ইন্টারনেট যুগে কর্তৃত্ববাদ-৩

ইন্টারনেট যুগে কর্তৃত্ববাদ-৩

ইভজেনি মোরজোভ

জর্জ অরওয়েল ১৯৪৯ সালে লেখা তাঁর ‘1984’ উপন্যাসে এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা কল্পনা করেছেন যেখানে সর্বব্যাপী নজরদারি ও প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আর অলডস হ্যাক্সলি তাঁর ১৯৩২ সালে লেখা উপন্যাস ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ এবং ১৯৫৮ সালে লেখা ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড রিভিজিটেড’ নামের প্রবন্ধে এক ভিন্নরকম দুনিয়া কল্পনা করেছেন। সেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে মানুষের আনন্দ সর্বোচ্চকরণের কাজে লাগানো হয়, মানুষের একা থাকার সময় সর্বনিম্নকরণ করা হয় এবং দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা ভোগবিলাসের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণের কাঠামো কাজ করে। এই লেখায় মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে জর্জ অরওয়েল ও অলডস হাক্সলির খুবই প্রভাবশালী এই দুই ভিন্ন ধরনের রূপকল্প বর্তমান সময়ের অভিজ্ঞতায় পরীক্ষা করা হয়েছে।  লেখাটি ইভজেনি মোরজোভ-এর ‘দ্য নেট ডিল্যুশন: হাউ নট টু লিবারেট দ্য ওয়ার্ল্ড’ (পেঙ্গুইন ২০১২) পুস্তকের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায় অবলম্বনে তৈরি করেছেন কল্লোল মোস্তফা।

ইন্টারনেট থেকে স্পিন্টারনেট

কেন সরকারি প্রপাগান্ডা‒বিশেষত মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে চালানো প্রচার এবং সত্যের উদ্দেশ্যমূলক ভুল উপস্থাপনা‒এখনো এমন একটি যুগে কার্যকর, যখন কেউ এগুলোকে ভুল প্রমাণ করার মতো প্রচুর বিশ্বাসযোগ্য উপাদান অনলাইনে সহজেই খুঁজে পেতে পারেন? এগুলো সেই একই দুর্ভাগ্যজনক কারণগুলোর জন্য কাজ করে, যে কারণে বারাক ওবামার হারিয়ে যাওয়া জন্মসনদ কিংবা ৯/১১ সম্পর্কিত গল্পগাথাগুলো অনেক মার্কিন নাগরিকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হয়। বিপরীত প্রমাণের সহজ প্রাপ্যতা এ ধরনের গল্পগাথা দূর করার জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ, এগুলো সবসময় প্রমাণের যৌক্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে না। উপরন্তু একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীন জনজীবনের কিছু কাঠামোগত বাস্তবতা এ ধরনের সরকার-প্ররোচিত মিথকে দূর করা কঠিন করে তুলতে পারে। বারবারা গেডেস, লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, যিনি বিশ্বজুড়ে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রগুলোর জন্য জনপ্রিয় সমর্থনের উৎস সম্পর্কে গবেষণা করেছেন, আবিষ্কার করেছেন যে জনগণের একটি নির্দিষ্ট অংশ সবচেয়ে বেশি সরকারি প্রচারণার ওপর আস্থাশীল হয়। সাধারণত এই অংশটিকে আমরা মধ্যবিত্ত হিসেবে বর্ণনা করতে পারি: এরা মোটামুটি শিক্ষিত ও ভালো জীবনযাপন করে থাকে, তারা খুব বেশি দরিদ্র ও অজ্ঞ নয় আবার খুব বেশি ধনী ও পরিশীলিতও নয়। গেডেস দেখেছেন, অতি দরিদ্র বা অতি ধনীরা সরকারি প্রপাগান্ডাকে তেমন একটা পাত্তা দেন না‒অতি দরিদ্ররা ও অজ্ঞ ব্যক্তিরা দেন না; কারণ, সরকার কী চায়, তা তাদের কাছে পরিষ্কার থাকে না এবং অতি ধনী ও পরিশীলিতরা পাত্তা দেন না; কারণ, তারা জানেন প্রকৃত পরিস্থিতি আসলে কী।

কাজেই সরকারি প্রচারণার বাড়বাড়ন্ত থাকলেই যে জনগণ এ বিষয়ে সচেতন হয়ে বুঝে যায় যে তাদের মগজ ধোলাই করা হচ্ছে‒এ রকমটি ভাবা সঠিক নয়। অথচ কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের সরকারি প্রচার সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে প্রচলিত ধারণা অনেকটা এ রকমই। ইথিয়েল দে সোলা পুল তো বলেছেন, ‘সরকারগুলো যখন বড় আকারের প্রপাগান্ডা দৈনিক চালাতে থাকে, লোকজন তখন সেগুলো পাত্তা দেওয়া বন্ধ করে দেয়।’ গেডেস এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, ‘আমাদের অনুধাবন করা উচিত যে, তথ্যপ্রবাহের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ বুমেরাং হিসেবে তখনই কাজ করতে পারে, যখন জনগণের মধ্যে অস্বাভাবিক সচেতনতা তৈরি হয়।’ ফলে শুধু যথাযথ তথ্য হাজির করা হলেই যে কর্তৃত্ববাদী সরকারের জনপ্রিয়তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে, এ রকম মনে করার কোনো কারণ নেই। শুধু একটি দেশের সব জনগণ অনলাইনে চলে এলেই সমালোচনামূলক চিন্তাধারায় বিপ্লব ঘটে যায় না; সাম্প্রতিক বৈশ্বিক প্রবণতা খতিয়ে দেখলে তার বিপরীত বাস্তবতাই সামনে চলে আসে।

শুধু একটি দেশের সব জনগণ অনলাইনে চলে এলেই সমালোচনামূলক চিন্তাধারায় বিপ্লব ঘটে যায় না; সাম্প্রতিক বৈশ্বিক প্রবণতা খতিয়ে দেখলে তার বিপরীত বাস্তবতাই সামনে চলে আসে।

কাজেই এতে খুব একটা অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, রাশিয়া থেকে ইরান এবং চীন থেকে আজারবাইজান পর্যন্ত কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো ইন্টারনেটকে স্পিন্টারনেটে পরিণত করতে ব্যস্ত—তাদের প্রয়োজন এমন একটি অনলাইন জগৎ, যেখানে সরাসরি সেন্সরশিপ থাকবে কম; কিন্তু স্পিন বা ঘূর্ণি এবং প্রপাগান্ডা বা প্রচারণা থাকবে প্রচুর, যা তাদের মতাদর্শিক আধিপত্যকে শক্তিশালী করে তুলবে। নতুন মিডিয়ার যুগ জনমতের বিভাজন ও নিয়ন্ত্রণের বিকেন্দ্রীভবনের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী সরকারের প্রচার কর্মকর্তাদের জীবনকে যথেষ্ট সহজ করে তুলেছে।

জনতার ক্ষমতায়ন!

২০০৯ সালের জানুয়ারিতে লি কিয়াওমিং নামের চব্বিশ বছর বয়সি এক কৃষককে অবৈধভাবে গাছ কাটার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। কিয়াওমিং চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমের ইউনান প্রদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ইউক্সি সিটির কাছে বসবাস করতেন। গ্রেফতার হওয়ার সময় তার বোঝার কথা নয় যে তিনি আর মাত্র দুই সপ্তাহ বেঁচে থাকবেন। পুনিং কাউন্টি কারাগারের ৯ নম্বর কক্ষে বন্দি থাকাবস্থায় সহবন্দিদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা খেলতে গিয়ে দরজার সঙ্গে মাথা ঠুকে তার মৃত্যু হয়‒অন্তত স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা তার পিতামাতাকে এ রকম একটা ব্যাখ্যাই দিয়েছিলেন।

কয়েক ঘণ্টার মধ্যে লি-র মৃত্যু চীনা ব্লগজগতের একটি বড় ইস্যুতে পরিণত হয়। নেটিজেনরা ইউনান পুলিশের বিরুদ্ধে আসল ঘটনা আড়াল করার অভিযোগ উত্থাপন করে। চীনের অন্যতম জনপ্রিয় সাইট QQ.com-এ এ বিষয়ে ৭০ হাজারেরও বেশি মন্তব্য পড়ে এবং পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে৷ চীনা কর্তৃপক্ষের সামনে হাজির হয় বড় আকারের সাইবার-দাঙ্গা।

চীনা কর্তৃপক্ষ পুরো ঘটনাটি যেভাবে মোকাবিলা করে, তা ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ক্রমবিবর্তনকেই তুলে ধরে, যা হয়তো ভবিষ্যতে ইন্টারনেট প্রপাগান্ডার পাঠ্যবইয়ে স্থান করে নেবে। ক্ষুব্ধ নেটিজেনদের হাজার হাজার রাগান্বিত মন্তব্য সেন্সর করার বদলে সরকার ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ‘নেটিজেন তদন্তকারী’ হওয়ার আমন্ত্রণ জানায় এবং তাদের পুনিং কাউন্টি কারাগারের ৯ নম্বর কক্ষ পরিদর্শন করে একটি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করতে বলে। সমাধানটি বেশ যুক্তিসংগতই মনে হয়েছিল, যা সাময়িকভাবে হলেও উত্তেজনাকে প্রশমিত করতে সাহায্য করে। এক হাজারেরও বেশি আবেদনকারীর মধ্য থেকে পনেরো জনকে বাছাই করে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং কিয়াওমিংয়ের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরির জন্য তাদের সেই বন্দিশালায় পাঠানো হয়।

ক্ষুব্ধ নেটিজেনদের হাজার হাজার রাগান্বিত মন্তব্য সেন্সর করার বদলে সরকার ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ‘নেটিজেন তদন্তকারী’ হওয়ার আমন্ত্রণ জানায় এবং তাদের পুনিং কাউন্টি কারাগারের ৯ নম্বর কক্ষ পরিদর্শন করে একটি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করতে বলে। সমাধানটি বেশ যুক্তিসংগতই মনে হয়েছিল, যা সাময়িকভাবে হলেও উত্তেজনাকে প্রশমিত করতে সাহায্য করে।

‘অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নেটিজেনদের সন্দেহ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনা আপনি দূর হয়ে যায় না,’ কথাগুলো বলেছিলেন ইউনানের প্রপাগান্ডা ডিপার্টমেন্টের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা উ হাও, যিনি সমস্যাটি দেখভাল করছিলেন। তিনি আরও বলেন, ‘ইন্টারনেট জনমতবিষয়ক সমস্যার সমাধান করতে হবে ইন্টারনেট পদ্ধতির মাধ্যমে।’ এ পদ্ধতিটি উন্মুক্ত এবং বিকেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত গ্রহণকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ভান করেছিল; চীনের শাসনব্যবস্থায় যে বিকেন্দ্রীভবন করা হচ্ছে, তার প্রদর্শনের জন্য খুব ভালো একটি উপলক্ষ্য করে দেয় ‘নেটিজেন’ কমিশন গঠনের ঘটনাটি।

আসলে কমিশন গঠনের ব্যাপারটি ছিল স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা। তদন্তকারীদের এমনকি বন্দিশালার সিসিটিভির ভিডিওগুলোও দেখতে দেওয়া হয়নি। ফলে বোধগম্য কারণেই তদন্ত কমিটি কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। কিন্তু পুলিশ, যারা কিয়াওমিংয়ের মৃত্যুর আসল কারণ আগে থেকেই জানতে পেরেছিল, রিপোর্ট প্রকাশের ফলে তৈরি হওয়া ইন্টারনেট গুঞ্জনটির সুযোগ নিয়ে তার পিতামাতার কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে জানাল যে, লি কিয়াওমিং আসলে অন্য বন্দিদের মারধরের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল। পুলিশের বিনয় প্রদর্শনের এর চেয়ে বড় সুযোগ আর কী হতে পারে!

এটি ছিল ডিজিটাল জনসংযোগের বেশ সফল একটি দৃষ্টান্ত। যে ঘটনা সরকারের জন্য একটি বড় দায় হয়ে উঠতে পারত, সেটাকে কাজে লাগানো হলো গণতন্ত্রীকরণের প্রতি সরকারের প্রতিশ্রুতি প্রকাশের সুযোগ হিসেবে। অবশ্য পুরো আয়োজনটি নিখুঁত ছিল না: চীনের ‘হিউম্যান ফ্লেশ সার্চ ইঞ্জিন’ বা সাধারণ মানুষের অনুসন্ধানের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে, কমিশনের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত পনেরো নেটিজেনের প্রায় সবাই ছিলেন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মিডিয়ার সাবেক অথবা বর্তমান কর্মী! চীনা কর্তৃপক্ষ হয়তো ভবিষ্যতে এ ধরনের কাচা কাজ আর করবে না।

মজার ব্যাপার হলো, দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার, সম্ভবত চীনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে, ইন্টারনেট গুজব মোকাবিলা করতে এবং নিজ দেশের নেটিজেনদের শান্ত করার জন্য অনুরূপ একটি পদ্ধতি ব্যবহার করেছে, যে পরিস্থিতি অনেক বেশি বিস্ফোরক ছিল। যখন ব্লগজগতের অনেকেই এমনকি ঐতিহ্যবাহী মিডিয়ায়ও কেউ কেউ উত্তর কোরিয়ার টর্পেডো দ্বারা দক্ষিণ কোরিয়ার যুদ্ধজাহাজ চেওনানকে ডুবিয়ে দেওয়ার সরকারি ব্যাখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করে, সন্দেহ করে যে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকতে বা আরও অশুভ কোনো কিছু ঢাকতে উত্তর কোরিয়াকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে, সরকার তখন ব্লগারদের আর খেপিয়ে না-তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। তার পরিবর্তে ঘোষণা করে, বিশজন টুইটার ব্যবহারকারী, দশজন ইন্টারনেট ব্লগার, ত্রিশজন ছাত্র সাংবাদিক, ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন পোর্টালের পাঁচজন প্রতিনিধি এবং পাঁচজন সরকারি কর্মকর্তাকে নিয়ে ধ্বংসস্তূপ পরিদর্শনের আয়োজন করা হবে। দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার চীনাদের চেয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে জানায় যে, সব অংশগ্রহণকারীকে আলোকচিত্র এবং ভিডিও তোলার অনুমতি দেওয়া হবে, যা হবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নাগরিক সাংবাদিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তবে দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের এই পরিকল্পনা সম্ভবত উত্তর কোরিয়ার সরকার ভেস্তে দিয়েছে, যারা অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে পুঁজিবাদী সাইবার স্পেসে উপনিবেশ স্থাপন করে, বিদেশি বন্ধুদের সহায়তা নিয়ে টুইটারে অ্যাকাউন্ট খুলে দক্ষিণ কোরিয়াবিরোধী প্রপাগান্ডার মাধ্যমে ওই জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের ভাষ্যকে চ্যালেঞ্জ জানায়।

স্ট্রিস্যান্ড ইফেক্ট

‘Streisand effect’ বলতে বোঝানো হয় ইন্টারনেট থেকে কোনো বিষয় মুছে ফেলা বা ব্লক করার যত বেশি চেষ্টা করা হয়, তত বেশি সেই বিষয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পায় এবং মুছে ফেলা বা ব্লক করার চেষ্টা তত বিফল হয়। মার্কিন গায়িকা বারবারা স্ট্রিস্যান্ড কর্তৃক তার ক্যালিফোর্নিয়ার মালিবুতে অবস্থিত বাড়ির ছবি ইন্টারনেট থেকে মুছে ফেলার জন্য মরিয়া, কিন্তু ব্যর্থ চেষ্টার ঘটনা অবলম্বনে মাইক মাসনিক নামের একজন জনপ্রিয় আমেরিকান প্রযুক্তি ব্লগার সর্বপ্রথম ‘স্ট্রিস্যান্ড ইফেক্ট’ কথাটি ব্যবহার করেছিলেন।

ক্যালিফোর্নিয়া কোস্টাল রেকর্ডস প্রকল্পের আওতায় উপকূলীয় অঞ্চলের ভূমিক্ষয়ের বিষয়টি নথিভুক্ত করার জন্য একজন পেশাদার ফটোগ্রাফার তার বাড়ির ছবিটি তুলেছিলেন। বারবারা স্ট্রিস্যান্ড পাঁচ কোটি ডলারের ক্ষতিপূরণ মামলা করার আগ পর্যন্ত এই ছবিটির কথা লোকজন তেমন জানত না। কিন্তু মামলা করার পর ইন্টারনেট ব্লগারদের কাছে মনে হলো, বারবারা স্ট্রিস্যান্ড যেন ইন্টারনেট ও সাধারণ জ্ঞান উভয়ের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সরানো প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে একটি বিশাল অনলাইন নেটওয়ার্ক তৈরি হতে বেশি সময় লাগেনি। শত শত ব্লগার তাদের নিজস্ব ব্লগে তার বাড়ির ছবিটি পোস্ট করতে শুরু করেন। ফলে স্ট্রিস্যান্ডের মালিবুর বাড়িটি আগের চেয়ে অনেক বেশি আলোচিত বিষয় হয়ে ওঠে।

অথচ স্ট্রিস্যান্ড যদি এই ছবির বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নিতেন, তাহলে এমনিতেই ছবিগুলো অনলাইন জগতে হারিয়ে যেত (ওনার বাড়ির ছবিগুলো ছিল ১২ হাজার ছবির অংশ)৷ কিন্তু তার বদলে তিনি সেন্সরশিপের রাস্তা বেছে নেওয়ার ফলে এর জন্য তাকে চরম মূল্য দিতে হলো। তিনি ছাড়াও আরও অনেক সেলিব্রেটি এবং ভিআইপি ব্যক্তি এই স্ট্রিস্যান্ড ইফেক্টের ভুক্তভোগী হয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে দ্য চার্চ অব সায়েন্টোলজি, রুশ অলিগার্ক আলিশার উসমানভ, সনি করপোরেশন, ব্রিটেনের ইন্টারনেট ওয়াচ ফাউন্ডেশন এবং জনপ্রিয় সোশ্যাল নিউজ সাইট ডিগ ডটকম।

প্রকৃতপক্ষে, WikiLeaks নামে গোটা একটি সংগঠনই গড়ে উঠেছে যেন ইন্টারনেট জগৎ থেকে যেসব বিতর্কিত বিষয় কেউ সরিয়ে ফেলতে চায়, সেগুলো যেন অনলাইনে সুরক্ষিত থাকতে পারে, তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে। এমনকি পরাক্রমশালী মার্কিন সামরিক বাহিনীর পক্ষেও ইন্টারনেট থেকে স্পর্শকাতর বিষয়বস্তু সরিয়ে নেওয়া দুরূহ হয়ে গেছে। উইকিলিকস ২০০৭ সালের বাগদাদে মার্কিন বিমান হামলার একটি ভিডিও প্রকাশ করে দেয়, যে হামলায় রয়টার্সের বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মী নিহত হয়েছিল। সেই সঙ্গে আফগানিস্তানের যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত নথিপত্রের একটি ভান্ডারও উন্মোচিত করে দেয় উইকিলিকস।

WikiLeaks নামে গোটা একটি সংগঠনই গড়ে উঠেছে যেন ইন্টারনেট জগৎ থেকে যেসব বিতর্কিত বিষয় কেউ সরিয়ে ফেলতে চায়, সেগুলো যেন অনলাইনে সুরক্ষিত থাকতে পারে, তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে। এমনকি পরাক্রমশালী মার্কিন সামরিক বাহিনীর পক্ষেও ইন্টারনেট থেকে স্পর্শকাতর বিষয়বস্তু সরিয়ে নেওয়া দুরূহ হয়ে গেছে।

স্ট্রিস্যান্ড ইফেক্টের পেছনের যুক্তি অবশ্য ইন্টারনেটের সঙ্গে খুব একটা সম্পর্ক নেই। মানব ইতিহাস জুড়েই দেখা গেছে, কোনো বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করার অর্থ হলো মানুষ সেই বিষয়ে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে। হেরোস্ট্রাটাসের ঘটনাটি হতে পারে বিশ্বের ইতিহাসে স্ট্রিস্যান্ড ইফেক্টের প্রথম নথিভুক্ত ঘটনা। গ্রিক যুবক হেরোস্ট্রাটাস ৩৫৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ইফেসাসের আর্টেমিসের মন্দিরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন। মৃত্যুদণ্ড ছাড়াও হেরোস্ট্রাটাসের বিরুদ্ধে যে চূড়ান্ত শাস্তি ঘোষণা করা হয়, সেখানে বলা হয়, তার ঘটানো কাজটিকে ভুলে যেতে হবে এবং তার নামও কেউ উচ্চারণ করতে পারবে না। ফল হলো এই যে, হাজার বছর পরও আমরা তাকে নিয়ে আলোচনা করছি (ইফিসিয়ান কর্তৃপক্ষ আন্দাজ করতে পারেনি যে হেরোস্ট্রাটাস তার উইকিপিডিয়া পাতায় অমর হয়ে যাবে)।

কিন্তু এই সিদ্ধান্তে আসা ভুল হবে যে, স্ট্রিস্যান্ড ইফেক্ট মানে তথ্য নিয়ন্ত্রণের অবসান। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া তথ্যের নেতিবাচক প্রভাব কমানোর জন্য অন্যান্য আরও বহু ধরনের উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে, যেগুলো মানুষের কাছে তত বেশি স্পষ্ট নয়। সেন্সর করলে যেহেতু কোনো পোস্ট বা লেখার বিশ্বাসযোগ্যতা আরও বৃদ্ধি পায়, তাই সরাসরি সেন্সর না করে অনেক সময় স্পিন্টারনেট বিকল্পটি বেছে নেওয়া হতে পারে: উক্ত ব্লগ পোস্টের বিরুদ্ধে সরাসরি নিষেধাজ্ঞার বদলে চালানো হতে পারে কার্যকর প্রপাগান্ডা।

যেসব দেশে এমনকি গণতন্ত্রীকরণের প্রবল সমর্থকরাও বিদেশি হস্তক্ষেপের ব্যাপারে স্পর্শকাতর থাকে, সেখানে একজন ব্লগারের বদনাম করার জন্য তাকে সিআইএ, এমআইসিক্স বা মোসাদ (বা এর চেয়েও ভালো, তিনটিই একই সঙ্গে!) বলে অভিযুক্ত করাই যথেষ্ট। যদি এই অভিযোগটি আরও একশ ব্লগার দ্বারা পুনরাবৃত্তির ব্যবস্থা করা যায়, এমনকি এসব অভিযোগকারী ব্লগারের কাউকে কাউকে সন্দেহজনক মনে হলেও সরকারের বেশিরভাগ বিচক্ষণ সমালোচকই কিন্তু সেই ব্লগারের সমালোচনামূলক বার্তাটি পুনরায় পোস্ট করার আগে দুবার চিন্তা করবেন। এ ধরনের অবিশ্বাসের সংস্কৃতি তৈরির জন্য সরকারের দিক থেকে সর্বোত্তম উপায় হলো, অত্যন্ত চটপটে দ্রুত প্রতিক্রিয়া প্রদানে সক্ষম এমন কিছু ব্লগিং দল গড়ে তোলা, যারা আগুন দিয়ে আগুনের সঙ্গে লড়াই করতে পারে।

বিনোদনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ: রাশিয়ার অভিজ্ঞতা

কেন অনেক কর্তৃত্ববাদী সরকার তাদের অনলাইন প্রচার-প্রচারণাকে সফলতার সঙ্গে চালিয়ে যেতে পারছে তার একটা কারণ হলো, এরা অনেক মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিকে দলে ভেড়াতে সক্ষম হয়েছে। এই সরকারগুলো সবসময় ভুল লোকের কাছ থেকে দুর্বল পরামর্শ পেয়ে থাকে‒এ রকমটা মনে না করা ভালো, অনেক ক্ষেত্রেই তারা সেরা বুদ্ধিটাই পেয়ে থাকে। তার একটা কারণ হলো, অনেক মেধাবী লোক সরকারের পক্ষে কাজ করে। কারণ, এতে অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা যায়।

রাশিয়ার প্রাণবন্ত ইন্টারনেট সংস্কৃতির সঙ্গে দৃঢ় সংযোগ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সফল বলা যেতে পারে ক্রেমলিনকে। ক্রেমলিন এই যোগসূত্রটিকে সফলতার সঙ্গে সরকারের নিজস্ব মতাদর্শগত সুবিধার জন্য কাজে লাগিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, জনপ্রিয় অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার ক্যাসপারস্কি ল্যাব-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ইন্টারনেট নিরাপত্তার বিষয়ে অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব ইয়েভজেনি ক্যাসপারস্কির কথা বলা যেতে পারে। তিনি ক্রেমলিনপন্থি সেলিব্রেটি, ব্যবসায়ী এবং বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি আধা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার পাবলিক চেম্বারে যোগদান করেছিলেন। নাগরিক সমাজের হয়ে সরকারের যে কোনো উদ্যোগের পক্ষে সমর্থন প্রদান করাই এই চেম্বারের কাজ। এই চেম্বারে যোগদানের পর ক্যাসপারস্কি বলতে শুরু করেন, ইন্টারনেটকে নিরাপদভাবে চালু রাখতে হলে বেনামে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করতে হবে।

কিন্তু রুশ ইন্টারনেট প্রপাগান্ডা মেশিনের দক্ষতার প্রতিনিধিত্ব কনস্ট্যান্টিন রাইকভের চেয়ে ভালোভাবে কেউ করতে পারবে না। ১৯৭৯ সালে জন্মগ্রহণ করা রাইকভ রুশ ইন্টারনেটের একজন অবিসংবাদিত গডফাদার এবং ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে এর সবচেয়ে উদ্ভট প্রতিসাংস্কৃতিক প্রকল্পগুলোর মধ্যে প্রধান ভূমিকা পালনকারী একজন ব্যক্তি। ১৯৯৮ সালে তিনি fuck.ru-এর মতো ইঙ্গিতমূলক একটি অনলাইন ম্যাগাজিন প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে মস্কোর নাইট লাইফ সম্পর্কে কৌতুক, হালকা বিনোদন এবং শিল্পবিষয়ক নিবন্ধ প্রকাশিত হতো। এমনকি অসংখ্য মিডিয়ার কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি একসময় নিজেকে রাশিয়ার প্রথম পর্নোগ্রাফার হিসেবে দাবি করেছেন।

রাইকভের আগের সহযোগীদের মধ্যে খুব কম ব্যক্তির পক্ষেই অনুমান করা সম্ভব ছিল যে, মাত্র এক দশক পরই তিনি রুশ ডুমার একজন সম্মানিত ডেপুটি হয়ে উঠবেন‒আসলে এর সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্যদের মধ্যে একজন। তিনি ইন্টারনেট বিষয়ে ক্রেমলিনের অনানুষ্ঠানিক রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৯০-এর দশকের উত্তেজনার অবসান ঘটিয়ে ডেপুটি রাইকভ এখন নিজেকে পারিবারিক মূল্যবোধের একজন শক্তিশালী রক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, মিডিয়ায় সহিংসতা এবং পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের সপক্ষে যুক্তি দিয়ে গেছেন এবং নয় বছরের কম বয়সি সব শিশুর জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করেছেন।

রাইকভকে ক্রেমলিনের কাছে এত আকর্ষণীয় করে তুলেছিল যে বিষয়টি তা হলো, এর মধ্যবর্তী বছরগুলোতে তিনি একটি সফল প্রচার সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন, যা ঐতিহ্যগত এবং নতুন উভয় মিডিয়া জগৎজুড়েই বিস্তৃত ছিল। প্রথাগত মিডিয়া জগতে রাইকভ ‘পপলিট’ নামের একটি প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা জনপ্রিয় কথাসাহিত্য প্রকাশ করত এবং বেশ আগ্রাসি প্রচারণার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে প্রকাশনাগুলোকে বৃহত্তর জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিত। রাইকভের ইন্টারনেট উপস্থিতি মূলত তার কোম্পানি নিউ মিডিয়া স্টারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। এই কোম্পানির মালিকানায় রয়েছে zaputina.ru (‘পুতিনের জন্য!’)-এর মতো ওয়েবসাইট‒একটি সংক্ষিপ্ত ইন্টারনেট প্রচারাভিযান, যা পুতিনকে তৃতীয় মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট হওয়ার অনুরোধ করেছিল; dni.ru একটি জনপ্রিয় ইন্টারনেট ট্যাবলয়েড; dozory.ru একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিনির্ভর ইন্টারনেট গেম; এবং vz.ru রক্ষণশীল ধাঁচের অনলাইন সংবাদমাধ্যম ইত্যাদি।

রাইকভ ভোগবাদী ইন্টারনেট টিভি স্টেশন Russia.ru-এর অন্যতম একজন প্রতিষ্ঠাতা, যেটি ‘দ্য টিটস শো’র মতো অনুষ্ঠান তৈরি করে। রাইকভ এই মিডিয়া ব্যবহার করে অসংখ্য প্রপাগান্ডা ভিডিও তৈরি করে থাকেন। রাইকভের প্রপাগান্ডা ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য সফলতা আসে যখন তার কোম্পানি ‘ওয়ার 08.08.08: দ্য ওয়ার অব ট্রিজন’ নামের একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করে, যেটি রাশিয়া এবং জর্জিয়ার মধ্যে ২০০৮ সালের যুদ্ধের অত্যন্ত স্পর্শকাতর কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করেছিল। বলা হয়েছিল যে, জর্জিয়ান সৈন্যরা নিজেরাই তাদের মোবাইল ফোনে ধারণ করেছিল এমন কয়েক ঘণ্টার ভিডিও ফুটেজ থেকে বাছাই করে এই চলচ্চিত্রটি তৈরি করা হয়েছিল। ফিল্মটিতে মতাদর্শিক অবস্থান থেকে যুদ্ধের বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যেখানে জর্জিয়ার নাগরিকদের অবিশ্বাস্য খারাপ হিসেবে চিত্রিত করা হয়।

চলচ্চিত্রটি অনলাইনে খুব দ্রুতই ভাইরাল হয়ে যায়, ২৫ লাখ মানুষ অনলাইনে সেটি দেখতে থাকে। অনলাইন প্রচারাভিযানের এই সাফল্যের রহস্য হলো, চলচ্চিত্রটির প্রযোজকরা ডিজিটাল বিতরণ ব্যবস্থার সব উপায়কেই কাজে লাগিয়েছেন, এটিকে সব গুরুত্বপূর্ণ পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্কে স্থাপন করেছেন এবং পাইরেসিকে উৎসাহিত করেছেন৷ Russia.ru-তে রাখার কারণে চলচ্চিত্রটি সহজেই দৃশ্যমান ছিল। চলচ্চিত্রটি সফলতার সঙ্গে টিভি পর্দায়ও প্রদর্শিত হয়: যুদ্ধের প্রথম বার্ষিকীতে, চলচ্চিত্রটি রাশিয়ার একটি জাতীয় দেশপ্রেমিক চ্যানেলে দেখানো হয়েছিল। এবং নিরঙ্কুশ মিডিয়া আধিপত্য নিশ্চিত করার জন্য এ বিষয়ে একটি বইও প্রকাশ করা হয়েছিল, রাশিয়ান ব্লগার এবং সাংবাদিকরা যেটিকে বেশ ভালোভাবেই গ্রহণ করেছিলেন। এটি মিডিয়া কনভারজেন্স বা সমকেন্দ্রিকতার এমন একটি স্তর, যা বেশিরভাগ পশ্চিমা নির্মাতার কাছে স্রেফ স্বপ্ন।

আজকের রাশিয়ায় ইন্টারনেট সম্পর্কে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিদের একজন হিসেবে রাইকভ ‘স্ট্রিস্যান্ড প্রভাব’ বোঝেন। ফলে তিনি সরকারকে সরাসরি এবং দৃশ্যমান ইন্টারনেট সেন্সরশিপ আরোপ করা থেকে দূরে সরিয়ে প্রপাগান্ডানির্ভর নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির দিকে পরিচালনার চেষ্টা করছেন। ২০০৯ সালে তিনি স্পষ্ট বলেছেন: ‘সেন্সরশিপ ইন্টারনেটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যতদিন ইন্টারনেট থাকবে, ততদিন সেন্সরশিপ অসম্ভব।’ রাশিয়ান নেতারা এ বিষয়ে রাইকভকে অনুসরণ করেন এবং বেশ উৎসাহের সঙ্গে ‘রাশিয়ায় ইন্টারনেট সেন্সরশিপ নেই’ বলে এর ঢোল পিটিয়ে চলেছেন, যেন নিজেদের চীনা প্রতিবেশীর চেয়ে বেশি প্রগতিশীল হিসেবে উপস্থাপন করা যায়।

রাইকভের মতো লোকজন যখন অনলাইন প্রপাগান্ডার কৌশল তৈরি করেন, তখন এমনকি সরাসরি ইন্টারনেট সেন্সরশিপ না-থাকলেও সাধারণ রুশদের পক্ষে ইন্টারনেটে তারা যা পড়ছেন বা দেখছেন, তার সত্যতা খতিয়ে দেখা কঠিন। তা ছাড়া রাইকভের প্রচেষ্টাগুলোর সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে তরুণ উদীয়মান ইন্টারনেট গুরুদের একটা দল, যারা ক্রেমলিনের তৈরি বিভিন্ন যুব আন্দোলনের কঠোর পরিশ্রমের ফসল। (রাষ্ট্র সমর্থিত যুব আন্দোলনের সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল সম্ভাব্য কালার রেভল্যুশন বা রঙিন বিপ্লবের হুমকি হ্রাস। কারণ, পশ্চিমাপন্থি বিভিন্ন যুব আন্দোলন সার্বিয়া, জর্জিয়া ও ইউক্রেনে সরকার পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।) সেই তরুণ ইন্টারনেট গুরুদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চরিত্র হলেন ২৫ বছর বয়সি মারিয়া সের্গেইভা, যিনি ইয়াং গার্ড নামের ক্রেমলিন গঠিত একটি যুব সংগঠনের সদস্য।

অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং দর্শনের ছাত্রী সের্গেইভা খুব জনপ্রিয় একটি ব্যক্তিগত ব্লগে লিখে থাকেন, যেখানে তিনি রাশিয়ার রুগ্‌ণ গাড়ি শিল্পের পক্ষে তার সমর্থনের কথা জানান, ক্যাথরিন দ্য গ্রেটের প্রশংসা করেন, সব অভিবাসীকে ‘বাড়িতে ফিরে যেতে’ বলেন এবং মাঝে মাঝে শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পার্টিগুলোতে অংশ গ্রহণের ছবি পোস্ট করেন। টাইমস অব লন্ডনের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে জন্মের প্রথম দিন থেকেই দেশপ্রেমিক হিসেবে বড় করা হয়েছিল।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘রাশিয়ার প্রতি আমার ভালোবাসা আমার মায়ের দুধের মাধ্যমে এসেছিল। আমি আমার দাদা-দাদির যুদ্ধের বীরত্বের গল্প শুনতে পছন্দ করতাম। [ভ্লাদিমির] পুতিন আমাদের স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দিয়েছেন। এটা ভালো যে, তিনি কট্টর এবং কঠোর।’

সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকা রেডিও, টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রের আওতার বাইরের তরুণদের কাছে পৌঁছানোর জন্য ক্রেমলিনের সের্গেইভার মতো লোকজনের খুব প্রয়োজন। তরুণদের ক্রেমলিনের আধিপত্যের মধ্যে ফিরিয়ে নিয়ে আসাটা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, ২০০৯ সালে ভ্লাদিমির পুতিন একটি জাতীয় হিপ-হপ কনভেনশনে দেওয়া ভাষণে ঘোষণা করেছিলেন: ‘ব্রেক ড্যান্সিং, হিপ-হপ এবং গ্রাফিতি’ ‘ভদকা, ক্যাভিয়ার এবং নেস্টিং পুতুলের’ চেয়ে বেশি বিনোদনমূলক।

প্রয়োজন বোধে ক্রেমলিন ইন্টারনেট, যুব আন্দোলন এবং ধর্মের সঙ্গে জোট করার জন্যও প্রস্তুত। ২০০৯ সালে ক্রেমলিনের নাশি যুব আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা বরিস ইয়াকেমেনকো, রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চকে ইন্টারনেট সম্পর্কে কী করতে হবে, তা পরামর্শ দিয়ে একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছিলেন। সেখানে তিনি ‘ইন্টারনেট-মিশনারি’ তৈরির আহ্বান জানান: ‘… যারা যুক্তি দিয়ে মানুষকে বোঝাতে পারবে। … যারা ইন্টারনেট জগৎ থেকে মানুষকে গির্জার দিকে নিয়ে যেতে পারবে… তরুণদের সংগ্রামে অনলাইনে চার্চের বিজয় অপরিহার্য।’ রুশ অর্থোডক্স চার্চের প্রধানের ইয়াকেমেনকোর আহ্বানে সাড়া দিতে এবং তার অনুসারীদের অনলাইনে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানাতে এক বছরেরও কম সময় লেগেছিল।

রাইকভ এবং সের্গেইভার মতো ব্যক্তিরা যেন জাতীয় আলোচ্য বিষয়ের ওপর আরও বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেন, সে জন্য ক্রেমলিন তাদের বক্তৃতা বা কার্যক্রমের বাছাই করা অংশ রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রথাগত মিডিয়ায় প্রচার করে করে তাদের জাতীয় সেলিব্রেটি ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। রাইকভের ঘনিষ্ঠ একজন বিশিষ্ট রক্ষণশীল ব্লগার ম্যাকসিম কোননেনকো একটি জাতীয় চ্যানেলে তার নিজস্ব প্রাইম টাইম টিভি শো হোস্ট করার সুযোগ পেয়েছিলেন, যা ব্লগ জগতে তার জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়েছে। এভাবে নতুন ও পুরোনো মিডিয়া একে অপরকে শক্তিশালী করে; ক্রেমলিনের নতুন প্রচারণাবিদরা টেলিভিশন বা প্রিন্ট মিডিয়ায় যত বেশি খ্যাতি পায়, তত বেশি মানুষ অনলাইনে তাদের কাজের প্রতি মনোযোগ দেয়। ক্রেমলিনের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্লগাররা অন্যায্য সুবিধা এবং প্রায় সীমাহীন সম্পদ নিয়ে যাত্রা শুরু করে; ফলে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, তারা তাদের উদারপন্থি বিরোধীদের চেয়ে সহজেই বেশি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

তারা প্রশিক্ষণের পেছনেও অর্থ ব্যয় করছে। ২০০৯ সালে একটি ক্রেমলিন-সংশ্লিষ্ট থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘দ্য ক্রেমলিন’স স্কুল অব ব্লগার’ নামের একটি প্রকল্প শুরু করে, যেখানে বর্তমান সরকারের নেতৃস্থানীয় মতাদর্শী এবং প্রচারকরা আলোচনা ও কর্মশালা পরিচালনা করে থাকে। এই প্রকল্পের শুরুটা ছিল আবার অন্য একটি ‘স্কুল’-এর প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া হিসেবে, যাকে আড়ম্বরপূর্ণভাবে ‘দ্য স্কুল অব ব্লগারস’ বলা হতো। এই স্কুল অব ব্লগারস গঠিত হয়েছিল গ্লাসনস্ত ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে, যে সংস্থাটি আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসির অর্থায়ন পেত (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক উগ্র রক্ষণশীল রাষ্ট্রদূত পামার যার একজন প্রতিষ্ঠাতা, যিনি ইন্টারনেটের সাহায্যে ‘স্বৈরশাসকদের উৎখাত করতে চান’)।

২০০৯ সালে একটি ক্রেমলিন-সংশ্লিষ্ট থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘দ্য ক্রেমলিন’স স্কুল অব ব্লগার’ নামের একটি প্রকল্প শুরু করে, যেখানে বর্তমান সরকারের নেতৃস্থানীয় মতাদর্শী এবং প্রচারকরা আলোচনা ও কর্মশালা পরিচালনা করে থাকে। এই প্রকল্পের শুরুটা ছিল আবার অন্য একটি ‘স্কুল’-এর প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া হিসেবে, যাকে আড়ম্বরপূর্ণভাবে ‘দ্য স্কুল অব ব্লগারস’ বলা হতো। এই স্কুল অব ব্লগারস গঠিত হয়েছিল গ্লাসনস্ত ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে, যে সংস্থাটি আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসির অর্থায়ন পেত।

দ্য ক্রেমলিন’স স্কুল অব ব্লগারদের পেছনের মাস্টারমাইন্ড বা প্রধান পরিকল্পনাকারী ছিলেন আলেক্সি চাদায়েভ। বত্রিশ বছর বয়সি চাদায়েভ ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টির শীর্ষ মতাদর্শিক নেতা এবং পুতিনের শাসনব্যবস্থার সমর্থনকারী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অন্যতম। ২০০৬ সালে চাদায়েভ এমনকি ‘পুতিন ও তার আদর্শ’ শিরোনামের একটি বই প্রকাশ করেন, যে বইটিকে পরবর্তী সময়ে ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টি ‘সরকারি আদর্শের আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা’ হিসেবে বিবেচনা করার প্রস্তাব করেছিল। চাদায়েভ, যার মাস্টার্সের থিসিসের বিষয় ছিল ওয়েব জগতে সাবকালচার বা উপসংস্কৃতি তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে, তিনি মূলত প্রযুক্তির মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন: তিনি একজন বিশিষ্ট উদারপন্থি রুশ রাজনীতিকের জন্য একটি ওয়েবসাইট ডিজাইন করেছিলেন। কয়েক বছর পর, দল পালটানো এবং ক্রেমলিনের হয়ে কাজ করার আগে তিনি এমনকি পুতিনবিরোধী অনলাইন প্রচারণাও চালিয়েছিলেন।

চাদায়েভ জনতুষ্টিবাদী এবং বুদ্ধিজীবীবিরোধী সের্গেইভার বিপরীত এবং তার পাণ্ডিত্য প্রকাশ করতে পিছপা নন। তিনি স্লাভোজ জিজেক, জাক লাকা ও জিলস ডেলিউজের মতো চিন্তাবিদদের দর্শনের সঙ্গে ক্রেমলিনের প্রচার কৌশলের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে তার ব্লগ এবং টুইটারে আলোচনা করতে বিশেষভাবে পছন্দ করেন। জুলাই ২০১০ সালে তার ক্রুদ্ধ হয়ে করা একগাদা টুইটের কারণে এমনকি ক্রেমলিনের মানবাধিকার কমিশনের প্রধানকে পদত্যাগ করতে হয়। তিনি ছিলেন ক্ষমতায় থাকা গুটিকয়েক রুশ উদারপন্থির মধ্যে একজন। চাদায়েভ, যিনি একবার স্বীকার করেছিলেন যে, ‘আমার যা কিছু অর্জন, তার সবকিছুর জন্য আমি ইন্টারনেটের কাছে ঋণী’, সাম্প্রতিক ইন্টারনেট প্রবণতা এবং আধুনিক প্রপাগান্ডার অত্যাধুনিক পদ্ধতি উভয় বিষয়েই অত্যন্ত পারদর্শী। তিনি রাশিয়ার বৈচিত্র্যপূর্ণ যুব সংস্কৃতির দিকেও নজর রাখেন, বিশেষ করে তরুণদের ক্রমবর্ধমান অংশ বিষয়ে যারা রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত মিডিয়া পরিত্যাগ করে ছোট ছোট অনলাইন কমিউনিটি গঠন করে এবং ইন্টারনেট থেকে প্রয়োজনীয় সব খবর সংগ্রহ করে।

রাইকভ ও সের্গেইভার মতো, চাদায়েভ জানেন কীভাবে বার্তাগুলো ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিতে হয়। এর প্রধান কারণ হলো, ইন্টারনেট হলো সেই জায়গা, যেখানে তিনি পেশাগত এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পরিপক্ব হয়েছেন৷ তার মতো দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা পর্দার আড়ালে কী করছেন, তা নজরের বাইরে থাকাই স্বাভাবিক। ক্রেমলিনের পাশে এ ধরনের পরমর্শদাতারা থাকার কারণেই হয়তো ইন্টারনেটের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের কোনো প্রয়োজন তারা বোধ করেন না। তাদের কাছে ইন্টারনেট স্রেফ নিয়ন্ত্রণ করার কোনো জায়গা নয়, এটা হলো বিভিন্ন ধরনের প্রপাগান্ডার কার্যকারিতা পরীক্ষা-নিরীক্ষার এক উত্তেজনাপূর্ণ নতুন খেলার মাঠ।

তাদের কাছে ইন্টারনেট স্রেফ নিয়ন্ত্রণ করার কোনো জায়গা নয়, এটা হলো বিভিন্ন ধরনের প্রপাগান্ডার কার্যকারিতা পরীক্ষা-নিরীক্ষার এক উত্তেজনাপূর্ণ নতুন খেলার মাঠ।

চীনের ফিফটি-সেন্ট পার্টি

চীনের স্পিন্টারনেট অনেক বেশি বিকেন্দ্রীকৃত, যেখানে স্থানীয় এবং আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ তাদের নিজ এলাকার ব্লগ জগতের আলোচনা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সমষ্টিগতভাবে চীনের সরকারপন্থি ইন্টারনেট মন্তব্যকারীরা ফিফটি-সেন্ট পার্টি হিসেবে পরিচিত, এখানে পঞ্চাশ সেন্ট সংখ্যাটি দিয়ে প্রতিটি সরকারপন্থি মন্তব্যের জন্য মন্তব্যকারীর কথিত আয়ের পরিমাণ বোঝানো হয়।

হংকং ইউনিভার্সিটির চীনবিষয়ক গবেষক ডেভিড বান্দুরস্কি ফিফটি-সেন্ট পার্টির বিবর্তনের ওপর ঘনিষ্ঠ নজর রাখেন। তিনি মনে করেন, ফিফটি-সেন্ট পার্টির লক্ষ্য হলো ‘দ্রুত সম্প্রসারণশীল চীনা ইন্টারনেট জগতে অনুপ্রবেশ এবং নজরদারির মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টির স্বার্থ রক্ষা।’ একটি বিশাল প্রচারযন্ত্রের অংশ হিসেবে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে অনলাইন আলোচনায় যুক্ত হয়, আলোচনাগুলোকে আদর্শগতভাবে সঠিক পথে পরিচালিত করে এবং বান্দুরস্কির মতে, ‘চ্যাট রুম এবং ওয়েব ফোরামগুলোতে পার্টির পক্ষে অভিমত দিয়ে অবাঞ্ছিত জনমতকে প্রতিরোধ করে।’ বান্দুরস্কির হিসাবে ফিফটি সেন্টারদের সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার। তাদের মধ্যে অনেককে তাদের অনলাইন অবদানের জন্য নিয়মিত অর্থ প্রদান করা ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা তাদের বিতর্ক করার দক্ষতা বাড়াতে নিয়মিত প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করে।

চীন সরকার অনলাইন কথোপকথন প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা গোপন করে না। উল্লিখিত ইউনানের প্রপাগান্ডা ডিপার্টমেন্টের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা উ হাও স্বীকার করেন যে, ‘যখন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে [অনলাইন] মতামত সম্পূর্ণভাবে একদিকে ঝুঁকে পড়ে, তখন আমরা সেখানে কিছু ভিন্ন কণ্ঠস্বরের ব্যবস্থা করি যেন জনসাধারণ সব জেনে-বুঝে স্বাধীনভাবে তাদের নিজস্ব রায় দিতে পারে।’ অন্য কথায়, চীনা কর্মকর্তারা জনসাধারণের স্বাধীনভাবে তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে আপত্তি করেন না, তবে তারা সংশ্লিষ্ট প্রমাণগুলোকে প্রভাবিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। চীনা শহর শাওগুয়ানের প্রপাগান্ডা বিভাগের প্রধান লি জিয়াওলিনের মতে, ফিফটি সেন্টারদের কার্যক্রমের প্রধান উদ্দেশ্য হলো গুজব প্রতিরোধ করা, প্রপাগান্ডা করা নয়: ‘কখনো কখনো একটি গুজব স্নোবল বা তুষার-গোলকের মতো ক্রমেই বড় হতে থাকে, বিশেষ করে ইন্টারনেটে এ রকম ঘটনা বেশি ঘটে। যোগাযোগের ঘাটতি থাকলে তা গুজবের বাজার তৈরি করে আর যোগাযোগ ঠিক থাকলে গুজবের কোনো জায়গা থাকে না।’

ফিফটি-সেন্ট পার্টির ধারণাটি হলো সরকার পরিচালিত পুরোনো প্রপাগান্ডা মডেল এবং সরকারি কৌশলের বাইরে গিয়ে নতুন ধরনের প্ররোচনা মডেল‒এই দুয়ের মধ্যকার একটি হাইব্রিড বা সংকর। এই ধারণাটি ‘পাবলিক-অপিনিয়ন গাইডেন্স’ বা ‘জনমত নির্দেশিকা’ বিষয়ে চীনা নেতাদের আগ্রহের সঙ্গে খাপ খায়, যেখানে সরকার ও নাগরিকরা একে অপরকে শক্তিশালী করে এবং অবশ্যই সরকার অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। চীনা কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীরাও এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন যে, প্রপাগান্ডা মডেলকে অবশ্যই ইন্টারনেট যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ বেশ আগ্রাসিভাবে ইন্টারনেটে আরও সক্রিয় মতাদর্শিক পদ্ধতি অবলম্বনের সুবিধার কথা বলে থাকেন। হুয়াং তিয়ানহান ও হুই শুগাং নামে দুই তরুণ চীনা শিক্ষাবিদ বলেন: ‘আমাদের অবশ্যই … উপলব্ধি করতে হবে যে, প্রচার ও শিক্ষার প্রচলিত রূপ এবং আধুনিক গণমাধ্যমের রূপের মধ্যে একটি বিশাল ব্যবধান রয়েছে। এর ফলে আমাদের প্রচার-প্রচারণার প্রচলিত ধরনগুলোতে সৃজনশীল পরিবর্তন সাধন করতে হবে এবং আমাদের সংস্কৃতির বিষয়বস্তু ও রূপগুলোকে আরও সমৃদ্ধ এবং নিখুঁত করতে আধুনিক উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে, যাতে তরুণরা এগুলো সহজে গ্রহণ করে এবং প্রভাবিত হয়।’

চীনা কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীরাও এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন যে, প্রপাগান্ডা মডেলকে অবশ্যই ইন্টারনেট যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ বেশ আগ্রাসিভাবে ইন্টারনেটে আরও সক্রিয় মতাদর্শিক পদ্ধতি অবলম্বনের সুবিধার কথা বলে থাকেন।

চীনা ইন্টারনেটে ফিফটি-সেন্ট পার্টির উত্থান দেশটির ক্রমাগত বিকশিত প্রচার কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়; এর সবশেষ বৈশিষ্ট হলো, এটি আগের চেয়ে আরও বেশি বিকেন্দ্রীকৃত, বেসরকারি খাতের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল এবং আন্তর্জাতিকীকৃত। চীনা প্রপাগান্ডা ব্যবস্থার বিবর্তন বিষয়ে বিশ্বের অন্যতম প্রধান বিশেষজ্ঞ অ্যান-মেরি ব্র্যাডি তার ২০০৯ সালে প্রকাশিত বই ‘মার্কেটিং ডিক্টেটরশিপ: প্রপাগান্ডা অ্যান্ড থট ওয়ার্ক ইন কনটেম্পরারি চায়না’তে চীনা কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রপাগান্ডা বিষয়ে আরও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির দিকে ঝুঁকে পড়ার কথা উল্লেখ করেছেন। তিয়ানানমেনের ঘটনার পর থেকে তারা জনসংযোগ, গণযোগাযোগ এবং সামাজিক মনোবিজ্ঞানের দিকে বাড়তি মনোযোগ দিচ্ছেন। মনে করা হয়, ১৯৮০-এর দশকে প্রপাগান্ডাব্যবস্থার দুর্বলতা ও মুক্ত আলোচনার সুযোগ করে দেওয়ার কারণেই তিয়ানানমেন ট্র্যাজেডির মতো ঘটনা ঘটেছে। ব্র্যাডির মতে, তিয়ানানমেন ট্র্যাজেডির পর চীনের পার্টি পুরোনো স্লোগান ‘দুই হাত দিয়ে দখল করতে হবে; উভয় হাতকেই শক্তিশালী হতে হবে’-এর দিকে ফিরেছে, যার অর্থ অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং প্রচার-প্রচারণা-রাজনৈতিক বৈধতার জন্য দুটোকেই কাজে লাগাতে হবে।

চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সৌভাগ্যই বলা যেতে পারে, প্রচুর পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীও, বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে, একটি আধুনিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের কার্যকারিতার জন্য প্রপাগান্ডাকে অপরিহার্য হিসেবে দেখেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় নয়, হ্যারল্ড ল্যাসওয়েল (যার নামকরা উক্তি ছিল: ‘মানুষকে তার নিজ স্বার্থের সর্বোত্তম বিচারক মনে করার গণতান্ত্রিক গোঁড়ামির কাছে নতিস্বীকার করা আমাদের উচিত হবে না।’) এবং ওয়াল্টার লিপম্যান (‘জনসাধারণকে অবশ্যই তার জায়গায় রাখতে হবে। … যাতে আমরা প্রত্যেকে পদদলনকারী বিভ্রান্ত পশুর গর্জন থেকে মুক্ত থাকতে পারি।’)-এর কাজগুলোকে চীনা ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে এবং ব্র্যাডির মতে, চীনের প্রপাগান্ডা কর্মকর্তাদের কাছে তারা বেশ জনপ্রিয়।

অন্য কথায়, চীনা প্রপাগান্ডা নেতারা পশ্চিমের বিশাল বৌদ্ধিক সম্পদ তাদের নিজেদের গণতন্ত্রবিরোধী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন। ব্র্যাডি উল্লেখ করেছেন, ‘টনি ব্লেয়ারের অধীন ব্রিটিশ লেবার পার্টির পুনঃ উদ্ভাবন ১৯৯০-এর দশকে সিসিপির নিজস্ব নবায়নের জন্য মডেল হিসেবে কাজ করে।’ পিটার ম্যান্ডেলসন, যিনি লেবার পার্টির পুনর্গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাকে ২০০১ সালে চীনের সেন্ট্রাল পার্টি স্কুলে বক্তৃতা দিতে এবং তার অন্তর্দৃষ্টি শেয়ার করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ব্র্যাডি মনে করেন, চীনা প্রপাগান্ডা কর্মকর্তারা ২০০২ ও ২০০৩ সালের SARS সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটের সময় মিডিয়া পরিচালনার জন্য টনি ব্লেয়ারের প্রপাগান্ডা কর্মকর্তাদের মডেল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। চীনা কর্মকর্তারা জার্মানির বামপন্থি দলগুলোর সঙ্গেও দেখা করেছিলেন, গত কয়েক দশক ধরে তাদের রূপান্তর অধ্যয়নের জন্য। বর্তমানে চীনা শাসকদের দ্বারা ব্যবহৃত বেশিরভাগ প্রপাগান্ডা কৌশল পশ্চিমা পাঠ্যপুস্তকগুলো থেকেই এসেছে। কাজেই আমরা যদি একদিন জানতে পারি, ফিফটি-সেন্ট পার্টির ধারণাটি এসেছে ‘এস্ট্রোটারফিং’-এর মতো বহুল ব্যবহৃত করপোরেট সংস্কৃতি থেকে, তাহলে মর্মাহত হওয়ার কিছু থাকবে না।

ব্র্যাডি মনে করেন, চীনা প্রপাগান্ডা কর্মকর্তারা ২০০২ ও ২০০৩ সালের SARS সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটের সময় মিডিয়া পরিচালনার জন্য টনি ব্লেয়ারের প্রপাগান্ডা কর্মকর্তাদের মডেল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। চীনা কর্মকর্তারা জার্মানির বামপন্থি দলগুলোর সঙ্গেও দেখা করেছিলেন, গত কয়েক দশক ধরে তাদের রূপান্তর অধ্যয়নের জন্য। বর্তমানে চীনা শাসকদের দ্বারা ব্যবহৃত বেশিরভাগ প্রপাগান্ডা কৌশল পশ্চিমা পাঠ্যপুস্তকগুলো থেকেই এসেছে।

চীনা অভিজ্ঞতা আরও বিভিন্ন দেশের স্বৈরাচারী এবং গণতান্ত্রিক উভয় ধরনের সরকারকেই অনুপ্রাণিত করেছে। ফলে তারা তাদের বিশ্বস্ত ইন্টারনেট অনুসারীদের নিয়ে নিজস্ব সাইবার-ব্রিগেড তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন। ২০০৯ সালে নাইজেরিয়ান সরকার দেশ-বিদেশের সাত শতাধিক নাইজেরিয়ানকে নিয়ে একটি ‘ব্লগারবিরোধী তহবিল’ তৈরির উদ্যোগ নেয়, যার উদ্দেশ্য হলো সরকার বিরোধীদের সঙ্গে অনলাইন যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য সরকারপন্থি ব্লগারদের একটি নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলা। এ জন্য পুরস্কার হিসেবে তাদের দেওয়া হবে সাইবার ক্যাফের ভাউচার ও ব্লগিং ভাতা। দক্ষিণ কোরিয়া সরকার উত্তর কোরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে অনলাইন যুদ্ধ শুরুর অভিযোগ করে। (উত্তর কোরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, দক্ষিণ কোরিয়ার যুদ্ধজাহাজটি যে উত্তর কোরিয়ার টর্পেডো হামলার কারণে ঘটেনি, সে বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার অভিযোগের বিরুদ্ধে তারা বানোয়াট প্রচারণা করছে)। ফেসবুক-ইউটিউব ব্যবহার করে বিরোধী দলের কর্মীদের সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণার বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে আজারবাইজানের ক্ষমতাসীন দল। ফলে ২০১০ সালের মে মাসে তারা সরকারপন্থি যুব গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে একটি বৈঠকের আয়োজন করে, যেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আজেরি স্পিন্টারনেট কর্মকাণ্ডের জন্য একটি অফিসের ব্যবস্থা করা হবে, যেখান থেকে কর্মীরা সরকারবিরোধীদের সঙ্গে অনলাইন যুদ্ধে লিপ্ত হবে।

২০০৯ সালে নাইজেরিয়ান সরকার দেশ-বিদেশের সাত শতাধিক নাইজেরিয়ানকে নিয়ে একটি ‘ব্লগারবিরোধী তহবিল’ তৈরির উদ্যোগ নেয়, যার উদ্দেশ্য হলো সরকার বিরোধীদের সঙ্গে অনলাইন যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য সরকারপন্থি ব্লগারদের একটি নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলা। এ জন্য পুরস্কার হিসেবে তাদের দেওয়া হবে সাইবার ক্যাফের ভাউচার ও ব্লগিং ভাতা।

পিছিয়ে নেই মিশরও। ২০০৮ সালে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে ফেসবুক ব্যবহারের বিষয়টি লক্ষ করে মিশরীয় কর্তৃত্ববাদীরা নিজেরাও ফেসবুক ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ, ফেসবুক এত জনপ্রিয় যে, তা সরাসরি নিষিদ্ধ করা যাবে না। হোসনি মুবারকের ছেলে এবং তার সম্ভাব্য উত্তরসূরি গামাল মুবারক যখন অনলাইনে সাক্ষাৎকার দিতে শুরু করেন, তখন পঞ্চাশটিরও বেশি ফেসবুক গ্রুপ, যার সব কটিই তৃণমূল থেকে উঠে আসা বলে প্রচার করা হয়, তাকে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য মনোনয়ন দিতে শুরু করে।

২০০৯ সালের বিক্ষোভের সময় ইরান সরকারের মধ্যে যতই ইন্টারনেটবিরোধী মনোভাব দেখা যাক-না কেন, তারা একপর্যায়ে উপলব্ধি করে যে, সাইবার স্পেসেও তাদের সক্রিয় হয়ে উঠতে হবে। ২০১০ সালে ইরানের কট্টরপন্থিরা তাদের নিজস্ব সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট চালু করে, যার নাম ভালায়তমাদারন (নামটির মাধ্যমে বিলায়ত বা ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির অনুসারীদের কথা বলা হয়েছে)। এ ধরনের একটি সাইটের যেসব ফিচার বা সুবিধা থাকার কথা তার সবই রয়েছে এতে: এর সদস্যরা পরস্পরের বন্ধু হতে পারে, ছবি, ভিডিও এবং লিঙ্ক পোস্ট করতে পারে৷ এ সাইটের সদস্যরা সবাই শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ, যদিও আরও নানারকম বিষয় নিয়ে আলোচনারও সুযোগ রয়েছে যেমন: ‘সর্বোচ্চ আইনশাস্ত্রের শাসন’ এবং ‘নারী ও পরিবার’ ইত্যাদি।

এক অর্থে, এ ধরনের একটি সাইটের উপস্থিতি আসলে ইরান সরকার কর্তৃক নতুন মিডিয়াকে আলিঙ্গন করার দীর্ঘমেয়াদি কৌশলেরই একটি ধাপ মাত্র। ইরান ২০০৬ সাল থেকে ধর্মীয় ব্লগারদের একটি নতুন প্রজন্মকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। সে সময় ইরানের ধর্মীয় জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র কোম-এ ব্যুরো ফর দ্য ডেভেলপমেন্ট অব রিলিজিয়াস ওয়েব লগস নামক অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ব্যুরোর অধিকাংশ কার্যক্রম পরিচালিত হয় নারীদের লক্ষ্য করে। ধর্মীয় নেতারা নারী ব্লগারদের অস্তিত্ব বাধ্য হয়ে মেনে নিলেও তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার চেষ্টা করছেন৷

ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনীও সাইবার স্পেসে বেশ আগ্রাসি। তারা ২০০৮ সালের শেষের দিকে ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগারদের মোকাবিলার জন্য আধা সামরিক বাসিজ বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ১০ হাজার ব্লগ চালুর অঙ্গীকার করেছিল। জরুরি পরিস্থিতির সময় এগুলো বেশ কাজে আসতে পারে। ইরানের টুইটার বিপ্লব সম্পর্কে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য‒কিন্তু সবচেয়ে উপেক্ষিত‒তথ্যটি ছিল যে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহ পর, নির্বাচন-পরবর্তী সময়ের তুলনায় টুইটারে সরকারপন্থি বার্তার সংখ্যা দুইশ গুণ বেড়ে যায়!

প্রপাগান্ডার ছোট ডোজও আপনার জন্য খারাপ

কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো যে অনলাইনের বিভিন্ন আলাপ-আলোচনাকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম, সে বিষয়টি ইতোমধ্যে প্রমাণিত। কখনো ফিফটি-সেন্ট পার্টির মতো কোনো অনলাইন বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে, তাদের জনমতের ‘প্রকৃত’ প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে হাজির করে আবার কখনো রাইকভ বা সের্গেইভার মতো সেলিব্রেটিদের পৃষ্ঠপোষকতা করে তারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে চলেছে। এসব তৎপরতা যে সবসময় শতভাগ সফলতা লাভ করে তা নয়। কখনো কখনো তাদের তৎপর হতে দেরি হয়ে যায় আবার কখনো কোনো ইস্যু এত বড় আকার ধারণ করে যে, প্রপাগান্ডার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল হয়ে পড়ে। কিন্তু ইন্টারনেটের মাধ্যমে সহজেই সত্য তুলে ধরা কিংবা সরকারি প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্পর্কে যেসব সরল ধারণা আমাদের রয়েছে, সেগুলো ঝেড়ে ফেলার উপযুক্ত সময় এটাই। ইন্টারনেট যুগের কারণে পাবলিক ডিসকোর্স বা গণ-আলোচনার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেছে এবং এখন যে কারো পক্ষে প্রায় বিনা মূল্যে নিজের মত প্রকাশ করা ও মানুষের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব বলে মনে করার কারণ নেই যে, সততা ও স্বচ্ছতা আপনাআপনি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।

রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং তার বিরোধিতাকারীদের মধ্যে ক্ষমতার বিদ্যমান ভারসাম্যহীনতার অর্থ এই যে, একেবারে শুরু থেকেই শক্তিশালী পক্ষটি অর্থাৎ রাষ্ট্র‒এই নতুন বিকেন্দ্রীভূত পরিবেশের সুবিধা নেওয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। কারণ, বিকেন্দ্রীভূত পরিস্থিতিতে যে কোনো শক্তিশালী গোষ্ঠীর পক্ষে জন-আলোচনাকে প্রভাবিত করার সুযোগ আরও বেশি থাকে।

বিভিন্ন ধরনের বানানো বিষয়বস্তু দিয়ে ব্লগ এবং সোশ্যাল নেটওয়ার্ক প্লাবিত করে সরকারগুলো আসলে কী অর্জন করার চেষ্টা করছে, তা বোঝা ততটা কঠিন নয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষ্য হলো এমন একটি ধারণা তৈরি করা যে, মধ্যপন্থি ও গণতন্ত্রপন্থি বক্তব্য ‘নেটিজেনদের’ কাছে ততটা জনপ্রিয় নয়, সেই সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে নিশ্চিত অবস্থান গ্রহণ করেননি এ রকম নাগরিকদের পক্ষে টানা৷ একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে গিয়ে এসব প্রচারণার সুফল আসতে শুরু করে: অর্থের বিনিময়ে সরকারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণকারীদের উপস্থিতি সরকারের প্রকৃত সমর্থকদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং নতুন সমর্থকরা তখন কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়াই নিজেদের উৎসাহেই সরকারের পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

রকারগুলোকে যা করতে হয় তা হলো, প্রাথমিক পর্যায়ে সরকার-সমর্থকদের ‘বীজ’ বপন করা‒তাদের সঠিক মতাদর্শ, কথা বলার যুক্তি-বুদ্ধি এবং অর্থ দিয়ে সহায়তা করা এবং তারপর আড়ালে চলে যাওয়া। এরপর বাদবাকি কঠিন কাজগুলো রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত সমর্থক গোষ্ঠী নিজেরাই করতে থাকে (দুর্ভাগ্যবশত, এমনকি সবচেয়ে নৃশংস শাসনব্যবস্থায়ও এ ধরনের সমর্থকদের কোনো অভাব হয় না)।

এভাবে সরকারগুলোকে যা করতে হয় তা হলো, প্রাথমিক পর্যায়ে সরকার-সমর্থকদের ‘বীজ’ বপন করা‒তাদের সঠিক মতাদর্শ, কথা বলার যুক্তি-বুদ্ধি এবং অর্থ দিয়ে সহায়তা করা এবং তারপর আড়ালে চলে যাওয়া। এরপর বাদবাকি কঠিন কাজগুলো রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত সমর্থক গোষ্ঠী নিজেরাই করতে থাকে (দুর্ভাগ্যবশত, এমনকি সবচেয়ে নৃশংস শাসনব্যবস্থায়ও এ ধরনের সমর্থকদের কোনো অভাব হয় না)। 

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •