থিয়েটারে হালের ‘সংকট’ বিতর্ক ও অনাস্থার সুলুক সন্ধান: সমাধান কোন পথে

থিয়েটারে হালের ‘সংকট’ বিতর্ক ও অনাস্থার সুলুক সন্ধান: সমাধান কোন পথে

সামিনা লুৎফা নিত্রা ও সৌম্য সরকার

স্বাধীনতার পর ঢাকায় থিয়েটার জগতে এক নতুন শক্তিশালী যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেই যাত্রায় থিয়েটার নতুন নতুন সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে, নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি সহিংসতা অবসানের বিষয়গুলো তুলে এনেছে। সেইসঙ্গে শিল্প মাধ্যম হিসেবে তার ভাষা, প্রকরণ, পরিবেশনাতেও নতুন নতুন সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর রেখেছে। কিন্তু তার সেই শক্তি যেন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ কী? এবিষয়ে নাট্যজগতের মানুষদের এই অনুসন্ধানী লেখা। এই লেখার প্রথম সংস্করণটি ২ সেপ্টেম্বর ২০২২ বাংলাদেশ মহিলা সমিতিতে অনুষ্ঠিত বটতলার আলাপ অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত হয়।

গত পাঁচ দশকে ‘স্বাধীনতার অন্যতম অর্জন’ নামে চিহ্নিত হয়েছে থিয়েটার–আমাদের নিজেদের মিলনায়তন হয়েছে, ব্রিটিশ আমলের ‘অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন’ বাতিল হয়েছে, জেলায় জেলায় শিল্পকলা একাডেমির ভবন হয়েছে, থিয়েটার-এর সঙ্গে সঙ্গে থিয়েটারওয়ালা নাট্যপত্রিকা হিসেবে বেশ চলছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নাট্যকলা বা পরিবেশনবিদ্যা নামে থিয়েটারের করণ-কৌশল পড়ানো হচ্ছে–এমফিল, পিএইচডি হচ্ছে বাংলাদেশের থিয়েটার নিয়ে। গত পঞ্চাশ বছরের পঞ্চাশটি নাটক নির্বাচিত হয়েছে দর্শকের ভোটে, যার বেশিরভাগই প্রাসঙ্গিক বিষয় ও তারুণ্যের সৃজনভাবনাকে উপস্থাপন করেছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই শুরু হওয়া ঢাকাই থিয়েটার প্রথমে বৈষম্যের বিরুদ্ধে, তারপর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে, নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি সহিংসতা অবসানের জন্য ডাক দিয়েছে। তবে হালের ডাকে ধক কমেছে বলে অনুভূত হচ্ছে। খুঁজে দেখা দরকার ধক কমার কারণ কী?

‘হাল’ কেন?

গত এক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে থিয়েটারচর্চায় নানা পরিবর্তনের ইশারা টের পাওয়া গেলেও সাম্প্রতিক (গত এক বছর) কিছু ঘটনা আমাদের বড় কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। সেসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্বাভাবিকভাবেই আবার নাট্যকর্মীদের নানামুখী তৎপরতা চলেছে, যা আমাদের বলে দিচ্ছে যে বাংলাদেশের থিয়েটারচর্চা একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদলের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছে। এ বদলকে পিঠ দিয়ে না বুক দিয়ে সামলাবো, সেটা নির্ধারণ করা এ আলাপের একটা লক্ষ্য।

গত দেড় বছরের ঘটনা যা নাট্যকর্মীদের নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছে, সে ঘটনাক্রম জানা জরুরি। যেমন, ২০২১-এর জুলাই মাসে হঠাৎ একটি খবরে প্রকাশিত হলো শিল্পকলার ভেতরে নানা অনিয়মের বয়ান, যাতে শিল্পকলা একাডেমি পরিচালনায় মহাপরিচালক-পরিষদের ঝামেলা দৃশ্যমান হলো। তবে মন্ত্রণালয় যে ঝামেলার তৃতীয় পক্ষ, সেটা সরাসরি দেখা না গেলেও একটু খেয়াল করে যারা পড়েন তাদের চোখে ধরা পড়ল।

একই বছর সেপ্টেম্বরে ২৬ কোটি টাকার অনিয়মের খবর পত্রিকা মারফত জানাজানি হলো আর নভেম্বর পর্যন্ত আরও নানান খবরের শিরোনাম হতে শিল্পকলায় ১২৮ কোটি টাকার ‘অনিয়ম’ বিষয়ে বাজারে ঢোল পড়ল! জানুয়ারি ২০২২-এ দুর্নীতি দমন কমিশনে তলব করা হলো শিল্পকলার মহাপরিচালককে, তিনি গেলেন। চারদিকে ঢিঢি পড়ে গেল!

এর পরের ঘটনা আরও সরেস। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের ২২ জানুয়ারির সভায় ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকসহ আরও একজন সম্পাদককে অর্থ আত্মসাতের কারণ দেখিয়ে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অব্যাহতি পাওয়া সাধারণ সম্পাদক প্রেস কনফারেন্স করেন, আইনি নোটিশ দেন। এরপর শুরু হয় ‘সংকট’-এর সংজ্ঞায়ন ও পালটা সংজ্ঞার ‘বাহাস’। ঘটনাক্রম আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ক্ষমতার ত্রিমুখী রশি টানাটানির দিকে।

‘সংকট’ বিতর্ক কী?

এতসব কাণ্ডের পর অগ্রজ নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার খোলা চিঠি লেখেন ফেসবুকে, সরব হন নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুও। কিছুতেই ফেডারেশন বা শিল্পকলার কোনো হেলদোল হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় না।

এরপর ২০২২-এর জুনে বের হয় থিয়েটারওয়ালা পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা, নাম: ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন এবং থিয়েটারচর্চার সামনের দিন’। শিরোনামে বোঝা যায় ‘সংকট’ চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়া একটা গড়ন নিচ্ছে, তবে তা গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনকে আলোচনার কেন্দ্রে রেখে। সে সংখ্যায় তরুণ-অগ্রজ মিলে ১৯ জন নাট্যকর্মীর রচনায় তাদের ফেডারেশন ও নাট্যচর্চার ভবিষ্যতের ভাবনা উঠে এসেছে। যদিও অনুপস্থিত ঢাকার বাইরের নাট্যদলের কর্মীরা, নারী (একজন) ও প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মানুষের স্বরও বড়ই ক্ষীণ। আলোচনার সূত্র হিসেবে সম্পাদক হাসান শাহরিয়ারের দারুণ ইতিহাসঋদ্ধ লেখা পড়ে বুঝতে পারি যে ফেডারেশন সমস্যা আকীর্ণ হলেও একে ঠিকঠাক করে এখনো কাজ চালানো সম্ভব–এই মত তাঁর। অন্য লেখকরা সবাই একমত না হলেও থিয়েটারওয়ালার এই ৩৪তম সংখ্যাটি বাংলাদেশের থিয়েটারচর্চার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন–এটা অস্বীকার করার জো নেই।

জুলাই মাসে ‘সাধারণ নাট্যকর্মীবৃন্দ’ নামের এক নতুন ব্যানার থেকে আয়োজিত হয় ‘থিয়েটারচর্চায় সাম্প্রতিক সংকট ও উত্তরণ’ শীর্ষক আলোচনা। অনেকে এ প্রচেষ্টাকে পাল্টা ফেডারেশন বানানোর চেষ্টা বলে দাগিয়ে দিলেও তাদের ধারণাপত্র ঘোষণা করে যে ‘সংকট কেবল ফেডারেশনের নয়, বাংলাদেশের সামগ্রিক থিয়েটারচর্চার পথ-প্রকৃতি নির্ণয়ের’। তবে তাদের উত্থাপিত আট সংকটের তালিকায় সাড়ে তিনটিই ফেডারেশন বিষয়ক।

মোটকথা হলো, কেউ বলছেন সংকট আছে, কেউ বলছেন সংকট নেই, কেউ বলছেন ফেডারেশনেরই দরকার নাই, কেউ বলছেন ফেডারেশন থাক, তবে একটু সারাই করে কাজ চালিয়ে নেওয়া যাক। সংকট কোথায় সে বিতর্ক সংকটের তর্কের চেয়ে কম না মোটেই।

 ‘অনাস্থা’ কোথায় পেলাম?

গত দেড় বছরে নখদন্ত নিয়ে একে অপরকে ঘায়েল করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া পক্ষপাতদুষ্ট নাট্যকর্মী এবারই এত প্রকাশ্যে তাদের মহড়া চালাচ্ছেন, যা আগে ‘ঢাকা-ঢুকা’ থাকত বেশিরভাগ সময়ে। আস্তিনের নিচে ছুরি লুকিয়ে আলিঙ্গন করা বন্ধুবেশীরা আজ প্রকাশ্যে ঢাকঢোল ঝাঁজর বাজাতে বাজাতে যুদ্ধে অবতীর্ণ।

আমাদের একে-অপরের প্রতি বিশ্বাস টুটে গেছে। মহড়া কক্ষে নির্দেশকের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছে শিশু নাট্যকর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার ল্যাবে শবাসনে থাকা শিক্ষার্থীর স্তনে হাত দিয়ে শাস্তি পেয়েছেন তার বিভাগের শিক্ষক। আমরা আমাদের সব কদর্যতা নিয়ে, স্বার্থচিন্তা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছি। আমরা এমনকি আর বড়দের কথাও শুনি না, সম্মানের সব উচ্চতাই অন্তর্হিত হয়েছে, অগ্রজদের টেনে নামানো হয়েছে মর্যাদার উচ্চাসন থেকে নর্দমার কাদায়। যে সুহৃদ নির্দ্বিধায় আমাদের ‘রাজাকার’, ‘বামাতি’ বলে দেগে দেয় তার প্রতি সম্মানও উধাও হয়েছে স্বভাবতই। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। ভব্যতার আড়াল গেছে কেটে।

তাতে কী এসে যায়?

আমরা বটতলা নামের যে দলে কাজ করি, তা গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সদস্য নয়, আমাদের গঠনতন্ত্রমতে কখনো যোগও দেব না। কারণ, আমরা ফেডারেশনকে আমাদের চর্চার জন্য জরুরি মনে করি না। তবু এ থিয়েটারি পাটাতনেই তো আমাদের নড়াচড়া। নগর যখন পোড়ে আঁচ সবার গায়েই লাগে। তাই থিয়েটারের এসব সমস্যা আমাদেরও, যেমন আর যেকোনো দলের। তাই সবাই মাথা ঘামাই।

সংকট ও অনাস্থার সুলুক সন্ধান কোথায়?

অতীতে – অতীত গরিমার মধ্যেই বর্তমানের পাঁকের দাগ দেখা যায়। গত দেড় দশকের ঘটনাক্রম, যা স্মরণযোগ্য বলে মনে করি তার মধ্যে এ শতাব্দীর শুরুর দশকের শেষভাগ থেকে (২০০৯) বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতি এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে একই ব্যক্তি নির্বাচিত ও আসীন হলেন–এটা এগিয়ে থাকবে। এতে কী এলো-গেল? আমরা যেন-বা জেনেও জানিনি, বুঝেও বুঝিনি এক দশকের বেশি সময় ধরে এক ব্যক্তির শাসনের মহিমা কী দাঁড়াবে! আন্দোলন করে স্বৈরাচার খেদানোর দাবি করা নাট্যকর্মীরাই নতুন স্বৈরাচারের বীজ নিজেদের হাতে বপন করেছি, পানি ঢেলে তাকে পরিপুষ্টি দিয়েছি। অর্থাৎ, শিল্পকলার মহাপরিচালক কেবল দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় আছেন তা-ই নয়, তিনি আবার থিয়েটারকর্মীদের বড় অংশের প্রেশার গ্রুপ বা দরকষাকষির সংগঠনেরও নির্বাচিত সভাপ্রধান। ফলে স্বার্থের সংঘাত (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) মেনে নিয়েই স্বল্পমেয়াদি লাভের আশায় থিয়েটার সংগঠনগুলো বছরের পর বছর ধরে একই ব্যক্তিকে নির্বাচিত করে গিয়েছে, গণতন্ত্রের বা সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক বিধিবিধানের ন্যূনতম তোয়াক্কা করেননি।

শিল্পকলার মহাপরিচালক কেবল দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় আছেন তা-ই নয়, তিনি আবার থিয়েটারকর্মীদের বড় অংশের প্রেশার গ্রুপ বা দরকষাকষির সংগঠনেরও নির্বাচিত সভাপ্রধান।

এখন আড়াল খোলা সময়ে ভালোমতো সব দেখে নেওয়া, বুঝে নেওয়া যাবে। আমাদের মত হলো, গত এক বছরের নড়াচড়ায় মূল মনোযোগটাই ভুল জায়গায়। চিহ্নিত সংকটের বেশিরভাগই উপরিতলের সংকট। মূল সংকট আরও গভীরে। উপরের সংকট মূল সংকটের উপসর্গমাত্র। তবে উপসর্গের বিতর্কও আমাদের লাভবান করেছে। কারণ, এ বিতর্কের কারণে আমরা মূল সংকটে দৃকপাত করতে পেরেছি।

হালের আসল সংকট তাহলে কোথায়?

২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তিপ্রক্রিয়া একটা পরিণতির দিকে জাতিকে নিয়ে গেলেও এর অভিঘাতে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে নানা রকম প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির উত্থান লক্ষণীয়। শাহবাগে জেতার শ্লাঘায় আত্মরতিরত ছিলাম বিধায় সে উত্থান আমাদের কল্পনার আগেই ছেয়ে ফেলেছে আমাদের আকাশ এবং তা আমাদের বর্তমানকে আচ্ছন্ন রেখেছে।

২০১৩-১৪ সাল জুড়ে দেশে প্রগতিশীল মুক্তমনা লেখক-সংস্কৃতিকর্মীরা হামলা, হত্যাকাণ্ড, জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। এ কাজে প্রতিক্রিয়াশীল সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির পেছনে রাষ্ট্রীয় পোষকতার ছায়া লুকানো থাকেনি। জুলহাস ও তনয় হত্যাকাণ্ডের পর তনয় একজন নাট্যকর্মী হওয়া সত্ত্বেও তাদের খুনের বিচারের দাবিটি তুলতে না পারা আমাদের নাট্য নেতৃত্বের পশ্চাদপসরণ ছাড়া আর কী? সে লজ্জা লুকোনো আছে আমাদের মনে।

ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা জাতিসত্তার মানুষ, প্রান্তিক যৌনতার মানুষের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে আমরা সরব হইনি। আমাদের নাটকের কন্টেন্টে এরা অনুপস্থিত বা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। সরকারের অলীক গৌরবগাথা রচনায় ব্রতী হয়েছি আমরা, যা মিথ্যা বিশেষণের ফুলঝুরিতে আটকে ফেলেছে আমাদের।

একদিকে রাজনীতিতে কর্তৃত্ববাদিতার থাবা, কথা বলার স্বাধীনতা না-থাকা, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও কর্মচারীদের লাগামহীন দুর্নীতি, গুম, নিপীড়ন। এসবের গল্প নেই থিয়েটারে। কৃতঋণ বিদেশি গল্পে কোনোক্রমে কাজ সারা চলে।

পুঁজির পুঞ্জীভবনের বৈশ্বিক অর্থনীতির কালে একটি প্রান্তিক দেশ হিসেবে দেশের নানা খাতের নির্ভরশীলতা আর উন্নয়নের নামে প্রকৃতি ধ্বংস চলে একতালে। অথচ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় শিকার হব আমরাই। এসব নিয়ে কার্যকর কোনো পাঠ নেই আমাদের থিয়েটারি জবানে-বয়ানে।

একদিকে রাজনীতিতে কর্তৃত্ববাদিতার থাবা, কথা বলার স্বাধীনতা না-থাকা, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও কর্মচারীদের লাগামহীন দুর্নীতি, গুম, নিপীড়ন। এসবের গল্প নেই থিয়েটারে। কৃতঋণ বিদেশি গল্পে কোনোক্রমে কাজ সারা চলে।

আঞ্চলিক রাজনীতির খেলায় ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার চাষ অবাধ। যার মূল আমরা পড়তে পারিনি। আমাদের থিয়েটারে সেই ক্রিটিক্যাল স্বর নেই। খুব ক্ষীণ শোনা যায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর্যালোচনা।

নারীর প্রতি সহিংসতা থামাতে কী করণীয় তা ঠিক করতে পারিনি। নারীর বা প্রান্তিক লিঙ্গের শিল্পীদের জন্য নিরাপদ জায়গা করে দিতে পারিনি এমনকি থিয়েটার দলগুলোতেও। নারীপ্রধান চরিত্রের নাটকের ছড়াছড়ি থাকলেও নারীপ্রধান দলের সংখ্যা নেহাতই কম। যৌথ সংগঠনে নারীর দেখা মেলা এমন কঠিন যে ফেডারেল বডিগুলোর থিয়েটারি আয়োজনের মঞ্চ খা-খা করে–বসে থাকে সার দেওয়া পুরুষ। অভিনেত্রীদের সাক্ষাৎকারে শুনি কী করে মঞ্চের পাশে উইংসে, দলে, আসা-যাওয়ার পথে, রাস্তায়, কর্মক্ষেত্রে নিপীড়নের জীবন তারা বয়ে চলেন, সৃজনসঙ্গীরা ঘুরেও দেখে না–এমপ্যাথিও দেখায় না। বরং তাকে আরও একটা নন্দন-মিথের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হতে হয়। হয় তাকে হতে হবে চোখধাঁধানো রূপসি অথবা কেউকেটা কারো মেয়ে বা বোন বা স্ত্রী বা নিদেনপক্ষে প্রেমিকা। যদি কেউ নিজ যোগ্যতায় অর্জনও করেন কিছু, তার কৃতিত্বও দলে থাকা স্বামী বা ভাই বা বাবার অর্জন বলেই বিবেচিত হবে। বডি শেমিং, স্লাট শেমিং, ম্যান্সপ্লেইনিং প্রতিদিনকার বাস্তবতা। অথচ গ্রুপ থিয়েটারে নাকি সবার সমান হওয়ার কথা, নায়িকার ‘সৌন্দর্য’ তবু চিন্তার বিষয়। আসলে আমাদের উদ্দেশ্য ঠিক করতে পারিনি এখনো–বিনোদন দেওয়াই লক্ষ্য এখনো, যদিও মুখে বিপ্লব!

নারীর বা প্রান্তিক লিঙ্গের শিল্পীদের জন্য নিরাপদ জায়গা করে দিতে পারিনি এমনকি থিয়েটার দলগুলোতেও। নারীপ্রধান চরিত্রের নাটকের ছড়াছড়ি থাকলেও নারীপ্রধান দলের সংখ্যা নেহাতই কম। যৌথ সংগঠনে নারীর দেখা মেলা এমন কঠিন যে ফেডারেল বডিগুলোর থিয়েটারি আয়োজনের মঞ্চ খা-খা করে–বসে থাকে সার দেওয়া পুরুষ।

নাট্যজনরা যখন রাষ্ট্র আর সরকারের পার্থক্য করতে পারেন না, যেকোনো সমালোচনাকে সরকার বিরোধিতা ও ‘বাহাস’কে থামানোর জন্য শক্তি প্রয়োগ করে তিরন্দাজের সুন্দরবন নিয়ে আলোচনা বন্ধ করতে তাদের নাটকই বন্ধ করে দেয়–তখন আমরা দেখেছি যে থিয়েটার স্বজনরা তিরন্দাজের বেয়াদবি, নিয়ম না-মানা নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন, নাটক বন্ধ হওয়ার বিরুদ্ধে একটা শব্দও করেননি। তখনই আস্থার জায়গা টলে গিয়েছে। তরুণরা বুঝে নিয়েছে সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রশ্ন তুললে রাষ্ট্রীয় বাহিনী লাগবে না, গ্রুপ থিয়েটারের বন্ধুরাই ব্রাত্য করে দেবে। বলে দেবে আপনি জামায়াত-শিবির-বামাতি। থিয়েটারের রাজনীতি এখন সরকারের স্তুতিগাথায় এসে ঠেকেছে।

নাট্যজনরা যখন রাষ্ট্র আর সরকারের পার্থক্য করতে পারেন না, যেকোনো সমালোচনাকে সরকার বিরোধিতা ও ‘বাহাস’কে থামানোর জন্য শক্তি প্রয়োগ করে তিরন্দাজের সুন্দরবন নিয়ে আলোচনা বন্ধ করতে তাদের নাটকই বন্ধ করে দেয়–তখন আমরা দেখেছি যে থিয়েটার স্বজনরা তিরন্দাজের বেয়াদবি, নিয়ম না-মানা নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন, নাটক বন্ধ হওয়ার বিরুদ্ধে একটা শব্দও করেননি।

তাহলে থিয়েটারের সংকট কোনগুলো?

১। কাদের জন্য থিয়েটার? শহরের বড়লোকের জন্য; না, মধ্যবিত্তের জন্য; না, গরিবগুর্বোর জন্য–এ নিয়ে মনে দ্বিধা রয়েই গেছে। আসলে মনে মনে চাই যে গুলশান-বারিধারা ছেয়ে যাক দর্শক আসনে, পাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি-বাড্ডা-যাত্রাবাড়ী হাতের আঙুলের কর গুনে শেষ হয় তাদের সংখ্যা অথচ গল্পটা লিখতে চাই কড়াইল বস্তির উন্নয়নে। কী-যে এক জটিল সম্পর্ক থিয়েটারে আর দর্শকে। কারো বেশি দর্শক হলেও বিপদ, গাল খেতে হয়। তবে নাটকের দর্শক তৈরি হয়নি বা হলেও খুব কম তারা সংখ্যায়। যারা নাটক দেখতে পাবে না কখনোই, তাদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টাও বিশেষ হয়নি।

২। আমাদের বোঝাপড়া শেষ হয়নি পেশাদারিত্ব কী আর গ্রুপ থিয়েটারই-বা কী তা নিয়ে, বা কেন করি বা করব বা করব না।

৩। ঝলমলে মিডিয়া দুনিয়ার প্রবেশদ্বার হয়ে রয়ে গেছি আমরা। স্বাধীনতার ৫০তম বছরে এসে আমাদের গর্ব সিনেমা আর টিভির তারকাদের নিয়ে যে তারা মঞ্চ থেকে উঠে এসেছেন।

ঝলমলে মিডিয়া দুনিয়ার প্রবেশদ্বার হয়ে রয়ে গেছি আমরা। স্বাধীনতার ৫০তম বছরে এসে আমাদের গর্ব সিনেমা আর টিভির তারকাদের নিয়ে যে তারা মঞ্চ থেকে উঠে এসেছেন।

৪। ফলে নাটকের বিষয়বস্তুতে মেরুদণ্ডের অভাব। ভেজা খবরের কাগজের মতো ন্যাতানো–তাতে খবর থাকলেও হাতে ধরে পড়া যায় না।

৫। আঙ্গিকগত ভাবনা অনুকৃতিতে ভরা। যেটুকু নতুন তা গিমিকে মোড়ানো চকচকে। কাছে গেলে ফাঁক বড় হয়ে বাজে।

৬। পড়ালেখা এমনকি বোঝাপড়ার থেকেও অনেক দূরে–জনতার সঙ্গে সংযোগ নেই যোগ নেই বইপত্রের সঙ্গেও। মেধাবী মানুষদের যেহেতু তেল দেওয়ার প্রয়োজন হয় না, তাই তারা ধীরে কোণঠাসা হয়। চারদিক ভরে যায় অনুকৃতিনির্ভর, পাঠহীন, মেধাহীনদের দখলে।

৭। অথচ এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কত স্নাতকোত্তর বাজারে–থিয়েটারচর্চার নানা ক্ষেত্রে তাদের উপস্থিতি সেভাবে অনুভূত হয় না। দল বা বিভাগগুলোও জানে না হয়তো কী করে তাদের পাস করে যাওয়া শিক্ষার্থীদের কী করে কাজে লাগানো যায়!

সমাধান কোন পথে?

আমাদের আগে যেসব আলোচনা হয়েছে সেখানে এবং আমাদের দলের ভেতরেও জিজ্ঞেস করে যা বুঝেছি–এর একক কোনো পক্ষ নেই যে এক পক্ষ সমাধান করে ফেলবে। তবে আমরা চিহ্নিত করেছি পক্ষগুলোকে–যাদের মাধ্যমে সমাধান হওয়া উচিত।

১। সরকার/রাষ্ট্র: শিল্পকলা ও মন্ত্রণালয়

এদের কাছে মূল দাবিগুলো অবকাঠামো উন্নয়নের ও পৃষ্ঠপোষকতার–থিয়েটার ইনস্টিটিউট, আর্থিক সহযোগিতা, আপৎকালীন সাহায্য, উৎসব আয়োজন, নাট্যকার-নির্দেশক ও দলগুলোর তালিকা তৈরি, বিদেশি নাট্যজনদের নিয়ে কর্মশালা পরিচালনা, জেলায় জেলায় নাট্যচর্চার ক্ষেত্র তৈরি, যোগ্য দল বাছাই করে আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ব্যবস্থা করা। তবে শর্তহীন সহযোগিতার ওপর জোর দিতে হবে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রীয় বরাদ্দে সবার অধিকার থাকবে এবং এসবই সরকারের চাপিয়ে দেওয়া যেকোনো নীতির নিগড়মুক্ত হতে হবে।

২। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন

যারা সারাই করে চালাতে চান তাদের কাছে এরাও একটা পক্ষ। ফেডারেশনের কাছে দাবি-দাওয়া নিয়ে আস্ত এক সংখ্যা থিয়েটারওয়ালাই রয়ে গেছে, এর সঙ্গে সাধারণ নাট্যকর্মীদের ধারণাপত্র মিলে পাই–মহড়াকক্ষ, সেট রক্ষণাবেক্ষণ, হল বরাদ্দ দেওয়া, বিদেশ যাত্রায় সহযোগিতা, স্ট্যাবলিশমেন্টের প্রতি নতজানু ভূমিকা পরিহার, সরকারি দলের তোষণ থেকে বেরিয়ে আসা, নাট্যচর্চার বিকেন্দ্রীকরণের দায়িত্ব নেওয়া, সব নৈতিক স্খলনের তদন্ত, বিচার, শাস্তির ব্যবস্থা করা, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নাটককে পাঠ্যক্রমের অংশ করা ইত্যাদি। এ ছাড়াও ফেডারেশন পথনাটক উৎসব, নাট্য প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে নাট্যকার তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে, করতে পারে দর্শকনন্দিত ও ভালো নাটকের বেশি প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও। এসব দাবি আছে ফেডারেশনের কাছে। আমাদের প্রশ্ন থেকেই যায়: কী করে ক্ষমতার প্রভাববলয় মুক্ত থেকে ফেডারেশন বা শিল্পকলা ভালো শিল্প বা ভালো দল বা নাটক বা নির্দেশক-এর তালিকা করবে এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করবে–কর্মপরিকল্পনাটা কী রকমের হবে?

৩। থিয়েটার দলসমূহ

সংগঠনে উত্তরসূরি বা গুরু-শিষ্য পরম্পরা তৈরি, পাঠের প্রতি, বশংবদ না স্বাধীন কর্মী তৈরি, দলের ভেতরে সৃজনশীলতা ও গণতন্ত্রের চর্চা করা, সহিষ্ণুতার শিক্ষা চালু করা, প্রান্তিক সদস্যদের জন্য নিরাপত্তার বলয় তৈরি করা, প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করা, দলের সদস্যদের বিশ্বরাজনীতি, আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনীতির সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকার ব্যবস্থা করা দরকার। এ ছাড়াও অর্থের হিসাব এবং ব্যবস্থাপনার মান উন্নীত করা জরুরি, যেন আর্থিক কেলেঙ্কারি দলের ভেতরে মাথাচাড়া না দেয়। অন্যান্য শিল্পমাধ্যম এবং ধারার সঙ্গে দলের সদস্যদের পরিচয় করানোর ব্যবস্থা করতে হবে। শিশু-কিশোরদের নাট্যচর্চায় যুক্ত করার প্রচেষ্টা নেওয়া দরকার বলে মনে করেন অনেকে। পেশাদার থিয়েটারের লক্ষ্য অর্জনে দলের ভেতরে পরিসর তৈরি করা প্রয়োজন। এখানেও প্রশ্ন থাকে: এসব বিষয়ে সংগঠনগুলো কী কী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় তা জানার মতো ভালো গবেষণা না থাকায় কীভাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে তার পরিকল্পনা কি আকাশ-কুসুম হবে না?

দলের ভেতরে সৃজনশীলতা ও গণতন্ত্রের চর্চা করা, সহিষ্ণুতার শিক্ষা চালু করা, প্রান্তিক সদস্যদের জন্য নিরাপত্তার বলয় তৈরি করা, প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করা, দলের সদস্যদের বিশ্বরাজনীতি, আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনীতির সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকার ব্যবস্থা করা দরকার।

৪। ব্যক্তি থিয়েটার কর্মী (যিনি নাটক লিখবেন, নির্দেশনা দেবেন, অভিনয় করবেন বা মঞ্চের পেছনে কাজ করবেন)

উপরে যে সংকটগুলোকে মূল সংকট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে যে কোনো নাট্যকর্মীর পরিচয় থাকতে হবে, এসব সংকট সমাধানের লক্ষ্যে যে কর্মপন্থা নির্ধারণ করা যায়, তা তার কাজের অংশ হতে হবে, নেতা হতে না চেয়ে শিল্পের রাজনীতির সঙ্গে তার পরিচয় থাকতে হবে। যে নাট্যকর্মী পেশাদার থিয়েটারে কাজ করতে চান, থিয়েটারের কাছে তার দায় এবং দায়িত্ব কী হবে, সেসব তার ভাবনার মধ্যে থাকা দরকার।

শেষ কথা হলো, রাষ্ট্রীয় বরাদ্দে সবার অধিকার যা সরকারের যে কোনো নীতির নিগড়মুক্ত হতে হবে। ক্ষমতার প্রভাববলয়মুক্ত থেকে ফেডারেশন বা শিল্পকলা ভালো দল, নাটক, নির্দেশকদের পৃষ্ঠপোষকতা করবে। সংগঠনে পাঠ, সৃজনশীলতা, সহিষ্ণুতা ও গণতন্ত্রের চর্চা করে স্বাধীন কর্মী তৈরি করে তাদের রাজনীতি, অন্য শিল্পমাধ্যম এবং ধারার সঙ্গে পরিচয় করাতে হবে। চিহ্নিত মূল সংকটগুলোর সঙ্গে প্রত্যেক নাট্যকর্মীর পরিচয় থাকতে হবে এবং তা থেকে উত্তরণের চেষ্টা তাদের থাকতে হবে।

 

সামিনা লুৎফা নিত্রা: বটতলা – এ পারফরম্যান্স স্পেস নামের নাটকের দলের সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ই-মেইল: samina.luthfa@gmail.com

সৌম্য সরকার: বটতলা – এ পারফরম্যান্স স্পেস নামের নাটকের দলের সদস্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ই-মেইল: soumyasarker@gmail.com

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •