ইউক্রেনে রুশ হামলা: সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা ও যুদ্ধবিরোধিতার গুরুত্ব

ইউক্রেনে রুশ হামলা: সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা ও যুদ্ধবিরোধিতার গুরুত্ব

আলমগীর খান

যুদ্ধ আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের ব্যাবসা ও খেলা দুই-ই। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলাটা যাদের নিয়ে খেলা হয়, তাদের কাছে মোটেও বিনোদন নয়‒জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন। আর সাম্রাজ্যবাদ নিজেও নিছক বিনোদনের জন্য এ খেলার আয়োজন করে না। এ খেলার সঙ্গে পুঁজি, বিনিয়োগ, লাভ ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক লুণ্ঠন জড়িত। রাশিয়া –ইউক্রেন যুদ্ধ-সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে এই বিষয়টিই সামনে আনা হয়েছে এই লেখায়।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন আচমকা আক্রমণ করে বসেছেন ক্ষুদ্র ইউক্রেন রাষ্ট্রকে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেনকে পদানত করার খায়েশ ছিল পুতিনের। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে না, কে কাকে ঘায়েল করবে, পুতিনের খায়েশ অনেকটাই মিটে যাচ্ছে। একে যুদ্ধ বলা ভুল। এ আসলে নিরীহ ইউক্রেনবাসীর ওপর সাম্রাজ্যবাদী পুতিনের বা পুতিনশাসিত রাশিয়ার মরণকামড়। কিন্তু এই আক্রমণ কোনোভাবেই ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ নয়। ইউক্রেনের জনগণ ও রুশ জনগণের মধ্যেও নয় এ যুদ্ধ। আমেরিকা কর্তৃক আফগানিস্তানে হামলা এবং ইরাকে হামলার সঙ্গে এর বেশ মিল আছে। আবার অমিল হলো, এ যুদ্ধ ভায়ে ভায়ে। মার্কিন জনগণের সঙ্গে আফগানিস্তান ও ইরাকের জনগণের যতটা দূরত্ব, ইউক্রেন ও রুশ জনগণের মধ্যে ততটাই নৈকট্য।

ইউক্রেন ও রাশিয়ার জনগণ প্রায় একই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার অংশীদার। আবার নানাদিক থেকে তাদের স্বাতন্ত্র্যও রয়েছে। ১৯১৭ সালের বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে এই স্বাতন্ত্র্যকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয়। রুশ বিপ্লবের ১০০ বছর পর পুতিন সব গুলিয়ে ফেলার চেষ্টা করছেন। দেশটিকে উগ্র রুশ জাতীয়তাবাদের অবাস্তব পাত্রে চুবিয়ে তিনি ইউক্রেন ও রাশিয়াকে এক করে ফেলতে চান।

এক করে ফেলার ইচ্ছেটা অবশ্য তার আপনাআপনি জাগেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর ক্রমাগত উসকানি ও হুমকি এই উগ্র রুশ জাতীয়তাবাদের অস্ত্রে শান দিয়েছে। ২০০৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ দেশটির ন্যাটো জোটভুক্ত হওয়ার পরামর্শ দেন। অথচ দেশটির জনগণের তখন এ নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। পরবর্তী সময়ে ইউক্রেন শাসকগোষ্ঠীর আগ্রহ, পশ্চিমা শক্তির উৎসাহ ও রুশ সরকারের দখলদারি আচরণ দেশটির মানুষের মনে ন্যাটোভুক্ত হওয়ার ইচ্ছে বাড়িয়ে তোলে। এভাবেই দুই দেশের মাঝে সম্পর্কটা ঘোলা করে তোলা হয়, যা এখন প্রাণঘাতী যুদ্ধে পরিণতি লাভ করেছে, যা ভবিষ্যতে আরও ক্ষতিকারক ও দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর ক্রমাগত উসকানি ও হুমকি এই উগ্র রুশ জাতীয়তাবাদের অস্ত্রে শান দিয়েছে। ২০০৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ দেশটির ন্যাটো জোটভুক্ত হওয়ার পরামর্শ দেন। অথচ দেশটির জনগণের তখন এ নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। পরবর্তী সময়ে ইউক্রেন শাসকগোষ্ঠীর আগ্রহ, পশ্চিমা শক্তির উৎসাহ ও রুশ সরকারের দখলদারি আচরণ দেশটির মানুষের মনে ন্যাটোভুক্ত হওয়ার ইচ্ছে বাড়িয়ে তোলে।

বিশ্ব রাজনীতিতে যুদ্ধের আগুনে ঘি ঢালছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ২৬ মার্চ পোল্যান্ডের রয়্যাল ক্যাসলে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় পুতিন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এই লোক আর ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।’ এই মার্কিন ‘ভদ্রলোক’ আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার কথা বেমালুম ভুলে যাওয়ার ভান করছেন। আমরা যদি পুতিন ও বাইডেনের মধ্যে পার্থক্য করতে বসি, তবে তা হবে চোর ও ডাকাতের মধ্যে পার্থক্য করার সমতুল্য। সত্য কথা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র না-চাইলে পৃথিবীর অনেক দেশেই দুর্নীতিপরায়ণ শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতায় থাকতে পারে না। পৃথিবীর দেশে দেশে অনেক গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে তারা একনায়কতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে ও তাদের টিকে থাকায় মদত দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভাষায় পুতিন একজন ‘খুনি একনায়ক’, ‘কসাই’ ইত্যাদি। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের এই পরম ‘মানবদরদি’ ব্যক্তিটি প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে কী বলে ডাকবেন? বুশের কসাইখানায় বসে বাইডেন নিজেও ছুরি ধার দিয়েছেন‒আফগানিস্তান-ইরাক আক্রমণে সমর্থন করেছেন।

এই যুদ্ধ বা রুশ হামলায় পক্ষাবলম্বন করতে অবশ্যই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করতে হবে, যা অতীতের নয়, ভবিষ্যতের। বিংশ শতাব্দীর শেষ ও একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বিশ্বে অনেক যুদ্ধ হয়েছে যাকে পরদেশ আক্রমণ ও দিনদুপুরে ডাকাতি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। আফগানিস্তানে ও ইরাকে মার্কিন হামলা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ। আক্রমণকারী দেশ এসব হামলাকে যুদ্ধ বলে থাকে। আক্রমণকারী ও আক্রান্তের মাঝে এখানে সামরিক-অর্থনৈতিক শক্তির পার্থক্য বিরাট। তবু আক্রমণকারী দেশের ‘ভদ্র ও সভ্য’ নেতাদের মৃদু ভাষায় এসব হামলা দুই দেশের মাঝে ‘যুদ্ধ’। তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের বিষয়টা ধামাচাপা দিয়ে ধর্ম, মানবতা ও জাতীয়তা রক্ষার জিগির তোলে।

ইউক্রেন আক্রমণে ভ্লাদিমির পুতিনও তাই করছেন। তিনি সেখানে নাৎসিবাদের উদ্ভব দেখছেন ও বলছেন যে, তা দমনের অভিযানে নেমেছেন। আসলে রুশ আক্রমণই সেখানে ডানপন্থি শক্তিকে আরও শক্তিশালী করবে। অন্যদিকে পশ্চিমা শক্তি ইউক্রেনের প্রতি যে দরদ দেখাচ্ছে, তা কুমিরের কান্নার মতো। পুতিন রাশিয়ার ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাকে সর্বপ্রকারে লাই দিয়ে চলেছে মার্কিন প্রশাসন। এই যুদ্ধ জিইয়ে রাখতেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তির স্বার্থ নিহিত। দুর্বল রাশিয়া তাদের কাম্য। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র এখন ভয় পাচ্ছে বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের অদম্য উত্থানকে। এরপর যদি চীন-রাশিয়া গাঁটছড়া বাঁধে, তাহলে মার্কিন নেতৃত্বের জন্য তা হবে গোদের ওপর বিষফোঁড়া।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বিশ্বের মানুষ তিনটি শিবিরে বিভক্ত‒পুতিন সমর্থক, ইউক্রেন সমর্থক ও যুদ্ধবিরোধী। এর মধ্যে পুতিন সমর্থক গোষ্ঠী সবচেয়ে বৈচিত্র্যময়, হাস্যকর ও অযৌক্তিক। এই গোষ্ঠীতে বামপন্থি ও ডানপন্থি সবই আছে। আর তিন শিবিরের মধ্যে যুদ্ধবিরোধীরাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই যুদ্ধের প্রতিবাদে রুশ জনগণ রাস্তায় নেমে পুতিনের পুলিশের হামলার শিকার হয়েছে। সেখানকার তরুণ জনগোষ্ঠী ও নারীরাও প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে এবং শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েছে। এমনকি ইউক্রেনে বসবাসরত রুশরাও রুশ আক্রমণের বিরোধিতা করছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ তো আছেই।

মনে রাখা প্রয়োজন, রাষ্ট্র ও জনগণ সবসময় টানাপোড়েনের সম্পর্কে আবদ্ধ। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে রাষ্ট্র বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। সেই তুলনায় জনগণ হয়েছে দুর্বল, অসম ও বিভক্ত। রাষ্ট্রের হাতে মানুষকে সার্বক্ষণিক চোখে চোখে রাখার, ভয় দেখানোর ও নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সে প্রযুক্তির ক্ষমতাও প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। অন্যদিকে জনগণের সংগঠিত হওয়ার এবং স্বাধীন মত প্রকাশের ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আগের চেয়ে কমছে। আর এ কারণে রাষ্ট্র ও জনগণের টানাপোড়েনের সম্পর্কটি আরও খারাপ ও ভারসাম্যহীন হচ্ছে। জনগণের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতা বাড়ছে আর রাষ্ট্রের ওপর থেকে জনগণের নিয়ন্ত্রণ ক্রমে কমছে। সেই সঙ্গে রাষ্ট্র ক্ষুদ্র মুনাফাখোরগোষ্ঠীর খপ্পরে পড়ছে আর জনগণ হারিয়ে যাচ্ছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশের এই আলাদা পথকে বাস্তবায়ন ও দ্রুততর করছে। এই পরিস্থিতিতে আক্রমণকারী দেশ রাশিয়াসহ বিশ্বব্যাপী জনগণের যুদ্ধবিরোধী ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

ব্রিটিশ লেবার পার্টির সমাজতান্ত্রিক নেতা জেরেমি করবিন এ নারকীয় হামলাবিষয়ক আলোচনায় বলেছেন, ‘কেউ কেউ বলেন, যুদ্ধবিরোধিতা দুর্বলতার চিহ্ন। কিন্তু এটা শক্তির পরিচয় যে, আপনি চলমান সংঘর্ষের ওপর দৃষ্টিপাত করছেন ও বলছেন এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব। সুতরাং আমাদের আরও বেশি শান্তিবাদী কণ্ঠ এবং যুদ্ধের নির্বুদ্ধিতা ও বিপদ উন্মোচন করতে ও নিজ নিজ সরকারের ভূমিকার বিরোধিতা করতে বিশ্বব্যাপী আরও যুদ্ধবিরোধী কর্মী প্রয়োজন।’

অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে আজ যুদ্ধবাজরা কল্পনাতীত রকম বেশি ভয়ংকর, নির্মম ও গণবিরোধী। অন্যদিকে বিভক্ত ও খণ্ডিত জনগণ আগের চেয়ে অনেক বেশি দুর্বল। এখন জনগণের সবচেয়ে বড় শক্তি তাদের ঐক্য ও মিলিত কণ্ঠ। তাই চলতি শতাব্দীর পরিবর্তিত বিশ্বে ঐক্যবদ্ধ যুদ্ধবিরোধিতা অনেক বেশি যুগের দাবিই নয় শুধু, অন্যতম প্রগতিশীল মানবিক কর্তব্য।

আলমগীর খান: সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি, ই-মেইল: alamgirhkhan@gmail.com

তথ্যসূত্র

১. Vladimir Putin, On the Historical Unity of Russians and Ukrainians, July 12, 2021, Presidential Executive Office 2022, Kremlin (ওয়েবসাইট)

২. Russia’s War on Ukraine Has Already Changed the World, Volodymyr Ishchenko-এর সাক্ষাৎকার, জ্যাকোবিন, ১৯ মার্চ ২০২২

৩. Biden: ‘butcher’ Putin cannot be allowed to stay in power, দ্য গার্ডিয়ান, ২৭ মার্চ ২০২২

৪. Ukrainians Are Going Through Absolute Hell. Our Job Is to Stop It, জেরেমি করবিন, জ্যাকোবিন, ২ মার্চ ২০২২

৫. আলমগীর খান, সাম্প্রতিক গণ-আন্দোলনের প্রিজম: রাষ্ট্র বনাম জনগণ, সর্বজনকথা, সপ্তম বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, মে-জুলাই ২০২১

৬. জেরেমি করবিন (পূর্বোক্ত)

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •