সিপি গ্যাং-এর ‘বেশ্যা’ ব্যানার-১৩

নৈতিক স্মৃতিচারণ হিসেবে ইতিহাস

সিপি গ্যাং-এর ‘বেশ্যা’ ব্যানার-১৩

রেহনুমা আহমেদ

“ইতিহাস শুধু একটি বিজ্ঞান নয় বরং একইসাথে,

ন্যুনতম অর্থে, ইতিহাস একধরণের স্মৃতিচারণও।”

                                    -ওয়াল্টার বেঞ্জামিন

কোনো কোনো লেখক, চিন্তকের দৃষ্টিতে বেঞ্জামিন ইতিহাসবিরোধী, সম্ভবত এ কারণে যে তিনি প্রগতির ধারণার সমালোচক ছিলেন।

বেঞ্জামিনের মতে, খোদ মানবজাতির প্রগতি হয় না। শুধু এটুকুই দাবিকরা যায় যে মানুষের সামর্থ্য ও জ্ঞানের অগ্রগতি হচ্ছে। প্রগতি অসীম কিছু না। বেঞ্জামিন বলেন, মানবজাতি ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ ত্রুটিহীনতার দিকে এগিয়ে চলেছে এই ধারণাটি ভ্রান্ত। প্রগতি অবশ্যম্ভাবী কিছু না। ধীরে ধীরে সবকিছু আগের চাইতে ভালো হতে বাধ্য, এই ধারণাটিও ভ্রান্ত। “প্রগতি এমনকিছু যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি সরল রেখায় বা পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরে ঘুরে অগ্রসরমান হয়” – প্রচলিত এই ধারণার সমালোচনা করেন বেঞ্জামিন।

প্রগতির ধারণার ব্যাপারে বেঞ্জামিনের অসন্তোষ “সময়” এর প্রগতি-সংস্লিষ্ট ধারণা নিয়ে। “মানবজাতির ঐতিহাসিক প্রগতির ধারণাটাকে সমরূপী ও ফাঁকা সময়ের ভিতর দিয়ে এগোতে-থাকার-ধারণা থেকে ছিন্ন করা সম্ভব না। অন্য কথায়, “সাধারণ ঐতিহাসিক সময়” একরৈখিক (linear), এটি ঘড়ি ও ক্যালেন্ডারের সময়, এর একক (সেকেন্ড,মিনিট, ঘন্টা,দিন) অভিন্ন ও একে অপরের সাথে বদলযোগ্য। একটি দিন আরেকটি দিনের মতোই।

বেঞ্জামিনের ক্রিটিকাল তত্ত্ব অ্যান্ড্রু রবিনসন আরো সহজ করে বুঝিয়ে বলেন, সাধারণ ঐতিহাসিক “সময়” কেটে পৌঁছায় “একটি চলমান বর্তমানে যা অতীত থেকে কেটে যায় ভবিষ্যতে কিন্তু মৌলিক অর্থে [সময়ের কোনো গুণগত বদল ঘটে না, এটি] একইরকম থাকে। বেঞ্জামিন জোর দিয়ে বলেন, সময়ের এই ধারণা ঐতিহাসিকভাবে নির্মিত, এই ধারণার আবির্ভাব ঘটেছে পুঁজিবাদের সাথে, পুঁজিবাদী কর্ম-শৃঙ্খলা সৃষ্টি করার জন্য সময়ের এই ধারণা আবশ্যক, এই ধারণা “পণ্য-পূজার (commodity fetishism) সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, এর সাথে এই ধারণাও [জড়িত] যে, পণ্যগুলো, যার মধ্যে শ্রমঘন্টা অন্তর্ভুক্ত (পণ্য উৎপাদন করার জন্য যেই সময়টুকু লাগে), একে অপরের সাথে বিনিময়যোগ্য।” পুঁজিবাদের ভোগবাদী অর্থনীতিতে ফ্যাশন ও প্রযুক্তি নিরন্তর বদলাতে থাকে কিন্তু অন্তর্নিহিত ব্যবস্থায় কোনো ধরণের বদল ঘটে না।

সামাজিক পরিবর্তন সম্বন্ধে নতুনভাবে ভাববার তাগিদ থেকে বেঞ্জামিন ইহুদি আধ্যাত্মিক চিন্তার সাথে (ক্বাবালাহ, ক্বাবালাহবাদ) মার্ক্সবাদী/সেক্যুলার বিপ্লবের তত্ত্বের সংযোজন ঘটান। এই সংমিশ্রণটি খাঁটি, এটি ফিউশান, একে টুকরো-টুকরো অংশে ভাগ করা যাবে না। ইতিহাসকে নতুনভাবে কল্পনা করার জন্য বেঞ্জামিন প্রস্তাব করেন “মেসিয়ানিক টাইম” এর ধারণা(যার অপর নামকরণ কেউ কেউ করেছেন “এখনের সময়” বা “ঐতিহাসিক সময়”) যাতে সময়কে ভিন্নভাবে অনুভব করা যায়। মেসিয়ানিক টাইমের দৃষ্টিতে সময় সংখ্যাগত না, গুণগত। একে অনুভব করা হয় এই-এক্ষুণি, বিলম্বহীন-অর্থে,তীব্রভাবে। এটি ছেদ ঘটায়, ব্যাহত করে, লঘু করে “সমরূপী ফাঁকা সময়”কে যা সংখ্যাভিত্তিক, যা “অতীত থেকে বর্তমানের ধারায় প্রবাহিত,” যা অনুভূত হয় “অনুভূতিহীন ও নিঃসাড়ভাবে, যা অনুভূতিকে করে তোলে অবশ।” এটি চলমান (আর স্পষ্টতই, এটি) সমরূপী, এটি ফাঁকা।

মেসিয়ানিক সময় “জেগে ওঠার মুহূর্ত।” এটি বর্তমানের জন্য ইতিহাসকে উদ্ধার করে, কিন্তু রবিনসন বলেন, সমরূপী ফাঁকা সময় থেকে মুখ ফেরানো শুধু চিন্তার পর্যায়ে ঘটার বিষয় না। এটি শুধু “আধ্যাত্মিক” না।১০ মেসিয়ানিক টাইমের ধারণা সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সংশ্লিষ্ট, এর বাস্তবিক অর্থে রূপান্তরকারী কার্যকারিতা আছে, এটি “সেই প্রাত্যহিক জীবনেরই অংশ হয়ে ওঠে যেটিকে সে বৈপ্লবিক করে তোলে।”১১

বেঞ্জামিনের জন্য বিপ্লব হচ্ছে মেসিয়ানিক মুহূর্ত; “প্রগতি ও… ঐতিহাসিক বিকাশের শেষ বিন্দু”১২ হওয়ার পরিবর্তে বিপ্লব তাহাই যাহা প্রগতির ব্যাঘাত ঘটায়। বেঞ্জামিন মেসিয়ানিক বা বৈপ্লবিক মুহূর্তে ট্রেনের শিকল টানার সাথে তুলনা করেন যেটি নির্ঘাত দুর্ঘটনার দিকে ধাবিত হচ্ছে; একজন বিপ্লবীর ট্রেনের গতির সাথে চলা উচিৎ না (“ইতিহাসের প্রবাহ”১৩), বরংতার ট্রেনকে থামানো উচিৎ “মৌলিক-অর্থে-ভিন্ন বাইরের”১৪ কিছু দিয়ে এর গতি থামানো উচিৎ। প্রগতির ধারণা থেকে বেঞ্জামিনের সমালোচনামনষ্ক দূরত্ব সমকালীন জার্মানির ঘটনা দিয়ে আংশিকভাবে বোঝা সম্ভব কারণ জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি শ্রমিকদের প্রগতির অনিবার্যতায় বিশ্বাস করার জন্য উৎসাহিত করত, বেঞ্জামিনের দৃষ্টিতে এই বিশ্বাস তাদের অবক্ষয় ঘটায় কারণ তাদের মধ্যে তাড়ার বোধ অনুপস্থিত ছিল, “[শ্রমিকরা] আত্মতৃপ্তির সাথে এই আশায় বসে থাকতেন যে প্রগতি এসে সংকটের সুরাহা করে দেবে।”১৫

ভ্যানেসা শোয়ার্টজ বলেন, বেঞ্জামিনের ঐতিহাসিক পদ্ধতির উল্লেখযোগ্য দিক হলো পাঠক ইতিহাসের মুখোমুখি হন “অতীত ও বর্তমানের মধ্যে একটি আলাপচারিতা হিসেবে”;১৬ ইতিহাসের তথ্য ও সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করার পরিবর্তে এটিকে লেখা হয় “মন্তাজ ও পাশাপাশি স্থাপনা হিসেবে।”১৭

বেঞ্জামিন বলেন, অতীত আসলে কেমন ছিল”১৮ এটি লেখা বা “অতীতের ‘চিরন্তন’ ভাবমূর্তি হাজির করা (অতীতে কোনো একসময়) ইতিহাসের কাজ না”;১৯ ইতিহাসবিদদের “যোগকারী” পদ্ধতি [additive procedure]২০ অনুসরণ করা উচিৎ না কিংবা কষ্টশষ্ট করে এক রাশ তথ্য যোগাড় করা উচিৎ না “সমরূপী ফাঁকা সময় ভরার জন্য।”২১ শোয়ার্টজ বলেন, বেঞ্জামিনের ঐতিহাসিক পদ্ধতি “অতীতকে [স্থাপন করে] ঐতিহাসিক বর্তমানের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা অনুসারে।”২২

ইতিহাস-রচনা যদি বিজ্ঞান না হয়ে এক ধরণের স্মৃতিচারণ হয়ে থাকে (“[ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক চরিত্র] নিশ্চিত করা হয় ইতিহাসের অরিজিনাল ভূমিকা স্মৃতিচারণের প্রতিটি চিহ্ন বিসর্জন দিয়ে”),২৩ তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, “স্মৃতিচারণ” বলতে বেঞ্জামিন কী বোঝান, আর ইতিহাস-হচ্ছে-স্মৃতিচারণ, এটি কীভাবে সামাজিক পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে উন্মোচন করে।

বেঞ্জামিন বলেন, “অতীতকে সাবলীলতার সাথে ঐতিহাসিকভাবে প্রকাশ করার… অর্থ হচ্ছে যখন ভয়াবহ কোনো মুহূর্তের স্মৃতি দুম করে মাথায় চলে আসে তখন সেটিকে আত্মসাৎ করা।”২৪ দুম করে মাথায় আসা স্মৃতি (বেঞ্জামিন-গবেষক এস্থার লেজ্লির ভাষায়, “অতৃপ্ত মুহূর্ত”২৫) ব্যর্থ বিপ্লবের পূর্ব অভিজ্ঞতার সাথে জড়ানো। অতীতের ‘দায় মোচন’ করতে হলে সেটিকে নতুন আকৃতিতে সাজাতে হবে; “প্রাত্যহিক বস্তু ও প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতাকে পুনরায় ব্যাখ্যা করতে হবে, দায় মোচনযোগ্য করার জন্য সেগুলোকে বিকল্প উপায়ে আত্মসাৎ করতে হবে।”২৬

“অতীতে কোনো এক সময়”-মার্কা ইতিহাস (অর্থাৎ, বৈজ্ঞানিক ইতিহাস, ইতিহাসবিদ নিরপেক্ষ স্বরে লিখবেন, দূরত্ব বজায় রেখে লিখবেন,উত্তেজনা প্রশমন করে লিখবেন, সুশৃঙ্খলভাবে তথ্য, উপাত্ত সংগ্রহ করবেন) আগেকার দিনের প্রতি মনোযোগী, আর তাই “এটি বর্তমান ক্রিয়াকর্ম থেকে সব শক্তি নিঃশেষ করে ফেলে।”২৭ পক্ষান্তরে, বেঞ্জামিন জোরারোপ করেন, ইতিহাস-হচ্ছে-স্মৃতিচারণ (সরল রেখার মতো না হওয়ার কারণে)-এর হওয়া উচিৎ “এমন ধরণের যা বর্তমান সময়ে ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করাকে সক্ষম করে তোলে।”২৮

আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল (পিতৃতান্ত্রিক) ইতিহাসে বীরাঙ্গনাদের কীভাবে স্মরণ করা হয়? কোথায় খুঁজব ভাবতে লাগলাম, তারপর মনে হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাইতে ভালো সূত্র আর কী হতে পারে। একেবারে খাঁটি জায়গা। একইসাথে এটাও মনে হলো, লিখিত কিছু পেলে ভালো হতো যাতে কী বলা হয়েছে আর কী উদ্ধৃত করা হচ্ছে তার মধ্যে কোনো ফাঁকফোকর না থাকে।

মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রায় সব দৈনিক পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার বাণী ছাপা হয়েছিল ২৬শে মার্চ ২০১৫ সালে, বাণীর প্রাসঙ্গিক দুই লাইন উদ্ধৃত করছি: “আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি ত্রিশ লাখ শহিদ এবং দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনকে, যাঁদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে কাক্সিক্ষত বিজয়।’ (বাঁকা হরফে যুক্ত)। ইংরেজিতে যার অনুবাদ করা হয়েছিল, ““I recall with deep gratitude the 3 million martyrs and 200 thousand [sic] women who lost their innocence in the War of Liberation in 1971. We earned our desired victory through their supreme sacrifices.”২৯(আবারো, বাঁকা হরফে যুক্ত)।

 

মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাণী, ২৬ মার্চ ২০১৫।©দৃক

“সম্ভ্রমহারা”র ইংরেজি অনুবাদ করা হয়েছে, “লস অফ ইনোসেন্স।” কী বিষয়ে ইনোসেন্স-হারা? রাজনীতি বোঝার ক্ষেত্রে ইনোসেন্স? নাকি অর্থনীতি? নাকি ধর্ম…? স্পষ্টতই কোনোটাই না, দুঃখ প্রকাশ করা হচ্ছে ‘লস অফ সেক্সুয়াল ইনোসেন্স’এর জন্য। কিন্তু আমার জিজ্ঞাসা, বাণীতে কেন বলা হয়নি দুই লক্ষ নারী ধর্ষণ ও যৌন আক্রমণের শিকার হয়েছে, বলা উচিৎ ছিল কারণ,

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবিউনাল) অ্যাক্ট, ১৯৭৩ (ও ২০০৯ এর সংশোধনীতে) ধর্ষণ হচ্ছে

একটি যুদ্ধাপরাধ (যদিও ধর্ষণের কোনো সংজ্ঞা দেওয়া হয় নাই)।

আইসিটি মামলা এখনো চলমান।

যুদ্ধপরাধীদের বিচার (পরে অনির্বাচিত) সরকারের শাসনের নৈতিক ভিত প্রদান করে।

প্রধান যুদ্ধাপরাধীদের: আব্দুল কাদের মোল্লা(২০১৩), দেলওয়ার হোসেন সাঈদী (২০১৩), মতিউর রহমান নিজামী (২০১৪), এটিএম আজহারুল ইসলাম (২০১৪)-দের ‘ধর্ষণের’ জন্য সাজা দেওয়া হয়েছে (ব্যাপক হত্যাকা-, গণহত্যা’সহ), মেয়ে বা নারীদের “সম্ভ্রমহারা” করার জন্য না।

অপরাধের নামকরণ করা হবে না কেন?৩০

প্রধানমন্ত্রী যেহেতু কথা বলেছেন পিতৃতান্ত্রিক ভাষায়, চলুন, পিতৃতান্ত্রিক যুক্তি ধরেই এগোতে থাকি: যদি কোনো মেয়ে বা নারী তথাকথিত “লস অফ ইনোসেন্স” বিয়ের সীমারেখার মধ্যে না ঘটে থাকে (‘সঠিক’ সেক্স) তাহলে… কী হয়? মেয়েটি তাহলে আর সতী, পূণ্যবতী, লজ্জাবতী,আদর্শ ও আদর্শায়িত বাঙালি নারী থাকে না, সে হয় ব্যভিচারিণী, নষ্টা, ভ্রষ্টা, ..হুম, তাহলে তিনি কে/তার ভাগ্য কী?

প্রধানমন্ত্রী যে নিজে বসে তার বাণী লেখেননি (“সম্ভ্রমহারা মা-বোন”) এটুকুন বোঝার মতো জাগতিক বোধবুদ্ধি আমার আছে, তিনি নিজে ইংরেজিতে অনুবাদও করেননি (“lost their innocence”), খুব সম্ভব এটি কোনো এক হতচ্ছাড়া আমলার কাজ, কিন্তু বাণীটি যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর নাম বহন করে তাই এর দায়ভার তার নিতে হবে।

সাড়ে চার দশক হয়ে গেল কিন্তু আওয়ামী লীগের তারকাখচিত সংস্কৃতি কারখানার কোনো সদস্যই, কি নতুন কি পুরান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, নাট্যকার, ইতিহাসবিদ, নাট্য পরিচালক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সাংবাদিক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, বিজ্ঞাপক, উপাচার্য, ইতিহাসবিদ, প্রফেসর এমিরিটাস, কবি, শিল্পী, পেইন্টার, টিভির কথা-বলিয়ে-মাথারা, বুদ্ধিমান নারী টিভি অ্যাংকর, মানবাধিকার নেতা, আইনজীবী, নারী আন্দোলন নেত্রী, কেউই এই পবিত্র পিতৃতান্ত্রিক পাঠ থেকে সরেননি। যখন একদল তরুণ (ও তরুণী) একাত্তরের সমর্থনে একটি ‘একক’ পৌরুষ কণ্ঠে নারীকে তার (অর্থনৈতিক) অপর হিসেবে নির্মাণ করেছিল পবিত্র শহীদ মিনারে, তাদের কেউই প্রতিবাদ করেননি।

তারা সশ্রদ্ধ, আজ্ঞাবহ, পদলেহী থেকেছেন, সযত্নে লালিত অন্যমনস্কতা ধারণ করেছেন, অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতে চেয়েছেন, থেকেছেনও…।

শুধু যুদ্ধাপরাধের বিচার করে দায় মোচন হবে? বাদবাকি শূন্য?

কিন্তু ইতিহাস যাদের কাছে ফাঁকা বুলি না তারা কীভাবে বীরাঙ্গনাদের দায় মোচন করতে পারে? শাসকদলের “দেশপ্রেমিক” ট্রেনকে কি সমরূপী ফাঁকা সময়ের সরল রেখায় ধাবিত হতে দিয়ে, ‘কোনো এক সময়, দুই লক্ষ নারী, আমাদের অভাগা মা-বোনেরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল…’

নাকি কেউ বাধা দেবে, ট্রেনের শিকল টানবে?

যদি “দেশপ্রেমিক” ইতিহাসের ট্রেনকে দ্রুত গতিতে এগোতে দেওয়া হয় তাহলে সিপি গ্যাং “মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে” বুদ্ধিবেশ্যা ব্যানার নিয়ে শহীদ মিনারে দাঁড়াবে।

কিন্তু যদি ইতিহাসের প্রবাহকে কেউ রোধ করতে চায় তাহলে দুম করে ভয়াবহ স্মৃতি ভেসে উঠতে দেবে, ৭১-এ ধর্ষিত নারীদের বেশ্যা বলে গালমন্দ করার স্মৃতি। কোনো কোনো বীরাঙ্গনার স্বাধীনতার পর বেশ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়ার স্মৃতি। ৭১-এ বেশ্যাদের ধর্ষিত হওয়ার স্মৃতি।

যদি “দেশপ্রেমিক” ইতিহাসের ট্রেনকে প্রচ- বেগে ছুটে যেতে দেওয়া হয় তাহলে মুক্তিযুদ্ধের-পক্ষের শিল্পীরা শহীদ মিনারে আঁকতে পারবেন, ‘পবিত্র শহীদ মিনার চরের লাশ বহন করবে না, পাকিস্তানে নিয়ে যাও।’ আওয়ামী লীগ ও চৌদ্দ দলীয় জোটের উচ্চপদস্থ নেতা আর তাদের সাথে তৃণমূল অ্যাক্টিভিস্টরা, বিএনপি নেতা খালেদা জিয়াকে বলতে পারবেন, ‘যাও পাকিস্তান চলে যাও।’

কিন্তু যদি ইতিহাসের গতিকে কেউ রোধ করতে চায় তাহলে ভয়াবহ স্মৃতি দুম করে মানসপটে দেখা দেবে, ৩০-৪০ জন যুদ্ধচলাকালীন ধর্ষণের শিকার নারী স্বাধীনতার পরপরই তাদের ধর্ষকদের পিছু পিছু পাকিস্তান চলে যেতে চেয়েছিল (আমার বিবেচনায়, এমন একজনই যথেষ্ট)। স্বাধীন দেশের দেশবাসীর সাথে থাকার চাইতে তারা তাদের ‘যুদ্ধপরাধী ধর্ষকের’ সাথে থাকতে চেয়েছিল।

যদি “দেশপ্রেমিক” ইতিহাসের ট্রেনকে ছুটে চলে যেতে দেওয়া হয় তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শহীদ মিনারে “লাশের ভার” সমাবেশ আয়োজনের অনুমতি দেবেন।

ধর্ষিতার প্রতি বাঙালি সমাজের ঘৃণা। একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি। ©দৃক

কিন্তু যদি “দেশপ্রেমিক” ইতিহাসের গতিধারা কেউ রোধ করতে চায় তাহলে আক্রান্ত হবে ভয়াবহ স্মৃতি দ্বারা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসিদ্ধ ছাত্রী হল রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও ৭১-এ ধর্ষিত হয়েছিল।৩১

দক্ষিণ আফ্রিকার যেই অ্যাকাডেমিক ও গবেষক দল বর্ণবাদী মহাফেজখানাকে (আর্কাইভ) “পুনঃনিরীক্ষণ, বর্ধিত ও বৃহৎ করা”র আহ্বান জানিয়েছে কারণ ১৯৯৪-পরবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকায় এখনো পুরানো ধরনের বর্ণবাদ টিকে আছে, আবার নতুন ধরনের বর্ণবাদের আবির্ভাব ঘটেছে, তারা বলেন, “দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারি ইতিহাসের সাথে [বর্ণবাদের] মহাফেজখানার কার্যত জড়িয়ে থাকা… বর্ণবাদী অতীতের এখনো-চলমান ক্ষতিকে নিরীক্ষা করার সামর্থকে ক্ষুন্ন করেছে।”৩২ তারা আরো বলেন, “সরকারি ইতিহাসের নিরঙ্কুশ প্রভাবকে কাউন্টার করার জন্য” প্রান্তিক দল ও নিম্নবর্গের আত্মস্মৃতি ও বয়ানকে পুনরুদ্ধার করতে হবে।৩৩ তথ্যসূত্র হিসেবে বর্ণবাদী পীড়নের বয়ান তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এগুলো মুক্তির প্রাক্সিসকে বিকশিত করার সাথে সম্পর্কিত: আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈচিত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, গণতান্ত্রিক, নতুন পদ্ধতি দ্বারা আন্তশাস্ত্রীয় ভাবে বোঝা ও জানাকে অনুমোদন করে যাতে “কৃষ্ণাঙ্গতা ও শ্বেতাঙ্গতার যেই অনঢ় ও বিপরীত-যুগলের-বিরোধ যা বর্ণবাদোত্তর-দক্ষিণ আফ্রিকাকেও দূষিত করে” তার থেকে মুক্তি লাভ করা যায়।৩৪

বেঞ্জামিনের একটি বাক্য আমাকে তাড়া করে। ইতিহাস শাসকশ্রেণীর শাসনের অস্ত্রে পরিণত হতে পারে এই আশঙ্কার কথা উল্লেখকালে তিনি বলেন “একমাত্র সেই ইতিহাসবিদ অতীতে আশার আলো জাগাতে পারেন যিনি নিশ্চিত যে শত্রুপক্ষ থেকে মৃতরাও রক্ষা পাবে না যদি সে হয় বিজয়ী। আর এই শত্রু বরাবরই বিজয়ী।”৩৫

আমার পাঠানুসারে, যারা ৭১-এর হয়ে কথা বলেন তাদের থেকে বীরঙ্গনারাও নিরাপদ না কারণ পিতৃতন্ত্র বিজয়ী। আর পিতৃতন্ত্রের বিজয়ী হওয়া কখনো থামেনি।

পিতৃতন্ত্রের অবিরাম বিজয় জ্বলজ্বলভাবে সবার কাছে স্পষ্ট, বেশ্যা হচ্ছে যাকে বলে সবকিছুকে-ধারণ-করা-যায় এমনই একটি ‘হোল্ডঅল’ সমাধান: আমরা যুদ্ধে ধর্ষিত নারীদের ফেরৎ নিতে চাই না, কী করব? তাদের বেশ্যা ঘোষণা কর। আমরা কিশোরীকে গণধর্ষণ করে হত্যা করেছি কিন্তু আমরা শাস্তি পেতে চাই না, কী করি, বলো তো? একটি সংবাদ সম্মেলন ডেকে বলো,ও বেশ্যা। আমরা এই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পছন্দ করি না যারা সরকারের সমালোচনা করে, ওদের মধ্যে কেউ-কেউ বিএনপি-জামায়াতকে সমর্থন করে, অন্যরা স্বতন্ত্র, কী করব? ওদের ছবি পোস্টারে ছাপো, বেশ্যা ডাকো। একজন নারী অ্যাক্টিভিস্ট আছে, শ্রমিক অধিকারের জন্য লাগাতার লড়াই করে যাচ্ছে, আমরা ওকে পছন্দ করি না, কী করব? বেশ্যা ডেকে মাইর দাও। আমাদের শালিসে বসতে হবে, মেয়েটিকে উত্যক্ত করার পর তুলে নিয়ে যায় এখন আবার তাকে পাওয়া গেছে, কী করি বলো তো? বেশ্যা ডাকো। আচ্ছা, ওই মেয়েটি তো কুমারিত্ব হারালো আমরা ওকে ধর্ষণ করেছি বলে, কী করব? আভিধান ম্যানেজ করো, বলো, যে নারী ধর্ষিত, সে বেশ্যা।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে আমাদের দেশপ্রেমিক শাসকদের মুঠো থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মুক্ত করতে হবে। বীরাঙ্গনাদের দায় মোচন করতে হলে নিজেদের মুক্ত করতে হবে বিপরীত-যুগলের-বিরোধ থেকে, সতী-অসতী, ভালো মেয়ে-খারাপ মেয়ে, বউ-বেশ্যা। এ জাতির কল্পনাজগতের এগুতে হবে বি-বেশ্যাকরণের দিকে।

তা না হলে কি বীরাঙ্গনা কি বেশ্যা, কেউই বিজয়ীদের কাছ থেকে নিরাপদে থাকতে পারবে না।

অনলাইন দল সিপি গ্যাংয়ের ব্যানারে (বাম থেকে ডানে): প্রবীণ সাংবাদিক মাহফুজুল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল ও আমেনা মহসিন, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, আইনজীবী তুহিন মালিক, লেখক ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহার, সাপ্তাহিক এর সম্পাদক গোলাম মোর্তজা, নিউ এইজ এর সম্পাদক নূরুল কবীর এবং দৈনিক মানবজমিন এর সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ১৭ অক্টোবর ২০১৪।© New Age

তথ্যসূত্র:

১. Walter Benjamin, The Arcades Project, edited by Rolf Tiedemann, transl. by Howard Eiland and Kevin McLaughlin, Cambridge, MA: Belknap Press of Harvard University Press, 1991,c„. 471| D×…Z n‡q‡Q wb‡¤œv³ cÖe‡Ü, Clarence W Joldersma, “Walter Benjamin’s Angel of History and the work of ethical remembrance in W G Sebald – Response to David Hansen,” in Claudia Ruitenberg (ed.), Philosophy of Education Society Yearbook, 2012, Urbana, Il: Philosophy of Education Society-University of Illinois, 2012, পৃ.১৩৫।

২. Walter Benjamin, “On the Concept of History,” in Walter Benjamin. Selected Writings, Vol. 4, 1938-1940, transl., by Edmund Jephcott and others, edited by Howard Eiland and Michael W. Jennings, Cambridge, Mass: Harvard University Press, 1999, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৯৪-৩৯৫।

৩. Andrew Robinson, “Walter Benjamin and the two souls of critical theory,” Lecture on Walter Benjamin (draft version), andrewrobinsontheoryblog.blogspot, November 15, 2004।

৪. উপরোক্ত।

৫. উপরোক্ত।

৬. বেঞ্জামিনের মেসিয়ানিক টাইম এর ধারণা নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও বাহাস চলমান। নারীবাদী তাত্ত্বিক জুডিথ বাটলার আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেন বেঞ্জামিনের চিন্তায় মেসিয়ানিক ধারণা কীভাবে আবর্তিত হয়ে পূর্ণতা লাভ করে। শুরুর দিকে পেইন্টিং-সূত্রে বেঞ্জামিন বিষয়টিকে একভাবে বুঝেছিলেন (understood the “messianic as a nonsensuous core of meaning that nevertheless organizes the sensuous field”); পরবর্তীকালে “Task of the Translator” প্রবন্ধে মেসিয়ানিকের ধারণাটি সময়ের প্রবাহে ভাঙ্গন ধরানোর সম্ভাবনাকে ইঙ্গিত করে। উদাহরণস্বরুপ, ভাঙা কলসির টুকরোগুলো জোড়া লাগিয়ে কখনোই পূর্বের আস্ত অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া যায় না; আগের চিন্তায় মেসিয়ানিকে মার্জনা, ক্ষমাশীলতা, দয়ালুর আভাস ছিল, কিন্তু “Critique of Violence” এ বেঞ্জামিন মেসিয়ানিক শক্তিকে দৈব সহিংসতা হিসেবে কল্পনা করেন যার চ্ছেদঘটেছে আইনি সহিংসতার সাথে (যার আরেক অর্থ, অপরাধবোধ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া)। “Theses on the Philosophy of History” প্রবন্ধে তিনি মেসিয়ানিককে যুক্ত করেন নির্যাতিতের ইতিহাসকে ভুলে যাওয়ার আরোপিত অবস্থা থেকে উদ্ধার করার লড়াই হিসেবে। বাটলার বলেন, “There is no single doctrine of the messianic for Benjamin, and we might start our consideration by affirming that the messianic is a counterdoctrinal effort to break with temporal regimes that produce guilt, obedience, extend legal violence, and cover over the history of the oppressed. If it seems that the messianic works in favor of oblivion in the early instances only to struggle against it in the later versions, that is only because the history of guilt is not the same as the history of oppression. As Benjamin becomes more clear that the effacement of the history of oppression must be countered, it is precisely not in the service of augmenting the world of guilt. Rather the guilty are those who remain tied to a version of law and violence that seeks to cover over the destruction it has caused and causes still. Thus the messianic emerges as a way of exploding that particular chronology and history in the name of recovering in scattered form those remnants of suffering’s past that in indirect ways comport us to bring to an end regimes whose violence is at once moral and physical.” দেখুন, Judith Butler, Parting Ways. Jewishness and the Critique of Zionism, New York: Columbia University Press, 2012, পৃ.৭০। বাটলারের বই নিয়ে টায়লর মর্গেনস্টার্ন এর প্রবন্ধটিও চিন্তা-উদ্দীপক, দেখুন, Tyler Morgenstern, “The Messianic Poetics of Return: Benjamin, Darwish and the Impossible in Judith Butler’s “Parting Ways,”” www.scribd.com|

৭. “Walter Benjamin and the Two Souls,” প্রাগুক্ত।

৮. উপরোক্ত।

৯. উপরোক্ত।

১০. উপরোক্ত।

১১. উপরোক্ত।

১২. উপরোক্ত।

১৩. উপরোক্ত।

১৪. উপরোক্ত।

১৫. উপরোক্ত।

১৬. Vanessa R . Schwartz, “Walter Benjamin for Historians,” The American Historical Review, Vol. 106, No. 5, 2001, পৃ. ১৭২৩।

১৭. উপরোক্ত, একই পৃষ্ঠা।

১৮. “On the Concept of History,” প্রাগুক্ত,পৃ.৩৯১।

১৯. উপরোক্ত, পৃ. ৩৯৬।

২০. উপরোক্ত, একই পৃষ্ঠা।

২১. উপরোক্ত, একই পৃষ্ঠা।

২২. “Walter Benjamin for Historians,” প্রাগুক্ত, পৃ.১৭৪০।

২৩. Walter Benjamin, “Paralipomena to On the Concept of History,” in Walter Benjamin. Selected Writings, Vol. 4, 1938-1940, transl. by Edmund Jephcott and others, edited by Howard Eiland and Michael W Jennings, Cambridge, Mass.,: Harvard University Press, 1999, পৃ.৪০১।

২৪. উপরোক্ত, পৃ.৪০৩।

২৫. উদ্ধৃত হয়েছে নিম্নোক্ত প্রবন্ধে, Andrew Robinson, “Walter Benjamin and the two souls,” প্রাগুক্ত।

২৬. উপরোক্ত।

২৭. উপরোক্ত।

২৮. উপরোক্ত।

২৯. Message of the Prime Minister, Government of the People’s Republic of Bangladesh, The Daily Star, 26March 2015|

৩০. Shireen Huq, “Restoring honour to Birangonas: War crime, not loss of honour!,” New Age, Victory Day Supplement, 16 December 2012|

৩১. সর্বজনকথার পাঠকদের জন্য টীকা: প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে, আমি এটা লিখেছিলাম। বছর দুয়েক আগে রোকেয়া হলের তৎকালীন হাউস টিউটর অধ্যাপক রওশন আরার সাথে আকস্মিক দেখা। ১৯৭১ নিয়ে কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন রোকেয়া হলের কোনো ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হননি। পরে, ওনার এই কথাগুলো লিখিত-আকারে চোখে পড়ল, ২৫ মার্চের সন্ধ্যায় “…রোল কল অনুযায়ী হলে একজন নেপালিসহ ৭ জন ছাত্রী ছিলেন।… রাত ১১টার দিকে অল্প-অল্প গুলির শব্দ পাচ্ছিলাম।… কিন্তু একটু পরেই এতো জোরে শব্দ হওয়া শুরু করলো যে মনে হলো বিল্ডিং কাঁপছে, ভেঙে পড়বে। শুনলাম মানুষের চিৎকার-আর্তনাদ। সেসময় আমাদের জানালা দিয়ে সার্চ লাইটের তীব্র আলো এসে পড়লো।…আমাদের নিচে গেটের কাছেই একটি জিপ, তাতে লাল ফ্ল্যাগ। আর্মিরা কি কি যেনো বলছে। প্রচ- গুলি শুরু হলো। আমাদের উপর তলার জানালার গ্লাস গুলিতে ভেঙে পড়লো। বাতি নিবে গেলো, আলো বলতে একটু পর পর তাদের সার্চ লাইটের আলো।’

এই গোলাগুলির পর ছাত্রীরা আতঙ্কিত। ছাত্রীদের রক্ষা করতে হাউস টিউটর সাহেরা খাতুন এগিয়ে আসেন জানিয়ে অধ্যাপক রওশন বলেন: অধ্যাপক সাহেরার বাসাটি ছিল গুরদুয়ারার উল্টো দিকে। তিনি সেই ৭ জন ছাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে নিজের বাসার পেছনের স্টোররুমে লুকিয়ে থাকতে বলে বাইরে থেকে তালা আটকে দেন।

এর মধ্যেই রোকেয়া হলে প্রবেশ করে পাকিস্তানি সেনারা। সেই চরম আতঙ্কের খবর পাওয়ার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন: খবর পেলাম আর্মিরা ট্যাংক দিয়ে গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকেছে। পরে শুনেছিলাম ঢুকেই তারা প্রভোস্ট আক্তার ইমামকে জিজ্ঞেস করেছিলো, “লারকি লোক কিধার”।

কারণ মূলত এই হলের ছাত্রীরা ছিল তাদের টার্গেট। কিন্তু কোন ছাত্রীকে তারা হলের কক্ষে পায়নি। আক্তার ম্যাডামও ছিলেন বেশ সাহসী নারী। তিনি আর্মিদের বেশ সাহসের সঙ্গেই বুঝিয়ে দেন যে হলে কোন ছাত্রী নেই। যারা ছিলো ফেব্রুয়ারি-মার্চের প্রথমেই চলে গেছে।” নাসিমুল শুভ, “সেই কাল রাতে রোকেয়া হল”, ২৫ মার্চ ২০১৮, www.channelionline.com|

বহু পরে বন্ধু মেঘনা গুহঠাকুরতার সাথে এ নিয়ে কথা হচ্ছিল। তিনি বলেন, ২৫ মার্চ রাতে হয়নি বলে নয় মাসকালীন সময়ে অন্য কোনো রাতে এমন ঘটনা ঘটেনি এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন।

৩২. Garth Stevens, Norman Duncan, Christopher Sonn, “The apartheid archive: Memory, voice and narrative as liberatory praxis,” PINS 2010, 40, পৃ. ৮।

৩৩. উপরোক্ত, একই পৃষ্ঠা।

৩৪. উপরোক্ত, পৃ.৮-৯।।

৩৫. “On the Concept of History,” প্রাগুক্ত, পৃ.৩৯১।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •