রোকেয়ার দর্শন: বিজ্ঞান ও মুক্তির চেতনা- আলমগীর খান

রোকেয়ার দর্শন: বিজ্ঞান ও মুক্তির চেতনা

আলমগীর খান

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাঙালি মুসলমান নারীর সমাজজীবনে আলোকবর্তিকা হয়ে এসেছিলেন। সমাজের জগদ্দল পাথরটিকে নাড়া দিয়েছিলেন প্রচণ্ড শক্তিতে। তার সাহসী ভূমিকা বাঙালি নারীজীবনের সর্বত্র প্রভাব ফেলেছে। তিনি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন শিক্ষায় নারীর অগ্রগতিতে, কেবল তাত্ত্বিকভাবে নয়, বাস্তব প্রয়োগেও। রোকেয়া সাহিত্যচর্চা করেছেন সাহিত্যের খাতিরে নয়, নারীমুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে। আর রোকেয়ার নারীভাবনা সমাজভাবনা থেকে আলাদা নয়, সমাজের সার্বিক বিকাশের অংশ।

বেগম রোকেয়া খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে নারীকে পশ্চাৎপদ রেখে সমাজ এগিয়ে যেতে পারে না। কিন্তু নারী কোথায় পিছিয়ে আছে বা সমাজকাঠামোর বন্ধনে তাকে কোথায় কীভাবে পিছিয়ে রাখা হয়েছে, রোকেয়া তা নিজে নারী হওয়ার কারণে এবং এসব কোনো কোনো বৈষম্যের প্রত্যক্ষ শিকার হওয়ার কারণে সহজে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। অন্যরা কি উপলব্ধি করেননি? রোকেয়ার মতো অন্য নারীরা যারা সুবিধাভোগী পরিবারের সদস্য, তারা প্রচলিত পুরুষাধিপত্যের সংস্কৃতিকে কেবল মেনেই নেননি; বরং ওই নারীবিদ্বেষী সংস্কৃতির ধারকবাহকে পরিণত হয়েছেন। রোকেয়ার মন সেখানে কেবল প্রতিবাদ করেই থেমে থাকেনি; বরং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি কাজ করেছেন। এভাবে রোকেয়া নিজে যেমন শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছেন, বাংলার সব নারীকেও শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এবং সে অভিযানে তাদের সাধ্যমতো সহায়তা করেছেন।

রোকেয়ার নারীমুক্তি ভাবনার একটি দৃঢ় বৈজ্ঞানিক-দার্শনিক ভিত্তি রয়েছে। তিনি কেবল নারী হিসেবে উপলব্ধিকেই তার লেখায় প্রকাশ করেননি, একটি বৈজ্ঞানিক-দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি সমাজ ও নারীকে বিশ্লেষণ করেছেন। তার বিজ্ঞানমনস্কতা এ ক্ষেত্রে দিকনির্দেশকের ভূমিকা পালন করেছে। বিজ্ঞানমনস্কতার কারণেই রোকেয়া প্রচলিত সামাজিক কুসংস্কারগুলো থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছেন ও অন্যদেরও মুক্ত রাখার চেষ্টা করেছেন। বিজ্ঞানের বস্তুবাদী কার্যকারণ সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন বলেই কোনো কিছুকেই ভাববাদী ঘোলাটে দৃষ্টিতে দেখেননি। মানবমনের অন্যতম শক্তিশালী আবেগ ধর্মকেও দেখেছেন বিজ্ঞানের দূরদর্শনযন্ত্রে—দেখেছেন তার উৎপত্তির ঐতিহাসিক পটভূমি ও তাতে পুরুষাধিপত্যের রূপ—এমনকি ধর্মের জালে আবদ্ধ চিন্তাচেতনায় একটি পশ্চাৎপদ সমাজের বাসিন্দা হয়েও তা দেখতে, বুঝতে ও অকপটে বলতে দ্বিধা করেননি।

এক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন,

‘মনে হয় যে পুরাকালে যখন সভ্যতা ছিল না, সমাজবন্ধন ছিল না, তখন আমাদের অবস্থা এরূপ ছিল না। কোনো অজ্ঞাত কারণবশতঃ মানবজাতির এক অংশ (নর) যেমন ক্রমে নানা বিষয়ে উন্নতি করিতে লাগিল, অপর অংশ (নারী) তাহার সঙ্গে সঙ্গে সেরূপ উন্নতি করিতে পারিল না বলিয়া পুরুষের সহচরী বা সহধর্ম্মিণী না হইয়া দাসী হইয়া পড়িল।’

রোকেয়া এখানে তার যুক্তি উপস্থাপনের জন্য সমাজবিজ্ঞানের আশ্রয় নিচ্ছেন, যদিও কিছুটা অনিশ্চিতভাবে। স্পষ্টভাবেই তিনি ধর্মীয় ব্যাখ্যার ওপর ভরসা করেননি। লিখেছেন (শিক্ষাবিদ শহিদুল ইসলামের প্রবন্ধ ‘বেগম রোকেয়ার লড়াই ও বর্তমান বাংলাদেশ’ থেকে উদ্ধৃত):

‘আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকেই ঈশ্বরের আদেশ-পত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। কোনো বিশেষ ধর্মের নিগূঢ় মর্ম বা আধ্যাত্মিক বিষয় আমার আলোচ্য নহে। ধর্মে যে সামাজিক আইন-কানুন বিধিবদ্ধ আছে, আমি কেবল তাহারই আলোচনা করিব; সুতরাং ধার্মিকগণ নিশ্চিন্ত থাকুন। পুরাকালে যে ব্যক্তি প্রতিভাবলে দশ-জনের মধ্যে পরিচিত হইয়াছেন, তিনিই আপনাকে দেবতা কিংবা ঈশ্বরের প্রেরিত দূত বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। এবং অসভ্য বর্বরদিগকে শিক্ষা দিতে চেষ্টা করিয়াছেন। ক্রমে যেমন পৃথিবীর অধিবাসীদের বুদ্ধি বিবেচনা বৃদ্ধি হইয়াছে, সেইরূপ পয়গম্বরদিগকে (অর্থাৎ ঈশ্বরপ্রেরিত মহোদয়দিগকে) এবং দেবতাদিগকেও বুদ্ধিমান হইতে বুদ্ধিমত্তর দেখা যায়।’

“তবেই দেখিতেছেন, এই গ্রন্থগুলি পুরুষ-রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যেরূপ কথা শুনিতে পান, কোনো স্ত্রী মুনির বিধানে হয়ত তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন। কিন্তু স্ত্রীলোকদের সেরূপ যোগ্যতা কই যে মুনি-ঋষি হইতে পারিতেন? যাহা হউক, ধর্মগ্রন্থসমূহ ঈশ্বরপ্রেরিত কিনা তাহা কেহই নিশ্চয় বলিতে পারে না। যদি ঈশ্বর কোনো দূত রমণীশাসনের নিমিত্ত প্রেরণ করিতেন, তবে সে দূত বোধহয় কেবল এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিতেন না। দূতগণ ইউরোপে যান নাই কেন? আমেরিকা এবং সুমেরু হইতে কুমেরু পর্যন্ত যাইয়া ‘রমণী জাতিকে নরের অধীন থাকিতে হইবে’ ঈশ্বরের এই আদেশ শুনান নাই কেন? ঈশ্বর কি কেবল এশিয়ারই ঈশ্বর? আমেরিকায় কি তাহার রাজত্ব ছিল না? ঈশ্বরদত্ত জলবায়ু তো সব দেশেই আছে, কেবল দূতগণ সর্বদেশময় ব্যাপ্ত হন নাই কেন? যাহা হউক, এখন আমাদের আর ধর্মের নামে নত মস্তকে নরের অযথা প্রভুত্ব সহা উচিত নহে। আরও দেখ, যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ়, সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক। … যেখানে ধর্ম-বন্ধন শিথিল, সেখানে প্রায় রমণী প্রায় পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থায় আছেন। এস্থলে ধর্ম অর্থে ধর্মীয় সামাজিক বিধান বুঝিতে হইবে।”

রোকেয়ার সাহিত্যকর্মের মধ্যে বিখ্যাত হচ্ছে Sultana’s Dream। রোকেয়ার ২৪ বছর বয়সে লেখা ‘সুলতানা’স ড্রিম’ ১৯০৫ সালে ইংরেজিতে প্রকাশিত। পরে ১৯২২ সালে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নিজেই একে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ শিরোনামে বাংলায় অনুবাদ করেন। এ ব্যাপারে আশরাফ আহমেদ লিখেছেন:

“গল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপকরণগুলো হচ্ছে সূর্যের আলো ও তাপ, আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ, বিমানে আকাশ ভ্রমণ, এবং বৈদ্যুতিক প্রযুক্তির প্রসার ঘটানো। এই বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও আবিষ্কারগুলোকে ভিত্তি করে কাল্পনিক মহিলা বিজ্ঞানীরা পুরুষকে গৃহবন্দি করার মত সামাজিক-প্রযুক্তি (সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং) ছাড়াও বৈদ্যুতিক-প্রযুক্তি, উড়োজাহাজ-প্রযুক্তি, আবহাওয়া-প্রযুক্তি, যুদ্ধ-প্রযুক্তি, গৃহস্থালি-প্রযুক্তি এবং কৃষি-প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি সাধন করেন। এর বাইরে আরও রয়েছে ছোঁয়াচে রোগ প্রতিরোধ করে মহামারি নিয়ন্ত্রণ, যদিও এর বৈজ্ঞানিক কোনো উপাদান বইটিতে নেই। তিনি যেসব বৈজ্ঞানিক উপাদান ব্যবহার করেছেন সেগুলোর প্রায় সবই ছিল প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি তত্ত্ব ও তথ্যের ওপর নির্মিত।

“মানুষ মূলত তিন প্রকারে কোনো জ্ঞান আহরণ করে থাকে। দেখে, শুনে এবং পড়ে। বিজ্ঞানের যে সব তথ্যকে তিনি উপন্যাসটিতে কাজে লাগিয়েছেন অথচ এর অধিকাংশই তিনি যে স্বচক্ষে অবলোকন করেননি তাঁর সময়ে বিরাজমান বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অবস্থা বিবেচনা করে অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানের ছাত্রী না হয়েও তিনি বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎমুখী যেসব উৎকর্ষতার কথা বলেছেন, তাঁর সময়ের বিচারে তা শুধু ক্ষণজন্মা, চিন্তাশীল দার্শনিক এবং অত্যন্ত মেধাবী কোনো ব্যক্তির ভাবনায়ই উদ্রেক হওয়া সম্ভব। কলকাতা তথা ভারতবর্ষে তখন জগদীশচন্দ্র বসু ও প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রচেষ্টায় আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণার মাত্র উন্মেষ ঘটছে। তাঁদের বা তখনকার অন্য কোনো বিজ্ঞানীর সঙ্গে রোকেয়ার সাক্ষাৎ ঘটেছিল কিনা জানা যায় না। …

“উল্লিখিত সব বৈজ্ঞানিক তথ্যকে তিনি কল্পনা দ্বারা এমনভাবে সামনে এগিয়ে দিয়েছেন যা দ্বারা পুরুষকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে নারীজাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার তাঁর অভীষ্ট পূরণ হয়। ফলে তাঁর কল্পনালব্ধ বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি প্রযুক্তি গল্পের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে যে তাঁর বর্ণিত বিজ্ঞানকে মোটেই কাল্পনিক মনে হয় না। আর সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে তিনি বিজ্ঞানের যে যে উৎকর্ষতার কথা বলেছেন তার প্রায় সবকটির প্রমাণই হাতেনাতে আমরা পেয়েছি এবং পেয়ে চলেছি বইটি প্রকাশের কয়েক দশক পর থেকে।”

সুলতানার স্বপ্ন নিয়ে আলোচনায় তিনি আরও লিখেছেন:

“‘নারীস্থান’-এ আরও কয়েকটি বৈজ্ঞানিক তথ্যের কথা রোকেয়া উল্লেখ করেছেন। আমার ধারণায় সেগুলো সেই সময়ের জন্য সাধারণ জ্ঞানের মধ্যে পড়ে না। বইটিতে শুধু বুদ্ধি দিয়ে কীভাবে পুরুষদের পরাজিত করা যাবে তেমন আলোচনায় লেখক প্রশ্ন করছেন, ‘এমন কী তাদের (পুরুষের) মস্তিষ্কও মেয়েদের থেকে বড় ও ভারী, তাই নয় কি?’ সোয়াশ বছর পরে আজকের দিনেও বিজ্ঞানের ছাত্রদের যদি এই প্রশ্ন করা হয়, আমার বিশ্বাস অধিকাংশই এর সঠিক জবাব দিতে পারবেন না। অথচ এটি পরীক্ষিত সত্য যে পুরুষের মস্তিষ্কের গড় ওজন ও আয়তন মহিলাদের মস্তিষ্কের গড় ওজন ও আয়তনের চেয়ে ১.১ গুণ বেশি। বিজ্ঞান সচেতন বেগম রোকেয়ার কাছে এই সত্যটি অজানা ছিল না। ওপরের প্রশ্নটির উত্তরে সিস্টার সারা বলছেন, ‘মেয়েদের মস্তিষ্ক পুরুষের চেয়ে কিছুটা দ্রুতগতি সম্পন্ন।’ আজ থেকে সোয়াশ বছর পূর্বে এই উক্তিটির বৈজ্ঞানিক সত্যতা কতোটুকু ছিল তা খুঁজে বের করার চেষ্টা আমি করিনি। কিন্তু বর্তমানে এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে ‘গ্রে ম্যাটার’ নামে মস্তিষ্কের যে অংশটিতে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ, স্পর্শ বোঝার ক্ষমতা এবং দেহের পেশি নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে তার পরিমাণ পুরুষ থেকে মহিলাদের বেশি থাকে।”

রোকেয়ার এ উপন্যাস একটি নারীবাদী ইউটোপিয়া। যেখানে পুরুষরা অন্তঃপুরবাসী ও নারীরা রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের কর্ণধার। সেই সঙ্গে সেখানকার নারীরা কেবল বিজ্ঞানমনস্ক তা-ই নয়, নতুন নতুন বিস্ময়কর সব জিনিসের আবিষ্কারক। অতএব সংক্ষিপ্ত এ উপন্যাসটির আরেকটি পরিচয় হলো, এটি রোকেয়ার একটি সফল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি। বিজ্ঞান-লেখক Thomas Lewton ২০১৯-এ Feminist Visions of Science and Utopia in Rokeya Sakhawat Hossain’s ‘Sultana’s Dream প্রবন্ধে একে বলেছেন, ‘বিশ্বে প্রথম দিককার নারীরচিত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিগুলোর একটি।’ তার মতে, রোকেয়া তার সমকালের চেয়ে কয়েক দশক এগিয়ে ছিলেন। এ নারীবাদী বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিটিতে তিনি কেবল বিজ্ঞান ও পুরুষতান্ত্রিকতার যোগসাজশের সমালোচনা করেননি, সমালোচনা করেছেন বিজ্ঞান ও ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদী শক্তির যোগসাজশেরও, যা তখন ভারতকে নিয়ন্ত্রণ করছিল। নারী-অধিকারের জন্য রোকেয়ার জীবনব্যাপী সংগ্রাম ও লেখালিখি বাংলার রাজনৈতিক অগ্রগতি ও ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে মুক্তির বার্তা বহন করেছে বলেও মনে করেন লিউটন।’

রোকেয়ার এ উপন্যাস একটি নারীবাদী ইউটোপিয়া। যেখানে পুরুষরা অন্তঃপুরবাসী ও নারীরা রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের কর্ণধার। সেই সঙ্গে সেখানকার নারীরা কেবল বিজ্ঞানমনস্ক তা-ই নয়, নতুন নতুন বিস্ময়কর সব জিনিসের আবিষ্কারক। অতএব সংক্ষিপ্ত এ উপন্যাসটির আরেকটি পরিচয় হলো, এটি রোকেয়ার একটি সফল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি।

থমাস লিউটন লিখেছেন, “বিজ্ঞান ও সাম্রাজ্যবাদের দীর্ঘকালীন সুসম্পর্কের সমালোচনা রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্ন। রোকেয়া লিখেছেন, ‘আমরা অপরের জমি-জমার প্রতি লোভ করিয়া দুই দশ বিঘা ভূমির জন্য রক্তপাত করি না; অথবা এক খণ্ড হীরকের জন্যও যুদ্ধ করি না,—যদ্যপি তাহা কোহেনূর অপেক্ষা শত গুণ শ্রেষ্ঠ হয়; কিম্বা কাহারও ময়ূর সিংহাসন দর্শনেও হিংসা করি না। আমরা অতল জ্ঞান-সাগরে ডুবিয়া রত্ন আহরণ করি। প্রকৃতি মানবের জন্য তাহার অক্ষয় ভাণ্ডারে যে অমূল্য রত্নরাজি সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছে, আমরা তাই ভোগ করি।”

মোরশেদ শফিউল হাসান লিখেছেন: ‘রোকেয়ার সাহিত্যকর্ম ও তাতে বিধৃত তাঁর চিন্তাচেতনার পরিচয় ক্রমে বাংলা ভাষাভাষী এলাকার বাইরেও চিন্তাশীল ও জিজ্ঞাসু মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করছে। অবরোধ-বাসিনী ও পদ্মরাগসহ তাঁর কয়েকটি রচনা ইতিমধ্যে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীবিষয়ক পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাঁর সুলতানাজ ড্রিম পুস্তকটি।’

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে, কার্বনদূষণের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানবসভ্যতাই আজ যখন হুমকির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ই কেবল আমাদেরকে বাঁচাতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে আশরাফ আহমেদ লিখেছেন: “বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে আজকের যে পৃথিবী ধ্বংস হতে চলেছে, তা বন্ধ করার উপায় খুঁজতে বর্তমান বিশ্বের বাঘা বাঘা সব বিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রনায়করা দুদিন পরপরই মহাসম্মেলন করে চলেছেন। একইভাবে রোগবালাইমুক্ত এবং সুস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা আমাদের প্রচুর টাটকা শাকসবজি ও ফল খেতে উৎসাহিত করছেন। গাছপালা লাগিয়ে পৃথিবীকে সবুজায়ন করতে তারা যেসব সুরাহা বা ফর্মুলা দিচ্ছেন, আজ থেকে সোয়াশ বছর আগে বেগম রোকেয়া ‘সুলতানা’স ড্রিম’-এ তা প্রয়োগ করে গেছেন। কাঠ বা কয়লা পুড়িয়ে বায়ুদূষণ বন্ধ করতে তার সৌরশক্তি ব্যবহারের কথা আগেই আলোচনা করা হয়েছে।”

‘সুলতানার স্বপ্নে’ আছে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতাযুদ্ধের কথা। ‘নারীস্থান’ একটি আগ্রাসি বিদেশি শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হলে দেশের আপামর জনসাধারণ সে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নারীস্থানের স্বাধীনতা রক্ষা হয় সেখানকার নারীদের বুদ্ধিমত্তার ফলে। পুরুষ সৈন্যদের পরাজয়ের পর নারীদের ডাক পড়ে দেশ রক্ষার জন্য। তারা দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করেন সৌরশক্তির মতো অগ্রসর বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি, যা তখন ছিল কল্পনাতীত, তার ব্যবহার দ্বারা। নারীস্থানের সৈনিকরা পরাজিত সৈন্যদের অস্ত্রশস্ত্র কুড়িয়ে গুদামজাত করেননি, পুড়িয়ে ফেলেছেন। নারীস্থানের এই স্বাধীনতাযুদ্ধ একে একটি অনন্য যুদ্ধবিরোধী গল্পের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে।

নারীস্থানের লেডি প্রিন্সিপাল কৌতূহলী সুলতানাকে যুদ্ধজয়ের কৌশল বলছেন এভাবে:

“আমাদের সার্চলাইটে ভয়ানক উত্তাপ ছিল। ছাত্রীগণ সেই সার্চলাইটের কেন্দ্রীভূত উত্তাপ-রশ্মি শত্রুর দিকে পরিচালিত করিলেন,—তখন তাহারা হয়ত ভাবিয়াছিল, একি ব্যাপার! শত সহস্র সূর্য মর্তে অবতীর্ণ! সে উগ্র উত্তাপ ও আলোক সহ্য করিতে না পারিয়া শত্রুগণ দিকবিদিক্ জ্ঞানশূন্য হইয়া পলায়ন করিল! নারীর হস্তে একটি লোকেরও মৃত্যু হয় নাই—একবিন্দু নরশোণিতেও বসুন্ধরা কলঙ্কিত হয় নাই—অথচ শত্রু পরাজিত হইল! তাহারা প্রস্থান করিলে পর তাহাদের সমুদয় অস্ত্রশস্ত্র সূর্যকিরণে দগ্ধ করা গেল।”

রোকেয়াকে কেবল বাঙালি মুসলমান সমাজের মুক্তির বার্তাবাহক মনে করলে তাকে খণ্ডিত করে দেখা হবে। কারণ, বাঙালি মুসলমান নারীর যে সংকট, তা প্রতিবেশী অঞ্চলেও আছে। তার সুলতানার স্বপ্নের ‘নারীস্থান’ এমন এক নারীবাদী ইউটোপিয়া, যা দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে সীমান্ত অতিক্রমকারী যেহেতু নারীর পরাজয়ও ব্যতিক্রম বাদ দিলে বৈশ্বিক। তাই তাকে সহজেই বলা যায় ‘দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে নারীমুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত’।১০

বেগম রোকেয়া নারীর মুক্তিকে সমাজের সার্বিক মুক্তি থেকে আলাদা করে দেখেননি। নারীমুক্তির বাহন হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন তাদের মাঝে শিক্ষাবিস্তারকে। লেখালিখিতে প্রতিষ্ঠালাভের চেয়ে তিনি বেশি মনোযোগ দিয়েছিলেন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় এবং রক্ষণশীল মুসলমান পরিবারের মেয়েদের উদার আধুনিক জীবনযাপন ও বিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পরিচয় করানোয়। রোকেয়া লিখেছেন: “আজি কালি অধিকাংশ লোকে শিক্ষাকে কেবল চাকরী লাভের পথ মনে করে। মহিলাগণের চাকরী গ্রহণ অসম্ভব। সুতরাং এই সব লোকের চক্ষে স্ত্রীশিক্ষা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক।”১১

শিক্ষা বলতে বেগম রোকেয়া কেবল সনদপ্রাপ্তি বুঝতেন না, প্রকৃত শিক্ষা বলতে বুঝতেন যা মানুষের মনকে বিকশিত করে। সে ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি তার শিক্ষাচিন্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। তার লেখালিখিতে জীবনযাপনের সবক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বিদ্যমান। শিক্ষাক্ষেত্রে এখন চারদিকে যে নৈরাজ্য, সন্ত্রাস, নোংরামি, লজ্জাজনকসব ঘটনা ঘটছে, তখন আমাদের শিক্ষাজীবনের কর্ণধারদের রোকেয়ার শিক্ষাভাবনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া প্রয়োজন।

‘নারীস্থানে’র ভগিনী সারা সুলতানারূপী রোকেয়াকে বলেছেন, ‘আমাদের ধর্ম্ম প্রেম ও সত্য।’১২ আজ যখন ধর্ম ক্রমান্বয়ে উগ্র রূপ ধারণ করে সংকীর্ণ রাজনৈতিক ফায়দা লুটার উপায়ে পরিণত হচ্ছে, তখন নারীস্থানের সুলতানার ধর্মচিন্তার সঙ্গে আমাদের আরও বেশি পরিচিত হওয়া প্রয়োজন।

ক্রমবর্ধমান নারী-শিশু নির্যাতন, শিক্ষক নির্যাতন, ধর্মীয় উগ্রতা, বিজ্ঞানবিদ্বেষের এই নেতিবাচক কালে রোকেয়া অনেক জরুরি। বেগম রোকেয়াকে তাই কেবল ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ ‘দিবস’ (৯ ডিসেম্বর রোকেয়া দিবস; তার জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর ও মৃত্যু ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর) ও ‘পদকে’র মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে শ্রমজীবীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে।

তার অগ্রসর রাষ্ট্রীয় চিন্তার প্রমাণ হিসেবে আরও উল্লেখ করা যায়, সুলতানার এ স্বপ্নের রাজ্যে কোনো অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড নেই, মহামারি নেই, কর্মসময় দৈনিক দুই ঘণ্টা, শিশুমৃত্যু ও অকালমৃত্যু দুর্ঘটনা ছাড়া নেই বললেই চলে, মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স একুশ, অধিবাসীদের প্রধান খাবার ‘ফল’ (প্রাণিজ আমিষ নয়, যার ফলে অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত ও মানবিক)—এ রকম অনেক সামাজিক-রাষ্ট্রিক অর্জন যার কিছু কিছু এখনকারই অনেক উন্নত রাষ্ট্রে বাস্তবায়নের পথে।১৩

সুলতানার এ স্বপ্নের রাজ্যে কোনো অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড নেই, মহামারি নেই, কর্মসময় দৈনিক দুই ঘণ্টা, শিশুমৃত্যু ও অকালমৃত্যু দুর্ঘটনা ছাড়া নেই বললেই চলে, মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স একুশ, অধিবাসীদের প্রধান খাবার ‘ফল’ (প্রাণিজ আমিষ নয়, যার ফলে অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত ও মানবিক)—এ রকম অনেক সামাজিক-রাষ্ট্রিক অর্জন যার কিছু কিছু এখনকারই অনেক উন্নত রাষ্ট্রে বাস্তবায়নের পথে।১৩

ওই রাজ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রযুক্তি ব্যবহারে অতি অগ্রসর, সেখানকার রাজনীতি-অর্থনীতি মানবিক, প্রকৃতিবান্ধব ও সুখকেন্দ্রিক। তারা মোট জাতীয় উৎপাদনের বা জিডিপির হিসাব কষে রাষ্ট্রের সাফল্য নির্ণয় করে না; বরং মোট সুখ পরিমাপ করে হয়তো। ভগিনী সারাকে তাই সুলতানা উচ্ছ্বসিত হয়ে নারীস্থান সম্পর্কে বলছেন: “আহা মরি! ইহার নাম ‘সুখস্থান’ হয় নাই কেন?”১৪ পৃথিবীর অনেক দেশ এখন মোট আয় বা অর্থ বা টাকা নির্দেশক জিডিপির শিকল ছিঁড়ে প্রত্যেক মানুষের সুখ বৃদ্ধির লক্ষ্যে অর্থনীতি ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছে। জাতিসংঘের উদ্যোগে অনেক দিন ধরে ২০ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক সুখ দিবস’ হিসেবে পালিত হয় এবং প্রতি বৎসর নিয়মিত একটি ‘বিশ্ব সুখ প্রতিবেদন’ প্রকাশিত হয়।১৫

ভবিষ্যতের মানবিক রাষ্ট্রগুলোয় এসব আর কেবল সুলতানার স্বপ্ন হয়ে থাকবে না, দৈনন্দিন বাস্তবতা হয়ে উঠবে। তবে নিশ্চয়ই সুলতানার মতো কেবল ‘শয়নকক্ষে আরাম কেদারায়’ বসে বসে ওই স্বপ্নের রাজ্যে যাওয়া যাবে না; তার জন্য আমাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে, অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার পথ পাড়ি দিতে হবে। কাউকে কাউকে গৃহবন্দিও করতে হতে পারে, তবে তা জেন্ডারভিত্তিক হবে না, হবে শ্রেণিভিত্তিক। জেন্ডারদাসী ও শ্রেণিদাস উভয়কে হাতে হাত মেলাতে হবে সেই সংগ্রামী অভিযাত্রায়।

আলমগীর খান: সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি

ই-মেইল: alamgirhkhan@gmail.com

তথ্যসূত্র:

১. স্ত্রীজাতির অবনতি, রোকেয়া রচনাবলী, ২০০৬, উত্তরণ, ঢাকা, পৃ. ২৯

২. শহিদুল ইসলাম, বেগম রোকেয়ার লড়াই ও বর্তমান বাংলাদেশ, অনুষ্টুপ (সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক), সপ্তবিংশ বর্ষ, শারদীয় সংখ্যা ১৩৯৯ (১৯৯২)

৩. বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ একটি আদর্শ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি (ছোটকাগজ), মে ২০২২, ঢাকা, পৃ. ১০

৪. ওই, পৃ. ২০

৫. https://www.ladyscience.com/features/feminist-visions-science-fiction-utopia-rokeya-hossain

৬. ওই

৭. ভূমিকা, রোকেয়া রচনাবলী, উত্তরণ, ২০০৬, পৃ. ১৫

৮. বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি, পৃ. ২১

৯. রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন-এর সুলতানার স্বপ্ন ও Sultana’s Dream, সম্পাদনা: সরিফা সালোয়া ডিনা, শোভা প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৮

১০. https://www.marxists.org/glossary/people/b/e.htm#begum-rokeya

১১. স্ত্রীজাতির অবনতি, রোকেয়া রচনাবলী, উত্তরণ, ২০০৬, পৃ. ৩৬

১২. সুলতানার স্বপ্ন, পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৮

১৩. ওই, পৃ. ১২০-১২৭

১৪. ওই

১৫. https://worldhappiness.report/ed/2021

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •