লাল পিঁপড়া স্বপ্ন

চলচ্চিত্র পর্যালোচনা

লাল পিঁপড়া স্বপ্ন

মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন

Let us declare that the state of war does exist and shall exist.

The choice of the course, whether bloody or comparatively peaceful, which it should adopt rests with you. Choose whichever you like.

But that war shall be incessantly waged.

Bhagat Singh (September 1907 – 23 March 1931)

সিনেমা সম্পর্কিত তথ্য

হিন্দি সংস্করণের নাম মাটি কে লাল | পরিচালনা করেছেন সঞ্জয় কাক | লিখেছেন সঞ্জয় কাক, তরুণ ভারতীয়া | চিত্রায়ন করেছেন সঞ্জয় কাক, রঞ্জন পালিত, সেতু পান্ডে | সম্পাদনা করেছেন তরুণ ভারতীয়া | সঙ্গীত করেছেন ওয়ার্ড সাউন্ড পাওয়ার / দিল্লি সালতানাত এবং ক্রিস ম্যাকগিনেসেস | মুক্তির তারিখ মে ২০১৩ | দৈর্ঘ্য ১২০ মিনিট | দেশ ভারত | ভাষা গোন্ডি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি।

লাল পিঁপড়ার পরিচয় 

পাঞ্জাবের রাস্তায়, ওড়িশার আদিবাসী ঘেরা পাহাড়ে জঙ্গলে, বস্তারের জঙ্গলে অর্থকড়িহীন একদল মানুষ প্রতিবাদ করছেন পৃথিবীর অন্যতম সেরা অস্ত্র প্রযুক্তিধারি, তথাকথিত পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের ধারাবাহিক নিপীড়ন, উৎপীড়নের বিরুদ্ধে। কারণ তথাকথিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফলে যে সকল রাজনৈতিক নেতা নির্বাচিত হয়েছেন তারা প্রাণ, প্রকৃতি ধ্বংসকারী একের পরে এক নীতি ও আইন প্রণয়ন করছেন শুধুমাত্র গুটিকয়েক মানুষের মুনাফার জন্য আর তাদের সহযোগিতায় রয়েছে সেনা, পুলিশ আর নানান নামের নানান বাহিনী, যাদের কাজ মিথ্যা প্রচার ও খুন! বিনিময়ে লাখ লাখ মানুষ ঘরহারা হয়ে বাধ্য হচ্ছে শহরের বস্তিবাসী হতে। কিন্তু আইন ও নীতি বদলের কোনো নাম নেই, যে করেই হোক “উন্নয়ন” হতেই হবে। গাছ কেটে, প্রাকৃতিক বন-পাহাড় ধ্বংস করে, নদী, প্রাকৃতিক জলাধার দূষিত করে, পৃথিবীর সকল প্রাণীর জীবন ধ্বংস করে, নদীতে বাঁধ দিয়ে, উন্নয়নের নাম করে, ধনীদের পকেটে আরো টাকার জোগান দিতেই হবে, যেন সকল রোগের মহাসমাধান এই রকম “উন্নয়ন”!? আর প্রতিবাদকারীদের মুখ বন্ধ করতে তাদের উপরে মামলা, হামলা, জেল-জুলুমের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী, পুলিশ, মিলিশিয়া, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গুণ্ডাদের দিয়ে ধারাবাহিকভাবে খুন করা হচ্ছে নানানভাবে।       

তারা প্রাণ, প্রকৃতি ধ্বংসকারী একের পরে এক নীতি ও আইন প্রণয়ন করছেন শুধুমাত্র গুটিকয়েক মানুষের মুনাফার জন্য আর তাদের সহযোগিতায় রয়েছে সেনা, পুলিশ আর নানান নামের নানান বাহিনী, যাদের কাজ মিথ্যা প্রচার ও খুন! বিনিময়ে লাখ লাখ মানুষ ঘরহারা হয়ে বাধ্য হচ্ছে শহরের বস্তিবাসী হতে। কিন্তু আইন ও নীতি বদলের কোনো নাম নেই, যে করেই হোক “উন্নয়ন” হতেই হবে। গাছ কেটে, প্রাকৃতিক বন-পাহাড় ধ্বংস করে, নদী, প্রাকৃতিক জলাধার দূষিত করে, পৃথিবীর সকল প্রাণীর জীবন ধ্বংস করে, নদীতে বাঁধ দিয়ে, উন্নয়নের নাম করে, ধনীদের পকেটে আরো টাকার জোগান দিতেই হবে, যেন সকল রোগের মহাসমাধান এই রকম “উন্নয়ন”!?  

কিন্তু প্রতিবাদ থেমে নেই, মার্ক্স, লেনিন, মাওয়ের বই থেকে অনুপ্রাণিত একদল স্বপ্নবাজ যুবকযুবতী ৮০ দশকের দিকে প্রথমে বস্তারের জঙ্গলের আবাস নেয়, তারা ৭০ দশকের চারু মজুমদারের দেখানো স্বপ্ন এখনো দেখে চলেছেন। ভারতের নিপীড়ক সরকার চারু মজুমদারকে খুন করলেও তাঁর রক্তবীজ গোপনে গোপনে ছড়িয়ে পড়েছে সারা ভারতে তথা পাঞ্জাবে, ওড়িশায়, বস্তারের জঙ্গলে। শুরুতে তাঁরা আদিবাসীদের আস্থাভাজন হয়েছেন, তাঁদের হয়ে তাঁদের সাথে থাকা শিখেছেন, শিখেছেন আদিবাসীদের ভাষা, শিখেছেন প্রয়োজন আর সমস্যা ও তার সমাধান, আদিবাসীদের মত করেই, আর আদিবাসীরাও আপন করে নিয়েছে তাদের। ফলে আদিবাসী ও অনাদিবাসী এ কৃত্রিম বিভাজন আর টেকেনি। তাঁরা জেনেছেন তাঁদের নানানভাবে বিভাজিত করে শুধু শতকের পর শতক ধরে শোষণ করা হচ্ছে এবং নানান মুনি নানান উপায় বলেন, নানান আশা দেখান, নানান সব মানবিক, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন, নানান রঙ বেরঙের বুদ্ধিজীবীদের নানান তত্ত্বের, গবেষণার খোরাক যোগান তারা কিন্তু পরিস্থিতি বদলায় না। তাঁদের পেটের ভাত জোগাড় হয়না, পরনের কাপড় থাকেনা, সাজগোজ করার জন্য ফুল থাকেনা, মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে তাদের আম-ছালা সব ভোগে যাচ্ছে ধনী ও ক্ষমতাবানদের। অবশেষে তাঁরা বুঝেছেন, মরতে তাঁদের হবেই, মিষ্টি মিষ্টি কথা তাঁদের সেই মরণকে শুধু ভুলিয়ে রাখার মাদক এবং বাঁচতে হলে, শোষণের শিকল থেকে মুক্তি পেতে হলে, একমাত্র পথ সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম।    

লাল পিঁপড়াদের/সংশপ্তকদের গল্প     

পুঁজিবাদি অর্থনৈতিক আগ্রাসনের ফলে অন্যান্য দেশের মতন ভারতেও আর কিছুই নিরাপদ নয়। স্বাধীনতার এত বছর পরেও ভারতের অধিকাংশ মানুষ মৌলিক অধিকারহীন। তাঁদের খাবার, বাসস্থান, চিকিৎসা, নিরাপত্তা কিছুই প্রদান করেনা সরকার, তাঁরা নিষ্পেষণের এই অর্থনৈতিক অবস্থার ভিতর কোনোক্রমে বেঁচে আছেন আশেপাশের জঙ্গল, নদী, খেত খামারের নানানসব প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদের উপর নির্ভর করে। কিন্তু নানান নামের ভারতীয় ও বিদেশি কোম্পানি শুধুমাত্র আরো বেশি বেশি মুনাফার জন্য, কোটি কোটি মানুষের আশ্রয় এই পাহাড়-জঙ্গল-নদী ধ্বংস করে আহরণ করতে চায় নানান খনিজ সম্পদ, কাঠ, কয়লা ইত্যাদি। আর এই লোভের সহযোগিতায় রয়েছে সেনা-সরকার-পুলিশ-রাজনীতিবিদ-ধর্মীয়নেতা-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী-গণমাধ্যম ইত্যাকার সবাই। তারা আরো বেশি বেশি টাকা চায় কিন্তু পরিবেশ ও প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান ধ্বংস হয়ে গেলে যে কেয়ামত নেমে আসবে সে বিষয়ে এ মিষ্টভাষী কিন্তু পরিবেশ বিনাশি নীতি প্রণয়নকারী, সমর্থনকারি ও সুবিধাভোগীদের কোনো হুঁশ নেই। আর মূল গণমাধ্যমসহ শিল্পের আরো সব শাখার সবাই ফেনিয়ে ফেনিয়ে মিথ্যা বলতে বলতে এমন অবস্থা দাঁড় করিয়েছে যেখানে সত্য, সঠিক তথ্য ও ব্যাখ্যা খুব “রাজনৈতিক” “কর্কশ” “একপেশে”। অন্যদিকে মিথ্যার বেসাতি ও পরিবেশ বিনাশি সবকিছু “গণতান্ত্রিক” “অংশগ্রহণমূলক” ও “উন্নয়নকামি”!

মূল গণমাধ্যমসহ শিল্পের আরো সব শাখার সবাই ফেনিয়ে ফেনিয়ে মিথ্যা বলতে বলতে এমন অবস্থা দাঁড় করিয়েছে যেখানে সত্য, সঠিক তথ্য ও ব্যাখ্যা খুব “রাজনৈতিক” “কর্কশ” “একপেশে”। অন্যদিকে মিথ্যার বেসাতি ও পরিবেশ বিনাশি সবকিছু “গণতান্ত্রিক” “অংশগ্রহণমূলক” ও “উন্নয়নকামি”!

তো “লাল পিঁপড়া স্বপ্ন” (২০১৩) এমন একটি রাজনৈতিক সিনেমা যেখানে জনপ্রিয়তার খোলস ছুঁড়ে ফেলে আমাদের দেখায় ভারতের নিপীড়ন বিরোধী অন্দোলনের চিত্র এবং বহুল আলোচিত, সমালোচিত, বিখ্যাত/কুখ্যাত জঙ্গলের মাওবাদী গেরিলাদের প্রকৃত অবস্থা। তাঁরা পুরানের, গল্পের চরিত্রের খোলস ছেড়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান সাধারণ রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে, যাদের ভূমি ভারতীয় সরকার কেড়ে নিতে চায়, ছলে, বলে, কৌশলে আর এসবে নাহলে সোজা খুন-জখম-হত্যা। বেঁচে থাকার কোনো পথ খোলা নেই তাঁদের সামনে।   

পাঞ্জাবের কৃষক ও নিপীড়িত মানুষদের সাহসী প্রতিবাদ ও আয়োজনের ভিতর দিয়ে ধীরে ধীরে গল্পের রেশ ধরে সঞ্জয় কাক আমাদের নিয়ে যান আবার বস্তারের জঙ্গলের ভিতরে যেখানে ভারত তার ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস গণহত্যা চালাচ্ছে, কাশ্মীরের মতোই।

অন্যদিকে পাঞ্জাবের রাস্তায় রাস্তায় চলছে আন্দোলন, সাথে নিপীড়ন বিরোধী দক্ষিন এশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় মুখ ভগৎ সিং এবং পাশ (৯ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ – ২৩ মার্চ ১৯৮৮) ( প্রখ্যাত বামপন্থি আন্দোলনকারী ও কবি অবতার সিংহ সান্ধুর ছদ্মনাম) এর স্মরণোৎসব। এর আয়োজক যেমন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষেরা তেমনি রয়েছে কর্পোরেট কালচারের বাবু-বিবিদের পোশাকি-সাহেবি আয়োজন যেখানে রয়েছে তাদের দর্শনের খণ্ডিত ও জাতিয়তাবাদি বিজ্ঞাপনধর্মী উপস্থাপন। পাঞ্জাবের কৃষক ও নিপীড়িত মানুষদের সাহসী প্রতিবাদ ও আয়োজনের ভিতর দিয়ে ধীরে ধীরে গল্পের রেশ ধরে সঞ্জয় কাক আমাদের নিয়ে যান আবার বস্তারের জঙ্গলের ভিতরে যেখানে ভারত তার ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস গণহত্যা চালাচ্ছে, কাশ্মীরের মতোই। ভারত এক আজব দেশ, যেখানে সরকার তার সর্বোচ্চ অস্ত্র ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজের দেশের মানুষ খুন করার জন্য! যে যুদ্ধের পোশাকি নাম “অপারেশন গ্রিনহান্ট” । আর এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে লাখ লাখ আদিবাসী মানুষের বাসস্থান দখল করে, জঙ্গল-পাহাড়-নদী ধ্বংস করে মুনাফা অর্জন করা, জনগণকে অভুক্ত গৃহহীন করে গুটিকয়েক কর্পোরেট প্রভুর আদেশ, অনুশাসন অক্ষরে অক্ষরে পালন করা! কিন্তু ব্যাপারটা খুব সহজে পেরে উঠছে না তথাকথিত গণতান্ত্রিক ভারত সরকার, কারণ বস্তারের এ আদিবাসীদের সাথে যোগ হয়েছে ৮০ দশক থেকে নানান বামপন্থী নেতা-কর্মী ও তাত্ত্বিকগণ। এসব নকশাল যোদ্ধাগণ আদিবাসীদের সুসংগঠিত করেছেন, তাঁদের দেখিয়েছেন কীভাবে একত্রিত হয়ে রক্ষা করা যায়, মাথায় গোঁজার পাখির পালকের বাসস্থান, খাবার, নিরাপত্তা, আত্মসম্মান, ব্যক্তির স্বাধীনতা আর জঙ্গল নামের নিজেদের গৃহ। ফলাফল যুদ্ধ, হ্যাঁ ভারত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। 

নকশাল যোদ্ধাগণ আদিবাসীদের সুসংগঠিত করেছেন, তাঁদের দেখিয়েছেন কীভাবে একত্রিত হয়ে রক্ষা করা যায়, মাথায় গোঁজার পাখির পালকের বাসস্থান, খাবার, নিরাপত্তা, আত্মসম্মান, ব্যক্তির স্বাধীনতা আর জঙ্গল নামের নিজেদের গৃহ।

ভারতের বস্তার এমন এক জায়গা যেখানে পুলিশ-প্রশাশন-সেনা-জনপ্রতিনিধিদের ভয়ে সাধারণ মানুষ পালিয়ে বেড়ায়, অপরাধী ও খুনিরা বুক ফুলিয়ে চলে, ধর্ষণকারীরা হয় পুরস্কৃত! তো এ পরিস্থিতি চুপ করে মেনে নেয়নি জঙ্গলের আদিবাসী মানুষেরা কারণ তাদের মাওবাদি দর্শনের ফলিত প্রশিক্ষণ, শুরুতে যখন শুধু প্রতিবাদ প্রতিরোধে কাজ হয়নি তখন ধীরে ধীরে তারা বাধ্য হয় সম্মুখ সমরে যেতে, কাজটা মোটেও সহজ বা নিরাপদ নয়। প্রতি পদে মৃত্যুর ভয়, হাতছানি, আর ধরা পড়লে তার চেয়েও ভয়ানক অত্যাচারের সামনে দাঁড়াতে হয় একেকজন জনযোদ্ধাকে কিন্তু মনে হয় এসবের চেয়েও অনেক মূল্যবান আত্মসম্মান! নিজের মত করে নিজের পরিবেশে বেঁচে থাকার ইচ্ছা! নিজের মতো করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা। তাইতো একেকজন মাওবাদি নেতাকে ধরিয়ে দিলে ভারত সরকারের ঘোষিত লাখ লাখ টাকার লোভেও কেউ কাউকে ধরিয়ে দেয়নি, মৃত্যুর ভয়ে থেমে থাকেনি জনযোদ্ধাদের লড়াই। এবং থামেনি সদ্য তরুণ-তরুণীদের ঢলের মতন যোগদান মাওবাদি সশস্ত্র আন্দোলনে, অনেক সময় মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও।

যোদ্ধাদের কারো কারো তেমন পোশাকও নেই, কারো কারো পা খালি কিন্তু মুখের হাসি সরছেনা, সাহস ও সরলতা মাখা প্রতিটা পদক্ষেপে, আর সবচেয়ে চোখে পড়ার মতন ব্যাপার হচ্ছে এ তরুণ তুর্কিদের প্রায় কমবেশি অর্ধেক হচ্ছেন নারী যোদ্ধা, বাকিরা পুরুষ যোদ্ধা কিন্তু চলছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, যেন পরবের নাচ! যেমন হয়ে থাকে মাঝে মাঝে জঙ্গলের গভীরতম প্রদেশে যেখানে রাইফেল কাঁধে যোদ্ধারা নেমে পড়েন পায়ে পা, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নাচতে, যেন তারাও সেদিন উঠে পড়ে প্রমাণ করতে চান, নাচেও তারা কম যান না। অনেক নারী ও পুরুষ যোদ্ধারা খুব কাছে থেকে দেখেছেন তাদের প্রিয় মানুষদের কীভাবে খুন করছে ভারতীয় সরকারি ও সমর্থিত নানান বাহিনী। তারা জানেন আজ হোক বা কাল মরতে তাদের হবেই বা কপাল জোরে শহরে বাবুদের বাড়িতে কাজ, বস্তিতে ঘর, আধপেটা খাবার বা বাধ্য হয়ে যৌনকর্মীদের খাতায় নাম তোলা, এছাড়া তাদের কপালে ভারত সরকার কিছু লিখেনি কিন্তু মাওবাদিরা তাদের দেখিয়েছে এরকম দাসের মতন টিকে থাকার চেয়ে, অল্প সময় নিজের মতন করে বেঁচে থাকা অনেক মূল্যবান। এ দর্শনের ছায়া পড়েছে খোদ ওড়িশার নিয়মগিরি পর্বতমালার আদিবাসীদের ভিতরেও তারাও নানান লোভের ফাঁদে পড়ে তাদের নিয়মরাজাকে হারাতে হারাতে, নিজেদের হারাতে হারাতে ফিরে পেতে চাচ্ছেন নিজেদের, সত্য প্রকাশ ও আন্দোলনের ভিতর দিয়ে। তাদের উপরেও নেমে এসেছে ভারত সরকারের একইরকম খড়গ।

যোদ্ধাদের কারো কারো তেমন পোশাকও নেই, কারো কারো পা খালি কিন্তু মুখের হাসি সরছেনা, সাহস ও সরলতা মাখা প্রতিটা পদক্ষেপে, আর সবচেয়ে চোখে পড়ার মতন ব্যাপার হচ্ছে এ তরুণ তুর্কিদের প্রায় কমবেশি অর্ধেক হচ্ছেন নারী যোদ্ধা, বাকিরা পুরুষ যোদ্ধা কিন্তু চলছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, যেন পরবের নাচ!

যারা সাম্প্রতিকালের ভারত সরকারের সাম্প্রদায়িক আইনকানুন প্রণয়ন, বাস্তবায়ন (সিএএ ও এরূপ অন্যান্য মানবধিকার বিরোধী ও গণহত্যার ইন্ধন যোগানো আইন) ও আন্দোলনকারীদের দমনে ভারত সরকারের নিষ্ঠুরতা দেখেছেন খোদ রাজধানী দিল্লির বুকে, তারা সহজেই অনুমান করতে পারেন ভারত সরকার তাহলে কতটা নিষ্ঠুর, অমানবিক ও খুন জখম চালাতে পারে জঙ্গলে!

কিশোর/কিশোরী আর সদ্য যৌবনে উপনীত যোদ্ধারা একে একে ছোট ছোট একেকটা বাক্যে জানান তাদের অভিজ্ঞতা, জঙ্গলে থাকার, নকশাল বাহিনীতে যোগ দেয়ার। আমরা শুনি এক নারী যোদ্ধা বলছেন, ভারতীয় বাহিনীর অত্যাচার থেকে কারো কোনো রেহাই নেই, সে নকশাল বা যাই হও আর নারী যোদ্ধাদের ক্ষেত্রে সমস্যা আরো বেশি কারণ অনেক নারী যোদ্ধারা, যুদ্ধের সুবিধার্থে চুল ছোট রাখেন আর ভারতীয় বাহিনীর চোখে ছোট চুলের মেয়ে মানেই চিনতে আর দেরি হয়না, তারা নকশাল। এসব বলছেন দৃঢ়তা আর সাহস দীপ্ত চোখে, সে মেয়ের চোখে ভয় নেই বরং আছে তাচ্ছিল্য, অতিভোগী মানুষদের প্রতি।

এতসব নিপীড়ন, অত্যাচারেও আন্দোলন থেমে নেই, যেমন শতবর্ষ থেকে ইজরায়েল ও ঔপনিবেশিক অন্যান্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে আছে ফিলিস্তিন, তাদের থামানো যায়নি গণহত্যা, নিপীড়ন চালিয়ে, ঠিক তেমনি, স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের অন্যান্যদের সাথে এই আদিবাসী মানুষেরাও আন্দোলন করছেন নিজের ভূমি রক্ষার্থে, এদেরও থামানো যাচ্ছেনা খুন-জেল-জুলুম-লোভের ফাঁদে ফেলে।      

 লাল পিঁপড়া স্বপ্নের নির্মাণরীতি ও অন্যান্য

“লাল পিঁপড়া স্বপ্ন”সহ যেকোনো ভাল প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বিষয়ের বয়ানের তথ্য নির্ভরতা বজায় রেখে নির্মাতার নিজের মতামত এবং সার্বিক বিষয়াদির যতটা সম্ভব একটা পূর্ণাঙ্গ অবস্থার ইশারা, ছবি তৈরি করা। এ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা যথারীতি প্রায় অসম্ভব ছিল কারণ প্রথমত মাওবাদী গেরিলা যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের ঘোষিত যুদ্ধ এবং নানান গোয়েন্দা সংস্থার প্রখর নজরদারি এড়িয়ে ঠিকঠাক লোকের সাথে যোগাযোগ স্থাপন এবং তারপরে আসে, চিত্রধারনের ব্যাপার। এসব পেরিয়ে নির্মাণ করতে হয়েছে আলোচিত সিনেমা। ফলে নির্মাণযাত্রা অতি কঠিন হলেও নির্মাতা অনায়াসে সে বাধা হজম করে সম্পর্ক ও আস্থা তৈরি করতে পেরেছেন গেরিলাদের সাথে এবং গেরিলাগণ, নির্মাতা ও তার সহচরদের বিশ্বাস করেছেন ফলে যে অকপট আর সহজ পরিবেশ তৈরি হয়েছে সে অবস্থা সঞ্জয় কাক তার স্বশিক্ষিত সিনেমা নির্মাণ জ্ঞান ব্যবহার করে খুব সহজ ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। যার ফলে এরকম জটিল পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়েও যেকোনো ভালো সিনেমার যেসকল বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার তার সব রয়েছে “লাল পিঁপড়া স্বপ্ন” সিনেমায়।

বর্তমান নব্য উদারনৈতিক অর্থনৈতিক প্রবণতা অনুযায়ী সবকিছুকেই একটা অরাজনৈতিক ও পণ্যায়নের যে সুশীল মোড়কে উপস্থাপন করার চল রয়েছে সে জনপ্রিয়তা, স্বীকৃতি, অর্থনৈতিক লাভের পথে সঞ্জয় কাক চলেননি বরং “রাজনৈতিক সিনেমা” বানানোর ঝুঁকি গ্রহণ করেছেন যার ফলে সহজেই তুলে ধরতে পেরেছেন আদিবাসী, অনাদিবাসী সবার সরল অথচ দৃঢ় বয়ান তাদের মতো করে, দেখিয়েছেন মুনাফা নির্ভর শিল্পায়নের ফলে পরিবেশের ধংসযজ্ঞ আর নিরীহ মানুষদের উপরে সরকারি সামরিক, আধাসামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ সোজা ও সহজ করে। যে কোনো ভাল সিনেমার মতোই উস্কে দিয়েছেন একের পরে এক প্রশ্ন, তৈরি করেছেন কৌতূহল, কেন একটা দেশ তার নিজের মানুষদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করে? কেন জঙ্গলের আদিবাসী মানুষদের হাতে গাছ, মাছ, ফুলের বদলে অস্ত্র? কেন নিজের দেশে, নিজের ভূমিতে থাকার ঠাঁই হবেনা ভূমিজদের? কেন সে জমি মানুষ খুন করে তুলে দেয়া হবে গুটিকয়েক মানুষের লালসা পূরণের জন্য?

যে কোনো ভাল সিনেমার মতোই উস্কে দিয়েছেন একের পরে এক প্রশ্ন, তৈরি করেছেন কৌতূহল, কেন একটা দেশ তার নিজের মানুষদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করে? কেন জঙ্গলের আদিবাসী মানুষদের হাতে গাছ, মাছ, ফুলের বদলে অস্ত্র? কেন নিজের দেশে, নিজের ভূমিতে থাকার ঠাঁই হবেনা ভূমিজদের? কেন সে জমি মানুষ খুন করে তুলে দেয়া হবে গুটিকয়েক মানুষের লালসা পূরণের জন্য?

জঙ্গল-পাহাড়-রাস্তা, যোগাযোগ দুর্গম সব অঞ্চল আর মানুষদের গল্প ছড়িয়ে আছে সারা সিনেমা জুড়ে, যা অনেকদিন ধরে চিত্রায়ন ও গবেষণার ফলাফল, এতসব ভাবনা, জায়গা মতামতের সুবিন্যাস চোখে পড়ার মতো, গল্পের দৃঢ়তা, বিষয়গততা একের পর এক বিখ্যাত সব উক্তির মাধ্যমে আরো ভালভাবে বিকশিত হয়েছে। রয়েছে সুষম সঙ্গীত, শব্দনকশা, সম্পাদনা, চিত্রায়ন আর ঠিকঠাক চিত্রনাট্য।    

এসবের ভিতর দিয়ে তোলা হয়েছে গেরিলাদের জীবনযাপন, মতামত, ব্যাখ্যা, পাশাপাশি রয়েছে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর প্রথম সারির কর্মকর্তাদের এ যুদ্ধ সম্পর্কিত বয়ান আর তাদের ধারাবাহিক সামরিক বিভিন্ন প্রস্তুতি ও কৌশলের বিবরণ, এবং এখানেও নির্মাতা তাঁর নির্মাণ কৌশল অনুসরণ করে নিজে কিছু বলেননা কিন্তু সম্পাদনা ও ছবির উপস্থাপনের ফলে সহজেই অনুমিত হয় প্রকৃত অবস্থার আর প্রতীয়মান হয় সরকারি বাগম্বর ও মিথ্যাচারের। বয়ান নির্মাণের এধারা তিনি সারা সিনেমা জুড়েই বজায় রেখেছেন, সিনেমাতে একের পরে এক স্থানের বদলের ফলেও বিষয়গত সামঞ্জস্যতা নষ্ট হয়নি  ফলে পাঞ্জাব, ওড়িশার নিয়মগিরি আর ছত্তিশগড়ের বস্তার যেখানেই আমরা ভ্রমণ করি সে যাত্রা সহজেই আমাদের বিষয়ের গভীরে নিয়ে যায়, সিনেমা থেকে ধীরে ধীরে এ গল্প আমাদের অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়। 

মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন: চলচ্চিত্রকার, চলচ্চিত্র সমালোচক। ইমেইল: raiparasadardi@gmail.com

দোহাই

https://www.youtube.com/watch?v=IMje28Fg0vk (এখানে দেখতে পারেন আলোচিত সিনেমার ইংরেজি সংস্করণ।)

https://en.wikipedia.org/wiki/Red_Ant_Dream

https://www.thehindu.com/features/metroplus/talking-about-arevolution/article4718324.ece

https://en.wikipedia.org/wiki/Walking_with_the_Comrades

https://www.ishantankha.com/index/G0000O420YWH.Zwo/thumbs

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •