নারীর বোরকা, বোরকার নারী

নারীর বোরকা, বোরকার নারী

আনু মুহাম্মদ

বাংলাদেশে, বিশেষত ঢাকা মহানগরীসহ বিভিন্ন শহরে, বিভিন্ন মাদ্রাসাসহ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কারখানা, অফিস-আদালতে, পথে, বাসে, সভা-সমাবেশে দুই দশক আগের চেয়ে নারীর উপস্থিতি এখন অনেক বেশি। আর সেই নারীর মধ্যে ক্ষুদ্র একটি অংশ বাদে বাকি সবাই এখন কোনো-না-কোনো ধরনের বোরকা বা হিজাব পরেন, যাদের মধ্যে কিশোরী-তরুণীর সংখ্যাই বেশি। প্রকৃতপক্ষে গত ১০ বছরে এই অবস্থার এমন ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে যে, পথঘাট, প্রতিষ্ঠান, মানুষ সবকিছু যেন পুরোই বদলে গেছে। এই বদলের কারণ কী? অনুসন্ধানে দেখা যাবে, এই পরিবর্তনের ধারা শুরু হয়েছে কয়েক দশক আগেই। এ রকম সময়েরই একটি লেখা এটি। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে এটি এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।

আমার মাকে কখনো বোরকা পরতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তিনি মাথায় কাপড় দিতেন, নীল সাদা শাড়ি পরতেন। তিনি নামাজ পড়তেন নিয়মিত। আগে এক রকম বোরকা ছিল আপাদমস্তক, চোখের জায়গায় দেখার জন্য কয়েকটি ছিদ্র, পোশাকটি ছোটদের ভয় পাওয়ার মতোই। শৈশবে আমার মা দুষ্টুমি করে আমাকে এ রকম পোশাক দেখিয়ে ভূতের কথা বলেছিলেন, সেটাও মনে আছে। আমার নানি বা দাদি, যারা প্রধানত গ্রামেই থাকতেন, তাঁরাও বোরকা পরেছেন বোধহয় হাতে গোনা কদিন, বিশেষ কোথাও যাওয়ার সুবাদে। বোরকাকে পোশাক হিসেবে আমার মা, নানি বা দাদি কেউই গ্রহণ করেননি। কিন্তু তাঁরা পর্দানশীনই ছিলেন।

মা, নানি, দাদি না করলেও বোরকাকে স্থায়ী পোশাক হিসেবে গ্রহণ করেছে আমার বড় বোন। আমার মায়ের মৃত্যুর চার বছর পর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়, চারদিকে তখন পাকবাহিনী ও রাজাকার-আলবদরদের জন্য কিশোরী-তরুণী মেয়েদের নিয়ে আতঙ্ক, সে সময়ই পরিস্থিতির চাপে তাড়াহুড়ো করে আমার এই বোনের বিয়ে দেওয়া হয়। আমার বোন তখন ক্লাস টেনের ছাত্রী। আমার বাবার পীর জরুরি ভিত্তিতে আমার বোনকে বিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন, তাবলিগি পাত্রও ঠিক করে দিলেন। তাঁর তরিকার মানুষ। আমার বোন সে সময় পর্যন্ত বোরকা খুবই অপছন্দ করতেন। কিন্তু তিনি যে বাড়িতে গিয়ে উঠলেন, সেখানে কিশোরী বয়সের মেয়েরাও বোরকা ছাড়া চলে না। অপছন্দ থেকে স্থায়ী পোশাক হিসেবে বোরকা গ্রহণের প্রক্রিয়াটি তাঁর জন্য শান্তিপূর্ণ হয়েছিল, না সংঘাত আর অশান্তির মধ্য দিয়ে তাঁকে এই পর্বে যেতে হয়েছিল, তা আমি জানি না। কিন্তু ক্রমে আমরা দেখেছি, আমার বোন বোরকার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হয়ে গেছে। বোরকার সঙ্গে ক্রমে যুক্ত হয়েছে হাত ও পায়ের মোজা। আমাদের অনেক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনও আর ওর চেহারা দেখতে পারে না।

ওর এই অবস্থা ক্রমে আমার ভাগনিদের মধ্যেও প্রবাহিত হয়েছে। আমার ভাগনিরা ৮-১০ বছর বয়স থেকেই বোরকা ও হাত-পায়ে মোজা না পরে বাইরে আসে না। ওরা সামনে আসে খুবই কম, সামনে পড়ে গেলে বোরকা একটু সরিয়ে সালাম দেওয়ার পর সব ভাগনিই প্রথম, কখনো কখনো একমাত্র, যে বাক্যটি উচ্চারণ করে তা হলো: ‘নামাজ পড়েন, মামা।’ বোরকা ওদের সীমাবদ্ধ, আটকে থাকা জীবনের প্রতীক হয়ে আছে।

২.

আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, তখন সহপাঠিনীর মধ্যে কেউ কেউ মাথায় কাপড় দিত; কিন্তু কাউকে বোরকা পরতে দেখিনি। এখন আমার ছাত্রীদের কেউ কেউ বোরকা পরে। এ রকম অনেক ছাত্রীকেই চেহারা দেখলে আমি চিনব না। কারণ, তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে অনেকই, কিন্তু তাদের কারো চেহারা দেখিনি। হয়তো ওদের চিনতে হবে বোরকা দেখেই। এ রকমও হয়েছে, পড়াশোনা শেষ করে পশ্চিমা দেশে যাওয়ার পরই কেউ কেউ বোরকা পরা শুরু করেছে। এখন তাদের এমনকি শিক্ষকের (যদি পুরুষ হয়) সামনে আসাও সম্ভব নয়।

তবে আমার বোরকাপরা ছাত্রী মানেই স্থবির নয়, তারা সচল। তাদের কেউ কেউ বেশ মেধাবী, মেধাচর্চায় তারা অনলস। কেউ কেউ ধর্ষণবিরোধীসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামেও সক্রিয়। ওদের অনেকেই এটা প্রমাণ করেছে যে, বোরকা মানেই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী বা যুদ্ধাপরাধী রাজনীতি নয়। বোরকা না-থাকা মানেই এসবের বিরোধী রাজনীতিও নয়।

তবে আমার বোরকাপরা ছাত্রী মানেই স্থবির নয়, তারা সচল। তাদের কেউ কেউ বেশ মেধাবী, মেধাচর্চায় তারা অনলস। কেউ কেউ ধর্ষণবিরোধীসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামেও সক্রিয়। ওদের অনেকেই এটা প্রমাণ করেছে যে, বোরকা মানেই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী বা যুদ্ধাপরাধী রাজনীতি নয়। বোরকা না-থাকা মানেই এসবের বিরোধী রাজনীতিও নয়।

আমার মা যে রকম বোরকা দেখিয়ে ছোটবেলায় আমাকে ভয় দেখাতেন, সে রকম এক কাপড়ের বোরকা এখন খুব কমই দেখা যায়। কিন্তু বোরকা দেখা যায় আগের তুলনায় অনেক বেশি। বোরকার এখন বৈচিত্র্য এসেছে। বোরকা এখন এক রং বা এক কাপড়ের নয়। রাস্তায় এখন বিজ্ঞাপন দেখা যায়: সৌদি, পাকিস্তানি বা ইরানি বোরকার। বোরকার বাইরে এখন যার ব্যবহার খুবই বেড়েছে তা হলো, এক রকম বড় চাদরের ব্যবহার। এই চাদর ‘সৌদি’ বা ‘ইরানি’ হিসেবে বিজ্ঞাপিত হয়। এগুলো এখন ব্যবসার উপাদান হিসেবে বেশ লাভজনক।

বোরকা বা চাদরের এই ব্যবহার বৃদ্ধিকে আমরা কীভাবে দেখব? অনেকে একে ‘মৌলবাদের’ বিস্তার বলে আশঙ্কা প্রকাশ করতে পারেন কিংবা কেউ কেউ এটাকে ইসলামি আন্দোলনের সাফল্য বলে আনন্দ প্রকাশ করতে পারেন। কেউ ভাবতে পারেন, এর মাধ্যমে নারীর পশ্চাদপসরণ ঘটছে, অবরোধে নারী আটকে যাচ্ছে; কেউ ভাবতে পারেন, এর মাধ্যমে নারী আদর্শ ইসলামি নারীর ভাবমূর্তিই গ্রহণ করছে। এমনও কেউ ভাবতে পারেন যে, বোরকার এই ব্যবহার বৃদ্ধি ‘পশ্চিমা’ আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক লড়াই। আমার কাছে বিষয়টা এত সরল মনে হয় না।

৩.

বোরকা মানেই মুসলিম পোশাক নয়, বোরকা মানেই অপশ্চিমি পোশাকও নয়। বোরকার মতো পোশাক পশ্চিমেই বরং আগে ব্যবহার হয়েছে, নারীর অবরোধের জন্যই। খ্রিষ্টান, ইহুদি পরিবারগুলোতেই বোরকার প্রচলন দেখা গেছে বেশি। প্রাচ্যে, বাংলায় বোরকা কখনোই সব নারীর পোশাক ছিল না। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে এটি সম্পদশালী অভিজাত পরিবারে নারীর পোশাক হিসেবেই ব্যবহার হয়েছে। সংখ্যায় যারা ছিলেন খুবই কম। অনেক মুসলিম পরিবার আজকাল পশ্চিমে গিয়ে খ্রিষ্টীয় আধিপত্যের পালটা নিজের পরিচয় দাঁড় করানোর জন্য নিজেদের পরিবারে বোরকা ব্যবহারে সক্রিয় হয়েছে। পশ্চিম থেকে এই বোরকার বিস্তার ঘটেছে এখানেও। পরিচয়ের সমস্যা সমাধানের এই পথ শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াচ্ছে সেটাও লক্ষণীয়, কিন্তু সেটা ভিন্ন এক বিস্তৃত আলোচনা।

বোরকা সবাই যে এক কারণে না-ও পরতে পারেন, সেটা আমরা অনেক সময় খেয়াল করি না। বোরকা পরার সঙ্গে সবসময় যে বোরকা পরছে তার নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস বা মতাদর্শ সম্পর্কিত থাকে না, সেটা এমনিতে খেয়াল না করলেও আমাদের চারপাশে একটু ভালো করে তাকালেই হয়তো আমরা বুঝতে পারব। পাঁচটি কারণে বোরকা একজন নারীর জন্য নিয়মিত পোশাক হয়ে উঠতে পারে: (১) আত্মরক্ষা বা আশ্রয়, (২) বিশ্বাস, (৩) জবরদস্তি, (৪) পছন্দ ও (৫) আভিজাত্য অর্জন।

বোরকা সবাই যে এক কারণে না-ও পরতে পারেন, সেটা আমরা অনেক সময় খেয়াল করি না। বোরকা পরার সঙ্গে সবসময় যে বোরকা পরছে তার নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস বা মতাদর্শ সম্পর্কিত থাকে না, সেটা এমনিতে খেয়াল না করলেও আমাদের চারপাশে একটু ভালো করে তাকালেই হয়তো আমরা বুঝতে পারব। পাঁচটি কারণে বোরকা একজন নারীর জন্য নিয়মিত পোশাক হয়ে উঠতে পারে: (১) আত্মরক্ষা বা আশ্রয়, (২) বিশ্বাস, (৩) জবরদস্তি, (৪) পছন্দ ও (৫) আভিজাত্য অর্জন।

এখানে কয়েকটি ঘটনার কথা বলি। আমার এক ছাত্রী পুরো শিক্ষাজীবন বোরকা পরে শেষ পরীক্ষা দেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় যখন বোরকা ছাড়াই বিদায় নিতে এলো, তখন বিস্ময়ের সঙ্গে শুনলাম ওর এতদিন বোরকা পরার কারণ। জিজ্ঞাসা করতে হয়নি, নিজের আগ্রহেই বলল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগেই ওর বিয়ে হয়েছিল। স্বামীর সঙ্গে ওর সম্পর্ক প্রথম থেকেই ভালো ছিল না। স্বামী ওর উচ্চশিক্ষারও বিরোধী ছিল। স্বামীর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ না-করার কারণে ‘শান্তি’ টিকল না। সম্পর্ক ভেঙে গেল। শিক্ষা অব্যাহত রাখা তখন আর জ্ঞানান্বেষণের ব্যাপারমাত্র নয়, তা তখন হয়ে দাঁড়িয়েছে তার বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রধান অবলম্বন। কিন্তু বাবা, আত্মীয়স্বজন এর বিরোধী, বিরক্তও বটে। সুতরাং এখানে তাকে লড়তে হলো, কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হলো: একাই চলতে হবে।

কিন্তু চলতে গেলে তো শুধু মনের বল দিয়েই হয় না। টাকাপয়সাও লাগে। সুতরাং টিউশনি। একের পর এক পরীক্ষা, পড়াশোনা ইত্যাদির মধ্যে চলতে হলো জান-প্রাণ দিয়ে। মাঝেমধ্যে টিউশনি থাকে না, তার জন্য কিছু সঞ্চয় রাখতে হয়। কয়েকটি কাপড় আর মাঝেমধ্যে অনাহার, এ নিয়েই চলল পুরো শিক্ষাজীবন। কিন্তু পরিশ্রম দিয়েই কি একটি মেয়ে নিজের জীবন গড়তে পারে? তার তো আরও অনেক বাধার মুখোমুখি হতে হয়। টিউশনি করতে গেলে তাকে যেতে হয় নানা জায়গায়। সময় সমস্যা হয়, হলের নিয়মকানুন টেকে না। রাস্তা, পার্শ্ববর্তী গ্রাম দিয়ে হাঁটতে গিয়ে তাকে প্রতিদিন যেন যুদ্ধ করতে হয়। পরীক্ষার আর শেষ নেই। সবচেয়ে অসুবিধা হলো যখন ছাত্রদের হলের পাশ দিয়ে টিউশনির জন্য পাশের গ্রামের এক বাড়িতে যাওয়ার প্রয়োজন হলো। মেয়েটি যখন খেয়ে না-খেয়ে নিজে টিকে থাকার জন্য মাইল হাঁটা শুরু করে হলের পাশ দিয়ে যেত, তখন ছাত্রদের দুপুরের অবসর। বিভিন্ন তলার ছাত্ররা তখন একজন ছাত্রীকে অনেকক্ষণ ধরে নানাভাবে দেখা ও মজা করার সুযোগ ছাড়বে কেন? অসহ্য হয়ে উঠল। এ সময়েই একজনের পরামর্শে তার বোরকা গ্রহণ। নিজেকে ঢেকে ফেলল, ও আড়াল করতে চাইল যাবতীয় আগ্রাসন থেকে। বাইরের ক্লেদকে অন্তত এভাবেই ঠেকানোর চেষ্টা। বাইরের ক্লেদকে সরানোর চেষ্টায় সফল না হলে তা থেকে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা কতটা সফল হয়?

মেয়েটি যখন খেয়ে না-খেয়ে নিজে টিকে থাকার জন্য মাইল হাঁটা শুরু করে হলের পাশ দিয়ে যেত, তখন ছাত্রদের দুপুরের অবসর। বিভিন্ন তলার ছাত্ররা তখন একজন ছাত্রীকে অনেকক্ষণ ধরে নানাভাবে দেখা ও মজা করার সুযোগ ছাড়বে কেন? অসহ্য হয়ে উঠল। এ সময়েই একজনের পরামর্শে তার বোরকা গ্রহণ। নিজেকে ঢেকে ফেলল, ও আড়াল করতে চাইল যাবতীয় আগ্রাসন থেকে। বাইরের ক্লেদকে অন্তত এভাবেই ঠেকানোর চেষ্টা।

আরেকজন ছাত্রীর কথা বলি। ওর ঘটনাটা একদিক থেকে উলটো। ওকে আগে কখনো বোরকা পরতে দেখিনি। শেষ বছরে একবার একের পর এক ক্লাস, পরীক্ষায়ও নেই। অনেক দিন এভাবে চলার পর আমরা সবাই ধরে নিলাম মেয়েদের সচরাচর যা হয়, পারিবারিক চাপে পড়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। শেষ মুহূর্তে ও এসে হাজির হলো। বোরকা পরা। বিস্মিত হলেও এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি। কিন্তু ও অনেকবার উদ্যোগ নেওয়ার পর সংকোচ কাটিয়ে শেষে নিজের জীবন সম্পর্কে যা বলল, তাতে সমবেদনা জানানোর কোনো জায়গা পাওয়াও কঠিন। স্বামীর সঙ্গে ওর সম্পর্ক ভালো বলেই ওর ধারণা ছিল। স্বামী যখন ওকে হলে থেকে পড়াশোনার ব্যাপারে উৎসাহ দিত, তখন ওর মনে হতো স্বামী ওর পড়াশোনার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। কিন্তু শেষবার ওর এই বিশ্বাস ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। হঠাৎ করে একদিন স্বামীকে অবাক করে দেওয়ার জন্য ও বাসায় গিয়ে হাজির হয়েছিল। গিয়ে স্বামীকে ‘কাজের মেয়ের’ সঙ্গে এমন অবস্থায় সে পেল, যার পর তার বেঁচে থাকার কোনো আগ্রহ ছিল না। সে অপমানের কোনো সীমা নেই। তারপর অসহ্য দিনগুলোর একপর্যায়ে ওর উপলব্ধি: ‘আমারই পাপের শাস্তি এটি। আল্লাহ এভাবেই আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন।’ সুতরাং ‘সঠিক পথ’ বেছে নেওয়ার জন্য ও নিজের জীবন পুরো পালটে ফেলেছে। বোরকা ধরেছে এবং স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চেষ্টা করছে প্রাণপণে। কার পাপে কার শাস্তি? কার কষ্টে কার শান্তি?

অসহ্য দিনগুলোর একপর্যায়ে ওর উপলব্ধি: ‘আমারই পাপের শাস্তি এটি। আল্লাহ এভাবেই আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন।’ সুতরাং ‘সঠিক পথ’ বেছে নেওয়ার জন্য ও নিজের জীবন পুরো পালটে ফেলেছে। বোরকা ধরেছে এবং স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চেষ্টা করছে প্রাণপণে। কার পাপে কার শাস্তি? কার কষ্টে কার শান্তি?

কদিন আগে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর অনেক রকম খুশি, কৃতিত্ব ইত্যাদির খবর আর প্রশস্তির মাঝখানে একটি পত্রিকায় একটি আক্রমণ করা খবর বের হয়। একজন ভ্যানচালকের মেয়ে পঞ্চম হয়েছে। এক ঘরে ভাই-বোন, বাবা-মা জড়াজড়ি করে থাকে। এর মধ্যেই তার পড়াশোনা, থাকা-খাওয়া। যেখানে চারদিকে টিউশনি আর কোচিং ইত্যাদির জয়জয়কার, যেখানে বিশাল অর্থের ঝাঁপি ছাড়া প্রথম বিশ জনের মধ্যে থাকা দূরে থাকুক, ভালো কোনো জায়গায়ই যাওয়া সম্ভব হয় না, সেখানে এই মেয়ে‒ঠিকমতো যে বই-কাগজ-কলম কিনতে পারেনি, সে কীভাবে এ রকম একটা কাজ করল, সেটা ভদ্রলোকদের এক গবেষণার বিষয়ই বটে! কিন্তু এসব বিস্ময় আর গবেষণার আড়ালে মেয়েটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথাও বলেছে। সেটাই এখানে বিশেষভাবে বলা দরকার। মেয়েটি সবসময় বোরকা পরেই স্কুলে যেত। কারণ কী? কারণ, বোরকা না পরলে তার জামা যে একটাই এবং তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা যে খুব খারাপ, সেটা সবাই জেনে ফেলত। তা ছাড়া তার পরিচয় নিয়েও প্রশ্ন উঠত। কিন্তু বোরকা একটা হলে কোনো অসুবিধা নেই। এটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে আসবে না। দূরত্বও থাকবে। সে কারণে বছরের পর বছর সে একটি বোরকা দিয়েই চালিয়েছে।

৪.

শুধু কি দারিদ্র্য, এমনকি নিজেকে, নিজের অস্তিত্ব, নিজের শরীরকে আড়াল করার জন্য, নিজেকে অদৃশ্য করে ফেলার জন্য বোরকার চেয়ে উপযোগী পোশাক আর কী আছে? যে সমাজে আমরা বসবাস করি, সেখানে নারীর পরীক্ষা সারাক্ষণ। চলাফেরা, কথা বলা, হাসি, কাজ, মনোযোগ, আদব সবকিছু নিয়েই সবাই চিন্তিত। এর পর আছে চেহারা, গায়ের রং। চেহারা আর গায়ের রঙের যে ‘আদর্শ মডেল’ সমাজে তৈরি করা আছে, তার সঙ্গে যার মিলবে না, তার জীবনকে দুর্বিষহ করার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা আর নিষ্ঠুরতা এই সমাজে মজুত আছে। এই নিষ্ঠুরতার হাত থেকে বাঁচার জন্য অনেকভাবে চেষ্টা করে নারী। বিজ্ঞাপনের ঝাঁপি এই নিষ্ঠুরতাকে নিজের পণ্য বিক্রিতে ব্যবহার করে। সবাই তার বর্ণ পরিবর্তনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সারাক্ষণ উদ্বেগ‒পাপক্ষয় হলো কি না, সৌন্দর্য তৈরি হলো কি না, পুরুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হলো কি না। পুরুষ গ্রহণ না করলে জীবনের কী সার্থকতা!

নারীর ‘সৌন্দর্যে’র যে মাপকাঠি সমাজে নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই মাপকাঠিতে পাস করে যাওয়া নারী রাস্তায় বের হলে শোনে: ‘খাসা মাল’, ‘মাল একখান’। যে পাস করে না, সে শোনে: ‘কাইল্লা ভূত’, ‘শরীরে কিছু নাই’, ‘চেহারার কী ছিরি’। অন্যদিকে আবার ধর্মের নামে ফতোয়ার লক্ষ্যও সে। নিজের শরীরই তার প্রধান শত্রু। এসব নিষ্ঠুরতার হাত থেকে আত্মরক্ষার আর কিছু না পেয়ে একটা উপায় হিসেবে কেউ কেউ বেছে নেয় বোরকা। এ যেন এক প্রতিশোধ, আত্মহত্যা করে শিক্ষা দেওয়ার মতো। কিন্তু একই কথা, একই বোধ, একই আক্রমণ ঘরের মধ্যেও, নিজের স্বজনদের মধ্যেও আরেকভাবে সারাক্ষণ উচ্চারিত হতে থাকে। সেখানে বোরকা তাকে আড়াল দিতে পারে না।

এসব নিষ্ঠুরতার হাত থেকে আত্মরক্ষার আর কিছু না পেয়ে একটা উপায় হিসেবে কেউ কেউ বেছে নেয় বোরকা। এ যেন এক প্রতিশোধ, আত্মহত্যা করে শিক্ষা দেওয়ার মতো। কিন্তু একই কথা, একই বোধ, একই আক্রমণ ঘরের মধ্যেও, নিজের স্বজনদের মধ্যেও আরেকভাবে সারাক্ষণ উচ্চারিত হতে থাকে। সেখানে বোরকা তাকে আড়াল দিতে পারে না।

অনেকের ক্ষেত্রে এসব আত্মরক্ষামূলক বা আশ্রয়মূলক ব্যবস্থা একপর্যায়ে বিশ্বাসের রূপ নেয়, যৌক্তিকতা দাঁড় করানোর জন্য পুরোপুরি বিশ্বাসের বর্ম দাঁড়িয়ে যায় সামনে। অনেকে পুরোপুরি বিশ্বাস থেকেই বোরকাকে পোশাক হিসেবে গ্রহণ করেন। যারা বিশ্বাস হিসেবে গ্রহণ করেন, তাদের সবার বিশ্বাসের ধাঁচ আবার এক নয়। বিশ্বাসের ধাঁচ আবার অনেক ক্ষেত্রে বোরকার ধরন, বোরকা পরে চলাফেরার ধরন, জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, না-গ্রহণকেও নির্ধারণ করে।

যারা নারীর অবরোধবাসকেই তার নিয়তি বা দায়িত্ব বলে মনে করেন, তাদের দৃষ্টিতে বোরকা হলো নারীকে চলনশক্তিহীন করে রাখার উপায়। অর্থাৎ, এ রকম দৃষ্টিভঙ্গিতে, স্বাধীনভাবে নারীর শিক্ষা, কর্মসংস্থান, চলাফেরার অধিকার নেই। তার জীবন, অস্তিত্ব সবকিছুর সার্থকতা বা ব্যর্থতা পুরুষের ওপর নির্ভর করে। এই মত অনুযায়ী, নারীর জোরে হাঁটা, জোরে কথা বলা, একা চলাফেরা, পুরুষের সঙ্গে শিক্ষা বা কাজ করা নিষিদ্ধ: বোরকা পরেও এগুলো চলবে না। তার অস্তিত্বকে প্রায় অদৃশ্য করার জন্যই বোরকা, সুতরাং তাকে সেভাবেই চলতে হবে। তা ছাড়া বোরকা হলো নারীর সৌন্দর্য বা আকর্ষণকে আড়াল করার জন্য। সুতরাং এমন বোরকা পরা যাবে না বা বোরকা পরে এমনভাবে চলাফেরা করা যাবে না, যাতে তার কোনোরকম সৌন্দর্য বা আকর্ষণ প্রকাশিত হয়। এ ধরনের বোরকাধারী মানে প্রকৃত অর্থেই অবরোধবাসিনী।

অন্যদিকে কেউ কেউ মনে করেন, বোরকা হচ্ছে নারীর স্বাধীনভাবে চলাফেরার মাধ্যম। নারী যাতে পুরুষের লোভী দৃষ্টি বা সামাজিক বিশৃঙ্খলা এড়িয়ে নিজের মতো করে চলতে পারে, সে জন্যই বোরকা। বোরকা পরবে নারী কিন্তু চলবে স্বাধীনভাবে, অর্থাৎ স্বাধীনভাবে চলাফেরা, পুরুষের সঙ্গে শিক্ষা, কাজ সবই সম্ভব, এমনকি জোরে হাঁটা বা কথা বলায়ও সমস্যা নেই। অনেকে বোরকাকে আকর্ষণীয় করারও পক্ষে। এদের সংখ্যা দিন দিন যে বাড়ছে, এটা খালি চোখেই দেখা যায়। এই দলের অনেক মেয়ে বোরকা পরে এমন আত্মবিশ্বাস নিয়ে হাঁটে, যা অনেক বোরকা না-পরা মেয়ের মধ্যেও দেখা যায় না। লন্ডনসহ পশ্চিমা বিশ্বের বড় বড় শহরের অনেক স্থানেই এ রকম মেয়েদের দেখা পাওয়া যায়, যারা বোরকা পরে পাল্লা দিয়ে একা একা দৌড়ে হাঁটছে, কাজ করছে, পড়ালেখা করছে, গাড়ি চালাচ্ছে, সেমিনারে বিতর্ক করছে, মিছিল করছে। আমাদের দেশেও একই রকম চেহারা এখন বেশি বেশি চোখে পড়ছে। এদের সংখ্যা বৃদ্ধি বোরকার মূল ধারাকেই কোণঠাসা করছে, বোরকা মানেই এ ক্ষেত্রে আগেরটির মতো অবরোধবাসিনী নয়। তবে তা অবরোধের মতাদর্শের বাইরে, তা-ও বলা যাবে না।

অন্যদিকে বোরকার আকর্ষণীয় চেহারা তৈরিতে তখন পুঁজিও তৎপর। বিজ্ঞাপন সক্রিয়। নানা মডেলে বোরকা আসছে। যুক্তরাষ্ট্রে কিছুদিন আগে মুসলিম একটি সংস্থা বোরকা নিয়ে ফ্যাশন শো-ও করেছিল। আকর্ষণীয় চাদর পরাও বোরকার একটি ধরন হিসেবে এখন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বোরকা বা চাদরের এই বিবর্তন‒এগুলো পরার গুরুত্বপূর্ণ অনেক ধর্মীয় কারণ বা শর্তকেই আঘাত করছে।

বোরকার আকর্ষণীয় চেহারা তৈরিতে তখন পুঁজিও তৎপর। বিজ্ঞাপন সক্রিয়। নানা মডেলে বোরকা আসছে। যুক্তরাষ্ট্রে কিছুদিন আগে মুসলিম একটি সংস্থা বোরকা নিয়ে ফ্যাশন শো-ও করেছিল।

বোরকা বা চাদর আবার আভিজাত্যেরও অংশ। কয়েক দশক আগেও মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারের আভিজাত্য বা সম্ভ্রান্ত পরিচয়ের সঙ্গে মেয়েদের বোরকার সম্পর্ক ছিল প্রত্যক্ষ। এখনো তার রেশ আছে। এই বোধ নিম্নবিত্ত পর্যন্তও, অবস্থা বা উপায় থাকলে, প্রসারিত। বাংলাদেশে বোরকা কখনোই শ্রমজীবী নারীর পোশাক ছিল না, তার জন্য শাড়িই যেখানে বিলাসিতা, সেখানে বোরকা কীভাবে তার পোশাক হয়? তা ছাড়া তার জীবনের যে ছক, তাতে বোরকা চলে না, তাকে সরাসরি যেসব কাজ করতে হয়, তাতে বোরকা সমস্যাই বটে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তার ধর্মবিশ্বাস কম বা নারীর অবস্থান-পাপ-দায়দায়িত্ব সম্পর্কে সমাজের প্রচলিত মত থেকে তার মত খুব আলাদা।

আল্লাহ বা রসুল সম্পর্কে তার বোধ, অভিযোগের একটা আলাদা চেহারা আছে। এই জগতে হাজারো অন্যায়ের মুখে তার কথা শোনার আর আছেটাই-বা কে? বোরকা বা চাদরের পর্দা তার জন্য বোঝা। কিন্তু পর্দা সম্পর্কিত বোধ তাকে অনেক মাত্রায় দখল করে রাখে, সে ‘মনের পর্দা’ ধারণাটিতেই বিশ্বাস রাখতে চায়। তারপরও সে প্রায় সবসময় অপরাধবোধে ভোগে। তার অপরাধবোধকে উসকে দেয় ধর্মীয় ওয়াজ, প্রচলিত বোধ। তার চারপাশের পুরুষরা এই দুর্বলতাকে কাজে লাগায়। তার বিপদ, অসহায়ত্ব, তার দুর্বিষহ জীবনের কারণ হিসেবে তার সংগ্রামী জীবনকেই দায়ী করা হয়, দুর্বৃত্তরাই জোর গলায় এসব কথাকে সামনে নিয়ে আসে। ভেঙে পড়ে তার সব যুক্তি। হাড়ভাঙা খাটুনি করে জীবিকা অর্জনের পরও তার মনে হতে থাকে: সত্যিই তো, তার চলাফেরা ভালো নয়, তার ‘পর্দা’ নাই, সুতরাং তার ওপর গজব পড়বে না তো কার ওপর পড়বে?

পর্দা সম্পর্কিত বোধ তাকে অনেক মাত্রায় দখল করে রাখে, সে ‘মনের পর্দা’ ধারণাটিতেই বিশ্বাস রাখতে চায়। তারপরও সে প্রায় সবসময় অপরাধবোধে ভোগে। তার অপরাধবোধকে উসকে দেয় ধর্মীয় ওয়াজ, প্রচলিত বোধ।

কোনো কারণে অবস্থার একটু উন্নতি হলে এই নারী তাই চেষ্টা করে ভালো করে ‘শরীর ঢাকার’ ব্যবস্থা নিতে। স্বামীর পয়সা হলে স্বামীও উদ্যোগী হয় অন্যদের থেকে তার ‘পরিবার’কে আলাদা করতে। কাজের ক্ষেত্রে বোরকা পরা এরপরও কঠিন, তাই চাদর হয়ে দাঁড়ায় একটি আপসরফা। চাদর এখন শ্রমজীবী নারীর মধ্যেও স্বাতন্ত্র্য বোঝানোর অবলম্বন। আলাদা মানে তার অর্থসম্পদ, অবস্থান একটু ‘উপরে’। নিরাপত্তার প্রশ্নও আছে। গার্মেন্টসের শ্রমিক বা শ্রমজীবী মেয়েদের অনেক রাত করেই ঘরে ফিরতে হয়। তার ঘর, তার কর্মস্থল‒কোথাও তার নিরাপত্তা নেই। দিন-রাত সবই তার জন্য বিপজ্জনক। তারপরও কেউ কেউ রাস্তায় একটা চাদর দিয়ে নিজেকে আড়াল করতে চেষ্টা করে। কিন্তু কর্মস্থলের মালিক-মাস্তান, ঘরের আশপাশের মাস্তান পুরুষদের থেকে নিজেকে সে উদ্ধার করবে কীভাবে?

৫.

পারিবারিক জবরদস্তির কারণে বোরকা পরা উল্লেখযোগ্য মাত্রাতেই আছে। তবে এখানে যে বিষয়টি বলা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, আরও অনেক ক্ষেত্রের মতো এখানেও জবরদস্তির সঙ্গে ইচ্ছার সীমারেখাকে অর্থাৎ কোথায় একটির পর আরেকটির শুরু, তাকে চিহ্নিত করা খুব কঠিন। কোথাও জবরদস্তি যদি সবকিছুর মধ্যে মিশে যায়, তাহলে ইচ্ছা বলে যা দেখা যায়, তা আসলে জবরদস্তিরই ফল। ধর্মীয় বিধিনিষেধ, নারীর অবস্থান-কর্তব্য-সীমা, নারীর বর্তমান-ভবিষ্যৎ, মানসম্মান সম্পর্কিত ধারণা সবকিছু ছোটবেলা থেকে একটি মেয়ে যেভাবে শুনতে শুনতে নিজের ভেতরে নিয়ে নেয়, তাতে তার পক্ষে নিজেকে একজন সম্পূর্ণ এবং দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে চিন্তা করাই কঠিন, এমনকি প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সে তখন স্বেচ্ছায় যা ভাবে বা বিশ্বাস করে, তার মধ্যে ছোটবেলা থেকে ক্রিয়াশীল জবরদস্তির কাঠামোই কাজ করে। সে জন্য আমরা বোরকার ব্যবহারে বা না-ব্যবহারে পরিবারের প্রভাবই মুখ্য দেখি। ‘স্বেচ্ছায়’ যে বোরকা পরে, তার মাথায়ও জবরদস্তির মতাদর্শই ক্রিয়া করতে থাকে।

জবরদস্তির সঙ্গে ইচ্ছার সীমারেখাকে অর্থাৎ কোথায় একটির পর আরেকটির শুরু, তাকে চিহ্নিত করা খুব কঠিন। কোথাও জবরদস্তি যদি সবকিছুর মধ্যে মিশে যায়, তাহলে ইচ্ছা বলে যা দেখা যায়, তা আসলে জবরদস্তিরই ফল।

যারা বোরকা পরে না, এমনকি যারা ‘আধুনিক’ পোশাক পরে তাদের কেন্দ্রীয় ধ্যানধারণা শুধু পোশাকের কারণেই আলাদা হয়ে যায়, তা-ও নয়। নানা কারণ বাদ দিলে সাধারণভাবে বোরকা বা চাদর পরার কেন্দ্রীয় মতাদর্শিক বিষয়টি কী, সেটা এখানে চিহ্নিত করার চেষ্টা করতে পারি। এগুলোকে নিম্নরূপে সারসংক্ষেপ করা যায়:

১. নারীর প্রধান পরিচয় -একটি যৌনবস্তু এবং সন্তান উৎপাদনের মাধ্যম। তার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যৌনতার বাণী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুতরাং তাকে ঢেকে না রাখলে সমূহ বিপদ। সমাজে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।

২. নারী বিপজ্জনক। যেহেতু তার যৌন আকাঙ্ক্ষা পুরুষের তুলনায় (কারো কারো মতে আট গুণ) ‘বেশি’, সেহেতু সে স্বাধীনতা পেলে সমাজকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারবে। সুতরাং তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

৩. নারী নির্ভরযোগ্য নয়। আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তার নেই। বাস্তব বুদ্ধি-বিবেচনা তার কম। সাহস কম। সুতরাং তার চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে।

৪. নারীর সৌন্দর্য বা যৌনতা শুধু তার স্বামীর জন্য। সুতরাং অন্য পুরুষের দৃষ্টি থেকে তাকে দূরে থাকতে হবে। আড়াল করতে হবে নিজেকে। এমন পোশাক পরতে হবে, যাতে অন্য পুরুষের কাছে সে অনাকর্ষণীয় হয়।

৫. পুরুষ ও নারী পাশাপাশি থাকলে সমস্যা হবেই। তারা অনিয়ন্ত্রিত যৌনকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়বে কিংবা তা নিয়ে পীড়িত থাকবে। সুতরাং তাদের আলাদা রাখতে হবে।

অন্যান্য কারণ বাদ দিলে বিশ্বাস থেকে যারা বোরকা পরেন, তারা এসব যুক্তি কার্যত স্বীকার করে নেন। যেসব পুরুষ এসব যুক্তিতে বিশ্বাস করেন, তারা নিজেদেরও কী পর্যায়ে নামিয়ে আনেন তা বলাই বাহুল্য।

নারীর জন্য এ রকম ভয়াবহ অপমানজনক ধারণা, কথা আর মতাদর্শ ধর্ম আর সংস্কৃতির নামে চারদিকে ছড়ানো। নারীর অস্তিত্বই যেন প্রধান সমস্যা। সে কারণে অনেক ধর্মীয় ওয়াজ বা বক্তৃতায় সবসময় নারীর চলাফেরাই মুখ্য আলোচনার বিষয় হিসেবে থাকে। অন্য কোনো সমস্যাই এসব বিষয়ে বিষোদ্‌গার থেকে বাণিজ্যিক ধর্মীয় বক্তাদের বিরত রাখতে পারে না। কিন্তু দুঃখের বিষয়, যে নারী এত ‘নিকৃষ্ট প্রাণী’ সে এসব ‘উদ্যোগী পুরুষের’ও মা। ছোটবেলা থেকে শুনতে শুনতে নারীর ভেতরেও এগুলো অবধারিতভাবে গেঁথে বসে থাকে। এর পর তার নিজের আত্মসম্মানবোধ দাঁড়ানো খুবই কঠিন হয়ে যায়। আত্মসম্মানবোধ বা আত্মোপলব্ধি উপরোক্ত চিন্তার কাঠামোতে একটা পাপের কাজ। বোরকা পরা বা না-পরা নয়, লড়াই আরও অনেক ভেতরের।

এখানে যে বিষয়টির ওপর আমি গুরুত্ব দিতে চাই তা হলো, উপরের বক্তব্যগুলো যে মতাদর্শকে প্রতিফলিত করে তা যে শুধু বোরকা বা কঠোর ধর্মীয় বিধিনিষেধ যেখানে আছে সেখানেই দেখা যায় তা নয়, এই ধারণাগুলোর মূল বিষয় কার্যকর থাকে সেখানেও, যেখানে নারীর শরীর ও যৌনতাকে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হয়। সেখানে নিয়ন্ত্রণ আসে আরেকভাবে। সেখানেও নারী শুধুই যৌনবস্তু এবং তার জীবনের সার্থকতা যৌনবস্তু হিসেবে নিজের দাম ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে। তার প্রতিযোগিতা, উৎকণ্ঠা একে ঘিরেই আবর্তিত হয়।

উপরের মতাদর্শকে ধারণ করে বোরকা পরার মধ্যে নারীর যে অপমান, সেই একই অপমান তাই কার্যকর থাকে সেসব ‘স্বল্প’ পোশাকেও। দুই ক্ষেত্রেই পোশাক নারীর পছন্দের নয় এবং এটা শুধু পোশাক নয়; এটা পুরুষের নির্মিত শৃঙ্খল। উদ্দেশ্য এবং তার সামাজিক অবস্থানের অধস্তনতা দুই জায়গাতেই ভিন্ন চেহারায় কার্যকর থাকে।

উপরের মতাদর্শকে ধারণ করে বোরকা পরার মধ্যে নারীর যে অপমান, সেই একই অপমান তাই কার্যকর থাকে সেসব ‘স্বল্প’ পোশাকেও। দুই ক্ষেত্রেই পোশাক নারীর পছন্দের নয় এবং এটা শুধু পোশাক নয়; এটা পুরুষের নির্মিত শৃঙ্খল। উদ্দেশ্য এবং তার সামাজিক অবস্থানের অধস্তনতা দুই জায়গাতেই ভিন্ন চেহারায় কার্যকর থাকে।

৬.

আমার মায়ের সেই সময় বা তারও আগের ও পরের নানি বা দাদি যে সময়কে ধারণ করতেন, সে সময় নারী মুখ্যত অবরোধবাসিনীই ছিলেন। তাদের ঘরের বা নির্ধারিত বৃত্তের বাইরে আসার সুযোগই ছিল অনেক কম, সুতরাং সে কারণেই হয়তো বোরকার বিষয়টিও এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। গত দুই দশকে এই অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। সকল শ্রেণির নারীর ক্ষেত্রেই তার নিজস্ব পুরোনো এলাকা আর অক্ষত নেই। সামাজিক জীবনে নারী এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি দৃশ্যমান। রাস্তায় এখন শ্রমিক নারী, মধ্যবিত্ত নারী দুজনকেই আগের তুলনায় বেশি দেখা যায়। বস্তুত নারী শ্রমিক এখন যেভাবে একটি সামাজিক শক্তি হিসেবে দাঁড়ানোর অবস্থায় এসেছে, সেটা আগে কখনোই ছিল না। শহরে তো বটেই, গ্রামেও নারী এখন শিক্ষা ও কাজে বেশি অংশগ্রহণ করছে। এই অংশগ্রহণ বৃদ্ধির বিরুদ্ধে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিরোধ এবং হামলাও আসছে বিভিন্নভাবে। যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, ফতোয়া, খুন ইত্যাদির ক্রমবর্ধমান প্রকোপ এরই বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু নারীর এখন পিছিয়ে আসার উপায় নেই। কেউ কেউ নিজেকে রক্ষা কিংবা আক্রমণকারী সমাজ বা বাধাদানকারী পরিবারের সঙ্গে আপসের রাস্তা হিসেবে বোরকাকে গ্রহণ করছে। অব্যাহতভাবে একক লড়াইয়ে রত আছে, পরিবারে/কর্মক্ষেত্রে/রাস্তায় রক্তাক্ত বা ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে অনেকেই। সামষ্টিক লড়াইয়ের জায়গা খুঁজছে।

তাই শুধু বোরকা দিয়েই কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় না। বোরকার মধ্যে যে পুরুষতান্ত্রিক আক্রমণের ছাপ আছে, তাকে মতাদর্শিকভাবে গ্রহণ না-করলে এই পোশাক পরেও একজন নারী নিজের উপলব্ধির জগৎকে ক্রমে প্রসারিত করায় নিয়োজিত থাকতে পারে; নিজেকে অধস্তন অপূর্ণাঙ্গ মানুষের পরিচয় থেকে বের করে আনার ব্যক্তিক-সামষ্টিক লড়াইয়ে সক্রিয় থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়া এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত। আবার অন্যদিকে একজন বোরকা না-পরেও দৃশ্যত ‘স্বাধীন’ পোশাক-আশাক পরেও নিজের ভেতর লালন করতে পারে, চর্চা করতে পারে উল্লিখিত ভয়াবহ, আত্মপীড়নমূলক, আত্মঘাতী মতাদর্শ।

(প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৯ ইং। পরে এই লেখকের নারী, পুরুষ ও সমাজ গ্রন্থের তৃতীয় সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত।)

আনু মুহাম্মদ: শিক্ষক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল: anu@juniv.edu

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •