সম্পাদকীয় ভূমিকা

সম্পাদকীয় ভূমিকা

বিভিন্ন দিক থেকে বাংলাদেশে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। সরকারের হিসাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা যখন চাহিদার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ তখন চলছে মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিং। সরকার যখন বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মেগাপ্রকল্প নিয়ে ধুমধাম করছে তখন ঋণের দায় দৈত্যের মতো ফুলছে আর এগিয়ে আসছে। পাশাপাশি অন্যান্য পন্থার সাথে সাথে আমদানি ও রপ্তানির আড়ালে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হবার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার অভূতপূর্ব সংকট তৈরি হয়েছে।

জিনিষপত্রের অবিরাম দামবৃদ্ধিতে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। জিনিসপত্রের দাম গত একবছরে কোনো কোনোটি ৩০ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অথচ নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠী ছাড়া কারও আয় বাড়ে নাই। কৃষকদের ফসলের যথাযথ দাম নাই, গার্মেন্টসসহ শ্রমিকদের মজুরি আগের নিম্ন মাত্রাতেই আটকে আছে, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে। এরমধ্যে মানুষ টিকে থাকার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করছে। অনিয়মিত অনিশ্চিত নানাকাজ, পরিবারের সদস্যদের সকলের আয় উপার্জনের চেষ্টা, ব্যয় কমাতে গিয়ে খাদ্য সংকোচন, চিকিৎসা স্থগিত রাখা, শিক্ষা থেকে সন্তানদের ঝড়ে পড়া এর অন্যতম।

উচ্চ বেকারত্বকালে দেশে ইজিবাইক, রিকশা কর্মসংস্থানের একটি উন্মুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে। ৫০ লক্ষাধিক মানুষ এখন এই পেশায় যুক্ত যাদের মধ্যে পাটকল, চিনিকল, গামেন্টসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে ছাঁটাই হওয়া মানুষেরা আছে, কিংবা অনেকেই অতিরিক্ত কাজ হিসেবে এগুলোর মাধ্যমে টিকে থাকতে চেষ্টা করছে। তাদের ওপরও সরকারের বৈরী ভূমিকায় ধরপাকড়, নির্যাতন, চাঁদাবাজী চলছে। এই সংখ্যার একটি লেখায় এ বিষয়ে তথ্যপ্রমাণসহ বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।    

সাম্প্রতিক ভয়াবহ মাত্রার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট বিশ্লেষণ করে এর কারণ পাওয়া যায় দেশের ভেতরেই। দেশ বিদেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে ব্যাবসা দেয়া বা তাদের খুশি করতে সুলভ, নিরাপদ, স্বনির্ভর পথ বর্জন করে সরকারের ব্যয়বহুল ঋণনির্ভর পরনির্ভর প্রাণ প্রকৃতি বিনাশী বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণের নীতি থেকেই এই সংকটের উৎপত্তি। এই ধারাতেই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ভারত, চীন, রাশিয়া, জাপান ও মার্কিন বিভিন্ন কোম্পানি নির্ভর নানা প্রকল্প। এই সংখ্যার একটি লেখায় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভারত নির্ভর কিছু প্রকল্প পরীক্ষা করে তার যৌক্তিকতা ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব  আলোচনা করা হয়েছে।     

একটি দেশে সর্বজনের চিকিৎসা ব্যবস্থা যদি কার্যকর না থাকে, যদি কর্মস্থল মা-বান্ধব না হয়, যদি শিশু যত্ন কেন্দ্রের মতো প্রাথমিক সুবিধাগুলোও না থাকে, যদি দেশে বাল্যবিবাহ অব্যাহত থাকার সামাজিক শর্ত অব্যাহত থাকে, যদি মজুরি মাত্রা দারিদ্রসীমা থেকেও অনেক কম থাকে, দুজন কাজ করেও যদি নিম্নতম নিরাপত্তা না পাওয়া যায়, অসুখ তৈরির উৎস যদি থাকে চারদিকে, নিরাপদ খাদ্যের বদলে যদি দূষিত খাবার-পানীয়ের রমরমা বাণিজ্য থাকে তাহলে কী পরিস্থিতি তৈরি হয় তারই একটি খন্ড চিত্র পাওয়া যাবে এই সংখ্যায়- একজন সংবেদনশীল চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণে।  

এ সংখ্যা থেকে শুরু হচ্ছে তারিক আলি  লিখিত বই The Clash of Fundamentalisms: Crusades, Jihads and Modernity  এর ধারাবাহিক অনুবাদ। এছাড়া ইন্টারনেট যুগে কর্তৃত্ববাদ, ২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান, সিপি গ্যাং-এর ‘বেশ্যা’ ব্যানার-১২, খুলনায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস-এর ধারাবাহিক পর্বগুলো এবারেও প্রকাশিত হলো। রোজা লুক্সেমবার্গ নিয়ে দ্বিতীয় পর্বে তাঁর প্রধান গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা থাকলো। ভারতে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী রাজনীতি নিয়ে অরুন্ধতি রায় এবং উন্নয়নের বিভিন্ন মডেল নিয়ে শ্রীলঙ্কার বিমল রত্নায়েক এর রচনার অনুবাদ প্রকাশিত হলো। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী খাদ্য, জ্বালানিসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর যোগান সংকট নিয়ে সংক্ষিপ্ত একটি পর্যালোচনার অনুবাদও প্রকাশিত হলো এই সংখ্যায়। চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনায় দুটো নতুন নির্মাণ নতুন চিন্তার খবর থাকছে।   

দেশে মতপ্রকাশ, লেখালেখি, শিক্ষকতার উপর প্রবল হুমকি হামলা অব্যাহত আছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বর্ম দিয়ে ছাত্রলীগ ও পুলিশবাহিনীর যৌথ আক্রমণের কোনো কমতি নেই। সভাসমাবেশে হামলা করে আক্রান্তদের বিরুদ্ধেই মামলা ধরপাকড়ের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনাও ঘটছে একাধারে। ছাত্রলীগের ত্রাস নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও কীভাবে বিপন্ন করছে, আইন কীভাবে লুটেরা কোটিপতিদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে তা এ সংখ্যায় প্রকাশিত দুটো বিবৃতি থেকে বোঝা যাবে। এই দুটো বিবৃতি দিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট (নারী) লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকর্মী ও সংগঠকবৃন্দ। ভারতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফর ও কতিপয় চুক্তি নিয়ে সর্বজনকথা আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের মূল বক্তব্যও এই সংখ্যায় যুক্ত করা হলো।

অনলাইন সংস্করণে আরও থাকলো কয়েক মাসের গুরুত্বপূর্ণ খবরাখবর।

আনু মুহাম্মদ

২৫শে অক্টোবর ২০২২

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •