৃষিতে ভর্তুকি দিতে পারব না। অথচ আমাদের সার কারখানাগুলোতে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা দূর করলে সারের আমদানি কমানো যেত। দেশীয় কাঁচামাল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে জৈব সারে বিনিয়োগ করলে আমদানি নির্ভরতা কমানো যেত। এভাবে খরচ বাড়ত না।

তৃতীয়ত, আমদানিকৃত কাঁচামাল-কেন্দ্রিক শিল্পখাত ও সরাসরি কাঁচামাল রপ্তানি শিল্পখাতকে টেকসই করছে না।

শিল্পখাতের দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে এমনসব শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে, যেখানে দেশীয় কাঁচামাল বা শ্রম ব্যবহার করে মূল্য সংযোজনের চেয়ে সরকারের প্রবণতা হলো আমদানি নির্ভর শিল্পখাতকে সুবিধা দেওয়া। যেমন, ৬টি রাষ্ট্রীয় চিনিকল যেগুলো দেশীয় আখ ব্যবহার করে চিনি উৎপাদন করত, সেগুলো বন্ধ করে সরকার আমদানি করা বা কাঁচা চিনি থেকে রিফাইন করে বিক্রি করছে। রাষ্ট্রায়ত্ত কাগজের মিলও বন্ধ করে বেসরকারি খাতকে সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। কাগজও বেশি আমদানি করতে হয়। বই ও শিক্ষা উপকরণের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। ডিজিটাইজেশনের কারণে যে ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, সেখানে কম্পিউটার কিনতে কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, কিন্তু সেই অনুযায়ী মানসম্পন্ন বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাচ্ছে না।

গার্মেন্টস ও নিট ওয়্যারে রপ্তানি আগের বছর ৩১ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২ সালে ৪২ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। কিন্তু আবার আমদানি বেড়েছে ১৪ বিলিয়ন থেকে ২২ বিলিয়ন ডলার। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি এসেছে গার্মেন্টস ও নিট ওয়্যার খাত থেকে। (Bangladesh Bank 2023) বিদেশ থেকে কাঁচামাল এনে সস্তা শ্রম ব্যবহার করে রপ্তানি করা হয়। তা ছাড়া আমরা দেখেছি, সবসময় গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা বলেন প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছেন না বলে লোকসান কমাতে শ্রমিকের মজুরি বাড়াতে পারেন না। ডলারের রেট বাড়ালে তারা লোকসান থেকে বাঁচবেন। অথচ এখন যখন রপ্তানি আয় বেড়েছে, আমরা শ্রমিকের মজুরি বাড়ার কোনো নাম-গন্ধ দেখছি না। এত বছরেও গার্মেন্ট শিল্পে আমদানি করা কাঁচামালের পরিমাণ কমানো গেল না।

গার্মেন্টস ও নিট ওয়্যারে রপ্তানি আগের বছর ৩১ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২ সালে ৪২ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। কিন্তু আবার আমদানি বেড়েছে ১৪ বিলিয়ন থেকে ২২ বিলিয়ন ডলার।

পাটকলের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রীয় পাটকলগুলো বন্ধ করে এখন বেসরকারি পাটকলের মালিকদের রপ্তানিতে বছরে নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে বছরে ৭ হাজার কোটি টাকা। ব্যবসায়ীরা সাধারণ পাটকে বিশেষ ধরনের পণ্য দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে নগদ সহায়তা নিচ্ছে। উল্লেখ্য, কাঁচা পাট রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন হয় কম। অর্থাৎ, পাটের পণ্য উৎপাদনে কর্মসংস্থান হয় এবং সেই পণ্য বিক্রি করলে সরকার বেশি নগদ সহায়তা দেয়। কিন্তু যেই বেসরকারি খাতের হাতে সরকার এই শিল্পকে উঠিয়ে দিয়েছে তাদের আগ্রহ দেশে পাটপণ্য উৎপাদন করা নয় বা কর্মসংস্থান তৈরিও নয়। তাদের উদ্দেশ্য–সরকারের দেওয়া সহায়তা পকেটস্থ করা। এমন যখন ঘটছে তখন পাটমন্ত্রী নীরব। মনে করছেন এখন রপ্তানি করে বিদেশি মুদ্রা অর্জনের সময়। এখন এগুলো নিয়ে কিছু বলা যাবে না। বিষয়টা হচ্ছে, ওনারা দেশে কর্মসংস্থান ধ্বংস করবেন, কাঁচা পাট বিক্রি করে সরকারের দৈনন্দিন খরচ মেটাবেন, আর দেশের মানুষ বেকার থেকে বেশি দাম দিয়ে বিদ্যুৎ, চাল, তেল চিনিসহ সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনবেন। শুধু তো তাই না, মৌলিক সেবা যেমন: স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা সবকিছু জনগণকে নিজের পয়সায় কিনতে হবে। এই অর্থ আসবে কোথা থেকে? সম্প্রতি বাজেট সামনে রেখে বিশ্বব্যাংক আয়কর ও ভ্যাট বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানোর শর্তে বাজেট সহায়তা দেবে বলে জানিয়েছে। এমনিতেই সাধারণ মানুষ ভ্যাট দিয়ে ৩৮ শতাংশের বেশি রাজস্ব আয়ে অবদান রাখছে। এই ভ্যাট বাড়িয়ে সরকার আবারও বিশ্বব্যাংক থেকে বাজেট সহায়তা নেবে।

পাটকলের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রীয় পাটকলগুলো বন্ধ করে এখন বেসরকারি পাটকলের মালিকদের রপ্তানিতে বছরে নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে বছরে ৭ হাজার কোটি টাকা। ব্যবসায়ীরা সাধারণ পাটকে বিশেষ ধরনের পণ্য দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে নগদ সহায়তা নিচ্ছে।

এদিকে সরকার তার শিল্পনীতিতে বহুদিন ধরে ইপিজেড নির্মাণের পর এখন স্পেশাল ইকোনমিক জোন তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়ে এগোচ্ছে। জেলায় জেলায় অধিগ্রহণ করা জমি বছরের পর বছর অনাবাদি পড়ে আছে। জমির দাম বাড়ছে, কিন্তু চাষাবাদের জমি কমছে। অথচ জমি দখল করে এসইজেড করার পরিকল্পনা অব্যাহত আছে। এদিকে শিল্প বিকাশের জন্য মানুষের জমানো আমানত ব্যাংক থেকে ঋণ দিলেও সে হারে শিল্পের বিকাশ হচ্ছে না। শিল্প বিকাশের নামে শিল্প ধ্বংস করা হচ্ছে। টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে আইটি পার্ক বানানো হয়েছে, কিন্তু সেগুলোতে বিনিয়োগ হচ্ছে না বলে কমিউনিটি সেন্টার করে বিয়ের পার্টির জন্য ভাড়া দিয়ে খরচ তোলার চেষ্টা হচ্ছে। এই সমস্ত কিছুকে আমি বলি সমন্বয়হীন শিল্প বিকাশ। একদিক থেকে ঋণ দিয়ে ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিক থেকে সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে, উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে, শিল্প বিকাশের সমস্ত পথ অবরোধ করে রেখেছে। জাপান অর্থনৈতিক অঞ্চল উদ্বোধন করে এলাকার আশপাশে জলাবদ্ধতা তৈরি করে মানুষের জীবনযাপন কঠিন করে ফেলেছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক অঞ্চলের জমি খালি পড়ে আছে। বিনিয়োগ আসছে না। বাস্তবায়ন তো দূরের কথা। মাঝখান থেকে মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। জলাবদ্ধতার মধ্যে আশপাশের মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। আমরা শুধু বিজ্ঞাপন দেখছি, অর্থনৈতিক অঞ্চলের আশপাশের জমির দাম বাড়ছে।

একদিক থেকে ঋণ দিয়ে ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিক থেকে সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে, উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে, শিল্প বিকাশের সমস্ত পথ অবরোধ করে রেখেছে। জাপান অর্থনৈতিক অঞ্চল উদ্বোধন করে এলাকার আশপাশে জলাবদ্ধতা তৈরি করে মানুষের জীবনযাপন কঠিন করে ফেলেছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক অঞ্চলের জমি খালি পড়ে আছে।

৫। সরকার কেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না?

অবশ্যই মূল্যস্ফীতি না কমানোর পেছনে সরকারের সদিচ্ছার অভাব একটি মূল কারণ। সরকার স্বীকারই করে না দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সরকার এটাও স্বীকার করে না, জ্বালানির ভুল নীতি আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে। সরকার স্বীকারই করতে চায় না, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। তাহলে সরকার কীভাবে সমাধান করবে? যদি স্বীকার করেও, তাহলে কি এখন রাতারাতি মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে? দীর্ঘ মেয়াদে নেওয়া কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এমন কিছু বাধা সৃষ্টি করেছে, যেগুলো সরকার রাতারাতি পরিবর্তন করতে গেলে স্বল্প মেয়াদে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে না।

সরকার স্বীকারই করে না দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সরকার এটাও স্বীকার করে না, জ্বালানির ভুল নীতি আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে। সরকার স্বীকারই করতে চায় না, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। তাহলে সরকার কীভাবে সমাধান করবে?

৫.১) আমদানি নির্ভরতা ও ঋণনির্ভর প্রকল্প: হঠাৎ করে ডলারের দাম বাড়ায় অর্থনীতিবিদরা বলছিলেন, এতদিন ধরে ধীরে ধীরে কেন টাকার অবমূল্যায়ন করা হলো না, তাহলে এই চাপ একসঙ্গে পড়ত না। কিন্তু বাংলাদেশে কতগুলো কৌশলগত পণ্য আমদানি করতে হয় যেমন: খাদ্য, জ্বালানি, সার ইত্যাদি। টাকার অবমূল্যায়ন করলে সরকারকে এগুলো বেশি দামে কিনতে হতো। যেসব দেশ আমদানিনির্ভর তারা সহজে অবমূল্যায়ন করতে চায় না। বাংলাদেশও সেভাবেই নীতি নির্ধারণ করে যাচ্ছিল। কিন্তু সে কারণে শুধু টাকার অবমূল্যায়ন করে সে সমাধান করতে চাওয়াটা মোটেই টেকসই নয়। কারণ, বৈশ্বিক যেকোনো কারণেই ডলারের দাম বাড়তে পারে। বরং উচিত ছিল আমদানি ব্যয় কমানো। যদি আমাদের স্থানীয় বিনিয়োগ আরও বেশি হতো, স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে আমদানির ওপর বোঝা কমানো হতো, ঋণনির্ভর প্রকল্পের কারণে ঋণের শর্তানুযায়ী বিদেশ থেকে আমদানি না বাড়ত, সর্বোপরি আমদানি কম হতো, তাহলে আমাদের শুধু টাকার অবমূল্যায়নের ওপর নির্ভর করতে হতো না। যেহেতু আমরা অত্যন্ত সংবেদনশীল ও কৌশলগত খাতে আমদানি নির্ভর, তাই আমরা বেশি বিপদে পড়েছি। এখন যখন ডলারের মূল্য বাড়ছে, টাকার অবমূল্যায়ন করতে আমরা বাধ্য হয়েছি। এখন চাইলেও আমরা টাকা অবমূল্যায়ন না করে পারব না।

ঋণ নির্ভর প্রকল্প হাতে নিলে তার দেনা পরিশোধ করতে আমরা বাধ্য। কাজেই এখন ফিরে গিয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের সুযোগ নেই। এমন যদি হতো যে ঋণনির্ভর এই প্রকল্পগুলোর কারণে বাংলাদেশ সুফল লাভ করতে শুরু করেছে এবং এ কারণে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে ও উৎপাদন বাড়ছে, তাহলে বলা যেত এই প্রকল্পগুলোর কোনো অবদান আছে। কিন্তু আমরা এখন এমন একটা অবস্থায় আছি যে ব্যয়বহুল প্রকল্প করে এখন ঋণ শোধে আমাদের উলটো ঋণ নিতে হচ্ছে। ঋণ নিলে সবসময়ই উৎপাদন খরচের বেশি দামে বিক্রি করে ঋণ শোধের প্রবণতা থাকে, কাজেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ঋণনির্ভরটা আরেকটা বাধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

৫.২) বাজারব্যবস্থার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা: বেশিরভাগ খাদ্যপণ্য বাজারব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। অথচ বাজার অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী আমাদের দেশের বাজার কাজ করে না। এখানে প্রতিযোগিতার নামে অসম প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করে রাখা হয়েছে সবখানে। মুরগির দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কয়েকটি বড় কোম্পানির বাজার দখল করে রাখার কারণে। বড় কোম্পানির সঙ্গে কিছু ছোট খামারির চুক্তির কারণে অন্য ছোট খামারিরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। কৌশল অবলম্বন করে বাজার দখল করে রাখার এই প্রবণতার কারণে বাজারের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ না রেখে সম্পূর্ণ বাজার বেসরকারি খাতের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছেড়ে দেওয়ায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। যে কারণে সরকার তেল আমদানিকারকদের সঙ্গে কয়েক দফা বসেও তেলের দাম আগের পর্যায়ে বা সহনীয় মাত্রায় আনতে পারেনি। বেশিরভাগ পণ্যে বাজারভেদে এই নিয়ন্ত্রণহীনতা দায়ী। কোনো রেগুলেশন নেই। সরকার যা নির্দেশনা দিচ্ছে তা কেউ মানছে না। সরকার চিনিতে শুল্ক কমালো, চিনির দাম উলটো বেড়ে গেল। অর্থাৎ, বাজার এত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে বাজারে অসম প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হলে সরকার আর তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এর ফলে বাংলাদেশে প্রফিট-পুশ ইনফ্লেশন শুরু হয়েছে। প্রফিট-পুশ ইনফ্লেশন হলো যেই ইনফ্লেশনে পণ্যের দাম চাহিদা বা উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির সঙ্গে সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায় না; বরং চাহিদা ও উৎপাদন খরচ বাড়লে যে পরিমাণ বাড়ার কথা তারচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়। এ ধরনের ইনফ্লেশন হয় যখন বাজার দখলে গুটিকয়েক কোম্পানি সংকট কাজে লাগিয়ে বেশি মুনাফা করার সুযোগ তৈরি করে।

বাংলাদেশে প্রফিট-পুশ ইনফ্লেশন শুরু হয়েছে। প্রফিট-পুশ ইনফ্লেশন হলো যেই ইনফ্লেশনে পণ্যের দাম চাহিদা বা উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির সঙ্গে সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায় না; বরং চাহিদা ও উৎপাদন খরচ বাড়লে যে পরিমাণ বাড়ার কথা তারচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়।

৫.৩) সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি কেন কাজ করছে না?

যেখানে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি হয় সেখানে সুদের হার বাড়ালে মূল্যস্ফীতি কমবে এমন মনে করার কারণ নেই। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে যেভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে, সেভাবে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। ২০২৩ সালে সঞ্চয়ের সুদহারের সীমা উঠিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ঋণের সুদহার অপরিবর্তিত রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নীতি হার বা ব্যাংক রেট আরও এক দফা বৃদ্ধি করেছে। এই মুদ্রানীতির কারণে আমানত হয়তো কিছু বাড়তে পারে, কিন্তু তাতে মূল্যস্ফীতি কমবে না। যদি যুক্তরাষ্ট্রের মতো ঋণের সুদহার বাড়ানো হয়, তা নতুন বিনিয়োগকে আরও সংকুচিত করবে। এ ছাড়া যারা আর্থিক অনটনের কারণে অসুবিধায় আছে, তাদের জন্য ঋণ নেওয়া আরও কষ্ট হয়ে যাবে। এসব কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদে কোনো পরিবর্তন আনেনি। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর আগেও দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি খুব একটা সংবেদনশীল ভূমিকা রাখে না। ধরা হয় সংকোচনশীল মুদ্রানীতির কারণে মানুষ বেশি সঞ্চয় করে এবং পণ্যের চাহিদা কমে। চাহিদা কমলে ব্যবসায়ীরা দাম কমায়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এক শ্রেণি সঞ্চয় করলেও অন্য শ্রেণি সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সঞ্চয় কমতেই আমরা দেখছি। আগে এভাবে মূল্যস্ফীতি কমেনি কখনো। বরং মানুষকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের পেছনে আয়ের বেশিরভাগ যখন ব্যয় করতে হয়, তখন দাম বাড়লেও তার মৌলিক পণ্যে খরচ কমানো সম্ভব হয় না। এসব কারণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করে না।

৫.৪) সরকার-ব্যবসায়ী আঁতাত: সরকার-ব্যবসায়ী আঁতাত যত শক্তিশালী হবে, সরকার তত বেশি ব্যবসায়ীদের সুযোগ তৈরি করে দেবে। এতে দেশের সাধারণ মানুষের চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে না। গণতন্ত্রহীনতায় মানুষের মতামত, তার ভোগান্তি–এগুলো কিছুই আমলে নেওয়া হচ্ছে না। সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের যে আঁতাত তৈরি হয়েছে তা নজিরবিহীন। যেকোনো কিছুতেই প্রতিযোগিতার পরিবেশ না রেখে কাউকে কাউকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে একটা অসম প্রতিযোগিতার বাজার তৈরি করা হয়েছে। সেখানে কিছু ব্যবসায়ী লাভ করছে। আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যাবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। গণতন্ত্রকে দখল করে নিয়েছে ব্যাবসাতন্ত্র। অর্থাৎ, কিছু ব্যবসায়ী যেমন: বসুন্ধরা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, সামিট গ্রুপ –তাদের আধিপত্য আমরা দেখছি। ঋণ নিয়ে, জমি দখল করে, উৎপাদনক্ষম খাতে খরচ করছে না। অন্যদিকে অর্থ পাচারকারীরা অর্থ পাচার করে যাচ্ছে এবং তাদের কোনো বিচার হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে গেলে এবং সরকার তাদের হাতে জিম্মি হয়ে গেলে, তাদের একচেটিয়া সুবিধা দিতে গিয়ে সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়।

গণতন্ত্রকে দখল করে নিয়েছে ব্যাবসাতন্ত্র। অর্থাৎ, কিছু ব্যবসায়ী যেমন: বসুন্ধরা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, সামিট গ্রুপ –তাদের আধিপত্য আমরা দেখছি। ঋণ নিয়ে, জমি দখল করে, উৎপাদনক্ষম খাতে খরচ করছে না। অন্যদিকে অর্থ পাচারকারীরা অর্থ পাচার করে যাচ্ছে এবং তাদের কোনো বিচার হচ্ছে না।

৬। উপসংহার

এই প্রবন্ধে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণ এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার কেন ব্যর্থ হচ্ছে, সেই দিকগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে। অর্থনৈতিক সংকটের এত দিক রয়েছে যে এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে সবকিছু একসঙ্গে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়নি। যেমন, এখানে সামাজিক নিরাপত্তা ও রেশনের ভূমিকা, খেলাপি ঋণের ভূমিকা, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ঋণ এবং বিদেশি ঋণ নির্ভরতার ভূমিকা এবং কৃষিখাতের দিকগুলো বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ হয়নি। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এই অচলাবস্থা এক দিনে তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে বাজারব্যবস্থার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, অসম প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করা, রেগুলেশন না থাকা, শিল্প ও খাদ্যে আমদানি নির্ভরতা, জ্বালানি খাতকে ইচ্ছাকৃতভাবে আমদানি নির্ভর করে ফেলা–সবকিছু এই অচলাবস্থার জন্য দায়ী। কেউ যদি বলে আমরা জানতাম না এমন হবে, তাহলে তাদের অজ্ঞতাকে ক্ষমা করা যাবে না। সংকট হলে কী করতে হয় বা কী প্রস্তুতি লাগে তা সবারই জানা। জানার পরও যা হচ্ছে তা সম্পূর্ণরূপে বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার কারণেই আজকের সংকট তৈরি হয়েছে।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সাধারণ মানুষ যেন এই সংকটে কিছুটা হলেও ন্যূনতম মানবিক জীবনযাপন করতে পারে সে জন্য অতিদ্রুত ১) জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ধার্য করতে হবে, ২) বাজারে অসম প্রতিযোগিতার হাতে ছেড়ে না দিয়ে প্রতিটি খাদ্যপণ্যের বাজার বুঝে দাম নিয়ন্ত্রণ করার মেকানিজম বের করতে হবে, ৩) পর্যাপ্ত রেশন দিতে হবে। রেশনে প্রয়োজনীয় ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধ যুক্ত করতে হবে।

অতিদ্রুত ১) জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ধার্য করতে হবে, ২) বাজারে অসম প্রতিযোগিতার হাতে ছেড়ে না দিয়ে প্রতিটি খাদ্যপণ্যের বাজার বুঝে দাম নিয়ন্ত্রণ করার মেকানিজম বের করতে হবে, ৩) পর্যাপ্ত রেশন দিতে হবে। রেশনে প্রয়োজনীয় ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধ যুক্ত করতে হবে।

বৈশ্বিক সংকটে মানুষ যেন সুরক্ষা পায় সে জন্য দীর্ঘ মেয়াদে ১) আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে, ২) শিল্পে মূল্য সংযোজন হয় ও দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করা যায় এমন কৃষিজাত ও শিল্পপণ্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রয়োজনে ভর্তুকি দিতে হবে, ৩) প্রযুক্তি সক্ষমতা বাড়াতে হবে, ৪) দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

মোশাহিদা সুলতানা: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ই-মেইল: moshahida@du.ac.bd

তথ্যসূত্র

তাহের, আবু (২০২৩)”৮১২ কোটি টাকা বিনিয়োগে ১ লাখ কোটি টাকার এলএনজি সাশ্রয় করেছে বাপেক্স”  বণিক বার্তা, ৫ জানুয়ারি ২০২৩

Sherman, Natalie, (2023) “US raises interest rates despite banking turmoil” BBC March 23, 2023 https://www.bbc.com/news/business-65041649

নিজস্ব প্রতিবেদক (২০২৩) “চাপে সীমিত আয়ের মানুষ, মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯.৩৩%” প্রথম আলো এপিল ৫, ২০২৩  https://www.prothomalo.com/business/a5t48445ff

নিজস্ব প্রতিবেদক (২০২৩) “মূল্যস্ফীতির চাপে ধার করে চলছে ৭৪ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবার” প্রথম আলো মার্চ ২৯ ২০২৩

Bangladesh Bank (2023) Bangladesh Bank Economic Data https://www.bb.org.bd/en/index.php

ফয়জুল্লাহ ও আহমেদ, রাজীব (২০২৩) “এবার রোজায় দাম বেশি” প্রথম আলো মার্চ ২৩, ২০২৩  https://www.prothomalo.com/bangladesh/gmmsakaeja

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •