শ্রীলংকার অর্থনৈতিক সংকট: উৎস সন্ধান

শ্রীলংকার অর্থনৈতিক সংকট: উৎস সন্ধান

কল্লোল মোস্তফা

দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় শ্রীলংকা বহুদিক থেকে অগ্রসর অবস্থায় থাকার পরও সম্প্রতি এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে। বিভিন্ন তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে, গত কয়েক বছরের অপরিণামদর্শী নীতি, বাণিজ্যিক ঋণনির্ভরতা বৃদ্ধি, বিচার বিবেচনাহীন মেগা প্রজেক্ট, এক পরিবারের নেতৃত্বে ব্যাপক দুর্নীতির বিস্তার আর সেইসাথে প্রতিকূল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি শ্রীলংকার অর্থনীতিকে এরকম সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই প্রবন্ধে সংকটের উৎস সন্ধান করে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ সনাক্ত করা হয়েছে।

ভূমিকা: শ্রীলংকায় অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সংকট চলছে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে আমদানি করা যাচ্ছে না খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ, গুঁড়া দুধ কিংবা কাগজের মতো প্রয়োজনীয় সামগ্রী। খাদ্য কিংবা জ্বালানির জন্য দীর্ঘ লাইন, দিনের বেশিরভাগ সময় বিদ্যুৎ না-থাকা এখন নিত্য বাস্তবতা। কাগজের অভাবে স্কুল-পরীক্ষা বন্ধ অনির্দিষ্টকালের জন্য, রাস্তার বাতি জ্বলছে না, হাসপাতালে সাধারণ অপারেশন বন্ধ হয়ে গেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না-থাকা, তেল, খাদ্য ও ওষুধ সংকটের কারণে জন-অসন্তোষ চরমে উঠেছে, সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ মানুষের বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা এবং কারফিউ জারি করেও মানুষকে ঘরে আটকে রাখতে পারছে না। সর্বশেষ, ঋণ পরিশোধে অক্ষমতার কারণে আইএমএফ এর সাথে সমঝোতা ও বৈদেশিক ঋণ পুনর্গঠনের আগ পর্যন্ত শ্রীলংকা সকল ধরণের বাণিজ্যিক ও দ্বিপাক্ষিক বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করেছে। বর্তমান প্রবন্ধটিতে শ্রীলংকার এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধান করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার থেকে উচ্চ সুদে বাণিজ্যিক ঋণ: শ্রীলংকার অর্থনৈতিক সংকটের একটা উল্লেখযোগ্য কারণ হলো, আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার থেকে উচ্চ সুদে বৈদেশিক মুদ্রায় (ডলার) সার্বভৌম ঋণ গ্রহণ। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে নেওয়া দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক ঋণের সঙ্গে এই বাণিজ্যিক সার্বভৌম ঋণ বা সোভেরেইন বন্ডের পার্থক্য হলো, এসব বাণিজ্যিক ঋণের মেয়াদকাল মাত্র ৫-১০ বছর, সুদের হার ৬ শতাংশের বেশি, বছরে দুবার সুদ পরিশোধ করতে হয় আর আসল পরিশোধ করতে হয় একবারে, মেয়াদ শেষে যা বৈদেশিক মুদ্রার ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি করে। বিভিন্ন দেশ বা বহুপাক্ষিক সংস্থার কাছ থেকে নেওয়া ঋণে নানা শর্ত থাকলেও এগুলোর সুদের হার কম (০.২৫ থেকে ৩%), দীর্ঘমেয়াদি (২০ থেকে ৪০ বছর), গ্রেস পিরিয়ড থাকে, সুদ-আসল বছর বছর কিস্তিতে পরিশোধ করা যায়। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর ততটা চাপ পড়ে না, যতটা চাপ পড়ে সার্বভৌম বন্ডের মাধ্যমে সংগৃহীত বাণিজ্যিক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে।

ছবি: দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক ঋণের তুলনায় সার্বভৌম ঋণের খরচ বেশি, সূত্র: publicfinance.lk

বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে নেওয়া দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক ঋণের সঙ্গে এই বাণিজ্যিক সার্বভৌম ঋণ বা সোভেরেইন বন্ডের পার্থক্য হলো, এসব বাণিজ্যিক ঋণের মেয়াদকাল মাত্র ৫-১০ বছর, সুদের হার ৬ শতাংশের বেশি, বছরে দুবার সুদ পরিশোধ করতে হয় আর আসল পরিশোধ করতে হয় একবারে, মেয়াদ শেষে যা বৈদেশিক মুদ্রার ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি করে।

সবচেয়ে চাপ পড়ে আইএসবি যখন ম্যাচিউরড হয়। কারণ, তখন একবারে ঋণের পুরো অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়, যা ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ওপর ব্যাপক চাপ ফেলে। ৫ বা ১০ বছর মেয়াদি বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে যদি এমনসব কাজে ব্যয় করা হয়, যা থেকে উচ্চ সুদসহ আসল পরিশোধ করার মতো বৈদেশিক মুদ্রা আয় না হয়, তাহলে সেই ঋণ অপরিশোধযোগ্য বোঝায় পরিণত হতে বাধ্য। শ্রীলংকার ক্ষেত্রে ঠিক তা-ই ঘটেছে। শ্রীলংকার বৈদেশিক ঋণ যখন বাড়ছিল, তখন জিডিপির অনুপাতে রপ্তানি আয় ক্রমশ কমছিল। ২০০০ সালে গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, চা, রাবার ইত্যাদি পণ্য ও সেবা রপ্তানি বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা আয় ছিল জিডিপির ৩৯ শতাংশ, যা ২০১৫ সালে ২০ শতাংশে নেমে আসে।

ছবি: জিডিপি অনুপাতে শ্রীলংকার ক্রমহ্রাসমান রপ্তানি আয়, সূত্র: longform.watchdog.team

একই সঙ্গে ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়তে থাকায় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটা বড় অংশ বৈদেশিক মুদ্রায় নেওয়া ঋণ পরিশোধেই ব্যয় করতে হয়, যা বাড়তে বাড়তে ২০২০ সালে রপ্তানি আয়ের ৩৩.৫ শতাংশ পর্যন্ত উঠে যায়। এ অবস্থায় শ্রীলংকা বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের জন্য আরও বেশি করে সার্বভৌম ঋণ করতে শুরু করে।

ছবি: শ্রীলংকার রপ্তানি আয়ের অনুপাতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ, সূত্র: longform.watchdog.team

শ্রীলংকা ২০০৭ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ড (আইএসবি) ইস্যু করে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার থেকে ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলার সংগ্রহ শুরু করে। এই ঋণের মেয়াদ ছিল ৫ বছর এবং সুদের হার ৮.২৫ শতাংশ। এরপর বছর বছর এই ঋণের পরিমাণ শুধু বৃদ্ধি পেয়েছে, সার্বভৌম বন্ড থেকে সংগৃহীত ঋণের একটা বড় অংশ পূর্ববর্তী বন্ডের সুদ পরিশোধে ব্যয় করা হয়েছে। শ্রীলংকা ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৩ বার সার্বভৌম বন্ডের মাধ্যমে বৈদেশিক ৫০ কোটি, ৬০ কোটি কিংবা ১০০ কোটি ডলার করে সংগ্রহ করেছে, যেগুলোর মেয়াদ ৫ বছর, ৬ বছর, ১০ বছর বা ১১ বছর। এভাবে ২০০৭ সালে যেখানে শ্রীলংকার বাণিজ্যিক ঋণের পরিমাণ ছিল বৈদেশিক ঋণের মাত্র ৪.৩ শতাংশ, ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় দেশের বৈদেশিক ঋণের ৪৭ শতাংশ, যার বেশিরভাগই আইএসবি। শ্রীলংকা সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব এক্সটারনাল রিসোর্সের দেওয়া তথ্যানুসারে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ঋণ ছাড়া আরও যেসব দেশ ও সংস্থার কাছে শ্রীলংকার বৈদেশিক ঋণ রয়েছে সেগুলো হলো: এডিবি (১৩ শতাংশ), চীন (১০ শতাংশ), জাপান (১০ শতাংশ), বিশ্বব্যাংক (৯ শতাংশ) ও ভারত (২ শতাংশ)।

ছবি: ঋণদাতা দেশ/প্রতিষ্ঠান অনুসারে শ্রীলংকার বৈদেশিক ঋণ, সূত্র: erd.gov.lk

২০০৭ সালে যেখানে শ্রীলংকার বাণিজ্যিক ঋণের পরিমাণ ছিল বৈদেশিক ঋণের মাত্র ৪.৩ শতাংশ, ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় দেশের বৈদেশিক ঋণের ৪৭ শতাংশ

সব মিলিয়ে শ্রীলংকার এখন এমন একটা পরিস্থিতি যে খাদ্য কিংবা জ্বালানির মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানির মতো প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা পর্যাপ্ত পরিমাণে না-থাকলেও সার্বভৌম ঋণ পরিশোধে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শেষ করতে হচ্ছে। যেমন: ২০১২ সালে নেওয়া ১০ বছর মেয়াদি ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলারের সার্বভৌম ঋণ শ্রীলংকাকে এই তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও পরিশোধ করতে হয়েছে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে। শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে ২ বিলিয়ন বা ২০০ কোটি ডলারের মতো অথচ এই বছরে সব মিলিয়ে শ্রীলংকাকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হবে ৭ বিলিয়ন বা ৭০০ কোটি ডলার, যার মধ্যে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে সার্বভৌম ঋণ, জুলাই মাসের মধ্যে।১০ এরকম একটা পরিস্থিতিতেই শ্রীলংকা সকল বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্তের আগের হিসাব অনুসারে, শ্রীলংকার ২০২৩ সালে ৫০০ কোটি ডলার, ২০২৪ সালে ৪৮০ কোটি ডলার, ২০২৫ সালে ৫০০ কোটি ডলার এবং ২০২৬ সালে ৩৮০ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করবার দায় ছিল, যার মধ্যে সার্বভৌম ঋণ ছাড়াও রয়েছে ডেভেলপমেন্ট বন্ড এবং চীন, জাপান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে নেওয়া বৈদেশিক ঋণ।১১

ছবি: ২০২২ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত শ্রীলংকার সার্বভৌম ঋণ ম্যাচিউর হওয়ার পরিসংখ্যান, সূত্র: longform.watchdog.team

বিদেশি ঋণনির্ভর অপ্রয়োজনীয় বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প: দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকার আকৃতি খুব বড় নয়, উত্তর থেকে দক্ষিণে সর্বোচ্চ দূরত্ব ৪৪০ কিমি এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে ২২০ কিমি। ব্যাবসা-বাণিজ্যের জন্য ব্রিটিশদের তৈরি যোগাযোগ অবকাঠামো যথেষ্ট শক্তিশালী। মোটামুটি ৫ ঘণ্টায় দেশের যে কোনো প্রান্তে যাতায়াত করা সম্ভব। এ রকম একটা ভৌগোলিক বাস্তবতায় রাস্তাঘাট, এক্সপ্রেসওয়ের মতো ব্যয়বহুল অবকাঠামোর পেছনে বিদেশি ঋণনির্ভর প্রকল্প কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে শ্রীলংকায় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। যেমন, শ্রীলংকার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব চন্দ্রসেনা মালিয়াদ্দে শ্রীলংকার সানডে টাইমসে শ্রীলংকার ভৌগোলিক বাস্তবতার কথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন: ‘যে কোনো অবকাঠামো প্রকল্পকে কারিগরি ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় লাভজনক ও বাস্তবায়নযোগ্য হতে হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা উনিশ শতকে আমাদের রেলওয়ে নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল, যা আমাদের অন্যতম প্রধান একটি অবকাঠামো। ১৮৬৪ সালে কলম্বো ও বাদুল্লার মধ্যে রেললাইন বসানোর প্রধান কারণ ছিল পাহাড়ি অঞ্চলে উৎপাদিত চা এবং কফি রপ্তানির জন্য কলম্বো নিয়ে আসা এবং বিনিময়ে ভোগ্যপণ্য পরিবহণ করে নিয়ে আসা। বহু বছর ধরে এই ধরনের পণ্য পরিবহণ ছিল এই রেল যোগাযোগব্যবস্থার আয়ের প্রধান উৎস। কিন্তু হামবানটোটা বন্দর কিংবা সাউদার্ন এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের বেলায় কি এমন কোনো কিছু বলা যাবে?’১২

মোটামুটি ৫ ঘণ্টায় দেশের যে কোনো প্রান্তে যাতায়াত করা সম্ভব। এ রকম একটা ভৌগোলিক বাস্তবতায় রাস্তাঘাট, এক্সপ্রেসওয়ের মতো ব্যয়বহুল অবকাঠামোর পেছনে বিদেশি ঋণনির্ভর প্রকল্প কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে শ্রীলংকায় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন।

উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা বলে চীনের কাছ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে ২ থেকে ৬ শতাংশ পর্যন্ত সুদে ১.৩ বিলিয়ন বা ১৩০ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে তৈরি হামবানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে প্রত্যাশিত আয় তো আসেইনি, উল্টো লোকসান সামলানোর জন্য বন্দরটিকে চীনের কাছে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিতে হয়েছে।১৩ হামবানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দরের কাছে চীনের কাছ থেকে ১৯ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে নির্মিত ১২ হাজার বর্গমিটার আয়তনের ঝকঝকে মাত্তালা রাজাপক্ষে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও একটি শ্বেতহস্তী প্রকল্প। এই বিমানবন্দরেরও আয় থেকে ব্যয় বেশি, বছরে লোকসান ১ দশমিক ৮ কোটি ডলার। এই বিমানবন্দর দিয়ে এত কম উড়োজাহাজ ওঠানামা করে যে, ফোর্বস ম্যাগাজিন এই বিমানবন্দরকে বিশ্বের সবচেয়ে ফাঁকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে চিহ্নিত করেছে।১৪ রাজাপক্ষের পরিবারের নির্বাচনি এলাকা হামবানটোটাকে ঘিরে এ রকম আরও কতগুলো লোকদেখানো ঋণনির্ভর অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্প হলো: মাহিন্দা রাজাপক্ষে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়াম, মাগাম রুহুনুপুয়া ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স হল, মাহিন্দা রাজাপক্ষে ন্যাশনাল টেলি সিনেমা পার্ক, সাউদার্ন এক্সপ্রেসওয়েকে মাতারা থেকে হামবানটোটা পর্যন্ত সম্প্রসারণ ইত্যাদি।

আরও কতগুলো লোকদেখানো ঋণনির্ভর অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্প হলো: মাহিন্দা রাজাপক্ষে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়াম, মাগাম রুহুনুপুয়া ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স হল, মাহিন্দা রাজাপক্ষে ন্যাশনাল টেলি সিনেমা পার্ক, সাউদার্ন এক্সপ্রেসওয়েকে মাতারা থেকে হামবানটোটা পর্যন্ত সম্প্রসারণ ইত্যাদি।

এভাবে ২০০৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত শ্রীলংকা সরকার জিডিপির অনুপাতে ক্রমহ্রাসমান রপ্তানি আয়ের মধ্যেও বিদেশি ঋণনির্ভর বহু অপ্রয়োজনীয় বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প নিয়েছে, যা স্বল্প মেয়াদে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের চমক সৃষ্টি করলেও দীর্ঘ মেয়াদে শ্রীলংকার অর্থনীতিতে বৃহৎ বোঝা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

ছবি: ২০০৫ সাল থেকে বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প বাবদ শ্রীলংকার নেওয়া বিদেশি ঋণের তথ্য, সূত্র: longform.watchdog.team 

শ্রীলংকায় বিদেশি ঋণনির্ভর অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে, যে দুর্নীতির কারণে শ্রীলংকার রাস্তা নির্মাণ ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ বলে অভিযোগ রয়েছে।

দুর্নীতি ও লুটপাট: শ্রীলংকায় বিদেশি ঋণনির্ভর অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে, যে দুর্নীতির কারণে শ্রীলংকার রাস্তা নির্মাণ ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ বলে অভিযোগ রয়েছে। সেখানে সাউদার্ন এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে কিমিপ্রতি ১৫০ কোটি রুপি, কাটুনায়েকে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে কিমিপ্রতি ১৮০ কোটি রুপি এবং আউটার সার্কুলার হাইওয়ে নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনটি পৃথক অংশ নির্মাণে কিমিপ্রতি ২৭০ কোটি, ৫০০ কোটি ও ৭০০ কোটি রুপি করে খরচ হয়েছে।১৫ ২০১৩ সালে শ্রীলংকার বিরোধী দল ইউএনপির একজন এমপি কিমিপ্রতি ১৮০ কোটি রুপি ব্যয়ে নির্মিত কাটুনায়েকে এক্সপ্রেসওয়েকে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল হাইওয়ে বলে গিনিস বুক অব রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য চিঠি দেবেন বলে ঘোষণা করেন।১৬ ২০১৪ সালে শ্রীলংকার বেসরকারি সংস্থা ‘শ্রীলংকা ক্যাম্পেইন’ ‘রোডস পেইভড উইথ গোল্ড’ বা ‘সোনায় মোড়ানো রাস্তা’ নামের এক রিপোর্টে অভিযোগ করে, বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বিশ্বে রাস্তা নির্মাণের গড় খরচ কিমিপ্রতি ১ মিলিয়ন ডলার থেকে সর্বোচ্চ ২.১ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে; অথচ শ্রীলংকার রাস্তার গড় ব্যয় কিমিপ্রতি ৩.৭২ মিলিয়ন ডলার (বৈশ্বিক সর্বোচ্চ ব্যয়েরও ১.৭ গুণ বেশি), কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই ব্যয় ২৩.৭ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে, যা আউটার সার্কুলার হাইওয়ের ক্ষেত্রে দেখা গেছে (এই ব্যয় বৈশ্বিক সর্বোচ্চ ব্যয়েরও ১১ গুণ বেশি)।১৭ রাস্তা নির্মাণে দুর্নীতি ও অপচয় ছাড়াও ২০০৫ থেকে ২০১৫ এবং ২০১৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ক্ষমতাসীন রাজাপক্ষের পরিবার ও তাদের ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে আরও যেসব দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন সদস্য কর্তৃক দুবাইয়ে ২ বিলিয়ন ডলার পাচার১৮; মাহিন্দা রাজাপক্ষের শ্যালক নিশান্ত বিক্রমাসিংহে শ্রীলংকার রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থার চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় কয়েক বিলিয়ন ডলারের দুর্নীতি এবং ২.৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যে ১০টি এয়ারবাস বিমান কেনায় অনিয়ম১৯; প্যান্ডোরা পেপার্সে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের ভাইঝি নিরুপমা রাজাপক্ষের ও তার স্বামী থিরুকুমার নাদেসানের নামে অর্থ পাচার করে সিডনি ও লন্ডনে বিলাসবহুল বাড়ি ও শিল্পকর্ম ক্রয়ের অভিযোগ২০; রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ক্যানউইল হোলডিংস কর্তৃক হায়াত হোটেল নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ১ হাজার ৩০০ কোটি রুপি থেকে বেড়ে ২ হাজার ৭০০ কোটি রুপিতে পরিণত হওয়া২১ ইত্যাদি।

ছবি: রাজাপক্ষের পরিবারের বিরুদ্ধে শ্রীলংকার আন্দোলনকারীদের দুর্নীতির অভিযোগ, সূত্র: টুইটার

ক্ষমতাসীন রাজাপক্ষের পরিবার ও তাদের ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে আরও যেসব দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন সদস্য কর্তৃক দুবাইয়ে ২ বিলিয়ন ডলার পাচার; মাহিন্দা রাজাপক্ষের শ্যালক নিশান্ত বিক্রমাসিংহে শ্রীলংকার রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থার চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় কয়েক বিলিয়ন ডলারের দুর্নীতি এবং ২.৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যে ১০টি এয়ারবাস বিমান কেনায় অনিয়ম

শ্রীলংকার করব্যবস্থার সংকট ও সরকারের আয় হ্রাস: শ্রীলংকার করব্যবস্থা ভীষণ অন্যায্য। কারণ, সরকারের রাজস্ব আয়ের ৮০ থেকে ৮২ শতাংশ আসে পরোক্ষ কর অর্থাৎ ভ্যাট, আমদানি শুল্ক ইত্যাদি থেকে। শ্রীলংকা সরকারের রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে পছন্দের উপায় হলো আমদানি শুল্ক (অর্ধেকেরও বেশি আসে আমদানি শুল্ক থেকে)। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় আবশ্যক খাদ্যসামগ্রী, রান্নার জ্বালানি এমনকি স্যানিটারি প্যাড আমদানি থেকেও ধনী-গরিবের কাছ থেকে সমান হারে কর আহরণ করা হয়। অন্যদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যক্তি করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে না পারার ফলে প্রত্যক্ষ করের হার বৃদ্ধি পায়নি, যা সরকারি বিনিয়োগে আর্থিক সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জিডিপির তুলনায় শ্রীলংকার কর আহরণের হার অত্যন্ত কম। ধরে নেওয়া হয়, কোনো দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করতে থাকলে তার কর-জিডিপির অনুপাত তুলনামূলকভাবে বাড়তে থাকে। শ্রীলংকার ক্ষেত্রে তার বিপরীতটাই ঘটেছে। ১৯৯০-এর দশক থেকে কর-জিডিপি অনুপাত হ্রাস পেয়ে গড়ে ১৮.৪ শতাংশ (১৯৯০-৯২) থেকে ১২.৭ শতাংশে (২০১৭-১৯) নেমে আসে, ২০২০ সালে যা আরও কমে হয় ৮.৪ শতাংশ।২২

এ রকম একটা পরিস্থিতিতে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে জর্জরিত গোতাবায়ে রাজাপক্ষে সস্তা জনপ্রিয়তার আকাঙ্ক্ষায় দেওয়া নির্বাচনি প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে ২০১৯ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর যখন হঠাৎ করে নানা ধরনের কর ছাড় দিয়ে বসেন, তখন শ্রীলংকার এমনিতেই দুর্বল অর্থনীতি আরও চাপে পড়ে যায়। এ সময় করপোরেট আয় কর ২৮ থেকে ২৪ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ থেকে ৮ শতাংশ করা হয়, অবকাঠামো ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে করহার হ্রাস, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশনের সীমা বছরে ১ কোটি ২০ লাখ রুপি থেকে বাড়িয়ে ৭ কোটি ৫০ লাখ রুপি করা, জাতি উন্নয়ন কর (নেশন বিল্ডিং ট্যাক্স) ও যত আয় তত কর (পে অ্যাজ ইউ আর্ন—পিএইউই) ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা, ব্যক্তিগত করযোগ্য আয়ের সীমা ৫ লাখ রুপি থেকে বাড়িয়ে ৩০ লাখ রুপি করা ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়া হয়।২৩ ফলে ২০১৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ব্যক্তি করদাতার সংখ্যা ৩৩.৫ শতাংশ হ্রাস পায়, জিডিপির প্রায় ২ শতাংশের সমপরিমাণ কর আয় হারিয়ে যায় এবং ভ্যাট থেকে আয়ের পরিমাণ কমে অর্ধেক হয়ে যায়।২৪

ছবি: কর ছাড় এবং সরকারের ব্যয় বৃদ্ধির ফলে ২০২০ সালে বাজেট ঘাটতি বৃদ্ধি পায়, সূত্র: Why did Sri Lanka’s budget deficit increase in 2021?, দ্য সানডে মর্নিং, ২৭ অক্টোবর ২০২১

 পর্যটন খাতের আয় হ্রাস: রেমিট্যান্স এবং গার্মেন্টসের পরেই শ্রীলংকার তৃতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাত হলো পর্যটন। গড়ে শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রার ২৫ শতাংশ রেমিট্যান্স খাত থেকে, ২০ শতাংশ গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল এবং ১৫ শতাংশ পর্যটন থেকে আসে।২৫ কিন্তু ২০১৯ সালের ইস্টার সানডে বোমা হামলা ও ২০২০ সালের করোনা মহামারির প্রভাবে পর্যটন থেকে শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রার আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে, যা ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ওপর বাড়তি চাপ ফেলেছে। ২০১৮ সালে পর্যটন খাত থেকে আয় ছিল ৪৩৮ কোটি ডলার, যা ২০১৯ সালে ১৭ শতাংশ হ্রাস পেয়ে হয় ৩৬০ কোটি ডলার। এরপর ২০২০ সালে পর্যটন থেকে আয় হয় মাত্র ৬৮ কোটি ডলার এবং ২০২১ সালে ২৬ কোটি ডলার।২৬

ছবি: ২০১৯ সাল থেকে শ্রীলংকার পর্যটন আয় ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পায়, সূত্র: ceicdata.com

২০১৮ সালে পর্যটন খাত থেকে আয় ছিল ৪৩৮ কোটি ডলার, যা ২০১৯ সালে ১৭ শতাংশ হ্রাস পেয়ে হয় ৩৬০ কোটি ডলার। এরপর ২০২০ সালে পর্যটন থেকে আয় হয় মাত্র ৬৮ কোটি ডলার এবং ২০২১ সালে ২৬ কোটি ডলার। 

রাসায়নিক সার আমদানি হঠাৎ নিষিদ্ধের ফলে কৃষি উৎপাদন হৃাস: রাজাপক্ষের নির্বাচনি ইশতেহারে জৈব সারের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কৃষকদের তা বিনা মূল্যে সরবরাহ করে ১০ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে রাসায়নিক সারকে জৈব সার দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের প্রেক্ষাপটে ২০২১ সালের মে মাস থেকে গোতাবায়ে সরকার হঠাৎ করে রাসায়নিক সার আমদানি পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কৃষি বিশেষজ্ঞরা এভাবে হঠাৎ করে রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ করলে ধান উৎপাদন ২৫ শতাংশ এবং চা উৎপাদন ৩৫ শতাংশ হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কার কথা জানালেও সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি।২৭

পরবর্তী সময়ে ব্যাপক মাত্রায় উৎপাদন হ্রাস ও কৃষকদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নভেম্বর ২০২১-এর মধ্যে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলেও ততদিনে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রথম ৬ মাসের মধ্যে ধান উৎপাদন ২০ শতাংশ কমে যায়। চাল উৎপাদনে দীর্ঘদিন ধরে স্বয়ংসম্পূর্ণ শ্রীলংকাকে ইতোমধ্যে ৪৫ কোটি ডলারের চাল আমদানি করতে হয়েছে, তারপরও বাজারে চালের দাম ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।২৮ শুধু ধানই নয়, এভাবে হঠাৎ রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ করার ফলে চা, রাবার, নারকেলের মতো অর্থকরী ফসলের উৎপাদনও হ্রাস পেয়েছে। এর মধ্যে শ্রীলংকার অন্যতম রপ্তানি পণ্য চা-এর উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার কারণে ৪২.৫ কোটি ডলারের ক্ষতি হবে বলে লিখেছে ফরেন পলিসি। শ্রীলংকার অর্থ মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে সানডে টাইমস লিখেছে, রাসায়নিক সার আমদানি বাবদ ৪০ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাতে গিয়ে এখন শ্রীলংকাকে ১৮৪ কোটি ডলারেরও বেশি খেসারত দিতে হবে।২৯

শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় শেষ হয়ে গেছে, ফলে দেশটির পক্ষে খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ, গুঁড়া দুধ কিংবা কাগজের মতো প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমদানি করা এবং বিভিন্ন ধরনের বিদেশি ঋণ পরিশোধ কঠিন হয়ে গেছে।

উপসংহার: একদিক থেকে দেখলে শ্রীলংকার চলমান অর্থনৈতিক সংকটটি স্রেফ ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বা বিনিময়ের ভারসাম্যের সমস্যা। শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় শেষ হয়ে গেছে, ফলে দেশটির পক্ষে খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ, গুঁড়া দুধ কিংবা কাগজের মতো প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমদানি করা এবং বিভিন্ন ধরনের বিদেশি ঋণ পরিশোধ কঠিন হয়ে গেছে। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার এই অর্থনৈতিক ঘটনার পেছনে যেসব সিদ্ধান্ত, প্রক্রিয়া, মতাদর্শ, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভিন্ন ধরনের ভূমিকা রেখেছে পুরোপুরি রাজনৈতিক। শ্রীলংকার শাসনব্যবস্থায় ন্যূনতম জবাবদিহি ও গণতান্ত্রিক চর্চা থাকলে শ্রীলংকার মতো আমদানিনির্ভর একটি দেশ জিডিপি অনুপাতে ক্রমহ্রাসমান রপ্তানি আয়ের মধ্যেও একের পর এক বিদেশি ঋণনির্ভর অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প, বৈদেশিক মুদ্রায় উচ্চসুদে বাণিজ্যিক ঋণ গ্রহণ থেকে শুরু করে হুট করে ব্যাপক কর ছাড় কিংবা রাসায়নিক সার আমদানি নিষিদ্ধ করে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটানো সম্ভব হতো না। আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রীলংকা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও কার্যত পারিবারিক বা গোষ্ঠীতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র চলছে সেখানে। ২০১৯ সাল থেকে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পরিবারের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত শ্রীলংকার সরকারব্যবস্থায়। রাজাপক্ষের পরিবারের সদস্যারা মন্ত্রিসভার ৯টি পদে থেকে শ্রীলংকার বাজেটের এক-চতুর্থাংশ নিয়ন্ত্রণ করছেন।

ছবি: রাজাপক্ষের পরিবারের সদস্যারা মন্ত্রিসভার ৯টি পদে থেকে শ্রীলংকার বাজেটের এক-চতুর্থাংশ নিয়ন্ত্রণ করছেন, সূত্র: srilankacampaign.org

তামিল স্বাধীনতাকামীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করে ও উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে শ্রীলংকার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি জনগোষ্ঠীর মন জয় করা রাজাপক্ষের পরিবার শ্রীলংকার রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছে। আর এই জবাবদিহিহীন গোষ্ঠীতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদের একচেটিয়া লুণ্ঠন ও আধিপত্যের ফল ভোগ করতে হচ্ছে শ্রীলংকার জনগণকে।

এর আগে মাহিন্দা রাজাপক্ষ প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ও (২০০৫-২০১৫) রাজাপক্ষের পরিবারের সদস্যরা মন্ত্রিসভা, আইনসভা, বেসামরিক প্রশাসন, কূটনৈতিক পদ, রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি মালিকানাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করেছিলেন।৩০ তামিল স্বাধীনতাকামীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করে ও উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে শ্রীলংকার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি জনগোষ্ঠীর মন জয় করা রাজাপক্ষের পরিবার শ্রীলংকার রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছে। আর এই জবাবদিহিহীন গোষ্ঠীতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদের একচেটিয়া লুণ্ঠন ও আধিপত্যের ফল ভোগ করতে হচ্ছে শ্রীলংকার জনগণকে।

কল্লোল মোস্তফা: প্রকৌশলী, লেখক | ইমেইল: kallol_mustafa@yahoo.com

তথ্যসূত্র:

১) Interim Policy Regarding the Servicing of Sri Lanka’s External Public Debt, Ministry of Finance, Sri lanka, ১২ এপ্রিল, ২০২২

২) Infrastructure Financing in Srilanka: Lessons Learnt and Future Collaborations, European Institue for Asian Studies, Dec 2021; Sri Lanka’s race to meet ISB obligations, দ্য সানডে মর্নিং, ৫ ডিসেম্বর ২০২১

৩) Cost of Bilateral and Multilateral Loans, publicfinance.lk, ১৯ জানুয়ারি ২০২২; Sri Lanka’s Foreign Debt Crisis Could Get Critical in 2021, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১, দ্য ডিপ্লোমেট

৪) What’s happening with the Sri Lankan economy?, longform.watchdog.team, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২২

৫) The Sri Lankan Foreign Debt Problem, longform.watchdog.team, ৪ মার্চ ২০২২

৬) ISB repayment headaches totalling $14 billion stretch until 2030, দ্য সানডে টাইমস, ১১ জুলাই, ২০২১

৭) Debt sustainability and debt management in Sri Lanka – a reflection on the applicability of Chinese policy lessons, আঙ্কটাড, অক্টোবর, ২০২১

৮) Foreign Debt Summary, erd.gov.lk, সবশেষ প্রবেশ করা হয়েছে ৫ এপ্রিল ২০২২

৯) Sri Lanka averts major default; repays USD 500 million international sovereign bonds, দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া, ১৮ জানুয়ারি ২০২২

১০) Sri Lanka reverses course, seeks financial support from IMF, আলজাজিরা, ১৫ মার্চ ২০২২

১১) ISB repayment headaches totalling $14 billion stretch until 2030, দ্য সানডে টাইমস, ১১ জুলাই ২০১১

১২) Infrastructure is necessary but is it sufficient?, দ্য সানডে টাইমস, ১ মার্চ ২০১৫

১৩) Hambantota Port (Magampura Mahinda Rajapaksa Port, thepeoplesmap.net, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১১

১৪) The Story Behind The World’s Emptiest International Airport, ফোর্বস ম্যাগাজিন, ২৮ মে ২০১৬

১৫) Sri Lanka: How Much Does Corruption Cost The Citizen?, কুমার ডেভিড, কলোম্ব টেলিগ্রাফ, ১৭ এপ্রিল ২০১৪

১৬) Video: Katunayake highway the most expensive in the world: UNP, ডেইলি মিরর, ৭ নভেম্বর ২০১৩

১৭) Roads paved with gold, srilankacampaign.org, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪

১৮) Sri Lanka says Mahinda Rajapaksa officials hid more than $2bn in Dubai, দ্য গার্ডিয়ান, ২০ মার্চ ২০১৫

১৯) Sri Lanka Airlines Linked to ‘Corruption Running Into Billions of Dollars’, এনবিসি নিউজ, ৬ এপ্রিল ২০১৫

২০) Clamor for crackdown on hidden wealth jolts Sri Lanka elite following Pandora Papers revelations, November 1, 2021, ICIJ

২১) Hyatt heist!, ডেইলি মিরর, ১ জুলাই ২০১৫

২২) Paradise squandered – what really happened to Sri Lanka’s economy, Yolani Fernando, devpolicy.org, March 31, 2022

২৩) Why did Sri Lanka’s budget deficit increase in 2021?, দ্য সানডে মর্নিং, ২৭ অক্টোবর ২০২১

২৪) Explaining Sri Lanka’s economic crisis, আর রামকুমার, দ্য হিন্দু, ৩১ মার্চ ২০২২

২৫) বার্ষিক পরিসংখ্যান রিপোর্ট ২০১৮ ও ২০১৯, শ্রীলংকা টুরিজম ডেভেলপমেন্ট অথিরিটি

২৬) Sri Lanka Tourism Revenue, 1966 – 2021, CEIC DATA

২৭) The Reversal of Revolution, ডন মানু, দ্য সানডে টাইমস, ২৮ নভেম্বর ২০২১

 ২৮) In Sri Lanka, Organic Farming Went Catastrophically Wrong, Ted Nordhaus ও Saloni Shah, ফরেন পলিসি, ৫ মার্চ ২০২২

২৯) Massive loss from SL’s hasty shift to organic farming, দ্য সানডে টাইমস, ৩০ জানুয়ারি ২০২২

৩০) Dynastic Politics: Rajapaksa Family Control of the State Budget, srilankacampaign.org, ৫ মার্চ ২০২১

 

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •