বাংলাদেশে নির্বাচনি কর্তৃত্ববাদ ও গণতন্ত্রের অসমাপ্ত লড়াই

বাংলাদেশে নির্বাচনি কর্তৃত্ববাদ ও গণতন্ত্রের অসমাপ্ত লড়াই

কল্লোল মোস্তফা

বাংলাদেশে আরেকটি সংসদীয় নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু সুষ্ঠু ভোটের নিশ্চয়তা, ন্যূনতম গণতান্ত্রিক পরিবেশই যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ সেখানে নির্বাচন আসা না আসায় কী পার্থক্য হয়? এই পরিস্থিতি আকস্মিক নয়, বরং কয়েক দশকে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে নির্দিষ্ট শ্রেণী ক্ষমতার আধিপত্যবৃদ্ধি এবং ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর স্বেচ্ছাচারিতার পরিণতি। একইসঙ্গে সর্বজনের অধিকারের লড়াইএর দুর্বলতার প্রতিফলন। গত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা কেন্দ্রে রেখে দেশে উদ্ভূত ব্যবস্থার স্বরূপ বিশ্লেষণ করা হয়েছে এই লেখায়।

বাংলাদেশে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে তিন দশকের বেশি সময় ধরে। একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন থাকে, আনুষ্ঠানিকভাবে তার সবই আছে দেশে–জাতীয় সংসদ, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনি আইনকানুন, ভোটার তালিকা, নির্দিষ্ট সময় পরপর নিয়মিত নির্বাচনে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতাও রক্ষিত হয়; কিন্তু নেই সুষ্ঠু ভোটের নিশ্চয়তা, নেই ন্যূনতম গণতান্ত্রিক জবাবদিহি। গণতন্ত্রের নানা আনুষ্ঠানিক আয়োজন থাকা সত্ত্বেও কার্যক্ষেত্রে তাতে গণতান্ত্রিক সারবত্তা না থাকায় এই শাসনব্যবস্থাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ‘নির্বাচনি কর্তৃত্ববাদ’ নামে অভিহিত করেন। এ কারণে সুইডেনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা দি ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিসট্যান্স (আইডিইএ) কর্তৃক বিশ্বে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে কর্তৃত্ববাদী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম দেখা যায়।

নির্বাচনি কর্তৃত্ববাদ সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আন্দ্রেয়াস শেডলার লিখেছেন, নির্বাচনি কর্তৃত্ববাদ বা ইলেকটোরাল অথরিটারিয়ানিজমে জনপ্রতিনিধি ও সরকারপ্রধান নির্বাচন করার জন্য নিয়মিতই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও ন্যায্যতার উদার-গণতান্ত্রিক নীতিমালাকে এমন ব্যাপক ও পদ্ধতিগতভাবে লঙ্ঘন করা হয় যে নির্বাচন বিষয়টি ‘গণতন্ত্রের হাতিয়ার’-এর বদলে কর্তৃত্ববাদের হাতিয়ারে পরিণত হয়। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় নির্বাচনে সবর্জনীন ভোটাধিকারের স্বীকৃতি এবং বিরোধী দলগুলোকে অংশ নিতে দেওয়া হলেও সব মিলিয়ে নির্বাচনি প্রতিযোগিতায় এত মারাত্মক, ব্যাপক ও পদ্ধতিগতভাবে রাষ্ট্রীয় প্রভাব বিস্তার করা হয় যে তখন আর তাকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলা চলে না। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় যেসব উপায় অবলম্বন করে নির্বাচনের ওপর প্রভাব বিস্তার করা হয় তার মধ্যে রয়েছে: বৈষম্যমূলক নির্বাচনি আইন, বিরোধী দল ও প্রার্থীদের নির্বাচনের মাঠ থেকে দূরে রাখা, তাদের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার বঞ্চিত করা, তাদের গণমাধ্যমে অংশগ্রহণ ও অর্থ সংগ্রহে নিয়ন্ত্রণ আরোপ, সমর্থকদের ভোটাধিকারে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক নানা উপায়ে বাধা প্রদান, ভয়ভীতি কিংবা প্রলোভনের মাধ্যমে পক্ষ ত্যাগ করানো কিংবা স্রেফ ভোট জালিয়াতি করা।

নির্বাচনি কর্তৃত্ববাদ সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আন্দ্রেয়াস শেডলার লিখেছেন, নির্বাচনি কর্তৃত্ববাদ বা ইলেকটোরাল অথরিটারিয়ানিজমে জনপ্রতিনিধি ও সরকারপ্রধান নির্বাচন করার জন্য নিয়মিতই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও ন্যায্যতার উদার-গণতান্ত্রিক নীতিমালাকে এমন ব্যাপক ও পদ্ধতিগতভাবে লঙ্ঘন করা হয় যে নির্বাচন বিষয়টি ‘গণতন্ত্রের হাতিয়ার’-এর বদলে কর্তৃত্ববাদের হাতিয়ারে পরিণত হয়।

গবেষকরা দেখিয়েছেন, নির্বাচনি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় নির্বাচনের দিন ছাড়াও নির্বাচনের ওপর প্রভাব বিস্তারের নানান পদ্ধতি রয়েছে, যেমন: ইনস্ট্রুমেন্টাল ম্যানিপুলেশন, ইনফরমেশনাল ম্যানিপুলেশন ইত্যাদি। ইনস্ট্রুমেন্টাল ম্যানিপুলেশন হলো সরাসরি নির্বাচনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে এমনসব কাজকারবার, যার মধ্যে রয়েছে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ ও প্রচারণায় বাধা দেওয়া, ভোটের আইনকানুন ও ভোটার রেজিস্ট্রেশনের ওপর প্রভাব বিস্তার, ভোটারদের প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে সরকারি অর্থ ব্যয় ইত্যাদি। অন্যদিকে ইনফরমেশনাল ম্যানিপুলেশন হলো নির্বাচনের আইনকানুন, ভোটার বা প্রতিপক্ষের ওপর প্রত্যক্ষ কোনো কার্যক্রম না চালিয়ে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করা যার মধ্যে রয়েছে: রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও স্থাপনা ব্যবহার করে সরকারি দলের নির্বাচনি প্রচারণা চালানো, সরকারি প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষমতাসীন দলের সভা-সমাবেশ ও প্রচারণায় ব্যবহার করা, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলোতে পক্ষপাতদুষ্ট প্রচারণা ও তথ্য প্রচার ইত্যাদি।

বাংলাদেশে নির্বাচনের বহু আগে থেকেই সারা বছর ধরে এ ধরনের ইনস্ট্রুমেন্টাল ও ইনফরমেশনাল ম্যানিপুলেশন জারি থাকে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে নির্বাচনের ফলাফলের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তারের যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছিল সেগুলো খতিয়ে দেখা যাক। 

নির্বাচন-পূর্ববর্তী পর্যায়ে কর্তৃত্ববাদী আধিপত্য

নির্বাচন সামনে রেখে ‘রাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার, গুজব, মিথ্যা’ প্রতিরোধের নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর প্রশাসনিক নজরদারি বাড়ানো হয়। এ জন্য নভেম্বর ২০১৮ থেকে এপ্রিল ২০১৯ পর্যন্ত ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যবেক্ষণ’ নামে ১২৫ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। এ প্রকল্পের আওতায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইনে কথিত ‘আপত্তিকর, ক্ষতিকর, বেআইনি’ পোস্ট ফিল্টার ও ব্লক করার কাজ করে পুলিশ ও র‌্যাব।

নির্বাচনের আগে অক্টোবর মাসে প্রণীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ নামের নিবর্তনমূলক আইনের মাধ্যমে গণমাধ্যমে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। ফলে সাংবাদিকদের অনেকেই জানিয়েছিলেন, এযাবৎকালের সবচেয়ে কঠোর গণমাধ্যম আইনের কারণে তারা একটি ভয়ের পরিবেশের মধ্যে আছেন। তাই তাদের অনেকেই ‘স্ব-আরোপিত’ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে কাজ করছেন। বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা, ডিজিটাল গণমাধ্যম ও টেলিভিশনের ৩২ জন সাংবাদিক ও সম্পাদকের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ কথা জানায়।

ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের বিজয়ী করতে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের নিয়মিত গোপন বৈঠক করার অভিযোগ ওঠে নির্বাচনের আগে। বিরোধী দল বিএনপি অভিযোগ জানায়, ২০ নভেম্বর রাতে ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের চারতলার পেছনের কনফারেন্স রুমে এক গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, নির্বাচন কমিশন সচিব, পানিসম্পদ সচিব, বেসামরিক বিমান পরিবহণ সচিব, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার ও মহানগরী রিটার্নিং অফিসার, প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-১। এ ছাড়া পুলিশের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন র‌্যাব, ডিএমপি ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা। রাত সাড়ে ৭টা থেকে আড়াই ঘণ্টা ধরে চলা এ বৈঠকে সারা দেশের ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং সেটআপ ও প্ল্যান রিভিউ’ করা হয় বলে অভিযোগে জানানো হয়।

নির্বাচন সামনে রেখে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পোলিং এজেন্টদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছে পুলিশ। বিশেষ করে তাদের বর্তমান ও অতীত রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে তথ্য চেয়েছে পুলিশ, নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ বা তাদের পরিবার বিরোধী দলের মতাদর্শের কি না, সেটা জানার জন্যই পুলিশ এ ধরনের তৎপরতা চালিয়েছে। যদিও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগের নীতিমালা অনুযায়ী, এ রকম কোনো যাচাই-বাছাইয়ের কাজ পুলিশের করার কথা নয়, জেলা প্রশাসনের তৈরি তালিকা থেকে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বাছাই করার কাজটি করেন সংশ্লিষ্ট জেলার রিটার্নিং কর্মকর্তা।

নির্বাচনি কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের এই অভিযোগ পুলিশের পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হলেও খুলনায় ৭৪ জন সম্ভাব্য নির্বাচনি কর্মকর্তার নামসহ তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের একটি তালিকা ‘ভুলবশত’ স্থানীয় সাংবাদিকের কাছে ই-মেইল করার ঘটনা থেকে অভিযোগটির সপক্ষে প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৮ সেপ্টেম্বর নিয়মিত প্রেস বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে খুলনার হরিণটানা থানা পুলিশের কাছ থেকে সাংবাদিকদের কাছে ওই ই-মেইলটি আসে। এতে দেখা যায়, ৭৪ জন শিক্ষকের মধ্যে ১১ জনকে বিএনপি ও জামায়াত সংশ্লিষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া একজনকে নিরপেক্ষ এবং বাকি সবাইকে আওয়ামী লীগের মতাদর্শী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

নানা অজুহাতে ছোট-বড় নানা কারণ দেখিয়ে বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাতিলের ঘটনা ঘটেছে। সারা দেশে যে ৭৮৬ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছিল তাদের বড় অংশই বিএনপির। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী (বিদ্রোহী) হিসেবে যারা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন, তাদের অনেকের মনোনয়নপত্র বাতিল হলেও আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, খেলাপি ঋণ ও আদালতে সাজার বাইরে প্রার্থীর সই না থাকা, দলীয় প্রত্যয়নপত্র ছাড়া দলের নাম ব্যবহার করা, হলফনামায় তথ্য গোপন করা, সরকারি সেবার বিলখেলাপি হওয়া এমনকি বিএনপির মহাসচিবের সই না মেলার মতো কারণ দেখিয়েও মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়।

নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে বিরোধী দল বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ‘গায়েবি ও মিথ্যা’ মামলা করার হার বৃদ্ধি পায়। নির্বাচন কমিশন বরাবর দেওয়া এক তালিকায় বিএনপি অভিযোগ করে, ২০১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৪ হাজার গায়েবি মামলায় ৪ লাখ ৩৫ হাজার জনকে আসামি করা হয় এবং গ্রেফতার করা হয় ১০ হাজার জনকে। নির্বাচনের সময় এর মাত্রা বৃদ্ধি পেলেও বছরজুড়েই বিরোধী নেতা-কর্মীদের চাপের মধ্যে রাখার জন্য মামলা-গ্রেফতার-গুম ইত্যাদি তৎপরতা চলেছে। বিএনপির দেওয়া হিসাব অনুসারে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৯০ হাজার ৩৪০টি। মামলায় আসামি করা হয়েছে ২৫ লাখ ৭০ হাজার ৫৪৭ জনকে, জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে ৭৫ হাজার ৯২৫ নেতা-কর্মীকে এবং গুম করা হয়েছে ১ হাজার ২০৪ জনকে।১০

২০১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৪ হাজার গায়েবি মামলায় ৪ লাখ ৩৫ হাজার জনকে আসামি করা হয় এবং গ্রেফতার করা হয় ১০ হাজার জনকে। নির্বাচনের সময় এর মাত্রা বৃদ্ধি পেলেও বছরজুড়েই বিরোধী নেতা-কর্মীদের চাপের মধ্যে রাখার জন্য মামলা-গ্রেফতার-গুম ইত্যাদি তৎপরতা চলেছে।

বিরোধী দলগুলোর নির্বাচনি জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে নির্বাচন কমিশন বরাবর অভিযোগে জানানো হয়, ১১ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপিসহ ২০-দলীয় জোট এবং ঐক্যফ্রন্টের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১৫৮টি মামলা করা হয়। এসব মামলার এজাহারে ২৩ হাজার ৫৩০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ২৪ হাজার ১৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। এর মধ্যে ঐক্যফ্রন্টের ৬ হাজার ২৯১ জন গ্রেফতার হয়। তাদের ১৩ জন নির্যাতনের শিকার হন এবং ৩ জন মারা যান।১১

নির্বাচনি প্রচারণার সময় বিরোধী দলের নেতকর্মীরা যেন নিজ এলাকায় থেকে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিতে না পারেন, সে উদ্দেশ্যে নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকেই কল্পিত অপরাধের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দেওয়া হতে থাকে।

উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে রাজধানী ঢাকায় উল্লেখযোগ্য কোনো রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা না ঘটলেও ঢাকা মহানগরের ৫০টি থানা এলাকায় বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বেআইনি জমায়েত, পুলিশের ওপর হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ এবং নাশকতার চেষ্টা চালানোর অভিযোগে শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই ৫৭৮টি মামলা করা হয়। এসব মামলায় বিএনপির কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে আসামি করে তাদের ধরতে ‘বিশেষ অভিযান’ শুরু করে ঢাকা মহানগর পুলিশ। ফলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা শুরু হলেও বিএনপির নেতা-কর্মীরা পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য হন। সেপ্টেম্বর ছাড়াও ২০১৮ সালের অক্টোবর, নভেম্বরেও নাশকতার মামলা হয়েছে। অক্টোবরে ৭৬টি ও নভেম্বরে ৪৩টি নাশকতা মামলার তথ্য পাওয়া যায়। সেপ্টেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত এসব মামলায় বিএনপি-জামায়াত ও এর অঙ্গসংগঠনের ১ হাজার ৫০৯ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।১২

নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের গণসংযোগ ও নির্বাচনি কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরুর পর ১১-২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ দিনে ১১৭টি আসনে কমপক্ষে ১৭৫টি হামলা, সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে।১৩

ফলে বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও সমর্থকরা উৎসবমুখর পরিবেশে প্রচার-প্রচারণা চালালেও উল্টো চিত্র দেখা গেছে বিরোধী শিবিরে। কোনো কোনো প্রার্থী কারাগারে, নেতারা এলাকাছাড়া, কর্মী-সমর্থকরা ছিলেন আতঙ্কে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই নির্বাচনি এলাকায় বিরোধী দলের প্রার্থীদের প্রকাশ্যে তেমন প্রচারণা কার্যক্রম ছিল না। বিরোধী নেতা-কর্মীরা প্রশাসন ও ক্ষমতাসীনদের চাপে প্রচার চালানোর উপায় নেই বলে অভিযোগ করেছেন।১৪

নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। বলা হয়, তারা শুধু ভোটকেন্দ্রে কোনো অনিয়ম হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করবেন। কোনো মিডিয়ার সঙ্গে নির্বাচনবিরোধী বিরূপ মন্তব্য বা কথা বলতে পারবেন না।১৫ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ভিসা না পাওয়ায় ব্যাংককভিত্তিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা এনফ্রেলকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশন বাতিল করতে হয়।১৬

নির্বাচনের এক দিন আগে ‘নিয়ন্ত্রণমূলক নির্বাচনি পরিবেশ’ নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানায় নির্বাচন ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা ১৫টি আন্তর্জাতিক সংগঠন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে বিবৃতিতে বলা হয়, ১০ ডিসেম্বর নির্বাচনি প্রচার শুরু হওয়ার পর বিরোধীদের গাড়িবহরে ৩০ বার হামলা হয়েছে। ১৫৯টি আসনে ২০৭টি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৪৩ প্রার্থী হামলার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ১৩ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। এযাবৎ বিরোধী দলের ১৭ প্রার্থী আটক হয়েছেন। নির্বাচনি সহিংসতায় পাঁচজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২ হাজার ৬৮২ জন। এসব সহিংসতা বাংলাদেশের ভোটারদের মনে ভীতি সঞ্চারের একটি প্রক্রিয়া। এ কারণে নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।১৭

নির্বাচনকালীন অনিয়ম

৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে নির্বাচনের দিন বিবিসি বাংলা প্রচারিত একটি ভিডিও থেকে দেখা যায়, চট্টগ্রাম-১০ আসনের শহীদ নগর সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের আগে সকাল ৭টা ৫০ মিনিটেই ব্যালট বাক্স ভরা!১৮

নির্বাচন শুরু হওয়ার আগেই ব্যালট বাক্স ভর্তি থাকার ঘটনাটি কি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নাকি সারা দেশেই ঘটেছে–এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘একাদশ সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা’ শীর্ষক গবেষণা থেকে।১৯

গবেষণার জন্য নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্য থেকে দ্বৈবচয়নের (লটারি) ভিত্তিতে ৫০টি বেছে নেয় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। নির্বাচনের দিন ৪৭ আসনে কোনো-না-কোনো নির্বাচনি অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছে টিআইবি। অনিয়মের ধরনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ৩৩টি আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল; ৪১টি আসনে জাল ভোট; ৪২টি আসনে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকা; ২১টি আসনে আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা; ৩০টি আসনে বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মেরে জাল ভোট; ২৬টি আসনে ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা; ২০টিতে ভোট শুরু হওয়ার আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা; ২২টিতে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া; ২৯টিতে প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেওয়া ইত্যাদি।

অনিয়মের ধরনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ৩৩টি আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল; ৪১টি আসনে জাল ভোট; ৪২টি আসনে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকা; ২১টি আসনে আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা; ৩০টি আসনে বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মেরে জাল ভোট; ২৬টি আসনে ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা; ২০টিতে ভোট শুরু হওয়ার আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা; ২২টিতে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া; ২৯টিতে প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেওয়া ইত্যাদি।

নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করার ঘটনা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ স্বীকার না করলেও তার শরিকরা বিভিন্ন সময় স্বীকার করেছে। ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর বরিশাল নগরের অশ্বিনীকুমার টাউন হলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির বরিশাল জেলা শাখার সম্মেলনে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায়নি। এর বড় সাক্ষী আমি নিজেই। আজ মানুষ তাদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত।’২০ পরবর্তী সময়ে চাপের মুখে তিনি নির্বাচন নিয়ে তার নিজের বক্তব্যকে ‘অতিশয়োক্তি’ বলে দুঃখ প্রকাশ করেন।২১

মহাজোটের আরেক শরিক বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ–আম্বিয়া) ফেব্রুয়ারি ২০১৯-এ তাদের জাতীয় কমিটির সভায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে ভোটের আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভর্তিসহ নানা অনিয়ম সংঘটিত হওয়ার কথা স্বীকার করে নেয়। জাসদের মূল্যায়নে প্রশাসনের একটি অংশকে দায়ী করে বলা হয়, প্রশাসনের একশ্রেণির অতি উৎসাহী অংশ ভোটের আগের রাতেই ভুয়া ভোটের মাধ্যমে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখাসহ নানা অনিয়ম সংঘটিত করেছে।২২

গণতন্ত্রের অসমাপ্ত লড়াই

প্রায় ৩২ বছর আগে ১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর প্রকাশিত ‘তিন জোটের রূপরেখা’য় বলা হয়েছিল: ‘এই সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত অতীতের প্রতিটি নির্বাচনে ভোট চুরি, ভোট জালিয়াতি, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, এমনকি নির্লজ্জ ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যু এবং অবশেষে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ঘোষণার নির্বাচনি ফলাফল প্রকাশের অব্যাহত প্রক্রিয়া চলে আসছে। এ অবস্থায় এই সরকারের অধীন কোনো অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।’ মনে হতে পারে, এটা বর্তমান সময়ের কোনো প্রচারপত্রের বক্তব্য।

১৯৯০ সালে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন আট দল, বিএনপি নেতৃত্বাধীন সাত দল এবং বামপন্থিদের নেতৃত্বাধীন পাঁচ দলের পক্ষ থেকে আন্দোলনের মূল দাবি ও লক্ষ্যসমূহ সম্পর্কে ঐক্যবদ্ধভাবে এই রূপরেখা প্রকাশ করা হয়েছিল। মূল্যায়ন করা জরুরি, তিন জোটের রূপরেখায় উল্লিখিত দাবি ও আকাঙ্ক্ষাগুলোর এ রকম একটা পরিণতি কী কারণে হতে পারে যে নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের তিন দশক পরও এসে ‘সরকারের দুঃশাসনের কবল থেকে মুক্তিকামী জনগণের’ উপলব্ধি ‘এই সরকারের অধীন কোনো অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।’

তিন জোটের রূপরেখার মূল দাবি ও লক্ষ্য হিসেবে ছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, রেডিও-টেলিভিশনসহ সব রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমকে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় পরিণত করা, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সব রাজনৈতিক দলের প্রচার-প্রচারণার অবাধ সুযোগ নিশ্চিত করা, জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা এবং মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি সব আইন বাতিল করা। তিন জোটের রূপরেখার তিন দশকেরও বেশি সময় পার করে এসে বলতে হচ্ছে, এসব দাবি ও লক্ষ্যের কোনোটাই বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু কেন? এটা কি রূপরেখার দাবি ও প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় আসা যেসব রাজনৈতিক শক্তির ওপর পড়েছিল তাদের ব্যর্থতা, বিশ্বাসঘাতকতা না আদর্শগত সমস্যা? নাকি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য যে ধরনের পরিবর্তনের প্রয়োজন, তিন জোটের রূপরেখার মধ্যে তা পুরোপুরি ধারণ করতে না পারা? নাকি উভয়ই?

তিন জোটের রূপরেখার মূল দাবি ও লক্ষ্য হিসেবে ছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, রেডিও-টেলিভিশনসহ সব রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমকে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় পরিণত করা, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সব রাজনৈতিক দলের প্রচার-প্রচারণার অবাধ সুযোগ নিশ্চিত করা, জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা এবং মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি সব আইন বাতিল করা। তিন জোটের রূপরেখার তিন দশকেরও বেশি সময় পার করে এসে বলতে হচ্ছে, এসব দাবি ও লক্ষ্যের কোনোটাই বাস্তবায়িত হয়নি।

প্রথমত, গত তিন দশকে যে রাজনৈতিক শক্তিগুলো বাংলাদেশকে শাসন করেছে, তারা যে গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে, তাদের বস্তুগত স্বার্থের সঙ্গে এসব গণতান্ত্রিক দাবি-দাওয়া ও আকাঙ্ক্ষার মৌলিক বিরোধ রয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে পরিবারতান্ত্রিক ও গোষ্ঠীতান্ত্রিক লুটেরা পুঁজিপতিদের সম্পর্ক পারস্পরিক মিথোজীবিতার, একটি আরেকটিকে পৃষ্ঠপোষকতা করে, একের আদলে ও প্রয়োজনে অপরের গঠন ও বিকাশ হয়েছে। এই লুটেরা পুঁজিপতিদের জন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, স্বাধীন গণমাধ্যম, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, জবাবদিহি, স্বাধীন নির্বাচনব্যবস্থা ইত্যাদি খুবই বিপজ্জনক। এ কারণেই আন্দোলনের চাপে পড়ে বিভিন্ন সময় তারা অবাধ নির্বাচন, আইনের শাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে নানান প্রতিশ্রুতি দিলেও ক্ষমতায় গিয়ে এগুলো বাস্তবায়নের জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলেনি, যার প্রতিক্রিয়ায় তাদের অনিয়ম, দুর্নীতি, লুন্ঠনের সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, আমরা যদি নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করি, দেখব আশির দশক ধরে বহু আন্দোলন হয়েছে, যে আন্দোলনের মধ্যে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি যেমন ছিল, তেমনি ছিল ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-দরিদ্র-মধ্যবিত্তদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের নানান দাবি। কিন্তু আন্দোলনের একটা পর্যায়ে এসে সবকিছু যখন ‘এক দফা এক দাবি’তে পরিণত হলো, যখন তিন জোটের রূপরেখা প্রণীত হলো, তখন অনেক দাবি ও লক্ষ্যই ফোকাস থেকে হারিয়ে গেল। তা ছাড়া রূপরেখায় স্বৈরশাসন থেকে গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক শাসনের ধারাবাহিকতায় ফেরার আকাঙ্ক্ষা স্বীকৃতি পেল, কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের বিষয়টি গুরুত্ব পেল না। সংবিধানের যে ৭০ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের দলীয় আনুগত্য পোষণ করতে বাধ্য করা হয়, সেই অনুচ্ছেদসহ প্রধানমন্ত্রীশাসিত সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হওয়ার হাত থেকে সংসদকে রক্ষা করার মতো অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার গুরুত্ব পেল না। এভাবে লুটেরা পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি দুর্বল হতে পারত যেসব রক্ষাকবচের মাধ্যমে, সেগুলোও জনগণের হাতে এলো না।

ফলস্বরূপ একটা সামরিক স্বৈরশাসকের পতন হলো ঠিকই, কিন্তু রূপরেখায় উল্লিখিত ‘স্থায়ী গণতান্ত্রিক ধারা ও জীবনপদ্ধতি কায়েম’ হলো না; বরং কালক্রমে নির্বাচনি কর্তৃত্ববাদের জন্ম দিল, যার নিদর্শন আমরা ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে-পরের ঘটনাপ্রবাহ থেকে উপলব্ধি করছি। আসলে শুধু ভোটের দিনের গণতন্ত্র বা এক দিনের নিরপেক্ষ নির্বাচনকে ফোকাস করে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেওয়া মুশকিল। নির্বাচন ও গণতন্ত্র তো কেবল এক দিনের ব্যাপার নয়। শুধু নির্বাচনের দিন ভোট জালিয়াতি হলো কি হলো না, শুধু এ বিবেচনা দিয়ে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো কি হলো না, তা নির্ধারণ করা যায় না। কোনো দেশে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে শুধু নির্বাচনের দিন সুষ্ঠু ভোট হলেই হবে না, নির্বাচনের আগের বছরগুলোতেও গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ-অর্থ-অবকাঠামো-আইন-প্রশাসনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। আর এসব বিষয় নিশ্চিত করতে হলে দেশের সংবিধান ও আইনকানুনের সংস্কার, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও অর্থ ব্যবহারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা ইত্যাদিকে আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা করে তুলতে হবে। এটা ঠিক যে, ভোটের দিনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না হলে সারা বছরের গণতন্ত্রের লড়াই করাও মুশকিল হয়ে যায়। ভোটের দিন যদি ইচ্ছেমতো ভোট লুটে নেওয়া যায়, তাহলে সারা বছরের গণতন্ত্র কায়েমের জন্য শাসকগোষ্ঠীর ওপর চাপ তৈরি করা বিরোধী দলগুলোর জন্য কঠিন হয়ে যায়। কাজেই লড়াইটা দুই ফ্রন্টেই চালাতে হবে–ভোটের দিনের গণতন্ত্রের জন্য যেমন লড়তে হবে, তেমনি সারা বছরের গণতন্ত্রের এজেন্ডাকেও সেই লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে স্থির করতে হবে।

কোনো দেশে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে শুধু নির্বাচনের দিন সুষ্ঠু ভোট হলেই হবে না, নির্বাচনের আগের বছরগুলোতেও গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ-অর্থ-অবকাঠামো-আইন-প্রশাসনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে।

দুনিয়ার গণতান্ত্রিক দেশগুলো তো বটেই, অনেক কর্তৃত্ববাদী দেশও বহু আগেই নির্বাচনের দিনের ভোট জালিয়াতির বিতর্ক থেকে বেরিয়ে এসেছে। এসব দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা অন্তত এটুকু পরিপক্বতা অর্জন করতে পেরেছে যে, কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার মধ্যেও ভোটের দিন ব্যাপক হারে সরাসরি ভোট জালিয়াতি করা সম্ভব হয় না। ফলে এসব দেশে রাজনৈতিক বিতর্কের জায়গাটা নির্বাচনের দিনের গণতন্ত্রকে ছাড়িয়ে সারা বছরের গণতন্ত্রের দিকে ধাবিত হতে পেরেছে। বাংলাদেশের জনগণের দিক থেকে আফসোসের ব্যাপার হলো, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় পার হয়ে এসেও ভোটের দিনের জালিয়াতি এখনো বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রধান সমস্যা, ফলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির লড়াই ভোটের দিনের গণতন্ত্রের প্রশ্ন অতিক্রম করে সারা বছরের গণতন্ত্র ও অধিকারের লড়াইয়ের দিকে মনোযোগ দিতে পারছে না।

বাংলাদেশের জনগণের দিক থেকে আফসোসের ব্যাপার হলো, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় পার হয়ে এসেও ভোটের দিনের জালিয়াতি এখনো বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রধান সমস্যা, ফলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির লড়াই ভোটের দিনের গণতন্ত্রের প্রশ্ন অতিক্রম করে সারা বছরের গণতন্ত্র ও অধিকারের লড়াইয়ের দিকে মনোযোগ দিতে পারছে না।

কল্লোল মোস্তফা: লেখক, প্রকৌশলী। ইমেইল: kallol_mustafa@yahoo.com 

তথ্যসূত্র

১। কর্তৃত্ববাদী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ, প্রথম আলো, ১ ডিসেম্বর ২০২২

২। Andreas Schedler, The Politics of Uncertainty: Sustaining and Subverting Electoral Authoritarianism, 2013, Oxford University Press

৩। Megan Hauser, Electoral Strategies under Authoritarianism: Evidence from the Former Soviet Union, 2019, Lexington Books

৪। নির্বাচন সামনে রেখে ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যবেক্ষণ’ প্রকল্পের অনুমোদন, বাংলা ট্রিবিউন, ৭ নভেম্বর ২০১৮

৫। স্ব-আরোপিত নিয়ন্ত্রণে সাংবাদিকেরা, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮, প্রথম আলো

৬। পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিএনপির ‘গুরুতর’ অভিযোগ, ২৪ নভেম্বর ২০১৮, প্রথম আলো

৭। পুলিশের ফোনে বিব্রত নির্বাচন কর্মকর্তারা, প্রথম আলো, ১ ডিসেম্বর ২০১৮

৮। পুলিশের পাঠানো ই-মেইলে নির্বাচনি কর্মকর্তাদের তথ্য, নভেম্বর ২৬, ২০১৮, ডেইলি স্টার অনলাইন বাংলা

৯। মনোনয়ন বাতিলের রেকর্ড, ৩ ডিসেম্বর ২০১৮, প্রথম আলো

১০। দশ বছরে ৯০ হাজার মামলা : আসামি ২৫ লাখ নেতা-কর্মী, ইত্তেফাক, ১৯ নভেম্বর ২০১৮

১১। আট দিনে গ্রেপ্তার ২২৪১ নেতা-কর্মী, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮, প্রথম আলো

১২। এক ভয়ংকর সেপ্টেম্বর!, ২০ ডিসেম্বর ২০১৮, দৈনিক প্রথম আলো

১৩। হামলা-ভাঙচুর ছাড়াল শতাধিক আসনে, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮, প্রথম আলো

১৪। উৎসবমুখর আওয়ামী লীগ, ভয়-আতঙ্কে বিএনপি, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮, প্রথম আলো

১৫। পর্যবেক্ষকরা মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না: ইসি সচিব, ২০ নভেম্বর ২০ ২০১৮, বণিক বার্তা

১৬। ভিসা জটিলতায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশন বাতিল এনফ্রেলের, ২২ ডিসেম্বর ২০১৮, প্রথম আলো

১৭। ‘নিয়ন্ত্রণমূলক নির্বাচনি পরিবেশ’ নিয়ে উদ্বেগ, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮, প্রথম আলো ডটকম

১৮। সংসদ নির্বাচন: চট্টগ্রামে ভোটের আগে ব্যালট বাক্স ভরা দেখতে পেলেন বিবিসির সাংবাদিক, বিবিসি বাংলা অনলাইন, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮

১৯। আগের রাতে ব্যালটে সিল, বুথ দখলসহ নানা অভিযোগ, প্রথম আলো, ১৬ জানুয়ারি ২০১৮

২০। মেননের বক্তব্যের ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছে ১৪ দল, ২৪ অক্টোবর ২০১৯, প্রথম আলো

২১। নির্বাচন নিয়ে নিজের বক্তব্যকে ‘অতিশয়োক্তি’ বলে মেননের দুঃখ প্রকাশ, ২৮ অক্টোবর ২০১৯, যমুনা টিভি অনলাইন

২২। নির্বাচনকে কলঙ্কিত করেছেন প্রশাসনের অত্যুৎসাহীরা, প্রথম আলো, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯; ভোটের আগের রাতেই ব্যালট বাক্সভর্তি, জাসদের কবুল, যুগান্তর, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •