উন্নয়ন যাত্রায় দুই মডেল: ওইসিডি, উপনিবেশ ও তৃতীয় বিশ্ব
বিমল রত্নায়েক
লেখক রাজনীতিবিদ বিমল রত্নায়েক শ্রীলঙ্কার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। ছাত্র ও যুব সংগঠনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বর্তমানে শ্রীলঙ্কা পিপল্স লিবারেশন ফ্রন্ট এর কেন্দ্রীয় সংগঠক এবং পলিট ব্যুরো সদস্য। তিনি এর আগে পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন। সম্প্রতি তিনি ঢাকায় সফরকালে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে যে প্রবন্ধ পাঠ করেন তার কিছুটা সংক্ষেপিত অনুবাদ এখানে প্রকাশ করা হলো। অনুবাদ করেছেন সুমাইয়া ফেরদৌস।
‘উন্নয়নশীল’ দেশগুলো কি ‘উন্নত’ দেশগুলোকে অনুসরণ করে ‘উন্নত’ হতে পারে?
একটি দেশ কতটা উন্নত তা পরিমাপের বিভিন্ন উপায় আছে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত অগ্রগতির বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, উন্নয়ন মাপার ক্ষেত্রে যেসব মানদণ্ড ব্যবহার করা হচ্ছে, তা মূলত পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভূত। আসলে উন্নয়নের নামে কী হচ্ছে, তা বোঝার জন্য যেসব তথ্য আমরা পাই, তা-ও এই দৃষ্টিকোণ থেকেই আসে–যাতে প্রায়ই দেখা যায় বাস্তব চিত্র প্রতিফলিত হয় না।
বর্তমানে মানবসমাজের অগ্রগতির সাপেক্ষে প্রচলিত পুঁজিবাদী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও মাপনীসমূহ একে একে ধসে পড়ছে। এসব পদ্ধতি একদিক থেকে যেমন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহের বাস্তব অগ্রগতি ও পরস্পরের সাপেক্ষে উন্নয়ন পরিমাপে ব্যর্থ, ঠিক তেমনি তা দিয়ে সামাজিক অগ্রগতি, অর্থনৈতিক অর্জন ও পরিবেশগত ক্ষয় সম্পর্কিত নিত্য হাজির হওয়া সমস্যাও ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, যেসব সমস্যা নিয়ে মার্কসবাদী তাত্ত্বিকরা বহুদিন ধরে কথা বলে আসছেন। তাই বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদী এই পরিমাপ পদ্ধতির ব্যর্থতা আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলস্বরূপ পরিমাপের কিছু নতুন পদ্ধতি জন্ম নিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ‘মানব উন্নয়ন সূচক’ (Human Development Index (HDI)) প্রতিস্থাপিত হয়েছে ‘অসমতা সংলগ্ন মানব উন্নয়ন সূচক, ১৭’ Inequality Adjusted Human Development Index, 17–IHDI), ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (Sustainable Development Goals–SDGs)) ইত্যাদি দ্বারা।
এ পরিস্থিতিতে আমরা আলোচনা করতে চাই ‘উন্নয়নশীল দেশগুলো কি উন্নত দেশগুলোকে অনুসরণ করে উন্নত হতে পারে’–এ বিষয়টা নিয়ে। এ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখা গেল, উন্নয়ন সংক্রান্ত বিশ্লেষণ পদ্ধতি (analysis method) এবং মানদণ্ডের (criteria) ব্যাপারে প্রাসঙ্গিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পথে সমূহ বাধা। সেই সঙ্গে এ ধরনের অনুসন্ধানকে পণ্ড করতে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিদের প্রচেষ্টাও লক্ষণীয়। পরিস্থিতির এমন বিরূপতার কারণে আমরা আইএইচডিআই সংক্রান্ত যেসব সূচক নিয়ে কাজ করেছি তা মূলত জাতিসংঘ থেকে প্রকাশিত। ধনী দেশ সংক্রান্ত তথ্যের ব্যাপারে আমরা নির্ভর করেছি ‘অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা’র (Organization for Economic Development–OECD) ওপর। এ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করছে যেসব স্বীকৃত আন্তর্জাতিক সংস্থা–এ কাজে তাদের তথ্য-উপাত্তও ব্যবহার করা হয়েছে।
যেসব দেশ আয়সীমা এবং মানব উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন সূচকে এগিয়ে আছে আন্তর্জাতিকভাবে, তাদের উন্নত দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মূলত এসব দেশ মিলেই গঠিত হয়েছে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা বা ওইসিডি। এটি আসলে কী? বর্তমানে এই সংস্থার সদস্যসংখ্যা ৩৭। সংস্থার মূলনীতি অনুসারে সদস্যদেশগুলোকে অবশ্যই (১) উচ্চ-উপার্জনশীল এবং (২) উচ্চ মানব উন্নয়ন সূচকের অধিকারী হতে হবে। সেই সঙ্গে সদস্যদেশগুলোকে অবশ্যই বাজার অর্থনীতির পরিকাঠামোতে থাকতে হবে। ফলত দেখা যাচ্ছে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কোনো দেশ প্রথম শর্ত দুটি পূরণ করলেও এ সংগঠনে থাকতে পারবে না। সংগঠনটির জন্ম ১৯৪৮ সালে। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালে নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি বৈশ্বিক রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক তৈরি করার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ‘মার্শাল প্ল্যান’ নামে একটি কর্মপরিকল্পনা নেয় এবং এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওইসিডি গঠন করা হয়। ১৯৬১ সালে মার্শাল প্ল্যান রদ হওয়ার পর ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থাকে (Organization for European Economic Co-operation–OEEC)) পুনর্গঠিত করা হয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (Organization for Economic Co-operation and Development–OECD) নামে। ২০১৭ সালের হিসাবে দেখা যায়, বিশ্বের মোট জিডিপির ৬২.২ শতাংশই আসছে ওই ৩৭টি দেশ থেকে।
১৯৪৫ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশদের তৈরি করা সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করে। এ সুযোগে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিল ওই সাম্রাজ্যকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। প্রকৃতপক্ষে ওইসিডি প্রতিষ্ঠা করা হয় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোকে একঘরে করে দমিয়ে রাখার জন্য, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্দেশ্য সফল হয়। সংগঠনটির জন্ম মূলত সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করার জন্য। শুধু এ কারণেই এখানে জায়গা হয়নি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের অন্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর, যদিও তারা বাজার অর্থনীতি ব্যবস্থা ছাড়া ওইসিডির বাকি সব শর্তই পূরণ করেছিল।
ওইসিডিতে রয়েছে কোন দেশগুলো?
ওইসিডির ৩৭টি সদস্যদেশ: অস্ট্রিয়া, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, চিলি, কলম্বিয়া, চেক রিপাবলিক, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, হাঙ্গেরি, আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ইসরায়েল, ইতালি, জাপান, কোরিয়া, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, লুক্সেমবার্গ, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, স্লোভাক রিপাবলিক, স্লোভেনিয়া, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।
ওইসিডির সদস্যদেশগুলোকে বিশ্লেষণ করা জরুরি। সদস্যদেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে–
- ৩৭টির মধ্যে ২০টি দেশ সেই ১৯০০ সাল থেকেই উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র বলে পরিচিত।
- ৩৭টির মধ্যে ২৪টি দেশ (সীমানা এবং সাম্রাজ্য বদল হওয়ার কারণে ২৪ সংখ্যাটি কিছুটা হেরফের হতে পারে) অতীতে ঔপনিবেশিক শাসক ছিল। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে এদের উপনিবেশ ছিল।
- এদের মধ্যে আটটি দেশ ১৯৯০ সালের আগে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল।
- পাঁচটি দেশ রয়েছে যারা উপরের চারটি ভাগের একটিতেও নেই। এগুলো হলো: দক্ষিণ কোরিয়া, ইসরায়েল, মেক্সিকো, চিলি ও কলম্বিয়া।
মানব উন্নয়ন সূচক কিংবা বাজার অর্থনীতির স্বাস্থ্য বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, এই পাঁচটি দেশের মধ্যে দুটি দেশের অবস্থা বেশ করুণ। যেমন কলম্বিয়া: মানব উন্নয়ন সূচকে ৮৩তম, এবং মেক্সিকো: মানব উন্নয়ন সূচকে ৭৪তম, যেখানে শ্রীলঙ্কা ৭২তম। সুতরাং বলা যায়, এই দেশ দুটিকে ওইসিডিতে সদস্যপদ দেওয়ার জন্য সংস্থাটির মূলনীতি স্পষ্টতই লঙ্ঘিত হয়েছে এবং শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় এদের যুক্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, মানুষের জীবনযাত্রার মানদণ্ড হিসেবে আইএইচডিআই (IHDI) দুনিয়াজুড়ে স্বীকৃত।
দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ কোরিয়া, ইসরায়েল ও চিলি কোন উপায়ে ওইসিডিতে প্রবেশের মানে উন্নীত হলো? এই দেশগুলো উন্নত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মার্শাল প্ল্যানের ‘অ-ইউরোপীয়’ সংস্করণের আওতায় দেওয়া অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং আর্থিক সহায়তা এই দেশগুলোর মূলশক্তি।
দক্ষিণ কোরিয়া: মার্কিন আগ্রাসনের বিরোধিতা করে উত্তর কোরিয়া সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যার পৃষ্ঠপোষক ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন। এর জের ধরে ১৯৪৫ সালে কোরিয়ান জাতিকে দ্বিখণ্ডিত করে কোরিয়া উপদ্বীপকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। কোরিয়া উপদ্বীপের দক্ষিণ অংশ দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর দখলে। ফলত, মার্শাল প্ল্যানের কৌশল অনুযায়ী নতুন এই রাষ্ট্রটিকে উন্নয়ন সমর্থন দেয়া হয়। যদি সমাজতান্ত্রিক উত্তর কোরিয়ার অস্তিত্ব না থাকত, যদি সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন অথবা চীনের অস্তিত্ব না থাকত, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন পড়ত না দক্ষিণ কোরিয়াকে পৃষ্ঠপোষকতা দেবার। এর অবস্থা হতো হাইতি অথবা যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করা লাতিন আমেরিকার অন্য দেশগুলোর মতো। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার অল্প কিছু পরিকল্পনা ও কর্মসূচি ছাড়া এ দেশের উন্নয়নের অধিকাংশই পুঁজিবাদের স্বাভাবিক নিয়মে হয়নি। এখন পর্যন্ত মার্কিন সৈন্যরা সে দেশে মজুত রয়েছে। শুরু থেকেই দক্ষিণ কোরিয়াকে শিশুর মতো আগলে রেখে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেখা গেছে,
‘দক্ষিণ কোরিয়ার বাজেটের অধিকাংশ অর্থের জোগান আসত ওয়াশিংটন থেকে। দেশটির বিশাল সামরিক বাহিনীর পুরো খরচটাই চালাত যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৪৬ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এখানে মোট ১২.৬ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা পাঠায় মার্কিনিরা। মাথাপিছু হিসাবে শুধু ইসরায়েল ও দক্ষিণ ভিয়েতনামই এর চেয়ে বেশি পেয়েছে। একই সময়ে আফ্রিকার সব কটি দেশ মিলে পায় ৬.৮৫ বিলিয়ন ডলার এবং লাতিন আমেরিকার সব কটি দেশ পায় ১৪.৮৯ বিলিয়ন ডলার।’ (জুং-এন উ, রেস টু দ্য সুইফট: স্টেট অ্যান্ড ফাইন্যান্স ইন দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন অব কোরিয়া, নিউইয়র্ক: কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯১, পৃ. ৪৫)
ইসরায়েল: এ দেশটি সম্পূর্ণভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট। নিজেদের আশ্রিত রাজ্যের (protectorate) মতো করে যুক্তরাষ্ট্র একে দেখেশুনে রাখে। এ দেশের উন্নয়ন কখনোই পুঁজিবাদী উন্নয়নের পথ ধরে হয়নি। (যুক্তরাষ্ট্র এযাবৎকাল সবচেয়ে বেশি অর্থসহায়তা দিয়েছে ইসরায়েলকে)।
চিলি: ১৯৭৩ সালে সিআইএ-র উসকানিতে সেনা বিদ্রোহের মাধ্যমে চিলির রাষ্ট্রপতি সালভেদর আলেন্দের নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সমাজতান্ত্রিক সরকারকে উচ্ছেদ করা হয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদরা বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে চিলিতে চালু করে নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এই সবকিছুই ছিল তাদের ‘অ-ইউরোপীয়’ মার্শাল প্ল্যানের অংশ। সঙ্গে যুক্ত হয় জেনারেল অগাস্তো পিনোচেটের ভয়ংকর স্বৈরশাসন। সুতরাং বলা যায়, চিলিও এমন কোনো রাষ্ট্র নয়, যা পুঁজিবাদের সাধারণ নিয়মে উন্নত হয়ে ওইসিডির সীমানায় পৌঁছতে পেরেছে।
সিঙ্গাপুর: সিঙ্গাপুর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৫ সালে। ওইসিডির সদস্যরাষ্ট্র না হলেও দেশটি উন্নত। মালাক্কা প্রণালিতে দেশটির অবস্থান কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে ইন্দো-চীনের বিস্তৃত অঞ্চলের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর (চীন, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া এবং বামপন্থি সরকার শাসিত ইন্দোনেশিয়া) খুব নিকটে অবস্থিত হওয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কমিউনিজমের বিস্তার রোধে একে উন্নত করায় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়াকে শক্তিশালী করা হয়েছে সমাজতান্ত্রিক উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য। মধ্যপ্রাচ্য এলাকায় ইসরায়েলকে শক্তিশালী করা হয়েছে যাতে ওই এলাকার অন্য দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেখানে সামরিক, রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়। চিলিকে শক্তিশালী করা হয়েছিল লাতিন আমেরিকায় একের পর এক শুরু হওয়া সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ঢেউকে থামানোর জন্য। সিঙ্গাপুরকে শক্তিশালী করা হয়েছে ইন্দো-চীনের বামপন্থি রাষ্ট্রগুলোর বিপরীতে এর কৌশলগত গুরুত্বের কারণে।
দক্ষিণ কোরিয়াকে শক্তিশালী করা হয়েছে সমাজতান্ত্রিক উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য। মধ্যপ্রাচ্য এলাকায় ইসরায়েলকে শক্তিশালী করা হয়েছে যাতে ওই এলাকার অন্য দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেখানে সামরিক, রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়। চিলিকে শক্তিশালী করা হয়েছিল লাতিন আমেরিকায় একের পর এক শুরু হওয়া সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ঢেউকে থামানোর জন্য। সিঙ্গাপুরকে শক্তিশালী করা হয়েছে ইন্দো-চীনের বামপন্থি রাষ্ট্রগুলোর বিপরীতে এর কৌশলগত গুরুত্বের কারণে।
এটুকু লেখার উদ্দেশ্য এটা বোঝানো যে, ওইসিডির নতুন সদস্যদের কেউই পুঁজিবাদের স্বাভাবিক নিয়মে উন্নত হয়নি। যদিও এখানে এই দেশগুলোর উন্নয়ন প্রক্রিয়ার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া সম্ভব হয়নি, তবে এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সবাই পুঁজিবাদী উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে সফলভাবে অনুসরণ করে সদস্যপদ লাভ করেছে, ব্যাপারটা এমন নয়। এই দেশগুলোকে উন্নত করা হয়েছে আশ্রিত দেশ হিসেবে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এবং এদের ব্যবহার করে এদের ও অন্যান্য রাষ্ট্রের ওপর ক্ষমতা, প্রতিপত্তি এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ বাড়ানোর জন্য।
সুতরাং, স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, ১৯৪৫ সাল থেকে কিংবা গত ১২০ বছরেও উপরোক্ত পাঁচটি দেশ ছাড়া আর কোনো রাষ্ট্রই সাধারণ পুঁজিবাদী উন্নয়নের নিয়মে বিবর্তিত হয়ে ওইসিডির সদস্যত্ব লাভ করতে সক্ষম হয়নি। এমনকি ১৯০০-এর দশকেই উন্নত বলে ধরা হয় যে দেশগুলোকে (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, জাপান এবং অন্যান্য), তাদের সব কটিই ছিল ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র। সুতরাং, এরাও পুঁজিবাদের ‘স্বাভাবিক’ নিয়মে উন্নত হয়নি।
এই দেশগুলোর বাইরে আর কোন কোন দেশ উচ্চ উপার্জনশীল এবং জীবনযাত্রার মানে এগিয়ে?
১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ ও কৌশলগত পদক্ষেপের মাধ্যমে উন্নত হয়েছে এমন দেশগুলো হলো: দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, চিলি ও ইসরায়েল। এদের যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রিত দেশ বলা যায়।
২. ওইসিডিতে যোগদান করার শর্ত পূরণ করে কিন্তু অতীতে সমাজতন্ত্রী ছিল এমন দেশ নয়টি। এগুলো হলো: রাশিয়া, চেক রিপাবলিক, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া ও স্লোভেনিয়া। এই দেশগুলো সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে উন্নত হয়েছে। বর্তমানে পুঁজিবাদী রাশিয়ায় পরিবর্তিত হওয়া সাবেক সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন উপার্জনশীলতা ও জীবনযাত্রার মানে এগিয়ে আছে। অর্থাৎ, দেশটি ওইসিডির সব শর্ত পূরণ করে। তবুও এই সংস্থায় তার জায়গা হয়নি। কারণ, বিশ্বব্যাপী প্রতিপত্তি বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে অন্যতম বাধা রাশিয়া।
১৯১৭ সালে ১৫টি প্রজাতন্ত্র একত্র হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হওয়ার সময় দেশগুলো ছিল অত্যন্ত গরিব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের ২৭ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়, ৭০ হাজার শহর ও গ্রাম মাটির সঙ্গে মিশে যায়। কিন্তু ১৯৪৫ সালের পর থেকে এরা ঘুরে দাঁড়ায় এবং একদম শূন্য থেকে উচ্চ আর্থসামাজিক জীবনমানে উন্নীত হতে সক্ষম হয়। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, গত ১২০ বছরের মধ্যে নতুন যে দেশগুলো ওইসিডির মানে উন্নীত হতে সক্ষম হয়েছে, তারা সমাজতান্ত্রিক উন্নয়ন মডেল অনুসরণ করেই সফলতা পেয়েছে। এ সময়কালে পুঁজিবাদী মডেল অনুসরণ করে কেউ উন্নত হয়নি।
মানব উন্নয়ন সূচক (এইচডিআই) ও পুঁজিবাদের অগ্রযাত্রা
জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রকল্পের (United Nations Development Programme (UNDP)) বিশেষ উপদেষ্টা থাকাকালীন খ্যাতিমান পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ মাহবুব উল হক ‘মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন’ ও ‘মানব উন্নয়ন সূচক’ সংক্রান্ত মূল পরিকল্পনাটি করেন। এই ধারণা অনুযায়ী উন্নয়নকে শুধু উপার্জন নয়, বরং পরিমাপ করা উচিত ‘ভালো থাকা’ দিয়ে। ১৯৯০ সালে চালু হওয়া উন্নয়ন পরিমাপের এই সূচকটি অন্যগুলোর চেয়ে অগ্রসর এবং এ প্রক্রিয়ায় বিস্তারিত ও গভীর বিশ্লেষণ আমলে নেওয়া হয়। ২০১০ সালের ‘মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন’ আমাদেরকে ‘অসমতা সংলগ্ন মানব উন্নয়ন সূচক’ (Inequality Adjusted Human Development Index–IHDI) ধারণার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। এর মানে হলো, উন্নয়ন পরিমাপের ক্ষেত্রে বৈষম্যকে বিবেচনা করা।
‘মানব উন্নয়ন সূচক’ (এইচডিআই) এমন একটি সূচক, যা মানব উন্নয়নের প্রধান কয়েকটি দিক পরিমাপের চেষ্টা করে। এর প্রধান তিনটি দিক হলো: • জন্ম থেকে সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল বা গড় আয়ু
- বিদ্যালয় গমনের বয়স থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য সময়কাল। এবং • শোভন জীবনমান, যা পরিমাপ করা হয় ‘স্থূল জাতীয় মাথাপিছু আয়’ (Gross National Income per capita) দ্বারা।
মানব উন্নয়ন সূচক (এইচডিআই) অনুযায়ী সব দেশকে উন্নয়নের মাত্রা অনুযায়ী কয়েকটি দলে ভাগ করা হয়।
এইচডিআই ০.৯০০–১.০০০ সর্বোচ্চ মানব উন্নয়ন হয়েছে এমন দেশ ২৭
এইচডিআই ০.৮–১.০০ অনেক বেশি মানব উন্নয়ন হয়েছে এমন দেশ ৬৬
এইচডিআই ০.৭৪৪–০.৭৯৯ বেশি মানব উন্নয়ন হয়েছে এমন দেশ ৫২
এইচডিআই ০.৫৫০–০.৬৯৯ মোটামুটি মানব উন্নয়ন হয়েছে এমন দেশ ৩৮
এইচডিআই ০.৩৫০–০.৫৪৯ কম মানব উন্নয়ন হয়েছে এমন দেশ ৩২
১৯০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মানব উন্নয়ন সূচকে এগিয়ে আছে যে ২৫টি দেশ, তাদের ২০টি-ই অতীতে ঔপনিবেশিক শাসক ছিল।
উন্নত বলে ধরা হয় যেসব দেশকে, অর্থাৎ ১৯০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মানব উন্নয়ন সূচকে এগিয়ে আছে যে ২৫টি দেশ, তাদের ২০টি-ই অতীতে ঔপনিবেশিক শাসক ছিল। সবচেয়ে উন্নত ২৫টি দেশের একটিও ১৯০০ সাল কিংবা ১৯৪৫ সাল, যাই ধরা হোক না কেন, এর পর উন্নত হয়নি। যদি আমরা উলটো দিক থেকে বিষয়টা দেখি, তাহলে কি এমন কোনো দেশ খুঁজে পাব, যারা সপ্তদশ, অষ্টাদশ, ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দী (পুঁজিবাদের যুগ) জুড়ে ঔপনিবেশিক শাসক ছিল, কিন্তু বর্তমানে ওইসিডির সদস্যদেশের আওতাভুক্ত নয়? পাব না। এর মানে মার্কস তার পুঁজি গ্রন্থে যে ‘আদিম সঞ্চয়নের’ (Primitive Accumulation) (ডাকাতি, লুটতরাজ অথবা জবরদখল করে ঔপনিবেশিক সম্পদ আহরণ করার প্রক্রিয়া) কথা বলেছিলেন, আজকের তথাকথিত ওইসিডিভুক্ত অধিকাংশ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছে সেই লুণ্ঠন। ২৫টি দেশের মধ্যে থাকা সিঙ্গাপুর, ইসরায়েল ও দক্ষিণ কোরিয়াকে ওই সময়কালে এমনই কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবেও বিবেচনা করা হতো না। এরা উন্নত হয়েছে তাদের কেন্দ্র করে থাকা বিশেষ পরিকল্পনার কারণে, যা আমরা আগে আলোচনা করেছি।
তাহলে কি এমন কোনো দেশ খুঁজে পাব, যারা সপ্তদশ, অষ্টাদশ, ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দী (পুঁজিবাদের যুগ) জুড়ে ঔপনিবেশিক শাসক ছিল, কিন্তু বর্তমানে ওইসিডির সদস্যদেশের আওতাভুক্ত নয়? পাব না।
সেই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, মাত্র ১৪ শতাংশ দেশ পুঁজিবাদের স্বাভাবিক নিয়ম অনুসরণ করে ওইসিডির সদস্য হতে পেরেছে বা এইচডিআই-এর মান অনুযায়ী মানব উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছে। মাত্র ৩৪ শতাংশ দেশ এইচডিআই সূচকে ০.৮-এর ওপর অবস্থান করছে। সুতরাং ৬৬ শতাংশ রাষ্ট্র, অর্থাৎ বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ রাষ্ট্র গত ১২০ বছরের মধ্যে কিংবা গত ৭৫ বছরের মধ্যে (যেভাবেই হিসাব করুন না কেন) মানব উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত স্তর নির্দেশ করে এইচডিআই-এর এমন মানে পৌঁছতে পারেনি।
বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ রাষ্ট্র গত ১২০ বছরের মধ্যে কিংবা গত ৭৫ বছরের মধ্যে (যেভাবেই হিসাব করুন না কেন) মানব উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত স্তর নির্দেশ করে এইচডিআই-এর এমন মানে পৌঁছতে পারেনি।
সুতরাং, অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ঔপনিবেশিক মোড়ল দেশগুলো, যারা ১৯০০ শতাব্দীর মধ্যেই পুঁজিবাদী উন্নয়নের একটা স্তরে উন্নীত হয়েছিল, তারা ছাড়া আর কেউই গত ১২০ বছরের মধ্যে উন্নয়নের উচ্চস্তরে উপনীত হতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোই একমাত্র ব্যতিক্রম। যে উন্নয়ন গত ১২০ বছরেও হয়নি, বর্তমান এই ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদের আমলে সেই উন্নয়ন আর কখনো হবে বলে আশা করা যায় না। অথচ একই সময়ে সমাজতান্ত্রিক মডেল অনুসরণ করে নয়টির বেশি দেশ ওইসিডির মানে উন্নীত হতে পেরেছে।
বিমল রত্নায়েক: শ্রীলঙ্কার রাজনীতিবিদ, লেখক। ইমেইল: bimalsl@yahoo.com