মানব প্রজনন ও যৌনতাঃ পাঠ্যবইয়ে কী পড়ছি?

মানব প্রজনন ও যৌনতাঃ পাঠ্যবইয়ে কী পড়ছি?

অনুপম সৈকত শান্ত

যৌনতা অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষের জীবনেও অবিচ্ছেদ্য। তবে মানুষের সমাজে এবিষয় ঘিরে আছে নানা বিধিনিষেধ, নিয়মকানুন, বাণিজ্য ও সহিংসতা। সমাজভেদে এসবের রূপ ও মাত্রা ভিন্ন। বাংলাদেশে ঘরে বাইরে ধর্ষণসহ নানা মাত্রায় যৌন নিপীড়ন, যৌন সহিংসতা ব্যাপকভাবে থাকলেও যৌনতা বিষয়ক সুস্থ স্বাভাবিক আলোচনা তর্ক বিতকের পরিবেশ দুর্লভ। সমাজের মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে লিঙ্গীয় সহিংসতা, দমন-আগ্রাসন, নিপীড়নমূলক তৎপরতা গ্রহণ করলেও স্বতস্ফূর্ত প্রেম ভালোবাসা যৌন সম্পর্ক গ্রহণ করতে রাজী থাকে না। তাই পর্ণগ্রাফী, যৌনজ গালিগালাজ, যৌন চিকিৎসার নামে ভুল চটুল নানা পণ্যসামগ্রী বাণিজ্য অবাধে চললেও এ বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রকাশনা আলোচনার সুযোগ খুবই সীমিত। এরফলে শৈশব থেকেই একজনকে যৌনতা বিষয়ে ভুল, বিকৃত, আক্রমণাত্নক চিন্তার যোগান দিতে থাকে সমাজ। বিশ্বের বহু দেশ এই পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হবার নানা পথ অনুসন্ধান করছে। এর একটি হলো স্কুল পর্যায় থেকেই এবিষয়ে যথাযথ শিক্ষা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ এদিক থেকে অনেক পিছিয়ে। এই লেখায় নেদারল্যান্ড ও বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে মানুষের শরীর ও যৌনতা বিষয়ে শিক্ষা নিয়ে একটি জরুরী তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে।     

ছেলের কল্যাণে সম্প্রতি নেদারল্যাণ্ডের মাধ্যমিক স্কুলের জীববিদ্যা (বায়োলজি) বইয়ের প্রজননতন্ত্র (রিপ্রোডাক্টিভ সিস্টেম) নামের অধ্যায়টি পড়লাম। এ অধ্যায়টি মাধ্যমিক স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির(ক্লাস টু) সব শিক্ষার্থীকে পড়তে হয়। নেদারল্যাণ্ডে শিশুরা ৪ বছর (বা ৫ বছর) বয়সে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করে, সেখানেপ্রথম গ্রুপ থেকে অষ্টম গ্রুপ (গ্রুপ-ওয়ান থেকে গ্রুপ-এইট) পর্যন্ত ৮ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে, সাধারণত ১২-১৩ বছর বয়স পর্যন্ত এই বুনিয়াদি শিক্ষায় মূলত আনন্দের সাথে (কোনোরকম চাপ ছাড়া, বাড়ির কাজ ছাড়া, কোনোরকম মুখস্থ বাদে) ভাষা শিক্ষা করে। ডাচ ভাষায় পড়া, লেখা, কোনো বিষয়ে উপস্থাপন করা, কোনো কিছু পড়ে ও বুঝে তার উপরে প্রশ্নের জবাব দেয়া- এগুলোই মূলত এই ৮ বছরে শেখানো হয়, সে সাথে থাকে গণিত এবং শেষ ৪-৫ বছরে ইংরেজি (গণিত ও ইংরেজিও ভাষা)। তারপরে তারা ১২-১৩ বছর বয়সে মাধ্যমিক স্কুলে যায়। তিন ধরণের মাধ্যমিক স্কুল আছে, সবচেয়ে বড় অংশের (অর্ধেকের বেশি) বাচ্চারা যায় প্রস্তুতিমূলক বৃত্তিমূলক মাধ্যমিক শিক্ষা (ফরবেরাইডিং মিডলবারে বেরুপ-ওন্ডারওয়াইজ বা ভিএমবিও), বাকিরা যায় উচ্চতর সাধারণ মাধ্যমিক শিক্ষা (হোখার আলখেমেন ফরখেজেট ওণ্ডারওয়াইজ বা হাভো) এবং প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা (ফরবেরাইডেণ্ড ওয়েটেনস্খাপেনলক ওণ্ডারওয়াইজ বা ভিডব্লিউও)। এই তিন ধরণের মাধ্যমিক স্কুলে যথাক্রমে ৪, ৫ ও ৬ বছর পড়তে হয়, প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ, পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণি (ক্লাস-ওয়ান থেকে ক্লাস-ফোর, ফাইভ বা সিক্স) পর্যন্ত।

মাধ্যমিক স্কুল শেষ হলে তারা পরের স্তরের শিক্ষায় প্রবেশ করে, ভিএমবিও-তে পড়া শিক্ষার্থীরা যায় মাধ্যমিক বৃত্তিমূলক শিক্ষায় (এমবিও), হাভো-তে পড়া শিক্ষার্থীরা যায় উচ্চতর বৃত্তিমূলক শিক্ষায় (এইচবিও) ও প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয়ে বা ভিডব্লিউও ৬ বছর পড়া শিক্ষার্থীরা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডব্লিউও)।মাধ্যমিক স্কুলের প্রথম শ্রেণি থেকেসবাইকেই ডাচ, ইংরেজি, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল ও জীববিদ্যা পড়তে হয়, ২য় ও ৩য় শ্রেণিতে পদার্থবিদ্যা, রসায়নও যুক্ত হয়। হাভো ও ভিডবিউও এর শিক্ষার্থীদের ফ্রেঞ্জ, জার্মান ভাষাও শেখানো হয়, ভিডব্লিউ এর শিক্ষার্থীদের একটা অংশকে গ্রীক, লাতিন ভাষাও শেখানো হয়। হাভো বা ভিডব্লিউ এর শিক্ষার্থীদের তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সবাই জীববিদ্যা পড়ে, এরপরে আমাদের সায়েন্স, আর্টস, কমার্সের মত শিক্ষার্থীরা চার ভাগে বা চারটি প্রোফাইলে বিভক্ত হয়ে যায়: ক. সংস্কৃতি ও সমাজ, খ. অর্থনীতি ও সমাজ, গ. প্রকৃতি ও স্বাস্থ্য, ঘ. প্রকৃতি ও প্রযুক্তি! ‘প্রকৃতি ও স্বাস্থ্য’ প্রোফাইলের শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক জীববিদ্যা ৫ম শ্রেণি (হাভো-র শিক্ষার্থীদের) বা ষষ্ঠ শ্রেণি (ভিডব্লিউও-এর শিক্ষার্থীদের) পর্যন্ত পড়ে যেতে হয়, অন্য প্রোফাইলের শিক্ষার্থীদের জন্যে এটা থাকে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে। আমি যে জীববিদ্যা বইটির কথা বলছি, তা হাভো ও ভিডব্লিউও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই। অধ্যায়টি যেহেতু দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ানো হয়, সাধারণভাবে ১৩-১৪ বছরের শিক্ষার্থীরা এই অধ্যায় পড়ে।

শিক্ষার্থীরা চার ভাগে বা চারটি প্রোফাইলে বিভক্ত হয়ে যায়: ক. সংস্কৃতি ও সমাজ, খ. অর্থনীতি ও সমাজ, গ. প্রকৃতি ও স্বাস্থ্য, ঘ. প্রকৃতি ও প্রযুক্তি! ‘প্রকৃতি ও স্বাস্থ্য’ প্রোফাইলের শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক জীববিদ্যা ৫ম শ্রেণি (হাভো-র শিক্ষার্থীদের) বা ষষ্ঠ শ্রেণি (ভিডব্লিউও-এর শিক্ষার্থীদের) পর্যন্ত পড়ে যেতে হয়, অন্য প্রোফাইলের শিক্ষার্থীদের জন্যে এটা থাকে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে।

প্রথমেই এই বইয়ের প্রজনন (রিপ্রোডাকশন) নামের অধ্যায়ের সূচির দিকে তাকানো যাক। অধ্যায়টি ১ থেকে ১০ নাম্বারে, ১০টি পরিচ্ছেদে (সেকশন) বিভক্ত। প্রতি পরিচ্ছেদেই আবার একাধিক অনুচ্ছেদ (সাবসেকশন) রয়েছে। এবং সেগুলোর পাশাপাশি বক্স করে বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও প্রতিবেদন যুক্ত করা হয়েছে। সেকশন, সাবসেকশন ও বক্স-তথ্যগুলোতে মানব শরীরের প্রাথমিক (প্রাইমারি) ও মাধ্যমিক(সেকেণ্ডারি) যৌন বৈশিষ্ট্য, বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক তথা যৌনাঙ্গের পরিবর্তন, আবেগ – অনুভূতির পরিবর্তন, পুরুষ ও নারীর প্রজননতন্ত্র ও যৌনাঙ্গের বিস্তারিত ও সচিত্র বর্ণনা, যোনিদ্বারপর্দাবা হাইমেন (বাংলায় বহুল ব্যবহৃত সতীচ্ছদ শব্দটি আপত্তিকর বিধায় আমি হাইমেন এর বাংলা প্রস্তাব করছি যোনিদ্বারপর্দা বা শুধু যোনিপর্দা), প্রেম-ভালোবাসা, যৌনতা (সেক্সুয়ালিটি), যৌন চাহিদা বা কামনা বা তাড়না(সেক্স ড্রাইভ বা লিবিডো), যৌনপছন্দ(সেক্সুয়াল প্রিফারেন্স) তথা বিষমকামী – সমকামী (হেটারোসেক্সুয়াল – হোমোসেক্সুয়াল) যেমন পুরুষ-সমকামী – নারী-সমকামী (গে – লেজবিয়ান) – উভকামী – কামহীন (বাইসেক্সুয়াল – এসেক্সুয়াল) সম্পর্ক, নারী ও পুরুষের বাইরেও ট্রান্সজেণ্ডার, ট্রান্সভেস্টাইট, ট্রান্সসেক্সুয়াল, এণ্ড্রোজিনাস বা উভলিঙ্গ, যৌন সহিংসতা (সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স) যেমন যৌন নিপীড়ন, যৌন হয়রানি ও ধর্ষণ (এসল্ট – হ্যারাসমেন্ট – রেপ), জন্ম নিয়ন্ত্রণের অনিরাপদ ও নিরাপদ পদ্ধতি যেমন কনডম, পিলসহ অন্যান্য পদ্ধতি, ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপ্টিভ, গর্ভধারণ (প্রেগনেন্সি), সন্তানের জন্মদান, এবং যৌনবাহিত বিভিন্ন রোগ প্রভৃতি নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত ও বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

এই পুরো অধ্যায়েকয়েকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা হয়েছেঃ

১/ পারফেক্ট শরীর বলে কোনো কিছু নেই। আদর্শ স্তন (ছোট বা বড়) বা আদর্শ শিশ্ন বলেও কিছু নেই (ফলে, এ নিয়ে ফান্টাসি বা হীনমন্যতায় ভোগারও কিছু নেই)! টিভিতে, ইন্টারনেটে, বিজ্ঞাপনে – আদর্শ শরীর বলে যা কিছু দেখানো হয়, তা অনেক সময়ই নকল বা বানানো(ফেক বা ম্যানিপুলেটেড)।

পারফেক্ট শরীর বলে কোনো কিছু নেই। আদর্শ স্তন (ছোট বা বড়) বা আদর্শ শিশ্ন বলেও কিছু নেই (ফলে, এ নিয়ে ফান্টাসি বা হীনমন্যতায় ভোগারও কিছু নেই)! টিভিতে, ইন্টারনেটে, বিজ্ঞাপনে – আদর্শ শরীর বলে যা কিছু দেখানো হয়, তা অনেক সময়ই নকল বা বানানো(ফেক বা ম্যানিপুলেটেড)।

২/ পুরো অধ্যায়ে “বিয়ে”, “স্বামী”, “স্ত্রী” – এই শব্দগুলোর কোনো উল্লেখ নেই। যৌন সংগম বা সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সের আলোচনাতেও এই তিন শব্দের কোনো উল্লেখ নেই।

৩/ ১ম পরিচ্ছেদে বয়:সন্ধিকালে নানা পরিবর্তনের যে আলোচনা, সেখানে মানসিক পরিবর্তনের আলোচনায় প্রথমবারের মত যৌন সংগম বা সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সের কথা বলা হয়েছে। ধাপে ধাপে যৌন সংগমের আলোচনাটা এসেছে এভাবে – এসময়ে আরেকজনের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হতে পারে, তারপরে একজন আরেকজনের প্রেমে পড়তে পারে, অন্যজনও যদি তার প্রেমে পড়ে, তাহলে দুজনের মাঝে সম্পর্ক বা রিলেশনশিপ তৈরি হতে পারে, এই সম্পর্কে একে অপরের হাত ধরা, চুমু দেওয়া, আলিঙ্গন করে আদর করা প্রভৃতি হতে পারে, এবং এসব কোনো কোনো ক্ষেত্রে যৌন সংগমের দিকেও ধাবিত করতে পারে! পরবর্তীতে যৌনতা বা সেক্সুয়ালিটি সম্পর্কিত পরিচ্ছেদে, বিশেষ সম্পর্ক বা স্পেশাল রিলেশনশিপ বজায় রাখা নিয়ে বড় আলাপ রয়েছে। সেখানেও দুইজনের পক্ষ থেকেই প্রেমে পড়াটা প্রথম শর্ত হিসেবে দেখানো হয়েছে এমন সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে, তারপরেই তা যৌন সংগমের দিকেও যেতে পারে। সেখানে, বিয়ের কথা নেই বা যৌন সংগমের ক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রীর কথাও বলা হয়নি।

যৌনতা বা সেক্সুয়ালিটি সম্পর্কিত পরিচ্ছেদে, বিশেষ সম্পর্ক বা স্পেশাল রিলেশনশিপ বজায় রাখা নিয়ে বড় আলাপ রয়েছে। সেখানেও দুইজনের পক্ষ থেকেই প্রেমে পড়াটা প্রথম শর্ত হিসেবে দেখানো হয়েছে এমন সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে, তারপরেই তা যৌন সংগমের দিকেও যেতে পারে।

৪/ নারীর বহির্যৌনাঙ্গ (এক্সটার্ণাল সেক্স-অর্গানস) সম্পর্কিত আলোচনায় আলাদাভাবে বক্স করে যোনিদ্বার পর্দা বা হাইমেন নিয়ে আলোচনা আছে। তিনটি যোনীর ছবি দিয়ে দেখানো হয়েছে, একেকজনের যোনিদ্বারের (ভ্যাজাইনাল ওপেনিং) আকার বা ধরণ একেক রকম, ফলে যোনিদ্বার পর্দার গঠনও নানারকম হতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে প্রথমবার যৌনক্রিয়াতে ব্লিডিং বা রক্তপাত হতে পারে, কিন্তু সকলের ক্ষেত্রেই এরকম রক্তপাতের ঘটনা ঘটে না।

৫/ যৌনতা বা সেক্সুয়ালিটি পরিচ্ছেদে লিবিডো বা সেক্স ড্রাইভ নিয়ে আলাদা একটি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এই আলোচনায় স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে, যৌনতা মানুষকে অনেক যৌন-আনন্দ(সেক্সুয়াল প্লেজার) দেয়, এটা তাদেরকে যৌনভাবে উত্তেজিত করে (এরাউজ দেম / টার্ণ দেম অন)!

৬/ সেক্সুয়ালিটির আলাপে পর্ণোগ্রাফি ও বেশ্যাবৃত্তি(প্রস্টিটিউশন) সম্পর্কেও জানানো হয়েছে।

৭/ যার প্রতি কেউ যখন আকৃষ্ট হয়, তার সাথে যৌনকর্ম বা যৌনসংগম(লাভমেকিং বা সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স)দারুণরকমযৌন-উত্তেজনা তৈরি করতে পারে, অনেক যৌন-আনন্দ দিতে পারে। আবার, অন্যের নগ্ন শরীর তথা যৌনাঙ্গের ও যৌনক্রিয়ার ছবি ও ভিডিও দেখেও একরকম যৌন উত্তেজনা, যৌন আনন্দ তৈরি হতে পারে। এসবকে বলা হয় পর্ণোগ্রাফি। এরপরে পর্ণোগ্রাফি সম্পর্কে তিনটা সমালোচনা রাখা হয়েছেঃ ১/ পর্ণোগ্রাফি আর প্রকৃত পার্টনারের সাথে যৌন সম্পর্ক এক নয়। ফলে, পর্ণোগ্রাফি দেখার মাধ্যমে অনেক সময়ই যৌনতা সম্পর্কে অবাস্তব ইমেজ ও ধারণা মাথায় চলে আসতে পারে। ২/ পর্ণোগ্রাফিতে অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের প্রতি অবন্ধুসুলভ আচরণ প্রকাশ পায়, ৩/ পর্ণোগ্রাফি অনেক ক্ষেত্রেই মেল ফ্যান্টাসিকে প্রকাশ করে।

পর্ণোগ্রাফি সম্পর্কে তিনটা সমালোচনা রাখা হয়েছেঃ ১/ পর্ণোগ্রাফি আর প্রকৃত পার্টনারের সাথে যৌন সম্পর্ক এক নয়। ফলে, পর্ণোগ্রাফি দেখার মাধ্যমে অনেক সময়ই যৌনতা সম্পর্কে অবাস্তব ইমেজ ও ধারণা মাথায় চলে আসতে পারে। ২/ পর্ণোগ্রাফিতে অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের প্রতি অবন্ধুসুলভ আচরণ প্রকাশ পায়, ৩/ পর্ণোগ্রাফি অনেক ক্ষেত্রেই মেল ফ্যান্টাসিকে প্রকাশ করে।

৮/ যৌনতা সম্পর্কিত পরিচ্ছেদে বিশেষ সম্পর্ক বজায় রাখা, যৌন-আনন্দ, বিভিন্ন যৌন-পছন্দ (সেক্সুয়াল প্রিফারেন্স), স্বাস্থ্যকর যৌন সম্পর্ক, যৌন সহিংসতা– এরকম অনুচ্ছেদের আলোচনাগুলোর ফাঁকে খুব ছোট করে প্রজনন বা রিপ্রোডাকশন নিয়ে একটি অনুচ্ছেদ রয়েছে। সে আলোচনায় জানানো হয়েছে, প্রজননের ক্ষেত্রে যৌন সংগম তথা যৌনতার বড় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু অনেকেই সন্তানের জন্মদানের উদ্দেশ্য ছাড়াই সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সে অংশ নিতে পারে। সেজন্যে দরকার জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি বা কন্ট্রাসেপ্টিভস। অর্থাৎ, কেবলমাত্র সন্তান জন্মদানের উদ্দেশ্যেই যৌনতা ও যৌনসংগম – এরকম আলোচনা কোথাও নেই।

৯/ বিভিন্ন যৌন পছন্দ(সেক্সুয়াল প্রিফারেন্স) এর আলোচনায়, বিষমকামী – সমকামী – উভকামী(হেটারোসেক্সুয়াল, হোমোসেক্সুয়াল, বাইসেক্সুয়াল) সম্পর্ক নিয়েআলোচনা রয়েছে। একইভাবে কারা ট্রান্সজেণ্ডার, ট্রান্সভেস্টাইট, ট্রান্সসেক্সুয়াল, এণ্ড্রোজিনাস- সেই আলোচনাও আছে। একই সাথে জানানো হয়েছে, সেক্সুয়াল প্রিফারেন্স ও সেক্সুয়ালিটির ভিন্নতার জন্যে যারা হোমোসেক্সুয়াল, লেজবিয়ান, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেণ্ডার তারা নানারকম বৈষম্য (ডিসক্রিমিনেশন), হয়রানি, নির্যাতন, এমনকি যৌন সহিংসতার শিকার হয়। এর বিরুদ্ধে অসংখ্য মানুষ প্রতিবাদও করে! এরপরে একটি বক্স প্রতিবেদনে সারাদেশের স্কুল-কলেজে সমকামিদের অধিকারের পক্ষে পার্পল কর্মসূচির কথা জানানো হয়েছে।

১০/ যৌন সহিংসতা (সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স) সম্পর্কিত অনুচ্ছেদে বিস্তারিতভাবে যৌন সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন, যৌন হয়রানি ও ধর্ষণ- এসবের সংজ্ঞা দিয়ে জানানো হয়েছে, এগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এমনকি জেল-জরিমানা পর্যন্ত সাজাও হতে পারে। এরপরে একটি বক্স প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, নেদারল্যাণ্ডের অল্প বয়সী শিশু-কিশোর-কিশোরিরা কি মাত্রায় ও সংখ্যায় যৌন হয়রানির শিকার হয়, তার একটি জরিপের ফলাফল।

যৌন সহিংসতা (সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স) সম্পর্কিত অনুচ্ছেদে বিস্তারিতভাবে যৌন সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন, যৌন হয়রানি ও ধর্ষণ- এসবের সংজ্ঞা দিয়ে জানানো হয়েছে, এগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এমনকি জেল-জরিমানা পর্যন্ত সাজাও হতে পারে।

১১/ জন্ম নিয়ন্ত্রণের আলোচনায় কনডম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে। সেখানে একাধিক কার্টুন ও পুরুষ শিশ্নের স্কেচ ছবি দিয়ে কীভাবে নিরাপদ কনডম পরিধান করতে হয়, সেই ধাপগুলো দেখানো হয়েছে। আলাদাভাবে, একটি বক্স প্রতিবেদনে কমবয়সী জুটি যে এখনো অনিরাপদ যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছে, সে সম্পর্কে একটি প্রতিবেদনের উল্লেখ আছে। এর বাইরে জরুরি জন্মনিরোধক বড়ি (ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপ্টিভ পিল) নিয়েও বড় আলোচনা আছে।

১২/ অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণের ক্ষেত্রে একজন নারীর মাঝে নানারকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব(ডিলেমা) তৈরি হতে পারে, সে আলোচনা আছে। সে সন্তানকে জন্ম দিতে প্রস্তুত কি না, সন্তান জন্ম দেয়ার পরে নিজে লালন পালন করতে পারবে নাকি কোনো পালক পিতামাতার (ফস্টার প্যারেন্ট) কাছে সন্তানকে দত্তক দিয়ে দিবে, সে কি ভ্রুণকে নষ্ট করবে, সে কি সন্তানের জন্মদাতা পিতার (বায়োলজিকাল ফাদার) সাথে একসাথে মুক্তভাবে আলোচনা করতে ও সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কি না, এমন নানা প্রশ্ন, দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে! এরপরে জানিয়েছে নেদারল্যাণ্ডে এরকম অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ করা নারীদের জন্যে মানসিক সহযোগিতার দেয়ার কাজ করে একটি প্রতিষ্ঠান, সেখানে ফোন করে মনোবিদের সাহায্য নেয়া সম্ভব।

১৩/ গর্ভপাত বা এবর্শনের নিয়েও আলোচনা রয়েছে। গর্ভপাত বিষয়ে কোনোরকম নৈতিক বোঝা চাপিয়ে না দিয়ে, দুই বিপরীত যুক্তি উপস্থাপিত হয়েছে। কেউ কেউ মনে করে, “প্রত্যেকের (অনাগত সন্তানেরও) বেঁচে থাকার, জীবনের স্বাধীনতার ও নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে”(Everyone has the right to life, liberty and security of person)। এর সাথে সাথে ভালোভাবেই বলা হয়েছে, অনেকেই মনে করে নারীর নিজের শরীরের সম্পূর্ণ রকমের অধিকার আছে (“Boss of her own body”), অর্থাৎ কোনো নারী তার শরীর তথা তার গর্ভ নিয়ে কী করবে, সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার সম্পূর্ণভাবে রাখে।

এর পাশাপাশি বাংলাদেশের নবম-দশম শ্রেণির জীববিজ্ঞান ২য় পত্র এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির জীববিজ্ঞান ২য় পত্র বই দুটোতে থাকা যৌনতা ও মানব প্রজনন সম্পর্কিত আলোচনার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। নবম-দশম শ্রেণির জীববিজ্ঞান ২য় পত্রের অধ্যায়টির নাম “জীবের প্রজনন”। সেখানে প্রথমে ১১.১ অনুচ্ছেদে ‘জীবে প্রজননের ধারণা ও গুরুত্ব’ দিয়ে অধ্যায় শুরু হয়। অর্থাৎ জীবের বংশবৃদ্ধির জন্যে এই প্রজনন খুব যে জরুরি একটা প্রক্রিয়া সেটা জানানো হয়েছে। প্রজনন দুই রকমের, যৌন ও অযৌন প্রজনন। এরপরে ১১.২-এ উদ্ভিদের প্রজনন নিয়ে বেশ বিস্তারিত ও সচিত্র আলচনা রয়েছে। এরপরে ১১.৩ অনুচ্ছেদের আলোচনা প্রাণীর প্রজনন নিয়ে, সেখানে যৌন ও অযৌন প্রজননের আলাপ শেষে ১১.৩.১-এ প্রাণীর নিষেক বা ফার্টিলাইজেশন নিয়ে আলোচনায় শুক্রাণু – ডিম্বাণু মিলে জাইগোট তৈরি হয়- এসবের আলাপ রয়েছে। এরপরেই হুট করে ১১.৩.২ অনুচ্ছেদে চলে গিয়েছে মানুষের প্রজননের আলাপে। অনুচ্ছেদের নামঃ “মানব প্রজননে হরমোনের ভূমিকা”! মানুষের প্রজনন বিষয়ক একটা আলাপ জীববিজ্ঞান বইয়ে শুরু হচ্ছে, হরমোনের ভূমিকা দিয়ে! সেখানে হরমোন, হরমোন গ্রন্থি – এসবের আলাপ শেষে বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর কিশোরিদের শরীরে কী কী পরিবর্তন ঘটে- সেই আলাপ আছে, কিন্তু নতুন কোনো অনুচ্ছেদের নামে না! কোনোরকম ছবিও নেই। তারপরে রজঃস্রাব, ঋতুচক্র নিয়ে একটু আলোচনা আছে, তারপরেই যৌন সম্পর্ক নিয়ে ছোট দুই প্যারায় আলাপ করা হয়েছে। এই সমস্ত আলোচনা সেই “মানব প্রজননে হরমোনের প্রভাব” নামক অনুচ্ছেদের আড়ালেই করা হয়েছে।

যৌনতা বা যৌন সম্পর্ক নিয়ে আলাপটাও খুব মজার। এটি শুরুই করা হয়েছে, বিয়ে নামক “সামাজিক”, “ধর্মীয়” ও “পারিবারিক” বন্ধনের কথা বলে। তারপরে, পুরো আলোচনার ক্রম হচ্ছে-স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে প্রেম ভালোবাসা হয়, নির্দ্বিধায় মেলামেশা হয়, তারপরে হয় দৈহিক সম্পর্ক। দৈহিক সম্পর্ক বলতে কী বুঝায়, কোন অঙ্গ সেখানে কী ভূমিকা নেয়, সেসব আলাপ নাই। তবে স্বামী ও স্ত্রীর দৈহিক সম্পর্কের আলাপের পরেই আছে, শুক্রাণুতে লেজ থাকে, ফলে শুক্রাণু সাঁতরিয়ে স্ত্রীর প্রজননতন্ত্রে ঢুকে, স্ত্রীর ডিম্বনালীতে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন বা নিষেক ঘটে, জাইগোট তৈরি হয়। মানে, শুক্রাণু কেবল ‘স্বামী’র শরীর থেকে তার ‘স্ত্রী’র ডিম্বনালীতে যেতে পারে, বা কেবল ‘স্ত্রী’র ডিম্বাণুকেই নিষিক্ত করতে পারে! আলোচনার ক্রম এমনই যে, মনে হবে (স্বামী-স্ত্রীর) দৈহিক সম্পর্ক হওয়া মানেই লেজ-ওয়ালা শুক্রাণু সাঁতরিয়ে ডিম্বনালী গিয়ে ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে ফেলে, ভ্রুণ তৈরি হয় এবং সন্তান জন্ম নেয়। আর, শুক্রাণুটা কোথা থেকে কীভাবে আসছে, অর্থাৎ ইজাকুলেশন(বীর্যপাত) বা বীর্য, নারী শরীরে (‘স্ত্রী’র শরীরে) ডিম্বাণু উৎপাদনের সাথে ঋতুচক্রের সম্পর্ক- এসবেরও কোনো উল্লেখ নেই!বাস, এখানেই মানব প্রজননের আলাপ শেষ। এরপরে, ভ্রুণের বিকাশ, সন্তানের জন্মদান সম্পর্কিত আলোচনা এবং তারপরে যৌনবাহিত রোগ সম্পর্কে আলোচনা বেশ ভালোভাবে আছে। পুরুষ বা নারীর প্রজননতন্ত্রের স্কেমেটিক ছবি পর্যন্ত নেই, যদিও অধ্যায়ের শুরুর দিকে ফুলের গর্ভাশয় – গর্ভদণ্ড এসবের রঙ্গিন, আকর্ষণীয় ছবি আছে। পুরুষ ও নারীর প্রজননতন্ত্রের কোনো ছবি না থাকলেও অবশ্য গর্ভে ভ্রুণের বিকাশের নানা পর্যায়ের ছবি রয়েছে।

যৌনতা বা যৌন সম্পর্ক নিয়ে আলাপটাও খুব মজার। এটি শুরুই করা হয়েছে, বিয়ে নামক “সামাজিক”, “ধর্মীয়” ও “পারিবারিক” বন্ধনের কথা বলে। তারপরে, পুরো আলোচনার ক্রম হচ্ছে-স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে প্রেম ভালোবাসা হয়, নির্দ্বিধায় মেলামেশা হয়, তারপরে হয় দৈহিক সম্পর্ক। দৈহিক সম্পর্ক বলতে কী বুঝায়, কোন অঙ্গ সেখানে কী ভূমিকা নেয়, সেসব আলাপ নাই।

বাংলাদেশে এই অধ্যায়টি সাধারণত দশম শ্রেণিতে পড়ার কথা, যখন গড়ে শিক্ষার্থীর বয়স থাকে ১৪ বছর। এই বইটি পড়ে কেবল বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে দ্বাদশ শ্রেণির ১৬-১৭ বছর বয়সের শিক্ষার্থীরা জীববিজ্ঞান ২য় পত্রে (এটিও বিজ্ঞান বিভাগের একটি ঐচ্ছিক বিষয়) যে অধ্যায়টি পড়ে তার নাম, “মানব জীবনের ধারাবাহিকতা”। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির জীববিজ্ঞান ২য় পত্র (লেখকঃ গাজী এস. এম. আজমল ও গাজী আসমত) বইটির এই অধ্যায়ে যে যে বিষয় আছে সবই অনেক বিস্তারিতভাবেই আলোচনা করা হয়েছে, এমনই বিস্তারিত ও বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা যে, প্রতি লাইনে লাইনে নানান খটমটে বাংলা ও ইংরেজি টার্ম কয়েকটা করে পাওয়া যাবে। অধ্যায়ের শুরু হয়েছে পুরুষ প্রজননতন্ত্র ও স্ত্রী প্রজননতন্ত্র দিয়ে, সেখানে পুরুষ ও নারীর বিভিন্ন যৌনাঙ্গের সাথে ও হরমোনাল ক্রিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন যৌনাঙ্গের সংজ্ঞা ও কাজ নিয়ে আলাপ আছে। এরপরে, প্রজননের বিভিন্ন পর্যায় ও দশা নিয়ে আলোচনা রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে বয়ঃসন্ধিকাল নিয়ে আলোচনা, সেখানে একটি ছকে দৈহিক, শরীরবৃত্তিক ও মানসিক পরিবর্তন দেখানো হয়েছে। তারপরের পর্যায়ে রজঃস্রাব নিয়ে অনেক বিস্তারিত এক আলোচনা আছে। তারপরে তৃতীয় পর্যায় হচ্ছে, গ্যামেট সৃষ্টি বা গ্যামেটোজেনেসিস। এখানে আছে শুক্রাণুজনন ও ডিম্বাণুজনন নিয়ে বিশাল আলোচনা। সেই সাথে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর গঠন, তাদের বিভিন্ন অংশের আলোচনা আছে। চতুর্থ পর্যায় হচ্ছে, নিষেক। আশ্চর্যজনকভাবে নিষেকের আলাপটা শুরু করা হয়েছে, প্রাণীদেহের নিষেক এর আলাপ দিয়ে, প্রাণীকূলে কয়েকরকম নিষেক হতে পারে, সেই আলাপ শেষ করে মানবদেহের নিষেক নিয়ে আলাপ শুরু করা হয়েছে। সেই নিষেকের ৬টি ধাপের প্রথমটি শুরুই করা হয়েছে স্খলিত শুক্রাণু থেকে। এই শুক্রাণু কোত্থেকে কীভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায় স্খলিত হলো, সে সম্পর্কে আলাপ নেই। তারপরে, নিষেক প্রক্রিয়ার গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা আছে। এরপরে একে একে গর্ভধারণ বা ইমপ্লান্টেশন, মানব ভ্রূণের পরিস্ফুটন, ভ্রূণ ও ফিটাসের বিকাশ, শিশু প্রসব, গর্ভাবস্থার পরিচর্যা – ইত্যাদি নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা রয়েছে। এরপরের অনুচ্ছেদে রয়েছে জন্ম নিয়ন্ত্রণের আলোচনা। কিন্তু এই সম্পর্কিত অনুচ্ছেদের নাম, “গর্ভনিরোধক পদ্ধতি ও পরিবার পরিকল্পনা”। এখানে জন্মনিয়ন্ত্রণের অস্থায়ী ও স্থায়ী নানান পদ্ধতির সাথে সংক্ষেপে পরিচয় করে দেয়া হয়েছে। এর বাইরে পরিবার পরিকল্পনার আলোচনার পুরোটাই হচ্ছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত। এমনভাবে এই অনুচ্ছেদের আলোচনা সাজানো হয়েছে, মনে হবে জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রধান বা একমাত্র দরকারই হচ্ছে, দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। এর পরের অনুচ্ছেদে নারী ও পুরুষের প্রজননতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে আলোচনা আছে। সেখানে, প্রজনন হরমোনের ভারসাম্যহীনতা নিয়ে আলাপ শেষে যৌনবাহিত রোগগুলোর লক্ষণ, নির্ণয়, প্রতিকার, প্রতিরোধ সম্পর্কিত আলাপ করে অধ্যায় শেষ করা হয়েছে।

পুরো অধ্যায়ের একটি জায়গাতেও প্রেম-ভালোবাসা, যৌনতা বা সেক্সুয়ালিটি, যৌনচাহিদা-তাড়না-যৌনকাম ও যৌন আনন্দ (সেক্স ড্রাইভ, লিবিডো, সেক্সুয়াল প্লেজার), কিংবা যৌন পছন্দ(সেক্সুয়াল প্রিফারেন্স) ও যৌনতা বৈচিত্র, যৌন সহিংসতা – যৌন হয়রানি –  যৌন নিপীড়ন – ধর্ষণ, প্রভৃতি নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। নারী বা পুরুষের শরীরকে চেনানোর জন্যে কোনো ছবি নেই, যৌনাঙ্গের ছবি নেই। পুরো অধ্যায়ের আলোচনাটি এমনই খটমটে কঠিন কঠিন সব টার্মোলজিতে এবং এত বেশি পয়েন্টে ভর্তি যে, বিভিন্ন টার্মোলজি, সেগুলো সংজ্ঞা ও কাজ, বৈশিষ্ট্য – এসব পড়ে মুখস্থ করা, মনে রাখা ছাড়া এই অধ্যায়টির আর কোনো কাজ আছে বলে মনে হয় না! মানব প্রজননের প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে, বংশ বিস্তার বা মানবজীবনের ধারাবাহিকতা, সেখানে যৌনতা, যৌন উত্তেজনা তথা যৌন আনন্দের কোনো অবস্থান বা ভূমিকা নেই, আর জন্ম নিয়ন্ত্রণের মূল কারণ বা উদ্দেশ্যই হচ্ছে, দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। এই হচ্ছে, এই অধ্যায়ের মোদ্দাকথা!

পুরো অধ্যায়ের একটি জায়গাতেও প্রেম-ভালোবাসা, যৌনতা বা সেক্সুয়ালিটি, যৌনচাহিদা-তাড়না-যৌনকাম ও যৌন আনন্দ (সেক্স ড্রাইভ, লিবিডো, সেক্সুয়াল প্লেজার), কিংবা যৌন পছন্দ(সেক্সুয়াল প্রিফারেন্স) ও যৌনতা বৈচিত্র, যৌন সহিংসতা – যৌন হয়রানি –  যৌন নিপীড়ন – ধর্ষণ, প্রভৃতি নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। নারী বা পুরুষের শরীরকে চেনানোর জন্যে কোনো ছবি নেই, যৌনাঙ্গের ছবি নেই।


শুরুতে নেদারল্যাণ্ডের যে পাঠ্যবইয়ের আলোচনা করেছি, তা কিন্তু কেবল জীববিদ্যা বা বায়োলজির আলোচনা। এর বাইরে আরো ছোট ক্লাসেই (প্রাথমিক স্কুলেই), আলাদাভাবে যৌনশিক্ষা দেয়া হয়। যেখানে মূলত বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক, মানসিক নানা পরিবর্তন, রজঃস্রাব ও ঋতুচক্র (মেন্সট্রুয়েশন ও মেন্সট্রুয়াল সাইকেল), বিভিন্ন রকম যৌন পছন্দ (সেক্সুয়াল প্রেফারেন্স), দুজনের মাঝে (ছেলে ও মেয়ের, ছেলে ও ছেলের এবং মেয়ে ও মেয়ের) বিশেষ সম্পর্ক, এবং সন্তান জন্মের সাধারণ প্রক্রিয়া – এসবের উপরে একটা মোটাদাগে ধারণা দেওয়া হয়! একটা মেয়ে তার রজঃস্রাব শুরু হওয়ার আগে থেকেই যৌনশিক্ষার ক্লাসে এ ব্যাপারে জেনে যায়, তার ছেলে সহপাঠীদেরও একই সাথে এ ব্যাপারে জানানো হয়! এরপরে জীববিদ্যা বইয়ের প্রজনন নামের অধ্যায়ে আরো বিস্তারিতভাবে যৌনতা সম্পর্কে জানতে পারে।বাংলাদেশে নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতেজীববিদ্যা কেবল বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা পড়লেও, নেদারল্যাণ্ডে এই জীববিদ্যা মাধ্যমিক স্কুলেরদ্বিতীয় শ্রেণিতে সবাইকেই পড়তে হয়।বাংলাদেশে যে এখনো যৌনতা নিয়ে মারাত্মক ট্যাবু কাজ করে, তারই নজির তার পাঠ্যবইয়ে পাওয়া যাচ্ছে। ট্যাবুর কারণে যেমন পাঠ্যবইয়ে যৌনশিক্ষা নিয়ে আলাদা কোনো পাঠ নেই, জীববিদ্যার বইতেও যৌনতা নিয়ে সহজ সুন্দর ভাষায় কোনো রকম আলোচনাও নেই! একইভাবে, যৌনতা নিয়ে সুস্থ ও সুন্দর-স্বাভাবিক আলোচনার অভাবে বাংলাদেশের কিশোর কিশোরিদের এ সম্পর্কে ট্যাবু নিয়ে বড় হয়ে উঠতে হয়, বন্ধু-বান্ধবের আড্ডায় কিংবা পর্ণোগ্রাফি বা চটি পত্রিকা-বইগুলো থেকে যৌনতা বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করতে হয়!

যৌনতাকে কেন্দ্র করে এরকম ট্যাবুই বস্তুত বাংলাদেশে যৌনতাকে এক নিষিদ্ধ বস্তুতে পরিণত করেছে, একদিকে সামাজিক – ধর্মীয় – পারিবারিক নানা মূল্যবোধ, সংস্কার ও অনুশাসনে যৌনতার মাঝে নিষিদ্ধতা, অপরাধ ও পাপবোধ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে প্রাকৃতিক কারণেই একটা বয়সের পরে যৌন আকর্ষণ তৈরি হওয়া, পুজিবাদী ভোগবাদী সমাজে সেই আকর্ষণকে তুমুলভাবে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলা, সুস্থ ও স্বাভাবিক যৌনতার সুযোগ ও চর্চার অভাবে যৌনতাকেন্দ্রিক সেই আকর্ষণ, তীব্র চাহিদা ও যৌনতাড়না- এখানকার মানুষের মাঝে নানারকম অবদমন ও বিকৃতি তৈরি করে ফেলে! ফলে, এখানকার মানুষ সাধারণভাবে যৌনভাবে অতৃপ্ত, অসুখী।

যৌনতাকে কেন্দ্র করে এরকম ট্যাবুই বস্তুত বাংলাদেশে যৌনতাকে এক নিষিদ্ধ বস্তুতে পরিণত করেছে, একদিকে সামাজিক – ধর্মীয় – পারিবারিক নানা মূল্যবোধ, সংস্কার ও অনুশাসনে যৌনতার মাঝে নিষিদ্ধতা, অপরাধ ও পাপবোধ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে প্রাকৃতিক কারণেই একটা বয়সের পরে যৌন আকর্ষণ তৈরি হওয়া, পুজিবাদী ভোগবাদী সমাজে সেই আকর্ষণকে তুমুলভাবে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলা, সুস্থ ও স্বাভাবিক যৌনতার সুযোগ ও চর্চার অভাবে যৌনতাকেন্দ্রিক সেই আকর্ষণ, তীব্র চাহিদা ও যৌনতাড়না- এখানকার মানুষের মাঝে নানারকম অবদমন ও বিকৃতি তৈরি করে ফেলে! ফলে, এখানকার মানুষ সাধারণভাবে যৌনভাবে অতৃপ্ত, অসুখী। সেই সাথে সামাজিক অসাম্য ও বৈষম্য, নারীর প্রতি আধিপত্যমূলক ও বিদ্বেষী সমাজব্যবস্থা, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অগণতান্ত্রিকতার চর্চা, বিভিন্ন স্তরে অন্যায় ক্ষমতার চর্চা এবং আইনের শাসনের অভাব- এই যৌনভাবে অবদমিত ও বিকৃত সমাজকে নানারকম যৌন অপরাধের দিকে ধাবিত করে! ফলে, সমাজের সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে গড়ে তোলার জন্যে যৌনতাকেন্দ্রিক ট্যাবু ভাঙ্গা জরুরি, জরুরি স্কুল পর্যায়েই যথাযথ যৌনশিক্ষার ব্যবস্থা করা।

অনুপম সৈকত শান্ত: প্রকৌশলী, লেখক। ইমেইল: anupam.shaikat@gmail.com 

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •