তিন জোটের রূপরেখা

নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শেষ পর্বে গৃহীত

তিন জোটের রূপরেখা

১৯৮২ সালের মার্চ মাসে জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বে দেশে সামরিক শাসন জারী হয়। ৮০ দশক জুড়ে এই স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে ১৯৯০ সালের ২১শে নভেম্বরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দল (আগের ১৫ দল), বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দল ও বামপন্থী ৫ দল এক ‘তিনজোটের রূপরেখা’র মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণের কাঠামো উপস্থিত করে। সেই রূপরেখায় ‘নির্বাচনে ভোট চুরি, ভোট জালিয়াতি, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালটবাক্স ছিনতাই, এমনকি নির্লজ্জ ভোট ডাকাতি, মিডিয়াক্যু এবং অবশেষে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশে’র যে বাস্তবতার কথা বলা হয়েছিলো তার অবসানের বদলে স্বৈরাচারের পতনের তিন দশক পরে তা আরো গভীর ও বিস্তৃত হয়েছে। এইরকম একটা পরিণতির কারণ কী? তিন জোটের রূপরেখার সাথে যুক্ত দলগুলো, বিশেষত যারা এরপর ক্ষমতায় এসেছে, তাদের ভূমিকা কী? এসব বিষয়ে মনোযোগ ও অনুসন্ধান জরুরী।  সেই তাগিদ থেকে বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাওয়া তিনজোটের রূপরেখা সর্বজনকথায় পুন: প্রকাশ করা হলো।

স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের দুঃশাসনের কবল হতে মুক্তিকামী জনগণ এরশাদ সরকারের অপসারণের দাবিতে এবং দেশে একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ধারা ও জীবনপদ্ধতি কায়েম এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ পুন: প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চলমান গণআন্দোলনে সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষ এক বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে। এই সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে জেল-জুলুম-নির্যাতন, এমন কি মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে মানুষ অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে একটি প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।

দেশবাসী বুকের রক্ত দিয়ে যে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, তার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হলো হত্যা, ক্যু প্রভৃতি অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা বদলের অবসান ঘটিয়ে সাংবিধানিক পন্থায় অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাত বদল ও হস্তান্তর নিশ্চিত করা। এজন্য আমাদের সংগ্রামের দাবির কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হলো একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সার্বভৌম সংসদ প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু অসাংবিধানিক ধারায় অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী এরশাদ সরকার প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ছলে-বলে-কৌশলে তার ক্ষমতাকে স্থায়ীভাবে কুক্ষিগত রাখার নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত অতীতের প্রতিটি নির্বাচনে ভোট চুরি, ভোট জালিয়াতি, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, এমন কি নির্লজ্জ ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যু এবং অবশেষে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশের অব্যাহত প্রক্রিয়া চালিয়ে আসছে। এমতাবস্থায় এই সরকারের অধীনে কোনো অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। এরশাদ ও অবৈধ সরকারের অধীনে কোনো জাতীয় নির্বাচনে আমরা ১৫, ৭ ও ৫-দলীয় ঐক্যজোট অংশ গ্রহণ করব না, তা রাষ্ট্রপতি বা সংসদ যে কোনো নির্বাচনই হোক না কেন। এসব নির্বাচন শুধু বর্জনই নয়, প্রতিহতও করব। একমাত্র একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আমরা ১৫, ৭ ও ৫-দলীয় ঐক্যজোট কেবলমাত্র সার্বভৌম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অংশ গ্রহণ করব।

এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে আমরা চলমান আন্দোলনের মূলদাবি ও লক্ষ্যসমূহ সম্পর্কে এক্যবদ্ধভাবে নিম্নরূপ সুস্পষ্ট ঘোষণা প্রদান করছি!

১. হত্যা,ক্যু, চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের ধারায় প্রতিষ্ঠিত স্বৈরাচারী এরশাদ ও তার সরকারের শাসনেরকবল থেকে দেশকে মুক্ত করে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র ওগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকল্পে :

ক. সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রেখে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী তথা সংবিধানের ৫১ অনুচ্ছেদের (ক) ৩ ধারা এবং ৫৫ অনুচ্ছেদের (ক) ১ ধারা এবং ৫১ অনুচ্ছেদের ৩ নং ধারা অনুসারে এরশাদ ও তার সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী আন্দোলনরত তিন জোটের নিকট গ্রহণযোগ্য একজন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে উপরাষ্ট্রপতির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।

খ. এই পদ্ধতিতে উক্ত ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি অন্তর্বতীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, যার মূল দায়িত্ব হবে তিন মাসের মধ্যে একটি সার্বভৌম জাতীয় সংসদের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা।

২. ক. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ হবেন অর্থাৎ তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের অনুসারী বা দলের সাথে সম্পৃক্ত হবেন না অর্থাৎ তিনি রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি বা সংসদ সদস্য পদের জন্য নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবেন না। তার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো মন্ত্রী নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে না।

খ. অন্তর্বতীকালীন এই সরকার শুধুমাত্র প্রশাসনের দৈনন্দিন নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনাসহ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম ও দায়িত্ব পুনর্বিন্যাস করবেন।

গ. ভোটারগণ যাতে করে নিজ ইচ্ছা ও বিবেক অনুযায়ী প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, সেই আস্থা পুন:স্থাপন এবং তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।

ঘ. গণপ্রচার মাধ্যমকে পরিপূর্ণভাবে নিরপেক্ষ রাখার উদ্দেশ্যে রেডিও-টেলিভিশনসহ সকল রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমকে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় পরিণত করতে হবে এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সকল রাজনৈতিক দলের প্রচার-প্রচারণার অবাধ সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

৩. অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধামে নির্বাচিত সার্বভৌম সংসদের নিকট অন্তর্বতীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন এবং এই সংসদের জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে।

৪. ক. জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির ভিত্তিতে দেশে সাংবিধানিক শাসনের ধারা নিরঙ্কুশ ও অব্যাহত রাখা হবে এবং অসাংবিধানিক যে কোনো পন্থায় ক্ষমতা দখলের প্রতিরোধ করা হবে। নির্বাচন ব্যতীত অসাংবিধানিক বা সংবিধানবহির্ভূত কোনো পন্থায়, কোনো অজুহাতে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না।

খ. জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষ এবং আইনেরশাসন নিশ্চিত করা হবে।

গ. মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী সকল আইন বাতিল করা হবে।

[আব্দুল হক লিখিত ও নূরুল হক সম্পাদিত লেখকের রোজনামচায় চারদশকের রাজনীতি-পরিক্রমা। প্রেক্ষাপট : বাংলাদেশ ১৯৫৩-৯৩ (ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৯৬) শীর্ষক গ্রন্থ থেকে গৃহীত।]

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •