ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, বিক্ষোভ এবং মিথ ও ইতিহাসের দ্বন্দ্ব

ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, বিক্ষোভ এবং মিথ ও ইতিহাসের দ্বন্দ্ব

অরুন্ধতী রায়

অরুন্ধতী রায় গত ১৯ এপ্রিল ২০২২ অস্টিনে অবস্থিত টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে Religious Nationalism, Dissent, and the Battle Between Myth and History বিষয়ে যে বক্তৃতা করেন, এটি তার লিখিত রূপ। সর্বজনকথার জন্য লেখাটি অনুবাদ করেছেন সুমাইয়া ফেরদৌস। মূল লেখাটি পড়া যাবে এখান থেকে: https://lithub.com/arundhati-roy-on-religious-nationalism-dissent-and-the-battle-between-myth-and-history/]

‘আমাদের আশায় এখন দগদগে ক্ষত, কল্পনা দূষিত।’ ‒অরুন্ধতী রায়

শুভ অপরাহ্ণ। ধন্যবাদ জানাই এবারের সিসি ফ্যারেন্টহোল্ড বক্তৃতা প্রদানে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। শুরু করার আগে ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ নিয়ে কিছু কথা বলে নিতে চাই। কোনো রকম দ্বিধা না-রেখেই আমি ইউক্রেনের ওপর চালানো রাশিয়ার এই আক্রমণের প্রতি নিন্দাজ্ঞাপন করছি এবং সেই সঙ্গে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি ইউক্রেনের লড়াকু জনতা ও‌ তাদের সাহসী প্রতিরোধের প্রতি। সেই সঙ্গে শ্রদ্ধা জানাই রাশিয়ার যুদ্ধবিরোধীদের প্রতি, যারা নিজেদের অনেক ক্ষতি মেনে নিয়েও বিক্ষোভ জারি রেখেছেন।

আমি এসব কথা বলছি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের ভণ্ডামো নিয়ে বেদনাদায়কভাবে এবং পূর্ণমাত্রায় সচেতন হয়েই। এরা একই রকম যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের ঘাড়ে। এরা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পাল্লা দিতে দিতে এত পরিমাণে বিধ্বংসী অস্ত্র জমা করেছে যে তা দিয়ে এই পৃথিবীকে কয়েক হাজারবার ধ্বংস করা যাবে। পরিহাসের বিষয় হলো, আজ পারমাণবিক অস্ত্র আছে বলেই তাদের বন্ধুসম একটি দেশ ধ্বংস হতে বসলেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করতে পারছে ‌না তারা। এ মুহূর্তে ইউক্রেনের মানুষ, ভূখণ্ড এমনকি তার পরম অস্তিত্বই বিপন্ন হতে বসেছে। কারণ, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা এবং প্রত্তিপত্তি বিস্তারের চিরস্থায়ী লালসার শিকার হয়েছে দেশটি।

এটুকু বলে আমি এখন ভারতের দিকে নজর দিতে চাই। ভারতজুড়ে বিবেকের দায়ে কারাবন্দিদের (prisoner of conscience) সংখ্যা বাড়ছে। এই বক্তৃতা আমি তাদেরকেই উৎসর্গ করছি। চলুন, আমরা সবাই স্মরণ করি জি. এন. সাইবাবাসহ ভীমা কোরগাঁও*-এর ১৬ জন পণ্ডিত, বিপ্লবী, সংগীতশিল্পী ও আইনজীবীদের সবাইকে। নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের (সিএএ, Citizenship Amendment Act) বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এরা সবাই কারাবরণ করেছিলেন। আমরা স্মরণ করি কাশ্মীরের খুররাম পারভেজকে, যাকে পাঁচ মাস আগে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমার চেনাজানা মানুষের ভেতরে‌ খুররাম সেরাদের একজন। খুররাম ও তার সংগঠন জম্মু কাশ্মীর নাগরিক জোট (জেকেসিসিএস, Jammu Kashmir Coalition of Civil Society) বছরের পর বছর ধরে কাশ্মীরের জনগণের ওপর চলমান অত্যাচার, গুম এবং খুনের করুণ কাহিনি সুনিপুণভাবে লিপিবদ্ধ করে আসছেন। আমি আজ যা বলব তা এদের সবাইকে উৎসর্গ করলাম।

ভারতে যেকোনো ধরনের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভকে ‘অপরাধ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এতদিন পর্যন্ত সেখানে আমাদের মতো বিক্ষোভকারীদের ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ বলা হতো। তবে আজকাল সরাসরি বুদ্ধিবৃত্তিক জঙ্গি (Intellectual Terrorist) বলে ডাকা হচ্ছে। ‘বেআইনি কর্মকাণ্ড দমন আইন’ (Unlawful Activities Prevention Act) নামে ভয়ানক একটি আইন রয়েছে ভারতে, যা ব্যবহার করা হয় বহু মানুষকে বছরের পর বছর ধরে বিনা বিচারে আটকে রাখার জন্য। সম্প্রতি সেই আইনটি বিশেষভাবে সংশোধন করা হয়েছে বর্তমান শাসকদের খায়েশ মিটিয়ে ‘বুদ্ধিবৃত্তিক জঙ্গিদের’ শায়েস্তা করার জন্য। আমাদের সবার গায়ে ‘মাওবাদী’ তকমা লাগানো হয়েছে। আমাদের সম্বোধন করা হয় ‘আরবান নকশাল’ কিংবা ‘জিহাদি’ নামে। এসব নামে ডাকার সুফল হলো, এর মাধ্যমে আমাদের আইনগতভাবে হয়রানি করা কিংবা উন্মত্ত জনতার দ্বারা হেনস্তা করার বৈধতা দেওয়া যায়। 

সম্প্রতি সেই আইনটি বিশেষভাবে সংশোধন করা হয়েছে বর্তমান শাসকদের খায়েশ মিটিয়ে ‘বুদ্ধিবৃত্তিক জঙ্গিদের’ শায়েস্তা করার জন্য। আমাদের সবার গায়ে ‘মাওবাদী’ তকমা লাগানো হয়েছে। আমাদের সম্বোধন করা হয় ‘আরবান নকশাল’ কিংবা ‘জিহাদি’ নামে।

মাত্র কয়েক দিন হলো আমি নয়াদিল্লি ছেড়েছি। এই অল্প কিছুদিন ধরে সেখানে যা যা ঘটে চলেছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে আমরা বিশেষ একটা সীমা অতিক্রম করে ফেলেছি। এর মানে হলো, এতদিন নিজের বলে জানতাম যে অঞ্চল, সেখানে আর ফেরা যাচ্ছে না।

২০২২-এর মার্চে ভারতের বৃহত্তম রাজ্য উত্তর প্রদেশের শাসক হিসেবে বিপুল ব্যবধানে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হয় ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। ভারতীয় রাজনীতির হিসাব-নিকাশ অনুযায়ী উত্তর প্রদেশের নির্বাচনকে সেমিফাইনাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেখানে ফাইনাল হলো ২০২৪ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচন। এই নির্বাচনি প্রচারণা স্মরণীয় হয়ে থাকবে গেরুয়া বস্ত্র পরিহিত ভগবানের সৈনিকদের দিনদুপুরে গণহত্যার হুমকি দেওয়ার মাধ্যমে। তারা জনসম্মুখে বলেছে, মুসলিম সম্প্রদায়কে নিকেশ করবে এবং তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করবে।

সিটের হিসাবে বিজেপির জয়কে নিরঙ্কুশ মনে হলেও বাস্তবে কিন্তু হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। এই ফল বিজেপির নেতাকর্মীদের মনে একই সঙ্গে আতঙ্ক এবং অতি-আত্মবিশ্বাস মিশ্রিত এক অদ্ভুত অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। ভোটের ফলাফলের মাত্র কয়েক দিনের মাথায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা রাম নবমী উদ্‌যাপন করে। এ বছর রোজাও পড়েছিল ওই একই সময়ে। রাম নবমী উদ্‌যাপন করবে বলে উন্মত্ত হিন্দু জনতা গদা ও তলোয়ার হাতে মোট এগারোটা শহরে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। স্বামীজিগণ এবং বিজেপির নেতাকর্মীদের নেতৃত্বে এই বাহিনী মুসলিম বসতিগুলোতে ঢুকে মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের নিদারুণ অপমান করে, উসকানিমূলক বক্তব্য দেয় এবং অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে। এরা জনসম্মুখে মুসলিম মেয়েদের ধর্ষণ এবং গর্ভবতী করার এবং মুসলিম পুরুষদের হত্যা করার ঘোষণা দেয়।

মুসলিমদের তরফ থেকে যেকোনো প্রতিক্রিয়ার জবাবে সরকারিভাবে তাদের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করা হয় কিংবা উন্মত্ত জনতা তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময়ে কারাবন্দিদের প্রায় সবাই মুসলিম। ষড়যন্ত্র এবং দাঙ্গার অভিযোগে আটক হওয়া এই মানুষগুলোকে সম্ভবত দীর্ঘদিন কাটাতে হবে জেলে। এ ঘটনায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এমন একজনকে, যিনি রাম নবমীর বহু আগে থেকেই ভিন্ন একটি মামলায় জেল খাটছেন। ওয়াসিম শেখ বলে আরেকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে হিন্দুদের মিছিলে ঢিল ছুড়েছে। কিন্তু নুলো এই লোকটির কনুই থেকে দুই হাত কাটা। সরকার বুলডোজার দিয়ে তাদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিয়েছে। কয়েকটি শহরে দেখা যায়, ওইসব বুলডোজারের ভেতরে বসে উন্মত্ত অবস্থায় উৎসাহ দিচ্ছে টেলিভিশনের সাংবাদিকরা।

উত্তর প্রদেশে যখন এই পরিস্থিতি, ঠিক সেই সময় দিল্লি হাইকোর্ট ২০২০ সালে দিল্লির গণহত্যায় হিন্দু দাঙ্গাবাজদের উসকানি দেওয়া বিজেপি নেতাদের দায়মুক্তি দিয়ে দিল। ওই রায়ে বলা হয়, উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার সময় মুখে হাসি থাকলে তাতে কোনো অপরাধ নেই। সেসব নেতার কেউ কেউ এখন অন্য শহরগুলোতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মুখে ওই একই সহিংসতার বুলি নিয়ে। অথচ তরুণ মুসলিম একাডেমিক উমর খালিদ এখনো জেলে। সিএএ আন্দোলনের সময় ভারতীয় সংবিধাননের সারবস্তু ধারণ করে দেওয়া তার সকল বক্তৃতার মূলে ছিল ভ্রাতৃত্ব, ভালোবাসা ও অহিংসা। কিন্তু পুলিশের চার্জশিটে বলা হয়েছে, তার বক্তৃতা একটি বৃহৎ ষড়ষন্ত্রের অংশ, যার ফলে ২০২০ সালে দিল্লিতে গণহত্যা ঘটেছে। অর্থাৎ, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফরের সময় ভারতের নাম ডোবাতে মুসলিমরা নিজেরাই দাঙ্গা বাধিয়ে নিজেদের হত্যা করেছে।

এসব ঘটনার অনুপ্রেরণা হিসেবে আছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই ব্যক্তির রাজনৈতিক জীবন গতি পায় ২০০২ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন মুসলিমবিরোধী কর্মসূচি গ্রহণের মধ্য দিয়ে। ইনি বেশির ভাগ সময়ই চুপ থাকেন, তবে তার চেয়েও বেশি সময় কাটান মুসলিমদের নিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে। উন্মত্ত জনতার ত্রাণকর্তা তিনি, তাদের দেবদূত। এই উন্মত্ত জনতাকে নিয়ম করে ইতিহাসের বিকট ভার্সন গুলে খাওয়ানো হয় হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে। ফলে তারা নিজেদের মনে করতে থাকে মুসলমানদের দ্বারা ঐতিহাসিকভাবে নিপীড়িত ও গণহত্যার শিকার জাতি হিসেবে, যার প্রতিশোধ নিতে হবে এ মুহূর্তেই।

আমরা এখন যে দেশে বাস করি, সেখানে এমন কোনো বস্তুনিষ্ঠ ও ঐতিহাসিক সত্য নেই, যার সঙ্গে আমরা সবাই একমত হতে পারি। আসলে এমন কিছুও নেই, যা নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে। এক ধারার বয়ানের সঙ্গে অন্য ধারার বয়ানের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এমন একটা বিন্দুও নেই, যেখানে এরা একে অন্যকে ছেদ করে। কারণ, এখানে ইতিহাসের বিপরীতে দাঁড় করানো হয়েছে মিথকে। আর এই মিথের পাহারাদার হলো রাষ্ট্রযন্ত্র, করপোরেট বাহিনী আর দেশভর্তি ২৪/৭ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেল। এদের হাত অনেক লম্বা, এদের ক্ষমতার নাগাল পাওয়া যায় না। এমন পরিস্থিতি পৃথিবী আগেও দেখেছে। বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে যখন তর্ক-বিতর্ক এবং ভিন্ন যুক্তি উত্থাপনের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়, তখনই শুরু হয় ধ্বংসের যুদ্ধ।

আমরা এখন যে দেশে বাস করি, সেখানে এমন কোনো বস্তুনিষ্ঠ ও ঐতিহাসিক সত্য নেই, যার সঙ্গে আমরা সবাই একমত হতে পারি। আসলে এমন কিছুও নেই, যা নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে। এক ধারার বয়ানের সঙ্গে অন্য ধারার বয়ানের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এমন একটা বিন্দুও নেই, যেখানে এরা একে অন্যকে ছেদ করে। কারণ, এখানে ইতিহাসের বিপরীতে দাঁড় করানো হয়েছে মিথকে। আর এই মিথের পাহারাদার হলো রাষ্ট্রযন্ত্র, করপোরেট বাহিনী আর দেশভর্তি ২৪/৭ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেল।

কল্পনা করার চেষ্টা করুন, আপনাকে যদি কেউ খুন করবে বা জেলে ঢোকাবে বলে চিহ্নিত করে রাখে, তাহলে আপনার কেমন লাগবে। নাৎসিরা ইহুদিদের সঙ্গে যে আচরণ করত, ভারতের মুসলমানদের সঙ্গে ঠিক তেমন ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের রাখা হয়েছে গেটোতে এবং পরিত্যাগ করা হয়েছে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে। তারা এখন একঘরে। মুসলমানদের প্রায়ই অভিযুক্ত করা হয় লাভ জিহাদ (যার মানে নিজেদের জনসংখ্যা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে মুসলিম যুবকরা ষড়যন্ত্র করে হিন্দু মেয়েদের প্রেমে পড়তে বাধ্য করে), করোনা জিহাদ (যার মানে মুসলমানরা ইচ্ছা করে কোভিড ছড়ায়, এভাবেই নাৎসিরা বলত ইহুদিরা ইচ্ছা করে টাইফাস ছড়ায়), চাকরি জিহাদ (যার মানে হিন্দু জনতাকে শাসন করার ষড়যন্ত্রে মুসলমানরা সিভিল সার্ভিসে চাকরির ধান্দা করে)‌ ইত্যাদি অপরাধে। খাদ্য জিহাদ, হাসির জিহাদ এসবের কথা নাই-বা বললাম। (উল্লেখ্য, মুনাওয়ার ফারুকী নামে এক‌‌ মুসলিম তরুণ কৌতুক অভিনেতাকে‌ বেশ কয়েক মাস জেলে আটকে রাখা হয় এমন এক কৌতুকের কারণে, যা সে কখনো বলেনি, তবে বলবে বলে পরিকল্পনা করছিল এই অভিযোগে)।

মুসলমানদের মধ্যে কেউ যদি এ নিয়ে কোনো কথা বলে কিংবা সামান্যতম ভুল কাজ করে, তবে তাকে উন্মত্ত জনতা পিটিয়ে মেরে ফেলে। হত্যাকারীদের গলায় মালা দেওয়া হয়, পুরস্কৃত করা হয় এবং প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় এক উজ্জ্বল রাজনৈতিক ভবিষ্যতের। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে পোড় খাওয়া, হতাশাবাদী লোকজনও আজকাল একে অন্যকে ফিসফিস করে বলে এখনো কি ওরা ভান করছে নাকি আসল ব্যাপারটা শুরু হয়ে গেছে? ঘটনাটা কি পূর্বপরিকল্পিত নাকি সত্যিই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে? এটা কি সারা দেশে ছড়িয়ে যাবে?

একটি দেশ হিসেবে, একটি আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের অস্তিত্ব মূলত বিভিন্ন ধর্ম, ভাষা, বর্ণ, জাতিসত্তা এবং উপজাতীয়তার সম্মিলনে গঠিত সাংবিধানিকভাবে আইনত জোড়া লাগানো সামাজিক ঠাসবুনন ছাড়া আর কিছুই নয়। ভারতের প্রতিটা নাগরিক কোনো-না-কোনো হিসাবে সংখ্যালঘু। আমাদের দেশটা হলো তার সংখ্যালঘুদের ভেতরে সংগঠিত সামাজিক সংহতি। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে একটা সংখ্যাগুরু গোষ্ঠী তৈরি করার লক্ষ্যে সামাজিক এই ঠাসবুনন খুলে ফেলা হচ্ছে কৃত্রিমভাবে জন্ম দেওয়া ‘বিক্ষুব্ধ হিন্দু সংখ্যাগুরু’দের ব্যবহার করে। এই ‘সংখ্যাগুরু’দের সচেতনভাবে বিশ্বাস করতে শেখানো হয় যে, ভারতে নাগরিক হিসেবে একমাত্র তাদেরই অধিকার আছে, হিন্দু জাতীয়তার দেশে তারাই সর্বাগ্রে। এই সংখ্যাগুরুরা নিজেদের পরিচয় দেয় ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ তথা তথাকথিত ‘জাতীয়তাবাদবিরোধী’ শিবিরের বিপরীত শক্তি হিসেবে। ভারতের অস্তিত্বের তন্তুগুলো একে একে খুলে ফেলা হচ্ছে‌।

ভারতের প্রতিটা নাগরিক কোনো-না-কোনো হিসাবে সংখ্যালঘু। আমাদের দেশটা হলো তার সংখ্যালঘুদের ভেতরে সংগঠিত সামাজিক সংহতি। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে একটা সংখ্যাগুরু গোষ্ঠী তৈরি করার লক্ষ্যে সামাজিক এই ঠাসবুনন খুলে ফেলা হচ্ছে কৃত্রিমভাবে জন্ম দেওয়া ‘বিক্ষুব্ধ হিন্দু সংখ্যাগুরু’দের ব্যবহার করে।

সংখ্যালঘুদের সমন্বয়ে গঠিত এই জাতির মধ্যে এমন খুব কম অংশই আছে, যারা নিজেদের নিয়ে একটা পরিষ্কার, দায়হীন ইতিহাস লিখতে পারে, যেখানে তাদের উপস্থিতি শুধু নিপীড়নের শিকার নিষ্পাপ গোষ্ঠী হিসেবে। আমাদের ইতিহাস একটা আরেকটাকে ছেদ করে, একসঙ্গে মিলে যায়, আবার একটা আরেকটাকে খেপিয়ে তোলে। সব কটি একসঙ্গে মিলেই আমাদের আত্মপরিচয় তৈরি হয়েছে। বর্ণ, শ্রেণি, ধর্ম, লিঙ্গ এবং জাতিসত্তা দিয়ে গঠিত সর্বব্যাপী যাজকতন্ত্রের বাইরেও আমাদের সমাজে উঁচু-নিচু ভেদ ছড়িয়ে আছে একদম আণবিক স্তরে। এখানে রয়েছে ক্ষুদ্র-উপনিবেশায়ন, ক্ষুদ্র-শোষণ, ক্ষুদ্র-পারস্পরিক নির্ভরশীলতা। সবকিছু মিলে এই সমাজ একটা ট্রাপেস্ট্রির (সুতো দিয়ে তৈরি সূক্ষ্ম নকশা করা পর্দাবিশেষ) মতো, যার একেকটা সুতো একেকটা মহাকাব্যের সমান এবং এর সব কটির জন্যই দরকার বিশেষ পাণ্ডিত্য, গবেষণা, যুক্তি, তর্ক, বিতর্ক এবং নিবিষ্ট চিন্তা। কিন্তু এই জটিল ট্রাপেস্টি থেকে একটা সুতো আলাদা করে তার মাধ্যমে গণধর্ষণের ডাক দেওয়া? গণহত্যার ডাক দেওয়া? এটা কি সমর্থন করার মতো কোনো বিষয় হলো?

ভারতীয় উপমহাদেশকে ভাগ করার সময় স্থানীয় জমিদার রাজাদের দ্বারা শাসিত শত শত স্বাধীন রাজ্যকে (অধিকাংশকেই তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করে) ভারত বা পাকিস্তানের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। তখন হাজার হাজার হিন্দু, মুসলিম, শিখ জনগণ একে অন্যের মুখোমুখি দাঁড়ায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়, কোটি কোটি মানুষ হয় বাস্তুচ্যুত। ওই সময়কালে কোনো একজন ব্যক্তি অথবা একটা সম্প্রদায়ের ওপর নেমে আসা দুর্যোগ ও দুর্ভোগ নিয়ে কোনো গল্প, তা সে যত সত্যই হোক না কেন, মিথ্যা বই কিছু হবে না, যদি তা বলার কৌশলে অন্য গল্পগুলো মুছে দেওয়া হয়। আর এই মিথ্যা একটি বিপজ্জনক মিথ্যা। জটিল ইতিহাসকে জলের মতো সরল করে তার সমস্ত খুঁটিনাটি ছিনতাই করে তাকে অস্ত্রের মতো ব্যবহার করার ফল মোটেও ভালো হবে না।

উপমহাদেশের সবাইকে এখন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা কি ন্যায়বিচারের সর্বসম্মত ধারণা তৈরির লক্ষ্যে এবং আমাদের সামষ্টিক স্মৃতিতে বিদ্যমান বেদনা এবং ঘৃণার ভূত তাড়ানোর উদ্দেশ্যে কাজ করব নাকি তা বাড়িয়ে তুলব‒সেটা আমাদের ঠিক করে নিতে হবে। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, তার নেতৃত্বে থাকা রাজনৈতিক দল এবং এর প্রসবকারী সংগঠন ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেভক সংঘ’ (আরএসএস, রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাসেবক সংঘ, মোদি এই ফ্যাসিস্ট সংগঠনের একজন সদস্য) মিলে তা বাড়িয়ে দেবে বলেই ঠিক করেছে। রক্তমাখা এই মাটির পেটের ভেতর থেকে খুব ভয়ংকর একটা কিছু ডেকে নিয়ে আসছে তারা। যে আগুন এরা সবাই মিলে ধরিয়েছে, তা কোনোভাবেই আগে থেকে ঠিক করে রাখা রাস্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। হয়তো শেষ পর্যন্ত সমগ্র দেশটাই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। এর সূচনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। ভারত আর কাশ্মীরের মুসলিম শুধু নয়, খ্রিষ্টানরাও তীব্রভাবে নিপীড়িত হচ্ছে। শুধু গত এক বছরেই শত শত গির্জার ওপর হামলা হয়েছে, যিশুর মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়েছে, যাজক ও নানদের লাঞ্ছিত করা হয়েছে।

আমরা কিন্তু সম্পূর্ণ একা। কেউ আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না, যেমন আসেনি ইয়েমেন, শ্রীলঙ্কা কিংবা রুয়ান্ডার ক্ষেত্রে‌। ভারতের ক্ষেত্রে অন্যরকম আশা করার কিছু নেই। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভালো-মন্দ বোধ নির্ধারণ করে মুনাফা, ক্ষমতা, জাত, শ্রেণি ও ভূরাজনীতি‌। এর বাইরে বাকি সব ভড়ং ছাড়া কিছু নয়।

ভারতকে শাসন করছে এমন কিছু মানুষ, যারা ক্ষমতাবান হয়েছে হাজার হাজার মুসলমানকে দিনদুপুরে খুন করার মাধ্যমে। এরা গুপ্তহত্যা চক্রান্তের গুজব ছড়িয়ে লোকদের উন্মত্ত করেছে এবং মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মুসলমানদের ওপর একের পর এক হামলা চালিয়েছে। অবশ্যই এই নিকৃষ্ট আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এসেছে সর্বস্তর থেকে। প্রতিবাদ এসেছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের থেকে, প্রতিবাদ এসেছে মুসলিমবিরোধী নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরোধিতাকারীদের থেকে, প্রতিবাদ এসেছে গত বছরের ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন থেকে এবং প্রতিবাদ এসেছে পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাডু, কেরালা ও মহারাষ্ট্রের অঞ্চলভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো থেকে, যারা বিজেপির সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেছে এবং একে পরাজিত করেছে। যদি বলি, যা ঘটছে অধিকাংশ ভারতীয় তা সমর্থন করে না, তাহলে মোটেও ভুল বলা হবে না।

অবশ্যই এই নিকৃষ্ট আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এসেছে সর্বস্তর থেকে। প্রতিবাদ এসেছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের থেকে, প্রতিবাদ এসেছে মুসলিমবিরোধী নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরোধিতাকারীদের থেকে, প্রতিবাদ এসেছে গত বছরের ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন থেকে এবং প্রতিবাদ এসেছে পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাডু, কেরালা ও মহারাষ্ট্রের অঞ্চলভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো থেকে

কিন্তু তাদের অসমর্থনের বহিঃপ্রকাশ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শুধু অপছন্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তারা হয়তো সব দেখেশুনে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে একবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে যায়, যা‌ কিনা দুধ-ঘি দিয়ে পোষা, বিশেষ মতাদর্শে টগবগে একদল‌ ফ্যাসিস্টকে আটকানোর কোনো ক্ষমতাই রাখে না। জাতীয় পর্যায়ে দেশের একমাত্র বিরোধী দল ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ শক্তিহীন এবং নৈতিক অবস্থান নিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। জনসম্মুখে বক্তৃতা দিতে গেলে তারা মুসলিম শব্দটি উচ্চারণ করতেও ভয় পায়।‌ মোদি যে ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারতের’ ডাক দিয়েছে, তা মূলত কোনো বিরোধী দল ছাড়াই সরকার চালানোর ডাক। এই পরিস্থিতি আর যাই হোক না‌ কেন, কখনো গণতন্ত্র হতে পারে না।

একটি নির্বাচনি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ার জন্য যা যা দরকার, খাতা-কলমে ভারতের তার সবই আছে। সংবিধান অনুযায়ী দেশটি ধর্মনিরপেক্ষ; এখানে রয়েছে গণতন্ত্র, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, নির্বাচিত শাসকদল ও বিরোধী দলের সমন্বয়ে গঠিত আইনসভা, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও মুক্ত গণমাধ্যম। কিন্তু সত্যিটা হলো, আরএসএস নামে খ্যাত ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাধর সংগঠনটি এই রাষ্ট্রযন্ত্রকে (তার বিচারব্যবস্থা, বেসামরিক প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা বাহিনী, পুলিশ বাহিনী এবং নির্বাচনি কলকবজা সমেত) ক্রমাগত দখল করে নিচ্ছে। ভারতের ওপর আরএসএসের পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় এখনো কিছু বাকি থাকলেও, রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর এর অত্যন্ত গভীর এবং প্রায়ই বিপজ্জনক প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সংগঠনটি সংবিধানের তোয়াক্কা না করে ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার দাবিতে দীর্ঘকাল ধরে প্রচারণা চালিয়ে আসছে। আরএসএসের চিন্তাগুরুরা প্রকাশ্যে হিটলারের সুনাম করে এবং জার্মানির ইহুদিদের সঙ্গে ভারতের মুসলমানদের তুলনা করে থাকে।

কেননা, শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্যধর্মের তথা হিন্দু বর্ণপ্রথার মৌলিক ভিত্তি হলো আর্য শ্রেষ্ঠত্ববাদ‒অর্থাৎ, মানুষের মাঝে কিছু মানুষ দেবতুল্য এবং বাকিরা অপূর্ণাঙ্গ, দূষিত এবং অচ্ছুত। আজকের দিনে এসেও হিন্দু সমাজ পরিচালিত হয় এই বর্ণপ্রথাকে ঘিরে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত যারা, তাদের মধ্য থেকেও অনেকে আরএসএসের র‌্যালি করেছে, প্রপাগান্ডার ঢেউয়ে ভেসে গিয়ে নিজেদের পরাধীনতার পক্ষে ভোট দিয়ে এসেছে। ২০২৫ সালে আরএসএসের শতবর্ষ পূর্ণ হবে। একশ বছরের ভগবদীয় নিষ্ঠা তাদের জাতির ভেতরে নতুন এক জাতিতে পরিণত করেছে। ঐতিহাসিকভাবে আরএসএস পশ্চিম উপকূলের ব্রাহ্মণদের নিয়ে গঠিত একটি ক্ষুদ্র উপদল দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত।

বর্তমানে এই সংগঠনের সদস্যসংখ্যা ১ কোটি ৫০ লাখ। সদস্যদের মধ্যে মোদিসহ তার কেবিনেটের কয়েকজন মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও গভর্নরদের অনেকেই আছে। আরএসএস এখন এক সমান্তরাল মহাবিশ্ব‌, যে বিশ্বের রয়েছে লাখ লাখ প্রাথমিক বিদ্যালয়, নিজস্ব কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র সংগঠন, প্রকাশনা সংস্থা, বনবাসী আদিবাসীদের ‘শোধন’ করে হিন্দু ধর্মে ‘ফেরত’ আনার জন্য ধর্মপ্রচার সংঘ, হরেক রকম নারী সংঘ, মুসোলিনির ব্ল্যাক শার্টের আদলে গড়ে ওঠা ভারী অস্ত্রে সুসজ্জিত লাখ লাখ তরুণকে নিয়ে গড়ে ওঠা আধা সামরিক বাহিনী আর ঝাঁকে ঝাঁকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন, যাদের কাজ হলো আসল সংগঠনকে আড়াল করে তার দায় এড়ানোর (plausible deniability) সুযোগ রাখা।

একদিকে কর্মসংস্থান কমতে কমতে ভারতজুড়ে অর্থনৈতিক মহামন্দার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে সম্প্রতি চালু হওয়া বেনামি ইলেকটোরাল বন্ডের সুবাদে গোপনে পাওয়া করপোরেট অনুদানে বিজেপি পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাজনৈতিক দলে। দলটির সমর্থক হিসেবে রয়েছে করপোরেট পুঁজি দ্বারা চালিত ভারতের সব কটি ভাষায় প্রচারিত কয়েকশ খবরের চ্যানেল, যেগুলোকে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব পালন করছে সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়াতে পটুবিশেষ কর্মীবাহিনী।

এসব সত্ত্বেও বিজেপি আরএসএসের ফ্রন্ট অফিস ছাড়া আর কিছু নয়। রাষ্ট্রের ভেতরের রাষ্ট্র এখন আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্বের রঙ্গমঞ্চে নিজের জায়গা দখলের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে। এরই মধ্যে শ্রদ্ধাভক্তি জানানোর জন্য আরএসএসের সদর দপ্তরে বিদেশি কূটনীতিকদের আনাগোনা শুরু হয় গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমানে বৈধতার খোঁজে প্রাণপাতকারীদের নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। কিন্তু বিপদ হলো, এরা বিশ্বাস করে, ন্যায়সংগতভাবে যা অর্জন করা যায় না, দূষিত পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে‌ তা পয়সা দিয়ে কেনা যেতে পারে।

২০২৫ সালে আরএসএস নিজেদের প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদ্‌যাপন করতে যাচ্ছে। ভারতের ইতিহাসে এই ঘটনা একটা গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে থাকবে। এর আগের বছর, ২০২৪ সালে আমরা পেতে যাচ্ছি একটা সাধারণ নির্বাচন।‌ এ কারণেই সম্ভবত হঠাৎ করে নৃশংস কর্মকাণ্ড বেড়ে গিয়েছে।

এদিকে আমাদের ধর্মাবতার মোদিজি সর্বত্র বিরাজমান। কোভিড টিকার সনদে তার মুখ। লক্ষ‌ লক্ষ সদ্যবেকার জনতা চাকরির পরিবর্তে যে আটা-লবণের বস্তা পাচ্ছে, সেখানেও তার মুখ। লোকে কী করে অকৃতজ্ঞ হয়?

কীভাবে অকৃতজ্ঞ হওয়া সম্ভব, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় যখন তারা দেখেছে হাজার হাজার চিতা আর গণকবর? কীভাবে অকৃতজ্ঞ হওয়া সম্ভব যখন তারা দেখেছে পবিত্র গঙ্গার জল ভারী হয়ে গেছে লাশে আর তার পাড়জুড়ে কোনো রকমে গর্ত খুঁড়ে চাপা দেওয়া হাজার হাজার মৃতদেহ? এসব দেখার পর তাদের যখন বলা হয়, মোদিজি না থাকলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতো, তখন তারা কী করে বিশ্বাস না করে থাকতে পারে?

আমাদের আশায় এখন দগদগে ক্ষত, কল্পনা দূষিত।

এই যুদ্ধে আরএসএস জিতে গেলে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। কারণ, ভারত বলে কোনো সত্তার অস্তিত্ব তখন আর থাকবে না। আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে। নির্বাচনের মাধ্যমে পরিস্থিতি পালটানো সম্ভব নয় আর। যুদ্ধের ঘানি এখন সবাইকেই টানতে হবে। আগুনের শিখা আমাদের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •