সুন্দরবন আন্দোলনের গান : প্রবণতা ও দিশা

সুন্দরবন আন্দোলনের গান : প্রবণতা ও দিশা

বীথি ঘোষ

ছবি: ব্রাত্য আমিন

সুন্দরবন রক্ষার গুরুত্ব মানুষের সামনে তুলে ধরা ও সুন্দরবন ধ্বংস হলে কী কী ক্ষতি হতে পারে তার চিত্র তুলে ধরার কঠিন কাজে বাংলাদেশসহ বিশ্বের গবেষক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, পরিবেশবাদীরা যেমন নানা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে শামিল হয়েছেন ঠিক তেমনি শিল্পীরাও এই আন্দোলনকে ঘিরে তাদের চিন্তা, সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন নানাভাবে। এখন পর্যন্ত সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনকে ঘিরে এই সময়কালে রচিত প্রায় ৪১ (একচল্লিশ)টি গানের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই গানগুলোর মধ্য দিয়ে একদিকে সুন্দরবন ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে অন্যদিকে তা মানুষের মনে প্রতিবাদের ভাষা জুগিয়েছে। এই লেখায় এসব গানের অন্তর্নিহিত বার্তা ও শক্তি অনুসন্ধান করা হয়েছে।

গান মানুষের অনুভূতি প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। মানুষের আবেগের প্রকাশ ঘটে গানের সুর-লয়-ছন্দ-কথায়। আমরা জানি, আদিকাল থেকেই গান মানুষের যাপনের, সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। গান যেমন কর্মে প্রেরণা জোগায়, আনন্দ-বেদনা প্রকাশের সহায়ক হয়, তেমনি শিল্পী গানে গানে সম্মিলিত শক্তির উত্থানের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের ডাকও দিয়ে যান। এমন সর্বজনের গানের শক্তির উদাহরণ ‘গদর’। এক সাক্ষাৎকারে গদর বলছেন, ‘‘…গান এক বিশেষ হাতিয়ার, গান আমার ‘বুলেট’, যাকে রোখা অসম্ভব!’’ গানের শক্তি অমিত। নেত্রকোণা কৃষক সম্মেলনে নিবারণ পন্ডিতের একটি জারি গান গাওয়ার অপরাধে করিমগঞ্জ থানার কিরাটন গ্রামের কয়েকজন গায়ককে গ্রেফতার করতে না পেরে পুরো গ্রামকেই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ গান শুধু বিপ্লবে বাঁচে না বিপ্লবকেও বাঁচায়। সঞ্জীবনী সুধার মতো তা কাল থেকে কালান্তরে বয়ে নিয়ে যায় সর্বজনের লড়াইয়ের কথা, পরবর্তীতে তা অনুপ্রেরণা যোগায় সমকালের কোনো লড়াই জিতে নিতে। হুল বিদ্রোহ নিয়ে লেখা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান ‘উর তাং তাং ধনুকে জোর দেরে টান’, তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিকায় সলিল চৌধুরীর গান ‘হেই সামালো ধান হো/কাস্তেটা দাও শান হো’, ভাষা আন্দোলন চলাকালীন আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত এবং প্রথমে আবদুল লতিফ ও পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদের সুরারোপিত গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রæয়ারি’ গানগুলোর মতো অসংখ্য কালজয়ী গান সমকালকে ডিঙিয়ে চিরকালীন হয়ে উঠেছে। ভারতের ওড়িশার নিয়মগিরি পাহাড়ে বেদান্ত লিমিটেডের বক্সাইট খননের উদ্যোগের বিরুদ্ধে স্থানীয় আদিবাসী ও পরিবেশ আন্দোলনকর্মী পথে নামেন সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রচিত ‘গাঁও ছোড়ব নেহি/জঙ্গল ছোড়ব নেহি’ গানের প্রভাব লক্ষ্য করি বাংলাদেশের দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত কয়লাখনির প্রতিবাদে রচিত সমগীত এর ‘ফুলবাড়ী’ গানে। এইভাবে গান দেশকালের সীমানা পেরিয়ে হয়ে ওঠে চিরন্তন, আন্তর্জাতিক; খুঁজে নেয় লড়াইয়ের স্বজন।

এক সাক্ষাৎকারে গদর বলছেন, ‘‘…গান এক বিশেষ হাতিয়ার, গান আমার ‘বুলেট’, যাকে রোখা অসম্ভব!’’ গানের শক্তি অমিত। নেত্রকোণা কৃষক সম্মেলনে নিবারণ পন্ডিতের একটি জারি গান গাওয়ার অপরাধে করিমগঞ্জ থানার কিরাটন গ্রামের কয়েকজন গায়ককে গ্রেফতার করতে না পেরে পুরো গ্রামকেই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ গান শুধু বিপ্লবে বাঁচে না বিপ্লবকেও বাঁচায়।

সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন বাংলার লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসের একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ইতোমধ্যে এই প্রকল্প বাতিলের দাবিতে সমাবেশ, মহাসমাবেশ, মিছিল, লংমার্চ, রোডমার্চ, জনযাত্রা, হরতাল, সাইকেল মিছিল, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পকে লালকার্ড প্রদর্শনসহ নানান কর্মসূচি পালিত হয়েছে। ‘সর্বপ্রাণ সাংস্কৃতিক শক্তি’ নামে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ থেকে গানের মিছিল হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের নানা মাধ্যমে কাজ করা শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেছেন। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত রচিত হয়েছে অনেক গান, ছড়া, নাটক, কবিতা। তৈরি হয়েছে প্রতিবাদী পোস্টার, আঁকা হয়েছে প্রতিবাদী চিত্রকর্ম, গ্রাফিতি, পথলিখন। নির্মিত হয়েছে ডকুমেন্টরি, এনিমেশন ফিল্ম। পথে নেমেছে পারফর্মিং আর্ট। বাঁধা হয়েছে প্রচুর স্লোগান। Global Day of Protest পালিত হয়েছে যেখানে বিশ্বের নানা ভাষা-ভাষী মানুষ তাদের নিজেদের মাতৃভাষায় সুন্দরবন রক্ষার স্লোগান তৈরি করেছেন।

২০১২ সাল থেকে ২০২১ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনকে ঘিরে রচিত প্রায় ৪১(একচল্লিশ)টি গান ও একটি পালার সন্ধান পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে, লংমার্চের পথে, মিছিলে এইগানগুলোর অধিকাংশই বিশাল ভূমিকা রেখেছে।

সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে গানের একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ২০১২ সাল থেকে ২০২১ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনকে ঘিরে রচিত প্রায় ৪১(একচল্লিশ)টি গান ও একটি পালার সন্ধান পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে, লংমার্চের পথে, মিছিলে এইগানগুলোর অধিকাংশই বিশাল ভূমিকা রেখেছে। এরমধ্যে ৩৮টি গান ও একটি পালাগান সর্বজনকথার যথাক্রমে ৫মবর্ষ ১ম সংখ্যা, ২য় সংখ্যা, ৩য় সংখ্যা ও ৪র্থ সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সবমিলিয়ে ৪০টি গানের একটি সংকলন ‘সুন্দরবন আন্দোলনের গান’ শিরোনামে সর্বজনকথা পুস্তিকা সিরিজ-১ আকারে প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। আর একটি গান ‘গানের ঝরাপাতা’ শিরোনামে হিমেল বরকত-এর গানের বইয়ে ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে।

গানগুলোর বিস্তারিত পরিচয় এই লেখার ছোট কলেবরে দেয়া সম্ভব নয় বিধায় শুধু গানগুলোর উল্লেখ করছি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমন্বিত প্রয়াসে নির্মিত হয় গান ‘কয়লার নৌকা’, Don’t Shootব্যান্ডের গান ‘অরণ্য’, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শৌভিক ঘোষের গান ‘সুন্দরবনের গান’, কাজী শহিদুল ইসলাম-এর কথা এবং লিপ্পু অসীমের সুরে গান ‘হাতে হাত ধরে এসো বাঁচাই সুন্দরবন’, বেতালবাল-এর গান ‘কয়লা’, গানের দল পথের দল-এর গান ‘সুন্দরী’, জলের গান-এর গান ‘A song by Wild Team to save Sundarban’, গানের দল স্বরব্যাঞ্জো-এর ‘লাল আগস্টের গান’ ও ‘ম্যানগ্রোভের কান্না’, আবদুল্লাহ মাহাফুজ অভির কথা এবং অ্যাসেজ এর ‘তামাক পাতা’র সুরে গান ‘চেতনা কয়লায় পোড়া’ গানের দল ভাটিয়াল শহুরে-এর গান ‘আহারে’ ও ‘সুন্দরীরো বনেতে’, নগরনাট-এর গান ‘পরাণের সুন্দরবন’ ও ‘দক্ষিণা সুন্দরী’, গানের দল হযবরল-এর গান ‘কয়লার তাপে পোড়াতে দেবোনা প্রাণ-প্রকৃতি সুন্দরবন’, গানের দল মাভৈঃ এর গান ‘বাদাবনের জারী’, গানের দল গঞ্জে ফেরেশতার গান ‘সুন্দরবন’, স্কিব খান এর গান- ‘বাঘের বাচ্চা’, Soundcloud এ প্রকাশিত একটি গান (বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি) ‘বার্তা শুনেছ নাকি শুনতে কি পাও?’, বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এর গান ‘গোলপাতার আড়ালে কাঁপছে দেখো বন’, ‘আমারই দেশ আমি চেতনায় রাখি’, ‘কান্দে সুন্দরবনের গাছপালা লতা-পাতা-ফুল’, ও ‘সুন্দরবনের কাছে আছে জনপদ রামপাল’, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর গান ‘দেশের স্বার্থে জাতির স্বার্থে রক্ষা করবো সুন্দরবন’, আহমেদ সানির গান ‘আমার মা সুন্দরবন শেষ ম্যানগ্রোভ’, আনা নাসরিন এর গান ‘আবার দুর্গ গড় হাতে হাত এক কর’, গানের দল সমগীত এর গান ‘বাঁচাও সুন্দরবন’ ও ‘Go Back Get Out India’, কাজী চপলের গান ‘আমার বিলাপ’, স্বাধীনানন্দ এর গান ‘টারজানের গান’, শতাব্দী ভব’র গান ‘বাঘের ল্যাজ দিয়া কান চুলকাইও না’, গানের দল রেরে -এর গান ‘থাকতে জীবন হারবো না’, জাহিদ জগৎ এর কথা ও সুরে রূপন মজুমদরের গাওয়া গান ‘সুন্দরবনের আগুন’, সাজিদ রাহাত এর গান ‘হাসু আপা তোমার তরে করি নিবেদন’, আনু মুহাম্মদ এর কথা ও আনুশেহ আনাদিল এর সুরে গান ‘দেহ মনে আঘাত তবু উঠে দাঁড়াই সুরে’, শহুরে গায়েন এর গান ‘প্রকাশ্য স্লোগান’, সিকদার বসুর গান ‘ধ্বংস করবে সুন্দরবন’, প্যারোডি (বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি) ‘এই সুন্দরবন সুন্দর বাঘ লোনা নদীর পানি’, সনতোষ বড়ুয়ার গান ‘সুন্দরবনের জন্য গান’, ইসরাত শিউলির গান ‘সুন্দরবন ধ্বংস হতে দিব না’, হিমেল বরকতের গান ‘সুন্দরবন হায়’ এবং নাটকের দল বটতলার পালাগান ‘মধুশিকারী’। গানগুলোতে সুন্দরবন নিয়ে নানান ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন মানুষের মনে যে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল বলা যায় অনেকক্ষেত্রে তার রেশ ধরেই বিভিন্ন সময় গানগুলো রচিত হয়েছে।  

সুন্দরবনের পরিচয়

সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। এটি একটি বিশাল গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ। কারও মতে এর প্রাচীন নাম ছিল সমতট। কারো মতে সুন্দরবনকে বলা হতো ভাটি অঞ্চল কারণ দক্ষিণবঙ্গের সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে বহু লবণ প্রস্তুত করার ভাটি ছিল। জোয়ার-ভাটার পানি এই বনভূমির ভেতর দিয়ে বয়ে যায়, একে বাদাবনও বলা হয়। আবার কারও কারও মতে, ‘সুন্দরবন’ নামটি সম্ভবত সুন্দরী বৃক্ষের আধিক্যের কারণে (সুন্দরী-বন) অথবা সাগরের বন (সমুদ্র-বন) কিংবা এ বনভূমির আদিবাসী চন্দ্রবেদে থেকে উদ্ভূত। সাধারণভাবে গৃহীত ব্যাখ্যাটি হলো এখানকার প্রধান উদ্ভিদ সুন্দরী বৃক্ষের (Heritiera fomes) নাম থেকেই এ বনভূমির নামকরণ। বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে সুন্দরবনের বিস্তৃতি। এই বনের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা অসংখ্য নদী সুন্দরবনকে পলি-জলে উর্বর করে তুলেছে। এখানে সমুদ্রের নোনাপানি দক্ষিণ থেকে এবং উত্তর থেকে মিঠাপানির প্রবাহ এসে পড়ে। সুন্দরবন অর্ধজলমগ্ন থাকে তাই এই জলাভূমি, পলি মেশানো নোনা ও মিঠাপানি, গাছপালার পচে ওঠা পাতা কোটি কোটি অণুজীবের জন্ম দেয়। যার ফলে এইসব নদীতে বসবাস করে অসংখ্য জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী। এই জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণ এই বনের খাদ্যচক্রকে পূর্ণতা দান করেছে। জোয়ার-ভাটার কারণে একইসাথে জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার ফলে এই বনের মাটি বিশেষ ধরণের। ফলে এই বনভূমির উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্যও ভিন্নতর। সুন্দরবনের গাছপালার অধিকাংশই ম্যানগ্রোভ ধরণের। অর্থাৎ অধিকাংশ গাছ তার উর্ধ্বমুখী শ্বাসমূল (Pneumatophore) দিয়ে বাতাস থেকে সরাসরি অক্সিজেন গ্রহণ করে। সুন্দরবনের উদ্ভিদের মধ্যে বিশিষ্ট হলো সুন্দরী, গেওয়া, গরান, গোলপাতা, কেওড়া। এই বনভূমির বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ। জলে রয়েছে ইরাবতী ডলফিন, কুমির, শামুক, কাঁকড়া, নানা প্রজাতির মাছ যেমন- পারশে, কাইক্কা, কালা হাঙর, ইলশা কামট, ঠুটি কামট, কানুয়া কামট, ভোলা, চেউয়া প্রভৃতি। এছাড়াও রয়েছে নানা প্রজাতির কাঁকড়া, শামুক ও জলজ উদ্ভিদ। সুন্দরবন কেবল একটি বনভূমি নয়, সুন্দরবনের সাথে জড়িয়ে আছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা সংস্কৃতি। এখানকার যারা অধিবাসী তারা কোনো না কোনোভাবে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। এদের কেউ বাওয়ালি, কেউ মধু সংগ্রহ করে, কেউ মোম সংগ্রহ করে, কেউ গোলপাতা সংগ্রহ করে, কেউ মাছ ধরে এভাবে নানা পেশার সাথে জড়িত এ অঞ্চলের অরণ্যজন্মা মানুষেরা।

সুন্দরবনের উদ্ভিদের মধ্যে বিশিষ্ট হলো সুন্দরী, গেওয়া, গরান, গোলপাতা, কেওড়া। এই বনভূমির বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ। জলে রয়েছে ইরাবতী ডলফিন, কুমির, শামুক, কাঁকড়া, নানা প্রজাতির মাছ যেমন- পারশে, কাইক্কা, কালা হাঙর, ইলশা কামট, ঠুটি কামট, কানুয়া কামট, ভোলা, চেউয়া প্রভৃতি। এছাড়াও রয়েছে নানা প্রজাতির কাঁকড়া, শামুক ও জলজ উদ্ভিদ। সুন্দরবন কেবল একটি বনভূমি নয়, সুন্দরবনের সাথে জড়িয়ে আছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা সংস্কৃতি।

সুন্দরবনের অবস্থান বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে, সমুদ্র উপকূলে। যার ফলে নিজের শরীর ক্ষতবিক্ষত করেও সুন্দরবন সমুদ্র থেকে আসা সমস্ত ঝড়-ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসকে প্রতিহত করে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ‘জাতীয় তথ্য বাতায়ন’-এ বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা ইউনিয়নের পরিচয় দিতে গিয়ে সেখানে সুন্দরবন যুগযুগ ধরে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে এই স্থলভূমি ও এর প্রাণকে রক্ষা করে চলেছে তার তথ্য প্রদান করা হয়েছে। সেখান থেকে আমরা জানতে পারি, ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে এক ভয়াবহ ঝড়-প্লাবন হয়। এরপরে যথাক্রমে ১৬৮৮, ১৭০৭, ১৭৩৭, ১৮৬৪, ১৮৬৭, ১৮৬৯, ১৮৭৬, ১৮৯৫, ১৯০৯, ১৯৬১, ১৯৬৫, ১৯৭০, ১৯৮৮ এবং ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে ভয়াবহ ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হয় এবং সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। ক্ষয়-ক্ষতির বিবেচনায় বলা যায় সুন্দরবন এই সমস্ত ঝড়কে নিজের বুক দিয়ে মোকাবেলা করেছে। আবার সুন্দরবনের কারণে ঘূর্ণিঝড় সিডরের গতি কমে যায় এবং গতিপথেরও পরিবর্তন হয়। সিডরের গতিপথ ছিল সুন্দরবনের দিকে। সিডর সুন্দরবনে আঘাত হানলেও প্রচুর পরিমাণ গাছ থাকার কারণে শক্তি হারিয়ে ফেলে। ফলে সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকায় কম ক্ষয়ক্ষতি হয়। সর্বশেষ ২০২০ এর মে মাসে তীব্র বাতাস, ভারী বৃষ্টিপাত ও উঁচু জলোচ্ছ্বাস নিয়ে উপকূলজুড়ে তান্ডব চালিয়েছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। সুন্দরবন দিয়ে অতিক্রম করার কারণে আম্পানের তান্ডব কিছুটা কম হয়েছে।১০

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র

২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি (এনটিপিসি) যৌথ অর্থায়নে সুন্দরবনের বাফারজোন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে রামপাল উপজেলায় ১,৮৩৪ একর জমিতে ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি হয়। চুক্তিতে বলা হয় কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ৬৬০ মেগাওয়াটের দুইটি বিদ্যুৎ উৎপাদন ইউনিট থাকবে। সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা ইন্দোনেশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সমুদ্র পথে আমদানি করতে হবে। আমাদানিকৃত কয়লা সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজের মাধ্যমে মংলা বন্দরে এনে তারপর সেখান থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সুন্দরবনের ভেতরে পশুর নদীর গভীরতা সর্বত্র বড় জাহাজের জন্য উপযুক্ত না হওয়ার কারণে প্রথমে বড় জাহাজে করে কয়লা সুন্দর বনের আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত আনা হবে, তারপর আকরাম পয়েন্ট থেকে একাধিক ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে কয়লা মংলাবন্দরে নিয়ে যেতে হবে। এর জন্য সুন্দরবনের ভেতরে হিরণ পয়েন্ট থেকে আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত ৩০ কিমি নদী পথে বড় জাহাজে এবং আকরাম পয়েন্ট থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত প্রায় ৬৭ কিমি পথ ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে হাজার হাজার টন কয়লা পরিবহন করতে হবে!১১ 

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতির সম্ভাবনা

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এবং ফরেস্ট আইন ১৯২৭ অনুসারে সুন্দরবনকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ এখানে কোনো বাণিজ্যিক কাজ, বন, বন্যপ্রাণী ও সম্পদের ক্ষতিসাধণ গ্রহণযোগ্য হবে না।১২ ইসিএ এবং বিইসিএ [Ecologically Critical Area (ECA), (Bangladesh Environment Conservation Act/BECA)] অনুযায়ী রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘রেড’ কেটাগরির তালিকাভুক্ত।১৩ সাধারণত এই ধরণের কোনো প্রকল্প সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে নির্মিত হয় না। সেকারণে “ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রণীত ‘পরিবেশ সমীক্ষা’ ইআইএ গাইডলাইন ম্যানুয়াল ২০১০ অনুযায়ী, কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বাঘ/হাতি সংরক্ষণ অঞ্চল, জৈব বৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য কিংবা অন্য কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা অনুমোদন করা হয় না। এই বিধিনিষেধের কারণে ভারতের সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও গ্রিন ট্রাইব্যুনাল গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ ও খনি প্রকল্প বাতিল করেছে।”১৪ অথচ ভারতেরই সরকারি প্রতিষ্ঠান এনটিপিসি বাংলাদেশের রামপালে সুন্দরবনের সন্নিকটে অত্যন্ত বিপজ্জনক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে। যা শুধু বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চল নয় ভারতের অংশের সুন্দরবনকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

 নদী দূষণ

সরকারের পরিবেশ সমীক্ষাতেই স্বীকার করা হয়েছে, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ চলাচল করার ফলে-

১) কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ থেকে কয়লা, তেল, ময়লা আবর্জনা, জাহাজের দূষিত পানিসহ বিপুল পরিমাণ বর্জ্য নিঃসৃত হয়ে নদী-খাল-মাটিসহ গোটা সুন্দরবন দূষিত করে ফেলবে;

২) সুন্দরবনের ভেতরে আকরাম পয়েন্টে বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে কয়লা উঠানো নামানোর সময় পানি-বায়ু দূষণ ঘটবে;

৩) চলাচলকারী জাহাজের ঢেউয়ে দুইপাশের তীরের ভূমি ক্ষয় হবে;

৪) কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ ও কয়লা লোড-আনলোড করার যন্ত্রপাতি থেকে দিনরাত ব্যাপক শব্দ দূষণ হবে;

৫) রাতে জাহাজ চলাচলের সময় জাহাজের সার্চ লাইটের আলো নিশাচর প্রাণীসহ সংরক্ষিত বনাঞ্চল সুন্দরবনের পশু-পাখির জীবনচক্রের উপর মারাত্বক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে ইত্যাদি।১৫

এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য টারবাইন শীতল রাখতে পশুর নদ থেকে ঘন্টায় ৯,১৫০ ঘনমিটার হারে পানি তুলে নেয়া হবে, তারপর বিপুল বেগে গরম পানি আবার নদীতে ফেলা হবে। এই উত্তপ্ত পানি ও পানিতে দ্রবীভূত নানা বিষাক্ত উপাদান নদীর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ, পানির প্লবতা, পলি বহন ক্ষমতা, মৎস্য এবং অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবনচক্র ইত্যাদিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আমরা জানি, খাদ্যচক্রে আঘাত এলে এক প্রজাতির অনুপস্থিতি অন্য প্রজাতিকে বিলুপ্ত করে দেয়। যার ফলে বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হয়। সরকারের পরিবেশ সমীক্ষাতেই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।১৬ নদী দূষিত হলে এর সাথে জড়িয়ে থাকা খাদ্যচক্র ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে সুন্দরবনের অধিবাসী প্রাণীকূলের ওপর। যার ফলে তাদের অস্তিত্ব বিলিন হবার সম্ভাবনা তৈরি হবে।১৭

বায়ু দূষণ

রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র-র কারণে সুন্দরবনের বায়ু দূষিত হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র বছরের ৪৭ লাখ টন কয়লা পোড়াবে। এর থেকে বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, ফ্লাই অ্যাশ ও বটম অ্যাশ উৎপাদিত হবে।১৮ বাংলাদেশের ‘তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’ (জাতীয় কমিটি) ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বছরে উৎপাদিত বায়ু দূষণকারী উপাদানগুলোর ক্ষতির বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছে,

১) ৭৯ লক্ষ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড যা প্রায় ৩৪ কোটি গাছ কেটে ফেলার সমান।

২) ৫২ হাজার টন সালফার ডাই-অক্সাইড। এই সালফার ডাই-অক্সাইড এসিড বৃষ্টির কারণ এবং অন্যান্য উপাদানের সাথে বাতাসে ক্ষুদ্র কণিকার পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে, যার ফলে ফুসফুস ও হার্টের রোগসহ বিভিন্ন অসুখবিসুখ হয়।

৩) ৩১ হাজার টন নাইট্রোজেন-অক্সাইড। এই নাইট্রোজেন-অক্সাইড ফুসফুসের টিস্যুর ক্ষতি করে, যার ফলে শ্বাসতন্ত্রের নানান রোগ হতে পারে।

৪) ১৩০০ টন ক্ষুদ্র কণিকা, যার ফলে ব্রংকাইটিসসহ ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ বেড়ে যায়।

৫) ১৯০০ টন বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড।

৬) ৪৪০ পাউন্ড মারকারি বা পারদ। ২৫ একর আয়তনের একটা পুকুরে এক চা চামচের ৭০ ভাগের একভাগ পারদ পড়লে সেই পুকুরের মাছ বিষাক্ত হয়ে খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে। পারদের কারণে ব্রেন ড্যামেজসহ স্নায়ুতন্ত্রের নানান রোগ হয়।

৭) ৫৯০ পাউন্ড বিষাক্ত আর্সেনিক। যার ফলে আর্সেনিকোসিস এবং ক্যানসারের বিস্তার ঘটায়।

৮) ৩০০ পাউন্ড সীসা, ১০ পাউন্ড ক্যাডমিয়াম এবং পরিবেশ ও মানব স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর অন্যান্য ভারি ধাতু।১৯

গানের কথা

এবার আসি গানের কথায়। সুন্দরবন আন্দোলনের গানগুলো বিশ্লেষণে প্রথমেই যা নজরে আসে তা হলো সুন্দরবনের সৌন্দর্য বর্ণনা ও এর গুরুত্ব বর্ণনা। গানের দল মাভৈ এর- ‘বাদাবনের জারি’ শিরোনামের গানে আমরা দেখি শিল্পী গানের শুরুতেই সুন্দরবনের সৃষ্টি, এর সৌন্দর্য, জনজীবনের সাথে তার সম্পর্কের দিকটি তুলে ধরেছেন। শিল্পী জানেন, যেকোনো আন্দোলনে স্থানীয় মানুষদের অংশগ্রহণ জরুরি তাই সুন্দরবনের অস্তিত্বের সঙ্গে যাদের সরাসরি সম্পর্ক একদিকে যেমন তাদের যাপনের চিত্রটি বর্ণনা করেছেন অন্যদিকে যারা কখনো সুন্দরবন দেখেন নি, সুন্দরবন সম্পর্কে জানেন না তাদেরকেও সুন্দরবন সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলতে চেয়েছেন। সুন্দরবনের মাছ, মধু, ফল সেই অঞ্চলের মানুষের জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত তা গানে উঠে এসেছে- ‘পারশে মাছের সাথে হবে কেওড়া টকের ঝোল/ জন্মের শোধ বন্ধ হবে গো, ও মুখে ফুটবে না আর বোল’।২০ গানের এই উচ্চারণ এক লহমায় শ্রোতাকে টেনে নিয়ে যাবে সেখানে যেখানে তার ও সুন্দরবনের অস্তিত্ব এক সুতায় গাঁথা। গানের দল সমগীত এর একটি পুঁথিগান ‘বাঁচাও সুন্দরবন’ এর প্রথম অংশেও সুন্দরবনের পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে। দল বেঁধে সুন্দরবন সংলগ্ন জনপদে ঘুরতে গিয়ে একদল বন্ধুর উৎসাহে তৈরি এই গান- ‘হাতে হাত ধরে এসো বাঁচাই সুন্দরবন’; এই গানের শুরুটা যেমন হয়েছে সুন্দরবনকে ঘিরে প্রাণের সমাবেশের বর্ণনায়, তেমনি গানের দল ‘জলের গান’ এর গানে সুন্দরবনকে ঘিরে যে বিচিত্র প্রাণের সমারোহ তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা পাই। আবার সনতোষ বড়ুয়া গানে ছোট্ট করে সুন্দরবনের অপূর্ব বর্ণনা তুলে ধরেছেন- ‘নদী নালা বেষ্টিত কেওড়ার বন/সুন্দরী শ্যামলিমা সুন্দরবন’।২১ সুন্দরবন এবং তাকে ঘিরে মানুষের যে জীবনাচার তার চিত্র আমরা শিল্পীদের গানে পাই- ‘এই বন মা আমার কাঠ-মধু-মাছে/ছোটকাল থেকে এ শরীরে লেগে আছে’।২২ ‘এই জঙ্গল মৌয়াল-বাওয়াল কতো জেলের প্রাণ/এতেই কাপড়, এতেই ভাত, এতেই গলার গান।’২৩

সুন্দরবনের জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ। বাঘ ও কুমির তাই মানুষের আরাধনা ও বন্দনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চৈত্র মাসে বাদাবনের ধর্মদেল উৎসবে মাটি দিয়ে কুমির বানানো হয়। ধানজমিন বা পুকুরের মাটি দিয়ে কুমির বানানো হয় এবং সারা শরীরে খেজুর ফল গেঁথে দেওয়া হয়। বনবিবির পূজায় ও ধর্ম দেল উৎসবে বাঘ ও কুমিরের সুস্থ থাকার জন্য প্রার্থনা করা হয়। পাশাপাশি বাঘ ও কুমির যাতে মানুষের কোনো ক্ষতি না করে এ জন্যও আবদার করা হয়। বাদাবনে বাঘকে মনে করা হয় দক্ষিণ রায়। বাদাবনের রক্ষাকবচ হলেন মা বনবিবি। মা বনবিবি ও শাহজঙ্গলী ধর্মে মুসলিম কিন্তু বাদাবনে তাঁরা পূজিত হন সকলের কাছে। তাদের নামে মুরগি ছেড়ে উৎসর্গ করে তারপর বাদায় প্রবেশ করতে হয়। মুসলিম কি সনাতন হিন্দু বাঙালি, আদিবাসী কি মহাতো বা বাগদী সকলেই মা বনবিবিকে মান্য করে বাদাবনে।২৪

শুধু জীবিকার সংস্থান নয় সুন্দরবন ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকেও সবাইকে রক্ষা করে। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে সুন্দরবনের অবস্থান। সমুদ্র থেকে প্রতিবছর অসংখ্য ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ভূখণ্ডের দিকে ধেয়ে আসে। তখন সুন্দরবনের বৃক্ষরাজী বুক চিতিয়ে সেই ঝড় থেকে উপকূলকে রক্ষা করে। যার ফলে যত ধ্বংসলীলা চালানোর কথা ঝড়-ঘূণিঝড় সেই পরিমাণ ক্ষতি করতে পারে না। বিভিন্ন গানে সেই গুরুত্বের দিকটি তুলে ধরা হয়েছে- ‘আইলা-সিডর-ঘূণি-বাণ আর মহাজলোচ্ছ্বাস/খোদা কি শান সুন্দরবন আছে বারোমাস।’২৫ আবার আরেকটা গানে পাই- ‘ঝড় বন্যা জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবন থাকে পাশে/ লক্ষ জনের জীবন বাঁচে স্বার্থ সিদ্ধি নাই তাহার’।২৬ সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হলে শুধু উপকূলীয় অঞ্চল নয় সমগ্র বাংলাদেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গানে গানে সেই আশঙ্কার কথাও ব্যক্ত করেছেন শিল্পীরা-

সেই বন উজাড় হইলে বাঁচিবনা আর

ঝড় জলোচ্ছ্বাস বাংলা হইবে ছাড়খার

দক্ষিণের মানুষ কেবল হারাইবে না প্রাণ

সারা বাংলা জুড়েই হবে লাশের শ্মশান।২৭  

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণ, এর মাত্রাগত অবস্থা এবং পরিণতি সম্পর্কে জানতে পারি। গত শতকের নব্বই দশকে নির্মিত থাইল্যান্ডের Mae Moh কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে হাজার হাজার মানুষ ফুসফুসের অসুখে ভুগেছে, চারপাশের কৃষি অঞ্চলে ফসলের ফলন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, জলাভূমিতে আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম ও ম্যাংগানিজ এর দূষণ ঘটেছে। ভিয়েতনামের Quang Ninh কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বন্যা ও জলোচ্ছাসের সময় বিপুল পরিমাণ কয়লা দিয়েন ভং নদীতে ভেসে গেছে, ব্যাপক নদী দূষণ ঘটেছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ আরো কিছু কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য হা লং বে’ও মারাত্মক দূষণের শিকার হয়েছে। তাইওয়ানের Taichung কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে দুনিয়ার অন্যতম দূষণকারী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বলা হয়। এই কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে তাইওয়ানের মধ্য ও দক্ষিণ অঞ্চলে বায়ু দূষণ এত বেড়েছে যে এক পর্যায়ে আন্দোলনের মুখে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন কমিয়ে ফেলতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।২৮ ঠিক তেমনি সুন্দরবন ধ্বংস হলে এই অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে জলচর, স্থলচর, আকাশচর সকল প্রাণ এবং অতি অবশ্যই সুন্দরবনেই বৃক্ষসমাবেশ। ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই বনভূমিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মানুষের কর্ম-আকাঙ্ক্ষা-যাপনের সংস্কৃতি। সেই সাথে বাংলাদেশ এবং ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখিন হবে। সুন্দরবনের নদী-নালা-খাল-জঙ্গল দূষিত হলে, এদের খাদ্যচক্র ভেঙে পড়লে তার প্রভাব শুধু বনের অস্তিত্ব নয় বনচারী মানুষের জীবিকার ওপরও পড়বে। শুধু বন নয়, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশে পাশে যত ধানিজমি, পুকুর নালা আছে সব বিষাক্ত হয়ে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াবে বহুগুণ। এইসব কথা নতুন কিছু নয়। কিন্তু শিল্পী যখন গানের সুরে ঘটনাকে মূর্ত করে তোলেন তখন তা সাধারণের কাছে সহজবোধ্য হয় এবং এই কথাগুলোর গুরুত্ব বেড়ে যায়। যেমন- ‘উড়াল দিবে পক্ষীসকল কয়লার বিষের ডরে/মরিবে পানির কুমির, মাছও যাবে মরে’।২৯ এই কথা শোনার পর সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে যাদের জীবিকার যোগান হয় তারা নিঃসন্দেহে খুব সহজেই পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পারবেন। অন্যদিকে যারা শহুরে, সুন্দরবন উজাড় হলে যারা মনে করেন তাদের আপাত কিছু ক্ষতির সম্ভাবনা নেই তাদের অস্তিত্বও যে বিলিন হবে সুন্দরবন আন্দোলনের গানে শিল্পীরা সেই ইঙ্গিতও করেছেন- ‘বন পুড়ে গেলে তুমিও মরে যাবে/সুন্দরবন জ্বলে গেলে দেশটাও জ্বলে যাবে’।৩০ তাদেরকে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে সুনাগরিক হিসেবে তার কর্তব্যের কথা-

তোমার মোবাইল ফোনকে,

চার্জ দেওয়ার জন্যে

পাওয়ার ব্যাংক এর অজুহাত ধরে

হারাবো দেশের ঐতিহ্য।৩১

সুন্দরবন ধ্বংস হলে এই অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে জলচর, স্থলচর, আকাশচর সকল প্রাণ এবং অতি অবশ্যই সুন্দরবনেই বৃক্ষসমাবেশ। ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই বনভূমিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মানুষের কর্ম-আকাঙ্ক্ষা-যাপনের সংস্কৃতি। সেই সাথে বাংলাদেশ এবং ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখিন হবে। সুন্দরবনের নদী-নালা-খাল-জঙ্গল দূষিত হলে, এদের খাদ্যচক্র ভেঙে পড়লে তার প্রভাব শুধু বনের অস্তিত্ব নয় বনচারী মানুষের জীবিকার ওপরও পড়বে। শুধু বন নয়, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশে পাশে যত ধানিজমি, পুকুর নালা আছে সব বিষাক্ত হয়ে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াবে বহুগুণ।

একটা বনভূমি শুধু কাঠ-মধু-ফল আর অক্সিজেনের জোগান দেয় না। বনভূমিকে কেন্দ্র করে কল্পনারাও ডানা মেলে আকাশে। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে মানুষের মন আশ্রয় খুঁজে পায়, পায় নতুন সৃষ্টি ও দ্রোহের অনুপ্রেরণা। তেমনই একটা গানে পাই- ‘স্বপ্নচারীরা জঙ্গল ঘিরে বাঁচে/ অজস্র মুখে আঁকা সুন্দরবন’,৩২ আবার আরো একটা গানে পাই-

তুমি হও ইরাবতী মেঘ পশুর অকুল

লাল পাড় শাড়ি জুড়ে বোদেলা ফাগুন

আগুনে পোড়াও তুমি আমি হবো জল

প্রেম হোক বিদ্রোহ ভাষার আগুন।৩৩

Don’t Shoot নামে এক গানের দলের গান ‘অরণ্য’তে প্রতিধ্বনিত হয়েছে-

খোলা চোখে দেখ আজ

তোমারো জানালায় বিশাল আকাশ

বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ।।

ফিরিয়ে কি দিবে আমায়

সবুজ অনুভূতিগুলো

ফিরিয়ে কি দিবে আমায় সে অরণ্য

যেখানে মন হতে চায় বন্য

এখনো।৩৪

সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে বহুযুগের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে সুন্দরবন ধ্বংস হলে তা হুমকির মুখে পড়বে। শিল্পী তার গানে সেই হাহাকারকে ব্যক্ত করে সুন্দরবন রক্ষায় সকলকে জেগে উঠতে বলছেন- ‘যায় যায় যায় যায় সুন্দরবন হায়।/ গাজী-কালু-বনবিবি-দক্ষিণ রায়/জেগে ওঠো এ বিপদে মাকে রক্ষায়’।৩৫ শিল্পীরা সুন্দরবনের পরিস্থিতি বর্ণনায় বনের পশু-পাখি-নদী-বৃক্ষরাজীর প্রতীকী উপস্থিতি ঘটিয়েছেন। শিল্পীরা তাদের মুখেই বনের বিপদের খবর তুলে দিয়েছেন। স্বাধীনন্দের ‘টারজেনের গান’ এ বাঘ সুন্দরবন থেকে চিঠি পাঠিয়েছে। সেই চিঠিতে সুন্দরবন নিয়ে বাঘের উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। বনের কাছেই কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবনের গাছপালা জ্বলে যাবে তখন বনের হরিণ, পাখি কোথায় পালাবে? শুধু বন আর বনের পশু-পাখির জন্যই তার উদ্বেগ নয় মানুষের জন্যও তার উৎকণ্ঠা। কারণ যদি এসিড বৃষ্টি হয় তাহলে সুন্দরীর পাতা জ্বলে যাবে তখন অক্সিজেন কোথা থেকে পাবে মানুষ। এইভাবে চমৎকার ভঙ্গিতে গানটাকে নির্মাণ করা হয়েছে-

একটা চিঠি লিখেছে বাঘ মামা

…যদি হরিণেরা শোনে

বল পালাবে কোথা

যদি পাখিরা জানে

বল মিলবে কি দেখা

যদি নদীটা হারায় ওর নীরবতা

তবে কাটবে সাঁতার কই

মৎস্য কুমীরেরা।৩৬

গানের দল ভাটিয়াল শহুরে এর একটা গানে পাই- ‘পশুর নদী কয়/মনে ভীষণ ভয়/পাহাড় সমান জাহাজ এবার/উঠবে বুকের পাঁজরে’।৩৭ আরেকটি গানে দেখি সাপ-কুমীর-পশু-পাখির কান্নার বর্ণনা। মনে হয় যেন শিল্পী তাদের কান্নাকে প্রত্যক্ষ করেছেন, এইভাবে রূপকথারা আবার সুন্দরবন আন্দোলনের গানে ফিরে এসেছে- ‘গেওয়া কান্দে, গরান কান্দে/সাপ, ব্যাঙ, ভোঁদর কান্দে//তোর পিত্তি নড়ে না’।৩৮ আরো একটি গানে আমরা পাই- ‘সুন্দরবনের পশুপাখি সব কান্দিয়া কয়/সুন্দর মোদের জীবনখানা করিয়েন না ক্ষয়/বাতাসে মিশিয়া গেলে গ্যাস, কয়লা আর ছাই/বুকেতে ঢালিবার মতন হাওয়া কোথা পাই?’৩৯ জনগণের সংঘবদ্ধ লড়াইয়ে সুন্দরবনের বাসিন্দা পশু-পাখি-নদী-বৃক্ষকেও সামিল করেছেন শিল্পীরা। তাদের প্রতীকী উপস্থিতি ও কল্পিত আচরণ আন্দোলনকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। এদের মুখে মানুষের ভাষা এবং মানুষের বেদনার প্রকাশ মানুষের কাছে তাদের উপস্থিতিকে বাস্তব করে তুলেছে। তাদের প্রত্যাশা মানুষ যেন তাদের হয়ে লড়াই করে। বনের পশু-পাখি-নদী-বৃক্ষরাজীর এই শঙ্কাময় জীবনের জন্য তো তারা দায়ী নয়। দায়ী কিছু লোভী মানুষ আর কিছু ভীরু মানুষের নীরবতা। এইসব মানুষের কারণেই তাদের অস্থিত্ব আজকে বিলীন হতে চলেছে। গানে গানে শিল্পীদের চাওয়া সুন্দরবনের পশুপাখির কাছ থেকে যেন মনের জোর আর লড়াইয়ের কৌশল শিখে নিয়ে মানুষগুলো লড়াই করে সুন্দরবনকে রক্ষা করে। কারণ এই বন রক্ষার দায় মানুষের। 

কুমিরের গায়ের কাঁটার বর্ম গায়ে

মানুষগুলো গাছের মতো সটান দাঁড়াক।৪০

জনগণের সংঘবদ্ধ লড়াইয়ে সুন্দরবনের বাসিন্দা পশু-পাখি-নদী-বৃক্ষকেও সামিল করেছেন শিল্পীরা। তাদের প্রতীকী উপস্থিতি ও কল্পিত আচরণ আন্দোলনকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। এদের মুখে মানুষের ভাষা এবং মানুষের বেদনার প্রকাশ মানুষের কাছে তাদের উপস্থিতিকে বাস্তব করে তুলেছে। তাদের প্রত্যাশা মানুষ যেন তাদের হয়ে লড়াই করে। বনের পশু-পাখি-নদী-বৃক্ষরাজীর এই শঙ্কাময় জীবনের জন্য তো তারা দায়ী নয়। দায়ী কিছু লোভী মানুষ আর কিছু ভীরু মানুষের নীরবতা।

গানে ক্ষতির হিসাব

মানুষ প্রকৃতির অংশ এই সত্যবচনকে ভুলে মুনাফাখেকো মানুষ প্রকৃতিকে ধ্বংস করার আয়োজনে লিপ্ত হয়, আত্মদংশনে মেতে ওঠে। সুন্দরবন তেমনি কিছু আত্মদংশি মানুষের কবলে আক্রান্ত। সুন্দরবনের অতি নিকটে রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। এই কোভিড-১৯ মহামারিতে যখন সমগ্র পৃথিবীর মানুষ থমকে গেছে, নিজেদের সব কর্মের দিকে দৃষ্টি ফেরাচ্ছে, ভুলগুলো শুধরে নিতে চাইছে, তখন বাংলাদেশের সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ প্রদত্ত তথ্য থেকে (সর্বশেষ ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ এ হালনাগাদ করা) আমরা জানতে পারি, রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে তুমুল বেগে।৪১ শুধু পরিবেশ বিপর্যয় নয় এই প্রকল্প অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধনের কারণও হতে চলেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ‘এই প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৭০ ভাগ অর্থ আসবে বিদেশি ঋণ থেকে, বাকি ৩০ ভাগের মধ্যে ভারত বহন করবে ১৫ ভাগ আর বাংলাদেশ ১৫ ভাগ। আর ওই ৭০ ভাগ ঋণের সুদ টানা এবং ঋণ পরিশোধ করার দায়দায়িত্ব বাংলাদেশের।’৪২ গানের মাধ্যমে শিল্পীরা এই হিসাবটি সহজ করে তুলে ধরেছেন এভাবে-

ভারতের এনটিপিসি নামের প্রতিষ্ঠান

লাভ সব তার হবে পিডিবি’র লোকসান

মোট ব্যয়ের ৭০ ভাগ টাকা আসবে বিদেশি ঋণে

এমনি করেই বিদেশিরা নিচ্ছে মোদের কিনে

৩০ ভাগের মধ্যে ভারত দেবে ১৫ ভাগ

কিন্তু তারা মালিকানার পাবে পুরো ভাগ

৭০ ভাগ টাকার সুদ পড়বে মোদের ঘাড়ে

শোষকের খেয়ালে ঋণের বোঝা বাড়ে।৪৩

অথচ একটু খোঁজ খবর করলেই জানা যায়, প্রতিবেশী দেশ ভারত নিজের দেশে যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে নি৪৪ তা-ই তারা বাংলাদেশের সুন্দরবন সংলগ্ন অঞ্চলে করতে চলেছে। আর যদিও এই প্রকল্পের নাম বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (প্রাঃ) লিঃ কিন্তু ইতোমধ্যেই ভারত বিভিন্ন ইস্যুতে, বিশেষ করে বর্ডার এবং ফারাক্কা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যে বৈষম্যপূর্ণ আচরণ করে আসছে তাতে সুন্দরবন আন্দোলনকারীরা এই চুক্তিকে প্রহসনমূলক বলে মনে করছেন। গানের ভাষায় এর রেশ খুঁজে পাই- ‘কাঁটাতারে ঘিরে রাখে বন্ধু ভারত মোদি/একে একে মানুষ হত সাথে হত নদী (হায়রে)’।৪৫ আরেকটি গানেও এই বিষয়টি নজর কাড়ে- ‘বর্ডার এর গুলিতে বাঁধ গড়ে নদীতে/খরা আর বন্যার কল ধরে দাঁড়িয়ে/প্রতিবেশী ছদ্মবেশটাকে সরিয়ে’।৪৬

বাংলাদেশ সরকারের বহুল প্রচারিত মেগা ‘উন্নয়ন প্রকল্পে’র একটি মৈত্রী সুপার থার্মাল সুপার পাওয়ার অর্থাৎ রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। আনু মুহাম্মদ উন্নয়নের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন,

উন্নয়ন তাকেই বলা যায়, যা সম্পদ সৃষ্টি করে, নতুন সম্পদ যোগ করে, দেশের মানুষের জীবন সহজ করে, উৎপাদনশীল খাতের সম্প্রসারণে সহায়ক হয়, দেশের সক্ষমতা বাড়ায়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সৃষ্টি করে নিরাপদ ও সমৃদ্ধ জগৎ।৪৭

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের শিল্পীরা গানের মাধ্যমেই এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন- ‘উন্নয়নের নামে স্বার্থের ফণা/ছোবল দিয়েছে আজ দ্যাখো’।৪৮ অন্য একটা গানে পাই- ‘মাথার ভেতরে পার্সেন্টিস ঘোরে কয়লার ভেতরে দালালি/দালালির ভেতরে পার্সেন্টিস ঘোরে’।৪৯ এইভাবে বিভিন্ন গানে উন্নয়নের নামের অন্তরালে নানান স্বার্থ উদ্ধারের অকথিত গল্প ব্যক্ত হতে থাকে। নেটিভ আমেরিকানদের একটা প্রবাদে আছে, ‘যখন শেষ গাছটি কেটে ফেলা হবে, শেষ মাছটি ধরা হবে, শেষ নদীটি বিষাক্ত হবে, তখন আমরা বুঝবো টাকা খাওয়া যায় না।’ এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, টাকা খাওয়া যায় না, তথাকথিত উন্নয়নের বিষ বাতাসে বুক ভরে না। তার জন্য প্রাণ-প্রকৃতির আবাহন চাই। প্রাণ-প্রকৃতি বাঁচলে মানুষ বাঁচবে। গানের দল শহুরে গায়েন এর গানে সেই আর্তিটি ফুটে উঠেছে-

জেনো প্রকৃতিবিহীন

দমের পাখিরা অজানায়

যাবে উড়ে, উড়ে, উড়ে, তাই

আধুনিক হতে চাইনা আমি

আমাকে ধ্বংস করে

আর আধুনিক হতে চাইনা

সুন্দরবন ধ্বংস করে।৫০

স্বার্থের সংঘাত

আমরা দেখেছি যখন জনগণের স্বার্থ আর শাসক শ্রেণির স্বার্থ পরস্পর সাংঘর্ষিক হয় তখন জনগণের অধিকার আদায় করতে দীর্ঘ ও লাগাতার সংগ্রাম করতে হয়। সেই আন্দোলনে আঘাত আসে। সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনেও আমরা দেখেছি বিভিন্ন সময়ে হামলা করা হয়েছে। সকল ধরনের নিপীড়নকে উপেক্ষা করেও সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন চলমান রাখতে শিল্পীরা গানে গানে সেই আন্দোলন চালিয়ে যাবার আহ্বান জানিয়েছেন। এমনকি কখনো প্রয়োজনে পাল্টা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার তাগিদ দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি গানের উল্লেখ করতে চাই-

ক. তুমি জোর কইরা আমগোরে পিডাইয়া

আন্দোলন থামাইতে চাও

মানুষের বিরুদ্ধে কি ক্ষমতায় থাকা যায় রে

জনগণের বিরুদ্ধে কি টিকা থাকা যায়।৫১

খ. রাজপথে হোক মিছিল-অঙ্গীকার

প্রতিবাদে হোক গল্প-কবিতা-গান।৫২

ঘ. কাঁটাতারে ঘেরা ব্যারিকেট ভাঙ্গো, চিৎকার করে স্লোগান ধরো,

সুন্দরবন ধ্বংস করে চাইনা কোনো উন্নয়ন’।৫৩

ঙ. রামপাল থেকে দস্যু হটাও,

সুন্দরবন বাঁচাও।৫৪

সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন সহজ হবে না। কারণ এর সাথে জড়িয়ে আছে দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী চক্র। তাই এই আন্দোলনের লড়াইকেও হতে হবে শক্তিশালী এবং এতে প্রকাশ ঘটাতে হবে সর্বজনের শক্তির। কয়েকটা গানে সেই শক্তি প্রদর্শনের বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য- ‘শোন মন্ত্রী, শোন আমলাতন্ত্রী তোমাদের দিন হবে গত/শোন নেতা, শোন নেত্রী এই বন মায়ের মত।/এই বন হারালে, সুন্দরবন হারালে কেউ ক্ষমা পাবেনা/ মন দিয়ে যদি শোন দেখ ম্যানগ্রোভের কান্না’।৫৫ আরেকটা গানে পাই- ‘বিদ্যুৎ তুমি চাইতে পারো রামপালে চাইয়ো না/রামপালের দিকে আর পা বাড়াইও না’।৫৬ একটি গানে সুন্দরবন রক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে এবং প্রতিরোধের শক্তি গড়ে তুলতে একাত্তরের হাতিয়ারকে আহ্বান করা হয়েছে।৫৭ আরেকটি গানেও পাই ক্রোধের প্রকাশ- ‘সুন্দরবনে জ্বলছে আগুন পশুপাখি কান্দে/শত্রু ধইরা সুন্দরবনে বান্ধ রে (এইবার)/খুন্তা কুড়াল লাঙ্গলের ফাল হাতের দাওয়ে শান দে।’৫৮

বর্তমানে প্রযুক্তি নির্ভরতার যুগে যখন বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে তখন প্রতিদিনের নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের আশ্বাস সবাই চায়। কিন্তু আমরা দেখি প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষা করে টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনার বদলে ব্যয়বহুল, প্রাণ-প্রকৃতি বিধ্বংসী পরিকল্পনা গ্রহণের প্রতিই সরকার বেশি আগ্রহী। আর এই সুযোগে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বন-নদী-পাহাড় দখল করাও সহজ। যার ফল স্বরূপ দেখতে পাই সর্বত্র দখল-লুন্ঠনের নৈরাজ্য। বেতাল বাল তাদের গানে সরকারের এই কয়লাপ্রীতিকে ব্যঙ্গ করেছেন- ‘কয়লা তুই গোসল কর, কয়লা দিয়া নাস্তা কর/সুন্দরবন ধ্বংস করে বিজলী দেখানোর কী দরকার!৫৯ সন্দেহ নেই, এই অবস্থা নিরসনে বিদ্যুতের বিকল্প উৎস ভাবতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পরিবেশ বিবেচনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করছে। এর মধ্যে জার্মানি ২০৩৮ সালের মধ্যে তাদের দেশের সব কয়লাভিত্তিক ও ২০২২ সালের মধ্যে সকল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করার ঘোষণা করেছে এবং এরই অংশ হিসেবে একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থাপনা ২০১৯ সালে ধ্বংস করা হয়।৬০ এদিকে বাংলাদেশ নতুন উদ্যমে এইসব প্রকল্প নির্মাণ করে চলেছে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। অথচ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিকল্প নিয়ে ভাবছে।

সুন্দরবন আন্দোলনের গানেও জানতে পারি, বন ধ্বংস করে কোনো উন্নয়নকেই শিল্পীরা সমর্থন করেন নি, এমনকি প্রয়োজনে বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তাকেই কমাতে বলছেন। বিকল্প খোঁজার কাজ যারা এই নিয়ে গবেষণা করছেন তাদের, যারা নীতিমালা নির্ধারণ করেন তাদের, শিল্পীরা কেবল আকাঙ্ক্ষার কথাই ব্যক্ত করতে পারেন। শিল্পীরা নানা মাধ্যমে সেই কাজটি করে চলেছেন। একজন বলছেন- ‘বিজলিটা চাই হক কথা বটে/কিন্তু বাঁচার দাবী তারও আগে’।৬১ আবার কেউ কেউ বিকল্প হিসেবে জীবনকেই গুরুত্ব দিয়েছেন প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে উৎপাদিত বিদ্যুতকে নয়- ‘শ্বাসমূল কাল করে কোন সে আলো চাই/বাদাবন ধ্বংস করা বিদ্যুৎ দরকার নাই।’৬২ সুন্দরবনের বিকল্প নেই, কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প আছে। গানের মধ্যদিয়ে শিল্পীরাও রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিকল্প ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তারা বলছেন- ‘বলছিনা থামাতে বলছি সরাতে/একবার হারালে পারবেনা ফেরাতে’।৬৩  আন্দোলনের মধ্য থেকে রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিকল্প প্রস্তাবও এসেছে এরকম-

‘প্রথমত, যেহেতু ভারতের কোম্পানি এটি পরিচালনা করবে, যেহেতু ভারতের ব্যাংক এর জন্য ঋণ জোগান দেবে, যেহেতু ভারতের বিশেষজ্ঞরা এখানে কাজ করবেন, যেহেতু সম্ভবত ভারতের কয়লাই এখানে ব্যবহার হবে; সেহেতু ফ্রেন্ডশিপ কোম্পানির এই কেন্দ্র ভারতেই প্রতিষ্ঠিত হোক, আমরা না হয় বিদ্যুৎ কিনব। অথবা দ্বিতীয়ত, সব বিধি মেনে স্বচ্ছতার সঙ্গে মেনে বাংলাদেশের অন্যত্র এই বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে পারে। অথবা তৃতীয়ত, যে পরিমাণ বিদ্যুৎ এই কেন্দ্র থেকে পাওয়া যাবে, তার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ, ২০ ভাগের এক ভাগ অর্থে, বিদ্যমান বিদ্যুৎকেন্দ্র মেরামত ও নবায়ন করেই পাওয়া সম্ভব। অথবা চতুর্থত, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বৃহৎ উদ্যোগ। ভারতের রাজস্থানই তার একটি ভালো দৃষ্টান্ত।’৬৪

গানের ভাষা ও সুরের বৈচিত্র্য

সুন্দরবন রক্ষার গানের ভাষার ব্যবহারে বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। কোনো কোনো গানে কথ্য বা আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহৃত হয়ে গানকে অনেক বেশি সহজবোধ্য এবং আন্তরিক করে তুলেছে। আমরা জানি, কথ্যভাষার ঢঙ মানুষ সহজেই গ্রহণ করে, যেমন- ‘সাপ কান্দে কুমির কান্দে, কান্দে গাঙ্গের পানি’৬৫ বা ‘তাইতো বলি সুন্দরবনের ভাগ্য আজ ভাই/বেনপি বলো আম্লিগ বলো কারো হাতে নাই’৬৬ আবার ‘সুন্দর সুন্দর কথা দিয়া সুন্দরীর কথা কই/ সুন্দরী মাগো তোমার লাইগা বাইন্ধাছি এই গান’৬৭ অথবা যখন ‘মুসা কলিম নামটি আমার নিবাস সাতক্ষীরা/এসো বন্ধু খাতি দেবো চিংড়ে মাছের বড়া’৬৮ এই যদি হয় গানের ভাষা তখন তা খুব সহজেই সর্বস্তরের মানুষকে আকৃষ্ট করে। অনেক কঠিন কথাও গানের সহজ ভাষার মাধ্যমে এক বিশাল জনস্রোতের কাছে খুব সহজেই পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়।

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী বা আপার্টহাইট বিরোধী এই আন্দোলন নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র “Amandla!: A Revolution in Four-Part Harmony” এর সংগীত পরিচালক ও এক্টিভিস্ট Sifiso Ntuli-র বক্তব্য, “Song is something that we communicate to the people who otherwise would not have understood where we are coming from. You could give them a long political speech and they would still not understand, but I tell you, when you finish that song, people will be like ‘Damn, I know where you guys are coming from”.৬৯

গানের ভাষার ব্যাপারে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শব্দের উপযুক্ত ব্যবহার। তাই শব্দ ব্যবহার এবং বাক্যগঠনে প্রাঞ্জল হওয়ার গুরুত্ব অনেক। গানে নানা উপমা-প্রতীকের ব্যবহার করে রচয়িতা তার বক্তব্য হাজির করতে চান। কিন্তু কখনো কখনো উপমা-প্রতীকের ব্যবহারের দুর্বোধ্যতার কারণে তা সর্বজনবোধ্য না হয়ে একটা বিশেষ ঘরানায় আটকে যায়। অবশ্য যদি লেখক সেই বিষয়ে সচেতন ভাবেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তাহলে সেই প্রসঙ্গ আলাদা। দু-একটি উদাহরণ এখানে প্রাসঙ্গিক, যেমন- ‘সবুজ প্রান্তরে বৃষ্টিমাখা সমুদ্রফেনা/নীল নীল জোছনায় আছড়ে পড়ে’৭০ যা সম্পূর্ণ গান থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়। অথচ এই গানেরই অন্য পংক্তি- ‘কয়লা তুই গোসল কর, কয়লা দিয়া নাস্তা কর/সুন্দরবন ধ্বংস করে বিজলী দেখানোর কী দরকার!৭১এই পংক্তি খুব সহজেই মানুষকে ‘কানেক্ট’ করতে পারে। আরেকটা গানের শুরুতে পাই- ‘তোমার চোখে মুখে খেলা করছে রোদ/তোমার চুল হাত দিয়ে যায়না ধরা/ আমার এ পতিত আঙ্গুল পুড়ছে ক্রোধে/ তবে কী রোদ পুড়ছে অনল বোধে?’৭২ হয়তো সুন্দরবনকে প্রিয় কারো সঙ্গে তুলনা করেছেন কিন্তু তা সহজবোধ্য নয়।

কয়েকটি গানে কিছু সূক্ষ্ম বোঝাপড়ার জায়গা আছে যা বোধের জায়গাগুলোতে নাড়া দেয় আর তাই সেই বিচারে রচয়িতার সচেতনতা অনেক বেশি দাবি করে। আমরা জানি, আজকে সুন্দরবন আক্রান্ত কিছু লোভী মানুষের দ্বারা। মুনাফালোভী এই মানুষদের কাছে সুন্দরবন, সুন্দরবনের প্রাণসম্পদ, সৌন্দর্যের কোনো মূল্য নেই। ঠিক তেমনি এই মুনাফা লোভীদের কাছে সাধারণ মানুষও মূল্যহীন। আর এদের মতো মানুষের কাছেই আজকে সুন্দরবন জিম্মি। তাই গানে যখন বলা হয় ‘মানুষ আগুন লাগাইয়া দিলি পরাণের সুন্দরবনে’৭৩ তখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই যে মানুষ নিজেও সুন্দরবনের পশু-পাখির মতোই আক্রান্ত। আদিবাসী বা পাহাড়ের সেই মানুষটি যার যাপনের অঙ্গ প্রকৃতিকে লালন ও তার আশ্রয়েই জীবন ধারণ এবং এই উন্নয়নের জিকিরে সে নিজেও বলি তখন সেই অসহায় দুর্বল মানুষটির ঘাড়েও এই দায় এসে পড়ে। তাই খুব স্পষ্টভাবেই প্রকৃত শত্রুকে সনাক্ত করা ও করানো খুব জরুরি বলে মনে করি। উপনিবেশিকতার আছড় কাটিয়ে এই অঞ্চলের মানুষ এখন আত্মশক্তিকে চিনতে শিখেছে। শিখেছে সাদা প্রীতি এবং কালোর প্রতি ঘৃণার উৎস। তাই গানের ‘কালো হাত রুখে বাঁচো সুন্দরবন’৭৪-এ ‘কালো হাত’ এর মতো বিতর্কিত বিশেষণকে বর্জন করা জরুরি বলে মনে করি। আরেকটা গানে আমরা পাই- ‘সুন্দরবন থেকে বাঁশখালী রূপপুর/সব শালা বেনিয়ারে তাড়াবেই এই সুর’।৭৫ আমরা জানি ‘শালা’ শব্দটি একটি সম্পর্কের নাম হলেও তা গালি হিসেবে অনেকে ব্যবহার করেন। যখন তা গালি হিসেবে ব্যবহার হয় তখন গালিদাতার মানস গঠনে পুরুষতন্ত্রের স্পষ্ট বা প্রচ্ছন্ন প্রভাবটি লক্ষ্য করা যায়। কারণ এই গালির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নারীকে অপমান করা। যারা প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলনে সামিল হয়েছেন আমরা ধরেই নিতে পারি তারা অন্য অনেকের চাইতে চিন্তায় প্রাগ্রসর। তাদের লেখা সমাজের প্রচলিত চিন্তাকে কখনো উস্কে দেবে কখনো নির্মাণ করবে।  যে কোনো সংবেদনশীল মানুষকে আহত করবে এমন কিছুকে তারা সচেতনভাবে পরিহার করবে। তাই ভাষাকে গড়েপিটে নেয়ার দায়িত্ব এসে পড়ে যারা সংস্কৃতি চর্চায় এগিয়ে তাদের ওপর।

আবার কিছু গানে এমন শক্তিশালী শব্দবন্ধ আছে যাতে দ্রোহের আগুন চট করেই জ্বলে ওঠে। যেমন- ‘ফুলবাড়ি মরে না মাথা নিচু  করে না/বুকেতে সাহস নিয়ে লড়ে যায় রাত দিন/ ফুলবাড়ি থেকে পথ চিনে নিন’৭৬ আরো কিছু গানে এমন শক্তিশালী শব্দবন্ধ আছে- ‘রুখে দাও রামপাল/ রুখে দাও শহুরে আক্রমণ’৭৭, ‘সুন্দরবন হারিয়ে যাবে সে হতে দিব না’৭৮ ’আমি ছাড়বো না ছাড়বো না আমার সুন্দরবন’৭৯, ‘আবার মিছিল হবে বিক্ষোভে বিপ্লবে, আগুনের গোলা হয়ে ধেয়ে যাও’,৮০ ‘হাতে হাতে তুলে নেব শক্ত কুঠার/মাগো তোর সুন্দরবন হবে না উজাড়/Go Back Get Out India’৮১। বাঘ বাংলাদেশের জাতীয় পশু। বাংলাদেশের জাতীয় বীরত্বকে বোঝাতে প্রায়ই বাঘের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। আবার ক্রিকেট খেলায় যখন বাংলাদেশের উপস্থিতি থাকে তখনও খেলোয়াড়দের মনোবল চাঙ্গা রাখতে প্রায়শই রয়েল বেঙ্গল টাইগারদের সাথে তাদেরকে তুলনা করা হয়। কিন্তু সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবনের সাথে সাথে বাঘের অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়বে, সেই বিষয়টিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেই গানে কখনো ব্যঙ্গচ্ছলে, কখনো আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে বাঘের প্রসঙ্গ এসেছে। যেমন ব্যঙ্গচ্ছলে পাই- ‘বনের রাজা বাঘ মামা/ মুখে তোমার ছাইয়ের ঝামা/ সোনার বাংলায় তোমার ঠাঁই নাই’৮২ আরেকটা গানে পাই- ‘কই সব বাঘের বাচ্চা?/বাংলার বাঘ তোরা কই সব আজ?/বাঁচাবো বাঘের বাচ্চাদের’৮৩ আবার অনেকটা হুমকির সুর পাই- ‘বাঘের ল্যাজ দিয়া কান চুলকাইও না, বিদ্যুৎকেন্দ্র চাইতে পারো রামপাল চাইয়ো না’।৮৪

সুরের প্রসঙ্গে বলতে গেলে বলতে হয়, সুন্দরবন আন্দোলনের গানগুলোর অধিকাংশই লোকসুরে বাঁধা। লোকসুর খুব সহজেই এদেশের মানুষকে আকৃষ্ট করে। তাই গানগুলোর মধ্যে বাংলার প্রচলিত জারি, সারি, পুঁথি-পালা, বাউল, ছড়ার সুর ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আবার কিছু গান বিদেশি ও পাশ্চাত্য সংগীতের সুরের আঙ্গিকেও তৈরি হয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা যেতে পারে। যেমন, নাটকের দল বটতলার নাটক ‘মধুশিকারী’তে আমরা পালাগানের সুরের ব্যবহার দেখতে পাই- ‘হায় গো আমার বিষয় না বুঝিয়া-জীবনে কি করলাম আমি গো/ সুন্দরবন সুন্দর থাকুক অপরূপ রইয়া-সবাই মিলে তারে বাঁচাব ভাইরে- এসো করি পণ।’৮৫ বাউল গানের সুরের প্রভাব দেখতে পাই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের করা একটি গানে-‘কয়লার নৌকা রামপালেতে যায়/ ও বুবু জান/ কয়লার নৌকা রামপালেতে যায়’।৮৬ জারিগানের সুর ও ঢঙে ‘বাদাবনের জারি’ তৈরি। গানের শিরোনাম এবং গানের ভেতরেও সেই কথা বলা হয়েছে-

গাজীপীর আর বনবিবির আশীর্বাদ সম্বরি

চরণধূলি লইয়া গাইনু বাদাবনের জারি।৮৭

গানের দল সমগীত এর গান ‘বাঁচাও সুন্দরবন’ পুঁথিগানের আদলে তৈরি-

শোন শোন দেশবাসী শোন দিয়া মন

সুন্দরবনের কথা করিব বর্ণন…

হায় আয় আয় আয়-

এমন সুন্দরবন ধ্বংস হবে ভাই

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে বাঁচার উপায় নাই।৮৮

গানের দল সমগীত’র আরেকটি গানে পাই সারি গানের সুর- ‘বনচারি জেগে ওঠো জাগো এইবার/ বনের বিপদ যত করো ছারখার’।৮৯ তথ্যপরিচয় না পাওয়া একটা প্যারডিতে কাজী নজরুলের জনপ্রিয় হামদ-নাত এর হামদ- ‘এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি’-এর সুর পাই, যা মূলত লোকসুর। অন্যদিকে অ্যাসেজ ব্যান্ডের জনপ্রিয় গান ‘তামাকপাতা’র প্যারডি পাই ‘চেতনা কয়লা পোড়া’ গানে। স্কিব খানের গান ‘বাঘের বাচ্চা’তে পাই র‌্যাপ ঘরানার সুর ও চলন। এছাড়া অনেক গানেই রক গান এর সুরেই মিলেমিশে আছে। এইভাবে গানগুলোতে নানান ধারার সুরের মিশ্রণ ঘটে গানগুলো সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চার করছে এবং নানা রুচি পছন্দের মানুষের মনে প্রতিবাদের প্রেরণা জুগিয়ে চলেছে।

সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনের গানগুলোর রচয়িতা, সুরকার এবং কন্ঠশিল্পীরা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার, বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এবং সর্বোপরি নানান পছন্দ ও ভাবনার মানুষ। তাই শব্দগঠন, সুর সংযোজন এবং গায়কীতেও প্রতিটি গান আলাদা। কিন্তু একটা জায়গায় সকলেই এক তা হলো সুন্দরবন রক্ষার ভাবনা। সকলেই তাদের গানের মধ্য দিয়ে সুন্দরবন রক্ষার ডাক দিয়েছেন।

শেষ কথা

সুন্দরবন মানুষের বসবাস থেকে দূরবর্তী। সুন্দরবনের ওপর সরাসরি যাদের জীবিকা নির্ভর করে সেই কতিপয় মানুষ ছাড়া সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হলে কারো ভিটে মাটি হারা হবার মতো তাৎক্ষণিক ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সুন্দরবনের গুরুত্ব কেবল স্থানীয় পর্যায়ে নয়, সমগ্র দেশ বা বলা যায় বিশ্বের এই প্রান্তের অস্তিত্ব এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। নাগরিক সভ্যতায় অভ্যস্ত মানুষ তার জীবন চর্চায় প্রকৃতি থেকে ভীষণভাবে বিচ্ছিন্ন। মানুষ যে প্রকৃতিরই অংশ এই সত্যটা ভুলে সে প্রকৃতির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছে। যার ফলে প্রকৃতির সঙ্গে তার জন্ম-সূত্র ছিন্ন হয়েছে। কিছু মুনাফালোভী মানুষ উন্নয়নের নামে, আধুনিকতার নামে সমগ্র পৃথিবীর নদী-বন-মাটি-বায়ুতে বিষ মিশিয়ে, দখল করে পৃথিবীর প্রাণ-প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে তৎপর। ২০২০ এ আমরা দেখেছি খনিজ পদার্থ আহরণের লোভে আমাজন জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দেয়া হলো।৯০ এইভাবে সমগ্র পৃথিবীজুড়ে নদী-বন-পাহাড় ধ্বংস করে কেবল মুনাফা অর্জনের পাঁয়তারা চলছে। দেশে-বিদেশে ক্ষমতার সঙ্গে এই চক্রান্তের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ক্ষমতার নানা শর্তে লুট হচ্ছে বনভূমি-নদী-সমুদ্র। বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভ বনভূমি ‘সুন্দরবন’ এই চক্রান্তের শিকার হতে চলেছে। এই চক্রান্তের কবল থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করতে না পারলে বাংলাদেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক যে ক্ষতি সাধিত হবে তা অপূরণীয়। সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনের গানগুলোর রচয়িতা, সুরকার এবং কন্ঠশিল্পীরা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার, বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এবং সর্বোপরি নানান পছন্দ ও ভাবনার মানুষ। তাই শব্দগঠন, সুর সংযোজন এবং গায়কীতেও প্রতিটি গান আলাদা। কিন্তু একটা জায়গায় সকলেই এক তা হলো সুন্দরবন রক্ষার ভাবনা। সকলেই তাদের গানের মধ্য দিয়ে সুন্দরবন রক্ষার ডাক দিয়েছেন। আকাঙ্ক্ষা করেছেন সর্বস্তরের মানুষ সুন্দরবন রক্ষায় এগিয়ে আসবে এবং যেকোনো মূল্যে সুন্দরবনকে রক্ষা করবে।

(জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান অনুষদ জার্ণাল সমাজবিজ্ঞান সমীক্ষা, জুন ২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত লেখার কিঞ্চিত পরিমার্জিত সংস্করণ) 

 

বীথি ঘোষ: শিল্পী, শিক্ষক। ইমেইল: bithighosh@hotmail.com

তথ্য নির্দেশিকা

১. কুমার, কাঞ্চন (অনুদিত)। ২০১২। সীমাহীন গানের খনি, অনুবাদ-, র‌্যাডিক্যাল, পৃ-১৮৪। কলকাতা।

২. আকাশ, অমল (সম্পাদিত)। ২০০৫। সমগীত, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, পৃষ্ঠাÑ ৮। নারায়নগঞ্জ।

৩. চৌধুরী, সবিতা, চৌধুরী, অন্তরা ও নিয়োগী, রণবীর (সংকলন ও সম্পাদনা), সলিল চৌধুরী । ২০১৩।রচনাসংগ্রহ-১, দে’জ পাবলিশিং, পৃষ্ঠা-২৯। কলকাতা।

৪. জানা, ডঃ মনীন্দ্রনাথ। ১৯৪৪। সুন্দরবনের সমাজ ও সংস্কৃতি। দীপালী বুক হাউস। পৃষ্ঠা-১-২। কলিকাতা।

৫. বাংলাপিডিয়া। ২০১৫। সুন্দরবন। bn.banglapedia.org

৬. বিস্তারিত দেখুন- চৌধুরি, খসরু। ২০১০, ২৩ জুলাই, প্রথম আলো। সুন্দরবনের হারানো মাছ, লিংক দেখুন- http://archive.prothom-alo.com/detail/date/2010-07-23/news/80773

৭. বিস্তারিত দেখুন, চৌধুরি খসরু, প্রগুক্ত।

৮. বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, কয়রা ইউনিয়ন, প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহ। লিংক দেখুন-  https://bit.ly/3bTlIAV

৯. বিস্তারিত দেখুন, প্রণব বল ও সুজন ঘোষ। ২০১৮, ২৯ জানুয়ারি, প্রথম আলো। আন্তর্জাতিক গবেষণা তথ্য, ঝড়ে সুন্দরবন থেকে দূরের জনবসতির বেশি ক্ষতি। https://bit.ly/3r3NYHa

১০. বিস্তারিত খবর দেখুন, আম্পানেও দেশকে মায়ের মতো আগলে রাখলো সুন্দরবন, ২০২০, মে ২১, বাংলা নিউজ ২৪ ডট কম। https://www.banglanews24.com/climate-nature/news/bd/789776.details

১১. বিস্তারিত, কল্লোল মোস্তফা, ‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র যে কারণে সুন্দরবনের জন্য বিপজ্জনক’, ১৯ মার্চ, ২০১৬। দেখুন- https://bit.ly/3r7N2S9

১২. মুহাম্মদ, আনু (সম্পাদিত) সর্বজনকথা, ৩য় বর্ষ: ৪র্থ সংখ্যা, ২০১৭। সুন্দরবনের ওপর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কিত দুটি গবেষণা প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ, রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহার্য কয়লা পরিবহন ও নদী ড্রেজিং পরিকল্পনার পরিবেশগত প্রভাব প্রতিবেদন। মূল প্রতিবেদন ড. উইলিয়াম ও ড. জন ব্রুডি, সারসংক্ষেপ ও আনুবাদ অধ্যাপক বদরুল ইমাম। পারদের নিঃসরণ বায়ুমন্ডলে সঞ্চয়ন ও প্রতিবেশদূষণ: সুন্দরবনের জীব-ভৌগলিক বলয়ে রামপাল থেকে নির্গত পারদের প্রভাব। মূল প্রতিবেদন চার্লস টি ড্রিসকল, সারসংক্ষেপ ও ভাষান্তর ড. মো. আনোয়ার হোসেন। পৃষ্ঠা-২০।

১৩. 13.  Final report on Environmental Impact Assessment (EIA) of 2x (500-600) MW Coal Based Thermal Power Plant to be Constricted at the Location of Khulna, Submitted by Center for Environmental and Geographic Information Service, Ministry of Water Resources, Dhaka, January 2013, page-6, from https://bit.ly/37XewCw

১৪. মুহাম্মদ, আনু (সম্পাদিত) সর্বজনকথা, ৩য় বর্ষ: ৪র্থ সংখ্যা, ২০১৬। ভারতের এনটিপিসির অংশ্রগ্রহণে সুন্দরবনবিনাশী রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়ে বাংলাদেশের নাগরিকদের পক্ষ থেকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি। পৃষ্ঠা-১৭।

১৫. মোস্তফা, কল্লোল ‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র যে কারণে সুন্দরবনের জন্য বিপজ্জনক’, ১৯ মার্চ, ২০১৬, https://bit.ly/3r7N2S9

১৬. Final report on Environmental Impact Assessment (EIA],page-259, from 

https://bit.ly/37XewCw

১৭. Final report on Environmental Impact Assessment (EIA) , January 2013, page- 287-288, from  https://bit.ly/37XewCw

১৮. মুহাম্মদ, আনু (সম্পাদিত) সর্বজনকথা, ৩য় বর্ষ: ৪র্থ সংখ্যা, ২০১৬। রামপাল ও ওরিয়ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ সুন্দরবনবিনাশী সকল অপতৎপরতা বন্ধ এবং বিদ্যুৎ সংকটের সমাধানে সাত দফা বাস্তবায়নে ১০-১৩ মার্চ ২০১৬, সুন্দরবন অভিমুখে জনযাত্রা শেষে জাতীয় কমিটির ‘সুন্দরবন ঘোষণা’। পৃষ্ঠা-২০।

১৯. সুন্দরবন রক্ষায় ঢাকা-রামপাল লংমার্চ উপলক্ষে জাতীয় কমিটির বুকলেট, তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎবন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, পিডিএফ, পৃষ্ঠা-৫। দেখুন- https://ncbd.org/?p=779%3E

২০. ঘোষ, বীথি (সংকলন)। সুন্দরবন আন্দোলনের গান-২, সর্বজনকথা। ৫ম বর্ষ: ২য় সংখ্যা, ২০১৯। পৃষ্ঠা-৩৪।

২১. ঘোষ, বীথি (সংকলন)। ২০১৯। সুন্দরবন আন্দোলনের গান, সর্বজনকথা পুস্তিকা সিরিজ-১। পৃষ্ঠা-৪৭।

২২. সুন্দরবন আন্দোলনের গান-২, পৃষ্ঠা-৩৩, প্রাগুক্ত।

২৩. পৃষ্ঠা-৩২, প্রাগুক্ত।

২৪. পার্থ, পাভেল। ২০১৬। ‘বাদাবনের বিজ্ঞান’, সর্বজনকথা, ৩য় বর্ষ: ১ম সংখ্যা, পৃষ্ঠা-২৯, ৩২।

২৫. সুন্দরবন আন্দোলনের গান-২, পৃষ্ঠা-৩৩, প্রাগুক্ত।

২৬. আন্দোলনের গান-২, পৃষ্ঠা-৩২, প্রাগুক্ত। 

২৭. আন্দোলনের গান-২, পৃষ্ঠা-৩২, প্রাগুক্ত।

২৮. পৃষ্ঠা-৩৪, প্রাগুক্ত ।

২৯. পৃষ্ঠা-৩৬,  প্রাগুক্ত।

৩০. বিস্তারিত দেখুন, কল্লোল মোস্তফা, প্রাগুক্ত।

৩১. সুন্দরবন আন্দোলনের গান-৩, সর্বজনকথা। ৫ম বর্ষ: ২য় সংখ্যা, ২০১৯। পৃষ্ঠা-৫১, প্রাগুক্ত।

৩২. সুন্দরবন আন্দোলনের গান-১, সর্বজনকথা। ৫ম বর্ষ: ১ম সংখ্যা, ২০১৯। পৃষ্ঠা-৫৪, প্রাগুক্ত।

৩৩. আন্দোলনের গান-২, পৃষ্ঠা-৩৩, প্রাগুক্ত।

৩৪. আন্দোলনের গান-১, পৃষ্ঠা-৫৪, প্রাগুক্ত।

৩৫. আন্দোলনের গান-২, পৃষ্ঠা-৩৩, প্রাগুক্ত।

৩৬. সুন্দরবন আন্দোলনের গান-১, পৃষ্ঠা-৫২, প্রাগুক্ত।

৩৭. বরকত, হিমেল। ২০১৭। গানের ঝরাপাতা। বাংলালিপি। পৃষ্ঠা-৬৪। ঢাকা।

৩৮. আন্দোলনের গান-৩, পৃষ্ঠা-৫১, প্রাগুক্ত।

৩৯. আন্দোলনের গান-১, পৃষ্ঠা-৫৪, প্রাগুক্ত।

৪০. আন্দোলনের গান, পৃষ্ঠা-৫৫, প্রাগুক্ত।

৪১. আন্দোলনের গান-৩, পৃষ্ঠা-৫২, প্রাগুক্ত।

৪২. আন্দোলনের গান-১, পৃষ্ঠা-৫৫, প্রাগুক্ত।

৪৩. সূত্র-১০, সেপ্টেম্বর, ২০২০। জাতীয় তথ্য বাতায়ন, বিদ্যুৎ বিভাগ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। https://bit.ly/3r7b53A

৪৪. সুন্দরবন রক্ষায় ঢাকা-রামপাল লংমার্চ উপলক্ষে জাতীয় কমিটির বুকলেট, তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎবন্দও রক্ষা জাতীয় কমিটি। ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩। পিডিএফ, পৃষ্ঠা-৪। দেখুন- https://ncbd.org/?p=779%3E

৪৫. আন্দোলনের গান-২, পৃষ্ঠা-৩৪, প্রাগুক্ত।

৪৬. ভারতের এনটিপিসির অংশ্রগ্রহণে সুন্দরবনবিনাশী রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়ে বাংলাদেশের নাগরিকদের পক্ষ থেকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি। সর্বজনকথা। ৩য় বর্ষ: ১ম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১৬। পৃষ্ঠা-১৭।

৪৭. আন্দোলনের গান-৩, পৃষ্ঠা-৫৩, প্রাগুক্ত।

৪৮. আন্দোলনের গান-২, পৃষ্ঠা-৩৩, প্রাগুক্ত।

৪৯. মুহাম্মদ, আনু। ‘কার সম্পদ কার হাতে’, মে ২১, ২০১৪, প্রথম আলো। বিস্তারিতদেখুন https://www.anumuhammad.net/article/52-2014-09-20-08-49-31

৫০. বরকত, হিমেল। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা-৬৪।

৫১. আন্দোলনের গান-১, পৃষ্ঠা-৫৪, প্রাগুক্ত।

৫২. আন্দোলনের গান-৩, পৃষ্ঠা-৫৩, প্রাগুক্ত।

৫৩. আন্দোলনের গান-১, পৃষ্ঠা-৫৪, প্রাগুক্ত।

৫৪. পৃষ্ঠা-৫৪, প্রাগুক্ত।

৫৫. পৃষ্ঠা-৫৬, প্রাগুক্ত।

৫৬. পৃষ্ঠা-৩৫, প্রাগুক্ত।

৫৭. আন্দোলনের গান-২, পৃষ্ঠা-৩৩, প্রাগুক্ত।

৫৮. আন্দোলনের গান-৩, পৃষ্ঠা-৫১, প্রাগুক্ত।

৫৯. পৃষ্ঠা-৫৩, প্রাগুক্ত।

৬০. পৃষ্ঠা-৫১, প্রাগুক্ত।

৬১. আন্দোলনের গান-১, পৃষ্ঠা-৫২, প্রাগুক্ত।

৬২. Former Coal-fired power plant is demolished in Germany. 2019, February 17, AP News.see also- https://apnews.com/article/da12ece9c1e54045b257ff7e161dc364

৬৩. আন্দোলনের গান-২, পৃষ্ঠা-৩৪, প্রাগুক্ত।

৬৪. আন্দোলনের গান-৩, পৃষ্ঠা-৫১, প্রাগুক্ত।

৬৫. আন্দোলনের গান-২, পৃষ্ঠা-৩৩, প্রাগুক্ত।

৬৬. মুহাম্মদ, আনু। ‘সুন্দরবন থেকে বঙ্গোপসাগর’, ফেব্রæয়ারি ২০, ২০১৪, প্রথম আলো। দেখুন- https://www.anumuhammad.net/article/53-2014-09-20-08-56-13

৬৭. আন্দোলনের গান-২, পৃষ্ঠা-৩৪, প্রাগুক্ত।

৬৮. পৃষ্ঠা-৩৫, প্রাগুক্ত।

৬৯. আন্দোলনের গান-১, পৃষ্ঠা-৫৩, প্রাগুক্ত।

৭০. আন্দোলনের গান-২, পৃষ্ঠা-৩২, প্রাগুক্ত।

৭১. The tale of a revolution made of music, By KENNETH TURAN, FEB. 28, 2003, TIMES STAFF WRITER. Retrieved from https://www.latimes.com/archives/la-xpm-2003-feb-28-et-turan28-story.html

৭২. আন্দোলনের গান-১, পৃষ্ঠা-৫২, প্রাগুক্ত।

৭৩. পৃষ্ঠা-৫২, প্রাগুক্ত।

৭৪. আন্দোলনের গান-২, পৃষ্ঠা-৩৩, প্রাগুক্ত।

৭৫. আন্দোলনের গান-১, পৃষ্ঠা-৫৫, প্রাগুক্ত।

৭৬. সর্বজনকথা পুস্তিকা সিরিজ-১। পৃষ্ঠা-৪৭। প্রাগুক্ত।

৭৭. আন্দোলনের গান-১, পৃষ্ঠা-৫৪, প্রাগুক্ত।

৭৮. পৃষ্ঠা-৫৪, প্রাগুক্ত।

৭৯. পৃষ্ঠা-৫২, প্রাগুক্ত।

৮০. সর্বজনকথা পুস্তিকা সিরিজ-১। পৃষ্ঠা-৪৭, প্রাগুক্ত।

৮১. আন্দোলনের গান-১, পৃষ্ঠা-৫৪, প্রাগুক্ত।

৮২. পৃষ্ঠা-৩৫, প্রাগুক্ত।

৮৩. আন্দোলনের গান-২, পৃষ্ঠা-৩৬, প্রাগুক্ত।

৮৪. আন্দোলনের গান-১, পৃষ্ঠা-৫১, প্রাগুক্ত।

৮৫. আন্দোলনের গান-২, পৃষ্ঠা-৩৩, প্রাগুক্ত।

৮৬. আন্দোলনের গান-৩, পৃষ্ঠা-৫১, প্রাগুক্ত।

৮৭. আন্দোলনের গান-৪, পৃষ্ঠা-৬৮, প্রাগুক্ত।

৮৮. আন্দোলনের গান-১, পৃষ্ঠা-৫১, প্রাগুক্ত।

৮৯. আন্দোলনের গান-২, পৃষ্ঠা-৩২, প্রাগুক্ত।

৯০. পৃষ্ঠা-৩৫, প্রাগুক্ত।

৯১. পৃষ্ঠা-৩৬, প্রাগুক্ত।

৯২. যে কারণে আমাজনে দাবানল। আনলাইন ডেস্ক। দেশ রূপান্তর। বিস্তারিত দেখুন- https://www.deshrupantor.com/amp/international/2019/08/23/163041

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •