ইউক্রেনে আগ্রাসনের সঙ্গে জ্বালানির ভূরাজনীতির সম্পর্ক
মোশাহিদা সুলতানা
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুধু সেদেশে মানুষের জীবন ও সম্পদ হানি করছে না তা এখন পুরো বিশ্বকেই নানাভাবে প্রভাবিত করছে। বহুদেশে তেলসহ বহুধরনের দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেছে। বহুদেশে সামরিক খাতে ব্যয় বেড়ে গেছে। বহুধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য ও জননিরাপত্তায়। কী কারণে রাশিয়ার এই আগ্রাসন তা নিয়ে বহুরকম ব্যাখ্যা আছে। ন্যাটোর ভূমিকা এবং বিশ্বে জ্বালানি নির্ভরতার ধরন দুটোই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই লেখায় বিশেষভাবে মনোযোগ দেয়া হয়েছে আরব ইসরাইল যুদ্ধ কেন্দ্র করে সত্তরের দশকে সৃষ্ট জ্বালানি সংকটের সঙ্গে বর্তমান সময়ে সৃষ্ট সংকটের ভিন্নতা এবং পরাশক্তিগুলোর স্বার্থের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিশ্লেষণে। এরকম পরিস্থিতি বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য কী বার্তা দেয় সেদিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে এই লেখায়।
১ ভূমিকা
এই প্রবন্ধটি লেখার পেছনে রয়েছে আমার ব্যক্তিগত ঔৎসুক্য। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ শুরুর পর থেকেই একটি প্রশ্ন আমাকে তাড়া করছিল। ইউক্রেনের ন্যাটোয় যোগদান নিয়ে বহুদিন ধরেই উত্তেজনা ছিল। কিন্তু ঠিক ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে এসে কী হলো? এ ক্ষেত্রে জ্বালানি রাজনীতির কোনো ভূমিকা কি আছে? রাশিয়া বহুদিন ধরেই ইউক্রেনের ন্যাটোয় যোগদান বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল এবং ইউক্রেনে ‘রেভলুশন অব ডিগনিটি’ শুরুর পর থেকে রাশিয়া নানান ধরনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ছিল। ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে এসে রাশিয়া যখন ইউক্রেনের ন্যাটোয় যোগদানকে আগ্রাসনের পেছনে কারণ হিসেবে দেখিয়েছে, তখনই আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে–ন্যাটোয় যোগদানের সঙ্গে কি জ্বালানির ভূরাজনীতির কোনো সম্পর্ক আছে? এর উত্তর খুঁজতে আমি রাশিয়ার সঙ্গে ইইউর জ্বালানি সম্পর্কের সাম্প্রতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করার চেষ্টা করেছি উদ্দেশ্যহীনভাবে। মনে হয়েছে, এ ব্যাপারে লেখার জন্য ব্যাপক পড়াশোনা করতে হবে এবং লেখার আগে পুরো বিষয়টি আরও ভালোভাবে বুঝতে হবে। শুধু তাই নয়, পুরো বিষয়টি স্রেফ একটি প্রবন্ধে আলোচনা করে শেষ করে ফেলতে চাইলে বিষয়টির ওপর অবিচারই করা হবে। পরবর্তী সময়ে দুই মাস ধরে ঘটনা বিশ্লেষণ করে যুদ্ধের পেছনে জ্বালানির ভূরাজনীতির সম্পর্কের সূত্র খুঁজতে থাকি এবং একপর্যায়ে মনে হয়েছে, এ বিষয়ে একটি স্বাধীন বিশ্লেষণ করা যেতেই পারে। তখন প্রবন্ধ লেখার উদ্দেশ্য নিয়ে সেভাবে এগোইনি। এর মধ্যে এপ্রিল মাসে ইউরোপের কয়েকটি দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ফিরে এসে ছোট করে লেখার সিদ্ধান্ত নিই। মনে হয়েছে, আমার বিশ্লেষণ সঠিক ও পর্যাপ্ত না-ও হতে পারে; কিন্তু কোথাও থেকে বিশ্লেষণ শুরু করলে হয়তো এর মধ্য থেকেই শুরু হতে পারে তর্কবিতর্ক, আসতে পারে নতুন প্রশ্ন।
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরুর পর থেকে তেল, গ্যাস ও কয়লা সব ধরনের জ্বালানির দাম হঠাৎ বেড়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে দাম কমতে শুরু করলেও দাম যুদ্ধের আগের মাত্রায় ফেরেনি। তা ছাড়া অনিশ্চয়তাকে কেন্দ্র করে জ্বালানির বাজারে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে, তাতে যেকোনো সময় এই দাম আবারও বৃদ্ধি পেতে পারে। সাধারণত যেকোনো সংকট সামনে হাজির হলে আমরা পূর্ববর্তী সংকটগুলোর দিকে তাকাই। বোঝার চেষ্টা করি, এর আগের সংকটগুলো কেন হয়েছে এবং তা মোকাবিলায় কোন দেশ কী করেছে এবং সংকট থেকে কারা ক্ষতিগ্রস্ত আর কারা লাভবান হয়েছে। তারপর প্রশ্ন জাগে‒আগের সংকটের সঙ্গে এখনকার সংকটের পার্থক্য কী। আগের যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটের সঙ্গে বর্তমান যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটের ভিন্নতা সংকটকে বুঝতে কী দিকনির্দেশনা দেয়। আর তখন যুদ্ধের পেছনের কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে পেছনের ইতিহাস যেমন দেখা দরকার হয়, তেমনি দরকার হয় চলমান ঘটনার ধারাবাহিকতা বিশ্লেষণ। এই প্রবন্ধে সংক্ষেপে দুটি দিক বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছি: ১) সত্তরের দশকের সংকটের সঙ্গে বর্তমান সংকটের ভিন্নতা এবং ২) গত কয়েক দশকে বৈশ্বিক পরিবর্তন ও রাশিয়া, ইউক্রেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে জ্বালানি সম্পর্কের নানান দিক উন্মোচন করে ইউক্রেন আগ্রাসনের পেছনে পরাশক্তিগুলোর স্বার্থের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিশ্লেষণ।
এই প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে, কীভাবে বর্তমান সময়ে জ্বালানিকে ভূরাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাশিয়া এই আগ্রাসনে লিপ্ত হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের কী ভূমিকা ছিল।
২ সংকটের ভিন্নতা
২.১ তেলকেন্দ্রিক সংকট বনাম বহু জ্বালানিকেন্দ্রিক সংকট
প্রথমেই সত্তর দশকের সংকটের সঙ্গে বর্তমান সংকটের ভিন্নতাগুলো দেখে নেওয়া যাক। সত্তরের দশকে সারা বিশ্বই জ্বালানি তেলের ওপর বেশি নির্ভর ছিল। গ্যাস ও কয়লার ওপর নির্ভরতা তখনো ছিল; কিন্তু তেলের ওপর নির্ভরতা সবচেয়ে বেশি ছিল। বাংলাদেশের কথাই যদি ধরি, বাংলাদেশে সত্তরের দশকের শুরুতে তেল থেকেই অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো (IEA 2019)। তেল সংকটের সময় জ্বালানি তেলের দাম বেশি থাকায় গড়ে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৭০-৮০ শতাংশ চলে যেত তেল আমদানি করে তা বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহণ, শিল্প ও অন্যান্য খাতে ব্যবহার করতে (World Bank 1983)। বেশিরভাগ তেল উৎপাদন হতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। ১৯৭৩ সালে তেল সংকট শুরুর সময় পৃথিবীর মোট তেল উৎপাদনের ৪৯ শতাংশ উৎপাদিত হতো মধ্যপ্রাচ্যে (IEA 2019)। পৃথিবীর পরাশক্তিগুলো যখন সামরিক অস্ত্র ও পারমাণবিক অস্ত্রকে নিরাপত্তা রক্ষার অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে আসছিল, তখন আরব দেশগুলোর জন্য জ্বালানি তেল ছিল সবচেয়ে বড় অস্ত্র। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশে জ্বালানি তেলের রিজার্ভ থাকা সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্য থেকে সস্তায় তেল পাওয়ার জন্য নিজ দেশে উৎপাদন কমিয়ে সত্তরের দশকের শুরুতে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছিল, তখন হঠাৎ দাম বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বিপাকে পড়লেও বর্ধিত দামে তেল বিক্রি করে তেল কোম্পানিগুলো সে সময় ব্যাপক মুনাফা করতে সক্ষম হয় (MERIP 1974)।
এখনকার সঙ্গে সত্তরের দশকের পার্থক্য হলো এখন শুধু তেল নয়; গ্যাস, নিউক্লিয়ার ও কয়লার ওপরও নির্ভরতা বেড়েছে। এখন তেল রপ্তানিতে সৌদি আরবের পরই রাশিয়ার অবস্থান। ২০০৯ সালের পর থেকে রাশিয়ার তেল উৎপাদনের পরিমাণ ১০ বছরে ১০ গুণ বেড়েছে। শুধু তেল নয়, রাশিয়া গ্যাস ও কয়লা রপ্তানিতেও এগিয়ে গেছে। বিশ্বে বর্তমানে যেসব নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট রয়েছে বা নির্মাণাধীন বা পরিকল্পনার ধাপে রয়েছে, তার ৬০ শতাংশ রাশিয়ার প্রযুক্তির
প্রায় ৫০ বছর পর, ২০২২ সালের মার্চে এসে রাশিয়া যখন ইউক্রেন আক্রমণ করে, তখন রাশিয়া জ্বালানি তেলকে সামরিক অস্ত্রের বিকল্প একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছে এবং এখনকার সঙ্গে সত্তরের দশকের পার্থক্য হলো এখন শুধু তেল নয়; গ্যাস, নিউক্লিয়ার ও কয়লার ওপরও নির্ভরতা বেড়েছে। এখন তেল রপ্তানিতে সৌদি আরবের পরই রাশিয়ার অবস্থান। ২০০৯ সালের পর থেকে রাশিয়ার তেল উৎপাদনের পরিমাণ ১০ বছরে ১০ গুণ বেড়েছে। শুধু তেল নয়, রাশিয়া গ্যাস ও কয়লা রপ্তানিতেও এগিয়ে গেছে। বিশ্বে বর্তমানে যেসব নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট রয়েছে বা নির্মাণাধীন বা পরিকল্পনার ধাপে রয়েছে, তার ৬০ শতাংশ রাশিয়ার প্রযুক্তির (Vetier et al 2019)। জ্বালানিকে ভূরাজনীতির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের এই তরিকা রাশিয়া সুচিন্তিতভাবেই করে এসেছে এতদিন ধরে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং কোল্ড ওয়ার-পরবর্তী বিশ্বে রাশিয়া একটি বৃহৎ শক্তি হিসেবে টিকে থাকার জন্য সারা বিশ্বে জ্বালানি বাণিজ্য বিস্তৃত করার মাধ্যমে একটি নির্ভরশীলতার সম্পর্ক রক্ষার কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বিশেষ করে পুতিন ক্ষমতায় আসার পর রাশিয়ার ঐতিহাসিক আধিপত্য পুনর্নির্মাণের জন্য জ্বালানি নির্ভরতার সম্পর্ক পুনর্নির্মাণই পুতিনের কৌশলে পরিণত হয়। তবে এই কৌশল সমাজতান্ত্রিক আদর্শ দ্বারা পরিচালিত নয়; বরং পুঁজিবাদী বিশ্বে পুঁজির আধিপত্য রক্ষাই এই কৌশলের উদ্দেশ্য। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের গ্যাস আমদানির ৪৫ শতাংশ এসেছে রাশিয়া থেকে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক-চতুর্থাংশের বেশি তেল আমদানি হয়েছে রাশিয়া থেকে। এ ছাড়া ইউরোপের কয়লার ৪৭ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। সারা পৃথিবীতে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য ব্যবহৃত ইউরেনিয়ামের ৩৫ শতাংশ রাশিয়া সরবরাহ করে থাকে (IEA 2019)। বুলগেরিয়া, চেক রিপাবলিক, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশের নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রযুক্তি রাশিয়ার। কাজেই রাশিয়ার জ্বালানির আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া ইউরোপের জন্য মোটেই সহজ নয়।
২০২১ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক-চতুর্থাংশের বেশি তেল আমদানি হয়েছে রাশিয়া থেকে। এ ছাড়া ইউরোপের কয়লার ৪৭ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। সারা পৃথিবীতে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য ব্যবহৃত ইউরেনিয়ামের ৩৫ শতাংশ রাশিয়া সরবরাহ করে থাকে (IEA 2019)।
২.২ বিকল্পের সংকট
প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, যে কোনো একটি উদ্ভূত সংকট পরিস্থিতিতে নতুন বিকল্প জ্বালানি দিয়ে ব্যবহৃত হয়ে আসা পুরোনো জ্বালানি প্রতিস্থাপন কোনো স্বল্পমেয়াদি বিষয় নয়। সত্তরের সংকটের সময় তা যেমন ছিল না, তেমন ২০২২-এর সংকটেও খুব দ্রুত কোনো সমাধান নেই, যা পুরো জ্বালানি সরবরাহের চেহারা পালটে দিতে পারে। যেকোনো প্রযুক্তি নতুন করে ব্যবহার উপযোগী করতে সময় প্রয়োজন হয়। এদিক থেকে সত্তরের দশকের বিকল্প আর এখনকার বিকল্পের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো এখন কিছু কিছু বিকল্প যেমন, সৌরশক্তি অপেক্ষাকৃত স্বল্প সময়ে উৎপাদনে যেতে পারে। এলএনজি অবকাঠামো প্রস্তুত থাকলে এলএনজি দিয়ে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। কিন্তু এ সংকটের বেলায় এলএনজি আশানুরূপ দ্রুতগতিতে গ্যাসকে প্রতিস্থাপন করতে পারছে না।
বিভিন্ন সময়ে রাশিয়ার জ্বালানিকে ভূরাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ করে বহুদিন ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিকল্প জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা করে আসছিল। এর মধ্যে রয়েছে স্টোরেজ নির্মাণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানো, নতুন জ্বালানি যেমন: হাইড্রোজেন প্রযুক্তি ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাই, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ। অন্যদিকে বিকল্প উৎস থেকে জ্বালানি ব্যবহার ব্যয়বহুল বলে এই দেশগুলো রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল ও গ্যাস আমদানিও বন্ধ করতে পারেনি; বরং রাশিয়া থেকে বাল্টিক সাগরের মধ্য দিয়ে প্রথম নর্ড স্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইন চালুর পর দ্বিতীয় নর্ড স্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণেও সম্প্রতি বিনিয়োগ করেছে ইউরোপ।
সত্তরের দশকের জ্বালানি তেলকেন্দ্রিক নির্ভরতা আর এখনকার একাধিক জ্বালানিকেন্দ্রিক নির্ভরতা দুটি ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সত্তরের দশকে তেল সংকটের পর যখন বিশ্ব বুঝতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর নির্ভর করে জ্বালানি নিরাপত্তা রক্ষা করা সম্ভব নয়, তখন দেশগুলো প্রাপ্যতাভেদে নিউক্লিয়ার, গ্যাস ও কয়লার দিকে ঝুঁকতে থাকে। কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরে বিশ্বব্যবস্থা এমনভাবে পুনর্বিন্যস্ত হয়েছে যে, জ্বালানির ওপর নির্ভরতার ধরন পরিবর্তন হয়েছে। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন রকম নির্ভরশীলতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় কয়লার ওপর নির্ভরতা কমানোর চাপ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে নিউক্লিয়ার ক্লিন এনার্জি হিসেবে স্বীকৃত নয় বলে এবং এর দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি বেশি বলে ইউরোপের অনেক দেশ ধীরে ধীরে নিউক্লিয়ারের ওপর নির্ভরতা কমানোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এদিকে রাশিয়া যখন একে একে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে জ্বালানি সম্পর্ক তৈরি করেছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র বসে ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই ইউরোপের দেশগুলোকে রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানোর জন্য সমালোচনা করে আসছিল। বিশেষ করে রাশিয়ার ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ ও ইউক্রেন আক্রমণের পর যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর শুধু অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাই জারি করেনি, রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইন যেন সম্পন্ন করা না যায়, সে জন্য পাইপলাইন নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত একটি সুইস কোম্পানির অপরিহার্য প্রযুক্তি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিল। অবশ্য পরে জার্মানির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্কের কারণে শর্তসাপেক্ষে যুক্তরাষ্ট্র এই নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে সম্মত হয়। নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইনটি নির্মাণ শেষ হলেও তা সার্টিফিকেশনের অপেক্ষায় ছিল। ইউক্রেন আক্রমণের পর জার্মানি ক্ষুব্ধ হয়ে নিজেই এই পাইপলাইনটি বন্ধের ঘোষণা দেয়। তবে জ্বালানি সংকট শুরুর কারণ নর্ড স্ট্রিম-২ বন্ধ করা নয়। ইউক্রেন আক্রমণের পর নতুন করে রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা কমানোর তাড়না, শীতকালে চাহিদা বৃদ্ধি, রাশিয়ান গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করার পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার কারণে নতুন করে সরবরাহে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়া–সব মিলিয়ে জ্বালানির যুদ্ধবিষয়ক অনিশ্চয়তা থেকে দাম বৃদ্ধি হওয়ার কারণে সংকট ঘনীভূত হয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই বাড়তি চাহিদার কারণে এলএনজির দাম এমনিতেই বেশি ছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি যেন না হয়, এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র আশা করছিল ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাসের বিকল্প হিসেবে এলএনজি সরবরাহ বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্র শেল গ্যাসের উৎপাদন বাড়িয়ে এই চাহিদা মেটাতে পারে কি না, তার সম্ভাব্যতা নিয়েও আলাপ শুরু করেছিল। শেল গ্যাস ফ্র্যাকিং-এর ওপর নির্ভরশীল এবং তা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক হওয়ায় এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে অভ্যন্তরীণ বিতর্ক চলছে (Yergin 2020)। তা ছাড়া এলএনজি অতিরিক্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় এবং টার্মিনালের সক্ষমতা কম থাকায় ইউরোপ চড়া দরে আরও এলএনজি কিনতে নারাজ (Yergin 2020)। তাই ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে যাওয়া ইউক্রেনীয় পাইপলাইন এবং নর্ড স্ট্রিম-১ পাইপলাইন দিয়ে ইউরোপে এখনো গ্যাস সরবরাহ চলছে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও রাশিয়া ইউক্রেনকে ট্রানজিট ফি দিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে ইউরোপ গ্রীষ্মের অপেক্ষায় আছে। এর মধ্যে জ্বালানির চাহিদা কমলে গ্যাসের প্রয়োজন কমবে। তা ছাড়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভবিষ্যতের জন্য স্টোরেজগুলোতে জ্বালানি মজুত করে রাখছে। তারা ২০২২ সালের শেষ দিক থেকে রাশিয়ার গ্যাস ব্যবহার বন্ধ করার পরিকল্পনা করছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক বক্তব্যে ইতোমধ্যে ফ্রান্স রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর আগাম (২০২২ সালের শেষ নাগাদ) নিষেধাজ্ঞা জারির আহ্বান জানিয়েছে। এবারের সংকটের সময় দেশগুলো দ্রুত কোনো সমাধানে যেতে পারছে না। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ করতে অন্তত এক দশক লেগে যায়। হুট করে গ্যাসচালিত ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানো, নবায়নযোগ্য জ্বালানি সক্ষমতা বৃদ্ধি, নিউক্লিয়ারের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি‒কোনোটিই করা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র শেল গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি করে এখন বাজারে স্থিতি আনতে চাইলেও তা অপ্রতুল এবং এর পরিবেশগত দিক বিবেচনায় সেদিকে এগোতে পারছে না। স্বল্প মেয়াদে একটি স্থিতাবস্থা তৈরি হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলো এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার দ্রুত কীভাবে বাড়ানো যায়, সেদিকে মনোযোগী হতে শুরু করেছে।
২.৩ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ধরনে ভিন্নতা
১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে আমেরিকা যখন ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দিয়েছিল, তখন আরব দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য যেসব দেশ ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, সেসব দেশে তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রসহ নেদারল্যান্ডস, দক্ষিণ আফ্রিকা ও পর্তুগালও ইসরায়েলকে সমর্থনের কারণে এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে। তবে এই নিষেধাজ্ঞা পাঁচ মাসের মতো কার্যকর ছিল। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের চেষ্টায় গোলান হাইটস ও সিনাই অঞ্চল থেকে ইসারাইল ও মিশর সৈন্য প্রত্যাহারে সম্মত হলে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। তবে সত্তরের এই সংকটের পর যুক্তরাষ্ট্র আরও তীব্রভাবে উপলব্ধি করে জ্বালানি নিরাপত্তা রক্ষায় ইসরায়েলকে সমর্থন করার কৌশলগত প্রয়োজনীয়তা। এই নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি; বরং যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতি তার সমর্থন বজায় রেখে এবং বিভিন্ন সময় সামরিক সহায়তা দিয়ে গত অর্ধশতকে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে একটি অস্থিরতা বজায় রাখতে দারুণভাবে সফল হয়েছে (Yergin 2012)।
রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে শুধু রাশিয়া নয়, রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত দেশগুলোও সমস্যায় পড়েছে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য হলো রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ চাপ বৃদ্ধি করা এবং এর মধ্য দিয়ে এমন সব সংকটের মুখাপেক্ষী করা, যা সামরিক হস্তক্ষেপের একটি বিকল্প হিসেবে রাশিয়াকে যুদ্ধ থেকে সরে আসতে বাধ্য করে। প্রাথমিকভাবে রাশিয়ার তেল, গ্যাস ও কয়লা ইইউ দেশগুলোতে রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া না-হলেও রাশিয়ার সঙ্গে ব্যাবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অর্থ পরিশোধ, যোগাযোগ, পরিবহণ ইত্যাদিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এমন সব নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। যেমন: রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল মেসেজিং সিস্টেম (সুইফট) থেকে অপসারণ, রাশিয়া থেকে ফ্লাইট বন্ধ করা, বিনিয়োগ বন্ধ করা, ব্যাবসা গুটিয়ে নেওয়া ইত্যাদি। এসব করতে গিয়ে রাশিয়াই শুধু বিপদে পড়েছে তা নয়, যেসব দেশ রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করে, তারা রাশিয়ার কাছ থেকে পাওনা আদায় করতে পারছে না। ভবিষ্যৎ আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। রাশিয়ার পণ্যের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো পণ্য ক্রয়ের জন্য বিকল্প খুঁজছে। ব্যাবসা গুটিয়ে নেওয়ায় শুধু রুশ নাগরিকরা চাকরি হারাচ্ছেন না, হারাচ্ছেন অন্যান্য দেশের কর্মীরাও। কাজেই একদিক থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা যেমন রাশিয়াকে কোণঠাসা করছে, তেমনি অন্য দেশগুলোও অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যেমন, বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা রাশিয়ায় রপ্তানির জন্য এলসি খুলতে পারছেন না, যারা পণ্য সরবরাহ করেছিলেন তাদের অনেকের অর্থপ্রাপ্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের কর্মীদের বেতন এবং সাপ্লাইয়ারদের দেনা পরিশোধের জন্য বিকল্প খুঁজতে হচ্ছে। কিন্তু এই বিকল্প পদ্ধতি কতদিন চালিয়ে নেওয়া যাবে, সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
প্রাথমিকভাবে রাশিয়ার তেল, গ্যাস ও কয়লা ইইউ দেশগুলোতে রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া না-হলেও রাশিয়ার সঙ্গে ব্যাবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অর্থ পরিশোধ, যোগাযোগ, পরিবহণ ইত্যাদিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এমন সব নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। যেমন: রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল মেসেজিং সিস্টেম (সুইফট) থেকে অপসারণ, রাশিয়া থেকে ফ্লাইট বন্ধ করা, বিনিয়োগ বন্ধ করা, ব্যাবসা গুটিয়ে নেওয়া ইত্যাদি। এসব করতে গিয়ে রাশিয়াই শুধু বিপদে পড়েছে তা নয়, যেসব দেশ রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করে, তারা রাশিয়ার কাছ থেকে পাওনা আদায় করতে পারছে না।
অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসলে যুদ্ধ থামাতে কতটুকু কার্যকর, এ নিয়ে নানা জনের নানা বিশ্লেষণ রয়েছে। কোনো কোনো বিশ্লেষক বলছেন, রাশিয়া ২০১৪ সাল থেকেই নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞার মুখাপেক্ষী হয়ে আসছে এবং অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে যতটা বিপদে ফেলেছে, অনেক ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি বিপদে ফেলেছে অন্য দেশগুলোকে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ, যারা কেউ-ই এই যুদ্ধের জন্য দায়ী নয়। তা ছাড়া অনেক জরুরি কারণে এই নিষেধাজ্ঞাগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। যেমন, এপ্রিল মাসেই রাশিয়ার ফ্লাইট ইইউর কোনো দেশে আসা নিয়ে যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তা ভঙ্গ করে হাঙ্গেরিতে নিউক্লিয়ার ফুয়েল সাপ্লাই দিতে রাশিয়ার প্লেন বিশেষ অনুমতি নিয়ে স্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, বেলারুশের মধ্য দিয়ে হাঙ্গেরিতে প্রবেশ করেছে (Barron’s 2022)। হাঙ্গেরির প্যাক নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসছে এবং রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। অন্য সময় রেলপথে এই জ্বালানি সরবরাহ করা হতো। এই প্রথম উড়োজাহাজে সরবরাহ করতে বাধ্য হয়েছে। এ কারণে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবানকে রাশিয়াকে সাহায্য করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। অন্যদিকে হাঙ্গেরির বিদ্যুৎ সরবরাহের উল্লেখযোগ্য অংশ এই নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে আসে। তাদের জন্য এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা মেনে রাশিয়ার সরবরাহ না-নেওয়া অনেকটা অবাস্তব ব্যাপার। রাশিয়ার প্রস্তাবনা অনুযায়ী, হাঙ্গেরি গ্যাস আমদানি বাবদ রাশিয়ার পাওনা রুবলে পরিশোধ করতে সম্মত হয়েছে। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা মেনে চলা শেষ পর্যন্ত জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে ইইউর দেশগুলো এক হয়ে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে পারছে না।
অন্যদিকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এ মুহূর্তে একমাত্র সমাধান বলে মনে করছেন অন্য বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, নিষেধাজ্ঞা না-দিয়ে পালটা আক্রমণ করলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। এর আগের প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও বহুগুণ বেশি ক্ষতি হবে, যার প্রভাব পড়বে সমস্ত বিশ্বে। তাদের মতে, বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে এই নিষেধাজ্ঞা চললে যেই চাপ সৃষ্টি হবে তাতে রাশিয়ার পক্ষে বেশিদিন যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না।
সত্তরের দশকে আরব দেশগুলো জ্বালানি তেল রপ্তানির ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, তা যুক্তরাষ্ট্রকে দরকষাকষিতে বাধ্য করেছিল। নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও পরবর্তী সময়ে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আরব বিশ্বে নানা অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে (Yergin 1991)। ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্ব অব্যাহত রয়েছে। আর যেহেতু নিষেধাজ্ঞা এসেছিল সরবরাহকারী দেশগুলোর পক্ষ থেকে, জ্বালানি সংকটের মুখাপেক্ষী হয়ে যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত একটি সমাধানের দিকে যেতে সচেষ্ট ছিল। অন্যদিকে ২০২২-এর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে জ্বালানি আমদানিকারক দেশগুলো (ইউরোপ), জ্বালানি সরবরাহকারী দেশের (রাশিয়ার) ওপর এবং এই নিষেধাজ্ঞা জ্বালানির ওপর নয়; বরং অন্যান্য অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ওপর।
এখন সংকট মুহূর্তে যদিও সব দেশকেই বেশি দামে জ্বালানি কিনতে হচ্ছে, এর মধ্যেও দেখা যাচ্ছে রাশিয়া ভারতকে বাজার দরের চেয়েও সস্তায় তেল সরবরাহ করতে প্রস্তাব দিয়েছে। যেকোনো দেশের জন্য এই দুর্মূল্যের বাজারে সস্তায় তেল পাওয়া অনেক বেশি লাভজনক। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র সে পথে বাধা দিচ্ছে।
এসব দিক বিবেচনা করলে ইউক্রেন আক্রমণকে কেন্দ্র করে ২০২২-এর সংকট বহুল বিস্তৃত, তীব্র এবং বহু পক্ষ-বিপক্ষ যুক্ত। সত্তরের দশকে সারা বিশ্বের দেশগুলো বেশি দামে তেল কিনতে বাধ্য হয়েছিল এবং সবচেয়ে গরিব দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তার মধ্যে অন্যতম ছিল বাংলাদেশও। বাংলাদেশকে চড়া মূল্যে তেল আমদানি করে ব্যবহার করতে হতো। যুদ্ধ-পরবর্তী অবকাঠামো নির্মাণ, শিল্পায়নে, যানবাহনে যে তেলের প্রয়োজন ছিল, তা কিনতে গিয়ে অনেক বছর মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় হয়ে যেত (World Bank 1983)। এখন সংকট মুহূর্তে যদিও সব দেশকেই বেশি দামে জ্বালানি কিনতে হচ্ছে, এর মধ্যেও দেখা যাচ্ছে রাশিয়া ভারতকে বাজার দরের চেয়েও সস্তায় তেল সরবরাহ করতে প্রস্তাব দিয়েছে। যেকোনো দেশের জন্য এই দুর্মূল্যের বাজারে সস্তায় তেল পাওয়া অনেক বেশি লাভজনক। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র সে পথে বাধা দিচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভারতের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনায় বসেছেন। ভারত এ প্রস্তাবে কতটুকু সাড়া দেয় এবং কীভাবে সাড়া দেয়, তার ওপর নির্ভর করবে সামনের দিনে দামের তারতম্যে কোন দেশ লাভবান হয়, আর কোন দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৩ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জ্বালানির ভূরাজনীতি
রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের পর এর পেছনের কারণ হিসেবে ইউক্রেনের ন্যাটোয় অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি যেভাবে আলোচিত হয়েছে, ততটা পরিষ্কারভাবে আলোচিত হয়নি জ্বালানির ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পরাশক্তিগুলোর মধ্যকার প্রতিযোগিতার বিষয়টি। অবশ্যই জ্বালানি নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নের সঙ্গে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি জড়িত। কিন্তু কীভাবে জড়িত, তা পরিষ্কার বিচার-বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ন্যাটোয় অন্তর্ভুক্তি নিয়ে এবং ইউক্রেনের জনগণের একাংশের মধ্যে ইইউ অন্তর্ভুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অনেকদিন ধরেই আলোচনা চলছিল। রাশিয়া সবসময়ই ইউক্রেনের এই সিদ্ধান্তের বিপরীতে অবস্থান প্রকাশ করে আসছিল। তাহলে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণটা ঠিক এখন কেন করল? এ প্রশ্ন নিয়ে আমি বিভিন্ন গবেষণা ও বিশ্লেষণ পড়া শুরু করি। কিন্তু কোনো বিশ্লেষণই আমার কাছে পুরোপুরি সন্তোষজনক মনে হয়নি। তাই জ্বালানি নিয়ন্ত্রণের ইতিহাস থেকে শুরু করে বর্তমান ঘটনাবলির ক্রমপরিবর্তনগুলো বিবেচনায় নিয়ে ইউক্রেন আক্রমণের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে নিজস্ব বিশ্লেষণ দাঁড় করিয়েছি। নিশ্চয়ই এ বিশ্লেষণের সীমাবদ্ধতা আছে আবার এই বিশ্লেষণ নতুন কোনো প্রশ্ন তৈরিতে অবদানও রাখতে পারে।
প্রথমেই ইউক্রেনের ভৌগোলিক গুরুত্ব দিয়ে শুরু করা যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর রাশিয়ার সাবেক রিপাবলিকগুলো স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও এবং বিদ্যমান নানান টানাপোড়েন সত্ত্বেও রাশিয়া তাদের সঙ্গে একধরনের ব্রাদারহুডের সম্পর্ক রক্ষার আকাঙ্ক্ষা প্রদর্শন করে আসছিল। পূর্ব ইউরোপে ইউক্রেন, বেলারুশ, মলদোভা; সেন্ট্রাল এশিয়ায় কাজাকস্তান, উজবেকিস্তান, তাজাকিস্তান, কিরগিজস্তান, তুর্কমেনিস্তান; দক্ষিণ ককেশাসে জর্জিয়া, আরমেনিয়া, আজারবাইজান; বালটিকে লিথুনিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া–এই দেশগুলোর অর্থনীতি সোভিয়েত পতনের পরও বিভিন্নভাবে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে। রাশিয়া একদিকে সোভিয়েত নস্টালজিয়া কাজে লাগিয়ে এই দেশগুলোর সঙ্গে ভাই ভাই সম্পর্ক রক্ষা করছিল, অন্যদিকে এই দেশগুলোর ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবসময় সক্রিয় ছিল। এই দেশগুলোর মধ্যে বাল্টিক দেশগুলো (লিথুনিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া) ন্যাটোর সদস্যপদ লাভ করে আর এর মধ্যে ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্যপদ লাভের জন্য চেষ্টা করছিল; কিন্তু রাশিয়া সবসময় এর বিরোধিতা করে আসছিল। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইউক্রেন ও বেলারুশ রাশিয়ার আধিপত্য রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো কারণেই। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো, ইউক্রেনের বিপুল সম্ভাবনাময় জ্বালানি ও কৃষিসম্পদ। এ ছাড়া রাশিয়া থেকে স্থলপথে ইউরোপের প্রবেশদ্বারে এই দেশগুলোর অবস্থান। ভৌগোলিকভাবে ইউক্রেন কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। আবার রাশিয়ার সঙ্গে সীমান্ত এবং ইউরোপের একাধিক ন্যাটো সদস্যদেশের সঙ্গে ইউক্রেনের সীমান্ত রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর থেকে একে একে ইউরোপের সীমান্তে সাবেক বাল্টিক দেশগুলো ন্যাটোর সদস্য হয়েছে। ইউরোপের প্রবেশদ্বারে এখন বাকি রয়েছে ইউক্রেন, মলদোভা ও বেলারুশ।
ভৌগোলিকভাবে ইউক্রেন কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। আবার রাশিয়ার সঙ্গে সীমান্ত এবং ইউরোপের একাধিক ন্যাটো সদস্যদেশের সঙ্গে ইউক্রেনের সীমান্ত রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর থেকে একে একে ইউরোপের সীমান্তে সাবেক বাল্টিক দেশগুলো ন্যাটোর সদস্য হয়েছে। ইউরোপের প্রবেশদ্বারে এখন বাকি রয়েছে ইউক্রেন, মলদোভা ও বেলারুশ।
দ্বিতীয়ত, ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে রাশিয়া ও ইইউর প্রভাব যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বুঝতে সাহায্য করবে। কয়েক দশক ধরেই রাশিয়া ইউক্রেনে আধিপত্য রক্ষা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ সেখানে প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় ছিল। জনগণের মধ্যেও সোভিয়েত পক্ষ ও পশ্চিমা পক্ষের বিভাজন দিনে দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ২০০৪ সালের নির্বাচন ছিল দুই ভিক্টরের লড়াই। এর মধ্যে ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ হলো রুশ সমর্থিত এবং ভিক্টর ইউশচেনকো হলো বিরোধী পক্ষ। ক্রেমলিন সমর্থিত প্রার্থী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ যেদিন নির্বাচন জালিয়াতির মাধ্যমে জয়লাভ করেন, তার পরদিন লাখ লাখ ইউক্রেনীয়কে শান্তিপূর্ণভাবে কমলা পতাকা হাতে নিয়ে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়। এই বিশাল প্রতিবাদের মুখে পড়ে ইউক্রেনে দ্বিতীয় দফা নির্বাচন হয় এবং সেখানে আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী ভিক্টর ইউশচেনকো (দুই ভিক্টরের এক ভিক্টর) ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। এই বিজয় রাশিয়ার জন্য চরম উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উল্লেখ্য ভিক্টর ইউশচেনকোকে এর আগে বিষপান করানো হয় এবং সেখানে এজেন্ট অরেঞ্জের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল (Karatnycky, 2005)। কে বা কারা বিষপান করিয়েছিল, এ নিয়ে নানান বিশ্লেষণ আছে। নির্বাচনের আগে রাশিয়া তার পছন্দের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে সমর্থন করে যাচ্ছিল, সেখানে বিরোধী পক্ষ (ভিক্টর ইউশচেনকো) ছিল পথের কাঁটার মতো। ইয়ানুকোভিচ শুধু রাশিয়ার সমর্থনপুষ্টই ছিলেন না, দুর্নীতি ও লুটপাট টিকিয়ে রাখার জন্যও ইউক্রেনের অলিগার্কদের কাছে তার নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা ছিল। ভিক্টর ইউশচেনকো ক্ষমতায় আসার পর অলিগার্কদের লুটপাট দমন শুরু করেন এবং সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেন। কিন্তু তিনি বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি এবং আবার রুশ সমর্থিত ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতায় আসেন।
২০১৪ সালে রাশিয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ২০১০-এ নির্বাচিত হয়ে আসা ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ইউক্রেনের জনগণকে ক্ষুব্ধ করে তোলেন এবং জনগণের তুমুল প্রতিবাদ ধীরে ধীরে দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনে রূপ নেয়। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণকে বুঝতে হলে এই আন্দোলনের গুরুত্ব বোঝা দরকার।
নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত পতনের পর এবং একটি নতুন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর ইউক্রেনে মুক্তবাজার নীতির প্রয়োগ বেড়ে চলেছিল। তবে তা যতটা-না ছিল জনগণের পক্ষে, তার চেয়ে বেশি ছিল অলিগার্কদের পক্ষে। ইউক্রেনে বেসরকারিকরণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারপর্ব শুরু হয়েছিল নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকেই। তবে তার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় ২০০০-এর দশকে এসে। সে সময় ক্রনি ক্যাপিটালিজমের একটি উর্বর ভূমিতে পরিণত হয় ইউক্রেন (Stent 2019)। রাশিয়ার মতোই ইউক্রেনেও অলিগার্কদের উত্থান ও লুটপাট চলতে থাকে। আর এই অলিগার্কদের শক্তির উৎসও ছিল রাশিয়ার অলিগার্কি। কাজেই বিভিন্ন রকম নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত জনগণের মধ্যে এই অলিগার্কদের লুটপাট নিয়ে অসন্তোষ চলছিলই। অন্যদিকে জনগণের কাছে বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হয় ইইউতে অন্তর্ভুক্তির স্বপ্ন। ইউরোপের উন্নত নাগরিক সেবা, জনকল্যাণমূলক নীতির প্রভাব পর্যবেক্ষণ করে জনগণের মধ্যে একদিক থেকে অলিগার্কদের প্রতি বিরূপ মনোভাব, অন্যদিক থেকে ইইউর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার তাগিদ তৈরি হয়। এদিকে ইউরোপ ও আমেরিকার জন্য ইউক্রেনও কৌশলগতভাবে প্রভাব বিস্তারের একটি লক্ষ্যে পরিণত হয়। সোভিয়েত বলয়ে থাকা হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক এর আগে ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তা অনুসরণ করে ইউক্রেনের জনগণের একাংশের মধ্যেও ইউরোপের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির পক্ষে জনমত তৈরি হয়েছে।
জনগণের মধ্যে ইইউ-কে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া আশা-আকাঙ্ক্ষা নিছক পশ্চিমা প্রপাগান্ডা বনাম রুশ নস্টালজিয়া দিয়ে পরিচালিত নয়; বরং নাগরিক হিসেবে জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জায়গা থেকে তাদের মধ্যে পশ্চিমা আদর্শের প্রতি অনুরাগ তৈরির পেছনে কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে এই আন্দোলন স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া বলেই মনে হয়েছে আমার কাছে। অলিগার্কদের ধারাবাহিক লুটপাট, নির্বাচনি জালিয়াতি, জনগণের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি শাসকগোষ্ঠীর অবহেলা–এসব কারণে রাশিয়া সমর্থিত নেতৃত্বকে যদি তারা প্রত্যাখ্যান করে, তবে তা তাদের নাগরিক অধিকার আদায়ের বাসনার প্রতিফলনই বলতে হবে। ২০১৪ সালে একদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন ইউক্রেনকে পলিটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এবং ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরের আহ্বান জানায়, তখন একই সঙ্গে রাশিয়া এগিয়ে যাচ্ছিল ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার দিকে। ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য এশিয়া ও ইউরোপে অবস্থিত সাবেক সোভিয়েত রিপাবলিকগুলোকে একত্রিত করে একটা অর্থনৈতিক সহযোগিতার ব্লক তৈরি করা। সেদিক থেকে রাশিয়ার আগ্রহ ছিল ইউক্রেন এই ইউনিয়নে যোগ দেবে। এ নিয়ে আলোচনাও চলছিল। কিন্তু ইউক্রেনের পক্ষে দুদিকে একই সঙ্গে দুটি সাংঘর্ষিক ইউনিয়নের সঙ্গে থাকা বাস্তবে সম্ভব নয়।
২০১৪ সালে একদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন ইউক্রেনকে পলিটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এবং ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরের আহ্বান জানায়, তখন একই সঙ্গে রাশিয়া এগিয়ে যাচ্ছিল ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার দিকে। ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য এশিয়া ও ইউরোপে অবস্থিত সাবেক সোভিয়েত রিপাবলিকগুলোকে একত্রিত করে একটা অর্থনৈতিক সহযোগিতার ব্লক তৈরি করা। সেদিক থেকে রাশিয়ার আগ্রহ ছিল ইউক্রেন এই ইউনিয়নে যোগ দেবে।
ইউক্রেনের সামনে যখন দুইয়ের মধ্যে যে কোনো একটিকে বাছাইয়ের কঠোর পর্ব সামনে আসে, তখন সে সময়ের রুশ সমর্থনপ্রাপ্ত ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ইইউর সঙ্গে ফ্রি টেড অ্যাগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নেন। সে সময় ইউক্রেনের জনগণ প্রবল আপত্তি তোলে, হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলন দমনে সরকার যখন সহিংস পদ্ধতি অবলম্বন শুরু করে, আন্দোলনের তেজ আরও বাড়তে থাকে। আগুন ছড়িয়ে পড়ার মতো আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ইউক্রেনজুড়ে। প্রায় ১০০ আন্দোলনকারী সরকারের সহিংস বাধার মুখে প্রাণ হারায়। ইউক্রেনের ইতিহাসে অরেঞ্জ রেভলুশনের পর এই দ্বিতীয় রেভলুশন, যা ইউরো-মায়দান আন্দোলন এবং পরে রেভলুশন অব ডিগনিটি নামে খ্যাত হয়েছিল, তা পৃথিবীর কাছে ইউক্রেনীয়দের মধ্যে পশ্চিমা নীতির প্রতি সমর্থনকে ব্যক্ত করে। এর মানে এই নয়, ইউক্রেনের সব মানুষ পশ্চিমাদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনের পক্ষে কাজ করেছে। রুশ নস্টালজিয়ায় ডুবে থাকা, রাশিয়ার হারানো দিনের সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ধারণ করা মানুষেরও অভাব ছিল না। আবার অলিগার্কদের হাতে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়ে তা থেকে স্বার্থ হাসিল করা মানুষেরও অভাব ছিল না।
২০১৪-এর আন্দোলনের মাধ্যমে ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ গদি ছাড়তে বাধ্য হন। পরের নির্বাচনে পেট্রো পরশেনকো নির্বাচিত হয়ে আসেন। তার সময় দনবাসে দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। তার নেতৃত্বে রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দনবাসের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। তিনি নিজেই ছিলেন একজন অলিগার্ক। ম্যানুফ্যাকচারিং, কৃষি ও কনফেকশনারি ব্যাবসার মাধ্যমে তিনি সে সময়ের একজন অলিগার্ক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তার প্রতি সমর্থন কমে যায় ২০১৮-র নির্বাচনে। ২০১৯ সালে ভ্লাদিমির জেলেনস্কি ভোটে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসেন। তিনি একজন কমেডিয়ান হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি একটি প্রডাকশন কোম্পানিও গড়ে তুলেছিলেন। একটি টিভি সিরিজে ইউক্রেনের পরিকল্পিত প্রেসিডেন্টের ভূমিকায় অভিনয় করে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ধীরে ধীরে রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠলে একসময় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। তার নির্বাচনি প্রচারণায় তিনি রাশিয়ার সঙ্গে ডায়ালগ শুরু করা এবং দ্বন্দ্ব অবসানের লক্ষ্য তুলে ধরেন। তবে ২০১৯ সালে ক্ষমতার আসার সময় জেলেনস্কি কি জানতেন ভবিষ্যতে এই দ্বন্দ্ব যে একটি যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হবে? তার জন্য রাশিয়ার বলয়ের মধ্যে বসবাস করে পুতিনের সঙ্গে সমঝোতায় থাকা এবং একই সঙ্গে জনগণের আশা-আকঙ্ক্ষা পূরণ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়।
তৃতীয়ত, এই অঞ্চলে জ্বালানি কী ভূমিকা রেখেছে, সে প্রসঙ্গে যাওয়া যেতে পারে। ইউক্রেনের স্বার্থরক্ষায় বরাবরই জেলেনস্কি নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইন চালু হলে ইউক্রেনিয়ান পাইপলাইন দিয়ে রাশিয়া আর গ্যাস সরবরাহ না-ও করতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রতিবছর ইউক্রেনের দুই থেকে তিন বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। রাশিয়া ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় পাইপলাইন ব্যবহার করে গ্যাস সরবরাহ করলে ট্রানজিট ফি বাবদ ইউক্রেন আর বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারবে না। এ ছাড়া ইউক্রেনে এখনো প্রচুর অব্যবহৃত গ্যাসসম্পদ রয়েছে। গ্যাস উত্তোলন এবং এ থেকে আয় করার জন্য ইউক্রেন বহুদিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছিল। রাশিয়া ইউক্রেনকে এড়িয়ে গিয়ে বাল্টিক সাগর দিয়ে গ্যাস রপ্তানি করলে ইউরোপকেও ইউক্রেনকে ট্রানজিট ফি দিতে হবে না, প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম কমবে। এ সুযোগ পেয়ে গেলে ইউরোপ ইউক্রেনে আর গ্যাস উত্তোলনে আগ্রহী হবে না। এসব দিক বিবেচনা করে ইউক্রেনের জাতীয় স্বার্থের পক্ষে জেলেনস্কি অবস্থান নিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু যেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, সেই রাশিয়ার জন্য ইউক্রেন হয় একটি স্বেচ্ছায় মেনে নেওয়া ক্ষমতাশালী বড় ভাইয়ের ছোট ভাই, না-হয় জোরপূর্বক ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে নতজানু হতে বাধ্য হওয়া ছোট ভাই। জ্বালানি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অর্জনের জন্য রাশিয়া যে কোনো মূল্য দেওয়ার জন্য যখন প্রস্তুত এবং তার চারদিকে যখন ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো বৈদেশিক শক্তি নানান স্বার্থ হাসিল ও শক্তি অর্জনের আকাঙ্ক্ষায় তৎপর, তখন ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের জীবনের মূল্য পুতিনের কাছে কতটুকু, সে প্রশ্ন এখন মূল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে ইউরোপের গ্যাস আমদানিকারক হিসেবে আরেক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার জার্মানি। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ইউক্রেনীয় পাইপলাইন এবং নর্ড স্ট্রিম লাইন দুটোই প্রথমে জার্মানির ওপর দিয়ে গিয়ে পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশের দিকে গেছে। জার্মানি শুধুই স্বল্পমূল্যে রাশিয়ার গ্যাস আমদানি করে না, এই গ্যাস জার্মানির ওপর দিয়ে অন্যান্য অঞ্চলে যাওয়ায় তার জন্যও ট্রানজিট ফি একটি আয়ের উৎস। জার্মানি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে উৎকর্ষ অর্জন করে তার জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গে গ্রিন এনার্জি ইমেজ তৈরির ব্যাপারে সবসময়ই সোচ্চার ছিল। সৌরশক্তি প্রযুক্তি উদ্ভাবন, তার বিকাশ এবং সর্বোপরি ব্যাপক ভর্তুকি দিয়ে জার্মানি ধীরে ধীরে তার অবস্থান মজবুত করেছে। শক্তিশালী গ্রিন পার্টির নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট ও কয়লা বর্জনের দাবির মুখে জার্মানি নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে গেছে ঠিকই; কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য সরকারের ভর্তুকি দিনে দিনে এত বেশি বেড়ে গিয়েছিল যে, সে চাপ সামলাতে না-পেরে জার্মানি প্রতিযোগিতামূলক বিডিংয়ের (অকশনের) দিকে ঝুঁকেছে। প্রতিযোগিতামূলক দামের কারণে জার্মানিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উন্নয়ন আগের চেয়ে ধীর হয়ে গেছে। অন্যদিকে কয়লার ব্যবহার বন্ধ করতে হলে কয়লা খাতে নিয়োজিত শ্রমিক-কর্মচারীকে যে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, তা-ও বিশাল অঙ্কের। অ্যাঞ্জেলা মারকেল ক্ষমতায় থাকার সময় এই বিষয়গুলো মোকাবিলা করতে গিয়ে রাশিয়ার সস্তা গ্যাস আমদানির ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইন রাজনৈতিক জেনেও এর বাণিজ্যিক দিকটিই সবসময় তুলে ধরেছেন। কারণ, নর্ড স্ট্রিম-১ যে গ্যাস সরবরাহ করে, নর্ড স্ট্রিম-২ চালু হলে এর পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাবে এবং সেখান থেকে বেঁচে যাওয়া অর্থ দিয়ে জার্মানি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে আরও নতুন বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইনের কাজ যখন শেষের দিকে, তখন যুক্তরাষ্ট্র এই লাইন চালু না করার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল। পরে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হয় এবং পরবর্তী সময়ে নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইনের কাজ শেষ হয়। তবে ইউক্রেন আক্রমণের আগপর্যন্ত পাইপলাইনের সার্টিফিকেশনের সময় এ নিয়ে নতুন করে বিতর্কের ঝড় তৈরি হয়।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ইউক্রেনীয় পাইপলাইন এবং নর্ড স্ট্রিম লাইন দুটোই প্রথমে জার্মানির ওপর দিয়ে গিয়ে পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশের দিকে গেছে। জার্মানি শুধুই স্বল্পমূল্যে রাশিয়ার গ্যাস আমদানি করে না, এই গ্যাস জার্মানির ওপর দিয়ে অন্যান্য অঞ্চলে যাওয়ায় তার জন্যও ট্রানজিট ফি একটি আয়ের উৎস।
ইইউর বিভিন্ন দেশ একদিকে রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারের যুক্তি দেখিয়ে এবং আগের গ্যাস পাইপলাইন বন্ধ করে ইউক্রেন ও ইইউকে ব্ল্যাকমেইল করার অভিজ্ঞতাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে লাইনটি চালুর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। অন্যদিকে জার্মানিসহ অন্যান্য দেশ জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় এর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। আবার এমন প্রসঙ্গও এসেছে যে, কীভাবে ইউক্রেনীয় পাইপলাইন চালু রেখে নর্ড স্ট্রিম-১ ও ২ দুটিই চালু রাখা যায় যেন ইউক্রেন বিপর্যস্ত না হয় এবং রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর শক্তির চর্চা করতে না পারে। কিন্তু এই আলোচনার কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি। ইউক্রেনের পাইপলাইন দিয়ে গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ না করে কমিয়ে দিলে ইউক্রেনের পাইপলাইন রক্ষণাবেক্ষণের খরচ উঠবে না। তখন পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস সরবরাহ করা আরও ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। কোনো দিক থেকেই ইইউ কোনো মাঝামাঝি সমাধানে আসতে পারছিল না।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর ইউরোপের নির্ভরতা কমাতে বহুদিন ধরেই ইউরোপজুড়ে এলএনজি প্রযুক্তিকে উৎসাহিত করে আসছিল। ইতোমধ্যে ইউরোপজুড়ে প্রায় ২১টি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়ে গেছে। ২০১৬ সালে টার্মিনালের মাত্র ৩৫ শতাংশ ব্যবহৃত হতো, আর পাইপলাইনের ৫৮ শতাংশ ব্যবহৃত হতো (Adomeit 2016)। ২০২১ সালের গ্রীষ্মে এসে টার্মিনাল ব্যবহারের হার ৪০ শতাংশ ও ২০২২ সালের জানুয়ারির শীতে এসে তা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে গেছে (European Commission 2022)। যদিও ধারাবাহিকভাবে এলএনজি ব্যবহার বেড়েছে, তবুও আমদানি ব্যয়বহুল হওয়ায় কারণে ইউরোপ এলএনজি ব্যবহার যত ইচ্ছা বাড়াতে পারছে না। সবদিক থেকে রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা কমাতে ইউরোপকে এখন যে পরিমাণ পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। এ রকম পরিস্থিতিতে নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইন চালু হয়ে গেলে ভবিষ্যতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা চাহিদার চেয়ে বেশি সক্ষমতা তৈরি করে ফেলতে পারে। এসব সম্ভাবনা মাথায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইন বন্ধ করা কৌশলগতভাবে সুবিধাজনক।
যদিও ধারাবাহিকভাবে এলএনজি ব্যবহার বেড়েছে, তবুও আমদানি ব্যয়বহুল হওয়ায় কারণে ইউরোপ এলএনজি ব্যবহার যত ইচ্ছা বাড়াতে পারছে না। সবদিক থেকে রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা কমাতে ইউরোপকে এখন যে পরিমাণ পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ।
২০২১ সালে অ্যাঞ্জেলা মারকেলের বিদায় এবং ওলাফ শলজের জার্মানির চ্যান্সেলর নির্বাচিত হওয়ার পর জার্মানির রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে। যে কোনো ইইউ দেশের জন্য নিজ দেশের স্বার্থ ইইউর স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে এ নিয়ে জবাবদিহি ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজা হয়। পূর্ববর্তী চ্যান্সেলর নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইনের পক্ষে অবস্থান নিলেও ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ওলাফ শলজ ক্ষমতা গ্রহণ করার পরই এই পাইপলাইন নিয়ে তিনি রাজনৈতিক প্রশ্নের মুখে পড়েন। ওলাফ শলজ পাইপলাইন নিয়ে মারকেলের এবং তার পার্টির প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে দৃঢ়ভাবে নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইনের পক্ষে অবস্থান নেননি। ইউক্রেনের ব্যাপারে ইইউর অবস্থানকে অগ্রগণ্য হিসেবে দেখেছেন। জার্মানির চ্যান্সেলরের এই পরিবর্তিত অবস্থান রাশিয়ার জন্য একটি দুঃসংবাদ। কারণ, রাশিয়া বহুদিন ধরে পরিকল্পনা করে রেখেছিল, নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইন চালু হলে ইউক্রেনের সঙ্গে দরকষাকষি করা এবং তাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা সহজ হবে। কিন্তু এই পাইপলাইনটি চালু হওয়ার সম্ভাবনা স্তিমিত হয়ে যাওয়ায় রাশিয়ার জন্য ইউক্রেনকে নিয়ন্ত্রণের আর কোনো উপায় খোলা থাকল না। তাই ইউক্রেনকে ন্যাটোয় যুক্ত হওয়ার সব পথ বন্ধ করার জন্য রাশিয়া ২০২১ সালের শেষ দিক থেকেই সামরিক বাহিনী ও অস্ত্র ইউক্রেন সীমান্তে জড়ো করা শুরু করে। ন্যাটোয় যুক্ত হওয়ার বিষয়টিকে ইউক্রেন-রাশিয়া সম্পর্কে বহুদিন ধরে টানটান উত্তেজনা তৈরি করে রাখলেও রাশিয়া পথ খুঁজছিল কীভাবে সামরিক শক্তি দিয়ে মোকাবিলা না করে জ্বালানি সংকট তৈরি করে ইউক্রেনকে নতজানু করা যায়। কিন্তু ২০২১-এর শেষে এসে সেই সম্ভাবনা কমে যাওয়ায় রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসনের প্রস্তুতি নেয় এবং এই আগ্রাসনে ইইউর জ্বালানিনির্ভরতাকে তার পক্ষে ব্যবহার করে। ইউরোপ একদিক থেকে ইউক্রেনের জন্য মায়াকান্না কাঁদছে, অন্যদিকে তার নিজস্ব সক্ষমতা তৈরির দিকে মনোযোগী হচ্ছে। পুরো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এখন এলএনজিকে বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করে দিল রাশিয়া।
রাশিয়া বহুদিন ধরে পরিকল্পনা করে রেখেছিল, নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইন চালু হলে ইউক্রেনের সঙ্গে দরকষাকষি করা এবং তাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা সহজ হবে। কিন্তু এই পাইপলাইনটি চালু হওয়ার সম্ভাবনা স্তিমিত হয়ে যাওয়ায় রাশিয়ার জন্য ইউক্রেনকে নিয়ন্ত্রণের আর কোনো উপায় খোলা থাকল না। তাই ইউক্রেনকে ন্যাটোয় যুক্ত হওয়ার সব পথ বন্ধ করার জন্য রাশিয়া ২০২১ সালের শেষ দিক থেকেই সামরিক বাহিনী ও অস্ত্র ইউক্রেন সীমান্তে জড়ো করা শুরু করে।
২০০৪ এবং ২০১৪-এর পর ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যখন রাশিয়া প্রভাব বিস্তার করতে পারছিল না, তখন সে তার হাতিয়ার পরিবর্তনের পরিকল্পনা করে এবং সত্তরের দশকে আরব দেশগুলোর মতো জ্বালানি নির্ভরতাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ২০০৬ ও ২০০৯ সালে গ্যাস সরবরাহ সাময়িক বন্ধ করে প্রতিক্রিয়াও পর্যবেক্ষণ করে। বহুদিনের হিসাব-নিকাশ অনুযায়ী রাশিয়ার পরিকল্পনা ছিল‒হয় সে জ্বালানি নির্ভরতাকে জিম্মি করে ইউক্রেনকে নিয়ন্ত্রণ করবে অথবা ইইউকের জ্বালানিনির্ভরতাকে জিম্মি করে ইউক্রেনকে সামরিক ভয়ভীতি দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করবে। পরেরটা রাশিয়ার এবং ইউক্রেনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু রাশিয়া শেষ পর্যন্ত পরের পরিকল্পনাই বেছে নিয়েছে এবং শুধু সামরিক ভয়ভীতি প্রদর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, একটি যুদ্ধের সূচনা করেছে। ইইউ সমাধান হিসেবে বিকল্প খুঁজছে, আমেরিকা শেল গ্যাস ও এলএনজিকে বিকল্প হিসেবে হাজির করছে। আর এর মধ্যে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ অন্য তিন পক্ষের স্বার্থের দ্বন্দ্বের বলি হচ্ছে।
৪ উপসংহার
সত্তরের দশকের সঙ্গে বর্তমান সময়ের যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, জ্বালানিনির্ভরতা, সংকটের ধরন, তীব্রতা ইত্যাদির পার্থক্য থাকলেও পরিবর্তিত বিশ্বে জ্বালানি নিরাপত্তা প্রশ্নটির পরিবর্তন হয়েছে মনে হলেও আসলে যে পরিবর্তন হয়নি, তা আরও স্পষ্ট হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর। সত্তরের দশকে পশ্চিমারা বুঝতে পেরেছিল জ্বালানির স্বনির্ভরতা কতটা জরুরি। তাই তারা শুধু মধ্যপ্রাচ্যের বিকল্পই খোঁজেনি, জ্বালানির উৎসেও এনেছে বৈচিত্র্য। সে সময় থেকেই জ্বালানিকে ভূরাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের যে প্রবণতা শুরু হয়, তা আজও বন্ধ হয়নি। শুধু রাশিয়া তার তেল-গ্যাস-কয়লা-নিউক্লিয়ার দিয়ে নয়, যুক্তরাষ্ট্রও পাল্লা দিয়ে তার শেল গ্যাস এবং এলএনজিকে ভূরাজনৈতিক শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছে অনেক আগে থেকেই। আর এর ফলেই এই দুই শক্তির মাঝে দ্বন্দ্বের ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করছে ইউক্রেনের মতো দেশ। এর আগেও আমদানিনির্ভর অনুন্নত দেশগুলোই তেল সংকটে চড়া মূল্য দিয়েছিল, এখনো তাই দিচ্ছে অনুন্নত বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ, যারা হয়তো জানেই না, কী কারণে তাদের চড়া মূল্যে তেল ও বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে।
ইতোমধ্যে পশ্চিমারা প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা না-করলেও ভিয়েতনাম যুদ্ধে রাশিয়ার পরোক্ষ সহায়তা দেওয়ার দৃষ্টান্ত ব্যবহার করে অস্ত্র সরবরাহ থেকে শুরু করে অর্থ দিয়ে ইউক্রেনকে সহায়তা করছে। মাঝখান থেকে বাংলাদেশের মতো দেশ কয়লা দিয়ে চীন, জাপান ও ভারতকে, এলএনজি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে, নিউক্লিয়ার দিয়ে রাশিয়াকে খুশি রেখে ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টার নামে দিনে দিনে আমদানিনির্ভর হয়ে উঠছে।
উদ্ভূত সংকট পরিস্থিতিতে এলএনজি রপ্তানিকারক দেশগুলো, তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলো বিপুল মুনাফা করবে বলে ধারণা করা যায়। আগে এই মুনাফার অর্থ ব্যবহৃত হয়েছে সামরিক অস্ত্র কেনায় এবং প্রয়োগ করা হয়েছে তাদের ওপর, যারা এর পথে বাধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে (Yergin 2012)। এই সংকটেও হয়তো তা-ই হবে। ইতোমধ্যে পশ্চিমারা প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা না-করলেও ভিয়েতনাম যুদ্ধে রাশিয়ার পরোক্ষ সহায়তা দেওয়ার দৃষ্টান্ত ব্যবহার করে অস্ত্র সরবরাহ থেকে শুরু করে অর্থ দিয়ে ইউক্রেনকে সহায়তা করছে। মাঝখান থেকে বাংলাদেশের মতো দেশ কয়লা দিয়ে চীন, জাপান ও ভারতকে, এলএনজি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে, নিউক্লিয়ার দিয়ে রাশিয়াকে খুশি রেখে ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টার নামে দিনে দিনে আমদানিনির্ভর হয়ে উঠছে। ২০২২-এর জ্বালানি সংকটের সময় গ্যাস রেশনিং চলছে। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, এলপিজি, এলএনজি চড়া দামে কিনেও জিওপলিটিক্যাল ব্যালেন্স খেলায় বাংলাদেশের মতো দেশগুলোই যুদ্ধের ভার বহন করে চলেছে। অথচ ইউরোপের দেশগুলো ঠিকই তেল গ্যাস মজুত করে তার আমদানিনির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
জ্বালানিকে ভূরাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ধনী দেশগুলো বিশ্বজুড়ে যে বৈষম্য তৈরি করেছে, তার ক্ষতির দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশগুলোর প্রয়োজন জ্বালানি নিরাপত্তা বিষয়টির ওপর অধিক মনোযোগী হওয়া। আজ যুদ্ধের কারণে রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের খরচ বেড়ে গেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের খরচ অনেক বেড়ে যাবে। অন্তত আগের বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষকে ভবিষ্যতে চড়া দাম দিয়ে বিদ্যুৎ কিনে রাশিয়ার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ইতোমধ্যে ইন্দোনেশিয়া কয়লা উত্তোলন কমিয়ে দেবে ঘোষণা দেওয়ায় ভারতীয় কয়লাকে বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ভারতের কয়লা পরিবেশের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর। যুদ্ধকে কেন্দ্র করে এলএনজির বাজারেও এর চাহিদা বেড়ে যাবে। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে বহুদিন ধরেই চীন ও পার্শ্ববর্তী দেশের মধ্যে সমস্যা চলছে। চীন আর ভারতের মধ্যে এর আগেও সীমান্ত নিয়ে সংঘাত হয়েছে। এসব সংঘাত কখনো বড় আকার ধারণ করলে ক্ষতিগ্রস্ত হব আমরাই।
উন্নত বিশ্ব যখন বারবার সংকটে পড়ে স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করে, তখন দরিদ্র দেশগুলো খেলার দর্শকে পরিণত হয়। জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির চিন্তা নানান স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থের আড়ালে মাটিচাপা পড়ে যায়। সংকটের দ্রুত সমাধান বের করতে গিয়ে বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর। বাংলাদেশে বহুদিন ধরেই গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। আমরা জনগণ এখনো জানি না, সাগরবক্ষে জরিপ করতে গিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অভিজ্ঞতা আসলে কী ছিল। নাকি ধরে নিতে হবে, জ্বালানি নিরাপত্তার একমাত্র ক্রেতা শুধু উন্নত বিশ্ব আর আমাদের ক্রয়ের জন্য তুলে রাখা আছে ব্যয়বহুল নিউক্লিয়ার, এলএনজি, আর যুদ্ধাহত মানুষের বিষণ্ন রক্ত?
মোশাহিদা সুলতানা: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল: moshahida@du.ac.bd
তথ্যসূত্র:
Adomeit, H. 2016. Germany, the EU, and Russia: The Conflict over Nord Stream 2, CES Policy Brief
Barron’s. 2022. Hungary Gets First Delivery of Russia Nuclear Fuel Since War, AFP News, Accessed on April 19 2022, from https://www.barrons.com/news/hungary-gets-first-delivery-of-russia-nuclear-fuel-since-war-01649327408
European Commission. 2022. EU-US LNG Trade from Available at https://energy.ec.europa.eu/system/files/2022-02/EU-US_LNG_2022_2.pdf [Accessed on April 19, 2022]
IEA. 2019. International Energy Agency website. Available at from https://www.iea.org/data-and-statistics [Accessed on 19th April, 2022]
MERIP 1974 A Political Evaluation of the Arab Oil Embargo Source: MERIP Reports, May, 1974, No. 28 (May, 1974), pp. 23-25 Published by: Middle East Research and Information Project, Inc. (MERIP)
Karatnycky, A. 2005. Ukraine’s Orange Revolution Foreign Affairs Vol. 84, No. 2 (Mar. – Apr., 2005), pp. 35-52
Stent, A. 2019. Putin’s World: Russia Against the West and With the Rest
Vetier, M. Jewell, J. Garcia-Cabrera, D. 2019 The international technological nuclear cooperation landscape: A new dataset and network analysis, Energy Policy, Volume 128,
2019, Pages 838-852
Yergin, D. 2020 The New Map: Energy, Climate, and the Clash of Nations, Penguine Press New York
Yergin, Daniel. 2012 The Quest: Energy, Security and the Remaking of the Modern World. New York: Penguin Books.
Yergin, Daniel. 1991. The Prize: the Epic Quest for Oil, Money, and Power. New York: Simon & Schuster.
World Bank. 1983. Petroleum Exploration Promotion Project, Report of Recommendation, Report no. P-3615-BD, June 15, 1983, p10. Available at https://documents1.worldbank.org/curated/pt/955971468014663735/text/multi-page.txt [Accessed on November 15, 2021]