বাজেট, উন্নয়ন ও মানুষ

সর্বজন বক্তৃতা

বাজেট, উন্নয়ন ও মানুষ

আনু মুহাম্মদ

গত ৯ই জুন সরকারের পক্ষ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। বাজেট নিয়ে দেশে আলোচনা হয় প্রধানত বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ পরিমাণ নিয়ে। দরকার এর পেছনের দর্শন আর গুণগত গতিপথ অনুধাবন, তাতেই কেবল বোঝা যাবে কীভাবে এসব আয়োজন সর্বজনের সম্পদ কতিপয়ের হাতে তুলে দেবার আইনী ব্যবস্থা মাত্র। এখানে বাজেট কেন্দ্র করে সামগ্রিক উন্নয়ন পথ নিয়ে একটি বক্তৃতার কিঞ্চিত সংক্ষিপ্তরূপ উপস্থিত করা হচ্ছে। দৃকনিউজ গত ১৮ই জুন এই বক্তৃতার আয়োজন করেছিল। সর্বজনকথার জন্য এই বক্তৃতা অনুলিখন ও সম্পাদনা করেছেন আনহা এফ খান।   

বাজেট নিয়ে কাদের সঙ্গে আলোচনা হয়। এটা প্রতিবছরেরই একটা নিয়ম যে বাজেট উপস্থাপিত হওয়ার পর অনেক আলোচনা হয়, লেখালিখি হয়। আমরা দেখি কিছু নির্দিষ্ট ব্যাবসায়িক গোষ্ঠী ছাড়া অন্য কেউ যেমন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী কৃষক, শ্রমিক (শ্রমিকদের মধ্যে বিভিন্ন ধরন আছে, প্রবাসী শ্রমিক, পোশাকশ্রমিক, কারখানা শ্রমিক, স্বনিয়োজিত শ্রমিক), শিক্ষার্থী আছে, নানান পেশাজীবী আছে, শিক্ষক আছে, ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী, বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিসত্তা আছে, যাদের আমরা আদিবাসী হিসেবে জানি, নারীরা আছেন, এই কোনো জনগোষ্ঠীর সঙ্গেই বাজেট আলোচনা করা হয় না। বাজেট একভাবে উপস্থিত হয় আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। কিছু ব্যাবসায়িক গোষ্ঠী যাদের লবিং যথেষ্ট শক্তিশালী, তাদের ইচ্ছারই প্রতিফলন আমরা বাজেটের মধ্যে পাই।

প্রথমে বলি বাজেট বলতে আমরা কী বুঝি। বাজেট হচ্ছে একটা দেশের সরকারের অর্থনৈতিক নীতির ওপর ভিত্তি করে গৃহীত কর্মসূচির বার্ষিক প্রতিবেদন। সরকার দেশের অভ্যন্তরে এক বছরে কাদের কাছ থেকে কীভাবে সম্পদ সংগ্রহ করবে এবং সেই সম্পদটা কোথায় বরাদ্দ হবে, ব্যয় হবে- এই আয় এবং ব্যয় দুটোর বিবরণই হচ্ছে বাজেট। বাজেট থেকে আমরা বুঝতে পারি সরকারের অবস্থান কেমন, কাদের কাছ থেকে তারা সম্পদ নিচ্ছে এবং কাদের দিচ্ছে।

প্রতিদিন, ২৪ ঘণ্টা, মাসের ৩০ দিন, ১২ মাস আমরা যে বিভিন্ন ধরনের তৎপরতার মধ্যে থাকি, চলাফেরা করি, খাবার খাই, বেড়াতে যাই, লেখাপড়া করি, চিকিৎসা করি, খেলি, সিনেমা দেখি, পরিবহনে উঠি, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি ব্যবহার করি, ঘরে থাকি, দোকানে যাই, বাজার করি, বাইরে রেস্টুরেন্ট-এ খাই, এইসব তৎপরতার মধ্যেই জেনে না জেনে আমাদের কিন্তু টাকা দিতে হয় সরকারকে। আমরা অনেক সময় খেয়াল করি না যে আমরা প্রায় প্রতিটা মুহূর্তে সরকারকে অর্থ দিচ্ছি। যেটাকে বলা হয় সরকারের টাকা। সরকার এই টাকা কোথাও দিচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী অনুদান দিচ্ছেন, উপহার দিচ্ছেন, এই মন্ত্রণালয় এই টাকা দিচ্ছে, কিংবা এটা বিশ্বব্যাংকের টাকায় হচ্ছে, ওটা ইউএসএইডের টাকায় হচ্ছে, এটা এডিবির টাকায় হচ্ছে, বা ভারত-রাশিয়া-চীনের টাকায় হচ্ছে; এই কথাগুলো মানুষের মধ্যে একটা ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করে। টাকা আসলে এদের কারো নয়। সরকারের যে অর্থনৈতিক নীতির বাস্তবায়ন হয়, তা বাস্তবায়নের জন্য সরকার নিজে কিছু অর্থ সংগ্রহ করে জনগণের কাছ থেকে, সেখানে যদি ঘাটতি পড়ে তখন সরকার ঋণ নেয়‒দেশের ভেতর থেকেও নেয়, আবার দেশের বাইরে থেকেও নেয়। যে বছর ঋণটা নেয়, সেই বছরের ঋণের ভার বা বোঝা হয়তো জনগণের ওপর পড়ছে না, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময় পর এই টাকা জনগণকেই পরিশোধ করতে হয়। ফলে যেটাকে মনে হয় বিশ্বব্যাংকের টাকা বা যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-রাশিয়া-চীনের টাকা, সেটা আসলে জনগণেরই টাকা। ফলে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে শুধু পদ্মা সেতু আমাদের টাকায় হচ্ছে, আর রামপাল ভারতের টাকায় হচ্ছে, রূপপুর রাশিয়ার টাকায় হচ্ছে। মোটেই তা নয়, সব টাকাই আসলে জনগণকে দিতে হবে। তার মানে, যত ঋণ হবে, যত ব্যয় হবে সব আসলে জনগণের ঘাড়েই পড়বে, জনগণকেই পরিশোধ করতে হবে। সে জন্য জনগণের সঙ্গে পরামর্শ ও তাদের মতামত একটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হওয়ার কথা। অথচ শেষ পর্যন্ত যাদের ঋণ বা ব্যয়ের বোঝাটা টানতে হবে ও পরিণতি বহন করতে হবে, সেসব জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাজেটের আগে কোনো আলোচনাই আমরা দেখি না।

এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে শুধু পদ্মা সেতু আমাদের টাকায় হচ্ছে, আর রামপাল ভারতের টাকায় হচ্ছে, রূপপুর রাশিয়ার টাকায় হচ্ছে। মোটেই তা নয়, সব টাকাই আসলে জনগণকে দিতে হবে। তার মানে, যত ঋণ হবে, যত ব্যয় হবে সব আসলে জনগণের ঘাড়েই পড়বে, জনগণকেই পরিশোধ করতে হবে। সে জন্য জনগণের সঙ্গে পরামর্শ ও তাদের মতামত একটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হওয়ার কথা। অথচ শেষ পর্যন্ত যাদের ঋণ বা ব্যয়ের বোঝাটা টানতে হবে ও পরিণতি বহন করতে হবে, সেসব জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাজেটের আগে কোনো আলোচনাই আমরা দেখি না।

অনেকে বলেন, পরিবার বা ব্যক্তির যেমন আয়-ব্যয়ের হিসাব ও পরিকল্পনা থাকে, সরকারের বাজেটও এমনই রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনা। এর মধ্যে সত্যতা আছে আবার দুয়ের মধ্যে বড় তফাতও আছে। একটা হলো, ব্যক্তি বা পরিবার প্রথমত আয়ের হিসাব করে, আর সেই আয়ের ভিত্তিতেই ব্যয়ের পরিকল্পনা করে। যেমন, গত বছরের জুনে মানুষ যা আয় করত সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হয়তো এই জুন মাসেও সমপরিমাণ আয় করছে। ধরা যাক সেটা ১০০ টাকা। অর্থাৎ, ২০২১ সালের জুন মাসে যিনি ১০০ টাকা আয় করতেন তিনি ২০২২ সালের জুন মাসেও ১০০ টাকা আয় করছেন। কিন্তু এক বছর আগে ১০০ টাকায় তিনি যা যা কিনতে পারতেন, এক বছর পর এসে তিনি তা কিনতে পারছেন না। তাকে অনেক কিছু কাটছাঁট করতে হচ্ছে। কারণ কী? কারণ, অনেক জিনিসের দাম বেড়েছে। এমনসব জিনিস, যা আমরা প্রতিদিন খাই যেমন: চাল, আটা, তেল, নুন, চিনি সমস্ত কিছুর দাম বেড়েছে। বাসভাড়া, বাসাভাড়া, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বেড়েছে। ফলে যে ব্যয়টা গত বছর করতে পারত, সেটা এ বছর করতে না পেরে মানুষ ব্যয় কাটছাঁট করবে। আয় অনুযায়ী ব্যয়।

এদিকে সরকার কী করে? সে প্রথমে ব্যয় ঠিক করে। সরকারের দুই ধরনের ব্যয় হচ্ছে প্রধান। একটা হচ্ছে রাজস্ব ব্যয়, অর্থাৎ যে ব্যয়গুলো তার প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার মধ্যে খরচ করতেই হয়, যেমন: বেতন, ভাতা, শিক্ষা, চিকিৎসা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রশাসনের জন্য নিয়মিত ব্যয় যেটা চলতি খরচ, এগুলোকে বলা হয় রাজস্ব ব্যয়।

আরেকটা হচ্ছে উন্নয়ন ব্যয়। সরকার কী কী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করবে। সেতু করবে, সড়ক করবে কিংবা বিদ্যুৎকেন্দ্র করবে; শিক্ষা-চিকিৎসায় কী কী ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করবে, তার ওপর নির্ভর করবে উন্নয়ন ব্যয়। অর্থাৎ, নতুন কোনো প্রোগ্রাম-প্রকল্প-নির্মাণ, নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি, নতুন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, এগুলোর পরিচয় হচ্ছে উন্নয়ন ব্যয়।

প্রতিটি সরকার তার নীতি ও দর্শন অনুযায়ী এই ব্যয়ের একটা ছক তৈরি করে। রাজস্ব ব্যয় আগের বছরের থেকে বাড়ে যদি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি পায়, নতুন করে গাড়ি বা মোবাইল বা অন্য কোনো প্রাপ্তি যুক্ত হয় তাহলে। আর উন্নয়ন ব্যয়ের ছকে থাকে, নতুন কী কী প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, কিংবা পুরোনো কী কী প্রকল্প বাকি আছে যেটা বাস্তবায়ন হয়নি, এই বছর বাস্তবায়ন করতে হবে এসব।

ব্যয়টা প্রথমে ঠিক করার পর সরকার হিসাব করবে এই টাকাটা কোথায় পাওয়া যাবে। এই টাকা আয়ের প্রধান পথ হচ্ছে জনগণের কাছ থেকে পাওয়া কর, ফি ইত্যাদি। যদি দেখা যায়, এই উৎসের আয়ে হিসাব কুলাচ্ছে না, তখন সরকার ঋণ করে। আর ব্যক্তি বা পরিবারের যে বাজেট, সেখানে সে আয় অনুযায়ী ব্যয়ের পরিকল্পনা করে। এবং সে ইচ্ছা করলেই নতুন করে কোনো আয় করতে পারে না। সে এই ক্ষমতার বাইরে থাকে। অর্থাৎ, সরকার প্রথমে ব্যয় ঠিক করে তার নীতি ও দর্শনের অগ্রাধিকার অনুযায়ী, তারপর সে অনুযায়ী আয় করতে গিয়ে জনগণের ওপর নতুন করের বোঝা চাপায়, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ায় এবং দেশের অভ্যন্তর থেকে ঋণ নেয়। যদি তাতেও না কুলায় তখন বৈদেশিক ঋণ নেয়। এবং অন্যান্য জায়গা থেকে আয়ের উৎস খুঁজতে থাকে। সরকারের বাজেটের সঙ্গে ব্যক্তি বা পরিবারের বাজেটের এটা একটা বড় তফাত। মানে ব্যয় অনুযায়ী আয়।

আরেকটা তফাত হলো ঋণের চাপ বহন। ঋণ নিয়ে একটা গল্প আছে, যা আমরা ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি। এখন আছে কি না জানি না। গণি মিয়ার গল্প। গণি মিয়া একজন অপচয়কারী ও অদূরদর্শী কৃষক, যিনি ঋণ করে ঘি খেতেন। সে সময় ঘি একটি দামি বিলাসসামগ্রী হিসেবে বিবেচিত ছিল, ধনী লোকের খাদ্য ছিল। তো গরিব কৃষক গণি মিয়া ঋণ করে ঘি খেতেন। এভাবে ঋণ করে ঘি খেতে খেতে একটা সময় ঋণের জালে জড়িয়ে গণি মিয়া তার সমস্ত অর্থসম্পদ, জমি, বাড়ি সব হারান; নিঃস্ব হয়ে ঘি তো দূরের কথা তার ভাত খাওয়ারও আর উপায় থাকল না।

আমি একবার একটা লেখা লিখেছিলাম, গণি মিয়ার সঙ্গে মুহিত (সে সময়ের অর্থমন্ত্রী) সাহেবের তফাত কী। মুহিত সাহেবের জায়গায় এখন কামাল সাহেব ঋণ করছেন। গণি মিয়া ঋণ করে অপচয় করলে সেই দুর্ভোগ গণি মিয়াকেই পোহাতে হয়। কিন্তু একটা দেশের অর্থমন্ত্রী বা সরকার যখন ঋণ করে সেই বোঝা দেশের সব মানুষকে বহন করতে হয়। সরকার ঋণ করে, কিন্তু তাদের কিছুই পোহাতে হয় না; বরং তাদের আরাম-আয়েশ, সুযোগ-সুবিধা, বিদেশ সফর,‌ ধনসম্পদ, জৌলুস বাড়ে। বোঝাটা বহন করতে হয় জনগণকে।

গণি মিয়া ঋণ করে অপচয় করলে সেই দুর্ভোগ গণি মিয়াকেই পোহাতে হয়। কিন্তু একটা দেশের অর্থমন্ত্রী বা সরকার যখন ঋণ করে সেই বোঝা দেশের সব মানুষকে বহন করতে হয়। সরকার ঋণ করে, কিন্তু তাদের কিছুই পোহাতে হয় না; বরং তাদের আরাম-আয়েশ, সুযোগ-সুবিধা, বিদেশ সফর,‌ ধনসম্পদ, জৌলুস বাড়ে। বোঝাটা বহন করতে হয় জনগণকে।

আসলে সরকার তো কোনো স্থায়ী প্রতিষ্ঠান নয়। ফুলবাড়ীর এক কৃষক বলেছিলেন, ‘সরকার তো অস্থায়ী, আজ আছে কাল নাই, আমরা জনগণই আসল ও স্থায়ী সরকার, আমাদের কথাই শুনতে হবে।’ আসলেই তাই, সরকারের তো স্থায়ী কোনো দায়ও নেই, তারা তো অস্থায়ী। তারপরও এদের সিদ্ধান্তের চাপ জনগণের ওপর দিয়েই যায়। ঋণের বোঝা যদি বাড়ে, তাকে বাড়তি ট্যাক্স দিতে হয়।

এই দুটি হচ্ছে বড় পার্থক্য‒সরকারের বাজেটের সঙ্গে ব্যক্তি বা পরিবারের বাজেটের।

বাংলাদেশের অর্থবছর বা বাজেটের সময়কাল নিয়েও কথা বলতে চাই। বাংলাদেশে অর্থবছর হচ্ছে ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন। এটা চলে আসছে পাকিস্তান আমল থেকে। এর আগে ব্রিটিশ ভারতে অর্থবছর ছিল এপ্রিল থেকে মার্চ, ভারতে এখনো সেটাই চলছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এটি জুলাই থেকে জুন হয়, যা এখনো পাকিস্তানেও অব্যাহত আছে, বাংলাদেশেও। অস্ট্রেলিয়া-পাকিস্তানসহ কয়েকটি দেশেই শুধু এই জুলাই-জুন অর্থবছর হিসাব করা হয়।

এর পরিণতি আমরা প্রতিবছর দেখি। এক বছরে সরকারের যত উন্নয়ন প্রকল্প চলমান থাকে, সেগুলোকে একত্রে বলা হয় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি। অবকাঠামো, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-যোগাযোগ বা অন্য কোনো খাতে কতটা বরাদ্দ ছিল ও কতটা বাস্তবায়ন হলো তার হিসাব করা হয়। যদি বাস্তবায়ন বেশি হয়, তাহলে এটাকে একটা কৃতিত্ব হিসেবে দেখানো হয়। যদি ৮০-৯০ ভাগের কম খরচ হয়, তাহলে বলা হচ্ছে এটা বাস্তবায়নের সক্ষমতা কম। এটা হিসাব করা হয় জুন মাসে। কিন্তু আপনি যদি এপ্রিল বা মে বা তার আগের মাসে খোঁজ নেন, তাহলে দেখা যাবে তখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে হয়তো ৩০-৪০-৫০ ভাগ। কারণ, প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি, খরচও হয়নি। জুন মাসে যদি যান সরকারি অফিসে দেখবেন ভাউচার নিয়ে তুমুল দৌড়াদৌড়ি ব্যস্ততা চলছে। তাড়াতাড়ি বিভিন্ন ধরনের ব্যয় করা হচ্ছে যেগুলোতে খরচ বেশি। টাকা খরচ করার জন্য সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-কনফারেন্স হচ্ছে, রাস্তা কাটাকাটিসহ নানান কিছু হচ্ছে।

এবং সেই সময় আমাদের দেশে নামে বৃষ্টি। কিছু জায়গায় ভারি বর্ষণ হয়ে মেরামত কী হলো, কতটুকু কাজে লাগল সেটা তদারক করার কেউ থাকে না। এখন এ সময়ে যেমন সুনামগঞ্জ-সিলেট পুরো বন্যার মধ্যে ঢাকা পড়ে আছে। সুনামগঞ্জ-সিলেটে রাস্তাসহ যত অবকাঠামো নির্মাণ, সেগুলোর ভাউচার তো তুলতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বড় বাজেট থাকে, শুধু ভাঙন ঠেকানো আর বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামেই তারা প্রচুর প্রকল্প করে। বলে রাখি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের এসব প্রকল্পের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি এবং নদী ও পানি ব্যবস্থাপনার বিপর্যয়ের সরাসরি সম্পর্ক আছে বলে আমি মনে করি। তাই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেই যে তা ভালো কিছু হবে তা নিশ্চিত বলা যায় না।

যাই হোক, জুন মাসে এই প্রকল্পগুলোর কাজ ব্যাপকভাবে হয়, ফলে কিছু মানুষের সুবিধা হয় যে ১০ টাকার কাজ করে ১০০ টাকার ভাউচার জমা দিতে পারে, বৃষ্টির জন্য যে কাজটা হয়-ই-নি সেটারও ভাউচার দেয়া যায়। ফলে জুনের এক মাসেই প্রায় প্রকল্পের ৩০/৪০ ভাগ খরচ হয়। ফলে কী পরিমাণ অপচয় ও দুর্নীতি হয়, আমরা বুঝতেই পারি।

আমি এবং আরও কেউ কেউ অনেক দিন ধরে বলছি ও লিখছি এই অর্থবছর পরিবর্তন করার জন্য। কোনো যৌক্তিকতা নেই জুলাই-জুন অর্থবছরের। বাংলাদেশে হতে পারে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর, শেষ মাসেও যদি কাজ হয়, তাহলে ডিসেম্বর মাসে কাজ হওয়ার জন্য যথেষ্ট ঠান্ডা পরিবেশ থাকবে। আরেকটা হতে পারে বাংলা বছর অনুযায়ী, বাংলাদেশের কৃষিসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য জীবন-জীবিকার পরম্পরা অনুযায়ী সংগতিপূর্ণ করে চৈত্র-বৈশাখ, অর্থাৎ এপ্রিল-মার্চেও হতে পারে। কিন্তু এর কোনটাতেই সরকারের কোনো আগ্রহ নেই, এটা কোনো আলোচনার মধ্যেই নেই। কারণ, জুলাই-জুন অর্থবছর রাখলে শেষ কয়েক মাসে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়, এ বছরও হচ্ছে। এ বছরও তাই অর্থবছর নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।

কোনো যৌক্তিকতা নেই জুলাই-জুন অর্থবছরের। বাংলাদেশে হতে পারে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর, শেষ মাসেও যদি কাজ হয়, তাহলে ডিসেম্বর মাসে কাজ হওয়ার জন্য যথেষ্ট ঠান্ডা পরিবেশ থাকবে। আরেকটা হতে পারে বাংলা বছর অনুযায়ী, বাংলাদেশের কৃষিসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য জীবন-জীবিকার পরম্পরা অনুযায়ী সংগতিপূর্ণ করে চৈত্র-বৈশাখ, অর্থাৎ এপ্রিল-মার্চেও হতে পারে।

আমরা স্পষ্টই দেখি যে, একটা সরকারের এক বছরের বাজেটের ওপর নতুন কোনো কিছুই বলার উপায় থাকে না, কারণ এটা একটা সমগ্র ও ধারাবাহিকতার অংশ। যেমন, এখন বাংলাদেশে সরকারের অনেক ধরনের চুক্তি ও প্রকল্প রয়েছে যাতে আগামী ১০-১৫ বছর পর বাংলাদেশের কী হবে সেটাও নিশ্চিত করা আছে। সরকার পরিবর্তনের ফলে এসবের কোনো পরিবর্তন হয় না। আমাদের একটা ইল্যুশন আছে যে খালেদা সরকারের সময় এটা হলো, হাসিনা সরকারের সময় ওটা হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এটা হলো, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এমন অনেক ধরনের প্রকল্প কর্মসূচি আছে, যেগুলোর সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, এগুলো অবিরামভাবে চলছে।

এসব চলে কীভাবে? পরিচালিত হয় উন্নয়ন দর্শন দ্বারা। উন্নয়ন দর্শন কে ঠিক করে বাংলাদেশে? কোনো নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানে কি এগুলো আলোচনা হয়? যেমন ধরেন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। বড় বড় প্রকল্পের কথা হয়তো অনেকেই জানেন, কিন্তু সরকার কী কী পরিকল্পনা নিচ্ছে আগামী পাঁচ বছরের জন্য, কোথায় কোথায় অগ্রাধিকার দিচ্ছে, কোন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, সেগুলোর কোনোটাই কিন্তু জনগণের আলোচনার মধ্যে, জানার মধ্যে নেই। এগুলো দূরে রাখার জন্যই যেন সব দলিল হয় ইংরেজিতে। সেই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অধীন হচ্ছে একটা বছরের বাজেট। আবার অনেক কিছুই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাইরেও হয়।

বাংলাদেশের মানুষের জীবন এবং ভবিষ্যৎ নিরাপদ এবং সুস্থ রাখার জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আরেকটা খাত হলো খাদ্য। এই তিনটাকে পাশাপাশি দেখেন, এই যে শিক্ষা ও চিকিৎসার ক্রমান্বয়ে বাণিজ্যিকীকরণ হলো, এটা কোথায় আলোচনা করে ঠিক করা হয়েছে? জনগণের সঙ্গে কি কোনো পর্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে? এমনকি পার্লামেন্টেও কি কোনো আলোচনা হয়েছে? এখন বাংলাদেশে কোনো নির্বাচিত সংসদ নেই, একসময় যখন ছিল, সেসব সংসদেও কি কখনো আলোচনা হয়েছে যে এসব খাত কি আমরা বাণিজ্যিকীকরণ করব? করলে কী কী সুবিধা ইত্যাদি। তাহলে কোত্থেকে এই পরিকল্পনা হলো?

শিক্ষা দেশের ১৬/১৭ কোটি মানুষের সব পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত, সন্তানরা লেখাপড়া করবে, সেটার একটা পরিকল্পনা আছে, খরচ আছে; কোন বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করবে সেই সিদ্ধান্ত আছে। তো এই শিক্ষা যে কিনতে হবে আমাদের, কেনার প্রক্রিয়াটাই শক্তিশালী হবে, সরকার আর স্কুল করবে না, কলেজ করবে না, এবং বিশ্ববিদ্যালয় যেগুলো করবে সেগুলোও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে গড়ে তোলা হবে। এইসব পরিকল্পনা কে ঠিক করল তা আপনি খুঁজে পাবেন না। মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে প্রশ্ন করলে সে-ও বলতে পারবে না। আপনি যদি সঠিক উত্তর পেতে চান, তাহলে আপনাকে যেতে হবে বিশ্বব্যাংকের অফিসে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অফিসে।

তো এই শিক্ষা যে কিনতে হবে আমাদের, কেনার প্রক্রিয়াটাই শক্তিশালী হবে, সরকার আর স্কুল করবে না, কলেজ করবে না, এবং বিশ্ববিদ্যালয় যেগুলো করবে সেগুলোও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে গড়ে তোলা হবে। এইসব পরিকল্পনা কে ঠিক করল তা আপনি খুঁজে পাবেন না। মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে প্রশ্ন করলে সে-ও বলতে পারবে না। আপনি যদি সঠিক উত্তর পেতে চান, তাহলে আপনাকে যেতে হবে বিশ্বব্যাংকের অফিসে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অফিসে।

২০০০ সালে বিশ্বব্যাংক শিক্ষা খাত নিয়ে কয়েক খন্ডে দলিল প্রকাশ করে। সেখানে যা যা বলা হয়েছিল, সেগুলোই কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমরা দেখছি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভেতরে ভেতরে প্রাইভেটাইজেশন হচ্ছে। সরকার নতুন স্কুলকলেজের পেছনে পয়সা খরচ করছে না। শিক্ষাখাতে বরাদ্দও কমিয়ে রাখছে।

পৃথিবীর মধ্যে তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম সরকারি মাধ্যমিক স্কুল বাংলাদেশে। মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকার কোনো স্কুলই করতে চায় না। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা সব জায়গায় সরকারি মাধ্যমিক স্কুল অনেক বেশি। বাংলাদেশে এমপিওভুক্তি দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু শিক্ষাখাতকে রাষ্ট্রের জনগণের অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার কোনো পরিকল্পনা, অগ্রাধিকার, বরাদ্দ কখনোই ঠিকমতো দেওয়া হয়নি। অর্থনীতিবিদদের একটা সমস্যা হচ্ছে তারা সবসময় শুধু পরিসংখ্যান দেখেন। পরিসংখ্যানের বাইরে ও ভেতরে যে আরও বিষয় থাকে, সেগুলোর প্রতি মনোযোগ খুব কম থাকে।

শুধু বরাদ্দ দেখলে হবে না, দেখতে হবে কোন কাজে তা খরচ হয়েছে। শিক্ষাখাতে বরাদ্দ আন্তর্জাতিক বিধি অনুযায়ী জিডিপির ৬ শতাংশ হওয়ার কথা। জিডিপি বলতে আমরা যে ধারণা পাই, তা বছরে একটা দেশে অর্থনৈতিক তৎপরতার আর্থিক মূল্য। আরেকটা ধারণা আছে জিএনআই‒গ্রস ন্যাশনাল ইনকাম বা জাতীয় আয়। বিদেশে যারা কর্মরত, তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স এই আয়ের অন্তর্ভুক্ত। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটা বিধি হলো এই জাতীয় আয়ের ছয় ভাগ শিক্ষাখাতে ব্যয় করা উচিত। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এটা শতকরা দুই ভাগের নিচে। এ বছরের বাজেটেও শিক্ষা ও প্রযুক্তি দুই খাতকে এক করে বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে। ফলে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এ খাতের ভেতরে রাখা হয়েছে মেগা প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। রূপপুর প্রকল্প কীভাবে শিক্ষাখাতে ঢুকল? ওই প্রকল্প যোগ করে শিক্ষাখাতের বাজেট দুই ভাগের বেশি, বাদ দিলে দুই ভাগের কম। এই যে দুই ভাগের কম বরাদ্দ, এটা খরচ হচ্ছে কীভাবে? যেমন, জাহাঙ্গীরনগর ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এই যে বড় বড় নির্মাণকেন্দ্রিক তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, এগুলোর সব শিক্ষাখাতের বরাদ্দ বলা যাবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যে বিভিন্ন ধরনের অপচয়, শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমনসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এসবের ব্যয়কে যোগ করলে দেখা যাবে শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে প্রকৃত ব্যয় দুই ভাগের অনেক কম। বিশ্ববিদ্যালয়ের এরকম অভিজ্ঞতা আছে, ঋণের টাকায় অনেক জিনিসপত্র কেনা হয়, কিন্তু সেগুলো চালানোর ব্যবস্থা হয় না। অনেকক্ষেত্রে দক্ষ লোক নাই। তার মানে কেনা ও ব্যবহারের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নেই।

স্বাস্থ্যখাতেও জাতীয় আয়ের ছয় ভাগ বরাদ্দ হওয়া উচিত ধরা হয়। এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্যখাতে সরকারের ব্যয় শতকরা এক ভাগেরও কম। যেখানে ছয় ভাগ হওয়ার কথা। এই যে এক ভাগেরও কম, এটা বলেই ইতি টানলে হবে না, যেটা অর্থনীতিবিদরা করে থাকেন। দেখতে হবে, সেই এক ভাগও কীভাবে বরাদ্দ হচ্ছে, কীসে খরচ হচ্ছে। গত এক/দুই বছরে, বিশেষত করোনাকালে, পত্রিকায় কিছু কিছু রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, আপনারা দেখেছেন যে সেই ব্যয়গুলোর মধ্যে কী ধরনের অনিয়ম, অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতি আছে। সরকারের মন্ত্রী, আমলা, কনসালট্যান্টদের দেখবেন দুটি কাজে খুব আগ্রহ। একটা হচ্ছে নির্মাণ, আরেকটা কেনাকাটা। তো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনেক কেনাকাটা হয়েছে। এখনো যদি কোনো হাসপাতালে যান, সেখানে দেখবেন অনেক ধরনের সরঞ্জামের বাক্সটাই এখন পর্যন্ত খোলা হয়নি। কেনার পর সেটা নিয়ে আর কোনো আগ্রহ নেই। একটা প্রকল্প নিয়ে হয়তো সেটা কেনা হয়েছে, কিন্তু সেটা চালানোর যে লোকবল সেটা নেই। তো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সময়ের কেনাকাটার দুর্নীতির কথা আমরা জানি, করোনার সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র কেনা হয়েছে, সেগুলো কেনার জন্য সরকারি লোকজন বিদেশ যান। কিন্তু সেগুলো কেনার পর আর কোনো ব্যবহার হয় না। অর্থাৎ, যেই বরাদ্দটা দেখছি এক শতাংশেরও কম, সেটাও মানুষের কাছে পৌঁছায় না।

সরকারের মন্ত্রী, আমলা, কনসালট্যান্টদের দেখবেন দুটি কাজে খুব আগ্রহ। একটা হচ্ছে নির্মাণ, আরেকটা কেনাকাটা।

চিকিৎসাখাতে বাংলাদেশের মানুষের যে ব্যয়, সেই ব্যয়ের গড়ে ৮০ ভাগ মানুষের নিজস্ব পকেট থেকে যায়, মানে ব্যক্তিগত খরচ থেকে দিতে হয়। আর সরকারের যে ব্যয়, সেটা ১৫-২০ ভাগ। করোনার একটা বার্তা ছিল, বলা যায় একটা বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত তৈরি হয়েছিল যে চিকিৎসা, স্বাস্থ্যসেবা কোনো ব্যাবসার ব্যাপার হতে পারে না। সর্বজনের স্বাস্থ্য রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে থাকতে হবে। এই বার্তা বাংলাদেশের কাছেও এসেছে, কিন্তু বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাত নিয়ে যেসব তৎপরতা, সেখানে আমরা এটার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক দেখি না। করোনার মধ্যে যে বাজেট দেওয়া হয়েছে, সেখানেও এর কোনো প্রতিফলন ছিল না। এ বছরও বাজেটের আগে আগে করোনা যখন আবার চতুর্থ ওয়েভে বিস্তার লাভ করছে, তখনো স্বাস্থ্যখাতের বাজেটে অগ্রাধিকার, টাকার অঙ্কে বরাদ্দ ও বরাদ্দের টাকা খরচ করার যে এলাকা, দুটোর কোনো ক্ষেত্রেই এমন কোনো ইঙ্গিত নেই যে স্বাস্থ্যসেবা মানুষের অধিকার। তাহলে এই যে স্বাস্থ্যখাতের পুরোপুরি বাণিজ্যিকীকরণ হলো এর সিদ্ধান্ত কোথায় হলো?

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, যিনি এ মুহূর্তে দিল্লিতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাকেও সহকর্মী  শিক্ষকদের কাছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ধরা হয় সমাজের প্রথম শ্রেণির একজন পেশাজীবী। অথচ চিকিৎসার জন্য তাকেও হাত পাততে হয়, চিকিৎসার নিশ্চয়তা তারও নেই। তাহলে বাকি যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, তাদের চিকিৎসার কী অবস্থা? অথচ স্বাস্থ্যখাতে আমরা অনেক সাফল্যের কথা শুনতে পাই।

এবারের বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ হলো ৩৬ হাজার কোটি টাকা। করোনার আগে একটা গবেষণার রিপোর্টে বের হয়েছিল যে বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়ে মানুষ চিকিৎসায় ব্যয় করে বছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা। কী নির্মম পরিস্থিতি! মানুষ কী কারণে চিকিৎসার জন্য ভারতে যায়? কারণ, এখানে পাবলিক বা সর্বজন স্বাস্থ্যব্যবস্থা দাঁড়ায়নি, সে জন্যই যায়। আস্থাও তৈরি হয়নি। আস্থা কীভাবে তৈরি হবে, একটা দেশের রাষ্ট্রপতিকে যদি এক মাস/দু-মাস পরপর মেডিকেল চেকআপের জন্য বিদেশ যেতে হয়, তার মানে তিনি ধরেই নিয়েছেন তার মেডিকেল চেকআপ করার মতো প্রতিষ্ঠানও বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। আমি ভাবি, একটা দেশের রাষ্ট্রপতি অন্য আরেকটা রাষ্ট্রে যাচ্ছেন মেডিকেল চেকআপের জন্য, এতে অন্যরা তার সম্পর্কে কী ভাবছে সেটা বোঝার ক্ষমতা কি তার হয় না? কোনো লজ্জাবোধ হয় না যে একটা দেশ ৫০ বছর পার করেছে, আমরা এত উন্নয়নের কথা শুনি, এত আমাদের সাফল্য, বাংলাদেশ একটা রোল মডেল হয়ে যাচ্ছে, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড ক্যালিফোর্নিয়া হয়ে যাচ্ছে অথচ সেখানকার রাষ্ট্রপতিকে মেডিকেল চেকআপের জন্য (বড় ধরনের কোনো চিকিৎসাও নয়) অন্য দেশে যেতে হয়! এই যে খরচ, তার প্রতিটা মেডিকেল চেকআপের সমস্ত খরচ আমাদের দিতে হয়। এই যে একটা প্রতিষ্ঠান, একটা হাসপাতাল তৈরি হলো না তা তো এই উন্নয়ন ধরনেরই ফলাফল! আমরা প্রধানমন্ত্রীর বাণী দেখি সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে: ‘অসুস্থ হলে আমাকে বিদেশে নেবেন না, আমি দেশের মাটিতেই চিকিৎসা নেব।’ কিন্তু এটা লাগানোর পরপরই তিনি বিদেশ গিয়েছিলেন চক্ষু চিকিৎসার জন্য। সে সময় ঢাকায় আমার চোখ দেখাতে গিয়ে প্রবীণ চক্ষু চিকিৎসককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম: ‘আপনারা কি চোখের চিকিৎসার জন্য সেই দক্ষতা এখনো অর্জন করতে পারেননি যে প্রধানমন্ত্রীর চক্ষু চিকিৎসা করতে পারেন?’ সেই ভদ্রলোক প্রশ্ন শুনে আতঙ্কিত হয়ে গেলেন মনে হলো, এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন, তার পরিণতি কী হবে, তার ক্লিনিক থাকবে কি না ইত্যাদি। তিনি তাড়াতাড়ি বললেন, ‘আপনার চশমাটা খোলেন, কী সমস্যা বলেন!’

একটা দেশের রাষ্ট্রপতি অন্য আরেকটা রাষ্ট্রে যাচ্ছেন মেডিকেল চেকআপের জন্য, এতে অন্যরা তার সম্পর্কে কী ভাবছে সেটা বোঝার ক্ষমতা কি তার হয় না? কোনো লজ্জাবোধ হয় না যে একটা দেশ ৫০ বছর পার করেছে, আমরা এত উন্নয়নের কথা শুনি, এত আমাদের সাফল্য, বাংলাদেশ একটা রোল মডেল হয়ে যাচ্ছে, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড ক্যালিফোর্নিয়া হয়ে যাচ্ছে অথচ সেখানকার রাষ্ট্রপতিকে মেডিকেল চেকআপের জন্য (বড় ধরনের কোনো চিকিৎসাও নয়) অন্য দেশে যেতে হয়!

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো দুটি গুরুতর বিষয়ে আমরা আছি এ অবস্থায়। কিন্তু এসব খাতের ব্যাবসা দারুণভাবে বেড়েছে।

এই ব্যাবসার সঙ্গে জিডিপি বৃদ্ধির একটা সম্পর্ক আছে। আমরা জিডিপি বৃদ্ধির অনেক কাহিনি শুনি, এটা ৬-৭-৮ ভাগ বেড়েছে, পৃথিবীর মধ্যে উপরের দিকে সামনের সারিতে। এখন যদি বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নেয় যে শিক্ষাখাতের বাণিজ্য আর থাকবে না, রাষ্ট্রই এর দায়িত্ব নেবে। চিকিৎসা খাতেও রাষ্ট্র সব দায়িত্ব নেবে ও উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করবে, এর জন্য রাষ্ট্রই বরাদ্দ দেবে। তাহলে কিন্তু জিডিপি কমে যাবে। কারণ, জিডিপি বাড়ে তখনই, যখন যেকোনো কাজে আর্থিক লেনদেন হয়। জিডিপি বাড়ছে কারণ, শিক্ষাখাতে অনেক আর্থিক লেনদেন হচ্ছে, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, কিন্ডারগার্টেন, স্কুল-কলেজের দিকে তাকালে দেখা যায়, মানুষ অনেক টাকা খরচ করে সন্তানদের লেখাপড়া শেখাচ্ছে।

সন্তানের শিক্ষা এবং পরিবারের চিকিৎসা–এই দুটো জায়গা হচ্ছে মানুষের খুব কোমল জায়গা। এই দুটো জায়গায় মানুষ খরচে দ্বিধা করে না। এর পরিমাণ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে ঋণ করে, জিনিসপত্র বিক্রি করে। যা যা করা সম্ভব সন্তানের লেখাপড়ার জন্য সব করে। কারণ, লেখাপড়া করা ছাড়া তার সামাজিক অবস্থান পরিবর্তন করা যাচ্ছে না, সোশ্যাল ক্লাইম্বিং এ ঢোকা যাচ্ছে না। ফলে শিক্ষাখাতে খরচ করার জন্য সে জীবন পণ করে, দরকার পড়লে অনেক বেশি পরিশ্রম করে, ঋণ নেয়, দরকার পড়লে সবকিছু বিক্রি করে। চিকিৎসার জন্যও মানুষ এটা করে। মানুষের কোমল ও দুর্বল জায়গা হিসেবেই শিক্ষা ও চিকিৎসা খাত ব্যাবসা হিসেবে ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। সেখানে আপনি বিজ্ঞাপন দেখছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, বিশ্ববিদ্যালয়ের, স্বাস্থ্যখাতের। পরিণতি কী হচ্ছে? পরিণতি হচ্ছে, শিক্ষা একটা বড় ধরনের নৈরাজ্যের মধ্যে পড়েছে।

করোনার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর অন্যতম হচ্ছে শিক্ষাখাত। পুরো করোনার সময় এই অনলাইন ক্লাস ও অন্যান্য শিক্ষার চিত্র খুবই খারাপ। একটা স্কুলের একজন প্রধান শিক্ষয়িত্রী টেলিভিশনে কথা বলছিলেন দেখছিলাম। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে: ‘আপনার স্কুলে কি অনলাইনে ছাত্রছাত্রীরা পড়েছে?’ উনি বলছেন: ‘না, কীভাবে পড়বে, তাদের তো ওই রকম জিনিসপত্র নাই। তা ছাড়া শিক্ষকরাও তো জানে না অনেক কিছু। শিক্ষকদের পক্ষেই তো অনলাইন ক্লাস নেওয়া মুশকিল।’ তারপর প্রশ্ন: ‘তাহলে পাসের হার কীরকম?’ উত্তর: ‘আলহামদুলিল্লাহ, শতকরা ১০০ ভাগ। আর এ-প্লাসও অনেক পেয়েছে।’ এই যে ঘটনাগুলো, পড়াশোনা হচ্ছে না, কিন্তু একটা রেজাল্ট আমরা পাচ্ছি। পরিসংখ্যানের প্রতি সরকারের একটা আগ্রহ-উচ্ছ্বাস, কত পার্সেন্ট পাস করল, কিন্তু তার মধ্যে শিক্ষার কোনো অবস্থাই দাঁড়াচ্ছে না। স্বাস্থ্যখাতও তা-ই।

এই দুটো খাতের দুর্বলতার পাশাপাশি আমরা যদি সরকারের এবারের বাজেটের অগ্রাধিকারগুলো অনুসন্ধান করি, তাহলে দেখব রাজস্ব ব্যয়ের মধ্যে জনপ্রশাসন খাতে ব্যয় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। আমরা এখন এমন একটা পরিস্থিতিতে আছি, যখন বৈশ্বিক সংকটের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। পুরো পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার বড় ধরনের সংকট যে রকম ২০০৭-০৮ সালে একবার হয়েছিল। সামনে আবার দেখতে পাচ্ছি, যেটাকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আরও বাড়িয়েছে।

স্ট্যাগফ্লেশন। এই সংকটের ধরন যেরকম তাতে এটা শুধু মুদ্রাস্ফীতি নয়, শুধু মন্দা নয়। মুদ্রাস্ফীতিকে অনেক সময় বলা হয় সরকারের ‘ট্যাক্সেশন উইদাউট ডিক্লারেশন’। অর্থাৎ, মুদ্রাস্ফীতির মধ্য দিয়ে রুলিং ক্লাস কিংবা ক্ষমতাবান শ্রেণি এমনকি সরকার যথেষ্ট লাভবান হয়। কারণ, মানুষের কাছ থেকে আরও বেশি সম্পদ নেওয়া তাদের জন্য তখন সহজ হয়। এই মুদ্রাস্ফীতি যখন ব্যাপক আকার ধারণ করে, তখন একে দূর করার জন্য সরকার কিছু পদক্ষেপ নেয়, সংকোচনমূলক অর্থনীতি মানে এমনভাবে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয় যেন ব্যয় তুলনামূলক কম হয়, মানুষজন তুলনামূলক কম ব্যয় করে, যাতে মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনা যায়। আরেকটা হচ্ছে মন্দা। মন্দাটা হচ্ছে এর বিপরীত। যখন অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে আসছে, মানুষ খরচ কম করছে, বিনিয়োগ কম হচ্ছে, বেকারত্ব বাড়ছে, মানুষের আয় কম হচ্ছে‒এ রকম একটা পরিস্থিতি হচ্ছে মন্দা। এখনকার যে সংকট আমরা দেখতে পাচ্ছি, এটা হচ্ছে এই দুটির সংমিশ্রণ। এর নাম হলো স্ট্যাগফ্লেশন। মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব-বিনিয়োগ সংকট একসাথেই চলছে। এটা একটা বিপজ্জনক পরিস্থিতি। যখন মুদ্রাস্ফীতি হয়, তখন মন্দার কিছু ইনস্ট্রুমেন্ট ব্যবহার করে মুদ্রাস্ফীতি দূর করা হয়। আবার যখন মন্দা হয়, তখন মুদ্রাস্ফীতির কিছু ইনস্ট্রুমেন্ট ব্যবহার করে মন্দাটা দূর করা হয়। দুটি যখন একসঙ্গে হয়, তখন আপনি কী চিকিৎসা করবেন।

বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে সরকারের একটা হিসাব পাই। মুদ্রাস্ফীতি মানে আমরা যে টাকাটা ব্যবহার করি তার ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া। একটা অঙ্ক সরকার বলেই যাচ্ছে, বলছে পাঁচ শতাংশের আশেপাশে। কিন্তু বাস্তবে আমরা যখন বাজারে যাই, তখন দেখি এটা অনেক বেশি। আমরা বেগুন, আলু, চাল, চিনি কিনি বা বাসে উঠে ভাড়া দিই, সবকিছুর মধ্যে দেখা যায় এটা অনেক বেশি। সে জন্য সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে হিসাবে ১০-১৫ ভাগ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে, কোনো কোনো খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে এটা ৩০-৪০ ভাগ। এটা যদি ভেঙে ভেঙে বিভিন্ন পণ্যে দেখি, তাহলে দেখা যায় অনেক বেশি।

আরেকটা জায়গা বৈদেশিক মুদ্রা, শ্রীলংকা বা তুলনীয় অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের রিজার্ভ অনেক ভালো। তার মধ্যেও একটা নিম্নমুখী প্রবণতা গত কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে।

বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের উৎস কী? প্রধান দুটি খাত‒একটি হচ্ছে রপ্তানি আয়, আরেকটি প্রবাসী আয়। এই দুটো আয়ের সঙ্গে যুক্ত আছে বাংলাদেশের দুই ধরনের শ্রমিক। একটা হচ্ছে পোশাক শ্রমিক, সরকার বা বিজিএমইএর হিসাবে প্রায় ৪০ লাখ। আর প্রবাসী শ্রমিক, যার সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। প্রবাসী শ্রমিকরা যে টাকাটা পাঠান, রেমিট্যান্স; অর্থাৎ আমাদের আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয় এই দুয়ের মধ্যে যে ব্যবধান, সেই ব্যবধান পূরণের অন্যতম আশ্রয় হচ্ছে আমাদের প্রবাসী আয়, তার মধ্যেও একটা নিম্নমুখী প্রবণতা এখন দেখা যাচ্ছে। এই দুইটার যদি নিম্নমুখী প্রবণতা হয়, তাহলে রিজার্ভেও একটা চাপ পড়ার কথা।

তাহলে এই যে মুদ্রাস্ফীতির অবস্থা, স্ট্যাগফ্লেশনের পরিস্থিতি এবং বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ, এই চাপটা আরও বাড়বে। এদিকে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। আমদানি ব্যয় বাড়ার দুটো কারণ: এক. আমাদের টাকার মান ডলারের তুলনায় কমে যাচ্ছে, দুই. আন্তর্জাতিকভাবে যে সাপ্লাই চেইন, সেটা কাজ করছে না বলেও অনেক জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সেটা আরও বেড়েছে। তার মানে, আমদানি পণ্যের মূল্য সামনে আরও বাড়বে। আমাদের মতো দেশ যাদের অনেক কিছু আমদানি নির্ভর, এমনকি আমাদের যে রপ্তানি আয় হয়, সেটাও আমদানির সঙ্গে সম্পর্কিত। আমাদের যে পোশাক রপ্তানি আয় হয়, সেটা পাটের মতো নয়। পাট থেকে রপ্তানি হলে সেই আয়ের শতভাগ বাংলাদেশ পায়। গার্মেন্টস থেকে যে আয় তার শতভাগ বাংলাদেশে আসে না। গার্মেন্টসের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, ডিজাইন এগুলো তো আমদানি করতে হয়। এগুলো প্রায় ৩০-৪০ ভাগ। গার্মেন্টস খাতে আমাদের যে আয়, তা প্রকৃতপক্ষে ১০০ টাকায় ৬০-৭০ টাকার মতো। আর প্রবাসী শ্রমিকরা যা পাঠাচ্ছেন, সেটা শতভাগ। তো প্রবাসী শ্রমিক ও পোশাকশ্রমিক যাদের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার বড় মজুত, তাদের জন্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতি কী, পরিকল্পনা কী, বাজেটে তাদের জন্য কী প্রস্তাব আছে‒খুঁজে পাবেন না কিছুই এবং তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনাও নেই।

প্রবাসী শ্রমিক ও পোশাকশ্রমিক যাদের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার বড় মজুত, তাদের জন্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতি কী, পরিকল্পনা কী, বাজেটে তাদের জন্য কী প্রস্তাব আছে‒খুঁজে পাবেন না কিছুই এবং তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনাও নেই।

উলটো আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, প্রতিবছর ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার প্রবাসী শ্রমিকের লাশ আসে, যাদের বয়স সাধারণত ২৫-৩৫ বছর। এই বয়স স্বাভাবিক মৃত্যুর বয়স নয়। কী কারণে তাদের মৃত্যু হচ্ছে, সেটার সরকারি কোনো ব্যাখ্যাও ঠিকমতো নেই। অনুসন্ধানে যতটা দেখা যায়, তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণগুলো হলো: স্ট্রেস, চিকিৎসাহীনতা, খাবারের সমস্যা এবং সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তা। তারা টাকা পাঠানোর জন্য খাওয়া কমাচ্ছে, সবসময় একটা চাপের মধ্যে থাকছে, তাদের খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থাও ঠিক নেই, তাদের চিকিৎসারও নিশ্চয়তা নেই। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে কোথাও বিনা চিকিৎসায়, কোথাও খাদ্যের অভাবে, কোথাও মানসিক চাপের কারণে এবং বিভিন্ন ধরনের অনিশ্চয়তার চাপে এই যে মৃত্যুগুলো ঘটছে, এটার কোনো স্বীকৃতি বা তার সমাধানের কোনো চেষ্টা সরকারের মধ্যে নেই। এত মানুষ মারা যাচ্ছে, তাদের ব্যাপারে কী করা হবে, বাজেটেও তাদের ব্যাপারে কোনো বরাদ্দ বা কর্মসূচি আমরা দেখি না।

যাই হোক, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর যে চাপ পড়ছে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে, আমদানি ব্যয় বাড়ছে এর কোনো প্রতিফলন কি বাংলাদেশ সরকারের বাজেট বরাদ্দের মধ্যে আছে? কাণ্ডজ্ঞান বলে, এই পরিস্থিতিতে প্রথম দরকার জনপ্রশাসনের ব্যয় কমানো, সেটা কমেনি। আমদানি ব্যয় যেহেতু বেড়ে যাচ্ছে সব জায়গায়, সেহেতু আমদানি ব্যয় কমাতে হবে। আমরা দেখি, বিভিন্ন দেশে আমাদের সরকারি যে প্রতিনিধিদল যায়, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যায়, অন্যান্য মন্ত্রীর সঙ্গে যায়, প্রতিনিধিদলের সংখ্যা… সারা পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশ তো বিভিন্ন ক্ষেত্রে রোল মডেল, এ ক্ষেত্রেও রোল মডেল। এতসংখ্যক মানুষ কোনো দেশের প্রতিনিধিদলে যায় না। অন্য দেশ থেকে হয়তো ১০-১৫ জন যাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছে ১০০ জন। তাদের মধ্যে কেউ হয়তো প্রশিক্ষণে যাচ্ছেন, প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে এসে অবদান রাখবেন বলে, অথচ তার হয়তো অবসর নেওয়ার আর এক দিন বাকি আছে, এসেই তিনি অবসর গ্রহণ করবেন।

কিছুদিন আগেই শুনলাম, যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা দেখতে একদল গেছে ওয়াশিংটন। প্রতিনিধিদলের একজনের সঙ্গে আমাদের এক বন্ধুর দেখা হয়েছে। জিজ্ঞেস করায় বলছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষা কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হয়, তা দেখতে এসেছি।’ তো তখন মাসটা কী? জুলাই মাস, যখন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ।

কিছুদিন আগেই শুনলাম, যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা দেখতে একদল গেছে ওয়াশিংটন। প্রতিনিধিদলের একজনের সঙ্গে আমাদের এক বন্ধুর দেখা হয়েছে। জিজ্ঞেস করায় বলছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষা কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হয়, তা দেখতে এসেছি।’ তো তখন মাসটা কী? জুলাই মাস, যখন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ।

এ রকম নানান কর্মসূচি হয়। কয়েক দিন আগে শুনলাম প্রধানমন্ত্রী বলছেন, আমাদের এখন বিদেশ সফর কমাতে হবে। কতটা কমবে সেটা আমরা জানি না। এদিকে আবার বাজেটে জনপ্রশাসনের ব্যয় কমানো হয়নি, বাড়ানো হয়েছে। আমদানি কমানো দরকার, যেমন: অপ্রয়োজনীয় কী কী ধরনের আমদানি হয়, ঘোষণা ছাড়া কী কী ধরনের আমদানি হয়। সীতাকুণ্ডের ঘটনাটা যদি দেখি, সেখানে কোন ধরনের কেমিক্যাল ছিল, সেটা কেউ জানে না। ওইখানে প্রশাসনের কোনো কোনো কর্মকর্তা জানেন, বাকি কেউ জানত না, ফায়ারব্রিগেড জানত না। এত যে মানুষ মারা গেল তার একটা বড় কারণ হলো, এই তথ্যটা জানা ছিল না। এমন অনেক কিছু আমদানি ও রপ্তানি হচ্ছে, যেগুলোর তথ্যটা প্রকাশিত নয়। এর জন্য যে কোনো বিচারও নেই, সীতাকুন্ড তার প্রমাণ।

আপনারা খেয়াল করছেন কি না, আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে ইনস্টলড ক্যাপাসিটি আছে, সেটা প্রায় ২৫-২৬ হাজার মেগাওয়াট। বিপরীতে আমাদের চাহিদা হচ্ছে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। তার মানে, চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। সেখানে বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বসিয়ে বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা দিতে হচ্ছে। সেটার পরিমাণ গত বছর ও তার আগের বছর ছিল প্রায় নয় হাজার কোটি টাকার মতো। এ রকম যখন অবস্থা, বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত উৎপাদন ক্ষমতা এবং আমদানি কমানো দরকার; সেখানে ভারত থেকে ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে; এবং সামনে আদানির কাছ থেকেও বিদ্যুৎ আমদানি করার চুক্তি আছে। আদানি ভারতের খুবই ক্ষমতাবান ব্যাবসায়িক গোষ্ঠী, নরেন্দ্র মোদির খুব ঘনিষ্ঠ, মোদি যখন এখানে সফর করেছিলেন তখন এই প্রকল্প নিয়ে কথা হয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী কয়েক দিন আগে বলেছেন, মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা হবে না এ কারণে যে, মেগা প্রকল্পগুলোর সব কাগজপত্র ঠিক আছে। খরচসহ অন্যান্য ফিজিবিলিটি স্টাডি, কস্ট বেনিফিট এনালাইসিস সব বুঝেশুনে ঠিকমতো করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই কথা মোটেও ঠিক নয়।

এখানেই আসে মেগা প্রকল্পের কথা। প্রধানমন্ত্রী কয়েক দিন আগে বলেছেন, মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা হবে না এ কারণে যে, মেগা প্রকল্পগুলোর সব কাগজপত্র ঠিক আছে। খরচসহ অন্যান্য ফিজিবিলিটি স্টাডি, কস্ট বেনিফিট এনালাইসিস সব বুঝেশুনে ঠিকমতো করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই কথা মোটেও ঠিক নয়। বাংলাদেশে যত মেগা প্রকল্প হয়েছে ও হচ্ছে, তার কোনোটিরই কাগজপত্র ঠিক নেই। নেই মানে কী, কাগজপত্র তো চাইলেই বানানো যায়। জুন মাসে যেমন প্রচুর কাজ হচ্ছে কাগজপত্র বানিয়ে, ওইভাবে তো বানানোই যায়। কোনো ধরনের বড় প্রকল্প করলে তার জন্য দরকার হয় ফিজিবিলিটি স্টাডি, এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট, পাবলিক কনসালটেশন অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট জনগণের মতামত ও সম্মতি দরকার হয়। অর্থাৎ, যে অঞ্চলে প্রকল্প হবে সেখানকার মানুষকে জানাতে হবে কী হতে যাচ্ছে, তাদের সম্মতি নেওয়ার প্রয়োজন আছে, স্বচ্ছতা থাকতে হবে। বাংলাদেশের বৃহত্তম মেগা প্রজেক্ট রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। লক্ষাধিক কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, যার বড় অংশ ঋণ করে নেওয়া হচ্ছে। ঋণটা নেওয়া হচ্ছে রাশিয়ার কাছ থেকে, সেখানে কাজ করছে রাশিয়ান কোম্পানি, রাশিয়ান ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য রাশিয়ান মানুষ। গত কিছু দিনে সেখানে যে বেশ কজন মানুষ মারা গেল, তার সম্পর্কে আমরা ঠিকমতো কোনো তথ্য জানি না। সেখানে সাংবাদিকদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। ওই এলাকায় মানুষ কখনো রূপপুর নিয়ে কথাবার্তা বলতে পারেনি। আমরা কয়েকবার চেষ্টা করেছি, ওই এলাকার মানুষের পক্ষে সম্ভবই নয় ওই প্রকল্প নিয়ে কোনো কথা বলা। আশপাশের যারা মানুষ তাদের মধ্যে একটা ভয়ের রাজত্ব তৈরি করে রূপপুর কিংবা রামপাল কিংবা মাতারবাড়ি কিংবা পায়রা কিংবা বাঁশখালী প্রকল্প হচ্ছে। মানুষের প্রশ্ন করারই অধিকার নেই। মানুষকে ঠেকানোর জন্য গোয়েন্দা সংস্থা, সরকারের গুন্ডাবাহিনী, পুলিশবাহিনী অতি তৎপর। যদি প্রশ্ন করা না যায়, তাহলে কীভাবে বলা যাবে এ প্রকল্পগুলোর কাগজপত্র ঠিক আছে? যদি কাগজপত্র ঠিক থাকে, যদি এগুলো প্রকৃতই উন্নয়ন প্রকল্প হয়, প্রকৃতই জনগণের কাজে আসে, তাহলে জনগণকে তো বুক ফুলিয়েই সব তথ্য জানানোর কথা। সেখানে জনগণকে কেবল জানানো হচ্ছে উন্নয়ন হবে, উন্নয়ন হবে, উন্নয়ন হবে; কিন্তু জনগণের যে ঝুঁকিগুলো সেগুলোর বিষয়ে, তাদের বা বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগের কখনো উত্তর দেওয়া হয়নি।

আশপাশের যারা মানুষ তাদের মধ্যে একটা ভয়ের রাজত্ব তৈরি করে রূপপুর কিংবা রামপাল কিংবা মাতারবাড়ি কিংবা পায়রা কিংবা বাঁশখালী প্রকল্প হচ্ছে। মানুষের প্রশ্ন করারই অধিকার নেই। মানুষকে ঠেকানোর জন্য গোয়েন্দা সংস্থা, সরকারের গুন্ডাবাহিনী, পুলিশবাহিনী অতি তৎপর। যদি প্রশ্ন করা না যায়, তাহলে কীভাবে বলা যাবে এ প্রকল্পগুলোর কাগজপত্র ঠিক আছে?

রূপপুর, রামপাল বা মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে অর্থনীতিবিদরা যখন হিসাব করেন, তখন এগুলোকে বৈদেশিক বিনিয়োগ হিসেবে ধরেন বা মেগা প্রকল্প খাতে সরকারের বরাদ্দ বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে সরকারের বরাদ্দ হিসেবে ধরেন। তাতে বাজেটের চেহারার ছবি সুন্দর হয়। এখন টাকার পরিমাণ সব বড় বড় অংক, হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিচ্ছে, নিয়ে যাচ্ছে, খেলাপি ঋণ হচ্ছে। তো মেগা প্রকল্পেও এমন বড় বড় ফিগার, অর্থনীতিবিদদের হিসাবে কত টাকা বরাদ্দ হলো সেটাই থাকে। কিন্তু তার পরিণতি কী হবে, পরিবেশের ওপর, মানুষের ওপর এবং মানুষের ওপর আর্থিক বোঝা কেমন হবে সে আলোচনা খুব কম। এখানেই ‘মুহিত বা কামাল সাহেবের’ সঙ্গে ‘গণি মিয়ার’ তফাত। এগুলো তো ঋণ করে হচ্ছে, যার টাকা আমাদেরই দিতে হবে। কোনো জায়গায় জাপান, কোথাও চীন, কোথাও রাশিয়া, কোথাও ভারত, তারা ঋণ দিচ্ছে, তাদের প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। চীনের প্রতিষ্ঠান পায়রা বন্দর, বাঁশখালী বিদ্যুৎ প্রকল্প। বাঁশখালীতে ইতোমধ্যে ১২ জন খুন হয়েছেন। সেটার ঠিকমতো তদন্তই হয়নি, বিচারও হয়নি। বাংলাদেশের এস আলম গ্রুপের সাথে চীনের যৌথ প্রকল্প সেটা।

এই মেগা প্রকল্পগুলো বিষয়ে আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, এগুলো বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে আর্থিক বোঝা তৈরি করবে, পরিবেশগত বিপর্যয় তৈরি করবে এবং মানুষের জন্য একটা ভয়াবহ বিপদের (বিশেষ করে রামপাল কয়লা ও রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প) জায়গা তৈরি করবে।

এই মেগা প্রকল্পগুলো বিষয়ে আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, এগুলো বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে আর্থিক বোঝা তৈরি করবে, পরিবেশগত বিপর্যয় তৈরি করবে এবং মানুষের জন্য একটা ভয়াবহ বিপদের (বিশেষ করে রামপাল কয়লা ও রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প) জায়গা তৈরি করবে।

বাংলাদেশে ‘নারীবান্ধব বাজেট’, ‘কৃষকের জন্য বাজেট’, ‘শ্রমিকের জন্য বাজেট’–এ ধরনের কথাবার্তা হয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাজে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। একটা কারণ তাদের নিজেদের পরিচয়ের জায়গা, আরেকটা হচ্ছে পরিবারের আর্থিক চাপ। একজন ব্যক্তির আয়ের ওপর নির্ভর করে একটা পরিবারের চলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের পরিবারের প্রায় সব সদস্যকেই কাজ করতে হচ্ছে। এমনকি নারী-পুরুষ শুধু নয়, শিশুদেরও কাজ করতে হচ্ছে। এভাবে সবাই মিলে কাজ করে তারা বেঁচে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

কয়েক দিন আগে একটা সমীক্ষায় দেখা গেল, চারজনের একটা পরিবারের মাসে খাওয়ার খরচই প্রায় ২২ হাজার টাকা। এই খাওয়াদাওয়া কোনো বিলাসী খাওয়াদাওয়া নয়, বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাওয়াদাওয়া। ঢাকা ও এর আশপাশে থাকতে গেলে একটা ঘর ভাড়া নিতেও তার ১০ হাজার টাকার মতো লাগে। এর বাইরে যাতায়াত খরচ আছে, চিকিৎসা আছে, সন্তান থাকলে তার লেখাপড়ার খরচ আছে। কম করে ধরলেও চারজনের একটা পরিবারের টিকে থাকতে ৪৭ হাজার টাকার মতো লাগে।

এবার গার্মেন্টসে আসেন, যেখানে মেয়েরা বেশি, সেখানে মিনিমাম ওয়েজ দেখা যাচ্ছে আট হাজার টাকার মতো। খেয়াল করলে দেখবেন, মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্ন মধ্যবিত্ত, শ্রমজীবী সকল পর্যায়ের নারীদের বিভিন্ন পেশায়, বিশেষ করে বাইরের কাজে অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছে। কিন্তু সামান্য একটা জিনিস, যেটার জন্য অনেক টাকাও লাগে না, ডে কেয়ার সেন্টার এখনও হয় নাই। এমন অনেক নারী যারা মা, এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যা সবচেয়ে শিক্ষিতদের প্রতিষ্ঠান, সেগুলোতেও ডে কেয়ার সেন্টার নেই। অথচ আমরা দেখি, আমাদের ছাত্রীরা মা আছেন, শিক্ষকরা মা আছেন, পোশাকশ্রমিকরা তো আছেনই। আপনারা যদি রাইজ অ্যান্ড শাইন নাটকটা দেখে থাকেন, একটা বাচ্চাকে নিয়ে একজন শ্রমিক মায়ের কী একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন শুরু করতে হয়। এর ব্যাপারে কিন্তু বাজেটে আমরা কিছু দেখি না।

এই শ্রমজীবী মানুষ, যাদের আয় আট হাজার টাকা, আরও অনেক শ্রমজীবী আছে, যাদের আয় আট হাজার টাকাও নয়, সেখানে মন্ত্রীর কাছ থেকে আমরা শুনি যে, প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে আমরা দেখি, আমাদের জিডিপি বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে। প্রতিদিনই বাড়ে, বাড়তে বাড়তে এখন সরকারের হিসাব দাঁড়িয়েছে মাথাপিছু আয় ২৮০০ ডলারের একটু বেশি। তাহলে প্রত্যেকের মাথাপিছু আয় মাসে ২০ হাজার টাকার মতো। মাথাপিছু ২০ হাজার টাকা মানে একটা পরিবারের আয় ৮০ হাজার টাকা। ৮০ হাজার টাকা আয়ে যদি ৪৭ হাজার টাকা খরচ হয়, তাহলে তো ভালোই, প্রায় ৩০ হাজার টাকা বাড়তি থাকে। কিন্তু সরকারি দলিলপত্র ও সবশেষ বাংলাদেশ ইকোনমিক রিভিউ যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব বাংলাদেশের ৭০ ভাগ মানুষের আয় ৪৭ হাজার টাকার অনেক নিচে। বেশির ভাগ পরিবারের আয় ২৫/৩০/৩৫ হাজারের মধ্যে। তার মধ্যেও কাজ করতে হচ্ছে ১২/১৪ ঘণ্টা, বাচ্চাদেরও কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু সরকারের হিসাব অনুযায়ী তাদের আয় হওয়ার কথা ৮০ হাজার টাকা। তাহলে বাকি ৪৫ হাজার টাকা কোথায় গেল?

বাংলাদেশের ৭০ ভাগ মানুষের আয় ৪৭ হাজার টাকার অনেক নিচে। বেশির ভাগ পরিবারের আয় ২৫/৩০/৩৫ হাজারের মধ্যে। তার মধ্যেও কাজ করতে হচ্ছে ১২/১৪ ঘণ্টা, বাচ্চাদেরও কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু সরকারের হিসাব অনুযায়ী তাদের আয় হওয়ার কথা ৮০ হাজার টাকা। তাহলে বাকি ৪৫ হাজার টাকা কোথায় গেল?

এই কেন্দ্রীভবনটাই হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গতিপথের মূল বৈশিষ্ট্য। মানুষের মাথাপিছু আয় যা দেখানো হচ্ছে তার ছোট একটা অংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কোনো রকমে ধারণ করে টিকে আছে, বড় অংশ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে কিছু গোষ্ঠীর হাতে। সেই যে কিছু গোষ্ঠী, তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত আছে মেগা প্রকল্প, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি, প্রশাসনিক ব্যয়, বড় বড় যে ভর্তুকি, খেলাফী ঋণ ইত্যাদি। তাদের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য নানা ব্যবস্থা আছে। এবং সেই টাকার বড় অংশ দেশের মধ্যে থাকে না, বাইরে চলে যায়। এটাকে বলা হয় ‘কালোটাকা’। ‘কালোটাকা’ মানে হচ্ছে যে টাকাটা বৈধ নয়। পৃথিবীব্যাপীই একে ব্ল্যাক মানি বলে। এই নামটাই বদলানো উচিত, কালো মানে খারাপ, সাদা মানে ভালো, এটা তো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই যে বর্ণবাদী নামকরণ, এটা থেকেও বের হওয়া উচিত। আসলে কালোটাকা বলে যে টাকাটাকে নির্দেশ করা হয়, অনুসন্ধান করলে দেখা যায় তার বড় অংশ হচ্ছে চোরাই টাকা, সেটাই বলা উচিৎ।

কালো মানে খারাপ, সাদা মানে ভালো, এটা তো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই যে বর্ণবাদী নামকরণ, এটা থেকেও বের হওয়া উচিত। আসলে কালোটাকা বলে যে টাকাটাকে নির্দেশ করা হয়, অনুসন্ধান করলে দেখা যায় তার বড় অংশ হচ্ছে চোরাই টাকা, সেটাই বলা উচিৎ।

এই চোরাই টাকা প্রতিবছর বিদেশে পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের কোনো হিসাব নেই, বাজেটে তার কোনো হিসাব নেই, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে কোনো স্টাডি নেই। আন্তর্জাতিক স্টাডি থেকে আমরা দেখছি যে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ বছরে প্রায় লক্ষ কোটি টাকা। গত ৩-৪ দিনে খবর হয়েছে যে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের যে টাকা আছে, সেটা গত এক বছরে বেড়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। শুধু একটা ব্যাংকে। এবং এই টাকা বৃদ্ধির হার দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি।

এই চোরাই টাকা ফেরত নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ফেরত আনার জন্য কর দিতে হবে সাড়ে সাত ভাগ। বাংলাদেশে যদি বৈধভাবে এই টাকাটা আয় করা হতো, তাহলে কর দিতে হতো ২৫ শতাংশ। আর পাচারকারী প্রথমে পাচার করে তারপর যদি ফেরত আনতে চায়, তাহলে তাকে দিতে হবে সাড়ে সাত ভাগ। ভালো একটা ইনসেনটিভ, এই বছর পাচার করো, সামনের বছর নিয়ে আসো, তাহলে নেট লাভ এখানে ১৮ শতাংশ। এই ঘটনাটা যদি এক বছর আগে হতো, তাহলে পি কে হালদার আর অপরাধী হতো না।

এই চোরাই টাকা ফেরত নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ফেরত আনার জন্য কর দিতে হবে সাড়ে সাত ভাগ। বাংলাদেশে যদি বৈধভাবে এই টাকাটা আয় করা হতো, তাহলে কর দিতে হতো ২৫ শতাংশ। আর পাচারকারী প্রথমে পাচার করে তারপর যদি ফেরত আনতে চায়, তাহলে তাকে দিতে হবে সাড়ে সাত ভাগ। ভালো একটা ইনসেনটিভ, এই বছর পাচার করো, সামনের বছর নিয়ে আসো, তাহলে নেট লাভ এখানে ১৮ শতাংশ।

অর্থমন্ত্রী কেন এ ঘোষণা দিলেন, সঠিক কারণ জানি না। তবে একটা কারণ হতে পারে, তাদের ঘনিষ্ঠ কারো কারো বিদেশে যেখানে টাকাটা রাখা আছে সেখানে ঝামেলা হচ্ছে। সে কারণে তাদের এখন টাকাটা নিয়ে আসা দরকার দেশে। এটা একটা কারণ হতে পারে। আরেকটা কারণ হতে পারে, যেটা সাইফুর রহমান করেছিলেন একবার, সেই কৌশল তার কাজে লেগেছিল। বাজেটে মদের ওপর শুল্ক কমিয়েছিলেন, মদের শুল্ক নিয়ে এত হইচই হতে থাকল যে আর কোনো বিষয় নিয়ে কেউ কোনো কথাই বলল না, বাজেট পুরোটা পাস হয়ে গেল। এমনটাও হতে পারে। তবে আমার মনে হয় প্রথমটার সম্ভাবনাই বেশি।

এ প্রক্রিয়াটাই চলছে বাংলাদেশে। সম্পদ কেন্দ্রীভবন হচ্ছে, পাচার হচ্ছে এবং সেটার বৈধতা দানের মধ্য দিয়ে অর্থনীতির একটা নতুন ধরন তৈরি হচ্ছে।

পুঁজিবাদের যে বিকাশ দেখতে পাচ্ছি আমরা, তার ফলে আমাদের অর্থনীতি প্রাণপ্রকৃতি সমস্ত কিছুর জন্যই একটা ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, বিপর্যয় তৈরি হচ্ছে, বৈষম্য বাড়ছে। সেই তৎপরতার বৈধতা দানের জন্য এবং সরকারি নীতিকাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার বাৎসরিক দলিলই হচ্ছে বাজেট।

বাজেটের বিশ্লেষণ করলে এটা আমরা নিশ্চিত পাব যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যাদের সম্পদ নেই, যারা কর দেন বেশি। এখানেই শেষ নয়, সরকারের টাকার জন্য অস্থির অবস্থা, বহু ব্যয়বহুল প্রকল্প, প্রচুর অজানা খরচ, উৎসব-আয়োজন। টাকা তোলার জন্য সরকার সবজায়গায় হাত দিচ্ছে, ব্যাংকে মানুষের জমা টাকা, সঞ্চয়পত্র, ভ্যাট, ঘরবাড়ি রাস্তাঘাটে নানা মাশুল। এর বাইরে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে যত টাকা জমা আছে এমনকি বিদ্যুৎ বিভাগ, পাটকলসহ বিভিন্ন পাবলিক প্রতিষ্ঠানে তহবিল উদ্বৃত্ত দেখিয়ে বাজেয়াপ্ত করে সরকার প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার মতো নিয়ে নিয়েছে। এসব তহবিল সর্বজনের কাজে লাগানোর কথা!

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে যত টাকা জমা আছে এমনকি বিদ্যুৎ বিভাগ, পাটকলসহ বিভিন্ন পাবলিক প্রতিষ্ঠানে তহবিল উদ্বৃত্ত দেখিয়ে বাজেয়াপ্ত করে সরকার প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার মতো নিয়ে নিয়েছে। এসব তহবিল সর্বজনের কাজে লাগানোর কথা! 

প্রশ্নোত্তর (সংক্ষিপ্ত রূপ)

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ কম দেওয়ার পক্ষে একটা যুক্তি দেয়া হয় যে, এনজিও বা প্রাইভেট সেক্টরগুলোর এ খাতে বরাদ্দ আছে। আসলে বরং উলটোটা, প্রাইভেট সেক্টরকে সমর্থন ও উৎসাহ দেওয়ার জন্যই বরাদ্দটা কমানো হয়। প্রাইভেটাইজেশনই মূল লক্ষ্য। এনজিও প্রাইভেট সেক্টরের অংশ হিসেবেই কাজ করে। স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা, দুটো ক্ষেত্রেই তা-ই। যদি সবার জন্য একই সুযোগ না থাকে, তাহলে বৈষম্য সৃষ্টি হবে, অভিন্ন গতিশীল একটি কাঠামোও তৈরি হবে না। বাংলাদেশে শিক্ষাখাতের যে নৈরাজ্য, এটা তার বড় একটা কারণ।

বাংলাদেশ হচ্ছে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম কম বেতনের শিক্ষকদের দেশ। যেমন, ভারতে তো বটেই, নেপালের শিক্ষকদেরও বেতন বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। এই পরিস্থিতিতে পাবলিক প্রতিষ্ঠানের বহু শিক্ষক এখন প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজের একজন প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। খেয়াল করলে দেখবেন, সরকারি কলেজ বা প্রাইমারি-মাধ্যমিক স্কুল, সেখানে ভেতরে ভেতরে প্রাইভেটাইজেশন হচ্ছে- কোচিং-টিউশনি কার্যত বাধ্যতামূলক। কলেজগুলোতে ভেতরে ভেতরে প্রাইভেট কোচিং সিস্টেম আছে এবং বাণিজ্যিকভাবে ক্লাসরুমেই হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এখন ইভিনিং-উইকএন্ড এক একটা প্রাইভেট সেক্টর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে। এটার বেনিফিশিয়ারি হচ্ছেন কিছু শিক্ষক। শিক্ষকরা যে চলমান প্রবাহের সঙ্গে খুশিমনেই যাচ্ছেন, বিদ্বৎসমাজের যে ধসটা আমরা দেখি, এটার একটা বড় কারণ।

সরকারি কলেজ বা প্রাইমারি-মাধ্যমিক স্কুল, সেখানে ভেতরে ভেতরে প্রাইভেটাইজেশন হচ্ছে- কোচিং-টিউশনি কার্যত বাধ্যতামূলক। কলেজগুলোতে ভেতরে ভেতরে প্রাইভেট কোচিং সিস্টেম আছে এবং বাণিজ্যিকভাবে ক্লাসরুমেই হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এখন ইভিনিং-উইকএন্ড এক একটা প্রাইভেট সেক্টর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে।

তথ্য সূত্র সমস্যা। নিয়মিত তথ্য পাওয়া যায় না, আর যতটুকু পাওয়া যায় তাও নির্ভরযোগ্য নয়। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস (বিবিএস) যত দিন একটা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে না পারবে, তত দিন পর্যন্ত আমাদের তথ্য ভ্রান্তির শিকার হতে হবে।

কৃষিজমি। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে এমন জায়গা পাওয়া মুশকিল, যেখানে ইটের ভাটা নেই। কৃষিজমির সরাসরি যে উর্বর জায়গাটা সেটা হচ্ছে ইটের ভাটার প্রধান কাঁচামাল। যে জায়গাটা তারা নিচ্ছে, সেখানে তারা একটা চুক্তিতে যায় কৃষকের সঙ্গে। কৃষকের কাছে মনে হয়, এক বছরে কৃষি করলে আমি পেতাম এত টাকা, ইটের ভাটাকে ভাড়া দিয়ে আমি যা পাচ্ছি সেটা লাভজনক। কৃষকের কাছে এই তথ্যটা নেই যে দীর্ঘ মেয়াদে তার কী ক্ষতি হচ্ছে। শুধু তো একটা কৃষিজমি নয়, পুরো গ্রামটাকে অতিক্রম করে ইটের ভাটার ক্ষতিটা হয়, অন্যান্য গ্রামের ক্ষতি হয়, পানির ক্ষতি হয়, বাতাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, শিশুরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়; পুরো প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ আক্রান্ত হয়। এই হিসাবনিকাশগুলো করা তো সরকারের দায়িত্ব, যেটা একজন ব্যক্তি কৃষক করতেও পারবেন না, এটা তার এখতিয়ারের মধ্যেও নেই। আমরা এও জানি শতকরা ৫০ ভাগ ইটের ভাটা যেগুলো অবৈধ।

কৃষিজমি চলে যাওয়া, বাড়িঘর চলে যাওয়া, নদীভাঙনের শিকার হওয়া, বিভিন্ন ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ, দখল, জালিয়াতি‒এই সবকিছুর মধ্য দিয়ে উন্নয়ন উদ্বাস্তু তৈরি হচ্ছে, পরিবেশ উদ্বাস্তু তৈরি হচ্ছে পরিবেশ নষ্ট হওয়ার কারণে। এই যে পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, এর কারণে পার্শ্ববর্তী এলাকার লক্ষাধিক মৎস্যজীবী যারা ছিলেন তাদের জীবন আজ বিপন্ন। মাছ পাচ্ছে না, পানি শেষ হয়ে গেছে। তারা হয়তো ঢাকা শহরে এসে কাজ খুঁজবে কোনো রকমে বাঁচার জন্য। আরেকটা হচ্ছে কৃষিজমি যে কমে যাবে, কৃষিজমি যত কমে যাবে আমরা তত আরেকটা গল্প শুনতে থাকব, সেটা হচ্ছে স্মার্ট কৃষি। হাইব্রিড অ্যাগ্রিকালচার থেকে জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড কৃষির যেসব টার্ম, আরও আরও কম জমিতে আরও উৎপাদন করতে হবে, সেটা করার জন্য এই বীজটা ব্যবহার করতে হবে, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে!

কৃষিজমি চলে যাওয়া, বাড়িঘর চলে যাওয়া, নদীভাঙনের শিকার হওয়া, বিভিন্ন ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ, দখল, জালিয়াতি‒এই সবকিছুর মধ্য দিয়ে উন্নয়ন উদ্বাস্তু তৈরি হচ্ছে, পরিবেশ উদ্বাস্তু তৈরি হচ্ছে পরিবেশ নষ্ট হওয়ার কারণে।

স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা। মানুষের সুস্থ থাকতে হলে চিকিৎসার আগে ঠিকমতো খাওয়া খেতে হবে। ধরেন, কারো মিনিমাম খাবার নেই, কিন্তু সুস্থ থাকার জন্য ওষুধপত্র বা চিকিৎসায় বরাদ্দ আছে, এটার তো কোনো অর্থ নেই। যে মেয়েরা গার্মেন্টসে বা অন্য কোথাও কাজ করে শ্রমিক হিসেবে, তাদের পুষ্টি নেই, তাদের খাবার নেই, গ্রামে টাকা পাঠাতে হয়। তখন সে কী করে? ফার্মেসিতে গিয়ে বলে এমন কোনো ট্যাবলেট আছে কি না, যেটা খেলে শরীরে বল আসবে। ফার্মেসির ওরা তখন অনেক সময় গরু মোটাতাজাকরণের ওষুধ দেয়, এই তথ্যও অনেকে হয়তো জানেন।

তার মানে, মানুষ হিসেবে তার যেভাবে থাকার কথা, তা তো সে পারছে না। সেটা থাকতে না পারলে চিকিৎসা দিয়ে সমাধান হবে না। ফুসফুস তো ঠিক থাকতে হবে। সে যে পরিবেশে থাকে, পানিটা বিশুদ্ধ হতে হবে, বাংলাদেশে তো পানিবাহিত ও বায়ুবাহিত রোগই বেশি। ঢাকা শহর বলেন আর বাংলাদেশ বলেন, যদি নদীগুলো বিষাক্ত না থাকে, ওয়াসার পানি যদি পরিষ্কার হয়, বাতাস যদি এরকম দূষিত না থাকে, যদি যথেষ্ট গাছপালা থাকে তাহলে মানুষের অসুখ-বিসুখ এমনিতেই অনেক কম হবে।

ঢাকা শহর বলেন আর বাংলাদেশ বলেন, যদি নদীগুলো বিষাক্ত না থাকে, ওয়াসার পানি যদি পরিষ্কার হয়, বাতাস যদি এরকম দূষিত না থাকে, যদি যথেষ্ট গাছপালা থাকে তাহলে মানুষের অসুখ-বিসুখ এমনিতেই অনেক কম হবে।

ফলে চিকিৎসা খাতে বরাদ্দের আগে তার যেন অসুখ না হয়, সেটা প্রধান বিবেচনার বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখন উন্নয়নের বা পুঁজিবাদী বিকাশের যে ধরনটা দেখতে পাচ্ছি, সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প যা দেখতে পাচ্ছি, সেগুলো হচ্ছে একেকটা অসুখ তৈরির কারখানা। কিন্তু এগুলোতে জিডিপি বাড়ে।

নৌপথ রেলপথ। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বহু বছর ধরেই এই চিন্তাটা প্রধান যে যদি রাস্তা হয়, যদি সেতু হয়, তাহলেই উন্নয়ন। বাংলাদেশে নৌপথ গত ৫০ বছরে কোনো গুরুত্ব পায়নি। ১৯৭২ সালে নৌপথের যে দৈর্ঘ্য ছিল, স্বাধীনতার ৫০ বছরে ২০২২ সালে সেই নৌপথ অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে। আর সড়ক ১৯৭২ সালে যা ছিল, তার চেয়ে কয়েকশ গুণ বেশি বেড়েছে। বলা হয় নৌপথে যাতায়াতটা স্লো। এটা ঠিক নয়। সড়কপথের মতো একই গতিসম্পন্ন যান আছে, উপায় আছে। এটা নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ আছে, সবই সম্ভব।

দ্বিতীয় সর্বোত্তম ব্যবস্থা ছিল রেলওয়ে। ১৯৭২ সালের পর নতুন কিছু রেলপথ যুক্ত হয়েছে, অনেকটা বন্ধ হয়েছে, তাতে হয়তো ’৭২ সালের থেকে মাত্র ১০০/২০০ কিলোমিটার বেড়েছে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি সবসময় তহবিল ঋণ দিয়েছে সড়কের জন্য। কারণ তাহলে গাড়ির যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হবে, গাড়ি বিক্রির মার্কেট বাড়বে। নৌপথের জন্য দেয়নি, রেলপথের জন্যও দেয়নি। এখন তারা ম্যাগনেটিক ট্রেন, মেট্রোরেল–এগুলোর জন্য টাকাপয়সা দেবে।

আমাদের রাষ্ট্রপতির একটা জনপ্রিয় কথা শুনেছি যে, হাওড়ের মধ্যে কবে সেই রাস্তা হবে আর আমরা কবে সে রকম একটা দিন পাব, যখন একটা বাস ইটনায় দাঁড়িয়ে ডাকবে ‘ঢাকা ঢাকা ঢাকা’। হাওড়ের ওপর রাস্তা হবে, সেই রাস্তা দিয়ে ঢাকায় বাস আসবে, সেই ভয়ংকর বিষয় কীভাবে মানুষের মধ্যে তৈরি হয় স্বপ্ন হিসেবে? পরিণতি এবারেই কিছুটা দেখা গেল।

আমাদের রাষ্ট্রপতির একটা জনপ্রিয় কথা শুনেছি যে, হাওড়ের মধ্যে কবে সেই রাস্তা হবে আর আমরা কবে সে রকম একটা দিন পাব, যখন একটা বাস ইটনায় দাঁড়িয়ে ডাকবে ‘ঢাকা ঢাকা ঢাকা’। হাওড়ের ওপর রাস্তা হবে, সেই রাস্তা দিয়ে ঢাকায় বাস আসবে, সেই ভয়ংকর বিষয় কীভাবে মানুষের মধ্যে তৈরি হয় স্বপ্ন হিসেবে?

আসলে নৌপথ যদি গুরুত্ব পেত, তাহলে এত সেতু আমাদের দরকার হতো না এবং এত সেতু যদি না হতো, তাহলে অনেক নদী শেষ হতো না। সড়ক ও সেতুনির্ভর যে যোগাযোগ ব্যবস্থা আমাদের, তা আমাদের কৃষিজমি শেষ করছে, নদী শেষ করছে, খাল-বিল-পানিপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ভৌগোলিকভাবে নৌপথ বিকাশ বাংলাদেশের জন্য একটা অসাধারণ সুযোগ ছিল, কিন্তু কোনো সরকারই এটাকে গুরুত্ব দেয়নি।   

আমাদের ভূপ্রকৃতি, প্রাণপ্রকৃতি, শক্তির জায়গা‒নদী, পানিসম্পদ। এই পানির কারণেই আমাদের জমি এত উর্বর, প্রাণপ্রকৃতি পরিবেশ এত শক্তিশালী। এ রকম দেশ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই, যেখানে পরিশ্রম ছাড়া গাছপালা হয়। বাধা না দিলে, আক্রমণ না করলে আমাদের এখানে বৈচিত্র্যপূর্ণ গাছপালা ও প্রাণপ্রকৃতির যে প্রকাশ, সেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেখতে পাই। বাংলাদেশের যারা ক্ষমতাবান লোক, তাদের সৌন্দর্যবোধটা হচ্ছে এমন যে তাদের কাছে বটগাছ, আমগাছ, লিচুগাছ, কাঁঠালগাছ, কৃষ্ণচূড়া, নিমগাছ এগুলোর সৌন্দর্য নাই, বনের সৌন্দর্য নাই, জঙ্গলের সৌন্দর্য নাই। তাদের পছন্দ হলো আমদানি করা বামুন গাছ, সেটার পাতা নাই, পাখি বসে না, সেগুলো হচ্ছে তাদের কাছে সুন্দর জিনিস, কিংবা প্লাস্টিক-ইট-সিমেন্টের নকশা। ফলে এটা তাদের বোধের মধ্যেই নেই; এই বোধে না থাকার একটা অর্থনৈতিক যুক্তি হচ্ছে জিডিপি বৃদ্ধি। টাকা, ইনকাম, মুনাফা বাড়াতে হবে তাতে যাই ঘটুক না কেন।

একটা খুবই আপত্তিকর শব্দ শুনি- নদীশাসন। মানুষের কি সেই ক্ষমতা আছে নদীকে শাসন করবে? নদীকে শাসন করতে গেলে কী হয়? নদী তখন বলে, ঠিক আছে আমি চলে গেলাম। যমুনা নদী শাসন করার ফলে যমুনা এখন চর। ঢাকা থেকে আরিচা পর্যন্ত ১০০-র মতো সেতু-কালভার্ট আছে। এর মধ্যে বহু সেতু ও নদীর ওপর দাঁড়িয়ে মনে হবে কেন এটা করা হলো? কারণ, নিচে কোনো পানি নেই। নেই মানে ছিল কিন্তু উধাও হয়ে গেছে। এই পুরো যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ওই অঞ্চলের যে পুরো ইকোলজিক্যাল সিস্টেমের ওপর তো এটা প্রভাব ফেলছে, কিন্তু এই যে স্ট্রাকচারগুলো হলো, এর মধ্য দিয়ে মুনাফা-জিডিপি এসব তো বাড়ছে, কিছু লোকের হাতে টাকা আসছে।

জনস্বার্থ বিবেচনা না করে শুধু মুনাফাভিত্তিক অর্থনৈতিক বিকাশের প্রক্রিয়া অবধারিতভাবে প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি বিদ্বেষী হবে, এটাই বাংলাদেশে আমরা প্রকটভাবে দেখতে পাচ্ছি। সুন্দরবন যে কারণে তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। নদীও গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখন পদ্মা নদীর কী দশা হবে, সেটা নিয়ে আমি চিন্তিত। আজও দেখলাম একজন বিশেষজ্ঞ, আইনুন নিশাত, বললেন, আমরা খুব ভালোমতো নদীশাসন করেছি। সেটা কীরকম? তিনি বললেন, আমরা যমুনা নদীর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছি। যমুনা নদীর পরিণতি যা হয়েছে, সেটা যদি আমরা খেয়াল করি, তাহলে তার কথা থেকেই তো আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। এখন যখন আমরা যমুনা সেতু দিয়ে নদী পার হই, দেখা যায় নিচের অধিকাংশ জায়গায়ই চর। বর্ষায় তবু কিছুটা দেখা যায়, শীতকালে পানি দেখতে সেতুর ওপর অনেকখানি চলার পর হয়তো একটু পানি পাওয়া যায়।

একদিকে বলা হয় বাংলাদেশ একটা জনবহুল দেশ, জনসংখ্যা বাংলাদেশের সমস্যা, এসব কথাবার্তা আমরা সবসময় শুনি। জনসংখ্যা যদি বেশি থাকে, তাহলে সে অনুযায়ীই তো পরিবহণ ব্যবস্থা দাঁড় করাতে হবে। সেটা তো কোনোভাবেই প্রাইভেট কারনির্ভর হতে পারে না; হতে হবে পাবলিক বাস, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, রেলওয়ে, নৌপথকেন্দ্রিক যাতায়াত ব্যবস্থা। সেগুলো তো হচ্ছে না।

একদিকে বলা হয় বাংলাদেশ একটা জনবহুল দেশ, জনসংখ্যা বাংলাদেশের সমস্যা, এসব কথাবার্তা আমরা সবসময় শুনি। জনসংখ্যা যদি বেশি থাকে, তাহলে সে অনুযায়ীই তো পরিবহণ ব্যবস্থা দাঁড় করাতে হবে। সেটা তো কোনোভাবেই প্রাইভেট কারনির্ভর হতে পারে না; হতে হবে পাবলিক বাস, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, রেলওয়ে, নৌপথকেন্দ্রিক যাতায়াত ব্যবস্থা। সেগুলো তো হচ্ছে না।

মধ্যবিত্ত বিকাশ। অর্থনৈতিক বিকাশের এই প্রক্রিয়ায় একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে, যাদের হাতে সুযোগ আছে নানা রকম। নিউ লিবারেল ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেমের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত যারা বেনিফিশিয়ারি, তাদের মধ্যেই সেই বিদ্বৎসমাজ, যাদের দেশের জন্য কথা বলার কথা, সমষ্টির জন্য কথা বলার কথা। তাদের যেই আত্মসমর্পণ আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাদের মধ্যে একটা খুশি খুশি আনন্দিত ভাব দেখতে পাওয়া যায়, তারা বেশ উপভোগ করছেন এ রকম একটা পরিস্থিতি।

আপনি পাকিস্তান আমলেও দেখবেন, শাসক শ্রেণীকে প্রশ্ন করছে, চ্যালেঞ্জ করছে বিদ্ব্যৎসমাজের একটা বড় অংশ। সেটা এখনকার বাংলাদেশে দুর্লভ। কারণ, এই পুরো উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারাও বেনিফিশিয়ারি। শুধু চোরাই কোটিপতিরা নয়, এই বেনিফিশিয়ারি মধ্যবিত্তরা নিজেরাও বাংলাদেশকে তাদের ভবিষ্যৎ হিসেবে ভাবে না, তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ হিসেবে ভাবে না।

চিন্তার যে ধরনটায় মধ্যবিত্ত অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে যে, আমি তো নিরাপদে আছি। আমার বাসায় যদি এসি থাকে, আমার গাড়িতে যদি এসি থাকে, তাহলে আর অসুবিধা কী। বায়ুদূষণ হলে আমার অসুবিধা কী। আমি যদি ফিল্টার লাগিয়ে বিশুদ্ধ পানি খেতে পারি, তাহলে আমার অসুবিধা কী। অর্গানিক ফুডের দাম বেশি পড়বে, কিন্তু সেইমতো আমি যদি কামাই করতে পারি; অর্থাৎ আমি একটা নিরাপদ বলয় তৈরি করলাম।

খেয়াল করলে দেখবেন, মধ্যবিত্ত-সচ্ছল ব্যক্তিরা দিন দিন আরও বাক্সের মধ্যে বন্দি হয়ে যাচ্ছে। আক্ষরিক অর্থেই, ঘরগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, জানালা-দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, গাড়ি-টাড়ি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বাইরে খোলা জায়গায় যাওয়ার তার উপায় নেই; অন্তরের দিক থেকেও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যাদের এনলাইটেন্ড বা আলোকিত মানুষ ধরা হয়, তারাই অনেকে নিজের তৈরি কোটরে বন্দি হয়ে যাচ্ছেন।

খেয়াল করলে দেখবেন, মধ্যবিত্ত-সচ্ছল ব্যক্তিরা দিন দিন আরও বাক্সের মধ্যে বন্দি হয়ে যাচ্ছে। আক্ষরিক অর্থেই, ঘরগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, জানালা-দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, গাড়ি-টাড়ি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বাইরে খোলা জায়গায় যাওয়ার তার উপায় নেই; অন্তরের দিক থেকেও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যাদের এনলাইটেন্ড বা আলোকিত মানুষ ধরা হয়, তারাই অনেকে নিজের তৈরি কোটরে বন্দি হয়ে যাচ্ছেন।

ঢাকা শহরে আপনি দেখবেন যে পাড়ায় পাড়ায় গেট লাগানো হচ্ছে। একদিকে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে, আরেক দিকে সবকিছু বদ্ধ বদ্ধ বাক্স, গাড়ির মধ্যে বাক্স, ঘরের মধ্যে বাক্স, পাড়ার মধ্যে বাক্স। সব বাক্স হয়ে নিজেরা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। এবং কখন এই ভয়ংকর দেশ থেকে চলে যেতে পারবে; আবার যাওয়ার জন্য যে টাকাটা দরকার সেটা বানাতে হবে।

এ রকম একটা জগতের মধ্যে কেউ যদি নিজেকে সেট করে নেয়, তাহলে তার নিজের ভেতরের বিকাশটা কীভাবে হতে পারবে! প্রথমে তো প্রত্যাখ্যান লাগবে যে, না, আমি এ ধরনের বন্দিত্ব, আটকে থাকা চাই না। যদি আমি জানালা-দরজা খোলা রাখতে চাই, রাস্তায় বের হতে চাই, তখন তো ওই বোধটা আসবে। ওই বোধটা তো আসছেই না, প্রথমেই সে নিজেকে আলাদা করে ফেলছে। এ জায়গাতেই সমস্যাটা তৈরি হচ্ছে।

বাজেট নিয়ে আলাদা করে আন্দোলন দাঁড়ানোর খুব একটা সম্ভাবনা নেই। কারণ, বাজেট পেশ হওয়ার খুব কম সময়ে মাত্র এক মাসের মধ্যেই সেটা পাস হয়ে যায়। পাস হয়ে গেলে সেটা সিস্টেমের মধ্যে চলে যাচ্ছে। যেটা দরকার সেটা হলো, অর্থনৈতিক নীতি ও দর্শন নিয়ে মানুষের মধ্যে চিন্তাভাবনা প্রশ্ন তৈরি করা। যে নীতি ও দর্শনের অধীন এই বাজেট তৈরি হয়, সেটা তো দশকের পর দশক ধরে রাজত্ব করছে। উন্নয়ন দর্শনবিষয়ক প্রশ্ন যদি যথেষ্ট মাত্রায় পরিষ্কার না হয় মানুষের মধ্যে, যে দলগুলো বা সংগঠনগুলো দেশের অবস্থার পরিবর্তন করতে চায়, তারা যত দিন চলমান উন্নয়ন দর্শনটাকে শনাক্ত ও নতুন উন্নয়ন দর্শনের চিন্তা স্পষ্ট না করতে পারবে, তত দিন নতুন রাজনীতিও স্পষ্ট হবে না।

যে আলোচনা তোলা দরকার, বরাদ্দের অগ্রাধিকারটা কীভাবে ঠিক করা হচ্ছে; বাস্তবায়নের প্রাতিষ্ঠানিক যে কাঠামো, জনগণের কাছে তার জবাবদিহির জায়গাটা কোথায়। জবাবদিহির জায়গায় আসলে তখন অনেক কিছু পরিষ্কার হয়। কেন সব তথ্য সুলভ থাকে না? থাকে না কারণ, স্বচ্ছতা থাকলে, জনগণের জবাবদিহির জায়গাটা থাকলে এই প্রকল্পগুলো চলতে পারবে না। এই প্রকল্পগুলোর যৌক্তিকতা দাঁড়ানোর একটা বড় জায়গা হচ্ছে অস্বচ্ছতা।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্মেলনে আমাদের প্রধানমন্ত্রী, অন্য মন্ত্রীরা যান বিশাল দলবল নিয়ে। গিয়ে বলেন, আমরা তো ক্ষতিগ্রস্ত, নিজেদের ভিকটিম হিসেবে উপস্থিত করে বলেন যে আমাদের ক্ষতিপূরণ দেন, টাকাপয়সা দেন। এ খাতের টাকা দিয়ে বনের মধ্যে রাস্তা তৈরি হচ্ছে, ঢাকা শহরে বেশ কিছু যাত্রীছাউনি দেখছি, সফর হচ্ছে, ভবন তৈরি হচ্ছে ক্লাইমেট মিটিগেশনের কথা বলে। সেটা নিয়ে বেশ কিছু রিপোর্ট হয়েছে। এটা হলো একটা দিক।

আরেকটা দিক হচ্ছে, সরকার এ খাতে আরও বড় তহবিল চায়, আরেক দিকে ক্লাইমেট চেঞ্জ মোকাবিলার জন্য যা যা করা দরকার তার উলটো কাজগুলো করে। যেমন, বনগুলোকে যেখানে আরও বেশি সুরক্ষা দিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে উপকূলজুড়ে যে বন তা আরও বেশি শক্তিশালী করাটা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করার অন্যতম প্রধান একটা অস্ত্র; সেখানে সরকার যেসব ‘উন্নয়ন’ কর্মসূচি নিচ্ছে সেগুলো উপকূলকে আরও অরক্ষিত করছে। হচ্ছে রামপালসহ একের পর এক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। নিরাপত্তার নামে, সামরিকীকরণের নামে পার্বত্য চট্টগ্রামের বন-জঙ্গল শেষ হয়ে যাচ্ছে, সুন্দরবন থেকে কক্সবাজার এখন উন্নয়ন নামে দখল সন্ত্রাসের মধ্যে। আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে গিয়ে এক রকমের কথা আর দেশের ভেতরে উলটো রকম উন্নয়ন কর্মসূচি, এটা হচ্ছে এখনকার একটা বড় বৈশিষ্ট্য।

বাঙালি ছাড়া আরও মানুষ আছে। সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়া অন্য জাতি যে আছে, সেটা তো স্বীকারই করা হয়নি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী যেগুলো বলা হচ্ছে, আলাদা একটা জাতির স্বীকৃতি মানে হলো তার নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, জীবনযাপন আছে, উৎপাদন পদ্ধতি আছে, আলাদা ধরনের পরিবেশের ব্যাপার আছে, সেটা রক্ষার একটা দায়িত্ব নেওয়া। কিন্তু রাষ্ট্র এবং সব সরকার নির্বিশেষে সেটাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করার মধ্য দিয়েই যাচ্ছে।

পর্যটন বিকাশের ধরন দেখেন। শান্তি নিয়ে বেড়ানোর কোনো জায়গাই তো পাওয়া কঠিন। কোথায় যাব? পার্বত্য চট্টগ্রাম, বান্দরবান, সাজেক বা উত্তরবঙ্গে বিভিন্ন রিসোর্ট হচ্ছে, সেখানে যাব? প্রত্যেক জায়গার পেছনেই একটা নির্মম নৃশংস কাহিনি আছে। হয় জমি দখল করা হয়েছে, নয়তো পাহাড় উজাড় করা হয়েছে, সামরিকীকরণ হয়েছে। সুন্দরবন? সব দখলদার শয়তানের তাণ্ডব সেখানে। ফলে বেড়াতে তো যাব মানসিক শান্তির জন্য, কোনো জায়গায় গিয়ে যদি নির্মমতা-অত্যাচার-নৃশংসতার চিহ্ন পাই, সেখানে তো মানসিক শান্তি পাওয়া যাবে না। রাজনৈতিকভাবে একটা ভয়ংকর নির্মমতার ওপর দাঁড়ানো শানশওকত দাঁড়াচ্ছে দেশে। ফলে জাতিগতভাবে যারা সংখ্যালঘু, তারা সহজ আক্রমণের শিকার, ধর্মীয় সংখ্যালঘুও একইভাবে আসে। দখলদাররা যে রাষ্ট্রে প্রধান শক্তি, সেখানে এরকম বিপন্ন অবস্থা তৈরি হয়।

সামরিক বাহিনীর পুরো বাজেট আমরা ঠিকমতো জানি না। বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যই তো সামরিক বাহিনী, এটাই তো আমরা জানি। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য কে আমাদের আক্রমণ করবে, যাদের কারণে এই সামরিক বাহিনী? ভারত হতে পারে, মিয়ানমার হতে পারে। ভারতই হচ্ছে প্রধান শক্তি, যারা আমাদের আক্রমণ করতে পারে। সেই ভারতের সঙ্গেই তো নানা যৌথ সামরিক কর্মসূচি হচ্ছে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশে কীরকম শক্তিশালী, তা আমরা জানি। তাহলে যাদের আক্রমণ করার কথা, তারা সব তথ্য জানতে পারে, কিন্তু যাদের নিরাপদ করতে হবে অর্থাৎ বাংলাদেশের জনগণ, তারা কিছু জানে না, জানে না নিরাপত্তার স্বার্থে।  পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে সামরিক নিরাপত্তার অংশ হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, সেটার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব হচ্ছে ভারতের। তো ভারতের নিরাপত্তার একটা এক্সটেনশন হিসেবে ধরতে হবে এখানে। তার মানে, তাদের কাছে সব তথ্য থাকবে, কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ কিছুই জানতে পারবে না। সেসব তথ্যও আমরা জানি না, বাজেটও আমরা জানি না।

অন্যদিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে নতুন নতুন সেনানিবাস হচ্ছে। কেন হচ্ছে, সেটার কোনো ব্যাখ্যাও আমাদের কাছে নেই, সেটার কোনো বিশ্লেষণও আমরা পাই না। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি যে বিভিন্ন জায়গায় অনেক জমি নিয়ে এসব হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নামেও সেনানিবাস হয়েছে। পাশাপাশি যত বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প হচ্ছে, সব কটির সঙ্গেই সেনাবাহিনী কোনো-না-কোনোভাবে সম্পৃক্ত। পদ্মা সেতু, রামপাল, রূপপুর সব জায়গায়ই সামরিক বাহিনী কনস্ট্রাকশন ও মেইনটেনেন্সের সঙ্গে যুক্ত আছে।

ফায়ারব্রিগেডের সক্ষমতা বাড়েনি, যে ফায়ারব্রিগেড আগুন নেভাবে, মানুষের জীবন রক্ষা করবে তাদের সংখ্যা, সক্ষমতা, যন্ত্রপাতি, জনবল বা আধুনিকায়ন হয়নি। বা ধরেন, শ্রম পরিদর্শক, যারা সংখ্যায় বাড়লে কারখানাগুলোর নিরাপত্তা তৈরি হবে, সেটা বাড়েনি। কিন্তু আমরা দেখব গোয়েন্দা সংস্থা ও নজরদারি সিস্টেম, আমরা এর মধ্যে জানলাম যে ইসরায়েলের যে নজরদারি সিস্টেম ‘পেগাসাস’, সেটা কেনা হয়েছে আরেকটা দেশের মাধ্যমে। সেগুলোর ক্ষেত্রে কিন্তু অর্থ বরাদ্দে কোনো ঘাটতি নেই। সিসিটিভি ক্যামেরা তো নানান জায়গায় লাগানো হচ্ছে। তাতে অপরাধের কী কমতি হলো, সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জনস্বার্থ সম্পৃক্ত, সেসব জায়গায় জনবল বা অর্থ বরাদ্দ নেই, কিন্তু জননিরাপত্তার নামে জনগণের ওপর নিপীড়ন করার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলোর বরাদ্দ ক্রমাগত বাড়ছে। এটা অবশ্যই আমরা কমানোর দাবি করতে পারি, কিন্তু প্রথমে তো দরকার জানা, আমরা তো জানিই না। আমাদের প্রথম দরকার হলো, এসব বিষয়ে আমাদের বাজেট বরাদ্দ যেগুলো হচ্ছে, সেটা স্বচ্ছতার সঙ্গে করতে হবে, যাদের নিরাপত্তার নামে এটা করা হচ্ছে, তাদের কাছে পরিষ্কার করতে হবে যে কী কী খাতে বরাদ্দ হচ্ছে এবং তাদের ভূমিকা কী।

ট্যাক্স-সার্ভিস রেশিও। একটা কথা বলে শেষ করি। ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বলে একটা কথা আছে। জিডিপির সঙ্গে ট্যাক্সের অনুপাত। জিডিপির তুলনায় বাংলাদেশে ট্যাক্স কম, এটা অর্থনীতিবিদরা বলছেন অনেক সময়। বাংলাদেশে ৯ পার্সেন্টের মতো, অনেক দেশে ১৫ পার্সেন্টও আছে। তো ট্যাক্স বেশি হলে সরকার খরচ করতে পারে বেশি। শিক্ষা-স্বাস্থ্য সব ক্ষেত্রেই খরচ করতে পারে বেশি। ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বাড়ানোর জন্য আমরা সবসময় বলে এসেছি যে যাদের ট্যাক্স দেওয়ার ক্ষমতা বেশি, তাদের কাছ থেকে সম্পদ নিলে কোনো অসুবিধা নেই; কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যাদের সম্পদ নেই বা যারা ইতোমধ্যে দিচ্ছে, তাদের ওপরই আরও ট্যাক্স বসানো হচ্ছে, এটা হচ্ছে প্রথম কথা।

আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আমি মনে করি যে আরেকটা কনসেপ্ট আমাদের সামনে আনতে হবে, ট্যাক্স-সার্ভিস রেশিও।  আমরা ট্যাক্স দিই শিক্ষার জন্য, আমাদের সর্বজন শিক্ষাব্যবস্থা তো কলাপস করার মতো অবস্থা। আমরা পানির জন্য ট্যাক্স দিচ্ছি, ওয়াসার পানি তো নিরাপদ হচ্ছে না, ওয়াসার এমডির বেতন বাড়ছে, ওয়াসার নানান রকম প্রজেক্ট হচ্ছে। আমরা নিরাপত্তার জন্য ট্যাক্স দিচ্ছি, জননিরাপত্তা বাহিনী হচ্ছে, গোয়েন্দা সংস্থা হচ্ছে; কিন্তু গুম, খুন, হেফাজতে নির্যাতনে খুন হওয়া সেগুলো বাড়ছে। সুতরাং আমরা যে ট্যাক্স দেব সেই ট্যাক্সের বিনিময়ে আমরা কী সার্ভিস পাচ্ছি, সেই প্রশ্নটা এখন সামনে আনা দরকার। আমরা শিক্ষার জন্য ট্যাক্স দিচ্ছি, শিক্ষা পেতে হবে। চিকিৎসার জন্য দিচ্ছি, চিকিৎসা পেতে হবে। শুধু চিকিৎসা নয়, যাতে অসুখ না হয়, সে ধরনের তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। সন্তানদের খেলাধুলা, বিনোদন এসব পেতে হবে। ট্যাক্স-সার্ভিস রেশিও‒আলোচনার মধ্যে প্রবলভাবে সামনে নিয়ে আরা দরকার।

আমরা ট্যাক্স দিই শিক্ষার জন্য, আমাদের সর্বজন শিক্ষাব্যবস্থা তো কলাপস করার মতো অবস্থা। আমরা পানির জন্য ট্যাক্স দিচ্ছি, ওয়াসার পানি তো নিরাপদ হচ্ছে না, ওয়াসার এমডির বেতন বাড়ছে, ওয়াসার নানান রকম প্রজেক্ট হচ্ছে। আমরা নিরাপত্তার জন্য ট্যাক্স দিচ্ছি, জননিরাপত্তা বাহিনী হচ্ছে, গোয়েন্দা সংস্থা হচ্ছে; কিন্তু গুম, খুন, হেফাজতে নির্যাতনে খুন হওয়া সেগুলো বাড়ছে। সুতরাং আমরা যে ট্যাক্স দেব সেই ট্যাক্সের বিনিময়ে আমরা কী সার্ভিস পাচ্ছি, সেই প্রশ্নটা এখন সামনে আনা দরকার।

আজ এখানেই শেষ করি, ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই আরও আলোচনা হবে।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •