সম্পাদকীয় ভূমিকা

সম্পাদকীয় ভূমিকা

সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানাই।

দুবছর হয়ে গেলো আমরা এখনও করোনা বিপর্যয় থেকে বের হতে পারিনি। ২০২০ এর মার্চ থেকে বাংলাদেশে করোনা বিস্তার ব্যাপকভাবে শুরু হলে প্রথম দিকে কয়েক মাস সবধরনের যানবাহন- অফিস আদালত- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- চলাফেরা সবকিছুই বন্ধ ছিল। এরপর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গত প্রায় দুবছরে বিভিন্ন পর্বে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এই পরিপেক্ষিতে আমরা সর্বজনকথা ২০২০ এর ফেব্রুয়ারি সংখ্যা প্রকাশের পর এর বিতরণ ও পরের সংখ্যাগুলো প্রকাশ নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ি। বহুমুখী প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা সর্বজনকথা প্রকাশ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেই তবে পরিস্থিতির কারণে মুদ্রণ বন্ধ করে তা অনলাইনে প্রকাশ করা শুরু করি। আমরা গত দুই বছর ধরে সর্বজনকথা মুদ্রিত সংখ্যা প্রকাশ করতে পারিনি বলে দুঃখিত, তবে অনলাইনে সবগুলো সংখ্যাই যথাসময়ে প্রকাশিত হয়েছে। সব সংখ্যা পাওয়া যাবে এখানে- (https://sarbojonkotha.info/)।

মুদ্রিত সংস্করণ প্রকাশের জন্য একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও অনিশ্চয়তার কারণে শেষ পর্যন্ত আমরা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি। আমরা এখন আনন্দিত যে, এই সংখ্যা থেকে আমরা সর্বজনকথার মুদ্রিত সংস্করণ প্রকাশ আবারও  শুরু করতে পারছি, এইসাথে এর অনলাইন সংস্করণের প্রকাশও অব্যাহত থাকবে। কোনো বিজ্ঞাপন ছাড়াই আমাদের জার্ণাল ২০১৪ সাল থেকে শুরু করে এখন অষ্টম বর্ষে পদার্পণ করেছে। এই চলার পথে সবসময় পাঠক ও লেখকদের আগ্রহ, ভালবাসা ও অংশগ্রহণ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। আশা করি ভবিষ্যতেও এই সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে। 

২.

এই সংখ্যা প্রকাশের আগে আগে গত কিছুদিনে দুটো বিষয় বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম ও সমাজ আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। একটি হলো যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন কর্তৃক  গুরুতর মানবাধিকার লংঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে র‍্যাব এবং এর ছয়জন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ। অন্যটি হলো শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং দেশব্যাপী তার সমর্থনে নানা কর্মসূচি।

যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞার পর সরকার থেকে দাবি করা হয়েছে র‌্যাব কখনোই মানবাধিকার লংঘন করেনি, দেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডই হয় না। যারা বলেন দেশে ‘ক্রসফায়ার’ ‘এনকাউন্টার’ ইত্যাদি নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড বা রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞ চলছে না, তারা খুব ভালো করেই জানেন যে এটা কতো বড় মিথ্যা। দেশে গুম নাই এটাও এরকমই বড় মিথ্যা। মানুষকে ভয়ের মধ্যে রাখার রাষ্ট্রীয় এজেন্ডার সাথে সাথে বিভিন্ন ব্যক্তি/গোষ্ঠীর দখল লুটপাট নির্যাতন, আটক বাণিজ্যসহ অন্যের ভাড়া খাটার কারণে এই হত্যা ও গুম যজ্ঞ চলছে। স্বাধীনতার পর থেকেই কম বেশি বিচারবহির্ভূত রাষ্ট্রীয় হত্যাকান্ড চললেও ২০০২ থেকে চলছে এর বর্তমান পর্ব যেখানে এক পর্যায়ে ২০০৪ সালে ভীতি সৃষ্টিকারী পোশাকে গঠিত র‌্যাবের ভূমিকা মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। অপারেশন ক্লিন হার্ট দিয়ে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এর শুরু, আওয়ামী লীগ সরকার এগুলো বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু বাস্তবে এগুলো বন্ধ দূরের কথা বরং বাড়িয়েছে। এখন মিছিল, সভা, স্থানীয় গন্ডগোল, আটক বাণিজ্য- সর্বত্র গুম বা ক্রসফায়ার একটি হুমকি বা লেনদেনের দরকষাকষির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হয়। শুধু র‌্যাব নয়, এখন পুলিশও এই কাজে সক্রিয়।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেখে কারও কারও এরকম প্রচারণায় আস্থা তৈরি হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র এসব নিপীড়ন-নির্যাতন-মানবাধিকার হরণ বিরোধী, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই তারা বিশ্বজুড়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের যাত্রাপথ, অতীত তো বটেই বর্তমানেও, দেখলে যে কারও কাছে পরিষ্কার হবে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দেশে দেশে এরকম বাহিনী আর স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসাবেই যুক্তরাষ্ট্র বরাবর কাজ করেছে। বহুদেশে নির্বাচিত সরকার উচ্ছেদ করে সামরিক শাসন আনায় মার্কিন উদ্যোগই ছিল মুখ্য। কন্ট্রা বাহিনী, সাভাক সহ বহু খুনী বাহিনী তাদেরই সৃষ্ট। ল্যাটিন আমেরিকায় বিভিন্ন খুনি বাহিনী তৈরিতে বিশেষ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রই ছিলো যুক্তরাষ্ট্রে। বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে প্রভাব অনেক কমে এলেও এখনও সামরিক দিক থেকে মানে খুন ও ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষমতা তাদের বহু বেশি। তাদের গোয়েন্দা সংস্থা দেশে দেশে সামরিক বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সাথেও যুক্ত।

ইতিহাস বলে, মার্কিন প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার নানা ধরন, লক্ষ্য আর ওঠানামা থাকে। ভারত ও পাকিস্তানে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, কোনো কার্যকর কিছু হয় নি। কিন্তু বোমা না বানালেও কিউবার ওপর শক্ত অবরোধ চলছে কয়েক দশক ধরে। ইরান, উত্তর কোরিয়ায় বোমা বানানোর আগেই শক্ত নিষেধাজ্ঞা হুমকি ধামকি চলছে। ইসরাইলের ব্যাপারে কোনো কথা নাই, সৌদী আরবে গণতন্ত্র নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নাই। গুজরাটে গণহত্যার পর প্রবল জনমতের চাপে তারা মোদীর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। নির্বাচনে জেতার পর তাকেই বুকে জড়িয়ে নিয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প আমলে তো বহু কোলাকুলি দেখেছি তাদের। তাহলে কি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ওপর তাদের আস্থা? না। বহুদেশে তারা বরং অনির্বাচিত বা সেনাবাহিনী দিয়ে নির্বাচিত ব্যবস্থা উচ্ছেদ করেছে। তাদের দরকার নিজেদের খুঁটি। ট্রাম্প গিয়ে বাইডেন আসায় এসব নীতির পরিবর্তন হয়েছে বলে যারা মনে করেন তারা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার আসল কেন্দ্রগুলো সম্পর্কে জানেন না বা জানতে চান না।

তাহলে বাংলাদেশে এই নিষেধাজ্ঞা কেন? মানবাধিকার রক্ষা বা দিনের বেলার নির্বাচন নিশ্চিত করা তাদের লক্ষ্য নয়, তবে এগুলো তাদের শক্ত অজুহাত, সন্দেহ নেই। আমাদের ধারণা এই সরকারের সাথে তাদের কিছু লেনদেন আছে, দরকষাকষির ব্যাপার আছে, আরও চাওয়া কিছু আছে। সেগুলো বোঝার চেষ্টা করছে সরকার, লবিস্ট আর বিজ্ঞাপনী সংস্থা এই সরকারের অন্যতম দুটো বাহিনী, সেইভাবেই কাজ করার চেষ্টা চলছে। ক্ষমতায় থাকার বিনিময়ে যেকোনো কিছু দিতে সরকারের কোনো দ্বিধা নাই।

৩.

ছাত্রীদের হলে খাবারের মান নিয়ে সমস্যা শুরু হয়েছিল শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই সমস্যা সমাধানের কোনো চেষ্টা না করে উল্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ দিয়ে হামলা, পরে আবার পুলিশী হামলা/গুলি/সাউন্ড গ্রেনেড দিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী জখম করার পর উপাচার্য বিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে হল খালি করতে বলায় তা অগ্রাহ্য করে শিক্ষার্থীরা উপাচার্য পদত্যাগের দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করে। এর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের কথা টেনে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সেখানকার ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে যেসব কথা বলেছেন তাতে তার দায়িত্বহীন চেহারাই উন্মোচিত হয়েছে, প্রমাণ করেছেন এরকম বোধ বুদ্ধি চিন্তার ধরন নিয়ে যারা শিক্ষক হবার যোগ্য নয় তারা এখন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করছে। ১৩ জানুয়ারি থেকে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, এর সমর্থনে সারা দেশজুড়ে অসংখ্য কর্মসূচি হয়েছে। অবশেষে সুনির্দিষ্ট আশ্বাসের ভিত্তিতে সাতদিন পর শিক্ষার্থীরা অনশন ভঙ্গ করেন তবে আন্দোলন অব্যাহত আছে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি নিয়ে এই বিষয়ে সক্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক-এর খোলা চিঠি এখানে প্রকাশ করা হলো। সেইসাথে যে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে আমরা বাস করছি তা নিয়ে একটি লেখা এই সংখ্যায় দেয়া হলো। 

৪.

ডিজেল তেল-এর দামবৃদ্ধি, তার কারণে বাস ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে এর আগে। মানুষের ওপর একের পর এক বোঝা চাপানো হয়েছে এর মাধ্যমে। এই সংখ্যায় তেলের দাম বৃদ্ধির বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করে একটা বিশ্লেষণ প্রকাশিত হলো।

মার্ক জুকারবার্গ প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির নাম ‘ফেসবুক’ থেকে এখন ‘মেটা’য় রূপান্তর করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে কোম্পানির ‘নতুন অধ্যায়’ শুরু হলো, সঙ্গে সঙ্গে তা খোদ ইন্টারনেটেরও এক ‘নতুন অধ্যায়’ সূচনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই জগত সম্পর্কে আমাদের মনোযোগী বিশ্লেষণ থাকা দরকার। এবিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা থাকছে এই সংখ্যায়। বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এবং  পুঁজির আগ্রাসী সম্প্রসারণে শ্রম ধরন যেমন বদলাচ্ছে তেমনি তা হয়ে ওঠছে অধিকতর বিচ্ছিন্ন, খন্ডকালীন, অনিশ্চিত। পুঁজির বৈশ্বিকীকরণে শ্রম বিভাজনও বৈশ্বিক হচ্ছে। শারীরিক শ্রমের পাশাপাশি ‘সৃজনশীল’ শ্রমেরও ক্ষেত্র বাড়ছে। এই শ্রমের ধরন এবং পুঁজির সাথে তার সম্পর্কের নানাদিক বিশ্লেষণ গুরুত্বপূর্ণ। এই বিবেচনায় Labor in the Global Digital Economy: The Cybertariat Comes of Age  গ্রন্থের একটি অধ্যায়ের অনুবাদ এখানে প্রকাশ করা হলো।

নাইজেরিয়ান প্রবাসী লেখক চিমামান্ডা এনগোজি আদিচির উই শুড অল বি ফেমিনিস্ট ২০১২ সালে টেডটক-এ প্রথম প্রচারিত হয় এবং প্রথম বই আকারে প্রকাশিত হয়, ২০১৪ সালে। গুরুত্ব বিবেচনা করে আমরা এর অনুবাদ প্রকাশ করছি। ভারতে নব্য উদারবাদী প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বঞ্চনা আর সেই সাথে সমাজ রাজনীতিতে নব্য ফ্যাসিবাদী বিকাশ নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন ভারতের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রভাত পাটনায়েক। আমরা লেখাটির অনুবাদ এখানে প্রকাশ করলাম।

কোনোরকম স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, পরিবেশ সমীক্ষা ছাড়া একের পর এক বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে দেশে। এগুলোর একটি পায়রা কয়লা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। এই এলাকার মানুষের উপর জোরজুলুম ও প্রতারণার কাহিনী জানা যায় তাদের সাথে কথা বললে। এবিষয়ে মাঠ পর্যায়ে সফর করে, মানুষদের সাথে কথা বলে তার ভিত্তিতে প্রস্তুত সরেজমিন প্রতিবেদন দেয়া হলো যা থেকে ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় উন্নয়ন উদ্বাস্তুদের পরিস্থিতি জানা যাবে।

এই সংখ্যায় ধারাবাহিক লেখাগুলো- ‘২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান’-৩ এবং ‘নারী-পুরুষের মানস : পুরুষতান্ত্রিক ধারণা ও বৈষম্যের জৈবসামাজিক ভিত্তি’ -শেষ পর্ব প্রকাশিত হলো।  সেই সাথে ‘চলচ্চিত্র পর্যালোচনা’ থাকছে। আরও আছে ফেলানী হত্যা ও বিচারহীনতা নিয়ে একটি লেখা। আফগানিস্তান নিয়ে লেখার দ্বিতীয় পর্ব অনলাইন সংস্করণে দেয়া হলো।  
এছাড়া গত কয়েক মাসের ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্তসার সংবাদপত্রের পাতা থেকে প্রকাশিত হলো অনলাইন সংস্করণে।

গত ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের শিক্ষা, গবেষণা ও বিপ্লবী রাজনীতির অন্যতম দিকপাল বদরুদ্দীন উমর তাঁর জীবনের সফল ৯০ বছর পূর্ণ করেছেন। তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রকাশ করা হলো।

আনু মুহাম্মদ

২৭শে জানুয়ারি ২০২২

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •