নৈতিক স্মৃতিচারণ হিসেবে ইতিহাস। সিপি গ্যাং-এর ‘বেশ্যা’ ব্যানার-১১
প্রতিরোধের পিতৃতান্ত্রিক ভাষা
রেহনুমা আহমেদ
ধর্ষণ বা যৌন সন্ত্রাস শাসক নির্যাতক ক্ষমতাবান আর তাদের নানারূপের প্রতিনিধিদের একটি ভয়ংকর অস্ত্র। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমরা এর ভয়াবহ রূপ দেখেছি, স্বাধীনতার পরও প্রতিষ্ঠানে, পথে ঘাটে, বাড়িতে ধর্ষণ আক্রমণ নিয়মিত ঘটনা হিসেবে অব্যাহত আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা ধর্ষিত হয়েছিলেন, পরেও যারা হয়ে যাচ্ছেন তাদের ওপর জুলুম এখানেই শেষ হয় না। তাদের ওপর সমাজের নানাবিধ আক্রমণ অব্যাহত থাকে, ‘চরিত্রহনন’, কুৎসা, অপপ্রচার চলতে থাকে। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের একটি ঐতিহাসিক অধ্যায় তৈরি হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে। এই আন্দোলন অনেক মতাদর্শিক সামাজিক পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাকে আঘাত করলেও আবার অনেক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পারেনি। এই পর্বে অভিজ্ঞতা স্মরণের পাশাপাশি অব্যাহত লড়াইএর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
প্রতিরোধের কাহিনী, জাহাঙ্গীরনগর ১৯৯৮: “আমরা সবাই ধর্ষিতা”
১৭ই আগস্ট ১৯৯৮ সালের ট্যাবলয়েড পত্রিকা মানবজমিন এর শিরোনাম ছিল, “[জাহাঙ্গীরনগরের] ৩ ছাত্রী ধর্ষণের শিকার।”১ ক্যাম্পাসে পিনপতন নিরবতা।
জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে ধর্ষণের খবর ১৮ই আগস্ট দৈনিক দিনকাল এও প্রকাশিত হয়। মানবজমিন এর নিউজ ক্লিপিংটি ৪ ছাত্রী হলের প্রতিটি দেয়ালে সাঁটা হয়, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানেও। রাতে ছাত্র ফ্রন্ট ও ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যরা পোস্টার লাগান, ধর্ষণকারীদের চিহ্নিত করতে হবে, তাদের শাস্তি দিতে হবে।
১৯শে আগস্ট সকালবেলা ৪০-৫০ জন শিক্ষার্থীর একটি মিছিল বের করে ছাত্র ফ্রন্ট; দুপুরে গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের মিছিল থেকে দাবি ওঠে ধর্ষকদের শাস্তি দিতে হবে।
সেদিন সন্ধ্যায় প্রীতিলতা হলের ছাত্রীরা ক্যাম্পাসে ধর্ষণের বিরুদ্ধে কী কী উপায়ে প্রতিবাদ করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করেন, রাত ১১:৩০টায় হলের মাঠে একটি সভার আয়োজন করা হয়, হলের প্রায় সব ছাত্রীর উপস্থিতিতে পরের দিন মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
২০শে আগস্ট প্রীতিলতা হলের ছাত্রীরা মিছিল বের করে, মিছিলে যোগ দেন অন্য ৩ হলের ছাত্রীরা – জাহানারা ইমাম, নওয়াব ফয়জুন্নেসা, ফজিলাতুনেনসা। মিছিলটির যাত্রাপথ ছিল ক্যাফেটেরিয়া বিল্ডিং থেকে সায়েন্স ফ্যাকাল্টি বিল্ডিং পর্যন্ত।
মিছিলটি যখন আর্টস ফ্যাকাল্টি বিল্ডিং থেকে রেজিস্ট্রার বিল্ডিংএ যাচ্ছিল তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কিছু সংখ্যক ছাত্র (আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায়), জাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জসিমউদ্দিন মানিকের নেতৃত্বে (পরে “সেঞ্চুরিয়ান” ধর্ষক বলে চিহ্নিত), মিছিলে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের অংশে ঢুকে পড়ে, ধর্ষণকারীদের শাস্তির দাবির স্লোগানে তারাও আওয়াজ মেলায়। ছাত্রলীগের ছাত্ররা যখন মিছিলের অগ্রভাগে যাওয়ার চেষ্টা করে তখন মিছিলের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করার স্বার্থে ছাত্রীরা সব ছাত্রদের মিছিল থেকে বেরিয়ে আসতে বলেন।
উপাচার্য ভবনের সামনে শুধু ছাত্রীদের জন্য একটি সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ততক্ষণে শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে পড়ে, প্রায় ৮০০ জন ছাত্রীর সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, এতে ১৫০ জন ছাত্রও যোগ দেন।স্লোগানে মুখরিত পরিবেশ, “হল থেকে, দল থেকে, মিছিল থেকে ধর্ষণকারীদের বহিষ্কার কর।” নারী শিক্ষার্থীরা উপাচার্যকে (রাজনৈতিক নিয়োগ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সব ভিসি নিয়োগের মতো) স্মারকলিপি পেশ করেন।
ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ছাত্রী প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলতে চান কিন্তু ছাত্রীরা রাজি হননি। আমাদের সবার সাথে কথা বলুন, আমরা একসাথে। ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য বলেন, কিন্তু আমরা তো ধর্ষণের কোনো অভিযোগের কথা শুনিনি। কাকে ধর্ষণ করা হয়েছে? যদি ধর্ষিতা এগিয়ে না আসে তাহলে আমরা বিচার করব কেমনে? আমাদের তো ক্লু পেতে হবে।
অভিযুক্ত ধর্ষকরা চারপাশে ঘোরাঘুরি করছিল, এই পরিস্থিতিতে ধর্ষিতার এগিয়ে আসাটা আত্মঘাতী হতো। আকসি¥কভাবে আট’শ জন ছাত্রী একসাথে বলে ওঠেন, “স্যার আমরা সবাই ধর্ষিতা। আমদের সবাই ধর্ষণের শিকার, আমরা বিচার চাই।” কোলাহলের উর্ধ্বে একটি সাহসী কণ্ঠ বেজে ওঠে, ধর্ষকের আত্মীয় প্রক্টর আপিসে কাজ করেন, এই আপনার ক্লু (শিক্ষার্থীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পরে প্রক্টর আফসার আহমেদ পদত্যাগ করেন; তিনি “সেঞ্চুরিয়ান জসিমউদ্দিন মানিকের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন)।
[ধর্ষণবিরোধী ছাত্রী আন্দোলন, ১৯৯৯ এর “ঘটনাক্রম”২ এবং আমার স্মৃতির সাহায্যে লেখা]
বীরাঙ্গনা: “সহস্র পুরুষকে দেহদান”
নীলিমা ইব্রাহিমের আমি বীরাঙ্গনা বলছি-তে শেফার কাহিনী শুরু হয় তিরষ্কার দিয়ে। আপনি যদি বাঙালি মুসলমান ঘরের পুরুষ হন, আর আপনার বয়স যদি পঞ্চাশ পার হয়ে থাকে তাহলে মনোবলে আপনি আমার চেয়ে নিকৃষ্ট। আমি আপনাদের ঘৃণা করি, করবার অধিকার রাখি। সেদিন আপনারা মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন!৩
শেফা একাত্তরে কলেজের ছাত্রী ছিল। প্রতারণা করে প্রতিবেশীর ছেলে তাকে জোর করে সেনানিবাসে নিযে যায়। পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তার কাছে তাকে “উপহার” দেয়। কতক দিন কি সপ্তাহ ধরে “প্রতিদিন নতুন নতুন অতিথির মনোরঞ্জন” করার পর শেফাকে “এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়” নিয়ে যাওয়া হয়।৪ কখনো এক দল মেয়ের সঙ্গে রাখা হয়, আর কখনো একা কক্ষে, নিঃসঙ্গ। বহু সপ্তাহ কি মাস’পর হঠাৎ পাঁচ-ছয়জন মেয়ের সঙ্গে ট্রাকে তোলা হয়, ট্রাকে পর্দা বাঁধা ছিল কিন্তু শীতে ওরা কাঁপছিল। অবশেষে ট্রাক থামে, নামার হুকুম দেওয়া হয়। একটি বাঙ্কার, সুড়ঙ্গের শেষে ম্যাট্রেস, দু’একটা খাটিয়া, পানির কলসী, গেলাস। “এরপর সময়টা শেফা স্মরণ করতে পারে না। বোধ হয় চায়ও না। সে কি যন্ত্রণা। কোনও দিন খাবার আসতো, কোনো দিন না। অনেক সময় পানিও থাকতো না। হঠাৎ করে একদিন এসে সবার জামা কাপড়, যদিও সেগুলো শতচ্ছিন্ন এবং ময়লায় গায়ের সঙ্গে এঁটে গিয়েছিলো তা টেনে হেঁচড়ে খুলে নিয়ে গেল। সম্পূর্ণ নগ্ন আমরা।”৫
স্বাধীনতার সাথে এলো অ্যাবরশন, ধরা পড়ল যৌনরোগ, প্রয়োজন পড়ল ঢাকার ধানমন্ডিস্থ নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে দীর্ঘ অবস্থান। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের পর শেফার বাবা-মা তাকে বাড়ি নিয়ে আসেন কিন্তু কুৎসা রটনার কারণে শেফা কেন্দ্রে ফিরে যেতে বাধ্য হন। স্টেনোটাইপিস্টের চাকরি গ্রহণ করেন। হবু স্বামীর সাথে পরিচয় ঘটে। তার বাবা-মা অবস্থাপন্ন, এক সন্ধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অভিজ্ঞতার কথা শেফা তাকে বলেন, তিনি তোয়াক্কা করেননি, বিযের প্রস্তাব দিলেন। তাদের বিয়ে হয়।
শেফার শ্বশুর, শাশুড়ি সব জানতেন, তারা খুব ভালোভাবেই নিয়েছিলেন। তার স্বামীও। তাই ভেবেছিল শেফা। কিন্তু একদিন যখন একটি বিষয় নিয়ে তর্ক বেধে যায়, শেফার স্বামী কর্কশ স্বরে বলে বসে, ওহ, “সহ¯্র পুরুষকে দেহ দান করে”৬ তুমি আমাকে সংযম শেখাতে চাচ্ছ।
শেফা বলেন, আজও আমার স্বামী থেকে শুরু করে অনেকেই আমাকে বাঁকা চোখে দেখেন।
“সহস্র পুরুষ …।” বেশ্যা।
“আমরা সবাই বেশ্যা”? যে প্রতিরোধ কল্পনাতীত
উপাচার্য, প্রক্টর, হল প্রভোস্ট, প্রফেসরের মতো শক্তিশালী পুরুষরা যারা রাষ্ট্রক্ষমতার তল্পিবাহী তাদের সামনে শত শত তরুণী কণ্ঠের উচ্চারণ, “আমরা সবাই ধর্ষিতা।” নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক।
কিন্তু বহু নারী একইসাথে চিৎকার করে বলছেন, “আমরা সবাই বেশ্যা” – এ কি আমরা কল্পনা করতে পারি? প্রতিরোধ হিসেবে। সংহতিপ্রকাশ করার জন্য (একটিস্থানীয় স্লাটওয়াক?)।
নিচের দুটো স্লোগান দেখুন, বহু দশক ধরে এ স্লোগানগুলো ক্যাম্পাসে, রাজপথে জনপ্রিয়। স্বাধীনতার আগে ও স্বাধীনতার পরে। এখনও।
স্লোগান ১
আমাদের ধমনীতে শহীদের রক্ত
এই রক্ত কোনো দিনও
পরাজয় মানে না
মাথা নত করে না
এই রক্ত কোনো দিনও
পরাভব মানে না
বেঈমানি করে না
স্লোগান ২৭
যুগে যুগে জিতল কারা
কৃষক-শ্রমিক-সর্বহারা
সর্বহারার মতবাদ
মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ
৫২-তে জিতেছে কারা?
কৃষক-শ্রমিক-সর্বহারা
৬৯-এ জিতেছে কারা?
কৃষক-শ্রমিক-সর্বহারা ৭১-এ জিতেছে কারা?
কৃষক-শ্রমিক-সর্বহারা
আমরা বেশ ক’জনা (প্রধানত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী)৮ বেশ ক’বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে স্লোগানগুলোতে “বীরাঙ্গনা” শব্দটি যোগ করার চেষ্টা করেছি,
স্লোগান ১-এ
আমাদের ধমনীতে বীরাঙ্গনার রক্ত
স্লোগান ২-এ
৭১-এ জিতেছে কারা?
কৃষক-শ্রমিক-বীরাঙ্গনা-সর্বহারা
কিন্তু কখনোই পারিনি। শাহবাগ এ বার কয়েক চেষ্টা করেছিলাম, তখন গণজাগরণ আন্দোলন সবচাইতে শক্তিশালী ছিল কিন্তু স্লোগানটি আমাদের ক’জনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। ছড়িয়ে পড়েনি।
কেন? অভ্যস্ততা একটা কারণ হতে পারে, আর সে কারণেই হয়ত আমরা সোৎসাহে একই পিতৃতান্ত্রিক স্লোগান বছরের পর বছর, দশকের পর দশক চিল্লাতে থাকি। (“আমাদের ধমনীতে প্রীতিলতার রক্ত” – এটি নিয়েও বেশি দূর এগুতে পারিনি)
কিন্তু এমনকি হতে পারে যে এর সাথে মিশে আছে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের “সাচ্চা মুসলমান”তৈরি করার প্রকল্প (বীণা দাসের ভাষায় “সুপ্রজনন ঘটানোর গন্ধ”)? এই স্লোগান তুলললে কি আমরা সেই নারীদের পুত্র-কন্যা হয়ে যাই যারা “সহস্র পুরুষকে দেহদান” করেছিলেন?
কিংবা, আরো ভয়াবহ, এই স্লোগানের মানে কি এই যে, আমাদের ধমনীর রক্ত ‘অসৎ’? ‘জারজ’? এটি কি সেই রক্ত যেটি শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশ থেকে বিতাড়িত করতে চেয়েছিলেন?৯
তথ্যসূত্র:
১। ধর্ষণবিরোধী ছাত্রী আন্দোলন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ’৯৮তে সংঘটিত আন্দোলন নিয়ে প্রকাশনা-সংকলন, ঢাকা: অশুচি,বাং ১৮০৭, ইং ১০৯৯,পৃ.২১।
২। উপরোক্ত।
৩। “শেফা,”আমি বীরাঙ্গনা বলছি, প্রাগুক্ত, পৃ.৮০।
৪। উপরোক্ত, পৃ.৮৪।
৫। উপরোক্ত, পৃ.৮৫।
৬। উপরোক্ত, পৃ.৯৮।
৭। স্পষ্টতই, বাম ঘরানার স্লোগান।
৮। যদিও জাহাঙ্গীরনগর থেকে বিদায় নিয়েছি ২০০১ সালে, সমমনা প্রাক্তন সহকর্মীদের সাথে আন্দোলন-সংগ্রামে একাট্টা হওয়া ও বুদ্ধিবৃত্তিক যোগাযোগ এখনো অটুট।
৯। “তারা,”আমি বীরাঙ্গনা, বলছি, প্রাগুক্ত, পৃ.২২।