আমৃত্যু আপসহীন রোজা লুক্সেমবার্গ
আতিয়া ফেরদৌসী
বিশ্বের বিপ্লবী চিন্তাবিদদের মধ্যে রোজা লুক্সেমবার্গ অন্যতম পথিকৃৎ। জার্মানসহ ইউরোপের বিপ্লবী সংগ্রামের সংগঠক এবং বিশ্ব বিপ্লবের তাত্ত্বিক হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হলেও বাংলাদেশে তাকে নিয়ে আলোচনা খুবই কম। তিনি একজন তাত্ত্বিক, বিপ্লবী এবং আরও বেশি কিছু। নারীর জন্য বিরূপ এক পৃথিবীকে তিনি তার নিজের বক্তব্য শুনতে বাধ্য করেছিলেন। তার কঠোর সংগ্রামী জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র, বিজ্ঞান, কলা ও প্রকৃতির প্রতি তার একনিষ্ঠ অনুরাগ এবং সর্বোপরি প্রেম তাকে অনন্য অবস্থানে নিয়ে গেছে। অল্প বয়স থেকেই তিনি ছিলেন মার্ক্সের সমর্থক, যদিও তিনি তার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে মার্ক্সের সমালোচনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়েছেন। তার লেখা গ্রন্থ অ্যাকিউমুলেশন অব ক্যাপিটালকে (১৯১৩) ডাস ক্যাপিটালের (১৮৬৭) অন্যতম প্রধান সম্প্রসারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই লেখায় রোজার জীবন পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে, আগামী সংখ্যায় তার গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করা হবে।
১৮৭০ সালের ৫ মার্চ লিনা নি লোয়েনস্টেইনের পঞ্চম সন্তান এবং দ্বিতীয় কন্যা ভূমিষ্ঠ হয়। তিনি ও তার স্বামী এলিয়াশ লুক্সেমবার্গ এই শিশুর নাম রাখেন রোজালিয়া। সংক্ষেপে রোজা নামে তাকে ডাকা হতো। পূর্ব ইউরোপের শহর জামোশচ, যা এখন রাশিয়ার অংশ হলেও তখনকার সময় এটি ছিল পোল্যান্ডের অংশ, সেখানে ছিল রোজাদের এই ইহুদি ব্যবসায়ী পরিবারের বসবাস। সেই এলাকার ওপর সে সময় ছিল রাশিয়ার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। রোজার জন্মের বছর দুয়েক পর রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তার পরিবার জামোশচ থেকে ওয়ারশোতে (যা তখন কার্যত রাশিয়ার অধীন ছিল) চলে আসতে বাধ্য হয়। এই চলে আসার সিদ্ধান্ত সম্ভবত পরবর্তী জীবনে রোজার চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিত গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। যেমনটি রিচার্ড আব্রাহাম মনে করেন:
‘পুঁজিবাদ সম্পর্কে রোজার ধারণা ভিন্ন হতে পারত যদি তার বাবা ওয়ারশতে তার ব্যাবসাটা চালাতে পারতেন। যেখানে অস্ট্রো-রাশান বাণিজ্যের কারণে জোমাস্কের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছিল, সেখানে ওয়ারশোর পুঁজিপতিরা রাশিয়ার শুল্কের জোরে ফুলে ফেঁপে উঠছিল। …সেইসঙ্গে প্রাণপণে তারা সমস্ত পোলিশ, জার্মান ইহুদি শ্রমিকদের ভয়াবহ জীবনমানের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে রেখেছিল।’ (আব্রাহাম, ১৯৮৯)
এলিয়াশ লুক্সেমবার্গের পরিবার ওয়ারশতে এসেছিল বাধ্য হয়ে, দুর্ভাগ্যের শিকার হয়ে। বাজারকেন্দ্রিক শক্তির সুফল ভোগকারী তারা হতে পারেননি। তারা কেবল তাদের সন্তানদের জন্য উন্নত একটা ভবিষ্যতের আশা করেছিলেন। তারা চেষ্টা করেছিলেন সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য সম্ভবপর সবচেয়ে ভালো, উন্নত ও আধুনিক শিক্ষার পেছনে বিনিয়োগ করতে। রোজার নিজের বয়ান অনুসারে, শৈশবেই তার বাবা তার মাথায় উদার চিন্তাভাবনার বীজ বুনে দিয়েছিলেন। তার মা ছিলেন বইপড়ুয়া। তাদের পরিবারে জার্মান ও পোলিশ ভাষায় কথা বলার চর্চা ছিল। পরবর্তী সময়ে রোজা রাশান ভাষাও শিখেছিলেন।
যদিও পরবর্তী জীবনে তিনি কদাচিৎই তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পেরেছিলেন। বরং পার্টি ও অন্যান্য সাথি-কমরেডরা হয়ে উঠেছিল তার আরেক পরিবার। এলিয়াশ লুক্সেমবার্গ মারা যান ১৯০০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। সে সময় রোজা আন্তর্জাতিক কংগ্রেসের সম্মেলনে যোগ দিতে প্যারিসে উপস্থিত ছিলেন, যা নিয়ে পরবর্তী সময়ে নিজেই শ্লেষ মিশিয়ে লিখেছিলেন: ‘তখন আমি গোটা মানবজাতির জরুরি ব্যাপার-স্যাপার দেখাশোনার কাজে এবং সারা দুনিয়াকে সুখী করার কাজে ব্যস্ত ছিলাম।’ (এটিঞ্জার, ১৯৮৬)
খুব ছোটবেলা থেকেই রোজা নানা রকম সামাজিক ও রাজনৈতিক সংঘর্ষ প্রত্যক্ষ করেছেন। ১৮৮৮ সালের মে মাসে, তার ১৮তম জন্মদিনের কিছু পরে, ওয়ারশতে ঘটে এক ইহুদিবিরোধী দাঙ্গা। জার অ্যালেক্সান্ডার-২-এর রাশান বিপ্লবীদের হাতে খুন হওয়ার খবর থেকে এই দাঙ্গার উৎপত্তি হয়। হত্যাকারীদের মধ্যে একজন ছিল অল্প বয়সি এক ইহুদি তরুণী। প্রশাসনের কিছু কিছু প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র এ ঘটনার সুযোগে সংখ্যালঘু ইহুদিদের প্রতি মানুষের ঘৃণা উসকে দিয়েছিল।
রোজা তার জিমনেশিয়াম (স্কুল) শুরু করেন ৯ বছর বয়সে। ‘খুব দ্রুতই তার দুটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেতে থাকে: অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা আর সেই সঙ্গে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার অদম্য আকাঙ্ক্ষা। এই দুই বৈশিষ্ট্য তাকে স্কুলে অল্প বয়সেই বিপ্লবী ক্যাম্পে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।’ (এডিটর’স নোট: দি অ্যাকিউমুলেশন অব ক্যাপিটাল, ১৯৬৪)
১৮৮৬ সালে তিনি যোগ দেন পোলিশ বামপন্থি প্রলেতারিয়েত পার্টিতে (এই পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৮২ সালে)। তিনি সে সময় একটি সাধারণ ধর্মঘট আয়োজনে অংশ নেন। এই ধর্মঘটের ফলাফল ছিল ভয়াবহ। চারজন পার্টি নেতাকে নির্বিচারে খুন করা হয়, এতে পার্টি কার্যত ভেঙে পড়ে। যদিও এ ঘটনার পরও রোজাসহ অন্য পার্টি কর্মীরা গোপনে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। স্কুলে পড়াবস্থায়ও এ ধরনের জীবনের ঝুঁকি নিতে রোজা দ্বিধা করেননি। ১৮৮৭ সালে মাতুরা (মাধ্যমিক স্কুল সমাপনী) পাস করেন রোজা। ১৮৮৯ সালে তিনি সুইজারল্যান্ডে পাড়ি দেন প্রথমত রাশিয়ার পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে, দ্বিতীয়ত তার পড়াশোনা শেষ করতে।
ইউনিভার্সিটি অব জুরিখে তিনি ‘আইন ও অর্থনীতি বিজ্ঞান’ বিষয়ে পড়াশোনা করেন এবং ডক্টর অব ল’ ডিগ্রি লাভ করেন। তার ডক্টরাল থিসিস ‘পোল্যান্ডের শিল্পোন্নয়ন’-এ তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে পোল্যান্ড এবং সেই সঙ্গে সমান্তরালে রাশিয়ায়ও পুঁজিবাদী বিকাশ ঘটেছে; যেহেতু এই দুই দেশের রয়েছে অভিন্ন রাজনৈতিক ও শুল্ক সীমানা।
ইউনিভার্সিটি অব জুরিখে তিনি ‘আইন ও অর্থনীতি বিজ্ঞান’ বিষয়ে পড়াশোনা করেন এবং ডক্টর অব ল’ ডিগ্রি লাভ করেন। তার ডক্টরাল থিসিস ‘পোল্যান্ডের শিল্পোন্নয়ন’-এ তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে পোল্যান্ড এবং সেই সঙ্গে সমান্তরালে রাশিয়ায়ও পুঁজিবাদী বিকাশ ঘটেছে; যেহেতু এই দুই দেশের রয়েছে অভিন্ন রাজনৈতিক ও শুল্ক সীমানা। তিনি উদাহরণ হিসেবে লজ (কেন্দ্রীয় পোল্যান্ডের একটি শহর, যা ছিল সাবেক টেক্সটাইল উৎপাদনের কেন্দ্র) ও মস্কোর মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন। জুরিখে গুটিকয় ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করা নারীর মধ্যে রোজা ছিলেন একজন। এ সময়ে তিনি বেশ কয়েকজন রাশিয়ান ডেমোক্র্যাটের সঙ্গে পরিচিত হন, যাদের মধ্যে ছিলেন পার্টির কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব, যেমন: জেওর্জি প্লেখানভ ও পাভেল আক্সেলরদ। এদের আগ্রহের সঙ্গে অনুসরণ করার মধ্য দিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক মার্ক্সবাদের পথে হাঁটতে শুরু করেন।
তিনি কিছু শারীরিক দৃশ্যমান ত্রুটি নিয়ে জন্মেছিলেন। তার একটি পা ছিল অন্য পা থেকে ছোট এবং সে জন্য সারা জীবন তাকে কিছুটা খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়েছে। পরিণত রোজা লুক্সেমবার্গ ছিলেন ৫ ফুটের মতো লম্বা এবং তার ছিল স্পষ্টত দৃশ্যমান সেমেটিক খাড়া নাক এবং উজ্জ্বল লম্বা কালো চুল। ‘আমার নাক সবসময় সবকিছু থেকে একটু বেশি এগিয়ে থাকে’–এই বলে তিনি মজা করতে পছন্দ করতেন। তিনি নিজের শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে প্রায়ই তামাশা করতেন। খুব অল্প বয়স থেকেই তিনি বিশ্বাস করতেন: ‘ভেনাস দি মিলো হাজার বছর ধরে নারীর সৌন্দর্যের উপমা হিসেবে নিজের খ্যাতি ধরে রাখতে পেরেছে। কারণ, তার মুখটি কখনো খোলার দরকার হয়নি।’ তবে, মুখ বন্ধ রাখার মতো কোনো পরিকল্পনা যে রোজার কস্মিনকালেও ছিল না, তা স্পষ্ট (আব্রাহাম, ১৯৮৯)।
বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সঙ্গে পরিচয় হয় তার প্রথম প্রেমিক লিও ইয়োগিশেসের। পরবর্তী সময়ে লিও ও রোজা দীর্ঘদিন একে অপরের সঙ্গী ছিলেন এবং মৃত্যুর আগপর্যন্ত তাদের কমরেডশিপ বজায় ছিল। সে সময় তার সঙ্গে আরও পরিচয় হয় সমাজতান্ত্রিক আনাতোলি লুনাচারস্কি এবং আরও কয়জন রাজনৈতিক সংগঠকের সঙ্গে। ১৮৮৩ সালে রোজা, লিও ও জুলিয়ান মার্শলিউস্কি মিলে একটি পত্রিকা (Sprawa Robotnicza: The worker’s cause) প্রকাশ করতে শুরু করেন। এই পত্রিকার মূল লক্ষ্য ছিল, সে সময়ের পোলিশ সোশ্যালিস্ট পার্টি ও অন্যান্য জাতীয় নীতিমালার সমালোচনা করা। একই বছর তিনি ও লিও মিলে প্রতিষ্ঠা করেন সোশ্যাল ডেমোক্রেসি অব দ্য কিংডম অব পোল্যান্ড অ্যান্ড লিথুয়ানিয়া (এসডিকেপি, পরবর্তী সময়ে এসডিকেআইপি) পার্টি। রোজা ছিলেন এই পার্টির প্রধান তাত্ত্বিক। লিও ও রোজা দুজনেই পার্টির নেতৃত্বে যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করেন।
জার্মানির সময়
ডক্টরাল ডিগ্রি শেষ করার পর রোজা লুক্সেমবার্গ সিদ্ধান্ত নেন জার্মানি যাওয়ার। জার্মানিতে সে সময়ের শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন তাকে আকৃষ্ট করে। রোজা বার্লিনে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করেন ১৮৯৬-তে। কিন্তু এটি সহজ কাজ ছিল না। বাধ্য হয়ে, দু-বছর পর তিনি একজন জার্মান নাগরিকের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বিয়ের চুক্তি করেন যাতে রাশিয়ায় তাকে ফেরত যেতে না হয়। তারা দুজন কখনোই একসঙ্গে বসবাস করেননি এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে তিনি ডিভোর্সের আবেদন করেন। পাঁচটি বিরক্তিকর দীর্ঘ বছর খরচ করে অবশেষে কোর্টের আদেশের মাধ্যমে তিনি ডিভোর্সের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেন। সে সময় তিনি ও লিও ছিলেন একে ওপরের সঙ্গী।
রোজা লুক্সেমবার্গের পরিণত বয়সের অধিকাংশ কেটেছে জার্মানিতে। জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নারী বিভাগে তার সঙ্গে পরিচয় হয় ক্লারা জেটকিনের। এই দুজন পরবর্তী সময়ে আমৃত্যু বন্ধু ও কমরেডে পরিণত হন। জেটকিন ছিলেন লুক্সেমবার্গের থেকে ১৩ বছরের বড় এবং সে সময় পার্টির অধিকতর বামপন্থি অংশে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী সদস্য।
রোজা লুক্সেমবার্গের পরিণত বয়সের অধিকাংশ কেটেছে জার্মানিতে। জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নারী বিভাগে তার সঙ্গে পরিচয় হয় ক্লারা জেটকিনের। এই দুজন পরবর্তী সময়ে আমৃত্যু বন্ধু ও কমরেডে পরিণত হন। জেটকিন ছিলেন লুক্সেমবার্গের থেকে ১৩ বছরের বড় এবং সে সময় পার্টির অধিকতর বামপন্থি অংশে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী সদস্য।
সে সময় জার্মান সোশ্যালিস্ট পার্টি এক বড় রকমের সমস্যার মুখোমুখি হয়। ১৮৯৯ সালে পার্টির একজন সিনিয়র সদস্য এবং তাত্ত্বিক এডওয়ার্ড বার্নস্টেইন এক বিতর্কিত লেখা ‘বিবর্তনমূলক সমাজতন্ত্র’ (Die Voraussetzungen des Sozialismus, 1899) প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি মার্ক্সের শ্রমের মূল্য তত্ত্বের কিছু ত্রুটি খুঁজে পেয়েছেন বলে দাবি করেন। সেই সঙ্গে তিনি মত দেন, পার্টির উচিত হবে বৈপ্লবিক ধারা থেকে বেরিয়ে এসে বিদ্যমান অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে দৃশ্যমান সংস্কারের পথে হাঁটা। সে সময় একে অভিহিত করা হয় ‘সংস্কারবাদের শোধনবাদ’ (রিভিশনিজম অব রিফর্মিজম) হিসেবে, যার বিরুদ্ধে লুক্সেমবার্গ খুবই শক্ত অবস্থান নেন। তখনকার পুরোটা সময় ক্লারা জেটকিন রোজা লুক্সেমবার্গকে সমর্থন জুগিয়েছেন। লুক্সেমবার্গ একই বছর বার্নস্টেইনের প্রত্যুত্তরে তার সহজাত তীক্ষ্ণ সমালোচনা সমেত একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন ‘সংস্কার নাকি বিপ্লব’, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ মার্ক্সবাদী পাঠ হিসেবে বিবেচিত।
১৯০৩ সালে রোজা আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক ব্যুরোর সদস্য হন। ১৯০৪ সালের আগস্ট মাসে ‘কংগ্রেস অব দ্য সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল’ লুক্সেমবার্গকে আরও সম্মান এনে দেয়। সেখানে তিনি দুটি ম্যান্ডেট উপস্থাপন করেন: একটি জার্মানির পক্ষে, আরেকটি পোলিশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষে। কংগ্রেস শেষ হওয়ার পর তিনি জার্মানিতে ফেরেন এবং সেখান থেকে তাকে যেতে হয় সরাসরি জেলে। প্রকাশ্য ভাষণে সম্রাট উইলহেম-২-কে অপমান করার দায়ে তাকে তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সম্ভবত কারাবরণের এই প্রথম অভিজ্ঞতা তার পরিপূর্ণ বিপ্লবী হয়ে ওঠার পথে উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছিল। যদিও পরবর্তী জীবনে বারবার এই কারাবরণ তার ভয়ানক বিরক্তির কারণ হয়। তবে ১৯২০ সালে প্রকাশিত লুক্সেমবার্গের কারাগারের চিঠি হয়ে উঠেছিল তখনকার তরুণ র্যাডিকেল বিপ্লবীদের জন্য এক অনুপ্রেরণা। এসব চিঠি লেখা হয়েছিল সোনিয়া লিবনেখট (সোফি লিবনেখট) নামে জার্মান সোশ্যালিস্ট ও নারীবাদী তরুণীর উদ্দেশে। সোনিয়া ছিলেন লুক্সেমবার্গের আরেক কমরেড কার্ল লিবনেখটের স্ত্রী।
কংগ্রেস শেষ হওয়ার পর তিনি জার্মানিতে ফেরেন এবং সেখান থেকে তাকে যেতে হয় সরাসরি জেলে। প্রকাশ্য ভাষণে সম্রাট উইলহেম-২-কে অপমান করার দায়ে তাকে তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সম্ভবত কারাবরণের এই প্রথম অভিজ্ঞতা তার পরিপূর্ণ বিপ্লবী হয়ে ওঠার পথে উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছিল।
১৯০৫ সালে রাশিয়ার গণজাগরণের সময় লুক্সেমবার্গ দ্রুত ওয়ারশতে ফেরেন এবং সেখানকার বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যোগ দেন। এর ফলশ্রুতিতে আবারও কারাবরণ করেন তিনি। এরপর বার্লিনে ফিরে এসে তার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে লিও ইয়োগিশেজের। ‘দি রোজা লুক্সেমবার্গ রিডার’ বই-এর সম্পাদকীয়তে পিটার হুডিস ও কেভিন বি এন্ডারসন মন্তব্য করেন, ইয়োগিশেজের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর রোজার আত্মপ্রকাশ স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। তিনি আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী ও বিপ্লবী মতাদর্শের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে ওঠেন। ১৯০৭ সালে তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে ক্লারা জেটকিনের ছেলে কোস্টা জেটকিনের। কোস্টা ছিলেন লুক্সেমবার্গ থেকে ১৫ বছরের ছোট, কিন্তু রোজার অনুভূতি ও দর্শন অনুধাবনের জন্য একটা অনুভূতিপ্রবণ হৃদয় তার ছিল।
আমাদের বিপ্লবী রোজা ছিলেন বিড়ালপ্রেমী। তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহচর ছিল বিড়াল মিমি। ‘রোজা মিমির প্রতি তার মাতৃসুলভ অনুভূতি কোনোদিন লুকানোর চেষ্টা করেননি। সোনিয়াকে লেখা চিঠিতে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা তিনি বর্ণনা করেছেন মিমির নানা রকম অ্যাডভেঞ্চারের কথা। এমনকি লেনিনের মতো মানুষকে বাসায় এসে মিমির গায়ে হাত বুলিয়ে তার প্রশংসা করতে হয়েছে রোজার কাছ থেকে আন্তরিক আলোচনা শোনার জন্য।’ (আব্রাহাম, ১৯৮৯)।
তার অন্তর্গত জীবন যা আমরা দেখি তার চিঠিপত্রের মধ্য দিয়ে, তার কর্মকাণ্ড, তার উদ্দীপনা সবকিছু একজন পরিশীলিত, সংবেদনশীল মানুষের প্রতিচ্ছবি তৈরি করে, যা অনেক প্রথাগত রাজনৈতিক চরিত্রের থেকে আলাদা। তিনি ছবি আঁকতে, রং করতে ভালোবাসতেন, তার বসার ঘর তিনি নিজের আঁকা ছবি দিয়ে সাজাতে ভালোবাসতেন। রাশিয়ান, জার্মান, পোলিশ ও ফরাসি ভাষার অসংখ্য সাহিত্য তার পড়ার তালিকার মধ্যে ছিল, তিনি কবিতা লিখতেন (অন্তত তিনটি ভাষায়)। তার প্রবল আগ্রহের কোনো পরিসীমা ছিল না। নৃবিজ্ঞান, ইতিহাস, উদ্ভিদবিদ্যা, ভূতত্ত্ব এবং কলা ও বিজ্ঞানের নানা শাখা যার মধ্যে আধুনিক বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটেছে তার সবকিছুতেই বিস্তৃত ছিল লুক্সেমবার্গের আগ্রহ।
নারীবাদ ও লুক্সেমবার্গ
কোনো কোনো নারীবাদী তাত্ত্বিক লুক্সেমবার্গের সমালোচনা করেন। কারণ তিনি নারীর অধিকার ইস্যুতে খুব বেশি উচ্চকিত ছিলেন না, যেমন ছিলেন অ্যালেক্সান্দার কোলন্তাই বা ক্লারা জেটকিন। রিচার্ড আব্রাহামের লেখায় পাওয়া যায়: ইয়োগিশেজ একবার লুক্সেমবার্গকে পরামর্শ দেন বার্লিনের নারী শ্রমিক আন্দোলনে এসপিডি পার্টির নারী শাখার এক্সিকিউটিভের সঙ্গে কাজ করতে। লুক্সেমবার্গ সেই পরামর্শ আমলে নেননি। এটাকে তিনি একটি ‘আনহ্যাপি আইডিয়া’ হিসেবে উল্লেখ করেন। (আব্রাহাম, ১৯৮৯: পৃ: ৫১)
তবে, আমরা যদি তার ‘নারীর ভোটাধিকার ও শ্রেণিসংগ্রাম (১৯১২)’ প্রবন্ধের দিকে তাকাই, আমরা শুনতে পাই লুক্সেমবার্গের অনমনীয় ঘোষণা:
‘প্রলেতারিয়েত নারীর সাধারণ, সমান ও সরাসরি ভোটাধিকার গোটা প্রলেতারিয়েত শ্রেণিসংগ্রামকে প্রবলভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করবে। এবং এ কারণে আমরা নারীর ভোটাধিকার চাই এবং তা অর্জন করে ছাড়ব। নারীর ভোটাধিকারের জন্য সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা সেই সময়ের দিকে এগিয়ে চলেছি, যখন বর্তমান সমাজ মুখ থুবড়ে পড়বে এবং বিপ্লবী প্রলেতারিয়েতের হাতুড়ির আঘাতে ধ্বংস হবে।’
লেনিনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব
মার্ক্সের দর্শনে গভীর বিশ্বাসের কারণে শুরুর দিকে লেনিন ও রোজার মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। তবে মার্ক্সের তত্ত্বকে কাজে পরিণত করার প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের দুজনের ছিল ব্যাখ্যায় পার্থক্য ছিল। এই দুই মহান মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকের দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু ছিল তত্ত্বকে কাজে পরিণত করার স্বতঃস্ফূর্ততাকে ঘিরে। পার্টির কর্মপরিসর ও নেতৃত্বের পরিসর কতটুকু হবে, তা নিয়ে দুজনের ছিল দুই মত। লেনিন পার্টিকে ভাবতেন বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু রোজা এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতেন। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন, পার্টির মূল দায়িত্ব হলো শ্রমিক শ্রেণিকে তাদের লক্ষ্য ঠিক করতে সহায়তা করা ও প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা-দিকনির্দেশনা দেওয়া।
রোজা লুক্সেমবার্গের মতে, ‘ঐতিহাসিকভাবে, কোনো সত্যিকার বৈপ্লবিক আন্দোলনের ভুলভ্রান্তি বরং কোনো এক চতুর কেন্দ্রীয় কমিটির নির্ভুলতা থেকে হাজার গুণে কাজের।’
পার্টরে ভেতর রোজার জোরালো প্রতিবাদের আওয়াজ শোনা যায় পোলিশদের জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রসঙ্গে। তিনি রুশ ও পোলিশ সোশ্যালিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। কারণ, পার্টি বিশ্বাস করত সংখ্যালঘু রুশ জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন তাদের অধিকার। রোজা বিশ্বাস করতেন, এই জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের ইস্যু আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে দুর্বল করে দিচ্ছে এবং বুর্জোয়া শ্রেণিকে নতুন স্বাধীন দেশে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির সুযোগ করে দিচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে রোজা লুক্সেমবার্গ নতুন পোলিশ সোশ্যালিস্ট ডেমোক্রেটিক পার্টি গঠনে হাত লাগান। তার প্রবন্ধ ‘রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট-এর সাংগঠনিক প্রশ্ন (১৯০৪)’ মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকদের মধ্যে একটি বহুল আলোচিত কাজ।
যুদ্ধবিরোধী অবস্থান
১৯০৭ সালে স্টুটগার্টে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সোশ্যালিস্ট কংগ্রেসে রোজা লেনিনের সঙ্গে যুক্তভাবে একটি প্রস্তাবের (রেজল্যুশন) খসড়া পেশ করেন। সেখানে তিনি পৃথিবীর সব শ্রমিক শ্রেণিকে ভবিষ্যৎ যুদ্ধগুলোকে পৃথিবীর পুঁজিবাদী ক্ষমতা ধ্বংসের একটি সুযোগ হিসেবে দেখার ও তা কাজে লাগানোর আহ্বান জানান। কিন্তু খুব দ্রুতই তিনি পরিস্থিতি অনুধাবন করেন। যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নির্মমতা তার ধারণাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় এবং তিনি কোনো দ্বিধা না করে নিজের অবস্থান বদল করেন। এসপিডির তাত্ত্বিকদের মধ্যে মূলত একাই তিনি বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন।
১৯১৩ সালের সেপ্টেম্বরে ফ্রাঙ্কফুর্টে রোজা লুক্সেমবার্গ এক বক্তৃতা দেন, যেখানে তিনি জার্মানির শ্রমিক শ্রেণির প্রতি অনুরোধ করেন অন্য দেশের শ্রমিকের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে না নিতে। এই বক্তব্যের ফলে পাঁচ মাস পর ১৯১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে শ্রমিক শ্রেণিকে রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত না থাকার ইন্ধন জোগানোর দায়ে ফ্রাঙ্কফুর্টের ক্রিমিনাল কোর্টে লুক্সেমবার্গের ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হয়। তিনি কোর্টের সামনে নিজের বক্তব্যের সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। তার সেই বক্তব্য (যা পরে ‘সামরিকতা, যুদ্ধ ও শ্রমিক শ্রেণি’ নামে প্রকাশিত হয়) ছিল যুদ্ধ, শান্তি ও মানুষের নিজের নিয়তি নির্ধারণের অধিকার সম্পর্কে একটি অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত ঘোষণা। এই বক্তব্যের পর রাতারাতি তিনি একজন আলোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তার সাহস, বক্তব্যের ঋজুতা ও বুদ্ধিদীপ্ত চোখা মন্তব্য মানুষের চিন্তার একদম সঠিক জায়গাটিতে আঘাত করতে পেরেছিল–কেউ এই বক্তব্যে উৎসাহিত হয়েছিল, কেউ হয়েছিল উদ্বেলিত এবং কেউ হয়েছিল লজ্জিত। (এটিঞ্জার, ১৯৮৬)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে রোজার মতামত ছিল, ইউরোপের শ্রমিক দলগুলোর উচিত হবে যুদ্ধ শুরু হলে তার বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া। কিন্তু ১৯১৪ সালে যখন বলকানের জাতীয় সংকট থেকে হানাহানি ও শেষপর্যন্ত যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে, তখন কোনো ধর্মঘট তো দূরের কথা, এসপিডি-এর অধিকাংশ সদস্য এই যুদ্ধের প্রতি সমর্থন দেন। একই কাজ করেন ফরাসি সমাজতান্ত্রিকরা। এই কঠিন সময়ে এসপিডির সদস্যরা সে সময়ের জার্মান সাম্রাজ্য (রেইখট্যাগ)-এর সমর্থনে ভোট দেন। জার্মান সরকারের যুদ্ধ ঋণের সপক্ষে দেওয়া এই ভোটে পক্ষে-বিপক্ষের অনুপাত ছিল ৭৮:১৪। এমনকি তারা একটি চুক্তিতে জার্মান সম্রাটকে যুদ্ধ মুহূর্তে কোনোরকম ধর্মঘট বা অসহযোগিতা না করার প্রতিশ্রুতি দেন। লুক্সেমবার্গ এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করেন। তিনি কোনোদিন সংশোধনবাদীদের সঙ্গে আপসের কথা ভাবতে পারেননি। তাই সম্ভবপর সব উপায়ে তিনি পার্টির সিদ্ধান্ত বদলের চেষ্টা করেন। কিন্তু তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সে সময় পার্টি সদস্য কার্ল লিবনেখট তাকে জোরালো সমর্থন দেন এবং সেই থেকে তারা দুজন ছিলেন রাজনৈতিকভাবে অবিচ্ছেদ্য কমরেড ও বন্ধু। শেষমেশ তারা দুজন নিজেরাই ধর্মঘট ডাকার সিদ্ধান্ত নেন। লুক্সেমবার্গ তখন জুনিয়াস (রোমান রিপাবলিকের প্রতিষ্ঠাতা লুসিয়াস জুনিয়াস ব্রুটাস) ছদ্মনামে নিজেদের চিন্তা ও ব্যাখ্যা সংবলিত একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন, যা ‘জুনিয়াস ইশতেহার’ নামে পরিচিতি পায়; যদিও এই লেখার আসল নাম ছিল ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসির সংকট’।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে রোজার মতামত ছিল, ইউরোপের শ্রমিক দলগুলোর উচিত হবে যুদ্ধ শুরু হলে তার বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া। কিন্তু ১৯১৪ সালে যখন বলকানের জাতীয় সংকট থেকে হানাহানি ও শেষপর্যন্ত যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে, তখন কোনো ধর্মঘট তো দূরের কথা, এসপিডি-এর অধিকাংশ সদস্য এই যুদ্ধের প্রতি সমর্থন দেন। একই কাজ করেন ফরাসি সমাজতান্ত্রিকরা।
১৯১৪ সালের আগস্টে রোজা লুক্সেমবার্গ তার বিশ্বস্ত কমরেড কার্ল লিবনেখট, ক্লারা জেটকিন ও ফ্রাঞ্জ মেহরিং মিলে একটি বিপ্লবী গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম ছিল দি ইন্টারন্যাশনাল (Die Internationale)। পরবর্তী সময়ে ১৯১৬ সালের জানুয়ারিতে এই গ্রুপের নাম দাঁড়ায় ‘স্পার্টাকাস লিগ’। তারা ক্রমাগত স্পার্টাকাস ছদ্মনামে যুদ্ধবিরোধী পুস্তিকা প্রকাশ করতে থাকে। এই পুস্তিকা সে সময় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৯১৬ সালের ১ মে লুক্সেমবার্গ একটি যুদ্ধবিরোধী সমাবেশের আয়োজন করেন। সকাল ৮টার মধ্যে সেখানে জড়ো হয় প্রায় ১০ হাজার লোক। তিনি সেই সমাবেশের বক্তৃতায় সাধারণ নাগরিকের বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে যোগদানের সরকারি আদেশের কঠোর বিরোধিতা করেন এবং সরকারি আদেশ মানতে অস্বীকৃতি জানানোর ডাক দেন। সে সময় কার্ল ও তিনি মিলে জার্মানির সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্ব দিয়ে একটি যুদ্ধবিরোধী সাধারণ ধর্মঘটের পরিকল্পনা করছিলেন। এর ফলশ্রুতিতে ১৯১৬ সালের জুনে ‘রাষ্ট্রের আদেশ ও আইন অমান্যের’ অভিযোগে তাদের দুজনকেই অনির্দিষ্ট কালের জন্য কারাবরণ করতে হয়।
তিনি সেই সমাবেশের বক্তৃতায় সাধারণ নাগরিকের বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে যোগদানের সরকারি আদেশের কঠোর বিরোধিতা করেন এবং সরকারি আদেশ মানতে অস্বীকৃতি জানানোর ডাক দেন। সে সময় কার্ল ও তিনি মিলে জার্মানির সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্ব দিয়ে একটি যুদ্ধবিরোধী সাধারণ ধর্মঘটের পরিকল্পনা করছিলেন। এর ফলশ্রুতিতে ১৯১৬ সালের জুনে ‘রাষ্ট্রের আদেশ ও আইন অমান্যের’ অভিযোগে তাদের দুজনকেই অনির্দিষ্ট কালের জন্য কারাবরণ করতে হয়।
রোজা লুক্সেমবার্গ তার এই দীর্ঘ ক্লান্তিকর কারাবাসে লেখালিখি চালিয়ে যেতে থাকেন। জেলের একজন নারী সেবিকার সাহায্যে তিনি তার অন্য কমরেডদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখতে সমর্থ হন। তার রাজনৈতিক বন্ধুরা লুকিয়ে নিয়মিত তার লেখা জেলের বাইরে এনে বেআইনিভাবে প্রকাশ করা অব্যাহত রাখেন। লুক্সেমবার্গ সে সময় একইসঙ্গে তার লেখার মধ্য দিয়ে রুশ বিপ্লব ও বলশেভিকদের মধ্যে সম্ভাব্য একনায়কতান্ত্রিকতা বিকাশের বিষয়ে উদ্বেগ ও সমালোচনা প্রকাশ করেছেন।
১৯১৭ সালে স্পার্টাকাস লিগ যুক্ত হয় ইনডিপেনডেন্ট সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (ইউএসপিডি) সঙ্গে এবং সাবেক এসপিডির যুদ্ধবিরোধী কমরেডরাও এতে যোগ দেন। সে সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধও শেষ হয় এবং ফলে জার্মানিতে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং প্রথমবারের মতো জার্মানি একটি সংসদীয় গণতান্ত্রিক রিপাবলিকে পরিণত হয়। রাজতন্ত্রের পতনের ফলে আশাতীতভাবে লুক্সেমবার্গ কারাগার থেকে মুক্তি পান। এই মুক্তির পরের দুই মাস ছিল তার জীবনের সবচেয়ে ঘটনাবহুল ও কর্মমুখর সময়। তিনি ও কার্ল মিলে স্পার্টাকাস লিগকে পুনরায় সংগঠিত করেন এবং ‘লাল পতাকা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন।
‘মুক্তির মাত্র এক সপ্তাহ পরেই রোজা বলশেভিকদের অ্যাসেম্বলি নিয়ে তার অপ্রকাশিত সমালোচনা প্রবন্ধ প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি লেনিনের মতো একটি সোজাসাপ্টা অবস্থান নেন, যেখানে সমাজতন্ত্র নাকি বর্বরতা–এই প্রশ্নের সমাধান আশু জরুরি বলে তিনি স্বীকার করেন। তার ভাষায়, ‘আজ গণতন্ত্র না একনায়কতন্ত্র সেটি আর গুরুত্বপূর্ণ নয়, ইতিহাস যে প্রশ্ন আমাদের সামনে এনেছে তা হলো, বুর্জোয়া গণতন্ত্র নাকি সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র।’ (আব্রাহাম, ১৯৮৯)
‘স্পার্টাকাস লিগ কী চায়’ শীর্ষক প্রবন্ধে রোজা লুক্সেমবার্গ তার কমরেডদের এই লিগের লক্ষ্য সম্পর্কে বলেন, ‘সব সংসদ ও স্থানীয় কাউন্সিলের বিলোপ এবং শ্রমিক শ্রেণির দ্বারা সবকিছুর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ স্থাপন।’ আবার একই সঙ্গে এই লিগের একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা অধিগ্রহণের কোনোরকম আকাঙ্ক্ষাকে তিনি নাকচ করেন। তিনি বলেন, ‘স্পার্টাকাস লিগ কখনোই সরকারের ক্ষমতা দখল করবে না, যদি কিনা শ্রমিক শ্রেণির বৃহত্তর অংশ দ্বিধাহীনভাবে তা দাবি না করে।’ (আব্রাহাম, ১৯৮৯)
মৃত্যু
শত্রুদের কাছে ‘ব্লাডি রোজা’ বা ‘রেড রোজা’ নামে পরিচিত এই অসাধারণ সাহসী মানুষটিকে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৯১৮ সালের ১০ নভেম্বর, যেদিন লুক্সেমবার্গ বার্লিনে ফেরেন মূলত সেদিনই তার অদৃশ্য মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়ে যায়। এর ঠিক ৬৭ দিনের মাথায় তিনি খুন হন। তিনি বার্লিনে ফিরেছিলেন বার্লিন অভ্যুত্থানের চার দিন পর। এই অভ্যুত্থানের ফলে লুক্সেমবার্গ নিজেদের কর্মপরিকল্পনা নতুন উদ্যমে সাজাতে শুরু করেন।
১৯১৮ সালে লুক্সেমবার্গ ও লিবনেখট তিন দিনব্যাপী (২৯ থেকে ৩১ ডিসেম্বর) যৌথ কংগ্রেসে যোগ দেন, যেখানে লিগ, ইনডিপেনডেন্ট সোশ্যালিস্ট ও ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিস্ট অব জার্মানি (আইকেডি) অংশ নেয়। এই কংগ্রেস থেকে ১৯১৯ সালের ১ জানুয়ারি লুক্সেমবার্গ ও লিবনেখটের নেতৃত্বে জন্ম নেয় কমিউনিস্ট পার্টি অব জার্মানি (কেপিডি)।
১৯১৯ সালের জানুয়ারিতে বার্লিনে দ্বিতীয় বৈপ্লবিক জোয়ার শুরু হয়, যা স্পার্টাসিস্ট উত্থান নামে পরিচিত। এটি স্বতঃস্ফূর্ত হলেও ছিল নেতৃত্ববিহীন, যদিও বিদ্রোহীরা লাল পতাকা থেকে উদ্দীপিত হয়েই লিবারেল প্রেসের ভবন দখল করে নিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। রোজা লুক্সেমবার্গ এটিকে শ্রমিকের দিকনির্দেশনাবিহীন উত্থান বলে বিবেচনা করেন; কিন্তু লিবনেখট ছিলেন এই অভ্যুত্থান নিয়ে খুবই উৎসাহী। তিনি পার্টির মেম্বারদের সঙ্গে নিয়ে এই বিদ্রোহে যোগ দেন। লুক্সেমবার্গ খুব একটা নিশ্চিত ছিলেন না, তবে তিনি লিগের সিদ্ধান্তের সঙ্গে অমত করতে চাননি। বেশ কয়েকজন সাক্ষী পরবর্তী সময়ে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে লুক্সেমবার্গ এই অভ্যুত্থানের পরিণতি সম্পর্কে চিন্তিত ছিলেন এবং তিনি বেশ কয়েকবার লিবনেখটকে মৃদু ভর্ৎসনা করেছেন এই বলে যে, ‘কার্ল, এটা কি আমাদের পরিকল্পনা ছিল?’ (এটিঞ্জার, ১৯৮৬)
স্পার্টাসিস্টদের সাংগঠনিক ক্ষমতার অভাব ছিল প্রকট, কিন্তু সেনাবাহিনীর তা ছিল না। এই অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়ায় সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লিডার ফ্রেডেরিখ এবার্ট (যে ছিল এসপিডির ট্রেনিং সেন্টারে লুক্সেমবার্গের ছাত্র) সৈনিকদের নির্দেশ দেন বামপন্থি বিপ্লবকে মাটিতে গুঁড়িয়ে দিতে। অভ্যুত্থানের রক্তাক্ত সমাপ্তি ঘটে জানুয়ারির ১২ তারিখে। ১৯১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি বার্লিন থেকে ক্যাভালোরি গার্ডের রাইফেল ডিভিশনের হাতে রোজা লুক্সেমবার্গ ও কার্ল লিবনেখট ধরা পড়েন। এর কমান্ডার ক্যাপ্টেন ওয়ালডেমার দ্বিধা না করে দুজনকেই হত্যার নির্দেশ দেন।
ধরা পড়ার পর তাদের দুজনকে হোটেল ইডেনে আনা হয় (যা ছিল তৎকালীন ক্যাভালোরি ও রাইফেলম্যানের হেডকোয়ার্টার)। তারা তখনো জানতেন না তাদের শেষ পরিণতি কী হতে যাচ্ছে।
রোজা লুক্সেমবার্গের হত্যার বর্ণনা সম্পর্কে যা জানা যায় তা এরকম: হোটেল ইডেনের একটি রুমে লুক্সেমবার্গকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে মেরে মাটিতে ফেলা হয়। কোনো শব্দ ছাড়াই তিনি কার্পেটে লুটিয়ে পড়েন। সেখান থেকে তাকে নিয়ে তোলা হয় রাস্তার পাশে পার্ক করে রাখা এক গাড়িতে। সেখানেই মাথায় গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। তার লাশ ছুড়ে ফেলা হয় বার্লিনের ল্যান্ডবোয়্যার খালে। লিবনেখটও একই পরিণতি বরণ করেন। হত্যার প্রায় পাঁচ মাস পর জুনের ১ তারিখে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। সুরতহালের মাধ্যমে তার পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। তার ও কার্লের মৃত্যুর খবরে জার্মানিজুড়ে সহিংসতা ও ধর্মঘটের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
লুক্সেমবার্গ ও তার আমৃত্যু কমরেড লিবনেখট সমাহিত আছেন বার্লিনের ফ্রিডরিখসফেলডা কেন্দ্রীয় সমাধিস্থলে। প্রতি জানুয়ারির দ্বিতীয় রোববার মানুষ সেখানে তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে। অদ্ভুতভাবে, লুক্সেমবার্গের রাজনৈতিক জীবনের সবশেষ প্রবন্ধ ‘Order Reigns in Berlin’ তিনি শেষ করেছিলেন এভাবে:
‘আগামীকাল বিপ্লব তার শিখরে পৌঁছাবে এবং তোমার বুকে ভয়ের কাঁপুনি ধরিয়ে তা ঘোষণা করবে এর বিজয়ের বাণী: আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকব।’
একঝলকে রোজার জীবন
তারিখ | ঘটনা |
১৮৮৯ | পোল্যান্ডের জামোশচ-এ জন্ম। |
১৮৮৯- ১৮৯৮ | সুইজারল্যান্ডের জুরিখে পাড়ি দেওয়া |
১৮৯৮ | জুরিখে আইন ও রাজনৈতিক অর্থনীতি অধ্যয়ন। ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ |
১৮৯৮ | প্যারিস গমন। সমাজতান্ত্রিক পত্রিকা ‘ওয়ার্কার্স কজ’ সম্পাদনা |
১৯০৫ | বার্লিন গমন, জার্মান নাগরিকত্ব লাভ |
১৯০৫ | জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য হিসেবে ‘ফরোয়ার্ড’ নামক পত্রিকা সম্পাদনা |
১৯০৬ | রুশ বিপ্লবে অংশ নিতে পোল্যান্ড যাত্রা, কারাবরণ |
১৯০৭ | জেল থেকে বেরিয়ে বার্লিন প্রত্যাবর্তন |
জুন, জুলাই ১৯০৭ | বার্লিনে কারাবরণ |
১৯০৭-১৯১৪ | বার্লিনে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির স্কুলে মার্ক্সবাদ ও অর্থনীতির পাঠদান |
জুলাই ২৮, ১৯১৪ | প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু |
জুলাই ২৯, ১৯১৪ | ব্রাসেলসের আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক কনভেনশনে যোগদান |
আগস্ট ১৯১৪ | কার্ল লিবনেখট-এর সঙ্গে যৌথভাবে ‘দি ইন্টারন্যাশনাল’ গ্রুপ তৈরি করা |
জানুয়ারি ১, ১৯১৬ | দি ইন্টারন্যাশনাল থেকে স্পার্টাকাস লিগে রূপান্তর |
১৯১৬-১৯১৮ | কারাবরণ। রোজা লেখালিখিতে এই সময়ের পুরোটা ব্যয় করেন। |
নভেম্বর ৮, ১৯১৮ | জার্মান বিপ্লব (নভেম্বর বিপ্লব) যার ফলে রোজা জেল থেকে মুক্তি পান |
জানুয়ারি ৫, ১৯১৯ | স্পার্টাকাস উত্থান |
জানুয়ারি ১৫, ১৯১৯ | মৃত্যুবরণ |
আতিয়া ফেরদৌসী: ইকনমিকস অ্যান্ড পলিসি অ্যানালিস্ট, সিটি অব নরফোক গভ., ভার্জিনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
ই-মেইল: chaity.srsp@gmail.com
তথ্যসূত্র:
১) আব্রাহাম, রিচার্ড, (১৯৮৯), রোজা লুক্সেমবার্গ: এ লাইফ ফর দি ইন্টারন্যাশনাল; বার্গ পাবলিশার্স লিমিটেড।
২) এম, মোনালিসা, কনফ্লিক্ট বিটউইন লেনিন অ্যান্ড লুক্সেমবার্গ, পলিটিক্যাল সায়েন্স জার্নাল http://www.politicalsciencenotes.com/political-thinkers/lenin/conflict-between-lenin-and-
luxemburg/1293
৩)) এটিঞ্জার, ই, (১৯৮৬), রোজা লুক্সেমবার্গ: এ লাইফ, বিকন প্রেস, বোস্টন
৪) উলফ, বারট্রাম ডি, (১৯৬৬), স্ট্রেঞ্জ কমিউনিস্ট আই হ্যাভ নোন, জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন লিমিটেড
৫) মার্ক্সিস্ট ইন্টারনেট আর্কাইভ https://www.marxists.org/archive/luxemburg/index.htm
৬) লুক্সেমবার্গ, রোজা, (১৯১২), উইমেন’স সাফরেজ অ্যান্ড ক্লাস স্ট্রাগল
৭) লুক্সেমবার্গ, রোজা, (১৯১৩), দি অ্যাকিউমুলেশন অব ক্যাপিটাল; মান্থলি রিভিউ প্রেস (১৯৬৪), অনুবাদ: অ্যাগনেস শোয়ার্জচাইল্ড, ভূমিকা: জোয়ান রবিনসন।
৮) হুডিস, পি; অ্যান্ডারসন, কেভিন বি; (সম্পা.), ‘দি রোজা লুক্সেমবার্গ রিডার’, জার্নাল অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল মার্ক্সিস্ট-হিউম্যানিস্ট