সম্পাদকীয় ভূমিকা

সম্পাদকীয় ভূমিকা

সর্বজনকথা গত সংখ্যা (মে-জুলাই, ২০২২) প্রকাশের সময় শ্রীলঙ্কায় অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সংকট চলছিল, সেখানে জনগণের বিক্ষোভও ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছিল। এই সংকটের কারণ নিয়ে আমরা বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছিলাম গত সংখ্যায়। গত তিন মাসে সেখানে জনগণের বিক্ষোভ আরও শক্তিশালী হয়েছে। আমরা বর্তমান সংখ্যা যখন প্রকাশ করতে যাচ্ছি ততদিনে শ্রীলঙ্কার জনগণ সরকারের পতন ঘটিয়েছে, দুর্নীতি আর স্বৈরতন্ত্রের দায়ে অভিযুক্ত প্রেসিডেন্টকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেশের দখল নিয়েছে। আমরা শ্রীলঙ্কার সংগ্রামী মানুষদের অভিনন্দন জানাই। লুটেরা, স্বৈরতন্ত্রী শাসক শোষকদের বিরুদ্ধে জনগণের লড়াইএ এই অধ্যায় অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

গত সংখ্যা প্রকাশের সময়ই ইউক্রেনে রুশ সামরিক আগ্রাসন এবং তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনৈতিক অবরোধ এবং সামরিক ব্যবস্থা চলছিল। এরফলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানিসহ বিভিন্ন পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়, বহু আমদানিনির্ভর দেশে তেল, গ্যাস, গম, ভোজ্যতেলসহ নানা সামগ্রীর অভাব দেখা দেয়। এর কারণে এবং এর সুযোগ নেবার মধ্য দিয়ে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়, মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে থাকে, একইসঙ্গে মন্দারও পরিস্থিতি দেখা দেয়। এই বিষয় নিয়েও গত সংখ্যায় দুটো লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে সৃষ্ট সেই অস্থিরতা গত কয় মাসে আরও বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্ব জোট ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন বন্ধের চাইতে এটাকে আরও বৃহত্তর রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার একটা অজুহাত হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা চালাচ্ছে বলেই মনে হয়, সেকারণে তারা এই সংকট নিরসনের  জন্য কোনো আলোচনা বা সমঝোতার চাইতে অবরোধ, যুদ্ধ হুমকি ও ন্যাটোসহ সামরিক ব্যবস্থা সম্প্রসারণের পক্ষেই কাজ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে গত কয় মাসে পদ্মা সেতু নিয়ে বিজ্ঞাপনী উচ্ছ্বাসে অনেক খবর ঢেকে দেবার চেষ্টা থাকলেও সাম্প্রদায়িক হামলা, শিক্ষকসহ বিভিন্ন অংশের মানুষের ওপর সরকারি দলের লোকজনদের নিপীড়ন, যৌন সন্ত্রাস, দুর্নীতি, অর্থ পাচারের সাথে সাথে দ্রব্যমূল্যও অনেক বেড়েছে। সীতাকুন্ডসহ একাধিক স্থানে ভবনে, কারখানায় মালিকদের দোষে বহু মানুষ খুন হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। অন্যদিকে তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম আগেই বেড়েছে, আরও বাড়ানোর প্রস্তুতি চলছে। এখন যোগ হয়েছে বিদ্যুতের বড় সংকট। সরকার এর জন্য ইউক্রেন যুদ্ধকে কারণ হিসেবে উপস্থিত করলেও বর্তমান বিদ্যুৎ সংকট, বিদ্যুৎ খাতে ক্রমবর্ধমান হারে ভর্তুকি, বিদ্যুতের নামে সুন্দরবনসহ প্রাণপ্রকৃতি দেশের জন্য বিপজ্জনক প্রকল্প গ্রহণ এইসব কিছুই এই খাত নিয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনা এবং স্বৈরতন্ত্রী ক্ষমতা চর্চার ফলাফল।          

এদিকে সরকার ‘জ্বালানি সনদ চুক্তি’ স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিচ্ছে, এতে দেশের জ্বালানি খাতে কোম্পানি আধিপত্য আরো বাড়বে, উন্নয়নের নামে বর্তমান প্রাণপ্রকৃতিবিনাশী তৎপরতা আরও শক্তিশালী হবে। কেন এই চুক্তির বিভিন্ন ধারা জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জনস্বার্থ বিপন্ন করবে এই সংখ্যায় তার ব্যাখ্যা উপস্থিত করা হয়েছে।

বর্তমান উন্নয়ন ধারার অন্যতম আরেকটি দিক হলো চোখ ঝলসানো সুবৃহৎ বা মেগা প্রকল্প। এসব প্রকল্প যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুরু হয় তা পূরণ হবার বদলে জনগণের জন্য যে বিপদের কারণ হয় তারও বহু প্রমাণ আছে। এই সংখ্যায় এসব বিষয়ের ব্যাখ্যাসহ মেগা প্রকল্পের সহযোগী বিভিন্ন গোষ্ঠীর পরিচয়, তাদের ভূমিকা এবং তার লাভক্ষতির ধরন পরীক্ষা করা হয়েছে। সিলেট, সুনামগঞ্জে বড় বন্যা হলো এবছর, এরকম বন্যাসহ নদী ভাঙন, জলাবদ্ধতা, পানির স্তর নেমে যাওয়ায় বছর বছর মানুষের ভোগান্তির পেছনেও এরকম অনেক প্রকল্পের ভূমিকা আছে।  ‘পানির দেশে পানি কোথায় গেল? কীভাবে গেল?’ এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করা হয়েছে একটি লেখায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানের ভিত্তিতে।   

এর মধ্যে গত ৯ই জুন সরকারের পক্ষ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। এই সংখ্যায় বাজেট কেন্দ্র করে সামগ্রিক উন্নয়ন পথ নিয়ে একটি সর্বজন বক্তৃতার সংক্ষিপ্ত অনুলিখন উপস্থিত করা হচ্ছে। এছাড়া বর্তমান সময়ে দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধিতে শ্রমিকের জীবন ও মজুরি প্রশ্ন কী দাঁড়াচ্ছে তা নিয়ে একটি অনুসন্ধানী লেখাও গেল এই সঙ্গে।  

জার্মানীসহ ইউরোপের বিপ্লবী সংগ্রামের সংগঠক এবং বিশ্ব বিপ্লবের তাত্ত্বিক হিসেবে রোজা লুক্সেমবার্গ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হলেও বাংলাদেশে তাঁকে নিয়ে আলোচনা খুবই কম। এই সংখ্যায় রোজার জীবন পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে, আগামী সংখ্যায় তার গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করা হবে। একইসঙ্গে রোকেয়ার রচনায় বিজ্ঞান ও মুক্তির চেতনা নিয়ে একটি লেখা প্রকাশ করা হলো। মানুষ মানেই শুধু নারী বা শুধু পুরুষ নয়, সেরকম একজন মানুষের আত্মানুসন্ধানের ভাব ও ভাষা নিয়ে রচনা প্রকাশিত হলো এই সংখ্যায়। 

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শক্তিশালী ঐতিহ্য আছে। অগণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের আধিপত্যের কালে নিজেদের শক্তির জায়গাগুলো পুনপাঠ প্রয়োজন। এই সংখ্যায় শুরু ধারাবাহিক লেখায় খুলনা অঞ্চলের বিশেষ অবস্থান, কৃষক বিদ্রোহ ও সশস্ত্র সংগ্রামের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে। প্রথম পর্বে এই অঞ্চলের পরিচিতি দেয়া হয়েছে।

‘ইন্টারনেট যুগে কর্তৃত্ববাদ’ অনুবাদ প্রবন্ধটির প্রথম পর্ব এই সংখ্যায় প্রকাশিত হলো। ধারাবাহিক লেখা “সিপি গ্যাং-এর ‘বেশ্যা’ ব্যানার-১১” এবং “২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-৫” প্রকাশিত হলো। এছাড়া অনলাইন সংখ্যায় থাকছে গত কয়েকমাসে উল্লেখযোগ্য খবর।

আনু মুহাম্মদ

২০ জুলাই ২০২২

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •