অভিব্যক্তি ও দখল: সৃজনশীল শ্রমে স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রণের দ্বন্দ্ব

অভিব্যক্তি ও দখল: সৃজনশীল শ্রমে স্বাধীনতা ও নিয়ন্ত্রণের দ্বন্দ্ব

উরসুলা হিউজ

বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এবং  পুঁজির আগ্রাসী সম্প্রসারণে শ্রম ধরন যেমন বদলাচ্ছে তেমনি তা হয়ে ওঠছে অধিকতর বিচ্ছিন্ন, খন্ডকালীন, অনিশ্চিত। পুঁজির বৈশ্বিকীকরণে শ্রম বিভাজনও বৈশ্বিক হচ্ছে। শারীরিক শ্রমের পাশাপাশি ‘সৃজনশীল’ শ্রমেরও ক্ষেত্র বাড়ছে। এই শ্রমের ধরন এবং পুঁজির সাথে তার সম্পর্কের নানাদিক বিশ্লেষণ গুরুত্বপূর্ণ। এই বিবেচনায় Ursula Huws-এর Labor in the Global Digital Economy: The Cybertariat Comes of Age (Monthly Review Press 2014) শীর্ষক গ্রন্থের ‘Expression and Expropriation: The Dialectics of Autonomy and Control in Creative Labor’ অধ্যায়ের অনুবাদ এখানে প্রকাশ করা হলো। অনুবাদ করেছেন প্রকৌশলী ও লেখক কল্লোল মোস্তফা

আধুনিক, বৈশ্বিক, ‘জ্ঞানভিত্তিক’ অর্থনীতিতে সৃজনশীল শ্রমের অবস্থানটি বেশ পরস্পরবিরোধী। একদিকে কোম্পানিগুলোকে উদ্ভাবনী ভাবনার নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহের প্রয়োজনীয়তা, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন ও সৃজনশীল কর্মীবাহিনী ব্যবস্থাপনার আবশ্যিকতার মধ্যে যথাযথ ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়। অন্যদিকে সৃজনশীল কর্মীদের ভারসাম্য রক্ষা করতে হয় তাদের আত্মপ্রকাশ ও স্বীকৃতি লাভ এবং জীবিকা অর্জনের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে। এসব বিরোধাত্মক আবশ্যিকতাগুলোর পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলে এক জটিল সম্পর্কের জন্ম হয়, যার আওতার মধ্যে থাকে ম্যানেজার, ক্লায়েন্ট ও কর্মীদের পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সংঘাতের বহু বিচিত্র রূপ। এখানে যেকোনো এক ধরনের কর্ম আরেক ধরনের প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয় এবং এমন এক গতিশীলতার সৃষ্টি হয়, যাকে অনেকটা ধীর লয়ের যুগল নৃত্যের মতো মনে হয়, যেখানে কিছু পদক্ষেপ থাকে প্রথাবদ্ধ আর কিছু পদক্ষেপের জন্য প্রতিনিয়ত উদ্ভাবনের প্রয়োজন হয়।

উক্ত দ্বন্দ্বমূলক নৃত্যই হলো এই লেখার বিষয়বস্তু। এই বিষয়বস্তুটি বেছে নেওয়ার মূল কারণ হলো বৈশ্বিক পুঁজির পুনর্গঠনে সৃজনশীল শ্রমের ভূমিকা সম্পর্কে আমার আগ্রহ। সৃজনশীল শ্রমের এই ভূমিকার কারণে তা একই সঙ্গে বৈশ্বিক পুঁজির পুনর্গঠনের সহযোগী ও শিকার। (তবে এ বিষয়টি বেছে নিতে আমাকে তাৎক্ষণিকভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে ওয়ার্কস (WORKS—Work Organization Restructuring in the Knowledge Society) প্রজেক্টের আওতায় করা কতগুলো ইউরোপীয় গবেষণার ফলাফল। ইউরোপীয় ইউনিয়নজুড়ে এই গবেষণাগুলো করা হয় ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত। পরিমাণগত ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ছাড়াও এই প্রকল্পের মাধ্যমে শ্রমের ভ্যালু চেইন পুনর্গঠনের ফলে শ্রম সংগঠন ও বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শিল্পের ও পেশাজীবী গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত শ্রমিকের জীবনমানের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়েছে, সে বিষয়ে বিশদ কেসস্টাডি করা হয়।

দেশ, শিল্প ও পেশাজীবী গ্রুপভেদে এই গবেষণার ফলাফলে বেশ পার্থক্য লক্ষ করা গেছে। কিন্তু এসব পার্থক্যের মধ্যেও কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে আশ্চর্য মিল লক্ষ করা গেছে, যার মধ্যে রয়েছে কাজের স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন বা প্রমিতকরণ, কাজের তীব্রতা ও গতি বৃদ্ধি।

দেশ, শিল্প ও পেশাজীবী গ্রুপভেদে এই গবেষণার ফলাফলে বেশ পার্থক্য লক্ষ করা গেছে। কিন্তু এসব পার্থক্যের মধ্যেও কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে আশ্চর্য মিল লক্ষ করা গেছে, যার মধ্যে রয়েছে কাজের স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন বা প্রমিতকরণ, কাজের তীব্রতা ও গতি বৃদ্ধি। এর ফলে শ্রমের গুণগত মান, নিরাপত্তা, ভবিষ্যৎ উন্নতি এবং কর্মস্থলের বাইরের জীবনমানের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশেষত যাদের সন্তান রয়েছে এবং যাদের ওপর অনেকের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল, তাদের ওপর এই নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে। ইউরোপিয়ান ওয়ার্কিং কন্ডিশন সার্ভে নামের জরিপ থেকেও একই ধরনের ফলাফল পাওয়া গেছে। এই নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি তীব্রভাবে পড়েছে হোয়াইট কলার বা অভিজাত শ্রমিকদের ওপর, যারা বেশ কয়েকটি দিক থেকে চাপের মধ্যে রয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে ক্লায়েন্টদের বেঁধে দেওয়া টার্গেট অনুযায়ী কাজ করা, সরাসরি কাস্টমারের চাহিদা মেটানো, অনেক সময় ভিন্ন ভিন্ন টাইম জোনের কাস্টমারদের সঙ্গে কাজ করা, নিজেদের মূল দক্ষতা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের কমিউনিকেশন ও ইমোশনাল স্কিল অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি।

যেসব শ্রমিকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় তাদের বেশিরভাগই এই নেতিবাচক প্রভাবগুলোর কথা বলেছেন। যে ৫৭টি বিশদ কেসস্টাডি করা হয়, সেগুলো সম্পন্ন হয় এমন সব কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানে, যার অনেকগুলোতেই শ্রমিক ইউনিয়ন ছিল, কয়েকটি দেশের ক্ষেত্রে তো যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের তুলনায় অনেক শক্তিশালী যৌথ দরকষাকষির ঐতিহ্য রয়েছে যেমন: ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডস। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এই পরিবর্তনগুলোকে এসব দেশে ও প্রতিষ্ঠানে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো বাধার মুখে পড়তে হয়নি। এ বিষয়ে পামেলা মেইল, পার ট্যাঙ্গব্লাদ ও পিটার ডখার্টি বলেছেন, ‘ইউনিয়ন কিংবা ওয়ার্কার্স কাউন্সিলগুলোর প্রতিক্রিয়া ছিল অপ্রতিরোধী ধাঁচের এবং তাদের মনোযোগের কেন্দ্রে ছিল কর্মসংস্থানের ওপর পুনর্গঠনের ফলাফল, নতুন কাঠামোকে প্রভাবিত করার কোনো চেষ্টা তাদের ছিল না’; এবং ‘পরিবর্তনকে প্রভাবিত করতে চায় এমন দৃষ্টান্ত খুব কম ছিল। পুনর্গঠন বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিশেষ অধিকার ছিল ম্যানেজমেন্টেরই।’

৫৭টি সংগঠনের ৩০টি পেশাভিত্তিক গ্রুপের যে ৩০০ জন কর্মীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়, তাদের মধ্যে এমন সব পেশার কর্মীও ছিলেন যাদের নিয়োগকর্তা বা ক্লায়েন্টদের সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে দরকষাকষির যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে বলেই ধারণা করা হয়, যেমন: ফ্যাশন ডিজাইনার, আইটি পণ্যের গবেষণা ও উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত গবেষক এবং সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। সুতরাং আশা করা অমূলক নয় যে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ যৌথভাবে না-হলেও অন্তত ব্যক্তিগত জায়গা থেকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু সাক্ষাৎকারগুলো থেকে এ রকম প্রতিরোধের তেমন কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি। প্রকৃতপক্ষে যে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের শারীরিক ও কেরানি ধরনের শ্রমে যুক্ত কর্মীদের তুলনায় অধিকতর যুক্তিবাদী হিসেবে গণ্য করা হয়, প্রতিরোধের একমাত্র যে দৃষ্টান্তগুলো পাওয়া গেছে, সেটা তাদের থেকেই এসেছে। যেমন, যুক্তরাজ্যের একদল আইটিকর্মী আউটসোর্সিং প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ধর্মঘট পর্যন্ত করেছেন।

কাজের পুনর্গঠনের ঘটনাটি কর্মীদের জন্য ক্ষতিকর হবে—এমনটি জানা থাকার পরও এই যে ‘জ্ঞানভিত্তিক কর্মীরা’ কোনো ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলেন না, এটা ছিল গোটা গবেষণা প্রকল্পের বিভিন্ন উদ্‌ঘাটনের মধ্যে অন্যতম বিস্ময়কর একটা ব্যাপার।

কাজের পুনর্গঠনের ঘটনাটি কর্মীদের জন্য ক্ষতিকর হবে—এমনটি জানা থাকার পরও এই যে ‘জ্ঞানভিত্তিক কর্মীরা’ কোনো ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলেন না, এটা ছিল গোটা গবেষণা প্রকল্পের বিভিন্ন উদ্‌ঘাটনের মধ্যে অন্যতম বিস্ময়কর একটা ব্যাপার। শার্লক হোমসের রহস্য গল্পে রাত্রিকালে কুকুরের ঘেউ ঘেউ না-করা থেকে যেমন প্রশ্নের জন্ম নেয়, এই ব্যর্থতাটিও তেমনি প্রশ্নের জন্ম দেয়—ঠিক কী কারণে ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক জায়গা থেকে এই ক্ষতিকর পরিবর্তনগুলো প্রতিরোধ করা গেল না?

আমার কাছে মনে হয়, এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান সরাসরি ‘ওয়ার্কস’ নামের গবেষণা প্রকল্পের আওতার মধ্যে না-পড়লেও এই প্রকল্পের মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণে তথ্য সংগৃহীত হয়েছে, সেই তথ্যভান্ডারটিকে ‘সৃজনশীল’ বা ‘জ্ঞানভিত্তিক কর্মীদের’ পরস্পরবিরোধী অবস্থানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের কাজে ব্যবহার করা বেশ ফলপ্রসূ হতে পারে। আমার আগ্রহ, বিশেষ করে কর্মীদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাওয়া এবং ব্যবস্থাপকদের ‘সৃজনশীল’ কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়ার মধ্যে যে জটিল ও গতিশীল পারস্পরিক কর্মকাণ্ড ঘটে, সে বিষয়ে এই অনুসন্ধান কোনো আলো ফেলতে পারে কি না তা। এ রকম একটি প্রক্রিয়ারই প্রথম ফল হলো এই লেখাটি, যেখানে ওয়ার্কস নামের গবেষণা প্রকল্পটি ছাড়াও অতীতে আমার করা আরও কিছু গবেষণা ও অন্য লেখকদের কাজের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। এ লেখায় প্রথমে ভ্যালু চেইন পুনর্গঠনে জ্ঞানভিত্তিক কর্মীদের ভূমিকা উল্লেখ করা হয়েছে। তারপর বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে জ্ঞানভিত্তিক ‘সৃজনশীল’ কর্মের বিশেষত্বটা ঠিক কী। এরপর জ্ঞানভিত্তিক কর্মের পুনর্গঠনের সাম্প্রতিক প্রবণতাগুলোর একটা সারমর্ম দাঁড় করিয়ে জ্ঞানভিত্তিক কর্মকাণ্ডের ওপর যে বহুমুখী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়, তার একটা বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে ম্যানেজমেন্টের উদ্যোগগুলো প্রতিরোধ করতে ব্যর্থতার পেছনে এই নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাপনার ভূমিকা কী হতে পারে। সবশেষে আমি সংক্ষিপ্ত কিছু উপসংহার টানার চেষ্টা করেছি।

আমি ‘জ্ঞানভিত্তিক কর্মী’ ও ‘সৃজনশীল কর্মী’ কথা দুটোকে অনেক সময় অদলবদল করে ব্যবহার করেছি। আমি জানি, এই অভিধাগুলো যথেষ্ট নয়, বিশেষত এমন একটা প্রেক্ষাপটে যখন অ-কায়িক শ্রমে যুক্ত কর্মীদের কাজের ধরন ও পেশাগত পরিচয়ের রূপ গড়ে উঠছে, যে জ্ঞানের মাধ্যমে তা নিজেই দ্রুতগতিতে পণ্যায়ন, অবনমন ও পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমি আশা করি, জ্ঞানভিত্তিক কর্মের মধ্যে সৃজনশীলতার ভূমিকা আলোচনার মধ্য দিয়ে পরিভাষাগত বিভ্রান্তি এড়ানো সম্ভব হবে।

পুঁজিবাদী উন্নয়নে সৃজনশীল কর্মীদের ভূমিকা

পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে এটা কমবেশি স্বতঃসিদ্ধ যে, প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে উদ্ভাবনের ওপর। আর গোটা ব্যবস্থাটা যত বেশি বৈশ্বিক ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়, উদ্ভাবনের গতি তত বেশি দ্রুততর করার প্রয়োজন হয়। যেহেতু চূড়ান্ত অর্থে উদ্ভাবনের উৎস হলো মানবীয় সৃজনশীলতা, কাজেই সৃজনশীল কর্মীরা যেকোনো উন্নয়ন প্রক্রিয়ার অন্তর্গত উপাদান।

কথাটা বলা সহজ কিন্তু বৈশ্বিক শ্রমশক্তি থেকে সৃজনশীল কর্মীদের আলাদা করাটা কিন্তু সহজ নয়। কারণ, প্রত্যেক কাজের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমের বিভাজন এতটা জটিল ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত যে স্থান, সময় এবং করপোরেট সীমার মধ্যে প্রত্যেক কাজই অন্য আরও বহু কাজের সঙ্গে আন্তঃনির্ভরশীল।

এক অর্থে প্রত্যেক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেই তো মানবীয় উদ্ভাবন কুশলতা ও জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। খাদ্য, আশ্রয় কিংবা উষ্ণতার মতো মৌলিক প্রয়োজনগুলো যেমন হাজার বছরেও পালটায়নি, তেমনি পাল্টায়নি এর জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো। মানুষ এখনো পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করে, সেগুলোকে নিজ উদ্দেশ্য সাধনে কাজে লাগায়, বণ্টন করে, ভোগ করে এবং বর্জ্য নিঃসরণ করে সেই সঙ্গে পরস্পরকে দেখভাল করে ও বিনোদিত করে। অতীতে কোনো একটা সময় পর্যন্ত কর্মীরা স্বাধীনভাবে নিজেদের ইচ্ছেমতো এই কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারত, তবে অবশ্যই প্রাপ্ত সম্পদ ও বিদ্যমান সময়ের সীমার মধ্যে। তবে সময়ের বিবর্তনে বিচিত্র রকম সামাজিক ব্যবস্থার আওতায় জটিল সব শ্রমবিভাজনের জন্ম হয়েছে, যেখানে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা লিঙ্গ ও উঁচু-নীচু ক্রমবিভাজনভিত্তিক। এই বিভাজনের মধ্যে কাজের হুকুমদাতারা হুকুম তামিলকারীদের কাছ থেকে সৃজনশীলতার সুযোগ কেড়ে নিয়েছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অধীন এই শ্রমবিভাজনের পরিবর্তনটা বেশ গতিশীল—নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রম থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ মূল্য আহরণের তাড়নায় শ্রম প্রক্রিয়া, দক্ষতা, বিভিন্ন সংগঠন ও খাতগুলোর ক্রমাগত ও অসমান বিলোপ ও পুনর্গঠন। এ প্রক্রিয়ায় ক্রমাগত একটি কাজ থেকে আরেকটি কাজের পৃথকীকরণ ঘটতে থাকে, বিশেষত নিত্যনৈমিত্তিক কাজ থেকে উদ্যম ও কল্পনাশক্তির প্রয়োজন হয় এমন কাজগুলোর পৃথকীকরণ। হ্যারি বেভারম্যান১০ বিশ্লেষণ করেছেন, কেমন করে এই কাজে ফ্রেডরিক উইনস্লো টাইলর কর্তৃক ১৯১১১১ সালে উদ্ভাবিত বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে এবং কেমন করে তা কারখানা থেকে অফিসে১২ সম্প্রসারিত হয়েছে। তিনি এ প্রক্রিয়ার অন্তর্গত উপাদান হিসেবে ‘ডি-স্কিলিং’ বা দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করার ধারণাটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে শ্রমিকের নিজস্ব জ্ঞানকে ম্যানেজাররা দখল করে, তারপর বিশ্লেষণ, স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন বা মান নির্ধারণ ও যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে সরলীকৃত শ্রম প্রক্রিয়ায় পরিণত করে, যা সম্পন্ন করতে তুলনামূলক কম দক্ষ (ফলে তুলনামূলক সস্তা) কর্মীর প্রয়োজন হয়। বেভারম্যানের অনুসারীরা শ্রম প্রক্রিয়ার পুনর্গঠনের মাধ্যমে দক্ষতা হ্রাস করার দিকটির দিকে জোর দিলেও বেভারম্যান কিন্তু পরিষ্কার করে উল্লেখ করেছেন, ‘কায়িক’ শ্রম থেকে ‘মানসিক’ শ্রমকে পৃথকীকরণের প্রক্রিয়ায় নতুন ধরনের কিছু দক্ষ কর্মের সৃষ্টি হয়। নৈমিত্তিক কর্মের সরলীকরণের সঙ্গে ম্যানেজারের কর্ম বিস্তারের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। টাইলর যেমন তার বইয়ের ভূমিকায় উল্লেখ করেছিলেন: ‘সাধারণ কর্মীরা যেসব কাজ করেন, তার বেশিরভাগটাই এখন ম্যানেজারদের সম্পন্ন করতে হবে; কর্মীদের প্রতিটি কাজের বিপরীতে ম্যানেজারদের এক বা একাধিক প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পাদন করতে হবে, যার মাধ্যমে কর্মীরা তাদের কাজ আরও ভালোভাবে ও দ্রততার সঙ্গে সম্পাদন করতে পারেন।’

অতীতের শ্রমবিভাজনের ফলাফল যত বেশি করে প্রযুক্তি, সামাজিক ব্যবস্থা ও বস্তুগত অবকাঠামোর মধ্যে প্রোথিত হয়েছে এবং চলতি শ্রমবিভাজন যত বেশি জটিল এবং ভৌগোলিক ও চুক্তিবদ্ধভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে, মানসিক ও কায়িক শ্রমের পৃথকীকরণ এমনভাবে ঘটেছে যে, তাদের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক বোঝা দুরূহ হয়ে যায়। যখন কর্মীরা ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানি ও মহাদেশে ছড়িয়ে থাকে, যাদের পারস্পরিক যোগসূত্র শুধু একটি সফটওয়্যার প্ল্যাটফর্ম বা মধ্যবর্তীদের মধ্যে ঘটা অনিয়মিত মিটিং কিংবা একই ধরনের লোগোর উপস্থিতি, তখন তাদের কাজকর্মের আন্তঃসম্পর্ক (এবং একই উৎস থেকে জন্ম নেওয়ার ইতিহাস) অদৃশ্য হয়ে যায়।

তথাপি, বৈশ্বিক ভ্যালু চেইনের বিভিন্ন অংশের আন্তঃসম্পর্কের বিশ্লেষণ ছাড়া সার্বিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে সৃজনশীল শ্রমের ভূমিকা উপলব্ধি করা কঠিন। শুধু এই বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই সৃজনশীল শ্রম ও পুঁজিবাদী উন্নয়নের মধ্যকার কার্যকর সম্পর্ক বিষয়ে এবং সৃজনশীল শ্রমের গঠন ও পুনর্গঠনের জন্য দায়ী পরস্পরবিরোধী চাপগুলো সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করা সম্ভব। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পুরোনো পেশাগুলোর নৈমিত্তিকীকরণ ও অদক্ষকরণ কিংবা একেবারে বাতিলকরণের পাশাপাশি উদ্ভাবনের নতুন সুযোগ ও নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত নতুন দক্ষতার জন্ম হতে থাকে।

বৈশ্বিক ভ্যালু চেইনের বিভিন্ন অংশের আন্তঃসম্পর্কের বিশ্লেষণ ছাড়া সার্বিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে সৃজনশীল শ্রমের ভূমিকা উপলব্ধি করা কঠিন। শুধু এই বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই সৃজনশীল শ্রম ও পুঁজিবাদী উন্নয়নের মধ্যকার কার্যকর সম্পর্ক বিষয়ে এবং সৃজনশীল শ্রমের গঠন ও পুনর্গঠনের জন্য দায়ী পরস্পরবিরোধী চাপগুলো সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করা সম্ভব।

তাহলে সৃজনশীল শ্রমের এই ভূমিকাগুলো ঠিক কী এবং কোন কোন অনুজ্ঞা এর পেছনে কাজ করে?

সৃজনশীলতার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো নতুন পণ্যের উদ্ভাবন। অগ্রসর পুঁজিবাদে এ কাজটি নানা উপায়ে সংঘটিত হতে পারে। এর মধ্যে একটা হলো, ঐতিহ্যগতভাবে কারুশিল্পের মাধ্যমে উৎপাদিত হয় এ রকম একটা পণ্যকে কারখানায় গণ-উৎপাদনের আওতায় নিয়ে আসা। আরেকটা হতে পারে, কোনো কোম্পানির গবেষণা ও উন্নয়ন (আরএনডি) বিভাগের মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন কোনো পণ্য উদ্ভাবন করা, যে কাজটি সম্পন্ন করেন বেতনভুক্ত কর্মীরা। বিকল্প হিসেবে ফ্রিল্যান্সার, স্বাধীন উদ্যোক্তা বা ক্ষুদ্র কোনো কোম্পানির (সাব-কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় অথবা লুণ্ঠনমূলক অধিগ্রহণের মাধ্যমে জোর করে) কাছ থেকেও প্রয়োজনীয় শ্রমের জোগাড় করা যেতে পারে। অন্য আরেকটা উপায় হলো, সর্বজনের অর্থে পরিচালিত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজটা সম্পন্ন করা এবং পরে তা শোষণের জন্য বেসরকারি কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করা। প্রত্যেক ক্ষেত্রে পণ্যের স্রষ্টা বা উদ্ভাবকের সঙ্গে পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানির সম্পর্ক এবং এই সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তৈরি বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের মালিকানার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভিন্ন ভিন্ন হবে। এই মালিকানার বিশেষ শর্ত, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্টদের মধ্যকার ক্ষমতা সম্পর্ক এবং সৃজনশীল কর্মীদের কর্মজীবন, তাদের আয় ও স্বাধীনতার মতো বিষয়ের ওপর প্রভাব বিস্তার করে।

মালিকানার বিশেষ শর্ত, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্টদের মধ্যকার ক্ষমতা সম্পর্ক এবং সৃজনশীল কর্মীদের কর্মজীবন, তাদের আয় ও স্বাধীনতার মতো বিষয়ের ওপর প্রভাব বিস্তার করে।

নতুন পণ্য উৎপাদনের সঙ্গেই সম্পর্কিত আরও কতগুলো কাজ হলো—পণ্যের পরিবর্তন, মানোন্নয়ন কিংবা বিভিন্ন ধরনের কাজ ও বাজারের ভিন্নতা অনুসারে অভিযোজন। এ ক্ষেত্রেও পুঁজির সঙ্গে সৃজনশীল কর্মীদের সম্পর্কের অনেকগুলো সম্ভাব্য ধরন রয়েছে, যা বিভিন্ন ধরনের চুক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। কাপড়চোপড় কিংবা গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত পণ্যের ডিজাইন ও স্টাইল তৈরির মতো তুলনামূলক ক্ষণস্থায়ী কাজের ব্যাপারেও একই কথা বলা যায়।

পণ্যের পরিবর্তন ও অভিযোজনের কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত আরেকটি কাজ হলো বিভিন্ন ধরনের মিডিয়ার জন্য কনটেন্ট সরবরাহ করা। এ ধরনের অনেক কাজের উৎস হলো বিনোদন ও শিল্পকলার ঐতিহ্যবাহী ধরন এবং এখানে যেসব কর্মী কাজ করেন, তাদের পেশা ব্যাপক বৈচিত্র্যময়: লেখক, সংগীতজ্ঞ, ভিজুয়াল আর্টিস্ট, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও প্রযুক্তিবিদ, গ্রাফিক ডিজাইনার, অনুবাদক, ওয়েবসাইট ডিজাইনারসহ আরও অনেকে—যার এক প্রান্তে রয়েছে নির্জনতা দাবি করে এমন অন্তর্মুখী কর্মকাণ্ড আর অন্য প্রান্তে রয়েছে প্রযুক্তিগত দক্ষতা দাবি করে এমন দলগত কাজ। বেশিরভাগ মানুষ সম্ভবত এ ধরনের কর্মীদেরই ‘সৃষ্টিশীল’ বলে মনে করে থাকেন। অবশ্য তাদের কর্মকাণ্ড ক্রমেই আরও বেশি করে বৃহৎ করপোরেশনের বৈশ্বিক ভ্যালু চেইনের মধ্যে প্রোথিত হচ্ছে কিংবা উৎপাদিত পণ্যের বিতরণ ও পৃষ্ঠপোষকতার জন্য এসব কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে। আর কোম্পানিগুলোর সঙ্গে এই ‘সৃজনশীল’ কর্মীদের সম্পর্ক এত বিচিত্র ধরনের যে, একই ভ্যালু চেইনের অন্তর্গত অপরাপর কর্মীদের থেকে তাদের পৃথক করা একেবারে অসম্ভব না-হলেও দুরূহ হয়ে উঠছে।

বেশিরভাগ মানুষ সম্ভবত এ ধরনের কর্মীদেরই ‘সৃষ্টিশীল’ বলে মনে করে থাকেন। অবশ্য তাদের কর্মকাণ্ড ক্রমেই আরও বেশি করে বৃহৎ করপোরেশনের বৈশ্বিক ভ্যালু চেইনের মধ্যে প্রোথিত হচ্ছে কিংবা উৎপাদিত পণ্যের বিতরণ ও পৃষ্ঠপোষকতার জন্য এসব কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে। আর কোম্পানিগুলোর সঙ্গে এই ‘সৃজনশীল’ কর্মীদের সম্পর্ক এত বিচিত্র ধরনের যে, একই ভ্যালু চেইনের অন্তর্গত অপরাপর কর্মীদের থেকে তাদের পৃথক করা একেবারে অসম্ভব না-হলেও দুরূহ হয়ে উঠছে।

এ ধরনের কনটেন্ট তৈরির কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত আরেক ধরনের কার্যক্রম হলো শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং জনগণকে তথ্য প্রদান। এগুলোকেও পৃথক করা ক্রমেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পণ্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে মুখোমুখি শিক্ষাদান, দূরশিক্ষণ কিংবা বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রশিক্ষণের জন্য কনটেন্ট প্রদানের মধ্যে ধারাবাহিকতা দেখা যাচ্ছে। একইভাবে সরকারি তথ্য বিতরণ, বিভিন্ন যন্ত্রসামগ্রীর ব্যবহার নির্দেশিকা, বিভিন্ন কোম্পানির গ্রাহক সেবাসম্পর্কিত তথ্য প্রদান ইত্যাদি আরও বেশি করে অনলাইন বা কল সেন্টারনির্ভর হয়ে যাচ্ছে। এভাবে যে নতুন শ্রমবিভাজন তৈরি হচ্ছে, তার এক প্রান্তে রয়েছে বিশেষজ্ঞ লেখক আর অন্য প্রান্তে রয়েছে অদক্ষ কর্মী, যার কাজ নির্দিষ্ট নির্দেশনা অনুসরণ করে তথ্য প্রদান। অতীতে বাণিজ্যিকভাবে ও সরকারিভাবে তথ্য প্রদানের মধ্যে হয়তো সুস্পষ্ট পার্থক্য তৈরি যৌক্তিক ছিল; কিন্তু সর্বজন খাতের ক্রমাগত বাণিজ্যিকীকরণ ও এসব সেবা বেসরকারি খাতের কাছে আউটসোর্স বা স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে এ ধরনের বিভাজন অসংগতিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তথাপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বৈধতা তৈরি ও পুনরুৎপাদন এবং শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সৃজনশীল শ্রমের বিনিয়োগ হয়। সুতরাং সৃজনশীল শ্রম যে শুধু বাজারের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য তৈরি ও সঞ্চালনের কাজেই ব্যবহৃত হয়, এ রকম মনে করা উচিত হবে না। এ ক্ষেত্রেও আমরা উৎপাদিত বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ও নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্পর্কের বিবিধ ধরনের সন্ধান পাই। এর মধ্যে রয়েছে সরকারের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আমলাতান্ত্রিক সম্পর্ক, বিভিন্ন অস্থায়ী সম্পর্ক, যার মধ্যে রয়েছে স্বনিয়োজিত শ্রম এবং বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক। কর্মীদের শ্রমের ফসলকে কখনো বাণিজ্যিক পণ্য বা জনসেবামূলক দ্রব্য এবং কখনো একধরনের বিজ্ঞাপন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

আমি সর্বশেষ যে ধরনের সৃজনশীল কর্মের কথা উল্লেখ করব, তাকে শ্রমের অন্য ধরনগুলো থেকে পৃথক করা আরও কঠিন। তবে এ ক্ষেত্রে সীমারেখাটা অস্পষ্ট হলো ব্যবস্থাপনা ও কারিগরি কাজের মধ্যে। এই সৃজনশীল শ্রম নতুন নতুন ব্যবস্থা (সিস্টেম) ও প্রক্রিয়ার (প্রসেস) উদ্ভাবন ঘটায় বা পুরোনোগুলোকে নতুন কোনো উদ্দেশ্যে পরিবর্তন করে। প্রায়ই এ ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়াগুলোর জন্য অন্য কর্মীদের শ্রমের প্রয়োজন হয়। সৃজনশীলতার এই বিশেষ ধরনটি ছাড়া বর্তমান বৈশ্বিক শ্রমবিভাজনটি টিকে থাকতে পারত না। মাইক হেইলস১৩ যাকে ‘লিভিং থিংকওয়ার্ক’ বলে নামকরণ করেছেন, সেই শ্রম অন্যদের শ্রম প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণ করে এবং এগুলোকে স্ট্যান্ডার্ডাইজ করা, অটোমেশন করা, আউটসোর্স করা, ম্যানেজ করা এবং নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ করে। এই পেশাজীবীরা হয়তো সিস্টেম ডিজাইনার বা ম্যানেজার; কিন্তু তাদের অনেক ক্ষেত্রে বৃহৎ প্রকল্পভিত্তিক দলে কাজ করতে হয়, যেখানে প্রযুক্তিবিদ, প্রশিক্ষক ও বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থাপক থাকেন। এই ব্যবস্থাপকরা কেউ মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা করেন আবার কেউ গ্রাহক, সরবরাহকারী ও স্থানীয় সরকার, আইনজীবীসহ বিভিন্ন ধরনের বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করেন। তাদের সফট এবং জ্ঞানভিত্তিক দক্ষতা কাজে লাগিয়ে শুধু যে নতুন নতুন সিস্টেম তৈরি এবং পুরোনো সিস্টেমের উন্নয়ন ও বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করা হয় তাই নয়, এসব সিস্টেম যখন চালু করা হয়, তখন সেগুলোকে পরিচালনার জন্যও তাদের প্রয়োজন হয়।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, পুঁজিবাদের বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কাজে সৃজনশীল শ্রমের প্রয়োজন হয়। অবশ্য কর্মীর সৃজনশীলতার সঙ্গে পুঁজিবাদী নিয়োগকর্তার সম্পর্কের একক কোনো ধরন রয়েছে—এ রকম মনে করা ঠিক হবে না। বরং সৃজনশীল শ্রমকে বুঝতে হবে শ্রমের চরম অসমত্ব একটি ধরন হিসেবে, যা দ্রুতগতির পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে থাকে। এই আলোচনা থেকে আরও দেখা যায় যে, ‘সৃজনশীল কাজ’কে মোটাদাগে ‘জ্ঞানভিত্তিক কাজ’ বলে মনে করা হয় এমনসব কাজ থেকে একেবারে আলাদা করার কোনো সুনির্দিষ্ট উপায় নেই। তথাপি সৃজনশীল কাজের এমন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা বলা যেতে পারে, যেগুলোকে আরও ভালোভাবে খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। আমি এখন সে বিষয়ে আলোচনা করব।

সৃজনশীল কাজের বিশেষত্ব কী?

আগেই বলা হয়েছে, পুঁজির সঙ্গে সম্পর্কের বিচারে যেকোনো ধরনের কাঠামোগত বিশ্লেষণের বেলায় সৃজনশীল কাজের সঙ্গে অন্যান্য জ্ঞানভিত্তিক কাজের সুস্পষ্ট পার্থক্য টানা অসম্ভব। তথাপি সৃজনশীল কর্মীদের এজেন্সি বা কর্তৃত্ব এবং যেসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সামাজিক ও ঐতিহাসিকভাবে তাদের পেশাগত পরিচয় গঠিত হয়েছে, সেদিকে মনোযোগ দিলে সৃজনশীল কর্মীদের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা সম্ভব। অবশ্য এই বৈশিষ্ট্যগুলো যে শুধু তাদের মধ্যেই দেখা যায় বা সব সময়ই তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়, এ রকমটা বলা যাবে না। এখানে এই বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে আলোচনা করা দরকার। কারণ, এর মাধ্যমে সৃজনশীল কর্মীদের নিজ কাজের প্রতি তাদের মনোভাব এবং নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের বিষয়ে ধারণা লাভ করা সম্ভব।

এর মধ্যে অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো নিজ কাজের প্রতি বেশ উঁচুমাত্রার দায়বদ্ধতা। একই কাজ বারবার করার বদলে নতুন নতুন সমস্যায় মনোনিবেশ করা হলো সৃজনশীল কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। কার্ল মার্কস গ্রুনদ্রিসেতে এ প্রক্রিয়াটির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে:

‘এই বাধা দূর করার কাজ নিজেই বেশ মুক্তিদায়ী এবং আরও একটি ব্যাপার হলো, বাহ্যিক লক্ষ্যগুলোকেও তখন স্রেফ বাহ্যিক প্রাকৃতিকভাবে জরুরি কাজ বলে মনে হয় না, মনে হয় ব্যক্তি নিজেই এই কাজের লক্ষ্য স্থির করেছেন। অতএব আত্মবিকাশ, ব্যক্তির নৈর্ব্যক্তিকীকরণ, মানে প্রকৃত স্বাধীনতা যার ক্রিয়া হলো শ্রম।’১৪

এমনকি বেশিরভাগ সময়ে যদি সৃজনশীল কর্মীরা গতানুগতিক ও পুনরাবৃত্তিমূলক কাজে নিয়োজিত থাকেন; কিন্তু এসব কাজের মধ্যে যদি সমস্যা সমাধানের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকে, তাহলেও কিন্তু এক অর্থে মনে হয় এসব কাজে ‘প্রকৃত মুক্ত শ্রমের’ উপাদান রয়েছে। এ ধরনের কাজ একধরনের অবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত পরিপূর্ণতার অভিজ্ঞতা দেয়।১৫ এটি প্রকৃত তৃপ্তির উৎস হিসেবে কাজ করে এবং কাজ করার জন্য বাড়তি একটি প্রেরণা তৈরি করে, যা জীবিকা অর্জনের সহজ অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যের বাইরের বিষয়। একজন কর্মী যে শুধু আর্থিক প্রাপ্তিকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন তা নয়, কাজের বিষয়বস্তুও (কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি) কিন্তু তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি তার কাজের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যটি বিক্রি হয়ে যাওয়ার পরও তা ‘নিজের’ বলে মনে হতে পারে, যা নিয়ে তিনি গর্ব করতে পারেন। কাজের প্রতি তার এই অনুরাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে সেবা ব্যবহারকারী (যেমন, শিক্ষায়), দর্শক-শ্রোতা (যেমন, শিল্পকলায়) কিংবা কাস্টমারের (যেমন, পণ্যের নকশায়) প্রতি তার দায়বদ্ধতারূপে। কর্মীর নিজের ব্যক্তিগত সুনামবিষয়ক উদ্বেগের সঙ্গেও এর সম্পর্ক থাকতে পারে। নিয়োগকর্তা বা ক্লায়েন্টের সঙ্গে দরকষাকষির ক্ষেত্রে জনস্বীকৃতি, নামকরা ক্লায়েন্টের সঙ্গে সম্পর্ক কিংবা শৈল্পিক স্বাধীনতার বিনিময়ে আর্থিক প্রাপ্তি বিষয়ে ছাড় দেওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে দরকষাকষির ধরনটা এমন যে, তার সঙ্গে অন্যান্য কর্ম-সম্পর্কের তুলনা করা মুশকিল এবং যা অনেক ক্ষেত্রে কর্মীর জন্য আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, বিশেষত যখন সৃজনশীল কর্মীদের সরবরাহ বেশি থাকে।

শ্রমের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যের সঙ্গে এ ধরনের শক্তিশালী একাত্মতাবোধের ফলে কর্মীর মধ্যে মালিকানার বিভ্রম তৈরি হতে পারে; যদিও হয়তো পণ্যটির বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি ও নিয়ন্ত্রণ তার হাতছাড়া। মালিকানা হারানোর এই বাস্তবতা মোকাবিলা করা তখন বেশ বেদনাদায়ক হতে পারে। যেসব কাজে বিচ্ছিন্নতাকে স্বাভাবিক বলে মনে করা হয়, সেসব কাজের চেয়ে সৃজনশীল কাজের ফসল বেদখল হয়ে যাওয়ার পুনঃপুন আঘাত চেতনায় তুলনামূলক বেশি দাগ কাটে। যে পরিমাণে এটি প্রকৃতপক্ষে উদ্ভাবনী, সৃজনশীল কাজকে বলা যেতে পারে বিচ্ছিন্নতার জন্য স্থায়ীভাবে প্রস্তুত এবং সৃজনশীল কর্মী বারবার দখলদারির একটি দ্বন্দ্বমূলক নাটকের কেন্দ্রে উপস্থিত: জন্মের সময় কাজটি একই সঙ্গে তার জন্মদাতার কাছে থাকে এবং জন্মদাতার কাছ থেকে কাজটিকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। জন্মদাতার সঙ্গে থাকার একটি কারণ হলো ব্যর্থতার ঝুঁকি; জন্মের আগ পর্যন্ত কোনো উদ্ভাবন সম্পর্কে জানা সম্ভব নয় (যদি সম্ভব হয়, তাহলে সেটা আর উদ্ভাবন থাকে না), ফলে প্রতিবারই ঝুঁকি থাকে যে উদ্ভাবনটি কার্যকর হবে না, কুৎসিত মনে হবে বা অন্য কোনো বিবেচনায় অগ্রহণযোগ্য হবে। সৃজনশীলতার ওই মুহূর্তে যেহেতু কর্মী তখনও তার কাজের ফল থেকে বিচ্ছিন্ন হননি, এ ধরনের ব্যর্থতা তার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য হতে পারে। সৃজন-দখলের নাটকের পটভূমিতে ব্যর্থতার আশঙ্কা সবসময়ই ওত পেতে থাকে। যেসব সৃজনশীল কাজ অতিমাত্রায় সংবেদনশীল এবং ব্যক্তির আত্মপ্রকাশের ওপর নির্ভর করে (যেমন: শিল্পকলা, গল্প-উপন্যাস রচনা কিংবা চলচ্চিত্র পরিচালনা), সেসব ক্ষেত্রে এই আশঙ্কাটি সবচেয়ে প্রকট থাকে; কিন্তু অন্যান্য সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্রেও তুলনামূলক কম দৃশ্যমানভাবে হাজির থাকে।

নিজের কাজের সঙ্গে সৃজনশীল কর্মীর একাত্মতার বিষয়টি ‘ওয়ার্কস প্রজেক্টে’ বেশ কয়েকজন ফ্যাশন ডিজাইনারের কথার মধ্যে উঠে আসে। একজন বলেন, ‘আমার কাছে ফ্যাশন হলো নিজেরই ধারাবাহিকতা।’১৬ অন্য আরও দুই ডিজাইনারের বক্তব্য তো আরও বেশি স্পষ্ট: ‘আপনি যখন ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেন, তখন তা আপনাকে পুরোপুরি অভিভূত করে রাখে,’ বলেন একজন আর অন্যজনের বক্তব্য হলো, ‘এই কাজকে আমাদের ভালোবাসতেই হবে। কারণ, এর মাধ্যমে আমরা নিজেদের ভেতরের বিষয় বাইরে নিয়ে আসি।’১৭

কিন্তু শিল্পী ও ডিজাইনাররাই একমাত্র সৃজনশীল কর্মী নন, যারা কাজ করতে গিয়ে নিজেদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলেন। কারণ, ‘আপনি ততটাই সফল যতটা সফল আপনার সর্বশেষ প্রজেক্ট’ কিংবা ‘কাজটা করতে গিয়ে নিজের সুনামকে আমি ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছি’—এ ধরনের বাক্যের ব্যবহার রীতিমতো সর্বজনীন।

উদ্ভাবনী কর্মীর নিজ উদ্ভাবনী ধারণার সঙ্গে ব্যক্তিগত একাত্মতার মধ্য দিয়ে আরেক ধরনের দ্বন্দ্বের জন্ম হয়: ব্যক্তিগত স্বার্থের সঙ্গে সমষ্টিগত স্বার্থ এবং প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতার দ্বন্দ্ব। যদি কোনো কর্মীর কাছে তার জ্ঞান ও ধারণা ছাড়া শ্রমবাজারে বিক্রয়যোগ্য আর কিছু না থাকে, তাহলে সেটা তার সবচেয়ে মূল্যবান ব্যক্তিগত সম্পদ, যা নিজ স্বার্থ রক্ষার্থেই তাকে বিনা মূল্যে বিতরণ থেকে বিরত থাকতে হবে; বরং সেগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে হবে যেন ভবিষ্যতে যেখানে সম্ভব বিক্রি করা যায়। কোনো ধরনের বিনিময়ের নিশ্চয়তা ছাড়া এগুলো নিয়োগকর্তা বা সহকর্মীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করার অর্থ হলো এমন একধরনের বদান্যতা দেখানো, যা পেশাগত আত্মহত্যারই শামিল। কিন্তু খুব কম সৃজনশীল কাজই আছে, যা বিচ্ছিন্নভাবে সম্পন্ন করা যায়। বেশিরভাগ কাজের জন্যই দলগত প্রচেষ্টার প্রয়োজন এবং এ ক্ষেত্রে নিজ স্বার্থেই দলগত সাফল্য অর্জনের জন্য জ্ঞান ও ধারণা পরস্পরের সঙ্গে ভাগাভাগি করা প্রয়োজন হয়। ভাগাভাগি করার মানসিকতার মাধ্যমে শেখা এবং শেখানো উভয় ক্ষেত্রেই উপকার পাওয়া যায়; এর মাধ্যমে সার্বিকভাবে গোটা প্রকল্পের মান উন্নয়ন ঘটে, যার ফলে প্রত্যেকের জন্যই ভবিষ্যতে আরও কাজ পাওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি পায়। সৃজনশীল কর্মীদের স্বীকৃতি পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষার সঙ্গেও এর সম্পর্ক রয়েছে। স্বীকৃতি ও তারিফ পাওয়ার জন্য এমনকি প্রতিযোগীদের সঙ্গেও উদ্ভাবনী ধারণা ভাগাভাগি করা যেতে পারে, যার ফলে ভাগাভাগি করা ও নিয়ন্ত্রণ করার আকাঙ্ক্ষার মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও বাড়তে থাকে।

অনেক ধরনের সৃজনশীল কাজের আরেকটি সহযোগী বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, ভাবাদর্শগত দিক থেকে কিংবা ইতিবাচক বা নেতিবাচক সামাজিক প্রভাব বিবেচনায় এ ধরনের কাজের বিশেষ ‘অর্থ’ থাকে। কাজটা কীভাবে সম্পন্ন করা হবে, সে বিষয়ে তাই সৃজনশীল কর্মীদের নৈতিক পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার যুক্ত থাকে। কোনো কোনো সময় এটি আনুষ্ঠানিক দায়িত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে; যেমন, পেশাগত কাজের নিয়ম বা কোড অব কনডাক্ট। অন্য অনেক ক্ষেত্রে কর্মীর ব্যক্তিগত বিচার-বিবেচনার ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিতে হয় নিজের ব্যক্তিগত বিশ্বাস আর নিয়োগকর্তা বা ক্লায়েন্টের চাহিদা রক্ষার মাঝে ঠিক কোথায় সীমারেখা টানতে হবে। যেসব ক্ষেত্রে সৃজনশীল কর্মীরা মনে করেন তাদের দায়িত্ব রয়েছে; কিন্তু ক্ষমতা নেই, সেসব ক্ষেত্রে নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করতে অনেক সাহস ও ত্যাগস্বীকারের প্রয়োজন হয়। আর তা করতে না পারলে তাকে অপরাধবোধ তাড়া করতে থাকে।

আমরা উপসংহার টানতে পারি যে, সৃজনশীল কর্মীদের সঙ্গে অন্যান্য জ্ঞানভিত্তিক কর্মীদের কাজের ধরনে মিল থাকলেও তাদের কাজের অভিজ্ঞতার মধ্যে এমন কতগুলো দ্বন্দ্ব তীব্রভাবে হাজির থাকে, যেগুলো অন্যান্য পেশার ক্ষেত্রে এতটা প্রকট থাকে না। যে মাত্রায় তারা নিজেদের কাজের মধ্যে অর্থময়তা খোঁজেন, ব্যক্তিগতভাবে কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকেন, তা থেকে নান্দনিক বা নৈতিক প্রাপ্তি খোঁজেন এবং এসব কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত বাধা অতিক্রমের জন্য নিজেদের মানসিক শক্তি ব্যয় করেন, সেই মাত্রায় তাদের পক্ষে শ্রমবাজারের সহজ-সরল অর্থনৈতিক লেনদেনের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হয় না। ‘আমার শারীরিক শ্রম ও সময়ের বিনিময়ে আমাকে কত দেবেন’—এই প্রশ্নের বাইরেও তাকে নানান বিবেচনা করতে হয়। ফলে এমন একটা বাজার তৈরি হওয়া সম্ভব, যেখানে পুঁজির দরকষাকষির ক্ষমতাই থাকে বেশি। কিন্তু সৃজনশীল কর্মীদের হাতেও শক্তিশালী তাস থাকে: তাদের অন্য অনেক কর্মীর মতো একই শারীরিক শক্তি, সহিষ্ণুতা ও ক্ষিপ্রতাসম্পন্ন অন্য কোনো কর্মীর দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা সম্ভব নয়; তাদের কাছে এমন কিছু থাকে, যা পুঁজি নিজের বিকাশের জন্য মরিয়া হয়ে খুঁজতে থাকে—নতুন ও মৌলিক আইডিয়া বা ধারণা। কিন্তু দ্রুত পরিবর্তনশীল অর্থনীতিতে এই আইডিয়াগুলোর মেয়াদ কম থাকায় এবং বিশ্ববাজার থেকে সৃজনশীল কর্মী নিয়োগের সুযোগ থাকায় শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতা থাকে বেশ তীব্র। ফলে পুঁজির পরবর্তী পুনর্গঠনে সৃজনশীল কর্মীরা কেমন থাকবেন, তা পূর্বানুমান করা কঠিন। পরিপ্রেক্ষিতটা পরিষ্কার করার জন্য পরবর্তী অংশে জ্ঞানভিত্তিক কাজের পুনর্গঠনের সাম্প্রতিক প্রবণতার একটি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা হলো।

সৃজনশীল কর্মীদের হাতেও শক্তিশালী তাস থাকে: তাদের অন্য অনেক কর্মীর মতো একই শারীরিক শক্তি, সহিষ্ণুতা ও ক্ষিপ্রতাসম্পন্ন অন্য কোনো কর্মীর দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা সম্ভব নয়; তাদের কাছে এমন কিছু থাকে, যা পুঁজি নিজের বিকাশের জন্য মরিয়া হয়ে খুঁজতে থাকে—নতুন ও মৌলিক আইডিয়া বা ধারণা। কিন্তু দ্রুত পরিবর্তনশীল অর্থনীতিতে এই আইডিয়াগুলোর মেয়াদ কম থাকায় এবং বিশ্ববাজার থেকে সৃজনশীল কর্মী নিয়োগের সুযোগ থাকায় শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতা থাকে বেশ তীব্র।

জ্ঞানভিত্তিক কাজ পুনর্গঠনের চলতি প্রবণতা

ওয়ার্কস প্রজেক্টের আওতায় গবেষণার কাজটি করা হয়েছে পরস্পর বিপরীতধর্মী জাতীয় প্রেক্ষাপটের বিভিন্ন ধরনের শিল্প খাতে এবং সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে বহুবিধ পেশার সঙ্গে যুক্ত কর্মীর, যাদের মধ্যে ফর্কলিফট অপারেটর থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক আরএনডি ল্যাবরেটরির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানীরাও পড়েন। জাতীয়, খাতভিত্তিক ও পেশাভিত্তিক অসংখ্য পার্থক্য থাকলেও ভ্যালু চেইন পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে কতগুলো সাধারণ প্রবণতা কিন্তু উন্মোচিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রবণতা হলো কাজের ইনটেন্সিফিকেশন বা তীব্রতা বৃদ্ধি, যার অর্থ:

কেবল শ্রমঘণ্টা বৃদ্ধিই নয়; বরং তার সঙ্গে যুক্ত থাকে সময়ের স্যাচুরেশন বা সম্পৃক্ততা, গতি বৃদ্ধি, ডেডলাইন বা সময়সীমা হ্রাস, চাপ বৃদ্ধি এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তির জীবনের অন্যান্য দিকের ‘ঔপনিবেশিকরণ’।১৮

কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই চাপ সার্বক্ষণিকই অনুভূত হয়। অন্যান্য ক্ষেত্রে এই তীব্রতার রূপটা দেখা যায় কর্মীর কাছ থেকে তার মূল কাজের বাইরে নতুন ধরনের কাজের চাহিদার মধ্য দিয়ে। এটা এমন এক কনসেপ্ট বা ধারণা, যাকে দক্ষতা বাড়ানোর বদলে বলা যায় ‘দক্ষতার তীব্রতা বৃদ্ধি’।

প্রথমত, পুনর্গঠনের আওতায় থাকা পেশাভিত্তিক দলগুলোর কাছ থেকে নতুন ধরনের পারদর্শিতা দাবি করা হয়, যেগুলো সাধারণভাবে তার মূল পেশার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়; বরং কতগুলো ‘পার্শ্ব’ দক্ষতা যেমন: সামাজিক দক্ষতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনার দক্ষতা। এভাবে মূল পেশাগত দক্ষতা থাকার প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে যুক্ত হয় এসব নয়া পারদর্শিতা, যা অনেক সময় এমনকি মূল পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ কমিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ত, নতুন নতুন দক্ষতা বৃদ্ধির সঙ্গে কাজের তীব্রতা বৃদ্ধির সম্পর্ক থাকে এবং কর্মীর প্রয়োজনীয় দক্ষতার তালিকা বড় করে তোলে… কর্মীকে একেবারে ভিন্ন ধরনের নতুন নতুন জ্ঞান আয়ত্ত করা ও সম্মিলন ঘটানোর কাজ করতে হয় এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করা ও প্রয়োগ করার মতো গতি অর্জন করতে হয়।১৯

বিশেষত প্রজেক্ট বা প্রকল্পভিত্তিক কাজগুলোয় তীব্রতা বৃদ্ধির বিষয়টি বেশি দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, আরএনডি বা গবেষণা ও উন্নয়নের২০ কথা বলা যেতে পারে। সাম্প্রতিক কালে আরএনডি অনেক বেশি বাজারমুখী হয়েছে। ফলে ‘বিশুদ্ধ’ গবেষণার স্থান দখল করছে এমন গবেষণা, যার ফল দ্রুত বাজারে নিয়ে আসা যায়। এর ফলে কর্মীরা সরাসরি বাজারে চাপের সামনে পড়ছেন, তাদের কাজের সময়সীমা বা ডেডলাইন খুব সংক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কতক্ষণ কাজ করা হয়েছে, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে কতটুকু কাজ সম্পন্ন হয়েছে তা।

সাম্প্রতিক কালে আরএনডি অনেক বেশি বাজারমুখী হয়েছে। ফলে ‘বিশুদ্ধ’ গবেষণার স্থান দখল করছে এমন গবেষণা, যার ফল দ্রুত বাজারে নিয়ে আসা যায়। এর ফলে কর্মীরা সরাসরি বাজারে চাপের সামনে পড়ছেন, তাদের কাজের সময়সীমা বা ডেডলাইন খুব সংক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

কাজের তীব্রতা এই বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত হলো কাজের গতি বৃদ্ধি। কখনো কখনো ইফিসিয়েন্সি বা কার্যকারিতা এবং প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধির সাধারণ প্রচেষ্টার কারণে এমন ঘটতে পারে; কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই এ রকম ঘটার পেছনে দায়ী হলো বাজারের চাপ। উদাহরণস্বরূপ, ফ্যাশন শিল্পের ‘সবচেয়ে সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য হলো ব্যাবসা ও কাজের গতি বৃদ্ধি। ফ্যাশন শিল্প খাতজুড়েই ঋতুভিত্তিক কালেকশনের চল আর দেখা যায় না; বরং কালেকশন ক্রমাগত পরিবর্তিত হতে থাকে… ব্যবসায়ী ও বিক্রেতারা ক্রমাগত আরও বেশি দ্রুত সরবরাহ পেতে চান।’২১

শিল্প খাতে বৈশ্বিক শ্রমবিভাজনের কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ফিনিশড প্রোডাক্ট বা উৎপন্ন পণ্যের পরিবহণে (যেমন, এশিয়া থেকে জলপথে পরিবহণে) যত বেশি সময় লাগে সৃজনশীল কাজের জন্য সময় তত কম পাওয়া যায়। ক্রিংগস ও অন্যরা২২ যেমন বলেছেন, ‘এই পরিবর্তনের ফলাফলস্বরূপ পণ্য উৎপাদন এবং নতুন পণ্য সৃষ্টি ও উদ্ভাবনের জন্য সময় নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে।’

সাক্ষাৎকারদাতাদের বক্তব্য অনুসারে,২৩ সময়ের চাপ বৃদ্ধির ফলে ডিজাইনার বা নকশাকারদের সৃজনশীলতার ক্ষতি হয়। নকশাকারের বিভিন্ন ধাপের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও মানোন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ক্রমেই কমছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাদ পড়ে যাচ্ছে, যার ফলে চাপের মাত্রাও বাড়ে… এর মধ্য দিয়ে নিজের কাজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পাওয়ার ফলে অসন্তুষ্টি আরও বৃদ্ধি পায়, বিশেষত এই কারণে যে সৃজনশীল কর্মীদের কাজের ফলাফলের সঙ্গেই যুক্ত তাদের আত্মতুষ্টি এবং যেহেতু নিজেদের প্রকাশ করার জন্য তা অপরিহার্য।২৪

 

তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ যে প্রবণতাটি চোখে পড়ে তা হলো, স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন বা প্রমিতকরণ। যেমন, আরএনডি বা গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে:

ভ্যালু চেইন বা মূল্যশৃঙ্খলজুড়ে যোগাযোগ সহজ করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কাজের আনুষ্ঠানিকীকরণ ও প্রমিতকরণ ক্রমেই বাড়ছে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, এর ফলে কাজগুলো সহজতর হচ্ছে। সব ধরনের কাজের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট টুলসের ব্যবহার ও আরও বেশি করে নথিভুক্তকরণের প্রবণতা হলো আনুষ্ঠানিকীকরণের কিছু দৃষ্টান্ত, যা একসময় শুধু বাজারভিত্তিক গবেষণা প্রকল্পের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো।২৫

সফটওয়্যার তৈরির সঙ্গে যুক্ত পেশাজীবীদের অনেকেই প্রমিতকরণকে তাদের কাজের জন্য হুমকি মনে করেন: যেহেতু তাদের দক্ষতার স্থানান্তর বা ভাগাভাগিকরণ প্রতিনিয়ত আরও সহজ হচ্ছে, ফলে বিশেষজ্ঞদের বদলে ফেলাও সহজ হচ্ছে।২৬

সাক্ষাৎকার প্রদানকারী ফ্যাশন ডিজাইনাররা আরও অভিযোগ করেছেন কীভাবে প্রমিতকরণের ফলে তাদের সৃজনশীলতার সুযোগ কমে যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর জন্য দায়ী হলো বিভিন্ন ইমেজ প্রসেসিং সফটওয়্যার প্যাকেজ ও বিভিন্ন ধরনের স্ট্যান্ডার্ড কম্পোনেন্ট মডিউল ব্যবহার বৃদ্ধির তাগিদ। একজন জার্মান ডিজাইনার বর্ণনা করছিলেন কেমন করে বিভিন্ন স্ট্যান্ডার্ড মডিউল ব্যবহার করে ডিজাইন করার অর্থ হলো পকেটের আকার সবসময় একটি নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ডে রাখতে বাধ্য হওয়া, ‘আর আমরা ডিজাইনাররা এ ধরনের কাজ করতে খুবই, খুবই অনিচ্ছুক।’ একজন ফরাসি ডিজাইনার বলছিলেন কেমন করে তার কাজ ক্রমেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল বা শিল্পকারখানার কাজের মতো হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে সৃজনশীলতা নষ্ট হচ্ছে।২৭

স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন বা প্রমিতকরণ হলো কাজ আউটসোর্স করা ও স্থানান্তর করার পূর্বশর্ত। আর কাজ এভাবে একবার স্থানান্তর হয়ে গেলে বারবারই তা ঘটতে থাকে, যাকে ‘স্লোবল ইফেক্ট’ বা তুষার গোলকের গড়াতে গড়াতে ক্রমেই বড় হওয়ার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।২৮ অবশ্য কোনো একটি স্ট্যান্ডার্ডাইজড ব্যবস্থাকেও ঠিকঠাক মতো পরিচালনা করতে কতটা জ্ঞান বা দক্ষতা লাগে, তা অনেক সময় ব্যবস্থাপকরা যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারেন না। স্ট্যান্ডার্ডাইজড কাজ সম্পাদন করার জন্যও কর্মীদের নানান সৃজনশীলতা, দক্ষতা ও জ্ঞানের প্রয়োজন হয়, যার জন্য তাদের কোনো মূল্যায়ন হয় না। এর ফলে কাজ অনেক সময় জ্ঞানভিত্তিক কর্মীদের কাছ থেকে পিছলে ভ্যালু চেইনের নিচের দিকের কর্মীদের কাছে চলে যায়।২৯

গ্লোবাল ভ্যালু চেইন বা বৈশ্বিক মূল্যশৃঙ্খল পুনর্গঠনের তিনটি সর্বজনীন প্রবণতা হলো তীব্রতা বৃদ্ধি, গতি বৃদ্ধি ও স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন বা প্রমিতকরণ। জ্ঞানভিত্তিক কাজকে আরও অনেক ধরনের প্রবণতাই প্রভাবিত করছে যার কোনো কোনোটা বিশেষ বিশেষ শিল্প বা পেশাভিত্তিক দলের কাজের সঙ্গে অধিক সংশ্লিষ্ট।

গ্লোবাল ভ্যালু চেইন বা বৈশ্বিক মূল্যশৃঙ্খল পুনর্গঠনের তিনটি সর্বজনীন প্রবণতা হলো তীব্রতা বৃদ্ধি, গতি বৃদ্ধি ও স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন বা প্রমিতকরণ। জ্ঞানভিত্তিক কাজকে আরও অনেক ধরনের প্রবণতাই প্রভাবিত করছে যার কোনো কোনোটা বিশেষ বিশেষ শিল্প বা পেশাভিত্তিক দলের কাজের সঙ্গে অধিক সংশ্লিষ্ট। এর মধ্যে রয়েছে: চুক্তিতে স্পষ্টভাবে থাকুক আর না-থাকুক, সরাসরি গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করা ও গ্রাহকের অসন্তুষ্টির দায় বহন করার ক্রমবর্ধমান তাগিদ; বিভিন্ন টাইম জোন বা সময় অঞ্চলে থাকা কর্মী ও গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকা এবং ইংরেজির মতো আন্তর্জাতিক ভাষা ব্যবহার করার ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনীয়তা; নিজের মূল দক্ষতার বাইরেও বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগের ও মানসিক দক্ষতা প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা; বিভিন্ন ধরনের টার্গেট ও পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করতে বাধ্য হওয়া; নতুন ধরনের নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা; বিশেষজ্ঞ জ্ঞানকে বৃহৎ ডেটাবেজের আওতায় নিয়ে আসা এবং দ্বিস্তরভিত্তিক এমন এক ব্যবস্থা তৈরি, যেখানে বিশেষজ্ঞ থাকবে খুব অল্প এবং সাধারণ কর্মীর সংখ্যা থাকবে তুলনামূলক বেশি, যাদের সহজেই পালটে ফেলা যায়; বিভিন্ন সেবাকে বাজারজাতযোগ্য প্রমিত পণ্যে রূপান্তর; কাজকে খোদ সেবাগ্রহীতার কাছে স্থানান্তর করে দেওয়া; যেমন, ওয়েবসাইটের মাধ্যমে গ্রাহক কর্তৃক নিজেই নিজের প্রয়োজন মেটানো; ‘যখন প্রয়োজন তখন এই পন্থার মাধ্যমে সমস্ত কাজের সম্পর্ককে ক্যাজুলাইজ করা বা ঠিকা কাজের সম্পর্কে রূপান্তর করা, যার ফলে কর্মীরা সার্বক্ষণিক এক চাপের মধ্যে থাকতে বাধ্য হন।৩০

সৃজনশীল কাজে নিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতা

ইতোমধ্যে আলোচিত হয়েছে যে, সমকালীন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সৃজনশীল কর্মীদের সঙ্গে তাদের নিয়োগকর্তার সম্পর্কের কোনো একক স্ট্যান্ডার্ড বা প্রমিত রূপ নেই। তাদের কাজের জন্য তারা বেতন, ফি, কমিশন, রয়্যালটি কিংবা এককালীন অর্থ ইত্যাদি নানারূপে অর্থ পেতে পারেন। তারা কর্মী, স্বাধীন উদ্যোক্তা, ফ্রিল্যান্সার, অংশীদার, ফ্র্যাঞ্চাইজির কিংবা দিনমজুর ইত্যাদি যেকোনো কিছুই হতে পারেন। কাজের সম্পর্কের যেমন বহুবিধ রূপ রয়েছে, নিয়ন্ত্রণেরও ধরনও তেমনি বহুবিধ। আরও জটিল ব্যাপার হলো, নিয়ন্ত্রণের এই রূপগুলো একক বা স্থির কোনো কিছু নয়; নিয়ন্ত্রণের একাধিক রূপ একসঙ্গে বিরাজ করতে পারে এবং একটি আরেকটিতে রূপান্তরিত হতে পারে। গ্লোবাল ভ্যালু চেইন পুনর্গঠন বলতে অনেক সময় সার্বিক পরিচালন প্রক্রিয়ার ধরন পরিবর্তন এবং তার মাঝে বিদ্যমান বিভিন্ন ইউনিটের পারস্পরিক ক্ষমতার বিন্যাস পরিবর্তন বোঝানো হয়। বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে নিয়ন্ত্রণের সম্পর্ক পরিবর্তনের প্রভাব কোনো একটি নির্দিষ্ট সাইট বা অঞ্চলে ম্যানেজমেন্ট স্টাইল ও স্থানীয় কর্মীবাহিনীর ওপর ম্যানেজমেন্টের বলপ্রয়োগের মাত্রার পরিবর্তন হিসেবে অনুভূত হয়।৩১

সমকালীন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সৃজনশীল কর্মীদের সঙ্গে তাদের নিয়োগকর্তার সম্পর্কের কোনো একক .স্ট্যান্ডার্ড বা প্রমিত রূপ নেই। তাদের কাজের জন্য তারা বেতন, ফি, কমিশন, রয়্যালটি কিংবা এককালীন অর্থ ইত্যাদি নানারূপে অর্থ পেতে পারেন। তারা কর্মী, স্বাধীন উদ্যোক্তা, ফ্রিল্যান্সার, অংশীদার, ফ্র্যাঞ্চাইজির কিংবা দিনমজুর ইত্যাদি যেকোনো কিছুই হতে পারেন।

আমন্ডা ডামারিন যেমন বলেছেন, ‘পোস্ট-ইন্ডাস্ট্রিয়াল বা শিল্পোত্তর যুগে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে কিংবা স্বাধীনতা বলতে ঠিক কী বোঝায়, সে বিষয়ে কোনো সাধারণ ঐকমত্য নেই।’৩২ বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বেশ কিছু বিশেষ ধরন লক্ষ করা গেছে, যেগুলো আবার বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক উপাদান অনুসারে বিভিন্নভাবে পরিবর্তিতও হয়েছে, যে উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য, লিঙ্গীয় সম্পর্ক এবং নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন উপাদান।

এমনই একটি বিশেষ ধরন হলো ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণ—পরস্পর পরিচিত ব্যক্তিদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও বাধ্যবাধকতার মধ্য দিয়ে যার প্রয়োগ ঘটে। নিয়ন্ত্রণের ধরনটা হতে পারে পিতৃতান্ত্রিক, যা পারিবারিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে প্রযুক্ত হতে পারে যেমন পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ঘটে কিংবা হতে পারে ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষকতা রূপে যেমন অভিজাতদের কোনো প্রিয় শিল্পীর সঙ্গে করতে দেখা যায়।

মনে হতে পারে, এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ দিনে দিনে অচল হয়ে যাচ্ছে। কারণ, একদিকে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে সমসুযোগ নীতিমালার প্রসার ঘটছে, অন্যদিকে বৈশ্বিক কোম্পানিগুলো মান নিয়ন্ত্রণের জন্য ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আমলাতান্ত্রিক নীতিমালার কারণে বিভিন্ন নৈর্ব্যক্তিক ধাঁচের স্ট্যান্ডার্ডাইজড প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে। হলিউডে যেটাকে ‘কাস্টিং কাউচ’ (যৌন সুবিধার বিনিময়ে কাজ প্রদান) বলে ব্যঙ্গ করা হয়, সেই ধরনের নিয়ন্ত্রণ বিনোদন শিল্পের সঙ্গে বহু বছর ধরেই সংযুক্ত। এ ধরনের ‘সৃজনশীল’ শিল্পের শ্রমবাজারে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা থেকে বোঝা যায়, এ ধরনের নিয়ন্ত্রণের চর্চা এখনো বলবৎ আছে। আগ্রহী তরুণ ও আশাবাদী সৃজনশীল কর্মীদের যে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য অবৈতনিক শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করতে হয়, তা এই চর্চাটিকে আরও উৎসাহিত করে চলেছে। বিনিময়ভিত্তিক সম্পর্ক এবং চুক্তির আনুষ্ঠানিক ধারা না-মানার প্রবণতা এ ধরনের নিয়ন্ত্রণগুলোকে আরও শক্তিশালী করছে। এর ফলে অধীনস্থ সৃজনশীল কর্মীরা শুধু যে চরম শোষণের শিকার হয় তা নয়, সম্পর্ক ভেঙে পড়ার পর প্রতিকার পাওয়ারও কোনো রাস্তা থাকে না তাদের। যৌন নিপীড়ন ও হয়রানির সঙ্গেও এর সম্পর্ক রয়েছে। কর্মীদের দিক থেকে এ ধরনের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের যেসব সুযোগ রয়েছে, সেগুলোও অনেকটা ব্যক্তিগত ও অনানুষ্ঠানিক: কৌশলে বসকে পরাজিত করা, ব্যক্তিগত মাধুর্যের ব্যবহার করে প্রভাবিত করা, আড্ডার নেটওয়ার্কে লজ্জা দেওয়ার চেষ্টা করা কিংবা স্রেফ দূরে সরে যাওয়া।

অধীনস্থ সৃজনশীল কর্মীরা শুধু যে চরম শোষণের শিকার হয় তা নয়, সম্পর্ক ভেঙে পড়ার পর প্রতিকার পাওয়ারও কোনো রাস্তা থাকে না তাদের। যৌন নিপীড়ন ও হয়রানির সঙ্গেও এর সম্পর্ক রয়েছে। কর্মীদের দিক থেকে এ ধরনের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের যেসব সুযোগ রয়েছে, সেগুলোও অনেকটা ব্যক্তিগত ও অনানুষ্ঠানিক: কৌশলে বসকে পরাজিত করা, ব্যক্তিগত মাধুর্যের ব্যবহার করে প্রভাবিত করা, আড্ডার নেটওয়ার্কে লজ্জা দেওয়ার চেষ্টা করা কিংবা স্রেফ দূরে সরে যাওয়া।

নিয়ন্ত্রণের দ্বিতীয় ধরনটি আমলাতান্ত্রিক। সুস্পষ্ট আনুষ্ঠানিক নীতিমালার মাধ্যমে এ ধরনটির প্রয়োগ ঘটে। শুধু পাবলিক সেক্টর নয়, ব্যাংক কিংবা এ রকম অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানে প্রথাগতভাবে নিয়ন্ত্রণের এই ধরনটিই আধিপত্যশীল। এর সঙ্গে হায়ারার্কিক্যাল বা উচ্চ-নীচ ক্রমবিভাজনের কাঠামো ও প্রবেশের ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণের সম্পর্ক রয়েছে, যার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারের৩৩ অনেক বৈশিষ্ট্যের মিল পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের পক্ষে যে ধরনের প্রতিরোধ করার সুযোগ থাকে সেগুলো হলো, নীতিমালার ঠিকঠাক পালন না-করা, বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা কিংবা নামেমাত্র পালন করা কিংবা শ্রমিকদের স্বার্থে নীতিমালার পরিবর্তনের জন্য দরকষাকষি করা; যেমন: কর্মঘণ্টা কমানো, সুবিধা বাড়ানো, মধ্যাহ্নবিরতি বাড়ানো ইত্যাদির ব্যবস্থা করা।

তৃতীয় ধরনের নিয়ন্ত্রণ অনেকটা টেইলরীয়, যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন বেভারম্যান।৩৪ এ ব্যবস্থার মূল কথা হলো ফলাফল নির্ভর ব্যবস্থাপনা। পুরো দল বা দলের সদস্যদের জন্য আলাদা লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়। দলগত লক্ষ্যমাত্রার মাধ্যমে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যান্ত্রিক পদ্ধতি ছাড়াও আরও যে বিষয়টি কাজে লাগানো হয়, তা হলো কর্মীদের পারস্পরিক সংহতির বোধ। হতে পারে নিয়ন্ত্রণটি প্রত্যক্ষভাবে প্রয়োগ করছেন একজন লাইন ম্যানেজার কিংবা হতে পারে, মাইকেল বুরাওয়ে যেমন লক্ষ করেছেন, বিশ্বাসঘাতকতার মধ্য দিয়ে এই নিয়ন্ত্রণটি কার্যকর হয়, দেখা যায় একান্ত বাধ্যগত কর্মীরা নিজেরাই আত্মশোষণ করে থাকেন।৩৫ যে যুগে বাইরে থেকে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়ার সুযোগ থাকে, যেমন: আউটসোর্স সেবার ক্ষেত্রে ক্লায়েন্ট কোম্পানি কিংবা পণ্য বা সেবার মানদণ্ডের শর্ত, সফটওয়্যারের ডিজাইন ইত্যাদি, যখন কাজের একটা বড় অংশ ইলেকট্রনিক মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব এবং যখন কর্মীদলগুলো অস্থায়ী ও বিভিন্ন ভৌগোলিকভাবে বিস্তৃত থাকে, তখন টেইলরীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে শনাক্ত করা কঠিন, বিশেষত ক্ষমতার উৎস যখন অদৃশ্য এবং কর্মীরা নিজেরাই নিয়ন্ত্রণকে আত্তীকরণ করে নিয়েছেন। টেইলরীয় ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সবচেয়ে বেশি গড়ে উঠতে দেখা যায় এর সূচনামুহূর্তে, যার মধ্যে রয়েছে কাজের স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনের বিরুদ্ধতা, আরও বৈচিত্র্যময় কাজের দাবি জানানো, জব রোটেশন বা কাজের পরিবর্তন কিংবা কাজের ধরনের উন্নয়ন কিংবা ‘মানবকেন্দ্রিক নকশা’র৩৬ দাবি।

স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বাইরে অধিকাংশ দেশেই এই দাবিগুলোর বাস্তবায়ন ঘটতে দেখা যায়। একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর সরাসরি অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার বাইরে টেইলরীয় ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির বিরুদ্ধে আর যে ধরনের প্রতিরোধ দেখা যায়, তার মধ্যে রয়েছে কর্মী দলগুলোর যৌথ সচেতন প্রচেষ্টার মাধ্যমে কাজের গতি কমিয়ে কিছু বাড়তি সময় হাতে পাওয়া ও কাজের চাপ হ্রাস৩৭, কাজের টার্গেট বা লক্ষ্যমাত্রা ও পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর বা কার্যসম্পাদন সূচকের ধরন ও মাত্রা নিয়ে দরকষাকষি এবং স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিধিবিধানকে কাজে লাগানো, যেন কাজের গতি ও চাপ অমানবিক পর্যায়ে পৌঁছাতে না পারে। এসব তৎপরতার অনেকগুলোতেই সৃজনশীল কর্মীদের পক্ষে অংশগ্রহণ করা সমস্যাজনক। কারণ, এর জন্য এমন ধরনের মনোভাবের প্রয়োজন হয়, যা আবার সৃজনশীলতা বিরোধী। ভিডিও গেম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইলেকট্রনিক আর্টসের ক্যালিফোর্নিয়ার কর্মীদের দৃষ্টান্তটা এদিক থেকে বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। কোম্পানির গেমের জন্য তারা ভিডিও ও অডিও তৈরি করলেও কর্মঘণ্টা কমানোর উদ্দেশ্যে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে করা এক মামলায় জয়লাভ করার জন্য কর্মীদের প্রমাণ করতে হয়েছে যে, তাদের কাজ ‘সৃজনশীল’ নয়।৩৮

ভিডিও গেম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইলেকট্রনিক আর্টসের ক্যালিফোর্নিয়ার কর্মীদের দৃষ্টান্তটা এদিক থেকে বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। কোম্পানির গেমের জন্য তারা ভিডিও ও অডিও তৈরি করলেও কর্মঘণ্টা কমানোর উদ্দেশ্যে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে করা এক মামলায় জয়লাভ করার জন্য কর্মীদের প্রমাণ করতে হয়েছে যে, তাদের কাজ ‘সৃজনশীল’ নয়।

নিয়ন্ত্রণের চতুর্থ ধরনটি হলো বাজারব্যবস্থার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ। বাজারে যেসব কাজের বিশেষ চাহিদা রয়েছে, সেসব কাজ বাদ দিলে স্বনিয়োজিত ও স্বাধীন কর্মী ও উৎপাদকদের কাজ করতে হয় ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী এবং তাদের বেঁধে দেওয়া দর অনুসারে। তাদের এমন একটা বাজারে কাজ করতে হয়, যেখানে প্রতিযোগিতা তীব্র ও বৈশ্বিক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে দরকষাকষির সুযোগ থাকলেও এ ধরনের কাজের ক্ষেত্রে প্রতিরোধ প্রধানত পেশাগত সংগঠন বা ইউনিয়ন তৈরির মাধ্যমেই ঘটে থাকে। এসব সংগঠনের মাধ্যমে সরবরাহকারীরা একজোট হয়ে প্রতিযোগিতার ন্যূনতম কিছু নিয়মকানুন প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন, যেন প্রতিযোগিতার নামে একে অপরের জন্য বেশি ক্ষতিকর হয়ে না ওঠেন। অভিনয়শিল্পী, লেখক ও আলোকচিত্রীরা এভাবে কিছুটা হলেও সফলতা লাভ করেছেন। অবশ্য এ ধরনের দলভিত্তিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সবসময়ই প্রতিযোগী ও সহযোগী মনোভাবের মধ্যে একধরনের টানাপোড়েন কাজ করে: যেকোনো মূল্যে তারকা হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দ্বন্দ্ব। এ ধরনের প্রতিরোধ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে আবার আরেক ধরনের নিয়ন্ত্রণের সুযোগ তৈরি হয়, সংগঠনের সদস্যপদ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে যে ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়, তাকে বলা যেতে পারে পেশাভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বনিয়ন্ত্রিত পেশাজীবী সংগঠনগুলো; যেমন, চিকিৎসক ও আইনজীবীদের সংগঠন, এ ধরনের নিয়ন্ত্রণকে এমন সফলতার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিতে সক্ষম হয়েছে যে, এগুলো জাতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা প্রদানের মাধ্যমে, যার মধ্যে এমনকি পেশাচর্চা করা থেকে বিরত রাখার মতো নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে, এসব সংগঠন যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষমতা চর্চা করতে সক্ষম। জ্ঞানের পণ্যায়নের মধ্য দিয়ে এমনকি এসব নিয়মকানুনও এখন হয় ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে অথবা পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।৩৯

দামারিন৪০ বলেছেন, নির্দিষ্ট কিছু শিল্পে (তার নিজের কেসস্টাডিটি ছিল ওয়েব ডিজাইনারদের নিয়ে) আরও বিস্তৃত ধরনের নিয়ন্ত্রণের দেখা মেলে যেটাকে তিনি ‘ব্যক্তি, প্রযুক্তি, প্রথা এবং প্রকরণভেদের সঙ্গে সম্পর্কিত এক সামাজিক-কারিগরি নেটওয়ার্ক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই ধারণাটির সঙ্গে ‘কমিউনিটিজ অব প্র্যাকটিস’৪১ বা নির্দিষ্ট পেশাগত চর্চার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সম্প্রদায়ের ধারণার কিছু বৈশিষ্ট্যের মিল পাওয়া যায়। এ বিষয়টাকে স্বতন্ত্র একটি নিয়ন্ত্রণ হিসেবে না-দেখে আমি বরং এটাকে সৃজনশীল কাজে নিয়ন্ত্রণ ধরনের বিভিন্ন জটিলতার এক অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন চরিত্রায়ণ হিসেবে আখ্যায়িত করব। আমি উপরে নিয়ন্ত্রণের যেসব ধরন নিয়ে আলোচনা করেছি (আরও যেসব ধরন আমি উল্লেখ করিনি), সেগুলো যে সবসময় আলাদাভাবে প্রয়োগ হয় তা নয়; নির্দিষ্ট আঞ্চলিক, সাংস্কৃতিক ও শিল্পের প্রেক্ষাপটে এগুলোকে নানাভাবে সম্মিলিত করে ব্যবহার করা হয়।

সৃজনশীল কর্মী ব্যবস্থাপনা যে পুঁজির জন্য সহজ কোনো কাজ নয় তা বেশ সুবিদিত। ইকোনমিস্টে প্রকাশিত এক লেখায় বিষয়টি এভাবে উঠে এসেছে:

‘সৃজনশীলতার ব্যবস্থাপনায় অনেকগুলো দুরূহ বিষয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়: কর্মীদের নতুন নতুন ধারণা নিয়ে আসার মতো স্বাধীনতা দিতে হয়; কিন্তু নিশ্চিত করতে হয় যে তারা নির্দিষ্ট একটি কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করবেন, শক্তিশালী একটি করপোরেট সংস্কৃতি তৈরি করতে হয়; কিন্তু নিশ্চিত করতে হয় যে খুব দমবন্ধ করা পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয়।’৪২

বাস্তবে এর অর্থ হলো একসঙ্গে নিয়ন্ত্রণের একাধিক ধরনের সহাবস্থান, যেখানে লাঠি ও মুলা উভয়ই ব্যবহৃত হয়। কিন্তু আমরা যেমন উল্লেখ করেছি, একেক ধরনের নিয়ন্ত্রণের প্রতিক্রিয়ায় একেক ধরনের প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ম্যানেজমেন্টের একধরনের আগ্রাসন প্রতিরোধের জন্য উপযুক্ত কোনো প্রতিক্রিয়াকে যদি ভিন্ন ধরনের আগ্রাসন বা নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে হয় কোনো লাভ হয় না অথবা হিতে বিপরীত হয়। উদাহরণস্বরূপ, কর্মীদের দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে হয়‒এমন একটি পরিস্থিতিতে কর্মসপ্তাহ কমানোর জন্য যে অফিশিয়াল বিধিবিধান আছে, সেটা কাজে লাগালে তেমন কোনো লাভ হবে না, যদি কর্মীরা নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সাপেক্ষে বেতন পায় (টেইলরীয় নিয়ন্ত্রণ) কিংবা যদি কর্মীরা বিশ্বাস করেন, কাজ বাকি রাখাটা তাদের জন্য লজ্জাজনক (নিয়ন্ত্রণের ব্যক্তিগত ধরন) কিংবা কর্মীরা যদি জানেন যে, তাদের সুনাম নির্ভর করছে সময়মতো কাজটি সম্পন্ন করার ওপর (বাজারভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ)।

যখন নিয়ন্ত্রণের একাধিক ধরন একসঙ্গে বিদ্যমান থাকে, তখন কর্মীদের ওপর পরস্পরবিরোধী চাপ এমন তীব্র মাত্রায় পড়ে যে, প্রতিরোধের কার্যকর কোনো পন্থা অবলম্বন করার কোনো সামর্থ্য তাদের থাকে না। এর পরিবর্তে তাদের মধ্যে যেসব প্রতিক্রিয়া দেখা যায় তার মধ্যে রয়েছে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাওয়া, চাপ সামলানোর ভার পরিবারের ওপর ছেড়ে দেওয়া (কিংবা পারিবারিক জীবনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকা),৪৩ নিঃশেষিত হয়ে যাওয়া, কাজ ছেড়ে দেওয়া, নিষ্ঠুর অনাচার করা, বিচ্ছিন্নভাবে নিজেকে শান্ত করা বা অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালানো, স্বার্থপর আচরণ করে সহকর্মীদের ক্ষতির কারণ হওয়া ইত্যাদি। সন্দেহ নেই, এসবের বিকল্প হলো ভিন্ন ধরনের যৌথ সংগঠন ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা। কিন্তু ‘ওয়ার্কস’ প্রকল্পে কাজ করতে গিয়ে এ রকম কোনো তৎপরতা আমাদের তেমন চোখে পড়েনি।৪৪

কেসস্টাডির ভিত্তিতে করা বিভিন্ন গবেষণা থেকে এ ধরনের পরস্পর বিরোধিতার অনেক দৃষ্টান্ত দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন কাজ ও প্রক্রিয়াকে আউটসোর্স করা বা স্থানান্তর করার জন্য এগুলোকে স্ট্যান্ডার্ডাইজ করা ও বিভক্ত করার৪৫ প্রয়োজন হয় আর এর জন্য দরকার টেইলরীয় ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। কিন্তু এই বহুধাবিভক্ত শ্রমপ্রক্রিয়াকে সময়ের সঙ্গে কোনো বাধাবিপত্তি ছাড়াই ব্যবস্থাপনা করার জন্য যে নতুন ধরনের সফট স্কিল বা দক্ষতার প্রয়োজন, তার জন্য এমন দায়বদ্ধতা ও প্রেরণার প্রয়োজন হয়, যা আবার টেইলরীয় পদ্ধতিতে ম্যানেজ করা যায় না।

ওয়ার্কস প্রকল্পের ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে রামিউল ও ডি ভ্রুম সফটওয়্যার উৎপাদনে নলেজ শেয়ারিং বা জ্ঞান ভাগাভাগি করে নেওয়ার ক্ষেত্রে এক ‘প্রিজনার্স ডাইলেমা’ বা কারাবন্দির উভয় সংকটের অস্তিত্বের কথা বলেছেন। একদিকে মাঝামাঝি অবস্থানে থাকা কোম্পানিগুলো চায় যত বেশিসংখ্যক কাজ নিচের দিকের বিভিন্ন সস্তা অঞ্চলে থাকা কোম্পানির কাছে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে, যেন খরচ কম হয়, অন্যদিকে তারা খুব ভালো করেই জানে, নিচের দিকের কোম্পানিগুলো চায় সাপ্লাই চেইনের উপরের দিকে উঠে আসতে, যেন তারা আরও বেশি মূল্যের কাজ পায়। এভাবে দুটি কোম্পানি পরস্পরের সঙ্গে এমন এক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে যায়, যেখানে তারা একই সঙ্গে পরস্পরের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল এবং পরস্পরের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত (যদি ক কোম্পানি খুব বেশি পরিমাণে জ্ঞান খ কোম্পানির সঙ্গে ভাগাভাগি করে, তাহলে দেখা যাবে চুক্তি নবায়নের সময় খ কোম্পানি ক কোম্পানির কাছ থেকে কাজ বাগিয়ে নিয়েছে)।৪৬ একই ধরনের উভয়সংকটের জন্ম হতে পারে যখন বিভিন্ন ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে কোনো একটি টিমে একসঙ্গে কাজ করতে বলা হয়: এই প্রকল্পে তাদের পরস্পরের বিশ্বাস ও সহযোগিতা প্রয়োজন; পরবর্তী প্রকল্পে তারা হয়তো পরস্পরের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে।

প্রেমিলা ডি’ক্রুজ ও এরনেস্তো নরনহা ভারতীয় কলসেন্টারের একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন, যেখানে ক্লায়েন্ট বা খদ্দের সংগঠনগুলো সার্ভিস লেভেল অ্যাগ্রিমেন্টে (এসএলএ) বেশ কঠোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়।৪৭ এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করার জন্য স্থানীয় ব্যবস্থাপকরা এমন কঠোর সব নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রয়োগ করেন যে, লেখকরা এটাকে ডিপারসোনালাইজড বুলিয়িং বা নৈর্ব্যক্তিক গুন্ডামি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্থানীয় ব্যবস্থাপকদের এর জন্য কর্মীদের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয় না। বাইরের ক্লায়েন্টদের ওপর সব দোষ চাপিয়ে, জাতীয় ব্যাক অফিস প্রসেসিং (বিপিও) শিল্প রক্ষার দোহাই দিয়ে এবং কলসেন্টার কর্মীদের প্রফেশনাল বা পেশাজীবী হিসেবে উল্লেখ করে এই ব্যবস্থাপকরা বেশ সফলতার সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়নকে দোষী সাব্যস্ত করা, নিজেদের দায়মুক্ত করা এবং লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য কর্মীদের স্বেচ্ছায় বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে উদ্বুদ্ধ করার কাজ করেছেন। কিন্তু কাজের চাপ এত তীব্র যে, কর্মীদের মাঝেমধ্যেই কিছুটা হালকা হওয়ার জন্য অন্তর্ঘাতমূলক কাজে লিপ্ত হতে হয়।

লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করার জন্য স্থানীয় ব্যবস্থাপকরা এমন কঠোর সব নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রয়োগ করেন যে, লেখকরা এটাকে ডিপারসোনালাইজড বুলিয়িং বা নৈর্ব্যক্তিক গুন্ডামি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্থানীয় ব্যবস্থাপকদের এর জন্য কর্মীদের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয় না।

আরেকটা কেসস্টাডি থেকে দেখা গেছে, একধরনের ব্যবস্থাপনা অন্য ধরনের ব্যবস্থাপনা দ্বারা প্রতিস্থাপনের বেলায় কেমন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। ডেনমার্কের কর ব্যবস্থার পুনর্গঠনবিষয়ক একটি গবেষণার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার আওতায় কাজ করা একদল কর বিশেষজ্ঞকে, যারা জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের অধীন কাজ করতেন, এমন একটি কেন্দ্রীয় কর ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়, যেখানে একদল করবিষয়ক পরামর্শদাতা কলসেন্টার ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির আওতায় টেলিফোন ও ই-মেইলের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে তথ্য প্রদান করে থাকেন। ট্রেড ইউনিয়ন ও ব্যবস্থাপকদের পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এই স্থানান্তরের কাজটা বেশ নমনীয়তার সঙ্গেই সম্পন্ন করা হয়, যেন তাদের পেশাভিত্তিক মান-মর্যাদা খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল টেইলরীয় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে প্রতিস্থাপিত করার ঘটনা। এই কর্মীরা তাদের নিয়োগদাতাদের প্রতি যথেষ্ট দায়বদ্ধ ছিলেন এবং বহু বছর ধরে কাজ করতে করতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিপুল জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তাদের এই জ্ঞানকে সাধারণ একটি ডেটাবেজের মধ্যে নিয়ে আসা ও টেইলরীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরোপ করার মধ্য দিয়ে স্বল্প মেয়াদে সফলতা এলেও ভবিষ্যতে এই জ্ঞান কীভাবে নবায়ন হবে, তা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্নের জন্ম হয়। কর্মীদের কাজের পুরোটা সময় মিটিং করে কিংবা গ্রাহকদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেই চলে যায়। ফলে নিজেদের জ্ঞান নবায়ন করার কোনো সময় কর্মীদের হাতে থাকে না এবং কর্মীদের মধ্যে চাকরি ছাড়ার হার বেশি থাকায় দেখা যায় নতুন সাংগঠনিক ব্যবস্থায় পুরাতন যেসব কর্মীর জায়গায় নতুন কর্মীরা যোগ দিচ্ছিলেন, তাদের দক্ষতা তুলনামূলক কম। কাজেই কোনো সংগঠনের জন্য স্বল্পমেয়াদি সুবিধা অর্জন অনেক সময় দীর্ঘ মেয়াদে বড় ধরনের সমস্যার জন্ম দিতে পারে।৪৮

এ রকম আরও বহু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আশা করি, আমি ইতোমধ্যে যথেষ্টসংখ্যক দৃষ্টান্ত হাজির করতে সক্ষম হয়েছি, যার মাধ্যমে বোঝা যায়, ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন ধরনের নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বনের ফলে শুধু যে কর্মীদের পরস্পরের মধ্যে বিভেদমূলক দ্বন্দ্বের জন্ম হয় তা নয়, এর মধ্য দিয়ে ব্যবস্থাপকদের জন্যও নানা ধরনের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।

উপসংহার

আমরা সিদ্ধান্ত টানতে পারি যে, পুঁজিকে সবসময়ই এমন একটি দ্বন্দ্ব মোকাবিলা করতে হয় যেখানে, একদিকে পুঞ্জীভবনের প্রক্রিয়া চালু রাখার উদ্দেশ্যে পুঁজির প্রয়োজন ক্রমাগত নতুন নতুন আইডিয়া বা ভাবনার সরবরাহ,  অন্যদিকে পুঁজির প্রয়োজন কার্যদক্ষতা ও মুনাফা সর্বোচ্চকরণ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য এসব প্রক্রিয়াকে কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা, যেন উৎপাদিত পণ্য নিয়ে ইচ্ছেমতো বাণিজ্য করা সম্ভব হয়। আর শ্রমের দিক থেকে দেখলে, ব্যক্তি কর্মীর আকাঙ্ক্ষা থাকে—একদিকে জীবনে অর্থময় কিছু করা, দুনিয়ায় নিজের কাজের ছাপ রেখে যাওয়া, শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতি লাভ করা ইত্যাদি; অন্যদিকে আকাঙ্ক্ষা থাকে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ উপার্জন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরি ও প্রিয়জনের সঙ্গে কাটানোর মতো সময় পাওয়া। এ বিষয়টি অনেক সময় স্বাধীনভাবে কাজ করার আকাঙ্ক্ষা বনাম জীবিকার নিরাপত্তার দ্বন্দ্ব হিসেবে প্রকাশিত হয়। এই দ্বন্দ্বগুলো জটিল এক নাচের মতো পরস্পরের বিরুদ্ধে ক্রিয়া করে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাপনার প্রতিক্রিয়ায় কর্মীদের দিক থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রতিরোধের জন্ম হয় (কিংবা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে)। গ্লোবাল ভ্যালু চেইনের নতুন নতুন মোচড়ের সঙ্গে সঙ্গে কর্মীদের ক্রমাগত নতুন ধরনের আঘাত ও বিস্ময়ের মোকাবিলা করতে হয়, এমনকি যেসব কর্মী দক্ষতা ও বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের জোরে একসময় নিজেদের শক্ত দরকষাকষির ক্ষমতাসম্পন্ন বলে মনে করতেন, তারাও এ প্রক্রিয়ার বাইরে থাকতে পারেন না। আবার শ্রমের দিক থেকে অপ্রত্যাশিত নতুন কোনো আইডিয়া ম্যানেজমেন্টের জন্য নতুন ঝুঁকির জন্ম দিতে পারে। (বিশ বছর আগে কে ধারণা করতে পেরেছিলেন যে, ভারতীয় সফটওয়্যার প্রকৌশলীরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিজেদের কাজের বৈশ্বিক দর সম্পর্কে অবগত হয়ে সেই তথ্য বৈশ্বিক বাজারে নিজেদের সুবিধার কাজে ব্যবহার করতে পারবেন?)

কাজের সঙ্গে ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির সঙ্গে সম্পর্কের ধরন বহুবিধ হওয়ার কারণে সৃজনশীল শ্রমের সঙ্গে পুঁজির সম্পর্ককে সহজে এককথায় বর্ণনা করার কোনো উপায় নেই। এই বহুমাত্রিকতা ও এর মধ্য দিয়ে জন্মানো বহুবিধ দ্বন্দ্ব উভয় পক্ষকে শক্তিশালী যেমন করতে পারে, তেমনি দুর্বলও করে দিতে পারে। সম্ভবত সৃজনশীল কর্মীদের দিক থেকে এই দ্বন্দ্বকে কাজে লাগানোর উপায় খুঁজে বের করার জন্য তাদের সৃজনশীলতার কিছু অংশ বিনিয়োগ করার সময় হয়ে এসেছে।

তথ্যসূত্র:

১। দেখুন Ursula Huws, “The Spark in the Engine: Creative Workers in a Global Economy,” Work Organization, Labor and Globalization 1/1 (2006): 1–12.

২। এই প্রকল্পটি ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব লিউভেনের হায়ার ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের মনিক রামিউলের নেতৃত্বে একটি সমন্বিত প্রকল্প হিসেবে ইউরোপীয় কমিশনের ষষ্ঠ ফ্রেমওয়ার্ক প্রোগ্রামের অধীন অর্থায়ন করা হয়েছিল, এর সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ১৪টি দেশের ১৭টি সহযোগী সংগঠন যুক্ত ছিল। আরও তথ্যের জন্য দেখুন http://www.worksproject.be

৩। J. Flecker, U. Holtgrewe, A. Schönauer, W. Dunkel, and P. Meil, Restructuring Across Value Chains and Changes in Work and Employment: Case Study Evidence from the Clothing, Food, IT and Public Sectors, WORKS Project, Higher Institute of Labor Studies, K.U. Leuven (Leuven: HIVA, 2008).

৪। G. Valenduc, P. Vendramin, B.-J. Krings, and L. Nierling, Occupational Case Studies: Synthesis Report and Comparative Analysis, WORKS Project, Higher Institute of Labor Studies, K.U. Leuven (Leuven: HIVA, 2007).

৫। J. Flecker, U. Holtgrewe, A. Schönauer, and S. Gavroglou, Value Chain Restructuring and Company Strategies to Reach Flexibility, WORKS Project, Higher Institute of Labor Studies, K.U. Leuven (Leuven: HIVA, 2009); B.-J. Krings, L. Nierling, M. Pedaci, and M. Piersanti, Working Time, Gender, Work-Life Balance, WORKS Project, Higher Institute of Labor Studies, K.U. Leuven (Leuven: HIVA, 2009); U. Huws, S. Dahlmann, J. Flecker, U. Holtgrewe, A. Schönauer, M. Ramioul, and K. Geurts, Value Chain Restructuring in Europe in a Global Economy, Higher Institute of Labor Studies, K. U. Leuven (Leuven: HIVA, 2009).

৬।N. Greenan, E. Kalugina, and E. Walkowiak, “European Working Conditions Survey,” in The Transformation of Work? A Quantitative Evaluation of the Shape of Employment in Europe, ed. Birindelli et al., WORKS Project, Higher Institute of Labor Studies, K.U. Leuven (Leuven: HIVA, 2007).

৭। M. Ramioul and B. De Vroom, Global Value Chain Restructuring and the Use of Knowledge and Skills, WORKS Project, Higher Institute of Labor Studies, K. U. Leuven (Leuven: HIVA, 2009).

৮।P. Meil, P. Tengblad, and P. Docherty, Value Chain Restructuring and Industrial Relations: The Role of

Workplace Representation in Changing Conditions of Employment and Work, WORKS Project, Higher Institute of Labor Studies, K.U. Leuven (Leuven: HIVA, 2009), 65, 69.

৯।S. Dahlmann, Organizational Case Study on IT Service Providers in Public Administration—UK, internal working paper, WORKS Project, 2007; S. Dahlmann (2008), “The End of the Road: No More Walking in Dead Men’s Shoes,” Work Organization, Labor and Globalization 2/2 (2008): 148–61.

১০। H. Braverman, Labor and Monopoly Capital (New York: Monthly Review Press, 1974), 85–121.

১১। F. W. Taylor, The Principles of Scientific Management (New York: W. W. Norton, 1911), পাওয়া যাবে এখানে https://www.marxists.org/reference/subject/economics/taylor/principles/index.htm.

১২। Braverman, Labor and Monopoly Capital, 124–37.

১৩। M. Hales, Living Think Work: Where Do Labor Processes Come From? (London: CSE Books, 1980).

১৪। Karl Marx, Grundrisse (Harmondsworth: Penguin, 1973), available at

http://www.marxists.org/archive/marx/works/1857/grundrisse/ch12.htm#p610.

১৫। দেখুন S. Sayers, “Creative Activity and Alienation in Hegel and Marx,” Historical Materialism 11/1: 107–28.

১৬। M. Muchnik, Dress Designers or Fashion Artists? Occupational Case Study on Designers in Clothing in France, WORKS Project working document, Fondation Travail Universitaire, University of Namur, May 2007.

১৭। G. Valenduc, P. Vendramin, M. Pedaci, and M. Piersanti, Changing Careers and Trajectories: How

Individuals Cope with Organizational Change and Restructuring, WORKS Project, Higher Institute of Labor Studies, K. U. Leuven (Leuven: HIVA, 2009), 36.

১৮। Krings et al., Working Time, Gender, Work-Life Balance, 85.

১৯। Ramioul and De Vroom, Global Value Chain Restructuring and the Use of Knowledge and Skills, 85.

২০। আইটি শিল্পে গবেষণা ও উন্নয়নের ওপর ‘পেশাগত কেস স্টাডিজ’-এর জন্য, নরওয়ে, অস্ট্রিয়া, জার্মানি এবং ফ্রান্সে ৪টি কেসস্টাডি করা হয়েছিল, প্রতিটিতে ৭-১০টি সাক্ষাত্কার নেওয়া হয়েছিল। এই ‘সাংগঠনিক কেসস্টাডি’গুলো শিল্পে মূল্যশৃঙ্খল পুনর্গঠনের কেসস্টাডিগুলোর পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে।

২১। Flecker et al., Restructuring Across Value Chains and Changes in Work and Employment, 24.

২২। Krings et al., Working Time, Gender, Work-Life Balance, 30.

২৩। ফ্যাশন ডিজাইনারদের ‘পেশাগত কেসস্টাডি’র জন্য, ফ্রান্স, জার্মানি এবং পর্তুগালের ৯টি ফার্মের ২২ জন ডিজাইনারের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল, যাদের মধ্যে ১৭ জন নারী ও ৫ জন পুরুষ। বয়স ছিল ২৭-৫৩ বছরের মধ্যে।

২৪। G. Valenduc, P. Vendramin, B.-J. Krings, and L. Nierling, Occupational Case Studies: Synthesis Report and Comparative Analysis, WORKS Project, Higher Institute of Labor Studies, K.U. Leuven (Leuven: HIVA, 2007), 41.

২৫। Ramioul and De Vroom, Global Value Chain Restructuring and the Use of Knowledge and Skills, 45.

২৬। Valenduc et al., Occupational Case Studies: Synthesis Report and Comparative Analysis, 86.

২৭। পূর্বোক্ত, ৮৬

২৮। M. Ramioul and U. Huws, “The Snowball Effect: Global Sourcing as an Accelerator of Economic

Globalization,” Journal of Architectural and Planning Research 26/4 (2009): 327–42.

২৯। J. Flecker, U. Holtgrewe, A. Schönauer, and S. Gavroglou, Value Chain Restructuring and Company Strategies

to Reach Flexibility, WORKS Project, Higher Institute of Labor Studies, K.U. Leuven (Leuven: HIVA, 2009).

৩০। এখানে এ তালিকা দেওয়া ছাড়া আর বেশি কিছু বলার জায়গা হবে না। আরও জানতে আগ্রহী পাঠক প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বেশ কিছু নিবন্ধ খুঁজে পেতে পারেন Work Organization, Labor and Globalization যা অনলাইনে পাওয়া যাবে এই ঠিকানায় http://analytica.metapress.com.

৩১। U. Huws, S. Dahlmann, J. Flecker, U. Holtgrewe, A. Schönauer, M. Ramioul, and K. Geurts, Value Chain Restructuring in Europe in a Global Economy, Higher Institute of Labor Studies, K.U. Leuven (Leuven: HIVA, 2009).

৩২। A. K. Damarin, “The Network-Organized Labor Process: Control and Autonomy in Web Production Work,” paper presented at the International Labor Process Conference, Rutgers University, New Brunswick, NJ, March 2010, 1.

৩৩। P. B. Doeringer and M. J. Piore, Internal Labor Markets and Manpower Analysis (Lexington, MA: D.C. Heath and Company, 1971).

৩৪। H. Braverman, Labor and Monopoly Capital (New York: Monthly Review Press, 1974).

৩৫। M. Burawoy, Manufacturing Consent (Chicago: University of Chicago Press, 1979).

৩৬। M. Cooley, Architect or Bee? (Boston: South End Press, 1999).

৩৭। H. Beynon, Working for Ford (Wakefield, UK: E. P. Publishing, 1975).

৩৮। L. Schumaker, “Immaterial Fordism: The Paradox of Game Industry Labor,” Work Organization, Labor and Globalization 1/1 (2006): 144–55.

৩৯। দেখুন C. Leys, Market-Driven Politics: Neoliberal Democracy and the Public Interest (London: Verso, 2003); এবং U. Huws, “The New Gold Rush: The New Multinationals and the Commodification of Public Sector Work,” Work Organization, Labor and Globalization 2/2 (2008).

৪০। Damarin, “The Network-Organized Labor Process.”

৪১। J. Lave and E. Wenger, Situated Learning: Legitimate Peripheral Participation (Cambridge: Cambridge University Press, 1991).

৪২। “Planning for the Sequel: How Pixar’s Leaders Want to Make Their Creative Powerhouse Outlast Them,” The Economist, June 17, 2010.

৪৩। দেখুন A. F. Steinko, “Rethinking Progressive and Conservative Values: Spain’s New Economy Workers and Their Values,” Work Organization, Labor and Globalization 1/1 (2006).

৪৪। কিন্তু আরও ইতিবাচক প্রমাণের জন্য দেখুন Mosco and McKercher, “Getting the Message: Communications Workers in Global Value Chains,” Work Organization, Labor and Globalization 4/2 (2010)

৪৫। U. Huws, “Defragmenting: Towards a Critical Understanding of the New Global Division of Labor,” Work Organization, Labor and Globalization 1/2 (2007).

৪৬। Ramioul and De Vroom, Global Value Chain Restructuring and the Use of Knowledge and Skills.

৪৭। P. D’Cruz and E. Noronha, “Experiencing Depersonalized Bullying: A Study of Indian Call-Centre Agents,”

Work Organization, Labor and Globalization 3/1(2009): 24–46.

৪৮। P. Bramming, O. Sørensen, and P. Hasle, “In Spite of Everything: Professionalism as Mass Customized Bureaucratic Production in a Danish Government Call Centre,” Work Organization, Labor and Globalization 3/1 (2009): 114–30.

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •