পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে বাংলাদেশ-রাশিয়া আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ

পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে বাংলাদেশ-রাশিয়া আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ

মোশাহিদা সুলতানা

‘জাতীয় গৌরবের’ প্রচারণায় আচ্ছন্নতা তৈরি করে বাংলাদেশে পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। রূপপুরের পর দক্ষিণাঞ্চলে আরও একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী আর এজন্যও রাশিয়ার রোসাটমের ‘সহযোগিতা’ চেয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা বাংলাদেশে ক্লিন এনার্জি বিস্তারের জন্য আরও আরও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার কথা বলেছেন। প্রকৃতপক্ষে এগুলো কি জাতীয় গৌরব না জাতীয় বিপর্যয় , এগুলো কি ক্লিন এনার্জি না ভয়ংকর বিপদের উৎস, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এরকম বিপদ ডেকে আনা অপরিহার্য কিনা সেসব প্রশ্ন বাংলাদেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রবন্ধে বিভিন্ন গবেষণার সূত্র ধরে এসব প্রশ্নের উত্তরের পাশাপাশি প্রকল্পের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত দিকগুলোও অনুসন্ধান করা হয়েছে।

ভূমিকা

২০১৭ সালে রূপপুরে বাংলাদেশ প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করেছে। প্রশ্ন উঠেছে–বাংলাদেশের মতো প্রযুক্তিগত দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ও নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ কেন এ ধরনের একটি ব্যয়বহুল মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া সক্ষমতার দিক থেকে বিবেচনা করলেও বাংলাদেশ প্রযুক্তিগত শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও গবেষণায় শুধু নয়; প্রযুক্তি বাস্তবায়নের সক্ষমতার দিক থেকেও পিছিয়ে। এতৎসত্ত্বেও ঠিক কী বিবেচনায় এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, তার কারণ উন্মোচন করতে গেলে এই প্রকল্পটি কীভাবে বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে, কাদের স্বার্থরক্ষার নজির স্থাপিত হচ্ছে এবং কী ধরনের যুক্তি ব্যবহার করে দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করা হচ্ছে, তা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে উন্মোচন করা প্রয়োজন। আর এ কাজটি করতে হলে প্রথম ধাপে উন্মোচন করা প্রয়োজন এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পেছনে যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে, তার কতটুকু আসলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লাভের জন্য আর কতটুকু কৌশলগত উদ্দেশ্য দিয়ে চালিত হয়েছে।

এই প্রকল্পটি কীভাবে বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে, কাদের স্বার্থরক্ষার নজির স্থাপিত হচ্ছে এবং কী ধরনের যুক্তি ব্যবহার করে দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করা হচ্ছে, তা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে উন্মোচন করা প্রয়োজন।

এ কাজটি করতে গিয়ে প্রথমেই কৌশলগত সহযোগিতা আর অর্থনৈতিক সহযোগিতা বলতে কী বুঝি এবং কেন এই বিভাজনের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ, তা সংক্ষেপে বর্ণনার দাবি রাখে। অর্থনৈতিক সহযোগিতা বলতে সেই সহযোগিতাকেই বুঝে থাকি, যার মধ্যদিয়ে সমানভাবে অথবা ঈষৎ অসমভাবে হলেও উভয় দেশের সরকার তথা জনগণের অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষা হয়। তবে উভয় পক্ষের ক্ষমতা ও একে অপরকে নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা অসমান হলে এই অসমতার মাত্রা যদি অনেক বেশি হয়, তাহলে বলা যেতে পারে, এ ধরনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা একচেটিয়াভাবে শুধু এক পক্ষের স্বার্থকেই রক্ষা করে। কৌশলগত সহযোগিতার বিষয়টি আরও অনেক বেশি জটিল এবং বহুমাত্রিক। তবে বিশ্লেষণের সুবিধার্থে সহজভাবে কৌশলগত সহযোগিতা বলতে সেসব সহযোগিতাকে বোঝাচ্ছি, যা শুধু অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের উদ্দেশ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না; বরং উভয় দেশের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, দুই বা ততোধিক দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্য, বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা অথবা সুদূরপ্রসারী নিরাপত্তা নিশ্চিতের কৌশলগত বিবেচনা দ্বারা চালিত হয়। এ ধরনের সহযোগিতায় উভয় পক্ষ যেহেতু নিজ নিজ ভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দ্বারা চালিত হয়, এখানে সমতা বা অসমতার পরিমাপক সরাসরি তুলনাযোগ্য না-হলেও একে অপরকে নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা, দীর্ঘ মেয়াদে সুবিধালাভের সম্ভাব্যতা ও ভবিষ্যৎ সুবিধাভোগীদের চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে কৌশলগত সহযোগিতার অসম স্বার্থরক্ষার ভিত্তি উন্মোচন করা যায়।

প্রশ্নের গুরুত্ব

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও কৌশলগত সহযোগিতার পার্থক্য করা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কী উদ্দেশ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রিত, তা উন্মোচন প্রয়োজন অনেক কারণেই। এর মধ্যে তিনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো: ১. অনেক সময় কৌশলগত সহযোগিতার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সহজবোধগম্য আকারে হাজির থাকে না, অথবা থাকলেও অর্থনৈতিক সহযোগিতার অধিক প্রচারে তা আড়াল হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পুঁজির প্রাপ্যতা (অর্থনৈতিক) বড় কারণ হয়ে ওঠে, অন্যদিকে প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা, উদ্দেশ্য, ভবিষ্যৎ স্বার্থ (কৌশলগত উদ্দেশ্য) আড়াল হয়ে যায়। ২. নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক নীতি ‘উন্নয়নের স্বার্থে’ পুঁজির অবাধ চলাচলকে উৎসাহিত করে; কিন্তু পুঁজির মালিকানা কোনো রাষ্ট্রের না ব্যাক্তিমালিকানার–সেই প্রশ্ন আড়ালে থেকে যায়। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও কৌশলগত সহযোগিতার পার্থক্য অনুধাবন করতে হলে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের পুঁজি ও রাষ্ট্রীয় পুঁজির গতি-প্রকৃতি, শর্ত ও ব্যবহার কীভাবে ভিন্ন হয়, তা প্রথমে বোঝা জরুরি। এর মাধ্যমে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য কার স্বার্থ চরিতার্থ করে তা পরিষ্কার হয়। ৩. আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় সাধারণত অর্থনৈতিক ও কৌশলগত উভয় উদ্দেশ্যই থাকে। তবে কোন নীতি বা পদক্ষেপের পেছনে কোন উদ্দেশ্য কতটুকু ক্রিয়াশীল থাকে, তা বোধগম্য না-হওয়ার কারণে ভুল জনমত গঠনের ক্ষেত্র তৈরি হয়। আর এ কারণে পৃথকভাবে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত উদ্দেশ্যের স্বরূপ উন্মোচন করা প্রয়োজন, যেন প্রকৃত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্ট বিদ্যমান দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে।

পূর্বের গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে মূল প্রশ্নের অবস্থান

ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রি স্ট্যাটাস রিপোর্ট (২০২১) অনুযায়ী, ১৭টি দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এবং আরও বেশ কয়েকটি দেশ এখনো চিন্তাভাবনা করছে। ২০১১ সালে জোয়েল (২০১১) পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে নতুন আগমনকারী দেশগুলোয় প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলেন। সেখানে তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে, একটি দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা নির্ভর করে সে দেশের সক্ষমতা ও প্রেরণার(motivation) ওপর। তিনি নতুন আসা দেশগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশকে মিশর, ইন্দোনেশিয়া ও নাইজেরিয়ার সঙ্গে ‘খুব ঝুঁকিপূর্ণ’ কাতারে ফেলেছেন। তিনি ধারণা করেছিলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সুশাসনের অভাবের কারণে এসব দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বিনিয়োগ নিশ্চিত করা কঠিন হবে। তার সেই গবেষণার সময় পারমাণবিকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ধারা যেভাবে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিল, তা তিনি বিবেচনায় না নিয়ে শুধু এর ঝুঁকির মাত্রা দিয়ে দেশগুলোকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ফেলেছিলেন। পরবর্তী সময়ে জোয়েল ও ব্রুসচিন (২০১৮) আরেকটি গবেষণাপত্র যখন প্রকাশ করেন, তত দিনে রাশিয়া ও চীন পিছিয়ে থাকা কয়েকটি দেশে বিনিয়োগে এগিয়ে গেছে। তাদের মতে, রাশিয়া ও চীন ঝুঁকি ও সক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রতিবন্ধকতাগুলোকে (যেমন: প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, নিউক্লিয়ারবিরোধী জনমত, ঝুঁকি) হয় আমলে না নিয়ে অথবা আপাতদৃষ্টিতে অতিক্রম করে (যেমন: প্রযুক্তি সক্ষমতায় সহযোগিতা, আন্দোলন দমন, জনমত নিয়ন্ত্রণ) বিনিয়োগে এগিয়ে গেছে। এ থেকে দেখা যায়, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিনিয়োগের সঙ্গে ঝুঁকির যে বিপরীতমুখী সম্পর্ক রয়েছে এবং প্রথাগত জ্ঞান অনুযায়ী আমরা যা কিছু বিনিয়োগের পূর্বশর্ত হিসেবে জানি, তা আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রয়োগ হচ্ছে না।

জোয়েলের (২০১১) গবেষণার সময়, ২০০৯ সাল থেকে ৪টি নতুন দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে। তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, তুরস্ক, বেলারুশ ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এর মধ্যে প্রথম তিনটি দেশে রাশিয়া বিনিয়োগ করেছে। ২০১৫ সালে জোয়েল ও আতেশ তুরস্কের ওপর কেস স্টাডি করে দেখিয়েছেন, রাশিয়া কীভাবে তুরস্ককে বিনিয়োগের অনিশ্চয়তা অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে। দেখা যাচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা আবশ্যক ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এ ধরনের সহযোগিতা নিয়ে খুব বেশি গবেষণা হয়নি। তবে এর মধ্যে ব্যতিক্রমভাবে ল্যান্টিস (২০১৪) প্রশ্ন তুলেছেন–এ ধরনের সহযোগিতার পেছনে কতটুকু অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে, আর কতটুকু কৌশলগত। ল্যান্টিসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো, তিনি প্রযুক্তি সরবরাহকারী দেশের মূল চালিকাশক্তি উদ্ঘাটন করতে গিয়ে ঐতিহাসিকভাবে নির্মিত কৌশলগত সম্পর্ক, ক্লায়েন্টকে রাজি করাতে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং ভবিষ্যৎ কৌশলগত কার্যভারের ভূমিকার ওপর আলোকপাত করেছেন। তবে তিনি প্রযুক্তি গ্রহণকারী দেশ কর্তৃক প্রদত্ত সুবিধার দিকে তেমন জোর দেননি। প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রসারে কেন্দ্র (core) ও প্রান্তের (periphery) মধ্যে অসম স্বার্থের সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করেননি।

জোয়েল ও ল্যান্টিসের গবেষণার অবদান অনস্বীকার্য হলেও তাদের ব্যবহৃত ফ্রেমওয়ার্ক আংশিকভাবে বাংলাদেশের পারমাণবিক প্রকল্প গ্রহণের বিষয়টি পর্যালোচনা করেছে, পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণের জন্য শুধু প্রযুক্তি সরবরাহকারী দেশ নয়, প্রযুক্তি গ্রহণকারী দেশের অবস্থান এবং কৌশলগতভাবে অসম স্বার্থরক্ষার প্রেক্ষিত বিবেচনা করা প্রয়োজন। আমি এই গবেষণাপত্রে জোয়েল ও ল্যান্টিসের পর্যালোচনায় প্রযুক্তি সরবরাহকারী দেশের উদ্দেশ্যের পাশাপাশি প্রযুক্তি গ্রহণকারী দেশের উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করব।

পারমাণবিক প্রকল্পের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

১৯৬০ সালে বর্তমান বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের অংশ ছিল, পাকিস্তান অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন প্রথম রূপপুরে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের পরিকল্পনা করে। ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পাকিস্তান ইউএসএআইডির সঙ্গে ৭০ মেগাওয়াট নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের জন্য দরকষাকষি শুরু করে। কিন্তু আলোচনা সফল হয়নি। ১৯৬৮ সালে একটি সোভিয়েত কোম্পানি প্রেশারইজড ওয়াটার রিঅ্যাকটর ব্যবহার করে ৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার প্ল্যান্ট নির্মাণের প্রস্তাব দেয়। ১৯৬৯ সালে একটি বেলজিয়াম কোম্পানিও ২০০ মেগাওয়াট প্ল্যান্ট নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল। (Ehsan et al, 2014); কিন্তু এর কোনোটিই বাস্তবায়ন পর্যন্ত এগোয়নি।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭০ ও ১৯৮০-র দশকে ফরাসি, জার্মান ও সুইস কোম্পানি বাংলাদেশে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের সম্ভাব্যতা যাচাই করে। এরপর ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে। ২০০৭ সাল নাগাদ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন একই স্থানে দুটি ৫০০ মেগাওয়াট রিঅ্যাকটর স্থাপনের খসড়া প্রস্তাব দাঁড় করায়। তখন থেকেই চীন, রাশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে অর্থায়নের আগ্রহ দেখায় এবং একইসঙ্গে প্রযুক্তি সহায়তা দেওয়ার আগ্রহ জানায়। (Karim et al. 2018) লক্ষণীয় যে, এখানে তখনও কোনো আনুষ্ঠানিক দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। একটি খসড়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।

২০০৯ সালে রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি প্রস্তাব পেশ করে। তারপর থেকে বাংলাদেশ অন্য কোনো দেশ থেকে কোনো সহযোগিতার প্রস্তাব পায়নি। রাশিয়ার প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ও রাশিয়া পরবর্তী সময়ে দ্বিপাক্ষিক পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি সই করে। ২০১৭ সালে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এর মধ্যে প্রথম ইউনিটটি ২০২৩ সালে এবং দ্বিতীয়টি ২০২৪ সালে কমিশনিং হওয়ার কথা। তবে ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রি স্ট্যাটাস রিপোর্ট (২০২১) অনুযায়ী, বর্তমানে নির্মাণাধীন প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৫৮.৮ শতাংশ প্রকল্পে দেরি হওয়ার নজির পাওয়া গেছে আর কিছু কিছু প্রকল্পে নিশ্চিতভাবে শেষ হবে তা বলা যায় না। বাংলাদেশ সেসব দেশের মধ্যে একটি, যেখানে সময়মতো শেষ হওয়ার ব্যাপারে অনিশ্চয়তা রয়েছে।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত মেকানিজম

প্রবন্ধের এই অংশে আমি তিন ধরনের মেকানিজম উপস্থিত করব, যার মাধ্যমে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার মধ্যে কোনটি, কখন ও কেন বেশি ক্রিয়াশীল ছিল, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। এর ভিত্তিতে এই সহযোগিতার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের স্বরূপ উন্মোচন করার চেষ্টা করব।

১। চাহিদার মেকানিজম

বেশিরভাগ দেশ নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরির পক্ষে সবচেয়ে বেশি যেই কারণগুলোকে যুক্তি হিসেবে দেখায় তা হলো, ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি, আমদানি নির্ভরতা কমানো, জ্বালানি ব্যবহারে বৈচিত্র্য আনা এবং বায়ুদূষণ কমানো (IAEA, 2016)। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যেই কারণটি সবসময় দেখানো হয়েছে তা হলো, বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি। ১৯৬০ সালে যখন প্রথম নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের আলোচনা শুরু হয়, তখনও যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছিল বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে। এরপর থেকে এই কারণ দেখানো অব্যাহত রয়েছে। যদিও এর মধ্যে বাংলাদেশে গ্যাস আবিষ্কার হয়েছে এবং উত্তোলন করে ব্যবহারও করা হয়েছে। গ্যাসের সম্ভাবনাকে যথাযথ পরিকল্পনামাফিক কাজে লাগানো না-হলেও ১৯৬০ সালের পর থেকে বাংলাদেশ ক্রমেই নিজ দেশেরই উত্তোলিত গ্যাসের ওপরই বেশি নির্ভরশীল হয়েছে। সুলতানার (২০১৬) গবেষণা প্রবন্ধে উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশের বিদ্যুতের ঘাটতির কারণ জ্বালানির অভাব নয়; বরং যথাযথ পরিকল্পনা ও নীতির অভাব। গত ৬০ বছরে (১৯৬০-২০২০ সাল) বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। চাহিদা ও জোগানের সমন্বয় পুরোপুরি না-হলেও যেই ঘাটতির কথা তখন বলা হয়েছিল, তা পূরণে নিজ দেশের গ্যাস ব্যবহার করা হয়েছে। পারমাণবিক প্রকল্প গ্রহণের ঠিক আগে যখন বিকল্প জ্বালানি (গ্যাস, সৌর, বায়ু) ব্যবহার করে আরও দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ ছিল, তখনও সেই একই যুক্তি দেখানো হয়েছিল।

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের স্থলভাগে ও অগভীর সমুদ্রে এখনো ১৩.৫ টিসিএফ proven and probable recoverable গ্যাস আছে। বাংলাদেশ এখন প্রতিবছর প্রায় এক টিসিএফ গ্যাস ব্যবহার করে। হাইড্রোকার্বন ইউনিট এবং নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডিরেক্টরেট বের করছে যে, বাংলাদেশে মোট ৫৫.১২ টিসিএফ অনাবিষ্কৃত গ্যাস রিজার্ভ থাকার ৫০ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে, আর ৯০ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে ৩২.০২ টিসিএফ অনাবিষ্কৃত গ্যাস মজুদের (EMRD, 2018)। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ৬৯ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে প্রাকৃতিক গ্যাস রিজার্ভ থেকে। যদি গ্যাস উত্তোলন অব্যাহত রেখে এরই মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে বাংলাদেশের সক্ষমতা বাড়ানো যায়, তাহলে ২০৪০ সাল পর্যন্ত এই গ্যাস ব্যবহার করে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের স্থলভাগে ও অগভীর সমুদ্রে এখনো ১৩.৫ টিসিএফ proven and probable recoverable গ্যাস আছে। বাংলাদেশ এখন প্রতিবছর প্রায় এক টিসিএফ গ্যাস ব্যবহার করে। হাইড্রোকার্বন ইউনিট এবং নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডিরেক্টরেট বের করছে যে, বাংলাদেশে মোট ৫৫.১২ টিসিএফ অনাবিষ্কৃত গ্যাস রিজার্ভ থাকার ৫০ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে, আর ৯০ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে ৩২.০২ টিসিএফ অনাবিষ্কৃত গ্যাস মজুদের (EMRD, 2018)।

বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান, যেমন: Renewable and Appropriate Energy Laboratory (RAEL), University of California, Berkeley and National Renewable Energy Laboratory (NREL) and Institute of Energy Economics and Financial Analysis (IEEFA) হিসাব করে দেখিয়েছে যে, বাংলাদেশে যথাক্রমে ১২০ গিগাওয়াট এবং ২৪০ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে (NREL 2014, IEEFA, 2016)। এ ছাড়া RISOE National Laboratory, Denmark, Denmark Technical University (DTU), and National Renewable Energy Laboratory (NREL) হিসাব করে দেখিয়েছে, বাংলাদেশের ২০ গিগাওয়াট (১০০ মিটার হাব হাইট ও ১৩০ মিটার রটর ডায়ামিটার) বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে (Saifullah et al, 2017)।

বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় গ্যাস (৭১.৮২ শতাংশ), তারপর তেল (১৩.৫ শতাংশ) এবং কয়লা (৪.১৬ শতাংশ) আমদানি (৫.৬৯ শতাংশ) ও জলবিদ্যুৎ (১.১৩ শতাংশ) (BPDB, 2020)। ২০১৬-এর বিদ্যুৎ খাত মহাপরিকল্পনা, যা ২০১৮ সালে কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে, সে অনুযায়ী ২০৪১ সাল নাগাদ বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি মিশ্রণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। সেখানে ২০৪১ সাল নাগাদ নিউক্লিয়ারের লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশ এবং আমদানি করা নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ রাখা হয়েছে। যখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির দাম কমে আসছে; যেমন, বাংলাদেশেই ২০১৫ থেকে ২০২০ সালে গ্রিডে সরবরাহযোগ্য ইউটিলিটি স্কেল সৌরবিদ্যুতের মূল্য প্রায় অর্ধেকে নেমে আসতে দেখা গেছে, সেখানে পরিকল্পনায় সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রতি জোর দেওয়া যেত। কিন্তু তা না-করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নের ব্যাপারে উদাসীনতা লক্ষ করা গেছে।

যখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির দাম কমে আসছে; যেমন, বাংলাদেশেই ২০১৫ থেকে ২০২০ সালে গ্রিডে সরবরাহযোগ্য ইউটিলিটি স্কেল সৌরবিদ্যুতের মূল্য প্রায় অর্ধেকে নেমে আসতে দেখা গেছে, সেখানে পরিকল্পনায় সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রতি জোর দেওয়া যেত। কিন্তু তা না-করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নের ব্যাপারে উদাসীনতা লক্ষ করা গেছে।

২। উন্নয়নের রাজনৈতিক মেকানিজম

অর্থনৈতিক দিক থেকে সাশ্রয়ী ও প্রযুক্তি সক্ষমতাবান্ধব হলেও বাংলাদেশের মতো দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নে গড়িমসি ও অন্যদিকে নিউক্লিয়ার প্রযুক্তির প্রতি অনুরাগ কেন, তা উন্মোচন করতে গেলে কয়েকটি উদাহরণ হাজির করা যায়। নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের নির্মাণকাজ উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী স্বপ্নপূরণের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম কংক্রিট ঢালাইয়ের মধ্যদিয়ে মূল অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হলো। এরই সঙ্গে সঙ্গে পরমাণু বিশ্বে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য অনেক আনন্দ ও গৌরবের।’ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম কংক্রিট ঢালাইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ যুক্ত হলো পারমাণবিক বিশ্বের কাতারে। শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন নয়, এই কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ উন্নীত হলো ভিন্ন ধরনের এক আন্তর্জাতিক মর্যাদায়।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের এই দেশকে একটি উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সমর্থ হব–রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ তার একটি প্রমাণ।’ (ভোরের কাগজ, ডিসেম্বর ১ ২০১৭)

ক. পারমাণবিক বিশ্বে পদার্পণের মর্যাদা

বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪০ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পরিকল্পনা করেছে। এই লক্ষ্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের রাজনৈতিক রূপকল্পের একটি অংশ। জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক অবস্থান থেকে ‘পারমাণবিক বিশ্বে পদার্পণ’ ধরনের অভিব্যক্তি প্রকাশ জনগণের মানসে জাতি হিসেবে উন্নত পদমর্যাদা বোধের ধারণা স্থিত করার বহিঃপ্রকাশ। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর নির্ভর করে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে একটি দেশ বড়জোর প্রযুক্তি ব্যবহারের সহায়তা পায়, প্রযুক্তির স্বত্ব লাভ করে না বা সাহায্য ছাড়া প্রযুক্তিকে অন্য কাজে লাগানোর সক্ষমতা অর্জন করে না। কাজেই ‘পারমাণবিক বিশ্বে পদার্পণের’ অভিব্যক্তিটি এখানে শুধু বিভ্রান্তিমূলকই নয়, পদমর্যাদা নিয়ে মোহগ্রস্ত মানুষকে একটি মিথ্যা গর্বের ভাগীদার করতে উদ্বুদ্ধ করার অনন্য কৌশলও। এ ছাড়া ‘নিউক্লিয়ার ক্লাবের’ সদস্য হওয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরেও ‘হাই স্ট্যাটাস’ পরিচয়ের মোহ কাজ করে। এ ধরনের ক্লাবের সদস্যভুক্তি যেমন দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তেমনি উচ্চমর্যাদার মোহে আবিষ্টও রাখে। অনুন্নত ও পিছিয়ে থাকা দেশের জন্য এ ধরনের সদস্যভুক্তি স্বপ্নের হাতছানির মতোই কাজ করে। রাজনৈতিক বক্তব্যগুলো থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশও নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণকে পদমর্যাদা বৃদ্ধির সুযোগ হিসেবে দেখছে। এ ছাড়া জনগণের মধ্যে উন্নয়ন সম্পর্কে যেই ধারণা সচেতনভাবে তৈরি করা হয়েছে, তাতে নিউক্লিয়ারের ঝুঁকি দূরবর্তী সম্ভাবনা হিসেবে হাজির করে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকে আধুনিকতা ও উন্নয়নের প্রতীকের মোড়কে পরিবেশন করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর নির্ভর করে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে একটি দেশ বড়জোর প্রযুক্তি ব্যবহারের সহায়তা পায়, প্রযুক্তির স্বত্ব লাভ করে না বা সাহায্য ছাড়া প্রযুক্তিকে অন্য কাজে লাগানোর সক্ষমতা অর্জন করে না। কাজেই ‘পারমাণবিক বিশ্বে পদার্পণের’ অভিব্যক্তিটি এখানে শুধু বিভ্রান্তিমূলকই নয়, পদমর্যাদা নিয়ে মোহগ্রস্ত মানুষকে একটি মিথ্যা গর্বের ভাগীদার করতে উদ্বুদ্ধ করার অনন্য কৌশলও।

ফ্রান্সের মতো দেশও নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি সক্ষমতা অর্জনের শুরুতে এ ধরনের জাতীয়তাবোধ দ্বারা উদ্বুদ্ধ ও চালিত হয়েছিল। ১৯৬০-এর দশকের ফ্রান্স ও ২০১০-এর দশকের বাংলাদেশ একই অবস্থায় নেই। সেই সময় উন্নয়ন সম্পর্কে বৈশ্বিক ধারণা, প্রতিযোগিতা ও পদমর্যাদার বিষয়টি যেভাবে দেখা হতো, এখন সেভাবে দেখা হয় না। এখন কোনো দেশ কত দ্রুত কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে, কত সাশ্রয়ে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারে এগিয়ে যাবে, তা দিয়ে মর্যাদা নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশের মতো দেশ সেদিক থেকে এখনো গৌরবের যেই ভ্রান্ত পরিমাপক দিয়ে আধুনিকতা ও উন্নয়নকে দৃশ্যমান করতে চাইছে, তা আসলে মর্যাদাকর না-হলেও এটাই বাস্তব যে, এই মোহাবিষ্ট দশার মধ্যে জাতীয় গৌরব ও আধুনিকতার মোহ এখানে অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। এর মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণাহীন, প্রযুক্তিভক্ত বিশেষজ্ঞ শ্রেণিরও উন্মেষ ঘটেছে। আর এই দুইয়ের সংযোগে যেভাবে জনমত গঠন করা হয়েছে তাতে অর্থনৈতিক লাভক্ষতি, পরিবেশগত লাভক্ষতি ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকির চেয়ে জাতীয় গৌরব, আধুনিকতা ও উন্নয়ন অগ্রগণ্য হয়েছে।

খ. শিথিল শর্ত ও নিউক্লিয়ারবিরোধী আন্দোলন দমন

বাংলাদেশ রোসাটমের সঙ্গে চুক্তির সময় কিছু শর্ত শিথিল করে দিয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশ সরকার ও রোসাটমের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী রোসাটম কস্ট প্লাস মডেল অনুসরণ করবে। শর্তানুযায়ী রাশিয়া ৯০ শতাংশ পুঁজি ঋণ হিসেবে দেবে, তবে খরচ বেড়ে গেলে তা জোগানোর দায়িত্ব বাংলাদেশের ওপর বর্তাবে। এতে রাশিয়ার নির্মাণ কোম্পানি সময় সময় প্রফিট মার্জিন বাড়ানোর জন্য ইচ্ছেমতো খরচ বাড়াতে পারে। ঘোষিত সময়ে রূপপুর প্রকল্প সম্পূর্ণ করা যাবে কি না, সংবাদপত্রের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের জন্য সঞ্চালন লাইন স্থাপনের কাজ ২০১৮ সালে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা শুরু হতে তিন বছর চলে যায়। এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণের ছাড়পত্র পেতেই ১৩ মাস লেগে যায়। এ ছাড়া ২০১৭ সাল থেকে শুরু করে ২০২১-এর জুলাই পর্যন্ত (৪ বছরে) প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৩৮.৬৭ শতাংশ। ২০২৩ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ কাজ শেষ হতে হলে দুই বছরের মধ্যে বাকি ৬২ শতাংশ কাজ শেষ হতে হবে। (মহিউদ্দিন, ২০২১)

দ্বিতীয়ত, কোনো কারণে প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেলে বা দুর্ঘটনার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা পড়লে বাংলাদেশকে সুদসহ এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। নিউক্লিয়ারবিরোধী আন্দোলন শক্তিশালী হলে যেহেতু এই প্রকল্প সরকারের জন্য একটি বড় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে, তাই প্রকল্প শুরুর আগে জমি অধিগ্রহণ ও ঝুঁকির কারণে যারা এর বিরোধিতা করেছেন, তাদেরকে প্রথম থেকে শক্ত হাতে দমন করা সরকারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ কাজটি করতে গিয়ে প্রকল্প শুরুর একেবারে প্রথমদিকে আন্দোলনের কর্মীদের লিফলেট বিতরণে বাধা থেকে শুরু করে মানববন্ধন করার আগে ভয়ভীতি প্রদর্শন ইত্যাদির মাধ্যমে গোড়াতেই স্থানীয় আন্দোলনকারীদের চাপের মধ্যে রাখা হয়। এ সময় স্থানীয়রা আন্দোলন গড়ে তুলতে না-পারলেও রাজধানীকেন্দ্রিক বিশেষজ্ঞ ও প্রবাসী বিশেষজ্ঞরা প্রকল্পের চুক্তি, স্থান নির্বাচন, দুর্ঘটনার ঝুঁকি, পরিবেশের ওপর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রভাব, সক্ষমতার অভাব, ব্যয়বহুলতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা, লেখালিখি ও বৈঠক চালিয়ে গেছেন। কিন্তু এই সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে সরকার নিউক্লিয়ার বিষয়ে বাস্তব পরিস্থিতিকে আড়াল করে, পরিবেশের ওপর প্রভাব নিয়ে জনগণকে তথ্য না দিয়ে, প্রযুক্তি বিষয়ে অন্ধভক্তি তৈরি করে, অন্ধভক্তিকে পুঁজি করে, নিউক্লিয়ারকে জাতীয়তাবাদী মনোভাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে যে পালটা বয়ান রচনা করেছে, তার মধ্যদিয়ে ঝুঁকি বিষয়ক জনমত ধামাচাপা পড়েছে। আর এই ভিন্নমত দমনের পেছনে সরকারের বিনিয়োগের অন্যতম কারণ হলো, এই দমনের পেছনে বিনিয়োগের খরচ রাজনৈতিকভাবে একটি প্রকল্পকে দৃশ্যমান করার সুফলের চেয়ে কম। অর্থাৎ, কৌশলগত কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে গিয়ে সরকার এই প্রকল্পের পক্ষের বয়ানকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। সরকারের এই প্রচেষ্টা রোসাটমের পক্ষে কাজ করছে আর এটা রোসাটমের জন্যও সুবিধাজনক হয়েছে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ দায়মুক্তি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নিউক্লিয়ার প্রকল্প চলাকালে কোনো দুর্ঘটনা বা অবহেলাজনিত ক্ষতি হলে তা থেকে কোম্পানিকে দায়মুক্তি দিয়েছে। এসব শিথিলতা বিবেচনা করলে বাংলাদেশ রোসাটমের জন্য কৌশলগত প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য।

প্রকল্প শুরুর একেবারে প্রথমদিকে আন্দোলনের কর্মীদের লিফলেট বিতরণে বাধা থেকে শুরু করে মানববন্ধন করার আগে ভয়ভীতি প্রদর্শন ইত্যাদির মাধ্যমে গোড়াতেই স্থানীয় আন্দোলনকারীদের চাপের মধ্যে রাখা হয়। এ সময় স্থানীয়রা আন্দোলন গড়ে তুলতে না-পারলেও রাজধানীকেন্দ্রিক বিশেষজ্ঞ ও প্রবাসী বিশেষজ্ঞরা প্রকল্পের চুক্তি, স্থান নির্বাচন, দুর্ঘটনার ঝুঁকি, পরিবেশের ওপর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রভাব, সক্ষমতার অভাব, ব্যয়বহুলতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা, লেখালিখি ও বৈঠক চালিয়ে গেছেন।

৩। প্রযুক্তিগত সক্ষমতার মেকানিজম

বিদ্যুৎ খাত মহাপরিকল্পনা ২০১৬ অনুযায়ী, বাংলাদেশ বর্তমানের ২০ গিগাওয়াট সক্ষমতা বৃদ্ধি করে ২০৩১ সাল নাগাদ ৩৪.৫ গিগাওয়াটে উন্নীত করার পরিকল্পনা করেছে। নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের প্রযুক্তিগত সামর্থ্যের শর্তানুযায়ী প্রাথমিকভাবে জাতীয় গ্রিডের আকার ততটুকু বড় হওয়া উচিত ছিল, যতটুকু হলে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের উৎপাদনক্ষমতা মোট উৎপাদনক্ষমতার ১০ শতাংশ হয়। অর্থাৎ, ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ গ্রিডে যুক্ত হতে হলে গ্রিডের সক্ষমতা থাকতে হবে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালনের। ২০২৩ সালে প্রথম ইউনিটটি চালুর সময় গ্রিডের সাইজ ২৪ হাজার মেগাওয়াট হলে নিউক্লিয়ার থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ মোট উৎপাদনের ১০ শতাংশ হবে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ২০২১ সালের অক্টোবরের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ২২ হাজার ৩১ মেগাওয়াট। অর্থাৎ, ২০২৩ সাল নাগাদ বাংলাদেশের স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা হতে হবে ২৪ হাজার মেগাওয়াট। যদি ধরে নিই, বাংলাদেশের ২০২৩ সাল নাগাদ সেই ক্ষমতা তৈরি হয়ে যাবে, তবু এর বাইরে একটি প্রশ্ন রয়ে যায়। আর তা হলো, স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা এখন ২২ হাজার ৩১ মেগাওয়াট হলেও চাহিদা কম থাকায় অক্টোবর মাসে সর্বাধিক উৎপাদন হয়েছে ১৩ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট। অর্থাৎ, স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াটের ওপর হলেও গ্রিডের সক্ষমতা কি আসলে ২২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের সক্ষমতা রাখে কি না, তা হাতে-কলমে প্রমাণিত নয়। শহরের বিভিন্ন এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকলেও জেলা শহরগুলোয় এবং গ্রামাঞ্চলে এখনো গ্রিড বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের ঘাটতি রয়েছে এবং কখনো কখনো গ্রিডের সক্ষমতা এই লোডশেডিংয়ের জন্য দায়ী। কাজেই স্থাপিত বিদ্যুৎ সক্ষমতাই গ্রিডের সক্ষমতার পরিমাপক নয়। এবং এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

আবার সক্ষমতা শুধু গ্রিডের সক্ষমতা ও আকার দিয়ে নির্ধারিত হয় না। প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর বাইরেও বিশেষ প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে এমন বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী ও অভিজ্ঞ পেশাদারি ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতি সক্ষমতার অন্যতম পরিমাপক। রোসাটম বাংলাদেশের প্রথম নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রের সহযোগী অংশীদার। তাদের দাবি অনুযায়ী আমদানিকৃত ভিভিআর-১২০০ ওয়াটার কুলড, ওয়াটার মডারেটেড পাওয়ার রিঅ্যাকটর প্রযুক্তি উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তি। এর ব্যবহার ও অভিজ্ঞতা এখন পর্যন্ত সীমিত পরিসরেই হয়েছে। করিমের গবেষণা প্রবন্ধে (Karim et al, 2018) উল্লেখ করা হয়েছে, পর্যাপ্ত দেশীয় জনশক্তির অভাব এই নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ প্রকল্পের ওপর প্রভাব ফেলবে।

প্রযুক্তি ও জনশক্তির পর তৃতীয় সক্ষমতার শর্তটি হলো, নির্দিষ্ট নিয়মে ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ২০১৫ সালে পাস করা নিউক্লিয়ার পাওয়ার অ্যাক্টের বাইরে উল্লেখযোগ্য কোনো নিয়ন্ত্রণকারী আইনি কাঠামো তৈরি করতে পারেনি। ওই অ্যাক্টের মাধ্যমে নিউক্লিয়ার পাওয়ার কোম্পানি অব বাংলাদেশ (NPCB) গঠন করা হয় বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য। কোনো বিপর্যয় ঘটলে কে দায়ী থাকবে, কাকে অভিযুক্ত করা হবে, কে ক্ষতিপূরণ দেবে, কতটুকু ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য–এই বিষয়ে কোনো আইন প্রণয়ন করা হয়নি। বরং অপারেটরদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে (Karim et al, 2018)। ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশে কোনো আইন না-থাকায় নিয়ন্ত্রণ সক্ষমতায় বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে।

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ২০১৫ সালে পাস করা নিউক্লিয়ার পাওয়ার অ্যাক্টের বাইরে উল্লেখযোগ্য কোনো নিয়ন্ত্রণকারী আইনি কাঠামো তৈরি করতে পারেনি। ওই অ্যাক্টের মাধ্যমে নিউক্লিয়ার পাওয়ার কোম্পানি অব বাংলাদেশ (NPCB) গঠন করা হয় বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য। কোনো বিপর্যয় ঘটলে কে দায়ী থাকবে, কাকে অভিযুক্ত করা হবে, কে ক্ষতিপূরণ দেবে, কতটুকু ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য–এই বিষয়ে কোনো আইন প্রণয়ন করা হয়নি।

সক্ষমতার চতুর্থ পরিমাপক হলো প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা (Institutional capacity)। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা মাপতে জোয়েল (২০১১) বিশ্বব্যাংকের প্রচলন করা Government Effectiveness indicator (GEI) ব্যবহার করেছেন। জোয়েল দেখিয়েছিলেন, এই রেটিংয়ে বাংলাদেশ সর্বশেষ কোয়ার্টাইলে ছিল বা বলা যায় র‍্যাঙ্কিংয়ে অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় অনেক নিচে ছিল। ২০০৯ সালের পর বাংলাদেশের অবস্থান আরও নিম্নগামী হয়, স্কোর ২০০৯ সালের ২৪ থেকে ২০১৭ সালে ২২-এ নেমে আসে (World Bank, 2018)। বিশ্বে এখন এমন কোনো দেশ নেই, যা এই রেটিংয়ে এত নিম্নে অবস্থান করে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে বা করছে।

বাংলাদেশকে রাশিয়ার সহযোগিতার মধ্যদিয়ে ভিভিআর-১২০০ নতুন প্রযুক্তিটির নিশ্চিত বিকাশ ঘটবে। একটি প্রযুক্তি একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানায় চালু হওয়ার পর তা ভিন্ন একটি স্থানে ব্যবহারের সক্ষমতা তৈরির মধ্যদিয়ে স্থানিক প্রযুক্তি বিকাশ (spatial technology diffusion) ঘটে। এতে প্রযুক্তির উদ্ভাবক দেশটির লাভ হলো, সেই দেশটি অন্য দেশে ঝুঁকি নিয়ে সফল হলে পরবর্তী সময়ে তার উদ্ভাবনের ব্যাবসায়িক মূল্য বাড়ে। কাজেই কোনো একটি নতুন স্থানে বা দেশে নিজ দেশের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রেরণা দিয়ে চালিত হয়ে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন কোনো নতুন ঘটনা নয়।

এই সর্বজনজ্ঞাত উদ্দেশ্যটি ছাড়াও এই প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার দুটি গুরুত্বপূর্ণ ও মূল চালিকাশক্তি ছিল:

ক. দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক শক্তির প্রসার

বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে। ১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশ জন্মের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। তখন থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে শুধু কৌশলগতভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যম হিসেবে ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্ভাবনা হিসেবেই দেখেনি; কৌশলগত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য অর্থনৈতিক প্রভাব প্রসারের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবেও বিবেচনা করেছিল। এই অর্থনৈতিক প্রসারের অংশ হিসেবে এত দিন রাশিয়া বাংলাদেশে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে অর্থনৈতিক সহযোগিতার নামে বিনিয়োগ ও অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছিল। কিন্তু এদিকে চীন বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণ, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসহ অন্যান্য বাণিজ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে যে দৃঢ় অর্থনৈতিক সম্পর্ক গঠন শুরু করে, তাতে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে চীনের অর্থনৈতিক আধিপত্য সংহত ও আরও দৃশ্যমান হতে থাকে। কাজেই রাশিয়ার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি রসাটমের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই অঞ্চলে সরবে ও দীর্ঘ সময়ের জন্য উপস্থিত থাকা কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে আর একটি বিষয়ও লক্ষ করার মতো। রাশিয়া ও ভারতের আগে থেকেই পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়নের ইতিহাস আছে। রূপপুর প্রকল্পে ভারতের অংশগ্রহণ রাশিয়ার ভারতের নিউক্লিয়ার সাপ্লাইয়ার গ্রুপে সদস্যভুক্তিকে সমর্থন হিসেবে দেখা যায়। উল্লেখ্য, নিউক্লিয়ার সাপ্লাইয়ার গ্রুপে সদস্যভুক্তির জন্য ভারত আগ্রহী হলেও চীন সবসময় এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এদিকে ভারতের জন্য দেশের বাইরে (বাংলাদেশে) নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি সহায়তা দেওয়ার রেকর্ড ভারতের নিউক্লিয়ার সাপ্লাইয়ার গ্রুপে সদস্যভুক্তির পক্ষে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াবে। এই প্রকল্পে ভারতকে যুক্ত করে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বিমতজনিত বিভেদের উদাহরণ আরও স্পষ্ট হলো। কৌশলগত দিক থেকে এই অঞ্চলে একটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে রাশিয়ার ভবিষ্যতে দীর্ঘ উপস্থিতি নিশ্চিত করে। এর মধ্যদিয়ে রাশিয়া এমন একটি দেশে আরও দৃশ্যমান হলো, যেখানে আগে থেকেই চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ করেছে এবং যেখানে রাশিয়ার উপস্থিতি ও বিনিয়োগ অতটা দৃশ্যমান ছিল না। আর এ ধরনের প্রকল্পে ঋণ দেওয়া তো আসলে অর্থসহায়তা নয়, দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ পরিশোধের দায় বাংলাদেশের জনগণের ওপরই বর্তায়। সেদিক থেকে ঋণসহায়তা ও প্রকল্প থেকে জনগণের ভবিষ্যৎ লাভের যে ধারণা তৈরি করা হয়েছে, তার পেছনে যতটুকু-না অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের জন্য লাভবান হওয়ার তাড়না কাজ করেছে, তার চেয়ে বেশি কাজ করেছে বাংলাদেশের জাতীয় গৌরবের আকাঙ্ক্ষাকে কাজে লাগিয়ে রাশিয়ার কৌশলগত উদ্দেশ্য সাধনের পরিকল্পনা।

রূপপুর প্রকল্পে ভারতের অংশগ্রহণ রাশিয়ার ভারতের নিউক্লিয়ার সাপ্লাইয়ার গ্রুপে সদস্যভুক্তিকে সমর্থন হিসেবে দেখা যায়। উল্লেখ্য, নিউক্লিয়ার সাপ্লাইয়ার গ্রুপে সদস্যভুক্তির জন্য ভারত আগ্রহী হলেও চীন সবসময় এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এদিকে ভারতের জন্য দেশের বাইরে (বাংলাদেশে) নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি সহায়তা দেওয়ার রেকর্ড ভারতের নিউক্লিয়ার সাপ্লাইয়ার গ্রুপে সদস্যভুক্তির পক্ষে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াবে।

খ. বাংলাদেশ ও ভারতকে নিয়ে সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি ক্লাস্টার

ভৌগোলিকভাবে কাছে অবস্থান করা ও অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীলতার সম্পর্কের কারণে বাংলাদেশ ও ভারতকে একইসঙ্গে এই প্রকল্পে যুক্ত করার মধ্য দিয়ে রাশিয়া প্রযুক্তি ক্লাস্টারের সুবিধা কাজে লাগাতে পারছে। ল্যান্তিস (২০১৪) নিউক্লিয়ার সহযোগিতা চুক্তি বাড়ার প্যাটার্ন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের চুক্তিগুলোর ধরন পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, এ ধরনের ক্লাস্টার তৈরি হয় সেসব দেশের আশপাশে, যেখানে যেমন সরকারগুলো তেমন করপোরেশনগুলো নিজেদের মধ্যে নিউক্লিয়ার চুক্তি নিয়ে দরকষাকষিতে সফল হওয়ার জন্য একে অপরের সহায়তা নিয়ে কাজ সম্পন্ন করতে উদ্ধত হয়। একটি দ্বিপক্ষীয় নিউক্লিয়ার সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদনের ফলে আরও ডজনখানেক চুক্তি করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। যেমন, যৌথ গবেষণা প্রকল্প, এনরিচমেন্ট, রিপ্রসেসিং এবং বর্জ্য স্টোরেজ (Lantis, 2014)।

রোসাটমের সঙ্গে ভারতের পারমাণবিক সহায়তার একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় ভারতে রাশিয়ার সহযোগিতায় আরও বেশ কিছু পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প পরিকল্পনাধীন রয়েছে। ২০০৯ সালে রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে একটি চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া ভারতকে ক্লোজড ফুয়েল সাইকেল করার পেছনে কোনো শর্ত জুড়ে দেয়নি। ক্লোজড ফুয়েল সাইকেলের শর্তানুযায়ী ভারত মাইনিং, রিঅ্যাকটরের জন্য ফুয়েল প্রস্তুত এবং খরচ হয়ে যাওয়া ফুয়েলকে পুনঃপ্রক্রিয়া (reprocessing) করে ব্যবহার উপযোগী করতে পারবে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রর উদ্যোগে গৃহীত নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের ক্ষেত্রে ভারতকে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থেকে ফুয়েল পুনঃপ্রক্রিয়া করতে হয়। কিন্তু এই শর্ত রাশিয়া-ভারত চুক্তির মধ্যে না-থাকায় ভারতের জন্য নিজ দেশের ইউরেনিয়ামের বাইরেও অন্য দেশ থেকে ফুয়েল এনে তা পুনঃপ্রক্রিয়া করে সামরিক কাজে ব্যবহার করার পথ আরও অবারিত হয়। ভারত নন-প্রলিফারেশন ট্রিটির অধীন চুক্তিবদ্ধ না-হওয়ায় শান্তিপূর্ণভাবে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত। ভারতের শান্তিপূর্ণভাবে পারমাণবিক মহড়ার উদাহরণ থাকলেও নন-প্রলিফারেশন ট্রিটির সদশ্যভুক্ত দেশ না-হওয়ার কারণে ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাব্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শর্তযুক্ত ফুয়েল রিপ্রসেসিং ও রাশিয়ার সঙ্গে শর্তহীন ফুয়েল রিপ্রসেসিংয়ের সুযোগ থাকলেও ভারতের নিউক্লিয়ার সামগ্রী রপ্তানির সক্ষমতা, তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে নিউক্লিয়ার সাপ্লাইয়ার গ্রুপের মধ্যে প্রশ্ন রয়ে গেছে। রোসাটমের প্রকল্পে জনবল তৈরির প্রকল্পের আওতায় ভারত বাংলাদেশের সক্ষমতা অর্জনে সহযোগী ভূমিকা পালনের মধ্যদিয়ে নিজের সক্ষমতা প্রকাশের সুযোগও পেল। এতে শুধু বাংলাদেশ উপকৃত হচ্ছে ভাবার কোনো কারণ নেই; বরং ভারতের মেক ইন্ডিয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে ভারতের জন্য বাংলাদেশে কৌশলগত সহযোগিতার সুযোগ একটি মাইলফলক (Chaudhury, 2018)। এই সহযোগিতার মধ্যদিয়ে ভারত তার সক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ পেল এবং পরবর্তী সময়ে নিউক্লিয়ার সাপ্লাইয়ার গ্রুপে যোগদানের জন্য বিশ্বস্ততা অর্জনের পথও সুগম করল।

রোসাটমের প্রকল্পে জনবল তৈরির প্রকল্পের আওতায় ভারত বাংলাদেশের সক্ষমতা অর্জনে সহযোগী ভূমিকা পালনের মধ্যদিয়ে নিজের সক্ষমতা প্রকাশের সুযোগও পেল। এতে শুধু বাংলাদেশ উপকৃত হচ্ছে ভাবার কোনো কারণ নেই; বরং ভারতের মেক ইন্ডিয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে ভারতের জন্য বাংলাদেশে কৌশলগত সহযোগিতার সুযোগ একটি মাইলফলক (Chaudhury, 2018)।

উপসংহার

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অর্থনৈতিক কারণে নয়; বরং সবসময় কৌশলগত কারণেই বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প করার উদ্যোগ নিয়েও পিছিয়ে এসেছিল। এর আগে যখন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আরও কম ছিল, প্রযুক্তি সক্ষমতা আরও কম ছিল, তখনও নিউক্লিয়ার প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ দেখা গেছে। বাস্তবায়ন না-হওয়ার পেছনে সক্ষমতার অভাব, ব্যয়, কৌশলগত কারণ অনেক কিছুই ছিল। কোনো দেশকে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদনের যোগ্যতা অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে কিছু মৌলিক শর্ত পূরণের চর্চা করা হয়ে আসছে। সেই হিসেবে কোনো পারমাণবিক প্রকল্পের উৎপাদনক্ষমতা দেশের মোট উৎপাদনক্ষমতার ১০ শতাংশের উপরে হলে সেই দেশকে সেই প্রকল্পের যোগ্য মনে করা হয় না। অর্থাৎ, নিউক্লিয়ার প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য গ্রিডের ক্ষমতা বেশি থাকতে হয়। বাংলাদেশে ২০১০ সালের পর থেকে দ্রুত গ্রিড বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়া ও ২০২৩ সাল নাগাদ নিউক্লিয়ার ব্যবহার করে উৎপাদনক্ষমতার ১০ শতাংশ নিউক্লিয়ার থেকে উৎপাদনের সম্ভাবনা পর্যালোচনা করে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভবিষ্যতে একটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণের স্বীকৃতি পেলেও গ্রিডের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। এ ছাড়া নিউক্লিয়ার প্রকল্পে দেশীয় জনবলের সক্ষমতার যে শর্ত, তা পূরণের আগেই প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন শুরু হয়ে যায়। প্রকৌশলী, টেকনিশিয়ান, ব্যবস্থাপক প্রভৃতি কাজের জন্য বিদেশে পড়াশোনার সুযোগ তৈরি হলেও এই জনশক্তির ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্পে কর্মরত থেকে সরাসরি অভিজ্ঞতা অর্জন ও পরিপক্বতা লাভ নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে।

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রোসাটম কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সুবিধার কারণে বাংলাদেশে পারমাণবিক প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশ চুক্তি করতে গিয়ে যেসব শিথিলতা প্রদর্শন করেছে, তা রাশিয়ার জন্য অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার বাংলাদেশে একটি কৌশলগত অবস্থান রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে রাশিয়া বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে বিভিন্ন সময় অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তবে, গ্যাস উত্তোলনে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির যুক্ত থাকার কারণে ও ৯০-এর দশকে রাশিয়ায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে ৯০-এর দশক থেকে শুরু করে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে রাশিয়ার উপস্থিতি কমে গিয়েছিল। রাশিয়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রোসাটমের মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রযুক্তি নতুন নতুন দেশে বিস্তারের কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয়। আর এর সূত্র ধরে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে যেখানে ইতঃপূর্বে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প করা হয়নি, সেসব দেশে রাশিয়া পারমাণবিক প্রযুক্তি বিস্তারের সুযোগ খুঁজতে থাকে। আর এটা করতে গিয়ে দেখা গেছে, বেশিরভাগ দেশে এ ধরনের ব্যয়বহুল প্রকল্প করতে গেলে প্রথমেই বাধা এসে দাঁড়ায় বিপুল বিনিয়োগ, সে দেশের প্রযুক্তিসক্ষমতা এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে জনমত ও বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতা যদিও দূর করা যায় দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুবিধা দিয়ে; কিন্তু অন্য বাধাগুলো কীভাবে অতিক্রম করা যায়, তা নির্ভর করে একেকটি দেশের বাস্তবতার ওপর। যেমন, তুরস্কে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট করার বিরোধিতা করে দীর্ঘদিন ধরে নাগরিক সমাজের একটি সচেতন অংশ সোচ্চার রয়েছে। ‘আধুনিক তুরস্ক’ গড়ার নামে এবং উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে এই প্রকল্পের ঝুঁকিপূর্ণ দিকগুলো সেখানেও সতর্কতার সঙ্গে জনসম্মুখে আনতে দেওয়া হয়নি। তুরস্কের নিউক্লিয়ার তথ্যকেন্দ্রে স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের নিউক্লিয়ার প্রযুক্তিকে একটি নিখুঁত ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি হিসেবে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, ফুকুশিমা বা চেরনোবিল দুর্ঘটনার কথা উল্লেখই করা হয়নি। গ্রিনপিস পরবর্তী সময়ে এই একপেশে তথ্য দেওয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়েছে। এতে স্পষ্টতই বোঝা যায়, একটি ইতিবাচক ধারণাকে জনপ্রিয় করে তোলার মাধ্যমে এর গ্রহণযোগ্যতা তৈরির নানাবিধ চেষ্টা শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্য দেশগুলোয়ও ব্যবহার করা হয়েছে।

উপরোক্ত পর্যালোচনা থেকে দেখা যায়, পারমাণবিক বিদ্যুৎ নিয়ে বাংলাদেশ রাশিয়ার মধ্যে যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তা অর্থনৈতিকভাবে উভয় দেশের সমান লাভের ভিত্তিতে নয়; বরং প্রযুক্তিদাতা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শক্তি ও প্রযুক্তির আধিপত্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা থেকেই তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো ও অর্থনৈতিক সুফলের চাহিদা যতটা-না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বাংলাদেশের আধুনিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য অর্জনের চাহিদা এই কৌশলগত সহযোগিতায় বেশি ভূমিকা পালন করেছে। দুর্ঘটনার ঝুঁকি, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, বর্জ্য থেকে পরিবেশদূষণ ও আকাশচুম্বী খরচ নিয়ে সব প্রশ্নকে যেভাবে নানান কৌশলে দমন করে রাখা হয়েছে, তাতে এই সহযোগিতাকে একটি অসম ক্ষমতার সম্পর্ক থেকে উৎসারিত কৌশলগত সহযোগিতা বলা যায়। যার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ বৃহৎ অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ঝুঁকি নিয়ে একটি অসম সহযোগিতার সম্পর্কে প্রবেশ করেছে।

মোশাহিদা সুলতানা: সহযোগী অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: moshahida@du.ac.bd

টীকা

১) একটি দেশ কতটুকু উদ্বুদ্ধ হয়, তা মাপতে তিনি বিদ্যুতের চাহিদার বৃদ্ধিকে পরিমাপক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সক্ষমতার পরিমাপক হিসেবে ব্যবহার করেছেন বিদ্যুতের গ্রিডের আকার, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রবলতা, জিডিপি, মাথাপিছু আয়-ব্যয়ের ক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে (per capita GDP at purchasing power parity), সরকারের শাসনক্ষমতার কার্যকারিতা (government effectiveness indicator), রাজনৈতিক স্থিরতা, ইত্যাদি।

২) বাংলাদেশ যদি গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলন শুরু করে, বিশেষ করে আরাকান বেসিনে, বাংলাদেশের গ্যাস উৎপাদন আরও বাড়বে। বর্তমানে কোরিয়ান কোম্পানি দাইয়ু বাংলাদেশের সমুদ্র ব্লকের ঠিক পাশেই আরেকটি ব্লকে ৯ টিসিএফ গ্যাস পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একই ভূতাত্ত্বিক গঠন থাকায় বাংলাদেশের ব্লকটিতেও বিপুল পরিমাণ গ্যাস থাকার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে (Filipov et al, 2017)।

৩) এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার দিক থেকে অন্য দেশের জন্য চিন্তার কারণ। তা ছাড়া বাংলাদেশের পাশের দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের ঐতিহাসিকভাবে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। চীন পাকিস্তানেও সরবে উপস্থিত। বাংলাদেশ আগে চীন থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ সামরিক অস্ত্র কেনার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ চীন থেকে সব সৌরবিদ্যুতের যন্ত্রাংশ ও উপকরণ আমদানি করে।

তথ্যসূত্র:

Ali, Tausif, Zaman Arnab, Islam Saiful, Anik Bhuiyan, Iftekhar Rahman, M Hossain, and Mohammad Shidujaman. 2013. “Feasibility Study of RNPP (Rooppur Nuclear Power Project) in Bangladesh.” Energy and Power Engineering 5 (January): 1526–30.

Brutschin, Elina, and Jessica Jewell. 2018 “Chapter 23 International Political Economy of Nuclear Energy,” In Handbook of the International Political Economy of Energy and Natural

Resources, editors: Andreas Goldthau, Michael F. Keating, Caroline Kuzemko,

2018, Edward Elgar: Chelentham UK

Bhowmik, P.K.; Barua, S. Prospect of Nuclear Power Plant in Bangladesh. In Proceedings of the 3rd Annual Paper Meet of Electrical Engineering Division (APMEE)-2012, Dhaka, Bangladesh, December 2012; pp. 43–48.

BPDB, 2021, website, Accessed on October 15, 2021

Chaudhury, D.R. 2018, India, Russia, Bangladesh sign tripartite pact for civil nuclear cooperation, The Economic Times, March 21, 2018

Cherp, Aleh, Vadim Vinichenko, Jessica Jewell, Elina Brutschin, and Benjamin K Sovacool. 2018. “Integrating Techno-Economic, Socio-Technical and Political Perspectives on National Energy Transitions: a Meta-Theoretical Framework.” Energy Research & Social Science 37: 175–90. doi:10.1016/j.erss.2017.09.015.

Eaton, Jonathan, and Samuel Kortum. 1999. “International Technology Diffusion: Theory and Measurement.” International Economic Review 40 (3): 537–70.

EMRD 2018, Annual Report 2017-2018, Energy and Mineral Resource Division Bangladesh, In Retrieved 2018-12-12

Froggatt, Antony, Julie Hazemann, Tadahiro Katsuta, Andy Stirling, Ben Wealer, Phil Johnstone, M V Ramana. Schneider, Mycle 2018. “The World Nuclear Industry Status Report,” Mycle Schneider Consulting Project. Paris, London, September 2018

Filipov, Allan; Dilindi, Robert; Drage, Magne. Electro-Magnetic Sensitivity in the Bengal Basin: Implications for Exploration in Mynmar, Bangladesh and NE India. International Petroleum Technology conference. 10-12 December. Malaysia.

Grubler, Arnulf. 1999. “Dynamics of Energy Technologies and Global Change.” Energy Policy.

INDC 2016 Intended Nationally Determined Contribution, Ministry of Environment and Forests (MOEF) Government of the People’s Republic of Bangladesh. Retrieved December 15 from

https://www4.unfccc.int/sites/ndcstaging/PublishedDocuments/Bangladesh%20First/INDC_2015_of_Bangladesh.pdf

IAEA 2016 Energy, electricity and nuclear power estimates for the period up to 2050. In. https://www4.unfccc.int/sites/ndcstaging/PublishedDocuments/Bangladesh%20First/INDC_2015_of_Bangladesh.pdfhttp://www-pub.iaea.org/MTCD/Publications/PDF/RDS-1-36Web-28008110.pdf, Retrieved 2018-12-12

Ehsan, Md Amimul, Choton Das, and Jobair Alam. 2014. “Feasibility and Safety Study of Nuclear Power in Bangladesh: Perspective to Rooppur Nuclear Power Plant.” Presented in “1st National conference on Electrical & Communication and Renewable Energy (ECERE 2014)” on 27th November, 2014.

IEEFA 2016 Bangladesh Electricity Transition: A Diverse, Secure and Deflationary Way Forward, November 2016, Institute for Energy Economics and Financial Analysis, Published in 2016, p. 22.

Jewell, Jessica. 2011. “Ready for Nuclear Energy?: An Assessment of Capacities and Motivations for Launching New National Nuclear Power Programs.” Energy Policy 39 (3): 1041–55.

Jewell, Jessica, and Seyithan Ahmet Ates. 2015. “Introducing Nuclear Power in Turkey: A Historic State Strategy and Future Prospects.” Energy Research & Social Science 10 (November): 273–82.

Karim, Ridoan, Mohammad Karim, Firdaus Muhammad-Sukki, Siti Abu-Bakar, Nurul Bani, Abu Munir, Ahmed Kabir, Jorge Ardila-Rey, and Abdullahi Mas’ud. 2018a. “Nuclear Energy Development in Bangladesh: A Study of Opportunities and Challenges.” Energies 11 (7): 1672.

Karim, Ridoan, Firdaus Muhammad-Sukki, Mohammad Karim, Abu Munir, Imtiaz Sifat, Siti Abu-Bakar, Nurul Bani, and Mohd Muhtazaruddin. 2018. “Legal and Regulatory Development of Nuclear Energy in Bangladesh.” Energies 11 (10): 2847.

Little, Daniel. 2015. “Mechanisms and Method.” Philosophy of the Social Sciences 45 (4–5): 462–80.

Lantis, Jeffrey S. 2014. “Economic Competition and Nuclear Cooperation: The ‘Nuclear Renaissance’ Revisited.” The Nonproliferation Review 21 (1): 21–41..

Lovins, Amory B., Titiaan Palazzi, Ryan Laemel, and Emily Goldfield. 2018a. “Relative Deployment Rates of Renewable and Nuclear Power: A Cautionary Tale of Two Metrics.” Energy Research & Social Science 38 (April): 188–92..

Nuclear Power in Bangladesh – World Nuclear Association.” n.d. Accessed November 10, 2018..

NREL 2014 Solar Resources By Class and Country, National Renewable Energy Laboratory, November 25, 2014, Retrieved from: http://en.openei.org/datasets/dataset/solar-resources-by-class-and-country.

Power System Master Plan 2016, Power Division, Ministry of Power, Energy and Mineral Resources, Government of The People’s Republic of Bangladesh.

Ram Mohan, M. P. 2015. “The Development of Institutions and Liability Laws Relating to Nuclear Energy.” In Nuclear Energy and Liability in South Asia, by M. P. Ram Mohan, 19–52. New Delhi: Springer India.

Saifullah, A.Z.A. Karim, M. A. Karim, M. R 2016 “Wind Energy Potential in Bangladesh”, American Journal of Engineering Research, Vol. 5 (7), pp-85-94, Available At: http://www.ajer.org/papers/v5(07)/K0507085094.pdf

Sultana, Moshahida 2016 “Power and Energy: Potentials, Crisis and Planning” in

 Routledge Handbook of Contemporary Bangladesh. Edited by, Riaz, Ali, and Mohammad

 Sajjadur Rahman. pp 245-258. Routledge.

Siitonen, Lauri. 1990 “POLITICAL THEORIES OF DEVELOPMENT COOPERATION – A Study of Theories of International Cooperation,” World Institute for Development Economics Research of the United Nations University

World Bank 2018“WGI 2018 Interactive”, Accessed December 15, 2018.

World Nuclear Industry Status Report 2021 A Mycle Schneider Consulting Project, Accessed on October, 2021

ভোরের কাগজ, ১ ডিসেম্বর ২০১৭

মহিউদ্দিন ২০২১ রূপপুরে কাজে গতি, চিন্তা সঞ্চালন লাইন নিয়ে, ৮ আগস্ট ২০২১, প্রথম আলো

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •