জ্ঞানের বিচ্ছেদ

বাংলাদেশে ভাষা, শ্রেণী ও রাষ্ট্র

জ্ঞানের বিচ্ছেদ

আনু মুহাম্মদ

মাতৃভাষার অধিকার এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিক আন্দোলন শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছিলো ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। এই দিন যেভাবে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়, তা বিশ্ববাসীকেও অনুপ্রাণিত করে। সেই কারণে এক পর্যায়ে জাতিসংঘ থেকে এই দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ২১শে ফেব্রুয়ারি যতোদিনে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ততোদিনে, বাংলাদেশ একটি প্রবল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হলেও, বাংলা ভাষা প্রান্তিক অবস্থানে চলে গেছে। সমাজ ও রাষ্ট্রে গুরুত্বের দিক থেকে দিনে দিনে আরও কোণঠাসা অবস্থা বাংলা ভাষার, পরিত্যক্ত বিবর্ণ।

কপটতা, স্ববিরোধিতা, আত্মপ্রতারণার এক অদ্ভ’ত ক্ষমতা আছে বাঙালী উচ্চ ডিগ্রীধারী সমাজের-বাঙালী শাসকদের। বিশেষত প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাস এলে, মাতৃভাষা বাংলাভাষা, ২১শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে তাদের যে আবেগ উচ্ছ্বাস দেখা যায় তার তুলনা যেমন বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যাবে না; তেমনি রাষ্ট্রীয় নীতিমালা, পরিকল্পনা, শিক্ষা, গবেষণা, আদালত, এমনকি সেমিনার-সম্মেলন পর্যন্ত সর্বত্র নিজের মাতৃভাষাকে যেভাবে অবশ্য বর্জনীয়, অব্যবহারযোগ্য হিসেবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, পায়ের নীচে পিষ্ট করে এরা ছুঁড়ে ফেলে দেয় তারও তুলনা পাওয়া কঠিন হবে। বাংলা ভাষাকে ‘হৃদয়ের ভাষা’ ‘প্রাণের ভাষা’ বলে বলে কাজের ক্ষেত্রে তাকে অপাংক্তেয় করে রাখা এই হলো বর্তমান চিত্র। কিন্তু কোনো দেশে সেই দেশের নাগরিকদের প্রধান ভাষাকে প্রান্তিক করে, বিদেশি ভাষায় দেশ পরিচালনার নীতিমালা প্রণয়ন করে, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করে কি কার্যকর বা টেকসই অগ্রগতি সম্ভব? এই প্রবন্ধে বর্তমান পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে এই প্রশ্নেরই উত্তর সন্ধান করা হয়েছে।

‘.. এখন আমরা বিধাতার নিকট এই বর চাহি, আমাদের ক্ষুধার সহিত অন্ন, শীতের সহিত বস্ত্র,

ভাবের সহিত ভাষা, শিক্ষার সহিত জীবন কেবল একত্র করিয়া দাও।’ -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রাষ্ট্র থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দূরত্ব সৃষ্টির রাষ্ট্রনৈতিক, অর্থনৈতিক, শ্রেণীগত বহুবিধ কারণ আছে। এসবের অন্যতম একটি দিক হলো বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা নয়, শিক্ষা ও রাষ্ট্রীয় সকল নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে, প্রধান ভাষা হিসেবে বিদেশি ভাষার একক আধিপত্য। শ্রেণীগত ও সা¤্রাজ্যবাদী আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় অস্ত্র, সন্দেহ নেই। 

সর্বত্র বিদেশি ভাষার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পেছনে যুক্তি হিসেবে হাজির করা হয় দেশের উন্নয়ন, আধুনিকীকরণ, বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মেলানো, বিশ্বের জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হওয়া, চাকুরির বাজার ইত্যাদি বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশের জ্ঞান বিজ্ঞানে যারা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত তাঁদের অনেকে যে  উপলব্ধিতে পৌঁছেছেন এবং যা সবাইকে জানাবার জন্য বলেছেন লিখেছেন তা হলো এই যে, একটি জনগোষ্ঠী মাতৃভাষা ছাড়া তার সামষ্টিক জ্ঞান বিজ্ঞানের ভিত্তি নির্মাণে সক্ষম হয় না। আর জ্ঞান বিজ্ঞানের শক্ত ভিত্তি ছাড়া একটি জনগোষ্ঠী কী করে বিশ্বের সাথে যোগসূত্র জোরদার করতে পারবে? 

অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৬৬) যাঁকে রবীন্দ্রনাথ বাংলায় নতুন যুগের পুরোধা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, যাঁর কাজের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা বিজ্ঞান, ইতিহাস ও পুরাতত্ত্বের তথ্য ও তত্ত্ব প্রকাশে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, যার যতিচিহ্নর ব্যবহারে বাংলাভাষা নতুন সক্ষমতার পর্যায়ে উঠেছিল, ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞানে যাঁর পারদর্শিতা ছিল প্রবাদতুল্য, যাঁকে আশুতোষ ভট্টাচার্য্য ‘বিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানসাধনার অগ্রদূত’ এবং ‘বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের ভবিষ্যৎ পথপ্রদর্শক’ হিসিবে অভিহিত করেছিলেন তিনি সেই ব্রিটিশ আমলেই মাতৃভাষায় শিক্ষা ছাড়া জাতীয় ভাব প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় বলে সিদ্ধান্ত টেনেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিলো বিদেশি শাসকদের বদলে দেশি শাসকেরা এলে জাতীয় শিক্ষাসমাজ স্থাপিত হবে এবং মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রকৃত বিকাশ সম্ভব হবে। তাঁর মতো অনেকের প্রত্যাশা যে কতো ভ্রান্ত উচ্চাশা ছিল তা আমরা এখনও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। তিনি লিখেছিলেন,

‘জাতীয় ভাবের অভাব বর্তমান শিক্ষাপ্রণালীর আর এক দোষ।… আজিকার দিনে ইংরাজিতে বিশেষ ব্যুৎপত্তি না থাকিলে কোনোমতেই চলে না এবং ইংরাজদিগের নিকট হইতে আমাদিগকে এখনও অনেক শিক্ষা করিতে হইবে, তথাপি ইহা প্রকৃত জাতীয় উন্নতির একটি বিশেষ প্রতিবন্ধকস্বরূপ বলিতে হইবে। স্বকীয় ভাষায় অনুশীলন হইয়া স্বভাবত যে জাতীয় উন্নতির অভ্যুদয় হয় তাহাই প্রকৃত জাতীয় উন্নতি।’১  

শিক্ষা বিষয়ে লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বরাবরই মাতৃভাষার অপরিহার্যতার কথা লিখেছেন। ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, শিক্ষার মাধ্যম বিদেশি ভাষা করে,

‘অন্তরে এবং বাহিরে যে দুইটি উদার এবং উন্মুক্ত বিহারক্ষেত্র আছে, মনুষ্য যেখান হইতে জীবন, বল এবং স্বাস্থ্য সঞ্চয় করে- যেখানে নানা বর্ণ, নানা রূƒপ, নানা গন্ধ, বিচিত্র গতি ও গীতি, প্রীতি ও প্রফুল্লতা, সর্বদা হিল্লোলিত হইয়া আমাদিগকে সর্বাঙ্গসচেতন এবং সম্পূর্ণ বিকশিত করিয়া তুলিবার চেষ্টা করিতেছে- সেই দুই মাতৃভ’মি হইতে নির্বাসিত করিয়া হতভাগ্য শিশুদিগকে কোন্ বিদেশী কারাগারে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া রাখা হয়?’

সেজন্যই, তিনি আরও বলেছেন,

‘চিন্তাশক্তি এবং কল্পনাশক্তি জীবনযাত্রা নির্বাহের পক্ষে দুইটি অত্যাবশ্যক শক্তি, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। অর্থাৎ, যদি মানুষের মতো মানুষ হইতে হয় তবে ঐ দুটা পদার্থ জীবন হইতে বাদ দিলে চলে না। অতএব বাল্যকাল হইতে চিন্তা ও কল্পনার চর্চা না করিলে কাজের সময় যে তাহাকে হাতের কাছে পাওয়া যাইবে না, এ কথা অতি পুরাতন। কিন্তু আমাদের শিক্ষায় সে পথ একপ্রকার রুদ্ধ।’     

সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৪-১৯৭৪) বহুভাষার পন্ডিত এবং বহুদেশে তাঁর কাজের অভিজ্ঞতা আছে। তার ওপর ভিত্তি করে তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকেই পূর্ব বাংলায় শিক্ষার মাধ্যম বাংলা করার বিষয়ে জোর যুক্তি উপস্থাপন করেন।

তিনি ইতিহাস ভ’গোল ঘেঁটে বলেছেন,

‘প্রথমত পৃথিবীর কোন শিক্ষিত সভ্য দেশ মাতৃভাষা ছাড়া অন্য মাধ্যমে শিক্ষা দিচ্ছে? ইংলন্ড, ফ্রান্স, জার্মানী, ইতালি, চীন, জাপান, রুশ, মিশর, ইরাক, তুকী, ইরান এমন কোন দেশ আছে যেখানকার লোক আপন মাতৃভাষাকে অবমাননা করে  আপন দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে?’ 

মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য মাধ্যমে শিক্ষাদানের দৃষ্টান্তও তিনি টেনেছেন এবং তার পরিণতিও আলোচনা করেছেন। একসময় ইউরোপের সর্বত্র মাতৃভাষার বদলে লাতিনের মাধ্যমে শিক্ষাদানই ছিলো আভিজাত্যের লক্ষণ। ক্রমে লাতিনের জায়গা দখল করে ফরাসী। এক সময়ে জার্মান স¤্রাটও ফরাসীতে কবিতা লিখেছেন। রাশিয়াতেও ফরাসীর আধিপত্য ছিলো বহুদিন। কতিপয়ের অভিজাত্য রক্ষায় বিদেশি ভাষা অবলম্বনের এই চর্চা থেকে বের হয়ে নিজ নিজ দেশের জনগণের প্রধান ভাষা অবলম্বন করেই ইউরোপের দেশগুলোতে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিস্তার সম্ভব হয়েছে।

শিক্ষার মাধ্যম নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন বোস (১৮৯৪-১৯৭৪) ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘শিক্ষা ও বিজ্ঞান’ প্রবন্ধে যা লিখেছিলেন তা বর্তমানে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক,

‘কিছুদিন আগে এই প্রস্তাব আমি দিয়েছিলাম যে, আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি পরিবর্তনের এবং স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সর্বস্তরেই শিক্ষার বাহন হিসেবে মাতৃভাষা ব্যবহারের সময় এসে গেছে। শত শত ছাত্রের সংস্পর্শে আসার সুযোগ ঘটেছে এমন একজন শিক্ষক হিসেবে আমার স্থির অভিমত এই যে, যথেষ্ট সময় বাঁচানো ও ছাত্রদের মনে বৈজ্ঞানিক চিন্তার দৃঢ়তর ভিত্তি গাঁথা সম্ভব, যদি প্রতিটি শিক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষক ও ছাত্রেরা সহযোগিতা করেন, তাদের সমস্যার খোলাখুলি আলোচনা ও তার সমাধানের জন্য একযোগে কাজ করেন। কিন্তু তাদের মধ্যে কোন বিদেশী ভাষা এসে দাঁড়ালে মস্ত অসুবিধা দেখা দেবেই। কথাবার্তা ও শিক্ষার বাহন হিসেবে সর্বদাই ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে হলে অনুসন্ধিৎসু ছাত্র অনেক সময়েই ঠিকমত মনের কথা বলতে পারে না এবং শিক্ষক নিশ্চিন্ত হতে পারেন না যে, ছাত্রকে যা তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, সে তার সবটাই বুঝতে পেরেছে কি না। বর্তমান পদ্ধতি যে মুখস্থ করতে প্ররোচনা যোগায়, এতে যে শিক্ষণীয় বিষয়ের সারতত্ত্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা জন্মায় না- সে সম্বন্ধে আমি নিঃসংশয়।’৪ 

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভাষা কী?

সংবিধান, সরকারি দাবি এবং প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু আমরা দেখি রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে, তার সাথে শিক্ষাঙ্গনে, আদালতে ইংরেজিই প্রধান ভাষা। সেই হিসেবে অঘোষিতভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা কার্যত ইংরেজি। পাকিস্তান আমল তো বটেই ব্রিটিশ আমলের সাথেও বর্তমান সময়ে সমাজে বাংলা ভাষার আপেক্ষিক অবস্থানের পার্থক্য খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে খুব লাভ হবে না।  অন্যান্য জাতির ভাষা আরও করুণ অবস্থায়।  

বিদেশি ভাষাকে কার্যত রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার সকল নীতিমালা প্রণয়ন করছে, দেশ ও জনগণ সম্পর্কে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। এরই অংশীদার বাঙালী ডিগ্রীধারী সমাজ তার শিক্ষা, গবেষণা, উপার্জন ও জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে তৈরি করছে এক সংখ্যালঘু জগত যার পা মাটিতে নাই। এসবের মধ্য দিয়ে যে জ্ঞানের জগত তৈরি হচ্ছে তা দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন। ভাষার দেয়াল টানা দুই জগতে জ্ঞানের/চিন্তার/ভাবের/কল্পনার/পরিকল্পনার এই বিভেদ দিনে দিনে বাড়ছেই কেবল। এই বিভেদ বাড়ানোর প্রধান কারিগর রাষ্ট্র নিজেই। আমরা দেখছি ‘উন্নয়নের’  তোলপাড়। কিন্তু তার নীতিমালা নির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তার পরিণতি কোনোকিছুই জনগণের জানা নাই। নীচে দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে বিদেশি ভাষার কর্তৃত্ব বিস্তারের কয়েকটি নমুনা হাজির করছি। 

বিদেশি ভাষাকে কার্যত রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার সকল নীতিমালা প্রণয়ন করছে, দেশ ও জনগণ সম্পর্কে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। এরই অংশীদার বাঙালী ডিগ্রীধারী সমাজ তার শিক্ষা, গবেষণা, উপার্জন ও জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে তৈরি করছে এক সংখ্যালঘু জগত যার পা মাটিতে নাই। এসবের মধ্য দিয়ে যে জ্ঞানের জগত তৈরি হচ্ছে তা দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন। ভাষার দেয়াল টানা দুই জগতে জ্ঞানের/চিন্তার/ভাবের/কল্পনার/পরিকল্পনার এই বিভেদ দিনে দিনে বাড়ছেই কেবল। এই বিভেদ বাড়ানোর প্রধান কারিগর রাষ্ট্র নিজেই। আমরা দেখছি ‘উন্নয়নের’  তোলপাড়। কিন্তু তার নীতিমালা নির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তার পরিণতি কোনোকিছুই জনগণের জানা নাই। নীচে দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে বিদেশি ভাষার কর্তৃত্ব বিস্তারের কয়েকটি নমুনা হাজির করছি। 

নমুনা ১:  বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশিক্ষণের জন্য সবচাইতে বড় প্রতিষ্ঠানের নাম:  ‘বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’, ইংরেজিতে ‘পিএটিসি’ নামে অধিক পরিচিত। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েই সরকারি কর্মকর্তারা দেশের কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালনা করেন। তাঁদের দ্বারাই রাষ্ট্রের সকল নীতি, পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়। তাঁরাই রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে সংযোগ মাধ্যম। আর এই প্রতিষ্ঠানেই সকল পর্যায়ের প্রশিক্ষণে, সকল ক্লাশ, বক্তৃতা, গবেষণা রিপোর্ট ইংরেজিতে করা বাধ্যতামূলক। শুধু তাই নয়, পোশাক-আশাক, খাবার দাবারেও সেটাই প্রাণপণ চেষ্টা করা হয়। কাঁটাচামচ চামচ ছাড়া খাওয়াও অনুমোদিত নয়।

এই প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে বলা হয় রেক্টর। বেশ কবছর আগে এই পদাধিকারী ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এই প্রতিষ্ঠানে কেন ইংরেজি ভাষায়/ভাবে সব কাজ বাধ্যতামূলক? তিনি  জবাবে বলেছিলেন, ‘বিদেশিদের সাথে নেগোশিয়েশন করতে হয় তো, তাই ইংরেজি ভাষা জানা না থাকলে কীভাবে হবে?’ কিন্তু বিদেশি মানে তো শুধু ইংরেজি ভাষী নয়। ইংরেজি জানা দরকার, কিন্তু তার জন্য সারাক্ষণ ইংরেজ ভাব নিয়ে থাকতে হবে কেন, বাংলাভাষা ফেলে দিতে হবে কেন? আর সরকারি কর্মকর্তাদের কতোক্ষণ ইংরেজিভাষী বিদেশিদের সাথে ‘নেগোসিয়েশন’ করতে হয় আর কতোক্ষণ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সাথে কাজ করতে হয়? দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক উচ্চারণ, দেশের অন্য জাতিসমূহের ভাষা জানা কি বেশি দরকার নয়? তাদের কি দেশের ভেতরে বাঙালী ছাড়া অন্য জাতিগুলোর ভাষা শেখানো হয়? 

সৈয়দ মুজতবা আলী মাতৃভাষায় শিক্ষা ও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনার অপরিহার্যতা বোঝাতে গিয়ে, ‘তাহলে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কীভাবে হবে’, এই জাতীয় প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতা দিয়ে সমাধানের পথ দেখিয়েছেন। কবিতার কয়েকটি অংশ:

কহিলা হবু  “শুনগো গোবু রায়

কালিকে আমি ভেবেছি সারারাত্র

মলিন ধূলা লাগিবে কেন পায়

ধরণী মাঝে চরণ ফেলা মাত্র?..

শীঘ্র এর করিবে প্রতিকার

নহিলে কারো রক্ষা নাহি আর।”

মন্ত্রী তখন,

“অশ্রুজলে ভাসায়ে পাকা দাড়ি

কহিলা গোবু হবুর পাদপদ্মে

‘যদি না ধূলা লাগিবে তব পায়

পায়ের ধূলা পাইব কি উপায়।”

….রাজা বলেন:

“কথাটা বটে সত্য,

কিন্তু আগে বিদায় করো ধূলি।

ভাবিয়ো পরে পদধূলির তত্ত্ব!”

এরপর বহুরকম চেষ্টা: সাড়ে সতেরো লক্ষ ঝাঁটা দিয়ে দুনিয়া সাফ করার চেষ্টা, হলো না, এরপর ‘একুশ লাখ ভিস্তি দিয়ে জল ঢালার ব্যবস্থা, তাতেও হলো না। তারপর:

….কহিল মন্ত্রী, “মাদুর দিয়া ঢাকো;

ফরাশ পাতি করিব ধূলা বন্ধ।”

কহিল কেহ, “রাজারে ঘরে রাখো

কোথাও যেন না থাকে কোনো রন্ধ্র।”

অবশেষে-

….কহিল সবে, “চামাররে তবে ডাকি

চর্ম দিয়া মুড়িয়া দাও পৃথ্বী।”…

তখন ধীরে চামার কুলপতি

কহিল এসে ঈষৎ হেসে বৃদ্ধ,

“বলিতে পারি করিলে অনুমতি

সহজে যাহে মানস হবে সিদ্ধ।

নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে

ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।”

মুজতবা আলী তাই বলছেন, কিছু কাজ, যোগাযোগের জন্য যা দরকার তার সমাধানে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেই হয়। কিন্তু এই অজুহাতে সকলের স্বতস্ফ’র্ত জ্ঞান আহরণ ও বিকাশের পথ রুদ্ধ করা কেন?

নমুনা ২: দেশব্যাপী, গ্রামে শহরে ইংরেজি মাধ্যমে সন্তানদের শিক্ষাদানের জন্য অভিভাবকদের আগ্রহ এখন উন্মাদনার পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর পেছনে অভিভাবকদের দৌড়ানো শুধু গড্ডালিকা প্রবাহ নয়, সন্তানের পেশাগত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার আকাঙ্খা, সমাজে মর্যাদা, প্রতিযোগিতা ইত্যাদিও কারণ হিসেবে কাজ করে। সেই কারণে যত্রতত্র ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল কলেজ মাদ্রাসা গড়ে উঠছে, এটি খুবই ব্যবসা সফল একটি খাত এখন। বাণিজ্যের তাড়নায় অনেকেই নেমে পড়ছে এই খাতে। দেশজুড়ে কোচিং, গাইড বই এর বাণিজ্যিক নেটওয়ার্কও গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ইংরেজির হাল কী, ইংরেজি ভাষায় কী কেমন শেখানো হয় সেসব বিষয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নাই,  তদারকিও নাই। এখানেও ভাষা সাহিত্য শেখার চাইতে ইংরেজ ভাবই প্রধান।

উচ্চ ডিগ্রীধারী সমাজে এই উন্মাদনা কম নেই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের ব্যবস্থাপনায় স্কুল কলেজ আছে। যেমন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই প্রতিষ্ঠান আছে প্রথম থেকেই। ক্যাম্পাসবাসী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারিদের সন্তানেরা এই প্রতিষ্ঠানেই সাধারণত লেখাপড়া করে। এটি বরাবরই বাংলা মাধ্যম স্কুল, গত কয়বছর ধরে পাশাপাশি ‘ইংলিশ ভার্সন’ও চলছে। এই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা শেষ করে পরে উচ্চশিক্ষা নিয়ে অনেকেই দেশে ও বিদেশে প্রতিষ্ঠিত, তাঁরা যোগ্যতার সাথেই কাজ করছেন। বেশ কজন দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।

সেই কারণে যত্রতত্র ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল কলেজ মাদ্রাসা গড়ে উঠছে, এটি খুবই ব্যবসা সফল একটি খাত এখন। বাণিজ্যের তাড়নায় অনেকেই নেমে পড়ছে এই খাতে। দেশজুড়ে কোচিং, গাইড বই এর বাণিজ্যিক নেটওয়ার্কও গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ইংরেজির হাল কী, ইংরেজি ভাষায় কী কেমন শেখানো হয় সেসব বিষয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নাই,  তদারকিও নাই। এখানেও ভাষা সাহিত্য শেখার চাইতে ইংরেজ ভাবই প্রধান।

কিন্তু গত কয়বছর ধরে দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই তাঁদের সন্তানদের ঐ স্কুলে দিচ্ছেন না। যে শিক্ষকেরা ক্যাম্পাসে থাকেন তাঁদের সন্তানেরা বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল কলেজে পড়লে শুধু শিক্ষা খরচ নয় ঝামেলাও অনেক কমে যায়। নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকে না, যাতায়াতের জন্য পরিবহণ নিয়েও চিন্তা করতে হয় না। শিশু কিশোরদের জীবনও সহজ হয়। তারপরও শিক্ষকদের অনেকে তাদের সন্তানদের ভর্তি করছেন ক্যাম্পাসের বাইরে ক্যান্টনমেন্ট স্কুল কলেজ বা প্রাইভেট স্কুলে। এগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল এগুলো ব্যয়বহুল এবং মাধ্যম ইংরেজি।

এতো ঝামেলা আর খরচের মধ্যে যাবার যুক্তি কী? শিক্ষক অভিভাবকদের উত্তর হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল কলেজে পড়াশোনা ঠিকমতো হয় না, সেজন্যই তারা অন্য প্রতিষ্ঠানে গেছেন। কিন্তু উত্তরটা পরিষ্কার নয়। বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল কলেজের শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বা দক্ষতা অন্য কোনো স্কুল/কলেজ থেকেই কম নয়। পরীক্ষার ফলাফলও খারাপ নয়। সমস্যা হতে পারে তদারকি, ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা, আর্থিক সঙ্গতি নিয়ে। এসব সমস্যার সমাধান হলে প্রতিষ্ঠানের মান আরও ভালো হওয়া সম্ভব, সে কাজতো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই করতে পারেন, শিক্ষকেরাও সন্তানদের কথা ভেবে এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে চাপ দিতে পারেন। কেন দেন না? উত্তর খুঁজতে গিয়ে বুঝলাম আসল কারণ অন্য- বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল কলেজ সবার জন্য উন্মুক্ত, সেখানে এই প্রতিষ্ঠানের তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারিদের সন্তানেরা ছাড়াও আশেপাশের গ্রামের ছেলেমেয়েরাও পড়ে। এদের সাথে সন্তানেরা যদি পড়ে, চলাফেরা করে তাহলে তারা ঠিক শিক্ষা পাবে না বরং ‘নষ্ট’ হয়ে যেতে পারে!

অন্য স্কুলগুলোতে গরীব মানুষের ছেলেমেয়েরা পড়তে পারে না, কারণ তার ব্যয় বহুগুণ বেশি। আসলে শিক্ষা যতো ব্যয়বহুল হবে সন্তানকে ততো ‘সাধারণ’ লোক থেকে দূরে রাখা যাবে। আগে এই সাধারণদের সাথেই পড়াশোনা শেষ করে বর্তমানে অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হয়েছেন। তখন শুদ্ধ শ্রেণী চর্চার অপশন কম ছিলো, এখন বেশ আছে। তবে ইংরেজি মাধ্যমে স্কুলে পড়িয়ে আভিজাত্য অর্জনের প্রতিযোগিতায় গরীব বা সীমিত আয়ের বাবা মায়েদের মধ্যেও কেউ কেউ বেপরোয়া হয়ে পড়েন। সর্বস্ব দিয়ে সন্তানদের নিশ্চিত ভবিষ্যৎ অর্জন করতে চান, তাদের জন্য তুলনামূলক কম ব্যয়ের বাণিজ্যিক স্কুলও আছে! সবমিলিয়ে ইংরেজি  মাধ্যম পসারের পথ প্রশস্ত। ঘরে, প্রতিষ্ঠানে বাংলা মাধ্যম ক্রমান্বয়ে আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ছে।

অথচ কান্ডজ্ঞান ও দায়িত্বশীল বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ দুটোই বলে, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা এবং তার সাথে, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে, কার্যকরভাবে ইংরেজিসহ বিদেশি ভাষা শেখানো নিশ্চিত করাই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের বিকাশের সবচাইতে উত্তম পথ। সকলের জন্য অভিন্ন, মানসম্পন্ন শিক্ষা বিস্তারে রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণ ছাড়া এটি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সমস্যার উৎস সেখানেই।     

অথচ কান্ডজ্ঞান ও দায়িত্বশীল বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ দুটোই বলে, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা এবং তার সাথে, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে, কার্যকরভাবে ইংরেজিসহ বিদেশি ভাষা শেখানো নিশ্চিত করাই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের বিকাশের সবচাইতে উত্তম পথ। সকলের জন্য অভিন্ন, মানসম্পন্ন শিক্ষা বিস্তারে রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণ ছাড়া এটি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সমস্যার উৎস সেখানেই।     

নমুনা ৩: বাংলাদেশে বিভিন্ন বিষয়ে যেমন অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, দর্শন, উন্নয়ন নীতি, অর্থনৈতিক সংস্কার, সুশাসন, সন্ত্রাস, পরিবেশ ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে, প্রতিষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার সিম্পোজিয়াম কনফারেন্স হয়। শতভাগ বাঙালি/বাংলা জানা বক্তা শ্রোতা থাকলেও ইংরেজি ভাষায় প্রবন্ধ/বক্তৃতা একটা উচ্চমান নির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হয়। এই মাপ/অলিখিত নিয়ম রক্ষা করতে নিয়ে বহুজন বিষয়বস্তুতে দক্ষ হলেও যে অংশগ্রহণ থেকে ছিটকে পড়েন তা নিশ্চিত বলা যায়।

উচ্চশিক্ষার মাধ্যম নিয়ে ১৯৭০ সালে সত্যেন বোস এক বক্তৃতায় যা বলেছিলেন তা স্মরণ করতে পারি,

‘আমরা ধরে নিয়েছি, বাংলা কাব্য ও সাহিত্যে চলতে পারে, মনের কথা বলতে পারে। কিন্তু কাজের কাজ ও ভাষায় চলবে না। যে কাজ ভিন্ন ভাষায় করতে হয়, সে কাজে কখনও মন থাকতে পারে না। সেজন্য দু’শ বছর ধরে ঐ ভাষাতে সব কাজ শিখেও তেমন কিছু গড়ে তুলতে পারি নি। আমাদের মনের ভাষা বংলা ভাষাকে কাজের ভাষা করে তুলতে হলে তার উপর কাজের দায়িত্ব দিতে হবে। সেই ভাষায় কাজের চিন্তার করতে হবে। তবেই এই ভাষা কাজের ভাষা হয়ে বলিষ্ঠ হয়ে উঠবে। এইভাবে আমাদের বিদ্বান, প-িত, ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, কারিগর, কারবারী, সরকারি-আমলা যখন এই বাংলা ভাষাকে তাদের মুখের, মনের ও কাজের ভাষা করে দাঁড় করাতে পারবেন, তখনই বাংলাদেশের অসংখ্য সাধারণ মানুষের সঙ্গে তারা তাদের নাড়ীর যোগ ফিরে পাবেন, বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে কাজকেও ভালবাসবেন। সাধারণ মানুষও উপর তলাকার জ্ঞানভারের শরিক হয়ে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবে।’

নমুনা ৪: ব্যাংক বা বিভিন্ন নিয়োগকারী দেশি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা অভিযোগ করে বলেন, ‘ইন্টারভিউ বোর্ডে আপনাদের ছাত্রছাত্রীদের অনেকে স্মার্টলি ইংরেজি বলতে পারে না কেন? কীভাবে ওদের চাকুরী হবে?’ আমি জিজ্ঞাসা করি, বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা ঠিক আছে?’ উত্তর হলো- ‘বিষয়বস্তু তো বড় ব্যাপার না। চাকুরির বাজারে ইংরেজি জানাই তো আসল।’ সবাই যে সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর জন্য পাগল তার একটা বড় কারণ এখানেই পাওয়া যাবে।

কিন্তু কেন?

ব্যাংকের আমানতকারী, ঋণগ্রহণকারী মানে যারা ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করেন তারা তো সবাই এদেশের মানুষ। এনজিওসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও তাই। যাদের সাথে কাজ তাঁেদর সবারই বাংলা জানার কথা। তাদের সাথে তো বাংলাতেই কথা বলতে হবে। বরং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উচ্চারণ রপ্ত করতে পারেন ভালো। সেখানে বিষয়বস্তু কর্মদক্ষতার চাইতে টাইস্যুট আর স্মার্ট ইংরেজি কেন চাকুরির জন্য অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হবে?

গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কনসালট্যান্সী ফার্ম এগুলোতেও কাজ করতে গেলে ইংরেজিই লাগে। কারণ সেখানে সবকাজ ইংরেজিতেই হয়। কিন্তু কেন? দেশের মানুষ এসব গবেষণার পাঠক হবে না কেন?

নমুনা ৫: বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানের সময় শিক্ষার্থীদের জন্য রেফারেন্স হিসেবে প্রধানত ইংরেজি বই-ই দেওয়া হয়। দিতেও হয়, কেননা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় মানসম্মত পাঠ্যবই, সম্পর্কিত গবেষণামূলক গ্রন্থ পাওয়া যায় না। অর্থনীতি বিভাগসহ সমাজবিজ্ঞান, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শনসহ সকল ক্ষেত্রেই এটি সত্য।

শিক্ষার্থীরা স্কুল কলেজে ১২ বছর ইংরেজি পড়ে আসার পরও সবচাইতে কাবু থাকে এই ভাষা নিয়েই। ১২ বছর ধরে ইংরেজি পড়লেও সেই ভাষায় লিখতে বলতে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাও বিপন্ন বোধ করে, কিন্তু এই দেশেরই অনেক শিক্ষার্থী জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশে গিয়ে দ্রুত সে দেশের ভাষা শিখে ফেলতে পারে, অনেকে সে ভাষায় পিএইচডি পর্যন্ত করে। ইংরেজি শেখার ব্যর্থতার কারণ প্রজাসুলভ ভীতি এবং শিক্ষার ভুল ধরন ছাড়া আর কী হতে পারে? ইংরেজি নিয়ে এতো আয়োজন যে ভেতর থেকেই ত্রুটিপূর্ণ এবং অসফল তা এখান থেকেই বোঝা যায়।

শিক্ষার্থীদের তাই ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে হয় বিষয়বস্তু নিয়ে না যতটা বিদেশি ভাষা ইংরেজি নিয়ে তার থেকে বেশি। হাতে গোনা কয়েকজন বাদে বাকিরা তাই কার্যত অনুসন্ধান করতে থাকে বাংলা বই। তারা পেয়ে যায় কিছু বই যেগুলোর বিষয়ে শিক্ষকেরাও হয়তো অবগত নন। এগুলোর বেশিরভাগ গাইড বই ধরনের, নিম্নমানের বা বাণিজ্যিক ভাবে সফল। অর্থাৎ ইংরেজি চাপিয়ে দিয়ে ফলাফল দাঁড়ায় এই যে, এতে না ভাষা শিক্ষা হয়, না বিষয়বস্তু যথাযথভাবে জানা হয়। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করে গভীর হীনমন্যতা নিয়ে। এরাই আবার পরে প্রশাসনে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দেয়। পুনরুৎপাদিত হতে থাকে হীনমন্যতা-অজ্ঞতার দুষ্টচক্র। এই চক্রের চাপে স্বাভাবিক জ্ঞানের নতুন নতুন জগত নিয়ে কৌতুহলও মরে যায়, প্রশ্ন আসে না। কৌতুহল আর প্রশ্ন না থাকলে আর কী অবশিষ্ট থাকে যা দিয়ে জ্ঞানচর্চা অগ্রসর হতে পারে?   

বহুবছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে আমি নিশ্চিত যে, যদি শিক্ষার্থীদের ওপর ‘ভয় পাওয়া’ ভাষার চাপ না থাকতো, যদি তারা নিজ ভাষায় ভালো মানের পাঠ্যবই পেতো তাহলে টেক্সট পড়া নিয়ে ভয় এই মাত্রায় থাকতো না। রেফারেন্স দেওয়া ইংরেজি বইএর বদলে নিম্নমানের বাংলা বই বা নোট বই বা গাইড বই বা বড় আপা/ভাইদের করা নোটের ফটোকপি নিয়ে তাদের ছুটাছুটি এবং নিরানন্দের পড়াশোনার বোঝা বইতে হতো না। তাদের চাপিয়ে রাখা মেধা হয়তো প্রকাশের পথ করে নিতে পারতো এবং আমরা হয়তো আরও আত্মবিশ্বাসী, কৌতুহলী, সৃজনশীল মানুষ পেতাম।

অর্থাৎ ইংরেজি চাপিয়ে দিয়ে ফলাফল দাঁড়ায় এই যে, এতে না ভাষা শিক্ষা হয়, না বিষয়বস্তু যথাযথভাবে জানা হয়। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করে গভীর হীনমন্যতা নিয়ে। এরাই আবার পরে প্রশাসনে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দেয়। পুনরুৎপাদিত হতে থাকে হীনমন্যতা-অজ্ঞতার দুষ্টচক্র। এই চক্রের চাপে স্বাভাবিক জ্ঞানের নতুন নতুন জগত নিয়ে কৌতুহলও মরে যায়, প্রশ্ন আসে না। কৌতুহল আর প্রশ্ন না থাকলে আর কী অবশিষ্ট থাকে যা দিয়ে জ্ঞানচর্চা অগ্রসর হতে পারে? 

জ্ঞানের সীমা নাই

আরজ আলী মাতুব্বর বলেছিলেন, ‘বিদ্যা শিক্ষার ডিগ্রী আছে, কিন্তু জ্ঞানের কোনো ডিগ্রী নাই। জ্ঞান ডিগ্রীবিহীন ও সীমাহীন’। খুবই ঠিক কথা। শুধু শিক্ষা-গবেষণা প্রতিষ্ঠানে নয়, শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রীধারীদের মধ্যে নয় জ্ঞান বিচরণ করে সর্বত্র। সকল স্তরের মানুষ তার নিজ নিজ পথে, নিজ নিজ উপায়ে জ্ঞান অর্জন করে, জ্ঞানচর্চা করে। একটি জনপদে পরম্পরায় তা প্রবাহিত হয়, কাল থেকে কালে, স্থান থেকে স্থানে তা ছড়াতে থাকে। জ্ঞান থেকে ডিগ্রী আসতে পারে ঠিকই কিন্তু ডিগ্রী মানেই জ্ঞান নয়। ইতিহাস সাক্ষèী, ক্ষমতাবানরা জ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে, কিন্তু তার উৎপাদন পুনরুৎপাদন কখনোই বন্ধ করে দিতে পারে না। তবে শিক্ষাব্যবস্থা বিকলাঙ্গ করলে যে কোনো দেশের জাতীয় সামগ্রিক বিকাশ মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। আমরা সেই পরিস্থিতির মধ্যেই হাবুডুবু খাচ্ছি।  

সমাজের বিভিন্ন সীমারেখা ধরে জ্ঞান চলে না, যদিও এসব সীমা জ্ঞানচর্চা প্রভাবিত করে। কোনো রাষ্ট্রীয় সীমা ধরেও জ্ঞান তৈরি হয় না, সে সীমায় আটকেও থাকে না, কোনো কালেও তা সীমিত থাকে না। জ্ঞানের মালিকানা, কর্তৃত্ব তাই কোনো রাষ্ট্র, জাতি, গোষ্ঠী দাবি করতে পারে না। সেজন্য কোনো জনগোষ্ঠী যদি জ্ঞানের সঠিক সন্ধান পেতে চায় তাহলে একদিকে তার নিজের জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানচর্চা সামনে আনতে হবে আর তার সাথে যোগ করতে হবে বিশ্বের নানা প্রান্তের জ্ঞান বিজ্ঞানের সার। শুধু নিজেদের মধ্যে আটকে থাকলে যেমন হবে না, তেমনি নিজের শেকড় অগ্রাহ্য করে ঝুলে থেকেও নিজের শক্তি দিয়ে তার সমগ্রটা ধরা তার পক্ষে সম্ভব হবে না।     

জ্ঞানের মালিকানা, কর্তৃত্ব তাই কোনো রাষ্ট্র, জাতি, গোষ্ঠী দাবি করতে পারে না। সেজন্য কোনো জনগোষ্ঠী যদি জ্ঞানের সঠিক সন্ধান পেতে চায় তাহলে একদিকে তার নিজের জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানচর্চা সামনে আনতে হবে আর তার সাথে যোগ করতে হবে বিশ্বের নানা প্রান্তের জ্ঞান বিজ্ঞানের সার। শুধু নিজেদের মধ্যে আটকে থাকলে যেমন হবে না, তেমনি নিজের শেকড় অগ্রাহ্য করে ঝুলে থেকেও নিজের শক্তি দিয়ে তার সমগ্রটা ধরা তার পক্ষে সম্ভব হবে না।

সেজন্যই জ্ঞানচর্চাকে একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর কাজ বা তার সীমানায় আটকে রাখা বা শুধু সেটাকেই জ্ঞান হিসেবে মান্য করে কোনো জনগোষ্ঠী তার সমগ্র নিয়ে দাঁড়াতে পারে না। যদি দাঁড়াতে হয় তাহলে জ্ঞান বিজ্ঞানের জগতে সকল নাগরিকের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তার জন্য বাংলাদেশে প্রথমত, সকল পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম প্রধানত বাংলা করতে হবে। এর বাইরে অন্যান্য জাতির ভাষার স্থানও তৈরি করতে হবে। সে অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক তৈরি করতে হবে। সেইসাথে স্কুল কলেজ পর্যায়ে ইংরেজিসহ বিদেশি ভাষা শিক্ষা বিশেষ গুরুত্ব  ও দক্ষতার সাথে পরিচালনা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বের সকল জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রকাশনা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করতে হবে। বাংলা প্রকাশনাও অনুবাদ করতে হবে অন্যান্য ভাষায়। অভিন্ন মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থায় মাতৃভাষায় শিক্ষার মধ্য দিয়ে সর্বজনের যে দৃঢ়ভিত্তি তৈরি হবে তার ওপর দাঁড়িয়েই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার সাথে অর্থবহ কার্যকর যোগসূত্র স্থাপন সম্ভব হবে। কোনো অঞ্চলেই এর কোনো ব্যতিক্রম নেই।

ভাষা ও পরিভাষা

অন্যান্য ভাষার মতো বাংলা ভাষারও বিবর্তন হয়েছে। প্রথমে লেখ্য ভাষা অনেক সংস্কৃত নির্ভর হিসেবে এলিট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমিত ছিলো। ক্রমে মুখের ভাষা আর লেখার ভাষার পার্থক্য কমিয়ে আনার চেষ্টা হয়েছে। বাঙালী মুসলিম সমাজে ব্যবহৃত আরবী ফার্সি তাতে যোগ হতে থাকে। আরও পরে বিভিন্ন আঞ্চলিক শব্দও প্রবেশের পথ পেতে থাকে। বাঙালী সমাজেও বাংলা ভাষার রূপ নিয়ে নানা বিতর্ক দেখা দেয়। বাংলা ভাষার বিকাশের সঠিক পথনির্দেশে শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায়কে পুরোধা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর ধারাবাহিকতায় দ্বিজেনদ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বিশেষ ভ’মিকা পালন করেন।       

উচ্চশিক্ষায় বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটা অভিযোগ প্রায়ই আসে যে, এখানে পরিভাষার সমস্যা প্রকট। বিভিন্ন জ্ঞান বিজ্ঞানের বিষয় বাংলায় বলা প্রসঙ্গে এরকম কথা খুব শোনা যায় যে, বাংলায় কীরকম উদ্ভট শোনায়! বাংলায় ঠিকভাবে প্রকাশ করা যায় না। রবীন্দ্রনাথ এদের কথাই বলেছিলেন,

বাংলা তাঁহারা জানেন না সে কথা স্পষ্টরূপে স্বীকার না করিয়া তাঁহারা বলেন, ‘বাংলায় কি কোনো ভাব প্রকাশ করা যায়? এ ভাষা আমাদের মতো শিক্ষিত মনের উপযোগী নহে।’

আসলে ভাষার বিকাশ এমনি এমনি হয়না। চর্চা আর জীবনের প্রয়োজনের সাথে সাথে ভাষার বিকাশ ঘটে, যার কোনো শেষ নেই। পরিভাষাও তাই আগে আসে না, আলাদা করে আসে না। প্রয়োজনের মধ্যে দিয়ে তা তৈরি হতে থাকে, সমাজে বিদ্যায়তনে গ্রহণযোগ্যতা পেলে তা টিকে যায়। যেমন একসময়ে ইউনিভার্সিটি আর বিশ্ববিদ্যালয় শব্দদুটো নিয়ে বেশ রসিকতা হতো, এখন বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটি বরং বেশি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু মোবাইল-এর বাংলা মুঠোফোন বা ইন্টারনেট এর বাংলা অন্তর্জাল, টেলিফোন এর বাংলা দুরালাপনী গ্রহণযোগ্যতা পায় নি। যেমন আগে থ্যাংকস এর বাংলা ধন্যবাদ বলার চল ছিলো না, ক্রমে এখন এই শব্দও বাঙালীর মুখে সহজ হয়ে গেছে। আসলে সকল শব্দের জোরজবরদস্তি বাংলা করারও দরকার নাই। কারণ দ্রব্য বা ধারণার উৎসস্থল যেখানে, সেগুলোতে তার জন্মস্থানের দাগ থাকাই স্বাভাবিক। যেমন ইন্টারনেট, মোবাইল, অনলাইন, টেলিফোন, টেলিভিশন এগুলো বাইরে থেকে আসা দ্রব্য ও নাম, এসব শব্দ এখন আমাদের মুখের কথার বাংলার অংশ হয়ে গেছে। সেটাই হয়। সব ভাষাতেই তাই হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় বাংলা ভাষায় বহুভাষার শব্দ প্রবেশ করেছে। এগুলোর মধ্যে আছে: সংস্কৃত, আরবি, ফার্সি, ইংরেজি, পর্তুগীজ, ফরাসি, তুর্কি, চীনা, বর্মি, হিন্দী, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, মারাঠি, সাঁওতাল, জাপানি, ওলন্দাজ ইত্যাদি। এটা ভাষার দুর্বলতা নয়, শক্তি। যেমন ইংরেজিতে লাতিন-ফরাসী শব্দের বহুল উপস্থিতি, সেগুলো ইংরেজি হিসেবেই গ্রহণ করি আমরা।  

প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন বিষয়ক যথেষ্ট সংখ্যক লেখা বাংলা ভাষায় না হবার কারণে পরিভাষার তাগিদও বাড়েনি। যান্ত্রিকভাবে শব্দের আক্ষরিক অনুবাদে প্রকৃত পরিভাষার কাজ হয় না। বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কিত শব্দ আরেক ভাষায় উপস্থিত করতে গেলে সে ভাষায় তার সমার্থক ধারণা করতে পারে এরকম শব্দই তৈরি করতে হবে, আক্ষরিক অনুবাদের বদলে নতুন শব্দ বেশি উপযোগী হতে পারে। বস্তুত এ এক অবিরাম উদ্ভাবনী কাজ। তার অনুপস্থিতির কারণেই এখনও বাংলায় কোনো পরিভাষা দুর্বল, অদক্ষ কিংবা হাস্যকর ঠেকে অনেকের কাছে। অবশ্য হাস্যকর ঠেকার আরও কারণ বাংলা ভাষা গ্রহণ না করার মনস্তত্ত্ব।

অন্যদিকে আমরা আবার দেখি বাংলাদেশে মোবাইল ও ইন্টারনেট বিস্তারের সাথে সাথে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে এর ব্যবহারের আওতায় আনতে গিয়ে এই প্রযুক্তি জগতেই বাংলার ব্যবহার বেড়ে গেল দ্রুত। ফেসবুক, গুগল তাদের গ্রাহক সংখ্যা বাড়াতে বাংলাভাষায় সবকিছু পাল্টে দিল। বহু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নিজেদের ব্যবসার স্বার্থেই বাংলা ব্যবহার শুরু করেছে। মোবাইল কোম্পানি গুলোও এখানে তাদের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য সেগুলোতে এখন বাংলা ব্যবহারের সহজ উপায় সৃষ্টি করেছে। তারমানে বাণিজ্যিক জগত ঠিকই বোঝে যদি ব্যবসা করতে হয় মানুষের সাথে যোগাযোগ ছাড়া উপায় নাই, আর তার জন্য তাদের ভাষাতেই যোগাযোগ করতে হবে। অথচ এই সহজ বিষয়টি রাষ্ট্র, নীতিনির্ধারক, বুদ্ধিজীবীরা বুঝতে পারেন না বা বুঝতে চান না। ‘যতো কম জানে ততো বেশি মানে’, ‘জনগণ থেকে যতো দূরে ততো বেশি আভিজাত্য’ এই দর্শনেই হয়তো শাসক এবং এলিটদের জন্য জ্ঞানের জগত থেকে জনগণকে দূরে রাখা দরকার।

যান্ত্রিকভাবে শব্দের আক্ষরিক অনুবাদে প্রকৃত পরিভাষার কাজ হয় না। বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কিত শব্দ আরেক ভাষায় উপস্থিত করতে গেলে সে ভাষায় তার সমার্থক ধারণা করতে পারে এরকম শব্দই তৈরি করতে হবে, আক্ষরিক অনুবাদের বদলে নতুন শব্দ বেশি উপযোগী হতে পারে। বস্তুত এ এক অবিরাম উদ্ভাবনী কাজ। তার অনুপস্থিতির কারণেই এখনও বাংলায় কোনো পরিভাষা দুর্বল, অদক্ষ কিংবা হাস্যকর ঠেকে অনেকের কাছে। অবশ্য হাস্যকর ঠেকার আরও কারণ বাংলা ভাষা গ্রহণ না করার মনস্তত্ত্ব। 

উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও উন্নয়নের ভাষা

বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র হিসেবে অভিহিত হয়। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বৌদ্ধ বিহার, মন্দির, গীর্জা, মসজিদ ঘিরে যে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল সেগুলো থেকে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভব ও বিকাশ।৭ বিশ্বজুড়ে এর ইতিহাসে বহু উত্থান পতন দেখা যায়। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস এদেশের যাত্রাপথের সাথেই সম্পর্কিত। তবে গত একদশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে দ্রুত। বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫০, আর প্রাইভেট বা বাণিজ্যিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা শতাধিক। তবে শিক্ষা, গবেষণা, শিক্ষক, পড়াশোনা, হলের অবস্থা, ক্লাশ, পরীক্ষা নিয়ে অভিযোগ আছে বিস্তর। প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ, গবেষণা, শিক্ষক নিয়োগ, ক্লাশ, পরীক্ষা ইত্যাদিতে মনোযোগ না থাকলেও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি বাধ্যতামূলক করার ব্যাপারে মনোযোগ ও সক্রিয়তা সবচাইতে বেশি। বই থাকুক না থাকুক, মান যাই হোক।

তবে নানারকম দুরবস্থা, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা সত্ত্বেও দেশে স্বাধীনভাবে (যা ফরমায়েশী নয়) যতটুকু গবেষণা হয় তার অধিকাংশ হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই, প্রধানত পুরনোগুলোতে। বিশেষত এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রী সূত্রে এসব প্রতিষ্ঠানে বহু বিষয়ে গবেষণার কাজ একটা অব্যাহত প্রক্রিয়া। এটা ঠিকই যে, এগুলোর একটি বড় অংশ প্রধানত মানের কারণে প্রকাশযোগ্য নয় বলে প্রকাশিত হয় না। আর যেগুলো প্রকাশিত হয় তার সিংহভাগই ইংরেজি ভাষায়।

বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে পিএইচডি করেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে গবেষণা করেন। সেগুলো তো অনিবার্যভাবে ইংরেজিই প্রধানত, অন্যান্য ভাষাও আছে। এসব গবেষণার প্রায় কোনোটাই দেশের মানুষের কাছে পৌছায় না। বাংলায় অনুবাদ হয়ে তো নয়ই। তার মানে বাংলাদেশ নিয়ে, বাংলাদেশের মানুষদের নিয়ে বিজ্ঞান-সমাজবিজ্ঞান-মানবিক বিভিন্ন শাখায় দেশে বিদেশে যতো গবেষণা হচ্ছে তার বিরাট অংশ দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ থেকে বহুদূরে, শুধু ভাষার কারণে।   

শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের ক্রম শক্তিবৃদ্ধিতে শিক্ষার সকল পর্যায়ে ইংরেজির আধিপত্য দ্রুত বেড়েছে। বাংলার বাজার মূল্য একেবারেই কম, ইংরেজি মাধ্যম ছাড়া বাণিজ্যের পসারের সম্ভাবনা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাণিজ্যিকীকরণ, মুনাফামুখি তৎপরতার ধারাকে আরও জোরদার করছে বিশ্বব্যাংকের ঋণে দর্শনে পরিচালিত ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্রসহ বিভিন্ন নীতিমালা ও প্রকল্প। এর সর্বশেষ সংযোজন ‘আইকিউএসি’। দেশের জনভিত্তিসম্পন্ন সামগ্রিক দার্শনিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ভ’মিকা থাকা দরকার তার উল্টোটাই ঘটছে বেশি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার সম্পর্কও খুবই ক্ষীণ। তাছাড়া দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পর্কিত সকল প্রতিষ্ঠানই তাদের কার্যক্রমে ইংরেজিই প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। সকল মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, পরিকল্পনা কমিশন, ওয়াসা, পিডিবি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, এনজিও, ব্যাংক এবং বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা বিআইডিএস, সিপিডি, পিআরসি সকলেই।

সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার চাহিদা এবং অর্থ বরাদ্দে বিভিন্ন কনসালট্যান্সী/গবেষণা হয়। এসব রিপোর্টে তাই মূল পাঠক হিসেবে সেসব সংস্থাকেই গণ্য করা হয়। ইংরেজি ভাষাতে প্রণীত এসব রিপোর্ট সাধারণের অগম্য তো বটেই অনেক ক্ষেত্রে ইংরেজি জানা কেউ আগ্রহী থাকলেও এগুলো পাওয়া কঠিন। যাদের নির্দেশে এসব গবেষণা, তারা ছাড়া আর কারও কাছে এগুলো পৌঁছানোর তেমন উদ্যোগও দেখা যায় না।  এনজিও রিপোর্টগুলোর ক্ষেত্রেও তাই, প্রধানত তহবিল যোগানদারদের অবগতির জন্য। তহবিল ছাড়ের শর্ত অনুযায়ী বিভিন্ন রিপোর্ট প্রণীত হয়। সেগুলোর ভাষাও ইংরেজি, অথচ এসব রিপোর্ট গবেষণা সবই বাংলাদেশের গরীব মানুষ, দারিদ্র ইত্যাদি নিয়ে।

বাংলাদেশে বর্তমান পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে সরকারিভাবে নিজেদের সকল উন্নয়ন কাজের চালিকা শক্তি হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এইসব পরিকল্পনা দলিল, তার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তৈরি বিভিন্ন গবেষণাপত্র সবই ইংরেজি ভাষার প্রণীত। জনগণ তো দূরের কথা, সেগুলো দেশের বিদ্যায়তনগুলোতেও সুলভ নয়। বাস্তবে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচির লক্ষ্য হিসেবে বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা গুলো এখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এজন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামের জন্য নিয়মিত অগ্রগতি রিপোর্ট প্রণয়ন করে থাকে। ব্যস্ততা এই কাজেই বেশি, আর এগুলো সবই লেখা হয় ইংরেজিতে। বাংলাদেশের মানুষের অজানাই থাকে সরকার তাদের নিয়ে কী পরিকল্পনা করছে, তাদের অগ্রগতির কী কী রিপোর্ট আন্তর্জাতিক দরবারে উপস্থিত করছে।

সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার চাহিদা এবং অর্থ বরাদ্দে বিভিন্ন কনসালট্যান্সী/গবেষণা হয়। এসব রিপোর্টে তাই মূল পাঠক হিসেবে সেসব সংস্থাকেই গণ্য করা হয়। ইংরেজি ভাষাতে প্রণীত এসব রিপোর্ট সাধারণের অগম্য তো বটেই অনেক ক্ষেত্রে ইংরেজি জানা কেউ আগ্রহী থাকলেও এগুলো পাওয়া কঠিন। যাদের নির্দেশে এসব গবেষণা, তারা ছাড়া আর কারও কাছে এগুলো পৌঁছানোর তেমন উদ্যোগও দেখা যায় না।  এনজিও রিপোর্টগুলোর ক্ষেত্রেও তাই, প্রধানত তহবিল যোগানদারদের অবগতির জন্য। তহবিল ছাড়ের শর্ত অনুযায়ী বিভিন্ন রিপোর্ট প্রণীত হয়। সেগুলোর ভাষাও ইংরেজি, অথচ এসব রিপোর্ট গবেষণা সবই বাংলাদেশের গরীব মানুষ, দারিদ্র ইত্যাদি নিয়ে।

সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, ইউএসএইড, জাইকার ঋণে বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালিত হয়। বস্তুত প্রায় সব মন্ত্রণালয়েই এসব সংস্থার ঋণযুক্ত বিভিন্ন প্রকল্পের সন্ধান পাওয়া যাবে। এসব প্রকল্পের ব্যাপারে ঋণদাতা সংস্থাগুলোর যেমন আগ্রহ থাকে তেমনি গ্রহীতা হিসেবে সরকারি আমলা/মন্ত্রী/ব্যবসায়ীদেরও আগ্রহ থাকে। কারণ এগুলোর সাথে মন্ত্রী আমলাদের বিদেশ সফর, প্রজেক্ট কর্তা হিসেবে আমলাদের বাড়তি সুযোগ সুবিধা, ব্যবসায়ীদের ক্রয়/আমদানির মুনাফা, কনসালট্যান্টদের বাড়তি আয় সম্পর্কিত। সুতরাং প্রয়োজন থাকুক না থাকুক, ক্ষতিকর বা বিপজ্জনক যাই হোক এসব প্রকল্পে ভরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়।

অথচ এগুলোর সবই বাংলাদেশের উন্নয়নসংক্রান্ত, যেমন, নারী-গরীব-প্রান্তিক মানুষদের ক্ষমতায়ন, উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ, তাদের জীবন জীবিকা, পরিবেশ, যোগাযোগ, পানিসম্পদ, বিদ্যুৎ জ্বালানি, সক্ষমতা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক সংস্কার, বিনিয়োগ, শিক্ষা, চিকিৎসা, দারিদ্র দূরীকরণসহ ভবিষ্যৎ নানা কর্মসূচি। সেসব প্রকল্পের রিপোর্ট সবই ইংরেজি। যাদের নিয়ে ব্যয়বহুল এসব রিপোর্ট তার কোনোটাই তাদের ধরাছোঁয়ার মধ্যে থাকে না। তাঁদের সম্মতি তো অনেক দূরের বিষয়। কেনাকাটা বিদেশ সফর তো বটেই এমন অনেক নীতি/কর্মসূচি এসব প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহীত হয় যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য ক্ষতিকর হয়। এধরনের প্রকল্পের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে পাটশিল্পের বিনাশের পথ তৈরি হয়েছে, সর্বজনের শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবসায়িক বিষয়ে পরিণত হয়েছে, জাতীয় সম্পদে বহুজাতিক পুঁজির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, গ্যাস বিদ্যুতের দাম ক্রমাগত বাড়ছে ইত্যাদি। দৃষ্টান্ত হিসেবে দুটো মহাপরিকল্পনার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। 

বাংলাদেশের জন্য নদী/পানি সম্পদ সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ, এই ভ’খন্ডের জন্ম, প্রাণ প্রকৃতি জীবন জীবিকার প্রধান উৎস। এই নদীর সাথে বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর।  তার শক্তি ও সংকটের, গতি ও দুর্গতির কারণ সমাধানের বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ১৯৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগত ক্রুগ মিশন থেকে গুরু করে সর্বশেষ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ পর্যন্ত নদী ও পানি সম্পদ নিয়ে যতগুলো পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে সবগুলোই বাংলাদেশের প্রকল্প প্রকৃতি সস্পর্কে অজ্ঞ বিদেশি কনসালট্যান্টদের নিয়ে। এগুলো সবই ইংরেজি ভাষায় প্রণীত, যারা ইংরেজি জানেন তারাও এগুলো সম্পর্কে খুব কমই জানেন। বিদেশি ঋণে এসব নীতি নির্ধারণী প্রকল্প নেয়া হয়েছে, সিদ্ধান্ত হয়েছে তার বাস্তবায়নও হয়েছে। এসব সম্পর্কে নদীর মানুষেরা কিছুই জানতে পারেননি।

দেশি বিদেশি কনসালট্যান্টদের সুপারিশে, ক্ষমতাবানদের ইচ্ছায় জনকল্যাণ/বন্যা নিয়ন্ত্রণ/সেচ/উৎপাদন বৃদ্ধি ইত্যাদি নামে সারা দেশের নদীগুলোর মধ্যে হাজারো বাঁধ/স্লুইস গেট/ পোন্ডার নির্মিত হয়েছে। বহু নদী এগুলোর কারণেই এখন মৃতপ্রায়। যেসব নীতি/ পরিকল্পনার কারণে নদীগুলোর এই দশা সেগুলোর যথাযথ পর্যালোচনা না করে, দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন না করে আবারও ওলন্দাজ বিশেষজ্ঞদের দিয়ে শতবর্ষের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ৭০০০ পৃষ্ঠার এই দলিল যথারীতি ইংরেজিতে প্রণীত। নদীর মানুষের কাছে মৌখিক অসার/মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছু পৌঁছায় না। একদিকে সমগ্র বাংলাদেশের নদী ও পানিসম্পদ নিয়ে শতবর্ষের মহাপরিকল্পনা নেবার পর আবার খন্ড খন্ড ভাবে বিভিন্ন নদী নিয়ে আবার মহাপরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। বিদেশি ঋণযুক্ত প্রকল্প যখন যেভাবে পাওয়া যায় সেভাবেই কাজ চলছে। এসব পরিকল্পনার বিষয় ঠিকাদার, প্রকৌশলী, কনসালট্যান্ট অর্থাৎ এসব প্রকল্প থেকে যারা লাভবান হবে তারাই কেবল জানে। জনগণের এগুলো নিয়ে জানা বা মতামতের কোনো সুযোগ নেই। বহু খাতেই একই ধরনে মহাপরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। 

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সম্পর্কে মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে ২০৪১ সাল পর্যন্ত। এটা করা হয়েছে জাপানী সংস্থা জাইকা এবং কয়েকটি প্রাইভেট কোম্পানির কর্তৃত্বে এবং শতভাগ জাপানী কনসালট্যান্টদের দিয়ে। জাইকার মাধ্যমে ২০১৬ সালে প্রণীত মহাপরিকল্পনা (পিএসএমপি ২০১৬) অনুযায়ী সরকার দেশের বিদ্যুৎ খাতে কয়লা, এলএনজি ও পারমাণবিক নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। ব্যয়বহুল পথ গ্রহণ ও দুর্নীতির বোঝা জনগণের উপর চাপাতে বারবার বাড়ানো হচ্ছে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম, গণশুনানীকে বানানো হয়েছে প্রহসন। পারমাণবিক বিদ্যুতের ঝুঁকি ও বিপদের যে কোনো সীমা পরিসীমা নেই তা সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশের মতো ঘন জনবসতি, পানি ও আবাদী জমির উপর বিপুল ভাবে নির্ভরশীল একটি দেশে এই ঝুঁকি বিশে^র যে কোনো দেশের চাইতে অনেক বেশি। এই সত্য অগ্রাহ্য করে রূপপুরে বাংলাদেশের সবচাইতে ব্যয়বহুল পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প করা হচ্ছে। উপক’ল জুড়ে সুন্দরবন থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত দেশবিনাশী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প করা হচ্ছে ২০টিরও বেশি। বাংলাদেশের জন্য তৈরি হচ্ছে মহাবিপর্যয় ও জাতীয় নিরাপত্তাহীনতার হুমকি। এই মহাপরিকল্পনার ভাষাও ইংরেজি। বাংলাদেশের মানুষের এসম্পর্কে বিস্তারিত জানার উপায় নাই, বরং এগুলো নিয়ে যাতে মানুষ না জানে বা প্রশ্ন করতে না পারে তার জন্য আছে প্রবল পাহারা, হুমকি, নজরদারির ভয়াবহ আয়োজন।

উন্নয়ন ও ভাষা: পরাধীনতা

‘উন্নয়ন’ যদি টেকসই না হয় তাহলে তাকে উন্নয়ন বলা যায় কীভাবে? প্রকৃতপক্ষে আমরা তাকেই উন্নয়ন বলতে পারি যা ভঙ্গুর নয়, অস্থায়ী নয়, শুধু বর্তমানের নয়, শুধু সমাজের ক্ষুদ্র একাংশের নয়, প্রকৃতি বিরুদ্ধ নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে নয়। একটি সমাজে উন্নয়ন শুধু অর্থনীতির বলয়ে সীমাবদ্ধ থাকার বিষয় নয়। উন্নয়ন টেকসই হোক বা ভঙ্গুর হোক, সর্বজনের হোক বা স্বল্পজনের হোক, তার প্রভাব সর্বত্রই পড়ে। মানুষের জীবন, তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ গতিমুখ, প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ, সমাজের নানা প্রতিষ্ঠানের বিকাশের ধরন, বিভিন্ন শ্রেণী পেশার ভাঙন গঠন, ঐক্য সংঘাত, শান্তি সহিংসতার ধরন সবকিছুকেই প্রভাবিত করে। সেজন্য উন্নয়ন প্রশ্ন সমাধান ছাড়া অন্য বিষয়গুলোও সমাধানের পথ পায় না। আর উন্নয়ন প্রশ্ন যে ভাষা প্রশ্নের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত তা দুনিয়ার সকল দেশের অভিজ্ঞতা থেকেই স্পষ্ট হয়। 

টেকসই উন্নয়নের সহজ সংজ্ঞা হলো যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজন মেটানোর সক্ষমতা নষ্ট না করে বর্তমানের প্রয়োজন মেটায়।  অর্থাৎ টেকসই উন্নয়ন হলো সম্পদ ব্যবহারের এরকম ধরন যা মানুষের প্রয়োজন মেটানোর সাথে সাথে পরিবেশ রক্ষা করে এমনভাবে যাতে তা শুধু বর্তমানের নয়, ভবিষ্যতের প্রজন্মের প্রয়োজন মেটাতেও কাজে লাগবে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যসমূহ নির্ধারণ করতে গিয়ে ২০১৫ সালের ২৫-২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ আয়োজিত সর্বরাষ্ট্রীয় সম্মেলন শেষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের দীর্ঘ ঘোষণা প্রকাশ করা হয়েছে। ঘোষণায় বলা হয়েছে,

‘আমরা এমন  এক বিশ্ব কল্পনা করি যেখানে প্রতিটি দেশ একটানা, অন্তর্ভূক্তিমূলক এবং টেকসই অর্থনৈতিক  প্রবৃদ্ধি ভোগ করবে এবং সবার জন্য শোভন কাজের নিশ্চয়তা থাকবে। এমন এক বিশ্ব যেখানে ভোগ এবং উৎপাদন ধরন এবং সকল প্রাকৃতিক সম্পদ- বাতাস থেকে জমি, নদী, লেক, ভ’গর্ভস্থ পানি থেকে সাগর মহাসাগর, ব্যবহারের ধরন হবে টেকসই।’ তাঁরা আরও বলেছেন,  ‘আমরা এমন এক বিশ্ব কল্পনা করি যেখানে গণতন্ত্র, সুশাসন এবং আইনের শাসনের সাথে সাথে টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশ রক্ষা হবে, অন্তর্ভূক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র ও ক্ষুধার নিরসন ঘটবে।’  বলছেন, ‘এমন এক বিশ্ব যেখানে উন্নয়ন এবং প্রযুক্তির ব্যবহার হবে জলবায়ু সংবেদনশীল, যেখানে জীববৈচিত্র গুরুত্ব পাবে। এমন এক বিশ্ব যেখানে মানুষ প্রকৃতির সাথে সমন্বয় করে বাঁচবে এবং যেখানে বন্যপ্রাণী ও অন্যান্য জীবিত প্রজাতি রক্ষা পাবে।’৯

বাংলাদেশ সরকারও এই ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে সম্পূর্ণ দূরে রেখে কী ধরনের উন্নয়ন সম্ভব তা আমরা এই ঘোষণার উল্টোযাত্রা- নদীর মৃত্যু, বন উজাড়, বায়ুদূষণ, সম্পদ পাচার, জাতীয় স্বার্থবিরোধী একের পর এক চুক্তি, সর্বজনের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তাহীনতা, সন্ত্রাস ও লুন্ঠনের ব্যাপক আয়োজন থেকে বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারি। এরকম একটি প্রাণবিনাশী উন্নয়ন মডেল যখন কোনো দেশে আধিপত্য করে তখন ভাষার মাধ্যমে দেশি-বিদেশি শাসকদের সাথে সর্বজনের বিচ্ছেদ এই মডেল বাস্তবায়নে অপরিহার্য সহযোগী হয়ে ওঠে। 

জনগণকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে, তার মতামত-জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-স্বার্থ বিবেচনায় না নিয়ে, অংশগ্রহণের সুযোগ রুদ্ধ করে একটি দেশের উন্নয়নধারা কীভাবে টেকসই হতে পারে? যেসব দেশ বর্তমানে জনগণের জীবনমান উন্নয়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যে মডেলেই হোক, সেসব দেশের কোনোটিতেই এরকম উদাহরণ নেই যে, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি বিদেশি ভাষা নির্ভর করে, জ্ঞান সৃষ্টির প্রক্রিয়ায়, নীতিনির্ধারণ, উন্নয়ন নীতিমালা সম্পূর্ণ বিদেশি ভাষায় প্রণয়ণ করে তারা তা সম্ভব করতে পেরেছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে পরিস্থিতি এমন যে, শিক্ষা গবেষণা ক্ষেত্রে ইংরেজি মাধ্যম গ্রহণ না করলে ব্যক্তিগত পেশাগত, বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে বিকাশের সম্ভাবনা ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে; আবার গবেষণা, পেশাগত পরিচয়ে নতুন সৃষ্টি বা কাজে ইংরেজি মাধ্যম নির্ভরশীলতার কারণে সংখ্যালঘুর সাথে সংখ্যাগুরুর জ্ঞানের দূরত্ব আরও বাড়ছে। এর কারণে আবার সংখ্যালঘুর জগত আরও সংকীর্ণ ও পরনির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে। এই দুষ্টচক্র ভাঙার একমাত্র উপায় দেশের জনগণের ভাষায় শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা নিশ্চিত করতে একটা বড়ধরনের মৌলিক পরিবর্তন আনা। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রকাশনা অনুবাদ নিয়মিত ও ত্বরিৎ প্রক্রিয়া হিসেবে চালু করার জন্য শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নাই। সাথে সাথে বাংলাদেশি ও বিদেশিদের সকল গবেষণা বাংলায় সুলভ করার ব্যবস্থা গ্রহণও অবশ্য কর্তব্য। সকল পর্যায়ে বাংলা পাঠ্যপুস্তুক প্রণয়ন ও অনুবাদও একইসাথে জরুরী কাজ। বাংলাদেশের উন্নয়ন সংক্রান্ত সকল জরীপ, গবেষণায় সরকারের নীতিমালা, পরিকল্পনা অবশ্যই বাংলাভাষায় প্রণয়ন করতে হবে এবং তা সর্বজনের জন্য সুলভ করতে হবে। প্রয়োজনে এর সারসংক্ষেপ বা প্রয়োজনীয় অংশ ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করতে হবে। দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়কে এসব নীতিমালা প্রণয়নে যুক্ত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা ও প্রকাশনা বাবদ বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

উন্নয়ন বলতে শুধু ভবন আর অবকাঠামো বোঝায়না। বোঝায় না শুধু জিডিপি প্রবৃদ্ধি। এসব ক্ষেত্রে অনেক সাফল্যও একটি দেশকে দীর্ঘমেয়াদে বিপর্যয়, বিপন্নতা ও ঋণগ্রস্ততার দিকে ঠেলে দিতে পারে যদি তা কতিপয়ের বুদ্ধি-স্বার্থ-বিবেচনাহীনতা দ্বারা পরিচালিত হয়। আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে- বন, নদী বিনাশ করে, বায়ু বিষাক্ত করে, দেশকে বিপন্ন করে, জনগণকে শৃঙ্খলিত করেও উন্নয়নের জৌলুস দেখা যেতে পারে। কিন্তু যদি জনস্বার্থ, দেশের প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ কেন্দ্রে না থাকে তাহলে কোনো জৌলুস, উচ্চ ভবন, আর্থিক বিস্তার সমগ্র বিকাশ বা টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারবে না।

দেশের মানুষকে জানতে হবে তার নামে, তার অর্থে কী হচ্ছে, কী নীতিমালায় দেশ চলছে, দেশ নিয়ে কী পরিকল্পনা হচ্ছে। জানতে হবে, সেই সাথে তার মতের গুরুত্ব থাকতে হবে, তার অংশগ্রহণ থাকতে হবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার কাঠামোতে। মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণে দেশে যে সকল জনসম্পদ তৈরি হবে, মাতৃভাষায় নীতিনির্ধারণের মধ্য দিয়ে নাগরিকদের কাছে জবাবদিহির যে ক্ষেত্র তৈরি হবে তার মধ্যে দিয়ে সর্বজনের উন্নয়নের শক্তিশালী ভিত্তি নির্মাণ হতে পারে, সর্বজনের সৃজনশীলতার সকল বাধা দূর হতে পারে কেবল এভাবেই।

ব্রিটিশ আমলের প্রসঙ্গ টেনে সৈয়দ মুজতবা আলী বহুবছর আগে যা বলেছিলেন তা ব্রিটিশ, পাকিস্তান পার হয়ে বাংলাদেশের প্রায় ৫০ বছর বয়সে আরও বেশি সত্য হয়ে ওঠেছে। তাঁর সেই কথা গুলো দিয়েই এই প্রবন্ধ শেষ করি। তিনি তখন বলেছেন,

‘মুসলমান যুগে বরঞ্চ ভদ্রে-গ্রাম্যে কিঞ্চিত যোগাযোগ ছিল, কারণ মুসলমান যুগে আমাদের সভ্যতা ছিল গ্রাম্য, অর্থাৎ জনপদ সভ্যতা; কিন্তু ক্রীশ্চান আমলে সভ্যতা ইংরেজী-অভিজ্ঞ এবং ইংরেজী-অনভিজ্ঞের মাঝখানে এমনি এক বিরাট, নিরেট পাঁচিল তুলে দিলে যে, আজও আমরা সে দেয়াল ভাঙতে পারি নি, এবং ভাঙবার চেষ্টা করতে চাই নে। আমরা এখন ইংরেজী জাননে ওয়ালা আর ইংরেজী-না- জাননে ওলার মাঝখানে সেই প্রাচীন অন্ধপ্রাচীর, অচলায়তন খাড়া রাখতে চাই। এই ব্যবস্থাটাকেই আমি ডরাই, বড্ড ডরাই। এ-ব্যবস্থা মেনে নিলে আপনারা একদিন আবার পরাধীন হবেন।’১০  

উচ্চ ডিগ্রীওয়ালা বাঙালী সমাজ এই পরাধীনতাকেই তুলে ধরছে ফুলের মালা হিসেবে।  

————————————–

আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ভাষা ও উন্নয়ন বিষয়ক আঞ্চলিক সম্মেলনে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধ (২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০), কিঞ্চিত পরিমার্জিত সংস্করণ।

তথ্যসূত্র:

১। অক্ষয় কুমার দত্ত: ‘বঙ্গদেশে শিক্ষার বর্তমান অবস্থা’, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ,  বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, ২০০৫

২। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: ‘শিক্ষার হেরফের’, শিক্ষা চিন্তা, রবীন্দ্ররচনা সংকলন, গ্রন্থালয়, কলকাতা, ১৯৮২

৩। সৈয়দ মুজতবা আলী: ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। তাঁর আরেকটি প্রবন্ধ ‘ইংরেজী বনাম মাতৃভাষা’ প্রবন্ধেও এই একই যুক্তি বিশ্লেষণ উপস্থিত  করেছেন।  

৪। মাতৃভাষায় উচ্চ শিক্ষা বিষয়ে সত্যেন বোসের বক্তব্য নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন ফিরোজ আহমেদ তাঁর ‘মাতৃভাষা এবং উচ্চশিক্ষার মাধ্যম’ প্রবন্ধে, সর্বজনকথা, ২য় বর্ষ ২য় সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০১৬।

৫। বাংলা ভাষার শক্তি ও বিতর্ক নিয়ে আরও আলোচনার জন্য দেখতে পারেন আমার ‘ভাষার যাত্রা ভাষার প্রাণ’, ঈশ্বর পুঁজি ও মানুষ গ্রন্থের একটি অধ্যায়। মাওলা ব্রাদার্স, মে ২০১৪।  

৬। পরাধীনতা, বিকৃতি ও আধিপত্য থেকে মুক্ত করে বাংলা ভাষাকে এই অঞ্চলে সর্বস্তরের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধা চিহ্নিতকরণ, নানামত মোকাবিলা এবং ব্যাকরণ ও সাহিত্যে এঁদের অবদান নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার জন্য দেখুন- মোহাম্মদ আজম: বাংলা ও প্রমিত সমাচার, প্রথমা, ২০১৯। এই গ্রন্থে ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় এর লেখার অনুবাদ ‘মুখের বাংলা ও লেখার বাংলা’  এই গ্রন্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।    

৭। ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার জন্য দেখুন: শিশির ভট্টাচার্য: বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস আদিপর্ব। প্রথমা, ২০১৮

৮। ‘Meets the needs of the present without compromising the ability of future generations to meet their own needs.’ ( Our Common Future, The Brundtland Commission, formally the World Commission on Environment and Development (WCED) report, United Nations. 1987.)

৯। বিস্তারিত দেখুন: https://sustainabledevelopment.un.org/post2015/transformingourworld

১০। সৈয়দ মুজতবা আলী: ইংরেজী বনাম মাতৃভাষা। ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, ২০০৬

অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের সাথে কথোপকথন-৩

ব্যবস্থাগত পরিবর্তন বিষয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে

অনুবাদ: ফাতেমা বেগম

২০১৪ সালে বেশ কয়েক মাস ধরে ই-মেইলের মাধ্যমে মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী লেখক ও অধিকার আন্দোলনে সক্রিয় ব্যক্তিত্ব অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের সাথে এই দীর্ঘ কথোপকথনে অনেক বিষয় পরিষ্কার করেছেন লেখক এ্যাক্টিভিস্ট ফ্রাংক বারাত। এতে মার্কিন সমাজ, বর্ণবাদী আক্রমণ, ফিলিস্তিনি জনগণ সহ বিশে^র বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের লড়াই নিয়ে তাঁর বক্তব্য সংকলিত হয়েছে। এটি সংকলিত হয়েছে একটি গ্রন্থে, নাম: Freedom is a Constant Struggle: Ferguson, Palestine and the Foundations of a Movement। এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে সর্বজনকথায় প্রকাশিত হচ্ছে। এবারে তৃতীয় পর্ব।

 

শেষবার আমরা ফারগুসনের ব্যাপারে কথা বলছিলাম। সংগঠিত অপরাধের প্রেক্ষিতে প্রধান জুরি তখনও রায় প্রকাশ করেনি। এরিক গার্নার নামে আরেকজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে পুলিশ হত্যা করল। আমি আবার এ ব্যাপারে কথা বলতে চাই। দুইজন কৃষ্ণাঙ্গ নিহত হল, অথচ পুলিশ স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখানে কী পরিবর্তন আবশ্যক?

প্রথমত, আমি উল্লেখ করতে চাই, পুলিশ কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ ও নারীদের হত্যাকাণ্ড কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। রবার্ট ডি জি কেলি লিখিত প্রবন্ধটি আপনার কাছে বেশ আকর্ষণীয় মনে হতে পারে। প্রবন্ধের নাম হোয়াই উই ওনট ওয়েট। তখন আমরা ফারগুসন রায়ের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ঠিক সেই সময় যারা পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল, প্রবন্ধটিতে সেই সকল কৃষ্ণাঙ্গর একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছিল।

এই হত্যাকাণ্ডগুলো সবই কি কয়েক মাসের মধ্যে ঘটেছিল?

ঠিক তাই- যে সময়কালে গ্র্যান্ড জুরি সাক্ষ্য তথ্য শুনছিল। আমরা এই মামলাগুলোকে প্রায়শ ব্যতিক্রম হিসাবে গণ্য করি। অভিযুক্তদের বিপথগামী হিসাবে বিবেচনা করি। বাস্তবে কিন্তু এরকম ঘটনা সব সময় ঘটে চলেছে। আমাদের ধারণা হল, অপরাধীকে শাস্তি দিতে সক্ষম হওয়া মানেই সুবিচার সংঘটিত হওয়া। কিন্তু বাস্তবে ভয়ংকর যে ঘটনাটি ঘটেছে তা হল মাইকেল ব্রাউন ও এরিক গার্নারের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত দুইজন পুলিশ অফিসারকে গ্র্যান্ড জুরি অভিযুক্ত করেনি। অবশ্য তাঁদেরকে অভিযুক্ত করা হলেও কোন কিছুর পরিবর্তন হত কি না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। আমি বলতে চাচ্ছি যে অপরাধী পুলিশরা অভিযুক্ত হলেও তাতে কোন পরিবর্তনের নিশ্চয়তা নেই।

নর্থ ক্যারোলাইনায় জোনাথন ফেরেল নামের একজন তরুণ অটোমোবাইল দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। তিনি একজনের বাড়ির দরজায় করাঘাত করে সাহায্য প্রার্থনা করেন। সেই বাড়ির লোক তাঁকে চোর সন্দেহ করে পুলিশকে ফোন করে। পুলিশ এসে তৎক্ষণাৎ সেই তরুণকে গুলি করে হত্যা করে। প্রাথমিক পর্যায়ে পুলিশকে অভিযুক্ত করা হয়নি। অতঃপর প্রসিকিউটরের চাপে শেষ পর্যন্ত গ্র্যান্ড জুরি সেই পুলিশকে অভিযুক্ত করতে বাধ্য হয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হল, আমাদের ব্যবস্থাগত পরিবর্তনের ব্যাপারে কথা বলতে হবে। শুধু ব্যক্তির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়ে আমাদের সন্তুষ্ট থাকা যাবে না।

সুতরাং আমাদের আরও অনেক কিছু নিয়ে ভাবতে হবে। পুলিশের ভূমিকা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। তার মানে হচ্ছে, সম্ভবত পুলিশের ওপর কমিউনিটির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পুলিশ অপরাধ করার পরে কেবল তার জন্য গৃহীত পদক্ষেপের পর্যালোচনা নয়, বরং পুলিশ সংস্থাগুলোর কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রয়েছে এমন সম্প্রদায়-সংস্থাগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তার মানে, বর্ণবাদকে বৃহত্তর পর্যায়ে বিবেচনা করতে হবে। এর আরও অর্থ দাঁড়াচ্ছে, যে প্রক্রিয়াগুলো সহিংসতাকে প্রথম অবলম্বন হিসাবে ব্যবহার করতে পুলিশকে উৎসাহিত করে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহিংসতা ও অন্যান্য ধরনের সহিংসতার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে, সেই প্রক্রিয়াগুলো লক্ষ করতে হবে। বিশেষত, ফারগুসন প্রসঙ্গে এর অর্থ হচ্ছে দেশব্যাপী পুলিশকে বেসামরিকীকরণ করার দাবি করতে হবে।

সুতরাং আমরা একটি ব্যবস্থাগত পরিবর্তনের কথা বলছি, তাই না?

হ্যাঁ, সঠিক বলেছেন।

সিস্টেম বা ব্যবস্থার একেবারে গভীর পর্যায় পর্যন্ত?

হ্যাঁ, পুরাপুরিভাবে।

আপনি একজন কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষের কথা বলেছিলেন, যিনি তাঁর গাড়িটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সাহায্য চাইছিলেন, কিন্তু লোকজন তাঁকে চট করে চোর বা এরকম কিছু একটা ভেবে নেয়। আপনি কি মনে করেন যে এর জন্য দায়ী সমাজ ও মিডিয়া, যারা গতানুগতিকভাবে কৃষ্ণাঙ্গদেরকে সম্ভাব্য বিপজ্জনক, সম্ভাব্য অপরাধী হিসাবে চিত্রায়িত করে- মানুষের মনে এই ভাবমূর্তি তৈরি করে, একটি পক্ষপাতদুষ্ট পূর্বধারণা তৈরি করে?

হ্যাঁ, সম্পূর্ণভাবে। এবং সত্যিকার অর্থে দাসযুগ থেকেই এই গতানুগতিক ধারণাগুলো প্রচলিত আছে। ফ্রেডরিক ডগলাসের লেখায় বর্ণের সাথে অপরাধ আরোপ করার ব্যাপারটি পাওয়া যায়। তিনি উল্লেখ করেছেন যে একজন সাদা বর্ণের মানুষ কাল মুখ বানিয়ে অসংখ্য অপরাধ করেছিলেন। কারণ তিনি ভালভাবে জানতেন যে সাদা বর্ণের মানুষ হওয়ার কারণে তাঁকে কখনই সন্দেহ করা হবে না। অন্যদিকে কাল ত্বক ও অপরাধ পরস্পর সম্পর্কিত-এই মতাদর্শগত ধারণার শিকার হয়েছেন সকল কৃষ্ণাঙ্গ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বর্ণবাদের বিবর্তনের সাথে সব সময় অপরাধের পরিমাপ সংযুক্ত করা হয়েছে। তাই আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কিভাবে অপরাধী হিসাবে কৃষ্ণাঙ্গদের ব্যাপারে এই গতানুগতিক ধারণা অদ্যাবধি বিদ্যমান আছে। জাতিগত প্রোফাইলিং করা তার একটি উদাহরণ। কৃষ্ণাঙ্গরা বিপজ্জনক, এই ধারণাটি চালু আছে। সম্প্রতি টুইটারে একটি সংলাপ চলছে, অপরাধী হিসাবে সাদা মানুষ। বেশ কিছুসংখ্যক সাদা মানুষ তাঁদের নিজেদের অপরাধের কথা বর্ণনা করেছেন, যার জন্য তাঁদেরকে কখনও সন্দেহভাজনদের তালিকাভুক্ত হতে হয়নি। তাঁদের মধ্যে একজনের বর্ণনায় পাওয়া যায়, সে এবং তার কৃষ্ণাঙ্গ বন্ধু একটি ক্যান্ডি বার চুরি করার অপরাধে একসাথে গ্রেফতার হয়। পুলিশ সাদা ব্যক্তিকে ক্যান্ডি বারটি দিয়ে দেয় এবং তার কৃষ্ণাঙ্গ বন্ধুকে জেলখানায় পাঠায়।

এর সত্যতা সর্বত্র বিরাজমান। প্যারিসেও প্রোফাইলিং করা হয়। প্যারিসে আপনি কোন মরোক্কান বা আলজেরিয়ান গোত্রের কারোর সাথে কথা বলে জানতে পারবেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকান-আমেরিকানদের মতই তারা একটি গৎবাঁধা এবং বানানো ধারণার শিকার হয়। আপনি কেন সেইসব ধারণাকে গৎবাঁধা এবং বানানো মনে করছেন? এটা কি ডিভাইড অ্যান্ড রুল কৌশল?

বর্ণবাদ খুব একটি জটিল ব্যাপার। বর্ণবাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত উপাদান রয়েছে। বর্ণবাদের অবসান বা বর্ণবাদকে চ্যালেঞ্জ করা সম্পর্কে আলোচনা করার সময় প্রায়শই এমন কাঠামোগত উপাদানগুলোকে বিবেচনায় নেয়া হয় না। মানসিক কাঠামোতেও এর প্রভাব থাকার কারণে গতানুগতিক ধারণাটির অস্তিত্ব টিকে থাকছে। গত কয়েক দশক এবং শতক যাবৎ কৃষ্ণাঙ্গদেরকে যেভাবে মানুষ হিসাবে অবমাননা করা হচ্ছে, অর্থাৎ তাদেরকে মানুষের চাইতে নিচু পর্যায়ের কিছু ভাবা হচ্ছে, তাদেরকে মিডিয়ায় প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনীতিতে ও অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমে যেভাবে দেখা যায়, এবং সামাজিক আদান-প্রদানে যেভাবে দেখা যায়, সেগুলোর মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গ ও অপরাধীকে এক করে দেখা হয়। তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না এই গতানুগতিক ধারণার অস্তিত্ব কেন দীর্ঘকাল যাবৎ টিকে আছে।

প্রশ্ন হলো, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি আচরণে বর্ণবাদের প্রভাব বোঝার জন্য কেন অদ্যাবধি কোন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া হয়নি? যত দিন পর্যন্ত আমরা বর্ণবাদকে সেই ব্যাপক পরিসরে প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারব, তত দিন এই গতানুগতিক ধারণা টিকে থাকবে।

ওবামার ব্যাপারে কী বলবেন? তিনি এখনও ফারগুসন পরিদর্শনে যাননি। এই মুহূর্তে, রাজনৈতিক দৃশ্যপটে তাঁর অবস্থান কোথায়?

আমার মতে, এই মুহূর্তে বর্ণবাদ, বর্ণবাদী সহিংসতা এবং পুলিশি সহিংসতার বিরুদ্ধে যে উল্লেখযোগ্য আন্দোলন গড়ে উঠতে দেখছি, তার অন্যতম ব্যাখ্যা হতে পারে ওবামার নির্বাচিত হওয়ার ঘটনাটিকে বর্ণবাদ-পরবর্তী যুগের সূচনাবিন্দু হিসাবে স্বাগত জানানো। অবশ্য একজন ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্ণবাদের প্রভাব এবং বর্ণবাদ সম্পর্কে সারা দেশের দৃষ্টিভঙ্গিতে রূপান্তর ঘটিয়ে ফেলতে পারবেন- এই রকম ভাবটা অর্থহীন। তবে সকলেই দেখেছে যে একজন কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নিজেকে সমর্পণ করছেন বর্ণবাদিতায়, বর্ণবাদী সহিংসতায়। ওবামার সক্রিয় নেতৃত্বে সহিংসতার প্রভাব আরও বেড়েছে। না, ওবামা ফারগুসন পরিদর্শন করেননি। অ্যাটর্নি জেনারেল, এরিক হোল্ডার পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। এই প্রশাসনের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, এরিক হোল্ডার ইতিপূর্বে পুলিশের সামরিকীকরণের গুরুত্বের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছিলেন। ফারগুসনে, প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা সামরিক পোশাক দেখেছি, সামরিক যন্ত্রপাতি দেখেছি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পুলিশ প্রথমে যে সামরিক পোশাক, অস্ত্র, প্রযুক্তি ইত্যাদি ব্যবহার করছিল তা পরবর্তীতে শেষের দিকে দৃশ্যমান ছিল না।

যাই হোক, আমি মনে করি, যে কেউ ক্ষমতায় থাকুক না কেন আমরা সরকারের ওপর  নির্ভর করতে পারি না। একমাত্র গণ-আন্দোলনেই সমাধান সম্ভব। আর এই মুহূর্তে চলমান বিক্ষোভের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এর কারণে সমস্যাগুলো চাপা পড়ার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে।

আপনি উল্লেখ করেছেন যে একজন ব্যক্তির পক্ষে পুরা ব্যবস্থা বদলানো সম্ভব নয়, তাহলে যে ব্যবস্থা ওবামাকে নির্বাচিত করল, সেই ব্যবস্থাই কিভাবে তাকে বাধাগ্রস্ত করল?

হ্যাঁ, অবশ্যই। কিছু কৌশলযন্ত্র প্রেসিডেন্সিকে নিয়ন্ত্রণ করে, এবং কোন পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সেগুলো প্রতিবন্ধকতা হিসাবে কাজ করে। তবে দৃঢ়তর পদক্ষেপ না নেয়ার জন্য ওবামার ক্ষেত্রে এটা কোন অজুহাত হতে পারে না। আমি মনে করি, চাইলে ওবামা কিছু পদক্ষেপ নিতে পারতেন। কিন্তু কেউ যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাস লক্ষ করে, তাহলে দেখতে পাবে, কেবল একজন প্রেসিডেন্টের অধিকতর প্রগতিশীল পথে চলার ফলশ্রতিতে কোন পরিবর্তন ঘটেনি।

গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিটি পরিবর্তন ঘটেছে। দাসত্বের যুগ থেকে শুরু করে গৃহযুদ্ধ, এবং সেই গৃহযুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গদের অংশগ্রহণ সত্যিকার অর্থে সেই রকম পরিবর্তন ঘটিয়েছে। অধিকাংশ মানুষের ধারণা হল, দাসত্ব প্রথার বিলোপসাধনে আব্রাহাম লিংকনের ভূমিকাই প্রধান ছিল। দাসপ্রথার বিলোপ ত্বরান্বিত করতে আব্রাহাম লিংকন অবশ্যই সাহায্য করেছেন, কিন্তু দাসত্বের বিরুদ্ধে জয়লাভের পেছনে প্রধান ভূমিকা ছিল দাসদের পক্ষ থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত এবং সেই উদ্দেশ্যে নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে ইউনিয়ন সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার ঘটনা। দাসপ্রথার অবসান ঘটিয়েছে স্বয়ং দাসরা এবং সেই সাথে অবশ্যই দাসপ্রথা বিলোপের আন্দোলন। নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সময়কালে লক্ষ করলে দেখা যাবে, গণ-আন্দোলনের কারণেই সরকার বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিল, ঘটনাচক্রে সেইসব গণ-আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে বর্তমানকালে কেন তার ব্যতিক্রম হবে?

তাই আপনি কি মনে করেন নতুন আন্দোলনের জন্য ফারগুসন ঘটনা অনুঘটক হিসাবে কাজ করতে পারে? এটা কি পরিবর্তনের সূচনাবিন্দু হতে পারে?

আমি মনে করি, আন্দোলন গড়ে উঠতে এবং পরিণত হতে সময় লাগে। সেটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটবে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেপথ্যের সংগঠন এবং কঠোর পরিশ্রমের ফলে আন্দোলনগুলো ঘটে থাকে। গত দুই দশক যাবৎ আসলে পুলিশি সহিংসতা, বর্ণবাদ, বর্ণবাদী পুলিশ-সহিংসতা, কারাগারের বিরুদ্ধে, কারাগার-শিল্প কমপ্লেক্সের বিরুদ্ধে সংগঠিত সংগ্রাম টিকে আছে এবং আমি মনে করি, এখন যে ধারাবাহিক বিক্ষোভগুলো হচ্ছে তা সংগঠিত করার জন্য অনেক কাজ করতে হবে। বিক্ষোভে প্রতিফলিত হচ্ছে যে অনেক সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে প্রচলিত ধারণার চাইতে রাজনৈতিক সচেতনতা বেশি কাজ করে। অর্থাৎ বর্ণবাদী পুলিশ-সহিংসতা এবং পদ্ধতিগত সমস্যাগুলোর মধ্যকার সংযোগ সম্পর্কে জনগণ জানে। সিআইএর গোপন কারাগার এবং নির্যাতনের সাথে যে কারাগার-শিল্প কমপ্লেক্সের একটি সম্পর্ক আছে তা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। কাজেই আমি মনে করি, আমাদের আন্দোলনের একটি ভিত্তি রয়েছে। দাবি করব না যে আন্দোলনটি মজবুত একটি সাংগঠনিক পর্যায়ে আছে। আমরা সেই পর্যায়ে এখনও পৌঁছিনি। তবে আন্দোলনের একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে এবং জনগণ সেই আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত।

বর্তমান সময়ের আন্দোলনগুলো কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কারাগার-শিল্প কমপ্লেক্স এবং কারাগার বিলুপ্তি আন্দোলনে সফলতা অর্জন করতে পারে? ষাট ও সত্তরের দশক থেকে আমাদের শিক্ষা কী?

আমি মনে করি, ষাট ও সত্তরের দশকের বছরগুলোতে আমরা শিখেছি যে গণ-আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতে পারে। যদি কেউ পাসকৃত সমস্ত আইনের দিকে লক্ষ করে তবে সে বুঝতে পারবে যে নাগরিক অধিকারের আইন, উদাহরণস্বরূপ-ভোটিং রাইটস অ্যাক্ট, কোন রাষ্ট্রপতির অসাধারণ পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে ঘটেনি। মানুষের মিছিল এবং সংগঠনের ফলেই এটি ঘটেছে।

আমার মনে পড়ছে, ১৯৬৩ সালে মার্চ মাসের আগে গ্রীষ্মকালে, নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সময়কালে ওয়াশিংটনে বার্মিংহামের আলাবামায় একটি শিশু বিক্ষোভ হয়েছিল। বার্মিংহামে বুল কনরের পুলিশি পরিচালনায় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ফায়ারহোস ও পুলিশের সহিংসতার মুখোমুখি হওয়ার জন্য শিশুদের সংগঠিত করা হয়েছিল। অবশ্য সন্তানদের সেই পর্যায়ে অংশগ্রহণের অনুমতি দিতে অনেকে অসম্মতি প্রকাশ করেছিল; এমনকি ম্যালকম এক্সও মনে করেছিলেন যে শিশুদের এরকম বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়া ঠিক হয়নি। তবে শিশুরা স্বেচ্ছায় এই অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিল। পুলিশি কুকুর এবং ফায়ারহোসের সম্মুখীন সেই শিশুদের ছবি সারা বিশ্বে প্রকাশিত হয়েছিল, যা বর্ণবাদের নির্মমতার বিরুদ্ধে বৈশ্বিক জনমত তৈরি করতে সাহায্য করেছিল। এটি একটি অসাধারণ পদক্ষেপ ছিল। বর্ণবাদের ব্যাপারে দুর্ভেদ্য নীরবতা ভাঙতে শিশুরা যে ভূমিকা রেখেছিল তা প্রায়শই আমরা ভুলে যাই।

তাই আমি মনে করি, ষাট ও সত্তরের দশকের বছরগুলোতে আমরা শিখেছিলাম যে সত্যিই পরিবর্তন সম্ভব। আমরা ঠিক যেমন পরিবর্তন চেয়েছিলাম তা ঘটেনি বা আরও সঠিক অর্থে যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটেনি। যদিও আইন-কানুনের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন ঘটেছিল তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তথাপি আর্থিক ও কাঠামোগত পদ্ধতিতে পরিবর্তন না ঘটার কারণে বর্ণবাদকে নির্মূল করা সম্ভব হয়নি।

সেটাই। আন্দোলনের মাধ্যমে কী করে এমনকি সবচেয়ে অনিচ্ছুক রাজনীতিবিদদের ওপর  চাপ তৈরি করা যায়?

সেই সময়ের প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন পরিবর্তনে অনিচ্ছুক দক্ষিণের একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি পরিষ্কারভাবে বর্ণবাদকে সমর্থন করেছিলেন। তবে তাঁর প্রশাসনের অধীনেই অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস করা হয়েছিল। তাই আমি মনে করি, আন্দোলনের মাধ্যমে পরিবর্তনে অনিচ্ছুক রাজনীতিবিদকেও পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করা সম্ভব। দক্ষিণ আফ্রিকার দৃষ্টান্ত দেখুন। কেউ কখনও বিশ্বাস করেছিল যে দে ক্লার্ক শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থান নেবে? এর কারণ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার অভ্যন্তরে আন্দোলন, দক্ষিণ আফ্রিকার বাইরে দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য আন্দোলন, এবং বৈশ্বিক সংহতি প্রচারণা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে কৃষ্ণাঙ্গ রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ রাজনীতির ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ব্যাপারে ওবামার কোন প্রধান ভূমিকা ছিল কি না তা আমি জানি না। তবে আমার মতে, মূল উদ্বেগের বিষয় হল বর্ণবাদবিরোধী রাজনীতির ভবিষ্যৎ।

আপনি এ ব্যাপারে আগে কিছুটা বলেছিলেন যে ওবামার নির্বাচিত হওয়ার ঘটনাটি আসলে একভাবে বাধাই তৈরি করেছে…

আসলে, আমার মনে হয়, এখন কৃষ্ণাঙ্গ রাজনীতিকে বৃহত্তর কাঠামোর আওতায় বিচার করা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কৃষ্ণাঙ্গ রাজনীতি সম্পর্কে আগের মত একইভাবে চিন্তা করতে পারি না। আমি বলব, কৃষ্ণাঙ্গ সংগ্রাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনতার সংগ্রামের একটি প্রতীক হিসাবে কাজ করে। স্বাধীনতার জন্য বৃহত্তর সংগ্রামের প্রতীক হিসাবে কাজ করে। তাই কৃষ্ণাঙ্গ রাজনীতির আওতার মধ্যে লৈঙ্গিক অধিকারের সংগ্রাম, হোমোফোবিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং সেই সাথে দমনমূলক অভিবাসন নীতিগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রামকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কৃষ্ণাঙ্গ র‌্যাডিক্যাল ঐতিহ্য বলে যাকে অভিহিত করা হয় তা উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ। কৃষ্ণাঙ্গ র‌্যাডিক্যাল ঐতিহ্য কেবল কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের সাথে নয়, বরং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত সকলের সাথে সম্পর্কিত। তাই সেই পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যৎকে উš§ুক্ত বিবেচনায় রাখতে হবে। অবশ্য সুনির্দিষ্টভাবে, বিশেষ করে বিপুলসংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যে নিমজ্জিত থাকার বিবেচনায় কৃষ্ণাঙ্গ স্বাধীনতা এখনও অর্জিত হয়নি। আরও বিবেচনার বিষয় হল, কারাগার-শিল্প কমপ্লেক্সের জালে আটকে পড়া অগণিতসংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ কয়েদি জেলখানায় আছে। একই সাথে ল্যাটিনো জনগোষ্ঠী এবং আদিবাসী আমেরিকান নাগরিকদের দিকেও আমাদের মনোযোগ দেয়া উচিত। আমাদের কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণবাদবিরোধী ভিত্তি থেকে মুসলমানবিরোধী বর্ণবাদ কিভাবে আসলে উদ্দীপিত হয়েছে তা দেখতে হবে। এখন তাই পূর্বাপেক্ষা জটিলতা বেশি। আমি কখনই বলতে যাব না যে কৃষ্ণাঙ্গ স্বাধীনতাকে সংকীর্ণ অর্থে দেখা সম্ভব। বিশেষ করে আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং অর্থনৈতিক আধিপত্যে কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিদের জন্য উত্থানের প্রতীক হয়েছেন রাষ্ট্রপতি ওবামা। তবে এই শ্রেণির উদ্ভব এবং উত্থান অপরিহার্যভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গদের অবস্থার কোন রূপান্তর করবে না।

খুবই মজার ব্যাপার। নিশ্চিত না ঠিক কিভাবে বলব। দক্ষিণ আফ্রিকার উদাহরণ থেকে আপনি কি মনে করেন যে একদল মানুষ যখন রাজনীতি কিংবা ব্যবসার বিচারে উঁচু অবস্থানে যায়, তখন কি কাল কিংবা নেটিভ আমেরিকান পরিচয় থেকেও অর্থকড়ি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে? সম্প্রতি আমি চিলিতে গিয়েছিলাম এবং চিলিতে থাকা ফিলিস্তিনিরা পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম সম্প্রদায়। চিলিতে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি বসবাস করে।

তাই নাকি? আমি এই ব্যাপারটি জানতাম না।

চিলিতে বক্তৃতা দেয়ার সময় আমি ভিলা গ্রিমালদিতে গিয়েছিলাম। সেখানে পিনোশে অনেক মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করেছিল। সেখানকার অধিবাসীদের থেকে জেনেছি, ফিলিস্তিনিরা, যারা চিলির ধনীতম সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে অন্যতম, তারা পিনোশের এই কর্মকাণ্ডকে সমর্থন জানিয়েছিল। নির্যাতন ও হত্যা নয়, পিনোশের নব্য-উদারনীতিভিত্তিক শাসন পদ্ধতির জন্যই তারা তাকে এই সমর্থন জানিয়েছিল। সম্পদ ও সুবিধা অটুট রাখাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। নির্যাতনের প্রতি নিন্দা জানানোর আগে তারা তাদের মানিব্যাগের সুরক্ষা করছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় একই ঘটনা ঘটেছিল…

বিশেষ করে বিশ্ব পুঁজিবাদ এবং নব্য-উদারনীতির এই যুগে এ ব্যাপারগুলো খুব জটিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি ক্ষমতাবান, ধনিক, বুর্জোয়া কৃষ্ণাঙ্গ শ্রেণি গড়ে ওঠে, বর্ণবৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের সময় যে সম্ভাবনা আমলে নেয়া হয়নি, অন্তত প্রকাশ্যভাবে। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায় যদি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা লাভ করে তাহলে কৃষ্ণাঙ্গদের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও একই অবস্থা।

আমি প্রকৃতপক্ষে বেশ কিছুদিন যাবৎ ব্রাজিল সফর করছি এবং লক্ষ করছি যে ব্রাজিল এখন বর্ণবাদ সম্পর্কিত কিছু বড় অগ্রগতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। আমি মনে করি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ আফ্রিকার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে কি না সে ব্যাপারে ব্রাজিলের সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ রয়েছে। আমি অবাক হব যদি ফিলিস্তিনিরা পিনোশেকে সমর্থন করে থাকে। তবে সেটা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য হবে না।

তারা সবাই নয়, তাই না…

না, আপনার কথা অনুযায়ী শতকরা ৬০ ভাগ হলেই যথেষ্ট। খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কিছু সময়কাল ধরে আমরা বিভিন্ন সংহতি প্রচারণা থেকে বিভিন্ন সংগ্রামকে একত্রীভূত হতে দেখেছি। ফিলিস্তিনি, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ সংগ্রাম থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে, তাদের উচিত কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়কে স্বাধীনতাসংগ্রাম চালিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করা। অন্যদিকে ব্যক্তি পর্যায়ে ক্ষমতা লাভ হলেই সমগ্র কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের অবস্থান পরিবর্তিত হবে- এই ধারণার অন্তর্নিহিত সমস্যাটি ফিলিস্তিনিদের উপলব্ধি করতে হবে। ফিলিস্তিনিদের মুক্তির জন্য শুধু অর্থ নয়, তার চাইতেও জটিল প্রয়োজনের হিসাবে পৌঁছাতে হবে।

কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদ এবং কৃষ্ণাঙ্গ সংগ্রাম ফিলিস্তিন আন্দোলনকে কী দিতে পারবে?

আমি জানি না, প্রশ্নটি ঠিক এভাবে করাটা ঠিক হবে কি না, কারণ আমি মনে করি, সংহতি বলতে সব সময় পারস্পরিকতার একটি ব্যাপার বোঝায়। ইতোমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদেরকে এরকম একটা ধারণা তৈরিতে উৎসাহিত করা হয়েছে যে দুনিয়ার সবচেয়ে সেরাটাই আমাদের আছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই বিশেষ অবস্থানের কারণে আমরা আন্দোলনকারী হিসাবে সারা দুনিয়ার সংগ্রামরত মানুষদের নসিহত করতে পারি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি একমত নই, আমি মনে করি, আমরা স্রেফ আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো ভাগাভাগি করি। কৃষ্ণাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ নারীবাদের অগ্রসরতা যেমন ফিলিস্তিনিদের জন্য ধারণা, অভিজ্ঞতা, বিশ্লেষণের উৎস হিসাবে কাজ করতে পারে, তেমনি ফিলিস্তিনি মানুষ এবং নারীবাদের সংগ্রামের অভিজ্ঞতার শিক্ষা থেকে কৃষ্ণাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ নারীবাদ নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করতে পারে। আমরা যে ধরনের নারীবাদের কথা বলছি, আন্ত পরিচিতি-মিশ্রণের (Intersectionality) পুরো ধারণার মধ্যে সেই বৈশিষ্ট্যটি চিহ্নিত হয়েছে। তার মানে হল, জাতি, শ্রেণি, যৌনতা, জাতীয়তা ও ক্ষমতা থেকে বা ফিলিস্তিনে সংগ্রামের অন্যান্য বিষয় থেকে বিচ্ছিন্নতার মধ্যে লিঙ্গ বিষয়টি দেখতে পারি না। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকেও আন্ত পরিচিতি-মিশ্রণের বিস্তৃত ধারণা কল্পনা করতে সহায়তা করেছে।

গত কয়েক বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিন সংগ্রামের পরিবর্তন কিভাবে ঘটেছে?

আমি অনুভব করি, সত্যিই কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার বিষয়টি দীর্ঘকাল যাবৎ গুরুত্বহীন ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেকেই প্রগতিশীল, তবে ফিলিস্তিনের বিষয়টি বাদ দিয়ে। রেবেকা ভিলকোমারসনের ফিলিস্তিন ব্যতীত প্রগতিশীলতা (Progressives Except Palestine) বিষয়ক আলোচনা থেকে এই বক্তব্যটি সংগ্রহ করেছি। এখন এ ব্যাপারে পরিবর্তন ঘটছে। ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি জায়নবাদ এখন তার ক্ষমতা হারাচ্ছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন (এসজেপি) নামক সংগঠনের বিকাশ ঘটছে এবং সংগঠনটিতে ব্যাপকসংখ্যক কর্মী যোগ দিচ্ছে, যারা ফিলিস্তিনি, আরব বা মুসলমান নয়। ফিলিস্তিন সমস্যা ক্রমবর্ধমান হারে সামাজিক ন্যায়বিচারের সমস্যাগুলোর সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে। অতীতে ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাকে সব সময় প্রতিরোধ ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু এখন ক্রমশই তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। ফিলিস্তিনে ঘটমান বিষয়গুলোর কারণেই এই গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া সমগ্র বিশ্বে ফিলিস্তিন সংহতি আন্দোলনের ফলে এই গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ, আদিবাসী নাগরিক ও ল্যাটিনো আন্দোলনের সাথে জড়িত ক্রমবর্ধমান মানুষ ফিলিস্তিনকে তাদের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার কারণে সুনির্দিষ্টভাবে এই গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। গত সাক্ষাৎকারে আমি ফিলিস্তিন আন্দোলনের কর্মীদের কথা উল্লেখ করেছিলাম; বলেছিলাম কিভাবে কাঁদুনে গ্যাসকে প্রতিহত করা যায়, সে ব্যাপারে তারা টুইটারে ফারগুসেনের বিক্ষোভকারীদের পরামর্শ দিচ্ছিল। সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে সামাজিক গণমাধ্যমের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।

একটি কনফারেন্স উপলক্ষে আমি সম্প্রতি সেভিলাতে গিয়েছিলাম। সেখানে এসজেপি ইউসিএলএর রহিম কুরওয়ার সাথে সাক্ষাৎ হয়। আপনি তাঁকে চেনেন। আমি তাঁকে বলেছিলাম যে আপনার সাথে আমার দেখা হবে। ছাত্র আন্দোলন বিষয়ে রহিম আপনার জন্য একটি মজার প্রশ্ন রেখেছেন। তিনি প্রশ্ন করেছেন : বর্তমানে ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকা কী, এবং বিশেষ করে এমন এক সময়ে, যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমবর্ধমান হারে অভিজাতদের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে, তখন ক্যাম্পাস এলাকায় বৃহত্তর সম্প্রদায় ও আন্দোলনের সম্পর্কের ব্যাপারে ছাত্রদের চিন্তাভাবনা কী হবে?

অবশ্যই। ঐতিহাসিকভাবে, জনসমাজের সাথে সংযুক্ত অসংখ্য সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে ইউসিএলএতে কাজ করেছে। আমি নিজে ইউসিএলএ-এর সাথে থেকে সংগ্রাম করেছি। কিন্তু বর্তমানে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমারেখাকে, এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে নব্য-উদারতাবাদীদের একটি দুর্গ হিসাবে স্থাপন করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে যে চ্যালেঞ্জ করছে, সেই চ্যালেঞ্জগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসজিপির মাধ্যমে সারা দেশে ক্যাম্পাসগুলোকে বিডিএসের সাথে সংযুক্ত করার ফলে বিডিএস আন্দোলনকে শুধু আরও শক্তিশালী হতেই প্রভাব ফেলেনি, ছাত্রদের জেল বেসরকারীকরণকে চ্যালেঞ্জ করার সম্ভাবনাও উš§ুক্ত করেছে। অনেক ক্যাম্পাসে ছাত্ররা যেখানে ফিলিস্তিনের দখল থেকে মুনাফা অর্জনকারী কর্পোরেশনগুলোর বিরুদ্ধে প্রস্তাব তৈরির প্রচেষ্টা করছে, সেখানে একই সঙ্গে জেলখানার বেসরকারীকরণ থেকে মুনাফা অর্জনকারী কর্পোরেশনগুলোর বিরুদ্ধে প্রস্তাব আনার জন্যও সংগ্রাম করছে। সুতরাং আমি মনে করি, অনেক ব্যাপারে এই দুটি বিষয় পারস্পরিক একটি নির্ভরশীলতায় সংযুক্ত। এবং অনেকের মধ্যে এটি একটি উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করেছে।

ফিলিস্তিন প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘটনাগুলো দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যবিরোধী সময়ের ঘটনাগুলোর সাথে তুলনামূলক বিচারে কী একই রকম, নাকি ভিন্ন?

অনেক সাদৃশ্য রয়েছে, বিশেষত বিডিএস আন্দোলন কর্তৃক দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের ঐতিহ্যকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্তের কারণে। বৈশ্বিক সংহতি তৈরির জন্য বিডিএস মাস বয়কট বা গণবর্জন পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল। আমার মনে হয়, জায়নবাদী তদবিরকারীদের অস্তিত্ব কিছুটা পার্থক্য তৈরি করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী তদবিরও শক্তিশালী ছিল। কিন্তু জায়নবাদী তদবিরের প্রভাবের শক্তির কাছে তা নগণ্য। সেই প্রভাব কৃষ্ণাঙ্গদের গির্জা পর্যন্ত পৌঁছেছে; ইসরাইল তাদের সপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিদের নিযুক্ত করার জন্য প্রত্যক্ষভাবে চেষ্টা করেছে। আমি জানি না বর্ণবাদবিরোধ যুগের সময় আমরা সেই স্তরের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম কি না। ইসরাইল রাষ্ট্র নিশ্চিতভাবে সেই আন্দোলন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছে। একই সাথে আমি মনে করি, সেই সময়ের সংগ্রামে আজকের আন্দোলনকারী দলগুলোর মত তৃণমূল পর্যায়ের সাথে সম্পৃক্ততা ছিল না। আমার অভিজ্ঞতায়, একটা সময় পর্যন্ত ফিলিস্তিনের সংগ্রামের জন্য উদ্বুদ্ধ হতে সম্ভবত অনেকে দ্বিধাগ্রস্ত হত, কিন্তু এখন সর্বত্র এই সংগ্রামকে আলিঙ্গন করার একটি প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। ফিলিস্তিনি সংহতি নিয়ে দি আমেরিকান স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পাস করেছে। ন্যাশনাল উইমেন স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশন (এনডাব্লিউএসএ) সম্মেলনের একটি প্যানেলে আমার অংশ নেয়ার সুযোগ হয়েছিল। জায়নিস্টদের প্রভাবের কারণে এনডাব্লিউএসএ কখনও ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নেয়নি। প্রায় ২৫০০ মানুষের একটি উš§ুক্ত সমাবেশে ফিলিস্তিন বিষয়ে সকলের ভোট আহ্বান করা হয়েছিল। উপস্থিত সকলে বিডিএসের সমর্থনে এনডাব্লিউএসএর একটি জোরালো সমর্থন আশা করছিল। বস্তুত প্রায় সকলের সমর্থন অর্জনের মাধ্যমে একটি নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছিল। সম্ভবত কেবল ১০-২০ জন অংশগ্রহণকারী ছাড়া বাকি সবাই সমর্থনের জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিল। অবিরাম করতালির মুখরতায় খুব উত্তেজনাকর একটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

একটি বৃহত্তর পরিবর্তনের জন্য এই পরিবর্তনগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি, মিডল ইস্ট স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশনও (এমইএসএ) সম্প্রতি বিডিএসের আহ্বানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে…

…এমনকি ইসরাইলি একাডেমিকও এটাকে একটি বড় পরিবর্তন বলছে।

এখানে স্মরণ করা প্রয়োজন যে এশিয়ান আমেরিকান স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশন প্রথম একটি প্রস্তাব পাস করেছিল, এবং তারপর আমেরিকান স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশন তাদের অনুসরণ করেছে, এবং এখন অবশ্যই…

এমইএসএ এবং…

…ক্রিটিক্যাল এথনিক স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশন। বেশ কিছুসংখ্যক একাডেমিক প্রতিষ্ঠান…

হ্যাঁ, সব কিছুই অসাধারণ। তবে আপনার মতানুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ন্যায়বিচারের সপক্ষে আন্দোলন আরও শক্তিশালী করার জন্য আমরা কী করতে পারতাম? এবং আমার মতে, এই প্রশ্নটি সারা বিশ্বের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

হ্যাঁ, আমি মনে করি, আমাদের ক্রমাগত আরও সংযোগ তৈরি করতে হবে। কাজেই ফারগুসন, মাইকেল ব্রাউন, ও এরিক গার্নারের প্রসঙ্গে যখন আমরা বর্ণবাদ সহিংসতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করব, তখন ফিলিস্তিনের সাথে সংযুক্ত হওয়ার ব্যাপারটি ভুলে যাওয়া চলবে না। সুতরাং নানাভাবেই আমাদের আন্ত ব্যক্তি-পরিচয়-মিশ্রণের অনুশীলন করতে হবে। সর্বদা সেই সংযোগগুলোকে গ্রাহ্য করে মানুষকে মনে করাতে হবে যে বিচ্ছিন্নতার মাঝে কিছুই ঘটে না। তাই আমরা যখন পুলিশকে ফারগুসনে বিক্ষোভকারীদের প্রতিবাদ দমন করতে দেখব তখন দখলকৃত ফিলিস্তিনে ইসরাইলি পুলিশ এবং ইসরাইলের সেনাবাহিনী যে বিক্ষোভকারীদের প্রতিবাদ দমন করে, সে সম্পর্কেও চিন্তা করতে হবে।

আমরা পুলিশের সামরিকীকরণের ব্যাপারে কথা বলেছিলাম; ফারগুসনে দেখেছেন, ওয়েস্ট ব্যাংক, গাজাতেও দেখেছেন- এথেন্স, গ্রিসেও এখন দেখতে পাচ্ছেন। পুলিশ বাহিনীকে রোবকপস-এর মত দেখায়। যখন এই সংযোগগুলো একত্রিত করা হবে তখন আন্তর্জাতিক সংগ্রাম অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়াবে।

…কিন্তু তারা ধূর্ত, তাই ফারগুসনে আমরা সে রকম দেখিনি। সেখানে তারা সামরিকীকরণকে কম দৃশ্যমান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে আমরা যদি তা নাও দেখি, আমাদের সে ব্যাপারে কথা বলতে হবে। আমি মনে করি, এটি সম্ভবত আরও গুরুত্বপূর্ণ যে অদৃশ্য করার প্রচেষ্টার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে এই সামরিক প্রভাবগুলো আরও দৃশ্যমান হতে পারে।

সংযোগ প্রসঙ্গে আরব সাম্রাজ্যের বর্ণবাদী আন্দোলনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ সচেতনতা এবং মুক্তি আন্দোলনের সংযুক্তিতে আপনি কি নিজের একটি ভূমিকা দেখতে পান?

আমি আমার নিজের বিশেষ ভূমিকা, নিজের ব্যক্তিগত ভূমিকার ব্যাপারে কথা বলব কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত নই। তবে নিশ্চিতভাবে সেই সংযোগগুলো তৈরি করা, তাদেরকে আরও দৃশ্যমান এবং অনুভবনীয় করার প্রচেষ্টায় আমি নিজেকে দেখতে পাই। মাঝে মাঝে আমরা তৃণমূল পর্যায়ের আন্দোলন থেকে শিখি, এবং সেখান থেকে লব্ধ অন্তর্দৃষ্টি যেন আমাদের ব্যক্তিগত অর্জন হিসাবে সীমিত না করি সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। স্বীকার করতে হবে যে সেই মুহূর্তগুলো থেকে আমরা শিখেছি এবং সেখান থেকে অর্জিত অন্তর্দৃষ্টি সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। আমি নিজেকে সেই ভূমিকাতেই দেখতে পাই।

কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদের ব্যাপারে ফিরে আসি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদের কতটা অগ্রগতি লক্ষ করছেন?

ফিলিস্তিনি সংহতির উদ্দেশ্যের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হওয়া সত্যিই অতি গুরুত্বপূর্ণ। কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বেভারলি গাই-শেফটাল একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। ঐতিহাসিকভাবে স্পেলম্যান কলেজ কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বেভারলি সেই কলেজে শিক্ষকতা করেন…

হাওয়ার্ড জিন সেখানে শিক্ষক ছিলেন…

হ্যাঁ, তিনি শিক্ষক ছিলেন। এলিস ওয়াকার স্পেলম্যানে যোগ দিয়েছিলেন। এটি একটি ছোট আকারের নারী কলেজ। কিন্তু এর ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ফিলিস্তিন প্রতিনিধি দলে বেভারলি গাই-শেফটাল আমাদের সাথে ছিলেন। এই দলে আদিবাসী এবং অশ্বেতাঙ্গ, বুদ্ধিজীবী-আন্দোলনকারী নারীদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। বেভারলি গাই-শেফটাল একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি এতই বিনয়ী যে নিজের জন্য কখনও কোন স্থান দাবি করেন না। কিন্তু তিনি যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তার গুরুত্বের ব্যাপারে আমি জোর দিতে চাই। স্পেলম্যান কলেজ প্রধানত একটি কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান। সেখানে একটি প্রধান এইচবিসিইউর একমাত্র এসজেপি অধ্যায় রয়েছে। তারা ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত অন্যান্য কৃষ্ণাঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

আপনি কি আপনার জীবনকালে নারীবাদ সংহতকরণের এমন কোন ঘটনা দেখেছেন, যা কার্যকরভাবে পিতৃতন্ত্র ও শ্বেতাঙ্গ সুবিধাবাদী উদার নারীবাদ- উভয়কেই চ্যালেঞ্জ করেছে?

আমি মনে করি, নারীবাদী আন্দোলনসহ অন্য সকল আন্দোলন তখনই সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়, যখন তারা আন্দোলনের সাথে যুক্ত নয় এমন সকল মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও দৃষ্টিকোণকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। তাই র‌্যাডিক্যাল নারীবাদ বা র‌্যাডিক্যাল বর্ণবাদবিরোধী নারীবাদ এই অর্থে গুরুত্বপূর্ণ যে তারা বিশেষ করে তরুণ সমাজকে সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য বর্তমান সংগ্রাম সম্পর্কে ভাবতে প্রভাবিত করেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত লিঙ্গ, লিঙ্গ ও যৌনপরিচয়, শ্রেণি এবং জাতীয়তা কিভাবে এই সংগ্রামে জড়িত সেটা আমাদের বোধগম্য না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোন বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামের সাফল্য অর্জনও সম্ভব হবে না। একটা সময় ছিল, যখন স্বাধীনতার সংগ্রামকে কেবল পুরুষদের সংগ্রাম হিসাবে দেখা হত। কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের স্বাধীনতা ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের স্বাধীনতার সমতুল্য। ম্যালকম এক্স এবং তাঁর মত অন্য অনেক ব্যক্তির দিকে নজর দিলে এরকমটাই মনে হবে। কিন্তু এখন আর এটি সম্ভব নয়। আর আমার মনে হয়, নারীবাদ এমন কোন পদ্ধতি নয়, যা শুধু নারীরাই ধারণ করবে; ক্রমবর্ধমান হারে সকল লিঙ্গের মানুষেরই নারীবাদকে গ্রহণ করতে হবে।

পরিবর্তন প্রসঙ্গে নাগরিক অধিকার আন্দোলন শেষ হওয়ার পর থেকে কৃষ্ণাঙ্গ রাজনীতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন কী? এর সাথে কি কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদও সম্পর্কিত?

বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সাথে লিঙ্গ প্রেক্ষিতের আন্ত সংযোগ জরুরি। তবে শ্রেণিভেদ, জাতীয়তা এবং জাতিগত বিষয়গুলোকেও এই আন্ত সংযোগের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলনের পদ্ধতি আগের মত হলে আর কাজ করবে না। কৃষ্ণাঙ্গ সংগ্রাম শুধু কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম- এই ধারণাটি আন্দোলনে একটি প্রাচীর তৈরি করেছিল। বর্তমানে এরকম কোন ধারণা টিকে থাকতে পারে না। আমি মনে করি, কৃষ্ণাঙ্গ র‌্যাডিক্যাল ঐতিহ্যকে মুসলমানবিরোধী বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে, যা বর্তমান সময়ে বর্ণবাদের সবচেয়ে জঘন্য রূপ। মুসলমানবিরোধী বর্ণবাদ নির্মূল না করে কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণবাদ নির্মূলের চিন্তা একেবারে অর্থহীন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কি বর্ণবাদমুক্ত পুলিশি তৎপরতা এবং কারাদণ্ড হওয়া সম্ভব?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই মুহূর্তে, এই পর্যায়ে পুলিশি ব্যবস্থা বর্ণবাদমুক্ত নয়। আমি মনে করি না যে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাটি বর্ণবাদ ছাড়াই কাজ করতে পারে। তার মানে হচ্ছে, একটি বর্ণবাদমুক্ত সমাজের সম্ভাবনা ভাবতে চাইলে সেই সমাজকে কারাগারমুক্ত হতে হবে; আজকের দিনে পুলিশি তৎপরতা বলতে যা বুঝি সেরকম পুলিশি তৎপরতামুক্ত হতে হবে। আমি মনে করি, একটি নিরাপদ সমাজব্যবস্থার কল্পনা করতে হলে একেবারে ভিন্ন ধরনের কাঠামো, সম্ভবত একটি পুনরুদ্ধারক বৈচারিক কাঠামোর ধারণা সামনে নিয়ে আসতে হবে। আমি নিরাপত্তাকে প্রধান বিষয় মনে করি। কিন্তু সেই ধরনের নিরাপত্তা নয়, যা পুলিশি নিয়ন্ত্রণ এবং কারাগারের ওপর  নির্ভরশীল। রূপান্তরিত বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে সৃষ্ট একটি কাঠামো সম্ভবত ভবিষ্যতে খুব ভিন্ন ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।

আপনি কয়েক দশক ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করে চলেছেন। আপনার এই চলার পেছনের প্রেরণা কী? আপনার কি মনে হয়, ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের আশাবাদী থাকা উচিত?

আশাবাদ পরম প্রয়োজনীয়, এমনকি তা যদি গ্রামসির ভাষায় স্রেফ ইচ্ছার আশাবাদ এবং বুদ্ধির হতাশাবাদও হয়। সমাজের নতুন নতুন পদ্ধতির বিকাশ আমাকে সচল রেখেছে। যদি আন্দোলন বেঁচে না থাকত, যদি সামাজিক প্রতিরোধ সংগ্রাম না থাকত, তাহলে আমি বেঁচে থাকতে পারতাম কি না জানি না। তাই আমি যা করছি তাতে আমি সব সময়ই সমাজের সাথে সরাসরি নিজেকে সংযুক্ত বোধ করি। আমি মনে করি, এটি এমন একটি যুগ, যখন নব্য-উদারবাদ মানুষকে শুধুমাত্র ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাবনায় বাধ্য করতে চায় এবং সামষ্টিক চেতনাকে নিরুৎসাহ করে। তাই আমাদের কাজ হল সামষ্টিক চেতনায় মানুষকে উৎসাহিত করা।

সমষ্টির মধ্যেই আমাদের আশা, ভরসা সঞ্চিত রয়েছে।

 

ফাতেমা বেগম: লেখক ও অনুবাদক

ইমেইল: 

অনুবাদকের টীকা

১) ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই তারিখে নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ড্যানিয়েল পেন্টালিও নামের পুলিশ অফিসার আফ্রিকান-আমেরিকান এরিক গার্নারকে গ্রেফতার করার সময় মাটিতে শ্বাসরোধ করে রাখে। এরিক গার্নার অচেতন হয়ে গেলে তাঁকে কোন প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে এক ঘণ্টা পর হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
২) ম্যালকম এক্স একজন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান (১৯২৫-৬৫)। তিনি মানবাধিকারকর্মী ছিলেন, এবং নাগরিক অধিকার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
৩) অগাস্টো পিনোশে চিলিতে ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত একজন জেনারেল, রাজনীতিবিদ এবং একনায়ক প্রেসিডেন্টের ভূমিকায় ছিলেন।
৪) University College London Association (UCLA)
৫) Students for Justice in Palestine (SJP)
৬) Boycott, Divestment, Sanctions (BDS)
৭) Historically Black Colleges and Universities (HBCUÑSince 1964)

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •