ইন্টারনেট যুগে কর্তৃত্ববাদ

ইন্টারনেট যুগে কর্তৃত্ববাদ-২

ইভজেনি মোরজোভ

জর্জ অরওয়েল ১৯৪৯ সালে লেখা তাঁর ‘1984’ উপন্যাসে এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা কল্পনা করেছেন যেখানে সর্বব্যাপী নজরদারি ও প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আর অলডস হ্যাক্সলি তাঁর ১৯৩২ সালে লেখা উপন্যাস ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ এবং ১৯৫৮ সালে লেখা ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড রিভিজিটেড’ নামের প্রবন্ধে এক ভিন্নরকম দুনিয়া কল্পনা করেছেন। সেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে মানুষের আনন্দ সর্বোচ্চকরণের কাজে লাগানো হয়, মানুষের একা থাকার সময় সর্বনিম্নকরণ করা হয় এবং দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা ভোগবিলাসের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণের কাঠামো কাজ করে। এই লেখায় মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে জর্জ অরওয়েল ও অলডস হাক্সলির খুবই প্রভাবশালী এই দুই ভিন্ন ধরনের রূপকল্প বর্তমান সময়ের অভিজ্ঞতায় পরীক্ষা করা হয়েছে।  লেখাটি ইভজেনি মোরজোভ-এর ‘দ্য নেট ডিল্যুশন: হাউ নট টু লিবারেট দ্য ওয়ার্ল্ড’ (পেঙ্গুইন ২০১২) পুস্তকের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায় অবলম্বনে তৈরি করেছেন কল্লোল মোস্তফা।

ক্রেমলিন কেন ব্লগারদের পছন্দ করে

আধুনিক কালের স্বৈরশাসকরা দুনিয়ার সব ধরনের তথ্যপ্রবাহ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে শুধু অর্থ গণনার কাজে লিপ্ত থাকে‒এ রকমটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং তারা অনেক ক্ষেত্রেই তথ্যপ্রবাহের সক্রিয় ভোক্তা ও উৎপাদক। বস্তুত, কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা টিকে থাকার অন্যতম একটা শর্ত হলো, বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ ও তা অনুধাবন করা, বিশেষত তা যদি হয় শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে হুমকি বিষয়ে। কিন্তু স্বৈরশাসকদের পক্ষে তো আর সরাসরি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মানুষের সাক্ষাৎকার নেওয়া সম্ভব নয়; প্রায় সব ক্ষেত্রেই তাদের বিভিন্ন মধ্যস্থতাকারীর সাহায্য নিতে হয়, যার মধ্যে গোয়েন্দা বাহিনী অন্যতম। কিন্তু এভাবে সংগৃহীত তথ্য ততটা নির্ভরযোগ্য থাকে না। আর এ কারণেই দেখা যায়, শাসকরা সবসময়ই তথ্যের বহুমুখী উৎসের সন্ধান করে। আর ইন্টারনেট স্বৈরশাসকদের জন্য তথ্যের এই বহুমুখী উৎস হিসেবে কাজ করে।

রাশিয়ার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না-থাকলেও দিমিত্রি মেদভেদেবের পক্ষে রাশিয়ার বৈচিত্র্যপূর্ণ অনলাইন জগৎ থেকে প্রয়োজনীয় অনেক কিছু জেনে নেওয়ার সুযোগ থাকে। তিনি নিজেই বলেছেন, অনলাইন জগৎ ঘাঁটাঘাঁটি করেই তার সকালটা শুরু হয় (মেদভেদেব ই-বুক ও আইপ্যাডের বেশ ভক্ত)। আর বিভিন্ন ধরনের অভিযোগের সন্ধান পেতে তার খুব বেশি খোঁজাখুঁজিও করতে হয় না। স্থানীয় কোনো আমলার প্রতি ক্ষুব্ধ যে কেউ চাইলে মেদভেদের ব্লগে অভিযোগ জানাতে পারেন। রাশিয়ায় এটা খুব জনপ্রিয় একটা প্রথা। আর মেদভেদেবের অধীনস্থরা এসব অভিযোগের বিপরীতে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে নানান ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে, যা সরকারি প্রপাগান্ডা হিসেবে কাজ করে। অবশ্য নির্দিষ্ট কিছু অভিযোগের বেলায়ই শুধু এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় আর উদ্দেশ্য যতটা প্রচারণা, সমস্যার পদ্ধতিগত সমাধান ততটা নয়। খুব বেশি সমালোচনামূলক অভিযোগগুলোর ভাগ্যে কী ঘটে, তা কেউ জানে না; কিন্তু অনেক সময়ই অনেক বড় অভিযোগ দ্রুত মুছে দেওয়া হয়।

একইভাবে চীনা কর্তৃপক্ষ খোলাখুলি সরকারবিরোধী কন্টেন্ট ব্লক করে দিলেও বিভিন্ন স্থানীয় সরকার পর্যায়ের দুর্নীতিবিষয়ক লেখালিখি নিয়ে সহনশীল আচরণ করে থাকে। সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষও নিয়মিত অনলাইনে সরকারের বিভিন্ন নীতির বিরুদ্ধে সমালোচনার ওপর নজর রাখে এবং তাদের নীতিমালা তৈরির বেলায় এসব সমালোচকের পরামর্শ গ্রহণ করে থাকে। ফলে অনলাইন জগতের অনেক বিষয় কর্তৃত্ববাদী শাসকদের পছন্দ না-হলেও এমন অনেক বিষয় থাকে, যেগুলো তারা সহ্য করে এমনকি পৃষ্ঠপোষকতাও করে।

ইন্টারনেট ও স্বৈরশাসকদের কথিত উভয়সংকট

স্বৈরশাসকরা সাধারণত ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ করতে না-চাইলেও মাঝে মাঝে নানা ধরনের হুমকি দেওয়ার জন্য তারা ইন্টারনেট জগতে নানা ধরনের সেন্সরশিপ আরোপ করে থাকে। এ বিষয়ে প্রচলিত ধারণা হলো, ইন্টারনেট যুগে সেন্সরশিপ কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার জন্য উভয়সংকট তৈরি করে: সেন্সর করলে অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে হয়। কারণ, বিশ্বায়িত দুনিয়ায় সেন্সরশিপ অচল আবার না করলে বিপ্লবের ঝুঁকির মুখে থাকতে হয়। হিলারি ক্লিনটন যেমন তার ইন্টারনেট স্বাধীনতাবিষয়ক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘যেসব দেশ সংবাদ এবং তথ্য সেন্সর করে, তাদের মনে রাখতে হবে যে, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক তথ্যের সেন্সরশিপের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যদি কোনো দেশের ব্যাবসা-বাণিজ্যের জন্য রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক তথ্যপ্রবাহে বাধা আরোপ করা হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই ওই দেশের প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ ইরানের টুইটার বিপ্লবে প্রযুক্তির ভূমিকা নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে নিউয়র্ক টাইমস লিখেছিল: ‘যেহেতু আধুনিক অর্থনীতিতে ডিজিটাল প্রযুক্তি এত গুরুত্বপূর্ণ, কাজেই নিপীড়নকারী সরকারগুলো যদি এসব প্রযুক্তি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়, যদি আদৌ তা সম্ভব হয়, তাহলে তার জন্য তাদের চরম মূল্য দিতে হবে।’

মুশকিল হলো, বাস্তব ক্ষেত্রে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো এই উভয়সংকটের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারে না‒এ রকম নজির তেমন একটা দেখা যায় না। উত্তর কোরিয়া বাদে দুনিয়ার সব কর্তৃত্ববাদী সরকারই কিন্তু ইন্টারনেট গ্রহণ করেছে, চীনে তো ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। এ ব্যাপারে পণ্ডিত ব্যক্তিরা যেই জায়গাটিতে ভুল করেছেন তা হলো, সেন্সরশিপের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির দক্ষতা ও নমনীয়তা কতটুকু হতে পারে, তারা তা অনুধাবন করতে পারেননি। ‘ডিক্টেটরস ডাইলেমা’ বা ‘স্বৈরশাসকের উভয়সংকট’ বিষয়ক ধারণাটির অন্যতম একটি পূর্বানুমান হলো, এমন নিখুঁত সেন্সরশিপব্যবস্থা গড়ে তোলা যাবে না, যার মাধ্যমে শুধু নির্দিষ্ট রাজনৈতিক তৎপরতা সেন্সর করে ইন্টারনেটে বাকি সবকিছু উন্মুক্ত রাখা সম্ভব হবে। এই পূর্বানুমানটি ইতোমধ্যে ভুল প্রমাণিত হয়েছে: সরকারগুলো কিওয়ার্ডভিত্তিক ফিল্টার করার পদ্ধতি আয়ত্ত করে ফেলেছে, যার মাধ্যমে পুরো ইন্টারনেট বন্ধ না করে নির্দিষ্ট কিছু ওয়েবসাইটের ইউআরএল, এমনকি সেসব ওয়েবসাইটের নির্দিষ্ট কিছু লেখা ব্লক করে দেওয়া সম্ভব। সরকারগুলোর পরবর্তী পদক্ষেপ হবে অনেকটা এ রকম: এমন একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করা, যার মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর পরিচয়, আচরণ, উক্ত ব্যবহারকারী শেষ দুই সপ্তাহে কী ধরনের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করেছে, তার উদ্দেশ্য কী হতে পারে ইত্যাদি বিষয়ে অনুমান করে কোনো নির্দিষ্ট ওয়েব পেজে তার প্রবেশাধিকার দেওয়া যেতে পারে।

সরকারগুলো কিওয়ার্ডভিত্তিক ফিল্টার করার পদ্ধতি আয়ত্ত করে ফেলেছে, যার মাধ্যমে পুরো ইন্টারনেট বন্ধ না করে নির্দিষ্ট কিছু ওয়েবসাইটের ইউআরএল, এমনকি সেসব ওয়েবসাইটের নির্দিষ্ট কিছু লেখা ব্লক করে দেওয়া সম্ভব।

হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এ রকম ব্যবস্থা গড়ে উঠবে যে, স্রেফ রয়টার্স ও ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস পড়ুয়া একজন ব্যাংক কর্মকর্তার ইন্টারনেটে যে কোনো কিছু করার অনুমোদন থাকবে, এমনকি মানবাধিকার নিয়ে উইকিপিডিয়ার পেজও। অন্যদিকে অচেনা পেশার একজন নাগরিক, যিনি হয়তো মাঝে মাঝে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস পড়েন, কিন্তু ফেসবুকে পাঁচজন নামকরা রাজনৈতিক কর্মীর সঙ্গে যার যোগাযোগ আছে, তিনি হয়তো দেখা যাবে সরকার পরিচালিত ওয়েবসাইট ছাড়া আর কোনো ওয়েবসাইটে সরাসরি ঢুকতে পারছেন না। অথবা তিনি যদি গোয়েন্দাদের টার্গেটে পড়েন, তাহলে হয়তো তাকে সব ওয়েবসাইটে ঠিকই ঢুকতে দেওয়া হবে; কিন্তু তার সমস্ত অনলাইন কার্যক্রমের ওপর নজরদারি করা হবে।

সেন্সর যখন আপনাকে মায়ের চেয়েও ভালো বুঝতে সক্ষম

কিন্তু এভাবে কি সেন্সরশিপের কাস্টমাইজেশন করা সম্ভব? সেন্সরের পক্ষে কি আমাদের সম্পর্কে এত বেশি জানা সম্ভব যে প্রতিটি মানুষ ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে কেমন আচরণ করবে তার অনুমান করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে?

অনলাইন বিজ্ঞাপনের কথা স্মরণ করলে এ রকম পরিস্থিতি খুব দূরের মনে হয় না। আমাদের অনলাইন সার্চ এবং ই-মেইলের বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে গুগল আমাদের বিজ্ঞাপন দেখায়; কোন কোন কনটেন্টে আমরা এবং আমাদের বন্ধুরা লাইক দিয়েছি এবং কী কী কেনাকাটা করেছি, তার ওপর নির্ভর করে ফেসবুকও আমাদের বিজ্ঞাপন দেখায়। এভাবে আচরণের ওপর ভিত্তি করে সেন্সরব্যবস্থা গড়ে ওঠাও অসম্ভব কিছু নয়। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য হলো, একটা সিস্টেম আমাদের সম্পর্কে সবকিছু জানতে চায়। যেন আমাদের প্রাসঙ্গিক বিজ্ঞাপন দেখাতে পারে আর অন্য সিস্টেমের কাজ হবে আমাদের সম্পর্কে সবকিছু জেনে প্রাসঙ্গিক ওয়েব পেজে আমাদের ঢুকতে না দেওয়া।

আমাদের অনলাইন সার্চ এবং ই-মেইলের বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে গুগল আমাদের বিজ্ঞাপন দেখায়; কোন কোন কনটেন্টে আমরা এবং আমাদের বন্ধুরা লাইক দিয়েছি এবং কী কী কেনাকাটা করেছি, তার ওপর নির্ভর করে ফেসবুকও আমাদের বিজ্ঞাপন দেখায়। এভাবে আচরণের ওপর ভিত্তি করে সেন্সরব্যবস্থা গড়ে ওঠাও অসম্ভব কিছু নয়। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য হলো, একটা সিস্টেম আমাদের সম্পর্কে সবকিছু জানতে চায়।

ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের প্রচলিত এবং সবচেয়ে মোটা দাগের পদ্ধতি হলো, নির্দিষ্ট ইউআরএল বা ওয়েবসাইটের অ্যাড্রেস ব্লক করা। এসব পদ্ধতির দিকে সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ করতে গিয়ে এ খাতের সবচেয়ে মৌলিক পরিবর্তনগুলোর দিকে আমরা নজর দিতে পারিনি। ইন্টারনেট সেন্সরশিপ দিনে দিনে আরও বেশি গভীর হয়ে আমরা অনলাইনে ও অফলাইনে কী কী করছি, সে বিষয়ে আরও বেশি খতিয়ে দেখছে এবং আরও বিস্তৃত হয়ে কোনো বিষয় সেন্সর করার আগে বেশি বেশি তথ্য ও নির্দেশকগুলো বিশ্লেষণ করছে।

২০০৯ সালের গ্রীষ্মে চীন সরকার ঘোষণা করে, দেশে বিক্রি করা সমস্ত কম্পিউটারে Green Dam নামের একটি সফটওয়্যার ইনস্টল করা বাধ্যতামূলক। দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে এই প্রকল্পটি একপর্যায়ে বাতিল হয়ে যায়; কিন্তু ততদিনে চীনের স্কুল ও ইন্টারনেট ক্যাফের লাখ লাখ কম্পিউটারে সফটওয়্যারটি ইনস্টল করা হয়ে যায়। গ্রিন ড্যাম নামের সফটওয়্যারটির বিশেষত্ব হলো, এর মাধ্যমে অনুমানমূলক সেন্সরশিপকে কাজে লাগানোর চেষ্টা। আমরা ভবিষ্যতে যে উঁচুমাত্রার কাস্টমাইজ সেন্সরশিপের মুখোমুখি হব, এটি হয়তো তারই পূর্বসূরি। এই সফটওয়্যারটির কাজ শুধু যান্ত্রিকভাবে নির্দিষ্ট কিছু ইউআরএলের ওয়েবসাইট ব্লক করাই ছিল না, সেই সঙ্গে এর কাজ ছিল ব্যবহারকারীর আচরণ বিশ্লেষণ করা এবং তার জন্য এই আচরণ স্বাভাবিক কি না‒বোঝার চেষ্টা করা। নিশ্চিতভাবেই এই সফটওয়্যারটি স্মার্ট কোনো কিছু ছিল না। কারণ, ব্যবহারকারী অভিযোগ করেছেন, যে কোনো ওয়েব ঠিকানার শুরুতে ‘এফ’ অক্ষরটি থাকলেই তা ব্লক হয়ে যাচ্ছিল।

কীভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে তা বড় কথা নয়, মনোযোগ দাবি করে এর পেছনের মূলনীতিটি। গ্রিন ড্যাম ব্যাপক আক্রমণাত্মক একটি সফটওয়্যার, যা ব্যবহারকারীর সমস্ত আচরণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। এটি তৈরিই করা হয়েছে ব্যবহারকারীর আচরণ পরীক্ষা করা‒ওয়েবসাইট ব্রাউজিং থেকে লেখালিখি করা, ছবি দেখা সবকিছু এবং অপছন্দনীয় কোনো কর্মকাণ্ড থেকে ব্যবহারকারীকে বিরত করার উদ্দেশ্যে (যা করা হয় মূলত সংশ্লিষ্ট অ্যাপ্লিকেশন যেমন: ইন্টারনেট ব্রাউজার বা ওয়ার্ড প্রসেসর বন্ধ করে দিয়ে)। উদাহরণস্বরূপ গ্রিন ড্যামের কাছে গোলাপি রং মানেই পর্ন ছবি; তাই যদি কোনো ছবিতে গোলাপি রঙের আধিক্য থাকে, তাহলে এটি ফটো দেখার অ্যাপ্লিকেশনটি বন্ধ করে দেয় (অবশ্য অশ্বেতাঙ্গ মানুষের নগ্ন ছবি ভদ্রতার এই পরীক্ষা থেকে ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়)।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, গ্রিন ড্যামের সঙ্গে একটি ইন্টারনেট ব্যাকডোর বা পেছনের দরজাও রয়েছে, যে দরজা দিয়ে সফটওয়্যারটি তার হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে এবং ব্যবহারকারীর আচরণ সম্পর্কে তার অন্তর্দৃষ্টি শেয়ার করতে পারে। এভাবে একটি কম্পিউটারের গ্রিন ড্যাম থেকে অন্য কম্পিউটারের গ্রিন ড্যামও শিখে নিতে পারে‒কী করে ফাঁকি দেওয়ার নতুন নতুন কৌশল ব্যর্থ করে দেওয়া যায়। গ্রিন ড্যাম হলো এমন এক সেন্সরশিপব্যবস্থা, যার স্বশিক্ষণের অসীম ক্ষমতা রয়েছে: যে মুহূর্তে এটি ধরে ফেলে যে একজন ব্যবহারকারী democracy-র বদলে demokracy টাইপ করছে, সেই মুহূর্ত থেকে গ্রিন ড্যাম নেটওয়ার্কে থাকা অন্যসব কম্পিউটারও এই লুপহোল বা ফাঁকি দেওয়ার রাস্তাটি সম্পর্কে জেনে যায়। ফলে ভবিষ্যতে আর কোনো ব্যবহারকারী তার সুযোগ নিতে পারে না।

যে মুহূর্তে এটি ধরে ফেলে যে একজন ব্যবহারকারী democracy-র বদলে demokracy টাইপ করছে, সেই মুহূর্ত থেকে গ্রিন ড্যাম নেটওয়ার্কে থাকা অন্যসব কম্পিউটারও এই লুপহোল বা ফাঁকি দেওয়ার রাস্তাটি সম্পর্কে জেনে যায়। ফলে ভবিষ্যতে আর কোনো ব্যবহারকারী তার সুযোগ নিতে পারে না।

এটাকে সেন্সরব্যবস্থার গ্লোবাল ব্রেন হিসেবে চিন্তা করা যেতে পারে। প্রতি মুহূর্তে এটি লাখ লাখ ব্যবহারকারীর আচরণ থেকে শিখছে কীভাবে তারা সেন্সরশিপকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছে এবং সেই শিক্ষাকে তৎক্ষণাৎ এমনভাবে কাজে লাগাচ্ছে যেন এ ধরনের ফাঁকি দেওয়া কারিগরিভাবেই অসম্ভব হয়ে ওঠে। গ্রিন ড্যাম হলো প্রচণ্ড শক্তিশালী ও বিপজ্জনক ধারণার দুর্বলতম বাস্তবায়ন।

সংশ্লিষ্টতার বিপদ

কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কতদিনে নিখুঁত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো শক্তিশালী হয়ে উঠবে, সরকারগুলো কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করে নেই। অন্য যে কোনো মাধ্যমের সঙ্গে ইন্টারনেটের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ একটি পার্থক্য হলো, ইন্টারনেটে সবকিছুই হাইপারলিংকড অর্থাৎ একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত। এক অর্থে এই লিংকগুলো একেকটি অতি ক্ষুদ্র অনুমোদন বা ন্যানো এন্ডোর্সমেন্ট হিসেবে কাজ করে। কেউ যদি কোনো একটি পেজের সঙ্গে তার কোনো পেজ বা লেখার লিংক করে দেয়, তাহলে সেই লিংকটির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। গুগল তো এই ন্যানো এন্ডোর্সমেন্টকে কাজে লাগিয়ে বিশাল বাণিজ্যের জগৎ তৈরি করেছে‒কোন কন্টেটের সঙ্গে কতগুলো লিংক যুক্ত হয়, তার ওপর ভিত্তি করে সার্চের ফলাফলের প্রাসঙ্গিকতা নির্ধারণ করছে গুগল।

ইন্টারনেটে সবকিছুই হাইপারলিংকড অর্থাৎ একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত। এক অর্থে এই লিংকগুলো একেকটি অতি ক্ষুদ্র অনুমোদন বা ন্যানো এন্ডোর্সমেন্ট হিসেবে কাজ করে। কেউ যদি কোনো একটি পেজের সঙ্গে তার কোনো পেজ বা লেখার লিংক করে দেয়, তাহলে সেই লিংকটির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। গুগল তো এই ন্যানো এন্ডোর্সমেন্টকে কাজে লাগিয়ে বিশাল বাণিজ্যের জগৎ তৈরি করেছে‒কোন কন্টেটের সঙ্গে কতগুলো লিংক যুক্ত হয়, তার ওপর ভিত্তি করে সার্চের ফলাফলের প্রাসঙ্গিকতা নির্ধারণ করছে গুগল।

এ ছাড়া হাইপারলিংকের মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট তথ্যের অর্থ না জেনেও কোন পরিপ্রেক্ষিতে এই তথ্যটি অনলাইনে ছড়িয়েছে, সে সম্পর্কে ধারণা অর্জন করা যায়। যদি এক ডজন সরকারবিরোধী ব্লগ কোনো নতুন একটি ব্লগে প্রকাশিত পিডিএফ ফাইলকে লিংক করে, তাহলে নতুন ব্লগটি সম্পর্কে ইন্টারনেট পুলিশের কোনো পূর্বধারণা না-থাকলেও শুধু সরকারবিরোধী বলে পরিচিত ব্লগের সঙ্গে যোগসূত্রের কারণে পিডিএফ ফাইলটি না-পড়েই তারা তা সরকারবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে ব্লক করে দিতে পারে। পিডিএফ ফাইলটি স্রেফ সংশ্লিষ্টতার কারণে দোষী। আর টুইটার, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এ ধরনের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে বের করা গোয়েন্দা পুলিশের জন্য দিনে দিনে আরও সহজ হয়ে যাচ্ছে।

ইন্টারনেটের জগৎটা এত ব্যাপক বিস্তৃত যে, সেন্সর করে কোনো লাভ নেই‒এ রকম বিশ্বাস আসলে বিপজ্জনক। ইন্টারনেট জগৎ যেহেতু দিনে দিনে আরও বেশি সামাজিক হচ্ছে, তাই সরকার বা অন্য কোনো পক্ষের জন্য অ্যামাজন বা নেটফ্লিক্সের রিকমেন্ডেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেন্সরশিপ ইঞ্জিন তৈরি করা অসম্ভব হবে না। একমাত্র পার্থক্য যেটি হবে তা হলো, আকর্ষণ করার বদলে সেন্সরশিপ ইঞ্জিন আমাদের নির্দিষ্ট কিছু কনটেন্ট ব্যবহারে বাধা দেবে। আমাদের পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে তৈরি সামাজিক গ্রাফ আমাদের ঘিরে ধরবে (চিন্তা করেন একটা গ্রাফে দেখা যাচ্ছে ফেসবুক-টুইটার কিংবা ইউটিউবে আপনি কাদের সঙ্গে যুক্ত)।

ইন্টারনেট জগৎ যেহেতু দিনে দিনে আরও বেশি সামাজিক হচ্ছে, তাই সরকার বা অন্য কোনো পক্ষের জন্য অ্যামাজন বা নেটফ্লিক্সের রিকমেন্ডেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেন্সরশিপ ইঞ্জিন তৈরি করা অসম্ভব হবে না। একমাত্র পার্থক্য যেটি হবে তা হলো, আকর্ষণ করার বদলে সেন্সরশিপ ইঞ্জিন আমাদের নির্দিষ্ট কিছু কনটেন্ট ব্যবহারে বাধা দেবে।

সেন্সরব্যবস্থা এখনো ততটা সামাজিক হয়ে না-ওঠার কারণ হলো, আমরা এখনো অনেক বেশি বেনামে ইন্টারনেট ব্রাউজ করি। আমরা যখন কোনো ওয়েবসাইট ভিজিট করি, তখন সেই ওয়েবসাইটের অ্যাডমিনিস্ট্রেটরদের পক্ষে আমাদের পরিচয় জানা কঠিন। আজ থেকে পাঁচ বছর পরও যে এই পরিস্থিতি থাকবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ, দুটি শক্তিশালী পক্ষ আমাদের নামহীনভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারের রাস্তা বন্ধ করে দিতে পারে। এর মধ্যে একটি হলো বাণিজ্যিক পক্ষ‒আমরা দেখছি, বিভিন্ন ওয়েবসাইট ক্রমেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে‒আপনি এখন প্রায় সব সাইটেই ফেসবুক লাইক বাটন দেখতে পারবেন‒নিজের পরিচয় প্রকাশের পক্ষে প্রণোদনা আগের চেয়ে আরও বেশি। আমরা অনেকেই হয়তো অ্যাপল স্টোরে ব্যবহারযোগ্য একটা ডিসকাউন্ট কুপনের বিনিময়ে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করে দেব। আরেকটি শক্তি হলো সরকার‒শিশু পর্নোগ্রাফি, কপিরাইট আইন ভঙ্গ, সাইবার অপরাধ এবং সাইবার যুদ্ধের কারণে অনলাইনে আমাদের পরিচয় প্রকাশ করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা হবে।

সেন্সরশিপের আউটসোর্সিং

আজকাল ইন্টারনেট সেন্সরশিপের বিষয়টা দৃশ্যমান না-হওয়ার আরেকটা কারণ হলো, সরকার নিজে সবসময় সেন্সরশিপের কাজটা করে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারের বিরুদ্ধে লেখা ব্লগ পোস্টটি ব্লক করে দেওয়া যথেষ্ট হলেও এর চেয়েও ভালো হলো ইন্টারনেট থেকে পোস্টটিকে একেবারে মুছে দেওয়া। সরকারের নিজের এই ক্ষমতা না-থাকলেও যেসব কোম্পানি ব্যবহারকারীদের ইন্টারনেটে ব্লগ প্রকাশের সুবিধা দিয়ে থাকে, তারা কিন্তু খুব সহজেই এ কাজটি করতে পারে। আর কোম্পানিগুলোকে এ কাজে বাধ্য করতে পারাটা যে কোনো সরকারের জন্য বেশ সুবিধাজনক একটা ব্যাপার। সমস্ত খরচ বহন করতে হচ্ছে কোম্পানিকে, নোংরা কাজটাও করতে হচ্ছে কোম্পানিকে এবং ব্যবহারকারীদের কাছে দোষীও হচ্ছে কোম্পানি। আর কোম্পানিগুলো নিজস্ব অনলাইন কমিউনিটিকে সরকারের তুলনায় ভালো জানে-বোঝে বলে তাদের পক্ষে সমস্যাজনক কন্টেন্ট শনাক্ত করা সহজ। সর্বোপরি বিভিন্ন কোম্পানি যার যার অনলাইন কমিউনিটি কীভাবে পরিচালনা করবে, তা কোনো ব্যক্তির পক্ষে ঠিক করে দেওয়া সম্ভব নয়। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবি করে কোনো ফল হয় না।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারের বিরুদ্ধে লেখা ব্লগ পোস্টটি ব্লক করে দেওয়া যথেষ্ট হলেও এর চেয়েও ভালো হলো ইন্টারনেট থেকে পোস্টটিকে একেবারে মুছে দেওয়া। সরকারের নিজের এই ক্ষমতা না-থাকলেও যেসব কোম্পানি ব্যবহারকারীদের ইন্টারনেটে ব্লগ প্রকাশের সুবিধা দিয়ে থাকে, তারা কিন্তু খুব সহজেই এ কাজটি করতে পারে। আর কোম্পানিগুলোকে এ কাজে বাধ্য করতে পারাটা যে কোনো সরকারের জন্য বেশ সুবিধাজনক একটা ব্যাপার।

বিস্ময়ের কিছু নেই যে, চীনা সেন্সরশিপব্যবস্থা এই পথেই এগোচ্ছে। সিএনএন-এর ব্যুরোপ্রধান রেবেকা ম্যাককিনের গবেষণা অনুসারে, চীনের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের কনটেন্ট সেন্সরশিপের কাজটা করা হয় ‘ব্যাপক বিকেন্দ্রীভূত’ উপায়ে এবং এই সেন্সর বাস্তবায়নের দায়িত্ব চীনা ওয়েব কোম্পানিগুলোর ওপরই বর্তায়।

বিষয়টি প্রমাণের জন্য তিনি ২০০৮ সালে এক ডজন চীনা ব্লগ প্ল্যাটফর্মে বেনামি অ্যাকাউন্ট খুলে বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়ে শতাধিক ব্লগ পোস্ট করেন। তার ব্লগ পোস্টগুলো ছিল দুর্নীতি থেকে শুরু করে এইডস, তিব্বত ইত্যাদি বিষয়ে। ম্যাককিনের উদ্দেশ্য ছিল পোস্টগুলো মুছে দেওয়া হয় কি না এবং মুছে দিতে কত সময় লাগে, তা পরীক্ষা করে দেখা। দেখা গেল বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের আচরণ করেছে: সবচেয়ে সতর্ক কোম্পানিটি প্রায় অর্ধেকসংখ্যক পোস্ট মুছে দিয়েছে আর সবচেয়ে অসতর্কটি মুছে দিয়েছে মাত্র একটি পোস্ট। কোম্পানিগুলোর আচরণের মধ্যে তেমন একটা মিল ছিল না; কিন্তু সরকার যখন সেন্সর করতে বলে কিন্তু ঠিক কী সেন্সর করতে হবে তা একেবারে সুনির্দিষ্ট করে দেয় না, তখন তো এরকমই ঘটার কথা। নীতিমালাগুলো অনুধাবন করার ক্ষেত্রে যত বেশি অসতর্কতার সুযোগ থাকে, তত বেশি অনিশ্চয়তা তৈরি হয়‒কোন পোস্ট মুছে দেওয়া হবে আর কোন পোস্ট মুছে দেওয়া হবে না, সে বিষয়ে। এই কাফকা ধাঁচের অনিশ্চয়তা কড়া সেন্সরশিপের চেয়ে বরং আরও বেশি সমস্যা তৈরি করে। কারণ, আন্দোলনকারীদের পক্ষে আগে থেকে নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ থাকে না, তাদের কন্টেন্টটি টিকে থাকবে কি থাকবে না।

ফলে গুগল বা ফেসবুককে আমাদের যত খারাপই মনে হোক না কেন, কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীন থাকা কোম্পানিগুলোর তুলনায় তারা সম্ভবত কমই সেন্সর করে। বৈশ্বিক কোম্পানিগুলো সহজে সেন্সরের ভূমিকা পালন করতে চায় না। কারণ, এতে বিশ্বজুড়ে তাদের সুনামের অনেক ক্ষতি হয়। (কিন্তু স্থানীয় কোম্পানিগুলোর অবশ্য এতে কিছু যায় আসে না: আজারবাইজানের সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানির ইউরোপ বা আমেরিকায় কোনো ব্যাবসা নেই, কংগ্রেস শুনানিতে তাদের অপদস্থ হওয়ারও কোনো আশঙ্কা নেই।)

কিন্তু ব্যবহারকারীরা সাধারণত স্থানীয় কোম্পানিগুলোর সেবার দিকেই বেশি আকৃষ্ট হয়; এগুলো সাধারণত বিদেশি কোম্পানির তুলনায় অধিকতর দ্রুতগতির, বেশি প্রাসঙ্গিক, ব্যবহার সহজতর এবং স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে থাকে। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলোর ইন্টারনেট মার্কেটের দিকে তাকালেই দেখা যায়, একেকটা সিলিকন ভ্যালির বৈশ্বিক কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বী অন্তত ৫টি কোম্পানি সেখানে আছে। ২০০৯ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, ফেসবুকের মোট ৩০ কোটি ব্যবহারকারীর মধ্যে চীনা ব্যবহারকারীর সংখ্যা মাত্র ১৪ হাজার, যা সাগরের মধ্যে পানির এক ফোঁটার মতো।

অবশ্য কোম্পানিগুলো ছাড়াও আরও একধরনের মধ্যস্থতাকারী আছে, যাদের বিভিন্ন কন্টেন্ট মুছে ফেলতে বাধ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, RuNet (রুশ ভাষাভাষীদের ইন্টারনেটকে প্রচলিত অর্থে এই নামে ডাকা হয়) প্রচণ্ডভাবে নির্ভর করে বিভিন্ন ধরনের ইন্টারনেট কমিউনিটির ওপর, যেগুলো অনেকটা ফেসবুক গ্রুপের মতো কাজ করে এবং এগুলোর প্রতিটির সুনির্দিষ্ট মডারেটর রয়েছে। LiveJournal নামের একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ওপর নির্ভর করে রাশিয়ার বেশিরভাগ অনলাইন অ্যাকটিভিজম সংঘটিত হয়ে থাকে। ২০০৮ সালে লাইভজার্নালের অটোমোবাইলপ্রেমীদের অনলাইন কমিউনিটিতে যখন ভ্লাদিভস্তক শহরের চালকদের আন্দোলনের ছবি ও রিপোর্ট পোস্ট করা হতে থাকে, তখন এর অ্যাডমিনিস্ট্রেটরদের কাছে রাশিয়ার এফএসবি (কেজিবির উত্তরসূরি) থেকে এসব ছবি ও রিপোর্ট মুছে ফেলার নির্দেশ চলে আসে। তারা এই নির্দেশ পালন করে, যদিও এ বিষয়ে একটা অভিযোগও তারা তাদের ওয়েব পেজে প্রকাশ করে (অবশ্য প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেটাও মুছে ফেলতে হয়)। আনুষ্ঠানিকভাবে কিন্তু কোনো কিছুই ব্লক করা হয়নি; এটা ছিল সেসব অদৃশ্য ধরনের সেন্সরশিপের দৃষ্টান্ত, যেগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করা সবচেয়ে কঠিন।

নির্দিষ্ট একটি তথ্য প্রকাশ ও বিতরণের ক্ষেত্রে যত বেশিসংখ্যক মধ্যস্থতাকারীর‒ব্যক্তি অথবা করপোরেট‒প্রয়োজন পড়ে, সেই তথ্য নীরবে মুছে ফেলা বা পালটে দেওয়ার সুযোগ তত বেশি থাকে। যারা ডিক্টেটরস ডিলেমা বা স্বৈরাচারের উভয়সংকট ধারণাটির ওপর শুরু থেকে বিশ্বাস রেখে এসেছেন, তারা তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে অনলাইন মধ্যস্থতাকারীদের ওপর নির্ভরশীলতার বিপদটিকে অবমূল্যায়ন করেছিলেন। কাউকে-না-কাউকে তো ইন্টারনেটে প্রবেশের ব্যবস্থাটা করে দিতে হয়, ব্লগ অথবা ওয়েবসাইট হোস্ট করতে হয়, অনলাইন কমিউনিটিকে মডারেট করতে হয়, এমনকি সার্চ ইঞ্জিনে সেটাকে দৃশ্যমান করতে হয়। যতদিন পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানকে কোনো-না-কোনো জাতিরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে, ততদিন পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানকে নানা ধরনের সেন্সর করার দায়িত্ব পালন করতে হবে।

সেন্সরশিপের ক্রাউডসোর্সিং

থাইল্যান্ডে রাজপরিবারের বিরুদ্ধে ব্লগ এবং টুইটারসহ কোনো মাধ্যমেই যেন কোনো ধরনের সমালোচনা প্রকাশ করা না হয়, সে বিষয়ে কঠোর আইন রয়েছে। কিন্তু ক্রমবিকাশমান ব্লগ জগতের প্রতিটি পোস্টের ওপর নজরদারি করা থাই পুলিশের জন্য দুরূহ। সে জন্য ২০০৯ সালের শুরুর দিকে রাজার প্রতি অনুগত এক থাই এমপি এ সমস্যার সমাধানের জন্য নতুন এক প্রস্তাবনা রাখেন। ProtectTheKing.net নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়, যেখানে নাগরিকরা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোনো কিছু দেখলেই অভিযোগ করতে পারবেন। বিবিসির সংবাদ অনুসারে, ওয়েবসাইটটি চালু হওয়ার প্রথম চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই পাঁচ হাজারের বেশি লিংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে, যেগুলো সরকার ব্লক করে। অবাক হওয়ার কিছু নেই, কোনো লিংক যদি ভুলবশত ব্লক করে দেওয়া হয়, সে বিষয়ে অভিযোগ জানানোর কোনো উপায় রাখতে ‘ভুলে’ গিয়েছিলেন এই সাইটটির প্রতিষ্ঠাতারা।

ProtectTheKing.net নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়, যেখানে নাগরিকরা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোনো কিছু দেখলেই অভিযোগ করতে পারবেন। বিবিসির সংবাদ অনুসারে, ওয়েবসাইটটি চালু হওয়ার প্রথম চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই পাঁচ হাজারের বেশি লিংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে, যেগুলো সরকার ব্লক করে।

একইভাবে সৌদি আরবও তার নাগরিকদের আপত্তিকর লিংক বিষয়ে অভিযোগ জানানোর সুযোগ করে দিয়েছে; দৈনিক প্রায় ১২০০-র মতো লিংক বন্ধ করার আবেদন জমা পড়ে দেশটির কমিউনিকেশন অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি কমিশনের কাছে। এর ফলে সৌদি সরকারের পক্ষে সেন্সরশিপব্যবস্থা অধিকতর কার্যকর করা সম্ভব হয়। বিজনেস উইকের সংবাদ অনুসারে, ২০০৮ সালে কমিশনের সেন্সরশিপ শাখায় মাত্র ২৫ জন কাজ করত।

গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও ক্রাউডসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সেন্সর করার চর্চা জনপ্রিয় হচ্ছে। ব্রিটেন ও ফ্রান্স উভয় দেশের সরকারেরই অনুরূপ ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে নাগরিকরা শিশু পর্নোগ্রাফিসহ বিভিন্ন ধরনের অবৈধ কন্টেন্ট বিষয়ে অভিযোগ জানাতে পারেন। দিনে দিনে ওয়েবসাইট ও ব্লগের সংখ্যা যত বাড়বে, এ ধরনের ক্রাউডসোর্সিংয়ের জনপ্রিয়তাও তত বৃদ্ধি পেতে থাকবে।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে তো রাষ্ট্রকে সরসারি সেন্সরশিপে অংশও নিতে হয় না, প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ সরকারের অনুগত ব্যক্তি বা দলগুলো নিজ দায়িত্বে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেন্সরশিপের কাজ করে থাকে। এ ধরনের নেটওয়ার্কের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত একটি নেটওয়ার্ক হলো জুয়িশ ইন্টারেনেট ডিফেন্স ফোর্স (জেআইডিএফ)। এই ইসরায়েলপন্থি গ্রুপটি ইসরায়েলবিরোধী ফেসবুক গ্রুপের তালিকা তৈরি, সেসব গ্রুপে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে অনুপ্রবেশ এবং গ্রুপগুলো অকার্যকর করে দিয়ে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। তাদের অন্যতম উল্লেখযোগ্য সফলতা ছিল হিজবুল্লার প্রতি সহানুভূতিশীল এ রকম একটি আরবি ভাষাভাষী ফেসবুক গ্রুপের ১ লাখ ১৮ হাজার সদস্যের মধ্য থেকে ১ লাখ ১০ হাজার সদস্য মুছে দেওয়া। এ ধরনের ক্ষেত্রে ফেসবুকের অ্যাডমিনিস্ট্রেটররা অনেক সময় সময়মতো হস্তক্ষেপ করে পুরো গ্রুপটিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন, অনেক সময় আবার পারেন না। মাসের পর মাস ধরে যে অনলাইন কমিউনিটি তৈরি করা হয়েছিল, তা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যায়। এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, ক্রমেই অনলাইনে ব্যক্তি ব্লগারের চেয়ে কমিউনিটির গুরুত্ব বাড়ছে। কাজেই আধুনিক কালের সেন্সরশিপব্যবস্থায় কোনো নির্দিষ্ট কন্টেন্ট মুছে দেওয়ার বদলে গোটা কমিউনিটিকে ধ্বংস করে দেওয়ার দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হবে।

নেটওয়ার্কের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত একটি নেটওয়ার্ক হলো জুয়িশ ইন্টারেনেট ডিফেন্স ফোর্স (জেআইডিএফ)। এই ইসরায়েলপন্থি গ্রুপটি ইসরায়েলবিরোধী ফেসবুক গ্রুপের তালিকা তৈরি, সেসব গ্রুপে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে অনুপ্রবেশ এবং গ্রুপগুলো অকার্যকর করে দিয়ে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। তাদের অন্যতম উল্লেখযোগ্য সফলতা ছিল হিজবুল্লার প্রতি সহানুভূতিশীল এ রকম একটি আরবি ভাষাভাষী ফেসবুক গ্রুপের ১ লাখ ১৮ হাজার সদস্যের মধ্য থেকে ১ লাখ ১০ হাজার সদস্য মুছে দেওয়া।

ডিডস আক্রমণ

দর্শনে যদি আপনার আগ্রহ থাকে, তাহলে বিদেশের যেসব জায়গায় আপনি এক বছর কাটাতে চান, সেই তালিকায় সৌদি আরব না থাকারই কথা। যেহেতু জ্ঞানের এই শাখাটি স্বাধীন চিন্তা ও কর্তৃত্ব বিষয়ে প্রশ্ন করতে শেখায়, তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দর্শন পাঠদান নিষিদ্ধ, সেই সঙ্গে নিষিদ্ধ দর্শনের বইও। সৌদি হাইস্কুলের পাঠ্যক্রমে দর্শন অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে নিজের আপত্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জেদ্দা এডুকেশনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পরিকল্পনাবিষয়ক পরিচালক ২০০৫ সালের ১ ডিসেম্বর বলেছিলেন: ‘দর্শন বিষয়টি গ্রিক ও রোমানদের কাছ থেকে এসেছে… আমাদের এ ধরনের দর্শনের প্রয়োজন নেই। কারণ, পবিত্র কোরান ইসলামি দর্শনে সমৃদ্ধ।’

সৌদি নাগরিক সমাজের আধুনিকতাবাদী একটি অংশ আশাবাদী হয়ে ওঠে যে, অন্তত সাইবার জগতে হলেও তারা কিছুটা স্বাধীনতা পাবে। তাদের সেই আশাবাদ অযথাই তৈরি হয়নি: ইন্টারনেট দ্রুতই শূন্যস্থান পূরণ করল, দর্শনের বই, ভিডিও লেকচার ও ম্যাগাজিন বিনা মূল্যেই সহজলভ্য হয়ে উঠল। কিন্তু এসব কনটেন্টের কোনো কেন্দ্রীয় লিংক না-থাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষিত একদল সৌদি নাগরিক Tomaar নামের একটি ইন্টারনেট ফোরাম প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে দর্শন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা ও আকর্ষণীয় সব কনটেন্টের লিংক পাওয়া যাবে। এই ওয়েবসাইটটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যে এর ব্যবহারকারীরা দর্শন ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এবং বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়ে আলোচনা করতে শুরু করেন। একপর্যায়ে ওয়েবসাইটটির সক্রিয় সদস্যের সংখ্যা ১২ হাজার ছাড়িয়ে যায়, যারা দৈনিক এক হাজারে বেশি পোস্ট করতেন।

একদল সৌদি নাগরিক Tomaar নামের একটি ইন্টারনেট ফোরাম প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে দর্শন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা ও আকর্ষণীয় সব কনটেন্টের লিংক পাওয়া যাবে। এই ওয়েবসাইটটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যে এর ব্যবহারকারীরা দর্শন ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এবং বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়ে আলোচনা করতে শুরু করেন।

তবে এটি একটি স্বল্পস্থায়ী বিজয় ছিল। সৌদি সরকার Tomaar-এর অসাধারণ সাফল্যের বিষয়টি লক্ষ করে এবং দ্রুতই সমস্ত সৌদি ব্যবহারকারীর সাইটটিতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। তবে এ সমস্যার সমাধান করা তুলনামূলক সহজ ছিল। গত এক দশকে বা তারও বেশি সময়ে এ ধরনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা এড়াতে প্রচুর টুলস তৈরি হয়েছে, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চীনা কর্তৃপক্ষের অত্যধিক সেন্সরশিপ এড়ানোর উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল। সরকারগুলোর পক্ষে তাদের অপছন্দের সব বিষয় মুছে ফেলা সম্ভব হয় না, বিশেষ করে যদি তা কোনো বিদেশি সার্ভারে হোস্ট করা হয়; তারা যা করতে পারে তা হলো, তাদের দেশের নাগরিকদের সেই বিষয়বস্তু অ্যাকসেস বা প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখা। এ জন্য তারা ISP বা ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডরদের নির্দেশ প্রদান করে যেন নির্দিষ্ট URL-এর ওয়েবসাইটে বা লিংকে সে দেশের নাগরিকরা প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু প্রথমে বিদেশের তৃতীয় একটি কম্পিউটারের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে, তারপর সেই কম্পিউটার থেকে নিষিদ্ধ ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে আইএসপিগুলোকে বোকা বানানো সম্ভব, এ ক্ষেত্রে সরকার যা দেখবে তা হলো, আপনি ইন্টারনেট ব্যবহার করে যে কোনো একটি বিদেশি কম্পিউটারের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছেন; কিন্তু তারা জানবে না যে আপনি তাদের অপছন্দের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করেছেন। Tomaar-এর ভক্তরা এ ধরনের সেন্সরশিপ-ফাঁকি দেওয়ার টুল ব্যবহার করে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও সাইটটি ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। (অবশ্যই একবারে অনেক ব্যবহারকারী একটি কম্পিউটারের সঙ্গে সংযুক্ত হলে বা এর ঠিকানা প্রচারিত হলে কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে কী ঘটছে এবং সেটিতেও প্রবেশ বন্ধ করে দিতে পারে।)

কিন্তু তাদের আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। খুব শিগগিরই ওয়েবসাইটটি এমনকি সেন্সরশিপ-ফাঁকি দেওয়া টুল ব্যবহারকারীদের কাছেও প্রবেশ অযোগ্য হয়ে ওঠে। দেখা গেল, ওয়েবসাইটটি এত জনপ্রিয়তা উপভোগ করছে যে, এটি শুধু ইন্টারনেট ট্রাফিকের কারণে ওভারলোড হয়ে গেছে। যে আমেরিকান কোম্পানির সার্ভারে সাইটটি হোস্ট করা ছিল, তারা Tomaar-এর সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে সাইটটিকে একটি ‘ডিজিটাল উদ্বাস্তু’তে পরিণত করে। ভয়ংকর কিছু একটা ঘটছিল; কিন্তু টোমারের পরিচালকরা বুঝতে পারছিলেন না যে তা ঠিক কী ছিল (তাদের মধ্যে কেউই প্রযুক্তিবিদ ছিলেন না—একজন ইলেকট্রনিক ভোগ্যপণ্যের দোকানের বিক্রেতা হিসেবে কাজ করতেন এবং অন্যজন একটি ব্যাংকের আর্থিক পরামর্শদাতা ছিলেন)। এটি বুঝতে বেশ সময় লেগেছিল যে, Tomaar একটি প্রলম্বিত সাইবার-আক্রমণের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছিল, যার লক্ষ্য ছিল ওয়েবসাইটটিকে ব্যবহার অনুপযোগী করা। আলোচ্য আক্রমণটিকে বলা হয় ডিস্ট্রিবিউটেড-ডিনিয়াল-অব সার্ভিস (DDoS) আক্রমণ, যা বিরোধীদের মুখ বন্ধ করার একটি ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় উপায়৷ যে কোনো পাব কিংবা সেলুনের মতোই, সব ওয়েবসাইটেরই ব্যবহারকারী ধারণের সক্ষমতা নির্দিষ্ট। CNN.com-এর মতো জনপ্রিয় সাইটগুলো লাখ লাখ সেশন একযোগে পরিচালনা করতে পারে; কিন্তু বেশিরভাগ অপেশাদার ওয়েবসাইট মাত্র কয়েক শ সেশন একযোগে ধারণ করতে পারে। DDoS আক্রমণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটের এই সীমিত সক্ষমতার সুযোগ নিতে অসংখ্য ভুয়া ব্যবহারকারী পাঠানো হয়। কিন্তু এ ধরনের ভুয়া ব্যবহারকারী কোথা থেকে আসে? এগুলো মেলওয়্যার এবং ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত কম্পিউটার কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হয়। আজকাল এ ধরনের আক্রমণ চালানোর প্রযুক্তি প্রায়ই ইবেতে মাত্র কয়েক শ ডলারে কেনাবেচা করা হয়।

Tomaar একটি প্রলম্বিত সাইবার-আক্রমণের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছিল, যার লক্ষ্য ছিল ওয়েবসাইটটিকে ব্যবহার অনুপযোগী করা। আলোচ্য আক্রমণটিকে বলা হয় ডিস্ট্রিবিউটেড-ডিনিয়াল-অব সার্ভিস (DDoS) আক্রমণ, যা বিরোধীদের মুখ বন্ধ করার একটি ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় উপায়৷

যেহেতু হামলার উৎপত্তি হাজার হাজার কম্পিউটার থেকে, তাই এর মূল পরিকল্পনাকারী শনাক্ত করা প্রায় সবসময়ই অসম্ভব। Tomaar-এর বেলায়ও তাই ঘটে। যদিও বোঝা যাচ্ছিল যে, সৌদি সরকার এই ওয়েবসাইটটিকে অকার্যকর করতে চাচ্ছিল, তবে তার সপক্ষে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছিল না। কিন্তু Tomaar-এর হোস্টিং কোম্পানি ওয়েবসাইটটিকে বিনা কারণে বাদ দেয়নি: DDoS আক্রমণের ফলে প্রচুর ট্রাফিক অপচয় হয়, পুরো সমস্যাটির সমাধান করতে বেশ সময় লাগে এবং খরচটা হোস্টিং কোম্পানিকেই বহন করতে হয়। আপনার কাছে যদি স্পর্শকাতর কোনো তথ্য থাকে এবং তার ফলে DDoS আক্রমণ হতে পারে, তবে বেশিরভাগ হোস্টিং কোম্পানি আপনাকে তাদের ক্লায়েন্ট হিসেবে গ্রহণ করার আগে দুবার চিন্তা করবে। যেহেতু ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও ঘনঘন DDoS আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়, তাই এই আক্রমণ থেকে সুরক্ষা সেবার বাজারও রয়েছে (উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল থেকে কেউ যেন আপনার সাইট পরিদর্শন করতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা); কিন্তু এর পেছনে খরচ এমন যে, তা বেশিরভাগ স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে পরিচালিত ওয়েবসাইটের পক্ষে বহন করা সম্ভব হয় না।

Tomaar-এর মতো ঘটনা দিনে দিনে বাড়ছে, বিশেষ করে বিভিন্ন আন্দোলনকারী এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো এর শিকার হচ্ছে। বার্মার নির্বাসিত মিডিয়া-ইরাবদি, মিজিমা এবং ডেমোক্রেটিক ভয়েস অব বার্মা‒সবাই বড় ধরনের সাইবার-আক্রমণের শিকার হয়েছে (২০০৮ সালে স্যাফ্রন বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকীতে সবচেয়ে বড় আক্রমণটি ঘটেছিল); বেলারুশিয়ান বিরোধিতামূলক সাইট Charter97, রাশিয়ান স্বাধীন সংবাদপত্র নোভায়া গাজেটা (খুন হওয়া রুশ সাংবাদিক আনা পলিটকভস্কায়া যেখানে কাজ করতেন), কাজাখবিরোধী সংবাদপত্র রেসপুব্লিকা এমনকি রেডিও ফ্রি ইউরোপ/রেডিও লিবার্টির বিভিন্ন স্থানীয় শাখা।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর DDoS-ধরনের আক্রমণের সবচেয়ে খারাপ দিকটি হলো, এগুলোকে বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট সেন্সরশিপের হিসাবের ক্ষেত্রে আমলে নেওয়া হয় না। সেন্সরশিপ সম্পর্কে আমাদের ঐতিহ্যগত ধারণা এখনো ‘ব্লকড/আনব্লকড’-এর বাইনারি যুক্তি দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত, যা ডিডস আক্রমণের ক্ষেত্রে খুব বেশি অর্থবহন করে না। এ ক্ষেত্রে ওয়েবসাইটগুলো কারিগরিভাবে আনব্লক থাকলেও তাদের ব্যবহারকারীরা বছরজুড়ে নির্বিঘ্নে সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন না। এমনকি যে দেশগুলো থেকে আক্রমণের শিকার ওয়েবসাইটের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকে না, সেসব দেশের ব্যবহারকারীরাও ওই সাইটগুলোতে প্রবেশ করতে পারেন না; নিষেধাজ্ঞা ফাঁকি দেওয়ার টুলগুলোও এসব পরিস্থিতিতে কাজ করে না। (চলবে)

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •