সরেজমিন পায়রা কয়লা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র ও পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকা

উন্নয়ন উদ্বাস্তুদের বেঁচে থাকার লড়াই

সরেজমিন পায়রা কয়লা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র ও পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকা

শহিদুল ইসলাম সবুজ

বহুল প্রচারিত পায়রা কয়লা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের এক নম্বর ইউনিটে উৎপাদন শুরু হয়েছে প্রায় বছরখানেক ধরে। গত অক্টোবর মাসের ২৭ তারিখ থেকে প্রায় সপ্তাহব্যাপী সরেজমিন প্রকল্প এলাকায় খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলাম আমরা। কেমন চলছে চালু হওয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রটি? স্থানীয় নারী-শিশুসহ সাধারণ মানুষ এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কতটুকু সুযোগ-সুবিধা বা অসুবিধা ভোগ করছে? এসব প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতে গিয়ে যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, উচ্ছেদ করা হয়েছে—সেসব পরিবারের সদস্যরা কেমন আছেন? কোথায় বসতি করেছেন? পেশার কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না, তা জানার জন্য প্রকল্পসংশ্লিষ্ট এলাকা সফর করে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি।

এলাকা ও প্রকল্প পরিচিতি

দেশের সর্বদক্ষিণের জেলা পটুয়াখালীর বঙ্গোপসাগর বিধৌত কলাপাড়া বা খেপুপাড়া উপজেলাটি ‘গলাচিপা নদী’র তীরে অবস্থিত। গলাচিপা নদীর আরও অনেক শাখা ছোট ছোট নদী, খাল কলাপাড়ার বুক চিরে প্রবাহিত। সমুদ্রের প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে, খাপ খাইয়ে এ অঞ্চলের মানুষ শত শত বছর ধরে বসবাস করে আসছেন। বর্তমান সরকার কলাপাড়া উপজেলার বঙ্গোপসাগর ও গলাচিপা নদীর তীর ঘেঁষে লালুয়া ইউনিয়ন, ধানখালী ইউনিয়ন ও টিয়াখালী ইউনিয়নের হাজার হাজার বাসিন্দার জমিজমা, ভিটেমাটি অধিগ্রহণ করে, তাদের উচ্ছেদ করে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ব্যয়বহুল তিনটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির অবস্থান ধানখালী ইউনিয়নে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দরের (পরবর্তী সময়ে বাতিলকৃত) অবস্থান লালুয়া ও টিয়াখালী ইউনিয়নে। এর মধ্যে কয়লাচালিত ১ হাজার ২৮০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র এক বছর ধরে উৎপাদন শুরু করেছে।

পায়রা কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান ফটক, ছবি: শহিদুল ইসলাম সবুজ

সরকার কলাপাড়া উপজেলার বঙ্গোপসাগর ও গলাচিপা নদীর তীর ঘেঁষে লালুয়া ইউনিয়ন, ধানখালী ইউনিয়ন ও টিয়াখালী ইউনিয়নের হাজার হাজার বাসিন্দার জমিজমা, ভিটেমাটি অধিগ্রহণ করে, তাদের উচ্ছেদ করে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ব্যয়বহুল তিনটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির অবস্থান ধানখালী ইউনিয়নে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দরের (পরবর্তী সময়ে বাতিলকৃত) অবস্থান লালুয়া ও টিয়াখালী ইউনিয়নে। এর মধ্যে কয়লাচালিত ১ হাজার ২৮০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র এক বছর ধরে উৎপাদন শুরু করেছে।

১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের অপর তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটির ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। অপর একটি মেগা প্রকল্প পায়রা সমুদ্রবন্দরের কাজ, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ পর্যায়েই ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে আছে। শোনা যাচ্ছে, সমুদ্রের নাব্যতাহীনতার কারণে এই সমুদ্রবন্দরটি এখানে আর করা হবে না। কিন্তু সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে, স্থানীয় জনগণের হাজার হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। কোটি টাকা খরচ করে সেসব জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে নানা ধরনের ভৌত অবকাঠামো। এই অবকাঠামোগুলো কী কাজে ব্যবহৃত হবে, তা কেউই বলতে পারছেন না। অথচ পুরো অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তার পাশে কিংবা বিলের মাঝখানে এখন উন্নয়ন-উদ্বাস্তুদের নতুন নতুন ডেরার মতো গড়ে তোলা টিনের ঘর।

স্থানীয়দের অভিজ্ঞতা ও যন্ত্রণা

প্রথমে কথা হয় স্থানীয় মোটরসাইকেলচালক আবু ছালের সঙ্গে। তার বাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে হলেও তিনি পেশাগত কারণে কেন্দ্র দুটির নির্মাণকাজের শুরু থেকেই আজ পর্যন্ত প্রতিদিন প্রায় দু-তিনবার প্রকল্প এলাকাটিতে যাওয়া-আসা করেন। ১ নম্বর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হওয়ার পর তারা কী কী সুবিধা ভোগ করছেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিদিন তিন-চারবার লোডশেডিংসহ প্রতি ঘরে ঘরে বিদ্যুতের তার টানা ছাড়া খুব বেশি উপকার এলাকার জনগণ ভোগ করছে না। তবে তার মতে, আগামী দিনগুলোয় ভোগান্তি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে! অঞ্চলজুড়ে তাপমাত্রা আরও বেড়ে যেতে পারে, যার নমুনা গত এক বছরে কিছুটা হলেও টের পেয়েছে এলাকার মানুষ। তার ভাষায়: ‘আমার মায়ের বয়স ৭০ বছরের কাছাকাছি হতে পারে। আমার গ্রামের বাড়ি কলাপাড়া শহর থেকে ৬–৭ কিলোমিটার দূরে এবং কয়লা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৬–১৭ কিলোমিটার দূরে। শারীরিকভাবে মা অসুস্থ। কিন্তু চিকিৎসার জন্যও তিনি কলাপাড়া শহরে আসতে চান না। শহরে নিয়ে আসতে চাইলে তিনি বলেন: ‘ওখানে যাব না। ওখান থেকে একটু কাছেই কয়লা পোড়াইয়া বিদ্যুৎ বানানোর কারখানা (কয়লা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র)। ওই কারখানা চালু হওয়ার পর এমনিতেই গরম বেড়ে গেছে, ওখানে গেলে আমি গরমে মরে যাব। বিদ্যুতের কারখানা থেকে বাইর হওয়া ধোঁয়ায় আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে! ওখানে গেলে আমি শ্বাস নিতে পারব না।’

তার মতে, ‘পরিবেশটা এখনই হয়তো আমার মায়ের আশঙ্কার মতো এত ভয়াবহ হয়নি। কিন্তু তার মনে যে ভয় ঢুকেছে, সেই ভয় তাড়ানোর ওষুধ তো আমার কাছে কিংবা কারও কাছেই নেই।’

একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার পর এর ধোঁয়ার সঙ্গে নির্গত কার্বনমিশ্রিত ছাইয়ের প্রকোপে ২৫–৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নারকেল-সুপারিগাছের ফলন কমে গেছে। ফলন যতটুকুই হয়, তা-ও আবার পরিপুষ্ট হতে পারে না। ৫০–৬০ ভাগ আগেই শুকিয়ে যায়, শুঁটকি দিয়ে যায় এবং ঝরে পড়ে। অনেক গাছের আগা মরে যাওয়া শুরু হয়ে গেছে।

ধান, রবিশস্য, প্রাকৃতিক মাছ, নারকেল সুপারি এ এলাকার অন্যতম অর্থকরী ফসল। একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার পর এর ধোঁয়ার সঙ্গে নির্গত কার্বনমিশ্রিত ছাইয়ের প্রকোপে ২৫–৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নারকেল-সুপারিগাছের ফলন কমে গেছে। ফলন যতটুকুই হয়, তা-ও আবার পরিপুষ্ট হতে পারে না। ৫০–৬০ ভাগ আগেই শুকিয়ে যায়, শুঁটকি দিয়ে যায় এবং ঝরে পড়ে। অনেক গাছের আগা মরে যাওয়া শুরু হয়ে গেছে। এখন বর্ষাকাল হওয়ায় গাছগুলোর পাতায় ছাইয়ের কালো আস্তরণ দেখা যায় কম। তারপরও একটু ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যায়, পাতাগুলো কার্বনমিশ্রিত ছাইয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে মোটা বা ভারী হয়ে যাচ্ছে! গাছগুলোরও যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে! স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে: দুই নম্বর কেন্দ্রটি চালু হলে এলাকাটি আর বসবাসের যোগ্য থাকবে কি না!

৩টি নারিকেল গাছের দু’টিই মরতে বসেছে, যেটি বেঁচে আছে সেটিরও পাতা ছাই দূষণের শিকার, ছবি: শহিদুল ইসলাম সবুজ

কথা হয় কলাপাড়া সদরের পাশের গ্রামের কৃষক সুজন মিয়ার সঙ্গে। তিনি কৃষিকাজের পাশাপাশি ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালান। তার মোটরসাইকেলে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকায় যেতে যেতেই কথা হয় তার সঙ্গে। প্রকল্প এলাকায় গিয়ে চায়ের দোকানে বসে অনেকক্ষণ আড্ডা হয়, কথা হয়। তিনি বলতে থাকেন, ফসলি জমির বাইরেও তিনি তার পুরো বাড়ির বিশাল আঙিনাজুড়ে বিভিন্ন ফল ও শাকসবজি চাষ করেন। ৫ বছর আগে শহর থেকে বেশ কয়েকটি দামি পেয়ারাগাছ এনে লাগিয়েছিলেন। গাছগুলোয় অনেক পেয়ারা ধরত। এর মধ্যে দুটি গাছের পেয়ারা পাকলে ভেতরে হলুদ রং হয়ে যেত, সুন্দর ঘ্রাণ এবং খেতে অনেক মিষ্টি লাগত। পরিবারের সবাই খেতে পারত, আত্মীয়স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশীকেও সেই পেয়ারা উপহার দেওয়া যেত। কিন্তু গত বছর ১ নম্বর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হওয়ার পর, গাছে এবার আর তেমন পেয়ারা ফলেনি। যতটুকু ফলেছে, তা-ও পরিপুষ্ট হয়নি। গাছগুলোর পাতা প্রথমে কালো হয়ে যাচ্ছে, পরে হলুদ হয়ে ঝরে পড়ছে।

সুজনের মোটরসাইকেলে ঘুরতে ঘুরতে চালু হওয়া ১ নম্বর বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কয়লা টার্মিনালের কাছে গেলে, সেখানে কর্তব্যরত একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা (পুলিশের এসআই) সামনের দিকে ইশারা করে বললেন, এই কেন্দ্রটি যেহেতু চালু হয়ে গেছে, ভেতরে ঢোকার কোনো পারমিশন নেই। ৫ মিনিট হাঁটলেই সামনে আরেকটি কেন্দ্র হচ্ছে, সেখানে গেলে অনেক কিছু দেখতে পারবেন। তার দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরে আমরা এগিয়ে যাই। মোটরসাইকেলে ৩০–৪০ সেকেন্ড যাওয়ার পরই ২ নম্বর কয়লা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশের ফুলতলী বাজারে পৌঁছাই। একটি চায়ের দোকানে স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলে, কথাবার্তায় প্রভাবশালী একজন বলে উঠলেন: যারা উচ্ছেদ হয়েছেন, যাদের ভূমি অধিগ্রহণ হয়েছে, তাদের কথা যদি জানতে চান, তাহলে আমার সঙ্গে একটু সময় দেবেন, আমি আপনাকে নিয়ে তাদের কাছে যাব (সংগত কারণেই এখানে তার নাম উল্লেখ করা যাচ্ছে না)। তার কথা শুনে এবং আন্তরিকতা দেখে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি আমাদের নিয়ে রওনা দিলেন বালু ভরাট এবং অবকাঠামো নির্মাণ পর্যায়ের ২নং কয়লা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে। বললেন, একটু সাবধানে চলবেন, প্রচুর বালুর মধ্য দিয়ে হাঁটতে হবে, প্রায় ২০ ফুট উঁচু বালু। এর মধ্যে অনেক জায়গায় পা দেবে যায়।

এই প্রকল্পটির বালু ভরাটের কাজও প্রায় শেষ, ৮০ শতাংশই ভরাট হয়ে গেছে। বালুর মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে তিনি বলছিলেন, ‘যে বালুর ওপর দিয়ে আপনি হাঁটছেন, সেই বালুর নিচে কত মানুষের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা, সম্ভাবনা, অনেকের বাপ-দাদাসহ কয়েক পুরুষের কবর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, সেটা আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না।’ সাড়ে নয় শ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠছে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় প্রকল্পটি। বালুর ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতেই চোখে পড়ল বালুর নিচে চাপাপড়া ঘরবাড়ির দু-একটি টিনের চাল। তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন প্রকল্পটির দক্ষিণ-পূর্ব দিকের সর্বশেষ অবশিষ্ট কয়েকটি বাড়িতে। অসাধারণ সুন্দর সাজানো পুকুর, গাছপালা, পশুপাখি নিয়ে গোছানো ছোট্ট গ্রাম ছিল এটি। এই গ্রামের বাসিন্দাদেরও নোটিশ দেওয়া হয়েছে, এক সপ্তাহের মধ্যে ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য।

বালির উপর পরিত্যক্ত টিনের চালা এবং যে পাইপের মাধ্যমে বালি এনে গ্রামবাসীর স্বপ্ন আশা চাপা দেয়া হয়েছে, ছবি: শহিদুল ইসলাম সবুজ

সাড়ে নয় শ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠছে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় প্রকল্পটি। বালুর ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতেই চোখে পড়ল বালুর নিচে চাপাপড়া ঘরবাড়ির দু-একটি টিনের চাল। তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন প্রকল্পটির দক্ষিণ-পূর্ব দিকের সর্বশেষ অবশিষ্ট কয়েকটি বাড়িতে। অসাধারণ সুন্দর সাজানো পুকুর, গাছপালা, পশুপাখি নিয়ে গোছানো ছোট্ট গ্রাম ছিল এটি। এই গ্রামের বাসিন্দাদেরও নোটিশ দেওয়া হয়েছে, এক সপ্তাহের মধ্যে ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য।

প্রথমে যে ঘরটিতে আমরা বসলাম তার মালিক সমের্ত বেগম। ৫০–৫৫ বছরের এই নারী জানান, এটা তার বাপদাদার বাড়ি। তিনি যাকে বিয়ে করেছেন, তার নাম হানিফ হাওলাদার। বয়স ৬৫ বছর। তিনি পেশায় একজন ভ্যানচালক। তাদের দুই ছেলে দুই মেয়ে। সবাই বিবাহিত। মেয়ে দুটি শ্বশুরবাড়িতে মোটামুটি ভালো আছে। দুটি ছেলে, তাদের বউ নাতি-নাতনিদের নিয়ে এই বাড়িতেই থাকতেন। তার স্বামীর নিজের কোনো ভিটেবাড়ি নেই। তাই সমের্ত বেগমের বাবা হোসেন হাওলাদার মেয়েজামাইকে থাকার জন্য এখানে সামান্য একটু জমি দিয়েছিলেন। গত ৪০ বছরে হানিফ হাওলাদার গতর খেটে, কামলা দিয়ে, তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন এই বাড়ি এবং কিনেছিলেন ৪ বিঘার বেশি জমি। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র তাদের ৪ বিঘা জমির পুরোটাই অধিগ্রহণ করার নামে কেড়ে নিয়েছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১ কোটি টাকা বলে তিনি দাবি করেন। অথচ জমির কোনো ক্ষতিপূরণ এখনো তারা পাননি। আদৌ কোনো টাকাপয়সা তাদের দেওয়া হবে কি না, তা জানায়নি কর্তৃপক্ষ।

গত ৪০ বছরে হানিফ হাওলাদার গতর খেটে, কামলা দিয়ে, তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন এই বাড়ি এবং কিনেছিলেন ৪ বিঘার বেশি জমি। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র তাদের ৪ বিঘা জমির পুরোটাই অধিগ্রহণ করার নামে কেড়ে নিয়েছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১ কোটি টাকা বলে তিনি দাবি করেন। অথচ জমির কোনো ক্ষতিপূরণ এখনো তারা পাননি। আদৌ কোনো টাকাপয়সা তাদের দেওয়া হবে কি না, তা জানায়নি কর্তৃপক্ষ।

এই জমির অধিকাংশই তারা কিনেছিলেন দলিলমূলে। কিন্তু ভোগদখল করছেন ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে। সমের্ত বেগম জানান, এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই এভাবে দলিলমূলে জমি কেনেন। তারপর ধীরে ধীরে এই জমির রেকর্ড করা হয়, তাতে অনেক বছর পার হয়ে যায়। তাদের ৩০ লাখ টাকা দামের ঘরের মূল্য ধরা হয়েছে মাত্র ১৫ লাখ টাকা। মূল্য বাবদ বরাদ্দকৃত ১৫ লাখ টাকা তুলতে ঘুষ এবং দালালদের দিতে হয়েছে ৬ লাখ টাকা। বাকি ৯ লাখ টাকার একটা অংশ দিয়ে দুই ছেলেকে দুটি মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছেন। তারা আগে নিজেদের খেতখামারে কাজ করতেন। এখন মোটরসাইকেল চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাদের এই ছোট্ট গ্রামটিতে এখনো উন্নয়নের বালু এসে সবকিছু চাপা দেয়নি। কিন্তু তাদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে, সাত দিনের মধ্যে ঘরবাড়ি ভেঙে নিতে। না-নিলে সবকিছু বালুর নিচে চাপা পড়বে বলেও হুমকি দিয়েছে। বড় নদীতে ড্রেজারের সঙ্গে লাগানো ২০ ইঞ্চি ব্যাসের মোটা পাইপ তাদের বাড়িঘরের তিন দিকে ঘিরে ফেলেছে। পাইপ দিয়ে নদী থেকে টেনে আনা বালু দিয়ে ইতোমধ্যে পুরো প্রকল্পের অধিকাংশ ভরে ফেলা হয়েছে। এই ৯৫০ একর জমির ভেতর হাজারখানেক পরিবার ছিল, ঘর ছিল, অনেকের মা-বাবা-দাদা-দাদিসহ পূর্বপুরুষের কবর ছিল। তাদের অনেকেই নিজেদের বাড়িঘরটুকু ভেঙে নিয়ে যাওয়ার সময় পাননি।

৩০ লাখ টাকা দামের ঘরের মূল্য ধরা হয়েছে মাত্র ১৫ লাখ টাকা। মূল্য বাবদ বরাদ্দকৃত ১৫ লাখ টাকা তুলতে ঘুষ এবং দালালদের দিতে হয়েছে ৬ লাখ টাকা। বাকি ৯ লাখ টাকার একটা অংশ দিয়ে দুই ছেলেকে দুটি মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছেন। তারা আগে নিজেদের খেতখামারে কাজ করতেন। এখন মোটরসাইকেল চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।

মামলা ও অঙ্গীকারনামা

বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অধিগ্রহণের পর বালু ভরাটের শুরুর দিকে প্রকল্প এলাকার মধ্যে থাকা পরিবারগুলোর সঙ্গে কোনো আলোচনা না-করেই শুরু হয় বালু ভরাট ও উচ্ছেদ। নিজেদের ঘরবাড়ি, বাগান, পুকুর, ফসলি জমি সবই তখন বালুর নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসন করা হচ্ছে না। এ অবস্থায় সর্বহারা হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের তিনজন পটুয়াখালী জজ আদালতে দেওয়ানি মোকদ্দমা ১১৫/২০১৭ এবং দেওয়ানি মোকদ্দমা ৫৩/২০১৭ দায়ের করেন। মামলা করার পর পটুয়াখালী জজকোর্ট থেকে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে শুধু ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের সঙ্গে সমঝোতায় আসার পরই কাজ শুরুর নির্দেশ প্রদান করা হয়। বাধ্য হয়ে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের (আরপিসিএল) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইকবাল করিম ৫/৯/২০১৮ তারিখে ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে স্থানীয় নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে একটি ১৪ দফা সমঝোতা চুক্তি বা অঙ্গীকারনামা সই করেন (প্রথম পক্ষ: লোন্দা মৌজার ২নং সিটের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পক্ষে (১) মো. আব্দুল লতিফ সরদার, পিতা: মৃত আফসের আলী সরদার, (২) অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট আবুল বশার ওরফে রজ্জব সরদার, পিতা: মৃত আপ্তার আলী সরদার, (৩) মো. হাসিবুল ইসলাম নয়ন, পিতা: মৃত শফিউল বশার, উভয় সাং: লোন্দা, ধানখালী, উপজেলা: কলাপাড়া, জেলা: পটুয়াখালী। দ্বিতীয় পক্ষ: মো. ইকবাল করিম (৪০), পিতা: মো. আ. ছালাম, সাং: এডিসি কলোনি, তবলছড়ি, থানা: রাঙামাটি, জেলা: রাঙামাটি। এ/পি: নির্বাহী প্রকৌশলী, আরপিসিএল, পটুয়াখালী-১৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, উপজেলা: কলাপাড়া, জেলা: পটুয়াখালী।)

বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অধিগ্রহণের পর বালু ভরাটের শুরুর দিকে প্রকল্প এলাকার মধ্যে থাকা পরিবারগুলোর সঙ্গে কোনো আলোচনা না-করেই শুরু হয় বালু ভরাট ও উচ্ছেদ। নিজেদের ঘরবাড়ি, বাগান, পুকুর, ফসলি জমি সবই তখন বালুর নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসন করা হচ্ছে না। এ অবস্থায় সর্বহারা হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের তিনজন পটুয়াখালী জজ আদালতে দেওয়ানি মোকদ্দমা ১১৫/২০১৭ এবং দেওয়ানি মোকদ্দমা ৫৩/২০১৭ দায়ের করেন।

দুই পক্ষই ৫/৯/২০১৮ তারিখে আইনজীবীর মাধ্যমে নোটারি পাবলিক কার্যালয়ে উপস্থিত থেকে শপথপূর্বক নিচের বিষয়গুলোয় স্বাক্ষর করেন:

১. আমরা পক্ষদ্বয় বাংলাদেশের স্থায়ী নাগরিক ও বয়োপ্রাপ্ত। আমাদের ভালোমন্দের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে বা রাখি।

২. আমি দ্বিতীয় পক্ষ এই মর্মে ঘোষণা করিতেছি যে, লোন্দা মৌজার ২নং সিটের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের বসতভিটা, বাড়ি, গাছপালা ও বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকা পরিশোধ না-করা পর্যন্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের অন্যত্র পুনর্বাসন না-করা পর্যন্ত তাদেরকে ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ অথবা বসতভিটায় বালু ভরাট করিব না। শুধু নাল জমি ভরাট কাজ চলিবে। ইহা আমার জ্ঞান ও বিশ্বাসমতে সত্য।

৩. আমি দ্বিতীয় পক্ষ আরও ঘোষণা করিতেছি যে, পাওয়ার প্ল্যান্টের প্রধান গেট অথবা যেকোনো একটি গেট ২নং সিটের গিলাতলা পয়েন্টে রাখা হইবে।

৪. আমি দ্বিতীয় পক্ষ ২নং সিটে কোম্পানির কাজে সহযোগিতার জন্য যদি স্থানীয় লোকজনের প্রয়োজন হয়, সেই ক্ষেত্রে ২নং সিটের লোকজনদের সহযোগিতা নিব। পার্শ্ববর্তী সিটের অথবা বহিরাগত প্রবেশ করিতে দিব না।

৫. আমি দ্বিতীয় পক্ষ দুই নম্বর সিটে বালু ভরাটের পূর্বে, বালু ভরাটের জন্য উপযোগী করার কাজকর্ম, যেমন: বনজঙ্গল পরিষ্কার ইত্যাদির কাজে ২নং সিটের শ্রমজীবী লোকজনকে নিয়োজিত করিব।

৬. আমি দ্বিতীয় পক্ষ দুই নম্বর সিটের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের শিক্ষা, দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি ও কর্মের সুযোগ সৃষ্টি করিয়া নিয়োগ দেওয়া হইবে।

৭. আমি দ্বিতীয় পক্ষ শ্রমিক সরবরাহের জন্য ভুক্তভোগী ২নং সিটের অধিবাসীদের ম্যানপাওয়ার কোম্পানির অনুমতি প্রদান করা হইবে।

৮. আমি দ্বিতীয় পক্ষ তেল/ফুয়েল সাপ্লাইয়ের কাজ এবং ক্যানটিনে খাবার সরবরাহের কাজ ভুক্তভোগী ২নং সিটের লোকজনকে দেওয়া হইবে।

৯. আমি দ্বিতীয় পক্ষ পারিবারিক কবরস্থান স্থানান্তরের মাধ্যমে সুরক্ষা করা হইবে।

১০. আমি দ্বিতীয় পক্ষ প্ল্যান্টের উৎপাদনে যাওয়ার পর, বছর শেষে লভ্যাংশের বিধি মোতাবেক নির্দিষ্ট হারে ফান্ড তৈরি করে উচ্ছেদ হওয়া অধিবাসীদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ব্যয় করা হইবে।

১১. দ্বিতীয় পক্ষের দায়েরকৃত কলাপাড়া থানার মামলা নম্বর ৬/১৮১, তাং: ০৫/০৮/২০১৮ ইং, ধারা ১৪৩/৪৪৭/ ৩২৩/৩৮৫/৩৮৬/৫০৬(খ) যাহা কলাপাড়া বিজ্ঞ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জিআর ৩৪০/১৮ নং মামলাটি ওসি কলাপাড়া থানা সমীপে অত্র অঙ্গীকারনামা উপস্থাপন করিয়া উহা চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ব্যবস্থা করিবেন।

১২. আমি দ্বিতীয় পক্ষ ২নং সিটে ক্ষতিগ্রস্তদের আবাসন পুনর্বাসন এলাকায় ব্লগ আকারে আলাদা করে নির্মাণ করা হইবে।

১৩. আমরা প্রথম পক্ষগণ এই মর্মে ঘোষণা করিতেছি যে, আমাদের দায়েরকৃত দেওয়ানি মোকদ্দমা ১১৫/২০১৭ এবং দেওয়ানি মোকদ্দমা ৫৩/২০১৭ পটুয়াখালী বিজ্ঞ জজ আদালত থেকে প্রত্যাহার করে নিব।

১৪. আমরা প্রথম পক্ষগণ অত্র চুক্তিনামা সম্পন্ন হওয়ার পর ৩ দিনের মধ্যে যৌথ তদন্তকাজ পরিচালনা করিব। যৌথ তদন্ত কার্যক্রম এবং অধিগ্রহণ কার্যক্রমে প্রথম পক্ষ এলএ শাখা ও আরপিসিএল কর্তৃক লোন্দা মৌজার ২নং সিটের যৌথ তদন্ত কার্যক্রমে কোনো প্রকার বাধাবিঘ্ন সৃষ্টি করিব না; বরং সহযোগিতা করিব।

পরবর্তী সময়ে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ এই ১৪ দফার একটিও কার্যকর করেনি।

প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ

তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ যে স্বাক্ষর করা কোনো অঙ্গীকারই রক্ষা করেনি, তা স্পষ্ট হয়েছে ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে আলোচনা করে। এলাকার লোকজন জানাচ্ছেন, এই প্রকল্পের জন্য স্থানীয় ১ হাজারেরও বেশি পরিবারের জমি ও বসতভিটা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তার বিপরীতে পুনর্বাসনের জন্য ঘর নির্মাণ করা হয়েছে মাত্র তিন শ। বাকি সাত শ পরিবার কোথায় যাবে, তা কেউ বলছে না। অধিকাংশ পরিবারকেই ঘরবাড়ি কিংবা জমির জন্য টাকা পরিশোধ করা হয়নি। কিন্তু ঘরবাড়ি তুলে নিয়ে চলে যাওয়ার নোটিশ জারি রয়েছে। বালুর পাইপ দিয়ে বাড়ির তিন দিকে ঘিরে ফেলা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেক ঘর বালুর নিচে চাপা পড়েছে।

তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ যে স্বাক্ষর করা কোনো অঙ্গীকারই রক্ষা করেনি, তা স্পষ্ট হয়েছে ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে আলোচনা করে। এলাকার লোকজন জানাচ্ছেন, এই প্রকল্পের জন্য স্থানীয় ১ হাজারেরও বেশি পরিবারের জমি ও বসতভিটা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তার বিপরীতে পুনর্বাসনের জন্য ঘর নির্মাণ করা হয়েছে মাত্র তিন শ।

পুতুলের ঘরের ক্ষতিপূরণ নেই

গ্রামের আরেক বাসিন্দা পুতুল বেগম। বয়স ২৭–২৮ বছর। পুতুল বেগমের স্বামীর নাম বাদশা গাজী। বয়স ৩৫ বছর। তাদের ছোট্ট দুটি কন্যাসন্তান রয়েছে। বাদশা গাজী জন্ম থেকেই পঙ্গু। কোনো ভারী কাজকর্ম করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কাঁধে হালকা বাক্স ঝুলিয়ে পান বিক্রি করা বা এ ধরনের হালকা দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্র নিয়ে গাওয়াল (হকার) করেন তিন। পুতুল বেগমও গ্রামের অন্য বাড়িঘরে কাজ করে কিছু টাকা উপার্জন করে সংসার চালাতেন। এখন পুরো গ্রাম বালুর নিচে চাপা পড়ে আছে। পুতুল বেগমের কাজেরও আর কোনো জায়গা নেই।

যে ঘরটিকে ‘নতুন’ দেখিয়ে ক্ষতিপূরণ বঞ্চিত করা হয়েছে, সেই ঘরের সামনে পুতুল বেগম, শিশু সন্তান কোলে তার স্বামী বাদশা গাজী, ছবি: শহিদুল ইসলাম সবুজ

পুতুল বেগমের স্বামী বাদশা গাজিরা পাঁচ ভাই। এর মধ্যে তিন ভাই বাপদাদার ৯ শতাংশ পৈতৃক জমিতে দুটি ঘর তুলে বসবাস করতেন। ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে তারা কোথায় যাবেন, কেউই বলতে পারছেন না। চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে তাদের। বাদশাহ গাজীর দুই ভাই আগে থেকেই এখানে থাকেন না। তিনি যে ঘরটিতে থাকেন সেটি নতুন দেখিয়ে কোনো ক্ষতিপূরণ বরাদ্দ করেনি তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। অথচ তাদের এই ঘরটি ৩০ বছরের বেশি পুরোনো। পুতুল বেগম বা বাদশা গাজী কারও নামেই কোনো ঘর বরাদ্দ করেনি কর্তৃপক্ষ। তবে বাড়ির গাছপালার জন্য ৪ লাখ টাকা বরাদ্দ করেছে। পুতুল বেগম বলেন, ‘আমার ঘর যদি পুরোনোই না হইবো, তাইলে আমি এত গাছপালা কি করে লাগাইলাম, আর এই গাছগুলা এত বড়ই-বা অইলো কয় দিনে? যার জন্য ৪ লাখ টাকা বরাদ্দ করল হ্যারা?’ পুতুল বেগম জানান, ৪ লাখ টাকা তুলতে ৩০ হাজার টাকারও বেশি ঘুস দালালদের দিতে হয়েছে। হাতে থাকা অবশিষ্ট টাকায় কোথাও জমি কেনা বা ঘর তোলার অবস্থা নেই। তাদের জন্য কর্তৃপক্ষ কোনো পুনর্বাসন প্রকল্পেও ঘর বরাদ্দ করেনি। অথচ সাত দিনের মধ্যে ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে যেতে বলা হয়েছে। পুতুলের ভাষায়: ‘ঘর ভেঙে নিয়ে কোথায় যাব জানি না, আর ঘর ভেঙে নিয়ে যেতে গেলে যে টাকা রয়েছে তার অধিকাংশ খরচ হয়ে যাবে। আবার প্রতিদিনের খরচ তো রয়েছেই।’

কর্তৃপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সঙ্গে চুক্তিতে বলেছিল: ‘বসতভিটা, বাড়ি, গাছপালা ও বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকা পরিশোধ না-করা পর্যন্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের অন্যত্র পুনর্বাসন না-করা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ অথবা বসতভিটায় বালু ভরাট করিব না।’ কিন্তু তারা তাদের কথা রাখেনি।

 রহিমার বাড়ি, ফারজানার স্কুল

রহিমা বেগম। বয়স ৩৮ বছর। প্রকল্প এলাকার ভেতরে ১২৭৩ নং দাগে তাদের বাড়ি। তার স্বামীর নিজের কোনো ভিটেবাড়ি ছিল না। স্বামীকে নিয়ে বাবার দেওয়া জমিতেই ঘর তুলে বসবাস করছিলেন। তাদের বাড়িটি এক সপ্তার মধ্যে ভেঙে নেওয়ার নির্দেশ আসছে কোম্পানির পক্ষ থেকে। রহিমা বেগমের স্বামীর নাম হেলাল হাওলাদার। বয়স ৪৪ বছর। তাদের তিনটি কন্যাসন্তান। বড় দুই মেয়ে বিবাহিত। ছোট মেয়ে ফারজানা আক্তার স্থানীয় ধানখালী গাজী এমএ মান্নান অ্যান্ড হাফিজা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। ফারজানার স্কুলটিও কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের মধ্যে পড়েছে। প্রকল্পের মধ্যে পড়লেও স্কুলটি সরিয়ে নেবে না বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। তাতে দেখা যাচ্ছে স্কুলটি টিকে থাকছে; কিন্তু সেখানকার শিক্ষার্থীরা অনেকেই নেই। স্কুলের শিক্ষক রুমন মিয়া জানান, ইতোমধ্যে তাদের শিক্ষার্থী অর্ধেকে নেমে এসেছে। এই স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রায় সবারই বসবাস ছিল প্রকল্প এলাকার মধ্যে। শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলোকে বেশ আগে থেকেই ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলো ঘরবাড়ি সরিয়ে নিয়ে কে কোথায় গেছে, তার সঠিক তথ্য এখনো পাওয়া যাচ্ছে না।

‘২০১৮ সালের বর্ষার দিনে বিদ্যুৎকেন্দ্রের লোক, সরকারি লোক, আর ইউনিয়ন পরিষদের লোক এসে গোনাকারি বা জরিপ করে। তখন আমি, আমার স্বামী ও সন্তানদের হাতে বাড়ির দাগ নম্বর, আইডি কার্ডসহ ছবি তুলে নিয়েছিল। বলেছিল ক্ষতিপূরণ দেবে। কিন্তু ঘরের জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়নি। শুধু গাছপালার জন্য কিছু টাকা আমাদের হাতে দিয়েছে।’ রহিমার স্বামী হেলাল মিয়ার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। কোথায় যাবেন, স্কুলপড়ুয়া সন্তান ফারজানাকে নিয়ে কোথায় মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবেন, কোথায়ই-বা পড়াশোনা করবে তাদের সন্তান, তা নিয়ে রহিমা ও তার স্বামী হেলাল মিয়ার দুশ্চিন্তার শেষ নেই।

উন্নয়নের বালি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে ফারজানার স্কুল ভবন, ছবি: শহিদুল ইসলাম সবুজ

রহিমার স্বামী হেলাল ঢাকায় ট্রাকের হেলপারের চাকরি করতেন। অনেক ছোট বয়সে তাদের বিয়ে হয়েছিল। তখন রহিমার বাবার দেওয়া একটি খড়ের ঘর ছিল তাদের। স্বামী হেলাল এবং তিনি নিজে মজুরি খেটে, শ্রম বিক্রি করে ৩০ বছর আগেই টিনের সুন্দর ঘর তুলেছিলেন। কিন্তু সেই ঘর ‘নতুন’ দেখিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ তাদের ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত করেছে। রহিমা বেগম বলেন, ‘২০১৮ সালের বর্ষার দিনে বিদ্যুৎকেন্দ্রের লোক, সরকারি লোক, আর ইউনিয়ন পরিষদের লোক এসে গোনাকারি বা জরিপ করে। তখন আমি, আমার স্বামী ও সন্তানদের হাতে বাড়ির দাগ নম্বর, আইডি কার্ডসহ ছবি তুলে নিয়েছিল। বলেছিল ক্ষতিপূরণ দেবে। কিন্তু ঘরের জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়নি। শুধু গাছপালার জন্য কিছু টাকা আমাদের হাতে দিয়েছে।’ রহিমার স্বামী হেলাল মিয়ার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। কোথায় যাবেন, স্কুলপড়ুয়া সন্তান ফারজানাকে নিয়ে কোথায় মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবেন, কোথায়ই-বা পড়াশোনা করবে তাদের সন্তান, তা নিয়ে রহিমা ও তার স্বামী হেলাল মিয়ার দুশ্চিন্তার শেষ নেই।

চম্পার জীবন: গার্মেন্টস থেকে উন্নয়ন-উদ্বাস্তু

চম্পা বেগম। বয়স ২৫ বছর। স্বামী মো. হালিম মাঝি, বয়স ৩৩ বছর। হাবিবা নামের ৫ বছরের একটি মেয়ে এবং খালিদ নামের ১০ মাস বয়সি একটি ছেলেসন্তান রয়েছে তাদের। চম্পা বেগম বাবা নজরুল ফরাজীর দেওয়া ১৫ কড়া বা ৪৫ শতাংশ জমিতে ঘরবাড়ি তুলে বসবাস করছিলেন। স্বামী হালিম মাঝি এবং চম্পা নিজে শ্রম দিয়ে সেই বাড়িতে পুকুর কেটেছিলেন, পুকুরভর্তি অনেক মাছ ছিল, হাঁস-মুরগির জন্য ঘর বানিয়েছিলেন। নিজেদের চাষের জমিতে হালিম মাঝি কৃষিকাজ করতেন, ফসল ফলাতেন।

চম্পা বেগম স্বামীসহ আগে নারায়ণগঞ্জে থাকতেন। চম্পা কাজ করতেন নারায়ণগঞ্জ বিসিকের ফকিরা গার্মেন্টসে আর হালিম কাজ করতেন কলোনি গার্মেন্টসে। পরবর্তী সময়ে বিয়ে, গর্ভধারণ ও বাচ্চা হয়ে যাওয়ায় চাকরি ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসেন তারা। গ্রামে ফিরে সবকিছু গুছিয়ে ওঠার পাঁচ বছরের মধ্যেই বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ ঘরবাড়ি, জমিজমা অধিগ্রহণ করার ফলে তারা দিশাহারা হয়ে পড়েন। দ্রুত ঘরবাড়ি সরিয়ে নেওয়ার নোটিশ আসে। ঘরের জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ না দিলেও বাড়ির গাছপালা, পুকুরের জন্য ছয় লাখ টাকা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এদিকে ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে তারা এখন ফুলতলীরই অন্য একটি জায়গায় ডানিডার রাস্তার পাশে ছয় শতাংশ জায়গা কিনে মাথা গোঁজার ঠাঁই বানিয়েছেন। হালিম মাঝির দিনমজুরির আয়ে টেনেটুনে এখন তাদের সংসার চলছে। হালিম মাঝি অবশ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের ভেতর কাজের চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু তাকে কোনো কাজে নেওয়া হয়নি। তাদের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ কোনো ঘরও বরাদ্দ করেনি।

চম্পা কাজ করতেন নারায়ণগঞ্জ বিসিকের ফকিরা গার্মেন্টসে আর হালিম কাজ করতেন কলোনি গার্মেন্টসে। পরবর্তী সময়ে বিয়ে, গর্ভধারণ ও বাচ্চা হয়ে যাওয়ায় চাকরি ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসেন তারা। গ্রামে ফিরে সবকিছু গুছিয়ে ওঠার পাঁচ বছরের মধ্যেই বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ ঘরবাড়ি, জমিজমা অধিগ্রহণ করার ফলে তারা দিশাহারা হয়ে পড়েন।

হাশেম শিকদারের মায়ের কবর

পারুল বেগম। বয়স ৪২ বছর। স্বামী হাশেম সিকদার। বয়স ৫০ বছর। জমিজমা হারিয়ে এখন কাঁচামালের ব্যবসায়ী। তাদের চার সন্তান। দুজনের বিয়ে দিয়েছেন। বাকি দুজনের একজন সপ্তম শ্রেণির, আরেকজন তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। কথার শুরুতেই হাসেম শিকদার বলেন, ‘৩৫ বছর আগে ১৫ কড়া বা ৪৫ শতাংশ জমি কিনে বাড়ি বানিয়েছিলাম। বিয়ে ও সন্তানদের জন্ম এই বাড়িতেই। মা প্রায় ৮০ বছর বেঁচে ছিলেন। এই বাড়ির প্রতিটি ধূলিকণায় মায়ের হাতের ছোঁয়া লেগে আছে।’ তিনি বলতে থাকেন: ‘এখন থেকে ৩০–৩৫ বছর আগে মাসিক মজুরি ছিল ৩০০ টাকা। আমি সেই ৩০০ টাকা মাসিক মজুরিতে সারা মাস কাজ করতাম। কোনোদিন বসে থাকতাম না। কোনো বিশ্রাম ছিল না আমার। আর সেই শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত আয়ে তিলে তিলে সাজিয়েছিলাম সংসার। বাড়ির চৌহদ্দির বাইরেও জমি কিনেছিলাম প্রায় ৬০ কড়া।’

পারুল বেগম বলেন, ‘চাষাবাদের জন্য হালের গরু এবং দুধের গাই মিলিয়ে আমাদের ৮টি গরু ছিল। বাড়িতে একটা বড় পুকুর, ছোট্ট একটা মাছের ঘের, সেই পুকুরে প্রচুর পরিমাণে দেশি জাতের মাছ এবং ঘেরভর্তি প্রচুর মাছ ছিল। আমাদের বাড়ি, পুকুরপাড়, ঘেরের পাড়ে তিন হাজারের বেশি গাছ ছিল, তার মধ্যে অনেকগুলো ছিল পুরোনো আর মোটা। এ ছাড়াও বাড়িতে দুটি বড় ঘর, হাঁস-মুরগির জন্য ঘর, দুটি আধা পাকা টয়লেট, অনেক বড় একটা রান্নাঘর সঙ্গে ঢেঁকিঘর ছিল। এসবের আর্থিক মূল্য দাঁড়াত কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা। অথচ আমাদের কোনো টাকা না-দিয়েই ঘর ভাঙতে এসেছিল। আমরা টাকা না পেলে কোথায় যাব, কোথায় থাকব, কী খাব? তাই ঘর ভাঙতে বাধা দিই। তখন আমাকে আরপিসিএল অফিসে ডেকে নিয়ে চাপ সৃষ্টি করে এবং বলে তুমি ঘর ভেঙে ফেল, ঘর ভাঙার টাকা দেব।’

হাশেম শিকদার বলেন, ‘ঘর ভাঙার আগেই বালু ছেড়ে দিয়ে মায়ের কবর, ঘরবাড়ি ভরাট করে ফেলে। মায়ের কবরটি সরিয়ে নেওয়ার জন্য সময় চেয়েছিলাম, সে সময়টুকু আমাদের দেয়নি তারা। মায়ের কবর এখন ১৫–২০ ফুট বালির নিচে চাপা পড়ে আছে। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে আমি মায়ের কবরটি খুঁজে ফিরছি বালুর নিচে। কবরটি খুঁজে পেলে সরিয়ে নেব।’ হাশেম বলতে থাকেন: ‘মা বেঁচে থাকতে চেষ্টা করেছি তার সেবা করতে। মায়ের দোয়ায় হয়তো সুস্থভাবে বেঁচে আছি। বেঁচে থাকতে মাকে কোনো অভাব অনুভব করতে দিইনি কখনো।’

স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ২০ ফুট বালির নিচে চাপা পরা মায়ের কবর খুঁজছেন হাসেম শিকদার, ছবি: শহিদুল ইসলাম সবুজ

তারা দুজনে আরও বলতে থাকেন: ‘আমরা ঘর ভাঙতে বাধা দিলে প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী আর পুলিশ এসে আমাদের বড় ঘর, যার মেজে পাকা করা ছিল, সেটাসহ সব ঘর ভেঙে ফেলে। ঘর বানাতে আমাদের প্রায় ৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। কিন্তু সেই ঘর বাবদ কর্তৃপক্ষ দিয়েছে মাত্র ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা, আর ৩ হাজার গাছের জন্য দিয়েছে মাত্র ৬৬ হাজার টাকা। আমাদের ৬০ লাখ টাকার বেশি মূল্যের চাষের জমি, ঘরবাড়ি, গাছপালা কেড়ে নিয়ে সর্বমোট বরাদ্দ হয়েছে মাত্র ১২ লাখ টাকা এবং পুনর্বাসন প্রকল্পের একটি ঘর। সেই ঘর কবে বুঝিয়ে দেওয়া হবে, তা কেউ বলছে না। কারণ, পুনর্বাসনের ঘরগুলো এখনো নির্মাণ পর্যায়ে আছে। আমাদের নিজেদের গড়ে তোলা সাজানো-গোছানো সুন্দর ঘরবাড়ি, উন্মুক্ত পরিবেশ ছেড়ে আমরা সেই বস্তির মতো ঘরবাড়িতে উঠে কীভাবে বসবাস করব, বুঝতে পারছি না!’

ঘর বানাতে আমাদের প্রায় ৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। কিন্তু সেই ঘর বাবদ কর্তৃপক্ষ দিয়েছে মাত্র ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা, আর ৩ হাজার গাছের জন্য দিয়েছে মাত্র ৬৬ হাজার টাকা। আমাদের ৬০ লাখ টাকার বেশি মূল্যের চাষের জমি, ঘরবাড়ি, গাছপালা কেড়ে নিয়ে সর্বমোট বরাদ্দ হয়েছে মাত্র ১২ লাখ টাকা এবং পুনর্বাসন প্রকল্পের একটি ঘর। সেই ঘর কবে বুঝিয়ে দেওয়া হবে, তা কেউ বলছে না।

শ্রমিকদের আন্দোলন ও মামলা

গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিকেরা তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। দাবি-দাওয়ার মধ্যে ছিল ৮ ঘণ্টা কাজ, ৬০০ টাকা হাজিরা, শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি এবং যখন-তখন ছাঁটাই না করা।

শ্রমিকদের বয়ানে জানা যায়, ৮ ঘণ্টা কাজের কথা বলে শ্রমিকদের দিয়ে ৯–১০ ঘণ্টা কাজ করানো হতো। ৬০০ টাকা হাজিরা দেওয়ার কথা বলে ৩৮০ টাকা দেওয়া হতো। দেশি শ্রমিকদের মধ্যে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা প্রায় সবাই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। শুক্রবার তারা সাপ্তাহিক ছুটি দাবি করেছিল; কিন্তু কর্তৃপক্ষ শুক্রবার ছুটি দিত না।

শ্রমিকদের থাকার জন্য কর্তৃপক্ষ ভেতরে শেড এবং ক্যানটিন নির্মাণ করেছে। শ্রমিকরা বলছেন, বসবাসের জন্য যে শেড নির্মাণ করা হয়েছে, তা বসবাসের অযোগ্য। ক্যানটিনের খাবারের মানও অত্যন্ত নিম্নমানের। শ্রমিকদের ভাষায়, ‘খাওয়ার অযোগ্য’। এসপি সাহেব নিজে খাবারের মান যাচাই করতে এসে খাবারে বালু পেয়েছেন। স্থানীয় দালাল প্রকৃতির কিছু লোকের সহযোগিতায় কর্তৃপক্ষ ক্যানটিন পরিচালনা, শ্রমিক সরবরাহ, তেল ও গাড়ি সরবরাহ করত। আর এই দালালরা শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন চালাত। এ কারণেই মূলত শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করেন।

প্রজেক্টের পাশেই বসবাস করেন হোসেন আলী খান। তিনি জানান, তার অনেক জমি বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ অধিগ্রহণ করেছে। তার বাড়ি থেকে ৫০–৬০ গজ দূরে শ্রমিকদের হইচই শুনে অন্য অনেকের সঙ্গে তিনিও সেখানে যান। শ্রমিকরা একটি গাড়িও ভাঙচুর করেন। আন্দোলন চলাকালীন পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। এরপর তিন থানার (আমতলী, কলাপাড়া ও পটুয়াখালী সদর) ওসি এবং পটুয়াখালীর এসপিসহ পুলিশ কর্মকর্তারা এসে শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন, শ্রমিকদের সব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন। এরপর শ্রমিকরা কাজে ফেরেন।

মীমাংসার তিন-চার দিন পর ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ রাত ১২টায় থানা থেকে পুলিশ এসে হোসেন আলী খানকে থানায় যেতে বলে। তিনি জানতে চান, ‘কেন থানায় যাব, কোনো মামলা আছে?’ তারা জানায়, কোনো মামলা নেই। তবে ওসি সাহেব তার সঙ্গে কথা বলবেন। হোসেন আলী খান জানান, তিনি সরল বিশ্বাসে তাদের সঙ্গে থানায় গেলে, তাকে থানাহাজতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। পরদিন দুপুর ১২টায় একজন চীনা কর্মকর্তা, তার দোভাষী এবং সিকিউরিটির লোকজন থানায় আসেন এবং সিকিউরিটি ইনচার্জ নাসির বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ সময় লকডাউন ও কোরবানির ছুটি চলছিল বলে থানার কার্যক্রম ঢিলেঢালাভাবে চলছিল। হোসেন আলী খান জানান, তাকে মোট ২৮ দিন জেল খাটতে হয়েছে। এখনো প্রতি মাসে তাকে হাজিরা দিতে হচ্ছে। তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘প্রজেক্টের ভেতর ৭০ কড়া জমি অধিগ্রহণ করেছে আমার। কিন্তু ১ টাকার ক্ষতিপূরণ দেয় নাই।’

তিনি আরও জানান, জমির রেকর্ড একজনের নামে; কিন্তু সেই জমি দলিলমূলে দু-তিনবার বিক্রি হয়েছে এই এলাকায়। সবশেষ দলিলগ্রহীতার টাকা পাওয়ার কথা; কিন্তু সেটাও আর হচ্ছে না। এভাবে জমি অধিগ্রহণের সময় বহু প্রকৃত জমির মালিক ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

পরিশেষ

পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বালু দিয়ে এলাকার ভরাটকাজ চলছেই। গ্রামবাসী ঘরবাড়ি ও জমি হারিয়ে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ছেন। ক্ষতিপূরণ নিয়ে দুর্নীতি-অনিয়ম চলছেই। উন্নয়নের নামে সব হারানো এসব মানুষের খবর কেউ রাখছে না।

শহীদুল ইসলাম সবুজ: লেখক, রাজনৈতিক সংগঠক। ইমেইল: sabuj.shahidul933@gmail.com

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •