গঞ্জে একটি মৃত্যুঃ একটি হত্যা বা আত্মহত্যার চলচ্ছবিময় দিনানুগ বিবরণ

৮ম বর্ষ Hide
চলচ্চিত্র পর্যালোচনা

গঞ্জে একটি মৃত্যুঃ একটি হত্যা বা আত্মহত্যার চলচ্ছবিময় দিনানুগ বিবরণ

মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন

সিনেমা সম্পর্কিত তথ্যঃ  

নামঃ গঞ্জে একটি মৃত্যু/A Death in the Gunj ।

দৈর্ঘ্যঃ১০৪মিনিট। পরিচালক:কঙ্কণাসেনশর্মা। চিত্রনাট্যকার: কঙ্কণাসেনশর্মা ও দিশারিন্দানী।

প্রযোজক: হানিত্রিহান, অভিষেকচৌবে, রাগীভাটনগর, আশীষভাটনগর, বিজয়কুমার, আরস্বামী।

প্রযোজনাসংস্থাগুলি: স্টুডিওজআইড্রিমবিনোদনপ্রাইভেটলিমিটেড, ম্যাকগুফিনপিকচার্স।

অভিনয় শিল্পী: বিক্রান্তমাসি, রণভীরশোরে, কালকিকোচলিন/কেকলা, গুলশানদেবায়াইয়া, তিলোত্তমা সোম, জিমসারভ, তনুজামুখোপাধ্যায়, ওমপুরী, আর্যশর্মা।

চিত্রগ্রাহক: সিরশারায়।

সম্পাদক: আরিফশেখ, মানসমিত্তাল। সংগীত: সাগরদেশাই।

প্রথম প্রদর্শন: টরন্টোআন্তর্জাতিকচলচ্চিত্রউত্সব (বিশেষউপস্থাপনা) (২০১৬) ।

পুরুষতন্ত্র এবং পুঁজিবাদী কাঠামো যেভাবে একজনকে মেরে ফেলতে পারে তার গল্প

একজনকে “পুরুষ” হতে হলে হতে হবে যথেষ্ট কদর্যতার অধিকারী, থাকবেনা/থাকার দরকার পড়বেনা   যথেষ্ট পরিমাণে সুক্ষতার বোধ, যেকোনো সময়ে যেকোনো আবোল তাবোল বলবে যার সমর্থন জোগাবে চারপাশের সবাই। এবং সাধারণত এসব কদর্য, বিবেচনাহীন, লজ্জাহীন পুরুষেরাই অধিকাংশ সময়ে যথেষ্ট পরিমাণে ধন সম্পদের দখলদারি বজায় রাখতে পারে বা পারতে চায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিন্নপত্রাবলিতে (সম্ভবত) পড়েছিলাম দার্জিলিং ভ্রমণের সময়ে তার বাড়ির মহিলাগণ তিরস্কার ও হাসাহাসি করছেন তিনি যথেষ্ট পুরুষালি নন বলে কারণ সারা ট্রেনে ও স্টেশনে তাকে কখনো অন্য পুরুষদের(?) মতন/ তাল মিলিয়ে আচার-ব্যবহার করতে দেখা যায়নি! ছোটু (শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়/বিক্রান্তমাসি অভিনীত চরিত্রের নাম)নিজেও যথেষ্ট পরিমাণে পুরুষালি নয় বলে সবজায়গাতেই সে ম্রিয়মান থাকে বা থাকতে হয়, দায়সারা গোছের সব কাজ করার দায় তার। কোনো কাজ ঠিকমতো না হলে সে দায় সেও শেষ পর্যন্ত যেয়ে পড়বে তার উপরে আর এর সাথে যোগ হয়েছে তার যথেষ্ট টাকা না থাকার অযোগ্যতা এবং পারিবারিকভাবে ধনসম্পত্তি না থাকার চূড়ান্ত অযোগ্যতা।

ভেবে দেখুন তার বাবা (ছিল) “সামান্য” কলেজের অধ্যাপক আর মা কিছু করেন না। আবার সে নিজেও আর সবার মতো যথেষ্ট প্রগলভ নয়, ফলে পৃথিবীতে বাস করা ও টিকে থাকা দিন দিন তার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। আর যারা তার জীবনকে ধীরে ধীরে শেষের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল তারা সবাই তার কাছের আত্মীয়, বন্ধু ও স্বজন। বা জীবন যাপনের সংস্কৃতিটাই এমন ছিল যেখানে শুধুমাত্র “boys will be boys” সেখানে বালকদের অন্যকিছু হয়ে ওঠার সুযোগ দেয়া হবেনা বা নেই। তাই এই কাছের মানুষেরা ও তাদের তৈরি পরিস্থিতি বা তাদের জীবন যাপনের সংস্কৃতির/ দর্শনের চাপ গঞ্জে একটি অকারণ ও অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটিয়ে তোলে। আর যে বালক “ঠিকমতো” “বালকের” মতো হয়ে উঠতে পারবেনা তার জন্য নেই ভালো ও সদর্থক কিছু। কারণ সে আর অন্য সবার/সব বালকের মতো নয়! ছোটু এসবের জন্য কোনোকারণ ছাড়াই সবার হাসির খোরাক জোগায়, এমনকি যে ছোট তানিসেও শেষ পর্যন্ত ছোটুকে অপমান করে। সিনেমার যেখানে ছোটু তানিকে মিছে কথা বলে মিমিকে নিয়ে বাইকে করে ঘুরতে যায় তারপরে তানি হারিয়ে যেয়ে ফিরে আসার পর অন্য সবার সাথে তাল মিলিয়ে সেও ছোটুকে অবহেলা করতে শুরু করে। যতটা না অভিমানের কারণে তার চেয়ে অনেক বেশি বড়দের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য। সে বুঝতে পারে দিনের পরে দিন বড়রা ছোটুকে অবহেলা করেছে, অপমান করেছে আর সে ছোটুর সাথে বোকার মতো বন্ধুতা করেছে। যেন খুব কমদামি কোনো কিছুকে ভুল করে ভালবেসেছিল তাই এবার সে কমদামি জিনিসের উপর অপমান ঢেলে তার ভুল ভালবাসার শোধ তুলতে চায়। সে যেন বড় হয়ে উঠেছে আদর্শিকভাবে(?) ঠিক বড়দের মতন। অথচ ছোটু আক্ষরিক অর্থেই তানিকে খুঁজতে যেয়ে জীবন মরণ বিপদের সামনে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু যেহেতু সে সফল হয়নি বা সে “সফল” বা “সার্থকদের” কেউ নয় তাই তার ভূমিকার খোঁজ কেউ করেনি। ছোটুর জন্য পৃথিবীতে কেউ নেই।

ছোটরাও বোঝে বড়দের মন জুগিয়ে চলার লাভ-লোকসান আর তারা কাকে কতোটুকু গুরুত্ব দিচ্ছে সে অনুযায়ী ছোটরাও আচরণ করতে শেখে। ছোটবেলা থেকেই আমাদের ছোটরা জেনে যায় বাড়ির কাজের লোকেদের সাথে অবহেলা করলে তেমন দোষ নেই। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে তাদেরকে তুই-তোকারি করা যেতে পারে আর তাদেরতো যেন এসব কাজেই আনা হয়েছে । ভারি ভারি কাজ করা থেকে শুরু করে ফাইফরমাশ এবং মাঝের সবকিছুর জন্য। তাই যে কাজের জন্য কোনোভাবেই কাউকে দরকার নেই, সে কাজের জন্যও তাদের ডেকে আনতে কারো বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয়না। প্রধানতম কারণ তাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতা আর এসব কাজের লোকেরা এই দুর্বলতার ফলে সামান্য টাকার বিনিময়ে এসব করতে থাকে বা করতে বাধ্য হয়। এইসব ছোট ছোট অনেকগুলো কারণ, নানান সব ব্যর্থতা, সামাজিক, পারিবারিক চাপ সব মিলিয়ে তথাকথিত “বালক” “পুরুষ” “সফল” হতে না পারার দায় নিয়ে, সবার সাথে তাল মিলিয়ে কথা না বলতে পারার ও চলতে না পারার ব্যর্থতা, চাপ নিয়ে,পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদী পরিবেশে টিকতে না পেরে গঞ্জে ছুটি কাটানোর সময় ছোটু আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়, নতুন বছরে।

নির্মাণ ও অন্যান্যঃ

“গঞ্জেএকটিমৃত্যু” (২০১৬) কঙ্কনার প্রথম নির্মাণ, নির্মাতা হিসেবে। সিনেমার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন তার এক বাবা মুকুল শর্মার ছোটগল্প, যে গল্প আবার একটা সত্য ঘটনার উপরে লেখা। যেখানে ১৯৮৯ সালে ম্যাকলাস্কিগঞ্জে (তৎকালীন বিহার বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্য, ভারত) পারিবারিক ছুটিতে বেড়াতে যেয়ে একটা মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। চমৎকার একটা চিত্রনাট্য যেখানে সব চরিত্রগুলোই চমৎকার জীবন্ত, স্বাভাবিক, যাদের কাউকে মনে হয়নি জোর করে সংলাপ বলানো হচ্ছে গল্প বলার জন্য। যদিও চাইলে কিছু কিছু সংলাপ এড়িয়ে গেলেও সিনেমার তাতে তেমন কিছু ক্ষতি বৃদ্ধি হতনা। ছোট তানির সংলাপ বা তানি ও ছটুর দুজনের সংলাপ দারুণ মানানসই ও স্বাভাবিক হয়েছে।

সিনেমাটিতে যে অ্যাংলোইন্ডিয়ান পরিবারটিকে উপস্থাপন করা হয়েছে তার সদস্য হিসেবে যারা অভিনয় করেছেন তারা সকলেই মানানসই কিন্তু ছটু/ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় হিসেবে বিক্রান্ত মাসির অভিনয় মনে রাখার মতন। তার চোখে মুখে বা শরীরে সব জায়গাতে তিনি দুর্দান্তভাবে একটা ২৩/২৪ বছরের ছেলের অসহায়তার প্রকাশ করেছেন, যে তার বাবার মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেনি, যে হয়তো বুঝতে পেরেছিল তার আচরণ, তার স্বভাব আর সবার মতো নয়, সে হয়তো বদলাতে চেয়েছিল বা নিজের মতো করেই বাঁচতে চেয়েছিল এই পৃথিবীর কোনো নির্জন কোণে। তাই হয়তো এভাবে রবাহূত হয়ে বেড়াতে আসা শোভন নয় কিন্তু তারপরেও ঠিকই বেড়াতে এসেছিল মাকলাস্কিগঞ্জে। হয়তো আশা করেছিল বেড়াতে এসে কিছুটা বদল হয়তো তাকে বদলাতে সাহায্য করবে, হয়তো আশা করেছিল, পরিপার্শ্ব তার গভীর বেদনা সারিয়ে তুলবে কিন্তু পরিপার্শ্ব তাকে আরো জান্তবভাবে চেপে ধরেছিল যথেষ্ট পরিমাণে অন্যদের মতো না হওয়ার জন্য। আশা জেগেছিল হয়তো মিমির নিকট থেকে ভালবাসা পাবার, পায়নি। মিমি তাকে ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলার চেয়ে মূল্যবান মনে করেনি। সম্ভবত ইংল্যান্ডে যেয়ে পড়ার ব্যাপারটা সত্য হলেও মিমি তাকে ছুঁড়েই ফেলত কিন্তু ছোটু তাকে আশ্রয় করে হলেও বাঁচতে চেয়েছিল। তার মনের কাছাকাছি কেউ ছিলনা, মাও নয়। তার কোনো বন্ধু ছিলনা এমনকি খানিকটা বড়ভাইয়ের মতো নান্দুও তার কাছের কেউ নয়, এমনকি ছোট তানি তারও বন্ধু হতে পারেনি সে। সবাই তাকে বিচার করেছে, নিজেকে নিয়ে কেউ ভাবেনি, নিজের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি! এমন আপাত সরল অথচ জটিল চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিক্রান্ত মাসি, তাকে কখনো মনে হয়নি তিনি ছোটু/শ্যামলগঙ্গোপাধ্যায় নন, তিনি বিক্রান্ত মাসি। আর ছোটুর মায়ের চরিত্র করেছেন প্রখ্যাত অভিনয় শিল্পী ও চিত্রনির্মাতা অপর্ণা সেন (নির্মাতা কঙ্কনা সেন শর্মার, নিজের মা), তিনি পর্দায় কোথাও নেই, শুধু আছেন প্রেক্ষাপট কণ্ঠস্বর হিসেবে, কিন্তু তার কণ্ঠ, তার চরিত্রের একাকীত্ব সব কিছুই গভীরভাবে ভাবাবে। সাগর দেশাইয়ের করা প্রেক্ষাপট সঙ্গীত,গানের সুরারোপ, আদিবাসী ঢঙয়ের সঙ্গীত,খুব মন কেমন করা একটা আবহ তৈরি করে গল্পের সাথে মিশে চমৎকার একটা রূপ তৈরি করেছে। এই প্রেক্ষাপট সঙ্গীত ও গান বারবার শোনার মতন। শব্দ আয়োজন ও নকশা ভালো হয়নি। শব্দের দিকে কান পাতলে মনে হতে পারে বধির একটা সিনেমা শুনছি। আর ছোটু যখন নান্দুকে “দাদা” “দাদা” করছে তখন সাবটাইটেল দেখাচ্ছে “নান্দু” “নান্দু”! এরকম সাব টাইটেল মেনে নেয়াটা বেশ দুস্কর।

কিন্তু গল্প ও অন্যান্য একের পর এক লোমহর্ষক আয়োজনের কারণেএসব খুব বেশি বাধার তৈরি করেনি।কারণ গল্পে একের পর এক ঘটনা চলতে থাকে আর ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হতে থাকে আমাদের তথাকথিত প্রগতির, আধুনিকতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা শ্রেণি চরিত্র। যার ফলে গঞ্জের মৃত্যু ঘটে, আমরা গুলির শব্দে, গাছের বেয়ে পড়তে থাকা রক্তের সাথে সাথে বেয়ে বেয়ে আমরাও হয়তো ঢুকতে থাকি অথবা ঢোকার চেষ্টা করি গঞ্জের মারা যাওয়া বা মারা যেতে বাধ্য হওয়া আত্মার হৃদয়ের ভিতরে। কিছু সময়ের জন্য হলেও হয়তো অনুধাবন করতে চেষ্টা করি আমাদের (শ্রেণি) চরিত্রকে।

“গঞ্জে একটি মৃত্যু” কঙ্কনার প্রথম সিনেমা এবং তিনি দারুণ সফলভাবেই তুলে ধরেছেন তার ভাবনা ও গল্পকে কোনো বিচার ছাড়াই। তিনি এক লোমহর্ষক রূপকথার বিবরণ তুলেছেন এ সময়কে তুলে ধরবার ও ব্যাখ্যা করার জন্য। 

মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন: চলচ্চিত্রকার, চলচ্চিত্র সমালোচক।

ইমেইল: raiparasadardi@gmail.com

দোহাইঃ

https://en.wikipedia.org/wiki/A_Death_in_the_Gunj

https://www.imdb.com/title/tt05918074/

https://gaana.com/album/a-death-in-the-gunj-original-motion-picture-soundtrack

https://www.youtube.com/watch?v=XliKkuxa_nA

চৌরঙ্গি লেনে হাতেখড়ি মায়ের, ম্যাকলাস্কিগঞ্জে যাত্রা শুরু কঙ্কনার | ২ জুন, ২০১৭

https://www.anandabazar.com/entertainment/konkona-to-make-her-directorial-debut-with-a-death-in-the-gunj-dgtlx-1.622143

“A Death in the Gunj,” a Horror Movie About Violent Masculinity| By Sheena Raza Faisal| February 25, 2019

https://www.newyorker.com/recommends/watch/a-death-in-the-gunj-a-horror-movie-about-violent-masculinity

‘A Death in the Gunj’: Film Review | TIFF 2016 | 9/14/2016 by Stephen Dalton (THE BOTTOM LINE: An imperfect but engrossing debut feature.)  

https://www.hollywoodreporter.com/review/a-death-gunj-review-929148

A Death in the Gunj’: Layered and skilfully crafted|IANS | New Delhi | June 2, 2017

https://www.thestatesman.com/entertainment/reviews/a-death-in-the-gunj-layered-and-skilfully-crafted-1496405546.html

‘A Death In The Gunj’: Busan Review | By Wendy Ide11 October 2016

https://www.screendaily.com/reviews/a-death-in-the-gunj-busan-review/5110198.article

Review: Expect the Unexpected from ‘A Death In The Gunj’ by Stutee Ghosh | 01 Jun 2017

https://www.thequint.com/entertainment/movie-reviews/a-death-in-the-gunj-movie-review

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *