কৃষক বিদ্রোহ ও সশস্ত্র সংগ্রাম

খুলনার গণতান্ত্রিক আন্দোলন

কৃষক বিদ্রোহ ও সশস্ত্র সংগ্রাম

রণজিৎ চট্টোপাধ্যায়

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শক্তিশালী ঐতিহ্য আছে। অগণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের আধিপত্যের কালে নিজেদের শক্তির জায়গাগুলো পুনপাঠ প্রয়োজন। এই ধারাবাহিক লেখায় খুলনা অঞ্চলের বিশেষ অবস্থান এবং কৃষক বিদ্রোহ এবং সশস্ত্র সংগ্রামের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে। প্রথম পর্বে এই অঞ্চলের পরিচিতি দেয়া হয়েছে।

শ্রেণি সংগ্রাম- কতগুলি শ্রেণি জয়লাভ করে, আর কতগুলি বা ধ্বংস হয়। এটাই ইতিহাস, এটাই হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, এই দৃষ্টিকোণের বিপক্ষে দাঁড়ানোই হচ্ছে ঐতিহাসিক ভাববাদ। মাও সে-তুং ১৪ আগস্ট ১৯৪৯।  

ভূমিকা

সাগরাভীমুখিনী গঙ্গা যে স্থান হতে পদ্মা ও ভাগীরথী নাম নিয়ে দুটি বাহুর মতো এগিয়ে গেছে সাগরপানে সেই সন্ধিস্থল হতে সমুদ্র পর্যন্ত প্রসারিত দুবাহু দ্বারা বেষ্টিত ভূভাগ একটি বদ্বীপাকার ধারন করেছে। গঙ্গার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আছে; তা হলো সুউচ্চবাহু বিস্তৃত ​হিমালয় পর্বতের সাথে গঙ্গার যেমন ঘনিষ্ট সম্বন্ধ পৃথিবীতে এমনটি আর কোথাও নাই। হিমালয় ধৌত অজস্র জলরাশি শতশত নির্ঝরিনী পথে গঙ্গার দেহ পুষ্ট করেছে; সাথে সাথে পাহাড় ধোয়া জলের রেণুকণা, বালুকণা বহন করেছে গঙ্গায় ওই দুটি স্রোতধারা পদ্মা ও ভাগীরথী। আর ওই সব রেণুকণা পলি আকারে নদীর তীরবর্তী ভূভাগকে গঠিত করেছে এবং করে তুলেছে প্রচণ্ড উর্বরক্ষেত্র। পৃথিবীতে এতো বেশি পর্বতরেণু বহনকারী নদী  আর নাই।  এমনভূমি গঠন ক্ষমতাও অন্য কোনো নদীর নাই। শুধু গঙ্গা নয় এই পর্বতরেণু পলিমাটি বহন করে চলেছে পদ্মা ও ভাগীরথীর অনেক শাখা নদীগুলিও। পদ্মার বামভাগে ঢাকা জেলার (বৃহত্তর) দক্ষিণাংশ এবং ভাগীরথীর পশ্চিমকূলে মেদিনীপুরের দক্ষিণভাগ। আর এ দুইয়ের মধ্যখানে যশোর-খুলনার বিস্তীর্ণ উর্বর সমভূমি।

খুলনার দক্ষিণে পৃথিবীর বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণসহ অসংখ্য জীবকুল ও প্রাণিকুলের অভয় আবাসস্থল। স্বাভাবিক কারণে এখনকার সকল নদীই উত্তর হতে দক্ষিণগামী। পূর্বদিকে গৌরী-মধুমতী, মধ্যভাগে ভৈরব-কপোতাক্ষ, পশ্চিম দিকে যমুনা-ইছামতী প্রভৃতি নদীগুলি সবই দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলিত হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দী হতে মধুমতীর পূর্ববর্তী অংশ ঢাকা বিভাগ এবং গৌরী-মধুমতী ও ভাগীরথীর মধ্যবর্তী ভাগকে প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্গত ছিল। প্রেসিডেন্সি বিভাগের প্রধানতঃ যমুনা-ইছামতী ও মধুমতীর মধ্যবর্তী অংশ যা মূলত ভৈরব-কপোতাক্ষ বেষ্টিত, সেই খুলনা জেলা আমাদের আলোচনার ক্ষেত্রবিন্দু। উল্লেখ্য যে বর্তমানে খুলনা জেলা ৩টি পৃথক জেলায়  বিভক্ত হয়েছে। এই খুলনার মানুষ, তার প্রকৃতি, তার জীবজন্তু, প্রাণীকুল সমেত যে প্রকৃতি সবই আলোচ্য বিষয় হলেও এর মানব সমাজ, তার জীবনজীবিকা, দুঃখ-বেদনা, লড়াই-সংগ্রাম এবং তার ফলাফল ও বিকাশ আমাদের আলোচনার প্রধান প্রসঙ্গ। 

গঙ্গার সকল বদ্বীপবিভাগই প্রধানত নদী মাতৃক। বিশেষত খুলনা, এই জেলায় নদী শিরা উপশিরার মতো ছড়িয়ে রয়েছে। এই অঞ্চলে নদীই সব। নদী দেশকে বাসোপযোগী করেছে, সমৃদ্ধ করেছে। আবার নদী বারবার গতি পরিবর্তন করেছে; ফলে জনপদ ধ্বংস হয়েছে, ফসলের ক্ষতি হয়েছে, মানুষ সামর্থ্য হারিয়েছে। আবার শসকেরা দেশের ক্ষতি সাধন করেছে নদী শাসন করতে গিয়ে। অধুনা প্রায় ছোট বড় অধিকাংশ নদীতে হয় বাঁধ নতুবা ব্রিজ করা হচ্ছে। এর ফলে নদীর স্রোতধারা বাধাগ্রস্ত হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে যা জনপদকে বিপদগ্রস্ত করে তুলছে। প্রতিটি নদী থেকে অসংখ্য খাল এবং জোলা বাহিত হয়ে চাষের জমিগুলি সতেজ রাখে। প্রয়োজনের সময় জল সরবরাহ করে, নিষ্কাশন করে এবং পলি ফেলে উর্বর করে। মানুষ প্রকৃতির স্বাভাবিক এইসব ক্রিয়াকর্মে বাধা সৃষ্টি করে প্রাণ প্রকৃতিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। অপরিণামদর্শী ধনী শ্রেণি প্রাকৃতিক নদী-খালগুলিকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার ফলে সাম্প্রতিক সময়ে সমগ্র খুলনা জেলায় গুরুতর সমস্যা সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

খুলনা জেলা ছিল মূলত কৃষি এলাকা। এখানে ৯৫ শতাংশ মানুষ একসময় কৃষি উৎপাদনে নিয়োজিত ছিল। পরবর্তীতে আধুনিক সভ্যতার বিকাশের ফলে খুলনা শহর, দৌলতপুর, মেমহাটি, আঠরা, গিমাতলা, মোংলাবন্দর, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের শিল্পাঞ্চলে আধুনিক কারখানা স্থাপিত হওয়ায় অনেক মানুষ শিল্পশ্রমিকে পরিণত হয়েছে। তদুপরি জমিদারদের নিষ্ঠুর নিপীড়নে, পাকিস্তান সরকার এবং বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত এবং কার্যক্রমের ফলে অনেক মানুষ তার উৎপাদনের ক্ষেত্রভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে সর্বহারায় পরিণত হয়ে শিল্প শ্রমিকে পরিণত হয়েছে। খুলনায় অসংখ্য মানুষ একদা দেশত্যাগ করেছে এবং এখনো তা অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় খুলনা জেলায় উত্থান পতন বেশি হয়েছে। সকল সময়ের মতো বর্তমান বাংলাদেশের শাসক শ্রেণি অনুৎপাদক শ্রেণির প্রতিনিধি হওয়ার কারণে অন্যান্য স্থানের মতো খুলনা জেলায় উৎপাদক শ্রেণি নানাভাবে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। উৎপাদক শ্রেণি অর্থাৎ কৃষক শ্রেণি বহু যুগ ধরে প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে তাদের উৎপাদন কাজ চালিয়ে যেতো। প্রথম বৃটিশ শাসকরা রাস্তাঘাট, রেলপথ প্রভৃতি করার সময় পূর্বাপর বিবেচনা করে নাই যা প্রতিবেশ পরিবেশের ক্ষতির সূচনা করেছে। অতঃপর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোঃ আইউব খান কানাডা-কলোম্বো পরিকল্পনার অধীনে খুলনা জেলার বিস্তির্নাঞ্চলে ভেড়ি বাঁধের প্রচলন করে কৃষিকাজের পায়ে কুড়ালের ঘা মেরেছিল এবং বর্তমান সময়ে ছড়িয়ে থাকা তাবেদার শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার জন্যে তারা নদী খালগুলি যেমন একদিকে দখল করেছে অন্যদিকে লবণ জলের বাগদা চাষের ফলে প্রকৃতির মহাক্ষতিসাধন করে চলেছে। আবহমানকালের ধান চাষ প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে খুলনার বিস্তির্ণ অঞ্চল থেকে। তিল এবং পাটচাষ নাই বললেই চলে। সমগ্র খুলনার ঐতিহ্যবাহী নারিকেল, সুপারির ফসল বিলুপ্তির পথে। নারিকেল অতি সুস্বাদু, পুষ্টিকর একটি পানীয় ও ফল দুইই- তা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে খুলনার গ্রামগুলো থেকে।

আবহমানকালের ধান চাষ প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে খুলনার বিস্তির্ণ অঞ্চল থেকে। তিল এবং পাটচাষ নাই বললেই চলে। সমগ্র খুলনার ঐতিহ্যবাহী নারিকেল, সুপারির ফসল বিলুপ্তির পথে। নারিকেল অতি সুস্বাদু, পুষ্টিকর একটি পানীয় ও ফল দুইই- তা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে খুলনার গ্রামগুলো থেকে।

প্রতিবেশ-প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মকাণ্ড না করলে প্রকৃতি তার নির্মম প্রতিশোধ নিবে তা আজ দিবালোকের মতো সত্য। খুলনাঞ্চলে সিডর, আইলা, আমফান প্রভৃতি ঘুর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস এবং করোনার মতো মহামারি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। অথচ সেই প্রকৃতিকে ধ্বংস করার জন্য শাসকশ্রেণি সুন্দরবনের কাছাকাছি কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ নানাবিধ কলকারখানা গড়ে তুলছে অপরিণামদর্শীর মতোই। 

খুলনা জেলা ও এর প্রাচীনত্ব

যশোর জেলার একটা থানা খুলনা মহকুমার মর্যাদা পায় ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে। আর অল্পকাল পরেই ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে খুলনা জেলায় রূপলাভ করে। খুলনাঞ্চল বাংলার একটি প্রাচীন জনপদ। অনেকে মনে করেন সমুদ্র উপকূল বিধায় এর তেমন কোনো প্রাচীনত্ব নেই। কিন্তু একথা সত্য নয়।

বাংলার প্রাচীনতা নিয়ে আলাপ এলে এর উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব শতকেও। বর্তমান বাংলাদেশের আশেপাশেই আর্যদের আসার পরপরই গঠিত হয়েছিল অঙ্গ, বঙ্গ, মগধ প্রভৃতি রাজ্যগুলি। এসব কিছুর বর্ণনা আমরা অথর্ব বেদে প্রথম পাই। মহাভারতে পৌন্ড্ররাজ বাসুদেব এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ভারতের ইতিহাসে বাংলা চিরকাল এক গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে যেমন আজো করে চলেছে। রোম ও গ্রিক অধিবাসিরা বাংলাকে এক ধনি দেশ বলে জানতো। চার হাজার বছর আগে বাংলায় সভ্যতার বিকাশের সূত্রপাত হয়। একসময় ইউরোপীয় বণিকদের কাছে বাংলা অত্যন্ত ধনশালী দেশ রূপে পরিগণিত ছিল। মুঘল আমলে বাংলা ছিল সবচেয়ে সম্পদশালী প্রদেশ। বাংলা সমুদ্রগামী জাহাজ ও বস্ত্রশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। মোঘল সাম্রাজ্যের মোট দেশজ উৎপাদনের ১২ শতাংশ উৎপন্ন হতো এই বাংলায়; যা সমগ্র ঐকালে সমগ্র ইউরোপের মোট দেশজ উৎপাদনের চেয়ে অধিক। চিনি, লবণ আবির প্রভৃতি পণ্য উৎপাদনে বাংলা ছিল অগ্রগণ্য।

আর এইসব উৎপাদনের সিংহভাগ খুলনা সরবরাহ দিত। খুলনার দৌলতপুর নদীবন্দর মারফত বিপুল পরিমাণে লবণ, চিনি এবং আবির সারা বাংলায় তথা ভারতে রপ্তানি হতো। খেজুরগুড় থেকে একপ্রকার সুস্বাদু চিনি এই খুলনায় প্রস্তুত হতো। লবণ চাষের উপর ব্রিটিশরা প্রথম কর আরোপ করে এবং অবশেষে আইন করে এখানে লবণ চাষ নিষিদ্ধ করে দেয়। এসব কিছু খুলনা জেলার প্রাচীনত্বের প্রমাণ দেয়। তাছাড়া যশোর-খুলনার ইতিহাস লেখক ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্র আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, প্রত্নতাত্বিক খনন কাজ চালালে খুলনার সুপ্রাচীনত্ব প্রকাশিত হতে পারে।

খুলনার দৌলতপুর নদীবন্দর মারফত বিপুল পরিমাণে লবণ, চিনি এবং আবির সারা বাংলায় তথা ভারতে রপ্তানি হতো। খেজুরগুড় থেকে একপ্রকার সুস্বাদু চিনি এই খুলনায় প্রস্তুত হতো। লবণ চাষের উপর ব্রিটিশরা প্রথম কর আরোপ করে এবং অবশেষে আইন করে এখানে লবণ চাষ নিষিদ্ধ করে দেয়। এসব কিছু খুলনা জেলার প্রাচীনত্বের প্রমাণ দেয়।

খুলনার নামকরণ

কবি কঙ্কণ বিরচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে বর্ণিত আছে যে, বহু পূর্বে অজয় নদী তটে উজ্জয়িনী নামে এক নগরী ছিল। সেখানে ছিল এক সওদাগরের বাস। ‘ধনপতি’ নামের এই সওদাগর বাস্তবেও ছিল অঢেল ধনের মালিক, বিপুল ছিল তার সম্পদ ও ঐশ্বর্য। সারা বাংলা জুড়ে ছিল তার বাণিজ্য। ধনপতি সওদাগরের ছিল দুই স্ত্রী, লহনা ও খুল্লনা। ধনপতির বাণিজ্য তরী সারা বাংলা বিশেষ করে দক্ষিণ বাংলা, যেখানে বসতি শেষে বনাঞ্চলের অবস্থান সেইসব স্থানে বিচরণ করতো এবং দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ করতো ও বিক্রি করতো। দীর্ঘ সময় এই দক্ষিণাঞ্চলে তার বাণিজ্যতরী অবস্থান করতো। খুলনার বহুস্থানে ধনপতি সওদাগরের কীর্তি এখনো বিদ্যমান। বিভিন্ন স্থানে তিনি মন্দির ও দেবালয় নির্মাণ করেছিলেন। বড় স্ত্রী ছোট স্ত্রীকে গহনা দিলে সওদাগরের অধিক প্রীতি লাভ করেন খুল্লনা। কল্পনা বা জনশ্রুতি যে, এই খুল্লনার নামানুসারে খুলনা নামের উৎপত্তি।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে রেনি সাহেব নামে এক সৈনিক বর্তমান খুলনার পূর্ব পারে, তামিলপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করে নীল চাষ ও চিনির ব্যবসা শুরু করেন। স্থানীয় জমিদার শিবনাথ ঘোষের সাথে তার বিবাদ শুরু হয় এবং পরে তা যুদ্ধে রূপ নেয়। শান্তি রক্ষার জন্য কোম্পানি নয়াবাদ থানা নামে একটা পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করে। বিবাদের তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পেলে খুলনা নামের এই স্থানে ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে একটি সাবডিভিশন স্থাপিত হয়। সমগ্র বাঙলায় এই খুলনাই প্রথম সাবডিভিশন এবং সেই থেকে খুলনা নামে এই শহর পরিচিতি লাভ করে এসেছে।

ঐতিহাসিক সতীশ মিত্র তাঁর যশোর খুলনার ইতিহাসে লিখেছেন,

“পূর্বকালে এখানে সুন্দরবনের ভীষণ জঙ্গল ছিল। ইংরেজ আমলে খুলনাকে নয়াবাদ বা নতুন আবাদজনিত অথবা উত্তর পারে ‘সেনের রাজার’ প্রাচীন স্থান। সেই পূর্বকালেও লোকে কাঠ কাটিতে সুন্দরবনে যাইত; তখন এদেশের ব্যবহারোপযোগী যাহা কিছু কাঠ সুন্দরবন হইতেই আসিত। পশ্চিম দেশে বা বিদেশে বাণিজ্যার্থে যাইতে হইলে, সুন্দরবনের মধ্য দিয়া যাইতে হইত। নয়াবাদেই বসতির শেষ এবং বনের আরম্ভ। দিবাশেষে নৌকার বহর নয়াবাদের নিম্নে আসিয়া রাত্রিবাস করিত, রাত্রিতে কেহ নৌকায় ঘুমাইতে সাহসী হইত না। লোকে বলে যে, রাত্রিতে কোনো দুঃসাহসি মাঝি নৌকায় ঘুমাইতে গেলে জঙ্গলের বনদেবতা তাহাকে বারণ করিয়ে বলিত,’খুলো না খুলো না’। যে স্থান হইতে এই খুলো না শব্দ হইত বা কোনো একবার হইয়াছিল তাহারই নাম হইয়া গেল খুলনা। হয়তো খুলনা শব্দের অক্ষর বিন্যাস হইতে কল্পনা-কৌশলেই এইরূপ ব্যুৎপত্তি বাহির হইয়াছে।”

কিন্তু এইসব কিংবদন্তি বা জনশ্রুতির কোনো বিশ্বাসযোগ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। কোনো প্রামাণ্য দলিলও আজ অবধি উদ্ধার করা যায় নি। তাই খুলনা নাম নিয়ে আমরা এর বেশি কোনো প্রামাণ্য তথ্যাদি উপস্থাপন করতে পারলাম না।

সীমানা, ভূপ্রকৃতি ও ভৌগলিক বিবরণ

খুলনার উত্তরে যশোর জেলা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে ফরিদপুর (অধুনা গোপালগঞ্জ) এবং বরিশাল জেলা (অধুনা পিরোজপুর), আর পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সীমান্ত। খুলনায় সমতল ভূমি ক্রমান্বয়ে দক্ষিণদিকে ঢালু। এখানকার সকল নদীগুলি উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত। উত্তরের হিমালয় থেকে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণে সাগরে গিয়ে পড়েছে এর সকল নদীগুলিই। আর খুলনায় প্রায় সবকটি নদীর মূল স্রোতধারা গঙ্গা থেকে এসেছে। ভূমি নির্মাণ করাই গঙ্গা ও তার শাখা নদীগুলির মুখ্য কর্ম। কোনো কোনো সময় স্থান বিশেষে একাধিক নদী কোনো স্থানে ভূমি নির্মাণে ভূমিকা রেখেছে। একস্থানের ভূমি গঠন সম্পূর্ণ হলে দেখা গেছে ওখান থেকে সেই নদী মজে গেছে বা গতিপথ পরিবর্তন করেছে অন্যদিকে, অন্যত্র। ভূতাত্ত্বিকরা মনে করেন খুলনার ভূমিগঠন আজও সম্পূর্ণ হয় নি। অথচ ইচ্ছাকৃতভাবে এখানকার অধিবাসীরা নদী এবং তার শাখা নদীর গতি বিঘ্নিত করছে। নদী শাসনের নামে নদীর গতিপথ রুদ্ধ করছে। কালভার্ট, ব্রিজ প্রভৃতি নির্মাণ করে নদীর স্রোত বিঘ্নিত করছে যা এই জনপদের গুরুতর বিপর্যয় ডেকে আনবে ভবিষ্যতে। খুলনার প্রধান তিনটি নদী- ভৈরব, মধুমতি ও কপোতাক্ষ। এর শাখা প্রশাখা নিয়ে অনেক নদী খুলনাকে জালের মতো ছেয়ে রেখেছে। বিশেষ করে সুন্দরবনের ভিতরে প্রবাহিত হয়েছে অসংখ্য নদী ও খাল।

ক্রমান্বয়ে দক্ষিণের ঢালু হওয়ার দরুণ দক্ষিণ খুলনার অনেকগুলি থানায় বছরে বেশ কয়েকমাস জলমগ্ন থাকতো। এখন তার অবসান হয়েছে ভেড়িবাঁধ দেয়ার ফলে। তবে তাতে নতুন উপসর্গ তৈরি হয়েছে। প্রাকৃতিক জোয়ার ভাটার ফলে ভূগঠনের প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়েছে এবং সমুদ্রের নোনা জলের আধিক্য দেখা দিয়েছে। তদুপরি উজানে ভারত গঙ্গায় বাঁধ দেয়াতে মিষ্টি জলের প্রবাহ না থাকায় লবণ জল উপরের দিকে উঠে আসছে। ফলে খুলনা জেলায় প্রায় সবকটি থানায় (উপজেলায়) লবণ জলের প্রাবল্য হয়েছে। এর পরিণতিতে আবহমানকালের উৎপাদিত ফসলাদি এখন আর তেমন ফলছে না আগের মতো। খুলনার প্রধান ফসল ধান বিলুপ্তপ্রায়। রোয়া ধান হচ্ছে কিন্তু পাট তিল প্রায় নাই বললেই চলে। রবি শস্যের উৎপাদনও তথৈবচ। খুলনার ঐতিহ্য নারিকেল, সুপারির ফলন কমে গেছে আনুমানিক ৬০%। সমগ্র বাংলাদেশের উৎপাদিত নারিকেল তেলের ৮০ শতাংশের বেশি বাগেরহাট শহর এবং বিসিক শিল্পনগরীতে উৎপাদিত হয় । এইসব তেলের মিলগুলিতে নারিকেল সংকট দেখা দিয়েছে। খুলনার বড় প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নদীর মরে যাওয়ার দরুণ, মিষ্টি জলের প্রবাহ বন্ধ হওয়ার দরুণ। এ প্রসঙ্গে এই অধ্যায়ের শেষাংশে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হবে।

খুলনা যশোরের মহকুমা থেকে ১৮৮২ সালে জেলায় রূপান্তরিত হয় তিনটি মহকুমা নিয়ে। যশোর জেলায় খুলনা ও বাগেরহাট এবং ২৪ পরগনা জেলার সাতক্ষীরা নিয়ে গঠিত হয় এই নবগঠিত খুলনা জেলা। তাই এর শুরুতে এই তিনটি মহকুমা এবং ২১টি থানা ছিল এই জেলায়। ওইকালে খুলনা সদর মহকুমায় ৮টি থানা ছিল। সাতক্ষীরা মহকুমায় ছিল ৬টি এবং বাগেরহাটে থানার সংখ্যা ছিল ৭টি। বাংলাদেশ আমলে প্রথমে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব উদ্যোগ নিলেও পরে প্রেসিডেন্ট এরশাদ ক্ষমতায় এসে সকল মহকুমাকে জেলায় রূপান্তরিত করেন, থানাগুলি উপজেলা নাম ধারণ করে, জেলা শহর থেকে দূরবর্তী থানাগুলি জেলা শহরের সাথে সংযুক্ত হয়। চলাচলের জন্য রাস্তা নির্মাণ হয়। উপজেলা কমপ্লেক্স তৈরি হয়, সেখানে একজন উপজেলা প্রশাসক (ইউএনও) নিযুক্ত হয়। তাছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মৎস্য, কৃষি, নির্মাণ-প্রকৌশল, ভূমি, নির্বাচন বিষয়ক দপ্তর খোলা হয় এবং সকল দপ্তরে একজন কর্মকর্তা নিযুক্ত হয়। খুলনা জেলাতেও এই পরিবর্তনগুলো দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়। 

মৌসুমী বায়ুর দেশ বাংলাদেশ। তাই এর প্রবল প্রভাব খুলনায় সর্বত্র। তবে বিশ্বব্যাপী প্রতিবেশ-পরিবেশ গুরুতর বিপর্যয়ের ফলে বাংলাদেশের আবহাওয়া-জলবায়ুরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিছুটা চরমভাবাপন্নতার লক্ষণ দৃষ্ট হচ্ছে এ অঞ্চলে। খুলনাঞ্চলে বেশ কিছুটা প্রভাব পড়েছে তার। ফলে অতিবর্ষণ, অসময়ে বর্ষণ, খরা, শৈত্যপ্রবাহ প্রভৃতি জনজীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকা তথা সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার জেলা-উপজেলা-গ্রাম-জনপদগুলি যথেষ্ট ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ইন্টারগভর্ণমেন্টাল পানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা গত ১০০ বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে ০.৩ থেকে ০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং আগামী ১০০ বছরে তা বেড়ে ১.৪ থেকে ৫.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে দাঁড়াবে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, সমুদ্রের জলরাশি ১ মিটার উচ্চতা বাড়লে পৃথিবীর বহু উপকূল ভাগ জলমগ্ন হবে। বাংলাদেশের ১৭.৫ শতাংশ ভূখণ্ড অর্থাৎ ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা জলের তলে তলিয়ে যাবে। খুলনার প্রাকৃতিক প্রসঙ্গ বা ভৌগোলিক বিবরণ দিতে গেলে সুন্দরবনের প্রসঙ্গ না বললেই চলে না। নানা দিক থেকে এর গুরুত্ব অসীম। খুলনার ক্ষেত্রে তো বটেই সমগ্র বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সুন্দরবন অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই এখানে বর্তমান খুলনার লোক সংখ্যার বিবরণ দেয়ার পর সুন্দরবন সম্পর্কে আমরা আলোচনা তুলব।

বর্তমানে খুলনা জেলার জনসংখ্যা হল ২৩,৭৮,৯৭১; এর মধ্যে পুরুষ হল ১২,৪৪,২২৬ জন, নারীর সংখ্যা ১১,৩৪,৭৪৫ জন। ধর্মীয় সম্প্রদায়গত বিবেচনায় মুসলিম জনগোষ্ঠী হলো ১৮,২১,১১৯ আর হিন্দু জনসংখ্যা হল ৫,৪০,৬৯৩ জন, এছাড়া খ্রিস্টান রয়েছে ১৫,৮১৮ জন এবং বৌদ্ধ ২৮৯ আর অন্যান্য হল ১০৫২ জন। বাগেরহাটে লোকসংখ্যা ১৫,৪৯,০৩১ জন। পুরুষ ৮,০৪,১৪৩ জন, নারী ৭,৪৪,৮৮৮ জন। এর ভেতর মুসলিম ১২,৩৭,৮৬২ জন হিন্দু ৩,০৪,৪২৭ জন। সাতক্ষীরার জনসংখ্যা মোট ১৮,৬৪,৭০৪ জন। পুরুষ ৯,৫৫,১৯৮ জন; নারী ৯,০৯,৫০৬ জন, মুসলিম ১৪,৯৫,২১৯ জন, হিন্দু ৩,৬০,৭২৩ হিন্দু ৩,৬০,৭২৩ জন। বর্তমানে খুলনা জেলার উপজেলা ৬টি, বাগেরহাটের উপজেলা মোট ৯টি এবং সাতক্ষীরায় আছে ৭টি আর থানা ১টি খুলনা মেট্রোপলিটন সিটি হওয়ার জন্য এর ভিতরে ৭টি থানা রয়েছে।

খুলনা জেলার (বৃহত্তর) ভূপ্রকৃতির নানাবিধ বৈচিত্র্যের মধ্যে সুন্দরবন এক বিশেষ বৈচিত্র্য নিয়ে অবস্থান করছে। প্রাণ-প্রকৃতি, জীব-বৈচিত্র্যে ভরা এই অঞ্চল বিশ্বের এক মহাবিস্ময়। ম্যানগ্রোভ বন পৃথিবীতে এতো বড় আর নাই। আর সুন্দরবনের অবদান খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরার ক্ষেত্রেই নয়, সমগ্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অতুলনীয়। এতো বৈচিত্র্য এর বৈশিষ্ট্য, এত বৈচিত্র্য এর অবদান আর এত বিচিত্র ভূমিকা যা স্বতন্ত্রভাবে আলোচনার দাবি রাখে। এই বনাঞ্চল খুলনার মানুষের জীবনকে শুধু প্রভাবিতই করে নি জীবন সংগ্রামে সহায়তা করেছে নানাভাবে। ৭১ এর যুদ্ধকালে শ্রেণিযোদ্ধারা এখানে আত্মগোপনে আশ্রয় নিয়েছেন। এখন আমরা আলাদাভাবে সুন্দরবনকে নিয়ে আলোচনা করছি।

সুন্দরবন

প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের অপূর্ব সমাহার রয়েছে সুন্দরবনে। পৃথিবীর সব থেকে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। ম্যানগ্রোভ হলো, দিনে চারবার জোয়ার-ভাটায় সমুদ্রের লবণ জলে ভরে যায়। এ জলের ভেতরেই বন জন্ম নেয়, বৃদ্ধি পায় এবং টিকে থাকে, এই হলো ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। পশ্চিম বাংলার কিছু অংশ সুন্দরবনের। তবে বড় অংশটি হলো বৃহত্তর খুলনা জেলার দক্ষিণভাগ নিয়ে। সুন্দরবনের মোট আয়তন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। ৬ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি রয়েছে বাংলাদেশে এবং তা প্রধানত খুলনায়। সুন্দরবন সংলগ্ন অঞ্চলের মোট ১০ লাখ মানুষ এই সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। এরসাথে পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ২৫ লক্ষ লোক। পৃথিবীতে কোনো শিল্প কারখানা নেই যেখানে এত বেশি মানুষকে কর্মসংস্থান দিতে পারে।

বাংলাদেশের অরক্ষিত এই সুন্দরবনের দুটি ডিভিশন আছে। ১, সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগ; ২, সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগ। এর প্রত্যেকটি বিভাগের দুটি করে মোট চারটি রেঞ্জ আছে। এগুলি হলো খুলনা রেঞ্জ, সাতক্ষীরা রেঞ্জ, শরণখোলা রেঞ্জ এবং চাঁদপাই রেঞ্জ। প্রতিটি রেঞ্জে আছে কয়েকটি করে স্টেশন এবং প্রতিটি স্টেশনে আছে একাধিক ক্যাম্প। এখানে বিশেষভাবে স্মর্তব্য যে সেই ব্রিটিশ শাসনামল থেকে আজ অব্দি শাসক শ্রেণি তাদের শ্রেণি ও ব্যক্তিস্বার্থে সর্বোপরি মুনাফা এবং রেভিনিউ আয়ের একটি ক্ষেত্র হিসেবে সুন্দরবনকে দেখে এসেছে। কিন্তু সুন্দরবন যে পুরো বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গের একাংশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা কবচ তা বোঝেন না বা বুঝতে চান না। তাই তারা নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করে বন্যপ্রাণী হত্যা করেন, বনাঞ্চলের অভ্যন্তরে স্থাপনা স্থাপন করেন এবং ইকোসিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত করেন। পরিবেশবিদরা বলেন যে, গত ২০০ বছরে বাংলাদেশের ভূখন্ডের উপকূলীয় অঞ্চলে মোট ৭০টি বড়ো দুর্যোগ ঘটেছে। তার মধ্যে ১৫০ বছরে ১৯টি এবং বিগত ৫০ বছরে ৫০টিরও বেশি দুর্যোগ হানা দিয়েছে এখানে। এতে যে ভয়ংকর ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল তা বহুলাংশে এই সুন্দরবন প্রতিহত করেছে। সাম্প্রতিক ১৫ বছর অত্যন্ত বড় ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলা করেছে এখানকার মানুষ। সিডর, আইলা, আমফান প্রভৃতি তার এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।      

গত ২০০ বছরে বাংলাদেশের ভূখন্ডের উপকূলীয় অঞ্চলে মোট ৭০টি বড়ো দুর্যোগ ঘটেছে। তার মধ্যে ১৫০ বছরে ১৯টি এবং বিগত ৫০ বছরে ৫০টিরও বেশি দুর্যোগ হানা দিয়েছে এখানে। এতে যে ভয়ংকর ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল তা বহুলাংশে এই সুন্দরবন প্রতিহত করেছে। সাম্প্রতিক ১৫ বছর অত্যন্ত বড় ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলা করেছে এখানকার মানুষ। সিডর, আইলা, আমফান প্রভৃতি তার এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

সর্বোপরি এখানকার ১০ লক্ষ লোক সরাসরি এবং ২৫ লক্ষ লোক পরোক্ষভাবে উপকৃত এই সুন্দরবন থেকে। এবং এখানকার বাওয়ালী, মৌআলী, মাঝি, জেলে, চুমারী, মুন্ডা, মাহাতো প্রমুখরা বন থেকে গোলপাতা, কাঠ, মধু, মোম, মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া প্রভৃতি আহরণ করে জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য বজায় রাখে একদিকে আর অন্যদিকে তারা যথেষ্ট পরিমাণে রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা দেয়। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, রক্ষক ভক্ষক হয়ে যে পরিমাণে সম্পদ এবং রাজস্ব আত্মসাৎ করে তার একশতাংশও এইসব গ্রামীণ সাধারন জনগণ পায় না। অথচ বন রক্ষার ক্ষেত্রে তাদেরকে অবাঞ্ছিত এবং বহিরাগত বলে মনে করা হয়। এছাড়া বনাঞ্চলে পেশিশক্তির দাপট, অবৈধ দখল, জলদস্যুতা, বিধিবহির্ভূত বৃক্ষনিধন, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসসাধন, বনসম্পদ চুরি, দুর্নীতি প্রভৃতির সাথে শাসকশ্রেণি, দল ও সম্প্রদায় সর্বদাই সম্পর্কিত।

সুন্দরবনকে রক্ষা করার জন্য মানুষ-এর কোনো প্রয়োজন নেই। সুন্দরবন নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারে। মানুষ যদি তাকে ধ্বংস সাধন থেকে বিরত থাকে তাতেই যথেষ্ট। যদি যথার্থভাবে সুন্দরবনকে রক্ষা করা না যায় তবে অদূর ভবিষ্যতে এই দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার বিস্তীর্ণাঞ্চল সাগরের জলের তলায় ডুবে যাবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

খুলনা জেলার ভূপ্রকৃতি, জনসাধারণ, প্রকৃতি-প্রতিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের আলোচনা সম্পূর্ণ করা যায় না সুন্দরবন সম্পর্কিত আলোচনা ছাড়া। খুলনা জেলার ভূভাগ এবং জনসাধারণ, এর প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য যথাযথভাবে রক্ষা করতে গেলে সুন্দরবন সম্পর্কিত আলোচনা, গবেষণা আরও বাড়াতে হবে। এই ভুখন্ডের রক্ষাকবচ হিসেবে সুন্দরবনকে দেখতে হবে। তাকে রক্ষা করতে হবে, তার বিকাশ ঘটাতে হবে। অবশ্য সুন্দরবনকে রক্ষা করার জন্য মানুষ-এর কোনো প্রয়োজন নেই। সুন্দরবন নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারে। মানুষ যদি তাকে ধ্বংস সাধন থেকে বিরত থাকে তাতেই যথেষ্ট। যদি যথার্থভাবে সুন্দরবনকে রক্ষা করা না যায় তবে অদূর ভবিষ্যতে এই দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার বিস্তীর্ণাঞ্চল সাগরের জলের তলায় ডুবে যাবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। (চলবে)

রণজিৎ চট্টোপাধ্যায়: লেখক, রাজনৈতিক নেতা। বাগেরহাট।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •