কী ঘটেছিল পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ায়: ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ভাষ্য

হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার সরেজমিন প্রতিবেদন

কী ঘটেছিল পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ায়: ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ভাষ্য

মাহতাব উদ্দীন আহমেদ

সুনীতি রানী দাস বসে আছেন তার পুড়ে যাওয়া খড়ের গাদার সামনে। তার গরুগুলোর মুখে কোন খাবার দিতে পারেননি গত কয়দিন। -- ছবি: তাপস পাল

গত ১৭ অক্টোবর রংপুরের পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের জেলেদের উপর ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়। আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় তাদের ঘরবাড়ি, চালানো হয় লুটপাট। সেই ঘটনার বিস্তারিত অনুসন্ধানের জন্য দৃক পিকচার লাইব্রেরির পক্ষ থেকে তাদের ফটোগ্রাফি বিভাগের আলোকচিত্রী তাপস পাল এবং রিসার্চ এন্ড পাবলিক ক্যাম্পেইনস বিভাগের গবেষক মাহতাব উদ্দীন আহমেদ গত ১৯ অক্টোবর ভোরে ঘটনাস্থলে যান। সেখানে তারা ২০ অক্টোবর রাত পর্যন্ত অবস্থান করে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ও গ্রামবাসীর সাথে কথা বলে ঘটনা সম্পর্কে তাদের বিভিন্ন বয়ানগুলো সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন। তারই ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন দৃকের গবেষক মাহতাব উদ্দীন আহমেদ।

সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট

গত ১৩ অক্টোবর ২০২১ তারিখে দূর্গা পূজা চলাকালীন সময়ে কুমিল্লার একটি পূজা মন্ডপে হনুমানের পায়ের কাছে কোরান শরীফ রেখে নাটক সাজিয়ে ফেসবুকে “কুমিল্লাতে পূজা মন্ডপে কোরান শরীফ অবমাননা করা হয়েছে” এই মর্মে সাম্প্রদায়িক প্রচারণা শুরু হয়। শুরু হয় ফেসবুকে ব্যাপক মাত্রায় সাম্প্রদায়িক উসকানি দেয়া। ফেসবুকে মন্ত্রী এমপি প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কোন “কটুক্তি” করলেই সাথে সাথে যেভাবে আইনশৃংখলা বাহিনী তৎপর হয়ে গ্রেফতার, বাড়ি থেকে উঠানোর তড়িৎ তৎপরতা দেখায়, এইসব সাম্প্রদায়িক প্রপাগান্ডা ও উসকানিমূলক বক্তব্য ফেসবুকে ছড়ানোর সময় আইন শৃংখলা বাহিনীর সেই সমান তৎপরতা দেখা যায়নি আগের অনেক ঘটনার মতোই। এই প্রেক্ষিতে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় একযোগে হিন্দুদের মন্দির-পূজামন্ডপে হামলা শুরু হয়। সপ্তাহব্যাপী চলে এই হামলা। ১৩ অক্টোবর থেকে গত ২২ অক্টোবর ২০২১ পর্যন্ত সারাদেশের ১৭টি জেলায় মোট ২০ বার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর বিভিন্ন মাত্রায় হামলা হয়।

১৩ অক্টোবরেই সবচেয়ে বেশি জায়গায় হামলা হয়। একযোগে ১০ জেলায় হামলা চলে। জেলাগুলো হচ্ছে: কুড়িগ্রাম, গাজীপুর, কুমিল্লা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ।

১৪ অক্টোবর হামলা চলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নোয়াখালী ও বান্দরবান – এই তিন জেলায়।

১৫ অক্টোবরও হামলার শিকার হন ৩টি জেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ – নোয়াখালী, সিলেট ও চট্টগ্রাম।

১৬ অক্টোবর হামলা হয় মুন্সিগঞ্জ ও ফেনীতে।

১৭ অক্টোবর হামলা হয় রংপুরের পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ায় যেখানে দৃকের দুই সদস্যের প্রতিনিধিদল যান অনুসন্ধান এবং ডকুমেন্টেশনের জন্য।

রংপুরের ঘটনার পরও ২১ অক্টোবর নতুন করে হামলা হয় বগুড়ায়।

এরপর ২২ অক্টোবর হামলা চলে হবিগঞ্জে।

এরপর থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নতুন হামলার খবর আপাতত আর পাওয়া না গেলেও এখানে উল্লেখ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল ২২ তারিখেই সীমান্তবর্তী ভারতের ত্রিপুরায় মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর একই কায়দায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। তার ছবি ও ভিডিও ইতিমধ্যেই ফেসবুক ও অন্যন্য মাধ্যম মারফত আমরা দেখেছি।

উত্তর মাঝিপাড়ার রুহিনী চন্দ্র দাসের বাড়ি। অন্য সবকিছুর সাথে তার ছেলের মোটরসাইকেলটিও পুড়ে যায়। — ছবি: তাপস পাল

স্বল্প সময়ে আমরা যেভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছি:

সারাদেশের এই ১৭টি জেলার মধ্যে কোথায় কী উদ্দেশ্যে কারা এই হামলাগুলো চালিয়েছে তার উত্তর এলাকাভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে আবার নাও পারে। অতীতের ঘটনাবলী থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতায় কিছু কিছু বিষয় আমাদের জানা – এসব হামলার সাথে ক্ষমতাসীনদের সম্পর্ক, সাম্প্রদায়িকতার সম্পর্ক, অর্থনৈতিক স্বার্থ, ভূমির দখলের স্বার্থ, নির্বাচন, উচ্ছেদ, আন্তর্জাতিক সংযোগ, সর্বোপরি রাজনীতি। কিন্তু রংপুরের পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ায় যখন হামলা হল হিন্দু জেলেদের উপর, জ্বালিয়ে দেয়া হল তাদের ঘরবাড়ি, তখন আমাদের সরেজমিন অনুসন্ধানের সময় আমরা ইচ্ছে করেই আমাদের মাথা থেকে এই অতীত অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত অনুমানগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি। আমরা সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করেছি “ফাঁকা” মাথা নিয়ে কিন্তু একটা গভীর অনুসন্ধিৎসা নিয়ে যেই অনুসন্ধিৎসার কাছে প্রতিটি তথ্যই মূল্যবান, প্রত্যেকের কথাই মূল্যবান। আবার একই সাথে সেই তথ্য ও বক্তব্যকে সেটি গ্রহণ করেছে নাকচ করে দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করার মধ্য দিয়ে। সুতরাং আমাদের কাজ ছিল – শোনা, শোনা এবং শুনে যাওয়া। প্রতিটি তথ্য, প্রতিটি বক্তব্যকে কাউন্টার করে প্রশ্ন করা, যাচাই করা, ক্রসচেক করা এবং যতবেশি সম্ভব ঘটনার বিভিন্ন প্রকারের বয়ানগুলোকে বোঝার চেষ্টা করা। আর শেষমেষ টুকরো টুকরো তথ্যগুলোকে ঘটনাক্রম অনুসারে সাজানোর চেষ্টা করার মধ্য দিয়ে একটা মালা গাঁথার চেষ্টা করা। এই সরেজমিন প্রতিবেদন আসলে সেই মালাটাই, যদিও তা যথেষ্টই অসম্পূর্ণ। এটাও মাথায় রাখা প্রয়োজন যে এখানে যা উপস্থাপিত হবে সেটি হল যে গ্রামে হামলা হয়েছে সেখানকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ভাষ্য। সেই ভাষ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করা এই স্বল্প সময়ে সম্ভবও নয়। আমরা তাই এই সরেজমিন অনুসন্ধানের প্রতিবেদনটিকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ভাষ্য হিসেবেই দেখতে চাই। যেহেতু আমাদের উদ্দেশ্যই ছিল ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছ থেকে ঘটনার বিভিন্ন রকম বয়ানগুলোকে সংগ্রহ করা তাই খুব সঙ্গত কারণেই আমরা স্থানীয় প্রশাসন বা আইন শৃংখলা বাহিনীর ভাষ্য নেয়াটাকে প্রয়োজন মনে করিনি। তাদের ভাষ্য পত্রিকা মারফত মোটামুটি সবাই জানে। আমরা পীরগঞ্জের হামলাস্থলে যাই ১৯ অক্টোবর সকালে। আর সেখানে থাকি ২০ অক্টোবর রাত পর্যন্ত।

রতুলচন্দ্র দাসের ছাগলের ঘর এখন ফাঁকা। হামলাকারীরা নিয়ে গেছে। এর পাশেই এখনো মায়ের দুধ খাওয়ার বয়সী এক ছাগল এতিমের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল। মা ছাগলটি সব সবগুলো ছাগলই নিয়ে গিয়েছে হামলাকারীরা। — ছবি: মাহতাব উদ্দীন আহমেদ

ঘটনার সূত্রপাত কি ১৭ তারিখেই?

১৭ তারিখ হামলা হলেও পীরগঞ্জে ঘটনা বিষয়ক নড়াচড়ার দৃশ্যমান সূত্রপাত হয় অষ্টমীর দিনে অর্থাৎ ১৪ অক্টোবর, কুমিল্লার কোরান অবমাননার সাজানো নাটকের একদিন পর, যখন ইতিমধ্যেই ১০ জেলায় হামলা হয়ে গেছে কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে। গৌতম অধিকারী (৫০) ছিলেন পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া গ্রামের এবারের দূর্গা পূজার মন্ডপের পুরোহিত। তিনি ওই এলাকার বাসিন্দা না হলেও পূজা উপলক্ষে দশমীর দিন অর্থাৎ ১৬ তারিখ পর্যন্ত ওই এলাকাতেই অবস্থান করছিলেন। হামলার পর যেদিন আমরা যাই সেদিন তার সাথে আমাদের কথা হয়। তিনি অনেকটা নিজে থেকেই আমাদের এসে বলেন যে তার “কিছু বলার আছে”। পুরোহিত গৌতম অধিকারী জানান, ১৪ তারিখেই দুপুরের দিকে পাশ্ববর্তী ৪ নং ইউনিয়নের পূজা কমিটির সদস্য শচিন ডাক্তার তাকে ফোন দেন। শচিন তাকে জানান, কুমিল্লার “কোরান অবমাননার” ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি স্থানীয় পূজা মন্ডপগুলোতে হামলার আশংকা করছেন। শচিন ডাক্তারের এই আশংকার কথা শুনে গৌতম তখন ফোন করেন তাদের মাঝিপাড়ার পূজা কমিটির সভাপতি অর্জুন বাবুকে। অর্জুন বাবুর কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন যে মাঝিপাড়ার পাশেই থাকা বটেরহাট বাজারে তিনি শুনে এসেছেন যে “এলাকার পূজা মন্ডপগুলোর ব্যাপারে মিটিং করেছে” মুসলমান সম্প্রদায়ের “কিছু” মানুষ। এবং এলাকায় কানাঘুষা শোনা গেছে যে মিটিং এর বিষয়বস্তু হল “মন্ডপগুলোকে এখন কি করা হবে”। তবে যেহেতু গৌতম কিংবা অর্জুন কেউই বিষয়টি নিজের কানে শুনেননি এবং এলাকা আপাতদৃষ্টিতে “শান্ত” ছিল তাই তারা নিজেরা আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেন যে “যেহেতু এলাকায় জোরালো কিছু নেই, তাই চিন্তা নেই।”

মাঝিপাড়ার রাধাগোবিন্দ মন্দিরে বিজিবির পাহারা। — ছবি: মাহতাব উদ্দীন আহমেদ

উল্লেখ্য গৌতমের সাথে যখন আমরা কথা বলছিলাম তখন দুইজন ষন্ডা মার্কা লোক এসে (যারা আমাদের পিছে পিছে প্রায় অনুসরণ করার মতো ঘুরছিলেন কিছুক্ষণ) আমাদের প্রায় ধমকের সুরে বলতে থাকলো, “এলাকার মানুষের সাথে কথা বলেন, এলাকার বাইরের মানুষের সাথে এত কি কথা?” একপর্যায়ে সেখানে যে অস্বস্তিকর আবহ তৈরি হল তাতে গৌতমকে আমরা বিদায় দেই। কিন্তু বিদায়ের আগে গৌতম আমাদের আরও যা জানান তা হল, ১৭ তারিখ যখন হামলা হয় তখন রাত ৮টার দিকে অর্জুন বাবুর ছেলে তাকে ফোন দিয়ে ঘটনা জানালে তিনি প্রথমে পীরগঞ্জ থানার ওসিকে ফোন দেন। কিন্তু ওসি ফোন ধরেননি। এরপর একপর্যায়ে যখন তিনি বুঝতে পারেন যে পুলিশ “হামলা ঠেকাতে পারছে না” তখন বাধ্য হয়ে ৯৯৯ এ কল করে সাহায্য চান। ৯৯৯ এ কল করে তিনি বলেন যে পুলিশ হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। এখানে ব্ল্যাংক ফায়ার করা প্রয়োজন। আরও ফোর্স প্রয়োজন। গৌতমের ভাষ্য অনুযায়ী, তখন ৯৯৯ থেকে তাকে বলা হয় যে তারা পুলিশের চাহিদামতো সাড়া দেবে।

১৭ তারিখ যখন হামলা হয় তখন রাত ৮টার দিকে অর্জুন বাবুর ছেলে তাকে ফোন দিয়ে ঘটনা জানালে তিনি প্রথমে পীরগঞ্জ থানার ওসিকে ফোন দেন। কিন্তু ওসি ফোন ধরেননি। এরপর একপর্যায়ে যখন তিনি বুঝতে পারেন যে পুলিশ “হামলা ঠেকাতে পারছে না” তখন বাধ্য হয়ে ৯৯৯ এ কল করে সাহায্য চান।

বিজিবির পাহারায় গ্রামে ‘শান্তি বিরাজমান’। — ছবি: তাপস পাল

পরিতোষ সরকার কি আদৌ ফেসবুকে ইসলাম ধর্মের অবমাননাকারী কমেন্ট করেছিল?

যে ছেলেটির মক্কা শরীফকে অবমাননা করা “ফেসবুক কমেন্ট” নিয়ে এত কান্ড সেই পরিতোষ সরকার পড়ে ইন্টারমিডিয়েট ১ম বর্ষে। তার বাবা প্রসন্ন চন্দ্র দাস একই সাথে একজন জেলে এবং এলাকার পরিচিত কবিরাজ। পত্রপত্রিকাতে যেভাবে রিপোর্ট হয়েছে পরিতোষের বাড়িতে কোন হামলা হয়নি সেই তথ্যটি সঠিক নয়। হামলা শুরু হয় পরিতোষের বাড়ির পাশের খড়ের গাদায় আগুন দেয়ার মধ্য দিয়ে। তার চিহ্ন আমরা স্বচক্ষেই দেখে এসেছি। যদিও তার বাড়িতে আগুন দেয়া হয়নি। পরিতোষের বাড়ি হল উত্তর মাঝিপাড়ায়।  আর মূল হামলাটি করা হয়েছে দক্ষিণ মাঝিপাড়ায়।

পরিতোষ সম্পর্কে দুই মাঝিপাড়ার বাসিন্দাদের মধ্যে দুই রকম ভাষ্য পাওয়া যায়। যেখানে হামলা হয়েছে সেই দক্ষিণ মাঝিপাড়ার ক্ষতিগ্রস্ত কেউ কেউ আমাদের বলেছেন যে পরিতোষ একজন ‘উচ্ছৃংখল’ ছেলে। কিন্তু যখন আমরা জিজ্ঞেস করি যে কেন উচ্ছৃংখল বলছেন সেটির কোন সদুত্তর তারা দিতে পারেননি। তারা যেসব বিষয়ে পরিতোষের ‘বদনাম’ আছে বলে আমাদের কাছে বলেছেন সেটির মধ্যে প্রধান ‘অভিযোগ’ হল ‘মুসলমান মেয়েদের সাথে প্রেম করা’ যেটি বিদ্যমান সামাজিক বাস্তবতায় ‘সমালোচনার যোগ্য’ হলেও আইনত কোন অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না। এটা সত্য যে পরিতোষের এক মুসলমান মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সেটি ধরা পড়ে যায় দুই পরিবারেরই অভিভাবকদের কাছে। পরে দুই পরিবারের অভিভাবকদের উপস্থিতিতে সেই সম্পর্কের ইতি টানানো হয় জোর করে। এর মধ্যে পরিতোষের মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন একটি অপারেশনের পরে। ফলে ‘একজন সেবাযত্নকারী প্রয়োজন’ এই তাগিদ থেকেও পরিতোষের বয়স খুব কম হলেও (১৯-২০ বছর) পারিবারিকভাবে তার বিয়ে ঠিক করা হয় মহিষকান্দির মাদারগঞ্জের এক হিন্দু মেয়ের সাথে। এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পরিতোষের কাকাত ভাই ও তার পাশের ঘরের বাসিন্দা স্বপন চন্দ্র দাস। তবে দক্ষিণ মাঝিপাড়ার বাসিন্দারা যেমনটি বলেছেন সে ব্যাপারে পরিতোষের গ্রামের মানুষ ও প্রতিবেশীরা বরং পরিতোষ সম্পর্কে উল্টো কথাই আমাদের বলেন। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী পরিতোষ একটু ‘দুরন্ত প্রকৃতির’ বন্ধুবৎসল ছেলে। কিন্তু মোটেও উচ্ছৃংখল কোন ছেলে ছিল না। পরিতোষ মুসলমান মেয়েদের উত্যক্ত করতো – দক্ষিণ মাঝিপাড়ার হিন্দু বাসিন্দাদের এমন ‘অভিযোগ’কে অস্বীকার করেন উত্তর মাঝিপাড়ার হিন্দুরা। তবে ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণ মাঝিপাড়ার যতজনের সাথে আমাদের পরিতোষ বিষয়ে কথা হয়েছে তাদের বেশিরভাগের কথা থেকে এটাও স্পষ্ট ছিল যে তারা আসলে পরিতোষ সম্পর্কে বেশি কিছু খবর রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি।

সুমতী বালা আর দেবেন্দ্র চন্দ্র দাসের পরিবারই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় হামলাকারীদের দেয়া আগুনে। — ছবি: তাপস পাল

পরিতোষের ব্যাপারে পত্রপত্রিকায় আইন শৃংখলা বাহিনীর বরাত দিয়ে যেভাবে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে যে সে দোষ স্বীকার করে ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে’ সেই বয়ান থেকে একেবারেই বিপরীত বয়ান দিয়েছে তার পরিবার ও আত্মীয়রা। আমরা পরিতোষের বাড়িতে যাই ২০ অক্টোবর দুপুরে। তখন সেখানে পরিতোষের পরিবারের কেউ না থাকলেও তার বাড়ির পাশের বাড়িতে থাকেন তার যে কাকাত ভাই সেই স্বপন চন্দ্র দাসকে আমরা খুঁজে পাই। যিনি নিজেও ঘটনার পর থেকে হামলার ভয়ে ১৯ তারিখ সকাল পর্যন্ত আত্মগোপনে ছিলেন। তিনি আমাদের সরাসরি বলেছেন যে তিনি দায়িত্ব নিয়েই বলতে চান যে, ঘটনার দিন যখন হামলাকারীরা পরিতোষের পাড়ায় জড়ো হয় তখন খবর পেয়ে তিনি পরিতোষকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেন যে সে কি পোস্ট করেছে ফেসবুকে? পরিতোষ তখন কাঁদতে কাঁদতে তাকে উত্তর দিয়েছিল যে, “দাদা আমি এগুলোর কিছু জানি না, আমার ফেসবুক সম্ভবত কেউ হ্যাক করেছে।” এর কিছুক্ষণ পর থেকেই পরিতোষের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এই ফোনালাপের কিছু সময় পরই পরিতোষ হামলার ভয়ে পুরো পরিবারসহ আত্মগোপনে চলে যায়। স্বপনের ভাষ্য অনুযায়ী তিনি এই কথা পুলিশকে জানাতে পারেন নি তার কারণ ঘটনার দিন হামলা হওয়ার পর যখন তিনি এলাকায় ফিরেন তখন পরিস্থিতি দেখে তিনি নিজেও ভয়ে আর বাড়িতে আসেননি। লুকিয়ে ছিলেন অন্য জায়গায়। আর বাড়িতে ফেরার পর কোন সাংবাদিক তার কাছে আসে নি তখন পর্যন্ত। তবে পীরগঞ্জ থেকে ফিরে আসার পর পরবর্তীতে আমরা যখন পরিতোষের বাবার সাথে যোগাযোগ করতে সমর্থ হই তখন পরিতোষের বাবা আমাদের ঘটনার আরও বিস্তারিত বয়ান দেন।

পরিতোষের ব্যাপারে পত্রপত্রিকায় আইন শৃংখলা বাহিনীর বরাত দিয়ে যেভাবে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে যে সে দোষ স্বীকার করে ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে’ সেই বয়ান থেকে একেবারেই বিপরীত বয়ান দিয়েছে তার পরিবার ও আত্মীয়রা।

যে ১৪ অক্টোবর স্থানীয় বটেরহাট বাজারে এলাকার পূজামন্ডপ বিষয়ে কিছু মুসলমান ব্যক্তির ‘মিটিং’ করার কানাঘুষা শোনা যায়, সেই ১৪ অক্টোবরেই পরিতোষ তার হবু শ্বশুরবাড়িতে যায় কয়েকদিন বেড়িয়ে আসার জন্য। সেখান থেকে পরিতোষ ফিরে ১৭ অক্টোবর বিকালে। শ্বশুরবাড়ি মাদারগঞ্জ থেকে ১৭ অক্টোবর পরিতোষ যখন বাড়ি ফিরছিল তখন চারটার সময় পীরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে সে একটি লাইনের অটো নেয় যেটি ভাড়ায় যাত্রী শেয়ার করে চলে। তাকে সেই অটোতে উঠতে দেখে পরিতোষের পরিচিত এলাকার স্থানীয় যুবক উজ্জল, আল আমিনসহ মোট ৪ জন সেই অটোতে উঠে। অটোতে উঠে তারা পরিতোষকে বলে যে “কিরে পূজা চলে গেল কিছু খাওয়াইলি না? আজকে তোর বাড়িতে যাব, নাড়ু খাব।” তারা এধরনের হালকা চালে পরিতোষের সাথে গল্প করতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা পরিতোষের হাতের মোবাইল দেখে বলে যে, “দেখি তো কি মোবাইল?” যেহেতু তারা পরিতোষের পরিচিত তাই পরিতোষ সাত পাঁচ না ভেবে তাদের হাতে মোবাইলটা দেয় দেখার জন্য। এসময় তিনজন পরিতোষের সাথে গল্প করার নামে তাকে ব্যস্ত রাখে আর একজন একপাশে বসে পরিতোষের মোবাইল নিয়ে টিপাটিপি করতে থাকে। এক পর্যায়ে সেই অটো যখন পরিতোষের বাড়ির কাছাকাছি চলে আসে তখন হঠাৎ করে উজ্জল, আল আমিন সহ ওই চার যুবক স্থানীয় বটেরহাট বাজারের আগে আখিরা নদীর ব্রিজের আগে নেমে যায় এবং পরিতোষকে বলে যে আজকে আর তোর বাড়িতে যাব না। আরেকদিন যাব। একথা বলে তারা চলে যায়। এরপর পরিতোষ ওই অটো নিয়েই তার বাড়িতে পৌঁছে। পরিতোষ ঘটনার দিন শুরুতে তার ফেসবুক হ্যাক হয়েছে মনে করে তার কাকাত ভাইয়ের সাথে কথা বললেও পরে পরিতোষের সন্দেহ হয় যে ওই চার যুবকই পরিকল্পিতভাবে পরিতোষের মোবাইল হাতে নিয়ে তার হয়ে ফেসবুকে ওই অবমাননাকারী কমেন্টটি করে তাকে ফাঁসিয়েছে। পরিতোষ তার বাবাকে পরবর্তীতে এই চার যুবকের তার অটোতে উঠা এবং মোবাইল হাতে নেয়াসহ এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছিল।

পরিতোষ ঘটনার দিন শুরুতে তার ফেসবুক হ্যাক হয়েছে মনে করে তার কাকাত ভাইয়ের সাথে কথা বললেও পরে পরিতোষের সন্দেহ হয় যে ওই চার যুবকই পরিকল্পিতভাবে পরিতোষের মোবাইল হাতে নিয়ে তার হয়ে ফেসবুকে ওই অবমাননাকারী কমেন্টটি করে তাকে ফাঁসিয়েছে। পরিতোষ তার বাবাকে পরবর্তীতে এই চার যুবকের তার অটোতে উঠা এবং মোবাইল হাতে নেয়াসহ এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছিল।

আমরা যখন পরিতোষের বাবা ও কাকাত ভাইকে একথা জিজ্ঞেস করি যে তাহলে আইন শৃংখলা বাহিনী কেন বলছে যে পরিতোষ দোষ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে তখন পরিতোষের বাবা আমাদের জানান যে তিনি মোবাইলের কোন কিছু বোঝেন না, মোবাইলের ফোন নম্বরটা পর্যন্ত তাকে অন্যদের বের করে দিতে হয়। তিনি পরিতোষের কাছ থেকে এতটুকুই শুনেছেন। আর পরিতোষ এগুলোই পুলিশকে বলেছে। আর তার কাকাত ভাই স্বপন জানান যে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে পরিতোষের সাথে তাদের পরিবারের কারও এখন পর্যন্ত যোগাযোগ হয়নি তাই কেন পুলিশ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির কথা বলছে কিংবা পরিতোষের পোস্ট দেয়া বিষয়ে তাদের বয়ানের সাথে মিডিয়ায় প্রকাশিত পুলিশের বয়ান কেন একদম বিপরীত সেটি তারা বলতে পারবেন না।

পরিতোষের সাথে ফেসবুকে যুক্ত আছে এমন কয়েকজন স্থানীয় কিশোর-তরুণের সাথে আমাদের দেখা হয়। তারা আমাদের জানায় যে, পরিতোষকে ফেসবুকে আগে কখনো ইসলাম বা অন্য কোন ধর্মকে অবমাননা করে কোন পোস্ট দিতে দেখেনি। পরিতোষের কাকাত ভাই স্বপন নিজেও পরিতোষের সাথে ফেসুবকে যুক্ত আছেন। তিনি জানান, পরিতোষ ফেসবুকে মূলত ফ্রেন্ডলি ফায়ার গেম খেলত। আর মূলত পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও গ্রামের ছবি দিত। এই ছিল তার ফেসবুকের দৈনন্দিন কর্মকান্ড। এছাড়াও সে স্থানীয় তরুণদের কিছু ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত ছিল। তিনি আমাদের এটাও জানান যে পরিতোষ মোটেও কোন ধার্মিক হিন্দুও ছিল না। সে ধর্মকর্ম কদাচিৎ পালন করত। তাই পরিতোষের অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ থাকার কোন প্রশ্নই আসে না। পরিতোষের গ্রামের মানুষও আমাদের জানান তারা আগে কখনো কোনদিন পরিতোষের মুখে ইসলাম বা অন্য কোন ধর্ম নিয়ে কোন প্রকার অবমাননাকর কিছু শোনেননি। উল্লেখ্য পরিতোষের নামে এখন পীরগঞ্জ থানায় ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। এবং সে এখন কারাগারে। ২২ অক্টোবর সর্বশেষ যখন আমরা তার পরিবারের সাথে কথা বলি তখন পর্যন্ত তার কোন আইনজীবী ছিল না।

পরিতোষের গ্রামের মানুষও আমাদের জানান তারা আগে কখনো কোনদিন পরিতোষের মুখে ইসলাম বা অন্য কোন ধর্ম নিয়ে কোন প্রকার অবমাননাকর কিছু শোনেননি। উল্লেখ্য পরিতোষের নামে এখন পীরগঞ্জ থানায় ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। এবং সে এখন কারাগারে। ২২ অক্টোবর সর্বশেষ যখন আমরা তার পরিবারের সাথে কথা বলি তখন পর্যন্ত তার কোন আইনজীবী ছিল না।

রাধাগোবিন্দ মন্দিরের ছোট একটি কক্ষের ভেতর। — ছবি: তাপস পাল

হামলা কিভাবে হল?

১৭ অক্টোবর পরিতোষ বাড়ি ফেরে বিকাল সাড়ে ৪টার সময় যার অল্প কিছু সময় আগেই সিএনজিতে তার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে “টিপাটিপি” করার পর তার মোবাইল তাকে ফেরত দিয়ে ওই চার যুবক বটেরহাট বাজারে নেমে যায়। সেসময় থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পরিতোষের ওই “কমেন্ট” কারা ফেসবুকে ছড়ায় সেটি আমরা তখন জানতে না পারলেও পরবর্তীতে র‌্যাবের ব্রিফিংয়ে জানা যায় যে পীরগঞ্জের স্থানীয় এক ছাত্রলীগ নেতা সৈকত এই কন্টেন্ট ছড়ানোর পিছনে কাজ করে।

এসময় কতগুলো ঘটনা সমান্তরালে ঘটে।

মাঝিপাড়া গ্রামের দুই মাথায় দুইটি মসজিদ, একটি হল উত্তর মাঝিপাড়ার পাশের বটেরহাট মসজিদ যেখানে ওই চার যুবক পরিতোষের অটো থেকে নেমে গিয়েছিল হঠাৎ করে। আর আরেকটি হল দক্ষিণ মাঝিপাড়ার পাশের হাতীবান্ধা মসজিদ। এই দুই মসজিদ থেকে সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে হামলার প্রস্তুতিমূলক মাইকিং করা হয়। গ্রামের মানুষ যারা সেই মাইকিং শুনেছেন তারা জানান যে, সেই মাইকিং এর ভাষ্য ছিল মোটের উপর এরকম: “মুসলমান ভাইয়েরা কে কোথায় আছেন, একজোট হন, আমাদের কোরানকে অপমান করা হয়েছে… হিন্দুদের আর এখানে থাকতে দেয়া যাবে না”… ইত্যাদি। এর মধ্যে হাতীবান্ধা মসজিদ থেকে উপরোক্ত উস্কানিমূলক মাইকিং এর পাশাপাশি আবার এ ধরনের কথাও বলা হয় যে “দক্ষিণ মাঝিপাড়ার হিন্দুরা নিজের বাড়িতে থাকুন, আপনারা কেউ উত্তর পাড়ায় যাবেন না। আপনারা আপনাদের ঘরে থাকলে কেউ আপনাদের গায়ে হাত দিবে না… ইত্যাদি”। এক্ষেত্রে আরও উল্লেখ্য যে বটেরহাট মসজিদে মাইকিং হয়েছিল সেই বটেরহাট বাজারে সেদিন ছিল হাট বসার দিন।

এই মাইকিং এবং হামলাকারীদের আনাগোনা ও পরিতোষের গ্রামের দিকে পুলিশের উপস্থিতি এই সবকিছু মিলিয়ে পরিতোষ এবং গ্রামের মানুষ প্রথম পরিতোষের ওই “ফেসবুকের কমেন্টের” বিষয়ে জানতে পারেন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে। সন্ধ্যা ৭টার মধ্যেই তিন চারশো হামলাকারী এসে পরিতোষের গ্রাম উত্তর মাঝিপাড়ায় এসে হাজির হয়। ইতোমধ্যে পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী তারা হামলার বিষয়টি আগাম টের পায়। তাই তারা পরিতোষের বাড়িতে পুলিশ পাঠায়। তবে গ্রামের মানুষ আমাদের জানান সেই পাঠানো পুলিশের সংখ্যা শুরুতে মাত্র ১৫ জনের মতো ছিল।

হামলাকারীরা এসে পরিতোষের বাড়ির থেকে কয়েকশো গজ সামনে আতাউলের মৌলভীর মুদি দোকানের সামনে এসে জড়ো হয়। এবং পরিতোষের কথা তুলে হিন্দুদের গালিগালাজ করতে থাকে। পরিতোষের গ্রামের মানুষেরা আমাদের জানান, এসময় আতাউলের দোকানের সামনে হামলাকারীদের সাথে “মিটিং করে” স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ পুলিশের সদস্যরা। তবে সেই মিটিংয়ে কী আলাপ হয়েছিল সেটা তারা আমাদের জানাতে পারেননি। কারণ তারা হামলার ভয়ে সেখানে যেতে পারছিলেন না। তবে এই মিটিং এর পরেই হামলাকারীরা এগিয়ে এসে পরিতোষের বাড়ির খড়ের গাদায় আগুন দেয়। এসময় পুলিশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুঁড়লে হামলাকারীরা সেখান থেকে এগিয়ে গিয়ে উত্তর মাঝিপাড়ার দিকে চলে যায় এবং সেখানকার বাড়িগুলোতে আগুন দিতে শুরু করে। তবে পুলিশ সেখানে আর না গিয়ে দক্ষিণ মাঝিপাড়াতেই বটেরহাট আখিরা নদীর ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। যদিও পরিতোষের বাড়ি থেকে উত্তর মাঝিপাড়ার যে বাড়িগুলো দিয়ে হামলা শুরু হয় সেখানে হেঁটে যেতেই লাগে মাত্র ৫-৭ মিনিট। গ্রামের মানুষ আমাদের এটাও জানায় যে হামলা হওয়ার আগে দিয়ে বিদ্যুতের সংযোগ চলে গিয়েছিল।

হামলাকারীরা সেখান থেকে এগিয়ে গিয়ে উত্তর মাঝিপাড়ার দিকে চলে যায় এবং সেখানকার বাড়িগুলোতে আগুন দিতে শুরু করে। তবে পুলিশ সেখানে আর না গিয়ে দক্ষিণ মাঝিপাড়াতেই বটেরহাট আখিরা নদীর ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। যদিও পরিতোষের বাড়ি থেকে উত্তর মাঝিপাড়ার যে বাড়িগুলো দিয়ে হামলা শুরু হয় সেখানে হেঁটে যেতেই লাগে মাত্র ৫-৭ মিনিট। গ্রামের মানুষ আমাদের এটাও জানায় যে হামলা হওয়ার আগে দিয়ে বিদ্যুতের সংযোগ চলে গিয়েছিল।

এক্ষেত্রে হামলাস্থলটি থানা থেকে বেশ দূরে, রাস্তাঘাটও ভাল ছিল না তাই চট করে পুলিশ পাঠানো কঠিন এই মর্মে যে বক্তব্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিয়েছেন সেটির সপক্ষে কোন যুক্তি পীরগঞ্জে সরেজমিন গিয়ে পাওয়া যায়নি। কারণ হামলাস্থল থেকে পীরগঞ্জ থানার দূরত্ব মাত্র ৫.৪ কিলোমিটার। এবং পীরগঞ্জ থেকে হামলাস্থল পর্যন্ত পুরোটাই ভাল পাকা রাস্তা রয়েছে। পীরগঞ্জ থেকে গাড়িতে কিংবা মোটরসাইকেলে সেখানে যেতে মাত্র ১০ মিনিট লাগার কথা। কিন্তু হামলা চলতে থাকলেও হামলাস্থলে কোন পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে যায়নি। বরং উল্টো পরিতোষের গ্রামের মানুষ জানান, হামলা শুরু হওয়ার ১ ঘন্টার মধ্যেই পরিতোষের গ্রামে র‌্যাব পুলিশ সহ প্রায় ৬০০-৮০০ আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা ঠিকই উপস্থিত হন। কিন্তু তারাও যেখানে হামলা হচ্ছে সেই উত্তর মাঝিপাড়ায় যাননি সাথে সাথে। তারা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন দুই ঘন্টা পরে যখন আগুন লাগানো শেষ করে হামলাকারীরা চলে যাওয়া শুরু করেছে।

হামলা শুরু হওয়ার ১ ঘন্টার মধ্যেই পরিতোষের গ্রামে র‌্যাব পুলিশ সহ প্রায় ৬০০-৮০০ আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা ঠিকই উপস্থিত হন। কিন্তু তারাও যেখানে হামলা হচ্ছে সেই উত্তর মাঝিপাড়ায় যাননি সাথে সাথে। তারা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন দুই ঘন্টা পরে যখন আগুন লাগানো শেষ করে হামলাকারীরা চলে যাওয়া শুরু করেছে।

এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিস আসলেও গ্রামের মানুষ জানান, অনেক বাড়িতেই ফায়ার সার্ভিস পৌছায়নি। আগুন তাই তাদেরকেই এসে নেভাতে হয়েছে। হামলাকারীরা মোট ৩০-৩২টি বাড়ির অন্তত ৮০টি ঘরে হামলা চালায় বলে গ্রামের মানুষ আমাদের জানান। হামলা থেকে বাঁচতে ওই বাড়িগুলোর হিন্দুরা সবাই নিজ নিজ বাড়ির পার্শ্ববর্তী ধানক্ষেতে লুকিয়ে থাকেন। হামলাকারীরা ঘরে আগুন দেয়ার পাশাপাশি লুটপাট চালায়। নগদ অর্থ ও স্বণালংকার থেকে শুরু করে গরু-ছাগল, ধান, চাল পর্যন্ত সবই লুট করে। প্রায় প্রতিটি ঘরের টিনই আমরা কোপানো দেখতে পেয়েছি। হামলাকারীরা সর্বশেষ যে বাড়িতে হামলা চালায় সেখানে হাতে থাকা বাকি সব পেট্রোল ওই বাড়িতে ঢালে এবং সেই বাড়িটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেখানে দুটো গরু আগুনে পুড়ে মারা যায়।

এখানেই সুমতী বালার পালা দুটি গরু জীবন্ত অঙ্গার হয়। তাদের আর্ত চিৎকার আর ছটফটানির সাক্ষী এই পোড়া টিনগুলো। — ছবি: মাহতাব উদ্দীন আহমেদ

হামলাকারীরা কারা ছিল?

প্রথম যেদিন আমরা সেখানে যাই তখন গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ এটা নিয়ে ভয়ে মুখ খুলতে চাননি। আশ্চর্যজনকভাবে তাদের সকলেরই ভাষ্য ছিল একদম তোতাপাখির মতো “অন্ধকার ছিল। আমরা ভয়ে ধানক্ষেতে লুকিয়ে ছিলাম। কাউকে আমরা চিনি নাই।” পরবর্তীতে তাদের যখন অভয় দেয়া হয় এবং তাদের কথা যে রেকর্ড করা হচ্ছে না সেটা নিশ্চিত করা হয় তখন নাম না প্রকাশ করার শর্তে অনেকেই আমাদের কাছে মুখ খুলেন।

হামলাকারীরা বহিরাগত ছিল বলে যে প্রচারণা প্রচারমাধ্যমে হয়েছে সেটার সাথে সরাসরি দ্বিমত পোষণ করেন গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুরা। কারণ তারা বলেন হামলাকারীরা যখন তাদের বাড়িঘরে হামলা চালাচ্ছিল তখন পাশের যেসব ধানক্ষেতে তারা লুকিয়ে ছিলেন সেখান থেকে তাদের উচ্চশব্দের কথোপকথন তারা শুনতে পান অনেকেই। সেই সব কথোপকথন ছিল এমন “ওইখানে টাকা আছে”, “ওইখানে স্বর্ণ আছে” “এই বাড়িতে অটো আছে”, “ওই বাড়িতে মটরসাইকেল আছে”, “নারায়ণের ঘরটায় এখনো আগুন দিলি না?” ইত্যাদি। হামলার শিকার যারা হয়েছেন তাদের বক্তব্য হচ্ছে স্থানীয় মানুষ ছাড়া এতটা বিস্তারিতভাবে বহিরাগতদের জানা সম্ভব নয় যে কোনটা কার বাড়ি এবং কার ঘরে কি আছে।

হামলাকারীরা মোটরসাইকেলে শোডাউন করে এসেছিল। পুলিশের নাকের ডগায় এই দুঃসাহস দেখানো ক্ষমতার ছত্রছায়ায় না থাকলে সম্ভব নয়।

যে আতাউল মৌলভীর দোকানের সামনে হামলাকারীরা প্রথম জড়ো হয়ে মিটিং করে সেই আতাউল মৌলভীর রাজনৈতিক পরিচয় জিজ্ঞেস করলে গ্রামবাসী জানান “সরকারী দলের লোক ছাড়া কি আর এগুলি সম্ভব হয়?” দুইজন গ্রামবাসী নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের জানান যে আতাউল ওলামা লীগের সদস্য। তবে এই তথ্য যাচাই করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এছাড়াও এখানে আরেকটি তথ্য উল্লেখ করার মতো। পরিতোষের বাবা প্রসন্ন চন্দ্র দাসের উপর আতাউলের রাগ ছিল। বছরখানেক আগে দোকানের বাকি নেয়াকে কেন্দ্র করে তিনি একবার প্রসন্নের গায়ে হাত তুলেছিলেন। ঘটনার পর থেকে আতাউলের দোকান বন্ধ এবং তিনি পলাতক। এছাড়া ঘটনার পর থেকে পরিতোষের বাড়ি নিকটে থাকা আরেকটি দোকানও বন্ধ। সেটি হল শাকিলের কম্পিউটারের দোকান। সেই দোকানে বসে পরিতোষ আড্ডা দিত প্রায়ই। শাকিলও ঘটনার পর থেকে পলাতক।  

যে আতাউল মৌলভীর দোকানের সামনে হামলাকারীরা প্রথম জড়ো হয়ে মিটিং করে সেই আতাউল মৌলভীর রাজনৈতিক পরিচয় জিজ্ঞেস করলে গ্রামবাসী জানান “সরকারী দলের লোক ছাড়া কি আর এগুলি সম্ভব হয়?” দুইজন গ্রামবাসী নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের জানান যে আতাউল ওলামা লীগের সদস্য।

সাহস করে যারা মুখ খুলেছেন তারা চিনতে পেরেছেন বলেছেন এমন কয়েকজন হামলাকারীর পরিচয় হল:

মজিদপুরের মিলন (৩৫) যে এলাকায় পেশাদার চোর ও টাউট হিসেবে পরিচিত।

নাগরপাড়ার বাবলু (৩৭) যে এলাকায় টাউট গোছের ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত।

বটেরহাট মসজিদের মুয়াজ্জিন রাশেদ। যাকে সরাসরি আগুন লাগাতে মানুষ দেখেছে।

ধুলগাড়ির রশিদ মিয়ার ছেলে উজ্জল।

গারাবের গ্রামের আবু ড্রাইভারের ছেলে জনৈক মৌলভীবেশের একজন ছেলে (নাম বলতে পারেননি)।

হাতীবান্ধা হাইস্কুলের দপ্তরী মোমিন।

নোকারপাড়ার গড়ের মাথার ভলুর ছেলে মনজুরুল যে কিনা এলাকায় পুলিশের সোর্স হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত!

এদের মধ্যে পুলিশের সোর্স এই মনজুরুলকে গ্রামবাসী হামলার সময় হাতে নাতে ধরে পুলিশের কাছে তুলে দিলেও পরে পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয় বলে আমাদের জানান গ্রামের মানুষ। স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিকও নাম না প্রকাশ করার শর্তে এই তথ্য আমাদের জানান।

গ্রামের একটি মাত্র ঘরে হামলাকারীরা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল। সেই ঘরে আর তারা আগুন লাগাতে পারেনি। সেটি হল শ্রী হিদর চন্দ্রের বাড়ি। সেখানে হিদর চন্দ্রের চার ছেলে, তাদের স্ত্রী, এবং ওই বাড়ির অন্যান্য নারীরা মিলে হাতের কাছে দা, লাঠি যা কিছু ছিল তাই দিয়ে হামলাকারীদের প্রতিহত করে। সেই বাড়ির রণজিতের স্ত্রী রূপালী আমাদের বলেন যে কয়েকজন হামলাকারী ছিল নারী যারা বোরকা পরে এসেছিল। ওই বোরকা পরিহিতা নারীরাও ‍লুটপাটে অংশ নিয়েছিল ও পুরুষদের সহযোগিতা করছিল।

গ্রামের একটি মাত্র ঘরে হামলাকারীরা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল। সেই ঘরে আর তারা আগুন লাগাতে পারেনি। সেটি হল শ্রী হিদর চন্দ্রের বাড়ি। সেখানে হিদর চন্দ্রের চার ছেলে, তাদের স্ত্রী, এবং ওই বাড়ির অন্যান্য নারীরা মিলে হাতের কাছে দা, লাঠি যা কিছু ছিল তাই দিয়ে হামলাকারীদের প্রতিহত করে।

গ্রামবাসীর ভাষ্যমতে, হামলাকারীরা যেসব বাড়ির গরু ছাগল লুটপাট করে নিয়ে গিয়েছিল সেগুলোর মধ্যে পরবর্তীতে কিছু কিছু গরু ছাগল আবার ফেরত দেয়া হয় চেয়ারম্যান, মেম্বারের লোকজন ও থানার লোকজন মারফত! প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক যে তাদের কাছে এসব লুট হওয়া গরু ছাগল জমা দিল কারা?

স্থানীয় সরকারদলীয় নেতা কর্মীরা এই হামলার দায় জামাত শিবিরের উপর চাপিয়ে মিছিল করলেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল হামলার সময় তাহলে সরকারদলীয় নেতা কর্মীরা কোন প্রকার বাধা দেয়ার চেষ্টা করল না কেন? কেন তারা সেসময় নীরব ভূমিকায় ছিল?

ছোট শিশুটি দেখাচ্ছে কিভাবে সে লুকিয়েছিল ধানক্ষেতের মধ্যে যখন হামলাকারীরা তাদের ঘরে আগুন দিতে আসে। — ছবি: তাপস পাল

হামলাকারীরা কি আদৌ নিয়ন্ত্রণহীন “উচ্ছৃংখল জনতা” ছিল?

যেভাবে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল যে হামলাকারীরা “এতই বেপরোয়া ছিল যে পুলিশ কিছুই করতে পারেনি”। কিন্তু প্রতিটি বাড়িতে হামলার যে প্যাটার্ন এবং শুরুতে পুলিশের সামনে হামলাকারীদের যে আচরণ ছিল পরিতোষের গ্রামে সেটি এই বক্তব্যের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। হামলাকারীরা যদি বেপরোয়াই থাকে তাহলে শুরুতে মাত্র ১৫ জন পুলিশের সামনে ৪০০-৫০০ হামলাকারী নতি স্বীকার করলো কেন? আর যদি তখন মাত্র ১৫ জন পুলিশের ফাঁকা গুলির মুখেই তারা পালিয়ে যায় তাহলে পরে পুলিশ আর এগোলো না কেন সেই প্রশ্ন রয়েই যায়।

তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল হামলার প্যাটার্ন। গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলে যা জানা যায় তাতে এটা পরিস্কার যে, হামলাকারীরা কোন নারীর প্রতি যৌন হয়রানি কিংবা সহিংসতা করেনি। কিন্তু ওইখানে যেভাবে হিন্দুবাড়িগুলো অবস্থিত তাতে বেপরোয়া নিয়ন্ত্রণহীন উচ্ছৃংখল জনতা হলে নারীদের উপর যৌন হয়রানি ও সহিংসতা চালানো খুবই সম্ভব ছিল। কিন্তু তারা একবারের জন্যও সেটা করেনি। দুই একজন নারী লাঠির বাড়ি খেয়েছেন কিন্তু সেটা যৌন সহিংসতা বা হয়রানির কাতারে পড়ে না। তবে একটি বাড়িতে গিয়ে হামলাকারীরা বলেছে যে তাদের যুবতী মেয়েরা কোথায়? কিন্তু এর চেয়ে বেশি তারা আগে বাড়েনি।

হামলাকারীরা পারতপক্ষে কাউকে মারধোরও করেনি। যাদের মেরেছে সেটাও সামান্য পর্যায়ের। তারা ছুরি দিয়ে ভয় দেখিয়েছে কিন্তু কাউকে গুরুতর আহতও করেনি। এটাও খুবই অস্বাভাবিক ঘটনা একটি বেপরোয়া নিয়ন্ত্রণহীন উচ্ছৃংখল জনতার ক্ষেত্রে।

গ্রামবাসীর বক্তব্য থেকে এটাও পরিস্কার যে, হামলাকারীদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আতংক সৃষ্টি করা এবং তাদের প্রধান কাজই ছিল আগুন লাগানো, বাড়িঘরের টিনগুলো কোপানো, টাকা পয়সা লুট করা। হামলাকারীরা ভালভাবেই দেখেছিল যে ধানক্ষেতে গ্রামের হিন্দুরা লুকিয়ে আছে তারা সেদিকে টর্চ মেরে ধর ধর বলেছে ঠিকই কিন্তু ধানক্ষেতে নেমে তাদের আক্রমণ করেনি। এমন ঘটনাও পাওয়া গেছে যে ঘরে বৃদ্ধ লোক একা ছিলেন, তাকে হামলাকারীরা কোন প্রকার গালাগালি না করে স্রেফ বলেছে যে ঘর থেকে বের হন আমরা এখানে আগুন দিব। এরপর তিনি ঘর থেকে বের হলে তার ঘরে আগুন লাগিয়ে চলে গেছে। এগুলোর কোনটাই নিয়ন্ত্রণহীন উচ্ছৃংখল বেপরোয়া জনতার আচরণের সাথে খাপ খায় না। বরং মনে হয় যে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে তারা কারও নির্দেশ পালন করে গেছে রীতিমতো শৃংখলার সাথে আগুন লাগানো, লুটপাট চালিয়ে।

কোপানো ঘর, ফাঁক দিয়ে যে ধানক্ষেত দেখা যায় সেটাই ছিল হামলার সময় ঘরের বাসিন্দাদের আশ্রয়। — ছবি: তাপস পাল

পীরগঞ্জের ওই এলাকার সাম্প্রদায়িক পরিবেশ, ইউপি নির্বাচনের তফসিল ঘোষনা এবং নিকট অতীতের কিছু বিষয়

পীরগঞ্জের ওই এলাকায় একটা সাম্প্রদায়িক পরিবেশ রয়েছে বলে আমাদের সরেজমিনে গিয়ে মনে হয়েছে। এবং সেই পরিবেশটাকেই কাজে লাগানো হয়েছে হিন্দুদের উপর হামলার ক্ষেত্রে। যখন হিন্দুপাড়ায় হামলা চলছিল তখন হিন্দুরা ধারে কাছের মুসলমানদের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় চেয়েছিলেন কিন্তু তাদের আশ্রয় দেয়নি তারা। পাকা বাড়িগুলোর ক্ষেত্রে গেটটা পর্যন্ত খুলেনি। তবে এটাও সত্য যে দূরবর্তী পাড়ার মুসলমানরা অনেকেই বিপদে থাকা হিন্দুদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। কিন্তু মাঝিপাড়ার পাড়ার মুসলমানেরা হামলা ঠেকানোর কোন প্রকার চেষ্টাই করেনি। হামলার মুখে পড়ে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী হিন্দু যুবক এক মুসলমান বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় চাইলে তাকে তখন বলা হয় যে “এখন কেন আমাদের কাছে এসেছিস? যা, তোর দুর্গা মার কাছে যা। কেন, তোর দূর্গা মা তোরে বাঁচাইতে পারে না?” বিশেষ করে পরিতোষের গ্রামে, যেখানে মুসলমান ঘরের সংখ্যা বেশি সেখানে হিন্দু মুসলিম দ্বন্দ্ব ভালোভাবেই রয়েছে।

এদিকে গ্রামের মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে যে, মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে সেখানকার হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব আছে। তবে সেটা অনেক বড় দ্বন্দ্ব বলে কেউ বলেননি। সেখানকার জেলেরা বংশ পরম্পরায় মাছ ধরে আসছেন, সবাই হিন্দু সম্প্রদায়েরই ছিলেন। তারা মাছ ধরেন সেখানকার দুটি বড় বিলে। সেই বিলের সাথে আবার নদীর সংযোগ আছে এবং সেখানে মাছের একটি অভয়াশ্রমও আছে। যার ফলে সেখানে মাছ ধরার মওসুমে প্রচুর মাছ হয়। সাম্প্রতিক কালে মুসলমান জনগোষ্ঠীর লোকেরাও মাছ ধরাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। ফলে সেখানে বিলে এই মাছ ধরার দখল নিয়ে একটা টানাপোড়েন আছে বলে আমাদের জানিয়েছেন গ্রামবাসী।

যে পাড়ায় হামলা হল – অর্থাৎ মাঝিপাড়া উত্তর, সেই পাড়ার হিন্দুদের উপর স্থানীয় বিরোধী আওয়ামী পক্ষের রাগ রয়েছে বলে মনে করেন গ্রামবাসী। কারণ দুই বছর আগে ইউপি নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগেরই দুই পক্ষের মধ্যে যে পক্ষ হেরে যায় তারা প্রচারণা চালায় যে হিন্দুরা তাদের পক্ষকে ভোট দেয়নি বলেই তারা হেরে গেছে। ফলে তারা তাদের হারের সব দায়ভার হিন্দুদের উপর চাপায়। যদিও এক্ষেত্রে এলাকার হিন্দুদের কথা হল তারা যে পক্ষ হেরে গেছে সেই পক্ষকেই ভোট দিয়েছিল কিন্তু এখনকার মেম্বার ভোট চুরি করে জিতে গেছে। যাই হোক ওই সময় এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও পাশের আরেকপাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর হামলা চালাতে আসে হেরে যাওয়া পক্ষ, যদিও সেই হামলা এবারের মতো এত ব্যাপক ছিল না। তখন ওই পাড়ার হিন্দুদের আশ্রয় দেন এই মাঝিপাড়ার হিন্দুরা। শুধু তাই নয় তারা তখন হামলাকারীদের সাথে মারামারিও করেন। তাই মাঝিপাড়ার হিন্দুরা মনে করেন সেইসব ঘটনার প্রেক্ষিতে তাদের উপর রাগ থাকতে পারে কোন মহল।

দুই বছর আগে ইউপি নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগেরই দুই পক্ষের মধ্যে যে পক্ষ হেরে যায় তারা প্রচারণা চালায় যে হিন্দুরা তাদের পক্ষকে ভোট দেয়নি বলেই তারা হেরে গেছে। ফলে তারা তাদের হারের সব দায়ভার হিন্দুদের উপর চাপায়।

এক্ষেত্রে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল যেদিন এইবার পীরগঞ্জে হামলা হল সেদিনই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষনা করা হয়। এবং এখন যেভাবে র‌্যাব থেকে বলা হচ্ছে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হল স্থানীয় ছাত্রলীগের “সদ্য বহিষ্কৃত” নেতা সৈকত তাতে এই হামলার ঘটনার সাথে এই ইউপি নির্বাচনের কোন সম্পর্ক রয়েছে কিনা সেই সন্দেহ তৈরি হওয়াটা নিতান্ত অমূলক নয়।  

যেদিন এইবার পীরগঞ্জে হামলা হল সেদিনই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষনা করা হয়।

পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেফতারে নামে নিরীহ মানুষকে হয়রানি করছে বলে অভিযোগ

যাদের উপর হামলা হয়েছে খোদ সেই ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুরাই আমাদের বলেছেন যে, পুলিশ আসল হামলাকারীদের বাদ দিয়ে পরবর্তীতে যাদের ধরেছে তাদের অনেককেই তারা চিনেন যারা খুবই নিরীহ প্রকৃতির মুসলমান তরুণ-যুবক। ওই মুসলমান যুবকেরা হামলাকারী এটা তারা বিশ্বাস করেন না। কারণ তাদের সাথে ওই এলাকার হিন্দুদের খুবই সুসম্পর্ক রয়েছে। ওই তরুণেরা কখনো হিন্দুদের নিয়ে কটু কথা বলা তো দূরে থাক তাদের সাথে কখনো উচ্চস্বরে কথা পর্যন্ত বলেনি। বরং সবসময় তাদের সাথে এসে হাসিমুখে কথা বলেছে, তাদের বাসায় এসেছে, তাদের সাথে থেকেছে। একই রকম ঘটনার কথা স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিকও আমাদেরকে বলেছেন এবং তারা এই আশংকাও করেছিলেন যে এর ফলে এলাকায় অযথা আরেকটা উত্তেজনা তৈরি হবে যেটা হিন্দুদের জন্য ভাল কিছু হবে না। স্থানীয় সাংবাদিকদের এই আশংকা আমরা সেখান থেকে ফিরে আসার এক দিন পরেই সত্য বলে প্রমাণিত হয়। গত ২২ অক্টোবর বটেরহাট মসজিদের সামনে কয়েকশো স্থানীয় মুসলমান নারী বিক্ষোভ করেন এই জন্য যে পুলিশ হামলাকারীর বদলে নিরীহ মুসলমানদের গ্রেফতার করছে।

ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুরাই আমাদের বলেছেন যে, পুলিশ আসল হামলাকারীদের বাদ দিয়ে পরবর্তীতে যাদের ধরেছে তাদের অনেককেই তারা চিনেন যারা খুবই নিরীহ প্রকৃতির মুসলমান তরুণ-যুবক। ওই মুসলমান যুবকেরা হামলাকারী এটা তারা বিশ্বাস করেন না। কারণ তাদের সাথে ওই এলাকার হিন্দুদের খুবই সুসম্পর্ক রয়েছে।

 সরকারি ‘ক্ষতিপূরণ’

গত ১৯ অক্টোবর আমরা পীরগঞ্জে থাকা কালেই সেখানে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী উপস্থিত হন। উল্লেখ্য স্পিকার শিরীন শারমিন সেখানকার বর্তমান সংসদ সদস্য। সেখানে বটেরহাট বাজারে সভা করে সে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় তার হিসেব মোটের উপর এরকম বলে আমাদের জানান গ্রামবাসী:

খানা প্রতি ১ থেকে ৩ বান্ডিল টিন।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা।

স্পিকারের তরফ থেকে ৯ হাজার টাকা।

একটি মাছ ধরার জাল।

পরিবার প্রতি বিভিন্ন পরিমাণে চাল।

স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এই টিন দিতে এসেছিলেন। ত্রাণ বিতরণ অনুষ্ঠানের পাহরায় বিজিবি ও এপিবিএন এর সদস্যরা। — ছবি: তাপস পাল

উল্লেখ্য সেখানে আমরা যখন কথা বলি তখন প্রায় প্রত্যেকেই আমাদের জানিয়েছেন যে, তাদের ঘরের টাকা পয়সা (কারো কারো ক্ষেত্রে লক্ষাধিক টাকাও), স্বর্ণালংকার, টিভি, অপেক্ষাকৃত দাবী আসবাব, গবাদিপশু লুট হয়েছে। পুড়ে গেছে পুরো ঘরের সকল কাপড়চোপড়, আসবাব, মোটরসাইকেল, রিকশা, ভ্যান। এহেন বাস্তবতায় সরকারের এই ‘ক্ষতিপূরণ’ কার্যত ক্ষতিগ্রস্তদের আরেকদফা অপমান করার শামিল। এই বিষয়ে দেবেন্দ্র চন্দ্র দাসের বাড়ির ছোটবউ অর্চনা রানী আমাদের বলেন যে আমাদের যে টিন দেয়া হয়েছে সেটা দিয়ে আমাদের যতগুলো ঘর পুড়েছে তার ছাদটাও ঠিকমতো হবে না। অন্যদিকে যে টিনের বান্ডিলগুলো দেয়া হয়েছে সেখানে বান্ডিল প্রতি সচরাচর যতগুলো টিন থাকে তার চেয়ে কম টিন পাওয়ার অভিযোগও করেছেন কেউ কেউ। তবে সেটা যাচাই করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

তদুপরি ৩০-৩২টি বাড়ির প্রায় ৮০টি ঘরে (খানা) হামলা হলেও সরকারের তরফ থেকে এই ‘ক্ষতিপূরণ’ দেয়া হয়েছে ৬৫ জনকে। বাকিদের শুধু ‘আশ্বাস’ দেয়া হয়েছে যে তাদেরকেও পরবর্তীতে সাহায্য করা হবে।

 শান্তি

আমরা যখন সেখানে ছিলাম তখন সামগ্রিকভাবে একটা জিনিসই আমাদের চোখে বার বার ধরা পড়েছে। তা হল আতংক। সেই আতংকের ছাপ সামনাসামনি না দেখলে বলে বোঝানো মুশকিল। তবে যখন পুরো ঘর পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হামলাকারীদের চেনার পরেও সরাসরি তাদের নাম নিতে মানুষ ভয় পায় তখন সেই আতংকের মাত্রাটা কিছু হলেও বোঝা যায়। রুহিনী চন্দ্র দাশের ছেলে নরেশ যখন সারারাত ধরে কান্নাকাটি করার পরে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় আমাদের জিজ্ঞেস করেন “দাদা আমরা শান্তি চাই, আমরা কি শান্তিতে থাকতে পারবো না কোনদিন?” আমরা তখন চুপ ছিলাম। কারণ সেই প্রশ্নের কোন ইতিবাচক উত্তর দেয়ার রাস্তা আমরা বিদ্যমান রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় দেখতে পাইনি। সেই প্রশ্ন আমাদেরও।

২৭ অক্টোবর ২০২১।

মাহতাব উদ্দীন আহমেদ: লেখক, গবেষক। ইমেইল: mahtabjuniv@gmail.com

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •