সার্বভৌম বন্ড: ঝুঁকি ও সম্ভাব্য পরিণতি বিশ্লেষণ

পুন:প্রকাশ

সার্বভৌম বন্ড: ঝুঁকি ও সম্ভাব্য পরিণতি বিশ্লেষণ

মোশাহিদা সুলতানা

শ্রীলংকা যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট পার করছে তার পেছনে একটি বড় কারণ সার্বভৌম বন্ড ভিত্তিক ঋণ নির্ভরতা বৃদ্ধি এবং পরিশোধ ক্ষমতা হ্রাস। বাংলাদেশকেও এই পথে নেবার চেষ্টা আছে বহুদিন। ২০১২ সালে যখন তেলের দামবৃদ্ধি হেতু বৈদেশিক মুদা মজুতের ওপর চাপ বৃদ্ধি পায় এবং একইসময়ে যখন পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঋণ জটিলতা তৈরি হয় সেসময় এই তৎপরতা অনেক বেড়েছিল, সরকার একটা কমিটিও গঠন করেছিল। সেসময়েই এই লেখায় এই পথের ভয়াবহতা ব্যাখ্যা করে এর বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছিল। সেই তৎপরতা এখনও চলছে তবে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য এই বন্ড নির্ভর ঋণের বিপদ আরও স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে শ্রীলঙ্কার সংকট। এই পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্ব বিবেচনা করে ‘সার্বভৌম বন্ড’ বিষয়টির ব্যাখ্যা করে ২০১২ সালে প্রকাশিত সেই লেখাটি এখানে পুন:প্রকাশ করা হচ্ছে। 

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে একটি খবর প্রায়ই আসছে পত্রিকায় আর তা হলো আমাদের অর্থমন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক পুঁজি বাজারে সার্বভৌম বন্ড ছাড়ার পূর্ব প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই মধ্যে সরকার সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে যারা যাচাই করে দেখছেন সম্ভাব্য কী উপায়ে ও কী পরিমাণে এই সার্বভৌম বন্ড বাজারে ছাড়া সম্ভব। কয়েকটি উত্স থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, মোট ৫০০ মিলিয়ন ডলারের সার্বভৌম বন্ড ছাড়তে পারে বাংলাদেশ সরকার। এর পক্ষে এবং বিপক্ষে অনেকেই অনেক ধরণের যুক্তি দিচ্ছেন। এর পক্ষে যারা যুক্তি দেখাচ্ছেন তাদের মতে দাতা সংস্থার ঋণের শর্তের চাপ বহন করার চাইতে সার্বভৌম ঋণ নিয়ে দেখা যেতে পারে কী হয়। আর এর বিপক্ষে যারা বলছেন তারা মনে করছেন সার্বভৌম ঋণ নেয়া যেতেই পারে কিন্তু এই মুহূর্তে যখন সুদের হার বেশী তখন বন্ড ছাড়া আদৌ জরুরী কিনা। আজকে আমি লিখছি এই পক্ষে বিপক্ষের মতামতগুলিকে পর্যালোচনা করে, বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন দেশের সরকার কীভাবে বন্ড বিক্রির মাধ্যমে নিজের দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে এবং আমাদের দেশের জন্য এর সম্ভাব্য ঝুঁকি বা পরিণতি কী হতে পারে তার উপর আলোকপাত করতে।

প্রথমেই বাংলাদেশের জন্য এই নতুন ধরণের বন্ড সম্পর্কে একটু বলে নেই। সার্বভৌম বন্ড একটি বিশেষ ধরণের বন্ড যা সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক পুঁজি বাজারে বিক্রি করার অধিকার রাখে এবং এর মধ্যে দিয়ে সেই রাষ্ট্র অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট ঘাটতি মোকাবেলা করতে কাজে লাগায়। সরকারের আয়ের চাইতে ব্যয় বেশি হয়ে গেলে অনেক দেশ সার্বভৌম বন্ড চালু করে সাধারণত এর মাধ্যমে অতিরিক্ত ব্যয়ের অর্থ যোগায়। যদিও বাংলাদেশে সব বন্ডকেই সার্বভৌম বন্ড বলার প্রচলন আছে তবুও সরকারের ইস্যু করা অন্যান্য বন্ডের সাথে এই নতুন ধরনের সার্বভৌম বন্ডের পার্থক্য আছে। আর এই পার্থক্যটি হলো সরকারী বন্ড কেনা বেচা হয় টাকায় এবং দেশের অভ্যন্তরে আর সার্বভৌম বন্ড কেনা বেচা হয় বৈদেশিক মুদ্রায় আন্তর্জাতিক বাজারে এবং এর ক্রেতা হতে পারে যে কেউ – কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দেশ, এবং আন্তর্জাতিক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকগুলিও । পৃথিবীর অনেক দেশ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সার্বভৌম বন্ড আন্তর্জাতিক পুঁজি বাজারে ছেড়ে তার ব্যয়ের জন্য অর্থ যুগিয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আর্জেন্টিনা, গ্রীস, এবং সম্প্রতি দক্ষিন এশিয়ার মধ্যে শ্রীলংকা ও পাকিস্তান। বাংলাদেশ এর আগে কখনো সার্বভৌম বন্ড আন্তর্জাতিক পুঁজি বাজারে ছাড়েনি। সম্প্রতি কুইক রেন্টালের বাড়তি তেলের চাহিদা মেটাতে গিয়ে আমদানী খরচ বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স হ্রাস, এবং টাকার অবমূল্যায়নের কারণে একদিকে যেমন ব্যালান্স অফ পেমেন্ট ঘাটতি তৈরি হয়েছে অন্যদিকে দেশীয় ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ নেয়ার কারণে ব্যাংকের তারল্য হ্রাস পেয়েছে। যদিও জানুয়ারী মাসে রেমিটেন্সের প্রবাহ বেড়েছে এবং যদিও রেমিটেন্স ও গার্মেন্টস রপ্তানির আয়ের তুলনায় সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে বৈদেশিক ঋণের/বিনিয়োগের অবদান সামান্যই, তবু এক দিকে বিনিয়োগ হ্রাস এবং অন্যদিকে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাঙ্কের সৃষ্ট জটিলতার ফলে বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহের গতি ব্যাহত হওয়ার কারণ দেখিয়ে নীতি নির্ধারকমহল বিকল্প অর্থায়নের উৎস হিসেবে উচ্চ সুদে সার্বভৌম ঋণের কথা ভাবছে।

সরকারের ইস্যু করা অন্যান্য বন্ডের সাথে এই নতুন ধরনের সার্বভৌম বন্ডের পার্থক্য আছে। আর এই পার্থক্যটি হলো সরকারী বন্ড কেনা বেচা হয় টাকায় এবং দেশের অভ্যন্তরে আর সার্বভৌম বন্ড কেনা বেচা হয় বৈদেশিক মুদ্রায় আন্তর্জাতিক বাজারে এবং এর ক্রেতা হতে পারে যে কেউ – কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দেশ, এবং আন্তর্জাতিক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকগুলিও ।

বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে শ্রীলংকা সার্বভৌম বন্ড আন্তর্জাতিক বাজারে ছেড়ে বিপুল সাড়া পেয়েছে। ক্রেডিট রেটিং এ শ্রীলংকা বাংলাদেশের কাছাকাছি, কাজেই বাংলাদেশ এই সময় বন্ড ছাড়লে বাংলাদেশের বন্ডেরও চাহিদা তৈরি হতে পারে। এবং তা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ এই মুহূর্তের বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি মেটাতে পারে। কিন্তু আমরা যদি পিছন ফিরে দেখি যে শ্রীলংকা কোন পরিস্থিতিতে পরে সার্বভৌম বন্ড ইস্যু করেছে তাহলে শ্রীলংকাকে ভালো উদাহরণ হিসাবে দাঁড় করানোর পিছনে ভ্রান্তিটা কিছুটা হলেও পরিস্কার হবে। ২০০৪ সনে সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে শ্রীলংকা আশা করেছিল দুর্যোগ পরবর্তী পুনর্নির্মাণের জন্য বিদেশী সাহায্য পাবে। কিন্তু এক বছরের মধ্যে শ্রীলংকা বুঝতে পারে যে যেই হারে বিদেশী সাহায্য প্রথম দিকে এসেছিল তা ছিল সাময়িক এবং অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের জন্য প্রয়োজন ছিল বিপুল পরিমান অর্থের। তখন শ্রীলংকা বন্ডের শরণাপন্ন হয়, ২০০৫ এ প্রথম দেশের বাজারে ডেভেলপমেন্ট বন্ড হিসাবে ছেড়ে, শেষে ২০০৭ সালে প্রথম সার্বভৌম বন্ড আন্তর্জাতিক পুঁজি বাজারে ছাড়ে। ২০০৭ সনে শ্রীলংকা ৫০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের বন্ড ছেড়ে প্রায় তিনগুণ অর্থাৎ দেড় বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বন্ড ক্রেতা পায়। তারপর যথাক্রমে ২০০৯ সালে, ২০১০ সালে, এবং ২০১১ সালে শ্রীলংকা যথাক্রমে ৫০০ মিলিয়ন, ১ বিলিয়ন ও ১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের বন্ড বাজারে ছাড়ে। যদিও বলা হয় শ্রীলংকা উন্নতি করছে কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় ২০০৫ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত শ্রীলংকার বাহ্যিক ঋণ বেড়েছে প্রায় ৬৫% (১০.৮৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৭.৯৭ বিলিয়ন ডলার )। অথচ ২০০০ সাল থেকে ২০০৪ পর্যন্ত ঋণের বৃদ্ধি ছিল মাত্র ২৪%। এবং লক্ষনীয় এই যে প্রথম এক দফা বন্ড ছেড়েই শ্রীলংকা থেমে যায়নি। তাকে বার বার পুঁজিবাজারে বন্ড ছেড়ে ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে যেমন ২০০৯ সালে বন্ড ছেড়ে পাওয়া ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ৩০০ মিলিয়নই ব্যয় করতে হয়েছে ২০০৭ সালের বন্ডের ঋণ শোধ করতে। অনেকেই বলে থাকবেন যে এটাই তো স্বাভাবিক যে ঋণ নিলে শোধ করতে হবে, এবং সেজন্য ঋণের বোঝা বাড়তে থাকবে। কিন্তু ঋণের বোঝা বাড়লে কি পরিণতি হয় তার প্রমাণ দেখতে অতীতের উদাহরণ ইন্দোনেশিয়া, আর্জেন্টিনা বা রাশিয়া পর্যন্ত না যেয়ে যদি সাম্প্রতিক গ্রীসের অবস্থার দিকেই তাকাই তাহলে দেখা যাবে গ্রীস কিভাবে ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে এখন দেশের জনগণকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে শ্রীলংকা সার্বভৌম বন্ড আন্তর্জাতিক বাজারে ছেড়ে বিপুল সাড়া পেয়েছে। ক্রেডিট রেটিং এ শ্রীলংকা বাংলাদেশের কাছাকাছি, কাজেই বাংলাদেশ এই সময় বন্ড ছাড়লে বাংলাদেশের বন্ডেরও চাহিদা তৈরি হতে পারে।

এবার আসা যাক ক্রেডিট রেটিং এর অর্থনৈতিক রাজনীতি প্রসঙ্গে। যেকোনো দেশ সার্বভৌম বন্ড বাজারে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রথমে যাচাই করে আন্তর্জাতিক পুঁজি বাজারে এর রেটিং কেমন। বর্তমান অর্থনৈতিক নীতি এবং ঋণ পরিশোধের পূর্ববর্তী রেকর্ড (ঋণ ও জিডিপির অনুপাত ) থেকে যদি দেখা যায় যে সেই দেশের ঋণ পরিশোধের রেকর্ড ভালো তাহলে সেই দেশ ভালো রেটিং পায়। আর তার পূর্বের রেকর্ড খারাপ থাকলে তার রেটিং আসে কম। এভাবে পৃথিবীর তিনটি বড় বড় ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি প্রতি বছর বিভিন্ন দেশকে ক্রেডিট রেটিং দিয়ে থাকে। এই ধরনের সেবা দিয়ে ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলো যেমন দেশগুলো থেকে বিপুল আয় করে, তেমনি দেশগুলো তাদের নিজস্ব প্রয়োজন অনুসারে ক্রেডিট রেটিং এজেন্সীগুলোর শরণাপন্ন হয়। যদি কোনো দেশের বাণিজ্যিক ঘাটতি বা বাজেট ঘাটতি হয় এবং আয়ের অনিশ্চয়তা দেখা দেয় তখন দেশগুলো বন্ড ছাড়তে উদ্যোগী হয়। ক্রেডিট রেটিং বেশী দেখালে দেশগুলোর জন্য বন্ড বিক্রি সহজ হয় কারণ তখন বেশী বিনিয়োগকারী পাওয়া যায়। ধরলাম এই সব কিছুই ঠিক আছে। কিন্তু ক্রেডিট রেটিং ঠিক ভাবে দেওয়া হচ্ছে কি হচ্ছে না তা এখন আর নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ গ্রীসের ক্রেডিট রেটিং ২০০০ এর প্রথম দিক থেকে A , A -, এবং A + এর মধ্যে ছিল। এর কারণ গ্রীস সহজ শর্তে ঋণ নেওয়ার জন্য ভুল তথ্য দিয়েছিল, এবং এর উপর ভিত্তি করে যখন ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলো পুঁজি বাজারে রেটিং দেয় তখন কেউ জানত না যে গ্রীসের বাজেট ঘাটতি, বাহ্যিক ঋণ দিনকে দিন বেড়েই চলেছিল।

কিন্তু ক্রেডিট রেটিং ঠিক ভাবে দেওয়া হচ্ছে কি হচ্ছে না তা এখন আর নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ গ্রীসের ক্রেডিট রেটিং ২০০০ এর প্রথম দিক থেকে A , A -, এবং A + এর মধ্যে ছিল। এর কারণ গ্রীস সহজ শর্তে ঋণ নেওয়ার জন্য ভুল তথ্য দিয়েছিল

২০০৯ এর ডিসেম্বরে যখন গ্রীসের রেটিং A – থেকে নেমে BBB + এ নেমে যায় তখন বোঝা গেল বাইরে থেকে দেখা রেটিং এর সাথে গ্রীসের আসল অর্থনীতির অবস্থার তফাত কোথায়। গত কয়েক বছর ধরে গ্রীস অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে কারো কিছু না হলেও গ্রীসের সাধারণ মানুষ নেমে এসেছে রাস্তায়। কারণ এত দিন তারা বসবাস করছিল ঋণ করে দাঁড়ানো অর্থনীতির উপর। যেই মুহূর্তে তাদের পায়ের নীচে থেকে মাটি সরে গেলো তখন তারা উপলব্ধি করা শুরু করলো এতদিন কী ফাঁপার উপর দাড়িয়ে ছিল গ্রীস।

এবার দেখা যাক বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং নিয়ে কী হচ্ছে। Standard and Poor’s বাংলাদেশকে দিয়েছে BB- গ্রেডিং এবং Moody’s দিয়েছে Ba3 গ্রেডিং। উভয় রেটিং অনুযায়ী বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ‘সন্তোষজনক’ ও ‘স্থিতিশীল’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের সাথে তুলনা করলে বাংলাদেশের রেটিং এখন শ্রীলংকা ও পাকিস্তানেরও উপরে। এবং এই তুলনা টেনে বলা হচ্ছে যদি শ্রীলংকা ও পাকিস্তান পারে তাহলে বাংলাদেশও বন্ড বাজারে ছেড়ে অবকাঠামো ও উন্নয়ন প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে পারবে না কেন। এখন দেখা যাক অন্য একটি রিপোর্ট কী বলে। সম্প্রতি ইউকে ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট বিভাগের ‘বাংলাদেশ কোয়ার্টারলি ম্যাক্রো-ইকোনমিক আপডেট (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১১)’ শীর্ষক প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে যেসব ব্যাংক ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে বেশি সংশ্লিষ্ট ছিল, তাদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি এবং ব্যাংক রক্ষায় সরকারের সহায়তা (বেইলআউট) লাগতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বলা হয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা, সরকারের ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া, দুই অঙ্কের ঘরে সুদের হার এবং মূল্যস্ফীতি, শেয়ারবাজারের বিপর্যয়, চাহিদা মেটাতে টাকার অভাব অর্থনীতির ঝুঁকিগুলোকে আরও বাড়িয়ে অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে গেছে | এদিকে আমাদের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা এমন নয় যে, তাদের জন্য বেইল আউট কর্মসূচির দরকার হতে পারে। শেয়ারবাজারে মোট কত টাকা বিনিয়োগ আছে ব্যাংকগুলোর? এ ধরনের প্রতিবেদন আমাদের অর্থনীতি এবং ব্যাংকিং সম্পর্কে ভুল বার্তা দিচ্ছে।”

এই দুই ধরণের বিশ্লেষণ স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করে, জনগণের পক্ষে বোঝা মুশকিল কোন পক্ষের কথা ঠিক। গ্রীসের সাম্প্রতিক ঘটনা যেমন জনমনে সন্দেহ তৈরি করেছে, তেমনি সন্দেহ তৈরি করেছে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের অবস্থান। এই সব বিশ্লেষণের পর এটাই প্রতীয়মান হয় যে এই দ্বিধাগ্রস্ততার মধ্যে রাখাটাই এক ধরণের আন্তর্জাতিক রাজনীতির কুটনৈতিক কৌশল। এথেকে আরো প্রতীয়মান হয় যে উন্নত বিশ্বের বাজার সব দিকে বাধা প্রাপ্ত হয়ে অর্থাৎ অর্থনৈতিক বিপর্যয় একে একে রাশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা, ইস্ট এশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপে আঘাত করে এখন দক্ষিন এশিয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে | ১৯৯৮এ রাশিয়া, ১৯৯৯ থেকে ২০০২ পর্যন্ত আর্জেন্টিনা, আশির দশকে ইন্দোনেশিয়া, এবং সাম্প্রতিক সময়ে গ্রীস যখন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় তখন হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করা মানুষকেই তার খেসারত দিতে হয়েছে | বেসরকারীকরণ, মূল্যস্ফীতি, বর্ধিত ট্যাক্স, সামাজিক নিরাপত্তা বাজেট খর্ব করা, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও সেবা খাত বাণিজ্যিকীকরণ এই সব কিছু আঘাত করেছে সবচাইতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে।

এই দিক থেকে যারা বলছেন যে বিশ্বব্যাংকের দেওয়া শর্তের থেকে রেহাই পেয়ে বাংলাদেশ সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখতে পারে তাদের কাছে গ্রীসকে একটি উদাহরণ হিসাবে দেখানো যেতে পারে। বন্ড বিক্রি করার সময় শর্ত লেখা না থাকলেও নিয়মিত বৈদেশিক মুদ্রায় উচ্চসুদে নেয়া ঋণের সুদাসল পরিশোধের চাপ এবং ক্রেডিট রেটিং এর ওঠানামা সেই একই শর্ত পূরণের ক্ষেত্রই তৈরি করবে। যেমন: ঋণের টাকায় বাংলাদেশ যদি এমন কোন প্রজেক্ট হাতে নেয় যার থেকে আয় সরকারী কোষাগারে জমা হতে সময় লাগবে পাঁচ বছর, তখন বাংলাদেশের জন্য এই টাকা প্রথম বছর থেকে নিয়মিত পরিশোধ কঠিন হয়ে পড়বে এবং তখন অন্য খাতে ব্যয় কমিয়ে সেই টাকা পরিশোধ করতে হবে | এই সমস্যাটিকে বলা হয় ম্যাচিউরিটি মিসম্যাচ অর্থাৎ ম্যাচিউরিটির সময়ের ভিন্নতার কারণে উদ্ভূত ঝুঁকি। আবার সার্বভৌম বন্ড বিক্রির সাথে সাথে এর চাহিদা ধরে রাখার জন্য সরকারকে জনকল্যাণমূলক খাতে ব্যয় কমিয়ে সেই অর্থ লাভজনক খাতে ব্যয় করতে হবে।

ঋণের টাকায় বাংলাদেশ যদি এমন কোন প্রজেক্ট হাতে নেয় যার থেকে আয় সরকারী কোষাগারে জমা হতে সময় লাগবে পাঁচ বছর, তখন বাংলাদেশের জন্য এই টাকা প্রথম বছর থেকে নিয়মিত পরিশোধ কঠিন হয়ে পড়বে এবং তখন অন্য খাতে ব্যয় কমিয়ে সেই টাকা পরিশোধ করতে হবে | এই সমস্যাটিকে বলা হয় ম্যাচিউরিটি মিসম্যাচ।

একারণেই দেখা গেছে আর্জেন্টিনা এবং গ্রীস সরকারকে খরচ কমাতে যেয়ে বেসরকারীকরণ ও জনকল্যাণমূলক খাতে ব্যয় কমাতে বাধ্য করা হয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে হয়ত পড়তে চায়নি গ্রীস বা আর্জেন্টিনা কিন্তু বাস্তবতা এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে ঋণের বোঝা সামলাতে না পেরে এর দায় জনগনের উপরই পড়েছে। কাজেই পরিণতির দিক থেকে বিশ্বব্যাংকের  শর্ত আর বন্ড কিনলে বাজার ধরে রাখার শর্তের মধ্যে আসলে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। খোলা চোখে মনে হতে পারে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প সার্বভৌম বন্ড। কিন্তু বাস্তবে উভয়ের শর্ত একই।

খুব আশাবাদী হয়ে যদি ধরেও নেই আমাদের পরিস্থিতি রাশিয়া, আর্জেন্টিনা, গ্রীসের মত হবে না তারপরও স্বীকার করতেই হয় যে সার্বভৌম বন্ডে রয়েছে নানা ধরনের ঝুঁকি। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে, টাকার অবমূল্যায়ন হলে, পরিশোধের নির্দিষ্ট সময়ে অনাকাঙ্খিত ভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফুরিয়ে গেলে, বড় ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলে, এবং কোনো আন্তর্জাতিক কুটনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের উপর কোনো অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ তৈরি হলে বন্ডের চাহিদা কমে যেতে পারে। সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যদি ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে তাহলে একটা ঋণ পরিশোধ করতে আরেকটা ঋণ নিতে হবে, এবং তখন আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রেডিট রেটিং কমে গেলে বাংলাদেশকে আরো অধিক সুদে বন্ড বিক্রি করতে হবে।

সরকার সার্বভৌম বন্ড বাজারে ছাড়লে এখন থেকে কয়েক বছর পর গ্রীসের সাধারণ মানুষদের মত আমাদের রাস্তায় নামতে হবে কিনা জানি না, তবে এই সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ সরকার ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে তাকে সবার আগে বাজেট খর্ব করতে হবে, এবং তা করতে হবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপর সেই বোঝা চাপিয়ে। জনগণ এই ঋণের বোঝা চায় কিনা তা সরকারকে জানতে হবে। জনগনকে অজ্ঞতার অন্ধকারে রেখে এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলে সরকার বড় ধরণের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে | গ্রীসের অবস্থায় গিয়ে নয়, ভাবতে হবে এখনই – জনগনকে এবং নীতি নির্ধারক মহলকে|

(প্রথম প্রকাশ: বিডিনিউজ২৪.কম; ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২)

মোশাহিদা সুলতানা: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: moshahida@du.ac.bd

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •