চলুন, আমরা সবাই নারীবাদী হই

চলুন, আমরা সবাই নারীবাদী হই

চিমামান্ডা এনগোজি আদিচি

নাইজেরিয়ান প্রবাসী লেখক চিমামান্ডা এনগোজি আদিচির উই শুড অল বি ফেমিনিস্ট ২০১২ সালে টেডটক-এ প্রচারিত এবং ২০১৪ সালে চতুর্থ এস্টেট দ্বারা প্রথম বই আকারে প্রকাশিত হয়। বইটি একুশ শতকের জন্য নারীবাদী হওয়ার অর্থ সম্পর্কে উপাখ্যান এবং বিশ্লেষণ অন্তর্ভুক্ত করেছে। তিনি যুক্তি দেন, ‘নারীবাদী’ কোনো গালি নয়; বরং এমন একটি পরিচয়, যা সবার গ্রহণ করা উচিত। নাইজেরিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বলা তাঁর গল্প, উদাহরণ, সমাজ বিধি সবই বাংলাদেশের সমাজেও পাওয়া যাবে। সর্বজনকথার জন্য এই লেখা অনুবাদ করেছেন লেখক অনুবাদক ফাতেমা বেগম।

২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে টেডটক আয়োজিত আফ্রিকা বিষয়ক বার্ষিক সম্মেলনে আমার আলোচনা পরিমার্জিত হয়ে ২০১৪ সালে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।

বিভিন্ন ক্ষেত্রের বক্তারা সেখানে চ্যালেঞ্জিং এবং অনুপ্রেরক আফ্রিকান এবং আফ্রিকার বন্ধুদের উদ্দেশ করে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন। আমি কয়েক বছর আগে আরেকটি টেড সম্মেলনে ‘দ্য ডেঞ্জার অব অব দ্য সিঙ্গেল স্টোরি’ শিরোনামে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলাম। বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল—কীভাবে গতানুগতিক ধারণা, বিশেষ করে আফ্রিকা সম্পর্কে আমাদের চিন্তাভাবনাকে সীমাবদ্ধ করে রাখে। আমার কাছে মনে হয়েছে, নারীবাদ সম্পর্কে ধারণা এবং নারীবাদী শব্দটি একই ধরনের গতানুগতিকতার সীমাবদ্ধতায় আক্রান্ত। TEDxEuston কনফারেন্সের সহসংগঠক, আমার ভাই চাকস এবং সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু আই, উভয়ে আমাকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য যখন পীড়াপীড়ি করছিল, তখন আমি আর না বলতে পারিনি। আমি নারীবাদ সম্পর্কে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কারণ, এটি এমন একটি বিষয়, যার গুরুত্ব আমি অনুভব করি। আমার সন্দেহ হয়েছিল, নারীবাদের বিষয়টি সবার পছন্দ না-ও হতে পারে। তবে এই বক্তব্য দেওয়ার মাধ্যমে আমি একটি প্রয়োজনীয় কথোপকথন শুরু হওয়ার আশা করছিলাম। সেই সন্ধ্যায় মঞ্চে দাঁড়িয়ে বন্ধুভাবাপন্ন এবং মনোযোগী শ্রোতাদের মাঝে আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন এক পরিবারের উপস্থিতিতে আছি। আমার বক্তব্যের বিষয় কেউ আক্রমণ করেননি। আলোচনার শেষ পর্যন্ত তাদের অভিবাদনের স্থায়িত্ব দেখে আমি আশাযুক্ত হয়েছিলাম।

ছোটবেলায় ওকোলোমা আমার অন্যতম একজন প্রিয় বন্ধু ছিল। সে ছিল খুব কৌতুকপ্রবণ এবং বুদ্ধিমান। বড় ভাইয়ের মতো সে আমার খেয়াল রাখত। ওকোলোমা আমার এমন একজন বন্ধু ছিল, যার সঙ্গে আমি মন খুলে কথা বলতে পারতাম। হাসিঠাট্টা করতাম। তর্কবিতর্ক করতাম। একদিন খুব তর্কবিতর্ক হচ্ছিল। তখন আমার বয়স ১৪ বছর। আমি বেশ তর্ক করছিলাম। একসময় ওকোলোমা আমাকে বলল, ‘তুমি একজন নারীবাদী।’ এই প্রথম আমি নারীবাদী শব্দটি শুনলাম। সে কিন্তু কোনো প্রশংসা করছিল না। বন্ধু ওকোলোমা সেই স্বরে আমাকে নারীবাদী বলেছিল যেমন কেউ বলে, ‘তুমি একজন সন্ত্রাসীর সমর্থক।’ তখন পর্যন্ত আমি এর অর্থ জানতাম না। কিন্তু আমি তাকে তা বুঝতে দিইনি। এরপর বাসায় ফিরে অভিধান থেকে আমি নারীবাদী শব্দের অর্থ জেনেছিলাম।

২০০৩ সালে আমি পার্পল হিবিসকাস নামে একটা উপন্যাস লিখেছিলাম। সেখানে অন্যান্য ব্যাপারের মধ্যে স্ত্রীকে পেটানোর একটি প্রসঙ্গ ছিল। গল্পের সমাপ্তি স্বামীর বিরুদ্ধে গিয়েছিল। এই গল্পের ব্যাপারে একজন সুপরিচিত সাংবাদিক এসে আমাকে অযাচিত উপদেশ দিলেন। তিনি বলেন, ‘মানুষ নাকি আমার উপন্যাসকে খুব নারীবাদী বলছে।’ কথা বলার সময় খুব দুঃখের সঙ্গে তিনি মাথা নাড়াচ্ছিলেন এবং বলছিলেন, কখনো আমার নিজেকে নারীবাদী বলা উচিত নয়। কারণ, নারীবাদীরা খুব অসুখী হয় এবং তাদের স্বামীভাগ্য হয় না।

আমি তখন সিদ্ধান্ত নিলাম—আমি এখন থেকে নিজেকে ‘সুখী নারীবাদী’ বলব।

কথা বলার সময় খুব দুঃখের সঙ্গে তিনি মাথা নাড়াচ্ছিলেন এবং বলছিলেন, কখনো আমার নিজেকে নারীবাদী বলা উচিত নয়। কারণ, নারীবাদীরা খুব অসুখী হয় এবং তাদের স্বামীভাগ্য হয় না।

আমি তখন সিদ্ধান্ত নিলাম—আমি এখন থেকে নিজেকে ‘সুখী নারীবাদী’ বলব।

এরপর একজন নাইজেরিয়ান শিক্ষাবিদ আমাকে জানান, নারীবাদ আমাদের সংস্কৃতির অংশ নয়। নারীবাদ একটি আফ্রিকান বিরোধী ব্যাপার এবং আমি নাকি পাশ্চাত্য বই থেকে প্রভাবিত হয়ে নিজেকে নারীবাদী ভাবছি। (মজার ব্যাপার হলো, আমার প্রথম দিকের পড়া সব বই কিন্তু অ-নারীবাদী ছিল। ষোলো বছর বয়সি হওয়ার আগে আমি মিলস অ্যান্ড বুন-এর প্রতিটা রোমান্টিক বই পড়ে ফেলেছিলাম এবং যখনই ‘ক্ল্যাসিক্যাল নারীবাদী লেখা’ পড়তে গিয়েছি, তখনই আমার খুব একঘেয়েমি লেগেছে এবং পড়ে শেষ করতে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। যাই হোক, যেহেতু নারীবাদ আফ্রিকানবিরোধী ব্যাপার, তাই এরপর থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম নিজেকে ‘সুখী আফ্রিকান নারীবাদী’ বলব।

তারপর একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমাকে জানাল, নারীবাদী মানে হলো আমি পুরুষদের ঘৃণা করছি। কাজেই

সিদ্ধান্ত নিলাম, এখন থেকে আমি একজন ‘সুখী আফ্রিকান নারীবাদী হব, যিনি পুরুষদের ঘৃণা করেন না’।

এ রকম করতে করতে নারীবাদী হিসেবে আমার নিজের সংজ্ঞা দাঁড়াল: একজন সুখী আফ্রিকান নারীবাদী, যিনি পুরুষদের ঘৃণা করেন না এবং যিনি লিপ গ্লস লাগাতে পছন্দ করেন এবং হাই হিল পরতে পছন্দ করেন এবং তা পুরুষের জন্য নয়।

এই কথাগুলো অবশ্যই আমি ব্যঙ্গভরে বলছি। কিন্তু এসব থেকে একটি ব্যাপার স্পষ্ট যে, নারীবাদী শব্দটি নেতিবাচকতার একটি ঝোলায় ভারী হয়ে আছে: তুমি পুরুষকে ঘৃণা করছ, তুমি ব্রা ঘৃণা করছ, তুমি আফ্রিকান সংস্কৃতি ঘৃণা করছ, তুমি মনে কর যে নারীদের সব সময় কর্তৃত্বপরায়ণ থাকতে হবে, তুমি প্রসাধন ব্যবহার কর না, তুমি শেভ কর না, তুমি সবসময় রেগে আছ, তোমার কোনো কৌতুকানুভূতি নেই, তুমি সুগন্ধি ব্যবহার কর না।

এখন আমি আমার শিশুবেলার গল্প শোনাব।

আমার বয়স তখন নয় বছর। দক্ষিণ-পূর্ব নাইজেরিয়ার ইউনিভার্সিটি শহরে সুক্কা নামে প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রী ছিলাম। শুরুতেই আমার শিক্ষক ঘোষণা দিলেন, তিনি একটি পরীক্ষা নেবেন এবং যে সবচেয়ে বেশি নম্বর পাবে তাকে ক্লাস মনিটর বানানো হবে। ক্লাস মনিটর ব্যাপারটি আমাদের জন্য খুব বড় একটা ব্যাপার ছিল। যারা দুষ্টামি করবে, ক্লাস মনিটর তাদের নাম ব্ল্যাক বোর্ডে লিখবে। এটা অনেক ক্ষমতার একটি ব্যাপার মনে করা হতো। এ ছাড়া একটা বেত নিয়ে ক্লাসে হেঁটে বেড়ানোর ক্ষমতা দেওয়া হতো। যদিও তা ব্যবহারের অনুমোদন ছিল না। সেই বয়সে আমার জন্য এই ভূমিকাটি খুব লোভনীয় ছিল। আমি ক্লাস মনিটর হতে খুবই আগ্রহী ছিলাম। সেই নির্ধারণী পরীক্ষায় আমি প্রথম হলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে শিক্ষক জানালেন, ক্লাস মনিটরকে একজন ছেলে হতে হবে। তিনি প্রথমে তা উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিলেন। কারণ, তিনি ধরেই নিয়েছিলেন—একজন ছেলেই পরীক্ষায় প্রথম হবে। সুতরাং পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকারী একজন ছেলে ক্লাস মনিটর হলো। আরও মজার ব্যাপার হলো, এই ছেলেটি খুব শান্তশিষ্ট, নরম প্রকৃতির ছিল। বেত হাতে ক্লাস পাহারা দেওয়ার কোনো আগ্রহ তার ছিল না। আমার কিন্তু ভীষণ আগ্রহ ছিল। তবে আমি একজন মেয়ে এবং সে ছেলে। তাই সর্বোচ্চ যোগ্যতা এবং আগ্রহ থাকার পরও লিঙ্গপরিচয়ের কারণে আমি ক্লাস মনিটর হতে পারিনি। সুতরাং সেই ছেলেটি ক্লাস মনিটর হলো।

আমি ক্লাস মনিটর হতে খুবই আগ্রহী ছিলাম। সেই নির্ধারণী পরীক্ষায় আমি প্রথম হলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে শিক্ষক জানালেন, ক্লাস মনিটরকে একজন ছেলে হতে হবে। তিনি প্রথমে তা উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিলেন। কারণ, তিনি ধরেই নিয়েছিলেন—একজন ছেলেই পরীক্ষায় প্রথম হবে।

কোনো কিছু বারবার হতে থাকলে আমরা তাকে একটি স্বাভাবিক ঘটনা ভাবতে থাকি। শুধু ছেলেকে সবসময় ক্লাস মনিটর বানানো হলে আমরা সবাই, এমনকি অবচেতন মনে হলেও ধারণা করি, একজন ছেলেকেই ক্লাস মনিটর বানাতে হবে। তেমনি করপোরেশনের প্রধান হিসেবে পুরুষকে দেখতে দেখতে স্বাভাবিক মনে হয়, শুধু একজন পুরুষই কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধান হবেন।

আমার একটা ভুল ভাবনা কাজ করত যে, আমি যা সঠিক ভাবি অন্যরাও নিশ্চয়ই তা-ই ভাবে। আমার একজন প্রগতিশীল, মেধাবী পুরুষবন্ধু লুইসের সঙ্গে এক আলোচনায় এই ভুলটি ভেঙে যায়। আমার প্রগতিশীল বন্ধুটি বলল, ‘নারীদের জন্য তুমি সবকিছু ভিন্ন এবং কঠিন বলছ। কিন্তু আমি তো সে রকম কিছু দেখছি না। অতীতে হয়তো নারী ও পুরুষের অভিজ্ঞতার মধ্যে ভিন্নতা ছিল। কিন্তু এখন তো আর সে রকম নেই। নারীদের জন্য এখন সব ঠিকঠাক আছে।’ আমি অবাক হয়েছিলাম, কীভাবে লুইস বাস্তবতাকে দেখতে পারছে না।

আমি নাইজেরিয়ায় ফিরে আসতে ভালোবাসি। এসে অধিকাংশ সময় লাগোসে থাকি। দেশের বৃহত্তম শহর লাগোস একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থল। জনবহুল এই শহরে প্রায় দুই কোটি মানুষ বাস করে। মাঝে মাঝে যখন সন্ধ্যার দিকে তাপমাত্রা কমে যায় এবং শহর কিছুটা শান্ত হয়ে আসে, তখন আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে রেস্টুরেন্ট বা ক্যাফেতে যাই। একদিন সে রকম এক সন্ধ্যায় লুইস এবং অন্য বন্ধুদের সঙ্গে আমি বাইরে গিয়েছি। লাগোসে চমৎকার একটি ব্যবস্থা আছে। লাগোসে লন্ডনের চেয়েও বেশি উদ্যমী, নিউইয়র্কের চেয়েও বেশি উদ্যোক্তা মানুষ আছে। উপার্জনের জন্য মানুষ নানা ধরনের উপায় বের করে। লাগোসে সন্ধ্যায় রেস্টুরেন্টগুলোয় খুব ভিড় হয়। কিছু উদ্যমী তরুণ বিভিন্ন ব্যাবসায়িক জায়গার আশপাশে ঘোরাঘুরি করে। তারপর তারা সবার গাড়ি পার্ক করতে সাহায্য করে। তারা গাড়িতে আসা মানুষদের পার্কিং খুঁজে বের করতে সাহায্য করে। পার্কিংয়ের জায়গা পাওয়ার সমস্যা যদি না থাকে, তাহলে তারা পার্কিংয়ের জন্য আরও ভালো জায়গার ব্যাপারে পরামর্শদাতা হয়। এই সাহায্য করার মাধ্যমে তরুণরা অর্থ উপার্জন করে। তারা পার্কিংয়ের পাশাপাশি ফিরে আসা না-পর্যন্ত গাড়ি পাহারা দেওয়ার কাজও করে। আমি একজন সাহায্যকারীর এই নাটকীয় ভূমিকা দেখে খুবই অভিভূত হলাম। ফিরে যাওয়ার সময় আমি তাকে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে বকশিশ দিলাম। আনন্দিত এবং কৃতজ্ঞ সেই তরুণ বকশিশ নিয়ে আমার পাশে বসা লুইসকে ধন্যবাদ জানাল। লুইস অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। প্রশ্ন করল: ‘ও আমাকে ধন্যবাদ দিল কেন? আমি তো বকশিশ দিইনি।’ তারপর অবশ্য লুইসের চেহারায় ব্যাপারটি বুঝতে পারার ছাপ দেখতে পেলাম। এখানে বিষয় হলো, সেই তরুণ বিশ্বাস করে, আমি তাকে যে বকশিশ দিচ্ছি, তা তো পাশে বসা লুইসের টাকাই হওয়ার কথা। কারণ, লুইস একজন পুরুষ।

নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য আছে। আমাদের হরমোন, যৌনাঙ্গ এবং শারীরিক সক্ষমতা ভিন্ন। নারীর প্রজনন ক্ষমতা আছে। পুরুষের তা নেই। পুরুষের বেশি টেস্টোস্টেরন থাকে। সাধারণত পুরুষদের শারীরিক শক্তি বেশি। কিছু ব্যতিক্রম আছে অবশ্য। বিশ্বে মোট নারীর সংখ্যা ৫২ শতাংশ এবং পুরুষ ৪৮ শতাংশ। নারীর সংখ্যা কিছুটা বেশি। কিন্তু ক্ষমতা এবং মর্যাদার অধিকাংশ পদ পুরুষের দখলে থাকে। কেনিয়ান নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ওয়াংগারি মাঠাই সহজ ভাষায় বলেছিলেন: পদের যত উপরের দিকে যাবেন, তত সেখানে কম নারী পাবেন। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে লিল্লি লেডবেটার আইন শুনছিলাম। এ আইনের মূল কথা হলো: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারী এবং পুরুষ একই যোগ্যতা নিয়ে একই কাজ করলেও মজুরি ভিন্ন। পুরুষ নারীর চেয়ে বেশি মজুরি পান। কারণ, তিনি পুরুষ।

আক্ষরিক অর্থে, পুরুষ বিশ্বকে শাসন করেন। হাজার হাজার বছর আগে বেঁচে থাকার জন্য শারীরিক শক্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল। বেশি শারীরিক শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরাই সাধারণত নেতৃত্বের জায়গায় থাকতেন। কিন্তু বর্তমানে আমরা ভিন্ন বিশ্বে বসবাস করছি। বুদ্ধি শারীরিক পরিশ্রমের জায়গা দখল করেছে। নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য অধিকতর যোগ্য ব্যক্তির বেশি শারীরিক শক্তির প্রয়োজন নেই। কার বেশি বুদ্ধি আছে, কার বেশি জ্ঞান আছে, কার বেশি উদ্ভাবনী শক্তি আছে, কে বেশি সৃজনশীল—সেটাই হলো আসল ব্যাপার। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্য হরমোনের ভিন্নতা নেই। বুদ্ধি, উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো ভিন্নতা নেই। আমরা বিবর্তিত হয়েছি; কিন্তু লিঙ্গের ব্যাপারে আমাদের ধারণার তেমন বিবর্তন ঘটেনি।

হাজার হাজার বছর আগে বেঁচে থাকার জন্য শারীরিক শক্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল। বেশি শারীরিক শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরাই সাধারণত নেতৃত্বের জায়গায় থাকতেন। কিন্তু বর্তমানে আমরা ভিন্ন বিশ্বে বসবাস করছি। বুদ্ধি শারীরিক পরিশ্রমের জায়গা দখল করেছে। নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য অধিকতর যোগ্য ব্যক্তির বেশি শারীরিক শক্তির প্রয়োজন নেই। কার বেশি বুদ্ধি আছে, কার বেশি জ্ঞান আছে, কার বেশি উদ্ভাবনী শক্তি আছে, কে বেশি সৃজনশীল—সেটাই হলো আসল ব্যাপার। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্য হরমোনের ভিন্নতা নেই। বুদ্ধি, উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো ভিন্নতা নেই।

সম্প্রতি আমি নাইজেরিয়ার একটি নামি হোটেলের লবিতে গিয়েছিলাম। আমাকে প্রশ্ন করা হলো: আমার নাম কী, আমি কত নম্বর রুমে যাব? যার রুমে যাব, আমি ওই লোকটিকে চিনি কি না। কার্ডের মাধ্যমে আমি কি প্রমাণ করতে পারব, আমি কারোর অতিথি? এসব প্রশ্নের কারণ হলো, একজন নারী একা হোটেলে ঢুকলেই ধরে নেওয়া হয়, সে যৌনকর্মী; নাইজেরিয়ান একজন নারীর একটা রুম ভাড়া করার জন্য নিজের তো অর্থ থাকার কথা নয়। অথচ একজন পুরুষ একা ঢুকলে ধরেই নেওয়া হয়, সে বৈধ কোনো প্রয়োজনে হোটেলে এসেছে।

আমি অনেক সুপরিচিত ক্লাব এবং বারে একা যেতে পারি না। একা থাকলে তারা ঢুকতে দেবে না। পরিচিত কোনো পুরুষের হাত ধরে ঢুকতে হয়। অনেক সময় আমার পুরুষবন্ধুরা এসব জায়গায় গেলে অনেক অপরিচিত নারীর সঙ্গী সেজে তাদের সাহায্য করে। আমি কোনো পুরুষের সঙ্গে ক্লাবে, বারে, হোটেলে গেলে আমার পুরুষসঙ্গীকে তারা অভ্যর্থনা জানায়। পাশে থাকলেও নারী বলে আমাকে অভিবাদন জানায় না। ওয়েটাররা সমাজের উৎপাদন। তারা নারীদের চেয়ে পুরুষদের গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শিখেছে। যতবার ওয়েটাররা এই আচরণ করেছে, ততবার আমি নিজেকে অদৃশ্য কিছু অনুভব করেছি। আমি মর্মাহত হয়েছি। আমি তাদের উদ্দেশে বলেছি: আমি পুরুষের মতোই একজন মানুষ। মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া আমার প্রাপ্য। এগুলো হয়তো ছোট ছোট ব্যাপার। কিন্তু ছোট ব্যাপারগুলোই অনেক সময় দংশনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

কিছুদিন আগে আমি লাগোস নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম। লাগোসের তরুণী নারীদের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা। আমার পরিচিত একজন মন্তব্য করলেন: এই প্রবন্ধটিতে খুব রাগ প্রকাশ করা হয়েছে। আমার এত রাগ প্রকাশ করা উচিত হয়নি। অবশ্যই আমি রাগ হয়েছি। আমাদের সবার রাগ হওয়া উচিত। তবে আমি সেই কারণে ক্ষমা চাইনি। বর্তমানে লিঙ্গ বিষয়ে খুবই অবিচার হচ্ছে। রাগের মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তনের লম্বা ইতিহাস আছে। তবে একই সঙ্গে আমি কিন্তু আশাবাদী থাকছি। কারণ, আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, মানুষ উত্তম পরিবর্তন আনতে সক্ষম। রাগ প্রসঙ্গে সেই পরিচিতজন আমাকে বোঝাতে চেয়েছিল যে, নারীদের রাগ থাকা ভালো নয়। সেই রাগী প্রবন্ধটি যেন আমার নিজের চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ। নারী হলে রাগ দেখানো ঠিক নয়। কারণ, তাতে হুমকি প্রকাশ করা হয়।

আমার একজন মার্কিন বন্ধু আছে। সেই বন্ধু একদিন ম্যানেজার হলো। তার পূর্ববর্তী পুরুষ ম্যানেজার খুবই কড়া ছিল। বিশেষত, টাইম শিটে স্বাক্ষর করার ব্যাপারে সে খুবই কড়া ছিল। নারীবন্ধুটি যখন ম্যানেজার হলো, তখন নিয়মকানুন পালনের ব্যাপারে তার ভূমিকাও পুরুষ ম্যানেজারের মতোই হওয়ার কথা। তবে আমার বন্ধু কিন্তু আগের ম্যানেজারের তুলনায় কিছুটা উদার ছিল। নতুন পদে কাজ শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মাথায় টাইম শিটে নকল স্বাক্ষর করার জন্য আমার ম্যানেজার বন্ধু একজন কর্মীকে নির্ধারিত শাস্তি দিল। আগের ম্যানেজার একই শাস্তি দিতেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সেই নকল স্বাক্ষর করা ব্যক্তি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করল যে, এই নারী ম্যানেজার খুবই আগ্রাসি এবং তার সঙ্গে কাজ করা অসম্ভব। অন্য কর্মচারীরাও তার অভিযোগের সঙ্গে একমত হলো। তারা জানাল যে, এই নারী ম্যানেজার থেকে তারা ‘নারী স্পর্শ’ আশা করেছিল। কিন্তু তাদের সেই আশা পূরণ হয়নি। তারা কেউ এটা ভাবল না যে, নারী ম্যানেজার সেই কাজটিই করেছে, যা করে একজন পুরুষ ম্যানেজার প্রশংসিত হয়ে থাকে।

আমার আরেকজন মার্কিন নারীবন্ধু বিজ্ঞাপনে উঁচু বেতনের চাকরি করত। তাদের টিমে আমার বন্ধুসহ দুজন নারী ছিলেন। আরেকজন নারী আমার বন্ধুকে অভিযোগ করলেন যে, তার বস তাকে উপেক্ষা করেছেন, মিটিংয়ে তার মন্তব্যকে বস উপেক্ষা করেছেন, অথচ একই মন্তব্য করে তার পুরুষ সহকর্মী প্রশংসিত হয়েছেন। মিটিংয়ের পর সেই নারী বাথরুমে গিয়ে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করেছিলেন। কোনো প্রতিবাদ করেননি। কারণ, তাতে তাকে আগ্রাসি মনে হবে। নারীদের তো আগ্রাসি মনে করানো যাবে না। আমার পরিচিত অনেক আমেরিকান নারীর মধ্যে যে প্রবণতা দেখেছি তা হলো, তারা নিজেদের অন্যদের কাছে ‘পছন্দনীয়’ রাখতে চান। নিজেকে এ রকম পছন্দনীয় রাখার জন্য রাগ দেখানো, আগ্রাসি হওয়া বা দ্বিমত করা যাবে না।

ছেলেরা মেয়েদের ব্যাপারে কী ভাবে, সেই ব্যাপারে মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমরা প্রচুর সময় ব্যয় করি। কিন্তু বিপরীত কাজে সময় ব্যয় করি না। অর্থাৎ, ছেলেদের শিক্ষা দিই না, মেয়েরা তাদের ব্যাপারে কী ভাবে। মেয়েদের অনেক সময় ব্যয় করে শিক্ষা দিই—তাদের রাগ করা যাবে না, আগ্রাসি হওয়া যাবে না, কঠোর হওয়া যাবে না। কিন্তু ছেলেদের ব্যাপারে আমরা তা উপেক্ষা করি বা প্রশংসা করি। দুনিয়ায় প্রচুর বই-ম্যাগাজিন আছে, যেগুলোয় লেখা হয়: পুরুষদের আকৃষ্ট করার জন্য এবং খুশি করার জন্য নারীদের কী করা উচিত, কেমন হওয়া উচিত, কেমন না-হওয়া উচিত।

মেয়েদের অনেক সময় ব্যয় করে শিক্ষা দিই—তাদের রাগ করা যাবে না, আগ্রাসি হওয়া যাবে না, কঠোর হওয়া যাবে না। কিন্তু ছেলেদের ব্যাপারে আমরা তা উপেক্ষা করি বা প্রশংসা করি। দুনিয়ায় প্রচুর বই-ম্যাগাজিন আছে, যেগুলোয় লেখা হয়: পুরুষদের আকৃষ্ট করার জন্য এবং খুশি করার জন্য নারীদের কী করা উচিত, কেমন হওয়া উচিত, কেমন না-হওয়া উচিত।

আমি লাগোসে একটি লেখার ওয়ার্কশপে কাজ করছিলাম। একজন তরুণী অংশগ্রহণকারী জানাল, তার বন্ধু তাকে পরামর্শ দিয়েছে, সে যেন আমার ‘নারীবাদী কথাবার্তা’ না শোনে। কারণ, এসব চিন্তাভাবনা মস্তিষ্কে প্রবেশ করলে তার বিয়েতে সমস্যা হতে পারে। এটা কিন্তু একটা বিশাল হুমকি—বিয়ে বিপর্যস্ত হওয়া বা একেবারে বিয়ে না-হওয়া। নারীদের বিরুদ্ধে সমাজ এই হুমকিটি ব্যবহার করে। পুরুষদের ব্যাপারে কিন্তু তা করা হয় না।

বিশ্বের সর্বত্র লিঙ্গ একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। লিঙ্গ সবকিছুকে প্রভাবিত করে। আজ সবাইকে একটা ভিন্ন বিশ্বের স্বপ্ন দেখার এবং তা পরিকল্পনা করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। আরও সুন্দর একটা বিশ্ব চাই। আরও সুখী পুরুষ এবং আরও সুখী নারীতে পরিপূর্ণ একটি বিশ্ব চাই। তাই শুরুটা হতে হবে—আমাদের কন্যাদের ভিন্নভাবে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের পুত্রদেরও ভিন্নভাবে গড়ে তুলতে হবে।

আমরা পুত্রসন্তানদের মানবতা বা মনুষ্যত্বকে দমন করি। পুরুষত্ব বা পুরুষালি ভাবকে আমরা খুব সংকীর্ণভাবে সংজ্ঞায়িত করি। পুরুষত্ব একটা শক্ত, ছোট খাঁচা। ছেলেসন্তানদের সেই খাঁচার মধ্যে বন্দি করে রাখি। আমরা শিশুপুত্রদের শিখাই—তারা যেন ভয় পাওয়াকে, দুর্বলতাকে ভয় পায়। আমরা তাদের প্রকৃত সত্তাকে মুখোশের আড়ালে রাখতে শিক্ষা দিই। তাদের, নাইজেরিয়ার ভাষায়, ‘শক্ত মানুষ’ হতে শিক্ষা দিই।

মাধ্যমিক স্কুলে ছেলে এবং মেয়ে যখন বাইরে বেড়াতে যায়, তখন তাদের দুজনের পকেটেই যথেষ্ট অর্থ থাকে না। তবু ছেলের থেকেই সবসময় বিল পরিশোধের প্রত্যাশা থাকে। এর মাধ্যমে তার পুরুষত্বের প্রমাণ হয়। (এ জন্যই হয়তো ছেলেদের তাদের মা-বাবার কাছ থেকে অর্থ চুরি করার সম্ভাবনা বেশি থাকে)। কেমন হতো, যদি ছেলে এবং মেয়েকে পুরুষত্ব এবং অর্থের সঙ্গে সংযুক্ত না করে গড়ে তোলা হতো? কেমন হতো, যদি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ‘ছেলেকে বিল পরিশোধ করতে হবে’ না হয়ে বরং এমন হতো—‘যার কাছে বেশি অর্থ থাকবে, সেই-ই বিল দেবে?’

ঐতিহাসিক সুবিধার কারণে অবশ্যই আজ অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরুষদের কাছেই বেশি অর্থ থাকে। আমরা যদি সন্তানদের ভিন্নভাবে গড়ে তুলি, তাহলে হয়তো আগামী পঞ্চাশ থেকে এক শ বছরে পুরুষদের নিজেদের পুরুষত্ব প্রমাণ করার জন্য আর্থিক ভিত্তির ওপর নির্ভর করতে হবে না। তবে এ পর্যন্ত আমরা পুরুষদের যে ক্ষতিগুলো করে চলেছি তা হলো, পুরুষদের অনুভব করাই—তাদের কঠিন হতে হবে এবং তাদের ঠুনকো অহংবোধের মধ্যে রাখি। যতই পুরুষকে কঠিনতর হতে বাধ্য করি, ততই তাদের অহংবোধ আরও দুর্বল হতে থাকে। তারপর আমরা যেটা করি, নারীদের এই ভঙ্গুর অহংবোধকে যত্ন করতে বলি। নারীদের বলি নিজেদের সংকুচিত করতে। নিজেদের ক্ষুদ্রতর করতে। আমরা কন্যাসন্তানদের বলি: তোমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে। তবে তা খুব বেশি নয়। তারা সফলতার পেছনে ছুটতে পারবে; কিন্তু তা অতি সফলতা যেন না হয়। নইলে তা পুরুষদের প্রতি হুমকি দেওয়া হয়ে যাবে। যদি সম্পর্কে তুমি উপার্জনকারী হও, তাহলে বিশেষ করে জনসম্মুখে ভান করবে তুমি তা নও। নতুবা তাদের পুরুষত্বহীন বানানো হয়ে যাবে।

এ পর্যন্ত আমরা পুরুষদের যে ক্ষতিগুলো করে চলেছি তা হলো, পুরুষদের অনুভব করাই—তাদের কঠিন হতে হবে এবং তাদের ঠুনকো অহংবোধের মধ্যে রাখি। যতই পুরুষকে কঠিনতর হতে বাধ্য করি, ততই তাদের অহংবোধ আরও দুর্বল হতে থাকে। তারপর আমরা যেটা করি, নারীদের এই ভঙ্গুর অহংবোধকে যত্ন করতে বলি। নারীদের বলি নিজেদের সংকুচিত করতে। নিজেদের ক্ষুদ্রতর করতে।

এখন, একজন নারীর সাফল্য কেন একজন পুরুষের জন্য হুমকি হবে? আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল: তুমি কি উদ্বিগ্ন হবে যদি তোমার কারণে কোনো পুরুষের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হয়? আমি জবাব দিয়েছিলাম: এমন পুরুষের প্রতি আমার আগ্রহই থাকবে না। তাই আমি মোটেই উদ্বিগ্ন হব না। তারপরও বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তোলে। যেহেতু আমি নারী, তাই আমার থেকে প্রত্যাশা করা হয়, আমার বিয়ের আকাঙ্ক্ষা মুখ্য হতে হবে। জীবনের যেকোনো আকাঙ্ক্ষা পূরণের ভিত্তিমূলে আমাকে ভাবতে হবে, বিয়ে হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিয়ে আনন্দ, ভালোবাসা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার এক ভালো উৎস হতে পারে। কিন্তু একজন মেয়েকে কেন বিয়ের আকাঙ্ক্ষা করতে শিখাই, যেখানে ছেলেসন্তানকে একই শিক্ষা দিই না?

একজন নাইজেরিয়ান নারী তার বাড়ি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ, তিনি বাড়ির মালিক হলে তাকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে কোনো পুরুষের মনে আতঙ্ক কাজ করতে পারে। আমি একজন অবিবাহিত নাইজেরিয়ান নারীকে জানি, যেকোনো কনফারেন্সে যাওয়ার সময় তিনি বিয়ের আংটি পরে যান। তাতে তার ভাষায়, তার সহকর্মীরা তাকে ‘সম্মানের দৃষ্টিতে’ দেখবেন। বিয়ের আংটি তাকে অবধারিতভাবে সম্মানের যোগ্য করে তুলবে; দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আংটি ছাড়া খুব সহজে তার সম্মান বাতিল হয়ে যাবে এবং আধুনিক কাজের পরিবেশেও এমন অবস্থা দেখা যায়।

সমাজ শেখায় একটি নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে একজন নারীর বিয়ে না হওয়া গভীরভাবে তার একটি ব্যক্তিগত ব্যর্থতা। পুরুষের ক্ষেত্রে কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট বয়সসীমা থাকে না। বলা খুব সহজ যে, ‘কিন্তু নারীরা তো এসব কিছুর ব্যাপারে না বলে দিলেই পারে।’ কিন্তু বাস্তবতা অনেক কঠিন এবং জটিল। আমরা সামাজিক জীব। সমাজের অংশ হিসেবে সমাজের ধারণাগুলো আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় হয়ে যায়। এমনকি আমাদের ভাষার ব্যবহারেও তার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। যেমন, বিয়ের ভাষা হচ্ছে মালিকানার ভাষা, তা অংশীদারত্বের ভাষা নয়। সম্মান, শ্রদ্ধা শব্দটি নারীর থাকতে হবে পুরুষের জন্য। কিন্তু নারীর ব্যাপারে কোনো পুরুষকে সম্মান, শ্রদ্ধা শব্দের দিকে খেয়াল করতে হয় না। নারী এবং পুরুষ উভয়কে বলতে শোনা যায়: ‘আমি এটা করেছি আমার বিয়েতে শান্তি টিকিয়ে রাখার জন্য।’ যখন পুরুষ এমন কথা বলে, তখন তা এমনিতেও তার করা উচিত ছিল না। তারা তাদের বন্ধুদের আদরমাখা স্বরে উত্তেজিতভাবে বলে—এমন কিছু বলবে, যা শেষ পর্যন্ত তাদের পুরুষত্ব প্রমাণ করে। সে বলে: আমার স্ত্রী নিষেধ করেছে ক্লাবে আসতে। তাই প্রতিদিন না এসে শুধু সাপ্তাহিক ছুটিতে আসি। সংসারের শান্তির জন্য। যখন নারীরা বলে, ‘আমি বিয়ের শান্তি বজায় রাখার জন্য এটা করেছি,’ তখন তা সাধারণত বোঝায়, তারা একটি পেশা বা একটি ক্যারিয়ার লক্ষ্য বা একটি স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছেন। সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীদের শেখানো হয়, সমঝোতা করে চলা তাদের দায়িত্ব।

মেয়েদের বড় করে তোলার সময় একে অপরের প্রতি প্রতিদ্বন্দ্বিতা শেখানো হয়। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা চাকরি বা যেকোনো অর্জনের জন্য নয়। তাহলে তো ভালোই ছিল। পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা শেখানো হয়। ছেলেসন্তানরা যৌনজীবনে স্বাধীন থাকতে পারবে; কিন্তু মেয়েসন্তানদের ক্ষেত্রে তা চলবে না। ছেলেসন্তানদের বান্ধবী আছে জেনে আমরা অখুশি হই না। একজন ছেলেসন্তান তার বান্ধবীকে বাড়িতে নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু আমাদের কন্যাসন্তানরা কি তা করতে স্বাধীন? তবে যথাসময়ে মেয়েরা স্বামীযোগ্য নিখুঁত পুরুষকে বাড়িতে নিয়ে এলে তাতে সমস্যা নেই।

কন্যাসন্তানদের ব্যাপারে আমরা খবরদারি করি। মেয়েদের কুমারীত্ব বজায় রাখাকে প্রশংসা করি। কিন্তু ছেলেদের কুমারীত্ব থাকা নিয়ে প্রশংসা করি না (এবং আমি অবাক হই ভেবে, কীভাবে এই কুমারীত্বের নিয়মটি কাজ করবে, যেহেতু এই প্রক্রিয়ায় দুজন বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে সক্রিয় হতে হয়)।

সম্প্রতি নাইজেরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্রী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। নাইজেরিয়ার অনেক তরুণ ছেলে এবং মেয়ে উভয়েই বলল: ‘হ্যাঁ, ধর্ষণ অন্যায়; কিন্তু ওই মেয়েটি একটা ঘরে চারজন ছেলের সঙ্গে কী করছিল?’

চলুন, সম্ভব হলে, এমন ভয়ংকর অমানবিক জবাব ভুলে যাই। নাইজেরিয়ায় সহজাতভাবে নারীদের অপরাধবোধে আক্রান্ত করা হয়। নারীরা পুরুষদের থেকে এত কম আশা করতে শিখেছে যে, পুরুষদের এক আত্মনিয়ন্ত্রণহীন বর্বর প্রাণী হিসেবে ধারণা করার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে।

আমরা মেয়েদের চলনে, পোশাকে লজ্জা পেতে শিখাই। আমরা তাদের ভাবাই, তারা মেয়ে হিসেবে জন্ম নিয়েই যেন একটা অপরাধ করে ফেলেছে। তাই মেয়েরা যখন একসময় নারী হয়ে ওঠে, তখন কিন্তু বলতে পারে না, তাদের নিজের কোনো আকাঙ্ক্ষা আছে। তারা নিজেদের নিঃশব্দ করে রাখে। তারা বলতে পারে না, তারা আসলে কী চিন্তা করে। এই ভণ্ডামিকে একটি শৈল্পিক রূপ দেওয়া হয়েছে।

আমার পরিচিত একজন নারী আছেন, যিনি গৃহস্থালি কাজ খুব অপছন্দ করেন। কিন্তু বিয়ের আগে তিনি ভান করতেন, তিন গার্হস্থ্য কাজ পছন্দ করেন। কারণ, নাইজেরিয়ায় তাকে এমনটাই শেখানো হয়। এমন আচরণ একজনকে ভালো নারী হিসেবে পরিচিত করে। সেই নারী একসময় বিয়ে করেন। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে অভিযোগ উঠল—তিনি বদলে গেছেন। তার গার্হস্থ্য কাজে কোনো আগ্রহ নেই। আসলে তিনি তো বদলাননি। শুধু বিয়ের আগের মতো ভান করার ব্যাপারে ক্লান্ত হয়ে তা বাদ দিয়ে দিয়েছেন।

লিঙ্গসংক্রান্ত সমস্যা থাকে তার প্রেসক্রিপশনে। সেখানে ‘আমরা কেমন আছি,’ তা না বলে ‘আমাদের কেমন হওয়া উচিত’, তা বলা হয়। কল্পনা করুন, আমরা কতটা সুখী হতে পারতাম, কতটা বেশি মুক্ত অনুভব করতে পারতাম, যদি আমরা নিজের আসল ব্যক্তিচরিত্র প্রকাশ করতে পারতাম, আর যদি আমাদের ওপর লৈঙ্গিক প্রত্যাশার ভারী বোঝাটা না থাকত।

কল্পনা করুন, আমরা কতটা সুখী হতে পারতাম, কতটা বেশি মুক্ত অনুভব করতে পারতাম, যদি আমরা নিজের আসল ব্যক্তিচরিত্র প্রকাশ করতে পারতাম, আর যদি আমাদের ওপর লৈঙ্গিক প্রত্যাশার ভারী বোঝাটা না থাকত।

ছেলে আর মেয়ের শারীরিক ভিন্নতা অনস্বীকার্য। কিন্তু সামাজিক প্রক্রিয়া এই ভিন্নতাকে অতিরঞ্জিত করে এবং তা একটি আত্মসন্তুষ্টি প্রক্রিয়ায় টিকে থাকে। রান্নার উদাহরণ নেওয়া যাক। সাধারণত রান্না, ঘরবাড়ি পরিষ্কার নারীরাই করে থাকেন। কিন্তু কেন? নারীরা কি রান্না করার বংশাণু নিয়ে জন্মেছেন, নাকি সামাজিক প্রক্রিয়ায় রান্না করাকে তারা নারীদের ভূমিকা হিসেবে জেনেছেন? আমি যদি না জানতাম, আলংকারিক ‘শেফ’ উপাধি নিয়ে বিশ্বের অধিকাংশ বিখ্যাত বাবুর্চি হলো পুরুষ, তাহলে হয়তো ভাবতে পারতাম, নারীরা রান্নার বংশাণু নিয়ে জন্মেছেন।

আমি আমার মেধাবী মাতামহকে লক্ষ করতাম। তিনি যদি তরুণ বয়সে পুরুষের মতো সমান সুযোগ-সুবিধা পেতেন, তাহলে কি ওনার পক্ষে কিছু অর্জন করা সম্ভব ছিল? আইন এবং নিয়মনীতি পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে নারীরা আমার মাতামহের সময়ের চেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা পান। কিন্তু আমাদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান এ ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে। কেমন হতো, যদি সন্তানদের লালনপালন করার সময় লিঙ্গ না দেখে ‘সামর্থ্য’ বিবেচনা করা হতো? কেমন হতো, যদি লিঙ্গের চেয়ে সন্তানদের ‘আগ্রহ’কে প্রাধান্য দেওয়া হতো?

আমি এক পরিবারকে চিনি যাদের দুই সন্তান। পিঠাপিঠি এক ছেলে আর এক মেয়ে। দুই ভাইবোনই স্কুলে মেধাবী। যখন ভাইয়ের ক্ষুধা পায় তখন মা-বাবা কন্যাকে বলেন: ‘যাও, ভাইয়ের জন্য ইনডোমি নুডলস বানাও।’ মেয়েটি ইনডোমি নুডলস বানাতে পছন্দ করে না। কিন্তু সে একজন মেয়ে। তাই তাকে করতেই হবে। কেমন হতো, যদি মা-বাবা শুরু থেকে দুই সন্তানকেই নুডলস বানাতে শেখাতেন? রান্না শেখা একজন ছেলের জন্য জীবন চালাতে খুব দরকারি একটি শিক্ষা। নিজেকে পুষ্টি দেওয়ার মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ সক্ষমতা অন্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া আমার কাছে কখনোই অর্থপূর্ণ ব্যাপার মনে হয়নি।

 আমি এক দম্পতিকে চিনি। স্বামী এবং স্ত্রীর একই ডিগ্রি, একই চাকরি। কাজ শেষে বাসায় ফিরে এলে ঘরের অধিকাংশ কাজ স্ত্রী করেন, যা অনেকের বিবাহিত জীবনে ঘটে। কিন্তু একটা ব্যাপারে আমার খটকা লাগে। স্বামী যখনই বাচ্চার ডায়াপার বদলান, তখনই স্ত্রী স্বামীকে ‘ধন্যবাদ’ জানান। কেমন হতো, যদি স্বামীর এই কাজটাকে স্ত্রী স্বাভাবিকভাবে নিতে পারতেন। বাবা হিসেবে তার স্বামী সন্তানের যত্ন করবেন, সেটা কি স্বাভাবিক হওয়ার কথা নয়?

শিশুকাল থেকে লৈঙ্গিক আচরণের অনেক শিক্ষা আমাকে আত্মস্থ করতে হয়েছিল। বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমি সেগুলো বাতিল করতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তবু মাঝে মাঝে লিঙ্গজনিত প্রত্যাশার মুখে দুর্বল বোধ করেছি। প্রথম যেদিন গ্র্যাজুয়েট স্কুলে লেখা শেখার ক্লাসে শিক্ষকতা করতে যাচ্ছিলাম, সেদিন আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম। আমার এই চিন্তা, উদ্বেগ ক্লাসে পড়ানোর বিষয়বস্তু নিয়ে ছিল না। আমার প্রস্তুতি ভালো ছিল এবং আমি আমার শিক্ষকতার ব্যাপারটি উপভোগ করছিলাম। ক্লাসে কী পোশাক পরে যাব, তা নিয়ে আমার উদ্বিগ্নতা ছিল। আমি উপলব্ধি করেছিলাম, নারী হওয়ার কারণে আমার যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। খুব বেশি মেয়েলি বা স্ত্রী লিঙ্গাত্মক দেখালে আমাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হবে না। তাই আমি পুরুষালি, সিরিয়াস এবং কুৎসিত একটি স্যুট পরলাম। বাস্তবতা ছিল, চেহারাগত উপস্থিতির ক্ষেত্রে পুরুষালি ইমেজকে একটি মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয়। যত বেশি কম নারীসুলভ লাগবে, তত বেশি তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। একটা ব্যাবসায়িক মিটিংয়ে যাওয়ার সময় একজন পুরুষকে ততটা ভাবতে হয় না। কিন্তু নারীকে ভাবতে হয়। খুব ভালো হতো, যদি সেদিন আমাকে সেই কুৎসিত স্যুটটা না পরতে হতো। সেদিন যদি আমি আজকের মতো আত্মবিশ্বাসী থাকতাম, তাহলে আমার ছাত্ররা আমার শিক্ষকতা থেকে আরও উপকৃত হতে পারত। (পাশ্চাত্যে প্রফেশনাল নারীদের বেশভূষা লক্ষ করলেও সেটা বোঝা যাবে। চুলের স্টাইল থেকে শুরু করে পোশাকের ধরনে পুরুষালি প্রভাবের পেছনে কি এই মনস্তত্ত্ব কাজ করে?)

আমি আমার নারীত্ব প্রকাশে আর লজ্জিত নই। ক্ষমাপ্রার্থী নই। আমি আমার সব নারীসুলভ প্রকাশ নিয়েই সম্মানিত হতে চাই। কারণ, সেটা আমার প্রাপ্য। আমি রাজনীতি, ইতিহাস পছন্দ করি। আমি সবচেয়ে খুশি হই, যখন বিভিন্ন ধারণা বিষয়ে যৌক্তিক আলোচনা করতে পারি। আমি মেয়েলি থাকতে পেরে খুব সুখী। আমি উঁচু হিলের জুতা পরতে এবং লিপস্টিক লাগাতে পছন্দ করি। নারী এবং পুরুষ উভয়ের থেকে প্রশংসা পেতে পছন্দ করি (তবে সত্যি বলতে, আমি স্টাইলিশ মহিলাদের প্রশংসাকে অগ্রাধিকার দিই)। আমার পোশাক নির্বাচন পুরুষ পছন্দ করবে কী করবে না, তা গুরুত্ব দিই না। আমি সেই পোশাক পরি, যা আমি পছন্দ করি এবং আমি যাতে ভালো বোধ করি।

আমি আমার নারীত্ব প্রকাশে আর লজ্জিত নই। ক্ষমাপ্রার্থী নই। আমি আমার সব নারীসুলভ প্রকাশ নিয়েই সম্মানিত হতে চাই। কারণ, সেটা আমার প্রাপ্য। আমি রাজনীতি, ইতিহাস পছন্দ করি। আমি সবচেয়ে খুশি হই, যখন বিভিন্ন ধারণা বিষয়ে যৌক্তিক আলোচনা করতে পারি। আমি মেয়েলি থাকতে পেরে খুব সুখী।

লিঙ্গ বিষয়ে আলোচনা সহজ ব্যাপার নয়। মানুষ এ ব্যাপারে কথা বলতে অস্বস্তিবোধ করে বা আলাপ শুরু হলে তাতে বিরক্তিবোধ করে। নারী-পুরুষ উভয়ে লিঙ্গ বিষয়ে কথা বলতে চায় না বা লিঙ্গসমস্যা নিয়ে আলাপ শুরু হলে তা তাড়াতাড়ি শেষ করে দিতে চায়। কারণ, গতানুগতিকতায় পরিবর্তন আনতে গেলে তাদের এক আরামদায়ক অবস্থান ত্যাগ করতে হয়।

কিছু মানুষ প্রশ্ন করে: নারীবাদ শব্দটির কী প্রয়োজন? কেন তুমি নিজেকে মানবাধিকারকামী বা সেই ধরনের কিছু দাবি কর না? অবশ্যই নারীবাদ মানবাধিকারের অংশ। কিন্তু মানবাধিকারের মতো একটা বিশাল ব্যাপারের মধ্যে নারীবাদের মতো একটি নির্দিষ্ট ব্যাপার অন্তর্ভুক্ত করে রাখলে বিষয়ের গুরুত্বের প্রতি অসততা করা হয়। তাতে ভান করা হয় যে, শত শত বছর ধরে নারীদের উপেক্ষা করা হয়নি। এর মাধ্যমে অস্বীকার করা হয়, নারীকে কেন্দ্র করে লিঙ্গগত সমস্যা নেই। অস্বীকার করা হয়, মানুষ হওয়ার জন্য নয়, সুনির্দিষ্টভাবে নারী হওয়ার জন্য সমস্যা তৈরি হয়েছে। শত শত বছর ধরে মানবজাতিকে বিশ্ব দুই ভাগে ভাগ করেছে। তারপর এক ভাগকে অর্থাৎ নারীকে বাইরে রেখে শোষণ করা হয়েছে। তাই সমাধানের জন্য আলাদাভাবে নারীবাদকে স্বীকৃতি দিতে হবে।

পুরুষরা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যে কর্তৃত্বের স্থান পেয়েছে এবং তারা যেভাবে শিশুকাল থেকে বেড়ে উঠেছে, সেই কারণে নারীবাদের ধারণাটি তাদের আত্মমর্যাদা টিকিয়ে রাখার জন্য হুমকি মনে হয়। কোনো পুরুষ হয়তো বলবেন, আচ্ছা, নারীবাদের ধারণাটি ভালো। কিন্তু আমি সেভাবে ভাবি না। আমি এমনকি লিঙ্গ নিয়েই ভাবি না।

পুরুষরা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যে কর্তৃত্বের স্থান পেয়েছে এবং তারা যেভাবে শিশুকাল থেকে বেড়ে উঠেছে, সেই কারণে নারীবাদের ধারণাটি তাদের আত্মমর্যাদা টিকিয়ে রাখার জন্য হুমকি মনে হয়।

হয়তো না এবং এটাই সমস্যার একটি অংশ যে, অনেক পুরুষ সক্রিয়ভাবে লিঙ্গ বিষয়ে ভাবে না বা খেয়াল করে না। যেমন, আমার বন্ধু লুইস বলেছিল, অতীতে হয়তো নারীদের সমস্যা ছিল; কিন্তু এখন সব ঠিকঠাক। অনেক পুরুষ তাই পরিবর্তনের জন্য কিছু করে না। রেস্টুরেন্টে ঢোকার সময় যখন শুধু পুরুষকে অভ্যর্থনা জানানো হয়, তখন সেই পুরুষ সঙ্গী ওয়েটারকে জিজ্ঞাসা করে না, তুমি আমার পাশের নারীকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছ না কেন? এ ধরনের আপাতদৃষ্টিতে সব ছোট ছোট ক্ষেত্রে পুরুষদের কথা বলতে হবে।

যেহেতু লিঙ্গ বিষয়টি অস্বস্তিকর, তাই যেকোনো উপায়ে এ ব্যাপারে আলোচনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিছু মানুষ তখন বিবর্তনবাদ আর নরবানরের প্রসঙ্গ নিয়ে আসবে। বলবে, নারী নরবানর পুরুষ নরবানরকে কুর্নিশ করে। কথা হলো, আমরা তো নরবানর নই। নরবানর গাছে বাস করে এবং কেঁচো খায়। আমরা তো তা করি না।

নারীবাদ নিয়ে কথা বললে কেউ কেউ মন্তব্য করে, দরিদ্রদেরও তো অনেক সমস্যা। তা ঠিক। কিন্তু লিঙ্গ এবং শ্রেণি ভিন্ন দুটি ব্যাপার। পুরুষ হওয়ার যে সুবিধাগুলো থাকে, তা দরিদ্র পুরুষদের ক্ষেত্রেও থেকে যায়।

কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের সঙ্গে বলে আমি নিপীড়নের ব্যবস্থা এবং কীভাবে তারা একে অপরের প্রতি অন্ধ হতে পারেন, সে ব্যাপারে অনেক কিছু শিখেছি। একদিন একজন প্রশ্ন করেন, কেন নিজেকে একজন নারী হিসেবে দেখছ? কেন নিজেকে একজন মানুষ হিসেবে দেখছ না? এ ধরনের প্রশ্নগুলো আসলে কারোর নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার ব্যাপারে চুপ করিয়ে দেওয়ার একটি উপায়। অবশ্যই আমি একজন মানুষ। কিন্তু শুধু নারী হওয়ার কারণে কিছু নির্দিষ্ট ব্যাপার আমার সঙ্গে ঘটে থাকে। যিনি আমাকে এই প্রশ্ন করেছেন, তিনি কিন্তু একজন কৃষ্ণাঙ্গ। তিনি প্রায়ই কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার অভিজ্ঞতা আলাপ করেন। আমার হয়তো জবাব দেওয়া উচিত ছিল: আপনার অভিজ্ঞতা কেন একজন মানুষ হিসেবে নয়? কেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে?

অনেকে বলেন, ‘ওহ্‌, কিন্তু নারীদের তো আসল ক্ষমতা আছে: বটম পাওয়ার বা তলার ক্ষমতা।’ তলার ক্ষমতা একটা নাইজেরিয়ান ভাষা। তলার ক্ষমতা হলো যৌন ক্ষমতা ব্যবহার করে পুরুষদের কাছ থেকে নারীদের সুবিধা আদায় করা। কিন্তু এই তলার ক্ষমতা আসলে কোনো ক্ষমতা নয়; এটা একটা পদ্ধতি, যার মাধ্যমে পুরুষের ক্ষমতায় একটু চাপ দিয়ে নারী সুবিধা আদায় করে। তারপর কী ঘটবে যদি সেই পুরুষ খারাপ মুডে থাকে বা অসুস্থ থাকে বা নপুংসক হয়?

অনেকে বলেন, আমাদের সংস্কৃতির কারণে নারীরা পুরুষের অধস্তন থাকে। কিন্তু সংস্কৃতি তো ক্রমাগত বদলাচ্ছে। আমার দুজন সুন্দরী যমজ ভাতিজি আছে। কয়েক শ বছর আগে তারা জন্মালে তাদের জন্মের পরপরই হত্যা করা হতো। কারণ, কয়েক শ বছর আগে ইগবো সম্প্রদায়ে মনে করা হতো, যমজ সন্তানের ওপর অশুভ শক্তির প্রভাব থাকে। বর্তমানে সেই একই ইগবো সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে এই সংস্কৃতির চর্চা একেবারে অবিশ্বাস্য।

সংস্কৃতির উদ্দেশ্য কী? সংস্কৃতি মানুষকে সংরক্ষণ এবং তার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে শেষ পর্যন্ত কাজ করে যায়। ইগবো সম্প্রদায়ের সংস্কৃতিতে কাছের এবং দূরের সম্পর্কের শুধু পুরুষ সদস্যদের অংশগ্রহণে পারিবারিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের জন্য মিটিং হয়। আমি আমার পরিবারের ঐতিহ্য, পূর্বপুরুষের বাসস্থান, ইতিহাস জানতে সবচেয়ে আগ্রহী। আমার ভাইয়েরা আমার মতো এসব ব্যাপারে আগ্রহী নয়। কিন্তু সেই পারিবারিক মিটিংয়ে আমার ভাইয়েরা সুযোগ পায়। আমি সুযোগ পাই না। কোনো সিদ্ধান্তে আমার কিছু বলার সুযোগ নেই। কারণ, আমি একজন নারী।

সংস্কৃতি মানুষকে বানায় না, মানুষ সংস্কৃতি তৈরি করে। যদি এটি সত্য হয়, নারীদের জন্য সম্পূর্ণ মানবিকতা আমাদের সংস্কৃতি নয়, তবে এটিকে আমাদের সংস্কৃতি হিসেবে গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক।

ওকোলোমা নামে ছোটবেলার যে ঘনিষ্ঠ ছেলেবন্ধু আমাকে প্রথম নারীবাদী বলেছিল, সে ২০০৫ সালে সসোলিসো প্লেন ক্র্যাশে মারা গিয়েছিল। প্রায়ই আমার তার কথা মনে পড়ে। অনেক বছর আগে ওকোলোমা সেদিন ঠিকই বলেছিল। আমি একজন নারীবাদী। সেই সময় আমি অভিধানে নারীবাদীর অর্থ খুঁজে পেয়েছিলাম—নারীবাদী: একজন ব্যক্তি, যিনি লিঙ্গের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমতায় বিশ্বাস করেন।

শুনেছি, আমার প্রমাতামহ একজন নারীবাদী ছিলেন। তিনি পরিবারের মতের বিরুদ্ধে পালিয়ে গিয়ে নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলেন। নারী হওয়ার কারণে তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হলে তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি নারীবাদী শব্দটি জানতেন না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তিনি নারীবাদী ছিলেন না। আমাদের আরও অনেকের এই নারীবাদী শব্দটিকে পুনরুদ্ধার করা উচিত। আমার জানামতে, সর্বশ্রেষ্ঠ নারীবাদী ছিলেন আমার ভাই, যিনি একই সঙ্গে খুব দয়ালু, সুদর্শন এবং খুবই পুরুষোচিত একজন তরুণ ছিলেন।

আমার সংজ্ঞায় নারীবাদী হচ্ছেন একজন নারী বা পুরুষ, যিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আজকের লিঙ্গপরিচয়ের মধ্যে সমস্যা আছে। আমাদের অবশ্যই এর সমাধান করা উচিত, আমাদের অবশ্যই আরও ভালোভাবে চেষ্টা করা উচিত।’

আমার সংজ্ঞায় নারীবাদী হচ্ছেন একজন নারী বা পুরুষ, যিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আজকের লিঙ্গপরিচয়ের মধ্যে সমস্যা আছে। আমাদের অবশ্যই এর সমাধান করা উচিত, আমাদের অবশ্যই আরও ভালোভাবে চেষ্টা করা উচিত।’

নারী এবং পুরুষ—আমাদের সবার আরও ভালো করা উচিত।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •