কেমন আছেন বাংলাদেশের বেসরকারি পাটকল শ্রমিকরা?

কেমন আছেন বাংলাদেশের বেসরকারি পাটকল শ্রমিকরা?

রুহুল আমিন

গ্রাফিক্স: দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১

‘দেখেন, আপনারা যেন আবার লিখালিখি কইরেন না, তালি যদি মিল বন্ধ হয়ি যায়, তালি আমাদের না খায়ি মত্তি হবে। এখন মা-ছেলি কাজ করি অন্তত খায়ি-পরি তো বাঁচতি পারি!’

–আকিজ জুটমিলে কর্মরত একজন নারী শ্রমিকের আকুতি।

আমরা হয়তো অনেকেই জানি না, বর্তমান পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম ‘আকিজ জুটমিল’। যশোরের নোয়াপাড়া শিল্পাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত এ জুটমিলে কর্মরত বর্তমান শ্রমিকসংখ্যা সাড়ে ১০ হাজারের বেশি এবং দৈনিক ৩৯০ টনেরও বেশি সুতা তারা উৎপাদন করে থাকে। সারা পৃথিবীতে যে পরিমাণ সুতা সরবরাহ করা হয়, তার চার ভাগের এক ভাগেরও বেশি সরবরাহ করে আমাদের দেশের নামকরা বেসরকারি এই জুটমিলটি। এ ছাড়াও এখানে উৎপাদিত হয় চটের ব্যাগ, ফুড গ্রেড ব্যাগসহ বেশ কিছু পাটজাত পণ্য।

১৯৯৪ সালে মাত্র ৩০০ জন শ্রমিক এবং দৈনিক ১০ টন উৎপাদনক্ষমতা দিয়ে যাত্রা শুরু হয় আকিজ জুটমিলের। মাত্র দুটি ইউনিট দিয়ে শুরু করা এ প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে কারখানার সংখ্যা ৭টি। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, তুরস্কসহ ৪০টি দেশে রপ্তানি হয় আকিজের পণ্য। ২০১৯ সালে তারা রেকর্ড ১০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। (সূত্র: পাট সুতা উৎপাদনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মিল আকিজের, ৬ জুলাই ২০২০, বণিক বার্তা)

গত অর্থবছর করোনা মহামারির কারণে যেখানে প্রায় সব রপ্তানি সেক্টরে ধস নেমেছে, সেখানে পাটপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ঘটেছে বিপ্লব। লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বাড়তি রপ্তানি করতে তারা সক্ষম হয়েছে এবং তিন নম্বর রপ্তানি পণ্য থেকে পাট ও পাটজাত পণ্য উঠে এসেছে দুই নম্বরে। আর এক্ষেত্রে আকিজ জুটমিলের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তাই বলা যায়, পাটপণ্যের বাজারে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আকিজ জুটমিল বর্তমানে বিশ্বের একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান। তবে মাত্র ২৭ বছরের ব্যবধানে ক্ষুদ্র থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান বনে যাওয়া এ জুটমিলে কর্মরত শ্রমিকদের অবস্থা কী? কেমন আছেন তারা? কেমন আছেন অপরাপর বেসরকারি পাটকল শ্রমিকেরা?

আকিজ জুটমিলে ১১ বছর ধরে কাজ করেন সেলিনা বেগম। তিনি স্প্রিং ডিপার্টমেন্টে মেশিন চালান। শুরুতে ১৬৫ টাকা দৈনিক হাজিরায় কাজ শুরু করে ১১ বছর পর এসে এখন তার দৈনিক মজুরি দাঁড়িয়েছে ২০৫ টাকায়। সংসার চালাতে ১৪ বছরের ছেলেটাকেও তিনি সঙ্গে নেন। গত কোরবানির ইদের পর পাটের অভাব দেখিয়ে (কোনো কোনো শ্রমিক বলছেন, বাড়তি দামে ভারতের কাছে পাট বিক্রি করে দেওয়ার কারণে এখন নিজেদের কাছে পাট না থাকায় মিল চালাতে পারছে না) মিল কর্তৃপক্ষ যখন জুটমিল বন্ধ রাখে, তারপর থেকেই তারা খুব খারাপ অবস্থায় দিনযাপন করছেন। অপেক্ষা করছেন মিল খোলার। সেলিনা জানান, তিনি নামাজ পড়ে সবসময় আল্লার কাছে দোয়া করেন মিল খুলে দেওয়ার জন্য।

মাত্র ২৭ বছরের ব্যবধানে ক্ষুদ্র থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান বনে যাওয়া এ জুটমিলে কর্মরত শ্রমিকদের অবস্থা কী? কেমন আছেন তারা? কেমন আছেন অপরাপর বেসরকারি পাটকল শ্রমিকেরা?

আকিজ জুটমিলে ১১ বছর ধরে কাজ করেন সেলিনা বেগম। তিনি স্প্রিং ডিপার্টমেন্টে মেশিন চালান। শুরুতে ১৬৫ টাকা দৈনিক হাজিরায় কাজ শুরু করে ১১ বছর পর এসে এখন তার দৈনিক মজুরি দাঁড়িয়েছে ২০৫ টাকায়। সংসার চালাতে ১৪ বছরের ছেলেটাকেও তিনি সঙ্গে নেন।

নার্গিস একসময় বদলি শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন নোয়াপাড়ার ‘জে জে আই’ নামক রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে। নিয়মিত সেখানে কাজ না-পেলেও সপ্তাহে ৩-৪ দিন কাজ করেও তার সংসার চলে যেত। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের পর নিরুপায় হয়ে চাকরি নেন আকিজ জুটমিলে। এখন তার দৈনিক মজুরি মাত্র ১৯০ টাকা। অথচ জে জে আই জুটমিলে পেতেন দৈনিক ৫৮০-৫৯০ টাকা।

তাদের ভাষ্যমতে, সাধারণত ১৮০-২২০ টাকার মধ্যেই বেসরকারি মিলের শ্রমিকদের বেতন ঘোরাফেরা করে। শতকরা হয়তো দু-একজন আছেন, যাদের বেতন ২২০-৩১০ টাকা। তারা বেশিরভাগই সরদার বা চার্জেন্ট।

আকিজে কাজ করা মাজেদা একজন লাইন সরদার। তার অধীন কাজ করেন এক শর বেশি শ্রমিক এবং তার বেতন সবচেয়ে বেশি। জানা যায়, মাজেদা বেতন পান দৈনিক ৩১০ টাকা। সপ্তাহে ১৮৬০ টাকা। তিনি বলেন, তার জন্য টার্গেট দেওয়া থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত সেই টার্গেট পূরণ না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি কারখানা থেকে বের হতে পারেন না।

এখানে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের মধ্যে বিরতি দেওয়া হয় মাত্র ২০ মিনিট। এর মধ্যেই খাওয়াসহ অন্যান্য কাজ শেষ করতে হয়। কেউ যদি ২০ মিনিটের অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে, তাহলে বকাঝকাসহ তার জন্য আছে ফাইন। এমনকি তার হাজিরা পর্যন্ত কেটে রাখা হয়। কারখানায় ২৪ ঘণ্টা মেশিন চালু থাকে। শ্রমিকদের তিন শিফটে ঘুরে ঘুরে ডিউটি করতে হয়।

এখানে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের মধ্যে বিরতি দেওয়া হয় মাত্র ২০ মিনিট। এর মধ্যেই খাওয়াসহ অন্যান্য কাজ শেষ করতে হয়। কেউ যদি ২০ মিনিটের অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে, তাহলে বকাঝকাসহ তার জন্য আছে ফাইন। এমনকি তার হাজিরা পর্যন্ত কেটে রাখা হয়।

একসময় আকিজ জুটমিলে কাজ করার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে কারিমুল সরদার বলেন, ‘২০০৬/২০০৭ সালের দিকে আমি আকিজ জুটমিলে কাজ করতাম। একদিন রাত ১০টার সি-শিফটে ঢুকে কাজ করার সময় হঠাৎ আমি অ্যাকসিডেন্ট করি। আমার দুই আঙুলের মাথায় মেশিনের সুঁই ঢুকে যায়। চিৎকার শুনে পাশের শ্রমিকরা এসে আমাকে মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যায় এবং ওখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কোয়াক ডাক্তার কোনো কিছু না বুঝেই চার-পাঁচজনকে নির্দেশ দেন আমাকে ঠেসে ধরতে (যারা আমাকে চেপে ধরেন, তারা ওখানকার মালিকের পোষা সিবিএ নেতা)। তারা আমাকে চেপে ধরলে দুই টাকার ব্লেড দিয়ে আমার দুই আঙুলের প্রথম কর কেটে ফেলা হয়। এরপর সেলাই করার জন্য পর্যাপ্ত চামড়া রাখতে ভুলে যাওয়ায় দ্বিতীয় করও একইভাবে কেটে ফেলা হয়। এরপর ওরা আমাকে কিছু ওষুধ কেনার টাকা ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। পরে আমি এনজিও থেকে সুদে টাকা তুলে চিকিৎসা করাই মেডিকেল থেকে। আমার বউও কাজ করত মিলে।’

তিনি বলেন, ‘আমি শুধু একা নই, আমার মতো শত শত শ্রমিকের এই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। উৎপাদন আমরা ঠিকই দিয়েছি, রাত-দিন একাকার করে এখানকার শ্রমিকরা কাজ করে, কাজ করতে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করে; কিন্তু মিলমালিক শ্রমিকের দিকে কখনো তাকান না। বিরতিহীনভাবে রাতে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় ঝিমুনি আসে, মেশিনের ওপর পড়ে গিয়ে কখনো কখনো মারাত্মক অ্যাকসিডেন্ট পর্যন্ত ঘটে, পঙ্গু পর্যন্ত হয়ে যায়। কিন্তু মিল কর্তৃপক্ষ এর কোনো দায়ভার নেয় না, দেয় না কোনো ক্ষতিপূরণ। আর এই অভাবের সময় শ্রমিকের তো কোনো উপায় নেই। সবকিছু জানা সত্ত্বেও পেটের তাগিদে তারা এখানে আসতে বাধ্য।’

রাত-দিন একাকার করে এখানকার শ্রমিকরা কাজ করে, কাজ করতে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করে; কিন্তু মিলমালিক শ্রমিকের দিকে কখনো তাকান না। বিরতিহীনভাবে রাতে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় ঝিমুনি আসে, মেশিনের ওপর পড়ে গিয়ে কখনো কখনো মারাত্মক অ্যাকসিডেন্ট পর্যন্ত ঘটে, পঙ্গু পর্যন্ত হয়ে যায়। কিন্তু মিল কর্তৃপক্ষ এর কোনো দায়ভার নেয় না, দেয় না কোনো ক্ষতিপূরণ।

সরকারি মিলগুলোতে কোনো শ্রমিক যদি অ্যাকসিডেন্টের শিকার হয়, তবে তার চিকিৎসার সমস্ত দায়ভার থাকে মিল কর্তৃপক্ষের। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত নিজ বেতনে তাকে ছুটি দেওয়া হয়। শারীরিক ক্ষতির পরিমাণ অনুযায়ী তাকে ক্ষতিপূরণও দেয় মিল কর্তৃপক্ষ। অথচ বেসরকারি মিলে ক্ষতিপূরণের বালাই তো নেই-ই, অসুস্থ থাকাকালীন তাকে দেওয়া হয় না কোনো বেতনও। অ্যাকসিডেন্টের চিকিৎসার জন্য অল্প কিছু ওষুধ কিনে দেওয়া ছাড়া তারা নেয় না কোনো দায়-দায়িত্ব। সব রোগের ওষুধ ওই এক প্যারাসিটামল।

মালেক মিয়া খুলনা ক্রিসেন্ট জুটমিলের পিপারিং ডিপার্টমেন্টের সরদার যখন ছিলেন, তখন তার সাপ্তাহিক বেতন ছিল ৫৫০০-৭০০০ টাকা। উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে তার মজুরি ওঠানামা করত। আবার এই মালিক মিয়াই পাটকল বন্ধের পর সাগর মিল নামক পার্শ্ববর্তী একটা বেসরকারি পাটকলে কাজ করতে যান, যেখানে তার দৈনিক বেতন হয় ২২০ টাকা। সপ্তাহে ৬ দিন টানা কাজ করলে এক দিনের বোনাসসহ পান ১ হাজার ৫৪০ টাকা। কিন্তু এই ৬ দিনের মধ্যে কোনো কারণে যদি এক দিন কাজে যেতে না পারেন, তবে বাড়তি এক দিনের বোনাস থেকে বঞ্চিত হন। ২২০ টাকা হিসাবেই তখন তার কাজের মজুরি দেওয়া হয়।

দৈনিক ১৬৫ টাকা থেকে শুরু করে ২২০ টাকার মধ্যেই ঘুরপাক খায় বেসরকারি মিল শ্রমিকদের মজুরি। সরকারি মিলে সর্বনিম্ন দৈনিক হাজিরা যেখানে ছিল ৫৭৫ টাকা, সেখানে বেসরকারি মিলে ১৬৫ টাকা মাত্র। খুলনার রূপসার গ্লোরি মিলে দৈনিক মজুরি শুরু হয় ১৫৫ টাকা থেকে।

দৈনিক ১৬৫ টাকা থেকে শুরু করে ২২০ টাকার মধ্যেই ঘুরপাক খায় বেসরকারি মিল শ্রমিকদের মজুরি। সরকারি মিলে সর্বনিম্ন দৈনিক হাজিরা যেখানে ছিল ৫৭৫ টাকা, সেখানে বেসরকারি মিলে ১৬৫ টাকা মাত্র। খুলনার রূপসার গ্লোরি মিলে দৈনিক মজুরি শুরু হয় ১৫৫ টাকা থেকে।

অথচ সরকারি পাটকল শ্রমিকদের মাসিক চিকিৎসা ভাতাসহ অপরাপর অনেক জরুরি ভাতা প্রদান করে থাকে। সবশেষ মজুরি কমিশন (২০১৫) অনুযায়ী মূল বেতনের সঙ্গে অপরাপর সুযোগ-সুবিধা হচ্ছে:

১। বাড়িভাড়া: মূল বেতনের ৫০ শতাংশ (সর্বনিম্ন মাসিক মূল বেতন ছিল ৮৩০০ টাকা)

২। যাতায়াত ভাতা: মাসিক ২০০ টাকা 

৩। চিকিৎসা ভাতা: মাসিক ১৫০০ টাকা

৪। শিক্ষা সহায়তা ভাতা: মাসিক ৫০০ টাকা এক সন্তানের জন্য এবং ১০০০ টাকা দুই সন্তানের জন্য

৫। টিফিন ভাতা: প্রতি মাসে ২০০ টাকা

৬। ধোলাই ভাতা: মাসে ১০০ টাকা

৭। নাইট শিফট ডিউটি ভাতা: প্রতি ঘণ্টায় ১৫ টাকা

৮। ঝুঁকি ভাতা: প্রতি মাসে ৪০০ টাকা

৯। গ্র‍্যাচুইটি: প্রতিবছরের জন্য ২ মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ টাকা।

১০। পাহাড়ি ভাতা: মাসিক মূল বেতনের ৩০ শতাংশ।

১১। রোটেটিং শিফট ডিউটি ভাতা: মাসিক মূল বেতনের ১০ শতাংশ

১২। উৎসব ভাতা: প্রতিবছর দুই মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ উৎসব ভাতা হিসেবে প্রদেয় হবে।

১৩। কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড: মূল বেতনের ১০ শতাংশ

১৪। নববর্ষ ভাতা: সব শ্রমিককে প্রতিবছর মার্চ মাসে আহরিত মূল মজুরির ২০ শতাংশ হারে বাংলা নববর্ষ ভাতা প্রদান।

১৫। নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি: ৬ মাস (স্ব বেতনে)

বাড়িভাড়া থেকে শুরু করে মাতৃত্বকালীন ছুটি–এসবের প্রায় কোনোটিই বরাদ্দ নেই বেসরকারি পাটকল শ্রমিকদের জন্য। অথচ প্রতিটি বেসরকারি পাটকলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই নারী শ্রমিক। একমাত্র ইদ বোনাসের নামে ইদের সময় শ্রমিক প্রতি দেওয়া হয় ১০০০-৩০০০ টাকা পর্যন্ত।

বাড়িভাড়া থেকে শুরু করে মাতৃত্বকালীন ছুটি–এসবের প্রায় কোনোটিই বরাদ্দ নেই বেসরকারি পাটকল শ্রমিকদের জন্য। অথচ প্রতিটি বেসরকারি পাটকলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই নারী শ্রমিক।

তবে প্রতিটি বেসরকারি পাটকলে একধরনের পরিবহণব্যবস্থা চালু আছে। মিনি ট্রাক এবং এর আদলের একধরনের মিনি বাস, যেখানে বসার জন্য কোনো সিট নেই। রড ধরে দাঁড়িয়ে বাদুড় ঝোলা হয়ে আসতে হয়। কোনো কোনো বাসে দুই সাইড দিয়ে বেঞ্চ বসানো আছে। অর্থাৎ, যত বেশি শ্রমিককে যেকোনোভাবে এনে কাজ শেষ করে দুমড়ে-মুচড়ে তাকে রেখে আসা হয়। ওদের যে বাসের সাইজ তাতে ৪০-৫০ জন যাতায়াত করার কথা; কিন্তু এসব বাসে ঢোকানো হয় ১০০-১২০ জন পর্যন্ত!!

খুলনার খালিশপুর জুটমিল বন্ধ হওয়ার পর বেসরকারি পাটকল গ্লোরি জুটমিলে কাজ করতে যাওয়া রাসেল বলেন, ওখানে বেশিরভাগই নারী ও শিশুশ্রমিক। ১৫৫-১৮০ টাকার মধ্যেই তাদের বেতন। নেই কোনো ছুটিছাটা। কোনো শ্রমিক যদি পুরো সপ্তাহ কাজ না করে, তবে তাকে বাকি দিনগুলোর মজুরি দেওয়া হয় না। দৈনিক কাজ করা তিন-চার হাজার শ্রমিকের মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই অ্যাকসিডেন্টের ঘটনা ঘটে। কেননা, এই শ্রমিকদের কোনো প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় না। স্বল্প মজুরিতে কাজ করতে রাজি হলেই তাকে লাগিয়ে দেয় মেশিনের কাজে। আর এ কারণেই এসব মিলে অ্যাকসিডেন্টের পরিমাণ বেশি।

রাসেল বলেন, আমাদের চোখের সামনেই এক দিন একটা মারাত্মক অ্যাকসিডেন্ট ঘটে। অষ্টম/নবম শ্রেণিপড়ুয়া রাজু নামের একটা ছেলে কয়েক দিন হলো কাজ করতে এসেছে। সবার চোখের সামনেই একদিন তার কবজি হাত থেকে কেটে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে মিলের গাড়িতে করে খুলনা মেডিকেলে নেওয়া হয়। সেখানে তাকে ফেলে এসে পরিবারকে খবর দিয়ে নিয়ে যায় এবং তাদের হাতে ওষুধ কেনার জন্য মাত্র ২০০০ টাকা দেওয়া হয়। ওই শেষ, তাকে আজ পর্যন্ত দেখতেও যায়নি মিল কর্তৃপক্ষ। পরিবার ধারদেনা করে তাকে সুস্থ করে তুললেও আজ তার একটা হাত পঙ্গু, নেই মিলের কাজ। এখন তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

অষ্টম/নবম শ্রেণিপড়ুয়া রাজু নামের একটা ছেলে কয়েক দিন হলো কাজ করতে এসেছে। সবার চোখের সামনেই একদিন তার কবজি হাত থেকে কেটে পড়ে যায়।

পেটের দায়ে কাজ করতে গিয়ে এমন শত শত হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে চলেছে বেসরকারি পাটকলে। কিন্তু দেখার কেউ নেই… ওখানকার শ্রমিকরা এগুলো দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ক্ষুধার দাবি অস্বীকার করতে না পেরে তারা আজ এই বেসরকারি মিলের জাঁতাকলে পিষ্ট।

মিলে নারী শ্রমিকদের সংখ্যা বেশি হওয়া সত্ত্বেও নারীদের জন্য সেখানে নেই কোনো নিরাপত্তা। সি শিফটে (রাত ১০টা থেকে ৬টা) যেসব মেয়ে ও নারীরা কাজ করতে যান, তাদের অনেক সময় যৌন হয়রানি থেকে ধর্ষণের শিকার পর্যন্ত হতে হয়। আবার এসব ক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না বললেই চলে। গত কয়েকদিন আগে খুলনার রূপসায় গ্লোরি জুটমিলে রাতে কর্মরত অবস্থায় একজন নারী শ্রমিককে মিলের বাইরে নিয়ে গিয়ে কয়েকজন মিলে ধর্ষণ করে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। মিল কর্তৃপক্ষেরও এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।

খাদিজা নামের একজন আকিজ জুটমিল শ্রমিককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এত কম বেতনে আপনারা কাজ করেন কেন? খুব সহজ উত্তর তার: ‘আর তো কিছু করার নেই, আমরা যাব কনে? আমরা পরিবারের সবাই মিলে আকিজে কাজ করি, তাই যা হয় তাই দিয়ে চলি।’

ভাবা যায়, দেশের নামকরা বেসরকারি পাটকলের শ্রমিকদের এই পরিস্থিতি? না-খেয়ে মরার ভয়ে তারা বেতন বাড়ানোর দাবি তুলতেও ভয় পায়! কাজের চাপে ও স্যারদের ভয়ে নারী শ্রমিকরা নাকি টয়লেটেও যেতে পারেন না। অনেক সময় চেপে রাখতে হয়। টানা ৮ ঘণ্টা কাজের মধ্যে খাবারের বিরতি থাকে মাত্র ২০-৩০ মিনিট। এই সময়ের মধ্যে খাওয়াসহ বাকি কাজ শেষ করতে হয়। আর কোনো বিরতি নেই। দু-একজন বয়স্ক শ্রমিক বাদে তরুণ শ্রমিকদের দেওয়া হয় না নামাজের ছুটি। এসব মিলমালিকের কাছে যন্ত্র ও শ্রমিকের কোনো পার্থক্য নেই। সবকিছুই উৎপাদনের হাতিয়ার মাত্র।

এখানে নেই চাকরির কোনো নিশ্চয়তা, নেই কোনো স্বাধীনতা। কথা বললেই চাকরি চলে যাওয়ার ভয়। চাকরি থেকে ছাঁটাই করার জন্য কোনো নোটিশের প্রয়োজনও হয় না। শ্রমিকের ভাষায়: ‘যারা কুড়ি গুনতি পারে, তাদের এখানে রাখা হয় না। যারা একদম বোকাসোকা, বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না; কিন্তু পশুর মতো খাটতে জানে, এটা তাদের জন্য।’

কোনো বেসরকারি মিলেই ইউনিয়ন নেই। আকিজ জুটমিলের মতো দু-একটি মিলে যদিও-বা ইউনিয়ন আছে, তা শ্রমিকদের জন্য নয়; বরং সাধারণ শ্রমিকদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্যই তাদের ব্যবহার করা হয়।

প্রায় কোনো বেসরকারি মিলেই ইউনিয়ন নেই। আকিজ জুটমিলের মতো দু-একটি মিলে যদিও-বা ইউনিয়ন আছে, তা শ্রমিকদের জন্য নয়; বরং সাধারণ শ্রমিকদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্যই তাদের ব্যবহার করা হয়। আর এই ইউনিয়ন শুধু বিদেশি বায়ারদের দেখানোর জন্য করা হয়েছে বলেই বোঝা যায়। এর সঙ্গে শ্রমিকস্বার্থের কোনো সম্পর্ক নেই।

যেসব পাটকল মালিক কোনো ধরনের শ্রম আইনের তোয়াক্কা না করে বছরের পর বছর তাদের কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের সম্পূর্ণভাবে দাস বানিয়ে রেখে যন্ত্রের মতো খাটিয়ে মুনাফা করে যাচ্ছেন, এ দেশের সরকার-পাটমন্ত্রী তাদের ভূয়সী প্রশংসা করে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো তাদের হাতেই তুলে দিতে যাচ্ছেন!

১৯৮২ সালে বাংলাদেশে ৮২টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল ছিল এবং তখন পর্যন্ত কোনো বেসরকারি পাটকল ছিল না। অথচ ২০২০ সালের ৩০ জুন যখন সবশেষ ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল একযোগে বন্ধ ঘোষণা করা হলো, তখন বাংলাদেশে বেসরকারি পাটকলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮১টি! লস দেখিয়ে আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করা হয়, কিন্তু লসের কারণ উদ্‌ঘাটন করে তা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয় না। বরং যেসব পাটকল মালিক কোনো ধরনের শ্রম আইনের তোয়াক্কা না করে বছরের পর বছর তাদের কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের সম্পূর্ণভাবে দাস বানিয়ে রেখে যন্ত্রের মতো খাটিয়ে মুনাফা করে যাচ্ছেন, এ দেশের সরকার-পাটমন্ত্রী তাদের ভূয়সী প্রশংসা করে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো তাদের হাতেই তুলে দিতে যাচ্ছেন!

রুহুল আমিন: সংগঠক, শ্রমিক-ছাত্র-জনতা ঐক্য, খুলনা

ইমেইল: ruhulaminssj@gmail.com

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •