মুখস্থবিদ্যা বনাম নৈতিক মানবিক জ্ঞানচর্চা

মুখস্থবিদ্যা বনাম নৈতিক মানবিক জ্ঞানচর্চা

আলমগীর খান

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভীষণ রকমের মুখস্থনির্ভর। পুরো শিক্ষাব্যবস্থা সাজানো হয়েছে বিদ্যাগেলানোর উপযোগী করে, যার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তোতাকাহিনী’র চমৎকার মিল রয়েছে। থাকারই কথা। কারণ, যে ব্রিটিশ-ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করে রবীন্দ্রনাথ ওই ছোটগল্পটি লিখেছিলেন, তার অব্যাহত ধারায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা চলমান। যদিও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মানচিত্রে অনেক বাহ্যিক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন ইত্যাদিসহ রাষ্ট্রিক-সামাজিক প্রায় সব বিষয়ই আগের মতোই বহাল আছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করার উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে: ‘মুখস্থ বিদ্যা নয়; বরং শিক্ষার্থী বিষয়বস্তুকে কতটুকু আত্মস্থ করতে পেরেছে’ তা মূল্যায়ন।

মুখস্থবিদ্যার প্রেক্ষাপট

কিন্তু ‘সৃজনশীল’ পদ্ধতি ছাত্রছাত্রীকে আরও মুখস্থের প্রতিযোগিতায় নিক্ষেপ করেছে। পরীক্ষার প্রশ্নোত্তর মুখস্থের সহায়ক হিসেবে বাজার সয়লাব হয়ে আছে কোচিং সেন্টার, নোট ও গাইড বইয়ে। সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করবে না তো কি, প্রশ্নগুলোই তো মুখস্থবিদ্যা পারদর্শীদের মানসিক কসরতের ফল। শুধু প্রশ্নের ধরন পালটেই মুখস্থের অভ্যাস পরিবর্তন করা যাবে না। পুরো শিক্ষাকাঠামো ও চাকরির সুযোগ মুখস্থশক্তির ওপর নির্ভর করছে। বিষয়বস্তুকে আত্মস্থ করা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা অর্জন, উদ্ভাবন ইত্যাদি শিক্ষার্থীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, কেবল স্মৃতিতে রেকর্ডকৃত জিনিস উগরে দেওয়ার ক্ষমতাই তাকে মেধাবী প্রমাণ করতে যথেষ্ট। তাই কেউ এসব মস্তিষ্কে রেকর্ড করে পরীক্ষার হলে নিয়ে যায়, আর কেউ তা গোপনে চিরকুটে রেকর্ড করে নিয়ে যায়।

কিন্তু ‘সৃজনশীল’ পদ্ধতি ছাত্রছাত্রীকে আরও মুখস্থের প্রতিযোগিতায় নিক্ষেপ করেছে। পরীক্ষার প্রশ্নোত্তর মুখস্থের সহায়ক হিসেবে বাজার সয়লাব হয়ে আছে কোচিং সেন্টার, নোট ও গাইড বইয়ে।

দুয়ের মাঝে আদতে তেমন কোনো পার্থক্য না থাকলেও খেলার খামখেয়ালি নিয়ম অনুযায়ী দ্বিতীয় প্রক্রিয়া অবলম্বনকে নিয়মভঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর প্রচলিত সমাজের চিরন্তন নীতি অনুযায়ী নিয়মভঙ্গ তখনই অন্যায়, যখন নিয়ম ভঙ্গকারী নিয়ম রক্ষাকারীর হাতে ধরা পড়ে বা নিয়ম রক্ষাকারী তাকে ধরতে ইচ্ছে পোষণ করেন। প্রচলিত লোককথায় এ সত্যের প্রকাশ ঘটেছে এভাবে: ‘চুরিবিদ্যা বড় বিদ্যা যদি-না পড়ে ধরা।’ এ কথা শুনে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। মার্কসের অঙ্ক কষে বের করার আগে এবং কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো ও ডাস ক্যাপিটালে লিখে ফাঁস করার আগে কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে পুঁজিপতিরা তাদের শ্রমিকের শ্রম চুরি ও ডাকাতি করে টাকার পাহাড় বানিয়ে থাকে। মার্কস ও এঙ্গেলসের কাছে তারা প্রথমবারের মতো ধরা পড়ে যায়। ক্যাপিটাল বইটি লিখে তাই মার্কস বিশ্বাস করতেন তার এ বই বুর্জোয়াদের এমন আঘাত করেছে, যার ক্ষত থেকে তারা কোনোদিনই সেরে উঠতে পারবে না। তবে আমাদের সমাজে নিয়ম রক্ষাকারীরা নিয়ম ভঙ্গকারীদের প্রেমে এমন হাবুডুবু খায় যে কেবল কিছু বোকা প্রেমহীনই ধরা পড়ার মতো দুঃখের শিকার হয়। এই কাঠামোর ভেতরে প্রশ্নফাঁসও তাই বহাল তবিয়তে আছে।

মুখস্থবিদ্যাকে ডাহা চুরি বলে আখ্যায়িত করেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘শিক্ষার বাহন’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন:

‘মুখস্থ করিয়া পাস করাই তো চৌর্যবৃত্তি। যে ছেলে পরীক্ষাশালায় গোপনে বই লইয়া যায় তাকে খেদাইয়া দেওয়া হয়; আর যে ছেলে তার চেয়েও লুকাইয়া লয়, অর্থাৎ চাদরের মধ্যে না লইয়া মগজের মধ্যে লইয়া যায় সেই বা কম কী করিল? সভ্যতার নিয়ম অনুসারে মানুষের স্মরণশক্তির মহলটা ছাপাখানায় অধিকার করিয়াছে। অতএব যারা বই মুখস্থ করিয়া পাস করে তারা অসভ্যরকমে চুরি করে অথচ সভ্যতার যুগে পুরস্কার পাইবে তারাই?’

তবু মুখস্থবিদ্যা এখানে কেন এত চর্চিত? ব্রিটিশ শাসিত ঔপনিবেশিক রাজ্যে শাসন-শোষণের কার্যালয়গুলোতে কম্পিউটার প্রয়োজন হতো। এ আবার কেমন কথা! সে আমলে যখন কম্পিউটারের নামই কেউ শোনেনি, তখন তাদের কম্পিউটারের প্রয়োজন হবে কী করে? যে কারণে এখন প্রয়োজন, সে কারণেই তখনো প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কম্পিউটার তখনো আবিষ্কার না হওয়ায় ঔপনিবেশিক দেশের মানুষ দিয়েই সে কাজ সারতে হতো। অর্থাৎ, ওইসব কর্মচারীর মাথায় অনেক কিছু রাখতে হতো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য। বিষয়বস্তুকে আত্মস্থ করা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা, উদ্ভাবন ইত্যাদি তাদের ক্ষেত্রে কেবল গুরুত্বপূর্ণ ছিল না তা-ই নয়, কর্মচারীদের এসব গুণাবলি সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের জন্য বিপজ্জনকও ছিল।

তাই এই শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এত কদর (দর/দাম) ছিল তাদের কাছে, যেমন শুরুতে আমাদের দেশে কম্পিউটারের দাম ছিল, এখন যা কমছে। একইভাবে কমছে সমাজে তথাকথিত শিক্ষিত ভদ্রলোকদের দামও। তাই আজকাল চাকরির ক্ষেত্রে সার্টিফিকেট হাতে মানুষের এত প্রাণান্তকর যুদ্ধ। বহু মুখস্থবিদ্যায় শিক্ষিত ভদ্রলোকের দাম বাজারে আরও কমবে। কারণ, কম্পিউটার এসে গেছে, প্রতিযোগিতা এখন অটোমেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। ধীরে ধীরে অফিসে শিক্ষিত ভদ্রলোকদের একমাত্র কাজ হবে ভালো করে কম্পিউটার চালানো। তাই তাদের হতে হবে ‘কম্পিউটার-লিটারেট’। অশ্বশক্তির ইঞ্জিন যেমন অশ্ব অর্থাৎ ঘোড়াকে প্রতিস্থাপন করেছে, তেমনিভাবে প্রতিস্থাপিত হয়ে যাবেন মুখস্থের ঘোড়ারা–অপ্রয়োজনীয় বলে।

মুখস্থশক্তির প্রয়োজনীয়তা-অপ্রয়োজনীয়তা

তাই বলে মানবেতিহাসে মুখস্থশক্তির কোনো অবদান নেই–এ কথা ভাবা যাবে না। কাগজ আবিষ্কারের আগে মানুষ পূর্বপুরুষের সব জ্ঞানকে প্রজন্মপরম্পরায় বহন করেছে তার স্মৃতিতে, যার ফলে তার জ্ঞানের সমৃদ্ধি ঘটেছে ও এটি তাকে অন্য প্রাণী থেকে পৃথক করে দিয়েছে। স্মৃতিশক্তির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। প্রাচীনকালে মহাকাব্য, চিকিৎসাশাস্ত্রসহ সব জ্ঞান মানুষ মুখস্থ করে রাখত বলেই সেগুলো এখনো টিকে আছে। এর প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য ছিল বলেই স্মৃতিতে ধরে রাখার বিভিন্ন অভিনব কৌশল আবিষ্কার হয়েছিল। কাগজ প্রথম মানুষকে স্মৃতি বহনের ভার থেকে মুক্তি দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথও তা-ই বলেছেন।

কাগজ আবিষ্কারের আগে মানুষ পূর্বপুরুষের সব জ্ঞানকে প্রজন্মপরম্পরায় বহন করেছে তার স্মৃতিতে, যার ফলে তার জ্ঞানের সমৃদ্ধি ঘটেছে ও এটি তাকে অন্য প্রাণী থেকে পৃথক করে দিয়েছে। স্মৃতিশক্তির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। প্রাচীনকালে মহাকাব্য, চিকিৎসাশাস্ত্রসহ সব জ্ঞান মানুষ মুখস্থ করে রাখত বলেই সেগুলো এখনো টিকে আছে।

স্মৃতি রক্ষায় পাথর, গাছের ছাল ইত্যাদির চেয়ে কাগজের ভূমিকা বৈপ্লবিক। আরও বৈপ্লবিক কম্পিউটার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবিষ্কার, যা মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় বিষয় ও সুখ-দুঃখের ঘটনাসমূহ মনে রাখার দায়িত্ব গ্রহণ করছে। এ হচ্ছে মানুষের মস্তিষ্কের স্মৃতিভান্ডারের সম্প্রসারণ। প্রাচীনকালে স্মৃতিতে রাখার উপযোগী জ্ঞানভান্ডারও কম ছিল, তাই সেসব পুরোটা মুখস্থ রাখা কারো কারো পক্ষে সম্ভব ছিল। এখন পৃথিবীতে প্রয়োজনীয় জ্ঞানভান্ডার ও বই-পুস্তক এত বিশাল যে, মস্তিষ্কের বাইরে তার একটি সংরক্ষণাগার প্রয়োজন, যা আবার জ্ঞানভান্ডারকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ করতে সহায়তা করছে। ছাপাখানা আবিষ্কার মানুষের স্মৃতিকে প্রথম সফলভাবে মস্তিষ্কের বাইরে সংরক্ষণের সুযোগ করে দিয়েছিল। তাই বলে তার ফলে স্মৃতিতে রাখার কৌশলগুলো ফেলনা হয়ে যায়নি।

কেননা, এসব আবিষ্কার অর্থাৎ যন্ত্রের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা কিছু বিপদের বার্তাও দিচ্ছে, সতর্ক না হলে যা ক্ষতিকরও হয়ে উঠতে পারে। স্মৃতিশক্তি মানুষের একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। কোনো কিছু পাঠ করে যদি কিছুই মনে না থাকে, তবে তা পড়ে লাভ কী? তা ছাড়া কিছু বিষয় মুখস্থ না করলে তা আত্মস্থ হয় না। তাই যা আত্মস্থ করা প্রয়োজন, তা কিছু মুখস্থ করাও আবশ্যক। কিন্তু আমাদের পরীক্ষা পাসের জন্য যেসব তথ্য মুখস্থ করা হয়, তা অপ্রয়োজনীয়। মুখস্থ করা সব তথ্যের মাঝে সম্পর্ক না বুঝলে তা মাথায় রাখা আর কম্পিউটারের মেমরি চিপসে থাকা একই কথা। তথ্যের বিশাল ভান্ডার হয়ে কম্পিউটারের যেমন আত্মোন্নতি হয় না, তেমনি উন্নতি হয় না মুখস্থকারীর। কিন্তু নজরুল-রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা শেক্সপিয়রের নাটক কিছু তো মুখস্থ রাখতেই হয়। শিল্পসাহিত্যের স্বাদ গ্রহণ না করেই কোনো চাকরির গাইড বই থেকে সেসব সম্পর্কে খুঁটিনাটি মুখস্থ করে ভালো চাকরি বাগিয়ে নেওয়া চরম প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। তারপর চাকরিদাতারাও যদি তা-ই চান, তবে প্রার্থীরা আর কী করবে?

কিন্তু জ্ঞান ও তথ্যকে স্মৃতিতে রাখার বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কৌশল আছে, যার চর্চা হতেই পারে। এ নিয়ে অনেক বই-পুস্তক লেখা হয়েছে। আমেরিকা-ইংল্যান্ডে মেমরি চ্যাম্পিয়নশিপ আছে, যা নিয়ে Joshua Foer-এর বইটি লেখা। স্মৃতিশক্তির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও বিজয়ী হওয়া আনন্দের বইকি! কিন্তু সেই খেলা আর জ্ঞানার্জন তো এক নয়।

প্রকৃত শিক্ষা

আমাদের পরীক্ষা মূলত মুখস্থশক্তির ক্ষমতা পরিমাপের জন্য। জ্ঞানার্জনের কৌতূহল তাতে উৎসাহ পায় না। যে শিক্ষার্থী ডারউইনের বিবর্তনবাদ মুখস্থ করছে, হয়তো দেখা যাবে সে তা বিশ্বাসই করে না। হয়তো সে শিক্ষার্থীই একদিন শিক্ষক হয়ে আবার ছাত্রছাত্রীকে বিবর্তনবাদ পড়াচ্ছে। তার মাথায় বিবর্তনবাদ আছে পেনড্রাইভে বা সিডিতে থাকার মতো, যা পড়ে ও পড়িয়ে তার আত্মার কোনো বিবর্তনই হয়নি, কিন্তু তার জীবিকার উপায় হয়েছে। মুখস্থবিদ্যার বদৌলতে আমাদের দেশে সার্টিফিকেটধারী মূর্খের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে, যারা কেবল মূর্খই নয়, ভয়ংকরও। রাষ্ট্র ও সমাজের একেকটা ক্ষেত্র যেমন: শিক্ষা, চিকিৎসা, আইন, আমলাতন্ত্র ইত্যাদি তাদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়, তার ফল আমরা এখন যা দেখছি, তার চেয়ে ভালো হওয়ার কোনো কারণ নেই।

নোবেল বিজয়ী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো তাদের ‘পুওর ইকোনমিকস’ বইয়ে ভারতের রমন বোর্ডস কোম্পানির একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা করেন। বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারে ব্যবহৃত কার্ডবোর্ড তৈরির এ কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা তামিল প্রকৌশলী ভি. রমন একদিন দেখেন রঙ্গস্বামী নামে এক তরুণ তার কারখানার সামনে দরজার বাইরে অপেক্ষা করছে, একটি চাকরি চায়। দরিদ্র ঘরের এ তরুণটির সামান্য ইঞ্জিনিয়ারিং প্রশিক্ষণ ছিল, কোনো উল্লেখযোগ্য ডিগ্রি নেই। কিন্তু ভি. রমন তার সঙ্গে কথা বলে তার মেধার ব্যাপারে আশ্বস্ত হন এবং তাকে চাকরি দেন। সুইডিশ বহুজাতিক কোম্পানি ABB পরবর্তী সময়ে কোম্পানিটি কিনে নেয়। রঙ্গস্বামী এই কোম্পানির প্রধান প্রকৌশলী। তার বন্ধু কৃষ্ণচারি, যার তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা নেই, সে এখানকার একজন ব্যবস্থাপক। ভি. রমনের ছেলে অরুণ বর্তমানে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন, যেখানে মূল চারজনের দলে দুজনই উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ালেখা সম্পন্ন করতে পারেননি। রমন ও অরুণরা সার্টিফিকেট নয়, সাহস ভরে মানুষের প্রকৃত মেধাকে মূল্যায়ন করেছেন, তাই এমন উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে।

অথচ আমাদের দেশে সার্টিফিকেটের ও বিভিন্ন কাগজপত্রের কদর যে কী ভয়ংকর, তা বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ বলা হচ্ছে:

‘চার বছরের সম্মান স্নাতক ডিগ্রিকে সমাপনী ডিগ্রি হিসেবে এবং উচ্চশিক্ষায় শিক্ষকতা ব্যতীত অন্য সব কর্মক্ষেত্রে যোগদানের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হবে।’ আবার ‘মাস্টার্স, এমফিল বা পিএইচডি-কে বিশেষায়িত শিক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং শুধু গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষকতা করতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করতে হবে।’

জাতীয় শিক্ষানীতি অনেক দিক থেকে ত্রুটিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এর মধ্যে যেটুকু ভালো আছে তারও কোনো প্রয়োগ নেই। শিক্ষানীতিতে যাই বলা থাকুক না কেন, এ দেশে টয়লেট পেপার তৈরির কারখানায়ও কেরানি নিয়োগের জন্য মালিকপক্ষ মাস্টার্স ডিগ্রিওয়ালা চাকরিপ্রার্থী চেয়ে বসেন। পিয়নের পদের জন্যও মাস্টার্সওয়ালাদের আবেদনের বন্যা বয়ে যায় দেশে। প্রায় সব বেসরকারি সংস্থা গবেষণা ও শিক্ষকতার কাজ ছাড়াও এই যে মাস্টার্স ডিগ্রি চেয়ে বসে থাকে, যে কারণে শিক্ষানীতিতে সমাপনী ডিগ্রি বলে বিবেচিত স্নাতক ডিগ্রিওয়ালারা বহু ক্ষেত্রে আবেদনই করতে পারে না–এ ব্যাপারে সরকারের দিক থেকে কোনো মাথাব্যথা নেই। কোম্পানির মালিকরা মেধা চায় না, সার্টিফিকেট চায় (চিবিয়ে খাওয়ার জন্য হয়তো)। অতএব মুখস্থবিদ্যার জয় কে রোখে?

নৈতিক মানবিক জ্ঞানচর্চা

এর ফল হচ্ছে নৈতিক মানবিক জ্ঞানচর্চার অকালমৃত্যু। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার আরেকটি বড় ত্রুটি হচ্ছে, এখানে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর মতো কেবল আইকিউর (ইন্টেলিজেন্স কোশেন্ট) চর্চা হয়, ইকিউর নয় (ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স)। রোবটিক বুদ্ধিমত্তারই একমাত্র মূল্যায়ন হয়, আবেগিক বুদ্ধিমত্তার নয়। ফলে শিক্ষার্থীর সততা, ন্যায়বোধ, দেশপ্রেম, সমাজবোধ, কল্যাণচিন্তা, মানবিকতা সবকিছুই চরম অবহেলিত হয়। জাতীয় পর্যায়ের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয়ে একজন শিক্ষার্থী তিন ঘণ্টায় খাতায় যা উগরে দেয়, তা-ই তাকে মূল্যায়নের একমাত্র মাপকাঠি। যিনি এ মূল্যায়ন করছেন, তিনি তার সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাও রাখেন না, চোখে দেখা দূরে থাক। আপাতনিরপেক্ষ এই মূল্যায়নটিতে মূল্যায়নকারীর মানসিক অবস্থারও প্রতিফলন ঘটে। পরীক্ষার্থীর আবেগিক বুদ্ধিমত্তার কোনো পাত্তাই নেই। আর এরূপ অবৈজ্ঞানিক মূল্যায়নের ফলে ঘোষিত ফলই ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতার নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। পুরো প্রক্রিয়াটিই চলমান অন্যায্য আর্থসামাজিক কাঠামোটিকে অক্ষুণ্ন রাখার মোক্ষম উপায়, তাই তা অব্যাহতও থাকে।

নৈতিক মানবিক জ্ঞানচর্চা মুখস্থবিদ্যা চর্চার মতো সহজ, নিরাপদ ও লাভজনক নয়। প্রকৃত জ্ঞানচর্চায় বিপদকে মোকাবিলা করতে হয়। কারণ, তা প্রশ্ন করে ও সত্যের সন্ধান করে। বিজ্ঞানি কার্ল সাগানের ভাষায়: ‘যখনই আমরা কৌতূহল নিবৃত্ত করতে শুরু করেছি, অনুসন্ধান ও জানতে শুরু করেছি মহাবিশ্ব কী, আমরা বিতাড়িত হয়েছি ইডেনের বাগান থেকে।’১০

বাংলায় নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার একটি উক্তি দিয়েই লেখাটি শেষ করব। বহু আগে সাগানের মতোই তিনিও বলেছেন: ‘… শাস্ত্রে (Genesis-এ) দেখা যায়, আদিমাতা হাভা (Eve) জ্ঞানবৃক্ষের ফলভক্ষণ করিয়াছিলেন বলিয়া তিনি এবং আদম উভয়েই স্বর্গচ্যুত হইয়াছেন।’ এরপর তিনি লিখেছেন: “ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা (faculty) দিয়াছেন, সেই ক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি (develop) করাই শিক্ষা। ঐ গুণের সদ্ব্যবহার করা কর্ত্তব্য এবং অপব্যবহার করা দোষ। ঈশ্বর আমাদিগকে হস্ত, পদ, চক্ষু, কর্ণ এবং চিন্তাশক্তি দিয়াছেন। যদি আমরা অনুশীলন দ্বারা হস্তপদ সবল করি, হস্ত দ্বারা সৎকার্য্য করি, চক্ষু দ্বারা মনোযোগসহকারে দর্শন (বা observe) করি, কর্ণ দ্বারা মনোযোগপূর্ব্বক শ্রবণ করি, এবং চিন্তাশক্তি দ্বারা আরও সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করিতে শিখি–তাহাই প্রকৃত শিক্ষা। আমরা কেবল ‘পাশ করা বিদ্যা’কে প্রকৃত শিক্ষা বলি না।”১১

আলমগীর খান: সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি | ই-মেইল: alamgirhkhan@gmail.com

তথ্যসূত্র

১. রবীন্দ্র শিক্ষাভাবনা সমগ্র, সংগ্রহ ও সম্পাদনা: শোয়াইব জিবরান, সংবেদ, ২০১২, ঢাকা

২. https://moedu.gov.bd/site/page/318a22d2-b400-48a7-8222-303ab11cc205/National-Education-Policy-2010- (PDF, পৃ. ৫০)

৩. Mark Skousen, The Big Three in Economics: Adam Smith, Karl Marx and John Maynard Keynes, M.E. Sharpe, পৃ. ৮০, নিউইয়র্ক, ২০০৭

৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিক্ষা, পৃ. ১৩১, প্যাপিরাস, ঢাকা, ২০১২

৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পূর্বোক্ত

৬. Joshua Foer, Moonwalking with Einstein: The Art and Science of Remembering Everything, পৃ. ১১২, পেঙ্গুইন, নিউইয়র্ক, ২০১১

৭. অভিজিৎ ভি ব্যানার্জি ও এস্থার দুফলো, Poor Economics: A Radical Rethinking of the Way to Fight Global Poverty, পৃ. ৯৩, PublicAffairs, নিউইয়র্ক, ইউএসএ, ২০১১

৮. জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, পৃ. ২৩, পূর্বোক্ত

৯. Daniel Goleman, Emotional Intelligence, Bloomsbury Publishing, লন্ডন, ২০২০

১০. Carl Sagan, Pale Blue Dot, Ballantine Books, নিউইয়র্ক, ১৯৯৪

১১. রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, স্ত্রীজাতির অবনতি, রোকেয়া রচনাবলি, পৃ. ৩৬, উত্তরণ, ঢাকা, ২০২০

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •