দ্রব্যমূল্য, শ্রমিকের জীবন ও মজুরি প্রশ্ন
তাসলিমা আখতার
সাম্প্রতিক সময়ে নিয়ন্ত্রণহীন বাজার এবং চড়া দ্রব্যমূল্যের বোঝা টানতে হচ্ছে দেশবাসীকে। এই অর্থনৈতিক দশা কেবল শ্রমজীবী বা পোশাক শ্রমিককেই নয় মধ্যবিত্তকেও ফেলেছে বিশেষ নাজুক দশায়। করোনাকালে মধ্যবিত্তের একটি অংশ ছুটিতে বেতন পেয়েছেন, আরেক অংশ কাজ হারিয়ে পড়েছেন নিদারুণ সংকটে, নতুন বাস্তবতায় কেউ কেউ সংকট মোকাবিলা করে সামলেও উঠেছেন। এবার সেই মধ্যবিত্তের জীবনেও বড় আঘাত হেনেছে দ্রব্যমূল্যর লাগামছাড়া গতি। সবচেয়ে বিপর্যস্ত দেশের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি এই শ্রমজীবী মানুষ বিশেষত পোশাক শ্রমিকের জীবনে কী প্রভাব ফেলেছে এবং প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির প্রশ্ন কেন জরুরি সেই বিষয়টি কেন্দ্র করে তথ্য উপাত্ত ভিত্তিক এই লেখা তৈরি করা হয়েছে। এই লেখার তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ, সম্পাদনা এবং বিন্যাসে কাজ করেছে ‘গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি’ আর গত ১লা জুলাই এই সংগঠনের সভাতেই তা প্রথম উপস্থাপন করা হয়।
আমরা চারটি ভাগে ভাগ করে এই বিষয়টি উপস্থিত করছি: ১. দ্রব্যমূল্য, বাজার ও শ্রমিকের জীবনে প্রভাব ২. শ্রমিকের মজুরির অবস্থা ৩. মালিকের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প এবং ৪. আমাদের প্রস্তাব।
১. দ্রব্যমূল্য, বাজার ও শ্রমিকের জীবনে তার প্রভাব
প্রথমেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণহীন বাজার অবস্থার দিকে নজর দিতে চাই। শ্রমজীবী মানুষ বিশেষত পোশাক শ্রমিকরা বর্তমান বাজারে কেমন আছেন, কীভাবে তাদের জীবন কাটছে সেটি বুঝতে প্রথমেই মৌলিক চাহিদার (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদনের) প্রথম চাহিদা খাদ্যের পরিস্থিতি দেখা দরকার।
দ্রব্যমূল্যর উর্ধ্বগতির প্রভাব আলোচনার আগে গত ৫ বছরে বাজারে দ্রব্যমূল্য কীভাবে ওঠা নামা করেছে তার একটি চিত্র তুলে ধরছি। পোশাক শ্রমিকের সর্বশেষ মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা হয় ২০১৮ সালে, তা কার্যকর হয় ২০১৯ সালে। তখন থেকে ২০২২ পর্যন্ত মোট ৫ বছরে বাজারের দামের পরিবর্তন পর্যালোচনা এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
টিসিবির তথ্য থেকে আমরা ২০১৮ থেকে ২০২২ এই পাঁচ সালের চাল, আটা, তেল, আলু, সয়াবিন, পেঁয়াজ, ডিম, বয়লার মুরগী, রুই, গরুর মাংসের দাম বিবেচনায় নিয়েছি। এছাড়া ঢাকার কাওরান বাজার, হাতিরপুল বাজার এবং আশুলিয়ার শ্রমিকাঞ্চল এবং মধ্যবিত্ত অঞ্চল থেকে বাজারের দাম যাচাইসহ অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করেছি। টিসিবির বাইরেও আমরা বিশেষভাবে পাঙ্গাস-তেলাপিয়া, ছোট মাছ ও বেশ কিছু শাক সবজির এখনকার দাম এখানে যুক্ত করেছি। আমরা দেখেছি টিসিবির তথ্যের বাইরে সাধারণত বাড়তি দামেই বিভিন্ন বাজারে নানা দ্রব্য বিক্রি হয়।
বাজারের তথ্য ও অবস্থা বিচার করে আমরা দেখি বাজারের শ্রেণিভেদ যেমন আছে তেমনি দ্রব্যের মানেরও প্রকার ভেদ আছে, যা সমাজের বৈষম্যপূর্ণ অবস্থাই তুলে ধরে। হাতিরপুলে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত বাজার করে, আবার কাওরান বাজারে সকল শ্রেণি বাজার করলেও কাঁচা বাজার মধ্যবিত্ত ও শ্রমিকের জন্য এক নয়। তেমনি আশুলিয়ার বিভিন্ন শ্রমিক পাড়া এবং মূল রাস্তার বাজারের মধ্যেও আছে মান, দাম ও ক্রেতার পার্থক্য। এলাকা ভেদে মূল রাস্তা ঘেঁষা বাজারে যান মূলত কারখানার প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আর এলাকার ভেতর বাজার করেন শ্রমিকরা। সবচেয়ে ভালো মানের চাল, সবজি, মাছ, মাংস কখনোই শ্রমিকদের আওতায় থাকে না।
কাওরান বাজারে সকল শ্রেণি বাজার করলেও কাঁচা বাজার মধ্যবিত্ত ও শ্রমিকের জন্য এক নয়। তেমনি আশুলিয়ার বিভিন্ন শ্রমিক পাড়া এবং মূল রাস্তার বাজারের মধ্যেও আছে মান, দাম ও ক্রেতার পার্থক্য। এলাকা ভেদে মূল রাস্তা ঘেঁষা বাজারে যান মূলত কারখানার প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আর এলাকার ভেতর বাজার করেন শ্রমিকরা। সবচেয়ে ভালো মানের চাল, সবজি, মাছ, মাংস কখনোই শ্রমিকদের আওতায় থাকে না।
প্রথমে ছক ‘ক’-তে আমরা মূলত দুধরনের চালের দাম তুলে ধরেছি, মাজারি ও মোটা চাল। টিসিবির চালের তিন রকম ভেদের প্রথম ভাগে আছে চাল সরু (নাজিরশাল/ মিনিকেট), ২য় ভাগে আছে চাল মাঝারি (পাইজাম/লতা), চাল মোটা (স্বর্ণা/চায়না/ইরি)। তিন ধরনের চাল প্রকৃতপক্ষে সমাজের তিন ধরনের শ্রেণির সামর্থ্যকে নির্দেশ করে। টিসিবির প্রতিটি দ্রব্যের নামকরণেই সেই বিভেদ স্পষ্টভাবে টের পাওয়া যায়। বাজার বুঝতে আশুলিয়ার একজন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম ‘দোকানে পাইজাম চাল এর দাম কত? উত্তরে তিনি জানান ‘পাইজাম চাল কিনার লোক এখানে নাই। ঐসব বেচি না। এখানে সবাই ২৮ ও ২৯ কেনে’। অর্থাৎ মাঝারি এবং মোটা চালের মাঝামাঝি বিআর ২৮/২৯ যা হাফভয়েল বা ধামরাই নামে শ্রমিকাঞ্চলে পরিচিত, সেটিই আশুলিয়ায় শ্রমিকরা কিনতে পারেন।
টিসিবিতে দাম যাই উল্লেখ থাক বর্তমানে কেজি ৬০ টাকার নিচে শ্রমিকের চাল পাওয়া মুশকিল। বিশেষভাবে শ্রমিকরা ভাতের ওপরই বেশি নির্ভরশীল। এই চাল গত ৫ বছরে প্রায় ১০ থেকে ১৫ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। যা গড়ে হিসাব করলে ৯-১০%। প্যাকেট আটার দাম বেড়েছে ৫ বছরে প্রায় ৫৭%, ডিম ১১০%, আলু ৫০%, ডাল ৭৯%, তেল ৯৪%। এভাবে প্রত্যেকটি জিনিসের দাম ৫ বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে গত ১ বছরে।
ছক- ক: চাল. আটা, আলু, ডিম, তেল, ডাল, পেয়াজ (শর্করা ও অন্যান্য, টাকায়)
পণ্যের নাম | ২০১৮ | ২০১৯ | ২০২০ | ২০২১ | ২০২২ | টাকায় ৫ বছরে বৃদ্ধি | শেষ এক বছরে বৃদ্ধি | ৫ বছরে % বৃদ্ধি |
চাল মোটা (স্বর্ণা/চায়না/ ইরি/ | ৪০-৪৪ | ৩৪-৪০ | ৩৮-৪৮ | ৪৪-৪৮ | ৪৮-৫২ | ৮ | ৮% | ১৮% |
চাল মাঝারী(পাইজাম/লতা) | ৫০-৫৫ | ৪৪-৫০ | ৪৬-৫২ | ৫০-৫৬ | ৫২-৬০ | ২-৫ | ৭% | ৯% |
আলু | ১৫-২০ | ১৮-২৫ | ২৯-৩২ | ২২-২৫ | ২৮-৩০ | ১০-১৩ | ২০% | ৫০% |
আটা (খোলা) | ২৬-২৮ | ২৬-৩০ | ২৬-৩০ | ৩০-৩২ | ৪২-৪৮ | ১৬-২০ | ৫০% | ৭১% |
আটা (প্যাকেট) | ৩২-৩৫ | ৩৪-৩৬ | ৩৩-৪২ | ৩২-৩৫ | ৫২-৫৫ | ২০ | ৫৭% | ৫৭% |
ডিম হালি | ২৫-৩০ | ৩৪-৩৮ | ৩৩-৩৫ | ৩৩-৩৫ | ৩৮-৪২ | ১২-১৩ | ২০% | ৪০ % |
সয়াবিন (খোলা) | ৮৫-৮৮ | ৭৭-৮২ | ৮৪-৮৮ | ১১৮-১২২ | ১৮০-১৮৫ | ৯৫-৯৭ | ৫২% | ১১০% |
সয়াবিন তেল (বোতল) | ১০৪-১০৮ | ১০০-১০৮ | ১০০-১১০ | ১৪০-১৫০ | ১৯০-২১০ | ৮৬-১০২ | ৪০% | ৯৪% |
ডাল বড় দানা (তুরস্ক/কানাডা) | নাই | ৫৫-৬০ | ৭০-৭৫ | ৭৫-৮০ | ১০৫-১১০ | ৫০ | ৩৮% | |
ডাল মাঝারী দানা (তুরস্ক/কানাডা) | ৬০-৭০ | ৬০-৭৫ | ৯০-১০০ | ৮০-৯০ | ১২০-১২৫ | ৩৯% | ৭৯% | |
পেঁয়াজ (দেশি) | ৪০-৫০ | ২৫-৩৫ | ২২-৩০ | ৪২-৪৫ | ৪৫-৫৫ | ২২% | ১০% | |
পেঁয়াজ (আমদানী) | ৩০-৩৫ | ২৫-৩৫ | ৪০-৪৫ | ৪৮-৫০ | ৫৫-৬০ | ২০% | ৭১% | |
শুকনা মরিচ | ১৭০-২০০ | ১৮০-২২০ | ২১০-২৮০ | ১৭০-২২০ | ২২০-৩০০ | ৩৬% | ৫০% | |
কাঁচা মরিচ | নাই | নাই | নাই | ২০-৬০ | ৮০-১২০ | ১০০% | ১০০% |
তথ্যসূত্র: টিসিবি। তথ্য সম্পাদনা: গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি। বাজার যাচাইয়ে সবকিছুই এর চেয়ে বেশী দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
চাল, আলু, আটা বা শর্করা জাতীয় খাবার দাম কম হওয়ায় সুষম খাবারের অন্যান্য খাদ্য উপাদানের (আমিষ, স্নেহ, ভিটামিন, খনিজ) চাইতে শর্করা জাতীয় খাবারের ওপর-ই শ্রমিক বেশি নির্ভরশীল। ভাত, আলু ভাজি, আলু ভর্তা, চাপড়া, রুটি, বনরুটি ইত্যাদি শ্রমিকের নিত্য দিনের খাবার। দুপুরে ভাত-তরকারি ছাড়া সন্ধ্যায় টিফিন হিসাবে কারখানায় অনেক নারী শ্রমিক আটা দিয়ে তৈরি ‘চাপড়া’ বা সামান্য চিনি দিয়ে কোনোমতে সিদ্ধ করে পিঠার মতো খাবার বানিয়ে নিয়ে যান। আর পুরুষ শ্রমিকদের অনেকেই ওভার টাইমের সময় টিফিনের ২০ টাকা দিয়ে সিঙ্গারা, বিস্কিট, পুড়ি, ছোলা, বন রুটি বা চা ইত্যাদি কিনে খান।
ভাত, আলু ভাজি, আলু ভর্তা, চাপড়া, রুটি, বনরুটি ইত্যাদি শ্রমিকের নিত্য দিনের খাবার। দুপুরে ভাত-তরকারি ছাড়া সন্ধ্যায় টিফিন হিসাবে কারখানায় অনেক নারী শ্রমিক আটা দিয়ে তৈরি ‘চাপড়া’ বা সামান্য চিনি দিয়ে কোনোমতে সিদ্ধ করে পিঠার মতো খাবার বানিয়ে নিয়ে যান। আর পুরুষ শ্রমিকদের অনেকেই ওভার টাইমের সময় টিফিনের ২০ টাকা দিয়ে সিঙ্গারা, বিস্কিট, পুড়ি, ছোলা, বন রুটি বা চা ইত্যাদি কিনে খান।
নারী শ্রমিকদের বড় অংশ এই সামান্য ব্যায়টাও করেন না। টাকাটা বাঁচাতে তারা সন্ধ্যায় টিফিন হিসাবে ঘর থেকে নানান খাবার বানিয়ে কারখানায় নিয়ে আসেন। তাড়াহুড়োর কারণে চাল ভাজা, সস্তা বিস্কুট বা চানাচুর খান কেউ কেউ। অনেক মেয়ে শ্রমিক আটা দিয়ে ‘চাপড়া; (সামান্য চিনি দিয়ে কোন মতে সিদ্ধ কওে মিষ্টি পিঠার মতো খাবার) বানিয়ে নিয়ে যান। চাল, আটা, ইত্যাদির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং আরও সব খরচ সামলাতে শ্রমিকরা এই সস্তাতম খাবার চাল ভাজা এবং চাপড়ার পিঠাও এখন আগের চাইতে কম খান। গত বছরের ১৫ থেকে ২০ টাকার আলূ এখন বিক্রি হচ্ছে আগের চাইতে প্রায় ১৩ থেকে ১৫ টাকা বেশী দরে। আটা ময়দা উভয়ের দাম বৃদ্ধির কারণে বাইরে সিঙ্গারা, পুড়ি, রুটি বা পরোটাও কম কিনতে পারেন শ্রমিকরা। ফলে এখানের তারা চাপের মধ্যে পড়েছেন।
ছক ‘খ’ তে দেখতে পাবো ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল ৫ বছর আগের চেয়ে বেড়েছে চাল, আটা ও আলু দামের তারতম্য। চাল (৯-১৮%) ৬০ এর কাছাকাছি, আটা ৫০ থেকে ৫৫ টাকা (৫৭%) আলু প্রায় ৩০ টাকা কেজি (৫০%) ।
ছক-খ: পাঁচবছরে চাল, আটা ও আলুর দামের ফারাক।
টিসিবির তথ্যানুযায়ী গত ৬ মাসে দফায় দফায় আটার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। মে-জুন মাসে আটার দাম বৃদ্ধি পেয়ে কেজি প্রতি প্রায় ১৫/২০ টাকা বেড়েছে। এর ফলে শ্রমিকদের এলাকায় দোকানে রুটি/পরোটা ৭/৮ থেকে বেড়ে ১০/১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বৃদ্ধি পেয়েছে বনরুটির দামও। যে বনরুটি ১০ টাকা করে কিনে খেতো শ্রমিক তার দাম প্রথমে ১৫ টাকা নির্ধারণ করে কারিগর ও দোকানীরা। এতে শ্রমিকদের বন কেনার হার কমলে দাম আবার ১০ টাকায় বিক্রি হয় । কিন্তু তাতে বন রুটির সাইজ ছোট হয়ে আসে বলে জানান শ্রমিকরা।
ছক ‘গ’ দেখলে আমরা মাছ মাংস এর দামের ফারাক বুঝতে পারবো।
ছক- গ: মাছ-মাংস (আমিষ)
নাম | ২০১৮ | ২০১৯ | ২০২০ | ২০২১ | ২০২২ | বৃদ্ধি টাকায় | শেষ ১ বছর% বৃদ্ধি | ৫ বছরে % বৃদ্ধি |
বয়লার মুরগী | ১৫০-১৬০ | ১২৫-১৩৫ | ১৫০-১৬০ | ১৩০-১৫০ | ১৩৫-১৫০ | ০ | ০ | -৬ |
দেশী মুরগী | ৪০০-৪৫০ | ৪৫০-৬০০ | ৫২০-৫৫০ | ৪৫০-৫৫০ | ৫০০-৬৫০ | ২০০ | ১৮ | ৪৪% |
গরুর মাংস | ৪৬০-৪৮০ | ৫৩০-৬০০ | ৫৭০-৬০০ | ৫৬০-৫৮০ | ৬৫০-৬৮০ | ২০০ | ১৭ | ৪২% |
রুই মাছ | ২০০-৩০০ | ২২০-৩৫০ | ২২০-৩৮০ | ২৫০-৩৫০ | ২৫০-৩৫০ | ৫০ | ০ | ১৭% |
ছোট মাছ | ২০০-২৫০ | ছোট মাছ | ||||||
পাঙ্গাস | ১৫০-১৬০ | পাঙ্গাস | ||||||
তেলাপিয়া | ১৫০-১৬০ | তেলাপিয়া |
তথ্যসূত্র: টিসিবি। তথ্য পর্যালোচনা ও সম্পাদনা: গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি। বাজার যাচাইয়ে এর চেয়ে বেশি দাম দেখা গেছে।
২০১৮ তে ঘোষিত এবং ২০১৯ এ কার্যকর হওয়া ৮ হাজার টাকা মজুরিতে গরুর মাংস (৬৫০-৬৮০), ইলিশ মাছ বা অন্যান্য দামি মাছ কেনা কঠিন। দাম কম থাকায় সাধারণত শ্রমিকরা বয়লার মুরগী ও তেলাপিয়া, পাঙ্গাস মাছ সহ কম দামি মাছ বেশি খান। দেশি মুরগী খাওয়া শ্রমিকদের পক্ষে সম্ভবপর হয় না। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে এখন গরীবের মাছ হিসাবে পরিচিত পাঙ্গাস বা তেলাপিয়া মাছের চেয়ে বয়লার মুরগীর দাম কম। পাঙ্গাস যেখানে কেজি ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে সেখানে বয়লার বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৫০ টাকায়। গত ৫ বছরে বয়লার মুরগীর দাম সবচেয়ে কম বাড়লেও অন্যান্য দ্রব্যের মূল্য বাড়ার কারণে শ্রমিকরা এখন বয়লার কিনলেও আগের চেয়ে বয়লার কেনার হারও কমেছে। এছাড়া গরুর মাংস, দুধ বা রুই মাছের দাম বাড়ায় সেসব শ্রমিকের নাগালের বাইরে। এ বছর সয়াবিন তেলের দাম গত ৫ মাসে ৪ বার বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার ৯ জুন আবারও দাম বৃদ্ধি করে বোতলজাত তেল ২০৫ টাকা নির্ধারন করলেও চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে, ৯৪% বৃদ্ধি ঘটেছে এই খাতে। এক বছর আগে এই তেলের দাম ছিলো ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা।
২০১৮ তে ঘোষিত এবং ২০১৯ এ কার্যকর হওয়া ৮ হাজার টাকা মজুরিতে গরুর মাংস (৬৫০-৬৮০), ইলিশ মাছ বা অন্যান্য দামি মাছ কেনা কঠিন। দাম কম থাকায় সাধারণত শ্রমিকরা বয়লার মুরগী ও তেলাপিয়া, পাঙ্গাস মাছ সহ কম দামি মাছ বেশি খান।
ছক- ঘ: গত ৫ বছরে মাছ, মাংস, দুধ ও মাছের দাম
বর্তমানে বাজারের তেল, আটা, আলু ও শাক সবজিসহ সকল পণ্যের দাম বাড়ায় শ্রমিকরা আমিষ খাবার কমিয়ে দিয়েছে আরো বেশি। রহিমা (ছদ্মনাম) নামে এক নারী শ্রমিক জানান,
‘আগে মাসে আমরা পরিবারের দুইজন ২/৩ বার রুই মাছ বা বয়লার মুরগী কিনতাম। এই মাসে সেটাও কেনা হয় নাই। এই মাসে ছোট মাছ, শুঁটকি এসব বেশি খাওয়া হইসে। মেয়েকে বাসায় মুড়ি, বিস্কিট বাইরে থেকে খাবার জন্য কিছু টাকা যা পারি দিতাম। এখন সেটাও দিতে পারি না।’
আর একজন শ্রমিক জানান লাগাম ছাড়া দ্রব্যমূল্য হওয়ায় এখন সবজি আর গুড়া মাছ বেশি কেনা হয়। অল্প গুড়া মাছ অল্প সবজিতে দিয়ে এক তরকারি পাক হয়। তিনি আরো বলেন, ডাল কিনলেও রাঁধেন খুব পাতলা করে যাতে অনেক দিন ১ কেজি ডাল চলে। আগে কলা ছাড়াও মৌসুমী ফল অল্প দামের মধ্যে কিনা হইতো এখন তাও কিনতে চিন্তা করতে হয়।
বাজার যাচাইয়ের কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখি আশুলিয়ার শ্রমিক পাড়ায় যে নিম্নমানের সবজি পাওয়া যায় সেই একইমানের বা তারও খারাপ মান পাওয়া যায় ঢাকার কাওরান বাজারের বাইরে খোলা জায়গার এক প্রান্তে। কাওরান বাজারে সকল শ্রেণির ক্রেতা গেলেও শ্রমজীবীর জন্য রয়েছে সস্তা বাজার। যেখান থেকে নিম্ন মানের সবজি কিনে খান শ্রমজীবীরা। মাছের ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি বেশির ভাগ শ্রমিক পাঙ্গাস, তেলাপিয়াসহ কম দামি মাছ ও ছোট মাছ বেশি খান। রুই মাছ কেনার সামর্থ্য তাদের হয় না। বাজারে দ্রব্যমূল্য বাড়ার ফলে বড় মাছের বদলে ছোট মাছ কিনে সেটা সবজির সাথে মিশিয়ে খান বেশির ভাগ শ্রমিক। বাজারে চিচিঙ্গা, ধুন্দুল দাম কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকা, পটল-ভেন্ডির দাম ৩০ থেকে ৪০ টাকা, শাক ১০ থেকে ২৫ টাকা। ফলে সবজির দামও বাড়ার কারণে শ্রমিকরা সবজিও কিনতে পারছেন আগের চেয়ে কম।
ছক-ঙ: ২০২১-২০২২ এর কিছু সবজির দাম
পণ্যের নাম | ২০২১ | ২০২২ |
শাক(গা.শ্র.স) | ১০-২৫ | |
চিচিঙ্গা (ঐ) | ৫০-৬০ | |
বেগুন(টিসিবি) | ৩০-৬০ | ৪০-৬০/৬০-৮০ |
পটল(গা.শ্র.স) | ৩০-৪০ | |
ভেন্ডি (ঐ) | ৩০-৪০ | |
লাউ (ঐ) | ৫০-৬০ | |
কাঁচা মরিচ(টিসিবি) | ২০-৬০ | ৮০-১২০ |
তথ্যসূত্র: টিসিবি ও নিজস্ব গবেষণা। উল্লেখ্য, গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি বাজার যাচাইয়ে দেখেছে সব এর চেয়ে বেশি দামে দ্রব্য বিক্রি হয়।
শ্রমিকরা সাধারণ সময়েও শরীরের জন্য দরকারি বা ২২০০-৩০০০ কিলোক্যালোরীর শক্তি উৎপাদনের জন্য জরুরি সুষম খাবার খেতে পারেন না। তাদের ৮ হাজার টাকার বেতনে ডিম দুধ মাছ মাংস মাখন ফল মুল তাদের খাবারের তালিকায় নিয়মিত হবার কোনোই সুযোগ নেই। গুড়া দুধ বা চিনি কেনার সামর্থ্য বেশিরভাগ শ্রমিকের হয় না। বেশিরভাগ শ্রমিক উপলক্ষ্য ছাড়া নিয়মিত চিনি বা দুধ কিনতে পারেন না।এভাবে খাদ্য তালিকা থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্যমান বাদ দিতে বাধ্য হয়ে সাধারণ সময় শর্করা জাতীয় খাবার শ্রমিকরা বেশি গ্রহণ করেন। এখন এমনকি বাড়িতে শিশু থাকলে কিংবা মেহমান আসলে বা কোন উপলক্ষেও দুধ চিনি কেনা কমে গিয়েছে বাড়তি দামের কারনে। দুধের দাম বেড়েছে প্রায় ৫৯% ভাগ, চিনির দাম ৩৭% ভাগ। কিন্তু মজুরির বাড়েনি পণ্যের এই বাড়তি দামের সাথে তাল মিলিয়ে।
ছক- চ: ৫ বছরে চিনি ও দুধের দাম বৃদ্ধি
নাম | ২০১৮ | ২০১৯ | ২০২০ | ২০২১ | ২০২২ | ১ বছরে বৃদ্ধি % | ৫ বছরে বৃদ্ধি % |
দুধ | ৪২০-৪৪০ | ৪২০-৪৫০ | ৪৪০-৫৫০ | ৫৫০-৬০০ | ৬৯০-৭০০ | ১৭% | ৫৯% |
চিনি | ৫৫-৬০ | ৫২-৫৬ | ৫৮-৬৫ | ৬৮-৭২ | ৮০-৮২ | ১৪ | ৩৭% |
তথ্যসূত্র: টিসিবি তথ্য । সম্পাদনা ও পর্যালোচনা: গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি । বাজার যাচাইয়ে বেশি দাম দেখা গেছে।
বর্তমান বাজারের দামে শাক-সবজি, ফলমূল থেকে প্রয়োজনীয় ভিটামিন সংগ্রহের সুযোগ তাদের নেই। এই অবস্থায় শ্রমিকদের আমিষ, ভিটামিন, স্নেহ ও খনিজ জাতীয় খাবারের সমন্বয়ের বদলে শর্করা জাতীয় খাবারের উপর বেশি নির্ভর করতে হয়। ফলে তাদের শরীরে পুষ্টি বর্তমানে আরো খারাপ অবস্থার দিকে যাচ্ছে। নারী-পুরুষ উভয়েই এখন আরো বেশি আর্থিক সংকটে, আরো বেশি অপুষ্টিতে। উভয়ই অনির্দিষ্ট সময় কাজের চাপ, ওভার টাইম, ছুটির অভাব এবং কম মজুরিতে নিজেদের শরীরের ক্ষয় পুরণের চাহিদার যোগান দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। নারী শ্রমিকদের পুনরুৎপাদন (সন্তান জন্মদানের ) এর জন্য শরীরে বাড়তি পুষ্টি ও খাদ্য দরকার। কিন্তু বর্তমানে কম পুষ্টিকর খাবার অধিক খাওয়া এবং অতিরিক্ত পরিশ্রম করার কারণে তারা দ্রুত ক্লান্ত হচ্ছেন, রোগাক্রান্ত হচ্ছেন এবং হারাচ্ছেন কর্ম উদ্দীপনা ও কর্মক্ষমতা।
ডিজেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রভাব
খাদ্যদ্রব্যের বাইরে অন্যান্য দ্রব্যের দামবৃদ্ধির দিকেও লক্ষ্য করা জরুরি। খাদ্যদ্রব্যের পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য দ্রব্য এবং গ্যাস ও ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে শ্রমিকের বেঁচে থাকা দায় হয়েছে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেতে পেতে ৫ জুন ২০২২, ৯৭৫ টাকা থেকে ১০৮০ টাকা হয়েছে, ২২.৭৮% শতাংশ দাম বেড়েছে। গত বছরের নভেম্বরের ৪ তারিখে জ্বালানি তেল ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে একলাফে ১৫ টাকা। অর্থাৎ লিটারে ৬৫ থেকে এখন ৮০ টাকায়।
ছক- ছ: দামবৃদ্ধি ও তার প্রভাব
২০২১ নভেম্বরে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম এক লাফে ১৫ টাকা বৃদ্ধি পায়
ডিজেলের দাম বৃদ্ধি পায়= ২৩. ০৭%
পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি পায় = ২৬. ০৫%
প্রভাব পড়ে
পরিবহণ ভাড়ায়: ৮-১০ টাকা বৃদ্ধি পায়
সকল নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি
জুন ৪ তারিখে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পায়
দুই চুলা ৯৭৫-১০৮০= ১০৫ টাকা বৃদ্ধি
২২.৭৮% বৃদ্ধি
তথ্যসূত্র: দৈনিক পত্রিকা এবং পণ্য ও গণপরিবহন মালিক সমিতি ( কালের কণ্ঠ: ৭ নভেম্বর, ২০২১)। সম্পাদনা: গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি
দেশের মালবাহী পরিবহনের বড় অংশ চলে ডিজেলে। কিন্তু বড় অংশ চলে গ্যাসে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে গত বছরের শেষ থেকেই শ্রমিকরা একটা বড় ধাক্কার মধ্যে আছে। যদিও ঢাকার ভেতর ৯৫% এবং ঢাকার বাইরে দূরপাল্লার ৬০% বাস গ্যাস চালিত। তারপরও ডিজেলের দাম বাড়ার পর সব বাসের ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে লোকাল বাস প্রতি স্টপেজ মিনিবাস ৫ টাকা নিম্ন ভাড়া ছিল, সেখানে এখন তা ৮ টাকা। আর বড় বাসে যেখানে ভাড়া ৭ টাকা তা ১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্ধারিত বাসের ভাড়ার বেশি ভাড়া নিচ্ছে বাস মালিকরা। অনেক বাসে ১৫ টাকা পর্যন্ত নিম্ন ভাড়া নেয়া হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধিসহ পরিবহণ খরচ বাড়ার প্রভাব অন্যসব দ্রব্যের মধ্যেও পড়েছে। চাল-ডাল-তেল-শাক-সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম ছাড়িয়েছে শ্রমজীবীর ক্রয়ক্ষমতা। গত ৫ বছরে দফায় দফায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে গ্যাস-মোবিল-ডিজেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবহনের খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্যাস-ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাবও শ্রমিকের জীবন যাপন ও খাদ্যাভ্যাসে প্রভাব ফেলেছে।
২. শ্রমিকের মজুরি অবস্থা
গত ২০১৮ সালের মজুরি বোর্ড এর মাধ্যমে নতুন মজুরি ২০১৯ এর জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে। ঐ সময় ৫৩০০ টাকা থেকে মোট মজুরি ৮ হাজার টাকা করা হয়। তখন শ্রমিকরা দাবি করেছিলেন ১০ হাজার বেসিক এবং সর্বমোট ১৬ হাজার টাকা। কিন্তু মালিকরা বেসিক দিয়েছেন ৪১০০ এবং সব মিলিয়ে ৮ হাজার টাকা বেতন। মালিকরা সব সময়ই বেসিকের পরিমাণ কম দেয় যাতে ওভারটাইমসহ অন্যান্য খাতেও শ্রমিকদের কম দিতে হয়। শ্রমিকরা বর্তমানে ওভার টাইম এবং কখনো অনির্দিষ্ট সময় কাজ করে তাদের জীবন কোনো মতে নির্বাহ করেন। কেবল মজুরির উপর নির্ভর করার কোনো সুযোগ তাদের নেই।
২০১৯ এই আমরা বলেছিলাম শ্রমিকদের ৮ হাজার টাকায় ৪ সদস্য কিংবা ৬ জনের সংসার চালানো অসম্ভব। ২২০০-৩০০০ কিলো ক্যালোরির শক্তি উৎপাদনের জন্য যে খাবার প্রয়োজন, সেই খাবারের ব্যয়ই এর চাইতে বেশি। আমরা ২০১৮ তে ১৬ হাজার টাকা মোট মজুরি দাবি করলেও সব মিলিয়ে দেয়া হয় ৮০০০ টাকা।
নিচে ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত মজুরি বোর্ড এর নির্ধারিত পোশাক শ্রমিকের বেতন এবং শ্রমিকদের দাবি উপস্থিত করা হলো।
১৯৯৪ সালে মজুরি ছিল ৯৩০ টাকা
২০০৬: ন্যূনতম মজুরি ১৬৬২ টাকা করা হয়। দাবি ছিল ৩০০০ টাকা।
২০১০: ন্যূনতম মজুরি ৩০০০ টাকা করা হয়। দাবি ছিল ৫০০০ টাকা।
২০১৩: ন্যূনতম মজুরি ৫৩০০ টাকা করা হয় । দাবি ছিল ১২০০০ টাকা।
২০১৮: ন্যূনতম মজুরি করা হয় ৮০০০ টাকা । দাবি ছিল ১৬০০০ টাকা।
১৯৯৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত প্রতিবারই আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমেই শ্রমিকরা নতুন মজুরির আওয়াজ তুললে মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়। শ্রম আইনে ৫ বছর পর পর মজুরি নির্ধারনের কথা থাকলেও সরকার প্রয়োজনে দেশীয় পরিস্থিতিতে যে কোনো সময় মজুরি পুনর্বিবেচনায় বোর্ড গঠন করার ধারাও আছে, যার নজির ২০১০ এবং ২০১৩ তে দেখা যায়। এই দুই পর্বেই একবার ৪ বছর পর আরেকবার ৩ বছরের মাথায় মজুরি বোর্ড গঠন করতে বাধ্য হয় মালিক ও সরকার।
করোনা কালে ৩ লাখ শ্রমিক কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছেন। এসময়ে ৩০ লাখ ডলারের অর্ডার বাতিল হয়, তবে পরবর্তীতে এর ৯০ শতাংশ অর্ডার ফেরত আসে। শ্রমিকরাও অনেকে নতুন কারখানায় কাজ পান, কিন্তু তাদের আয় কমে যায়। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দীর্ঘদিন অনেককে বেকার থাকতে হয়। একদিকে করোনার ধাক্কা অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের নির্মম চাপ বর্তমানে শ্রমিকদের উপর থাকলেও মজুরি বোর্ড গঠন করার বিষয়ে সরকার এবং মালিকের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। শ্রমিক এবং শ্রমিক সংগঠনসমূহ নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করা ও ২০ হাজার টাকা মজুরি করার জন্য গত ১ বছরের বেশি সময় ধরে বলে আসছে। অথচ গত এক বছরে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে শ্রমিকের জীবন আরো বিপর্যস্ত হয়েছে।
সম্প্রতি সিপিডি একটি গবেষণায় দেখিয়েছে ঢাকায় একজনের খাবারের খরচই শুধু ৫৩৩৯ টাকা। ৪ জনার খাবার খরচ ২১,৩৫৮ টাকা। মাসে একটি পরিবারের খরচ হয় ৪২ হাজার ৫৪৮। বর্তমান অবস্থা বিচারে বিভিন্ন সংগঠন প্রস্তাবিত মজুরি ২০ হাজার টাকাকে বর্ধিত করে দাবি তোলার কথা ভাবছে। কারণ ২০ হাজার টাকার দাবি ১ থেকে দেড় বছর আগে তোলা হয়েছিল। বর্তমান দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি লাগাম ছাড়া হওয়ায় এখন নতুন করে দাবি উত্থাপনের প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে।
ঢাকায় একজনের খাবারের খরচই শুধু ৫৩৩৯ টাকা। ৪ জনার খাবার খরচ ২১,৩৫৮ টাকা। মাসে একটি পরিবারের খরচ হয় ৪২ হাজার ৫৪৮। বর্তমান অবস্থা বিচারে বিভিন্ন সংগঠন প্রস্তাবিত মজুরি ২০ হাজার টাকাকে বর্ধিত করে দাবি তোলার কথা ভাবছে। কারণ ২০ হাজার টাকার দাবি ১ থেকে দেড় বছর আগে তোলা হয়েছিল। বর্তমান দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি লাগাম ছাড়া হওয়ায় এখন নতুন করে দাবি উত্থাপনের প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে।
৩. মালিকদের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
একদিকে শ্রমিকরা দুর্দশায় নিমজ্জিত অন্যদিকে বাংলাদেশের পোশাকখাতের সাফল্যের কথা অর্থনৈতিক পর্যালোচনায় এবং জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সামনে এসেছে। বিশ্ব বাজারে পোশাক কেনার গতি করোনাকালে কিছুটা স্থবির হলেও পরবর্তীতে ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি নতুন নতুন বাজারও তৈরি হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের ঘুরে দাঁড়ানো এবং রপ্তানি আয়ের উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধির খবর ছাপা হচ্ছে পত্রিকায়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বরে) রপ্তানি বেড়েছে ২৮ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের প্রচলিত চেনা বাজারের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ৪৬%, ইউরোপ ও কানাডার বাজারে ২৬% রপ্তানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ইউরোপের বাজারে। বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক অবস্থার কারণে ক্রয়বৃদ্ধির সাথে সাথে বাজারও সম্প্রসারণ হয়েছে। বাজার অন্য জায়গা থেকে সরেও এসেছে বাংলাদেশে। বিশেষভাবে চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার ও ইথিওপিয়ার ক্রয়াদেশ এখন বাংলাদেশে আসছে। চেনা বাজারের সীমানা বিস্তৃত হয়েছে চিলি, চীন, জাপান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো, তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা ও রাশিয়ার বাজার পর্যন্ত। এই অপ্রচলিত বা নতুন অচেনা বাজারে প্রবৃদ্ধি ও রপ্তানি বেড়েছে গাণিতিক হারে যা প্রায় ২৪.২৬ %।
সার্বিকভাবে এই অবস্থা অব্যাহত রাখার বিষয় মালিক এবং সরকার উভয় পক্ষ আশাবাদী। বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশীর ভাষ্যে ‘চলতি বছর এই খাত ৫২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে একটি মাইল ফলক সৃষ্টি করবে। যা হবে ৫০ বছরের বড় অর্জন’। মালিকদের এই সাফল্যের সময়ে যখনই শ্রমিক সংগঠনগুলো মজুরি বাড়িয়ে ২০ হাজার করার দাবি করছে তখনই মালিকরা নাখোশ। তারা যুক্তি দেখাতে চাচ্ছে বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও অন্যান্য পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে তাদের আয় বৃদ্ধি তেমনটা হচ্ছে না।
৪. আমাদের প্রস্তাব
পোশাক খাতের সুস্থ বিকাশ শ্রমিকসহ সকলেরই কাম্য। কারণ এর সাথে জড়িয়ে আছে ৪০ লাখ শ্রমিকের রুটি রুজির প্রশ্ন। একইসাথে জড়িয়ে আছে দেশীয় উদ্যোক্তা ও শিল্পখাতের বিকাশের বিষয়। এতো সাফল্য গাথায় এই খাতের প্রাণ তরুণ শ্রমিকদের ঠাঁই পেতে দেখি না। তারা সেই সস্তা ৮০০০ টাকার মজুর হয়েই আগের চাইতে বেশি দুর্বিষহ জীবন চালাচ্ছে। যে শ্রমিকের শ্রমে ঘামে অর্থনীতির মেরুদন্ড বিকশিত হচ্ছে বর্তমান বাজারে ৮ হাজার টাকা পাওয়া সেই পোশাক শ্রমিকসহ শ্রমজীবী মানুষের বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। হাতে গোনা দু একজন অর্থনীতিবিদ ছাড়া সমাজের মূল ধারার অর্থনীতিবিদ বা বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে বরাবরের মতো নীরব।
শ্রমজীবী মানুষেরা এমনিতেই অর্থাভাবের কারণে শর্করা জাতীয় খাদ্য চাল, আলুর উপর অধিক নির্ভরশীল। এখন যাবতীয় নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে শর্করা জাতীয় খাবারসহ সবরকম খাবারেই চাপ বেড়েছে। আগে যদি কোন পরিবার ৫ কেজি তেল ব্যবহার করতো তো এখন তারা ২ কেজি তেল ব্যবহার করে। এভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চাপ সরাসরি তাদের খাদ্য চাহিদা, চিকিৎসা, সন্তানের শিক্ষাসহ পুষ্টিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ফলে তারা বাধ্য হচ্ছে খাদ্য চাহিদাসহ অন্যান্য চাহিদা কাটছাঁট করতে।
শ্রমিকরা চা, রুটি, কলা যেসব নাস্তা হিসাবে খেতেন দাম বাড়ায় এখন সেটুকুও খেতে পারছেন না। ফলে এই দাম বৃদ্ধিতে যেই শ্রমজীবী একরকম নিজের শরীর খেয়ে এবং দিনমান পরিশ্রম ওভার টাইম করে সামান্য পারিশ্রমিকে চলে তার পক্ষে ধৈর্য্য-শৃঙ্খলার পরীক্ষা দেয়া বিলাসিতা মাত্র। এ কারণেই গত ৪ থেকে ৭ জুন পর্যন্ত হঠাৎই ক্ষেপে উঠতে দেখলাম মিরপুরের পোশাক শ্রমিকদের। তাদের মুখে একটা কথাই ছিল দ্রব্যমূল্য কমাও মজুরি বাড়াও। এর মাঝে নিদারুণ পেটের ক্ষুধা আর পরিবার পরিজন নিয়ে অথৈ সমুদ্রে অনিশ্চয়তায় পড়ার ভয় ও ক্ষোভ ছাড়া আর কোনো ‘চক্রান্ত’ খুঁজে পাইনি আমরা।
অনিয়ন্ত্রিত বাজারের জন্য সরকার বিশেষভাবে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ইউক্রেন যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতি দায়ী করে। অথচ বাজার নিয়ন্ত্রণসহ আমদানি দ্রব্যে কর কমানোর যথাযথ উদ্যোগ অনুপস্থিত। এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকের চাহিদা কমানোর বদলে মালিকের চাহিদা কমানো এবং এই খাতের উন্নয়নের ভাগীদার করা দরকার শ্রমিককে। শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো তাই এখন সময়ের দাবি। আমরা মনে করি চারপাশে গুমোট আর ভয়ের পরিবেশ যতই শ্রমিকদের ঘিরে থাকুক মজুরির দাবিকে কেবল আশ্বাসে নয় বাস্তবায়নের জন্য কাজ করতে হবে। কোনো অবস্থায়ই পরিবর্তন হবে না যদি এই বিষয়ে জনমত তৈরি না হয়। কোনো পরিবর্তনই হবে না যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন না করি।
আমরা নিম্নোক্ত ৬ টি দাবির ভিত্তিতে সকল শ্রমিক সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহবান জানাই। এগুলো হলো:
১. অবিলম্বে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতায় আনতে হবে।
২. মিরপুর-উত্তরাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মজুরি আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা, মামলা-গ্রেফতার বন্ধ করতে হবে।
৩. অবিলম্বে মজুরি বোর্ড গঠন করে নতুন মজুরি নির্ধারণ করার উদ্যোগ নিতে হবে।
৪. শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজারের কম করা যাবে না। পোশাক শ্রমিকের জীবন-জীবিকার মান নিশ্চিতের দায় মালিক, সরকার ও বায়ার তিন পক্ষকেই নিতে হবে।
৫. নতুন মজুরি কার্যকর হবার আগ পর্যন্ত মহার্ঘ্য ভাতা এবং শ্রমিকদের রেশনিং ও সামাজিক সুরক্ষার অধিকারের আওতায় আনতে হবে।
৬. জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা নির্ধারণের উদ্যোগ নিতে হবে ।
তাসলিমা আখতার: শিক্ষক, আলোকচিত্র শিল্পী ও সভাপ্রধান গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি
ইমেইল: taslimaakhter1971@gmail.com