যুক্তরাষ্ট্রের এলিজাবেথ নদী দূষণমুক্তকরণ প্রকল্প

যুক্তরাষ্ট্রের এলিজাবেথ নদী দূষণমুক্তকরণ প্রকল্প

আতিয়া ফেরদৌসী

ঔপনিবেশিক শাসনকালে পুঁজির ক্রমবর্ধমান দাপটে যুক্তরাষ্ট্রে যখন আদি আমেরিকানসহ মানুষ প্রাণ প্রকৃতি ছিন্নভিন্ন হচ্ছিলো তখন আরও অনেককিছুর সাথে নদীগুলোও দূষণ অব্যবস্থায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। অনেক পরে নাগরিকদের চাপ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নাগরিকদের পাশাপাশি নদীসহ প্রকৃতি সুরক্ষার জন্যও বহুরকম আইনী ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেয়া হয়। এই লেখায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি নদীর মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে জীবনপ্রাপ্তির অভিজ্ঞতা পরীক্ষা করা হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এই অভিজ্ঞতা বহুভাবেই প্রাসঙ্গিক।

নতুন চাকরি নিয়ে প্রথম যখন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার নরফোক শহরে আসি, তখন সবকিছু আমার কাছে নতুন। এমন একটা মানুষ নেই যাকে চিনি, এমনকি শহরের পরিবেশ-আবহাওয়াটাও আমার আগের শহর থেকে আলাদা মনে হলো। তবে শহরকে আপন লাগল এর বুকের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এলিজাবেথ নদী দেখে। নদীর দেশের মানুষ হিসেবে তো বটেই, নদীঘেঁষা শহরে বেড়ে ওঠার কারণে নদী নিয়ে আমার আগ্রহ বরাবরই বেশি। গাড়ির জানালা দিয়ে, শাটল ট্রেন থেকে কিংবা অফিসের ছাদ থেকে এই নদীর দিকে তাকিয়ে অসংখ্যবার আমি মুগ্ধ হয়েছি। মনে মনে দেশের নদীর কথা ভেবেছি।

কিন্তু প্রথম যেদিন এই নদীকে খুব কাছ থেকে দেখি, খেয়াল করি যে, এর পানি ঠিক টলটলে স্বচ্ছ নয়, যেমনটা আমি আশা করেছিলাম এবং নদীর কোনো কোনো তীরের কাছের নোংরা দূষণ খালি চোখেই ধরা পড়ে। আমি এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের যে গুটিকয় রাজ্যে গেছি, সেখানে নদীর এই দুর্দশা চোখে পড়েনি। কথা প্রসঙ্গে আমি তাই নানাজনকে নদীর এই দুর্দশার কারণ জিজ্ঞেস করি। যা জানতে পারি তা অনেকটা এরকম: এই নদীর পরিস্থিতি আগে ছিল আরও ভয়াবহ। একজন আমাকে জানায়, ছোটবেলায় তারা নদীর পানিতে রংধনু খুঁজে পাওয়ার খেলা খেলত। তাদের ধারণা ছিল নদীর পানি এমনই হয়। বড় হয়ে তারা বুঝতে পারে, এই রংধনু আসলে পানির উপরের তেল ও পেট্রোলিয়ামের স্তর। সেই বাজে পরিস্থিতি থেকে এই নদীর এখন অনেকখানি উত্তরণ ঘটেছে। এই উত্তরণ সম্ভব হয়েছে নানারকম সমন্বিত সামাজিক উদ্যোগ, সরকারি সহযোগিতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীন গবেষণা ও নানারকম বেসরকারি স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে। এই নদী দূষণমুক্ত করার উদ্যোগের আদ্যোপান্ত নিয়েই আজকের এই লেখার অবতারণা।

প্রথম যেদিন এই নদীকে খুব কাছ থেকে দেখি, খেয়াল করি যে, এর পানি ঠিক টলটলে স্বচ্ছ নয়, যেমনটা আমি আশা করেছিলাম এবং নদীর কোনো কোনো তীরের কাছের নোংরা দূষণ খালি চোখেই ধরা পড়ে। আমি এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের যে গুটিকয় রাজ্যে গেছি, সেখানে নদীর এই দুর্দশা চোখে পড়েনি।

ছবি ১। এলিজাবেথ নদী ঘিরে গড়ে ওঠা নরফোক শহর। শহরের প্রয়োজনীয় যাতায়াত, অবকাশ ভ্রমণ ও মালামাল পরিবহণে এই নদীর ভূমিকা অন্যতম।

এলিজাবেথ নদীর দূষণের ইতিহাস: এলিজাবেথ নদীর মূল ধারাটি মূলত ৫ মাইলের মতো লম্বা চেসাপেক উপসাগরের একটি মোহনা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় হিসেবে এটি পরিচিত। এর শাখা-প্রশাখা মিলিয়ে নদীটি প্রায় ২১ মাইল লম্বা। অতলান্তিক মহাসাগরের খুব কাছে হওয়ায় এই নদীর পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা অনেক বেশি। বিখ্যাত হ্যাম্পটন রোডসংলগ্ন চারটি শহরের প্রায় ২৫০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে এই নদীর জলবিভাজিকা (Watershed), নরফোক তারমধ্যে একটি। বাকি তিনটি শহর হলো: চেসাপেক, পোর্টসমাউথ ও ভার্জিনিয়া বিচ। সব মিলিয়ে ৫ লাখ পরিবারের বসবাস এই অঞ্চলজুড়ে। নদীর নামটিই বলে দেয়, এই নামের ইতিহাস ব্রিটিশদের হাত ধরে (যদিও এই নদীর নাম রানি প্রথম এলিজাবেথ-এর নামানুসারে নয়; বরং রাজা প্রথম জেমস-এর কন্যা প্রিন্সেস এলিজাবেথ স্টুয়ার্ট-এর নামানুসারে রাখা হয়েছে)। ইতিহাসের উৎসুক পাঠকরা জানেন, আমেরিকায় ব্রিটিশদের প্রথম স্থায়ী কলোনি ছিল জেমসটাউন, ভার্জিনিয়ায় এবং এখান থেকেই আমেরিকার ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অধ্যায়ের যাত্রা শুরু। ১৬০৭ সালে এই জেমসটাউনে কলোনিস্টরা পৌঁছানোর কিছুদিনের মধ্যেই নদীপথে পশ্চিমে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রথম যে নদীটির দেখা পায়, তার নামকরণ করে জেমস নদী (তৎকালীন রাজা প্রথম জেমস-এর নামানুসারে)। প্রথম কয়েক বছর জেমস নদীর তীর ঘেঁষেই তারা উপনিবেশ বাড়াতে থাকে। স্প্যানিশসহ অন্য ইউরোপীয় কলোনিস্টদের থেকে নিরাপদ থাকা এবং জলসীমা বা সামুদ্রিক পথের কাছাকাছি থাকার জন্য নিরাপদ জায়গার খোঁজ করতে গিয়ে তারা কয়েক বছরের মধ্যেই নিকটবর্তী এলিজাবেথ নদী খুঁজে পায় ও এর তীর ঘেঁষে উপনিবেশ গড়ে তুলতে থাকে। জানা যায়, ব্রিটিশদের আগে স্থানীয় নেটিভ আমেরিকানরা এই নদীকে চিসাপেক নামে ডাকত। এলিজাবেথ নদী ভার্জিনিয়ার এমন উপকূলীয় জলপথের অংশ, যা ধরে গভীর সমুদ্র এড়িয়ে নিরাপদে সোজা ফ্লোরিডা রাজ্যে পৌঁছানো সম্ভব। তাই এই নদীর গুরুত্ব একটু বেশিই ছিল।

আমেরিকায় ব্রিটিশদের প্রথম স্থায়ী কলোনি ছিল জেমসটাউন, ভার্জিনিয়ায় এবং এখান থেকেই আমেরিকার ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অধ্যায়ের যাত্রা শুরু। ১৬০৭ সালে এই জেমসটাউনে কলোনিস্টরা পৌঁছানোর কিছুদিনের মধ্যেই নদীপথে পশ্চিমে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রথম যে নদীটির দেখা পায়, তার নামকরণ করে জেমস নদী (তৎকালীন রাজা প্রথম জেমস-এর নামানুসারে)। প্রথম কয়েক বছর জেমস নদীর তীর ঘেঁষেই তারা উপনিবেশ বাড়াতে থাকে।

ছবি ২। শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা এলিজাবেথ নদী। পথচারী ও সাইকেল আরোহীদের প্রিয় এই পথ।

অন্য অসংখ্য প্রাকৃতিক সম্পদের মতো এই নদীর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব একই সঙ্গে এর সমৃদ্ধি ও সর্বনাশের কারণ। প্রাক-ঔপনিবেশিক সময়ে হাজার হাজার বছর ধরে চেসাপেক উপসাগর অঞ্চলে নেটিভ আমেরিকানদের ওয়েস্টার শিকারের প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে সেই সময় শিকারের মূল উদ্দেশ্য ছিল পরিবার বা গোষ্ঠীর খাদ্যচাহিদা মেটানো। তাই এতে বাস্তুতন্ত্রের ওপর তেমন কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়েনি। ঔপনিবেশিক সময়ে এই শিকারের হার বহুগুণে বাড়তে থাকে। খাবারের উদ্দেশ্য ছাড়াও চুন উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ওয়েস্টার প্রাচীর খনন করা হতে থাকে।এই চুন ব্যবহার করা শুরু হয় নতুন বানানো রাস্তার বেড, রেলপথের ব্যালাস্ট, পোলট্রির খাবার ইত্যাদির উপকরণ হিসেবে। আঠারো শতকের প্রথমদিকে নিউ ইংল্যান্ড ওয়েস্টার ফিশারি কোম্পানি নিজেদের এলাকার ঝিনুক-প্রাচীর নিঃশেষ করার পর ভার্জিনিয়ায় আসে এবং প্রথম ব্যাপক হারে এই অঞ্চলে ঝিনুক-প্রাচীর খনন করতে থাকে। ১৮৪৪ সালের দিকে এই উপসাগরীয় অঞ্চলের ওয়েস্টার টিনজাত করে বৃহৎ পরিসরে আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে সরবরাহ শুরু হয়।

এরপর ১৮৮০ সালের শেষদিকে ওয়েস্টার উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য ধস নামা শুরু করে। ওয়েস্টার চাষিরা অভিযোগ করতে শুরু করেন, ভয়াবহ ড্রেজিংয়ের ফলে ওয়েস্টার প্রাচীরগুলো বিলুপ্ত প্রায়। এ ছাড়া নানা ইন্ডাস্ট্রি ও স্যুয়ারেজের লাইন এই উপসাগরে মেশার কারণে পানি অতিমাত্রায় দূষিত হয়ে পড়েছিল। জনস্বাস্থ্য রিপোর্টে দেখা যায়, এখানকার মাছ, ওয়েস্টার ও ক্ল্যাম খাওয়ার ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এসবের ফলে ১৯২০ সালে ভার্জিনিয়া রাজ্য সরকার আইন করে পুরো উপসাগরীয় এলাকার দূষিত পানিতে ওয়েস্টার শিকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

১৮৮০ সালের শেষদিকে ওয়েস্টার উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য ধস নামা শুরু করে। ওয়েস্টার চাষিরা অভিযোগ করতে শুরু করেন, ভয়াবহ ড্রেজিংয়ের ফলে ওয়েস্টার প্রাচীরগুলো বিলুপ্ত প্রায়। এ ছাড়া নানা ইন্ডাস্ট্রি ও স্যুয়ারেজের লাইন এই উপসাগরে মেশার কারণে পানি অতিমাত্রায় দূষিত হয়ে পড়েছিল। জনস্বাস্থ্য রিপোর্টে দেখা যায়, এখানকার মাছ, ওয়েস্টার ও ক্ল্যাম খাওয়ার ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।

দূষণের আরও কারণ

১৭৬৭ সালে নদীমুখের একদম কাছে স্থাপন করা হয় নরফোক নাভাল ইয়ার্ড। পৃথিবীর সর্বপ্রথম এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এই নেভাল ইয়ার্ডের ড্রাই ডকে বানানো হয়েছিল, যেখানে কাজ করত ৪৩ হাজারের বেশি মানুষ। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে নরফোক শহর এবং এলিজাবেথ নদী অনেক খ্যাতির মুকুট মাথায় পরে ফেলে, যেমন: নতুন বিশ্বের বাণিজ্যিক কেন্দ্র, ইউএস নেভির জন্মস্থান, জাহাজ নির্মাণের তীর্থস্থান ইত্যাদি। এটি সেই সময়, যখন মুনাফা হয়ে উঠছে পৃথিবীর চালিকাশক্তি। ঔপনিবেশিক শক্তির মূল নজর তখন ক্ষমতার বলয় বাড়িয়ে তোলা, অন্যান্য ঔপনিবেশিক শক্তি ছাড়িয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখা এবং সবকিছুর ওপর মুনাফার হার ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে তোলা। আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধ থেকে সিভিল ওয়ার এবং শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ‒সবকিছুর সরব সাক্ষী এই নরফোক নেভাল ইয়ার্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই ইয়ার্ড ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ মেরামতের প্রাথমিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। প্রায় ৬ হাজার ৮৫০টি জাহাজ এই ইয়ার্ডে মেরামত করা হয় যুদ্ধকালীন সময়ে। স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃতি, সাধারণ মানুষ কিংবা নদী-উপসাগর এবং এর ইকোসিস্টেম নিয়ে চিন্তার কথা বলা সে সময়ের ক্ষমতাবানদের কাছে বাতুলতা ছাড়া কিছুই ছিল না। তাই এই জনস্বার্থবিচ্ছিন্ন খ্যাতির চড়া মূল্য গুনতে হয়েছে/হচ্ছে পরের অনেক প্রজন্ম ধরে।
এসব যুদ্ধজাহাজ, কামানের গোলার দাপট ছাড়াও এই নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য শিল্পকারখানা, সেই সঙ্গে বহুগুণে বাড়তে থাকে মানুষের বসতি। এর সঙ্গে যোগ হয় স্টর্ম ওয়াটার রানঅফ ও স্যুয়ারেজ সিস্টেম, যা নানারকম কীটনাশক, ভারী ধাতু ও কেমিক্যাল বহন করে নদীর পানিতে ফেলে পানিকে দূষিত করতে থাকে। তবে এই দূষণ সৃষ্টির দক্ষযজ্ঞে অন্যতম ভূমিকা রেখেছিল কাঠ প্রক্রিয়াজাত কারখানা (উড ট্রিটমেন্ট ফ্যাসিলিটি)। এ এলাকায় কাঠের প্রতুলতা, আবার শিপইয়ার্ড ও রেলপথের জন্য কাঠের অস্বাভাবিক চাহিদার ফলে এই উড ফ্যাসিলিটি জমজমাট হয়ে ওঠে। এসব কারখানার কয়লা ও আলকাতরা থেকে নিঃসৃত ক্রিয়োসোট (Creosote) এই নদীর দূষণের এক অন্যতম কারণ বলে বিভিন্ন গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, উনিশ শতকে নরফোক ছিল কয়লা রপ্তানির সর্ববৃহৎ বন্দর।

খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে নরফোক শহর এবং এলিজাবেথ নদী অনেক খ্যাতির মুকুট মাথায় পরে ফেলে, যেমন: নতুন বিশ্বের বাণিজ্যিক কেন্দ্র, ইউএস নেভির জন্মস্থান, জাহাজ নির্মাণের তীর্থস্থান ইত্যাদি।

দূষণ প্রতিকারের উদ্যোগ

আগেই উল্লেখ করেছি, ১৯২০ সাল থেকে এলিজাবেথ নদীতে ওয়েস্টার শিকার বন্ধ রয়েছে। সেই সময় থেকেই বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিপর্যায়ে এই নদীর পানি ও মাছ শিকার নিয়ে পর্যালোচনা, উদ্বেগ জারি ছিল। ১৯৭৬ সালে ভার্জিনিয়া স্টেট ওয়াটার কনট্রোল বোর্ড একটি রিপোর্ট তৈরি করে। ইউএস কংগ্রেস ও এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি (ইপিএ) বরাবর এই রিপোর্ট পেশ করার দায়িত্ব ছিল এই বোর্ডের। এই রিপোর্টে এলিজাবেথ নদীর পানিকে স্টেটের অন্যতম দূষিত পানি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এর আগে কাঠকয়লা থেকে যে ক্রিয়োসোট নিঃসরণের কথা আমরা জেনেছি, সেই ক্রিয়োসোটের অন্যতম উপাদান পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন (পিএএইচ)। এলিজাবেথ নদীতে এই পিএএইচ নিয়ে প্রথম স্টাডির খোঁজ পাওয়া যায় ১৯৮৫ সালে (Merrill and Wade) মানব শরীরে পিএএইচ-এর ভয়ানক প্রভাব সম্পর্কে সেই সময়ই প্রথম বিস্তারিত গবেষণা শুরু হয়। এলিজাবেথ নদীর ইকোসিস্টেমের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি আটলান্টিক কিলিফিশ বা মাম্মিচগ (Fundulus heteroclitus) একধরনের মাছ, যার শরীরে ব্যাপক হারে এই পিএএইচ-এর উপস্থিতি পাওয়া যায় এবং গবেষণা স্যাম্পলের অধিকাংশ মাছের শরীরে ক্যানসারের উপস্থিতি দেখা যায়। এই মাছ থেকে মানব শরীরে ক্যানসার ছড়ানো খুবই সহজ বলে গবেষণায় প্রকাশ পায়।

১৯৯৩ সালে ইপিএ এই নদীকে কেমিক্যাল দূষণ আক্রান্ত অন্যতম ‘উদ্বেগজনক অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। ১৯৯৫ সালে ইপিএ-র নির্দেশনায় উড ট্রিটমেন্ট ফ্যাসিলিটিগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যায় কিংবা স্থান বদল করে এবং বর্জ ব্যবস্থাপনার জন্য নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

এলিজাবেথ নদী রক্ষায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটে ১৯৯৩ সালে। এ বছর নাগরিক উদ্যোগে ভলান্টারি সংগঠন ‘এলিজাবেথ রিভার প্রজেক্ট’ (ইআরপি) গঠিত হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল মৃতপ্রায় এই নদীকে রক্ষা করা ও দূষণমুক্ত করা। জানা যায়, চারজন বন্ধুর কোনো এক কিচেন-টেবিল আলোচনা থেকে এই সংগঠনের যাত্রা শুরু।

তবে এলিজাবেথ নদী রক্ষায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটে ১৯৯৩ সালে। এ বছর নাগরিক উদ্যোগে ভলান্টারি সংগঠন ‘এলিজাবেথ রিভার প্রজেক্ট’ (ইআরপি) গঠিত হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল মৃতপ্রায় এই নদীকে রক্ষা করা ও দূষণমুক্ত করা। জানা যায়, চারজন বন্ধুর কোনো এক কিচেন-টেবিল আলোচনা থেকে এই সংগঠনের যাত্রা শুরু। এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ও কো-ফাউন্ডার মারজোরি মেফিল্ড জ্যাকসন, যিনি প্রায় এক যুগ ধরে সাংবাদিকতা করেছেন এবং পুলিৎজার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। লয়োলা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট মারজোরি পরিবেশগত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বিস্তৃত প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এই ‘এলিজাবেথ রিভার প্রজেক্ট’ স্থানীয় বিজনেস, নাগরিক, স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়, লাইব্রেরি ও সরকার সবাইকে যুক্ত করে ১৯৯৬ সালে প্রথম ওয়াটারশেড অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করে। পরের বছরই এই প্ল্যান অনুযায়ী প্রথম জলাশয় পুনরুদ্ধার প্রজেক্টের কাজ শুরু হয়, যার নাম দেওয়া হয় বার্ডসং ওয়েটল্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট। এই প্রজেক্টটি তত্ত্বাবধান করে নরফোক পাবলিক লাইব্রেরির লার্চমন্ট শাখা। লার্চমন্ট লাইব্রেরির পার্শ্ববর্তী এলিজাবেথ নদীর প্রায় ৩০০ ফুট উপকূলরেখা এবং প্রায় ১৫ হাজার স্কয়ারফুট জলাভূমি পুনরুদ্ধার করা হয়। এই প্রজেক্টের ডিজাইন করা হয় ভার্জিনিয়া ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সের সহযোগিতায়। পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার খুঁটিনাটি এখানে আর বর্ণনা করছি না, তবে এর মাধ্যমে নদীর পানির মান ও বাস্তুসংস্থান পুনরুদ্ধার ছাড়াও লবণাক্ত পানির জলাবদ্ধতা দূর করে পার্শ্ববর্তী এলাকায় সবজি চাষ সম্প্রসারিত হয়।

ছবি ৩। ‘The goo must go’ প্রকল্পের চিত্র। প্রায় দেড় মিলিয়ন ডলার ব্যয়। এই প্রকল্পের খরচের অধিকাংশ বহন করেছে ফেডারেল, স্টেট ও সিটি গভর্নমেন্ট।

একই বছর ইআরপির উদ্যোগে শিল্পকারখানার জন্য রিভার স্টার প্রোগ্রাম চালু করা হয়। এই প্রোগ্রামে স্থানীয় ব্যাবসা-কারখানা যে কেউ বিনা খরচে যোগ দিতে পারবে। নির্দিষ্ট ক্যাটাগরির মধ্য থেকে যে কটি সম্ভব দূষণ কমানোর উদ্যোগ নিয়ে সেই সম্পর্কে জানাতে হয়। এ-সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র জমা দিতে হয়। ইআরপির রিভিউ বোর্ড সেগুলো রিভিউ করে সেই প্রতিষ্ঠানকে ফলাফল জানায়। সেই অনুযায়ী রিভার স্টার খেতাব পায় প্রতিষ্ঠানগুলো। বছরে একবার স্থানীয় সরকার প্রণোদনামূলক কিছু পুরস্কার ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে এই রিভার স্টার প্রজেক্ট আবাসিক বিল্ডিং, নন প্রফিট সংগঠন ইত্যাদিকেও যুক্ত করে। ২০২১ সালের স্টার তালিকা থেকে দেখা যায়, প্রায় ৪৮টি প্রতিষ্ঠান ট্রিপল স্টার অর্জন করেছে, ৩৮টি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে ডাবল স্টার, ৫১টি পেয়েছে সিঙ্গেল স্টার। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওয়াটারশেড অ্যাকশন প্ল্যানের ক্রমান্বয় সাফল্যের পর ইআরপি একটি নতুন প্রকল্প নেয়, যার নাম দেওয়া হয় ‘The goo must go’। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল নদীগর্ভ থেকে ক্রিয়োসোটের স্তর পরিষ্কার করা। এই প্রকল্পে বেশ সাড়া পাওয়া যায় নানা স্তরের সংগঠন ও স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে। ফলে নির্দিষ্ট কয়েকটি অতি দূষিত এলাকার নদীগর্ভ পরিষ্কারের কাজ শুরু হয়।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওয়াটারশেড অ্যাকশন প্ল্যানের ক্রমান্বয় সাফল্যের পর ইআরপি একটি নতুন প্রকল্প নেয়, যার নাম দেওয়া হয় ‘The goo must go’। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল নদীগর্ভ থেকে ক্রিয়োসোটের স্তর পরিষ্কার করা।

উদ্যোগের পর্যালোচনা ও নদীর বর্তমান পরিস্থিতি

‘এলিজাবেথ রিভার প্রজেক্ট’ ২০২০-এর ডিসেম্বরে এই প্রজেক্টের কাজের পর্যালোচনামূলক একটি বিস্তৃত রিপোর্ট প্রকাশ করে। নদীর পানি, পলল, জলজ প্রাণী এবং উদ্ভিদ সংগ্রহ করে গবেষণাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে একটি স্কোরকার্ড প্রস্তুত করে গবেষকদল। এই গবেষকদলের মধ্যে ছিল ভার্জিনিয়া ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স, উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি সেন্টার ফর কনজারভেটিভ বায়োলজি, ওল্ড ডোমিনিয়ন ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ম্যারিল্যান্ডের গবেষকরা। এ ছাড়াও আরও প্রায় ডজনখানেক গবেষক এই কাজে শ্রম দিয়েছেন। এই রিপোর্ট ২০১৪ এবং ২০২০-এর তুলনামূলক পর্যালোচনার মাধ্যমে নদী প্রকল্পের সাফল্য ও ব্যর্থতা তুলে ধরা হয়।

এই স্কোরকার্ডে গ্রেডিং সিস্টেমের মতো বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে A, B, C, D, E, F‒এই পাঁচ রকমের গ্রেডিং দেওয়া হয় নদীর ৫টি শাখার ওপর।

গ্রেডিংয়ের ক্যাটাগরিগুলো ছিল এ রকম:

ক্যাটাগরি

বর্ণনা

ব্যাকটেরিয়া (মানব সংস্পর্শ)

নদীতে বিনোদনমূলক কার্যক্রমের ফলে মানবদেহে এনটারোককাস ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ

ব্যাকটেরিয়া (শেলফিশ)

নদীর পানিতে ফেকাল কলিফর্মের উপস্থিতি

নদীগর্ভের স্বাস্থ্য

নদীগর্ভে জলজ প্রাণের প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্য

মাছের ক্যানসার

মাম্মিচগ মাছের লিভারে ক্যানসার ও প্রাক-ক্যানসার পর্যায়ের উপস্থিতি

নির্মলতা

পানির মধ্যে সূর্যের আলোর অনুপ্রবেশ মাত্রা

দূষণকারক

নদীর পললে পলিসাইক্লিক হাইড্রোকার্বনের উপস্থিতি

দ্রবীভূত অক্সিজেন

পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা, যা জলজ জীবনের জন্য অপরিহার্য

ফসফরাস

পানিতে ফসফরাসের মাত্রা, যার অতিরিক্ত উপস্থিতি শৈবাল ও মাছের মৃত্যু ঘটায়

নাইট্রোজেন

পানিতে নাইট্রোজেনের মাত্রা, যার অতিরিক্ত উপস্থিতি শৈবাল ও মাছের মৃত্যু ঘটায়

ক্লোরোফিল

পানিতে ক্লোরোফিলের মাত্রা, শৈবাল বা ফাইটোপ্লাংকটন নদীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

টিবিটি

পানিতে ট্রিবিউটিলিনের মাত্রা, যা মারাত্মক দূষণের কারণ

নদীর পাঁচটি শাখায় প্রতিটি ক্যাটাগরিতে গ্রেড দেওয়ার পর প্রতি শাখার সামগ্রিক গ্রেড দেওয়া হয়। প্রতি শাখার সামগ্রিক গ্রেড অনুযায়ী এলিজাবেথ নদীর ২০২০ সালের গ্রেড C।

নদীর শাখা

২০১৪ গ্রেড

২০২০ গ্রেড

মেইন স্টেম

C

B

লাফায়েতে

C

C

পূর্ব শাখা

D

C

 ক) ব্রড ক্রিক

F

D

খ) ইন্ডিয়ান নদী

F

C

দক্ষিণ শাখা

D

C

প্যারাডাইজ ক্রিক

D

C

পশ্চিম শাখা

C

C

উল্লেখ্য, নদীর প্রতিটি শাখায় সব ক্যাটাগরিতে পরীক্ষা করা হয়নি। ভিন্ন ভিন্ন শাখা নদীর পরিস্থিতি বিবেচনায় ক্যাটাগরির সংখ্যায় তারতম্য করা হয়েছে। নিচে সামগ্রিক স্কোরকার্ড দেওয়া হলো।

নদীর শাখা

ব্যাকটেরিয়া (মানব সংস্পর্শ)

ব্যাকটেরিয়া (শেলফিশ)

নদীগর্ভের স্বাস্থ্য

মাছের ক্যানসার

নির্মলতা

দূষণকারক

দ্রবীভূত অক্সিজেন

ফসফরাস

নাইট্রোজেন

ক্লোরোফিল

টিবিটি

শাখার স্কোর

শাখার গ্রেড

মেইন স্টেম

B

A

C

C

C

C

A

C

C

C

B

৩.০৫

B

লাফায়েতে

B

C

D

C

D

B

A

D

B

C

A

২.৮৬

C

পূর্ব শাখা

B

 

F

F

C

D

B

D

C

C

B

২.২০

C

ব্রড ক্রিক

F

     

C

F

D

D

 

১.৩০

D

ইন্ডিয়ান নদী

F

     

A

F

C

C

 

২.১০

C

দক্ষিণ শাখা

D

 

D

F

C

F

B

C

B

B

B

২.৩০

C

প্যারাডাইজ ক্রিক

D

     

B

D

D

B

 

২.৩০

C

পশ্চিম শাখা

C

B

D

A

D

C

A

D

C

C

A

২.৯৫

C

বিগত ছয় বছরের মধ্যে কিছু ক্যাটাগরিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের মুখ দেখেছে এই নদী প্রকল্প। যেমন, দক্ষিণ শাখা এই প্রথম C ক্যাটাগরিতে উন্নীত হয়েছে। ট্রিবিউটলিনের মাত্রা প্রথমবারের মতো উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে, বলা যায় এটি এখন বিলুপ্ত হতে শুরু করেছে। তবে কিছু শাখায় ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি বাড়তে দেখা গেছে। তাই নতুন করে কিছু হটস্পট চিহ্নিত করে সেখানকার পলি পরিষ্কারের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়াও এলিজাবেথ নদী প্রকল্পের মাধ্যমে ওয়েস্টার প্রাচীর রক্ষা করা ও এর বৃদ্ধিতে সহায়তা করা, কিছু অঞ্চলকে সাঁতার ও অন্যান্য বিনোদনমূলক কাজে ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব হয়েছে। মাছ শিকার কিংবা পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখনো স্বাস্থ্যঝুঁকির নির্দেশনা দেওয়া থাকলে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বলে শহরের মানুষ মনে করছে।

 যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নদী দূষণমুক্তকরণ প্রকল্প

এলিজাবেথ নদী রক্ষার নানারকম উদ্যোগ ও প্রকল্প সম্পর্কে জানতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আরও অনেক নদী রক্ষার উদ্যোগ সম্পর্কে আমার জানার সুযোগ হয়েছে। প্রতিটি উদ্যোগেই স্থানীয় কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ, গবেষক, মুনাফাবিহীন প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৪৮ সালে ইউএসএ ক্লিন ওয়াটার অ্যাক্ট প্রবর্তন করে, যা ১৯৭২ সালে কিছু সংশোধনীর ফলে নদীর পানি দূষণ রোধে অধিক কার্যকর হয়। এই অ্যাক্টের মাধ্যমে নদীর পানিতে বর্জ্য ফেলা নিয়ন্ত্রণ করা শুরু হয়।

৯৪৮ সালে ইউএসএ ক্লিন ওয়াটার অ্যাক্ট প্রবর্তন করে, যা ১৯৭২ সালে কিছু সংশোধনীর ফলে নদীর পানি দূষণ রোধে অধিক কার্যকর হয়। এই অ্যাক্টের মাধ্যমে নদীর পানিতে বর্জ্য ফেলা নিয়ন্ত্রণ করা শুরু হয়।

উইসকনসিন রাজ্যের মিলুওয়াকি নদীর দূষণের ইতিহাস আঠারো শতক থেকে। অসংখ্য ট্যানারি ও স্টকইয়ার্ডের উপস্থিতি এবং উৎপাদিত পণ্যের পরিবহণের জাহাজঘাট ছিল এই নদীর তীরে। ১৯০৯ সালে স্থানীয় সরকার প্রথম এই নদী পরিষ্কারের উদ্যোগ নেয় এবং পরবর্তী নানা ধাপে বিষাক্ত কেমিক্যাল নিষিদ্ধ করা, বর্জ্য ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা ইত্যাদির মাধ্যমে এর অনেকটা উন্নতি হলেও এখনো এই নদীর পানি শিশু ও বৃদ্ধের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ নয় বলে উইসকনসিনের প্রাকৃতিক সম্পদ বিভাগ জানিয়েছে।

এই রাজ্যের ফক্স নদী পরিষ্কার প্রকল্প জাতীয়ভাবে অন্যতম ব্যয়বহুল প্রকল্প এবং ২০২০ সালে এই প্রকল্পকে সফলভাবে শেষ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ১৭ বছরব্যাপী এই প্রকল্পে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ হয়, যা কেন্দ্রীয়, রাজ্য ও স্থানীয় সরকার বহন করে। ফক্স নদী দূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয় কাগজের মিলকে, যা মধ্যপঞ্চাশের দশক থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭ লাখ পাউন্ড পলিক্লোরিনেটেড বাইফিনাইল নদীর পানিতে ফেলেছে। ১৯৭৯ সালে সরকার আইন করে বিষাক্ত কেমিক্যালের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। ২০০৪ সালে এই নদী দূষণমুক্তকরণ শুরু হয় এবং সরকার ২০১০ সালে প্রায় ১০টি কাগজের কারখানার বিরুদ্ধে মামলা করে। এই কোম্পানিগুলো দূষণমুক্তকরণ প্রকল্পের ব্যয় অনেকখানি বহন করে। এই নদী থেকে অপসারণ করা হয়েছে ১৯.৫ মিলিয়ন ঘনফুট দূষিত পলি।

১৯৭৯ সালে সরকার আইন করে বিষাক্ত কেমিক্যালের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। ২০০৪ সালে এই নদী দূষণমুক্তকরণ শুরু হয় এবং সরকার ২০১০ সালে প্রায় ১০টি কাগজের কারখানার বিরুদ্ধে মামলা করে। এই কোম্পানিগুলো দূষণমুক্তকরণ প্রকল্পের ব্যয় অনেকখানি বহন করে।

মিসৌরি রাজ্যের বিগ রিভার আরেকটি সাম্প্রতিক প্রকল্প। এই নদী দূষণের শুরু সতেরো শতকে, যখন মিসৌরি ছিল সিসা উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র। নদীর আশপাশে গড়ে ওঠা সব সিসার কারখানার বর্জ্য এবং স্তূপীকৃত সিসা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে নদীতে মিশেছে বহু বছর ধরে। এই নদীগর্ভে জমে থাকা সিসার পুরু স্তর মাছ, কাঁকড়া ইত্যাদিকে বিষাক্ত করেছে। এমনকি পাখি ও অন্যান্য স্থলজ প্রাণী, যারা নদীর পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে, তারা এই সিসা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। ২০০১ সালে মিসৌরি রিভার রিলিফ নামক ভলান্টারি সংস্থার উদ্যোগে এই নদী পরিষ্কারের কাজ শুরু হয়। সম্প্রতি ইপিএ এই নদী সংস্কারের কাজে যোগ দিয়েছে। 

উপসংহার

ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে শিল্পায়ন, মুনাফা আর রাজনৈতিক ক্ষমতাবৃদ্ধি আর গুটিকয় মানুষের স্বার্থের জোয়ারে প্রকৃতির স্বার্থ বরাবরই ভেসে গিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতির স্বার্থ আর মানবজাতির স্বার্থ যে ভিন্ন কিছু নয়, মানুষ তা দেরিতে হলেও শিখেছে বা শিখছে অনেক দাম দিয়ে। দেশে-দেশে, কালে-কালে এর উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। ক্ষমতা বা অর্থের পেছনে অন্ধভাবে ছুটে বেড়ানো গুটিকয় মানুষ বাদে সবাই বোঝেন একটি নদী, জলাভূমি বা এলাকা দূষিত হলে তার প্রভাব কত মাত্রায় মানুষের জীবনে পড়তে পারে। আর তাই একে রক্ষার কাজটিও সাধারণ মানুষের উদ্যোগ থেকেই শুরু হয় বলে আমরা দেখতে পাই। এলিজাবেথ নদী সে রকমই একটি উদাহরণ। সাংবাদিক, শিক্ষক, ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয়, মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউশন, লাইব্রেরি সবাই মিলে এই নদী পরিষ্কারের কাজ করে যাচ্ছে। এসব উদ্যোগের কারণে স্থানীয় ও ফেডারেল সরকারও এই উদ্যোগে ফান্ড জুগিয়েছে এবং অন্যান্য সহযোগিতা দিয়েছে। এই নদী তার আদর্শ চেহারা এখনো ফিরে পায়নি। শত শত বছরের দূষণ মাত্র অল্প কিছুদিনে মুছে ফেলা সম্ভবও নয়। একই কথা সত্য আমাদের দেশের নদীগুলোর ক্ষেত্রেও। তাই সেই চেষ্টা যতদ্রুত শুরু করা যায় তত মঙ্গল। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা অন্য দেশগুলোর ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারতেন। কিন্তু স্পষ্টতই তারা সেই ভুলগুলো শিক্ষার উপকরণ হিসেবে নিয়েছেন এবং অনুসরণ করছেন। এলিজাবেথ নদী প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য তাই প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের নদীগুলোর ভয়ংকর দুর্দিনে এমন কোনো উদ্যোগের এখন ভীষণ প্রয়োজন।

আতিয়া ফেরদৌসী: ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিসি অ্যানালিস্ট, সিটি অব নরফোক গভর্নমেন্ট।

মেইল: chaity.srsp@gmail.com 

তথ্যসূত্র:

১) The Elizabeth River Project: Learning Barge, 2009. 

২) The Frontiers in Marine Science, 2017, History of the Virginia Oyster Fishery, Chesapeake Bay, USA. 

৩) Save the Bay, 2009, Chesapeake Foundation. 

৪) Giulio, Richard, T, Di; Clark, Brian, W, The Elizabeth River Story: A Case Study in Evolutionary Toxicology, 2015.

৫) Birdsong Wetland Restoration at the Larchmont Library – Norfolk’s First “Living Shoreline”, 2016. 

৬) Elizabeth River Project, 2020, The State of Elizabeth River Project Scorecard. 

৭) Encyclopedia of Milwaukee Project, 2016. 

Milwaukee Riverkeeper Newsletter, 2021.

৮) Wisconsin Public Radio, 2020, $1B Cleanup Of Lower Fox River Complete.

৯) United States Environmental Protection Agency. 

 

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •