পানির দেশে পানি কোথায় গেল? কীভাবে গেল?

পানির দেশে পানি কোথায় গেল? কীভাবে গেল?

মাহতাব উদ্দীন আহমেদ ও পারভেজ আহমদ রনি

এই লেখাটি মূলত বিভিন্ন মানুষের সামষ্টিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা। এই লেখাটি লিখতে গিয়ে আমাদের কথা বলতে হয়েছে বহু মানুষের সাথে। এই সব মানুষের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া আমাদের পক্ষে এই লেখাটি লিখা সম্ভব হত না। আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই অভিনাথ মার্ডির পরিবারের সদস্য রোজিনা হেমব্রম (স্ত্রী), সোহাগী সরেন (মা), মাইকেল মার্ডি (ভাই), পার্বতী সরেন(ভাবী), রবি মার্ডির পরিবারের সদস্য দুলিনা মুর্মু (মা), সুশীল মার্ডি (ভাই), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সরওয়ার জাহানসহ রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের কৃষক,পাম্প অপারেটর, দিনমজুর, কৃষিমজুর, গৃহিনী, দোকানদার, স্থানীয় ডাক্তার, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, এনজিও কর্মী, কারুশিল্পী এবং সর্বোপরি স্থানীয় সকল মানুষের প্রতি যারা নিজেদের জরুরী কাজ ফেলে রেখে আমাদের সময় দিয়েছেন, তথ্য দিয়েছেন, জানিয়েছেন, বুঝিয়েছেন। একই সাথে এই লেখা লিখতে গিয়ে আমাদের সাহায্য নিতে হয়েছে বহু সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের। ফলে আমরা আরও কৃতজ্ঞতা জানাই সেই সাংবাদিকদের প্রতি যারা গত এক দশক ধরে যত্নের সাথে এই অঞ্চলের পানি সংকট নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন করে চলেছেন একের পর এক।

রাজশাহীর গোদাগাড়ীর নিমঘুটু গ্রামের দুই সাঁওতাল কৃষক অভিনাথ ও রবি গত মার্চ মাসে আত্মহত্যা করলেন সেচের পানি না পেয়ে। ১২দিন ধরে তারা জমিতে সেচ দেয়ার পানি পাচ্ছিলেন না। পাম্প অপারেটর সাখাওয়াত তাদের ঘুরাচ্ছিলেন আজ দেব কাল দেব বলে। বাংলাদেশে সেচের পানি না পেয়ে কৃষকের আত্মহত্যা সম্ভবত এটাই প্রথম। পুরো ঘটনাটিকে একজন ব্যক্তি ওয়ার্ড কৃষক লীগের সভাপতি সাখাওয়াতের স্বেচ্ছাচারিতার ফসল হিসেবে দেখছেন অনেকে, এতে আসল সমস্যার দিকে আমাদের নজর যাবে না।

প্রকৃত সমস্যা হল আসলেই এলাকায় পানি প্রায় নেই। শুনতে আমাদের যতই ধাক্কা লাগুক, ঘটনা আসলেই তাই। সাখাওয়াতের মতো পাম্প অপারেটররা স্থানীয় রাজনৈতিক ক্ষমতাবলয়ে থেকে সেই পানি সংকটকে পুঁজি করেই স্বেচ্ছাচারিতা চালাচ্ছে সেটা সত্য, তার চেয়ে বড় সত্য হল মাটির নিচের পানির স্তর নেমে যাচ্ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এই অবস্থা চলতে থাকলে আক্ষরিক অর্থেই এই পুরো জনপদের মরুভূমি হয়ে যাওয়ার হুমকি রয়েছে। নিরাপদ খাওয়ার পানি ও সেচের পানির এই হাল এখন প্রায় পুরো বাংলাদেশেই। যার পরিচয় “নদীমাতৃক” বলে এখনো স্কুলের পাঠ্যবইয়ে পড়ানো হয়, সেই মিঠা পানির দেশে পানি হারিয়ে গেল কিভাবে? দৃকের গবেষণা বিভাগের পক্ষ থেকে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে সরেজমিন অনুসন্ধানের ভিত্তিতে সেই গল্পটিই এখানে বলার চেষ্টা করব। এই গল্পের নানা চরিত্র – স্থানীয়, দেশীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক।

সেচের পানি না পেয়ে আত্মহত্যা করা সাঁওতাল কৃষক অভিনাথ মার্ডির মা সোহাগী সরেনের চোখে অনেক প্রশ্ন, যার উত্তর দেয়ার কথা এই রাষ্ট্রের। — ছবি: মাহতাব উদ্দীন আহমেদ

এক ফসলী জমিকে জোর করে তিন ফসলী বানানো উন্নয়ন

এই বরেন্দ্র অঞ্চল ছিল প্রাকৃতিকভাবে একফসলী। এখানে সারা বাংলাদেশের তুলনায় বৃষ্টিপাত কম। বর্ষা মৌসুমে এখানে ধান হত। বাকি মৌসুমে জমিতে ধান আবাদ হত না। বরেন্দ্র অঞ্চল বাংলাদেশের সমতলের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু অঞ্চল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর কোন কোন জায়গা এমনকি ৪৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু। যেখানে বাংলাদেশের অন্যান্য সমতলের অঞ্চল গড়ে ৯-১০ মিটার উঁচু। সারাদেশে যেখানে গড়ে বার্ষিক ২৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় সেখানে বরেন্দ্র অঞ্চলে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১২০০-১৩০০ মিলিমিটার। যদিও ২০২০ সালে এই অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১৮০০ মিলিমিটার হয়েছিল। কিন্তু তার আগে ২০১৮ সালের পূর্ববর্তী ৭ বছর ধরে কোনবারই বৃষ্টিপাত ১৪০০ মিলিমিটারের অতিক্রম করেনি বলে জানা যায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সংবাদ প্রতিবেদনে। অন্যদিকে এই অঞ্চলে যে স্তরে পানির অ্যাকুইফার রয়েছে সেটির উপরে রয়েছে পুরু কাদার স্তর। ফলে বৃষ্টির পানি এই কাদার স্তর ভেদ করে পানির অ্যাকুইফারের স্তরে যেতেও অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি বাধার মুখে পড়ে।

এই অঞ্চলের এসমস্ত প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে উপেক্ষা করেই গত শতাব্দীর ৮০র দশকের মাঝামাঝি থেকে, আরও সক্রিয়ভাবে ৯০ এর দশকের শুরু থেকে প্রাকৃতিকভাবে একফসলী হওয়ার উপযোগী এই অঞ্চলটিকে জোর করে তিনফসলী বানানো শুরু হয়। আর এই কাজে ব্যবহার করা হয় সবুজ বিপ্লবের কৃষি মডেল। কৃষিখাতের একচেটিয়া বৈশ্বিক পুঁজির স্বার্থে যে মডেল চাপানো হয়েছে সারা দুনিয়া জুড়েই। যে মডেলের কৃষি নির্ভর করে প্রচুর সার, প্রচুর কীটনাশক এবং প্রচুর পরিমাণে যান্ত্রিক সেচের উপর।

সেই সেচ যদি এই অঞ্চলে ভূ-উপরিস্থ পানি দিয়ে দেয়া হত তাহলেও পানির সমস্যা এত প্রকট হত না। কিন্তু সেটা করা হয়নি। প্রথমত, শুরুর দিকে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার নিয়ে রাষ্ট্রের কোন কার্যকর মাথাব্যাথাই ছিল না। দ্বিতীয়ত, যখন মাথাব্যাথা শুরু হল ততদিনে যে নদী, খাল, বিলগুলো ছিল সেগুলো হয় মরে গেছে নয় পানির প্রকট স্বল্পতায় ভোগা শুরু করেছে। তার কারণ একদিকে যেমন উজানের ভারত সরকারের দেয়া বাঁধ, ব্যারেজ; অন্যদিকে ভাটির এই দেশের ভূমিদস্যূ, নদীখেকো, বিলখেকোদের তৎপরতা, আমাদের সরকারগুলো যাদের বরাবর রক্ষা করে এসেছে।

সেচের পানি না পেয়ে আত্মহত্যা করা সাঁওতাল কৃষক রবি মার্ডির মা দুলিনা মুর্মুর দিন কাটে ছেলের কথা চিন্তা করে। তিনি জানান, তার গলা দিয়ে আর ভাত নামে না। — ছবি: মাহতাব উদ্দীন আহমেদ

সরকারের পানি নীতিতে এই সংকটের কিছু “প্রতিফলন”

ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে সরকারগুলোর দৃষ্টিভঙ্গীর বড় প্রমাণ ১৯৯৯ সালে প্রণীত ‘জাতীয় পানি নীতি’। ততদিনে ভূগর্ভস্থ পানি এভাবে টেনে নিলে যে বিপদ আছে সেটা নিয়ে কমবেশি দেশের মানুষও অবগত। সেই পানি নীতিতে “পানি সরবরাহ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা” অনুচ্ছেদে স্বীকার করা হয় যে “সেচের জন্য ব্যাপক মাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে বহু এলাকায় পানির স্তর হস্তচালিত নলকূপেরও কার্যকর নাগালের নিচে নেমে গেছে।” সেখানে এটাও স্বীকার করা হয় যে এর বিপদ হিসেবে, আর্সেনিক, লবণাক্ততা ইত্যাদি সমস্যা বাড়বে। কিন্তু এতসব কথা বলার পরেও সেই অনুচ্ছেদে সমস্যা মোকাবেলায় যে নীতি নির্ধারণ করা হয় তাতে মূল ফোকাসটি ছিল শহরের প্রাকৃতিক জলাশয় সংরক্ষণ। গ্রামের কথা সেখানে নেই। সেই পানি নীতির “পানি ও কৃষি”  অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ভূউপরিস্থ পানির পাশাপাশি কৃষিতে প্রবৃদ্ধির জন্য ভূগর্ভস্থ পানিতে সেচ কাজের বেসরকারী কর্মকান্ড অব্যাহত থাকবে।” পানির অধিকার ও বন্টন অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “বেসরকারী বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য সরকার বেসরকারী এবং এলাকাভিত্তিক কোন সংস্থাকে ভূউপরিস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির অধিকার অর্পণ করতে পারে।”

পুরো পানি নীতির কোথাও বৃষ্টির পানিকে ধরা, সেটা ভূগর্ভে পাঠানোর ব্যবস্থা করা, নদী-খাল-বিলগুলোর নাব্যতা রক্ষা, ভূগর্ভের পানি ব্যবহারে কোন প্রকার রেশনিং করা, ভারতের কাছ থেকে ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সরব আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ভূমিকা নেয়া এগুলোর ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন উল্লেখ ছিল না। যা ছিল তা খুবই ভাসা ভাসা। এমনকি আত্মসমর্পণের মতো করে এই কথাও স্বীকার করে নেয়া হয়েছে শুরুতেই যে, “সবচেয়ে ভাটিতে অবস্থানের কারণে সীমান্ত দিয়ে প্রবিষ্ট নদীর উপর বাংলাদেশের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।” পরবর্তী দুই দশকে সরকারগুলোর কর্মকান্ড এই পানি নীতিকেই অনুসরণ করেছে।

পুরো পানি নীতির কোথাও বৃষ্টির পানিকে ধরা, সেটা ভূগর্ভে পাঠানোর ব্যবস্থা করা, নদী-খাল-বিলগুলোর নাব্যতা রক্ষা, ভূগর্ভের পানি ব্যবহারে কোন প্রকার রেশনিং করা, ভারতের কাছ থেকে ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সরব আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ভূমিকা নেয়া এগুলোর ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন উল্লেখ ছিল না।

অভিনাথ মার্ডির কবর। কবরের পাশে সাঁওতাল রীতি অনুযায়ী অভিনাথের জন্য খাওয়ার পানির কলস রাখা। সেই কলসও শুকিয়ে গেছে। — ছবি: মাহতাব উদ্দীন আহমেদ

পানি সংকট সৃষ্টিতে সরকারি সংস্থা যেভাবে ভূমিকা রেখেছে

বরেন্দ্র অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হলেও এই অঞ্চলে এখন যেরকম পানির সংকট তেমন সংকট তিন-চার দশক আগেও ছিল না। স্বাধীনতার পর পর ১৯৭৫ সালেও এখানে শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর ছিল মাটির মাত্র ২০ ফুট গভীরে। তখন এখানে হাতে গোনা কয়েকটি ডিপ টিউবয়েল ছিল। প্রকৃতপক্ষে এই অঞ্চলের মাটির নিচে কাদার পুরু স্তরের কারণে এখানে গভীর নলকূপ তৎকালীন প্রযুক্তিতে বসানো অসুবিধাজনক ছিল। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন বিএডিসি শুরুতে সেচের জন্য যে ৩০০০ গভীর নলকূপ বসায় তখন বরেন্দ্র অঞ্চলকে তার আওতা থেকে বাদ রেখেই বসায়। পরবর্তীকালে বিএডিসির প্রকৌশলীরা বরেন্দ্রর বিশেষ মাটিস্তরের মধ্যে থেকে কিভাবে ভূগর্ভস্থ পানি আনা যাবে সেই প্রযুক্তি আবিষ্কার করে। ১৯৮৫ সালে সরকার হাতে নেয় ‘বরেন্দ্র সমন্বিত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প’ বা Barind Integrated Area Development Project। পরবর্তীতে সেই প্রকল্পের সূত্র ধরেই ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এখন বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য এ বিষয়ক যে সংশ্লিষ্ট সরকারী সংস্থাটি রয়েছে, সেই বিএমডিএ বা বরেন্দ্র বহুমুখী ‍উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। মূলত বিএমডিএ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় ব্যাপক মাত্রায় এই অঞ্চলে ডিপ টিউবয়েল বসানো।

যত বেশি করে ডিপ টিউবয়েল বসানো হতে থাকে ততই দ্রুত হারে নামতে থাকে ভূগর্ভের পানির স্তর। যেখানে ১৯৬৬-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলের পানির স্তর শুষ্ক মৌসুমে মাত্র ২০ ফুট নিচে ছিল সেখানে ২০১০ সালের মধ্যেই এই অঞ্চলের পানির স্তর শুষ্ক মৌসুমে নেমে যায় ৪৭ ফিট নিচে। আর আমরা এইবার যখন শুষ্ক মৌসুমে এই অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরলাম, এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে জানতে পারি সেই পানির স্তর এখন অন্তত ১২০ ফিট থেকে ২০০ ফিট নিচে! এর বিস্তারিত এই লেখারই পরবর্তী অংশে দিব। আপাতত উদাহরণ হিসেবে তানোরের কথা বলা যায়, ১৯৮৬ সালে তানোরে সরকারী ডিপ টিউবয়েল ছিল ১২২টি। ২০১০ এর মধ্যে এই সংখ্যা ৫০০তে গিয়ে ঠেকে।

২০১২ সালের পর থেকে সমালোচনার মুখে বিএমডিএ ডিপ টিউবয়েল বসানো বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তার স্থান দখল করে বেসরকারি মালিকানার মিনি ডিপ টিউবয়েলগুলো। সরকারের পানি নীতি অনুযায়ীই কাজটি হয়। বর্তমানে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে বিএমডিএর ১৫ হাজারেরও বেশি ডিপ টিউবয়েল রয়েছে, যার মধ্যে শুধু রাজশাহী বিভাগেই রয়েছে ৮ হাজারের বেশি ডিপ টিউবয়েল। এককভাবে সবচেয়ে বেশি নলকূপ হল রাজশাহীর গোদাগাড়ী আর তানোরে। গোদাগাড়ীতে ৭১৩টি আর তানোরে ৫১৯টি। এটা হল সরকারি হিসেব। বেসরকারি মিনি ডিপগুলোকে হিসেবে ধরলে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে। গত বছর পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় যে খোদ বিএমডিএর হিসেবেই গোটা বরেন্দ্র অঞ্চলে যত পানি তোলা হয় মাটির নিচ থেকে তার প্রায় ৭০ শতাংশই আসে বেসরকারি মালিকানাধীন ডিপ টিউবয়েল থেকে!

যে গোদাগাড়ী আর তানোরে সবচেয়ে বেশি ডিপ টিউবয়েল সেই গোদাগাড়ী আর তানোরের গ্রামে গ্রামে এখন পানির জন্য তীব্র হাহাকার চলে। আত্মহত্যা করা সাঁওতাল কৃষকেরা গোদাগাড়ী উপজেলারই বাসিন্দা। এই যথেচ্ছভাবে ডিপ টিউবয়েল বসানোর ফলাফল খোদ সরকারি সংস্থার জরীপেই উঠে এসেছে। সরকারি সংস্থা ওয়ারপো গত বছর রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর ৫০টি জায়গায় প্রায় দেড় হাজার ফুট পর্যন্ত বোরিং করে জরীপ চালায়। সেই জরীপে কোথাও কোথাও তারা পানির স্তরেরই সন্ধান পায়নি! অর্থাৎ সেসব জায়গা থেকে হারিয়ে গেছে মাটির নিচের পানি।

আত্মহত্যা করা সাঁওতাল কৃষকেরা গোদাগাড়ী উপজেলারই বাসিন্দা। এই যথেচ্ছভাবে ডিপ টিউবয়েল বসানোর ফলাফল খোদ সরকারি সংস্থার জরীপেই উঠে এসেছে। সরকারি সংস্থা ওয়ারপো গত বছর রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর ৫০টি জায়গায় প্রায় দেড় হাজার ফুট পর্যন্ত বোরিং করে জরীপ চালায়। সেই জরীপে কোথাও কোথাও তারা পানির স্তরেরই সন্ধান পায়নি!

অবশেষে অভিনাথের ক্ষেতে পানি এল তার মৃত্যুর বিনিময়ে — ছবি: মাহতাব উদ্দীন আহমেদ

এই অঞ্চলের নদীগুলো কোথায় গেল?

প্রধান নদী পদ্মা ছাড়াও এই অঞ্চলে নদনদীর অভাব ছিল না। এগুলোর বহু শাখা নদীও ছিল। নদীগুলো যখন জীবন্ত ছিল তখন মানুষ নদী, খাল, বিলের পানিতেই সেচ দিত। কিন্তু নদীগুলো এখন মৃতপ্রায়। এই নদীগুলো হত্যার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রেখেছে ভারত, পদ্মাসহ বেশিরভাগ আন্তঃদেশীয় নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করার মাধ্যমে। আর ভাটিতে বাংলাদেশের সরকার সেই অন্যায় পানি প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর আন্তর্জাতিক চাপ গড়ে তোলেনি। শুধু তাই নয় এক্ষেত্রে কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার মতো করে ছোট, মাঝারি নদীগুলোকে মারছে বাংলাদেশের সরকারের বিভিন্ন ‘উন্নয়ন’ প্রকল্প।

১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার কয়েক বছরের মাথায়ই তার প্রভাব পড়া শুরু করে। শুকিয়ে যেতে থাকে পদ্মা, এখন পদ্মায় শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকেনা বললেই চলে। ফারাক্কা নিয়ে এবং সাম্প্রতিককালে তিস্তা নিয়ে দেশে কথাবার্তা হয়, তবে তার চেয়ে বড় মাথাব্যাথার কারণ হল ভারতের অন্যান্য নদী বিষয়ক কর্মকান্ড। প্রকৃতপক্ষে গঙ্গা নদীকে মেরে ফেলার যতো আয়োজন ভারত করেছে তার মধ্যে ফারাক্কা ছোট একটি অংশ। ফারাক্কা পয়েন্টের আগেই গঙ্গা নদীতে অন্তত ২৪টি জায়গায় বাঁধ ও ব্যারেজ বানিয়ে পানি আটকিয়ে সেই পানি প্রত্যাহার করেছে ভারত। শুধু তাই নয় উজানে গঙ্গার উপনদীগুলোতে নেপালও বাঁধ দিয়েছে। ফলে ফারাক্কা পয়েন্টের পুরো পানিও যদি এখন বাংলাদেশ পায় তাতেও বাংলাদেশের পদ্মা নদীর খুব একটা লাভ হবে না, যদিও সেটাও বাংলাদেশ পায় না। ২০১৮ সালে ভারতের একটি নাগরিক কমিটি পুরো গঙ্গা বেসিনে (শুধু গঙ্গা নদী নয়) ভারত কয়টি বাঁধ, ব্যারেজ, নিচুবাঁধ বানিয়েছে তার একটা হিসাব দেয়। সেই সংখ্যাটি আঁতকে উঠার মতো। পুরো গঙ্গা বেসিনে অন্তত ৯৪২টি বাঁধ, নিচুবাঁধ ও ব্যারেজ বসিয়েছে ভারত। যার প্রভাব ভারতসহ এই পুরো অঞ্চলেই পড়েছে। মহানন্দা, পুনর্ভবা, করতোয়া, নাগরসহ বিভিন্ন নদীতেই রয়েছে ভারতের বাঁধ, ব্যরেজ। ফলাফল সেই নদীগুলোও পানিশূন্য হয়ে পড়ছে।

২০১৮ সালে ভারতের একটি নাগরিক কমিটি পুরো গঙ্গা বেসিনে (শুধু গঙ্গা নদী নয়) ভারত কয়টি বাঁধ, ব্যারেজ, নিচুবাঁধ বানিয়েছে তার একটা হিসাব দেয়। সেই সংখ্যাটি আঁতকে উঠার মতো। পুরো গঙ্গা বেসিনে অন্তত ৯৪২টি বাঁধ, নিচুবাঁধ ও ব্যারেজ বসিয়েছে ভারত। যার প্রভাব ভারতসহ এই পুরো অঞ্চলেই পড়েছে। মহানন্দা, পুনর্ভবা, করতোয়া, নাগরসহ বিভিন্ন নদীতেই রয়েছে ভারতের বাঁধ, ব্যরেজ। ফলাফল সেই নদীগুলোও পানিশূন্য হয়ে পড়ছে।

আমরা যে অঞ্চলে গিয়েছিলাম সেই রাজশাহী আর চাঁপাইনবাবগঞ্জে এবং তার আশেপাশে যেসব নদী আছে সেগুলো হল: পদ্মা, মহানন্দা, পাগলা, বারনাই, গুরনাই, বড়াল, আত্রাই, শিব, নাগর, তুলসিগঙ্গা। এদিকে শুধু রাজশাহী জেলাতেই ছিল পদ্মার ৯টি শাখানদী যেগুলোকে মেরে ফেলা হয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে, স্লুইসগেট বানিয়ে। অনেক জায়গায় এখন সেই নদীগুলোর চিহ্ন পর্যন্ত নেই।পদ্মা আর মহানন্দা তো মেরেছে ভারত। মহানন্দায় পানি না থাকার সুযোগে তার শাখা পাগলাতেও আর পানি থাকছে না। সেই সুযোগে এককালের প্রমত্তা এই নদীগুলো পড়েছে নদীখেকোদের কবলে। এই নদীখেকোর তালিকায় স্থানীয় প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা যেমন আছে ঠিক তেমনি রয়েছে খোদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভা। তারা মহানন্দার তীরে ৫ বছর ধরে ময়লা আবর্জনা ফেলে ভরাট করছে।১০ অন্যদিকে বেঁড়ি বাধ নির্মাণ করে পদ্মার সাথে পাগলার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পরে একসময়ের প্রমত্তা ৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ পাগলা নদীতে এখন বর্ষাকালেও পানি থাকে না অনেক সময়।১১ একই অবস্থা পার্শ্ববর্তী জেলা নওগাঁর ১১০ কিলোমিটার দীর্ঘ তুলসীগঙ্গা নদীর। তাজনগর এলাকায় বাঁধ দিয়ে পানিপ্রবাহ আটকে, গতি পরিবর্তন করে এটিকে যখন ছোট যমুনা নদীর সাথে যুক্ত করা হয় তারপর থেকে মরতে থাকে তুলসীগঙ্গা। এখন পড়েছে দখলের কবলে। নদীর নওগাঁ অংশে ৩০ কিলোমিটারে নদীতে কোন পানি থাকে না।১২ বারোমাস ধরেই নাব্যতা থাকত দেখে বারনই নদীর নাম হয়েছিল বারনই। কয়েক বছর আগে সেখানে রাবার ড্যাম নির্মাণ করার পর থেকে নাব্যতা হারায় নদীটি বলে অভিযোগ রয়েছে। রাবার ড্যাম বানিয়েছে খোদ বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষই।১৩বড়াল নদীকে মেরে ফেলা হয়েছে উৎসমুখে বাঁধ, স্লুইসগেট বসিয়ে আর ভাটিতে আড়াআড়ি তিনটা বাঁধ দিয়ে পানিপ্রবাহ থামিয়ে দিয়ে। এখন বড়ালের বুকে ধান চাষ হয়।১৪ নওগাঁর পুনর্ভবা নদীতে এখন পানিই থাকে না বর্ষাকাল ছাড়া। নদীর বুকে মহিষের গাড়ি চলে। পুনর্ভবা নদী এখন পরিণত হয়েছে খেলার মাঠে!১৫শিব নদীতে হয় ধানচাষ। শিব মারা গেছে কারণ শিব হল আত্রাইয়ের শাখা নদী। আত্রাইয়েই পানি নাই। এক সময়ের খরস্রোতা আত্রাই এখন পুরোপুরি শুকিয়ে যায় মাঝে মাঝেই। কারণটা ওপারে ভারতের বাঁধ বলে অভিযোগ আছে।১৬

এদিকে শুধু রাজশাহী জেলাতেই ছিল পদ্মার ৯টি শাখানদী যেগুলোকে মেরে ফেলা হয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে, স্লুইসগেট বানিয়ে। অনেক জায়গায় এখন সেই নদীগুলোর চিহ্ন পর্যন্ত নেই।পদ্মা আর মহানন্দা তো মেরেছে ভারত। মহানন্দায় পানি না থাকার সুযোগে তার শাখা পাগলাতেও আর পানি থাকছে না। সেই সুযোগে এককালের প্রমত্তা এই নদীগুলো পড়েছে নদীখেকোদের কবলে।

এদিকে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের দেয়া তথ্যমতে, শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জেই রয়েছেন ১৪৫ জন নদী দখলকারী। রাজশাহীর মোহনপুরে নালা দখলকারী আছেন অন্তত ৩১ জন, চারঘাটে নদী দখলকারী আছেন অন্তত ৫৬ জন, আর তানোরে বিল দখলকারী আছেন অন্তত ১০৯ জন।১৭ এই দখলকারীরা যে সরকারের আশ্রয় প্রশ্রয় ছাড়া এই কাজ করেনি সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ভূগর্ভের পানির স্তরের সাথে যেমন নদীর পানি সম্পর্কিত তেমনি নদীর পানির উপরেও ভূগর্ভের পানির স্তর সম্পর্কিত। দুটোই একে অপরকে রিচার্জ করতে পারে। কিন্তু এই বরেন্দ্র অঞ্চলে নদীগুলোর এই দশা হওয়া আর ডিপ টিউবয়েল বসানো দুটোই একই তালে এগিয়েছে। একই সাথে দুই উৎস থেকেই প্রত্যাহার হয়েছে পানি। ভূগর্ভের পানির স্তর যে ৬ থেকে ৮ গুণ নিচে নেমে গেল গত তিন দশকে সেটি একারণেই।

বরেন্দ্র অঞ্চলে নদীগুলোর এই দশা হওয়া আর ডিপ টিউবয়েল বসানো দুটোই একই তালে এগিয়েছে। একই সাথে দুই উৎস থেকেই প্রত্যাহার হয়েছে পানি। ভূগর্ভের পানির স্তর যে ৬ থেকে ৮ গুণ নিচে নেমে গেল গত তিন দশকে সেটি একারণেই।

এখানকার নদীগুলোর ক্ষেত্রে একটি কথা প্রায়ই মিডিয়াতে বলা হয় যে ড্রেজিং করাতে হবে, নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু পানিই যেখানে নেই নদীতে সেখানে ড্রেজিং করে হবে কী? এখানে আরও যেটি মনে রাখা প্রয়োজন যে নদীতে ড্রেজিং একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটি প্রতিবছর করতে হয়। এটি শুধু এক বছর করলাম আর এর পরে কয়েক বছর করলাম না ব্যাপারটা তা নয়। বর্ষাকালে যে পরিমাণ পলি আসে উজান থেকে সেটি দিয়ে ড্রেজিং করা নদী ভরাট হয়ে যায়। উজানে নদীর পানি প্রবাহ আটকানো না ঠেকালে, ভাটিতে পানি প্রবাহ নষ্ট করার ব্যবস্থাগুলো না সরালে, অর্থাৎ নদীর পানি প্রবাহ ছাড়া শুধু ড্রেজিং করে নদীর পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো যায় না। আর নদীতে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক থাকলে অত ড্রেজিংএরও দরকার পড়ে না।

সরেজমিন গিয়ে সংকটের এখনকার যে চেহারা দেখা গেল রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে

দুই সাঁওতাল কৃষক মারা যাওয়ার পরে দৃকের গবেষণা বিভাগের পক্ষ থেকে আমরা গত এপ্রিল মাসে সরেজমিন অনুসন্ধানের জন্য রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর উপজেলা আর চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঝিলিম ইউনিয়নে যাই। সেখানে কৃষক ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে আমরা জানতে পারি যে, ওই অঞ্চলগুলোতে খাওয়ার পানির জন্য যেসব চাপকল ছিল সেগুলো অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে অন্তত ২০ বছর আগেই। কারণ কোন চাপকলেই আর পানি উঠত না। এলাকার প্রবীণ মানুষেরা জানান, চাপকল বসানোর আগে এলাকার পুকুর, কুয়ার পানিই খেতেন মানুষ। তাতে ডায়রিয়ার সমস্যা ছিল। কিন্তু এটাও সত্যি যে, পানির অপ্রতুলতাও ছিল না তখন। এরপর যখন নলকূপ আসে তখন থেকে মানুষ ধীরে ধীরে মাটির নিচের পানি খাওয়ার উপরই অভ্যস্ত হতে থাকে। পরবর্তীতে পুকুরগুলো ধীরে ধীরে মাছ চাষের জন্য নিয়ে যাওয়া হল। এক পর্যায়ে সেই পুকুরগুলোও শুকিয়ে যেতে থাকল।

খেয়াল রাখতে হবে সেই সময়টাতেই একদিকে একের পর এক ডিপ টিউবয়েল উঠিয়ে পানি তোলা হচ্ছিল সেচের জন্য আর অন্যদিকে নদীগুলোর পানি হারিয়ে যাচ্ছিল। নদীর পানি হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে কুয়া আর পুকুরগুলোও হারিয়ে যাওয়ার ফলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঝিলিম ইউনিয়নে এরশাদের আমলে ট্রাকে করে খাওয়ার পানি আনা হত বলেও জানান এলাকার মানুষ। টিউবয়েল আসার পরে কিছুদিন স্বস্তি পেয়েছিলেন তারা অবশ্যই। কিন্তু ২০ বছর আগে যখন পানির স্তর এতটাই নিচে নেমে যায় যে খাওয়ার পানির চাপকলগুলোতে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে গেল তখন মানুষের খাওয়ার পানির একটা সংকট দেখা দেয়। সেই সংকট কাটাতে এখন সেখানে বিএমডিএ যে নিদান দিল সেটি হল গ্রামের ডিপ টিউবয়েলগুলোর পাশেই উঁচু ট্যাংকি বানিয়ে সেই ট্যাংকিতে পানি উঠিয়ে সেখান থেকে পাইপে করে বাড়ি বাড়ি খাওয়ার পানি সরবরাহ করা। মানে পুরোপুরি প্রায় শহরাঞ্চলে যেভাবে পানি সরবরাহ করা হয় সেভাবে। যদিও এই ব্যবস্থা যে পুরো গ্রামের জন্য যথেষ্ট ছিল তাও না। ফলে প্রচুর বেসরকারি উদ্যোগে মিনি ডিপও বসানো শুরু হয়। শুরুর দিকে এগুলো বসানো হয় মূলত খাওয়ার পানির অভাব মেটাতেই।

বিএমডিএ এর স্থাপিত একটি ডিপ টিউবয়েল, যেটি এখন পরিত্যাক্ত। কারণ মাটির তলে পানি নেই আর। — ছবি: মাহতাব উদ্দীন আহমেদ

এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, এই প্রেক্ষাপটে একই সাথে বিএমডিএর যেসব ডিপ টিউবয়েল ছিল শুধু সেচের জন্যই, সেই ডিপ টিউবয়েলগুলোও একের পর এক বন্ধ হতে থাকে। কারণ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নামতে থাকে, ফলে আরও বেশি গভীরতার ডিপ টিউবয়েল বসানো হতে থাকে। সেটিও কয়েকবছর পরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। ফলে একটা পর্যায়ে এই জায়গাগুলোর মানুষ যে মিনি ডিপগুলো শুরুতে বসিয়েছিল শুধু খাওয়ার পানির জন্য, সেই মিনি ডিপগুলো দিয়েই একযোগে ক্ষেতে সেচ দেয়া এবং খাওয়ার পানির চাহিদা মেটাতে থাকে। শুরু হয় আরও দ্রুততার সাথে পানির স্তর নামা।

যেভাবে যথেচ্ছভাবে এই ডিপ আর মিনি ডিপ বসানো হতে থাকে তাকে ‍উন্মাদতুল্য বললেও অত্যুক্তি হবে না। আমরা তানোরের চিনাশো, আমপুকুরিয়া, পাচন্দর, মরাপুকুরিয়া গ্রামগুলোতে গিয়ে এমন চিত্রও দেখতে পাই মাত্র ২৫০ মিটার ব্যাসার্ধের এলাকার মধ্যে অন্তত ৫টি ডিপ-মিনি ডিপ বসানো হয়েছিল। শুরুর তিনটি বসিয়েছিল বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষই। একটি বসানোর কয়েক বছরের মধ্যে পানি চলে গেলে তার অদূরেই আরেকটি ডিপ বসানো হয়। এভাবে একের পর এক। অন্যান্য জায়গাগুলোর চিত্রও এর থেকে খুব ভিন্ন কিছু দেখতে পাইনি আমরা। তানোরের গ্রামগুলোতে গিয়ে আমরা একের পর এক পরিত্যক্ত ডিপ ও মিনি ডিপ দেখতে পাই। এমনও দেখা যায় যে মাত্র ২০ ফিট দূরত্বের মধ্যে দুটি পরিত্যক্ত নলকূপ। অন্যদিকে তানোরের নোনাপুকুর জামতলায় গিয়ে আমরা দেখতে পাই বিএমডিএর ডিপ টিউবয়েলে তো পানি উঠছেই না ঠিকমতো, স্থানীয় কৃষকেরা নিজেরা যেসব মিনি ডিপ বসিয়ে জমিতে সেচ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন সেগুলোতেও পানি ঠিকমতো আসছে না। গোদাগাড়ীর দুই সাঁওতাল কৃষক তো ১২ দিন পানি পান নি। তানোরের ওই অঞ্চলের কৃষকেরা জমিতে পানি পাচ্ছেন না ২০ দিনের বেশি হল। কোনরকমে খাওয়ার পানিটুকু ধরার জন্য মিনিডিপগুলো চলছে। কৃষকেরা আমাদের দেখান যে পানি না পেয়ে কিভাবে প্রতিটি ধান গাছের গোড়ায় শীষ এসে আর বের হতে পারছে না। কৃষকরা জানান, এভাবে পানি পেতে দেরি হওয়ার কারণে শীষ ছোট হয়ে যাবে। ফলে ফলনও কমে যাবে।

তানোরের মুন্ডুমালা পৌরসভার পাশে স্থানীয় একটি এনজিওর স্থাপিত পানির স্তর মাপার পাইপ। ১৬০ ফুট পর্যন্ত নিচে গিয়ে পানি পাওয়ার সংকেত পাওয়া যেত। বর্তমানে পানি আর নেই। তাই এটি এখন পরিত্যাক্ত। — ছবি: মাহতাব উদ্দীন আহমেদ

আমরা গিয়ে এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে জানতে পারি গোদাগাড়ীতে বিভিন্ন জায়গায় এখন ১২০-১৪০ ফুট নিচে নেমেছে পানির স্তর। তানোরের মুন্ডুমালায় একটি বেসরকারী সংস্থা পানির স্তর মাপত পৌরসভার পাশের একটা জায়গায় পাইপের মধ্যে দিয়ে ডিভাইস পাঠিয়ে। সেখানে পানির স্তর ১৬০ ফিট নিচে যাওয়া পর্যন্ত রেকর্ড ছিল। তবে পানির স্তর মাপা বন্ধ হয়ে গেছে গত বছর থেকে। কারণ এখন ডিভাইস তার নিচে পাঠিয়েও কোন পানি পাওয়ার সংকেত পাওয়া যায় না। চাপাইনবাবগঞ্জের ঝিলিমে এখন পানির স্তর ১৬০ ফিট নিচে। কিন্তু তার নিচে গিয়ে আর কোন পানির স্তর নেই। এলাকার মানুষ জানান যে ২৫০ ফিট পর্যন্ত গিয়েও তারা ব্যক্তিগতভাবে বোরিং করে কোন পানির সন্ধান পাননি। নাচোলের কিছু মানুষ আমাদের জানান যে, সেখানে ৩০০ ফিট নিচে নেমে গেছে পানির স্তর।

পানির স্তর মাপা বন্ধ হয়ে গেছে গত বছর থেকে। কারণ এখন ডিভাইস তার নিচে পাঠিয়েও কোন পানি পাওয়ার সংকেত পাওয়া যায় না। চাপাইনবাবগঞ্জের ঝিলিমে এখন পানির স্তর ১৬০ ফিট নিচে। কিন্তু তার নিচে গিয়ে আর কোন পানির স্তর নেই। এলাকার মানুষ জানান যে ২৫০ ফিট পর্যন্ত গিয়েও তারা ব্যক্তিগতভাবে বোরিং করে কোন পানির সন্ধান পাননি। নাচোলের কিছু মানুষ আমাদের জানান যে, সেখানে ৩০০ ফিট নিচে নেমে গেছে পানির স্তর।

শুধু যে সেচ আর খাওয়ার পানির জন্যই মাটির নিচের পানি উঠানো হচ্ছে তাই নয়। ইচ্ছেমতো পানি তোলা হচ্ছে অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জন্যও। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঝিলিমের মানুষ আমাদের অভিযোগ করেন যে সেখানকার স্থানীয় অটোরাইস মিলগুলোতে ইচ্ছামতো বসানো হয়েছে ডিপ টিউবয়েল। যেগুলো দিনরাত পানি উঠাচ্ছে কোন নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই। সেই সাথে সেখানে স্থাপিত হয়েছিল দুইটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। একটি ১০০ মেগাওয়াটের সরকারি ও অন্যটি ৫০ মেগাওয়াটের বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র। সেই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্যও ভেতরে বড় বড় ডিপ টিউবয়েল বসানো হয়েছে বলে তারা আমাদের কাছে অভিযোগ করেন। তারা আরও অভিযোগ করেন যে, ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র আর চালকলগুলোতে ডিপ বসানোর পর থেকে তারা আর পানি পাচ্ছেন না ঠিকমতো। যদিও সেই অভিযোগ যাচাই করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে ৫০ মেগাওয়াটের বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এখন বন্ধ। গোদাগাড়ী থেকে ঝিলিম যাওয়ার পথে রাস্তার দুই ধারে আমরা প্রচুর জমি দেখতে পাই যেগুলোতে পানি না পাওয়ার কারণে এখন অনাবাদী হিসেবে ফেলে রাখা হয়েছে।

বেসরকারি মিনিডিপগুলো আসার পরে আরও একটি ঘটনা ঘটে। সেটি হল পানি কিনে খাওয়া। এখন সেটি পরিবারপ্রতি ৫০ টাকা মাসে। অন্যদিকে এখন সেচের পানির জন্য কৃষককে খরচ করতে হয় প্রতি মৌসুমে বিঘা প্রতি ৩০০০-৩৫০০ টাকা। এই অঞ্চলের কৃষকেরা জানান, তারা এই টাকা খরচ করেন ঠিকই কিন্তু পানি পান না ঠিক মতো। গোদাগাড়ী, তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ – সব জায়গাতেই কৃষকেরা আমাদের কাছে অভিযোগ করেন যে একে তো এমনিতেই পানি পাওয়া যায় না ঠিক মতো, সেটাতে মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো যোগ হয়েছে পাম্প অপারেটরদের স্বেচ্ছাচারিতা। এই পাম্প অপারেটরদের বেশিরভাগই বর্তমানে কোন না কোন ভাবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। গোদাগাড়ীর সাঁওতালরা জানান, সাঁওতাল হওয়ার কারণে তাদের অন্যান্য মুসলিম কৃষকদের থেকে বেশি ঘুরায় পাম্প অপারেটররা। শুধু তাই নয়, পানি সংকটের সুযোগে তাদেরকে দিয়ে বেগার খাটিয়ে নেন পাম্প অপারেটররা। পানি দেয়ার শর্ত হিসেবে কখনো হয়তো বলেন তার নিজের জমিতে কাজ করে দিতে, কখনো বা তার বাড়িতে কোন কাজে বেগার খাটিয়ে নেন। কৃষক সেখানে জিম্মি। কারণ তার পানি লাগবে। সাঁওতালরা আরও জানান, রাত ছাড়া কখনো তাদের পানি দেয়া হয় না।

একে তো এমনিতেই পানি পাওয়া যায় না ঠিক মতো, সেটাতে মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো যোগ হয়েছে পাম্প অপারেটরদের স্বেচ্ছাচারিতা। এই পাম্প অপারেটরদের বেশিরভাগই বর্তমানে কোন না কোন ভাবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। গোদাগাড়ীর সাঁওতালরা জানান, সাঁওতাল হওয়ার কারণে তাদের অন্যান্য মুসলিম কৃষকদের থেকে বেশি ঘুরায় পাম্প অপারেটররা। শুধু তাই নয়, পানি সংকটের সুযোগে তাদেরকে দিয়ে বেগার খাটিয়ে নেন পাম্প অপারেটররা।

পাশাপাশি দুইটি ক্ষেত। একই সময়ে লাগানো। অথচ দুইরকম চিত্র তাদের। বাম পাশেরটা বাঙালী মুসলমান কৃষকের। আর ডান পাশেরটা একজন আদিবাসী সাঁওতালের। বাঙালী মুসলমানের ক্ষেতটি পানি পাচ্ছে নিয়মিত। তাই শীষ বের হয়েছে। আর ডানপাশের আদিবাসী কৃষকের জমিটি পানি পায় না নিয়মিত। সেটিতে শীষ নেই। — ছবি: মাহতাব উদ্দীন আহমেদ

তানোরের চিনাশোর কৃষকেরা জানান, এমনও দেখা গেছে যে, যার টাকা আছে সে টাকার জোরে আগে আগে তার জমিতে পানি নেয়, এমনকি ঘন ঘন পানি নেয়। এমন ঘটনাও জানিয়েছে সেখানকার কৃষকেরা যে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে যে জমি পাম্পের আওতাভুক্ত নয় অনেক দূরের সেই জমিতেও নালা কেটে পানি দেয়া হয়েছে পাম্প থেকে। আমরা যেসব জায়গা ঘুরেছি সেই সব জায়গাতেই কৃষকেরা আমাদের বলেছেন- পাম্প অপারেটরদের মধ্যে এটা খুব সাধারণ চর্চা যে পাম্প এর সেচ দেয়ার ক্ষমতার বাইরে গিয়ে ওই পাম্পের সেচের আওতায় নতুন নতুন জমিকে নিয়ে আসা। কখনো কখনো পাম্প অপরারেটরা কৃষককে প্রলুব্ধ করেন এমন সব জমিতে আবাদ করতে যেটা পাম্পের আওতায় নেই। কিন্তু তারা সেখানে পানি দিবেন বলে কৃষককে আশ্বাস দেন। এভাবে পাম্পের সক্ষমতার বাইরে নতুন নতুন জমি আনতে পারলে পাম্প অপারেটরদের লাভ। কারণ পানি যতটুকুই দিক মৌসুম শেষে বিঘা প্রতি ৩০০০-৩৫০০ টাকা পাওয়া যায়। তাই বেশি টাকার লোভে এমনটি করা হয়। আর এই সবই ঘটে বিএমডিএর নাকের ডগায়। আর এইসব কিছু আরও বেশি করে নামিয়ে দিতে থাকে মাটির নিচের পানির স্তর।

সাঁওতালদের বিএমডিএ অফিস ঘেরাও করে স্মারকলিপি পেশ। ১১ এপ্রিল ২০২২। — ছবি: মাহতাব উদ্দীন আহমেদ

অন্যদিকে ওই অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামের নারীদের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, নলকূপগুলো হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে এখন এমনও হয়েছে যে, তাদের আধা কিলোমিটার থেকে এক কিলোমিটার দূর থেকে পানি আনতে হয়। আর এই পিতৃতান্ত্রিক বাস্তবতায় পানি আনার কাজটি সব সময় নারীদেরই করতে হয়। কাজটি নিয়মিত করায় তাদের মধ্যে পিঠের ব্যাথা খুবই সাধারণ ঘটনা। তারা জানান, প্রায় প্রায়ই রাতের বেলা তাদের ব্যাথার ওষুধ খেতে হয়। স্থানীয় বাজারে গিয়ে ফার্মেসী থেকে কিনে নিয়ে আসেন এসব ব্যাথার ওষুধ। এইসব ওষুধের তীব্র পাশ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তারা অবগত নন। তানোরের মরাপুকুরিয়া গ্রামে আমাদের সাথে সাক্ষাত হয় এক নারীর যিনি আমাদের সাথে সাক্ষাত হওয়ার কয়েকদিন আগেই একটি মেয়ে শিশুর জন্ম দিয়েছেন। তিনি জানান, তার সন্তান জন্ম নেয়ার দুই দিন আগে পানি আনতে গিয়ে তিনি পড়ে গিয়েছিলেন। তিনি আমাদের আরও জানান, যেসব বাড়িতে মিনি ডিপ বসানো হয়েছে সেখান থেকে পানি আনতে গিয়ে কটু কথা শোনা একটা খুবই সাধারণ ঘটনা। এসব ঘটনা মানসিক চাপও তৈরি করে তাদের মধ্যে। এমন কথাও তিনি বলেন যে তাদেরকে মাঝে মাঝে বলা হয় শুধু খাওয়ার পানি নিয়ে চলে যেতে। তিনি আমাদের প্রশ্ন করেন যে, তাহলে রান্না করবো কি দিয়ে আর গোসল করব কী দিয়ে? পানি তো আর কোথাও নাই। তার প্রশ্নের কোন উত্তর আমাদের জানা ছিল না।

আধা কিলোমিটার থেকে এক কিলোমিটার দূর থেকে পানি আনতে হয়। আর এই পিতৃতান্ত্রিক বাস্তবতায় পানি আনার কাজটি সব সময় নারীদেরই করতে হয়। কাজটি নিয়মিত করায় তাদের মধ্যে পিঠের ব্যাথা খুবই সাধারণ ঘটনা।

পানি খুব হিসেব করে খরচ করার কারণে এই অঞ্চলগুলোর মানুষের মধ্যে সারাক্ষণই আমরা পানি নিয়ে হাহাকার দেখেছি। এই সীমিত মাত্রায় পানি প্রাপ্তির অন্যান্য শারীরিক প্রভাবও আছে। আমরা কথা বলেছিলাম মুন্ডুমালা বাজারের স্থানীয় চিকিৎসকের সাথে। তিনি আমাদের জানান, এই অঞ্চলের নারীরা তার কাছে সবচেয়ে বেশি যেসব সমস্যা নিয়ে আসে তার মধ্যে অন্যতম হল ইউরিন ইনফেকশন। অন্যদিকে তার পর্যবেক্ষণ হল নারীদের ইউরিন ইনফেকশনের হার সাঁওতাল নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ওই অঞ্চলে। সেই বাজার থেকে আধা কিলো দূরেই রাস্তার পাশে আমাদের দেখা হয় কয়েকজন সাঁওতাল নারীর সাথে। তারা সেচের জন্য এখন পরিত্যক্ত এমন একটি বিএমডিএর নলকূপের পাশে বসে ছিলেন। ওই নলকূপ দিয়ে এখন শুধু খাবার, রান্নার পানিই নেয়া হয়। কিন্তু সেখান থেকে লাইন দিয়ে পানি নিতে হয়। ওই সাঁওতাল নারীরা জানান, এক কলস পানি ভর্তি হতে কখনো কখনো ঘন্টা পার হয়ে যায়। কারণটা যে খুব লম্বা লাইন হয় তা নয় কিন্তু, পানি প্রায়শই এতটাই ক্ষীণ ধারায় আসে যে তাতে সময় যায়।

এদিকে যে উচ্চ ফলনের গল্প শুনিয়ে এই প্রচুর সেচ নির্ভর সবুজ বিপ্লব আমদানি করা হয়েছিল সেই সবুজ বিপ্লবও এখন আর কাংখিত ফলন দিতে পারছে না। শুধু তাই নয় আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার। আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে দিতে হয় সেগুলো এখন জমিতে। নয়তো ফলন ভাল হয় না। একে তো পানি কম পাওয়ার কারণে ফলন কমছে অন্যদিকে মাটির উর্বরতা এভাবে কমার কারণেও ফলন কমছে। শুধু ধানের ফলনই নয়, মুন্ডুমালার কৃষকেরা জানান, আমের ফলনও কমে গেছে। স্থানীয় কৃষকরা আমাদের একটা আনুমানিক হিসাব জানান। আগে বিঘাতে ১০ কেজি ডিএপি সার দিলেই চলত। এখন সেখানে বিঘাতে ৫০ কেজি দেয়ার পরেও কাজ হয় না ঠিকমতো। পটাশ আগে দেয়া লাগত বিঘাতে ৫ কেজি এখন ২০ কেজি লাগে। টিএসপি আগে দিতে হত বিঘায় ১০ কেজি এখন সেটাও ২০ কেজি লাগে। কীটনাশকও এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি দিতে হয়। তানোরের নোনাপুকুর এলাকায় কৃষকরা আমাদের কাছে যখন বলছিলেন যে পানির কারণে তাদের ফসল মার যাচ্ছে গত কয়েকবছর ধরে, অর্থাৎ তারা কাঙ্খিত ফলন আর পাচ্ছেন না, লাভও করতে পারছেন না। তাদের উৎপাদন খরচই উঠছে না। তখন তাদের আমরা প্রশ্ন করি তাহলে এইভাবে বছরের পর বছর ধরে লস করে কেন ধান আবাদ করেই যাচ্ছেন। উত্তরে তারা আমাদের জানান- কারণটা হল, প্রথমত তাদের আর কোন কাজ জানা নেই। দ্বিতীয়ত, এইভাবে লোকসান হওয়ার পরেও তারা ধান বুনেন আরেকটি নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে, সেটি হল নিজের ঘরের খাবারের নিরাপত্তা। এই উর্ধ্বমুখী বাজারমূল্যের জমানায় তারা লোকসান হলেও ধান করেন কারণ তাতে তার নিজের ঘরের সারা বছরের চালটুকু থাকার নিশ্চয়তাটুকু অন্তত পাওয়া যায়।

আগে বিঘাতে ১০ কেজি ডিএপি সার দিলেই চলত। এখন সেখানে বিঘাতে ৫০ কেজি দেয়ার পরেও কাজ হয় না ঠিকমতো। পটাশ আগে দেয়া লাগত বিঘাতে ৫ কেজি এখন ২০ কেজি লাগে। টিএসপি আগে দিতে হত বিঘায় ১০ কেজি এখন সেটাও ২০ কেজি লাগে। কীটনাশকও এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি দিতে হয়।

অন্যদিকে এই সবুজ বিপ্লবের মডেলটি বাস্তবায়নের সময় কৃষকের মধ্যে এমনই প্রচার চালানো হয়েছিল যে এখন কৃষকেরা অন্য কোন বিকল্প উপায়ের কৃষির কথা ভাবতেই পারেন না। এখানে কৃষকের মধ্যে একটা সম্মতি উৎপাদনের শক্তিশালী প্রচারকার্য ক্রিয়াশীল ছিল। এবং সেই সম্মতি উৎপাদনে রাষ্ট্র সফল। আমরা এমনকি প্রবীণ সাঁওতাল কৃষকের সাথেও কথা বলে দেখেছি, তাঁরও একই কথা ছিল। তিনি আমাদের জানান যে যত বেশি সার, যত বেশি কীটনাশক, যত বেশি পানি তত ভাল ফলন। এই ছাড়া আবাদের আর কোন উপায় তার জানা নাই। তবে ওই প্রবীণ কৃষক আমাদের আরও কিছু কথা বলেন। তিনি জানান, আগে তারা তিন বেলা খেতে পারতেন না। এখন পারেন। এই জন্য তিনি খুশি। এই যে খাবারের নিশ্চয়তা বৃদ্ধি পাওয়া এটাকে উপেক্ষা করার কোন কারণ নেই। এটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার এই কথা একই সাথে এটাও সামনে আনে যে যদি এই অঞ্চলে বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ পরিকল্পিতভাবে করা হত তাহলে কৃষকদের এই সবুজ বিপ্লবের মডেলটি গিলতে হত না।

এই অঞ্চলের কৃষকরাই আবার আমাদেরকে জানান যে আগে এখানে স্থানীয় কিছু ধান হত যেগুলো ছিল খরাসহিষ্ণু। অনেক কম পানিতেই সেগুলো চাষ করা যেত। সবুজ বিপ্লব আসার পরে সেই ধানগুলো উচ্ছেদ হয়েছে, এমন কিছু ধান হল লফিতশাইল, ঝিঙ্গাশাইল, মাগুরশাইল। শুধু তাই নয় এখানে ছিল নানারকম স্বাদের বৈচিত্রময় ধান। এমন কিছু ধান হল দাউদকানি, রান্ধুনিপাগল, টেঙ্গুশাইল, মাইটাকরল, কালোশনি। অন্যদিকে দ্রুত ফলন হত এমন ধানও ছিল। এরকম একটা ধান হল ষাইটা। এই অঞ্চলেরই এক কৃষক সদ্য প্রয়াত ইউসুফ মোল্লা নিজের প্রচেষ্টায় সংগ্রহ করেছিলেন ৩০০ দেশী জাতের ধানবীজ। সেগুলো এখন বারসিক নামের এনজিওর অফিসে সংরক্ষিত রয়েছে।

হারিয়ে যাওয়া কিছু ধান। ধানের রূপ, গড়ন লক্ষ্যনীয়। স্থানীয় কৃষক মোহাম্মদ আলীর সংগ্রহশালার একাংশ। ৩০০ স্থানীয় জাতের ধানবীজ তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পরে ধানগুলো এখন বারসিকের অফিসে রয়েছে। — ছবি: মাহতাব উদ্দীন আহমেদ

এখন এই অঞ্চলে মসুর হয়, আলু হয়। কারণ ধানের বিকল্প হিসেবে মানুষ এগুলোর চাষ করছে। কিন্তু এগুলো বেশি পরিমাণে হয় না। অন্যদিকে কৃষি বিভাগ ও বিএমডিএ থেকেও এখন এখানকার কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে ভুট্টা চাষের জন্য যেটা ধানের থেকে অনেক কম পানিতে হয়ে যায়। কিন্তু কৃষকরা তাতে সাড়া দেননি ভালোভাবে। ভুট্টার ক্ষেত্রে তারা জানান যে, ক্ষেতে একবার ভুট্টা লাগালে সেই জমিতে আর অন্য কিছু করা যায় না। আর ভুট্টার আবাদ করা প্রচন্ড পরিশ্রমসাধ্য একটা কাজ। গমেও পানি কম লাগে। কিন্তু গমেও কৃষকের আগ্রহ কম। কারণ একই পরিমাণ জমিতে গম লাগালে যতটুকু গম পাওয়া যায় ধান পাওয়া যায় তার থেকে অনেক অনেক বেশি। ফলে এই অঞ্চলে কৃষক ধানের আবাদ ছাড়তে পারছেন না।

তবে এভাবে মাটির নিচ থেকে পানি তুলতে থাকলে যে এই অঞ্চলে আর পানি থাকবে না সে সম্পর্কে কৃষকরা এখন অবগত। আমরা যখন তিনটি এলাকাতেই কৃষকদের জিজ্ঞেস করি যে, জানেনই যখন যে এভাবে পানি তুললে পানি থাকবে না তাহলে বিকল্প কিছু ভাবছেন না কেন, তখন কৃষকরা আমাদের সামনে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকেন। তারা স্বীকার করেন যে পানি না থাকলে এই জনপদ বিরানভূমিতে পরিণত হবে। এলাকা ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু তারা জানান যে তারা আসলে নিরুপায়। তাদের সামনে এখন পর্যন্ত অন্য কোন বিকল্প হাজির হয়নি। তারা এও আমাদের জানান যে ব্যাপারটা তারা সৃষ্টিকর্তার উপরে ছেড়ে দিয়েছেন।

সেচের পানি না পেয়ে দুই সাঁওতাল কৃষককে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়ার প্রতিবাদে রাজশাহী শহরে বিএমডিএ অভিমুখে সাঁওতালদের পদযাত্রা। ১১ এপ্রিল ২০২২। — ছবি: মাহতাব উদ্দীন আহমেদ

ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারে বিএমডিএর এখনকার কিছু উদ্যোগের যে হাল আমরা দেখতে পাই

অন্যদিকে যথেচ্ছভাবে ডিপ টিউবয়েল বসিয়ে সর্বনাশের চূড়ান্ত ঘটিয়ে এখন বিএমডিএ কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে বেড়াচ্ছে যে ভূউপরিস্থ পানি ব্যবহার করতে। কিন্তু ভূপৃষ্ঠের উপরে তো পানি নেই। আমরা যখন এলাকাগুলোতে ঘুরি একের পর এক প্রায় শুকিয়ে যাওয়া পুকুর দেখি। আর নদীগুলোর অবস্থা তো আগেই বলা হয়েছে।

বিএমডিএর একটি প্রকল্প হল পাতকুয়া খনন করে ছোট আকারে সেচ দেয়া এবং খাওয়ার পানি সরবরাহ সহ গৃহস্থালি প্রয়োজন মেটানো । বিএমডিএ প্রচার করে যে সেগুলোতে বৃষ্টির পানি ধরার ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু বিষয়টা আসলে হাস্যকর। অত ছোট একটা জায়গায় বৃষ্টির পানি ধরে ভূগর্ভের পানিস্তরের আসলে কিছুই যায় আসে না। যদিও এই অঞ্চলে এখন বিএমডিএর এরকম ৫ শতাধিক পাতকুয়া রয়েছে। আমাদের পক্ষে তো আর এতগুলো পাতকুয়া ঘুরে দেখা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ঘুরতে গিয়ে আমাদের সামনে যে দুটি পাতকুয়া পড়ে সেগুলোর কোনটি থেকেই কৃষক কোন উপকার পাচ্ছে না। গোদাগাড়ীর মোহনপুরের জৈববটতলা গ্রামের পাতকুয়ার চারপাশের বাসিন্দারা জানান, কুয়াটা চালু হয়েছে দুই বছর। কিন্তু এগুলো দিয়ে কোন সেচ দেয়া হয়নি। কারণ হিসেবে তারা জানান, ওই কুয়ার আশে পাশে যেসব জমি আছে সেগুলো চাপাইনবাবগঞ্জের শহরাঞ্চলের মানুষের। তারা ওখানে আবাদ করেন না। শুধু বর্ষাতেই ধান লাগান। বাকি সময় ফেলে রাখেন। ফলে ওখানে ওই কুয়ার পানির চাহিদা নেই। ওই কুয়ার পাশেই যারা থাকেন তারাও মিনি ডিপের পানিই ব্যবহার করেন। কুয়ার পানি নয়। এরকম আরেকটি পাতকুয়া আমাদের চোখে পড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঝিলিম ইউনিয়নের ধিনগর গ্রামে। সেই পাতকুয়ায় পানি নেই। স্থানীয়রা জানান, সেই পাতকুয়ার পানি দিয়ে সেচ দেয়ার আশায় আশেপাশের জমিতে পেঁয়াজ, রসুন, চিনা লাগানো হয়েছিল। কিন্তু পাতকুয়াতে পানি না থাকায় সেই ফসলগুলো মারা যায়। গত ডিসেম্বর থেকে নষ্ট সেই পাতকুয়া।

বিএমডিএর বসানো পাতকুয়া। পাতকুয়ায় পানি নেই। ফলে কোন কাজে লাগেনি। — ছবি: মাহতাব উদ্দীন আহমেদ

বিএমডিএর আরেকটি উদ্যোগ হল পুকুর পুনঃখনন করে সেটিকে সেচের কাজে লাগানো। এই প্রকল্পের আওতায় এখন কয়েকশত পুকুর খনন করা হচ্ছে। এরকম একটি পুকুর আমাদের সামনে পড়ে। পুকুরটি গোদাগাড়ীর মোহনপুর ইউনিয়নেই। সেই পুকুরের আশেপাশের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, যদিও সেই পুকুরটি সেচ কাজের জন্য বলে সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে কিন্তু বাস্তবে সেই পুকুরের পানি দিয়ে কোন প্রকার ক্ষুদ্র সেচ দিতে দেয়া হচ্ছে না। কারণ ওই পুকুরে মাছ চাষ করছেন স্থানীয় এক ব্যক্তি। আমরা যখন তাদের জিজ্ঞেস করি যে এইখানে পানির স্তর এত নিচে তাহলে এই এপ্রিল মাসে এই পুকুরে পানি শুকিয়ে যাচ্ছে না কেন। উল্লেখ্য আমরা ততক্ষণে অন্যান্য পুকুরগুলোর শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা দেখে এসেছি। আমাদের প্রশ্নের উত্তরের এলাকাবাসী আমাদের জানান যে, ওই পুকুরেও আসলে পানি থাকত না। ওই পুকুরে আসলে ডিপ টিউবয়েল থেকে পানি উঠিয়ে পাম্প করে পানি ভরা হয়েছে। আর সেখানে চলছে মাছ চাষ।

বিএমডিএর খনন করা পুকুর, উদ্দেশ্য ছিল ক্ষুদ্র সেচ দেয়া। কিন্তু এর পানি দিয়ে সেচ দিতে দেয়া হয় না, পুকুরে মাছ চাষ হচ্ছে। ডিপটিউবয়েল থেকে পানি উঠিয়ে পুকুরে পানি ভরা হচ্ছে বলে জানান এলাকাবাসী। — ছবি: মাহতাব উদ্দীন আহমেদ

এই যে ভূগর্ভের পানি তুলে পুকুর ভর্তি করে জোর করে মাছ চাষ এটা এখন এই অঞ্চলের জন্য নতুন মাথাব্যাথার কারণ হতে চলেছে। গত বছর ডেইলি স্টার রিপোর্ট করে যে অপরিকল্পিতভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলসহ এর আশেপাশের এলাকায় ফসলী জমি ও বিলের জমি দখল করে মাছ চাষের জন্য খোঁড়া হচ্ছে বহু পুকুর। এগুলোর সাথে স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও ক্ষমতাবানেরাই মূলত জড়িত। সেই রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয় যে, এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন যে রাজশাহী অঞ্চলে সেই পুকুরগুলোকে ভূগর্ভের পানি তুলেই ভর্তি রাখা হয় সারা বছর। জোর করে এক ফসলী জমিকে তিন ফসলী করার মতো এই জোর করে মাছ চাষও চাপ তৈরি করতে যাচ্ছে মাটির নিচের পানিতে। আমরা যে জায়গাগুলোতে সরেজমিন গিয়েছিলাম সেখানেও শুকিয়ে যাওয়া পুকুরের পাশেই ছিল পানি ভর্তি পুকুর। এবং এলাকার মানুষ জানান ওই পুকুরে এখন আর তারা গোসলও করতে পারেন না। কারণ ওই মাছ চাষ। ফলে গোসলের জন্যও এখন তাদের মাটির নিচের পানির উপরই ভরসা করতে হয়।  

এই অঞ্চলে বিএমডিএর আরেক উদ্যোগ হল গোদাগাড়ীর পদ্মা নদী থেকে পানি পাইপলাইনে করে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে নিয়ে এসে গোদাগাড়ীর নিত্যানন্দপুরের সরমংলা খালে পাম্প করে ফেলা। নিত্যানন্দপুর থেকে বিলপাতিকোলা পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটার লম্বা সরমংলা পুনখনন করা হয় ২০০৩ সালে। কথা ছিল পদ্মার পানিতে এই খালে পানি ভরে সেটা সেটি দিয়ে ১৮৫০ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হবে। কিন্তু সরমংলা খাল সেটা করতে পারেনি। খালের নিত্যানন্দপুর থেকে শুরুর ১০ কিলোমিটারেই পানি থাকে। এর পরের বাকি ১৯ কিলোমিটারে পানি থাকে না বলে অভিযোগ রয়েছে এলাকাবাসীর। এ নিয়ে গত বছর পত্রিকায় রিপোর্টও হয়।১৮

বিএমডিএর আরেক উদ্যোগ হল গোদাগাড়ীর পদ্মা নদী থেকে পানি পাইপলাইনে করে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে নিয়ে এসে গোদাগাড়ীর নিত্যানন্দপুরের সরমংলা খালে পাম্প করে ফেলা। নিত্যানন্দপুর থেকে বিলপাতিকোলা পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটার লম্বা সরমংলা পুনখনন করা হয় ২০০৩ সালে। কথা ছিল পদ্মার পানিতে এই খালে পানি ভরে সেটা সেটি দিয়ে ১৮৫০ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হবে। কিন্তু সরমংলা খাল সেটা করতে পারেনি।

শুধু তাই নয় আমরা যখন সরমংলায় যাই তখন খালের শুরুতে যেখানে পদ্মার পানি পাম্প করে ফেলা হচ্ছে তার পাশেই খাল থেকে পানি পাম্প করে জমিতে দেয়া হচ্ছে দেখতে পেলেও সেই জমিতে পাম্প করে পানি তোলার জায়গা থেকে কয়েকশো গজের মধ্যেই দেখতে পাই অনতিদূরে ডিপ টিউবয়েল বসানো। সেখানে মাটির নিচের পানি দিয়েই সেচ চলছে। আমরা যখন ঝিলিমে যাই তখন সেখানকার মানুষ আমাদের জানান, শুরুতে কথা হয়েছিল যে পদ্মার পানি ঝিলিম পর্যন্ত পাম্প করে আনা হবে। কিন্তু পদ্মাতেই পানি নেই। তাই সেই পরিকল্পনা পরে বাতিল হয়। উল্লেখ্য, আমরা সেখান থেকে চলে আসার পরে পরবর্তীতে এপ্রিল মাসের শেষের দিকে পত্রিকায় খবর আসে যে এই সরমংলা খাল দেখতেই নাকি সেখানে গিয়েছেন নেপালের সেচ মন্ত্রী। এবং বিএমডিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবুল কাশেম মিডিয়াকে তখন জানান যে, নেপালের মন্ত্রী সেই খালসহ বিএমডিএর সেচ ব্যবস্থা দেখে সন্তোষ প্রকাশ করে গেছেন! প্রহসনেরও তো একটা সীমা থাকে!

৫০ শতাংশ সেচের পানি সাশ্রয়ী পদ্ধতিতে ধান চাষের ব্যাপারে সরকারের অনাগ্রহ কেন?

এটা সত্য যে, একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক, দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রাম ছাড়া সবুজ বিপ্লবের এই বিষাক্ত কৃষি মডেলকে প্রতিস্থাপন করা বর্তমান দুনিয়ায় সম্ভব নয়। সরকার সেটি করবে না। সেটি জনগণের সংগ্রাম, জনগণকে এই সংগ্রাম করতে হবে। তবে এটাও সত্য যে, মাটির নিচের পানি তুলে সেচ দেয়ার যে কৃষি ব্যবস্থা গত তিন দশকে গড়ে তোলা হয়েছে সেটাও আর রাতারাতি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। যে সবুজ বিপ্লবের বিষাক্ত কৃষি মডেলে কৃষক অভ্যস্ত হয়ে গেছে তা থেকে রাতারাতি কৃষককে সরানোর চেষ্টা করা হলে কৃষি ব্যবস্থায় তাৎক্ষণিক যে বিপর্যয় নামবে তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সমস্যা হল এই বাজারী কৃষি ব্যবস্থাতেই মাটির নিচের পানির উপর চাপ কমানো যায় এমন কোন কার্যকর উদ্যোগের ব্যাপারে সরকারের তেমন কোন আগ্রহ চোখে পড়ে না।

ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান শুকনো পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষ করে সাফল্য এনে দেখিয়েছিলেন। তিনি দেশের বিভিন্ন জেলায় পরীক্ষামূলকভাবে এই কাজ করে সফল হন। এটা নিয়ে পরবর্তীতে ২০১৮ সালে পত্রিকায় প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। ড. মশিউরের এ বিষয়ক গবেষণা প্রবন্ধগুলোর অনেকগুলোই অনলাইনে পাওয়া যায়। নির্দিষ্ট নিয়ম নেমে সেই শুকনো পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষে যে ফলন কোন অংশেই কম হয় না সেটাও ড. মশিউরের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে । শুধু তাই নয় শুকনো পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষের ওই পদ্ধতিতে সবচেয়ে বড় যে সুবিধা তা হল ওই পদ্ধতিতে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সেচের পানিসাশ্রয় হয়।১৯ খোদ বিএমডিএর হিসেবেই গোটা বরেন্দ্র এলাকায় বার্ষিক যে পরিমাণ পানি মাটির নিচ থেকে তোলা হচ্ছে তার পরিমাণ ১৩৭১০ ঘনমিটার। এই পরিমাণ পানি দিয়ে এক বিঘা আয়তনের দুই মিটার গভীরতা বিশিষ্ট ১৮ লাখ পুকুর ভরে ফেলা যায়!২০ এটাও আগের হিসাব। এখন সেই পানি উত্তোলনের পরিমাণ আরও বাড়ার কথা। তাহলে এই বিপুল পরিমাণ পানির ৫০ শতাংশকে যদি সাশ্রয় করা যেত তাহলে সেটা কি কার্যকর কোন প্রভাব ফেলত না? অবশ্যই ফেলত। কিন্তু সেই শুকনো পদ্ধতিতে ধান চাষের ব্যাপারে সরকারের কোন আগ্রহ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। উল্লেখ্য, এই শুকনা পদ্ধতি ধান চাষ এখন পৃথিবীর বহু দেশেই হচ্ছে। এই পদ্ধতির নানা সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। কিন্তু সেই সীমাবদ্ধতা নিয়েও তো গবেষণা চলতে পারে। সেটারও কোন কার্যকর দৃশ্যমান সরকারি উদ্যোগ আমাদের জানা নাই। ড. মশিউরের সাথে যখন আমরা কথা বলি তখন তিনি জানান যে গোদাগাড়ীতেও তিনি তার শুকনো পদ্ধতিতে ধান চাষ করে দেখিয়েছিলেন। যদিও তাকে যে জমি দেয়া হয়েছিল এবং তিনি যেসব পরিস্থিতি তৈরি করে ধান চাষ করতে চেয়েছিলেন সেই সুযোগটা তিনি পাননি। কিন্তু তারপরেও সেই ফলন সবকিছু বিবেচনায় নিলে খারাপ হয়নি।

নির্দিষ্ট নিয়ম নেমে সেই শুকনো পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষে যে ফলন কোন অংশেই কম হয় না সেটাও ড. মশিউরের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে । শুধু তাই নয় শুকনো পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষের ওই পদ্ধতিতে সবচেয়ে বড় যে সুবিধা তা হল ওই পদ্ধতিতে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সেচের পানিসাশ্রয় হয়।

বরেন্দ্র অঞ্চলের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতিতে ভারতের জনগণ (সরকার নয়) লোকজ জ্ঞানে পানি সংকটের কি সমাধান করেছে?

বরেন্দ্র অঞ্চলের পানির সংকটের একটা প্রাণ-প্রকৃতি বান্ধব সমাধান হতে পারত রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং বা বৃষ্টির পানিকে একত্রিত করার মধ্য দিয়ে। এই রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং করে ভারতের জনগণ একের পর এক তাদের খরাপ্রবণ এলাকাগুলোতে রীতিমতো বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন। আর এটা তারা করেছেন একেবারেই স্থানীয় লোকজ জ্ঞানে, নিজস্ব উদ্যোগে। এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের ওই সব অঞ্চলের কৃষি ও সেচের নতুন ধারা, নতুন জীবন ধারণ শুরু করেছে।

তবে এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং বলতে আমাদের দেশে যা বোঝানো হয় সেটি মূলত টিনের চাল থেকে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির পানি একটি ট্যাংকিতে ধারণ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এটা রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং এর খুবই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। এ ধরনের রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং করে বড়জোর একটি পরিবারের কয়েক মাসের খাওয়ার পানির সংস্থান হতে পারে। কিন্তু সেটা দিয়ে কৃষিতে সেচের সমস্যা কিংবা খরাপ্রবণ পানিহীন এলাকার পানির সংকট দূর করা যায় না।

ভারতের রেইন ওয়াটার হারভেস্টিংএর লোকজ প্রচেষ্টাগুলো এই ধারার একেবারেই বিপরীত। সেখানে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং এর মূল উদ্দেশ্যই হল মাটির নিচের পানির স্তরকে পুনরায় জীবনদান করা। আমাদের দেশে যার কোন কার্যকর উদ্যোগ এখন পর্যন্ত বৃহদাকারে চোখে পড়েনি। বরেন্দ্র অঞ্চলে তো নয়ই। ভারতের সেইসব উদ্যোগ নিয়েই একটা আলাদা বৃহৎ লেখা হতে পারে। কিন্তু এই লেখায় অত বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার সুযোগ নেই। এখানে কয়েকটা উদাহরণ দিয়েই শেষ করব।

ভারতের রেইন ওয়াটার হারভেস্টিংএর লোকজ প্রচেষ্টাগুলো এই ধারার একেবারেই বিপরীত। সেখানে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং এর মূল উদ্দেশ্যই হল মাটির নিচের পানির স্তরকে পুনরায় জীবনদান করা। আমাদের দেশে যার কোন কার্যকর উদ্যোগ এখন পর্যন্ত বৃহদাকারে চোখে পড়েনি। বরেন্দ্র অঞ্চলে তো নয়ই।

আমাদের বরেন্দ্র অঞ্চলের থেকে অর্ধেকেরও কম বৃষ্টিপাত হয় ভারতের রাজস্থানে। মাত্র তিনশো থেকে সাড়ে ছয়শো মিলিমিটার। অথচ এই রাজস্থানেরই একসময়ের মরুময় লাপোডিয়া এলাকায় কাজ শুরু করেন লক্ষ্মণ সিং। ১৯৭০ সালেও লাপোডিয়াতে একটি ভাল বর্ষাকালের পরেও খরা ছিল স্থায়ী ব্যাপার। ১৯৭৭ সালে লক্ষ্মণ সিং এবং তার নিজের হাতে গড়া সংস্থা গ্রামীণ বিকাশ নবযুগ মন্ডল কাজ শুরু করে। কালক্রমে পুরো লাপোডিয়া জুড়ে বৃষ্টির পানি ধরার জন্য বিভিন্ন উচ্চতায় বৃহৎ পরিসরে জলাশয় খুড়েন। তাদের কিছু জলাশয় ২ কিলোমিটার পর্যন্ত লম্বা। উপরের স্তরের জলাশয়ের সাথে নিচের স্তরের জলাশয়ের সংযোগ ঘটান খালের মাধ্যমে। যাতে কোন জলাশয়ের পানিই উপচে গিয়ে অপচয় না হয়। গ্রামের মানুষকে তারা বোঝাতে সক্ষম হন যে, এতে দীর্ঘমেয়াদে সকলেরই লাভ। তাদের উদ্দেশ্যই ছিল এক ফোঁটা বৃষ্টির পানিও যাতে অপচয় না হয়। এবং বৃষ্টির পানিটা যাতে সময় নিয়ে মাটির ভেতর চুইয়ে পড়ার সুযোগ পায়। এই সব কিছুর ফল ফলতে শুরু করে ৫-৬ বছর পর থেকেই। তারা স্থানীয় প্রাচীন চৌকা ব্যবস্থাতেও প্রতিটি কৃষি জমির চারপাশে পানি জমা হওয়ার গর্ত খুঁড়েন। একইসাথে তাদের গড়া বৃহৎ জলাশয়গুলোর চারপাশে গাছ লাগান। সব কিছুর মিলিত ফলাফলে লাপোডিয়ার পানির স্তর উপরে উঠতে থাকে। ধীরে ধীরে মাটির নিচের পানির স্তর বাড়তে থাকে। এক কালের বিরানভূমি ছেয়ে যায় সবুজে। সেই বিরান ভূমিতে এখন ১২৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়। ২০০১ সালে পুরো রাজস্থান যখন ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ খরার মুখে পড়েছিল তখনও লাপোডিয়ায় পানির কোন সংকট হয়নি। বর্তমানে সেখানকার ৫৮টি গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে লক্ষ্মণ সিংয়ের এই উদ্যোগ।২১ ও ২২

রাজস্থানের জয়পুর থেকে মাত্র ৩৬ কিলোমিটার দূরের ফাগি তেহসিল এলাকা। জয়পুরেরও বার্ষিক বৃষ্টিপাত বরেন্দ্র অঞ্চলের বার্ষিক বৃষ্টিপাতের অর্ধেক। ১৯৮১ সালে এক প্রলয়ংকরী বন্যায় এই অঞ্চলের পুরো টপ সয়েল ধুয়ে যায়। পরবর্তীতে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির চাষাবাদ এবং প্রাণ প্রকৃতি বিনাশী সেচ চলমান থাকায় ফাগি তেহসিল পরিণত হয়েছিল এক ধুলোময় মরুভূমিতে। ২০১৩ সালে ৫০০ একরের এই ভূমিতে মাত্র ৩০টি গাছ ছিল। সেই ৫০০ একরের মরুভূমিকে মাত্র ৭ বছরের মাথায় আবারও প্রাণ ফিরিয়ে দেন জয়পুরের এক তরুণ। তার নাম মানবেন্দ্র সিং শেখাওয়াত। তারও পদ্ধতিটি ছিল লোকজ জ্ঞান। এবং সেটা অবশ্যই রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং করে মাটির নিচের পানির স্তরকে বাড়ানো। বর্তমানে সেই ভূমিতে ৮টিরও বেশি জলাশয় রয়েছে বৃষ্টির পানি ধরার। তৃষ্ণার্ত মাটিকে পানি খাওয়ার সুযোগ দেয়ার মাত্র ৭ বছরের মাথায় সেই মাত্র ৩০টি গাছের ধুলোময় ৫০০ একরে এখন শত সহস্র গাছ। সেটি এখন এক সবুজ প্রান্তর। সেই জায়গার মানুষ এখন নতুন করে বাঁচার উপায় নির্মাণ করছেন। ওই জায়গার পানির স্তর যখন উপরে উঠে এল সেটার প্রভাবে আশেপাশের গ্রামগুলোতেও পানির সংকট কমা শুরু করেছে এখন। মানবেন্দ্র হিন্দি ভাষায় তার প্রচেষ্টার নাম দিয়েছেন ধুন। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় সুর। ৭ বছরে যা ঘটেছে সেটা ভীষণ সুরেলাই বটে।২৩ ও ২৪

জয়পুরেরও বার্ষিক বৃষ্টিপাত বরেন্দ্র অঞ্চলের বার্ষিক বৃষ্টিপাতের অর্ধেক। ১৯৮১ সালে এক প্রলয়ংকরী বন্যায় এই অঞ্চলের পুরো টপ সয়েল ধুয়ে যায়। পরবর্তীতে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির চাষাবাদ এবং প্রাণ প্রকৃতি বিনাশী সেচ চলমান থাকায় ফাগি তেহসিল পরিণত হয়েছিল এক ধুলোময় মরুভূমিতে। ২০১৩ সালে ৫০০ একরের এই ভূমিতে মাত্র ৩০টি গাছ ছিল। সেই ৫০০ একরের মরুভূমিকে মাত্র ৭ বছরের মাথায় আবারও প্রাণ ফিরিয়ে দেন জয়পুরের এক তরুণ।

রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং করে পাল্টে দেয়া ভারতের জয়পুরের ফাগি তেহসিলের চেহারা: ২০১৩ থেকে ২০২১। — ছবি: Down to Earth এর ইউটিউব ভিডিও থেকে স্ক্রিনশট নিয়ে কোলাজ করা।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়াতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় বরেন্দ্র অঞ্চলের মতোই। সেখানে কাজ করেছেন অর্ধেন্দু চ্যাটার্জি। তার ডিআরএসসিসি নামের সংস্থার মাধ্যমে, যেটির তিনি প্রতিষ্ঠাতা। পুরুলিয়াতে তারা টেরেস পন্ড সিস্টেম নামের সিঁড়ির মতো থাক থাক করে খনন করা পুকুর চালু করেছেন। যার প্রতি থাক থেকে পানি চলে গেলে সেখানে চাষও হয়। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে তারা পানির দ্রুত বাষ্পীভবন হওয়া ঠেকিয়েছেন। তাদের এই পদ্ধতিতে একটি পুকুর দিয়েই ৩০ একর জমি চাষ করা যায়। একই সাথে তাদের উঁচু এলাকাগুলো থেকে বৃষ্টির পানি যাতে দ্রুত গড়িয়ে না পড়ে সেজন্য সেখানে নিয়মিত দূরত্বে খুঁড়েছেন ১২০০ স্কয়ার ফিটের গর্ত। এই যে বৃষ্টির পানি দ্রুত গড়িয়ে পড়ে না যাওয়া এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মাটির নিচের পানির স্তরে বৃষ্টির পানি চোয়ানোর জন্য। যাই হোক এভাবে নানান রকম দেশীয় ও লোকজ জ্ঞান ব্যবহার করে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং করে মাটির নিচের পানির স্তর উপরে উঠানোর ফলাফল হয়েছিল এই যে একসময়ের একফসলী পুরুলিয়ায় জমিকে তিন ফসলী করা গিয়েছিল। এবং সেটা সবুজ বিপ্লব ছাড়াই।২৫

ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের বার্ষিক বৃষ্টিপাত বরেন্দ্রর থেকে কম। সেই অন্ধ্রপ্রদেশের মরুময় এলার্থিতে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং করে, গাছ লাগিয়ে, প্রাকৃতিক কৃষির প্রচলন করে এলার্থিকে বাঁচিয়ে তুলেছেন এক নারী। তার নাম পদ্মা কপুলা। তিনি তার সংস্থা অরণ্য এগ্রিকালচার অলটারনেটিভ এর মাধ্যমে গ্রামের মানুষকে এইসব বিষয় বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। তারা কাজ শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যেই এলার্থির মরুময় পরিবেশ নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হয়। আগে শুকনা মৌসুমে এলার্থিতে কোন আবাদই হত না। এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। শুধু তাই নয় যারা একসময় পানির অভাবে এলার্থি ছেড়ে শহরে চলে গিয়েছিলেন কাজের অভাবে তারা আবার ফিরে আসছেন।২৬

এই লেখা যখন লিখছি তখন সুনামগঞ্জের হাওরে মাটির নিচের পানির স্তর ৫০০ ফিট নিচে নেমেছে বলে জানান স্থানীয় বন্ধু সাংবাদিক। অন্যদিকে নেত্রকোনার বন্ধু জানান, সেখানে সাড়ে তিনশো ফিট নিচে পানির স্তর। সাতক্ষীরায় ৭০০ ফিট নিচে নেমে গেছে পানির স্তর।

পানি ফেরাবে কে?

ভারতের এরকম আরও বহু উদাহরণ দেয়া যায়। এই উদাহরণ গুলো দিলাম এটা বলার জন্য যে এখনো বরেন্দ্র অঞ্চলকে প্রাণ ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব। কাজটা কঠিন, কিন্তু সম্ভব। কিন্তু সেজন্য আমাদের অনেক কিছুই করার আছে। আমাদের সবার আগে যেটা উপলব্ধি হওয়া প্রয়োজন যে পানির প্রশ্নটি একটি চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিক প্রশ্ন। সারা দুনিয়াতেই আগামী দিনগুলোতে রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয় হবে পরিবেশ। আর বাংলাদেশে পরিবেশের ভেতরেই রাজনীতির আরেক কেন্দ্রীয় বিষয় হতে যাচ্ছে পানি। যার লক্ষণ ইতিমধ্যেই দেশের সকল প্রান্তেই দেখা যাচ্ছে। এই লেখা যখন লিখছি তখন সুনামগঞ্জের হাওরে মাটির নিচের পানির স্তর ৫০০ ফিট নিচে নেমেছে বলে জানান স্থানীয় বন্ধু সাংবাদিক। অন্যদিকে নেত্রকোনার বন্ধু জানান, সেখানে সাড়ে তিনশো ফিট নিচে পানির স্তর। সাতক্ষীরায় ৭০০ ফিট নিচে নেমে গেছে পানির স্তর।২৭ এইসব কিছু যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে সেটি নিয়ে যদি আমাদের মাথাব্যথা না হয় তাহলে বুঝতে হবে আমাদের মাথার “পানিও” শুকিয়ে গেছে এই ফ্যাসিস্ট জমানায়। পানির এই সংকট মোকাবেলা করার প্রশ্নটি তাই রাজনৈতিক শুধু নয়, এটি একাধারে একটি দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক প্রশ্নও। এর জন্য সবার আগে প্রয়োজন এই প্রাণ-প্রকৃতি বিনাশী উন্নয়নের যে বৈশ্বিক ধারণা তাকে প্রত্যাখ্যান করা। এর জন্য প্রয়োজন একটা ভিন্ন সাংস্কৃতিক জীবনযাপনকে নির্মাণ করা। আর সেই কাজ এই দেশের বনখেকো, নদীখেকো সরকার, তার তল্পিবাহক বুদ্ধিজীবী, বিশেষজ্ঞদের দিয়ে কখনোই হবে না। সেই কাজ করতে এগিয়ে আসতে হবে এদেশের জনগণকেই। একমাত্র এবং একমাত্র সংগঠিত জনগণই এই অঞ্চলের পানিকে ফেরাতে পারে। কিন্তু তার আগে জনগণকেও মাথা থেকে বিষাক্ত কৃষি মডেলের আবর্জনা ফেলতে হবে, বিকল্প ভাবার মতো সাহস নিতে হবে, হতে হবে প্রাণ-প্রকৃতি বান্ধব। সেই প্রাণ-প্রকৃতি বান্ধব হওয়ার ব্যাপারে আমাদের সবারই দায় আছে।

মাহতাব উদ্দীন আহমেদ: গবেষক, রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিক ক্যাম্পেইন, দৃক। ইমেইল: mahtab@drik.net

পারভেজ আহমদ রনি: আলোকচিত্রী, দৃক। ইমেইল:  parvez@drik.net 

তথ্যসূত্র:

১. ড. আহমেদ আলী হাসান, বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূ:গর্ভস্থ পানির নিম্নমুখীতা ও করণীয়, কৃষিবার্তা, ৯ ডিসেম্বর ২০১৩

২. প্রাগুক্ত

৩. প্রাগুক্ত

৪. প্রথম আলো, বরেন্দ্রর সেচের পানি নিয়ে বাণিজ্য, ২৯ মার্চ ২০২২

৫. ডেইলি স্টার বাংলা, তীব্র পানি সংকটে বরেন্দ্র অঞ্চল, ৭ এপ্রিল ২০২১

৬. সোনালী সংবাদ, পাতাল পানিশূন্য করছে বিএমডিএ, ২৯ মার্চ ২০২২

৭. Business Standard, Dams on River Ganga, 13 October 2016

৮. The Times of India, ‘942 dams, barrages, weirs in Ganga basin preventing river’s rejuvenation’, 25 November, 2018

৯. প্রথম আলো, রাজশাহীতে হারিয়েছে ৯টি নদী, ১০০ বছর পর একটি উদ্ধার, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

১০. কালের কণ্ঠ, মহানন্দা ও পাগলা ভরাট, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

১১. বাংলাদেশ প্রতিদিন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে আষাঢ়েও পানিশূন্য পাগলা নদী, ২ জুলাই ২০১৭

১২. চ্যানেল আই অনলাইন, শুকিয়ে গেছে তুলসীগঙ্গা নদী, ৬ মার্চ ২০১৮

১৩. সমকাল, রাজশাহীর নদীগুলো এখন প্রত্ন, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

১৪. বাংলাদেশ প্রতিদিন, শুকিয়ে গেছে বড়াল চাষ হচ্ছে ধান, ২৪ এপ্রিল ২০২১

১৫. দৈনিক খবরপত্র, নওগাঁর সাপাহারে পুনর্ভবা নদী এখন খেলার মাঠ, ১৬ এপ্রিল ২০২২

১৬. প্রথম আলো, সাত নদীর প্রাণ যায় যায়, ১৪ জুন ২০১৬

১৭. জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ওয়েবসাইট, রাজশাহী বিভাগের নদ-নদীর অবৈধ দখলদারের তালিকা

১৮. ডেইলি স্টার বাংলা, সরমংলা খাল শুকিয়ে কাঠ, বরেন্দ্র অঞ্চলে বোরো চাষিদের মাথায় হাত, ৮ এপ্রিল ২০২১

১৯. Md. Md Moshiur Rahman, Potential benefits of dry direct seeded rice culture: A review, Fundamental and Applied Agriculture, Vol. 4(2), pp. 744–758: 2019

২০. বাংলা ট্রিবিউন, পানিশূন্য হয়ে পড়েছে উত্তরাঞ্চলের ৮৫টি নদী, ২২ মার্চ ২০২২

২১. Down to Earth, This green oasis is a drought-proof village in Rajasthan

২২. আরও দেখতে পারেন: https://www.unsung.in/lakshman-singh/

২৩. Down to Earth, This man changed the fortunes of a barren land using traditional water wisdom. The story of Dhun-1

২৪. Down to Earth, How this 500 acres was turned into a sanctuary for native trees of Rajasthan-The story of Dhun- 2

২৫. Andrew Millison’s Documentary, India’s Water Revolution #3: From Poverty to Permaculture with DRCSC

২৬. Andrew Millison’s Documentary, India’s Water Revolution #5: Permaculture Rescue for Dying Farmland

২৭. দেশ রুপান্তর, সাতক্ষীরায় নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, নলকূপেও নেই পানি, ২৪ এপ্রিল ২০২২

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •