একটি শিল্প এলাকায় শ্রমজীবী পরিবার ও শিশুস্বাস্থ্য

কয়েকজনের অভিজ্ঞতায় বহুজনের জীবন

একটি শিল্প এলাকায় শ্রমজীবী পরিবার ও শিশুস্বাস্থ্য

বনানী চক্রবর্তী

একটি দেশে সর্বজনের চিকিৎসা ব্যবস্থা যদি কার্যকর না থাকে, যদি কর্মস্থল মা-বান্ধব না হয়, যদি শিশু যত্ন কেন্দ্রের মতো প্রাথমিক সুবিধাগুলোও না থাকে, যদি দেশে বাল্যবিবাহ অব্যাহত থাকার সামাজিক শর্ত অব্যাহত থাকে, যদি মজুরি মাত্রা দারিদ্রসীমা থেকেও অনেক কম থাকে, দুজন কাজ করেও যদি নিম্নতম নিরাপত্তা না পাওয়া যায়, অসুখ তৈরির উৎস যদি থাকে চারদিকে, নিরাপদ খাদ্যের বদলে যদি দূষিত খাবার-পানীয়ের রমরমা বাণিজ্য থাকে তাহলে কী পরিস্থিতি তৈরি হয় তারই একটি খন্ড চিত্র এই লেখা। একজন সংবেদনশীল চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ।  

শিল্পকারখানাকে ঘিরে ক্রমে শহর হয়ে উঠতে থাকা এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শিশু-রোগের চিকিৎসক হিসেবে কাজ করার সুবাদে প্রতিদিন কিছু শিশুর পরিবারের সঙ্গে কথার আদান-প্রদানের সুযোগ হয়। সেই ফাঁকে শিশুদের এই গল্পগুলোর সঙ্গে একটু একটু করে পরিচয়। চিকিৎসা করতে গিয়ে রোগের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে সম্পর্কিত ইতিহাস জানা আর শিশুকে পরীক্ষা করা, ব্যবস্থাপত্র লেখা—এই অল্প সময়ে কথা প্রসঙ্গে চলে আসা বিন্দু পরিমাণের গল্পগুলো মাত্র অল্প ক’জন শিশুর।

প্রতিটা গল্প আরও চলতে চায়, আরও স্পষ্ট হওয়ার দাবি রাখে, কিন্তু বক্তা বা শ্রোতা কারো হাতে সেভাবে সময় নেই। চিকিৎসা নেওয়া-দেওয়া সবকিছু ছকে বাঁধা, সময়ে বাঁধা। হাসপাতালে চিকিৎসক আর রোগীর যে অনুপাত, তাতে দীর্ঘসময় কথা বলা কঠিন। রোগীর মা-বাবার হাতেও সময় বাঁধা। রোগী, চিকিৎসক সবাই এই চক্রে ঘুরছে। তাই একসময় নজরে এলো, একই গল্প ঘুরেফিরে আসছে। কখনো অনেক শিশু একই গল্প নিয়ে আসছে। কখনো মনে হয় একজনই ফিরে ফিরে আসছে। গল্পের সঙ্গে গল্প মিলেমিশে একাকার। কোথায় শুরু কোথায় শেষ, নাকি এক কাহিনি থেকে আরেক কাহিনির জন্ম। আবার এদের মধ্যে একটা যোগসূত্রও লক্ষ করা যায়। রোগের কারণ, ধরন খুঁজতে গিয়ে চিকিৎসা বা চিকিৎসক সম্পর্কে অভিভাবকদের ধারণা, খাদ্যপুষ্টি বিষয়ে জ্ঞান এবং পুষ্টি, চিকিৎসা এই মৌলিক বিষয়গুলোর অনিশ্চয়তার দিকগুলো ধীরে ধীরে সামনে আসতে থাকে আর একসময় রোগকে ছাপিয়ে এর অন্যান্য সম্পর্কিত ইতিহাসই প্রকট হয়ে ওঠে। তার সঙ্গে যোগ হয় অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা। আর সেখান থেকে তৈরি হওয়া দৈনন্দিন অস্থিরতা। শিশুদের অসুস্থতা আর পরিবারের পক্ষ থেকে তার ব্যবস্থাপনায় এই অস্থিরতার ছবি অনেকটা স্পষ্ট। জটিল জালে আটকে পড়া রোগকে আলাদা করে দেখার সুযোগ কমে যায়। এই জালকে ঠিকমতো আবিষ্কার, তার সূত্র ধরা এবং চিন্তার আদান-প্রদানের জন্য এই প্রসঙ্গের অবতারণা।

রোগের কারণ, ধরন খুঁজতে গিয়ে চিকিৎসা বা চিকিৎসক সম্পর্কে অভিভাবকদের ধারণা, খাদ্যপুষ্টি বিষয়ে জ্ঞান এবং পুষ্টি, চিকিৎসা এই মৌলিক বিষয়গুলোর অনিশ্চয়তার দিকগুলো ধীরে ধীরে সামনে আসতে থাকে আর একসময় রোগকে ছাপিয়ে এর অন্যান্য সম্পর্কিত ইতিহাসই প্রকট হয়ে ওঠে। তার সঙ্গে যোগ হয় অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা। আর সেখান থেকে তৈরি হওয়া দৈনন্দিন অস্থিরতা।

কেস-১: নয় মাসের ফারজানা

ফারজানার বয়স নয় মাস। পাঁচ দিন ধরে তার ডায়রিয়া। জ্বর, পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া, পেটে ব্যথা এসব উপসর্গ নেই। চাকরি থেকে দুই ঘণ্টা ছুটি নিয়ে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন মা। ছুটি পাওয়া খুব কঠিন। অসুস্থ বাচ্চা অন্যের কাছে রেখে যেতে হয়। খুব টেনশনে থাকেন। শুরুতে ভেবেছিলেন অল্পতে সেরে যাবে, কিন্তু পাঁচ দিন হয়ে যাওয়ায় ভয় পেয়েছেন। কাজেই মা ভালো ওষুধ চান, যাতে এক দিনে অসুখ ভালো হয়ে যায়। পরীক্ষার প্রয়োজন হলেও তিনি রাজি। ফার্মেসির ‘ডাক্তার’-এর চিকিৎসা নিয়েছেন। ওষুধের কোনো প্রেসক্রিপশন দেননি ডাক্তার, নামও বলতে পারলেন না। কিন্তু ব্যাগে ওষুধের বাক্স পাওয়া গেল। দেখা গেল গত পাঁচ দিনে দুই ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হয়েছে। আজিথ্রো মাইসিন আর মেট্রোনিডাজল। প্রথম ওষুধে না কমায় দুদিনের মাথায় আবার ওষুধ এনেছেন। ভিজিট কত দিতে হয়েছে জানতে চাইলে জানা গেল এই ডাক্তার ভিজিট রাখেন না!

শিশুটি মোটামুটি হাসিখুশি। পানিশূন্যতার লক্ষণ নেই। মৃদু রক্তস্বল্পতা পাওয়া যাচ্ছে। শিশুর খাবারের ইতিহাস শুনতে গিয়ে জানা গেল তিন মাস বয়স থেকে সে কৌটার দুধ খায়। রাতে মা অফিস থেকে ফিরলে অল্প পরিমাণে বুকের দুধ পায়। মা জানেন যে দু-বছর পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়াতে হয়, কিন্তু চাকরির কারণে পারেননি। একজন প্রতিবেশী ভদ্রমহিলা তাকে দিনের বেলা লালন-পালন করেন ৩ হাজার ৫০০ টাকার বিনিময়ে। তার আবার তিন বছর বয়সি একটি শিশু আছে। তাই তিনিও পারিবারিক খাবার খাওয়ানোর বিষয়ে খুব একটা সময় দিতে পারেন না। মা রাতে ফিরে কখনো একটু ডাল-ভাত খাওয়ানোর চেষ্টা করেন।

মাকে বুঝিয়ে বলা হলো যে, এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ। ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। কোনো ওষুধ দিয়ে পায়খানা বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। পানিশূন্যতা প্রতিরোধের পদ্ধতি ও খাবার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হলো। সাত দিনের মাথায় না কমলে পরীক্ষা করানোর জন্য ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হলো। জরুরি লক্ষণগুলো জানানো হলো। মা খুব একটা সন্তুষ্ট হলেন বলে মনে হলো না। এই পরামর্শমতো চলতে গেলে শিশুকে সার্বক্ষণিক সময় দিতে হবে, যা এ মায়ের পক্ষে সম্ভব নয়। কথায় কথায় জানা গেল বাবা-মা দুজনেই গার্মেন্টস অপারেটর। দুজনের ইনকামে চলে মোটামুটি। রংপুর বাড়ি। মেয়ে বড় হলে টাকা-পয়সা লাগবে। সন্তোষজনক জমা হলেই তারা বাড়ি ফিরে যাবেন। মেয়ের যত্ন করবেন।

জরুরি লক্ষণগুলো জানানো হলো। মা খুব একটা সন্তুষ্ট হলেন বলে মনে হলো না। এই পরামর্শমতো চলতে গেলে শিশুকে সার্বক্ষণিক সময় দিতে হবে, যা এ মায়ের পক্ষে সম্ভব নয়। কথায় কথায় জানা গেল বাবা-মা দুজনেই গার্মেন্টস অপারেটর।

 কেস-২: সাত বছরের শাহাদাত

শাহাদাতের বয়স সাত বছর। খাওয়ার রুচি নেই, কোষ্ঠকাঠিন্য আর পেটে ব্যথা। বাবা-মা দুজনেই গার্মেন্টস অপারেটর। কয়েকজন ডাক্তার দেখানো হয়েছে, অনেক ওষুধ খাইয়েছেন, কেউ ভালো করতে পারেনি। তাই এখানে ভালো চিকিৎসা হয় শুনে এসেছেন। বাবার দাবি, যেন ভালো রুচির ওষুধ লিখে দেওয়া হয়, যাতে তার ছেলে ভালোমতো খায়।

শাহাদাত খুব সপ্রতিভ একটি শিশু। জানা গেল সে মাদ্রাসায় পড়ে। সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানেই থাকে। মায়ের অফিস শেষে বাসায় ফেরে। ১০০০ টাকা মাসিক দিতে হয়। বাবা বেশ গর্ব করেই বললেন, তার ছেলে ‘মজা’ খেতে ওস্তাদ। সমস্যা শুধু বাসার খাবার খেতে। প্রতিদিন ৪০-৫০ টাকার ‘মজা’ খায়। রোগীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এতদিনে জানা হয়েছে যে, ‘মজা’ হলো রঙিন প্যাকেটে ঝুলতে থাকা অপুষ্টিকর খাদ্যদ্রব্য।

জন্মের পর থেকে তিন-চার বছর বয়স পর্যন্ত তার মোটামুটি কোনো অসুবিধা ছিল না। ঢাকায় আসার পর থেকে অসুবিধার শুরু। শারীরিক পরীক্ষা করে মাঝারি রক্তস্বল্পতা ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না। রক্ত আর প্রস্রাবের প্রাথমিক পরীক্ষা দেওয়া হলো। পুরো সমস্যাটা খাদ্যাভ্যাস থেকে তৈরি মনে হওয়ায় রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে করতে খাবার বিষয়ে কিছু পরামর্শ দেওয়া হলো। এটাও বোঝানোর চেষ্টা হলো যে, বাইরের কেনা খাবার খেয়ে পেট ভরে থাকে বলে তার ক্ষুধা নষ্ট হয় আর এই খাবারগুলোর কারণেই কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

বাবার কথা হলো বাসার সামনে এত দোকান আর এত প্যাকেট ঝুলছে, মা-বাবা বাসায় থাকেন না, বাচ্চাও মাদ্রাসায় থাকে, না দিয়েও পারা যায় না। তারা যে ঘরে থেকে খাবার তৈরি করে খাওয়াবেন, সেই সময়ও তেমন পান না। সকাল ৬টায় মাদ্রাসায় যেতে হয়, তাই সকালে টয়লেটে বসিয়ে যে অভ্যাস করবেন, সেই উপায়ও নেই। তারপর অনুরোধ করলেন রিপোর্ট আসার পর যেন ভালো কোনো রুচির ওষুধ লেখা হয়। তাদের তো সময় নেই তাই ওষুধই ভরসা।

বাসার সামনে এত দোকান আর এত প্যাকেট ঝুলছে, মা-বাবা বাসায় থাকেন না, বাচ্চাও মাদ্রাসায় থাকে, না দিয়েও পারা যায় না। তারা যে ঘরে থেকে খাবার তৈরি করে খাওয়াবেন, সেই সময়ও তেমন পান না।

কেস-৩: ২২ দিনের মুক্তা

মুক্তার বয়স ২২ দিন। সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে। মায়ের মনে হচ্ছে তার বাচ্চার ঠান্ডা লেগেছে, নিশ্বাস নিতে শব্দ হচ্ছে, তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে এসেছেন। মাকে বেশ সচেতন মনে হলো। তিনি এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছেন। বাবাও এসএসসি পাস। মা জানালেন তার বাচ্চা বুকের দুধই খায়। তবে মুরুব্বিরা বলছিলেন আর মায়েরও মনে হচ্ছিল যে বাচ্চাটি রাতে দুধ কম পায়, যদিও সারা দিন তার খাওয়া, পায়খানা, প্রস্রাব ঠিকই আছে। রাতে খুব কাঁদে, তাই কৌটার দুধ খাওয়াচ্ছেন। তবে তিনি সেটা ঘন করে খাওয়াচ্ছেন না। মিছরি দিয়ে পাতলা করেই দিচ্ছেন।

কার কাছে কৌটার দুধের পরামর্শ পেয়েছেন জানতে চাইলে জানা গেল পাশের ওষুধের দোকানের ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে তিনি দুধ কিনেছেন। ওই ডাক্তার খুব ভালো। পরিবারের সবাই তার কাছেই চিকিৎসা নেয়। 

শিশুটিকে পরীক্ষা করে দেখা গেল তার তাপমাত্রা, নিশ্বাস-প্রশ্বাসের হার, হৃৎপিণ্ডের গতি, রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিক। হাত-পায়ের রং, নড়াচড়া স্বাভাবিক। ফুসফুস পরিষ্কার। নাকে সামান্য শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। দুধ খেতে কোনো অসুবিধা নেই। শুধু একটু নাক বন্ধ। মাকে বুঝিয়ে বলা হলো আর নাকে আরাম হওয়ার জন্য একটা নরমাল স্যালাইন ড্রপ লিখে কী ধরনের অসুবিধা দেখলে তিনি হাসপাতালে চলে আসবেন, জানানো হলো। শিখিয়ে দেওয়া হলো, কীভাবে তিনি বুঝবেন বাচ্চা বুকের দুধ যথেষ্ট পাচ্ছে কি না। এ মুহূর্তে বাচ্চাটির অন্য কোনো দুধের প্রয়োজন নেই। পাতলা করে মেশানো দুধ আর মিছরি ক্ষতিকর।

বুঝিয়ে দেওয়ার পরও মা জানতে চাইলেন যদি কখনো দুধ না পায়, তাহলে কৌটার দুধ খাওয়ানো যাবে কি না! মাকে পর্যাপ্ত পুষ্টি আর বিশ্রামের উপদেশ দেওয়া হলো। দুধ না পেলে শিশু-চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলা হলো। তিনি জানালেন বাড়িতে লোক নেই। বাচ্চা নিয়ে এত দূরে আসা একটু কঠিন, তাই তারা পাশের ডাক্তারের দোকানে যান। মুরুব্বিদের কাছ থেকে এতদিনে হয়তো জেনেছেন যে হাসপাতালের ডাক্তাররা কতকিছুই বলে‒সব শুনতে হয় না। তা ছাড়া দোকানে কৌটার দুধ সহজপ্রাপ্য।

কেস-৪: সাত বছরের রহমান

আব্দুর রহমানের বয়স ৭ বছর। পাঁচ দিন ধরে জ্বর-ঠান্ডা-কাশি। বাবা নিয়ে এসেছেন। ছোট বাচ্চা থাকায় মা আসতে পারেননি। তিন দিনের মাথায় জ্বর না কমায় কাছে একটি ক্লিনিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছিলেন। প্রেসক্রিপশনে দেখা গেল তিনি সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরের চিকিৎসা আর পরামর্শ দিয়েছিলেন। চার দিনের মাথায় জ্বর না কমায় কাছেই এক ‘ডাক্তার’-এর পরামর্শ নিয়েছেন। তিনি কোনো প্রেসক্রিপশন দেননি। ওষুধ দিয়েছেন। ওষুধটা বাবা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। সেটি একটি তৃতীয় জেনারেশনের সেফ্রাডিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক। পঞ্চম দিনেও জ্বর চলে আসায় তারা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

শিশুর শারীরিক পরীক্ষায় তাপমাত্রা বেশি ছাড়া আর বিশেষ অসুবিধা পাওয়া গেল না। সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরই মনে হলো। শিশুর খাওয়া একটু কম হলেও সে খাচ্ছে। পায়খানা-প্রস্রাব মোটামুটি ঠিক আছে। তাপমাত্রা কমে যাওয়ার পর সে খেলাধুলাও করে। সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরের ক্ষেত্রে পঞ্চম দিনের পর প্রাথমিকভাবে কিছু পরীক্ষা প্রয়োজন। বাবা পরীক্ষাগুলো জরুরি ভিত্তিতে করে সেদিনই দেখাতে চাইলেন। কারণ, তিনি একটা গার্মেন্টসে কোয়ালিটি কন্ট্রোল-এ গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। পরপর আসা সহজ নয়। আর কেউ নেই যে যাকে দিয়ে পাঠাবেন। তিন ঘণ্টা পর রিপোর্ট পাওয়া গেল। রিপোর্ট ভালো। বাবাকে বুঝিয়ে বলা হলো যে এখানে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো কাজ নেই। সাত দিন অপেক্ষা করলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জ্বর কমে যাওয়ার কথা। তাপমাত্রা কমানোর জন্য প্যারাসিটামল আর কাশির আরাম হওয়ার জন্য একটা ওষুধ দেওয়া হলো। কুসুম গরম পানি, লেবু চা, ঘনঘন তরল খাবার দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলো। সাত দিন পরও যদি জ্বর আসে অথবা কোনো জরুরি উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসার পরামর্শ দেওয়া হলো।

কেস-৫: ১১ মাসের আফিয়া

আফিয়ার বয়স ১১ মাস। সমস্যা ডায়রিয়া। নিয়ে এসেছেন বৃদ্ধা দাদি। হাতে ফিডিং বোতল। বোতলের মুখে ঢাকনা নেই। ভেতরে হালকা সাদা চালধোয়া পানির মতো তরল। রোগের ইতিহাস শুনতে গিয়ে জানা গেল শিশুটি জন্মের পর এক মাস পর্যন্ত বুকের দুধ খেয়েছে। তারপর মায়ের ছুটি শেষ হওয়ার ফলে মা চাকরিতে যোগদান করেন। এরপর থেকে কৌটার দুধ খায়। ‘ডাক্তার’-এর কাছ থেকে নিয়ে এসেছেন দুধ। হজম না হওয়ার আশঙ্কায় দুধ খুব পাতলা করে মেশানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দাদি। কারণ, লালন-পালন তিনিই করেন। তা ছাড়া নিয়ম মেনে মেশালে দুধ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। শিশুর বাবার তেমন আয় নেই। একজনের আয়ে সুবিধা করে উঠতে পারেন না। বাসাভাড়া দিতে হয় তিন হাজার টাকা। এখন দাদির সিদ্ধান্তেই সুজি খাওয়ানো হয় লবণ আর পাতলা দুধ মিশিয়ে। পাশাপাশি পাতলা করে সেরেলাকও খাওয়ানো হয়। দু-মাস আগে শিশুটি একবার নিউমোনিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। এবারও ফার্মেসি থেকে অনেক টাকার ওষুধ এনেছেন। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় এখানে ভালো ওষুধ নিতে এসেছেন।

শিশুটির ওজন পাঁচ কেজি। পায়ের পাতা ফোলা। মারাত্মক অপুষ্টির লক্ষণ। অবস্থা খুব আশঙ্কাজনক। মারাত্মক পানিশূন্যতা। পরীক্ষা করে জ্বরও পাওয়া গেল। নিশ্বাস-প্রশ্বাসের হার স্বাভাবিক সীমার ওপরে। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাচ্ছে। দাদিকে জানানো হলো যে জরুরি ভিত্তিতে শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। শুনে দাদি কেঁদে ফেললেন। তিনি কী করে বাচ্চাকে ভর্তি করবেন? মা ছুটি পাবেন না। কামাই করলে চাকরি থাকবে না। তা ছাড়া হাসপাতালে দৈনিক ১০০০ টাকা বিছানা ভাড়া, ওষুধের খরচ বহন করা অসম্ভব।

দাদিকে জানানো হলো যে জরুরি ভিত্তিতে শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। শুনে দাদি কেঁদে ফেললেন। তিনি কী করে বাচ্চাকে ভর্তি করবেন? মা ছুটি পাবেন না। কামাই করলে চাকরি থাকবে না। তা ছাড়া হাসপাতালে দৈনিক ১০০০ টাকা বিছানা ভাড়া, ওষুধের খরচ বহন করা অসম্ভব।

কিন্তু এই মুহূর্তে নষ্ট করার মতো সময়ও নেই। তাড়াতাড়ি জরুরি বিভাগে পাঠিয়ে প্রাথমিক জরুরি চিকিৎসা শুরু করা হলো। তারপর হাসপাতালে দরিদ্র তহবিলের সুপারিশ লিখে দেওয়া হলো। অভিজ্ঞতা বলে, একটু সুস্থ হয়ে উঠলেই তারা রিস্ক বন্ড দিয়ে ছুটি নেবেন। পুরো চিকিৎসা নেবেন না অর্থাৎ নিতে পারবেন না। কারণ, হাসপাতাল চিকিৎসার খরচ মওকুফ করবে, চাকরির নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। শিশুটি আবার ফিরে যাবে দুষ্টচক্রে।

কেস-৬: ৫০ দিনের হালিম

হালিমের বয়স এক মাস বিশ দিন। একটু ঠান্ডা লেগেছে। তা ছাড়া বাড়িতে ডেলিভারি হওয়ার পর ডাক্তার দেখানো হয়নি, তাই চেকআপ করতে এনেছেন মা। সপ্তাহখানেক আগ পর্যন্ত শুধু বুকের দুধই খেত। কিছুদিন ধরে পাতলা করে মিছরি মিশিয়ে কৌটার দুধ খাওয়ানো হচ্ছে। অভ্যাস করানোর জন্য। ‘পাড়ার ডাক্তার’-এর দোকান থেকে দুধ নিয়ে এসেছেন। 

কৌটার দুধ খাওয়ানোর কারণ জানতে গিয়ে জানা গেল আগামী মাস থেকে মা কাজে যাবেন। একজনের আয়ে চলে না। বাবা জোগালির কাজ করেন। সব দিন কাজ থাকে না। মা গার্মেন্টসে কাজ করতেন। বাচ্চা হওয়ার পর আর করবেন না ঠিক করেছেন। কারণ, বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। আবার ভোরে চলে যেতে হয়। তাই একটা বাসার কাজ নিয়েছেন। গৃহকর্ত্রী স্কুলের শিক্ষক। তার তিনটি শিশুসন্তান আছে। তাদের নিয়ে পুরো বাসার দায়িত্ব নিতে হবে সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। বাচ্চাকে নানির কাছে রেখে যাবেন। বাসা থেকে ৫ মিনিটের হাঁটারাস্তা। কিন্তু বুকের দুধ খাওয়াতে বাসায় আসার অনুমতি নেই। মাসিক ৫০০০ টাকা পাবেন। তিনি কিছুটা খুশি এই ভেবে যে অন্তত রাতে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন আর বাচ্চার সঙ্গে কিছু সময় পাবেন।

পরীক্ষা করে দেখা গেল শিশুটি সুস্থ। ওজন বয়স অনুযায়ী স্বাভাবিক সীমার মধ্যে। বুকে কোনো অসুবিধা নেই। নিশ্বাসে আরাম হওয়ার জন্য নরমাল স্যালাইন ড্রপ লিখে দেওয়া হলো। নিয়মানুযায়ী মাকে বুকের দুধের উপকারিতা সম্পর্কে বোঝানো হলো। এটাও জানানো হলো যে বুকের দুধ চেপে রাখা যায়, যা পরিবেশের তাপমাত্রা অনুযায়ী ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত ভালো থাকে। রেফ্রিজারেটরে রাখলে ২৪ ঘণ্টা আর ডিপ ফ্রিজে রাখলে সাত দিন পর্যন্ত ভালো থাকে। কীভাবে সংরক্ষণ করবেন, কীভাবে গরম করবেন জানানো হলো। জানা গেল বাসায় ফ্রিজ নেই।

এ পদ্ধতিতে যেতে গেলে মায়ের পর্যাপ্ত পুষ্টি আর বিশ্রাম দরকার, যার কোনোটিই তিনি যে ব্যবস্থা করতে পারবেন না, সেটা অনেকটা নিশ্চিত। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, এত দীর্ঘ সময় মা-শিশুর সান্নিধ্য যদি না হয়, তাহলে এমনিতেই মায়ের দুধ নিঃসরণ কমে যাওয়ার কথা, তারপরও জানানো হলো- যদি কোনো উপকার হয়। পাশাপাশি কৌটার দুধ সঠিকভাবে মেশানোর নিয়মটাও বলে দেওয়া হলো। উদ্দেশ্য, কিছুটা পুষ্টি নিশ্চিত করা।

কেস-৭: ছয় বছরের আইয়ান

আইয়ানের বয়স ছয় বছর। খাবার রুচি নেই, কোষ্ঠকাঠিন্য, জ্বর জ্বর ভাব-এই অসুবিধার জন্য মা নিয়ে এসেছেন। কোলে বছরখানেক বয়সি আরেকজন। সমস্যাগুলো বেশ কিছু সময় ধরে। যদিও জ্বর কখনো মাপা হয়নি। মাঝে মাঝে এলাকার ডাক্তারের কাছ থেকে টুকিটাকি ওষুধ কিনে খাইয়েছেন। ‘ডাক্তার’ প্রেসক্রিপশন দেননি। তিনি নামও বলতে পারলেন না। মা ঠিক করেছেন, এবার ভালো ডাক্তার দেখিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওষুধ খাওয়াবেন। অর্থের জোগাড় হয়নি, তাই এতদিন হাসপাতালে আসতে পারেননি।

শিশুটির ওজন উচ্চতা বয়সের স্বাভাবিক সীমার নিচের দিকে। বাসায় যা রান্না হয়, তা-ই তাকে কমবেশি খাওয়ানোর চেষ্টা করা হয়। ‘মজা’র প্রতিও তেমন আগ্রহ এখন নেই। শারীরিক পরীক্ষায় দেখা গেল ওই মুহূর্তে জ্বর নেই, নিশ্বাস-প্রশ্বাসের হার, হৃৎপিণ্ডের গতি স্বাভাবিক। মাঝারি রক্তস্বল্পতা লক্ষ করা গেল। এ ছাড়া আর কোনো সমস্যা পাওয়া গেল না। শরীরে কোথাও ইনফেকশন থাকলে যেমন জ্বর আসতে পারে, তেমনি রক্তস্বল্পতার কারণেও জ্বরভাব হতে পারে। রক্ত আর প্রস্রাবের পরীক্ষা লিখে দেওয়া হলো। তাপমাত্রা কমানোর জন্য প্যারাসিটামল লিখে বুঝিয়ে বলা হলো যে তাপমাত্রা মেপে খাওয়াতে হবে। জ্বর না পেলে খাওয়ানোর দরকার নেই। 

রক্তস্বল্পতার কারণ হিসেবে আয়রনের ঘাটতিই মনে হলো। নিশ্চিত না হয়ে আপাতত কিছু দেওয়া যাবে না। তাই প্রতিদিন খাবারে মাছ, কলিজা, লালশাক ইত্যাদি আয়রনজাতীয় খাবার রাখার পরামর্শে মা হঠাৎ কেঁদে ফেললেন। জানা গেল বাচ্চার বাবা চায়ের দোকান করেন। মাসে ১২-১৩ হাজার টাকা পান। বাড়িভাড়া ৩০০০, জ্বালানি খরচ আরও হাজারখানেক। ছেলেকে স্কুলে দিয়েছেন। কাছে সরকারি স্কুল নেই দেখে প্রাইভেটে পড়াচ্ছেন। বেতন ৫০০। তার কাছে ৩০০ টাকা নেয়। এর বাদে খাবার খরচ কী আর থাকে যে বাচ্চাকে পুষ্টিকর খাবার দেবেন! বড় বাচ্চার বয়স ১১ বছর। মায়ের ভাষায় ‘প্রতিবন্ধী’। বাড়িতে ডেলিভারি হয়ে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়েছিল। হাঁটতে পারে না। সেই বাচ্চাকে দেখে রাখা, সংসার সামলানো, সব শেষে মায়ের কোনো কাজ ধরার উপায় নেই।

এ পর্যায়ে চিকিৎসক রক্ত পরীক্ষা দেখে ওষুধ লিখে দেওয়ার আশ্বাস দিলেন। শিশুর বিকাশের সময়টায় আয়রন, প্রোটিনজাতীয় খাবারের মূল প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা মা করতে না পারলেও মাস তিনেক ওষুধ হিসেবে আয়রন-এর ব্যবস্থা করতে পারবেন বলেই মনে হলো।

কেস-৮: ১৩ মাসের মুস্তাকিম

মুস্তাকিমের বয়স ১৩ মাস। এখনো ঘাড় শক্ত হয়নি। উঠে বসতে পারে না। মা নিয়ে এসেছেন। সঙ্গে অভিভাবক হিসেবে দাদি এসেছেন। মায়ের বয়স উনিশ-বিশ বড়জোর। শিশুটি মায়ের প্রথম সন্তান। জন্মের আগে মা কখনো ডাক্তার দেখাননি। তার জন্ম গ্রামের বাড়িতে দাই-এর মাধ্যমে। জন্মের পর বাচ্চার কাঁদতে দেরি হয়েছিল। এক ঘণ্টা পর খিঁচুনি শুরু হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছিল ১৩ দিন। সবার সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে চিকিৎসা করেছেন। কেন বাড়িতে ডেলিভারি হলো-জানতে চাওয়া হলে দাদি জানালেন তার নিজের বাচ্চাও বাড়িতেই হয়েছে আর তা ছাড়া হাসপাতালে অনেক খরচ। দাইকে শুধু একটা শাড়ি দিতে হয়। যাদের সামর্থ্য আছে তারা টাকা-পয়সা দেয়। উনি বয়স্ক মানুষ। বহু বছর ধরে ডেলিভারি করেন।

মস্তিষ্কের একটা পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল হাসপাতাল থেকে ছুটির সময়। টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করতে পারেননি বলে আর করা হয়নি। এখনো মাঝে মাঝে খিঁচুনি হয়। একবার সাভার সিআরপি-তে দেখিয়েছেন। কিন্তু ডাক্তার দেখাতে ৫০০ টাকা, থেরাপি ৩০০ টাকা, যাতায়াত খরচ সব মিলিয়ে হাজার টাকা লাগে। খুব উন্নতি দেখেননি, তাই আর যাওয়া হয়নি।

শিশুটির সেরিব্রাল পালসি। জন্মের সময় মস্তিষ্কে অক্সিজেনের ঘাটতি হওয়ার কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। মাথার মাপ বয়সের তুলনায় অনেক কম, ঘাড় শক্ত হয়নি। বসতে পারে না, চোখে দেখতে কিছুটা পায়, কানে শুনতে পায়। নরম খাবার খেতে পারে। মা আর দাদিকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করা হলো যে বাচ্চার মস্তিষ্কে জন্মের সময় কিছু ক্ষতি হয়ে গেছে। যার ফলে সে কখনোই আর দশ জন শিশুর মতো হবে না, কিন্তু ওষুধ আর থেরাপি দীর্ঘদিন চালাতে পারলে তার খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে আর মাংসপেশির শক্তিও বাড়ানো যাবে। কিছু পরীক্ষা করা প্রয়োজন, যাতে ক্ষতির পরিমাণ, ক্ষতির ধরন-এগুলো বোঝা যায়। পরীক্ষাগুলোর পরামর্শ দেওয়া হলো, কোথায় করবেন তা-ও জানানো হলো। একটা ধারণাও দেওয়া হলো যে চিকিৎসাটা অল্প ক’দিনের নয়। লেগে থাকতে হবে।

শিশুটির সেরিব্রাল পালসি। জন্মের সময় মস্তিষ্কে অক্সিজেনের ঘাটতি হওয়ার কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। মাথার মাপ বয়সের তুলনায় অনেক কম, ঘাড় শক্ত হয়নি। বসতে পারে না, চোখে দেখতে কিছুটা পায়, কানে শুনতে পায়।

খরচের কথা এলে জানা গেল যে বাচ্চার বাবা রিকশা চালান, জমা বাদ দিয়ে মাসে ১০-১২ হাজারের মতো থাকে। দাদি মেসে রান্না করে আট হাজার টাকা পান। দাদা বয়স্ক, কাজ করতে পারেন না। তার আরেক ছেলে কাজ পায়নি এখনো। পাঁচজনের সংসার। এই খরচ জোগাড় করা কঠিন। জানানো হলো যে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই চিকিৎসা কম খরচে পাওয়া যাবে। কিন্তু দূরত্ব যা তাতে গাড়ি ভাড়া পড়বে অনেক। দাদি জানতে চাইলেন চিকিৎসা করলে বাচ্চাটা ভালো হবে কি না? দুঃখ করলেন, ‘কপালের দোষে আজ এই অবস্থা।’

 কেস-৯: দুই শিশু

স্কুলের পোশাক পরা এক শিশু। বুকের ওপর বেণি দুলিয়ে এসেছে। দেখে মনে হলো অষ্টম বা নবম শ্রেণিতে পড়তে পারে। বয়স অনুপাতে ওজন কম হবে বলেই মনে হলো। তার কোলে আরেক শিশু। কে রোগী বোঝা গেল না। জানা গেল কোলের জনকে দেখতে হবে আর তার বয়স সাত মাস। বড়জনের কাছে জানতে চাওয়া হলো মা কোথায়? মাকে ডাকলে ভালো হয়। উত্তরটা খুব আশ্চর্যজনক না হলেও ব্যস্ত বহির্বিভাগে হঠাৎ একটু অপ্রস্তুত হওয়ার মতোই।

বড় মেয়েটি বলল, ‘আমার মা অফিসে।’ ছুটি পায়নি। তাই সে তার বাচ্চা একাই নিয়ে এসেছে। বাচ্চাটির মা সে নিজেই। ডাক্তার দেখিয়ে সে ক্লাসে যাবে। পরীক্ষা আছে। কোনো প্রশ্ন করার আগেই সে জানাল সে এখন নবম শ্রেণিতে পড়ে। আসলে তার দশম শ্রেণিতে পড়ার কথা ছিল। বিয়ে হওয়ার পর বাচ্চা হলো। তাই গ্যাপ পড়ে গেছে। সে আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। স্কুলে যাওয়ার সময় বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে যায়। প্রধান শিক্ষিকা অনুমতি দিয়েছেন। স্কুলের মাসিদের কোলে থাকে আর ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে দুধ খাওয়ায়। দুপুরে একসঙ্গে বাসায় আসে। রাতে তার মা সামলান আর সে পড়াশোনা করে। বাচ্চার বাবা কী করেন, কোথায় থাকেন-এই প্রশ্ন আসায় সংক্ষিপ্ত উত্তর এলো বিদেশ থাকে।

বাচ্চাটির মা সে নিজেই। ডাক্তার দেখিয়ে সে ক্লাসে যাবে। পরীক্ষা আছে। কোনো প্রশ্ন করার আগেই সে জানাল সে এখন নবম শ্রেণিতে পড়ে। আসলে তার দশম শ্রেণিতে পড়ার কথা ছিল। বিয়ে হওয়ার পর বাচ্চা হলো। তাই গ্যাপ পড়ে গেছে। সে আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। স্কুলে যাওয়ার সময় বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে যায়।

শিশুটির ডায়রিয়া। হালকা জ্বরও আছে। কোনো ওষুধ খায়নি। অল্প স্যালাইন খাওয়ানো হয়েছে। পায়খানার পরিমাণ বেশি মনে হওয়ায় নিয়ে এসেছে। শিশুটির ওজন, দৈর্ঘ্য, বয়সের তুলনায় স্বাভাবিক সীমার নিচে। শিশুটি সময়ের অনেক আগে জন্ম নিয়েছিল। জন্মের সময় ওজন ছিল এক কেজি নয়শ গ্রাম। শারীরিক পরীক্ষা করে মৃদু পানিশূন্যতা লক্ষ করা গেল। আর কোনো বড় ধরনের অসুবিধা পাওয়া গেল না। নিয়মমতো স্যালাইন খাওয়ানো গেলে ভর্তির প্রয়োজন হবে না হয়তো। কিন্তু পুরো পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সেটা কতটা সম্ভব, বোঝা মুশকিল। মাকে বুঝিয়ে বলা হলো যে ডায়রিয়া সারতে সময় লাগবে। কিন্তু পরামর্শমতো স্যালাইন খাওয়াতে হবে। মা জানালো যে স্কুলের মাসিকে বুঝিয়ে দিলে খাওয়াতে পারবে। পরীক্ষা শেষে সে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে যাবে। তার আম্মুও তাড়াতাড়ি ফিরবে। সমস্যা হবে না।

কিছু ওষুধ, স্যালাইনের নির্দেশ আর খাবারের পরামর্শ লিখে দেওয়া হলো। বিপদের লক্ষণগুলো জানিয়ে রাখা হলো। অপরিণত শিশু কোলে অপরিণত মা চিকিৎসা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল নিজ স্কুলের উদ্দেশে।

 কেস-১০: ২৫ দিনের আফসানা

আফসানার বয়স ২৫ দিন। ঘনঘন পায়খানা আর বমি করে। নানি নিয়ে এসেছেন। এর মধ্যে কিছু ওষুধও কিনে খাইয়েছেন পাশের এক ‘ডাক্তার’-এর কাছ থেকে। প্রেসক্রিপশন দেননি ডাক্তার। নানিই সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন। মা কোথায় জানতে চাইলে জানা গেল বাইরে-অপেক্ষায়। ডাক পেয়ে বোরকাপরা এক শিশু ঢুকল যার বয়স ১৮ যে হয়নি সেটা নিশ্চিত।

সিজারিয়ানের মাধ্যমে শিশুর জন্ম। নানির ভাষ্যমতে, বাচ্চা নিচে নামছিল না, হার্টবিট কমে যাচ্ছিল, তাই ডাক্তার সিজার করেছে। জন্মের পর বাচ্চার কোনো অসুবিধা হয়নি। সে শুধু বুকের দুধই খায়। প্রস্রাব ভালোই করে। বাচ্চার পায়খানা, বমি হচ্ছে দেখে নানি মায়ের দুধ, ডিম, মাছ খাওয়া বন্ধ রেখেছেন। তা ছাড়া অপারেশনের ক্ষত শুকাতে দেরি হবে এগুলো খেলে! তাই এ ব্যবস্থা। মা-কে ডাক্তার সবকিছুই খেতে বলেছিলেন, কিন্তু নানির এক বোন সেই ডাক্তারের চেম্বারে কাজ করেন, তিনি এ পরামর্শ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে জানা গেল বাচ্চার মা ক্লাস নাইন পর্যন্ত স্কুলে পড়েছে।

শিশুকে পরীক্ষা করে দেখা গেল তার ওজন, দৈর্ঘ্য, বয়স অনুপাতে স্বাভাবিক। কোনো পানিশূন্যতার লক্ষণ নেই। নড়া-চড়া, নিশ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক। বুকের দুধ খাওয়া শিশু অনেক সময় ঘনঘন পায়খানা আর হালকা-পাতলা বমি করতে পারে। যদি বাচ্চার নড়াচড়া, খাওয়া-দাওয়া স্বাভাবিক থাকে আর ২৪ ঘণ্টায় ৬-৭ বার প্রস্রাব করে, তাহলে খুব চিন্তার কিছু নেই। এ জন্য কোনো ওষুধ প্রয়োজন হবে না। পায়খানার একটা পরীক্ষা দেওয়া হলো। রিপোর্টে কোনো অসুবিধা পাওয়া গেলে ওষুধের চিন্তা করা যাবে। মায়ের পুষ্টি বিষয়ে নানিকেই পরামর্শ দেওয়া হলো। কারণ, এই দুজন শিশুর পালন-পোষণ তিনিই করবেন!

 কেস-১১: ৮৭ দিনের আদিব

আদিবের বয়স ২ মাস ২৭ দিন। পেটে মোচড় দিয়ে বারবার পায়খানা হচ্ছে। আগের রাত থেকে ওষুধ খাওয়াচ্ছেন, কিন্তু সকাল থেকে পায়খানার সঙ্গে রক্ত লক্ষ করেছেন মা। তাই তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন। শিশুটিকে পরীক্ষা করে পানিশূন্যতা বা অন্য কোনো জরুরি লক্ষণ পাওয়া গেল না। প্রস্রাব ঠিক আছে। খাচ্ছেও ঠিকমতো। কী খায়? জানা গেল রাতে বুকের দুধ খায় আর দিনের বেলায় প্রাণের তরল দুধ খায় মিছরি মিশিয়ে। মা-বাবা দুজনেই চাকরি করেন একটা গার্মেন্টসে। তাই বাচ্চার জন্মের পর দাদি এসেছেন। তিনিই দেখাশোনা করেন। বাড়ি পাবনার সাঁথিয়ায়। কেন বাড়ি ছেড়ে ঢাকা এলেন? বাবার ভাষ্যমতে, বাচ্চার দাদা কম দামে জমি কিনে থাকার জন্য একটু ব্যবস্থা করেছিলেন। খেত-খামার করে চলে যেত। এখন তারা শুনতে পাচ্ছেন সেগুলো সরকারি জমি। বহু বছর আগে সরকার কিনে নিয়েছিল। সেই বিক্রি হয়ে যাওয়া জমিই তারা কিনেছিলেন। এতদিন সরকার খোঁজ নেয়নি। এখন সবাইকে উচ্ছেদ করবে। গ্রামে তিনি চাষবাস করতেন। বিপদে পড়েই ঢাকায় আসা। বাচ্চার দাদা চায়ের দোকান করেন। তাতে সংসার চলে না। এখানে ৮টা থেকে ৫টা চাকরি করে আট হাজার টাকা করে পান দুজনে। ৭টা পর্যন্ত ওভারটাইম করে সেটা ১৩ হাজার পর্যন্ত হয়ে যায়। কাজেই দুজনের আয় ২৬ হাজারের মতো হয়। আপাতত তিনি খুশি। বড় বাচ্চাটির বয়স চার বছর। গত বছর তার হার্টের অপারেশন হয়েছে। এ জন্য তিনি অর্থনৈতিকভাবে নাজুক অবস্থায় আছেন। মায়ের মাতৃত্বকালীন ছুটির পুরো টাকাটা এখনো পাননি। ওটা পেলেই মাকে আপাতত আর চাকরিতে পাঠাবেন না।

শিশুটির সমস্যা খাদ্যাভ্যাস থেকে তৈরি। সেটা ধারণা করা যায়। তারপরও এ ক্ষেত্রে বুকের দুধ বিষয়ে পরামর্শ দেওয়াটা একটা প্রহসনের মতো মনে হতে পারে। মাকে বুঝিয়ে বলা হলো তিনি যেন ফিডিং বোতলে দুধ না দিয়ে অন্ততপক্ষে বাটি-চামচে খাওয়ান। তাতে কিছুটা জীবাণুমুক্ত করা সম্ভব। দুধ কী দেবেন, সেটা মা তার আয়-অবস্থা-অবস্থান বুঝে ঠিক করবেন। বুকের দুধের পর তরল দুধ ভালো নাকি কৌটার দুধ ভালো, ভালো হলে কোনটা ভালো-এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া কঠিন।

 কেস-১২: ৫০ দিনের শিশু

শিশুর বয়স ১ মাস ২০ দিন। মা-বাবা নিয়ে এসেছেন। ঘনঘন পায়খানা করে। পরিমাণে বেশি নয়। কিন্তু অল্প অল্প করেই যায়। মা কোনো কথা বলছিলেন না। সব কথা বাবাই বলছিলেন।

শিশুর ওজন বয়স অনুপাতে স্বাভাবিক। স্বতঃস্ফূর্ত এবং কোনো পানিশূন্যতা নেই। বুকের দুধ খায়। তবে বাবা মনে করছেন যে বুকের দুধে কোনো ঝামেলা থাকতে পারে। কারণ, খেলেই সে পায়খানা করে। এ জন্য তিনি lactose free formula খাওয়ানো শুরু করেছেন। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানালেন যে তিনি ফার্মাসিস্ট, তাই ওষুধ সম্পর্কে তার ধারণা আছে ভালো। বাচ্চাকে পায়খানার চিকিৎসা করেছিলেন মেট্রোনিডাজল অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে। এতেও সারেনি দেখে ভালো ডাক্তার দেখাতে নিয়ে এসেছেন। পরীক্ষাও করতে চান।

তিনি কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মাসি পড়াশোনা করেছেন-জানতে চাইলে হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। তাকে অপ্রস্তুত করার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্নটা করা নয়। বিষয়টা জানতে চাওয়া। জানা গেল তিনি তিন মাসের ট্রেনিং করেছেন। কোথায় সেটা কোনোভাবেই মনে করতে পারলেন না। বারবার বলছিলেন, তিনি একটা ওষুধের দোকান চালান, টুকিটাকি চিকিৎসাও দিয়ে থাকেন। কথা না বাড়িয়ে তাকে আশ্বস্ত করা হলো যে এই অসুবিধা দু-তিন মাস বয়স পর্যন্ত থাকতে পারে। জরুরি বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হলো আর শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দেওয়া হলো।

 চিকিৎসক পর্যবেক্ষকের মূল্যায়ন

অনেক ক্ষেত্রে অন্য জেলা থেকে আসা এই শিশুদের পরিবারগুলো জীবিকার প্রয়োজনে এ এলাকায় রয়েছে। কখনো শিশু আর মা-বাবা নিয়েই পরিবার, কখনো-বা বৃদ্ধ দাদা-দাদি বা নানা-নানি শিশুর দেখভাল করার জন্য সঙ্গে থাকেন। কেউ কেউ মাসে হাজার তিনেক টাকার বিনিময়ে অন্য পরিবারে শিশুকে রেখে চাকরি করেন। খুব নগণ্য ক্ষেত্রে মায়ের অফিসে ডে-কেয়ার থাকে। এসব জায়গায় ছয় মাসের নিচের বয়সি শিশুকে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই, যদিও দেড় দু-মাস বয়সি শিশু রেখেই মায়েরা চাকরি করতে আসেন। সরকারি নিয়মমতো সন্তান জন্মের সময় প্রাপ্য ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটির ক্ষেত্রে তারা চার মাস পান। এই চিত্র শুধু এই মায়েদের নয়, বেশি বেতন পাওয়া পেশাজীবী মায়েদেরও। চাকরিজীবী মায়েদের কথায় যতটুক বোঝা যায়, সম্ভাব্য ডেলিভারির দুই-আড়াই মাস আগেই তাদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে যেতে হয়। জন্মের পর মাস দেড়েক ছুটি হাতে থাকে। শিশুদের খাবারের কোনো ব্যবস্থা ডে-কেয়ারে সাধারণত থাকে না। মা আসার সময় যা নিয়ে আসতে পারেন, সেটা খাইয়ে রাখা হয় আর কাজের ফাঁকে মা বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন। কাজেই শিশুর প্রাথমিক পুষ্টির বিষয়টি পুরোই অবহেলিত থেকে যায়। পরিবার তাদের সুবিধামতো সহজলভ্য বিকল্প পথ বেছে নেয়। 

যে মায়েরা চাকরি করেন না, তারা সন্তান নিয়ে বাড়িতে একাই থাকেন। প্রতিবেশীর সাহায্য- মতামত নিয়ে চলেন। স্কুলের বয়সি শিশুর ক্ষেত্রে মা-বাবা স্কুলের চেয়েও মাদ্রাসাকে বেছে নেন। সেটা যতটা-না ধর্মীয় কারণে, তার চেয়ে বড় হলো আবাসিক মাদ্রাসা অনেকটা ডে-কেয়ারের কাজ করে। হাজার পনেরোশ টাকা খরচ করে বাচ্চাকে ওখানে রেখে তারা নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারেন। কখনো-বা সন্ধ্যায় নিয়ে আসেন, কখনো সপ্তাহে, মাসে। যাদের একজনের বেশি সন্তান, তারা বিশেষ করে কম বয়সিদের বাড়িতে দাদি-নানির কাছে রেখে আসেন। অসুস্থতার খবর পেয়ে কখনো কখনো ভালো ডাক্তার দেখাতে নিয়ে আসেন। বয়সে একটু বড় শিশুটি বাসায় একা ছোট শিশুর দেখাশোনা করে, এ রকমও কম নয়। একা শিশুকে ঘরে তালা দিয়ে প্রতিবেশীর হেফাজতে রেখে যান, কাজের ফাঁকে এসে দেখে যান-এই গল্পও শোনা যায়। পরিবারগুলো চাকরির বেতন দিয়ে নিজেরা চলে, অন্য জেলায় থাকা মা-বাবা, ভাই-বোনের জন্য টাকা পাঠায়। রোগীর অভিভাবকদের মধ্যে শিল্পকারখানার শ্রমিক ছাড়াও ভ্যানচালক, রিকশাচালক, হকার, গৃহকর্মী, হোটেল শ্রমিক এবং দিনমজুরও আছেন। তাদের অনেকের মনেই ইচ্ছা, তারা আবার নিজ এলাকায় ফেরত যাবেন।

স্কুলের বয়সি শিশুর ক্ষেত্রে মা-বাবা স্কুলের চেয়েও মাদ্রাসাকে বেছে নেন। সেটা যতটা-না ধর্মীয় কারণে, তার চেয়ে বড় হলো আবাসিক মাদ্রাসা অনেকটা ডে-কেয়ারের কাজ করে। হাজার পনেরোশ টাকা খরচ করে বাচ্চাকে ওখানে রেখে তারা নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারেন। কখনো-বা সন্ধ্যায় নিয়ে আসেন, কখনো সপ্তাহে, মাসে।

যেসব কারণে শিশুরা চিকিৎসা নিতে আসে, তার মধ্যে জ্বর, ডায়রিয়া, ঠান্ডা, কাশি, কোষ্ঠকাঠিন্য, পেটে ব্যথা, খাবার অরুচি এগুলোই সাধারণত বেশির ভাগ শিশুর সমস্যা। জ্বরের কথা যদি ধরা হয়, মূলত জ্বর হলো উপসর্গ, যা জীবাণু আক্রমণ ছাড়াও আরও অনেক কারণে হতে পারে। শিশুদের একটি বড় অংশ সাধারণ ভাইরাসজনিত জ্বরে বেশি আক্রান্ত হয়, যা পাঁচ দিন বা কখনো কখনো সাত দিনও চলতে পারে। ঠান্ডা, কাশির বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। তাপমাত্রা কমানোর ওষুধ আর ঠান্ডা, কাশির লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা শিশুকে আরাম দিতে পারে। তেমনি শিশুর একটা বয়স পর্যন্ত ভাইরাসজনিত ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা যায়। এ ধরনের ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে প্রধান চিকিৎসা হলো প্রথমত পানিশূন্যতা প্রতিরোধ। দ্বিতীয়ত, তার পুষ্টি নিশ্চিত করা। এ ধরনের অসুস্থতায় অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো কাজ নেই। এসব ক্ষেত্রে একজন চিকিৎসকের কাছ থেকেই প্রাথমিক পরামর্শ প্রয়োজন। কারণ, এই উপসর্গগুলো মারাত্মক রোগের পূর্বাভাসও হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিশুকে বাড়িতে রেখেই সার্বক্ষণিক পরিচর্যা সম্ভব আর প্রয়োজন চিকিৎসকের পরামর্শমতো ফলোআপ অথবা প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ। যাতে রোগের গতি-প্রকৃতি বোঝা যায়, সময়মতো নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া যায়। রোগের উপশম না-হওয়া পর্যন্ত নিয়মিত যোগাযোগ জরুরি, সেটা হোক চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী। সাময়িক উন্নতি চিকিৎসার শেষ কথা নয়। যেকোনো রোগের ক্ষেত্রেই পুরো চিকিৎসা নেওয়া, রোগ বা চিকিৎসাজনিত কোনো জটিলতা হয়ে থাকলে সমাধান করা, পরবর্তী প্রতিরোধবিষয়ক পদক্ষেপ-এই সবই চিকিৎসার অন্তর্গত। রোগ-পরবর্তী শিশুর বৃদ্ধি-বিকাশের নিয়মিত পর্যালোচনা রোগ প্রতিরোধ চেষ্টার একটি প্রক্রিয়া।

শিশুর অসুস্থতা তার অভিভাবক বা পরিবারের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয়। পরিবার তার জানা, বোঝা, সামর্থ্য অনুযায়ী দ্রুত নিরাময়ের ব্যবস্থা নেয়। কারণ, এর সঙ্গে অর্থ, সময়, জনবলের মতো বিষয়গুলো জড়িত। শিশুর সুস্থতা তো আছেই। যেকোনো রোগের উপসর্গ দেখা দিলে প্রাথমিক আরামের জন্য ঘরোয়া ব্যবস্থা করা একটি সাধারণ প্রচলিত অভ্যাস। বিশেষ করে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত অংশে রোগবালাই তারা নিজেরাই মিটিয়ে ফেলতে চায়। রোগের পেছনে ছুটতে গেলে তাদের কাজের সময় নষ্ট হয়। বিভিন্ন ধরনের প্রাচীন অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির পাশাপাশি সহজ তথ্যপ্রাপ্তির কারণে চিকিৎসার ঘরোয়া পদ্ধতিও পালটে গেছে। যদিও অজ্ঞতা আর অবাধ তথ্যপ্রবাহের মিলিত ফলাফল প্রায় সময় স্বস্তিদায়ক হয় না। পাশাপাশি চিকিৎসা ও চিকিৎসক বিষয়ে ধারণায় প্রচুর বিভ্রান্তি লক্ষ করা যায়। এই বিভ্রান্তি শিক্ষা বা অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষেই হয়। চিকিৎসা সুবিধার ঘাটতি ও অব্যবস্থা, অশিক্ষা, অর্থনৈতিক সংকট, বাণিজ্যিক প্রচার-প্রচারণা এই বিভ্রান্তিগুলোকে আরও পুষ্ট করে যাচ্ছে।

সাধারণত সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ প্রথম পর্যায়ে ফার্মেসিতে পরামর্শ নেন। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা জানা মানুষও এই দলে থাকেন। যেখানে সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র কাছাকাছি নেই আর বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র ব্যয়বহুল, সেখানে ওষুধ বিক্রেতাই তাদের ডাক্তার। অনেক বিষয় এখানে কাজ করে। গ্রাম-মফস্বলে এই ফার্মেসির ‘ডাক্তার’ চিকিৎসক হিসেবে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। ওষুধ কোম্পানির লোকজন তাদের বেশ সমীহ করে চলে আর কেন্দ্রীয় কোনো তদারকি না থাকায় তারাও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। যারা চিকিৎসা নেন, তাদের ক্ষেত্রে কিছু মনস্তত্ত্ব কাজ করতে পারে। প্রথমত, তারা খুব শক্তপোক্তভাবে বিশ্বাস করেন যে এরা ডাক্তার। এই ডাক্তার তাদের চারপাশের মানুষগুলোর চেয়ে আলাদা নন। তিনি হাসপাতালের ডাক্তারের মতো কথা বলেন না। রোগীর মতো এই ডাক্তারও চিকিৎসা পুষ্টি এই বিষয়গুলোতে কুসংস্কারে বিশ্বাসী, যার সঙ্গে তারা নিজেদের মিল খুঁজে পান। মাঝে মাঝে হাসপাতালে ডাক্তার দেখানোর পরও এই ফার্মেসির ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করা হয়। তারা সেই চিকিৎসায়ও নিজেদের মতামত দিয়ে থাকেন আর সেই মতামত গ্রহণযোগ্য হতে দেখা যায়। তার ওপর এখানে কোনো ভিজিট দিতে হয় না, পরীক্ষার কোনো উপদেশ দেওয়া হয় না, ওষুধ কিনলেই হয়। প্রয়োজনে প্রতি বেলায় ওষুধ আনা যায়। ইনজেকশনও করা যায়। তারা বাড়ি গিয়েও চিকিৎসা দিয়ে আসেন। তাদের হাতের কাছে পাওয়া যায়। কাজেই অভিভাবক নিশ্চিন্তে ওষুধ বিক্রেতার পরামর্শে ওষুধ কেনেন। অসুস্থতার শুরু থেকেই রোগের ধরনের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন অপ্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়ে শিশুর চিকিৎসা চলতে থাকে। প্রায় ক্ষেত্রেই একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক থাকে। এক ফার্মেসি থেকে আরেক ফার্মেসি ঘুরে বেড়ান অভিভাবকরা আর ওষুধ কিনে চলেন-যেহেতু সবই কিনতে পাওয়া যায়। তবে অনেকেই জানেন যে হাসপাতালে ভালো ডাক্তার আছে, কিন্তু খরচ বেশি, সিরিয়াল ধরে বসে থাকার সময় কম, নিয়ে যাওয়ার লোক নেই-এসব কারণে প্রাথমিক চিকিৎসা ফার্মেসির ডাক্তার দিয়েই তারা শুরু করেন। তারাই ঠিক করেন রোগের পর্যায়। অভিভাবকরা ভাবতে চান যে রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে আছে আর ইচ্ছা পোষণ করেন যে অল্পের ওপর সেরে যাবে। কখনো-বা প্রাথমিক চিকিৎসা হয় দ্বিতীয়/তৃতীয় স্তরের ওষুধ দিয়ে, কখনো গুরুতর অবস্থা অগোচরে দ্রুত খারাপের দিকে যেতে থাকে।

এক ফার্মেসি থেকে আরেক ফার্মেসি ঘুরে বেড়ান অভিভাবকরা আর ওষুধ কিনে চলেন-যেহেতু সবই কিনতে পাওয়া যায়। তবে অনেকেই জানেন যে হাসপাতালে ভালো ডাক্তার আছে, কিন্তু খরচ বেশি, সিরিয়াল ধরে বসে থাকার সময় কম, নিয়ে যাওয়ার লোক নেই-এসব কারণে প্রাথমিক চিকিৎসা ফার্মেসির ডাক্তার দিয়েই তারা শুরু করেন। তারাই ঠিক করেন রোগের পর্যায়। অভিভাবকরা ভাবতে চান যে রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে আছে আর ইচ্ছা পোষণ করেন যে অল্পের ওপর সেরে যাবে।

যেসব শিশুর পরিবার কিছুটা শিক্ষিত এবং অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল তাদের ক্ষেত্রেও প্রায়ই দোদুল্যমানতা লক্ষ্য করা যায়। একদিকে তারা বড় শহরে বড় হাসপাতালে গিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে থাকেন আবার দু-তিন দিনের মাথায় রোগ না সারলে এই ‘ফার্মেসির ডাক্তার’-এর কাছ থেকেই ওষুধ নেন। রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনো ধরনের ওষুধ বিক্রি করা যাবে না, সে বিষয়ে বিধিমালা থাকলেও ওষুধ বিক্রেতা বা ক্রেতা কারো মধ্যে সে ধরনের কোনো সচেতনতা নেই। কারণ, এই বিধিমালার প্রয়োগ লক্ষ করা যায় না। এই সচেতনতা অর্জন করা বা করানো কারো ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় সম্ভব নয়। এই কারণগুলো আলাদা করে বিস্তৃত পর্যবেক্ষণের বিষয়।

একটা বড় অংশের ক্ষেত্রে মা বা দাদি-নানি প্রাথমিকভাবে ব্যবস্থা নেন হাতের কাছে যা পান সেভাবেই। অনেক সময় গাড়িভাড়া, যোগাযোগ ব্যবস্থার অসুবিধা, লোকবলের অভাব ইত্যাদি কারণে হাসপাতালে আসতে পারেন না। হাসপাতাল সম্পর্কে কারো কারো কিছু ভীতিও কাজ করে যে গেলেই পরীক্ষা করে, ভর্তি করে, অনেক টাকা খরচ। এই বিষয়গুলো মোটেও অমূলক নয়। আবার অজ্ঞতাজনিত বিভিন্ন সংস্কার, পীর-ফকিরদের পানিপড়ার ওপরও নির্ভরশীলতা আছে। অজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত হয় দারিদ্র্য। পানিপড়া নিলে ওষুধের খরচটাও বেঁচে যায়। পীর-দরবেশের ধরন অনুযায়ী আবার খরচও ভিন্ন হয়। কবিরাজি, ঝাড়ফুঁক, পানি পড়ায় হাজার টাকা খরচ করে সম্বল হারিয়ে অথবা জটিলতা তৈরি করে শেষ ভরসা হিসেবে হাসপাতালে আসেন-এই ঘটনাও কম নয়।

কবিরাজি, ঝাড়ফুঁক, পানি পড়ায় হাজার টাকা খরচ করে সম্বল হারিয়ে অথবা জটিলতা তৈরি করে শেষ ভরসা হিসেবে হাসপাতালে আসেন-এই ঘটনাও কম নয়।

বাড়ির পরিচর্যা পর্যবেক্ষণের বিষয়টি প্রায়ই কঠিন হয়ে পড়ে শ্রমজীবী মা-বাবার ক্ষেত্রে। মা-বাবা সকালে শিশুকে রেখে কাজে যান আর রাতে শিশু ঘুমিয়ে পড়লে বাড়ি ফেরেন। এই বৃত্তে জীবন। কাজেই মধ্যবর্তী সময়টা তাদের অজানা থেকে যায়। শিশুর অবস্থার উন্নতি-অবনতি কোনোটাই তারা ঠিকমতো জানেন না। কখনো তারা অকারণে অস্থির হয়ে যান, কখনো প্রয়োজনীয় সতর্কতার অভাব দেখা যায়। অফিস, বেতন কামাই যাওয়ার বিষয়গুলোতে পারিবারিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে। একটা বড় অংশের ক্ষেত্রে শিশুর যত্নে নিয়োজিত অপরিণত বয়স্ক, শিক্ষাবঞ্চিত মা অথবা বৃদ্ধা দাদি-নানি, যিনি প্রায় ক্ষেত্রেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন-অজ্ঞ, যার নিজেরই যত্ন দরকার। যেসব ক্ষেত্রে মা বাড়িতে থাকেন, সেখানে তিনি বাবা বা অন্য সদস্যদের চাপে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। চিকিৎসার খরচ অহেতুক বাড়তে থাকে, সঙ্গে যুক্ত হয় মানসিক চাপ। এই পর্যায়ে হাসপাতালে এসে তারা তাৎক্ষণিক উপশম চান, কিন্তু তার আগেই অনেক টাকার ওষুধ কিনে এসে হাসপাতালেও বাড়তি টাকার ভিজিট দিয়ে সামান্য ওষুধ, উপদেশ আর প্রয়োজনীয় পরীক্ষার পরামর্শ পেয়ে চূড়ান্ত হতাশ হয়ে পড়েন। কখনো-বা রোগকে জটিল করে নিয়ে আসেন আর ভর্তির কথা শুনে অকূল সমুদ্রে পড়ে যান। ভর্তির ব্যবস্থা আছে এ রকম সরকারি হাসপাতাল অনেক দূরে। সেখানে যদিও-বা কোনোভাবে পৌঁছাতে পারেন, বেড পাওয়া কষ্টসাধ্য বা দুঃসাধ্য। কারণ, প্রয়োজনের তুলনায় বেডের সংখ্যা অপ্রতুল। তার সঙ্গে সঙ্গে আনুষঙ্গিক ভোগান্তিও রয়েছে। বেডের সিরিয়াল, পরীক্ষার সিরিয়ালের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে চারপাশ থেকে দালালের খপ্পরে পড়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন-এ রকম উদাহরণ আছে। কেউ কেউ বেড না পেয়ে যে চিকিৎসক ভর্তির জন্য পাঠিয়েছেন, তাকেই অভিযুক্ত করেন যে তিনি জেনে-বুঝে কেন পাঠালেন।

ভর্তির ব্যবস্থা আছে এ রকম সরকারি হাসপাতাল অনেক দূরে। সেখানে যদিও-বা কোনোভাবে পৌঁছাতে পারেন, বেড পাওয়া কষ্টসাধ্য বা দুঃসাধ্য। কারণ, প্রয়োজনের তুলনায় বেডের সংখ্যা অপ্রতুল। তার সঙ্গে সঙ্গে আনুষঙ্গিক ভোগান্তিও রয়েছে। বেডের সিরিয়াল, পরীক্ষার সিরিয়ালের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে চারপাশ থেকে দালালের খপ্পরে পড়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন

এদিকে বেসরকারি হাসপাতালের দৈনিক খরচের হিসাব তাদের মধ্যে অনেকটা রক্তক্ষরণই ঘটায়। অভিভাবক রোগের জটিল অবস্থাটা মানতে রাজি হন না। অর্থনৈতিক অবস্থা, স্বাস্থ্য বা সুস্থতার ধারণার অভাব, চিকিৎসক, চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর অবিশ্বাস-এই বিষয়গুলো এখানে কাজ করে। চিকিৎসকের কাছে তারা অনুরোধ করেন চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি পাঠাতে, তারা বাড়িতে রেখে বা বাড়ি থেকে এসে-গিয়ে চিকিৎসা নিতে চান। মুমূর্ষু শিশুর ক্ষেত্রে তদবিরও করতে শোনা যায় যে, তারা টাকা-পয়সা জোগাড় করে এসে ভর্তি হবেন; আপাতত ডাক্তার যেন ওষুধ লিখে দেন। প্রায় ক্ষেত্রে চিকিৎসকের সঙ্গে খরচ নিয়ে দেনদরবার করেন। তাদের জানার কথা নয় যে চিকিৎসক হাসপাতালের মালিক নন। চিকিৎসক বড়জোর সুপারিশ করতে পারেন। ভর্তিযোগ্য শিশুকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া যে সম্ভব নয়, সেটা তারা বুঝতে পারেন না বা অনেক সময় বুঝতে চান না। কারণ, সরকারি-বেসরকারি যে হাসপাতালই হোক, শিশুর ভর্তির কারণে পুরো পরিবারকে জড়িয়ে যেতে হয়। নিরুপায় অবস্থায় যখন ভর্তি হন, তখন দিন গেলেই তাদের অস্থিরতা বাড়ে। রোগের উন্নতি বা আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে অসন্তুষ্টি শুরু হয়, চিকিৎসা শেষ না হতেই চিকিৎসকের কাছে ছুটির তদবির শুরু করেন। সব মিলিয়ে চিকিৎসকের ওপর ক্ষোভ তৈরি হয়, দূরত্ব বাড়ে। একটু উন্নতি হতে-না-হতেই তারা নিজ দায়িত্বে ছুটি নেন চিকিৎসা সম্পূর্ণ না করেই। রোগ পুরোপুরি নির্মূল হয় না।

এ ধরনের অসুবিধা কমিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ। অথবা, অন্তত স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ চলমান রাখা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, জনসংখ্যার অনুপাতে চিকিৎসক কম। প্রতি এক হাজার জন মানুষ একজন চিকিৎসক ভাগে পান না। সরকারি চিকিৎসকের হিসাব ধরলে এই অনুপাত আরও কম। আবার অঞ্চলভেদে এই অনুপাতেরও অনেক তারতম্য হয়। শহর এলাকা আর শহরতলি বা গ্রাম, রাজধানী আর রাজধানীর বাইরে এই তারতম্য খুব লক্ষণীয়। দূরত্ব, খরচ এই বিষয়গুলো তো আছেই। এ ছাড়া শহর হয়ে উঠতে থাকা এলাকায় একটা বড় জনসংখ্যা অভিবাসিত। তাদের পারিবারিক জনবল নেই। ঢাকার নিকটবর্তী এলাকার কথাই যদি ধরা যায়; ধামরাই, সাভার এই দুটো উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র পুরো এলাকায় সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অধীন চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে। এসব হাসপাতালে দুপুর ২টা পর্যন্ত বহির্বিভাগে রোগী দেখা হয়, তারপর জরুরি সেবা চালু থাকে। অন্যদিকে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এখানে আসতে গেলে কয়েকটা যানবাহন পরিবর্তন করে পৌঁছাতে হয়। কাজেই বেশ প্রস্তুতি নিয়েই তাদের আসতে হয়। বাস, রিকশা বা অটোতে ভেঙে ভেঙে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে জনপ্রতি ভাড়া পড়ে যায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে একশ টাকার কাছাকাছি। সময়মতো পৌঁছে চিকিৎসা নেওয়া অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। পৌঁছাতে পারলেও অজস্র রোগীর ভিড়ে কখনো কখনো ডাক্তার না দেখিয়ে ফেরত যেতে হয়। ফলে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ আর কম থাকে না। জনসাধারণ এ ধরনের অভিজ্ঞতা পায় বলেই সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখান না, উপায়ও নেই তাদের। কারণ, কেউ কেউ দু-ঘণ্টা ছুটি নিয়ে আসেন। সময়মতো অফিসে না ঢুকতে পারলে বেতন কাটা যায়। হাসপাতালের কাছাকাছি যারা আছেন, তারা হয়তো কিছুটা সুবিধা পেয়ে থাকেন। এসব হাসপাতালে শিশু বিশেষজ্ঞের পদায়ন থাকলেও কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই, তাই ভর্তির প্রয়োজন হলে সবক্ষেত্রে তারা জোর দিতে পারেন না। ঢাকা অথবা এলাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে পাঠাতে হয়। এ ছাড়া শুধু দুটি হাসপাতাল এত বড় জনগোষ্ঠীর জন্য কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়।

বাস, রিকশা বা অটোতে ভেঙে ভেঙে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে জনপ্রতি ভাড়া পড়ে যায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে একশ টাকার কাছাকাছি। সময়মতো পৌঁছে চিকিৎসা নেওয়া অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। পৌঁছাতে পারলেও অজস্র রোগীর ভিড়ে কখনো কখনো ডাক্তার না দেখিয়ে ফেরত যেতে হয়। ফলে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ আর কম থাকে না।

বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলো কোনো কোনো এলাকায় বলা যায় প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আবার কোথাও-বা এলাকার পর এলাকা কোনো হাসপাতাল খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি কোনো চিকিৎসকও নয়। এ এলাকার আশপাশে বেসরকারি হাসপাতাল সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেশি। বড় বেসরকারি হাসপাতাল ৩টি। গণস্বাস্থ্য কমিউনিটি হাসপাতাল, নারী ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সরকারি হাসপাতালের তুলনায় চিকিৎসা খরচ স্বাভাবিকভাবেই অনেকটা বেশি। বহির্বিভাগে প্রতি ভিজিটে তুলনায় অনেক টাকা গুনতে হয়। পরীক্ষা করার খরচও বেশি। এত ব্যয়বহুল যোগাযোগ রক্ষা করে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা অসম্ভব বলা চলে। এর বাইরে রয়েছে ছোট-বড় ক্লিনিক। আর আছে, গলির ভেতরে ওষুধের দোকান, যারা প্রায় প্রত্যেকেই চিকিৎসা দেওয়ার নামে ওষুধ বিক্রি করে। হাতের কাছে রোগ উপশমের এ রকম সহজ রাস্তা থাকার পর অনেক দূরে অনেক খরচ করাটা অভিভাবকের কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। অনেকটা বেঁচেও যান। কারণ, ওষুধ আর চিকিৎসা এই দুটোর আকাশ-পাতাল পার্থক্য তাদের জানা নেই। হাসপাতালে যাওয়ার চেয়েও তুলনামূলক কম খরচে সহজলভ্য ফার্মেসি থেকে ওষুধ কেনা অনেকে সুবিধাজনক মনে করেন। সময়, খরচ দুটোই বাঁচে, যদিও এসব ওষুধের ব্যবহার দীর্ঘ মেয়াদে শিশুর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। প্রায় সময় তাদের হাতে দেখা যায় নাম না-জানা কোম্পানির ওষুধ। রোগ কঠিন হয়ে গেলে তারা নিজেদের ভাগ্যকে দোষারোপ করেন বা ওষুধের দোকানদার, চিকিৎসকদের দোষারোপ করেন। চিকিৎসাব্যবস্থার অব্যবস্থাপনার বিষয়টি তাদের জানা থাকার কথা নয়।

তুলনামূলক কম খরচে সহজলভ্য ফার্মেসি থেকে ওষুধ কেনা অনেকে সুবিধাজনক মনে করেন। সময়, খরচ দুটোই বাঁচে, যদিও এসব ওষুধের ব্যবহার দীর্ঘ মেয়াদে শিশুর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। প্রায় সময় তাদের হাতে দেখা যায় নাম না-জানা কোম্পানির ওষুধ। রোগ কঠিন হয়ে গেলে তারা নিজেদের ভাগ্যকে দোষারোপ করেন বা ওষুধের দোকানদার, চিকিৎসকদের দোষারোপ করেন। চিকিৎসাব্যবস্থার অব্যবস্থাপনার বিষয়টি তাদের জানা থাকার কথা নয়।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, লক্ষণের সাময়িক উন্নতি বা উপশম হলেই চিকিৎসা শেষ মনে করা হয়। চিকিৎসক আবার আসার উপদেশ দিলেও রোগী আর আসে না। মা-বাবাও অনেক ক্ষেত্রে বোঝেন না, বোঝার উপায়ও থাকে না। পরবর্তী সময়ে আবার অসুবিধা না হওয়া পর্যন্ত আর আসা সম্ভব হয় না। এ ধরনের একটি চিকিৎসা ব্যবস্থায় একটি শিশুর চিকিৎসা, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ যদি শিশুর অভিভাবকের দায়িত্ব হয় আর তার আয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে সব শিশু সমান চিকিৎসা পাবে না-এটা সহজ কথা। অভিভাবকরা তাদের ধারণানুযায়ী আয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে চিকিৎসা নেবেন বা নেবেন না, নিলে কোথায় নেবেন-তারাই ঠিক করবেন। তাহলে জনস্বাস্থ্য কেমন থাকবে, সেটি জনগণের ওপর নির্ভর করছে! এ পরিস্থিতিতে রোগের লক্ষণ উপশমই লক্ষ হয়ে যায়। রোগ নির্ণয়, রোগের কারণ নির্ধারণ, সম্পূর্ণ চিকিৎসা হয়ে ওঠে না প্রায় ক্ষেত্রে। আনুষঙ্গিক অসুবিধাগুলো রয়েই যায়। এই শিশুরা বারবার ফিরে আসে। তার ওপর যথেচ্ছভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার শুধু শিশুস্বাস্থ্য নয়; জনস্বাস্থ্যের ওপর ভয়ংকর প্রভাব ফেলছে। জীবাণুর অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যা বাড়তে দিলে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়বে। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, এই জীবাণু শুধু এই মানুষগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আসলে এই জীবাণুগুলো শক্তিশালী হয়ে ছড়িয়ে যাবে, যার ফলে বিশেষায়িত হাসপাতালেও কার্যকরী অ্যান্টিবায়োটিকের অভাব দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে নষ্ট করে শিশুদের প্রতিনিয়ত জীবাণু আক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। অনেক দাম দিয়ে এসব ওষুধ একটার পর একটা কিনে রোগ সারাতে গিয়ে খরচের সাশ্রয় করার যে চেষ্টা করা হয়, প্রায়ই সেটা অপচয়ে পরিণত হয়, ভোগান্তি বাড়ে। পরিবারে অর্থনৈতিক, মানসিক চাপ বাড়ে, শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

যেসব কারণে অভিভাবকরা শিশুর জন্য চিকিৎসা নেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সেগুলো প্রতিরোধযোগ্য। রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে পুষ্টি খুব গুরুত্বপূর্ণ আর অপরিহার্য বিষয়। জন্মের পর বুকের দুধই শিশুর প্রথম খাদ্য, প্রথম প্রতিষেধক, যা শিশুকে দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা দেয়। ছয় মাস বয়স পর্যন্ত এক ফোঁটা পানিরও প্রয়োজন নেই। কিন্তু পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণে প্রাকৃতিক এই অধিকার থেকে শিশু বঞ্চিত হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে দুধ, জ্বালানি, অপুষ্টিজনিত চিকিৎসা খরচ, পারিবারিক চাপ। বুকের দুধ থেকেই শিশুর সম্পূর্ণ পুষ্টি পাওয়ার জন্য অবশ্যই মায়ের পুষ্টি, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিশ্চিত করা একটি শর্ত। ছয় মাস বয়সের পর থেকে বুকের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য পারিবারিক খাবার ধীরে ধীরে যুক্ত করতে হয়। কারণ, এই সময় থেকে শিশুর বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রয়োজনীয় প্রোটিন, আয়রন ইত্যাদির চাহিদা বাড়তে থাকে, যা শুধু বুকের দুধ পূরণ করতে পারে না। এ জন্য পরিবারে তেমন কোনো আলাদা খরচ যোগ হয় না। যদিও পারিবারিক খাবারের পরিবর্তে এখন পর্যন্ত জায়গা করে নিচ্ছে সুজি, গরুর দুধ, সেরেলাক, এমনকি ছাগলের দুধ পর্যন্ত। অনেক মা বা পরিবারের সদস্যরা হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকর্মী বা টেলিভিশনের মাধ্যমে এ তথ্যগুলো শুনে থাকেন এবং জানেন, কিন্তু চর্চা করেন না। আসলে বিভিন্ন কারণে করতে পারেন না। যেমন: মায়ের চাকরি, ছুটির সমস্যা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি বিষয়ে ভুল ধারণা (বিশেষত, দুধ না পাওয়া বা কম পাওয়ার ধারণা), পরিবারের মুরুব্বিদের মতামত ও কুসংস্কার, বহুদিন ধরে চলে আসা অভ্যাস। মায়ের অপুষ্টি, শারীরিক ও মানসিক বিশ্রামের অভাব, সংসারের কাজের চাপ‒এগুলো পরোক্ষ ভূমিকা রাখে। এ ছাড়াও শুধু শিশুর স্বাস্থ্য হওয়া বা ওজন বাড়ানোর চিন্তা থেকেও অনেকে খাওয়ান।

জন্মের পর বুকের দুধই শিশুর প্রথম খাদ্য, প্রথম প্রতিষেধক, যা শিশুকে দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা দেয়। ছয় মাস বয়স পর্যন্ত এক ফোঁটা পানিরও প্রয়োজন নেই। কিন্তু পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণে প্রাকৃতিক এই অধিকার থেকে শিশু বঞ্চিত হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে দুধ, জ্বালানি, অপুষ্টিজনিত চিকিৎসা খরচ, পারিবারিক চাপ।

কৌটার দুধ, সেরেলাক–এসব শিশুখাদ্য কিনতে কোনো প্রেসক্রিপশন লাগে না, তা ছাড়া এটা যে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার মতো একটা বিষয়, তা বহুজনের ধারণায় নেই। থাকার কথাও নয়। কারণ, অন্যান্য পণ্যের মতোই এগুলো মুদি দোকানে পাওয়া যায়। যদিও কৌটার দুধ বা অন্যান্য শিশুখাদ্যের ব্যবহার-বিক্রি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা আছে। মোটামুটি পুষ্টি নিশ্চিত করতে গেলে এক প্যাকেট শিশুখাদ্যে বয়সভেদে ৪-৫ দিনের বেশি যাওয়ার কথা নয়। আয়-ব্যয়ের সমন্বয় করতে না পেরে, বা শিশুর হজম না হওয়ার চিন্তায় তারা একসময় পানি মিশিয়ে পাতলা করে খাওয়াতে শুরু করেন। শিশু আর একটু বড় হলে তার পেট ভরানোর জন্য সঙ্গে মেশানো হয় সুজি, সাগু, চালের গুঁড়া। তার সঙ্গে যোগ হয় পরিচ্ছন্নতা জ্ঞানের অভাব, সুবিধাবঞ্চিত জীবনযাপনের প্রভাব। দুঃখজনক যে এখন পর্যন্ত দু-মাস বয়সি শিশুরাও আসে যারা গরুর দুধ, সুজি, কখনো-বা শুধু সুজি, লবণ বা মিছরি দিয়ে খায়। মিলিত ফল? অপুষ্টি আর জীবাণু সংক্রমণ। আবারও ওষুধ, চিকিৎসা খরচের দুষ্টচক্র। এই ছবি রাজধানী শহর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে।

শিশুর বিকাশ আর শরীরবৃত্তীয় সাম্য রক্ষা করার জন্য সুষম খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের অভিভাবকদের সাধারণ অভিযোগ, শিশু খেতে চায় না। শিক্ষা, অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে মনস্তাত্ত্বিক-সামাজিক কিছু বিষয় এখানে সম্পর্কিত। বিভিন্ন বিজ্ঞাপন এই মনস্তত্ত্বকে জোরদার করে। খুব ছোট শিশুর বেলায় মা বা পরিবারের লোকজন তার চাহিদার ধরন না-বুঝেই প্রচলিত বোধ-বুদ্ধি অনুযায়ী খাওয়াতে চেষ্টা করেন। স্বাস্থ্য বলতে বেশি ওজনের ধারণা প্রচলিত থাকায় মা-বাবা একটা মানসিক চাপে ভোগেন। ফলে শিশুর ওজন-উচ্চতা-পুষ্টি ঠিক থাকার পরও তারা সন্তুষ্ট হতে পারেন না। কাজেই খাবার খাওয়ানোর জন্য জোরাজুরি, চিকিৎসা চলতে থাকে। শিশু যখন একটু বড় হয়, তখন দেখা যায় শিশুটি চিপস, জুস, কেক এসব টুকিটাকি সহজলভ্য খাবার খেয়ে নেয়। অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবা বাসায় থাকেন না, তারা তার ক্ষতিপূরণ হিসেবেও শিশুর হাতে টাকা দিয়ে যেতে চান বা বাধ্য হয়ে দেন। এর বাইরে দীর্ঘসময় মাদ্রাসায় বা স্কুলে থাকা, বাসস্থানের চারপাশের দোকান, রঙিন প্যাকেটের আকর্ষণ, টেলিভিশনে এসব খাবারের বিজ্ঞাপনের মতো বিষয়গুলো তো আছেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মা-বাবা পুষ্টিকর খাবার জোগাড় করতে না পারলেও ১০-২০ টাকার প্যাকেট দিয়ে খুশি করতে চেষ্টা করেন। এসব খাবারে ব্যবহৃত উপাদানের মান নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। এগুলো শিশুর পেট ভরিয়ে দেয়, ক্ষুধা নষ্ট করে, ঘরের খাবারের প্রতি আকর্ষণ কমিয়ে দেয়।

শিশু যখন একটু বড় হয়, তখন দেখা যায় শিশুটি চিপস, জুস, কেক এসব টুকিটাকি সহজলভ্য খাবার খেয়ে নেয়। অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবা বাসায় থাকেন না, তারা তার ক্ষতিপূরণ হিসেবেও শিশুর হাতে টাকা দিয়ে যেতে চান বা বাধ্য হয়ে দেন। এর বাইরে দীর্ঘসময় মাদ্রাসায় বা স্কুলে থাকা, বাসস্থানের চারপাশের দোকান, রঙিন প্যাকেটের আকর্ষণ, টেলিভিশনে এসব খাবারের বিজ্ঞাপনের মতো বিষয়গুলো তো আছেই।

আপাতদৃষ্টিতে শিশুর ওজনের তেমন তারতম্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে না হলেও প্রক্রিয়াজাত এসব খাবার প্রাকৃতিক পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি তৈরি করে। রক্তস্বল্পতা, কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো উপসর্গ দেখা দেয়। শুরু হয় অরুচি আর পেটের অসুবিধার চিকিৎসার জন্য যাওয়া-আসা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, খরচ। ভালো থাকা আর ভালো রাখার দৈনন্দিন পরিশ্রম, চেষ্টা বিপর্যস্ত হতে থাকে। খাবার অরুচির সঙ্গে আর একটি বিশেষ দিক খেয়াল করা যেতে পারে। শিশুর সঙ্গে তার মা-বাবার যোগাযোগ খুব সামান্য সময়। সারা দিন শিশুর মনোজগতের কোনো খবর না-জেনেই দিনশেষে তারা তাদের পছন্দমতো স্বাস্থ্যবান শিশু দেখতে চান। স্কুলে বা মাদ্রাসায়, পরিবারে বা চারপাশ থেকে কী ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়, এই খবর বিশেষ কারো কাছে পাওয়া যায় না। কোনো কোনো শিশুর ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো মানসিক চাপ বা মানসিক সাহচর্য ও আদান-প্রদানের ঘাটতি‒এসবেরই বহিঃপ্রকাশ হতে পারে অরুচি বা কোষ্ঠকাঠিন্য। ছুটির দিনে শিশুর যত্নের অংশ হিসেবে মা-বাবা চিকিৎসক, ফার্মেসির ডাক্তারদের কাছে যান রুচির ওষুধ আনতে। যদিও সত্যিকার অর্থে রুচির ওষুধ বলে জানামতে কিছু নেই। রক্ত কম থাকা, আয়রন বা অন্যান্য খনিজের ঘাটতি সাধারণ ঘটনা। ওষুধ দিয়ে ঘাটতি পূরণ হলে খাওয়ার আগ্রহ কিছুটা বাড়ে, তাই বলে আয়রনকে বা ভিটামিনকে কোনোভাবে রুচির ওষুধ বলা যাবে না। কিন্তু যেভাবেই হোক, এই ধারণা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। রুচি বাড়ার পর প্যাকেটের খাবারের জোগানের কমতি হয় না। চিকিৎসকের কাছে গেলে দু-একবার পুষ্টি পরামর্শ অভিভাবকরা শুনতে পান, কিন্তু প্রতিদিন-মাস-বছরব্যাপী চারপাশে পুষ্টির নামে অপুষ্টিকর খাবারের বিজ্ঞাপন বিপণনের পরিপ্রেক্ষিতে তাল সামলানো সহজ কথা নয়। তা ছাড়া কমপক্ষে যতটুক প্রোটিন, আয়রনের জোগান দরকার, ততটুকু প্রাণিজ খাবারের ব্যবস্থা প্রায় পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য নিয়মিত করে উঠতে পারে বলে মনে হয় না। কাজেই অরুচির চক্র চলতে থাকে আর রুচির ওষুধের বিক্রি ব্যবহার বাড়ে। অন্যদিকে এই শিশুরা শারীরিক-মানসিক দুদিকেই পিছিয়ে পড়তে থাকে।

শিশুস্বাস্থ্যকে শিশুর জন্মকালীন সময়, মায়ের স্বাস্থ্য এগুলো থেকে আলাদা করা যায় না। কারণ, তার জীবন শুরু গর্ভকালীন থেকে। এ সময় থেকে শুরু করে জন্মের পর প্রথম ২ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা শিশুর পরবর্তী বিকাশে প্রভাব ফেলে। মায়ের বয়স এবং স্বাস্থ্য, জন্মকালীন জটিলতা‒এসবের প্রভাব তাকে বহন করতে হয়, সেটা কখনো কখনো সারা জীবনের জন্য। মায়ের পুষ্টি, গর্ভকালীন যত্ন, শিশু জন্মকালীন জটিলতার হার কমানোর বিষয়গুলো নিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কার্যক্রমের ফলে নবজাতক ও শিশুমৃত্যুর হার, মাতৃমৃত্যুর হার পরিসংখ্যান অনুযায়ী ‘নিম্নগামী’। কিন্তু এখন পর্যন্ত শতকরা ৫০ ভাগের বেশি ডেলিভারি বাড়িতে হয়। গর্ভকালীন প্রয়োজনীয় সেবার মধ্যে সর্বনিম্ন চারবার অন্তত সেবা পান বা নিতে পারেন এ রকম মায়ের সংখ্যা অঞ্চলভেদে যথেষ্ট তারতম্য রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে এ হার শতকরা ৩০ ভাগেরও কম। গর্ভকালীন পুষ্টিও অনিশ্চিত।

এখন পর্যন্ত শতকরা ৫০ ভাগের বেশি ডেলিভারি বাড়িতে হয়। গর্ভকালীন প্রয়োজনীয় সেবার মধ্যে সর্বনিম্ন চারবার অন্তত সেবা পান বা নিতে পারেন এ রকম মায়ের সংখ্যা অঞ্চলভেদে যথেষ্ট তারতম্য রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে এ হার শতকরা ৩০ ভাগেরও কম। গর্ভকালীন পুষ্টিও অনিশ্চিত।

মায়ের পুষ্টি বিষয়ে স্বাস্থ্যকর্মী বা চিকিৎসকের কাছে যতটুকু তথ্য পান, তার চেয়ে আত্মীয়স্বজন-মুরুব্বিদের জ্ঞানই বেশি গুরুত্ব পায়। পুষ্টিকর খাবার খেলে বাচ্চা বড় হয়ে যাবে, নরমাল ডেলিভারি হবে না-এটি এখন পর্যন্ত একটি প্রচলিত বিশ্বাস। এ ছাড়া সামাজিক অভ্যাসমতো নারীদের পুষ্টি এমনিতেই অবহেলিত। পরিবারে অধিকারের দিক থেকে নারী সবার শেষে থাকেন আর সুবিধাবঞ্চিত সমাজে যেখানে পুষ্টির জোগানই কম, সেখানে তো কথাই নেই। এরপর রয়েছে অল্পবয়সি মা। অভাব আর সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার চেষ্টা ছাড়া তেমন কোনো পথ তৈরি হয়নি আজও। শিশুকাল পার করতে-না-করতে বা পার করার আগেই শিশু জন্ম দেওয়ার পর্বে ঢুকে পড়ে এই অপরিণত মায়েরা। সচেতনতার অভাব, পর্যাপ্ত সুযোগের অপ্রতুলতা আর অর্থনৈতিক অবস্থার চলমান চক্রে গর্ভকালীন চেকআপ তেমন গুরুত্ব পায় না। এ ধরনের জনগোষ্ঠীতে কেউ কেউ একটা আলট্রাসনো পরীক্ষা করেই সন্তুষ্টি পান। কেউবা কিছু চেকআপ করলেও ডেলিভারি হওয়ার সময় গ্রামে নিজেদের বাড়িতে চলে যান আবার কেউ অভিবাসিত বাড়িতেই ডেলিভারি করেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দাই, নার্স, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণবিহীন দাইরাও সামান্য উপহারের বিনিময়ে ডেলিভারি করতে সাহায্য করেন। এর সঙ্গে আছে কুসংস্কার আর অস্বাস্থ্যকর জীবনচর্চা। যেখানে নবজাতকের চিকিৎসার সুযোগ সীমিত ও ব্যয়বহুল, সেখানে উল্লিখিত কারণে জন্ম-পরবর্তী বিভিন্ন সমস্যা, মারাত্মক জীবাণু সংক্রমণ, নির্দিষ্ট সময়ের আগে জন্ম নেওয়া কম ওজনের শিশু এমনিতেই বিভিন্নভাবে ভারাক্রান্ত পরিবারের ওপর দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা খরচের বোঝা বাড়ায়।

বর্তমানে বাংলাদেশে চিকিৎসা ক্ষেত্রে অগ্রগতি যে হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সেই অগ্রগতির অংশ হিসেবে শিশু-চিকিৎসাও থেমে নেই। নবজাতকের চিকিৎসা, হৃদ্‌রোগসহ বিভিন্ন জন্মগত রোগের চিকিৎসা, শিশুদের ক্যানসার ও বিভিন্ন রক্তরোগ, কিডনি রোগ, নিউরোলজিক্যাল সমস্যা; প্রতিটা ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা দেশেই সম্ভব। সরকারি-বেসরকারি দুই ক্ষেত্রেই শিশুরোগের বিশেষ বিভাগগুলোয় উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। প্রয়োজনের তুলনায় কম হলেও, অবকাঠামোগত দুর্বলতা সত্ত্বেও তারা এসব বিশেষায়িত চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছেন। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরির প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন। বিশেষায়িত চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা, সম্প্রসারণ আর অগ্রগতি কোনোটাকেই কম গুরুত্ব দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, এসব রোগের চিকিৎসা বিদেশে গিয়ে নেওয়ার মতো সক্ষমতা রয়েছে মুষ্টিমেয় সংখ্যক পরিবারের। দেশেই এই সুযোগগুলো সৃষ্টির ফলে অনেক শিশুই কম খরচে চিকিৎসা করে সুস্থ জীবন পাচ্ছে আর এসব সুযোগ আরও বেশি প্রসারের প্রয়োজন আছে। কিন্তু চিকিৎসাক্ষেত্রে উন্নতি বলতে শুধু বিশেষায়িত চিকিৎসার উন্নতি বা অগ্রগতি যদি ধরা হয়, তাহলে সেটি হবে আংশিক সত্য। বিশেষ চিকিৎসা বিশেষ অবস্থার জন্য। প্রশ্ন হলো: সাধারণের চিকিৎসার কী অবস্থা, অর্থাৎ চিকিৎসা ব্যবস্থার সুযোগ আর প্রাপ্যতা কেমন? বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, সেখানে দৈনন্দিন যেসব অসুস্থতা, তার জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা কতটুকু পর্যাপ্ত? পর্যাপ্ত ব্যবস্থা বা সুযোগ সব শিশুর নাগালে আছে কি? তারা সেটা পাচ্ছে কি না বা নিচ্ছে কি না? না পেলে কেন পাচ্ছে না? স্বাস্থ্য বিষয়ে সাধারণ মানুষের ধারণা বা কীভাবে সর্বসাধারণ তাদের শিশুদের স্বাস্থ্যগত সমস্যার সমাধান করছে? ঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা না করতে পারা বা না পাওয়ার ফলে অদূর ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যব্যবস্থা আরও জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে কি না? স্বাস্থ্য পুষ্টির সঙ্গে শিক্ষা, অর্থনৈতিক অবস্থা, অন্যান্য সামাজিক সমস্যাগুলোর সম্পৃক্ততা কিরকম?

বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, সেখানে দৈনন্দিন যেসব অসুস্থতা, তার জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা কতটুকু পর্যাপ্ত? পর্যাপ্ত ব্যবস্থা বা সুযোগ সব শিশুর নাগালে আছে কি? তারা সেটা পাচ্ছে কি না বা নিচ্ছে কি না? না পেলে কেন পাচ্ছে না?

জনসাধারণের নাগালের মধ্যে চিকিৎসা সুযোগ পৌঁছানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা না হলে শুধু অবাধে ওষুধ বিক্রি বন্ধ করার চেষ্টা যেমন সফল হবে না, তেমনি গলির ভেতর বিনা অনুমতিতে ইচ্ছামতো ওষুধের দোকান চলতে দিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বললেও খুব কাজের হবে না। শিশুরা অন্যের ওপর নির্ভরশীল। মা-বাবা জীবিকার জালে আটকে পড়া, যাদের সারা দিন গিয়ে রাত আসে পরের দিনের চাকরির সময়ের প্রস্তুতির জন্য অথবা যেসব এলাকা থেকে হাসপাতালে আসতে বড় ধরনের প্রস্তুতি প্রয়োজন, সেসব ক্ষেত্রে সময়, খরচ বাঁচাতে বাসার পাশের দোকানেই শিশুর প্রাথমিক চিকিৎসা হবে-এটাই স্বাভাবিক। পরিবার ও সমাজে শিশুর পুষ্টি, বুকের দুধ খাওয়ানোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য ও জ্ঞান দিয়ে জনসচেতনতা তৈরি করার কাজগুলো সরকারি-বেসরকারি অনেক সংস্থা করে যাচ্ছে। কিন্তু অবাধে শিশুখাদ্য বাজারজাতকরণ ও বিক্রি বন্ধ না করে, মায়ের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত না করে, মায়ের পুষ্টি, বিশ্রাম নিশ্চিত না করে সচেতনতা বৃদ্ধির ফল আশানুরূপ হওয়ার কথা নয়। বাকি শর্তগুলো পূরণ না করে যদি শুধু শিশুখাদ্য বন্ধ করা হয়, সে ক্ষেত্রেও গরু, ছাগলের দুধ সহজলভ্য আছেই। শিশু বড় হওয়ার পর চারপাশে রঙিন মোড়কের আয়োজন রেখে দিয়ে; চিপস, কেক, ফলের জুসের নামে হরেক রকম কোম্পানির পণ্য খাদ্য হিসেবে বিনা বাধায় বিক্রি অব্যাহত রেখে মাকে পুষ্টি পরামর্শ দিলে কতটা ফলপ্রসূ হতে পারে, ভাবার বিষয়। আবার পুষ্টি পরামর্শ পাওয়ার পর ন্যূনতম পুষ্টির জোগাড় করার সামর্থ্য যদি না থাকে, সেই পরামর্শ প্রহসন হয়ে দাঁড়ায়। রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা না গেলে চিকিৎসক ও হাসপাতালের ওপর চাপ বাড়তে বাধ্য। শিক্ষার প্রাথমিক ভিত্তি না থাকলে যেকোনো বিষয়ে যতই তথ্যজ্ঞান দেওয়া হোক, সেটা ঠিকমতো নেওয়ার এবং সেইমতো কাজ করার বোধ তৈরি হয় না। কাজেই শৈশব থেকেই স্বাস্থ্যবিষয়ক পাঠ দরকার। এখানে আবার প্রশ্ন চলে আসে: কতভাগ শিশু প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করা পর্যন্ত স্কুলে যেতে পারে? পারলেও সব শিশু একই ধরনের শিক্ষা পায় কি না? প্রতিটা শর্ত পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। কেবল চিকিৎসাব্যবস্থায় আংশিক রদবদল সার্বিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট নয়।

বনানী চক্রবর্তী: শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। ইমেইল: cbanani24@gmail.com

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •