আফগানিস্তান : বিশ্ব সন্ত্রাসের ‘নতুন’ যাত্রা-২

পুনপ্রকাশ

আফগানিস্তান : বিশ্ব সন্ত্রাসের ‘নতুন’ যাত্রা-২

আনু মুহাম্মদ

২০০১ সালে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামে আগ্রাসনের নতুন পর্ব শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। যে তালিবানদের তারা ক্ষমতায় বসিয়েছিল তাদের উচ্ছেদ করে সেবছর আফগানিস্তান দখলে নেয়, তারপর ২০০৩ সালে দখল করে ইরাক।  ২০ বছর পর খুব সহজেই তালিবানরা আবারও দখলে নিয়েছে আফগানিস্তান, তবে সমঝোতার মাধ্যমে। গত কয় বছরে তালিবানদের সাথে নানারকম সমঝোতা আলোচনা হচ্ছিলো মার্কিন প্রশাসনের। ট্রাম্প আমলে শুরু, তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব এসব বিষয় পরিচালনা করেছেন, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুপক্ষের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তার আগে বর্তমান তালেবান নেতা বারদারকে পাকিস্তান জেল থেকে মুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্রই। অর্থাৎ বাইডেন আমলে এসে তালিবানদের হাতে ছেড়ে দিয়ে তাদের আফগানিস্তান ত্যাগ একটি পূর্ব সিদ্ধান্তেরই বাস্তবায়ন। এখন এই দেশে নতুন ব্যবসার জন্য মার্কিন, চীন, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত ও পাকিস্তান তাকিয়ে আছে তালিবানেরই দিকে। এই পর্যায়ে ইতিহাসের দিকে আবারও দৃষ্টি দেয়া দরকার। এই পরিপ্রেক্ষিতে আফগানিস্তান দখলের পরপর লেখা এবং ২০০৩ সালে ত্রৈমাসিক পত্রিকা নতুন পাঠ-এ প্রকাশিত এই প্রবন্ধ এখানে পুনপ্রকাশ করা হলো। এই প্রবন্ধে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে আফগানিস্তান সংকট অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রাসঙ্গিকভাবে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার সন্ত্রাসী গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এবারে দ্বিতীয় পর্ব… 

ওসামা বিন লাদেন : ব্যক্তি থেকে মুখপাত্র

ওসামা বিন লাদেন আফগান নাগরিক নন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ-ধ্বংস-হত্যা উন্মাদনায় আফগানিস্তান যখন ক্ষতবিক্ষত তখন তার কেন্দ্রে যার নাম সবচাইতে বেশি উচ্চারিত তিনি ওসামা বিন লাদেন।২০ ওসামা এবং আফগানিস্তান যখন যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত, যখন মাসের পর মাস ধরে একটি দুর্বল বিধ্বস্ত দেশ এবং একজন ব্যক্তি বিশ্বের সকল ক্ষমতাধর দেশ, সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, প্রচার মাধ্যম, সংবাদ সংস্থা, প্রকাশনা সংস্থা, গবেষণা সংস্থার আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে থাকে তখন রাতারাতি তা নিজের থেকে অনেক বড় হয়ে উঠে, অতিকায় হয়ে উঠে। সেজন্য এ বিষয়ে আলোকপাত দরকার।

ওসামা বিন লাদেন এর পুরো নাম ওসামা বিন মুহাম্মদ বিন আওয়াল বিন লাদেন। তাঁর জন্ম ১৯৫৭ সালে, রিয়াদে। মা সিরীয়, মতান্তরে সৌদি। বাবা ইয়েমেন থেকে সৌদি আরবে এসে সবচাইতে ধনী ও রাজপরিবারের সবচাইতে ঘনিষ্ঠ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের মালিকে পরিণত হয়েছেন। ওসামা বাবার ৫৭ জন সন্তানের ৭ম বা ১৭তম। বাবার বিভিন্ন দেশীয় স্ত্রীর বিভিন্ন সন্তানেরা ভিন্ন ভিন্ন দেশের নামের ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে পরিচিত হয়ে থাকে। 

১৯৭৯ পর্যন্ত ওসামার জীবন আরব বিশ্বের ধনিক পরিবারের গড়পড়তা সন্তানদের মতোই কাটে। কিছুটা ব্যতিক্রম, সবচাইতে ব্যয়বহুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগের তিনি অপচয় করেননি, কাজে লাগিয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে তিনি বাদশা আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন। এই সময়ই আফগানিস্তানে মুজাহেদিনদের সোভিয়েত বিরোধী লড়াই শুরু হয়। 

পরের বছর তিনি আফগানিস্তান যান। ১৯৮৪ পর্যন্ত তিনি একাধিকবার পাকিস্তান বা আফগানিস্তান গেছেন কিন্তু সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেননি। তবে সে সময় তহবিল, অস্ত্র সংগ্রহে তিনি বেশ সক্রিয় ভূমিকা নেন। সৌদি ধনকুবের পরিবারের একজন সদস্য যখন আগ্রহ নিয়ে যাচ্ছেন তখন দরিদ্র আফগান মজুর সৈনিকদের মধ্যে তা বিপুল উৎসাহ তৈরি করে এবং আফগানদের গড় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে তাঁরা ওসামার জন্য নিজেদের মধ্যে স্থায়ী কৃতজ্ঞতার আসনও তৈরি করেছেন। কিন্তু আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে, মুজাহেদিনদের সোভিয়েত বিরোধী লড়াই আসলে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে, সিআইএ এর সঙ্গে তাদের স্থানীয় প্রতিনিধি পাকিস্তানের আইএসআই এর সঙ্গে ওসামার কি ধরনের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোন কিছু জানা যায় না। তবে কোন কোন সূত্র বলে যে, মার্কিন উচ্চতর প্রশাসনের সঙ্গে ওসামার যোগাযোগ ছিল।

ওসামা যুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা নেন সোভিয়েত বিরোধী আফগান যুদ্ধের শেষ ভাগে। বিভিন্ন স্থান থেকে বিশেষত আরব বিশ্ব থেকে আগত যোদ্ধাদের সমন্বয় সাধনের জন্য ১৯৮৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘আল কায়েদা’। ১৯৮৯ সালে তিনি দেশে ফেরেন এবং সৌদি রাজতন্ত্রের সঙ্গে ক্রমে তার বৈরিতা সৃষ্টি হয়। এই বৈরিতা স্পষ্ট আকার নেয় যখন সৌদি রাজতন্ত্র মার্কিন বাহিনীকে সেখানে আমন্ত্রণ জানায়। সৌদি রাজতন্ত্র এমনিতে বরাবরই রাজতন্ত্র বিরোধী বিক্ষোভের সম্ভাবনায় আতঙ্কিত থাকে। প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান হওয়ায় ওসামার মনোভাব তাদেরকে সতর্ক করে তোলে। সেজন্য রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ওসামার বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় তাঁকে এক প্রকার গৃহবন্দি করে রাখা হয়। এর থেকে মুক্তি পাবার জন্য ব্যবসার নাম করে ভাইয়ের সাহায্যে তিনি দেশত্যাগ করেন এবং সুদানে অবস্থান গ্রহণ করেন। আফগানিস্তানে পুরনো যোগাযোগ রক্ষা করতে থাকেন এবং সুদানে এসময় তিনি নির্মাণ ব্যবসাতেও অংশ নেন। সৌদি রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ও আরব বিশ্ব থেকে মার্কিন বাহিনী বিতাড়নের পক্ষে ওসামা তার অবস্থান জানালেও এ সম্পর্কে সংগঠিত চিন্তা বা কর্মসূচির কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।

৯০ দশকের প্রথমার্ধের মধ্যে বিশেষত ইরাক, লিবিয়া, প্যালেস্টাইনে মার্কিনি ভূমিকায় বিক্ষুব্ধ বহু তরুণ জঙ্গী গ্রুপ গড়ে উঠে যেগুলোর কোন কোনটি মার্কিনি পৃষ্ঠপোষকতায় ৭০ ও ৮০ দশকে সোভিয়েত বিরোধী হিসাবে গড়ে তোলা কাঠামো থেকেই জন্ম নেয়া। এর ফলে ৭০/৮০ দশকে সিআইএ অর্থায়নে নির্মিত অবকাঠামো প্রশিক্ষণও এসব গ্রুপের কাজে লাগে। ৯০ দশকের মাঝামাঝির পর থেকে বিভিন্ন দেশে-কেনিয়া, তানজানিয়া, সোমালিয়া, সৌদি আরবে মার্কিনি বাহিনীর উপর আক্রমণ হয়। এসব আক্রমণ কোনো সংগঠিত নেটওয়ার্ক থেকে হয়েছে নাকি বিচ্ছিন্ন জঙ্গী গ্রুপ থেকে হয়েছে নাকি অন্য কোন বিষয় এর পেছনে আছে তা এখনও পরিষ্কার হয়নি। অভিযোগ আছে, এসব নিয়ে তদন্তে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনই আন্তর্জাতিক কোন উদ্যোগে সহায়তা করেনি। ওসামা বিন লাদেন এগুলোর সঙ্গে জড়িত এর কোন প্রমাণ তখনও ছিল না, পরেও প্রকাশিত হয়নি। তবে ওসামা বিভিন্ন বক্তব্যে এসব আক্রমণে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

সৌদি রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করার কারণে আটক, নির্যাতন, গুম খুন, প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ডের অনেক নজির সৌদি আরবে আছে। এসব ঘটনার যারা শিকার হন, যারা সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চেষ্টা করেন তারা কখনও পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহের সহায়তা পাননি-খুবই সংগঠিতভাবে প্রচার মাধ্যম থেকে এসব ঘটনা আড়াল করা হয়ে থাকে। কেউ কেউ পশ্চিমে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন এবং পরে আর তাঁদের খোঁজ পাওয়া যায়নি এরকম ঘটনাও আছে অনেক। ব্রিটেনেই কয়েক বছর আগে এরকম একটি ঘটনা ঘটেছে। সৌদি রাজতন্ত্রের প্রতি “মুক্ত বিশ্বের” “গণতান্ত্রিক” দেশসমূহের এই উদার আচরণ খুব বিস্ময়কর নয়। বহু স্বৈরতন্ত্রী শাসকই এই পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে পশ্চিম থেকে। মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু ইত্যাদি এখানে কোন নির্ধারক বিষয় নয়।

সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ওসামার অবস্থানে রাজ শাসকেরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এই কারণে যে, আফগানিস্তানে যুদ্ধে প্রত্যক্ষ পরোক্ষ ভূমিকা নেবার মাধ্যমে তার একটি আন্তর্জাতিক সমর্থক গোষ্ঠী ও প্রভাব তৈরি হয়েছিল যা সৌদি রাজতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে বলে তাদের আশংকা হচ্ছিল। ওসামা-র সৌদি নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয় ১৯৯৪ সালে। আফগানিস্তানে অবস্থানকালে তাঁর উপর একাধিকবার হামলার পরিকল্পনা করা হয়। তাঁর উপর গুপ্ত হামলায় সিআইএ এবং পাকিস্তানি আইএসআই সৌদি রাজতন্ত্রের সহযোগী হিসেবে উদ্যোগী ভূমিকা নেয়। ওসামা-কে কোণঠাসা করবার চেষ্টায় বিভিন্ন “সন্ত্রাসবাদী” তৎপরতার সঙ্গে তার নাম জড়ানোতে প্রধান উদ্যোগী ভূমিকা নেয় সৌদি গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকারি প্রচার মাধ্যম। 

১৯৯৬ সালে ওসামা বিন লাদেন সৌদি রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ এবং সৌদি আরব থেকে মার্কিন বাহিনীর বহিষ্কারের পক্ষে ‘জেহাদ’ এর ডাক দেন। ১৯৯৮ সালে তিনি আরও ১১টি ইসলামী গ্রুপের সঙ্গে মিলে ‘ওয়ার্ল্ড ইসলামিক ফ্রন্ট’ গঠনের ঘোষণা দেন।  আফগানিস্তানে মুজাহেদিন ও তালিবানদের মধ্যেকার লড়াই-এ ওসামা বস্তুত কারও পক্ষ নেননি। ৮০ দশকের ভূমিকার কারণে দু’পক্ষের নেতৃবৃন্দেরই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ ছিল। ১৯৯৬ এর পর নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে তিনি তালিবান অধিকৃত আফগানিস্তানে যান এবং সেখানে আশ্রয় পান। আফগান সংস্কৃতিতে অতিথি, কৃতজ্ঞতা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা ইত্যাদির গুরুত্ব অনেক বেশি। কাজেই সিআইএ-আইএসআই পৃষ্ঠপোষকতায় অধিষ্ঠিত সরকার হলেও তালেবানদের কাছে ওসামা বিন লাদেন আশ্রয় পান খুবই নির্ভরতার সঙ্গে। ওসামার প্রতি যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সরাসরি বৈরিতার কোন লক্ষণ এসময় দেখা যায়নি। তবে প্রচার মাধ্যমে তাঁর নাম জড়িয়ে “সন্ত্রাসের” খবরাখবর ও জল্পনাকল্পনা প্রকাশিত হওয়া ছিল রুটিন বিষয়। 

আসলে সৌদি রাজতন্ত্রের বিরোধিতার মধ্য দিয়েই সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং বৃহৎ ধনকুবের পরিবারের সদস্য ওসামা গতানুগতিক জীবন থেকে ভিন্ন দিকে যাত্রা শুরু করেন। তাঁর এই রাজতন্ত্র বিরোধিতা পশ্চিমীদের সমর্থন পায়নি আবার তার যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ভূমিকার বিরোধিতা সৌদি রাজতন্ত্রের সমর্থন পায়নি। এক পর্যায়ে ওসামার সক্রিয়তা এবং বিশ্বব্যাপী মার্কিন বিরোধী বিভিন্ন ইসলামী জঙ্গী গ্রুপের আবির্ভাব ওসামার বিরুদ্ধে সৌদি-মার্কিন ঐক্যকে সক্রিয় করেছে-পেছনে বরাবরের মতো যুক্ত থেকেছে পাকিস্তান। ওসামা বিন লাদেন ক্রমান্বয়ে সৌদি-যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কারণেই ইসলামী জঙ্গী সমষ্টির মুখপাত্রে পরিণত হয়েছেন।

আফগানিস্তানে তালিবানদের সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বহুজাতিক সংস্থা ও প্রশাসনের দিক থেকে মার্কিনি পৃষ্ঠপোষকতা, সমর্থন ও আগ্রহের পেছনে দুটি কারণ ছিল: প্রথমত তাদের ধারণা অনুযায়ী মধ্য এশিয়ার তেল সম্পদ পাইপলাইনে আফগানিস্তানের উপর দিয়ে নিয়ে আসা এবং আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদের লাভজনক দখল সম্ভব করবার জন্য তালিবানরা একটি স্থিতিশীল সরকার উপহার দিতে সক্ষম এবং দ্বিতীয়ত তাদের ধারণা অনুযায়ী তালিবানদের কাছ থেকে যে কোন শর্তে কাজ আদায় করে নেয়া সম্ভব। 

প্রথম কয়েক বছরে দু’ক্ষেত্রেই অনুকূল পরিবেশ ছিল এবং সে অনুযায়ী ১৯৯৮ পর্যন্ত মার্কিনি বহুজাতিক কোম্পানি ইউনোক্যাল অনেকগুলো প্রকল্পে হাত দেয়। তালিবান মন্ত্রীরা যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। কিছু চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু এই অনুকূল অবস্থায় ভাঙন আসে বিভিন্ন দিক থেকে। সেগুলোকে সারসংক্ষেপ করা যায় নিম্নরূপে :

১. তালিবান বিরোধী মুজাহেদিনদের লড়াই অব্যাহত থাকায় সমগ্র আফগানিস্তানে স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা খর্ব হতে থাকে।

২. অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তালিবান সরকারের নীতি বিশেষত সমাজের সকল ক্ষেত্র থেকে শিশু-তরুণী-বৃদ্ধ নারীকে হঠিয়ে ঘরে বন্দি করার কঠোর ব্যবস্থা প্রবাসী আফগানসহ বিশ্বব্যাপী বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বিশেষত এই সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতা পশ্চিমের নারী সংগঠনসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল ব্যক্তি ও সংগঠনের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে।

৩. প্রাচীন ভাস্কর্য শিল্পকলার বিরুদ্ধে তালিবানদের অবস্থান বিশেষত বিশাল ঐতিহ্য বামিয়ান মূর্তি আনুষ্ঠানিকভাবে ভাঙার পর এই সরকারের উপর ভর অব্যাহত রাখা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সরকারগুলোর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।

৪.  পাকিস্তান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ভিন্ন আর কোন দেশ এমনকি মুসলিম দেশগুলোও তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে তালিবানদের গ্রহণযোগ্যতা দেখানো কঠিন হয়ে উঠে।  

৫. ইউনোক্যাল তালিবানদের সঙ্গে তেল, গ্যাস উত্তোলন এবং পাইপলাইন বিষয়ে যেসব চুক্তি করেছিল, যেসব প্রকল্প দাঁড় করাতে যাচ্ছিলো সেগুলো তাদের জন্য খুবই লাভজনক ছিল। এটা সম্ভব হচ্ছিল এসব বিষয়ে তালিবানদের অনভিজ্ঞতার কারণে। বিভিন্ন দলিল দস্তাবেজ থেকে ধারণা করা যায় যে, ওসামা তার আশ্রয়দাতাদের স্বার্থে এসব চুক্তি ও প্রকল্প নিয়ে যে বিশেষজ্ঞ ভূমিকা গ্রহণ শুরু করেন তা মার্কিনি কোম্পানিকে বিরক্ত ও পরে ক্রুদ্ধ করতে থাকে। এক পর্যায়ে মার্কিন প্রশাসন ওসামাকে সরাসরি এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক স্বার্থের ক্ষেত্রে একটি প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে। পেশাগত দক্ষতা, প্রশিক্ষণ, পারিবারিক বৃহৎ ব্যবসার অভিজ্ঞতার ফলে ওসামার পক্ষে অনেক চুক্তি বা প্রকল্পের ফাঁক-ফোকর, প্রতারণা ধরা সম্ভব ছিল যা তালিবানদের ছিল না।  

মার্কিনি কোম্পানি চাপ সৃষ্টির জন্য তালিবানদের ‘নির্যাতক’ ‘মানবাধিকার লংঘন’ ইস্যুগুলো সামনে আনতে থাকে। ওসামা বিন লাদেনকে ‘জীবিত বা মৃত’ ধরবার ঘোষণা বুশের মুখে ১১ সেপ্টেম্বরের পরে শোনা গেলেও এটি দশ বছর আগে থেকে সৌদি রাজতন্ত্রের কথা এবং গত দু/তিন বছর থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন কর্মসূচি। সুতরাং ১১ সেপ্টেম্বরের বেশ আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সামনে দুটো করণীয় জরুরি হয়ে উঠে। প্রথমত, আফগানিস্তানে নতুন ‘গ্রহণযোগ্য’ ‘স্থিতিশীল’ সরকার প্রতিষ্ঠা এবং দ্বিতীয়ত, ওসামা বিন লাদেনকে নিধন। 

অর্থনৈতিক মন্দা ও যুদ্ধের দাবি

অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির নিয়মে, বিশেষত পুঁজিবাদী অর্থনীতির চক্রাকার দাবি পূরণের জন্য আরেকটি কাজ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অবশ্যকরণীয় হয়ে উঠে ২০০০ সালের শেষ থেকেই- সেটি হলো যুদ্ধ। মার্কিন অর্থনীতিই যে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি বড় ধরনের যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাবে তা ২০০১ সালের প্রথমদিকেই বোঝা যাচ্ছিলো।২১  এটা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা জোরদার হয়ে উঠে যখন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন যুদ্ধবাজদের দখলে আসে। বুশের নেতৃত্বে এই যুদ্ধবাজ প্রশাসন যথাযথ নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসেনি-যুক্তরাষ্ট্রের তেল কোম্পানি, পেন্টাগন এবং অন্যান্য বড় মালিকদের সহায়তায় জোরপূর্বক ক্ষমতায় এসেছে।

১১ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার গুঁড়িয়ে না গেলেও তাই দুটো ঘটনা ঘটতোই, আরও ঠিক হবে বললে যে, দুটো ঘটনা ঘটছিলই সেগুলো হল : ১. মার্কিন অর্থনীতি ও সেই সূত্রে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা এবং ২. যুক্তরাষ্ট্রের বর্ধিত আকারে যুদ্ধ-আগ্রাসন। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর জগতের যাবতীয় ঘটনাবলিকে ঐ দিনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেবার একটা “পন্ডিতি” প্রবণতা প্রচার মাধ্যম ও তথাকথিত “বিশেষজ্ঞ”দের মধ্যে আছে। কিন্তু ঘটনাটা উল্টো করে দেখলে বরঞ্চ দেখা যায়-যাকে দেখানো হচ্ছে কারণ আসলে সেটাই ফল, যাকে বলা হচ্ছে ফল সেটাই কারণ।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের প্রায় বছরখানেক আগেই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে মন্দার আওয়াজ জোরদার হতে থাকে। এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পাওয়া যায় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের চেয়ারম্যান এ্যালেন গ্রিন্সপ্যানের কাছ থেকে, সে বছরই নভেম্বর মাসে। ২০০১ সালের শুরু থেকে বিশ্বের অর্থনীতি বিষয়ক প্রধান পত্রিকাগুলোতে যেমন ইকনমিস্ট, ফিনান্সিয়াল টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকায় ক্রমাগত এই মন্দা বিষয়ে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, প্রকাশিত হয়েছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।২২

মন্দার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য গতানুগতিক অস্ত্রপ্রয়োগ তখন থেকেই শুরু হয়, যার প্রধান হলো সুদের হার হ্রাস। এক বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার হ্রাস করা হয়েছে ১১ বার। ২০০২ সালের শুরুতে সেখানে সুদের হার ৪০ বছরের ইতিহাসে নিম্নতম পর্যায়ে পৌঁছায়।২৩ এর আগে থেকেই, বিশেষত আগের দু’বছরে যুক্তরাষ্ট্রসহ পুঁজিবাদী বিশ্বের কেন্দ্রীয় অর্থনীতিতে বৃহৎ সংস্থাগুলোর মধ্যে মুনাফার হার ঠিক রাখার তাগিদে মার্জার ও ইকুইজিশনের (সম্মিলন ও অঙ্গীভবন) প্রবণতা বাড়ে। বড় বড় শিল্প ও ব্যবসায়িক সংস্থার নাজুক অবস্থা সামাল দিতে সেসব রাষ্ট্র এগিয়ে আসে। জনগণের করের পয়সায় যথারীতি বড় আকারে শুরু হয় বৃহৎ সংস্থাগুলোকে ভর্তুকি দান। ১৯৯৭ সালে এশীয় অর্থকরী সংকটের পর থেকেই এসব চর্চা বাড়তে থেকে। ‘পণ্ডিতরা’ বলতে থাকেন বিশ্ব অর্থনীতিতে নয়া খাতই এখন প্রবৃদ্ধির রাস্তা চেনাবে সেটি হলো আইটি সেক্টর : কম্পিউটর, ই-কমার্স, ইন্টারনেট ইত্যাদি। পুরনো খাতগুলোতে ধস নামলেও এগুলোতে নামবে না। কিন্তু ২০০১ সালে এসে সেই জায়গাও মিথ্যা প্রমাণিত হলো, ধ্বস নামল এখানেও। শুধু তাই নয় ১৯২৯/৩০ এরপর এইসময়েই প্রথম যুক্তরাষ্ট্র-জাপান-ইউরোপ তিন অঞ্চলে একইসঙ্গে মন্দার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

১১ সেপ্টেম্বর এই সাধারণ গতির মধ্যে একদিকে নতুন গতি যেমন আনলো তেমন মার্কিন প্রশাসনকে তার ‘প্রয়োজন অনুযায়ী’ দাঁড়ানোর জায়গাও করে দিল। ঐক্যবদ্ধ সুরে যেন জয়গান শুরু হলো : ‘১১ সেপ্টেম্বরের কারণে সকল মন্দা শুরু হয়েছে।’ এতদিনের খবরাখবর, বিশ্লেষণ, আশংকা, ছাঁটাই, লেঅফ, ভতুর্কি, মার্জার, নানারকম আয়োজন বেমালুম ভুলে গিয়ে সবাই আবিষ্কার করলো ১১ সেপ্টেম্বর থেকেই সবকিছুর শুরু, এখানেই সবকিছুর শেষ। সুতরাং অর্থনীতির মন্দার জন্য দায়ী পুঁজিবাদ নয়, দায়ী একজন ব্যক্তির উন্মাদনা এবং সেই ব্যক্তির নাম ওসামা বিন লাদেন। সুতরাং উন্মাদ হয়ে উঠলো সকল প্রচার মাধ্যম আর পণ্ডিতেরা। বিরাট স্বস্তিও বটে!

এই সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে অনেকরকম গল্প মার্কিন সমাজ থেকে জন্ম নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রচারিত ছিল-সেগুলোর  সারকথা হলো : ‘বুশ ভোটচোর’, ‘বুশ গর্দভ’, ‘বুশ গবেট’ ইত্যাদি। ১১ সেপ্টেম্বরের পর এসব গল্পের প্রচার অনেক কমে যায়। ‘জাতীয়’ ঐক্যের ডাক আসে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে’। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের অন্যতম সন্ত্রাসী প্রেসিডেন্ট বুশের সুযোগ্য পুত্র, সন্ত্রাসী আওয়াজ দিয়েই যার আগমন, সেই জুনিয়র বুশ ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের মহানায়ক’ হিসেবে চিত্রিত হতে থাকলেন।

এর মধ্যেই একদিন, ২০০১ সালের ৯ অক্টোবর দেখলাম, কানাডার প্রধান জাতীয় দৈনিক গ্লোবাল এ্যান্ড মেইল-এ মার্কিন নির্বাচন ফলাফল তদন্ত নিয়ে ছোট্ট একটি সংবাদ। ‘বুশ-গোর নির্বাচন নিয়ে যখন হট্টগোল, বিবাদ, বিচার, পুনরায় গণনা ইত্যাদি বাস্তব নাটক দৃশ্য তৈরি হচ্ছিলো তখন বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার সংগঠন থেকে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল প্রকৃত তথ্য অনুসন্ধান করে রিপোর্ট দিতে। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে প্রকৃতপক্ষে বুশ পরাজিত হয়েছিলেন। এই রিপোর্ট পাবার পর সংবাদ সংস্থার সংগঠন ‘বাস্তব পরিস্থিতির কারণে’ এই রিপোর্ট প্রকাশ না করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ এই সংবাদটিও আর কোথাও পরে দেখা গেল না। পরাজিতের তখন বিরাট দাপট ও সাফল্য! 

পুঁজিবাদের মধ্যে কমবেশি এটা একটা অব্যাহত প্রক্রিয়া হলেও ২০০০ এর মাঝামাঝি থেকেই ছাঁটাই বৃদ্ধি পায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থার (এএফএল-সিআইও) হিসাব অনুযায়ী জুলাই ২০০০ থেকে আগস্ট ২০০১ পর্যন্ত ১০ লাখেরও বেশি শ্রমিক  ছাঁটাই হয়। এরপর ১১ সেপ্টেম্বর থেকে দু’মাসে ছাঁটাই হয় প্রায় ৬ লাখ। ১১ সেপ্টেম্বরের পর হোটেল রেস্তোঁরা, পরিবহণ, শিল্পখাত, খুচরা ব্যবসা সর্বত্রই ছাঁটাই বৃদ্ধি পায়। অর্থনৈতিক সংকট, ছাঁটাই সবগুলোকেই দেখানো হতে থাকে ১১ সেপ্টেম্বরের ফল হিসেবে।২৪

পুঁজিবাদের মধ্যে কমবেশি এটা একটা অব্যাহত প্রক্রিয়া হলেও ২০০০ এর মাঝামাঝি থেকেই ছাঁটাই বৃদ্ধি পায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থার (এএফএল-সিআইও) হিসাব অনুযায়ী জুলাই ২০০০ থেকে আগস্ট ২০০১ পর্যন্ত ১০ লাখেরও বেশি শ্রমিক  ছাঁটাই হয়। এরপর ১১ সেপ্টেম্বর থেকে দু’মাসে ছাঁটাই হয় প্রায় ৬ লাখ। ১১ সেপ্টেম্বরের পর হোটেল রেস্তোঁরা, পরিবহণ, শিল্পখাত, খুচরা ব্যবসা সর্বত্রই ছাঁটাই বৃদ্ধি পায়। অর্থনৈতিক সংকট, ছাঁটাই সবগুলোকেই দেখানো হতে থাকে ১১ সেপ্টেম্বরের ফল হিসেবে।

আগের ছাঁটাই প্রবণতা দেখলে যে কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে না যে, সংখ্যা হেরফের হলেও এই ছাঁটাই কমবেশি ঘটতোই। ১১ সেপ্টেম্বরের ‘সন্ত্রাসী হামলা’য় যারা নিহত হয়েছেন, চাকুরিচ্যুত হয়েছেন, পরবর্তীকালে কর্মসংস্থান কমে যাওয়ায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁরা প্রধানত কম আয়ের মানুষ, ইমিগ্র্যান্ট, নারী, অশ্বেতাঙ্গ। কিন্তু একই ঘটনার সূত্র ধরে লাভবানও হয়েছে কেউ কেউ। তারা কারা?

‘সন্ত্রাসী হামলা’র ক্ষতিপূরণের জন্য ঘটনার পর পরই ৬০০০ কোটি মার্কিন ডলারের একটি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। এবং এর খরচ হয় ভর্তুকি, লোন গ্যারান্টি ও  সমরাস্ত্র ক্রয়ে। এছাড়া ট্যাক্স মওকুফ করা হয় একই ঘটনার অজুহাতে। বৃহৎ যেসব সংস্থা এসব মওকুফ লাভ করে সেগুলো হলো : আইবিএম : ১৪০ কোটি মার্কিন ডলার, জেনারেল মটরস : ৮৩ কোটি মার্কিন ডলার, জেনারেল ইলেকট্রিক : ৬৭ কোটি মার্কিন ডলার, শেভরন/টেক্সাকো (যেটি বাংলাদেশে গ্যাস ব্লক দখলের ইজারা পেয়েছে) : ৫৭ কোটি মার্কিন ডলার, এনরন (আরেকটি তেল কোম্পানি যেটি বুশ এর নির্বাচনী তহবিল যুগিয়ে বহু সুবিধা নিয়েছে কিন্তু এখন তারপরও প্রায় দেউলিয়া) : ২৫ কোটি মার্কিন ডলার। বেশ বড় অংকের টাকা। পুরোটাই বস্তুত গেল জনগণের জন্য বিভিন্ন বরাদ্দ বাতিল করে। একই সময় প্রশাসন গৃহায়নের ৮০ কোটি মার্কিন ডলারের একটি কর্মসূচি স্থগিত রাখলো টাকার অভাবে।২৫

‘সন্ত্রাসী হামলা’র ক্ষতিপূরণের জন্য ঘটনার পর পরই ৬০০০ কোটি মার্কিন ডলারের একটি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। এবং এর খরচ হয় ভর্তুকি, লোন গ্যারান্টি ও  সমরাস্ত্র ক্রয়ে। এছাড়া ট্যাক্স মওকুফ করা হয় একই ঘটনার অজুহাতে। বৃহৎ যেসব সংস্থা এসব মওকুফ লাভ করে সেগুলো হলো : আইবিএম : ১৪০ কোটি মার্কিন ডলার, জেনারেল মটরস : ৮৩ কোটি মার্কিন ডলার, জেনারেল ইলেকট্রিক : ৬৭ কোটি মার্কিন ডলার, শেভরন/টেক্সাকো (যেটি বাংলাদেশে গ্যাস ব্লক দখলের ইজারা পেয়েছে) : ৫৭ কোটি মার্কিন ডলার, এনরন (আরেকটি তেল কোম্পানি যেটি বুশ এর নির্বাচনী তহবিল যুগিয়ে বহু সুবিধা নিয়েছে কিন্তু এখন তারপরও প্রায় দেউলিয়া) : ২৫ কোটি মার্কিন ডলার।

ক্রুসেড এর মনোজগত তৈরির চেষ্টা এবং হান্টিংটন মডেল

আগেই বলেছি, ১১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে ‘সন্ত্রাস বিরোধী’ প্রচারের সবগুলো ‘সরকারি’ ‘বেসরকারি’ মাধ্যমের মধ্যে তাল সুর লয়-এর সঙ্গতি ছিল লক্ষণীয়। এখানে আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে, মার্কিন-ব্রিটিশ সরকার, বৃহৎ সবগুলো টিভি চ্যানেল, বৃহৎ সবগুলো সংবাদপত্র সবগুলো প্রথম দিন থেকেই সন্ত্রাস বিরোধী প্রচারণায় যে ঐকতান তৈরি করে তাতে মূল সুরটি ছিল সাম্প্রদায়িক এবং বর্ণবিদ্বেষী। আরব মানে ‘সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি’ মুসলিম মানে ‘সন্ত্রাসী’-মুসলিম মানে ‘অনগ্রসর,’ ‘অসহিষ্ণু,’ ‘অনুন্নত,’ মুসলিম নারী মানে ‘অন্তঃপুরবাসিনী,’ মুসলিম মানে ‘মৌলবাদী’ সরাসরি কিংবা ঘুরিয়ে এইসব ধারণা, বক্তব্য প্রচার সেইসময় এমন আকার ধারণ করে যে, উত্তর আমেরিকার সমাজে তা রীতিমত একটি চাপ তৈরি করে। অমুসলিম মার্কিনি বা কানাডিয়ান যে মুসলিম প্রতিবেশি বা সহকর্মী নিয়ে এতদিন নিশ্চিন্তে কাজ করেছেন তাঁকে নিয়ে আতঙ্কে ভুগতে থাকেন : ‘এও কি সন্ত্রাসী’? মুসলিম/আরবি নাম শুনলেই আঁতকে উঠে সন্দেহ নিয়ে ঘাড় ফেরান সকল অমুসলিম নারী-পুরুষ, ভয়! এর মধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠে শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান বা ইহুদি উগ্রপন্থী কিছু গ্রুপ। হামলার ঘটনাও ঘটে কিছু। 

মুসলিম জনগোষ্ঠী, যারা এতদিন অন্তত এরকম নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেননি তাঁরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকলেন। একই কারণে আরবি নাম থাকায় আরব-খ্রিস্টান, পাগড়ি-দাড়ি থাকায় ভারতীয় শিখ প্রভৃতিও আক্রান্ত হন এতে। একজন শিখ নিহতও হন। মধ্যপ্রাচ্য বা দক্ষিণ এশীয় চেহারা/গায়ের রং, আরবি নাম মাত্রই বিশেষ মনোযোগ/আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।২৬

প্রচার মাধ্যমে এইরকম অস্থির আতঙ্ক সৃষ্টি করা ও তাকে জিইয়ে রাখার আয়োজন চলে। এর মধ্যে ‘মুসলিম সন্ত্রাসী’দের হাত থেকে বাঁচার জন্য, খ্রিস্টান-ইহুদি দোয়াদরূদ, সংহতি বৃদ্ধি, প্রচারপত্র, পুস্তিকা প্রকাশ-প্রচার ইত্যাদিও চলতে থাকে। চাঙ্গা হয়ে উঠে চরম ডানপন্থী বর্ণবাদী সাম্প্রদায়িক বিভিন্ন গোষ্ঠী। প্রেসিডেন্ট বুশ এক পর্যায়ে যে তাদের প্রচারিত ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ’ কে ‘ক্রুসেড’ হিসেবে অভিহিত করেন তা তাই নিছক ‘বলার ভুল’ ছিল না। যেভাবে নিজেদের যুদ্ধসাজকে বৈধতাদানের জন্য একটা সাম্প্রদায়িক-বর্ণবাদী আবহ তৈরি করা হয়েছিল তাতে সেই যুদ্ধকে ক্রুসেড বলাই তার দিক থেকে সঙ্গত। এই আবহ তৈরি, ক্রুসেড বলে যুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষকে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভাগ করা এবং অতীতের ক্রুসেডের জোশকে ফিরিয়ে আনার একটা বড় যুক্তি হলো পশ্চিমের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী খ্রিস্টান ও ইহুদিদের ‘চাঙ্গা’ করা এবং ‘জাতীয়’ ঐক্যকে পেছনে নিয়ে যুদ্ধ ও আগ্রাসনকে বৈধতা দান। পরে কূটনৈতিক কারণে স্বরটাকে একটু নরম করতে হয় : আফগানিস্তানের উপর একটানা আক্রমণকে নাম দেয়া হয় ইনফিনিট জাসটিস-তার মধ্যেও ঐশ্বরিক ক্ষমতার একটা সুর ছিল, পরে আবার নাম দেয়া হয় “এনডুরিং ফ্রিডম” -যার বিবিধ অর্থ হতে পারে। 

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এই সাম্প্রদায়িক বর্ণবাদী রূপটি খুব অপরিচিত বিষয় নয়। তবে ৮০ দশক পর্যন্ত ‘কমিউনিজম’ বিরোধী লড়াই এর সময় সব ধর্মকেই বর্ম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, বর্ণবাদী রূপটিও তখন কমিউনিজম বিরোধিতার মধ্যেই প্রবিষ্ট ছিল। ধর্মের যাবতীয় ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে যত ধরনের প্রতিষ্ঠান ও নেটওয়ার্ক দাঁড়িয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সেগুলো এখন মুখোমুখি। শুধু বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে নয়, একই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেকার বিবিধ সংঘাতও ক্রমেই জোর পাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এই সাম্প্রদায়িক বর্ণবাদী রূপটি খুব অপরিচিত বিষয় নয়। তবে ৮০ দশক পর্যন্ত ‘কমিউনিজম’ বিরোধী লড়াই এর সময় সব ধর্মকেই বর্ম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, বর্ণবাদী রূপটিও তখন কমিউনিজম বিরোধিতার মধ্যেই প্রবিষ্ট ছিল। ধর্মের যাবতীয় ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে যত ধরনের প্রতিষ্ঠান ও নেটওয়ার্ক দাঁড়িয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সেগুলো এখন মুখোমুখি। শুধু বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে নয়, একই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেকার বিবিধ সংঘাতও ক্রমেই জোর পাচ্ছে।

যে ‘পশ্চিম’কে এখন ‘উদারনৈতিক গণতন্ত্রী’ সভ্যতার ধারক বাহক হিসেবে উপস্থিত করা হয় সেই পশ্চিমকে ইতিহাস থেকে, জনগণ থেকে বিযুক্ত করে বিচার করা চলে না। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই এই ‘পশ্চিম’ কয়েকশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসন-লুণ্ঠন-গণহত্যা-আগ্রাসন-নির্যাতনের উপরই ‘উদারনৈতিক গণতন্ত্র’-এর পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসেও এমনকি চলতি বর্তমানেও সেই পতাকায় গণহত্যা-বর্বরতা-দখল-লুণ্ঠনের চিহ্ন পাওয়া যাবে। এই সত্যটি আড়াল করবার জন্য ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনাকে ‘পশ্চিমী সভ্যতা’র-‘গণতান্ত্রিক’ সভ্যতার উপর অসভ্য বর্বরদের আক্রমণ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা চলেছে। কখনো কখনো তাদের ভাষ্যে পশ্চিমী সভ্যতা হয়ে যায় খ্রিস্টীয় সভ্যতার সমার্থক এবং অসভ্য বর্বর হয়ে যায় মুসলিম সভ্যতার সমার্থক।

এইভাবে যখন বিষয়টি উপস্থাপিত হয় তখন ক্রুসেড ডাকটি এর সঙ্গে খুবই সঙ্গতিপূর্ণ হয়। আবার এর বিপরীতে ওসামা কিংবা তাঁর সহচিন্তকরা যখন ‘জেহাদ’ এর ডাক দেন তা বস্তুত পশ্চিমের সাম্প্রদায়িক বর্ণবাদী মডেলেরই প্রতিধ্বনি করে।  এই মডেলের সাম্প্রতিক প্রভাবশালী মুখপাত্র স্যামুয়েল হান্টিংটন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হান্টিংটন মার্কিন প্রশাসন সম্পর্কিত বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করেছেন এবং কার্টার প্রশাসনে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কর্মকর্তাও ছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর যখন মার্কিনি আরেক তাত্ত্বিক ফুকুয়ামা ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ ঘোষণা করেছেন তখন হান্টিংটন ‘নতুন বিশ্বব্যবস্থার পর্বে’ নতুন এক সংঘাতের সম্ভাবনা তুলে ধরেন। ১৯৯৩ সালে এক প্রবন্ধে তিনি পশ্চিমের সভ্যতা নিয়ে খ্রিস্টীয়-ইহুদি/ইউরোপীয় উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অস্বস্তির সারসংকলন করেন। প্রবন্ধটির নাম ছিল ‘দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন’। এটি প্রকাশিত হয় ‘ফরেন এ্যাফেয়ার্স’-এ। প্রকাশের পর এটি নিয়ে জার্নালটির সম্পাদনা পরিষদের মতে, যে বিতর্ক তৈরি হয়, যে রকম প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় জার্নালটির ইতিহাসে গত পঞ্চাশ বছরে সেরকম কখনো হয়নি। এসব আলোচনা, বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে হান্টিংটন প্রবন্ধটিকে বাড়িয়ে একটি বৃহৎ গ্রন্থের আকার দান করেন যাবতীয় সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে।২৭  প্রকাশের পর ‘এন্ড অব হিস্ট্রি’র মতো এটি অধিপতি প্রচার মাধ্যম এবং বিদ্যাজগতে ব্যাপক প্রচার ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। এই প্রচার লাভের মূল কারণ- দুটো গ্রন্থই সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্রে ‘পথ নির্দেশক’ মর্যাদা লাভ করেছে। উপরন্তু এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, হান্টিংটনের গ্রন্থ পশ্চিমের কেন্দ্রে বর্ণবাদী-সাম্প্রদায়িক সত্তাটিকে চাঙ্গা করেছে।

এইভাবে যখন বিষয়টি উপস্থাপিত হয় তখন ক্রুসেড ডাকটি এর সঙ্গে খুবই সঙ্গতিপূর্ণ হয়। আবার এর বিপরীতে ওসামা কিংবা তাঁর সহচিন্তকরা যখন ‘জেহাদ’ এর ডাক দেন তা বস্তুত পশ্চিমের সাম্প্রদায়িক বর্ণবাদী মডেলেরই প্রতিধ্বনি করে।  এই মডেলের সাম্প্রতিক প্রভাবশালী মুখপাত্র স্যামুয়েল হান্টিংটন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হান্টিংটন মার্কিন প্রশাসন সম্পর্কিত বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করেছেন এবং কার্টার প্রশাসনে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কর্মকর্তাও ছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর যখন মার্কিনি আরেক তাত্ত্বিক ফুকুয়ামা ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ ঘোষণা করেছেন তখন হান্টিংটন ‘নতুন বিশ্বব্যবস্থার পর্বে’ নতুন এক সংঘাতের সম্ভাবনা তুলে ধরেন। ১৯৯৩ সালে এক প্রবন্ধে তিনি পশ্চিমের সভ্যতা নিয়ে খ্রিস্টীয়-ইহুদি/ইউরোপীয় উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অস্বস্তির সারসংকলন করেন।

হান্টিংটনের বিবেচনায় বিশ্ব কয়েকটি সভ্যতায় বিভক্ত। এর মধ্যে তিনটি সভ্যতা প্রধান এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের যাবতীয় দ্বন্দ্ব সংঘাত এই তিনটির মধ্যেই হবার সম্ভাবনা। এই তিনটি হলো : ‘পশ্চিম সভ্যতা’, ‘ইসলামী সভ্যতা’ এবং ‘চীন সভ্যতা’। হান্টিংটনের বিশ্লেষণে পশ্চিমা সভ্যতার বিরুদ্ধে ইসলামী ও চীনা সভ্যতার একটা সমঝোতা আছে এবং এটি আরও দৃঢ় হবার সম্ভাবনা।

হান্টিংটন ‘পশ্চিমা সভ্যতা’ বলতে মুখ্যত ইউরোপীয় এবং তার সম্প্রসারণ হিসেবে উত্তর আমেরিকার বর্ণগত দিক থেকে শ্বেতাঙ্গ এবং ধর্মীয় দিক থেকে খ্রিস্টীয়/ইহুদিদের ‘সভ্যতা’কে বোঝাচ্ছেন। ইসলামী সভ্যতা বলতে মুসলিম প্রধান দেশগুলোকে সমষ্টিগতভাবে বোঝাচ্ছেন এবং চীনা সভ্যতা বলতে বোঝাচ্ছেন চীন এবং চীনা জাতিগতভাবে সম্পর্কিত অন্যান্য জাতি (পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশ)গুলোকেও বোঝানো হয়েছে। চীনা সভ্যতাকে অন্যদিক থেকে কনফুসীয় সভ্যতাও বলা হচ্ছে। হান্টিংটনের ভাষায়, ভবিষ্যতের ভয়াবহ সংঘাতগুলি তৈরি হবে পশ্চিমা ঔদ্ধত্ব, ইসলামী অসহিষ্ণুতা এবং চীনাদের নিজেদের আরোপ করবার ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে। 

পশ্চিমা সভ্যতা হান্টিংটনের কাছে গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, উদারতাবাদ, ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের সমার্থক। তাঁর মতে, এগুলো পশ্চিমা সভ্যতার নিজস্ব বৈশিষ্ট, এগুলো বিশ্বজনীন করতে যাওয়ার ফলেই দ্বন্দ্ব সংঘাত তৈরি হচ্ছে। হান্টিংটনের উদ্বেগের জায়গা হল, ক্রমান্বয়ে ‘পশ্চিমা সভ্যতা’ কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে জনসংখ্যার দিক থেকে, ইমিগ্রান্টদের কারণে এবং অর্থনৈতিক-সামরিক দিক থেকেও। তাঁর বিবেচনায় মুসলমানদের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার এবং চীনের সামরিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পশ্চিমা সভ্যতাকে হুমকির সম্মুখীন করেছে। 

পশ্চিমা সভ্যতাকে শ্বেতাঙ্গ-খ্রিস্টীয়-ইহুদি এই সভ্যতা হিসেবে দেখে অন্য কারও শরীকানা অস্বীকার করেন হান্টিংটন। তাঁর ভাষায় অন্যান্য সভ্যতা-সংস্কৃতির সংমিশ্রণ পশ্চিমা সভ্যতার অবিমিশ্র ধারাবাহিকতার জন্য বিপজ্জনক। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বিভিন্ন সভ্যতার মানুষ মিলে জাতিসংঘ হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র থাকে না। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে পশ্চিমা সভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে টিকে থাকতে হলে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট অটুট রাখতে হবে। হান্টিংটন ডেমোক্রেটসহ বিভিন্ন রাজনীতিবিদদের ইমিগ্রান্ট কিংবা অশ্বেতাঙ্গদের প্রতি ‘সহানুভূতি’কে কিংবা বৈচিত্রকে উৎসাহিত করাকে ‘বিপজ্জনক অপশ্চিমীকরণ প্রক্রিয়ার’ অংশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই প্রক্রিয়া তাঁর মতে বেশি জোরদার হয়েছে ১৯৬০ এর দশকে সিভিল রাইটস এ্যাক্ট পরবর্তী বিভিন্ন আইন কানুন এবং ১৯৯০ দশকে ক্লিনটন প্রশাসনের বিভিন্ন পদক্ষেপে। 

পশ্চিমা সভ্যতাকে শ্বেতাঙ্গ-খ্রিস্টীয়-ইহুদি এই সভ্যতা হিসেবে দেখে অন্য কারও শরীকানা অস্বীকার করেন হান্টিংটন। তাঁর ভাষায় অন্যান্য সভ্যতা-সংস্কৃতির সংমিশ্রণ পশ্চিমা সভ্যতার অবিমিশ্র ধারাবাহিকতার জন্য বিপজ্জনক। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বিভিন্ন সভ্যতার মানুষ মিলে জাতিসংঘ হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র থাকে না। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে পশ্চিমা সভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে টিকে থাকতে হলে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট অটুট রাখতে হবে। হান্টিংটন ডেমোক্রেটসহ বিভিন্ন রাজনীতিবিদদের ইমিগ্রান্ট কিংবা অশ্বেতাঙ্গদের প্রতি ‘সহানুভূতি’কে কিংবা বৈচিত্রকে উৎসাহিত করাকে ‘বিপজ্জনক অপশ্চিমীকরণ প্রক্রিয়ার’ অংশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

তার মানে হান্টিংটনের বিশ্ব দেখার যে দৃষ্টিভঙ্গিটি ক্রুসেড ও পাল্টা জেহাদ এর মনোজগত তৈরি করতে সক্ষম তার মূল দিকগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ :

ক. বিশ্বকে কেবল ধর্মের এবং বর্ণের ভিত্তিতে ভাগ করে দেখা; 

খ. মুসলিম-খ্রিস্টান-ইহুদি ধর্মাবলম্বী বা গোষ্ঠীর সদস্য জনগোষ্ঠীকে সমরূপ বিবেচনা করা; 

গ.পশ্চিম ও প্রাচ্য উভয় বিশ্বকে সমরূপ বিবেচনা করা;

ঘ. ঔপনিবেশিক শাসন, দখল ও গণহত্যার পর্ব সভ্যতার ধ্বংস ও বিকাশ ধারায় যে ভূমিকা পালন করেছে সে সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকা।

ঙ. জনসংখ্যার মধ্যে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষদের সচলতা (নাগরিকত্ব পরিবর্তন, অবস্থান পরিবর্তন) বিবেচনায় না নেয়া;

চ. কোন ধর্মই যে এক ধর্ম নয়, একই ধর্মের মধ্যে যে বহু ধর্ম থাকে, সামাজিক-মতাদর্শিক অবস্থানের সঙ্গে ধর্মও যে বদলে যায় কিংবা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মের ব্যাখ্যা বা রূপে যে অনেক পার্থক্য তৈরি হয় তা সম্পর্ণ অবজ্ঞা করা; এবং

ছ.পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সংস্থা, সংস্কৃতি সব কিছুর মধ্যে যে পরিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে সেগুলোকে উপেক্ষা করা।

বস্তুত ‘পশ্চিমী সভ্যতা’ যেমন অখণ্ড, সমরূপ, শ্রেণী-মতাদর্শ বিভেদমুক্ত, অনৈতিহাসিক নয় তেমনি ‘মুসলিম সভ্যতা’ও অখণ্ড সমরূপ, শ্রেণীর-মতাদর্শ বিভেদ মুক্ত, অনৈতিহাসিক নয়। এই দুটি পরস্পর পুরোপরি বিচ্ছিন্নও নয়। পশ্চিমে যা কিছু জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিধি ও ব্যবস্থা তা বিশেষত প্রাচ্যের অতীতের সঙ্গেও নানাভাবে যুক্ত আবার প্রাচ্যের অনেক ‘পশ্চিমমুখী’ ‘পশ্চিম বিরোধী’ ধারণা পশ্চিম থেকে প্রাপ্ত। পশ্চিমের মধ্যে যেমন, অপশ্চিমের মধ্যেও তেমন শাসক শ্রেণী আর জনগণের ইতিহাস এক নয়। জনগণের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পশ্চিমে যা কিছু গড়ে উঠেছে তাকে শাসক শ্রেণীর মতাদর্শিক শারীরিক আধিপত্যের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা ভয়ঙ্কর। আবার মুসলিম সভ্যতা বলতে যেসব জনগোষ্ঠী বোঝানো হয় সেখানে জীবন ও চিন্তায় আকাশ-পাতাল তফাৎ নিয়ে মানুষজন বসবাস করেন। ইসলাম সেখানে অভিন্ন পরিচয়ের সূত্র হলেও ইসলাম সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি, তার চর্চা, তার মতাদর্শে পার্থক্য যে মাত্রায় তাকে অভিন্ন কাঠামোয় ফেলা ভেতরের মৌলিক অনেক পার্থক্য-ভিন্নতাসহ সবকিছুকে অস্বীকার করবার একটা অপচেষ্টা কিংবা বিপজ্জনক ভ্রান্তি। 

বস্তুত ‘পশ্চিমী সভ্যতা’ যেমন অখণ্ড, সমরূপ, শ্রেণী-মতাদর্শ বিভেদমুক্ত, অনৈতিহাসিক নয় তেমনি ‘মুসলিম সভ্যতা’ও অখণ্ড সমরূপ, শ্রেণীর-মতাদর্শ বিভেদ মুক্ত, অনৈতিহাসিক নয়। এই দুটি পরস্পর পুরোপরি বিচ্ছিন্নও নয়। পশ্চিমে যা কিছু জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিধি ও ব্যবস্থা তা বিশেষত প্রাচ্যের অতীতের সঙ্গেও নানাভাবে যুক্ত আবার প্রাচ্যের অনেক ‘পশ্চিমমুখী’ ‘পশ্চিম বিরোধী’ ধারণা পশ্চিম থেকে প্রাপ্ত। পশ্চিমের মধ্যে যেমন, অপশ্চিমের মধ্যেও তেমন শাসক শ্রেণী আর জনগণের ইতিহাস এক নয়। জনগণের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পশ্চিমে যা কিছু গড়ে উঠেছে তাকে শাসক শ্রেণীর মতাদর্শিক শারীরিক আধিপত্যের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা ভয়ঙ্কর। আবার মুসলিম সভ্যতা বলতে যেসব জনগোষ্ঠী বোঝানো হয় সেখানে জীবন ও চিন্তায় আকাশ-পাতাল তফাৎ নিয়ে মানুষজন বসবাস করেন।

প্রথমে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ পর্বে এবং পরবর্তীতে পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণ প্রক্রিয়ায় বিশ্বে বিভিন্ন অঞ্চল, সভ্যতা, ভাষা ও বর্ণের স্থানিক অবস্থানের স্থিতি ভেঙে গেছে। গত কয়েক দশকে এই সংমিশ্রণ, গতিশীলতা বেড়েছে অনেক বেশি। সুতরাং হান্টিংটন না চাইলেও পশ্চিমকে এখন আর শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টানদের অঞ্চল হিসেবে কোনভাবেই বর্ণনা করা যায় না। মুসলিম, চীনারাও ‘পশ্চিমের’ এখন গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হান্টিংটন কিংবা তার সহচিন্তকদের ইচ্ছাপূরণের মডেলে যে মুসলিম সভ্যতা উপস্থিত করা হয়, বাস্তব জগতে তার কোন অস্তিত্ব নেই। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সামরিক শক্তি বৃদ্ধিকে হান্টিংটন পশ্চিমের জন্য একটি হুমকি হিসেবে উপস্থিত করতে চেয়েছেন আবার এই ঘটনাকে অনেক মুসলিম শাসক কিংবা সহচিন্তক ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু এই সরল সত্যটি এখানে অস্বীকার করা হয়েছে যে বর্তমানে মুসলিম দেশগুলোতে অস্ত্রের বাজার, এর সামরিক চেহারা পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর কাঠামোর মধ্যেই তৈরি। ‘মুসলিম’ প্রধান অধিকাংশ দেশের শাসকশ্রেণী ‘খ্রিস্টান’ প্রধান অঞ্চলের সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্রের উপগ্রহ মাত্র। ‘মুসলিম’-‘খ্রিস্টান’ পার্থক্য এখানে খুব গৌণ। অন্যদিকে খ্রিস্টান মানে শুধু পশ্চিমী নয়, অ-পশ্চিম দেশগুলোতে খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এখন পশ্চিমের থেকে বেশি। খ্রিস্টান বলে তাদের উপর সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্রের শোষণ-নিপীড়ন-ধ্বংস-আধিপত্যের কোন কমতি কখনও দেখা যায়নি। তাদের লড়াইও তাই কম জোরদার নয়। হান্টিংটনের (কিংবা সহচিন্তক মুসলিম-হিন্দু-ইহুদি) মডেলে এই বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ-ঔপনিবেশিক কাঠামোর কোন অস্তিত্ব নেই, এই বিশ্বে শ্রেণীর অস্তিত্ব নেই, এই বিশ্বে মুসলিম-হিন্দু-খ্রিস্টান-ইহুদি-বৌদ্ধ-অধর্মীয় জনগণের সম্মিলিত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শোষণ-পীড়ন বিরোধী লড়াইএর কোন ইতিহাস নেই! নেই শুধু তাই নয় এই ধারাবাহিকতাকে বিনাশ করবার জন্যই এই মডেলের চিন্তকদের এবং সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী শাসকশ্রেণীর এভাবে জগতকে উপস্থিত ও ব্যাখ্যা করবার প্রাণপণ চেষ্টা চলছে। 

১১ সেপ্টেম্বরের পরবর্তী বিশ্ব সন্ত্রাসের নতুন যাত্রা ও তার প্রতিবাদের স্থানিক/সামাজিক রূপ দেখলে আমরা এই মডেলের বিপরীত চিত্রটিই পাই। আমরা এখানে দেখি, 

প্রথমত, ইরাক, সুদান, লিবিয়া বাদে সকল মুসলিম প্রধান দেশ মার্কিন সন্ত্রাসের কোয়ালিশনের সদস্য হয়েছে। সৌদি আরব ও পাকিস্তান এক্ষেত্রে বরাবরই মার্কিনি মডেলে অগ্রণী।

দ্বিতীয়ত, ‘মুসলিম’ বিশ্বে যেমন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে তার থেকে কম নয়, অনেক ক্ষেত্রে বেশি প্রতিবাদ হয়েছে ‘অ-মুসলিম’ বিশ্বে। বিশ্বের বহু সংখ্যক প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে প্রধানত বামপন্থী, ‘বিশ্বায়ন বিরোধী’ গ্রুপগুলোর মাধ্যমে। যাদের অনেকে পারিবারিক পরিচয়ে অমুসলিম। 

তৃতীয়ত, খেয়াল করা দরকার যে, ‘মুসলিম’ বিশ্বে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের প্রতিবাদকে পশ্চিমী মূলধারার প্রচার মাধ্যম সম্পূর্ণ হত্যা করেছে। অন্যান্য অঞ্চলের প্রতিবাদকেও খুবই কম দেখানো হয়েছে। উদ্দেশ্য স্পষ্টত এটাই দেখানো যে, ‘মুসলিম মৌলবাদীরা’ই কেবল মার্কিনি সন্ত্রাসের বিরোধী। 

চতুর্থত, বিশ্ব সন্ত্রাসের নতুন যাত্রার পাটাতন যে পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা, সেখানে ‘মুসলিম’ ‘অমুসলিম’ বিশ্বের শাসক-সহচিন্তকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা এবং এনজিও নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে শাসক শ্রেণীর আন্তর্জাতিক সংহতিই মুখ্য হয়ে উঠেছে। 

পঞ্চমত, পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা যত আন্তর্জাতিক ও কেন্দ্রীভূত হচ্ছে ততোই তার বিরুদ্ধে সংগ্রামও আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করছে। বিভিন্ন ধর্ম, জাতি, বর্ণ, ভাষার নারী-পুরুষের এই ঐক্য বা সংহতির বস্তুগত ভিত্তি পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থাই তৈরি করছে।

 

সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বৈশ্বিক আন্দোলনের নতুন পর্ব এবং দমনপীড়নের ব্যবস্থা

২০০১ সালের ২৯-৩০ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর যৌথ সভা অনুষ্ঠানের কর্মসূচি ছিল। এই যৌথ সভা ঘেরাও করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রতিবাদী গ্রুপ দল ব্যক্তির সমবেত হবার প্রস্তুতি চলছিল কয়েক মাস থেকেই। ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রচার, যোগাযোগ, বিতর্ক, মতবিনিময়, প্রস্তুতির খবর ইত্যাদি থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিলো লাখ দুয়েক মানুষ বিক্ষোভ ঘেরাও-এ শামিল হবেন। এর কিছুদিন আগেই জেনোয়ার ঘটনা ঘটেছে, সেখানে অনেক বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও বিপুল জমায়েত হয়েছিল এবং এই পর্বের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে (‘বিশ্বায়ন বিরোধী’ বলে পরিচিত) ইটালীয় পুলিশের হাতে একজন শহীদও হয়েছিলেন। 

১৯৯৯ এর নভেম্বরে সিয়াটল থেকে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্রীয় সংস্থাসমূহ ও রাষ্ট্রসমূহের সকল আন্তর্জাতিক সমাবেশই বিক্ষোভের সম্মুখীন হচ্ছে। এবং এই বিক্ষোভ সমাবেশের আয়তন এবং জোরও বাড়ছে দিন দিন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে তথাকথিত ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’-র পর যখন পুঁজিবাদের বিশ্ব অভিযান অনেক গতিলাভ করেছে তখন তা আবার অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্রের তৃপ্ত-নিশ্চিন্ত গোষ্ঠীসমূহকে বিস্মিত করে দিয়ে নতুন পর্বের প্রতিরোধেরও সম্মুখীন হয়েছে। নতুন পর্বে নতুন প্রযুক্তিকে সাথে নিয়ে প্রতিরোধও যেরকম বৈশ্বিক চেহারা নিয়েছে তাতে কোন দেশে বা কোন অঞ্চলে গিয়েই সাম্রাজ্যবাদী সভা-সমাবেশ জন প্রতিরোধ-এর হাত থেকে রক্ষা পায়নি। শেষে জি-৮ অর্থাৎ বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রসমূহের সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলনের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল আমির সমর্থিত কাতারের দোহা। সেখানে প্রতিবাদীরা যেতে পারেননি ঠিকই কিন্তু বিশ্বব্যাপী সে সময়ে প্রতিবাদ সমাবেশগুলি অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

নতুন পর্বে নতুন প্রযুক্তিকে সাথে নিয়ে প্রতিরোধও যেরকম বৈশ্বিক চেহারা নিয়েছে তাতে কোন দেশে বা কোন অঞ্চলে গিয়েই সাম্রাজ্যবাদী সভা-সমাবেশ জন প্রতিরোধ-এর হাত থেকে রক্ষা পায়নি। শেষে জি-৮ অর্থাৎ বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রসমূহের সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলনের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল আমির সমর্থিত কাতারের দোহা। সেখানে প্রতিবাদীরা যেতে পারেননি ঠিকই কিন্তু বিশ্বব্যাপী সে সময়ে প্রতিবাদ সমাবেশগুলি অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

এসব আন্দোলন, প্রতিবাদ, ঘেরাও এককেন্দ্রিক সাংগঠনিক প্রচেষ্টার ফল নয়। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রবাহ, বিভিন্ন লক্ষ্যাভিমুখী আন্দোলন আছে। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার বর্তমানে আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিভিন্নমুখী আন্দোলন গড়ে উঠার যে উর্বর ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে তা থেকেই এসব সমাবেশের শক্তিবৃদ্ধি ঘটছে। এগুলোর ‘জ্বালাতন’ থেকে বাঁচার জন্য বেশ কিছুদিন থেকে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে বহুবিধ কর্মসূচি গ্রহণের সম্ভাব্যতা বিচার চলছিল পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্রে। প্রতিরোধের সঙ্গে সঙ্গে শাসকদের দমনপীড়নও বাড়ছিল ক্রমাগত। আন্দোলন দমন নির্যাতনের জন্য ‘উদার গণতন্ত্রী’ রাষ্ট্রের চেহারাটাও স্পষ্ট হচ্ছিল। 

২৯-৩০ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এর বার্ষিক সাধারণ সভা বিরোধী বিশাল অনুষ্ঠিতব্য বিক্ষোভ সমাবেশ মোকাবিলার জন্য ত্রস্ত মার্কিন রাষ্ট্র বহু আগে থেকেই নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে বিশাল পুলিশবাহিনী মোতায়েন, কাঁটাতারের কয়েক পর্যায়ের বেড়া দিয়ে ঘেরাও দেয়া, বিশ্ববিদ্যালয় সপ্তাহ খানেকের জন্য ছুটি দেয়া এর সবই অন্তর্ভুক্ত ছিল। কার্যত অবস্থা এরকম দাঁড়িয়েছে যেন, কার্ফু জাতীয় অবস্থা ছাড়া সাম্রাজ্যবাদী সংস্থাসমূহের কেন্দ্রীয় সমাবেশের কোন সুযোগই আর অবশিষ্ট নেই। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা যেন বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ এর সেই সভা নিয়ে সংস্থার নেতৃবৃন্দ এবং মার্কিন প্রশাসনের উদ্বেগের অবসান ঘটায় এবং ঐদিনই বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে বার্ষিক সাধারণ সভা স্থগিত ঘোষণা করা হয়।

২৯-৩০ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এর বার্ষিক সাধারণ সভা বিরোধী বিশাল অনুষ্ঠিতব্য বিক্ষোভ সমাবেশ মোকাবিলার জন্য ত্রস্ত মার্কিন রাষ্ট্র বহু আগে থেকেই নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে বিশাল পুলিশবাহিনী মোতায়েন, কাঁটাতারের কয়েক পর্যায়ের বেড়া দিয়ে ঘেরাও দেয়া, বিশ্ববিদ্যালয় সপ্তাহ খানেকের জন্য ছুটি দেয়া এর সবই অন্তর্ভুক্ত ছিল। কার্যত অবস্থা এরকম দাঁড়িয়েছে যেন, কার্ফু জাতীয় অবস্থা ছাড়া সাম্রাজ্যবাদী সংস্থাসমূহের কেন্দ্রীয় সমাবেশের কোন সুযোগই আর অবশিষ্ট নেই। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা যেন বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ এর সেই সভা নিয়ে সংস্থার নেতৃবৃন্দ এবং মার্কিন প্রশাসনের উদ্বেগের অবসান ঘটায় এবং ঐদিনই বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে বার্ষিক সাধারণ সভা স্থগিত ঘোষণা করা হয়।

শুধু তাই নয় বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সর্বব্যাপী যে প্রচারযুদ্ধ ও প্রচার আক্রমণ শুরু হয় তার মধ্যে ‘বিশ্বায়ন’ বিরোধী বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধ বিক্ষোভের শক্তিসমূহকেও টার্গেট করা হয়। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে, ‘বিশেষজ্ঞ’ ভাষ্যকারদের অভিমতে, একদিকে এসব শক্তিকে সন্ত্রাসীদের আশ্রয়দাতা হিসেবে যেমন অভিযুক্ত করা হয় তেমনি অন্যদিকে ১১ সেপ্টেম্বরের পর এসব আন্দোলনের বিনাশ হবে বলে আনন্দও প্রকাশ করা হয়। এই প্রচার আগ্রাসনের পাশাপাশি পুলিশি ব্যবস্থাও নতুন মাত্রা লাভ করে।

উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে গত দশ বছরে পুরনো বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগঠনসমূহের বাইরে অসংখ্য তরুণ-নারী-পরিবেশবাদী, যুদ্ধ বিরোধী, দারিদ্র বিরোধী সংগঠন গড়ে উঠেছে। পুরনো শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে নতুন রাজনীতির প্রভাবও বেড়েছে। এই সংগঠনগুলোর কার্যক্রম বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় কিংবা ইস্যুভিত্তিক সভা সমাবেশ প্রতিবাদ দাবি-দাওয়ার মধ্যেই সীমিত ছিল দীর্ঘদিন। ক্রমে এই ইস্যুগুলো নিয়ে আন্দোলন ব্যাপকাকার ধারণ করবার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে যোগাযোগও নতুনভাবে সংগঠিত ও ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। ইন্টারনেট এই যোগাযোগের গতি বাড়াতে সাহায্য করলো অনেক। আর এসব সংগঠনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর নতুন সদস্যদের বিপুল অধিকাংশই তরুণ। 

ক্রমেই পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া একদিকে যেমন বৈশ্বিক কেন্দ্র তৈরি করছে অন্যদিকে আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তুও হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেসব বৈশ্বিক কেন্দ্রই। তার ফলে আন্দোলন আর স্থানীয় থাকছে না। পুঁজিবাদের বৈশ্বিক আগ্রাসন প্রতিরোধের বৈশ্বিক রূপকেও স্পষ্ট করছে। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্রীয় তিন ব্যবস্থাপক সংস্থা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, এবং সেই সঙ্গে বহুজাতিক সংস্থাসমূহ, মার্কিন যুদ্ধ মেশিন ইত্যাদির নীতি ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের কর্মকাণ্ড ক্রমে এসব বিক্ষোভ-প্রতিরোধের কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। গত কয়েক বছরে বিশ্বের যে কোন স্থানে সাম্রাজ্যবাদী যে কোন কর্মকাণ্ড তাই এসব সংস্থার কাজের বিষয় হয়ে উঠেছে। এই বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক, দ্রুত যোগাযোগ, দ্রুত প্রতিক্রিয়া, সর্বত্র একই সময়ে প্রতিবাদ তৈরির বিভিন্ন কিন্তু সম্পর্কিত কাঠামো অবশ্যই শত্রু-মিত্র সবার জন্যই নতুন অভিজ্ঞতা।

১১ সেপ্টেম্বরের পর প্রচার মাধ্যমে আফগানিস্তান, তালিবান, ‘মুসলিম সন্ত্রাসী’, ‘ইসলামী মৌলবাদ’ ইত্যাদি সম্পর্কে খ্রিস্টান প্রধান পশ্চিমা দেশগুলোতে, ‘এশীয় আরব সন্ত্রাসী’দের বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গ প্রধান পশ্চিমা দেশগুলোতে যখন সাম্প্রদায়িক বর্ণবাদী উন্মাদনা তৈরি করা হয় তখন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে, পাশাপাশি দেশের ভেতরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে কর্মরত প্রতিবাদী বিভিন্ন সংগঠনের বিরুদ্ধে পুলিশী তৎপরতাও বৃদ্ধি পায়। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে  একটি উদাহরণ দেই। ২০০১ সালের ১৬ অক্টোবর কানাডার টরন্টোতে দারিদ্র্য-ছাঁটাই-নির্যাতন বিরোধী অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয় প্রায় ২৫টি সংগঠনের উদ্যোগে। এই সংগঠনগুলোই ১৪ অক্টোবর মার্কিন দূতাবাসের সামনে আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার বিরুদ্ধে সমাবেশ করে। যে সংগঠনগুলো এই কার্যক্রমে অংশ নেয় তার প্রায় সবগুলোই ১১ সেপ্টেম্বরের পর পুলিশের খাতায় তালিকাভুক্ত করা হয়েছে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে। ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হবার কারণে প্রতিটি সংগঠন ও কর্মীদের দারিদ্র্য কিংবা যুদ্ধ বিরোধী কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে বহুরকম পুলিশি হয়রানি, জেরা, জবরদস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে।

এই পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ কেন্দ্রীয় সকল দেশে পুলিশী, গোয়েন্দা, দমনমূলক সবরকম সংস্থার তহবিল বাড়ানো হয়েছে; সবারই সক্রিয়তা বেড়ে গেছে বহুরকম। নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে ‘সন্ত্রাসী দমনের’ জন্য, কিন্তু আইনগুলোর অনেক ধারা দেখলেই পরিষ্কার হবে যে, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ-প্রতিবাদ-প্রতিরোধ দমনই এগুলোর লক্ষ্য। এসব আইনের চেহারা বোঝার জন্য বাংলাদেশের বিশেষ ক্ষমতা আইন, ‘জননিরাপত্তা বিল’ কিংবা সর্বশেষ ‘জন নিরাপত্তা আইন’-এর দিকে দৃষ্টি দেয়া যায়। সন্ত্রাস দমনের নামে অন্যান্য দেশেও এ ধরনের আইন প্রণয়ন শুরু হয় এসময়েই। ভারতে ২০০১ সালের শেষ দিকে পার্লামেন্টে হামলার আগেই ‘পোকো’ নামে এ ধরনের আইন প্রণয়ন করবার উদ্যোগ নেয়া হয়। নেপালে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে কালাকানুন ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বাড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ‘সন্ত্রাস’ এর কথা বলে আইন প্রণয়ন করা হলেও এর অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : ‘মৌলিক অধিকার’ নামে স্বীকৃত অধিকারগুলোর উপর হস্তক্ষেপ, পুলিশের ক্ষমতা বৃদ্ধি, যে কোন ধরনের প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ যদি রাষ্ট্র সমর্থিত কোন কর্মসূচির সামনে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাহলে সেই ধরনের কর্মসূচিকে সন্ত্রাস হিসেবে আখ্যায়িত করা; যে কোন ব্যক্তি বা যে কোন ধরনের সংগঠনের তথ্য, তৎপরতা ও উদ্যোগের উপর রাষ্ট্রের খবরদারি ও জবরদস্তি বাড়ানো।  এসব আইনের ধারা উপধারা দেখলে অসুবিধা হয় না যে, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রসমূহ এখন আতঙ্কিত; এই আতঙ্ক যেমন বাইরে থেকে আক্রমণের, তেমনি ভেতর থেকে আঘাতের। আর এর আরেকটি দিক হলো, নতুন পর্যায়ে যখন প্রধানত ভেতর থেকেই নতুন বিপ্লবী রাজনীতির উত্থানের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠছে তখন ‘উদারনৈতিক’ রাষ্ট্রগুলোর ফ্যাসিবাদী রূপের প্রকাশও স্পষ্ট হচ্ছে। 

বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ‘সন্ত্রাস’ এর কথা বলে আইন প্রণয়ন করা হলেও এর অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : ‘মৌলিক অধিকার’ নামে স্বীকৃত অধিকারগুলোর উপর হস্তক্ষেপ, পুলিশের ক্ষমতা বৃদ্ধি, যে কোন ধরনের প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ যদি রাষ্ট্র সমর্থিত কোন কর্মসূচির সামনে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাহলে সেই ধরনের কর্মসূচিকে সন্ত্রাস হিসেবে আখ্যায়িত করা; যে কোন ব্যক্তি বা যে কোন ধরনের সংগঠনের তথ্য, তৎপরতা ও উদ্যোগের উপর রাষ্ট্রের খবরদারি ও জবরদস্তি বাড়ানো।

অন্যদিক থেকেও ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রসহ সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্র দেশগুলোকে বড় একটি ফুরসৎ দিয়েছে, আরাম দিয়েছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে মন্দাকে যুক্তিযুক্ত করা ও এর অজুহাতে জনগণের বিপুল পরিমাণ করের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ সামরিক ও সম্পর্কিত খাতগুলোতে খরচ করার এ সুযোগ এসেছে এখান থেকেই। 

দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দিক থেকে ক্রমবিস্তারমান সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ-বিশ্বায়ন বিরোধী আন্দোলন এবং তার শক্তিবৃদ্ধিকে ঠেকানোর জন্য ‘জোরদার’ কিছু ইস্যু এর মাধ্যমে হস্তগত হয়েছে। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যেখানে জাতীয় ঐক্য দরকার,’ ‘সভ্যতার উপর আক্রমণ যেখানে ঠেকানো দরকার’, ‘গণতন্ত্রকে যেখানে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার’ সেখানে এসব আন্দোলন ‘সন্ত্রাসের পক্ষে, সভ্যতার বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে’ই ভূমিকা পালন করবে-এ ধরনের বক্তব্য বহুভাবে বহুঢঙে এখন বিভিন্ন আলোচনায়, সংবাদ বিশ্লেষণ বিশেষজ্ঞের মতামতের মধ্যে আসছে। যুদ্ধোন্মাদনা তৈরির প্রচার আগ্রাসনে বিপর্যস্ত জনগণের মধ্যে এর প্রভাবও যে পড়বে তাতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। 

তৃতীয়ত, বিভিন্ন দেশে যেখানে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে, বহুজাতিক সংস্থাসমূহের লুণ্ঠন তৎপরতার বিরুদ্ধে আন্দোলন বিক্ষোভ সংঘটিত হচ্ছে বা হবার সম্ভাবনা আছে সেখানে সন্ত্রাস দমন এর নামে আগের চাইতে অধিকতর ‘বৈধ’ বিধিমালার সাহায্যে নির্যাতন দমন পীড়ন চালানো সম্ভব। সন্ত্রাস দমনের আন্তর্জাতিক উদ্যোগের অর্থ হল দেশে দেশে এসব কাজ অধিকতর এবং আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের মাধ্যমে হবে। সে জন্যই আফগানিস্তানে মার্কিনি সামরিক আগ্রাসনের জন্য, ‘সন্ত্রাসী বিরোধী’ যে গ্লোবাল কোয়ালিশন গঠিত হয়েছে সেটি বস্তুত পক্ষে সারা বিশ্বের জনগণের সংগ্রাম, সংগঠনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের শাসক শ্রেণীর আনুষ্ঠানিক সন্ত্রাসী ঐক্য। জনগণের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক সুসংগঠিত সন্ত্রাস পরিচালনার সাংগঠনিক কাঠামো। এর ফলে দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক লড়াই এর উপর চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে, বৈশ্বিক সমন্বিত আক্রমণের ফলে সাময়িকভাবে এর মোকাবিলা তুলনামূলকভাবে কঠিন হতে পারে। 

এক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে কোন রকম মোহ থাকা বিভ্রান্তিকর। আগেই বলেছি যে, জাতিসংঘ এখন যে ভূমিকা পালন করছে, তার সঙ্গে, বোঝার সুবিধার জন্য, তুলনা করা যায় বাংলাদেশের মত দেশগুলোর পুলিশ-এর। পুলিশ-এর যেমন কাগজেপত্রে যাই থাক কার্যকর ভূমিকা বড় দুর্বৃত্ত-অপরাধী-সন্ত্রাসীর পক্ষে; জাতিসংঘের ভূমিকাও, বলাই বাহুল্য, বিশ্বের বড় সন্ত্রাসী, ক্ষমতাবান দুর্বৃত্ত দখলদারদের পক্ষেই। 

যাইহোক, ২৯-৩০ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ সভা স্থগিত হয়ে যাওয়ায় এর বিরোধী বিশাল সমাবেশও শেষ পর্যন্ত হতে পারেনি। কিন্তু সংগঠনসমূহ ও উদ্যোগীরা ঐদিনের ওয়াশিংটনে সমবেত হওয়ার কর্মসূচি বাতিল করেননি। সেই সমাবেশ শেষ পর্যন্ত পরিণত হয়েছে যুদ্ধ বিরোধী সমাবেশ ও মিছিলে। শুধু ওয়াশিংটনেই নয় যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বহু দেশেই তখন যুদ্ধ বিরোধী মিছিল সমাবেশ হয়েছে। এসব মিছিল সমাবেশ যেগুলো বিভিন্ন মার্কসবাদী বা বিভিন্ন ধরনের বিপ্লবীদের উদ্যোগে  সংগঠিত, মুসলিম-আরব-এশীয় সংখ্যালঘুর বড় ভরসার স্থল হয়ে দাঁড়ায়।  

আফগানিস্তান দখল : মুজাহেদিন সহযোগে বিশ্ব সন্ত্রাসীদের উৎসব

২০০১  সালের ২২ ডিসেম্বর জার্মানিতে বিশ্ব সন্ত্রাসী কোয়ালিশনের সদস্যদের সভায় আফগানিস্তানের ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার গঠন করা হয়েছে। এই ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারের মূল অংশ মুজাহেদিনরা যারা তখন ‘নর্দার্ন এলায়েন্স’ নামের জোটের মাধ্যমে কাজ করে। এই মুজাহেদিনরা মার্কিনি প্রত্যক্ষ সমর্থনে আফগানিস্তানে একবার ক্ষমতায় এসেছিল এর দশ বছর আগে, এরপর মার্কিন সমর্থনপুষ্ট তালিবানদের দ্বারা উৎখাত হয়েছিল পরে আবার মার্কিনি এবং তার সহযোগী বিশ্ব কোয়ালিশনের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে ‘সন্ত্রাস দমন করে গণতান্ত্রিক আফগানিস্তান গঠনের কর্মসূচি’ হিসেবে।

আফগানিস্তানের নারী সংগঠন রাওয়া (RAWA) তাঁদের বিবৃতিতে নারী বিদ্বেষী খুনী, নির্যাতক হিসেবে এদেরকে অভিহিত করেছে। হত্যা, ধ্বংস ছাড়াও তাদের ভয়াবহ নির্যাতন নিপীড়নের বহু উদাহরণ তাঁরা উপস্থিত করেছেন। তালিবানদের বিরুদ্ধেও তাঁরা নারী প্রশ্নে লড়াই করছিলেন।

এই জোটের অন্তর্ভুক্ত দলগুলো হচ্ছে: বোরহান উদ্দীন রব্বানী ও আহমদ শাহ মাসুদ নেতৃত্বাধীন জামাতে ইসলামী। দু’নেতাই জাতিগতভাবে তাজিক। মোহাম্মদ করিম খালিলি নেতৃত্বাধীন হিজবি ওয়াহদাত, এটি প্রধানত শিয়া মতাবলম্বীদের দল। জাতিগতভাবে হাজারাদের মধ্যে এর প্রভাব বেশি। উজবেকদের নিয়ে গঠিত জানবিশ ইসলামী দল। এর নেতৃত্বে আছেন আহমদ রশিদ দোস্তম। হরকাত-ই ইসলাম, যাদের মধ্যে হাজারা জাতিবহির্ভূত শিয়াদের অংশগ্রহণ বেশি। ইত্তেহাদে ইসলাম যার নেতৃত্বে আছেন আব্দুল রসুল সায়াফ। ১৯৯৬-এ পশতুন জাতি প্রভাবিত তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণের পর এই জোট ইরান ও রাশিয়া থেকে সমর্থন পেয়েছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর এটি মার্কিনি সমর্থন পেয়ে দ্রুত ক্ষমতা দখলে অংশ নেয়। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সময়কালে মুজাহেদিনদের ক্ষমতাসীন অবস্থায় খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, বিচারের নামে প্রহসনসহ বিভিন্ন নিপীড়ন ধ্বংসের অভিযোগ অসংখ্য। আফগানিস্তানের নারী সংগঠন রাওয়া (RAWA) তাঁদের বিবৃতিতে নারী বিদ্বেষী খুনী, নির্যাতক হিসেবে এদেরকে অভিহিত করেছে। হত্যা, ধ্বংস ছাড়াও তাদের ভয়াবহ নির্যাতন নিপীড়নের বহু উদাহরণ তাঁরা উপস্থিত করেছেন। তালিবানদের বিরুদ্ধেও তাঁরা নারী প্রশ্নে লড়াই করছিলেন। কিন্তু তালিবানদের হটিয়ে মুজাহেদিনদের নিয়ে আসার মার্কিনি খেলার বিরোধিতা করে তাঁরা বলেছেন, কেবলমাত্র আফগান জনগনের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই জনগণের এবং নারীর মুক্তির পথ সৃষ্টি সম্ভব।

সরকারে তখন মুজাহেদিনরা আছেন, আছেন রোমে নির্বাসিত প্রাক্তন বাদশাহ জহির শাহ্র-র প্রতিনিধি। সরকারে যারাই থাকুক এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হবার কথা নয় যে, আফগানিস্তান শাসন কিংবা পরিচালনায় এই সরকারের নীতি নির্ধারণী ভূমিকা  গৌণ। আফগানিস্তানের কর্তৃত্ব, তাদের মাধ্যমে হলেও, কার্যত আফগানিস্তানের বাইরের শক্তিগুলোর হাতে। কিন্তু সেখানেও যে স্থিতিশীল একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে তা নয়। আফগানিস্তান বাস্তবে এখন একটি আহত বন্দি কোন প্রাণীর মতো যার চারপাশে মাংশাসী জন্তু উন্মত্ত। কে বড় ভাগ পাবে কিংবা বহু শকুন বা শিয়ালের ঘেরাও অবস্থায় মৃত প্রাণীর মতো। একই সঙ্গে ক্ষিপ্ত প্রতিযোগিতা এবং উন্মুক্ত উৎসব।

আফগানিস্তান বাস্তবে এখন একটি আহত বন্দি কোন প্রাণীর মতো যার চারপাশে মাংশাসী জন্তু উন্মত্ত। কে বড় ভাগ পাবে কিংবা বহু শকুন বা শিয়ালের ঘেরাও অবস্থায় মৃত প্রাণীর মতো। একই সঙ্গে ক্ষিপ্ত প্রতিযোগিতা এবং উন্মুক্ত উৎসব। 

এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই এখানে প্রধান বিজয়ী শক্তি। জাতিসংঘ শান্তিবাহিনী, উপদেষ্টা কমিটি, উন্নয়ন সম্মেলন, বিদেশী সাহায্য ইত্যাদির পেছনে মূল কলকাঠি মার্কিনি প্রশাসন ও ইউনোক্যালসহ বহুজাতিক সংস্থাসমূহের। কিন্তু ইতিহাসে আফগানিস্তান কখনোই একটি নির্দিষ্ট বৈদেশিক শক্তির করতলগত হয়নি। এই না হবার পেছনে অভ্যন্তর থেকে জনগণের প্রতিরোধ যেমন ক্রিয়াশীল ছিল তেমনি একের অধিক শক্তিশালী ভাগীদার থাকাও ছিল এর অন্যতম কারণ। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে জাতিগত বিভেদ সবসময়ই আফগানিস্তানকে খণ্ড খণ্ড ভাগে বিভক্ত করে রেখেছে। 

মুজাহেদিনদের ক্ষমতা গ্রহণের পর গত দশ বছর ‘কড়া’ ইসলামি গ্রুপগুলোর হাতেই আফগানিস্তান ‘শাসিত’ (কিংবা বিপর্যস্ত) হয়েছে। কিন্তু কোন গ্রুপ বা গ্রুপের সমষ্টি আফগানিস্তানে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ১৯৯২ সালে ‘ইসলামিক স্টেট অব আফগানিস্তান’ প্রতিষ্ঠার পর মুজাহেদিনদের বিভিন্ন গ্রুপে সংঘাত শুরু হয়। সেই সংঘাত ছিল অবিরাম এবং রক্তক্ষয়ী। সংঘাত-যুদ্ধ-হত্যা নৃশংসতা ধর্মীয় গ্রুপগুলোর মধ্যেই সীমিত ছিল, কেননা সংস্কারপন্থী গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ আগেই বিপর্যস্ত, উৎপাটিত কিংবা নির্বাসিত হয়েছিল। এই হত্যা-ধ্বংস-নৃশংসতায় অস্ত্রের যোগানে কোন সমস্যা হয়নি। চোরাচালান, আফিম উৎপাদন ও পাচার ইত্যাদিরও কোন বিঘœ সৃষ্টি হয়নি। এগুলোর আরও সুবিধা হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার ফলে। তাতে করে আফগানিস্তানের সবগুলো সীমান্তই এসব পণ্যের বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। পশ্চিমের হিরোইন বাণিজ্যের তিন চতুর্থাংশের যোগান আফগানিস্তান থেকেই হতে থাকে।

মুজাহেদিনরা প্রধানত মার্কিনি সন্তান হলেও তাদের মধ্যে ইরানের সমর্থকও ছিল। বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে যে সংঘাত তাতে সুন্নি-শিয়া বিরোধ খুব কাজ করেনি। শিয়া জনসংখ্যা আফগানিস্তানে শতকরা ১৫ ভাগেরও কম। প্রধানত শিয়া অধ্যুষিত ইরানের ইসলামী শাসন এখানে মতাদর্শিক প্রভাব ফেলতে পেরেছে কমই। মুজাহেদিনদের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলছিল বছরের পর বছর তার পেছনে ইসলামের ব্যাখ্যা নিয়ে তফাৎ কিংবা বিভিন্ন লাইনের পার্থক্যের ভূমিকা ছিল কম। যেসব উপাদান এই সংঘাতকে জারি রেখেছে তার মধ্যে প্রধানত ১. জাতিগত পার্থক্য ২. আঞ্চলিক আধিপত্য ৩. পুরনো সামন্ত প্রভুদের কর্তৃত্ব রক্ষার চেষ্টা এবং ৪. বহিঃস্থ বিভিন্ন শক্তির ক্রিয়া। 

১৯৯২ এর পর রক্তক্ষয়ী অবিরাম সংঘাতের সময়কালে মার্কিনি বিভিন্ন সংস্থা এখানে সক্রিয় ছিল, ছিল তার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান। ছিল একদিকে সৌদি আরব, অন্যদিকে ইরান। রাশিয়া নতুন কাঠামোতে এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছিল; সীমান্তবর্তী নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরঘিজস্তানের ভূমিকাও সেই সঙ্গে সক্রিয় হচ্ছিল। বিভিন্ন গ্রুপের সংঘাত অব্যাহত থাকার এক পর্যায়ে মার্কিনি-পাকিস্তানি-সৌদি ছকের অধীনে তালিবানদের উদ্ভব ঘটলো। তালিবানদের অধীনে মুজাহেদিনদের ‘ইসলামিক স্টেট অব আফগানিস্তান’ পরিণত হলো ‘ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান’-এ। মুজাহেদিনরা উৎখাত হল ক্ষমতা থেকে কিন্তু তাদের প্রতিরোধ অব্যাহত থাকলো ইউনাইটেড ফ্রন্টের মাধ্যমে। এই ফ্রন্টে আগের বিবদমান গ্রুপগুলো ঐক্যবদ্ধ হলো এবং তালিবানদের বিরুদ্ধে তাঁদের নতুন লড়াই শুরু হলো। এই লড়াই-এর পেছনেও কোন ইসলাম ব্যাখ্যার তফাৎ কিংবা শাসন পদ্ধতির তফাৎ মুখ্য ভূমিকা পালন করেনি। তালিবানদের শাসনামলে রাষ্ট্র বাদ দিয়ে আমিরাত ঘোষণা এবং ইসলামী শাসনের বর্তমান বিশ্বে অতুলনীয় অসহিষ্ণু নির্দয় কঠোর রূপ তারা প্রয়োগ করলেও বিরোধ এটা নিয়ে নয়। প্রধানত বিরোধ এখানেও জাতিগত। তালিবানরা প্রধানত পশতুন, তালিবান বিরোধীরা প্রধানত তাজিক। এছাড়াও অঞ্চলের কর্তৃত্বের বিষয়টিও ছিল। এখানেও বহিঃস্থ শক্তির ভূমিকা আগের পর্বের চাইতে অধিকতর কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। তালিবানদের অস্ত্র যোগান, তহবিল যোগান, বুদ্ধি যোগান সবই এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, তার সঙ্গে ছিল পাকিস্তান ও সৌদি আরব। অন্যদিকে মুজাহেদিনদের অস্ত্র অর্থ বুদ্ধি যোগান এসেছে ইরান ও রাশিয়া থেকে। ১৯৯৮ এর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র মুজাহেদিনদের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক স্থাপনে মনোযোগী হয়। এবং ঘটনাক্রমে প্রধানত মার্কিনি ভূমিকার মধ্য দিয়েই তালিবানদের উচ্ছেদ করে মুজাহেদিনদের আবার ক্ষমতায় আরোহণ ঘটে।

এই পালাবদলের রক্তাক্ত ‘খেলায়’ বহিঃস্থ শক্তিগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইরান, সৌদি আরব তার নিজ নিজ অবস্থান রক্ষা করতে সচেষ্ট থেকেছে।২৮  কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের খেলার গুটি হিসেবে বরাবরের মতো কাজ করতে গিয়ে এবং স্থানীয়ভাবে আফগানিস্তানে নিজেদের বাণিজ্যিক-রাজনৈতিক প্রভাব বলয় তৈরি করবার নানা খেলায় প্রবেশ করে এরপর সবচাইতে কোণঠাসা অবস্থার মধ্যে পড়েছে পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে মুজাহেদিনদের সমর্থন এবং পরে তালিবানদের সমর্থনে পাকিস্তান সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। আবার যুক্তরাষ্ট্র যখন তালিবানদের উচ্ছেদ কর্মসূচি নেয় তখনও পাকিস্তান সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। কিন্তু মুজাহেদীন সরকার তালিবানদের প্রতি পূর্ব সমর্থনের কারণে পাকিস্তানের প্রতি বৈরী, ভারতের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। ইরানের সঙ্গেও তার সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে ঘনিষ্ঠ। 

এখানে আরও উল্লেখ্য যে, বর্তমান বৈশ্বিক কাঠামোয় বহুজাতিক সংস্থাগুলোর দক্ষিণ এশিয়ায় বিনিয়োগ পরিকল্পনায় ভারত হচ্ছে কেন্দ্র। সুতরাং পশ্চিমের পুরনো ভারত বিরোধী অবস্থান এখন পরিবর্তিত।২৯  ভারতের সাথে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্র এই অঞ্চলে তার কার্যক্রম সম্প্রসারণ করছে। এই ভারতও এখন আফগানিস্তানের অন্যতম ভাগীদার। পাকিস্তান বরঞ্চ দুই বৈরী শক্তির মাঝখানে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অপেক্ষায়।

আফগানিস্তানের সম্পদ দখলের এবং সেখানে স্থায়ী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দাবিদার তাই অনেকে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রিক বহুজাতিক সংস্থাসমূহ প্রধান, এরপরে আছে বৃটেন এবং ইউরোপীয় অন্যান্য দেশ। এখানে রাশিয়া পক্ষ হিসেবে বিশেষ দাবিদার, তার পাশাপাশি ইরান। চীন এযাবত আফগানিস্তান নিয়ে বিশেষ কোন ভূমিকা পালন না করলেও এরপর তারও সক্রিয়তা বাড়বে বলে ধারণা করা যায়। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা বিভিন্ন ভাগীদারদের সমন্বয় করবার কাজেই নিয়োজিত। তবে এশীয় ও পুরনো সোভিয়েত ভাগীদারদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপীয় ভাগীদারদের দ্বন্দ্ব সংঘাত খুবই সম্ভব।

আফগানিস্তানের সম্পদ দখলের এবং সেখানে স্থায়ী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দাবিদার তাই অনেকে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রিক বহুজাতিক সংস্থাসমূহ প্রধান, এরপরে আছে বৃটেন এবং ইউরোপীয় অন্যান্য দেশ। এখানে রাশিয়া পক্ষ হিসেবে বিশেষ দাবিদার, তার পাশাপাশি ইরান। চীন এযাবত আফগানিস্তান নিয়ে বিশেষ কোন ভূমিকা পালন না করলেও এরপর তারও সক্রিয়তা বাড়বে বলে ধারণা করা যায়। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা বিভিন্ন ভাগীদারদের সমন্বয় করবার কাজেই নিয়োজিত। তবে এশীয় ও পুরনো সোভিয়েত ভাগীদারদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপীয় ভাগীদারদের দ্বন্দ্ব সংঘাত খুবই সম্ভব।

আফগানিস্তান নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মধ্যে মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়া গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই সমগ্র অঞ্চল নিয়ে বিবিধ পরিকল্পনায় দখল বিনিয়োগের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে আছে সামরিক তৎপরতা। বহুজাতিক নামের আড়ালে মার্কিনি নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধির লক্ষণ স্থলভূমি থেকে জলভূমি পর্যন্ত এখনই স্পষ্ট। বাংলাদেশে আমরা মার্কিন সেই সঙ্গে ভারতীয় সামরিক তৎপরতা এবং ইউনোক্যাল সহ মার্কিন কেন্দ্রিক বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলোর যে আগ্রাসী ভূমিকা দেখছি তা শুধু বাংলাদেশের ব্যাপার নয়। আফগানিস্তান পর্যন্ত পুরো অঞ্চলে একই তৎপরতা সামনে আরও বৃদ্ধি পাবে। 

একদিকে প্রেসিডেন্ট বুশ ক্রুসেড এর ডাক দিয়ে ইউরো মার্কিন খ্রিস্টীয়-ইহুদি জনগণকে পেছনে আনার চেষ্টা করলেও অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য রক্ষা ও তা শক্তিশালী করবার প্রয়োজনে আগের ধারাবাহিকতায় ইসলামপন্থী গ্রুপ তোষণে (প্রতিষ্ঠান স্থাপন, বরাদ্দ বৃদ্ধি) মার্কিনি ভূমিকাও সামনে আরও বাড়বে। আমরা এর ফলে ইসলামী গবেষণা, এনজিও প্রকাশনাসহ তৎপরতার বিস্তার সামনে দেখবো যার মূল পৃষ্ঠপোষকতা আসবে পশ্চিম থেকেই। 

এমনিতে ওসামা বিন লাদেন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে মুসলমানদের জেহাদে আহ্বান করলেও লিবিয়া, ইরান, ইরাক, সুদান বাদে পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ সকল মুসলিম প্রধান দেশের সরকার যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেই দাঁড়িয়েছে। এই দাঁড়ানোকে ‘ইসলামের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা’ কিংবা ‘খ্রিস্টানদের দালালি’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায় না। এটি আসলে সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্রের সঙ্গে প্রান্তস্থ দেশগুলোর শাসক শ্রেণীর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। মুসলিম প্রধান দেশগুলোর প্রায় সবগুলোই ‘তৃতীয়’ বিশ্বভুক্ত দেশ। এসব দেশের জনগণের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই, তার শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই এর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবেই অগ্রসর হয়। কোথাও কোথাও এই লড়াই এ ইসলামী সংগঠনের ভূমিকা দেখা গেলেও তা কোন কার্যকর ধারা হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। ইরান শিয়া প্রধান হবার কারণে সুন্নী প্রধান বিশ্বে ইরান বিপ্লবের প্রভাব খুবই কম। উপরন্তু ইরান ভিন্ন অন্যত্র ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী,’ ‘শোষণ বিরোধী’ লড়াই এর একটি তাত্ত্বিক কাঠামো দিতে ইসলামি কোন সংগঠন এখনও সক্ষম হয়নি। 

বরঞ্চ মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, নিপীড়ক, জালেমরাই তুলনামূলকভাবে ইসলামকে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে অনেক বেশি। বাংলাদেশে এর ভয়াবহ চেহারা আমরা দেখেছি ১৯৭১ সালে। তখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা, ধর্ষণ পরিচালনা করেছে। আর এই কাজে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মূল ভরসা ছিল তৎকালীন ইসলামপন্থী দলগুলো। মুসলিম জনগণ যখন ভয়াবহ আক্রমণের শিকার এবং লড়াই করছেন পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে তখন ধর্মীয় নেতারা পাক মার্কিন অনুচর হিসেবে কাজ করেছেন, ঘাতক দালাল হিসেবে সক্রিয় থেকেছেন।

বাংলাদেশে ব্রিটিশ পরবর্তী সময়কালে ইসলামি দলগুলোর উল্লেখ করবার মতো কোন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূমিকা দেখা যায়নি। তবে ইসলামের শোষণ পীড়ন বিরোধী ব্যাখ্যা নিয়ে বাংলাদেশের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিলেন মওলানা ভাসানী। ইসলামি দলগুলো তাঁকে বরাবর ‘ইসলামের দুশমন’ হিসেবে বিবেচনা করেছে।

বাংলাদেশে ব্রিটিশ পরবর্তী সময়কালে ইসলামি দলগুলোর উল্লেখ করবার মতো কোন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূমিকা দেখা যায়নি। তবে ইসলামের শোষণ পীড়ন বিরোধী ব্যাখ্যা নিয়ে বাংলাদেশের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিলেন মওলানা ভাসানী। ইসলামি দলগুলো তাঁকে বরাবর ‘ইসলামের দুশমন’ হিসেবে বিবেচনা করেছে।

ইরাকে মার্কিনি হামলার পর থেকে মার্কিনি বিভিন্ন আগ্রাসী ভূমিকার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ইসলামী বিভিন্ন দল প্রতিবাদ করেছে, আফগানিস্তানে হামলার সময়ও। কিন্তু এসব প্রতিবাদ মুসলিম দেশে সামরিক হামলার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ এর বেশি কিছু দাঁড়ায়নি। সাম্রাজ্যবাদ তো কেবল সামরিক হামলা নয়, সাম্রাজ্যবাদ কেবল এক/দুই রাষ্ট্রে সীমাবদ্ধ নয়। সে জন্য বোমা হামলার বিরোধিতাই বর্তমান সময়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের শর্ত পূরণ করে না। এর জন্য সাম্রাজ্যবাদের মতাদর্শিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক আধিপত্য বিরোধী যে অবস্থান গ্রহণ দরকার তা দৃশ্যমান ইসলামি সংগঠনগুলো পূরণ করতে সক্ষম নয়। 

আফগান জনগণের লড়াই কীভাবে আমাদেরও?

আফগানিস্তান নাম বললেই একটি দুর্গম গিরি-র কথা মনে হয়। প্রকৃতই তাই। পাহাড়, দুর্গম রাস্তা, পানি-বাসস্থান-যোগাযোগের খুবই কষ্টকর ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়েই আফগানিস্তান। জনগণের জীবন তাই আমাদের তুলনায় অনেক বেশি কঠিন সে দেশে। কিন্তু বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে জীবন এমন কঠিন থাকার কথা নয়। আফগানিস্তানের জনগণ বরঞ্চ শতকরা ১২ ভাগ আবাদী জমি নিয়েও স্বচ্ছন্দে একটি সুন্দর সুস্থ নিরাপদ জীবন পেতে পারেন। আফগানিস্তানের বিপুল সম্পদ আছে, পরিশ্রমী জনগণের বিপুল প্রাণশক্তি আছে। ভৌগলিক দিক থেকেও আফগানিস্তান এমন জায়গায় অবস্থিত যাতে ইউরোপ ও এশিয়া দুদিকের সঙ্গেই তার যোগাযোগ রাখা সম্ভব। অর্থনৈতিক মানবিক। 

আফগানিস্তান নাম বললেই একটি দুর্গম গিরি-র কথা মনে হয়। প্রকৃতই তাই। পাহাড়, দুর্গম রাস্তা, পানি-বাসস্থান-যোগাযোগের খুবই কষ্টকর ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়েই আফগানিস্তান। জনগণের জীবন তাই আমাদের তুলনায় অনেক বেশি কঠিন সে দেশে। কিন্তু বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে জীবন এমন কঠিন থাকার কথা নয়। আফগানিস্তানের জনগণ বরঞ্চ শতকরা ১২ ভাগ আবাদী জমি নিয়েও স্বচ্ছন্দে একটি সুন্দর সুস্থ নিরাপদ জীবন পেতে পারেন। আফগানিস্তানের বিপুল সম্পদ আছে, পরিশ্রমী জনগণের বিপুল প্রাণশক্তি আছে। ভৌগলিক দিক থেকেও আফগানিস্তান এমন জায়গায় অবস্থিত যাতে ইউরোপ ও এশিয়া দুদিকের সঙ্গেই তার যোগাযোগ রাখা সম্ভব। অর্থনৈতিক মানবিক।

সম্রাট বাবর কাবুল হয়ে ভারতে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেও কাবুলেই কবরের আকাঙ্খা প্রকাশ করেছেন। কাবুল যে সেই সময়ের ব্যাপক অঞ্চলের বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র ছিল তার স্বাক্ষর তাঁর জীবনী। তাঁর জীবনী থেকে তৎকালীন কাবুলে বাণিজ্যে কত ভাষার মানুষ সমবেত হতেন তার পরিচয় পাওয়া যায়। সে এক বিশাল সমাবেশ। 

এর আগে সুলতান মাহমুদের শাসনের সময়ে আফগানিস্তান পেয়েছে আল বেরুণীকে। ভারতবর্ষের সংক্ষিপ্ত বিশ্বকোষ তিনিই লিখেছিলেন। আফগানিস্তান যেমন একদিকে অসাধারণ সৃষ্টির ইতিহাস তৈরি করেছে, তেমনি ধ্বংসের ইতিহাসও তার সঙ্গী। এদেশে বর্ণপ্রথা টিকতে পারেনি, একই কারণে বৌদ্ধ ধর্ম পুরো দেশে প্রথম সুযোগেই আধিপত্য বিস্তার করেছে। বামিয়ানে বিশাল বুদ্ধ মূর্তি এবং বৌদ্ধ বিহারের জ্ঞান বিজ্ঞানের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা তারই চিহ্ন। চিহ্ন ছিল, কেননা তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে তালিবান আমলের শেষ দিকে। আগেও বারবার বহিঃস্থ শাসকদের আক্রমণে আফগানিস্তানের অনেক সৃষ্টি ধ্বংস হয়েছে। মানুষ বিপর্যস্ত হয়েছেন। জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসার যেমন হয়েছে তেমনি তাকে অবরুদ্ধ করবার চাপও তৈরি হয়েছে এখানে।

ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বিস্তারের পর থেকেই আফগানিস্তানের সকল সৃজনশীলতার উপর বড় পাথর চাপা পড়ে। কেন, তার বিশ্লেষণ আমি আগেই করেছি। সর্বশেষ ধ্বংসযজ্ঞ, গত দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে, সেখানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়েছে। যে ভৌগলিক অবস্থান আফগানিস্তানকে এক সময়ে জ্ঞান বিজ্ঞান, শিল্প সাহিত্য এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত করেছিল সেই ভৌগলিক অবস্থানের কারণেই আফগানিস্তান বারবার বহিঃস্থ আক্রমণের শিকার হয়েছে। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে এবং তার সম্পদের কারণে সকল ক্ষমতাবান প্রভুর শ্যেনদৃষ্টির শিকার হতে হতে আফগানিস্তান অবশেষে ‘কোয়ালিশন’ নামক নয়া বিশ্বসন্ত্রাসী ঔপনিবেশিক শক্তির অধিকৃত হলো।

আফগানিস্তানের সম্পদ আফগান জনগণের জীবন থেকে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, শীত, আশ্রয়হীনতা দূর করতে সক্ষম; সক্ষম শিক্ষা-স্বাস্থ্য অবসর নিশ্চিত করতে। সেই সম্পদই তাঁদের জন্য কাল হয়েছে। জনগণের সম্পদের উপর কর্তৃত্ব জনগণের না থাকলে, রাজনৈতিক ক্ষমতা জনগণের হাতে না থাকলে সম্পদ কিভাবে বিপদের কারণ হয় তা এখন বাংলাদেশে আমরা ভালভাবেই টের পাওয়া শুরু করেছি। আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা আরও বহু দেশ একই অভিজ্ঞতার অংশীদার। 

বর্তমান কালে পুরনো ঔপনিবেশিক আমলের মতো কোন দেশ দখল করা সাম্রাজ্যবাদের বর্তমান যে রূপ তাতে অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় পরিপূর্ণ দখলের রূপটি কি হতে পারে আফগানিস্তান তার একটি মডেল উপস্থিত করলো। এখন পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার সকল ‘উন্নয়ন সংস্থা’, বহুজাতিক সংস্থা, মাফিয়া সংস্থা, একচেটিয়া ব্যাংক, সামরিক বাহিনী আফগানিস্তানের সম্পদ, নারী-পুরষ-শিশু-প্রতিষ্ঠান মাটি-পানির উপর দখল বিস্তারের কাজে নিয়োজিত। তাদের সহযোগী আফগান মুজাহেদিনরা আর রাজতন্ত্রের প্রতিনিধি।   

আফগানিস্তানের জনগণ গত কয়েক দশক ধরে মার্কিনি ছকে সে অঞ্চলকে সাজানোর রক্তাক্ত খেলার শিকার হয়েছেন। এর শেষ পর্যায়ে এসে তাঁরা সরাসরি মার্কিন গণহত্যার- বোমাবর্ষণের দ্বারা বিধ্বস্ত হয়েছেন। এই পুরো সময়কালে মার্কিন সমর্থিত বিভিন্ন গ্রুপ ইসলামের নামে জনগণকে তাদের জীবন-জীবিকা, স্বপ্ন-সম্ভাবনা, ঘর-বাহির, সর্বক্ষেত্রে দেয়ালের সাথে ঠেকিয়েছে। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সকলেই নির্মম বর্তমানের ভেতর যেন কোন সুস্থ ভবিষ্যত দেখার আশা হারিয়েছেন। পক্ষ-বিপক্ষ, শত্রু-মিত্র, বর্তমান-ভবিষ্যত, ভালো-মন্দ, ইহকাল-পরকাল সবকিছু গুলিয়ে চরম বিভ্রান্ত অবস্থার মধ্যে যেন পতিত আফগান জনগণ। অধিকাংশ পরিবারের কিশোর-তরুণ-মধ্যবয়সী পুরুষ কোন না কোন পক্ষে থাকার কারণে নিহত, নিখোঁজ বা পঙ্গু। নারীর হাত পা অচল। শিশু মূক। ২২ বছরে প্রায় ২২ লাখ মানুষ মরেছেন এই উপত্যকায়। লাখ লাখ মানুষ মার্কিনি বোমাবর্ষণের আগেই মৃত্যুর মুখে ছিলেন এখন তাদের সংখ্যা আরও বেশি। 

এই পুরো সময়কালে মার্কিন সমর্থিত বিভিন্ন গ্রুপ ইসলামের নামে জনগণকে তাদের জীবন-জীবিকা, স্বপ্ন-সম্ভাবনা, ঘর-বাহির, সর্বক্ষেত্রে দেয়ালের সাথে ঠেকিয়েছে। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সকলেই নির্মম বর্তমানের ভেতর যেন কোন সুস্থ ভবিষ্যত দেখার আশা হারিয়েছেন। পক্ষ-বিপক্ষ, শত্রু-মিত্র, বর্তমান-ভবিষ্যত, ভালো-মন্দ, ইহকাল-পরকাল সবকিছু গুলিয়ে চরম বিভ্রান্ত অবস্থার মধ্যে যেন পতিত আফগান জনগণ। অধিকাংশ পরিবারের কিশোর-তরুণ-মধ্যবয়সী পুরুষ কোন না কোন পক্ষে থাকার কারণে নিহত, নিখোঁজ বা পঙ্গু। নারীর হাত পা অচল। শিশু মূক। ২২ বছরে প্রায় ২২ লাখ মানুষ মরেছেন এই উপত্যকায়। লাখ লাখ মানুষ মার্কিনি বোমাবর্ষণের আগেই মৃত্যুর মুখে ছিলেন এখন তাদের সংখ্যা আরও বেশি। 

এতদিনের এই নির্মম সাম্রাজ্যবাদী খেলার শেষে এসে আফগানিস্তানে পেছনের সকল শক্তি এখন সামনে, টেবিলে। এই দেশ স্পষ্টতই এখন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ করতলগত। আন্তর্জাতিক বহুজাতিক সংস্থা, উন্নয়ন সংস্থা, এনজিও, গবেষক, কনসালট্যান্ট সকলেই দারিদ্র্য বাণিজ্য থেকে সম্পদ দখল সর্বত্রই বিশাল মুনাফার সম্ভাবনায় পুলকিত। বিভ্রান্ত, বন্দিত্বের-শৃঙ্খলের ঘায়ে ক্ষত-বিক্ষত জনগণ এখন ‘গণতন্ত্র,’ স্বাধীনতার কোলাহল শুনছেন।

আফগানিস্তান দখল এবং এই দেশ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের পরিকল্পনা-ছক বাস্তবায়ন মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে তাদের অর্থনৈতিক সামরিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও দ্রুততর ও জোরদার করবে। একই কারণে পুরো অঞ্চল জুড়ে মানুষের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম আরও অনেক বেশি পরস্পর প্রবিষ্ট এবং পরস্পর সম্পর্কিত হবে।

মধ্য এশিয়া থেকে মায়ানমার পর্যন্ত ইউনোক্যালের মতো বহুজাতিক সংস্থা কিংবা বিশ্বব্যাংক- এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এখন সহজতর। পাশাপাশি এই পুরো অঞ্চলের জনগণের সম্মিলিত উত্থানের বস্তুগত ভিত্তিও এর মধ্যে দিয়েই তৈরি হচ্ছে। এই উত্থানের অভিন্ন ভিত্তি নির্মিত হচ্ছে অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে অভিন্ন স্বার্থের জায়গা থেকে; সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক দেশী বিদেশী আধিপত্য থেকে মুক্তি, শ্রেণীগত-জাতিগত-ধর্মীয়-লিঙ্গীয় শোষণ নিপীড়ন থেকে মুক্তির বিষয়টি এখানে কেন্দ্রীয় প্রশ্ন।

এই মুক্তি সংগ্রামের কাজ এই অঞ্চলের দেশে দেশে সংগঠিত হবে পরস্পরকে শক্তিশালী করেই। আফগান জনগণের এখন সাম্রাজ্যবাদী ছকের মধ্যে পড়ে থাকার, ধর্ম সামনে রেখে প্রতারণার শিকার হবার এক পর্ব শেষ হয়েছে। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জনগণের সঙ্গে তার এখন ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ানো ছাড়া কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশে তার ক্ষেত্র শক্তিশালী করাই এখন আমাদের কর্তব্য।

এরকম বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে না দেবার জন্য নানারকম চেষ্টা আমরা এখন দেখবো। আমরা দেখবো ধর্মীয় কিংবা জাতিগত পরিচয়কে সামনে এনে জনগণের মধ্যে বিভক্তি এবং সংঘাত সৃষ্টি করতে। আমরা দেখবো বিদ্যমান ‘রাষ্ট্রগুলোর’ মধ্যে সংঘাত এবং তার সূত্র ধরে ‘জাতীয়তাবাদী’ শ্লোগানে জনগণের মধ্যে বিভক্তি আনার চেষ্টা।   

সাম্রাজ্যবাদী দখল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আফগান সমাজ অর্থনীতির বদলও ঘটবে অনেক। পুরনো সম্পর্ক এবং প্রতিষ্ঠানগুলো অটুট থাকার কোন সম্ভাবনা নেই, ক্ষমতার বিন্যাসেও পরিবর্তন ঘটবে। শ্রেণীর ভাঙন-গঠনও ঘটবে। এসব বদল যেমন শান্তিপূর্ণ হবে না, তেমনি পরিকল্পনামাফিকও ঘটবে না পুরোপুরি। আফগান জনগণ এর মধ্যে দিয়েই প্রবেশ করবেন মুক্তির সংগ্রামের নতুন পর্বে। অতি অবশ্যই এই পর্ব, এই লড়াই, আফগান জনগণের একক নয়, তা আমাদেরও।

তথ্যসূত্র:

১। রবীন্দ্রনাথঠাকুর : ‘কাবুলিওয়ালা’, গল্পগুচ্ছ।পাওনা টাকা পরিশোধ না করে মিথ্যা কথা বলায় ক্রুদ্ধ হয়ে যে রহমত ‘কাবুলিওয়ালা’ দেনাদার ব্যক্তির গায়ে ছুরি মেরে জেল খেটে এসেছে তাঁর আরেক পরিচয়, “… সে আপনার মস্ত ঢিলা জামাটার ভিতর হাত চালাইয়া দিয়া বুকের কাছে কোথা হইতে একটুকরা ময়লা কাগজ বাহির করিল। বহুযত্নে ভাঁজ খুলিয়া দুই হস্তে আমার টেবিলের উপর মেলিয়া ধরিল। দেখিলাম, কাগজের উপর একটি ছোট হাতের ছাপ।ফটোগ্রাফ নহে, তেলের ছবি নহে, হাতে খানিকটা ভূষা মাখাইয়া কাগজের উপরে তাহার চিহ্ন ধরিয়া লইয়াছে। কন্যার এই স্মরণ চিহ্নটুকু বুকের কাছে লইয়া রহমত প্রতিবৎসর কলিকাতার রাস্তায় মেওয়া বেচিতে আসে-যেন সেই সুকোমল ক্ষুদ্র শিশুহস্তটুকুর স্পর্শখানি তাহার বিরাট বিরহী বক্ষের মধ্যে সুধা সঞ্চার করিয়া রাখে।”

২। সৈয়দ মুজতবা আলী : দেশে বিদেশে, প্রথম প্রকাশ ১৩৫৬ (বাংলা), কলিকাতা।লেখকের শবনম উপন্যাসটিও ঐ সময়কে বুঝতে সাহায্য করে।

৩। S.J. Noumef : “The boomerang always returns”, Internet,  Doctor Zayar : Afghanistan-An Historical Overview, October 2001, Chronology of Afghan History (Internet), , “Terror Crisis in Context”, Monthly Review, November 2001.

৪। মোহসেন মাখমালবাফ : না শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ (অনুবাদ : মোস্তফা কাওসার), প্রথম আলো ২৩.১১.২০০১।মূল লেখা Limbs of No Body : The Afghan Tragedy (June 20, 2001), Monthly Review পূর্বোক্ত।

৫। এই চুক্তির বিরোধিতা করবার মধ্য দিয়ে ১৯৫৭ সাালে তৎকালীন পাকিস্তানে আওয়ামীলীগ দ্বিধাবিভক্ত হয় এবং মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন চুক্তিবিরোধী অংশ গঠন করে নতুন রাজনৈতিক দল, ন্যাপ।পরে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন চুক্তিপক্ষীয় অংশও পাকিস্তানের সরকারে ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। কালক্রমে সামরিক বাহিনী পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে।

৬। ইরানের ওপর সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ, শাহ আমলের নিষ্পেষণ ও প্রতিরেধের বিস্তৃত আলোচনার জন্য দেখুন, Soroosh Irfani : Revolutionary Islam in Iran, Popular liberation or Religious Dictatorship? Zed, 1983.

৭। Sayed Qasim Reshtya : The price of liberty : the tragedy of Afghanistan, 1984 Part I.

৮। সৈয়দ মুজতবা আলী, দেশে বিদেশে, পৃষ্ঠা৯০-৯১

৯। মার্কিনী গণহত্যা, ক্যু, অন্তর্ঘাতে সিআই এর ভূমিকার বিশ্বস্ত বিবরণের জন্য দেখুন, William Blum : Killing Hope : US Military CIA Intervention Since World War II. Common Courage Press 1995 Ges The CIA : A Forgotten History, Zed, 1986.

১০। Lal Khan : Bracing for a New Afghan war, www.PTUDC.org

১১। আফগানিস্তানে তৎকালীন সময়ের ঘটনাবলির প্রামাণ্য বর্ণনার জন্য দেখুন,  সলিমুল্লাহখান : ‘আফগানিস্তান বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব’, প্রাক্সিস জার্নাল, জানুয়ারি-জুন, ১৯৮০।এবং সেই সঙ্গে মার্কিন সমর্থিত মুজাহেদিনদের ভাষ্যের বাংলাদেশী উপস্থাপনার জন্য দেখুন : আলমাহমুদ ও আফজাল চৌধুরী সম্পাদিত : আফগানিস্তান আমার ভালবাসা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৮৩।

১২। William Blum : “Understanding the Attack on America : An Alternative View” UNC-Chapell Hill campus-এ দেয়া বক্তৃতা। ১৭সেপ্টেম্বর, ২০০১ (Internet).

১৩। “Pentagon bombs public with lies.” Workers World, New York, November 15, 2001

১৪। এই পর্যায়ে নিকারাগুয়াসহ যেসব প্রান্তস্থ দেশ যে বিভিন্নভাবে স্বাধীন উন্নয়ন চেষ্টা নিয়েছে তার বিশ্লেষণের জন্য দেখুন আনু মুহাম্মদ : পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণ ও অনুন্নতবিশ্ব, দ্বিতীয় অধ্যায়, সমাজ গবেষণা কেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৯৪।

১৫। নিকারাগুয়ায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা দুটো প্রামাণিক গ্রন্থ এইসময় ও পরিস্থিতি বুঝতে সাহায্য করবে। এগুলো হলো, মানব বন্দোপাধ্যায় : মুক্ত মানবের মন, ১৯৯০ এবং Salman Rushdie : Jaguar Smile, A Nicaraguan Journey,  Random House, 1991

১৬। Noam Chomski : “The New War Against Terror” transcribed from audio recorded at the Technology and Culture Forum at MIT, (Internet).

১৭। Yusuf Agha : The Camera that couldn’t shoot straight : Osama Gump! Counter Punch, 4.12.2001, Boston, (Internet).

১৮। Anthrax নিয়ে ভাল বাণিজ্যও হয়েছে। মুখোশ, ওষুধ, পোশাক দেদার বিক্রি হয়েছে।কানাডার একটি দেশী ওষুধ কোম্পানি প্রতিটি ১ ডলারে ১ কোটি ওষুধ তৈরির অর্ডার পেল সরকার থেকে।পরে কানাডার সংসদ এটি বাতিল করে মার্কিন কোম্পানিকে প্রতিটি ২ ডলার দামের ওষুধের অর্ডার দান করে।

১৯। বলাই বাহুল্য, ইরানের বিপ্লব বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। ইরান বিপ্লবকে সাধারণভাবে ‘খোমেনী’র বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করা হয়।কিন্তু এই ধারণা খণ্ডিত এবং বিপ্লবের অনেক শক্তিকে তা আড়াল করে।ইরান বিপ্লব একই সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবী করণের একটি দৃষ্টান্ত। এই বিপ্লবীধারা তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক দুই ভাবেই বিকশিত হয়েছিল।খোমেনী এই ধারার মূল প্রতিনিধি নন। খোমেনীর ক্ষমতা গ্রহণের পর বরঞ্চ ঐ বিপ্লবীধারা, যারা মার্কসবাদীদের সঙ্গে সহযোগী কার্যক্রমের মাধ্যমে ইরান বিপ্লবের মূল ভিত্তি নির্মাণ করেছিলেন, ভয়াবহ নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হন।মার্কসবাদী বিভিন্ন গ্রুপ ও মুজাহেদীন খালকসহ ইসলামী বিপ্লবী ধারার অসংখ্য নারী পুরুষ নিহত-পঙ্গু ও বন্দি হন খোমেনী আমলে।

২০। ওসামা বিন লাদেনকে নিয়ে, তাঁর জীবন নিয়ে পশ্চিমে বহু লেখালেখি হয়েছে।১১ সেপ্টেম্বরের পর তাঁর জীবন কর্ম নিয়ে বই ও প্রকাশিত হয়েছে একাধিক। আরও বের হয়েছে।ওসামা সম্পর্কে এসব লেখালেখির মধ্যে অনেকগুলোতেই অতিরঞ্জন বা অসত্য আছে।বিভিন্ন লেখা, ও সামার বক্তব্য এবং সম্পর্কিত তথ্য সমূহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে এখানে তাঁর সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।যে লেখাগুলো থেকে তার জীবনধারা সম্পর্কে ধারণা নেয়া হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল :  ১৯৯৮ সালেকেনিয়া ও তানজানিয়ায় বোমা বর্ষণের দু’মাস আগে তাঁর সহকর্মী ও এবিসি রিপোর্টার জন মিলারের কাছে দেয়া ওসামার দীর্ঘসাক্ষাৎকারের বিবরণ (ইন্টারনেট) এবং ওসামার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের প্রেরিত তথ্যের ভিত্তিতে প্রকাশিত জীবনী। ফ্রন্টলাইন, নভেম্বর ২০০১ এবং আগে উল্লিখিত ওয়েবসাইট সমূহসহ সিআইএ ওয়েবসাইট।

২১। ২০০০ সালের শেষ দিকে ও ২০০১ সালের প্রথম দিকের দুটো লেখায় এই আশংকা প্রকাশ করা হয়েছিল- আনু মুহাম্মদ : “মহামন্দার ‘ভূত’ কিংবা নির্বাচনী চাঙ্গাভাব”, যুগান্তর, ডিসেম্বর ২০০০, “মার্কিন অর্থনীতির উঠা নামা এবং ধ্বংসের আয়োজন” অর্থনীতি, এপ্রিল ২০০১।

২২। চটকরে দেখার জন্য : The Economist Intelligence Unit : World Economy in 2001, January 2, 2001; Rafael Behr : World Overview, Financial Times, December 28, 2000; Far Eastern Economic Review : January 25, 2001; UNCTAD : World Investment Report 2000, October 2000.

২৩। Economist (Global Agenda) : That Sinking feeling, Dec. 11, 2001.

২৪। www.meghbarta.net November, 2001 এবং January, 2002.

২৫। New York Times, ১৮নভেম্বর, ২০০১

২৬। এই সময়কালের অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বর ও পরবর্তী ঘটনাবলির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে লিখিত বেশ কয়েকটি লেখার সংকলন : Kamla Bhasin, Smitu Kothari & Bindia Thapar (ed) : Voices for Sanity, Reaching Out for Peace, NY. 2001.

২৭। Samuel P. Huntington : The Clash of Civilization and the Remaking of World Order, Penguin, 1996| এর কয়েকটি দিক নিয়ে কয়েকটি পর্যালোচনা/ভিন্নমতের প্রবন্ধের একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে ঢাকাথেকে। Salim Rashid (ed) : The Clash of Civilization, Asian Responses, UPL, 1997| এইগ্রন্থে C.J.W.-L.Wee এবং Chandra Muzaffar এর লেখা দুটি উল্লেখযোগ্য।

২৮। আফগানিস্তানে বিভিন্ন রাষ্ট্রের ভূমিকার মধ্যে সম্ভবত সমন্বয় সাধনের জন্য জাতিসংঘ ১৯৯৭ সালের শেষের দিকে “সিক্স প্লাস টু কন্টাক্ট গ্রুপ” গঠন করে।এই গ্রুপের সদস্য রাষ্ট্রগুলো ছিল : সীমান্তবর্তী ছয়টি রাষ্ট্র : চীন, ইরান, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তান।আর এর বাইরে কিন্তু মূল বহিঃস্থশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সঙ্গে রাশিয়া।আফগানিস্তানে বহিঃস্থশক্তির ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত রিপোর্টের জন্য দেখুন www.hrw.org

২৯। সাম্রাজ্যবাদের এই অঞ্চল পরিকল্পনায় ভারতের কেন্দ্রীয় অবস্থান নিয়ে আলোচনার জন্য দেখুন, আনু মুহাম্মদ : ‘বাংলাদেশের উন্নয়নে মার্কিন প্রস্তাবনা, বিনিয়োগ কৌশল এবং ভারতকেন্দ্রিকতা’, নতুনপাঠ, ১মবর্ষ, ১মসংখ্যা, জুলাই-আগস্ট২০০১।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •