গরিবের ‘ইজিবাইক-অর্থনীতি’ বনাম আইন-আদালত, সরকার ও গণমাধ্যম

গরিবের ‘ইজিবাইক-অর্থনীতি’ বনাম আইন-আদালত, সরকার ও গণমাধ্যম

মাহা মির্জা

বাংলাদেশে ইজিবাইক-ব্যাটারিচালিত রিকশা/অটোরিকশা গত কয়বছরে শহর গ্রামে একদিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সর্বজন পরিবহণে পরিণত হয়েছে অন্যদিকে তা চালক, মেকানিকসহ সম্পর্কিত বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৫০ লাখেরও বেশি মানুষের কাজের সংস্থান করেছে। প্রথমে আমদানি দিয়ে শুরু হলেও ক্রমে তা সম্প্রসারণশীল দেশি শিল্প হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া পায়ে টানা রিকশা তার সাথে ব্যাটারী সংযোজন করে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। একইসাথে এসব বাহনের কাঠামোগত দুর্বলতা চিহ্নিত করে ক্রমে প্রযুক্তিগত বিকাশও ঘটেছে স্থানীয় মেকানিক প্রযুক্তিবিদদের হাত ধরেই। কিন্তু মহাসড়কে এসব পরিবহণ যাবার বিকল্প না থাকলেও সেখানে সার্ভিস রোড না থাকা, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পরিকল্পিত প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সমর্থন না দেয়া, দেশিয় শিল্পের বিকাশ ও বিশাল কর্মসংস্থানের এই ক্ষেত্রকে গুরুত্ব দিয়ে বিকশিত করার বদলে রাষ্ট্রীয় জোরজুলুম কয়েক কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকাকে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। এই জোরজুলুমে বৈধতা দিচ্ছে সংবাদ মাধ্যম ও গোষ্ঠীস্বার্থে পরিচালিত আইন আদালত। এই লেখা এই বিষয়ের অধিকতর বিশ্লেষণ করেছে।

গাজীপুরের টিএন্ডটির মাঠটি এখন ইজিবাইক-ব্যাটারিচালিত রিকশা ধরপাকড়ের এক বিশাল গোডাউনে পরিণত হয়েছে। তিনটি মাঠ মিলিয়ে আটক করে রাখা হয়েছে প্রায় ছয় হাজার ইঞ্জিনচালিত রিকশা আর ইজিবাইক। অর্থাৎ, ছয় হাজার রিকশাচালক, ভ্যানচালক আর ইজিবাইকচালকের কয়েক মাস ধরে কোনো রোজগার নেই। অতিরিক্ত যানজটের কারণে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ নাকি এই ধরপাকড় করেছে। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে গাড়ি ছাড়াতে মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, গরিব মানুষের ওপর ঘটে যাওয়া এই অন্যায়গুলোকে তুলে না ধরে, গণমাধ্যম বরাবরই এই ধরপাকড় অভিযানকে সমর্থন জোগাচ্ছে। অথচ ইজিবাইকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা মিডিয়া এই প্রশ্ন ভুলেও করছে না যে, যারা এসব ইজিবাইকের পার্টস আমদানি করছে, তাদের ধরপাকড় হয় না কেন? সারা দেশের বিলাসবহুল শোরুমগুলোতে দেদার ইজিবাইকের পার্টস বিক্রি হচ্ছে, অথচ সেখানে নিষেধাজ্ঞা নেই কেন? তাদের সঙ্গে প্রশাসনের বোঝাপড়াটা কী? এ বিষয়ে গণমাধ্যম চুপচাপ।

অথচ ইজিবাইকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা মিডিয়া এই প্রশ্ন ভুলেও করছে না যে, যারা এসব ইজিবাইকের পার্টস আমদানি করছে, তাদের ধরপাকড় হয় না কেন? সারা দেশের বিলাসবহুল শোরুমগুলোতে দেদার ইজিবাইকের পার্টস বিক্রি হচ্ছে, অথচ সেখানে নিষেধাজ্ঞা নেই কেন? তাদের সঙ্গে প্রশাসনের বোঝাপড়াটা কী? এ বিষয়ে গণমাধ্যম চুপচাপ।

গণমাধ্যমের জরুরি কাজ‒পর্যবেক্ষণ করা, সমস্যার গভীরে যাওয়া, বিশ্লেষণ করা এবং অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলো ওঠানো। কিন্তু গত কয়েক বছরে ইজিবাইক প্রশ্নে বাংলাদেশের গণমাধ্যম নিয়ম করে ব্যাটারিচালিত সব বাহনকে রীতিমতো ‘ভিলেন’ বানানো শুরু করল। ইজিবাইকে যানজট হয়, ইজিবাইক বিদ্যুৎ ‘খায়’, ইজিবাইক অবৈধ। বিশেষজ্ঞদের বারবার চিহ্নিত করে দেওয়া যানজটের সুস্পষ্ট কাঠামোগত কারণগুলোকে এড়িয়ে, যানজটের প্রধান খলনায়ক হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো কাজ করে খেতে চাওয়া নিরীহ ইজিবাইকচালকদের।

বিশেষজ্ঞদের বারবার চিহ্নিত করে দেওয়া যানজটের সুস্পষ্ট কাঠামোগত কারণগুলোকে এড়িয়ে, যানজটের প্রধান খলনায়ক হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো কাজ করে খেতে চাওয়া নিরীহ ইজিবাইকচালকদের।

১০ বছর ধরে গাজীপুরের রাস্তাগুলোতে মেগা প্রকল্প নির্মাণের কাজ চলছে, ভয়াবহ যানজটে মানুষ অতিষ্ঠ, বিপর্যস্ত। তো, সেই মেগা প্রকল্পের মেগা জট লাগানোর দায়ও ছোট ইজিবাইকওয়ালার? বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের এক দশকের ভয়াবহ হরিলুটের বাস্তবতার ধারেকাছে দিয়ে না গিয়ে একজন অটোরিকশাওয়ালাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো ‘বিদ্যুৎখেকো’ হিসেবে। অর্থাৎ, ক্ষমতাবান কর্তৃপক্ষকে টোকাটি না দিয়ে ক্ষমতাহীন কাজ না-পাওয়া মানুষটির বিরুদ্ধে একের পর এক রায় দিয়ে গেল এ দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল। খেয়াল করুন, প্রভাবশালী পার্টস আমদানিকারকের বিরুদ্ধে নয়, বিলাসবহুল শোরুম ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে নয়, নতুন যে কোম্পানিটি প্রতি মাসে কয়েক হাজার করে ইজিবাইক বাজারে আনার ঘোষণা দিল, তার বিরুদ্ধেও নয়; সংবাদমাধ্যমের অবস্থান শুধু দরিদ্র চালকটির বিরুদ্ধে!

‘গণমাধ্যম’ যদি সত্যিকার অর্থেই গণমাধ্যম হতো, তাহলে ইজিবাইক প্রশ্নে তাদের ভূমিকা কেমন হতে পারত? ইজিবাইক বাড়ল কেন, সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল কেন, কারা কিনছে, কেন কিনছে, চাহিদা হঠাৎ বাড়ল কেন, স্থানীয় উৎপাদন হঠাৎ বাড়ল কেন, আমদানি হঠাৎ বাড়ল কেন, বিকল্প ছিল কি না‒এসব জরুরি অনুসন্ধানের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যেত বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরের এক নিদারুণ আর্থসামাজিক বাস্তবতা। গত এক দশকে ইজিবাইক বেড়ে যাওয়ার সেই বাস্তবতাকে খুঁজতে গিয়েই এ লেখার প্রয়াস।

আমদানি বৈধ, বিক্রি বৈধ, চালানো অবৈধ? 

বাংলাদেশে ইজিবাইকের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। অর্ধেক দেশে তৈরি হলে বাকি অর্ধেক কোত্থেকে আসে? শুধু গাজীপুরেই তিন সড়কের মোড় থেকে টাকশাল পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত শোরুম আছে। এমনকি সেনাকল্যাণ সংস্থার অধীন ‘ট্রাস্টের’ই একাধিক ইজিবাইকের শোরুম আছে এ রাস্তায়। আমদানিকারকদের পার্টস এবং সম্পূর্ণ ‘বডি’আমদানি করার অনূমোদন আছে। এতদিন ধরে আমদানি হয়েছে, বিক্রিও হয়েছে, অথচ গরিব তরুণ সেই একই জিনিস নিয়ে রাস্তায় নামলেই ধরপাকড়, জরিমানা, ডান্ডার বাড়ি?

বাংলাদেশে ইজিবাইকের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। অর্ধেক দেশে তৈরি হলে বাকি অর্ধেক কোত্থেকে আসে? শুধু গাজীপুরেই তিন সড়কের মোড় থেকে টাকশাল পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত শোরুম আছে। এমনকি সেনাকল্যাণ সংস্থার অধীন ‘ট্রাস্টের’ই একাধিক ইজিবাইকের শোরুম আছে এ রাস্তায়। আমদানিকারকদের পার্টস এবং সম্পূর্ণ ‘বডি’আমদানি করার অনূমোদন আছে। এতদিন ধরে আমদানি হয়েছে, বিক্রিও হয়েছে, অথচ গরিব তরুণ সেই একই জিনিস নিয়ে রাস্তায় নামলেই ধরপাকড়, জরিমানা, ডান্ডার বাড়ি?

গত বছর (২০২১) ১৫ ডিসেম্বর হাইকোর্ট থেকে রায় দেওয়া হয়েছিল‒ইজিবাইক অবৈধ। নির্দেশ এলো, সব অবৈধ থ্রি হুইলার এবং ইজিবাইক চিহ্নিত করে অপসারণ করতে হবে। তো, হাইকোর্টে এ রিট করল কে? অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, রিটটি করেছিল নতুন একটি ইজিবাইক কোম্পানি। সারা দেশে অ্যাসিড ব্যাটারিচালিত থ্রি হুইলার ও ইজিবাইকের চলাচল বন্ধে নির্দেশনা চেয়ে বাঘ ইকো মোটরস লিমিটেড নামের এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি কাজী জসিমুল ইসলাম ওই রিটটি করেন {রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আতিক তৌহিদুল ইসলাম। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশ গুপ্ত।}

যাই হোক, এ বছর এপ্রিলে আদালত আরেকটি রায় দিয়েছেন। রায়ে বলা হয়েছে: আমদানি বৈধ, কিন্তু ইজিবাইক মহাসড়কে চলতে পারবে না, চলতে পারবে শহরের মধ্যে, অলিগলিতে। এই পাল্টা রিট করল কে? এই রিট করল আমদানিকারক। তারা হাজার হাজার পার্টস আর বডি কিনে ফেলেছে, তাদের শোরুম আছে, খরচাপাতি আছে। বিক্রি বাড়ানোর পরিকল্পনাও আছে। তার মানে কী দাঁড়াল? নতুন ব্যবসায়ীর রিটে স্থানীয় ইজিবাইক অবৈধ। আর পুরোনো ব্যবসায়ীর রিটে আমদানি করা ইজিবাইক বৈধ। আর এতসব বৈধ-অবৈধর আইনি মারপ্যাঁচের মধ্যে পড়ে চল্লিশ লাখ ইজিবাইকচালকের কী বিশ্রী অপমান। খেটে খাওয়া তরুণকে চোরের মতো রাস্তায় গাড়ি বের করতে হয়। কিস্তির টাকায় কেনা গাড়ি মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে ছাড়াতে হয়।

চাহিদার চেয়ে ইজিবাইক বেশি?

জেলা শহরগুলোর জনসংখ্যা বেড়েছে, স্কুল-কলেজ, দোকানপাটের সংখ্যা বেড়েছে, গণপরিবহণ সীমিত; তাহলে ইজিবাইকের চাহিদা বাড়বে না কেন? টিসিবির দেশে তো আর ঘরে ঘরে টয়োটা নেই। চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বেড়েছে সত্যি। ২৫০০ টাকার দৈনিক রোজগার ১৫০০ টাকায় নেমে এসেছে। কিন্তু গাজীপুরের ইজিবাইকচালকরা জানান, মাসে এখনো ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করতে পারেন তারা। ইজিবাইকের সংখ্যা আরও বেড়ে গেলে উপায় কী‒এই প্রশ্নের উত্তরে নিজেরাই সমাধান দিলেন। গাড়ির প্লেট ভাগ করে দেওয়া হবে। এক দিন লাল প্লেট বের হবে, পরদিন নীল প্লেট। নীলের দিনে লাল বের হবে না, তাতে যানজট কম হবে, আবার নীলের আয়ও দ্বিগুণ হবে। চালকরাই জানান, ময়মনসিংহ রোডে এই পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর হয়েছে।

এখন গণমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী, ইজিবাইকের সংখ্যা-না অতিরিক্ত বেড়ে গেছে? চাহিদার চেয়ে না গাড়ি বেশি? তাহলে রিট করা কোম্পানিটি হাজার হাজার ইজিবাইক রাস্তায় নামানোর ‘বিজনেস প্ল্যান’ করে কীভাবে? গাজীপুরে কোটি টাকার কারখানা খুলেছে, সংবাদপত্রে লক্ষ টাকার বিজ্ঞাপনও ছাপাচ্ছে, বাজার না বুঝেই?

এখন গণমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী, ইজিবাইকের সংখ্যা-না অতিরিক্ত বেড়ে গেছে? চাহিদার চেয়ে না গাড়ি বেশি? তাহলে রিট করা কোম্পানিটি হাজার হাজার ইজিবাইক রাস্তায় নামানোর ‘বিজনেস প্ল্যান’ করে কীভাবে? গাজীপুরে কোটি টাকার কারখানা খুলেছে, সংবাদপত্রে লক্ষ টাকার বিজ্ঞাপনও ছাপাচ্ছে, বাজার না বুঝেই?

তা ছাড়াও এই-যে ইজিবাইকের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে, এর দায় কি শুধু ইজিবাইক চালকের? এই ইন্ডাস্ট্রির দ্রুত বিকাশ কি এমনি এমনি হয়েছে? গত এক দশকে শ্রমজীবী মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে, ৩০ টাকা রিকশা ভাড়ার বদলে মাত্র ৫-১০ টাকা দিয়ে সে কর্মক্ষেত্রে পৌঁছাতে পারছে, উৎপাদিত পণ্য দ্রুত বাজারে নিতে পারছে, অসুস্থ মা-কে দ্রুত হাসপাতালে নিতে পারছে, ইজিবাইকের দ্রুত বিকাশে গরিবের এই চাহিদার কোনো ভূমিকা নেই? এই দেশে যে গরিবের গণপরিহণ বলে কিছু তৈরি হয়নি, সেই দায়ও গরিবকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া গরিব মানুষটিকেই বহন করতে হবে??

ইজিবাইকে যানজট হয়?

নগরবিদরা বরাবরই বলে আসছেন, একটি আধুনিক নগরীর মোট আয়তনের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ রাস্তা থাকা দরকার। অথচ ঢাকায় অলিগলিসহ রাস্তা মাত্র ৭ শতাংশ! জেলা শহরগুলোতে রাস্তা মোট আয়তনের মাত্র ২-৩ শতাংশের মতো! যানজট কমাতে জেলা শহরগুলোতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত বাইপাস সড়ক। পর্যাপ্ত অলিগলি। পর্যাপ্ত প্যারালাল রোড এবং লিংক রোড। জেলা শহরগুলোর ভেতরে পর্যাপ্ত রাস্তা না থাকার কারণে মহাসড়কে উঠেই গন্তব্যে পৌঁছাতে হয় গাড়িকে। এখন শহরের আয়তনের তুলনায় প্রয়োজনীয় রাস্তা অর্ধেকেরও কম থাকলে যানজট হবে না তো কী হবে?

দুর্বল কাঠামো ও দুর্ঘটনা

বলা হচ্ছে ইজিবাইকের দুর্বল কাঠামোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটে, ‘বডি’র তুলনায় মোটরের ওজন ভারী হওয়ার কারণে গতি নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। প্রকৌশলীরা বলছেন, এটি বেশ কয়েক বছর আগে সমস্যা ছিল। কিন্তু স্থানীয়ভাবে বহু পরীক্ষামূলক চর্চার মধ্য দিয়ে এই কাঠামো শক্ত হচ্ছে। যেমন, দেশের স্থানীয় মেকানিকরা যে বোরাক তৈরি করছেন, তার কাঠামো তুলনামূলকভাবে মজবুত। প্রকৌশলীদের মতে, কিছু জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে যেমন: মোটরের সঙ্গে স্পিড রেগুলেটর (গতি নিয়ন্ত্রক) বসানো, বডির ওজন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এবং পেছনের কাঠামো নিয়ে কাজ করা। গাজীপুরের স্থানীয় মেকানিকরা জানান, গাড়ি সারানোর সময় তারা নিজেরাই নতুন করে চিন্তা করেন। আগের চেয়ে উন্নত করার চেষ্টা করেন। এ ছাড়াও দেশীয় যেসব থ্রি হুইলার কোম্পানি বিআরটিএ-র অনুমোদন পাচ্ছে, সেগুলোর কাঠামোকে ‘মডেল’ কাঠামো হিসেবে ব্যবহার করায় উৎসাহ দিতে সরকারি উদ্যোগ থাকবে না কেন? মোটকথা, কোনো রকমের ভর্তুকি ছাড়াই স্থানীয় দক্ষতায় যে শিল্প গড়ে উঠেছে, তার নিরাপদ বিকাশের দায়িত্ব রাষ্ট্র কেন নেবে না? যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, চীন, ভারত বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো তাদের স্থানীয় শিল্পের বিকাশ ও গবেষণায় বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিচ্ছে না?

মোটকথা, কোনো রকমের ভর্তুকি ছাড়াই স্থানীয় দক্ষতায় যে শিল্প গড়ে উঠেছে, তার নিরাপদ বিকাশের দায়িত্ব রাষ্ট্র কেন নেবে না? যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, চীন, ভারত বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো তাদের স্থানীয় শিল্পের বিকাশ ও গবেষণায় বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিচ্ছে না?

বলা হয়, মহাসড়কে দ্রুতগতির বাস-ট্রাকের সঙ্গে স্বল্পগতির ইজিবাইক একসঙ্গে চলা ঝুঁকিপূর্ণ। খুবই সত্যি কথা। এ দেশে গরুর গাড়ি এবং দূরপাল্লার বাস এক সড়কেই চলে এবং এটি আমাদের সড়ক ব্যবস্থার একটি পুরোনো সমস্যা। কিন্তু এ সমস্যার সমাধান তো বিশেষজ্ঞরাই বাতলে দিয়েছেন। প্রতিটি মহাসড়কের পাশে একটি করে সার্ভিস সড়ক সংযুক্ত করা এবং সার্ভিস সড়কগুলোকে মূল সড়কের তুলনায় নিচু রাখা। ব্যস এটুকু হলেই হয়।

এ রকম বহু এলাকা আছে, যেখানে কৃষিপণ্য পরিবহণ, রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া বা মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার একমাত্র ভরসা ভ্যান আর ইজিবাইক, এবং এই বাহনগুলোকে একপর্যায়ে মহাসড়কে উঠতেই হয়। তাহলে এত বছরেও মহাসড়কগুলোতে সার্ভিস রোড নেই কেন? যোগাযোগ অবকাঠামোতে এ বছরের বরাদ্দ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। ভারত ও চীনের দ্বিগুণ-তিন গুণ খরচে মহাসড়ক বানানো যায়, বিশ্বের সর্বোচ্চ খরচে মাওয়া রুট তৈরি হয়, অথচ বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের প্রেক্ষাপটে অতি প্রয়োজনীয় সার্ভিস সড়কগুলো তৈরি করা যায় না? গ্রামীণ অর্থনীতির চলাচলের পথকে দুর্ঘটনামুক্ত রাখতে ন্যূনতম কোনো দায় নেই রাষ্ট্রের?

ভারত ও চীনের দ্বিগুণ-তিন গুণ খরচে মহাসড়ক বানানো যায়, বিশ্বের সর্বোচ্চ খরচে মাওয়া রুট তৈরি হয়, অথচ বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের প্রেক্ষাপটে অতি প্রয়োজনীয় সার্ভিস সড়কগুলো তৈরি করা যায় না? গ্রামীণ অর্থনীতির চলাচলের পথকে দুর্ঘটনামুক্ত রাখতে ন্যূনতম কোনো দায় নেই রাষ্ট্রের?

অ্যাসিড ব্যাটারি পরিবেশবান্ধব নয়

কোনো সন্দেহ নেই যে লেড অ্যাসিডব্যাটারি পরিবেশবান্ধব নয়। এখন যদি প্রশ্ন করি: এ দেশে ঠিক কোন জিনিসটা পরিবেশবান্ধব? রামপাল, মাতারবাড়ি আর পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা খুব পরিবেশবান্ধব? বড়লোকের এসি আর মধ্যবিত্তের ফ্রিজের রেফ্রিজারেন্ট পরিবেশবান্ধব? তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ধ্বংস করা পোশাকশিল্প খুব পরিবেশবান্ধব? এখন কি পোশাকশিল্পওয়ালা আর এসিওয়ালাদের বিরুদ্ধে রিট করবেন? পৃথিবীর সেরা বায়ু দূষণের দেশে, সেরা প্লাস্টিক দূষণের দেশে আর কারও কোনো দায়-দায়িত্ব নেই, খালি রিকশাচালকদের ব্যাটারি পরিবেশবান্ধব হওয়াই লাগবে!!

এই দেশে তড়িঘড়ি করে হাজার কোটি টাকার পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো ভয়ংকর জটিল চুক্তিও হয়ে যায়, অথচ সামান্য একটা ব্যাটারি রিসাইকেল নীতিমালা হয় না। লেড অ্যাসিড থেকে ধীরে ধীরে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিতে একসময় যেতেই হবে, কিন্তু সেই রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ সরকারের কোনো পরিকল্পনা থাকবে না? ভর্তুকি থাকবে না? পরিবেশ রক্ষার ঝান্ডা ওড়াতে হবে খালি রিকশা-অটোওয়ালাদের?

ইজিবাইক একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প নয়?

সস্তার বাহন হিসেবেই নানা ডিজাইনের, নানা রঙের ইজিবাইক ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। একসময় শুধু চীন থেকে আমদানি হতো। চীনেরটা কপি করতে করতে এখন গ্রামগঞ্জের মিস্ত্রি-মেকানিকরাও এই বাহন তৈরিতে পারদর্শী হয়ে উঠেছেন। একেকটি গাড়ি তৈরিতে একজন মোটর মেকানিক বা একজন কাঠমিস্ত্রির কত পরিশ্রম, কত চিন্তা। বোরাকের হুড, সিস, বডি, বাম্পার, চাকা, ব্যাটারি সব দেশে তৈরি হচ্ছে। চার্জার, পিকআপ, স্টিয়ারিং, বাতি, গ্লাস, হুইপার, ব্রেক সু, এলইডি, প্যাডেল, চেইন, বেল‒এগুলোও তৈরি হচ্ছে দেশে। চাকার ফ্রেম, চাকার টিউব, চাকার টায়ার‒এগুলোও।

বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই এখন শত শত পার্টসের দোকান, ইজিবাইকের গ্যারেজ, স্টিলের ওয়ার্কশপ, আর টায়ারের দোকান। এই বাহনকে ঘিরে আবার দেশজুড়ে গড়ে উঠেছে লাখ লাখ মেরামতের দোকান। কন্ট্রোল বক্স পুড়ে যায়, স্টিয়ারিং ছিঁড়ে যায়, বিয়ারিং ভেঙে যায়, ব্রেক ‘লুজ’ হয়ে যায়, নষ্ট পার্টস সারাতে হয়, ইঞ্জিনের তেল বদলাতে হয়। মোটরের মিস্ত্রি, পেইন্টিং মিস্ত্রি, বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি, ইঞ্জিন মিস্ত্রি, হেলপার সব মিলিয়ে একেকটা দোকানেই ৭ থেকে ১০ জনের কর্মসংস্থান হয়। রহিমআফরোজ, পাওয়ার প্লাস দেশেই ব্যাটারি সংযোজন করছে। উৎপাদক, সংযোজক, চালক আর মেরামত মিলিয়ে এক দশকে তৈরি হয়েছে দারুণ প্রাণবন্ত এক স্থানীয় অর্থনীতি। কোনো রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ছাড়াই দেশজুড়ে ষাট-সত্তর লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করেছে এ খাত। এটা জরুরি শিল্প না হলে কোনটা জরুরি শিল্প?

উৎপাদক, সংযোজক, চালক আর মেরামত মিলিয়ে এক দশকে তৈরি হয়েছে দারুণ প্রাণবন্ত এক স্থানীয় অর্থনীতি। কোনো রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ছাড়াই দেশজুড়ে ষাট-সত্তর লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করেছে এ খাত। এটা জরুরি শিল্প না হলে কোনটা জরুরি শিল্প?

অথচ ইজিবাইক নিয়ে গণমাধ্যমের ভাষা খেয়াল করুন: ‘অবৈধ’, ‘নিষিদ্ধ’, ‘দাপিয়ে বেড়াচ্ছে’, ‘দৌরাত্ম্য’, ‘রাজত্ব’ ইত্যাদি। খেয়াল করুন, সব রকমের প্রযুক্তি ভালো, ডিজিটাল বাংলাদেশ ভালো, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ভালো, রোবট ভালো, কিন্তু শুধু রিকশার ‘অটোমেশন’ করা প্রযুক্তি ভালো নয়। এই যে প্যাডেলচালিত রিকশা থেকে অটোরিকশা/ইজিবাইক হলো, স্থানীয় পুঁজি, স্থানীয় উদ্যোগ এবং স্থানীয় চাহিদায় একটা গোটা ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠল, রিকশাচালকের অর্ধশত বছরের ঘামের কষ্ট লাঘব হলো, লাখ লাখ বেকার তরুণের কর্মসংস্থান হলো, কিন্তু ইজিবাইক ভালো নয়। কারণ, এই জিনিস হাইওয়েতে চললে ’উন্নয়ন’-এর দেশের মান-সম্মান থাকে না!

পোশাকশিল্প বা অন্যান্য ভারী শিল্পের মাল পরিবহণের কাজে মহাসড়ক ব্যবহৃত হবে, কিন্তু লাখ লাখ ছোট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে গতি দেওয়া স্থানীয় মেকানিকদের তৈরি এ বাহনের বেলায় মহাসড়ক ব্যবহার নিষিদ্ধ। আমরা মহাসড়ক বানিয়েছি পৃথিবীর সর্বোচ্চ খরচে, কিন্তু সেখানে অর্ধকোটি বেকারের জন্য জায়গা রাখার প্রয়োজন মনে করলাম না।

ইজিবাইকচালক খেতমজুর হয় না কেন?

ইজিবাইকওয়ালাদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ হলো, গ্রামে খেত-খামারে কাজ করার লোক পাওয়া যায় না, আর এই লোকগুলো শহরে এসে খালি জঞ্জাল বাড়ায়! অথচ স্থানীয় ইজিবাইক শিল্পের দ্রুত বিকাশের গল্পটি বুঝতে হলে প্রশ্ন করতে হতো মানুষ কেন গ্রাম থেকে শহরে আসে, আবার কেন গ্রামে ফেরত যায়, তারপর আবার কেন গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে অটোরিকশা চালায়? গ্রামীণ অর্থনীতির কোন ‘ইনসিকিউরিটি’ তাকে শহরে এসে কাজ খুঁজতে বাধ্য করে?

এটা খুবই সত্যি যে, প্রতিবছরই ফসল কাটার মৌসুমে খেতমজুর সংকট তৈরি হয়। কিন্তু এর মানে কি এই যে দেশের চারদিকে শুধু কাজ আর কাজ? ভুলে গেলে চলবে না, খেতের কাজের চাহিদা সারা বছর থাকে না। যেমন, বর্ষাকালে ধান রোয়ার জন্য লোক লাগে, এক-দেড় বিঘা জমিতে বড়জোর ৩-৪ জন লোক কাজ পায়। কিন্তু বর্ষাটা শেষ হলেই পরের পাঁচ মাস কোনো কাজ নেই। ওই পাঁচ মাস কি খায়, কীভাবে বাঁচে খেতমজুর? ইজিবাইকচালকদের খেতমজুর হওয়ার পরামর্শ দেনেওয়ালাদের সেই মাথাব্যথা নেই।

বর্ষাকালে ধান রোয়ার জন্য লোক লাগে, এক-দেড় বিঘা জমিতে বড়জোর ৩-৪ জন লোক কাজ পায়। কিন্তু বর্ষাটা শেষ হলেই পরের পাঁচ মাস কোনো কাজ নেই। ওই পাঁচ মাস কি খায়, কীভাবে বাঁচে খেতমজুর? ইজিবাইকচালকদের খেতমজুর হওয়ার পরামর্শ দেনেওয়ালাদের সেই মাথাব্যথা নেই।

এটাও সত্যি যে শীত/ফাল্গুনে ধান কাটার দুই-আড়াই মাস লোক পাওয়া যায় না। এর অন্যতম কারণ বৃষ্টি মৌসুমে টানা ৪-৫ মাস বসে থাকার পর শীতকালেই ইটের ভাটাগুলো পুরোদমে উৎপাদন শুরু করে। অর্থাৎ, ইটভাটায় শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ে। এর মধ্যে আবার শুকনো মৌসুমে শুরু হয় গাছ কাটার কাজ। অর্থাৎ, টানা কয়েক মাস গ্রামীণ অর্থনীতির অনেক মৌসুমি খাত একই সঙ্গে চলমান থাকে। ধান কাটা, গাছ কাটা, ইটভাটা সব একই সময়ে শুরু হলে লোকের টান তো পড়বেই। খুবই সত্যি কথা যে দৈনিক ৯০০ টাকা দিয়েও তখন লোক পাওয়া যায় না, কিন্তু সে তো বছরে সর্বোচ্চ ৪-৫ মাসের জন্য। ‘ইজিবাইকওয়ালা গ্রামে গিয়ে খেতে কাজ করে না কেন’‒এমন অভিযোগ করা শহুরে নাগরিক অনেক সময় জানেও না যে বছরে ছয় মাস বেকার থাকা গ্রামীণ কৃষি শ্রমিকদেরই একটা বড় অংশ কাজের খোঁজে জেলা শহরগুলোতে এসে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাতে বাধ্য হয়।

ইজিবাইকচালক পোশাকশিল্পে কাজ করে না কেন?

ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল বাংলাদেশের ওপর একটা প্রতিবেদন করেছিল ২০১৮ সালে ‘দ্য রোবটস আর কামিং ফর গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স’। প্রতিবেদন বলছে, ব্যাপক অটোমেশনের ফলে পোশাকশিল্পে কর্মসংস্থানের হার আশঙ্কাজনক হারে কমছে। বাস্তবেও আমরা দেখি, গাজীপুর, আশুলিয়া বা টঙ্গীতে গত কয়েক বছরে শত শত সোয়েটার কারখানা বন্ধ হয়েছে, এক ধাক্কায় হাজার হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে। বলা হচ্ছে, অটোমেশনের কারণে ২০৩০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশের শতকরা ৬০ ভাগ পোশাকশ্রকি চাকরি হারাবেন (ডেইলি স্টার, ২০১৯)। অথচ পোশাকশিল্পে বছর বছর রপ্তানি অর্ডার কিন্তু ঠিকই বেড়েছে। কিন্তু সেই অনুপাতে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। অর্থাৎ, শ্রমিকের কাজটা এখন করছে স্বয়ংক্রিয় মেশিন।

তবে গত বছর থেকে বাংলাদেশের পোশাক খাতে শ্রমিক সংকট চলছে। অনেক বড় কারখানাতেই অর্ডার আসছে, কিন্তু পর্যাপ্ত শ্রমিকের অভাবে কাজ নিতে পারছেন না মালিকরা। বেকারত্বের দেশে এই শ্রমিক সংকটের কারণ কী? প্রথমত, করোনার সময় গ্রামে চলে যাওয়া শ্রমিকের একটি বড় অংশই আর শহরে ফেরেনি। আবার শহরে ফিরলেও দক্ষ শ্রমিকদের একটা বড় অংশই আর পোশাক খাতে ফেরত আসেননি। কিন্তু কেন?

মূলত, করোনা মহামারির সময় পোশাক খাতের শ্রমিকদের জীবনের এক নিদারুণ বাস্তবতা সবার সামনে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। করোনায় বোঝা যায় বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিক কতটা সঞ্চয়হীন, কতটা গরিব, কতটা ঋণগ্রস্ত। দক্ষ শ্রমিকরাই অভিযোগ করছেন যে পোশাকশিল্পের বেতন দিয়ে ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে আর টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। অতিরিক্ত বাসাভাড়া, অতিরিক্ত পরিবহণ খরচ, কিছু দিন পরপর গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, আর খাদ্যপণ্যের ভয়ংকর দাম, সবকিছু মিলিয়ে পোশাকশিল্পে কাজ করে আর পোষায় না। তার ওপর আবার অনিয়মিত বেতন এবং অসুস্থতাকালীন ছুটি না পাওয়ার অত্যাচার। দক্ষ শ্রমিকদের একটি বড় অংশ তাই কারখানার কাজের বদলে অন্য পেশায় ঢোকার চেষ্টা করছে।

গাজীপুরে ইজিবাইকচালকদের সঙ্গে কথা বলে দেখা যায় তারা একসময় দীর্ঘদিন পোশাকশিল্পেই কাজ করেছেন। সোয়েটার কারখানাগুলোর ব্যাপক অটোমেশনের ফলে চাকরি হারিয়ে শেষে ধার-দেনা করে ইজিবাইক কিনেছেন। এমনকি সারা দেশের ২৬টি পাটকল বন্ধ হওয়ার পর দেখা গেল খুলনা বা ডেমরার কাজ হারানো শ্রমিকরা যখনই পাওনা টাকা বুঝে পেতে শুরু করলেন, অন্য কোথাও কাজের সুবিধা করতে না পেরে শত শত শ্রমিক শেষ পর্যন্ত ইজিবাইক কেনা শুরু করলেন।

বাস্তবতা হলো, ঢাকার পোশাকশিল্প, খুলনার পাটকল, উত্তরবঙ্গের চিনিকল থেকে ছাঁটাই হয়েছে লাখো শ্রমিক। এসব অঞ্চলের গোটা স্থানীয় অর্থনীতিটাই ধসে পড়েছে। চারদিকে কাজের জন্য হাহাকার। গাজীপুরের ছাঁটাই হওয়া শ্রমিক, খালিশপুরের কাজ হারানো মানুষ, গ্রামগঞ্জের মৌসুমি কৃষিশ্রমিক বা সারা দেশের অল্পশিক্ষিত বেকার তরুণ দলে দলে ঋণ করে ইজিবাইক কিনেছে। অথচ ইজিবাইকচালককে ক্রমাগত ভিলেন বানানো টিভি ও পত্রিকাগুলো বাংলাদেশের এই নিদারুণ আর্থসামাজিক বাস্তবতাকে একবারও কি বোঝার চেষ্টা করেছে?

গাজীপুরের ছাঁটাই হওয়া শ্রমিক, খালিশপুরের কাজ হারানো মানুষ, গ্রামগঞ্জের মৌসুমি কৃষিশ্রমিক বা সারা দেশের অল্পশিক্ষিত বেকার তরুণ দলে দলে ঋণ করে ইজিবাইক কিনেছে। অথচ ইজিবাইকচালককে ক্রমাগত ভিলেন বানানো টিভি ও পত্রিকাগুলো বাংলাদেশের এই নিদারুণ আর্থসামাজিক বাস্তবতাকে একবারও কি বোঝার চেষ্টা করেছে?

গণমাধ্যমে নতুন ইজিবাইক: খবরের মতন দেখতে কিন্তু আসলে কোম্পানির বিজ্ঞাপন

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, যানজটের ওপর গণমাধ্যমের অনেক রাগ। কিন্তু খেয়াল করুন, যেসব টিভি মিডিয়া এবং পত্রিকা প্রচার চালাচ্ছে‒ইজিবাইকে যানজট হয়, দুর্ঘটনা হয়, বিদ্যুৎ খায়, তাদেরই একটি অংশ আবার নতুন একটি ধনী কোম্পানির তৈরি করা ইজিবাইকের গুণগান গেয়ে দীর্ঘ খবর ছাপাচ্ছে। দেখতে খবরের মতন, কিন্তু আসলে বিজ্ঞাপন। দেশীয় কোম্পানি ‘বাঘ ইকো মোটরস’ নতুন ইজিবাইক নিয়ে বাজারে আসছে, তা নিয়ে খবর ছাপানো হবে, খুবই স্বাভাবিক। দেশীয় শিল্পের উত্তরণ কে-না চায়। কিন্তু এই ‘খবর’গুলো তো শুধু কোম্পানির পণ্যের গুণগান গাইছে না; বরং গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে থাকা স্থানীয় মেকানিকদের তৈরি ইজিবাইকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছে। প্রচলিত দেশি-বিদেশি ইজিবাইকগুলো কত খারাপ, কত পরিবেশ দূষণ করে, কত বিদ্যুৎখেকো, কত খরচ বেশি‒এই হলো এসব ‘নিউজ’-এর মূল বিষয়বস্তু। কিন্তু সেই একই মিডিয়া তাদের বিখ্যাত মিলিয়ন ডলার প্রশ্নটি করতে বেমালুম ভুলে যাচ্ছে! পুরোনো ইজিবাইকে যানজট হয়, নতুন ইজিবাইকে যানজট হবে না? বাঘ ইকো মোটরসের কয়েক লাখ নতুন ইজিবাইক চলবে কোথায়? মঙ্গল গ্রহে?

খবরের মতন দেখতে বিজ্ঞাপনগুলোতে আরও যে তথ্যটি আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে তা হলো, স্থানীয় ইজিবাইকের দাম এক-দেড় লাখ টাকা, আর এই নতুন কোম্পানির ইজিবাইকের দাম ছয় লাখ টাকা (যে টাকায় জেদ্দা বা কুয়েতে নির্মাণশ্রমিকের চাকরি পাওয়া সম্ভব।) এখন বলুন, দেড় লাখ টাকার পুরোনো ইজিবাইকগুলো রাস্তায় চললে ছয় লাখ টাকার নতুন ইজিবাইকগুলো কিনবে কে? কেউই না। তাহলে উপায়? শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে যে স্থানীয় ইজিবাইকগুলো যেন রাস্তায় চলতে না পারে, সেই উদ্দেশ্যে গত ডিসেম্বরে এই বাঘ ইকো মোটরসের পক্ষ থেকেই উচ্চ আদালতে একটি রিটও করা হয়েছিল। যে রিটের ওপর ভিত্তি করেই আদালত মহাসড়কে ইজিবাইক চলাচল নিষিদ্ধ করেছেন।

এখন হিসাব মেলান, বাঘ ইকো মোটরস গাজীপুরের হোতাপাড়ায় কারখানা বসিয়ে হাজার হাজার ইজিবাইকের উৎপাদন শুরু করেছে, খুব শিগগিরই বাজারেও আসবে। তার ওপর আবার জিনিসটা অ্যাপভিত্তিক। অর্থাৎ, ছয় লাখ টাকা দিয়ে কিনবেন ঠিকই, কিন্তু কোম্পানি কেটে রাখবে চালকের রোজগারের একটি অংশ। তার মানে এই গাড়িটি যেন রাস্তায় নির্বিঘ্নে চলতে পারে, বাঘ নামক কোম্পানিটিকে তা যেকোনো মূল্যে নিশ্চিত করতেই হবে। কারণ, ইজিবাইক চলাচলের ওপরই নির্ভর করছে তার বছরব্যাপী অ্যাপভিত্তিক ’রেভিনিউ’।

কিন্তু ছয় লাখ টাকা পুঁজি বিনিয়োগ করে কেবল অলিগলিতে চালিয়ে পোষাবে? মহাসড়কেই যদি চলতে না পারে, তাহলে এত টাকা খরচ করে শুধু স্বল্পপরিসরে গলিতে চালানোর জন্য এই খরচবহুল জিনিস কিনবে কে? ঠুক ঠুক করে গলিতে চালিয়ে টাকা উঠবে? বিষয়টা আসলে খুব পরিষ্কার। পুরানোগুলোকে ধরপাকড় করা হচ্ছে, রাস্তা সাফ করা হচ্ছে, যেন বাঘের ইজিবাইকগুলো নির্বিঘ্নে মহাসড়কে চলতে পারে। আর সে জন্য প্রশাসনকে আগেই ‘ম্যানেজ’ করে ফেলা হয়েছে। ধরপাকড় ও নির্যাতনের হার বেড়ে যাওয়া এবং আদালতের রিট সেই বার্তাই দেয়।

কিন্তু এত টাকা বিনিয়োগ করে এবং কোম্পানিকে দৈনিক ‘জমা’ দিয়ে, চালকের পক্ষে গাড়িভাড়া না বাড়িয়ে কি উপায় থাকবে? শেষ পর্যন্ত গাড়িভাড়া বাড়বেই। তার মানে ধনীবান্ধব ‘অ্যাপ’ প্রযুক্তির মারপ্যাঁচ আর ধনীবান্ধব সরকারের নির্যাতনে গরিবের পছন্দের এই সাশ্রয়ী বাহনটি শেষ পর্যন্ত আর গরিবের বাহন থাকবে কি না সেটাই প্রশ্ন। কিন্তু এই ভীষণ জরুরি প্রশ্নগুলো না তুলে ‘গণমাধ্যম’-এর একটি অংশ ব্যস্ত আছে বাজারে নতুন কোম্পানির সহজ ‘এন্ট্রি’ নিশ্চিত করতে।

পরিশেষ

এক দশক ধরেই আমরা খেয়াল করছি, গণমাধ্যম, সরকার, পুলিশ এবং আইন-আদালত সবাই দেশের মানুষের শ্রমে-ঘামে তৈরি হওয়া গরিবের এই ইজিবাইক শিল্পকে চরম লাঞ্ছিত করে আসছে। অথচ বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরিতে সরকার যে ব্যর্থ, সেটা নিয়ে কেউ টু শব্দ করেনি। আমাদের কর্মসংস্থান আর ঠিক কবে কীভাবে তৈরি হবে? চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হবে? আমেরিকা রোবট বানাবে, আর আমাদের এখানে আপনা আপনি আন্তর্জাতিক মানের প্রোগ্রামার তৈরি হয়ে যাবে? লাখ লাখ অর্ডার আসবে? প্রোগ্রামার যে তৈরি হবে, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা থেকে ঝরে পড়া তরুণ আর পোশাকশিল্প থেকে ছাঁটাই হওয়া তরুণকেও কি ঘাড়ে ধরে প্রোগ্রামারই বানানো হবে? অভাবের তাড়নায় পড়ালেখা শেষ করতে না পারা এই দেশের কয়েক কোটি স্বল্পশিক্ষিত তরুণের জন্য রাষ্ট্রের ন্যূনতম কোনো পরিকল্পনাও আমরা দেখতে পাচ্ছি না কোথাও। বরং একের পর এক সচল কর্মসংস্থান নষ্ট করার বহু উদাহরণ আমরা দেখতে পেলাম এই এক দশকে।

[প্রথম প্রকাশ, দৈনিক প্রথম আলো, দুই কিস্তিতে]

মাহা মির্জা: লেখক, গবেষক। মেইল: maha.z.mirza@gmail.com

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •