বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভারত নির্ভরতা

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভারত নির্ভরতা

মোশাহিদা সুলতানা

সরকারের দাবি অনুযায়ী দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা যখন চাহিদার তুলনায় দ্বিগুণ তখন দেশে চলছে মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিং। সকল তথ্য প্রমাণ বিশ্লেষণ থেকেই দেখা যায় এই সংকটের কারণ দেশের ভেতরেই, দেশ বিদেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে ব্যবসা দেয়া বা খুশি করতে গিয়ে সুলভ, নিরাপদ, স্বনির্ভর পথ বর্জন করে ব্যয়বহুল ঋণনির্ভর পরনির্ভর প্রাণ প্রকৃতি বিনাশী বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণে সরকারের নীতি থেকেই এই সংকটের উৎপত্তি। এই ধারাতেই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ভারত, চীন, রাশিয়া, জাপান ও মার্কিন বিভিন্ন কোম্পানি নির্ভর নানা প্রকল্প। এই লেখায় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভারত নির্ভর কিছু প্রকল্প পরীক্ষা করে তার যৌক্তিকতা ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব  আলোচনা করা হয়েছে।

ভূমিকা

গত ১০ বছরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। সবসময়ই প্রশ্ন ছিল এই প্রকল্পগুলোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। গত এক বছরে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর যে জ্বালানি সংকট শুরু হয়েছে, তাতে বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়নের আসল চিত্র বের হয়ে এসেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস পড়ে থাকায় গত ১১ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ৯০ হাজার কোটি টাকা। (আহমেদ ২০২২) বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে আমদানিনির্ভর করে তোলা হয়েছে। আর তাই বর্তমানে দিনে ৩৫০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। অর্থনৈতিক বড় ক্ষতির মধ্যে পড়েছে দেশ। কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। এ রকম অবস্থায় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরের সময় বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সমালোচিত প্রকল্প রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন করে এসেছেন। এ ছাড়া আরও কিছু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই সংকট মুহূর্তে নতুন করে ভারতীয় প্রকল্পগুলোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রবন্ধে ভারতীয় প্রকল্পগুলোর হালনাগাদ চিত্র আসলে কী এবং বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রকল্পগুলো কী পরিণতি বয়ে নিয়ে আসতে পারে তার একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করা হয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ১৫২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন ২৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। এর মধ্যে বর্তমানে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি হয় সর্বোচ্চ উৎপাদনের প্রায় ৮ শতাংশ (১১৬০ মেগাওয়াট)। ভারতীয় প্রকল্পগুলো (বাংলাদেশ ও ভারতে) বাস্তবায়ন হলে এই নির্ভরশীলতা বেড়ে হবে প্রায় ৪৮৬০ মেগাওয়াট। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে ভারতের অংশগ্রহণ দাঁড়াবে প্রায় ১৬ শতাংশ। (তাহের ২০২২) এর সঙ্গে নির্মিতব্য পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল আমদানি শুরু হলে জ্বালানি খাতে ভারতের অংশগ্রহণ ২০ শতাংশের বেশি হয়ে যাবে। এই প্রবন্ধে প্রথমে সংক্ষেপে ভারতের ওপর বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি নির্ভরশীলতার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় অংশে এই নির্ভরশীলতা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের দিক থেকে কী অর্থ বহন করে এবং এই প্রকল্পগুলো কীভাবে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধিতে অন্তরায় হিসেবে কাজ করতে পারে, তা নিয়ে একটি বিশ্লেষণ হাজির করা হয়েছে।

ভারতের ওপর বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও ব্যবস্থাপনাগত নির্ভরশীলতা

ভারতের ওপর বিদ্যুৎ নির্ভরশীলতা

 প্রকল্প সক্ষমতা

উৎপাদন বা সরবরাহ

(চলমান ও সম্ভাব্য)

মন্তব্য
১।পশ্চিমবঙ্গ বহরমপুর-পাবনা সঞ্চালন লাইন১০০০ মেগাওয়াটচলমান

গত তিন অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ প্রায় পাঁচ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।

(আহমেদ ২০২২)

২।ত্রিপুরার সূর্যমণি থেকে কুমিল্লা সঞ্চালন লাইন১৬০ মেগাওয়াটচলমান
৩।আদানির ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র১৬০০ মেগাওয়াটপ্রাথমিকভাবে ৪০০ মেগাওয়াট আমদানি শুরু হতে পারে ১৬ ডিসেম্বর ২০২২।চুক্তি অনুসারে ২৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ এক লাখ কোটি টাকা (টিবিএস নিউজ ২০২২)
৪।রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র১৩২০ মেগাওয়াট

৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ উদ্ভোধন করা হয়।

সম্ভাব্য উৎপাদন তারিখ: অক্টোবর ২০২২-এ প্রথম ইউনিট। ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সালে দ্বিতীয় ইউনিট

সুন্দরবন সংলগ্ন এই বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রাণ প্রকৃতিবিনাশী।
৫।রিলায়েন্স এলএনজিভিত্তিক মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেদ্র৭৫০ মেগাওয়াটসম্ভাব্য তারিখ ছিল সেপ্টেম্বর ২০২২এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচ বেড়ে গেছে।
৬।সোনাগাজী বায়ুবিদ্যুৎ৩০ মেগাওয়াটঅনিশ্চিতরিজেন পাওয়ারটেক ও সিদ্ধান্ত উইন্ড এনার্জি লিমিটেড নামে ভারতীয় দুটি কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে।
 মোট৪৮৬০ মেগাওয়াটআগামী ২-৩ বছরেভারতের ওপর নির্ভরশীলতা

 

ভারতের ওপর জ্বালানি নির্ভরশীলতা

 প্রকল্প জাতীয় সক্ষমতা কৌশলগত ঝুঁকি আর্থিক ক্ষতি
১। ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে পরিশোধিত তেল আমদানিপরিশোধনে জাতীয় সক্ষমতা তৈরির পথে দীর্ঘমেয়াদি বাধা।কৌশলগত দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণপাইপলাইনে আমদানিতে সাশ্রয়ের (২-৩ ডলার) চেয়ে দেশীয় রিফাইনারির মাধ্যমে পরিশোধন (১১ ডলার সাশ্রয়) অধিক সাশ্রয়ী।
২। এলএনজি আমদানিএলএনজি আমদানির অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় দেশীয় গ্যাস উত্তোলনের বিনিয়োগ সংকুচিত করে।ভারত নিজেই এলএনজি আমদানি করে। ভারতের ওপর নির্ভরতা ভবিষ্যৎ জ্বালানি সংকটে কৌশলগত বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে পারে।এলএনজি আমদানি ব্যয়বহুল।
৩। ওএনজিসির গ্যাস উত্তোলনবাংলাদেশের জাতীয় সক্ষমতা তৈরির পথে বাধা। ওএনজিসি নিজেও বিভিন্ন দেশ থেকে পরামর্শক নিয়োগ করে নিজ দেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে থাকে।অগভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনের নামে কালক্ষেপণ করে বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ সম্পর্কে খবরাখবর রাখার পথ তৈরি করে ভারতকে কৌশলগত সুবিধা দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের পর থেকে সময় বাড়িয়ে বাজেট দ্বিগুণ করেছে ওএনজিসি।

‘বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে বিদেশ থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে প্রতি ব্যারেলে পরিবহণ খরচ হয় ৩ ডলারের মতো। সেই তেল চট্টগ্রামে শোধন করে সড়কপথে পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। চট্টগ্রাম থেকে সড়কপথে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় তেল পরিবহণে খরচ হয় ব্যারেলপ্রতি ৪ থেকে ৫ ডলার। ফলে পরিবহণ ব্যয় দাঁড়ায় সব মিলিয়ে ৭ থেকে ৮ ডলার। আর ভারত থেকে পাইপলাইনে পরিশোধিত তেল এনে দেশের উত্তরাঞ্চলে সরবরাহ করতে পরিবহণ ব্যয় হবে সাড়ে ৫ ডলারের মতো।’ অর্থাৎ ভারত থেকে পরিশোধিত তেল আমদানি করলে ব্যারেলপ্রতি সাশ্রয় হবে ২ থেকে ৩ ডলার। (জ্যেষ্ঠ প্রতিবদেক ২০১৮, রহমান ২০২২)

অন্যদিকে বিদেশ থেকে অপরিশোধিত তেল এনে দেশের পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন করে ডিজেল উৎপাদন করা হলে সাশ্রয় হয় ব্যারেলপ্রতি ১১ ডলার! (মহিউদ্দিন ২০২২) 

পেট্রোবাংলা অগভীর সমুদ্রের এসএস-০৪ এবং এসএন-০৯ ব্লকের জন্য ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পাঁচ বছরের পিএসসি সই করে ভারতের ওএনজিসির সঙ্গে, যা শেষ হয় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এরপর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চুক্তির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়, যা শেষ হবে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তবে অনুসন্ধানকাজ সম্পন্ন না হওয়ায় তৃতীয়বারের মতো সময় বৃদ্ধির আবেদন করেছে কোম্পানিটি। (ইমতিয়াজ ২০২২)

ইজারা নেওয়া দুই ব্লকে তিতলি ও মৈত্রী নামে দুটি অনুসন্ধান কূপ খননের জন্য ঠিকাদার নিয়োগে দুই দফা দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। এতে ১১০ মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব পায় ওএনজিসি, যা তাদের বাজেটের দ্বিগুণ। (ইমতিয়াজ ২০২২)

ভারতের ওপর ব্যবস্থাপনাগত নির্ভরশীলতা

২০১৮ সালে রূপপুর নিউক্লিয়ার প্রকল্পে যুক্ত হয় ভারত। রাশিয়া এ প্রকল্পে ডিজাইন, চুল্লিপাত্র ও মূল যন্ত্রপাতি সরবরাহ করলেও ভারতকে যুক্ত করা হয়েছে এ প্রকল্পে কর্মীদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ, অবকাঠামো নির্মাণে সহযোগিতা এবং প্রকল্পের ছোট ছোট যন্ত্রাংশ সরবরাহ করতে। এতে ভারত নিউক্লিয়ার সাপ্লাইয়ার হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আস্থা অর্জন করলেও বাংলাদেশের জন্য ভারতীয় ব্যবস্থাপনার ওপর দীর্ঘমেয়াদি নির্ভরশীলতা কৌশলগত দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ।

ভারতের ওপর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নির্ভরতা: সম্ভাব্য পরিণতি

দুটি সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে বর্তমানে ত্রিপুরা ও বহরমপুর থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। কিন্তু চাহিদা কম থাকায় গত তিন বছরে বিদ্যুৎ আমদানি না করে ভারতকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। সরকারি উদ্যোগে দেশীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখলে এই ক্যাপাসিটি চার্জের অর্থ বেঁচে যেত। তাই এই আমদানি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

আদানির ঝাড়খণ্ডের ১৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন গোড্ডা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র এখনো নির্মাণাধীন। সংবাদপত্রের সংবাদ বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে ৫৬.২ শতাংশ বেশি ও অন্যান্য কয়লা বিদ্যুতের চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি দাম নেবে। সম্প্রতি বিডব্লিউজিইডি ও গ্রোথওয়াচের প্রতিবেদন অনুসারে দেখা গেছে, ২৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হবে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা, যা দিয়ে ৩টি পদ্মা সেতু বানানো যায়। (টিবিএস নিউজ ২০২২)

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় কোম্পানির যেসব প্রকল্প নির্মাণাধীন তার মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত প্রকল্প হচ্ছে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। সম্পন্ন হওয়ার আগেই ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরের সময় প্রকল্পটি উদ্বোধন করেন। এর মধ্যে প্রথম ইউনিট চালু হওয়ার কথা অক্টোবর ২০২২ ও দ্বিতীয় ইউনিট চালু হওয়ার কথা ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারিতে। এই পরিবেশবিধ্বংসী প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ দীর্ঘ মেয়াদে সুন্দরবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় কোম্পানির দ্বিতীয় প্রকল্পটির বিনিয়োগকারী ভারতীয় ধনকুবের অমল আম্বানির রিলায়েন্স। ৭৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এলএনজিভিত্তিক এই প্রকল্পটি সেপ্টেম্বরেই উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় যখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই এলএনজির অভাবে সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে পারছে না, ঠিক সেই সময়ে এ ধরনের একটি অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাংলাদেশের সংকটের সময় কোনো ভূমিকাই রাখতে পারবে না।  এমনকি ভবিষ্যতেও এ প্রকল্প অপ্রয়োজনীয় ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে থাকার আশঙ্কা রয়েছে। এবং এতে জনগণের অর্থে আরও একটি প্রকল্প অব্যবহৃত সক্ষমতার কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের দায়ে দায়গ্রস্ত হতে পারে।

এই ছয়টি প্রকল্প চালু হলে আগামী ২-৩ বছরে ৪৮৬০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ গ্রিডে যুক্ত হবে। এতে ভারতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা বর্তমানের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে।

জ্বালানি খাতের চিত্রটিও প্রায় একই রকম। বর্তমানে ১৩১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের কাজ চলছে। এই পাইপলাইন দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে ডিজেল আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা তৈরি হবে। এভাবে আমদানির সুযোগ তৈরি হলে বাংলাদেশের তেল পরিশোধন শিল্পে নিজেদের সক্ষমতা তৈরির তাগিদ থাকবে না। এবং কখনো সংকট মুহূর্তে ভারত ডিজেল রপ্তানি করতে অস্বীকৃতি জানালে তখন বাংলাদেশের জনগণ ভুক্তভোগী হবে। কৌশলগত দিক থেকে জাতীয় স্বার্থে এ ধরনের নির্ভরশীলতা ঝুঁকিপূর্ণও বটে। আমরা দেখছি, রাশিয়া কীভাবে ইউক্রেন ও ইউরোপের গ্যাস সরবরাহের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এই দেশগুলোকে কোণঠাসা করেছে। ভারতও যে প্রয়োজনে বড় দেশ হিসেবে ছোট দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে না, তা নিশ্চিত হয়ে কেউ বলতে পারে না। বিশেষ করে সীমান্ত হত্যা নিয়ে ভারতের চরম উদাসীনতাই বলে দেয়, ভারত এই জ্বালানি নির্ভরতাকেও তার স্বার্থে ব্যবহার করতে উদ্যত হতে পারে।

এ ছাড়া পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল আমদানির পক্ষে যৌক্তিকতা হাজির করতে গিয়ে বাংলাদেশ যে ২-৩ ডলার সাশ্রয়ের কথা বলছে তা আসলে ভিত্তিহীন। কারণ, ক্রুড অয়েল আমদানি করে দেশে পরিশোধন করলে সাশ্রয় হবে ১১ ডলার। সে ক্ষেত্রে পাইপলাইন দিয়ে ডিজেল আমদানির প্রকল্প আসলে আর্থিক দিক বিবেচনায়ও যৌক্তিক নয়।

সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় ভারত থেকে এলএনজি আমদানির ব্যাপারেও আলোচনা হয়েছে। প্রথমত, এলএনজি এমনিতেই ব্যয়বহুল। বাংলাদেশ এলএনজি আমদানি কমিয়ে যখন দেশেই গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে না, তখন বাংলাদেশের দেশীয় গ্যাস উত্তোলনে আরও বিনিয়োগ করা দরকার। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে সংকটের সময়ও বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে এমন একটি প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করেছে। এলএনজি অবকাঠামো এমনিতেই সক্ষমতা পুরো কাজে লাগাতে পারছে না। এ অবস্থায় ভারত থেকে আমদানির জন্য নতুন অবকাঠামো নির্মাণে যে ব্যয় হবে, তা গ্যাস উত্তোলনের বিনিয়োগকেই এক অর্থে সংকুচিত করবে।

ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি (ONGC) ২০১৪ সালে অগভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ নেয়। কয়েকবার মেয়াদকাল শেষ হলেও অগভীর সমুদ্র ব্লকে গত ৮ বছরে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। ওএনজিসির নিজস্ব প্রযুক্তি না থাকলেও তারা বিভিন্ন দেশ থেকে পরামর্শক ও সাপ্লাইয়ার নিয়োগ করে তাদের কাজ সম্পন্ন করে। বাংলাদেশ চাইলে নিজেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে অগভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ নিতে পারত। এতে বাংলাদেশের জাতীয় সক্ষমতা তৈরিরও সম্ভাবনা ছিল। ওএনজিসি যেখানে দীর্ঘদিনেও এ কাজে অগ্রগতি দেখাতে পারেনি, সেখানে ওএনজিসির মতো প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশ নিজ দেশের সক্ষমতা তৈরির পথে অন্তরায়ও সৃষ্টি করেছে। এমনকি আর্থিক দিক থেকেও বাংলাদেশ ওএনজিসির কার্যক্রমের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছে বা হবে এমনও নয়। কারণ, ২০১৪ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ওএনজিসির বাজেট দ্বিগুণ হয়েছে। ভবিষ্যতে এই খরচ বেড়ে কত দাঁড়াবে এবং বাংলাদেশ এই গ্যাস উত্তোলন থেকে আদৌ কোনোভাবে উপকৃত হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি (ONGC) ২০১৪ সালে অগভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ নেয়। কয়েকবার মেয়াদকাল শেষ হলেও অগভীর সমুদ্র ব্লকে গত ৮ বছরে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। ওএনজিসির নিজস্ব প্রযুক্তি না থাকলেও তারা বিভিন্ন দেশ থেকে পরামর্শক ও সাপ্লাইয়ার নিয়োগ করে তাদের কাজ সম্পন্ন করে। বাংলাদেশ চাইলে নিজেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে অগভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ নিতে পারত।

যদিও রূপপুর প্রকল্পে ডিজাইন, চুল্লিপাত্র ও মূল যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে ভারতকে যুক্ত করা হয়েছে বলা হয়, কিন্তু আমরা দেখলাম রূপপুর প্রকল্পে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের প্যাকেজ-৬-এর রিভারক্রসিং (২০ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ) প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার পেছনে এক্সিম ব্যাংকের নির্ধারিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল। ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের নির্ধারিত যে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দরপত্র নিতে হয়েছে, সেখানে দেখা গেছে, দরপত্রে প্রস্তাবিত দর প্রাক্কলিত দরের চেয়ে অনেক বেশি। এ নিয়ে জটিলতা তৈরি করেছে ভারত। অবশেষে দীর্ঘদিন এলওসির ঋণের অপেক্ষায় থেকে বাংলাদেশ প্রকল্পটি এলওসি থেকে বাদ দিতে অনুরোধ করে। বাংলাদেশ এখন নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। (মুহিব ২০২২) ব্যবস্থাপনায় ভারতের অংশগ্রহণের এই উদাহরণ ভারতের স্বার্থকেই আবার সামনে নিয়ে আসে।

রূপপুর প্রকল্পে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের প্যাকেজ-৬-এর রিভারক্রসিং (২০ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ) প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার পেছনে এক্সিম ব্যাংকের নির্ধারিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল। ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের নির্ধারিত যে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দরপত্র নিতে হয়েছে, সেখানে দেখা গেছে, দরপত্রে প্রস্তাবিত দর প্রাক্কলিত দরের চেয়ে অনেক বেশি।

উপসংহার

গত ১০ বছরে ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে অথবা ভারতীয় কোম্পানির সরাসরি বিনিয়োগে যেসব বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রকল্প শুরু হয়েছে, সেগুলোকে প্রায়ই ভারতীয় সহযোগিতায় নির্মিত প্রকল্প হিসেবে হাজির করা হয়। অথচ এই প্রকল্পগুলোতে ভারতের আংশিক বিনিয়োগ থাকলেও এর ঋণ পরিশোধের দায় কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের ওপরই বর্তায়। কাজেই ভারত বাংলাদেশের কৌশলগত নির্ভরতার দিক থেকে এই প্রকল্পগুলো যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বাংলাদেশের জনগণের কাছে এই প্রকল্পগুলোর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই প্রবন্ধে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ভারত বাংলাদেশের ওপর যেভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, আপাতদৃষ্টিতে তা নিরীহ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রকল্প মনে হলেও সেগুলো আসলে ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কিছু উদাহরণ। কারণ, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, প্রতিটি প্রকল্পের বিপরীতে কোনো-না-কোনো‒হয় সাশ্রয়ী অথবা বেশি পরিবেশবান্ধব‒বিকল্প ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সেই বিকল্পগুলো গ্রহণ না করে ভারতকে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা করেছে জাতীয় সক্ষমতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে, কখনো করেছে পরিবেশের ক্ষতি করে, কখনো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে, এবং কখনো বিনা প্রশ্নে জাতীয় নিরাপত্তার কথা না ভেবে কৌশলগত ঝুঁকির বিনিময়ে।

প্রতিটি প্রকল্পের বিপরীতে কোনো-না-কোনো‒হয় সাশ্রয়ী অথবা বেশি পরিবেশবান্ধব‒বিকল্প ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সেই বিকল্পগুলো গ্রহণ না করে ভারতকে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা করেছে জাতীয় সক্ষমতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে, কখনো করেছে পরিবেশের ক্ষতি করে, কখনো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে, এবং কখনো বিনা প্রশ্নে জাতীয় নিরাপত্তার কথা না ভেবে কৌশলগত ঝুঁকির বিনিময়ে।

ভারতের ওপর ভবিষ্যতে যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নির্ভরতা তৈরি হতে যাচ্ছে, কৌশলগত দিক বিবেচনায় তা বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন কারণে। আমরা এরই মধ্যে দেখছি, বৈশ্বিক সংকট মুহূর্তে যেকোনো দেশের আমদানি নির্ভরতা কীভাবে সংকটকে বাড়িয়ে তুলছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঋণ পরিশোধের দায়। আমরা শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে দেখেছি কীভাবে অপ্রয়োজনীয় খাতে বিদেশি বিনিয়োগ দেশের রিজার্ভকে তলানিতে পৌঁছে দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, ভৌগোলিক দিক থেকে ভারত দিয়ে বেষ্টিত রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়ন ভারতের জন্য শুধু আর্থিক দিক বিবেচনায়ই নয়, কৌশলগতভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠারও একটি উপায়। খুব অল্প সময়ে এই নির্ভরতা যদি ২০ শতাংশের ওপরে চলে যায় এবং বাংলাদেশ যদি তার নিজস্ব সক্ষমতা তৈরি করতে না পারে, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ভারতের উত্তরোত্তর প্রভাব ভারতকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের আরও বেশি সুযোগ তৈরি করে দেবে।

মোশাহিদা সুলতানা: সহযোগী অধ্যাপক, একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: moshahida@du.ac.bd

তথ্যসূত্র

ইমতিয়াজ, হাসনাইন: ২০২২ ‘তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বাড়ছে বহুজাতিক কোম্পানির বলয়’ সমকাল, ১১ সেপ্টেম্বর

মহিউদ্দীন ২০২২: ‘৫০ বছরেও জ্বালানি তেল শোধনক্ষমতা বাড়েনি’ প্রথম আলো, ৮ আগস্ট

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক: ২০১৮ ‘ভারত থেকে তেল আনতে পাইপলাইন নির্মাণের উদ্বোধন’, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১৮ সেপ্টেম্বর

রহমান, মতিউর: ২০২২ ‘ভারত থেকে পাইপলাইনে সরাসরি আসবে ডিজেল’ দিনাজপুর অফিস, দৈনিক ইত্তেফাক, ৩১ আগস্ট

টিবিএস নিউজ: ২০২২ ‘বাংলাদেশ বিদ্যুৎ কিনতে আদানি গ্রুপকে যে অর্থ দেবে তাতে বানানো যাবে ৩টি পদ্মা সেতু’ ৮ জুন

আহমেদ, সজীব: ২০২২ ‘৯০ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ’ কালের কণ্ঠ, ৩ সেপ্টেম্বর।

তাহের, আবু: ২০২২ ‘বাংলাদেশ-ভারত বিদ্যুৎ জ্বালানি সহযোগিতা অর্থনৈতিক নাকি ভূরাজনৈতিক’ বণিক বার্তা, ২৫ জানুয়ারি

মুহিব, আবু হেনা: ২০২২ ‘যুগ পার আশ্বাস আর আশায়’ সমকাল ২ সেপ্টেম্বর

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •