ফেলানী হত্যা: বিচারহীনতার ১০ বছর
হাসান শাওন
প্রতিবেশী দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক হয়। কখনো ফোনে। কখনো একান্তে। কখনো দ্বিপক্ষীয়। কখনো চারকোনা টেবিলে। কখনো গোলটেবিলে। সর্বশেষ করোনাকালে একাধিক বৈঠক হয়েছে সরাসরি ও ভার্চুয়ালি। এরপর সিনে আসেন আমলারা। চুক্তি করেন নেতারা। ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ, ঐতিহাসিক—নানা শিরোনামে তা খবরে আসে। বৈঠকের সময়ের দৈর্ঘ্যও জানা যায়। তবে তা কোনো দিনই পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী নয়। কারণ, পাঁচ ঘণ্টা মনে করায় এক শোকার্ত আর্তনাদ। রক্তের স্রোত বয়ে যায় কুড়িগ্রাম থেকে বঙ্গোপসাগর অবধি।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সদস্য অমিয় ঘোষের গুলিতে কিশোরী ফেলানীর জীবন একবারে যায়নি। পাঁচ ঘণ্টা ধরে সে ঝুলে ছিল কাঁটাতারে। পানি, পানি বলে চিৎকার করেছে এই ১৪ বছরের মেয়ে। রক্তক্ষরণে একসময় নিথর হয় প্রাণ। তুলনীয় শুধু কারবালা। ফোরাতের পানির জন্য আক্ষেপ।
গোটা জনপদকে ছুঁয়ে যাওয়া সীমান্তে নৃশংস খুনের ১০ বছর হলো এই ৭ জানুয়ারি। ‘ফেলানীর লাল পোশাক আমাদের পতাকা’—এ স্লোগান উঠেছিল দেশের রাস্তায়। আর নেটে সাইবারযুদ্ধ শুরু হয়। হ্যাক হয় দুই দেশেরই অসংখ্য সাইট। বাংলার হ্যাকার দল গুগল ম্যাপে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের রাস্তার নাম রাখে ‘ফেলানী স্ট্রিট’।
এসব এখন বিবর্ণ ইতিহাস। মহিমান্বিত এখন হৃদ্যতার আলাপ। যে জাতি অসমাপ্ত জনযুদ্ধ একাত্তরকে ভুলে যায়, দিল্লির ‘বাসার কাজের মেয়ে’ ফেলানীকে মনে রাখার কী দায় তাদের! ভারতীয় দূতাবাস খুঁজে পাই বারিধারার পার্ক রোডে। সে পার্কে ডুমুরের ফুল ফোটে নিশ্চয়ই। কিন্তু সব শাসন, শোষণ ও তোষণের একটি মেয়াদ আছে। আর আমরা জানি, গত দশ বছরেও ফেলানী হত্যার বিচার হয়নি। সীমান্তে খুন থামেনি।
ফেলানী হয়তো ভাগ্যবতী। এই শহিদ হত্যার বিচার আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। আর বাকি শহিদরা আটকে আছেন মাত্র সংখ্যায়। বিচার প্রক্রিয়াটি গণমাধ্যমমাফিক যেমন জানা তা হলো, বাংলাদেশ ও ভারতের মানবাধিকার সংগঠন এবং সংবাদমাধ্যমের চাপে বিএসএফ তার কনস্টেবল অমিয় ঘোষের বিরুদ্ধে বিএসএফ আইনের (THE BORDER SECURITY FORCES ACT 1968) ৬৪ ও ৬৫ ধারা মোতাবেক জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্ট (GSFC) গঠন করে এবং ২০১২ সালের আগস্টে ওই কোর্টে চার্জশিট দেয়। তার বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় হত্যা (culpable homicide not amounting to murder) এবং বিএসএফ বিধির (THE BORDER SECURITY FORCES RULES 1969) ১৪৬ ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
১৩ আগস্ট ২০১৩ তারিখে বিচার শুরু হয় কুচবিহার শহরের কাছে সোনারি ক্যাম্পে। ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে বিএসএফের বিশেষ আদালত কনস্টেবল অমিয় ঘোষকে ‘সিদ্ধান্ত অযোগ্য ও অপর্যাপ্ত প্রমাণ’ (Inconclusive and Insufficient evidence) মর্মে নির্দোষ ঘোষণা করে। জিএসএফসির প্রধান ছিলেন আসাম-মেঘালয় ফ্রন্টিয়ার ডিআইজি এসপি ত্রিবেদী। সঙ্গে ছিলেন আরও চারজন কর্মকর্তা। কিন্তু বাংলাদেশের আপত্তি এবং ভারতের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর চাপে ১৬ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে রিভিশন ট্রায়ালে বসে ওই একই আদালত এবং ২ জুলাই ২০১৫ তারিখে অমিয়কে আবারও নির্দোষ ঘোষণা করা হয়। ফোর্সেস কোর্টের রায়টি পাঠানো হয়েছে বিএসএফের ডিজির কাছে। তিনি অনুমোদন করলেই সেটি চূড়ান্ত। ছাড় পেয়ে যাবেন অভিযুক্ত বিএসএফ কনস্টেবল অমিয় ঘোষ।
ইতিমধ্যে ভারতীয় মানবাধিকার কমিশন ফেলানীর পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। এ বিষয়ে তারা ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের GSFC কোর্টের রায় চূড়ান্ত হওয়া পর্যন্ত সাময়িক স্থগিতাদেশের আপিল খারিজ করে দিয়েছে।
কমিশন তার পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছে: ‘কমিশন এই বিষয়ে সচেতন যে, নিরাপত্তারক্ষীরা সীমান্তে অত্যন্ত সংবেদনশীল কর্মে নিযুক্ত আছে। তারপরও তাদেরকে এই ধরনের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অবশ্যই শৃঙ্খলা এবং কিছু মানদণ্ড বজায় রাখতে হবে।’
কমিশন তার পর্যবেক্ষণে আরও উল্লেখ করে, “উল্লিখিত ক্ষেত্রে ভিকটিম একটি নিরস্ত্র বালিকা। সুতরাং এই অভিযুক্ত কনস্টেবল বিএসএফ সদর দপ্তরের নির্দেশনা লঙ্ঘন করেছে। এমনকি বিএসএফের স্টাফ কোর্ট অব ইনকোয়ারি বলেছে, উক্ত কনস্টেবল ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ বা RIGHT TO SELF DEFENCE-এর সীমা লঙ্ঘন করেছে। একটি নিরস্ত্র বালিকাকে গুলি করার কোনো যুক্তিসংগত কারণ থাকতে পারে না।”
২০১৫ সালে আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং ভারতের মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) আরও একটি ক্ষতিপূরণ মামলা করে। ৩১ আগস্ট ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সে দেশের সরকারকে ফেলানীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাঁচ লাখ রুপি প্রদানের অনুরোধ করে। এর জবাবে সে দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলামকে দায়ী করে বক্তব্য দেয়।
এরপর ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে কয়েক দফা শুনানি পিছিয়ে যায়। পরে ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি শুনানির দিন ধার্য হলেও শুনানি হয়নি এখনো।
ফেলানী হত্যা মামলার বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সদস্য কুড়িগ্রাম জেলা জজকোর্ট পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘করোনায় ভার্চুয়ালি চলছে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের কার্যক্রম। ফলে ফেলানী হত্যা মামলার শুনানি হচ্ছে না। আমরা চাই, ভার্চুয়ালি শুনানি হলেও দুই দেশের সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। মামলাটির দ্রুত নিষ্পত্তি হলে তা উভয় রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক।’
ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম ও মা জাহানারা বেগম সংবাদমাধ্যমে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে মানবাধিকার সংস্থাসহ বহুজনের কাছে গিয়েছি; কিন্তু ১০ বছরেও কাঙ্ক্ষিত বিচার পেলাম না।’
আগেই বলা হয়েছে, ফেলানী ভাগ্যবতী। শহিদ হওয়ার ১০ বছর পরও তাঁকে নিয়ে কথা হয়। আর বিএসএফের এমন খুনে অমিয় ঘোষ একাই—এটি ভাবার কোনো কারণ নেই।
কিছু পরিসংখ্যানে আসা যাক, মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর হাতে প্রাণ হারান ৪১ জন, এদের মধ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ৩৫ জনকে, নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ৬ জনকে। আর আহত হয়েছেন ২২ জন, অপহরণ করা হয় ২২ জনকে।
সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৫ বছরে সীমান্তে হত্যা করা হয়েছে ১৫৩ জন বাংলাদেশি নাগরিককে। ২০১৬ সালে হত্যা করা হয় ৪১ জন, ২০১৭ সালে ২৪ জন, ২০১৮ সালে ১৪ জন, ২০১৯ সালে ৪৩ এবং ২০২০ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত ৪১ জন।
গত ১০ বছরে বিএসএফ বাংলাদেশ-ভারত ২ হাজার ৫৫০ মাইল সীমান্তজুড়ে প্রায় ১ হাজার বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। এতে প্রতি চার দিনে একজনকে হত্যা করা হয়েছে বলে বোঝা যায়। দি ইকোনমিস্ট একই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করেছে, এই হত্যার সংখ্যা স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন ‘ইনার জার্মান বর্ডার’ অতিক্রমকালে নিহত লোকের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি।
ফেলানীর মৃত্যুর পরেই ২০১১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি প্রভাবশালী পত্রিকা দি ইকোনমিস্ট (The Economist)-এ Felani’s last steps শিরোনামে এক প্রতিবেদনে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা Human Rights Watch-এর বরাতে বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে বিএসএফ বাংলাদেশ-ভারত ২ হাজার ৫৫০ মাইল সীমান্তজুড়ে প্রায় ১ হাজার বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। এতে প্রতি চার দিনে একজনকে হত্যা করা হয়েছে বলে বোঝা যায়। দি ইকোনমিস্ট একই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করেছে, এই হত্যার সংখ্যা স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন ‘ইনার জার্মান বর্ডার’ অতিক্রমকালে নিহত লোকের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি।
দি ইকোনমিস্ট-এর প্রতিবেদনের সমর্থন পাওয়া যায় ২৩ জুলাই ২০১১ দ্য গার্ডিয়ান (The Guardian)-এ ব্রাড অ্যাডামসের প্রতিবেদনে। India’s shoot-to-kill policy on the Bangladesh border শিরোনামে লেখায় তিনি উল্লেখ করেন, ‘ভারতের বিএসএফ’ সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ‘গুলি করে-হত্যা কর’ (shoot-to-kill) নীতি বজায় রেখেছে, এমনকি নিরস্ত্র গ্রামবাসীর ক্ষেত্রেও। গত ১০ বছরে ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষীরা প্রায় ১ হাজার লোককে হত্যা করেছে, যার অধিকাংশই বাংলাদেশি। এতে সীমান্ত এলাকা পরিণত হয়েছে ‘দক্ষিণ এশিয়ার বধ্যভূমি’তে (south Asian killing fields)।
ব্রাড তার প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করেন, এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য কাউকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি, যদিও প্রমাণ রয়েছে যে এগুলো ছিল ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড এবং মানুষগুলো ছিল নিরস্ত্র ও প্রতিরোধহীন।
ব্রাড তার লেখায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে, ভারতীয় কর্তারা এ ধরনের গুলিবর্ষণকে বৈধতা দিয়ে কথা বলছেন, এমনকি যদি সীমান্ত অতিক্রমকারী ব্যক্তি নিরস্ত্রও হয়ে থাকে। যেমনটি বলেছেন ফেলানী হত্যাকাণ্ডের সময়ের বিএসএফপ্রধান রমন শ্রীবাস্তব: ‘এসব মানুষের জন্য দুঃখবোধ করার কিছু নেই। যেহেতু তারা রাতের বেলায়ও ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করে, তাদের ঠিক নির্দোষ বলা যাবে না। সুতরাং তাদের প্রতি গুলিবর্ষণ বৈধ ছিল।’ সূত্র: (‘কাঁটাতারে ফেলানীর রক্তাক্ত মৃতদেহ ও এক দরিদ্র কিশোরীর রাষ্ট্র সন্ধান’, জহিরুল হক মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অন্তত ৪২ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন বিএসএফের গুলিতে।
তাই দিল্লি-ঢাকার বৈঠক প্রভাব রাখে না সীমান্তে। সময়ে সময়ে পতাকা বৈঠকে কমে না শহিদসংখ্যা। বেড়েই চলে। অনেক রক্তের দানে পাওয়া দেশের অনমনীয় জনতাই হয়তো এর উত্তর দেবে একদিন। নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ওপর ভরসা করে আর কী লাভ?
হাসান শাওন: ফ্রিল্যান্স লেখক ও সাংবাদিক। ই-মেইল: h.shawon@gmail.com