ভারতে বৌদ্ধধর্মের অধোগমন

ডি.ডি. কোসাম্বীর দৃষ্টিতে

ভারতে বৌদ্ধধর্মের অধোগমন

অনুবাদ: চৌধুরী মুফাদ আহমদ

দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বী (ডি.ডি.কোসাম্বী) (৩১ জানুয়ারী ১৯০৭- ২৯ জুন ১৯৬৬)  একজন বহুমুখী ও অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ব্যক্তি ছিলেন। গণিত, পরিসংখ্যান, ভাষাতত্ত্ব, জেনেটিক্স ও ইতিহাস ছিল তাঁর আগ্রহের এলাকা। তিনিই প্রথম মার্কসীয় বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে ভারতের প্রাচীন ইতিহাস ব্যাখ্যা করে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ভারতীয় ইতিহাস চর্চায় মার্কসবাদী ঘরানার তিনি গুরুস্থানীয়। বিখ্যাত ভারতীয় ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার তাঁর উপর কোসাম্বীর প্রভাব সম্পর্কে  বলতে গিয়ে বলেছেন যে, প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস বিশ্লেষণের সময় অবধারিতরূপে গৃহীত ব্যাখ্যার বাইরে (beyond the obvious) চিন্তা করতে কোসাম্বীর রচনা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে। কোসাম্বী ভারতের ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতির উপর অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। তাঁর দুটি প্রধান গ্রন্থ An Introduction to the Study of Indian History এবং The Culture and Civilization of India in Historical Outline ভারতে ইতিহাস চর্চায় একটি নতুন ধারা সুচনা করার জন্য উল্লেখযোগ্য।

তাঁর বর্তমান প্রবন্ধটি টাইমস্‌ অফ ইন্ডিয়া-য় ১৯৫৬ সালের ২৪ মে তারিখে “Buddhism history” শিরোনামে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে তিনি The Decline of Buddhism in India শিরোনাম দিয়ে প্রবন্ধটিতে সামান্য পরিবর্তন করেন। প্রবন্ধটি Exasperating Essays – Marxists Internet Archive থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

চৈনিক পরিব্রাজক হিয়ুয়েন সাঙ  (৬৩০ খ্রিস্টাব্দ) ভারতের একটি কর্দমাক্ত স্থানে পরিত্যক্ত একটি বৌদ্ধমূর্তি ডুবে থাকতে দেখেছিলেন। তিনি স্থানীয় ভবিষ্যতবাণী শুনেছিলেন যে, এই মূর্তিটি যেদিন কাদার নিচে সম্পূর্ণ তলিয়ে যাবে সেদিন বুদ্ধের ধর্ম সম্পুর্ণ বিলুপ্ত হবে। বাংলার রাজা শশাঙ্ক* পরিকল্পিতভাবে বৌদ্ধ ধর্মীয় স্থাপনাসমূহ ধ্বংস করেছিলেন এবং গয়ায় যে পবিত্র বৃক্ষের নিচে সেই সময়ের  বারো শতাব্দী পূর্বে বুদ্ধ আলোকিত জ্ঞান বা বোধি অর্জন করেছিলেন সেই বৃক্ষ কেটে পুড়িয়ে দেন।

অশোকের সর্বশেষ বংশধর পুমাবর্মণ বৃক্ষটির একটি অঙ্কুর খুঁজে বের করে শীঘ্রই গাছটিকে যত্ন করে পরিপূর্ণ বৃক্ষে পরিণত করেন। হর্ষ§ শশাঙ্ককে বিতারিত করেন, ধ্বংসপ্রাপ্ত বৌদ্ধ স্থাপনাগুলো পুনর্নির্মাণ করেন এবং বহু নতুন স্থাপনা নির্মাণ করেন। তখনও হাজার হাজার বৌদ্ধ মঠে অসংখ্য বৌদ্ধ সন্তের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হতো। সমৃদ্ধশালী নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তখন তার খ্যাতির শীর্ষে ছিল। সব ভালই চলছিল।

কিন্তু আসল ক্ষতিটা হয়েছিল ভেতর থেকে এবং সেই একই চৈনিক পরিব্রাজকের বর্ণনা থেকে তা উপলব্ধি করা যায়, যদিও তার কথার তাৎপর্য সম্পর্কে  তিনি হয়তো সচেতন ছিলেন না:

‘(যে বৌদ্ধ পণ্ডিত) তিন শ্রেণীর পবিত্র গ্রন্থ ব্যাখ্যা করতে পারেন তাঁর নিকটে থাকার ও তাঁর আদেশ পালনের জন্য একজন ভৃত্য দেয়া হতো ।… যিনি পাঁচ শ্রেণী ব্যাখ্যা করতে পারতেন তাঁকে একটি হাতীতে টানা গাড়ি দেয়া হতো। যিনি ছয় শ্রেণীর ধর্মগ্রন্থ ব্যাখ্যা করতে পারতেন তাঁকে ঘিরে থাকার জন্য রক্ষীদল দেয়া হতো। বিতর্ক সভায় পরিশীলিত ভাষা, নিগূঢ় তত্ত্বানুসন্ধান, গভীর বিচক্ষণতা এবং প্রখর যুক্তিবিদ্যার দ্বারা যিনি নিজেকে বিশিষ্ট প্রমাণ করতে পারতেন তাঁকে একটি অলঙ্কার-সজ্জিত হাতীর পিঠে তুলে অসংখ্য অনুচরবৃন্দ পরিবেষ্টিত অবস্থায় মঠের প্রবেশ দ্বারে নিয়ে নিয়ে আসা হতো।

অপর দিকে বিতর্কের সময় কেউ যুক্তির খেই হারিয়ে ফেললে অথবা সুরুচিবিরোধী কোন বাক্য ব্যবহার করলে অথবা ন্যায়শাস্ত্রের কোন রীতি ভঙ্গ করলে তার মুখে লাল-সাদা রঙ মাখিয়ে, দেহে ধুলা-ময়লা আবৃত করে কোন বিরান এলাকায় বা কোন খাদে ফেলে দিয়ে আসা হতো। এভাবেই তারা মেধাবী ও অপদার্থদের মধ্যে, জ্ঞানী ও মূর্খের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করতো।’

বুদ্ধের সময়ে নিশ্চয়ই প্রতিভা যাচাইয়ের পদ্ধতি এমন ছিল না।  সদা-বিচরণশীল ভিক্ষুদের আদি কাজ ছিল যথাসম্ভব সহজ ভাষায়, সাধারণ মানুষের ভাষায় সত্যের পথ ব্যাখ্যা করা করা। সমৃদ্ধ মঠগুলোর বাসিন্দা এই তর্কপ্রবণ নতুন শ্রেণী, যাদের উদ্ধৃত পণ্যে তারা বিলাসি জীবন যাপন করতো সেই গ্রামের মানুষকে নিয়ে মোটেই চিন্তিত ছিল না। বুদ্ধের মূল নীতি অনুযায়ী একজন ভিক্ষুকে অতি সামান্য সম্পত্তি রাখার অনুমতি দেয়া হয়েছে এবং স্বর্ণ, রৌপ্য ও অলঙ্কারাদি স্পর্শ করা তাঁদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ অজন্তার গুহাচিত্রে বুদ্ধমুর্তিগুলো রত্নখচিত মুকুট পরিহিত অবস্থায়, মহামূল্যবান সিংহাসনে উপবিষ্ট দেখানো হয়েছে।

প্রাচীন বৌদ্ধধর্ম অশোককে যুদ্ধের পথ থেকে শান্তির পথে ফিরিয়ে এনেছিল। তাঁর অনুশাসনগুলোতে বলা আছে যে, সেনাবাহিনী এখন থেকে কেবল প্রদর্শনী ও কুচকাওয়াজের জন্য ব্যবহৃত হবে। অপরদিকে ধর্মপ্রাণ সম্রাট হর্ষ বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে যুদ্ধের সম্মিলন ঘটান, যেরূপ তিনি বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে তাঁর সূর্যদেবতা ও মহেশ্বর উপাসনার মিলন সাধন করেছিলেন। ত্রিশ বছরের একটানা আগ্রাসী যুদ্ধ-বিগ্রহে হর্ষের সেনাবাহিনী বৃদ্ধি পেয়ে ৬০ সহস্র হাতী, ১ লক্ষ অশ্বারোহী সৈন্য, এবং আরো অধিক সংখ্যক পদাতিক সৈন্যে দাঁড়ায়। হর্ষ তাঁকে হত্যা করতে আসা একজন আততায়ীকে পরাভূত ও নিরস্ত্র করেছিলেন, সমবেত রাজা ও অভিজাতগণ তার মৃত্যুদণ্ড দাবী করলেও একজন খাঁটি বৌদ্ধের মতো হর্ষ তাকে ক্ষমা করেছিলেন। অবশ্য সাধারণ মানুষ, যারা তাঁর যুদ্ধের ও জাঁকজমকপূর্ণ বিজয় সমাবেশের ব্যয় নির্বাহ করতো, সেই আততায়ীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েও তিনি যদি যুদ্ধক্ষেত্রে একটু কম মানুষকে হত্যা করতেন হয়তো সেটিই পছন্দ করতো। 

এক অর্থে বৌদ্ধ ধর্ম অলাভজনক হয়ে পড়েছিল। অসংখ্য মঠ ও সেগুলোতে লালিত পালিত বাসিন্দারা ব্যয়বহুল সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিরূপে পরিণত হয়েছিল। বৌদ্ধধর্ম গোড়া থেকেই সার্বভৌমিক রাজতন্ত্র উদ্ভবের পক্ষে ছিল যা ছোটখাট যুদ্ধ বন্ধ করবে। বুদ্ধ ছিলেন চক্রবর্তী, সম্রাটের আধ্যাত্মিক প্রতিরূপ। কিন্তু এসব বিশাল, ব্যক্তিগতভাবে পরিচালিত সাম্রাজ্য নিজেরাই অলাভজনক হয়ে পড়েছিল। হর্শ এধরণের শেষ সম্রাট ছিলেন। এরপর থেকে সামন্তবাদী ব্যবস্থায় সামন্তদের ভূমি-মালিকানার উদ্ভব হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রাজ্যগুলো ছিল অনেক ছোট আকারের। এরপর রাষ্ট্রপ্রশাসন ধীরে ধীরে নীচে সামন্ততন্ত্রের হাতে চলে যায়।

সঠিকভাবে বলতে গেলে তৎকালীন একটি ব্যাপক সামাজিক প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হয়েছিল বলেই প্রথমদিকে বৌদ্ধধর্ম সফল হয়েছিল। ষষ্ঠ শতাব্দীতে গাঙ্গেয় অববাহিকা শান্তিপূর্ণ স্বনির্ভর গ্রামে বিভক্ত ছিল না। অনেক কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত এসব অঞ্চল পরস্পর দ্বন্দ্বমুখর আধা-উপজাতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এসব উপজাতির অনেকগুলোই তখনও লাঙল দিয়ে কৃষি উৎপাদনের স্তরে পৌছায় নি।

প্রতিবেশীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত পশুচারী উপজাতিগুলোর উপাসনার ধারা বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদের সঙ্গে খাপ খেতো। কিন্তু উঠতি কৃষি অর্থনীতির জন্য বৈদিক যজ্ঞে পশু বলি দেয়া নিতান্তই দুর্বহ ছিল। তাছাড়া মৌর্য-পূর্ব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জনপদগুলোকে দূরবর্তী এলাকার সঙ্গে ধাতু, লবণ এবং কাপড়ের জন্য লেনদেন করতে হতো, যা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের সুরক্ষা ছাড়া করা সম্ভব ছিল না। একদল উপজাতি থেকে একটি সর্বজনীন সমাজে উত্তরণের জন্য তাই একটি নতুন সামাজিক দর্শনের প্রয়োজন ছিল।

        সার্বভৌম  রাজতন্ত্র ও সর্বজনীন  সমাজের ধর্ম যে সমান্তরালভাবে বিকশিত  হয়, মগধে একই সময়ে এই দুটি জিনিষ বিকশিত হওয়ার মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয়েছিল । কেবল বৌদ্ধধর্ম নয়, সমসাময়িক মগধে আরো অনেক ধর্মসম্প্রদায় একই বিষয় প্রচার করেছিল: জৈন, আজীবিক ও অন্যন্যরা সবাই বৈদিক যজ্ঞের বৈধতা ও হত্যার  প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করেছিল। বৌদ্ধধর্ম বন্য উপজাতি অধ্যুষিত একটি অরণ্যময় দেশে প্রথম বণিকদলকে সুরক্ষা দিয়েছিল এবং তাদের সহযাত্রী হয়েছিল। জুনার, কারলা, অজন্তা, এবং আদি বাণিজ্যপথের সঙ্গমস্থলে অবস্থিত অন্যন্য প্রাচীন স্তম্ভগুলো থেকে তাই বোঝা যায়।

        ভারতীয় সমাজকে সভ্য করার ক্ষেত্রে বৌদ্ধধর্মের প্রধান ভূমিকা সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে শেষ হয়ে যায়। ততদিনে অহিংস নীতি সর্বত্র পালিত না হলেও সর্বত্র স্বীকৃত। বৈদিক যজ্ঞ পরিত্যাগ করা হয়েছে। কেবল বিরল কিছু ক্ষুদ্র নৃপতি যজ্ঞ চালু রাখলেও তাঁদের এই পুনরুত্থানবাদী চেষ্টার অতি সামান্য প্রভাবই পড়েছিল সাধারণ অর্থনীতির উপর। তখন নতুন সমস্যা ছিল বেশি বলপ্রয়োগ না করে গ্রামীণ কৃষিজীবীদের মধ্যে আনুগত্যবোধ তৈরি করা। এই কাজটি বৌদ্ধ মতবাদ দিয়ে করা হয়নি, করা হয়েছিল ধর্ম দিয়ে । গ্রামে বর্ণ রূপে যে শ্রেণী কাঠামো গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধরা তা সর্বদা ঘৃণা করেছে। এখন আদিম উপজাতিদের নতুন বর্ণ হিসেবে সমাজে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। উপজাতি এবং কৃষক উভয়েই নানা আচারের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল, যা আবার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। আচার-অনুষ্ঠান ছিল ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া বিষয়।

তখন উৎপাদনে কর্মপ্রেরণা যোগানোতে ব্রাহ্মণের একটি অগ্রণী ভূমিকা ছিল। কারণ লাঙল চালানোর, বীজ বপনের বা ফসল তোলার সঠিক সময় সম্পর্কে পূর্বাভাষ দেয়ার মতো একটি কার্যকর বর্ষপঞ্জি তার আয়ত্তে ছিল। নতুন শস্য সম্পর্কে ও বাণিজ্য সম্ভাবনা সম্পর্কেও তার ধারণা ছিল।

        এছাড়া তখন উৎপাদনে কর্মপ্রেরণা যোগানোতে ব্রাহ্মণের একটি অগ্রণী ভূমিকা ছিল। কারণ লাঙল চালানোর, বীজ বপনের বা ফসল তোলার সঠিক সময় সম্পর্কে পূর্বাভাষ দেয়ার মতো একটি কার্যকর বর্ষপঞ্জি তার আয়ত্তে ছিল। নতুন শস্য সম্পর্কে ও বাণিজ্য সম্ভাবনা সম্পর্কেও তার ধারণা ছিল। তার যজ্ঞকারী পূর্বসূরিদের মতো অথবা বৃহৎ বৌদ্ধ মঠগুলোর মতো সে উৎপাদনে ভাগ বসাতো  না। এছাড়া এসময় বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার বানিয়ে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে একটা আপোষ করাও সম্ভব হয়েছিল। তাই আনুষ্ঠানিক বৌদ্ধধর্ম এসময় অনিবার্যভাবে বিবর্ণ হয়ে পড়ে। 

তবে বৌদ্ধধর্মের মূল শিক্ষা কখনো হারিয়ে যাওয়া উচিত নয়: গান গাইবার জন্য যেমন গলার বা কারুনৈপুণ্যের জন্য যেমন হাতের তেমনি উত্তম চিন্তার জন্য ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় মনের কর্ষণ ও প্রশিক্ষণ দরকার। অপরদিকে চিন্তার মূল্য বিচার করতে হবে তার দ্বারা কতটুকু সামজিক অগ্রগতি অনুপ্রাণিত হয় তার দ্বারা।

চৌধুরী মুফাদ আহমদ: লেখক, অনুবাদক। ইমেইল: mufad.dhaka@gmail.com

*শশাঙ্ক ( ৫৯০-৬৩৮ খ্রীস্টাব্দ ) গৌড়ের রাজা।

  • হর্ষবর্ধন (৫৯০–৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ) উত্তর ভারতের খ্যাতনামা সম্রাট।
Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •