“ইঁদুর ফিল্ম” (২০১৬) এবং “একটি না জানার রাত” (২০২১)

চলচ্চিত্র পর্যালোচনা: সব কিছু মনে থাকবে

“ইঁদুর ফিল্ম” (২০১৬) এবং “একটি না জানার রাত” (২০২১)

মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন

“আমি মনে করি আমার অনেক কাজ এমন সম্প্রদায় এবং সংস্কৃতির সাথে কাজ করে যেগুলির আমি অংশ নই, যেখানে আমি নই। আমার অনেক কাজ দূরত্বের ধারণা এবং দূরত্বের বিশেষাধিকারের সাথে জড়িত – দূরত্ব এমন কিছু যা দৃষ্টিকোণকে সক্ষম করে।”

(গুগল অনুবাদ ব্যবহার করা হয়েছে, থিও অ্যান্থনির মুবির পাতা থেকে।)

  • থিও অ্যান্থনি।

“সিনেমার কল্পনাশক্তি খোলার সম্ভাবনা আছে।”

(গুগল অনুবাদ ব্যবহার করা হয়েছে, পায়েল কাপাডিয়ার মুবির পাতা থেকে।)

  • পায়েল কাপাডিয়া।

ভূমিকা

শত বছরের বেশি সময় ধরে শিল্পের,সমাজের অন্যতম একটা প্রকাশভঙ্গি হিসেবে সিনেমা বেশ সফল এবং অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম। সিনেমায় শুরু থেকেই নানান গভীর ভাবনার, জীবনদর্শনের ছবি উঠে এসেছে প্রতিজন শিল্পীর/নির্মাতার/পরিচালকের/অতরের নিজের মতন করে। চ্যাপলিন, আইজেনস্তাইন, মুর নাউ, ফ্লাহার্টি থেকে গদার, শাতাল আকারমান, ক্রিস মার্কার সবাই সবার মতো করে বলেছেন তাদের দর্শন, গল্প, ভাবনা, বিষয়। কখনো গল্পের মতন করে, কখনো রচনা হিসেবে বা হাস্যরসের মাধ্যমে। এভাবে ধীরে তৈরি হয়েছে সিনেমার বিভিন্ন ধরনের, যেমন প্রামাণ্যচিত্র, নাটকীয় (Drama), কল্পকাহিনীসহ আরো একাধিক নানান বিচিত্র প্রকারভেদ। “উত্তরের নানুক” (১৯২২) এর উদাহরণ ধরে বলা যায় এ যেমন এক দুর্দান্ত প্রামাণ্যচিত্র ঠিক সেরকম নাটকীয় সিনেমার প্রচুর উপাদান ছড়িয়ে রয়েছে নানুকের শরীর জুড়ে। আবার নব্যবাস্তবতার প্রচুর নাটকীয় সিনেমায় রয়েছে নানান প্রামাণ্যচিত্রের উপাদান বা এসব ধরনের মিশ্রণের অনেক আলাপ করা যায় জহির রায়হান, তারেক মাসুদ বা ঋত্বিক-সত্যজিৎ-সেনের কাজের উদাহরণ ধরে। আবার কেউ কেউ এ মিশ্রণের সমাহারকে তার ভাবনার প্রকাশভঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

একসাথে এসব মিশ্রণের সমাহার সমৃদ্ধ সিনেমাকে বোঝাতে সাধারণত পরীক্ষামূলক সিনেমা হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং আরো নানানসব নামধাম বিভাজন, যেমন রচনা সিনেমা, শংকর সিনেমা, সৃজনশীল সিনেমা, পাতাললোক সিনেমা ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব সিনেমা বিনোদন হয়তো জোগাতে চায় তবে তার চেয়ে বেশি বেশি চায় আমাদের মনকে জাগাতে, চায় আমাদের সরল কৌতূহল বেঁচে থাক, মনে প্রশ্ন জাগুক, আমরা ইঁদুর দৌড়ের বাইরের পৃথিবী, ভাবনা, বাস্তবতা দেখি, ভাবি। জনপ্রিয়তা, ক্ষমতাকেন্দ্রিক ভাবনার বাইরের আসল পৃথিবী দেখি। আসল বাস্তবতা দেখানোর পথ খুব সহজ, এমন নয়। নিজস্ব মেধার সাথে ঠিকঠাক আর্থিক সঙ্গতি এবং দরকার দুর্দান্ত সাহস, সোজা করে না বলতে পারলে ভিন্নপন্থায়, ভিন্ন পথে। কিন্তু মুক্তি চাই, মুক্ত ভাবনা বিকাশের পরিবেশ চাই, প্রকৃতি আর মানুষের উপর চেপে বসা অসহনীয় শুধুমাত্র মানব অর্থনৈতিক উন্নয়ন কেন্দ্রিক ব্যবস্থার বদল চাই। এমনসব বিষয়েরা নানানভাবে ছবি আর মুহূর্ত হিসেবে হাজির হয় পায়েল কাপাডিয়া (একটি না জানার রাত [২০২১]) ও থিও অ্যান্থনির (ইঁদুর ফিল্ম [২০১৬]) সাপ্প্রতিক রচনায়/সিনেমায়।

এসব সিনেমা বিনোদন হয়তো জোগাতে চায় তবে তার চেয়ে বেশি বেশি চায় আমাদের মনকে জাগাতে, চায় আমাদের সরল কৌতূহল বেঁচে থাক, মনে প্রশ্ন জাগুক, আমরা ইঁদুর দৌড়ের বাইরের পৃথিবী, ভাবনা, বাস্তবতা দেখি, ভাবি। জনপ্রিয়তা, ক্ষমতাকেন্দ্রিক ভাবনার বাইরের আসল পৃথিবী দেখি

নতুন নির্মাণ, নতুন নির্মাতা

ইঁদুর ফিল্ম (২০১৬)

নির্মাণ ও লেখকঃ থিও অ্যান্থনি।

প্রযোজনাঃ সেবাস্তিয়ান পারডো, রিয়েল রচ ডেক্টার । চিত্রায়নঃ থিও অ্যান্থনি। সঙ্গীতঃ ড্যান ডেকন।

উৎপাদন প্রতিষ্ঠানঃ স্মৃতি। বিতরণ: সিনেমা গিল্ড। মুক্তির তারিখঃ আগস্ট ১০, ২০১৬

(লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসব)। দৈর্ঘ্যঃ ৮২ মিনিট। দেশ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

ভাবনা

শুরুতে পৃথিবী পৃথিবীর মত ছিলনা। ছিল ডিমের মতো আর অন্ধকার। ইঁদুর একসময় এ ডিম ঠোকরাতে থাকে এবং ধীরে ধীরে আলো প্রবেশ করতে থাকে, শুরু হয় পৃথিবীর আর ইঁদুর সিনেমার। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শহর বাল্টিমোরের গল্প বলে ইঁদুর সিনেমা। স্মৃতি, ইতিহাস, তথ্য, প্রমাণ আর নিজের সব ভাবনা থিও-র, সব মিলিয়ে। আমরা শুরু থেকেই সিনেমার এক প্রটাগনিস্ট মাধ্যমে জানি ইঁদুর সমস্যা ছিলনা, বাল্টিমোরে এসব মানুষের সমস্যা, খুব দার্শনিকসুলভ ভঙ্গিতে কথা বলতে থাকেন কালো রঙ্গের ইঁদুর নিধনকারী মানুষ এডমুন্ড। তার সাথে আমরা ভ্রমণ করতে থাকি শহরের কালো আর গরিব মানুষদের পাড়ায়।প্রায় রোবোটিক এক কণ্ঠের বর্ণনাকারি আমাদের নানানসব তথ্য, গল্পের মাধ্যমে সিনেমার সূত্রধর হিসেবে সাথে নিয়ে চলেন। শহরের ইতিহাস, সাদাকালো মানুষের বিভাজন আর ভিন্ন ভিন্ন পাড়ার গল্প আমরা জানতে থাকি। খুব সহজ ইতিহাস বড়লোক ও সাদা মানুষদের পাড়ায় কখনো ইঁদুর ছিলনা আর গরিব ও কালো মানুষদের পাড়ায় ইঁদুর ছিল আর শহর বিভক্ত ছিল, বার্লিন দেয়ালের মতন কিন্তু অমন দেয়াল এখানে ছিলনা কিন্তু বিভাজন সহজ, সাদা মানুষদের শহর আলাদা আর কালো মানুষদের শহর আলাদা। সেই সময় আর নেই কিন্তু মানচিত্র একই রকম রয়ে গেছে। এখনো, অপরাধ, ইঁদুর আর কালো মানুষেরা একসাথে বাস করে। তাদের পূর্বপুরুষদের/ পূর্বনারীদের পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে এখানে জোর করে আনা হয়েছিল দাস হিসেবে, সেই নানানসব হিসেব, তরিকা এখনো বিদ্যমান নানানসব বিচিত্র কারণে!? এভাবে ইঁদুর সিনেমায় আমরা আলোচিত এ শহর আর তার বর্ণবাদি চরিত্রের অতীত, বর্তমান দেখতে থাকি নানান মানচিত্র আর ইঁদুরের সম্পর্কিত আলাপের অছিলায়।

ভিন্ন ভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন গল্প বলতে থাকেন থিও। ১৯৫৭ সালের এক পরীক্ষার কথা জানান, যেখানে ইঁদুরের বাসস্থান সীমিত রেখে অঢেল খাবারের যোগান দেয়া হতো। এক সময় পর্যন্ত সব ঠিক ছিল কিন্তু একটা পর্যায়ের পরে সব ভেঙ্গে পড়ে। শুরু হয় ইঁদুরের উন্মাদীয় শারীরিক সম্পর্ক। সারা বছর জুড়ে এবং ভাবনায় শুধু সংসার আর সন্তান এবং সন্তান! এভাবে চলতে চলতে একসময় ইঁদুরের জন্ম বিস্ফোরণ ঘটে। চারিদিকে শুধু ইঁদুর আর ইঁদুর।একসময় ইঁদুরের আচারে পরিবর্তন শুরু হয়। একটা সময় তাদের ভিতর দেখা যায় নিজেদের খেয়ে ফেলা আর যৌনতাকেন্দ্রিকতা ও শোষণের প্রক্রিয়া! আবার কমতে থাকে তাদের পুনঃউৎপাদন! মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের অর্থায়নে এ পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। যেখানে দেখানো হয়েছিল বাসস্থানের ধরন কীভাবে মানসিকতার উপর প্রভাব ফেলতে পারে। এসবসহ আরো নানানসব পরীক্ষা করা হচ্ছিল ও হচ্ছে যে কীভাবে ইঁদুর কমানো যায় বা একেবারে নাই করে ফেলা যায়! 

সিনেমার এ ভাবনা খানিক আমাদের ভাবার অবকাশ করে দেয়। আমাদের বাসস্থান, তার অবস্থান, নকশা আমাদের উপর বিশাল প্রভাব রাখতে পারে। বাল্টিমোরের কালো মানুষদের কথা ও তাদের অবস্থান বারবার দেখানোর সাথে এ পরীক্ষার ফলাফল মিলিয়ে দেখা যায় কেন, কী আর কীভাবে হচ্ছে। আর প্রকৃতিকে নিজের মতন চলতে দিলেই ভালো, তাকে সংশোধন করার বা তার কিছু পরিবর্তন করা সমস্যা বাড়ানো ছাড়া কিছুই করতে পারেনা। হয়তো সাময়িক একটা নিদান হিসেবে কিছুদিন চলতে পারে বা পরিবর্তনের সুফল চলতে চলতেই শুরু হয়ে যেতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়।

আছে ভিডিও গেমের মতো করে শহর পরিভ্রমণ, ইঁদুর আসলে কীভাবে দেখে তার খানিক, প্রযুক্তির সাহায্যে অনুধাবন করার চেষ্টা এবং থিও তার মতো করে একটা সত্য বলতে চেয়েছেন বাল্টিমোর শহরের ইঁদুরের সাথের সম্পর্কের ভিতরকার ইতিহাসের মাধ্যমে। অনেক কিছুই আমাদের প্রচলিত যুক্তিবোধের সাহায্যে প্রমাণ করা যায়না বা চারিদিকে তথ্যের কারচুপির ছড়াছড়ি বা সোজাভাবে অনেক তথ্যই প্রকাশ করা হয়না নানানসব দোহাই দিয়ে কিন্তু তথ্যের অভাব নিয়েও আমরা অনুমানে ঠিক ধরতে পারি কি হচ্ছে। কার জন্য হচ্ছে আর কীভাবে হচ্ছে?

এভাবেই ৮২ মিনিটের “ইঁদুর ফিল্ম” এ থিও তার ভাবনা প্রকাশ করেছেন।

একটি না জানার রাত (২০২১)

নির্মাণঃ পায়েল কাপাডিয়া। রচনাঃ পায়েল কাপাডিয়া ও হিমাংশু প্রজাপতি। প্রযোজনাঃ রণবীর দাস, জুলিয়েন গ্রাফ, টমাস হাকিম। বর্ণনাঃ ভূমিসুতা দাস।চিত্রায়ন ও সম্পাদনাঃ রণবীর দাস। উৎপাদন কোম্পানিঃ ক্ষুদ্র বিশৃঙ্খলা, আরেকটি জন্ম। বিতরণঃ চতুষ্কোণ চোখ। মুক্তির তারিখঃ ১৫ জুলাই ২০২১ (কান)। দৈর্ঘ্যঃ ৯৭ মিনিট। ভাষাঃ হিন্দি,বাংলা ও ইংরেজি। দেশঃ ফ্রান্স ও ভারত।

সব কিছু মনে থাকবে

চারিদিক জুড়ে চলছে এক নিম্নগামীতার উৎসব। পৃথিবীজুড়ে নানান দেশের নানান রঙ্গের নানান জনপ্রিয় আর অজনপ্রিয় নেতাদের বিশাল ও বিচিত্রসব উছিলা আর খামখেয়ালি, অগণতান্ত্রিকসব আচরণের সমাহার। নেতাগণ যেমন মানের তাদের অনুসারীগণ তাদের চেয়ে খুব একটা ভালো না। ফলে এসব জনগণের মন জয় করে আম-ছালা সব ভোগ করছে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ। আর সাধারণ জনগণের কাছে এসব নেতাগণ দেবতা!

নেতাগণ যেমন মানের তাদের অনুসারীগণ তাদের চেয়ে খুব একটা ভালো না। ফলে এসব জনগণের মন জয় করে আম-ছালা সব ভোগ করছে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ। আর সাধারণ জনগণের কাছে এসব নেতাগণ দেবতা!

মোদী, হাসিনা, পুতিন, শি চিনফিং, ট্র্যাম্প (২০১৭-২০২১), সালমান (যদিও এখনো বাদশাহি সরাসরি নেননি কিন্তু সবাই জানেন এ যুবরাজ এখন সৌদির ক্ষমতার মূল কারিগর) এরা এখন জনপ্রিয় নেতা আর এদের শাসনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তথ্যের অবাধ প্রবাহে সমস্যা ও বাধা তৈরি করা। নিজেদের মতাদর্শের জয়গান এবং ভিন্ন মতামতের মানুষদের প্রতি নির্যাতন, হুমকি, মামলা-হামলা, হত্যা, গুমসহ নানা অগণতান্ত্রিক উপায়ে ভিন্নমত দমন করা। আর অন্যদিকে এদের প্রচার, বিজ্ঞাপন ও প্রপাগন্ডায় তৈরি হয়েছে বিশাল জনপ্রিয়তা। এরা এখন যেকোনো “তারকা”র চেয়ে কম নয়।এমন এক সময়ে মোদীর ভারতের এক ফিল্ম স্কুলের “ল” (এল) নামের এক (কল্পিত) প্রাক্তনের না পাঠানো চিঠি, চিরকুট, আঁকা, তোলা কিছু আন্দোলনের ফুটেজ, ফেলে যাওয়া সংগ্রহের কিছু ছোট বেলার ফুটেজ ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে বানানো এক প্রামাণ্যচিত্র “একটি না জানার রাত”, নির্মাতা পায়েল কাপাডিয়া।

পায়েল যখন পড়ছিলেন এফটিআইআই-এ তখন মোদী সরকার জোর করে অগণতান্ত্রিক উপায়ে যোগ্যতাহীন এক চেয়ারম্যান নিয়োগ করে ছিলেন। যার প্রধান যোগ্যতা হচ্ছে মোদী সরকারের সাথে তার সম্পর্ক। কিন্তু বাদ সাধে সাধারণ ছাত্রছাত্রীগণ। তারা একের পরে এক প্রশ্ন তোলে। এরকম যোগ্যতাহীন একজন লোকের এরকম সম্মানজনক একটা পদে নিয়োগ নিয়ে। ফলাফল তাদের উপর নেমে আসে পুলিশি হামলা, নির্যাতন, মুখোশ পরা শাসক দলের পোষা বাহিনীর হামলা, মামলা, গ্রেফতার! দেড়শ দিন ওরা আন্দোলন করেছিল। ওরা লেনিন থেকে বলেছিল, ওরা সমতা আর গণতন্ত্রের কথা বলেছিল। কিন্তু কী হয়েছে আর মোদী এবং বিজেপির ভারতে কী হচ্ছে আমরা সবাই জানি। পায়েল নিজের কাঁধে দায় নিয়ে তুলে ধরেন কল্পিত চরিত্রের মাধ্যমে তার ও তার বন্ধুদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা। যে চরিত্রের নাম “ল” ।

ল’য়ের টুকরো টুকরো মন্তব্য, আঁকা আর তার প্রেমিকের কাছে না পাঠানো এক চিঠির মাধ্যমে আমরা জানতে থাকি তার প্রেমিককে তার মা-বাবা এক ঘরে বন্দি করে রেখেছে যেন সে ভিন্ন জাতের মেয়েকে বিয়ে করতে না পারে। ল’য়ের মুখে শুনতে থাকি এসব বয়ান। তার প্রেমিক, সহপাঠী আবার ক্যাম্পাসের বিপ্লবী ছাত্র বটে! যার সম্পর্কে প্রশাসন নিয়মিত খোঁজ খবর জানার চেষ্টা করে কিন্তু এ বিপ্লবী প্রেমিক তার মা-বাবার আঁচল ছেড়ে বের হতে পারেনা, জাত পাতের শিকল ভেঙ্গে!? যেন অরুন্ধতী রায়ের মতামত প্রবন্ধে পড়া ভারতীয় সমাজের যথার্থ প্রতিনিধি এ প্রেমিক আর তার মা-বাবা। রায় লিখেছিলেন সমকামিতা বিষয়ে, যে আমরা সবাই সমকামিতাকে মেনে নিতে রাজি আছি কিন্তু সমস্যা শুরু হয় তখনি যখন নিজের ছেলে বা মেয়ে সমকামি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তখন আমাদের সমস্ত সুশীলতার মুখোশ খসে পড়ে। যেমন বিপ্লবী প্রেমিক ও তার মা-বাবার মুখের মুখোশ খসে পড়েছে জাত-পাতের প্রশ্ন উঠতেই। কিন্তু ল’য়ের প্রেমে এসবে ভাটা পড়েনি। সে ভালবেসেই যাচ্ছিল তার প্রেমিককে! ল প্রশ্ন তুলেছিল কিন্তু উত্তরে আগ্রহ দেখায়নি, ও সয়ে যাচ্ছিল একা বিরহের ভার! কিন্তু এসব করতে করতে একসময় দিল্লিতে যায় তার এক বন্ধুর ফিল্ম সম্পাদনা করতে। তারা সম্পাদনার টেবিলে বসে মনযোগ দিতে পারেনা সম্পাদনায়। ধীরে রাস্তায় নেমে আসে, ঢুকে পড়ে তৎকালীন দিল্লির মোদীর জুলুমি আইনের বিরুদ্ধে চলতে থাকা ছাত্রআন্দোলনে। উমর, খালিদ, আজাদ আরো সব ছেলে-মেয়েদের সাথে জড়িয়ে পড়ে ল। সিনেমা ধীরে শেষের দিকে আগাতে থাকে। ল দেখতে থাকে চারিদিকের নারকীয় তাণ্ডব যা ভিতর থেকে তাকে নাড়িয়ে দেয়, সে একসময় বোধি প্রাপ্ত হয়। সিনেমা শেষ হয় কবি আমির আজিজের কবিতার একটা লাইন দিয়ে,

‘সব মনে রাখা হবে।’

বিক্ষিপ্ত কিন্তু বিচ্ছিন্ন নয়

‘ইঁদুর ফিল্ম’ ও ‘একটি না জানার রাত’, প্রথাগত প্রামাণ্যচিত্র নয় বা ঠিক ঠিক যুক্তি তর্কের ধার ধেরে যে গল্প বলেছে এমন নয়। প্রচুর নাটকীয় সিনেমার উপাদান রয়েছে এ সিনেমা দুটোতে। রয়েছে মুক্ত কল্পনার সহজ বিকাশ। অনেক সময় আমরা অনেক কিছু অনুমান করতে পারি কিন্তু প্রমাণ করতে পারিনা। তো সহজেই শিল্প যেহেতু ক্ষমতাবানদের আদালত নয় তাই এখানে আমরা সেই প্রমাণবিহীন কিন্তু সত্যি কথা আশা করতেই পারি। সে সত্য কথনের দায় পুরো কাঁধে করে গল্প বানিয়েছে বা রচনা করেছে আলোচিত সিনেমার নির্মাতাগণ।

আমাদের চারপাশের অনেক কিছুই আর আমাদের চোখে পড়েনা বা আমরা পড়তে দেইনা। যেন না দেখলেই আমরা আমাদের দায় স্বীকার করার দায়িত্ব নেই বা সুমনের গানের মতন করে বলা হবে দেখছিলামনা ভালো করে! এসব করে বা ভেবে আমরা আমাদের পরিণতি এড়াতে পারিনি! পৃথিবী আজ তার সমস্ত প্রাণীকুল নিয়ে ধ্বংসের মুখে পতিত। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রকৃতি আর তার নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। তার সব কিছুই এখন নির্ভর করছে মানুষসৃষ্ট দূষণের উপর। আর মানুষেরা ভাবছে পৃথিবী তার একার! সে যা খুশি তাই করতে পারে। চাইলে পৃথিবী ধ্বংস করে মঙ্গলে যাবার পরিকল্পনা করতে পারে এবং কোটি কোটি মানুষ এসবে হাতে তালি দিয়ে উৎসাহ যোগায়। এগুলো উন্নয়ন এখন মানুষের কাছে। মানুষ এখন জঙ্গল কেটে জঙ্গল বুক বানাতে শিখে গেছে! এখন আর জঙ্গলের দরকার নেই!? আমরা এখন বাঘ, সিংহ, হাতি, অজগর, পাখি সবকিছুই নিজের বাড়ির পোষা প্রাণী বানিয়ে ফেলেছি। তাদের প্রাকৃতিক বাসস্থান ধ্বংস করে ফেলেছি আর বাড়ির কারাগারে বন্দি করে “ভালোবাসা” ফলাচ্ছি!

পৃথিবী আজ তার সমস্ত প্রাণীকুল নিয়ে ধ্বংসের মুখে পতিত। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রকৃতি আর তার নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। তার সব কিছুই এখন নির্ভর করছে মানুষসৃষ্ট দূষণের উপর। আর মানুষেরা ভাবছে পৃথিবী তার একার! সে যা খুশি তাই করতে পারে।

আমাদের চারিদিকে এখন মুক্তি, স্বাধীনতা, প্রকৃতি এসব শব্দের অর্থ চুরি করে, চালাকি করে বদলে ফেলা হয়েছে! এখন খুব বুঝে, শুনে আমরা এতটা চতুর হয়ে গেছি যে, আমরা লেনিন আর হিটলারকে এক দলভুক্ত করি। চার্চিলের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস ভুলে যেতে পারি। ভুলে যেতে পারি ভারতীয় উপমহাদেশের, বিশেষত বাংলার লাখো মানুষের মৃত্যুর মিছিল। ভুলে যেতে পারি উপনিবেশবাদ, ভুলে যেতে পারি সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ, ভুলে যেতে পারি ইজরায়েল রাষ্ট্রের নাজিল কাহিনি! ভুলে যেতে পারি দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে একের পরে এক সাম্প্রদায়িক হামলা, মামলা। কিন্তু ‘ইঁদুর সিনেমা’ আর ‘একটি না জানার রাত’ আমাদের জানায় সবাই জোয়ারে ভেসে যায়না। কেউ কেউ মনে রাখে, কারো কারো সব মনে থাকবে। 

মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন: চলচ্চিত্রকার, চলচ্চিত্র সমালোচক। ইমেইল: raiparasadardi@gmail.com

দোহাই

https://en.wikipedia.org/wiki/Rat_Film

https://en.wikipedia.org/wiki/Theo_Anthony                   

https://mubi.com/cast/theo-anthony

https://vimeo.com/theoanthony

http://www.theoanthony.net/

https://www.rogerebert.com/reviews/rat-film-2017

https://en.wikipedia.org/wiki/A_Night_of_Knowing_Nothing

https://en.wikipedia.org/wiki/Payal_Kapadia_(filmmaker)

https://mubi.com/cast/payal-kapadia

https://www.youtube.com/watch?v=Y3PTimpr_W8&ab_channel=TheCinemaGuild

https://vimeo.com/payalkapadia                 

https://www.theguardian.com/film/2022/mar/28/a-night-of-knowing-nothing-review

https://www.youtube.com/watch?v=PHk_5gEXDY0&ab_channel=AamirAziz

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •