অবরোধের অন্ধকার এবং নারীর মন

নারী-পুরুষের মানস : পুরুষতান্ত্রিক ধারণা ও বৈষম্যের জৈবসামাজিক ভিত্তি-৮

অবরোধের অন্ধকার এবং নারীর মন

মনিরুল ইসলাম

“নারী ও তার শরীরের ওপরেই (প্রতীকী অর্থে) মানব সমাজ নৈতিকতার রীতিনীতি লিপিবদ্ধ করেছে।*৯৫

শেলা বেনহাবিব, The Claims of Culture

হিন্দু সমাজে যা কিছু ক্ষতিকর জিনিস আছে তার সবগুলোই মুসলিম সমাজে আছে এবং কিছুটা বেশিও আছে, তা হল সব মুসলিম নারীদের বাধ্যতামূলক পর্দা করার প্রথা।… তারা (মুসলিম নারী) তাদের অন্য সম্প্রদায়ের বোনদের থেকে পিছিয়ে আছে কারণ তারা ঘরের বাইরের কোনো কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারে না এবং একধরণের দাসোচিত মানসিকতা এবং হীনমন্যতার মনোভাব নিয়ে কোণঠাসা হয়ে থাকে।৯৬

বি আর আম্বেদকার

“নিজের ঘর দিয়েই যাত্রা আমার শুরু,

শেষটা কবরস্থানে।

জীবনটা কেটেছে লাশের মতই,

কখনো বাবা কখনও ভাই,

কখনও স্বামী বা পুত্রের কাঁধে ।

ধর্মের অনুশাসনে ডুবে,

প্রথার জালে জড়ানো আষ্টেপিষ্টে

অজ্ঞতার কবরে সমাহিত (এক জীবন)”। ৯৭

আতিয়া দাউদ, সিন্ধী (পাকিস্তানি) কবি

ষোল বছরের কিশোরী আকসা পারভেজ, ২০০৭ সালের ১০ই ডিসেম্বর খুন হয় নিজের বাবা ও ভাইয়ের হাতে কারণ সে পর্দা করতে অর্থাৎ ‘ইসলামী পোশাক’ পড়তে অস্বীকার করেছিল এবং পরিবারের অমতে পার্টটাইম কাজের জন্য আবেদন করেছিল। শুনে মনে হতে পারে ঘটনাটি আফগানিস্তান, ইরান বা সৌদি আরবের। না, ঘটনাটি উদারনৈতিক দেশ কানাডার টরন্টো শহরের মিসিসাগায় এক পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত পরিবারের। কানাডায় বসবাস করেও ষোল বছর বয়স পর্যন্ত আকসা কখনও সিনেমায় যায় নি, মৃত্যুর মাত্র দুদিন আগে সে জীবনে প্রথম সেই শখ পূরণ করতে গিয়েছিল। ঘটনাটি এখন অনেকেই ভুলে গেছে কিন্তু এই একটি ঘটনা নারীর উপর চাপিয়ে দেয়া অবরোধ প্রথার অনেকগুলো দিক সম্পর্কে আমাদের চোখ খুলে দেয়। পর্দার নামে যা প্রচলিত প্রথা কেবল ড্রেস-কোড বা শরীর ঢাকার বিষয় নয়। উর্দুতে বলা হয় ‘চাদার আউর চারদিওয়ারি’, অর্থাৎ আবরণ ও চারদেয়ালের গন্ডি। পোশাক ছাড়াও পর্দার আরও গুরুত্বপূর্ণ দুটি অংশ রয়েছে। একটি হল নারীকে পারিবারিক চৌহদ্দি বা নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে থাকতে বাধ্য করা। অন্যটি হল পাবলিক প্লেসেও (যেমন- কোনো অনুষ্ঠান বা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান) নারীদের পুরুষের থেকে আলাদা রাখা। অর্থাৎ ড্রেসকোড মেনেও গন্ডির বাইরে যাওয়া কিংবা ‘পর-পুরুষ’ বা অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে মেশা বা কথা বলা, কোনো পুরুষ সঙ্গী ছাড়া একা একা কোথাও যাওয়া ইত্যাদিরও অনুমোদন নাই এই প্রথায়। এই প্রথা যতটা না ধর্মীয় তার চেয়ে অনেক বেশি সাংস্কৃতিক ও পুরুষতান্ত্রিক। এর সঙ্গে জড়িত পুরুষতান্ত্রিক অহম এবং পারিবারিক ‘সম্মান’। তাই এই প্রথার প্রচলনের ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক পরিবার অত্যন্ত কঠোর ও নির্মম। পর্দা খেলাপ করে ‘ইসলাম-বিরোধী’ জীবন যাপনের জন্য পারিবারিক সদস্য কর্তৃক বা অন্যান্যদের দ্বারা নারীর নিহত বা গুরুতরভাবে আহত হবার ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। কিন্তু পর্দার চেয়েও অবশ্য-পালনীয় ধর্মীয় বিধান (যেমন নামাজ, রোজা ইত্যাদি) পালন না করা বা করতে অস্বীকৃতি জানানোর জন্য কেউ পরিবারের লোকদের হাতে খুন হয়েছে বা গুরুতর আহত হয়েছে এমন ঘটনা নেই বললেই চলে। নারীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অবরুদ্ধ করে রাখার এই প্রথা এবং তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সমাজ ও পরিবারের কঠোর ও নির্মম অবস্থান নারীর মানসের উপর বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

পর্দার চেয়েও অবশ্য-পালনীয় ধর্মীয় বিধান (যেমন নামাজ, রোজা ইত্যাদি) পালন না করা বা করতে অস্বীকৃতি জানানোর জন্য কেউ পরিবারের লোকদের হাতে খুন হয়েছে বা গুরুতর আহত হয়েছে এমন ঘটনা নেই বললেই চলে। নারীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অবরুদ্ধ করে রাখার এই প্রথা এবং তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সমাজ ও পরিবারের কঠোর ও নির্মম অবস্থান নারীর মানসের উপর বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

নারীর উপর পর্দা বা অবরোধের ভার নতুন কিছু নয় বিশেষত মুসলিম সমাজগুলোতে এবং এই উপমহাদেশে। বোধহয় বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনই প্রথম পর্দাকে ‘অবরোধ’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। ১৯৩১ সালে প্রকাশিত তার বিখ্যাত বই অবরোধবাসিনীতে তিনিই প্রথম পর্দা প্রথার কঠোর ও নির্মম যাতাকলে পিষ্ট নারীদের করুণ অবস্থা তুলে ধরেন। এই অসাধারণ রচনাটিতে রোকেয়া তাঁর নিজের কোনো মন্তব্য বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যা না দিয়ে শুধু নির্লিপ্তভাবে ঘটনাগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন। তাতেই উঠে এসেছে কঠোর এই প্রথার স্বরূপ অর্থাৎ এই প্রথা নারীকে মানসিকভাবে কতটা অন্ধ ও শক্তিহীন করে ফেলে সেই বাস্তবতা। এই অমানবিক প্রথা নারীর মানসের উপর কীভাবে ও কতটা প্রভাব ফেলে তা বোঝার ক্ষেত্রে এ যুগেও তাঁর এই বইটি আমাদের কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। রোকেয়ার সময়ে এদেশে পর্দার নামে যে কঠোর অবরোধ-প্রথা চালু ছিল বর্তমানে আমাদের দেশে ততটা কঠিনভাবে না হলেও নানা উত্থানপতনের পরও ব্যাপকভাবে চালু আছে এবং এর মৌলিক ভিত্তি ও কাঠামো কমবেশি আগের মতই আছে। অবরোধ প্রথা এককভাবে ইসলাম ধর্মের ব্যাপার নয় কারণ অন্য ধর্মাবলম্বী নারীদের উপরও পোশাক-আবরণ এবং চলাফেরা ও অবস্থানের বিধি-নিষেধ রয়েছে। তবে ইসলাম ধর্মে এই প্রথা সবচেয়ে সংগঠিত ও কঠোর। অন্য ধর্মে এটা কেবল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচারের বিষয় কিন্তু ইসলামে এটা অনেকটা শাস্ত্র দ্বারা নির্ধারিত। অর্থাৎ কোরান ও হাদিসে এ সম্পর্কে নির্দেশ আছে। তবে শাস্ত্রের ব্যাখ্যায় ভিন্ন ভিন্ন ইসলামিক সমাজে এমন কি ভিন্ন ভিন্ন শাস্ত্রবিদদের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান দেখা যায়। সাধারণভাবে আমরা দেখি- যে সমাজ যত বেশি পশ্চাৎপদ বা যে সমাজে নারীর উপর পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ যত বেশি সে সমাজে পর্দার বিধান তত কঠোর ও নির্মম।

আমাদের দেশে এই প্রথার কঠোরতা আগের চেয়ে অনেক কম হলেও পাকিস্তান, আফগানিস্তান,ইরান, সৌদি আরব ইত্যাদি দেশের সমাজে ব্যাপকভাবে এই প্রথার উপস্থিতি রয়ে গেছে। এসব দেশে কঠোর আইন এবং কঠোরতর সামাজিক আচারের মাধ্যমে এই প্রথা এখনও নির্মমভভাবেই প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। এটা করতে গিয়ে হয় তারা ধর্মীয় যুক্তি দিয়ে এই প্রথা মেনে নেবার পক্ষে নারীদের মতামত গড়ে তোলেন অথবা বল প্রয়োগে তা আরোপ করতে চেষ্টা করেন। যে আদর্শ বা মূল্যবোধের ভিত্তিতে পর্দার কঠোর প্রথাকে মেনে নেবার পক্ষে নারীদের মতামত গড়ে তোলা হয় উর্দু ভাষায় তাকে বলা হয় ‘শারাম’। এর আক্ষরিক অর্থ লজ্জা বা লজ্জাবোধ হলেও পাকিস্তানি সমাজে এর দ্বারা অনেক ধরণের মূল্যবোধ ও আচরণবিধিকে বোঝানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে শালীনতাবোধ, নৈতিকতা, ধার্মিকতা, নারীর সম্মান রক্ষা ও যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা ইত্যাদি।৯৮পর্দা প্রথাকে নারীর ‘সম্মান ও চরিত্রের রক্ষাকবচ’ বলে প্রচার করা হয়। এ ক্ষেত্রে নারীর সম্মান ও চরিত্র বলতে সততা, সত্যবাদীতা, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদিকে বোঝানো হয় না, এর আসল অর্থ কৌমার্য ও সতীত্ব রক্ষা এবং স্বামী বা পিতার প্রতি আনুগত্য। পর্দাপ্রথা কঠোরভাবে আরোপিত হয় এমন সমাজের অধিবাসীদের মধ্যে যারা অভিবাসী হয়ে কোনো উন্নত দেশে চলে গেছেন, তাদের বেশিরভাগই ধর্মীয় বিশ্বাস ও পরিবারিক অভ্যাসের কারণে এই প্রথাকে প্রয়োজনীয় মনে করেন এবং একই কায়দায় ঐ দেশেও পরিবারের নারীদের তা মানতে বাধ্য করেন। সেরকমই একটি পরিবার হল কানাডায় প্রবাসী অকসার পরিবার। তার বড় বোনদের সবাই পরিবারের সিদ্ধান্তে চাদর ও চারদেয়াল এর বন্দীত্ব মেনে নিয়েছিল। ‘ইসলামিক পোশাক’ পড়া এবং উন্নত দেশে থাকা সত্ত্বেও লেখাপড়া ও পেশাগত জীবনের কথা বাদ দিয়ে অল্প বয়সে বিয়ে করে গৃহিনীর জীবন মেনে নিয়েছিল তারা। আকসার পরিবার কানাডায় না থেকে পাকিস্তানে থাকলে হয়ত আকসা তার পরিবারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পর্দার বাইরে যাবার কথা ভাবতই না কিংবা ভাবার সাহসই পেত না। কারণ সেখানে সমগ্র সমাজেই অবরোধের বন্ধন অনেক শক্ত এবং অবরোধের গন্ডির বাইরে নারীর জন্য মুক্ত অঞ্চলের পরিসর খুব সীমিত। এমন সমাজে বেশিরভাগ মেয়েদের মধ্যে পর্দার ধারণার পক্ষে মত গড়ে ওঠে। পাকিস্তানের মতো ধর্ম-ভিত্তিক সমাজে বিশেষত শহরাঞ্চলের অল্প সংখ্যক যেসব নারী এই মতের বিরুদ্ধে যান তারা প্রায়ই পারিবারিক ভাবে এবং সামাজিক ভাবে অনেক ধরণের প্রতিকূলতার শিকার হন। পশ্চাৎপদ পরিবারের চাপিয়ে দেয়া অবরোধের বাইরে আকসা যে অলোকিত মুক্ত-প্রান্তর ও মুক্ত-জীবনকে দেখেছিল আফগানিস্তান, ইরান বা সৌদি আরবের মত সমাজে নারীরা তা দেখতে পায় না।

অবরোধে বসবাসের বাস্তবতা

পর্দা সম্পর্কে ইসলামী শাস্ত্রে কী আছে তা নিয়ে মতভেদ আছে। শাস্ত্রের নানা রকম ব্যাখ্যাও দেখা যায়। শাস্ত্রে যাই থাক বিভিন্ন দেশের মুসলিম সমাজে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্নভাবে এর প্রয়োগ দেখা যায়। এমনকি একই দেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলে, শিক্ষিত ও নিরক্ষর পরিবারে, বনেদী ও গরীব পরিবারে এক্ষেত্রে বিস্তর তফাৎ দেখা যায়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রয়োগকারীরা তাদের ‘বিধান’কে ‘শাস্ত্র-সম্মত’ বলে দাবী করে থাকে। ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান, প্যালেস্টাইন, সুদান, আলজেরিয়া, ইত্যাদি যে সব দেশে ইসলামি মৌলবাদী গোষ্ঠী ক্ষমতায় আছে বা ক্ষমতায় না থাকলেও তাদের শক্তিশালী তৎপরতা রয়েছে সেখানে নারীদের পর্দা করতে বাধ্য করা এবং এর অন্যথা হলে শাস্তি, নির্যাতন ও হত্যার শিকার হওয়া নৈমিত্তিক ঘটনা। সব ইসলামি সমাজেই পর্দা শুধু পোশাক বা শরীর ঢাকার ব্যাপার নয়, নারীর চলাফেরা, কাজকর্ম এবং পারিবারিক ও সামাজিক ভূমিকাও নিয়ন্ত্রিত হয় এই প্রথার রীতিনীতি দ্বারা। তবে পোশাকের ভারও কঠিন। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ইসলামি সমাজে হিজাব, নেকাব,আলখেল্লা, খামির, বোরখা,বান্দারি বোরখা, চাদর, দোপাট্টা ইত্যাদি বহু ধরনের অবরণ পর্দার জন্য প্রচলিত আছে। সব ঋতুতে এই ধরণের আবরণ দীর্ঘক্ষণ পড়ে থাকা ভীষণ যন্ত্রণার ব্যাপার।

পর্দা সম্পর্কে ইসলামী শাস্ত্রে কী আছে তা নিয়ে মতভেদ আছে। শাস্ত্রের নানা রকম ব্যাখ্যাও দেখা যায়। শাস্ত্রে যাই থাক বিভিন্ন দেশের মুসলিম সমাজে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্নভাবে এর প্রয়োগ দেখা যায়। এমনকি একই দেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলে, শিক্ষিত ও নিরক্ষর পরিবারে, বনেদী ও গরীব পরিবারে এক্ষেত্রে বিস্তর তফাৎ দেখা যায়।

আফগানিস্তানে সম্প্রতি মৌলবাদী তালেবান শাসনের অধীনে আসায় ষষ্ঠ শ্রেণির উপরে নারীদের শিক্ষা বাতিল করা হয়েছে, পুরুষ-সঙ্গী ছাড়া নারীদের বাইরে বের হওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক ভূমিকার জন্য নারীদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে এমনকি হত্যা করা হচ্ছে। নারী খেলোয়ারদের উপর এদের রাগ সবচেয়ে বেশি, এদেরকে খুঁজে খুঁজে শিরোচ্ছেদ করে হত্যা করা হচ্ছে। এর থেকে মনে করার কোনো কারণ নেই যে গত বিশ বছরের ‘তালেবান-মুক্ত’ সময়ে আফগান নারীরা কঠোর অবরোধ থেকে মুক্ত ছিল। উল্লিখিত সময়ে আফগান বড় শহরগুলোতে নারীদের শিক্ষা, চলাফেরার স্বাধীনতা এবং পেশাগত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে উন্নতি হয়। কিন্তু গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হয় নি। এসব অনেক অঞ্চলে সরকারের চেয়ে তালেবানদের প্রভাব বেশি ছিল। ফলে, নারীরা তাদের কথিত ইসলামিক পর্দা প্রথার বাইরে গেলে তালেবানের পক্ষ থেকে তাদের শাস্তি ও হত্যার হুমকি দেয়া হত। ওই সময়েও গ্রামাঞ্চলে এবং বিভিন্ন উপগোষ্ঠীর নারীদের শিক্ষা ও পুরুষ আত্মীয়ের সঙ্গ ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। পরিবারের পছন্দে বিয়ে না করা বা নিজ পছন্দের পুরুষকে বিয়ে করার কারণে পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নির্যাতিত হওয়া কিংবা তাদের অভিযোগের কারণে কারাবরণ করার বহু ঘটনা ঐ ‘মুক্ত’ সময়েই ঘটেছে। কট্টর মৌলবাদীদের শাসন না থাকলেও সমাজ ও পরিবারে প্রচলিত ‘ইসলামী পর্দা’র ধারণা এবং নারীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার পিতৃতান্ত্রিক ঐতিহ্য থেকে মুক্ত ছিল না ঐ সময়ের আফগান সমাজ। শহরাঞ্চলে যে সব পরিবারের মেয়েরা শিক্ষিত বা উচ্চ শিক্ষিত হচ্ছিল তাদের অধিকাংশের পরিবারও বিয়ের পর মেয়েদের পেশায় থাকা সমর্থন করেনি।

এর থেকে মনে করার কোনো কারণ নেই যে গত বিশ বছরের ‘তালেবান-মুক্ত’ সময়ে আফগান নারীরা কঠোর অবরোধ থেকে মুক্ত ছিল। উল্লিখিত সময়ে আফগান বড় শহরগুলোতে নারীদের শিক্ষা, চলাফেরার স্বাধীনতা এবং পেশাগত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে উন্নতি হয়। কিন্তু গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হয় নি। এসব অনেক অঞ্চলে সরকারের চেয়ে তালেবানদের প্রভাব বেশি ছিল। ফলে, নারীরা তাদের কথিত ইসলামিক পর্দা প্রথার বাইরে গেলে তালেবানের পক্ষ থেকে তাদের শাস্তি ও হত্যার হুমকি দেয়া হত।

 লেখিকা জ্যান গুডউইন তার Price of Honor: Muslim Women lift veil of silence on the Islamic Worldবইটি শুরু করেছেন মারিয়া নামের একটি দরিদ্র পরিবারের পাকিস্তানি আফগান বালিকার জীবনের গল্প দিয়ে, যার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল পাকিস্তানের পেশাওয়ার শহরে। মারিয়া তখন ৩য় শ্রেণির ছাত্রী, বয়স নয়। এই চটপটে মেয়েটির প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন তার বুদ্ধিমত্তা দেখে। ওই বয়সেই সে উর্দু ও ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলতে পারত। যদিও তার মাতৃভাষা দারি ও পশতু। আইসক্রিম কিনে দেবার জন্য তিনি মারিয়াকে তার হোটেল লবিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। এ ঘটনায় মারিয়ার বাবার বন্ধুরা অনেকেই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু লেখিকা অবাক হন যখন তার ‘বন্ধু’ পাকিস্তানি উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। লেখিকা তাকে জানান তিনি মেয়েটির বাবার অনুমতি নিয়েছেন। কর্মকর্তাটি অভিযোগ করেন জ্যান একজন মুসলমান মেয়েকে অশালীন হতে উৎসাহিত করেছেন। লেখিকা তাকে জানালেন তিনি এবং মারিয়া দুজনেই সেখানকার ঐতিহ্যসম্মত পর্দার(পোশাক) মধ্যে ছিলেন। জবাবে কর্মকর্তাটি বলেন “ তুমি তাকে এমন একটি জীবন প্রণালীর মধ্যে নিয়ে যাচ্ছ যা এ দেশীয় নয় … সে প্রকাশ্য জনসমাগমে যেতে পারে না- তুমি তাকে পতিতা হতে উৎসাহিত করছ”। (ÔÔYou are exposing her to a way of life that is alien to her….. She does not belong to public placesÍyou are encouraging her to be a prostitute.’’)৯৯ অর্থাৎ ড্রেসকোডের চেয়েও পর্দার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নারীর গন্ডি বা সীমারেখা। অবস্থান ও সক্রিয়তার যে সীমারেখা পুরুষতন্ত্র তাকে বেঁধে দিয়েছে তার বাইরে যাওয়াই নারীর জন্য ‘অশালীন’ এবং এই গন্ডির বাইরে যাওয়া তার জন্য ‘পতিত হবার’ সামিল। ওই কর্মকর্তার মতো পাকিস্তানের বহু উচ্চশিক্ষিত মানুষও তাই মনে করেন।

ড্রেসকোডের চেয়েও পর্দার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নারীর গন্ডি বা সীমারেখা। অবস্থান ও সক্রিয়তার যে সীমারেখা পুরুষতন্ত্র তাকে বেঁধে দিয়েছে তার বাইরে যাওয়াই নারীর জন্য ‘অশালীন’ এবং এই গন্ডির বাইরে যাওয়া তার জন্য ‘পতিত হবার’ সামিল। ওই কর্মকর্তার মতো পাকিস্তানের বহু উচ্চশিক্ষিত মানুষও তাই মনে করেন।

যদিও পাকিস্তানে  (সৌদি আরব, ইরান বা আফগানিস্তানের মত) পর্দায় বাধ্য করার কোনো আইন নেই কিন্তু ধর্মভিত্তিক লোকাচার ও সামাজিক ঐতিহ্যের কারণেএরকম অবরুদ্ধ ও গন্ডিবদ্ধ সেদেশের অধিকাংশ নারীর জীবন। এই অবরোধের মধ্যে নারীদের কতটা কঠিন ও কষ্টের জীবন কাটাতে হয় তার ব্যাপক অংশই আমাদের দৃষ্টির বাইওে থেকে যায়। মাঝে মাঝে দুএকটি ঘটনা আমাদের গোচরিভূত হয় সেগুলো আসলে টিপ অফ দ্য আইসবার্গ (Tip of the iceberg)। মারিয়ার ঘটনাও এমন একটি ঘটনা। পরবর্তীতে গুডউইন জানতে পারেন ওই ঘটনার কিছু দিনের মধ্যেই মারিয়ার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে তার বাবা। মাত্র এগারো বছর বয়সে মারিয়াকে বয়স্ক ও অসুস্থ এক পুরুষের কাছে বিয়ে দেয়া হয় যার আগেও দুই বউ রয়েছে। তার বাবাই তার বিয়ে দেন কারণ তার বিনিময়ে সেই লোক তার মেয়েকে মারিয়ার বাবার কাছে বিয়ে দিতে রাজি হয়। পরিবারের এসব পদক্ষেপ মেনে নিতে না চাওয়ায় তার বাবার নির্মম নির্যাতনের শিকার হয় মারিয়া। এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে মারিয়ার দাদী লেখিকাকে বলেন- “একজন পুরুষের অধিকার আছে তার পরিবারের মেয়েদের প্রহার করার…পরিবারিক শৃঙ্খলা রক্ষা করার অধিকার পুরুষের”। লেখিকার একজন আফগান বন্ধু তাকে বলেন- “যদি তার বাবা তাকে মেরেও ফেলে এখানে কারওই এখতিয়ার নেই তাকে বাধা দেবার”।১০০পর্দার কারণে যে সমাজে নারীদের পরিবারের পুরুষের সঙ্গ ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়া নিষেধ, সেখানে পরিবারের পুরুষেরা যখন তাদের বিরুদ্ধে অন্যায় আচরণ করে এবং সমাজের বেশিরভাগ লোক মনে করে এটা তাদের “অধিকার”, দেশের আইনে যাই থাক এরকম ঘটনার প্রতিকার হওয়া সেখানে অসম্ভব।

“একজন পুরুষের অধিকার আছে তার পরিবারের মেয়েদের প্রহার করার…পরিবারিক শৃঙ্খলা রক্ষা করার অধিকার পুরুষের”। লেখিকার একজন আফগান বন্ধু তাকে বলেন- “যদি তার বাবা তাকে মেরেও ফেলে এখানে কারওই এখতিয়ার নেই তাকে বাধা দেবার”।

১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর ইরান ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। ১৯৩৫ সাল থেকে সেকুলার রাষ্ট্র হিসেবে থাকায় সেখানে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। বিপ্লবের পর প্রথম দিকে ইসলামি সরকার (‘পর্দা’র অংশ হিসেবেই) ব্যাপকভাবে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত করেছিল। কিন্তু যেহেতু নারীরা ব্যাপকভাবে কর্মক্ষেত্রে ছিল এই সিদ্ধান্তে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শূণ্যতা এবং সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলে সরকার নারীদের ঘরের বাইরে ভূমিকা রাখার অনুমতি দেয় কিন্তু শর্ত ছিল তাদের পরিপূর্ণ পর্দার মধ্যে থেকে বের হতে হবে। এর অন্যথা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নয় বছর বয়স থেকেই ঘরের বাইরে গেলে বা ‘পরপুরুষের’ সামনে গেলে মেয়েদের দেহকে প্রথাগতভাবে আবৃত করা বাধ্যতামূলক। কারণ ইসলামি বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির নির্দেশনা অনুযায়ী নয় বছর থেকে মেয়েদের বিয়ে দেবার অনুমোদন দেয়া হয়। ইরানে ঘরের বাইরে ‘ইসলামি প্রথাসম্মত’ পোশাক পড়া আইনত বাধ্যতামূলক হলেও আফগানিস্তান, সৌদি আরব, এমনকি পাকিস্তানের চেয়ে ইরানের সমাজ ছিল অনেক অগ্রসর ও উন্নত সংস্কৃতির। একারণে পর্দার এই বাধ্যবাধকতা এবং নানা রকম বিধি নিষেধ ব্যাপক সংখ্যাক ইরানি মেয়েরা মেনে নিতে পারেনি। পর্দার প্রতি মেয়েদের অসন্তোষ ইরানে ওইসব দেশের তুলনায় অনেক বেশি। বাধ্যতামূলক পর্দার সামান্য বরখেলাপ করলে ইরানে নারীদের উপর কীধরণের কঠোর শাস্তি ও নির্যাতন নেমে আসে তা উঠে এসেছে তেহরানের পঞ্চান্ন বছরের নারী ফারিবার কাহিনীতে। ফারিবা একদিন এক সুপার শপে বাজার করে দুহাত ভর্তি মালামাল নিয়ে তার গাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। অসাবধানতা বশত তার চাদরের ঘোমটা পেছন দিকে পড়ে যায়, দুহাত বন্ধ থাকায় তিনি ঘোমটা তুলে দিতে পারেন নি। এই অল্প সময় তার মাথা অনাবৃত থাকায় তিনি টহল পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। অন্য অনেক একই ধরণের ‘অপরাধী’ নারীর সঙ্গে তাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। দুজন পুরুষ কারারক্ষী তাকে কারাগারের একটি অন্ধকার সেলে নিয়ে যায়। তাদের হাতে ছিল চাবুক। কাঠের বিছানায় উপুড় করে শুইয়ে পুরুষ রক্ষীরাই ৮০ বার চাবুক মারার শাস্তি কার্যকর করে। ফারিবা ধার্মিক মুসলমান হলেও এই বিষয়টি তার কাছে মনে হয়েছে চরম অমানবিক। যা তাকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে। প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি বলেন-“যা ঘটেছে তা যতটা না শারীরিকভাবে আমাকে আক্রান্ত করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি আক্রান্ত করেছে মানসিকভাবে।… এমন অসহায়ত্ব এবং অত্যাচার যেন মান-সম্মান সব লুটে নিচ্ছে। এটা এতটাই বাজে ও অপমানজনক নিপীড়ণ ছিল যে মনে হচ্ছিল এটা ধর্ষণ।”১০১

ফারিবার ঘটনার চেয়েও নির্মম একটি ঘটনা ইরানে পর্দা প্রথার কঠোর ও অমানবিক বাস্তবতাকে আমাদের সামনে তুলে ধরে সেটি হচ্ছে ডা. হোমা দারাবীর ঘটনা। হোমা দারাবী ছিলেন ইরানের এক মেধাবী চিকিৎসক। এর চেয়েও তাঁর বড় পরিচয় হল তিনি ছিলেন অত্যন্ত মানাবিক এবং গভীরভাবে দেশপ্রেমিক একজন মানুষ যিনি রোগীদের সেবায় ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ ও অত্যন্ত আন্তরিক। খুবই দুঃখজনক হলেও সত্য যে নারীদের উপর ইরানি ইসলামি শাসকদের নির্মম অত্যাচার ও নিগ্রহের কারণে এরকম একজন মহৎপ্রাণ মানুষের প্রাণ অকালে ঝরে গেছে। ডাক্তারি পাশ করার পর হোমা নিজ যোগ্যতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হন। তিনি কয়েক বছর সেখানে কৃতিত্বের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেন। কিন্তু এক পর্যায়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে, দেশের মানুষকে তার চিকিৎসা সেবা দেবার উদ্দেশ্যেই ইসলামি বিপ্লবের বেশ কয়েক বছর আগে তিনি ইরানে ফিরে আসেন এবং সরকারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। দেশপ্রেমিক আদর্শের কারণেই তিনি মার্কিনপন্থী শাহ্-এর বিরোধী ছিলেন এবং শাহ্-বিরোধী আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু ‘বিপ্লব’-এর পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কট্টর ইসলামি মৌলবাদীদের নারী-বিরোধী তৎপরতায় তিনি হতাশ হতে থাকেন। হোমার সঙ্গে প্রথম বিরোধ বাধে তিনি কর্মস্থলে পর্দার নিয়ম না মানায়। এই ‘অপরাধে’ শেষ পর্যন্ত তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। এর পরও তিনি পর্দা না মানায় তার প্রাইভেট প্র্যাকটিসও বন্ধ করা হয় এবং তিনি কার্যত গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। মার্কিন নাগরিক হিসেবে এ সময়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার চেষ্টা করেন কিন্তু ইসলামি ইরানের আইন অনুযায়ী কোনোবিদেশি নারী যদি ইরানের নাগরিককে বিয়ে করে তবে বিদেশে যেতে হলে তাকে স্বামীর লিখিত অনুমতি নিতে হবে। হোমার খোমেনীপন্থি স্বামী তাকে অনুমতি দিতে অস্বীকার করে। ইরানের ইসলামি আইনে স্বামী রাজী না হলে স্ত্রীর পক্ষে বিবাহ-বিচ্ছেদও প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। অতএব ঘরে অন্তরীণ থাকতে থাকতে হোমা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়তে থাকেন। সামান্য কারণে ইরানি নারীদের উপর অকথ্য অত্যাচার ও অপমানের সংবাদগুলো তার মানসিক অশান্তিকে আরও বাড়িয়ে তুলছিল। মৃত্যুর কিছুদিন আগে উত্তর তেহরানে লিপিস্টিক লাগানোর ‘অপরাধে’ সরকারি বাহিনীকতৃক ষোল বছরের এক কিশোরীকে গুলি করে মারার পর তিনি একদম ভেঙ্গে পড়েন। ১৯৯৪ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি তিনি একটি খোলা চত্তরে গিয়ে শত শত সানুষের সামনে তার হিজাব খুলে ফেলেন এবং গায়ে পেট্রেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। পর দিন তাঁর মৃত্যু হয়।

সামান্য কারণে ইরানি নারীদের উপর অকথ্য অত্যাচার ও অপমানের সংবাদগুলো তার মানসিক অশান্তিকে আরও বাড়িয়ে তুলছিল। মৃত্যুর কিছুদিন আগে উত্তর তেহরানে লিপিস্টিক লাগানোর ‘অপরাধে’ সরকারি বাহিনীকতৃক ষোল বছরের এক কিশোরীকে গুলি করে মারার পর তিনি একদম ভেঙ্গে পড়েন। ১৯৯৪ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি তিনি একটি খোলা চত্তরে গিয়ে শত শত সানুষের সামনে তার হিজাব খুলে ফেলেন এবং গায়ে পেট্রেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। পর দিন তাঁর মৃত্যু হয়।

ইসলামের জন্মভূমি আরব। আরবীয় উপদ্বীপে সাতটি রাষ্ট্রের মধ্যে জনসংখ্যা ও ভৌগলিকভাবে সবচেয়ে বড় সৌদি আরব। এ ছাড়া এই রাষ্ট্রের গুরুত্বের বিশেষ কারণ হল ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি তীর্থস্থান এই রাষ্ট্রে অবস্থিত। কিন্তু নারীদের অবস্থার কথা বিবেচনা করলে বলতে হয় ঐতিহ্যগতভাবে এবং বহু প্রজন্ম ধরে এদেশে নারীরা আইন, প্রথা ও রাষ্ট্রের দ্বারা সবচেয়ে বেশি অবদমিত এবং অবরুদ্ধ। কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রার্থী ২৪ বছরের সৌদি নারী নাদার উচ্চারিত কয়েকটি বাক্য থেকেই এখানে নারীদের অবরুদ্ধ অবস্থা সম্পর্কে আন্দাজ করা যায় – “ সৌদি আরবে নারীদের শিশুর মত  অন্তকরণহীন করে গড়ে তোলা হয়। এমনকি সবচেয়ে বুদ্ধিমান নারীটিকেও বলা হয় সে তার নিজের দায়িত্ব নিতে পারবে না। তারা শুধু ধর্মের মাধ্যমে নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। যদি কোনো নারী তাদের আদেশ অমান্য করে তারা তাকে একটা পোকার মতই পা দিয়ে পিষে মারতে উদ্যত হয়।” ঘরের বাইরে যেতে হলে সৌদি আরবে নারীদের কেবল উপযুক্ত পোশাক  (বোরখা/হিজাব) পড়লেই হবে না সঙ্গে একজন মাহরামও থাকতে হবে। মাহরাম বলতে বোঝানো হয় একজন আত্মীয় পুরুষ যার সঙ্গে বিয়ে হওয়া বৈধ নয়। বিদেশিকোনো নারী যদি একা সেদেশে আসেন তার জন্য সৌদি কোনো পুরুষ মাহরাম হতে পারবেন যিনি তার দায়িত্ব নিতে লিখিতভাবে স্বীকারোক্তি দেবেন। এর অন্যথা হলে ‘ধর্মীয় পুলিশ’ এর দ্বারা আটক হতে হয় এবং সাধারণ পুরুষদের দ্বারাও নিগৃহিত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। নাদার ভাষায়- “(বোরখা পড়লেও) মুখমন্ডল ঢাকতে আমার একদম ভাল লাগত না। রাস্তায় বের হয়ে যদি আমি মুখমন্ডল না ঢাকতাম লোকেরা আমার দিকে পাথর ছুঁড়ত এবং আমাকে বেশ্যা বলে ডাকত এবং ‘ধর্মীয় পুলিশ’(মুতাওয়া) আমাকে গ্রেফতার করতে চেষ্টা করত।” ১০২ পর্দাপ্রথার সৌদি ধরণ শুধু নারীদের চলাফেরাই নয় তাদের শিক্ষা ও কর্মকান্ডের সীমাকেও নিয়ন্ত্রণ করে। নাদা শারীরিক শিক্ষা(Physical Education) বিষয়ে লেখাপড়া করতে আগ্রহী ছিল কিন্তু এ বিষয়ে পড়া সৌদি নারীদের জন্য নিষিদ্ধ।

ঘরের বাইরে যেতে হলে সৌদি আরবে নারীদের কেবল উপযুক্ত পোশাক  (বোরখা/হিজাব) পড়লেই হবে না সঙ্গে একজন মাহরামও থাকতে হবে। মাহরাম বলতে বোঝানো হয় একজন আত্মীয় পুরুষ যার সঙ্গে বিয়ে হওয়া বৈধ নয়। বিদেশিকোনো নারী যদি একা সেদেশে আসেন তার জন্য সৌদি কোনো পুরুষ মাহরাম হতে পারবেন যিনি তার দায়িত্ব নিতে লিখিতভাবে স্বীকারোক্তি দেবেন।

শিক্ষকতাসহ কিছু পেশায় সীমিত সংখ্যক সৌদি নারী নিয়োজিত আছেন। তবে তাদের পেশাগত কর্ম নারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তা সত্ত্বেও সেখানকার উলেমাগণ অনেকদিন থেকেই দাবী করে আসছেন নারীদের পেশাগত কাজ নিষিদ্ধ করার। ১৯৯০ সালে সৌদি নারীদের জন্য গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ করা হয় এবং তিরিশ বছর পর সম্প্রতি এই নিষেধাজ্ঞা বাতিল করা হয়েছে। সৌদি অবরোধপ্রথা ‘পর-পুরুষের’ সঙ্গে অর্থাৎ মাহরাম নন এমন পুরুষের সঙ্গে নারীদের দেখা সাক্ষাত এমনকি কথা বলারও অনুমোদন দেয় না। কাছের আত্মীয় হলেও না। যেমন কোনো নারী তার আপন ননদের স্বামীর সঙ্গে দেখা দিতে বা কথা বলতে পারবেন না। সৌদি অবরোধপ্রথার প্রধান লক্ষ্য নারীর যৌন-বিশ্বস্ততা বিশেষত স্বামীর প্রতি। আরবের আইনে কোনো অবিবাহিত নারীর অবৈধ যৌন-মিলনের শাস্তি নব্বই চাবুকের ঘা কিন্তু বিবাহিত নারীর অবৈধ যৌনমিলনের শাস্তি মৃত্যুদন্ড। সম্ভবত সৌদি আরবই একমাত্র দেশ যেখানে কোনো নারী বাচ্চা প্রসবের জন্য হাসপাতালে গেলে তাকে বিয়ের দলিল দেখাতে হয়। যদি কেউ দেখাতে না পারে তা পুলিশকে জানানো হয়। ব্যাভিচার এখানে নারীর সর্বোচ্চ অপরাধ এমনকি তা যদি রাজপরিবারের কোনো নারীও করে। সৌদি এক রাজকুমারী মিশাইল এর অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল এক বয়স্ক পুরুষের সঙ্গে। তার স্বামীর আরও স্ত্রী থাকায় মিশাইলের প্রতি তার আগ্রহ ও মনযোগ ছিল না। লেবাননে পড়তে গিয়ে মিশাইল অন্য এক তরুণের সঙ্গে প্রেম সম্পর্কে জড়িয়ে যান। দেশে থাকলে তার পক্ষে বিবাহবিচ্ছেদ পাওয়া এবং প্রেমিকের সঙ্গে মিলিত হওয়া সম্ভব হবে না বুঝতে পেরে মিশাইল দেশ ছেড়ে যেতে চেষ্টা করেন এবং বিমানবন্দরে তাকে আটক করা হয় এবং ব্যাভিচারের জন্য তাকে বিচারের সম্মুখিন করা হয়। পরিবারের অনুরোধ উপেক্ষা করে আদালতে ব্যাভিচারের স্বীকারোক্তি দেন মিশাইল। তার মৃত্যুদন্ড হয় এবং সৌদি রীতি অনুযায়ী প্রকাশ্যে তার এবং তার প্রেমিকের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।

পাকিস্তান ছাড়া উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতেও মুসলিম সমাজে ঐতিহ্যগতভাবে অবরোধ প্রথার ধারা চলে আসছে। মুসলিম সমাজ ছাড়াও ভারতের রাজস্থানে হিন্দু ধর্মের নারীদের জন্যেও পর্দা করার কঠোর লোকাচার প্রচলিত। যার মধ্যে ড্রেসকোডের পাশাপাশি চলাফেরা ও মেলামেশার গন্ডীবদ্ধতাও রয়েছে। তবে এসব দেশে পর্দাপ্রথা মূলত মুসলিম সমাজেরই ব্যাপার। বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে না হলেও বেশিরভাগ রক্ষণশীল পরিবারে নারীদের মধ্যে পর্দার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নির্দিষ্ট পোশাক পড়া ছাড়াও চলাফেরা ও মেলামেশা ক্ষেত্রের বাধ্যবাধকতাও এর মধ্যে পরে। এখানেও রক্ষণশীল পরিবারগুলোতে পর্দার সীমানা কেবল চলাফেরা ও মেলামেশার বাধ্যবাধকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় মেয়েদের বিয়ে, শিক্ষা ও পেশাগতজীবনও পর্দার ‘রীতি’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মেয়েরা কতদূর পরতে পারবে, কী বিষয়ে পরতে পারবে এবং পেশায় যেতে পারবে কিনা গেলেও কোন পেশায় যেতে পারবে সে সিদ্ধান্ত পরিবার নেয় ‘পর্দার নীতি অনুযায়ী’। অনেক বনেদী ও স্বচ্ছল রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েদের পর্দার কারণে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং অনেক অল্পবয়সে বিয়ে দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে পর্দার কঠোরতা কমতে থাকে। শুধু পোশাকের বাধ্যবাধকতা না চলাফেরা ও মেলামেশার গন্ডীও ক্রমান্বয়ে শিথিল হয়ে এসেছে। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যাপক কর্মসংস্থানের ফলে গরীব ও নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েদের উপরও পর্দাপ্রথার নিগড় শিথিল হয়ে এসেছিল। তবে গত দুই দশকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলামি মৌলবাদের উত্থান হওয়ায় তা আমাদের দেশেও পর্দার একটি নতুন ‘ঢেউ’ নিয়ে এসেছে যা বেশি প্রভাবিত করেছে শহুরে মধ্যবিত্তদের। এই ঢেউ মূলত মেয়েদের ড্রেসকোডকে আক্রান্ত করেছে। তবে এর পাশাপাশি মেয়েদের চলাফেরা ও কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণের রীতিনীতিগুলোও কমবেশি প্রয়োগ করার প্রচেষ্টা রয়েছে। বাংলাদেশে নারীদের সাক্ষরতা যে হারে বেড়েছে নারীর কর্মসংস্থানের হার তার চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। এক্ষেত্রেও পর্দাপ্রথার পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। তবে ড্রেস-কোডের চেয়ে এক্ষেত্রে বেশি প্রভাবিত করে মেয়েদের চলাফেরার সীমাবদ্ধতা।১০৩

অবরোধের শেকল ও নারীর মন

অবরোধের কঠোর শৃঙ্খল ও অবদমনের মধ্যে থাকা নারী যে মানসিকভাবে দুর্বল ও পঙ্গু হয়ে যায়, স্বাভাবিক অনেক কাজ করার মানসিক শক্তি এবং নিজের পরিচিত চৌহদ্দির বাইরে সাবলীলভাবে চলাফেরা ও কাজকর্ম করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তার বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে রোকেয়ার কালোত্তীর্ণ গ্রন্থ অবরোধবাসিনী-তে। এখানে উল্লিখিত অবরোধে থাকা অনেক নারী মানসিকভাবে এতই দুর্বল ছিল যে চোর এসে শরীর থেকে গয়না খুলে নিয়ে যাবার সময় বাধা দেওয়া তো দূরের কথা টু শব্দটিও করতে পারেনি (অবরোধবাসিনী-৩১)। কেউ নামিয়ে আনেনি বলে আত্মীয়ের বাড়িতে অতিথি হিসেবে আসা গৃহবধু ‘পৌষ মাসের দীর্ঘ রজনী’ খোলা পালকিতে সারা রাত কোলের শিশুকে নিয়ে বসে থেকেছেন কিন্তু নিজে থেকে বেরিয়ে আসতে বা শব্দ করে কাউকে জানান দিতে পারে নি (অবরোধবাসিনী-২)। বাড়িতে আগুন লাগায় এক গৃহিনী তাড়াতাড়ি গয়নার বাক্স নিয়ে ঘর থেকে বের হবার জন্য দরজার কাছে এসে দেখলেন কয়েকজন পুরুষ আগুন নেভাচ্ছে। গৃহিনী পুরুষদের সামনে বের না হয়ে ঘরে গিয়ে খাটের নিচে গিয়ে বসে রইলেন এবং সেখানেই পুড়ে মরলেন (অবরোধবাসিনী-৮)। নারীর মন কতটা শক্তিহীন এবং সংকোচপূর্ণ হলে এতটা কষ্ট সহ্য করে বা মৃত্যু যন্ত্রণার মধ্যেও মুখ খুলতে বা সংকোচ কাটাতে পারে না। এটি ছিল এমন একটি অন্ধকার এবং আচ্ছন্ন অবস্থা যা মানুষের মনের মধ্যে আলো প্রবেশ করতে দেয় না এবং তাকে এক অবাস্তব ভীতি, লজ্জা ও সংকোচের মধ্যে ডুবিয়ে রাখে। বাইরের জগত এবং পরিবারের বাইরে সমাজের অন্যসব বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন এসব নারীরা একরকম ‘শিশুর মত অন্তকরণহীন’ হয়েই গড়ে উঠত। তাদের মন এতটাই আত্মবিশ্বাসহীন হয়ে গড়ে উঠত যে পূর্ণবয়স্ক হয়েও তারা জানত এবং বিশ্বাস করত নিজেদের দায়িত্ব নেবার ক্ষমতা তাদের নেই। অবরোধের ধারণাগুলোর কারণে ছেলেবেলা থেকে শরীর, পোশাক ও পরপুরুষ নিয়ে অনেক কঠোর এবং অবাস্তব এক ‘ট্যাবু’ (Taboo) তাদের মধ্যে সৃষ্টি হত যা অনেকটা আমাদের নগ্ন হবার ট্যাবুর (Nakedness Taboo) মতো। অর্থাৎ বাড়িতে আগুন ধরলে বাঁচার জন্যে হলেও সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে বের হতে হলে আমাদের যেমন সংকোচ হবে এটা অনেকটা সেরকম।

একশো বছর আগে এদেশের নারীদের উপর যে মাত্রায় অবরোধ আরোপ করা হতো সেরকম কঠোর অবরোধ হয়তো এখন আমাদের দেশে নেই কিন্তু যে মাত্রায় এটি এখনও টিকে আছে তাও পুরুষের মতো মুক্তভাবে মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। গবেষণায় দেখা গেছে নারীর আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতার অভাব (উদাহরণ স্বরূপ, ঘরের বাইরে চলাচলের স্বাধীনতা না-থাকা, অসুস্থ শিশুর চিকিৎসা করানোর কর্তৃত্ব না থাকা) নারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।১০৪ অন্য অনেক দেশে এখনও নানাভাবে কঠোর অবরোধ আছে তা আমরা উপরে উল্লেখ করেছি। ইসলামি বিপ্লবের পর কঠোর অবরোধ ইরানের নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ইরানে আত্মহত্যার হার বৈশ্বিক গড়ের পাঁচগুণ এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে এর শতকরা ৮৩ জন হল নারী।১০৫ হোমা দারাবীর মতো একজন গুণী ও দেশপ্রেমিক মানুষ থেকে শুরু করে বহু সাধারণ নারী পরিবার ও সমাজে অবরুদ্ধ ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত জীবনের চাপে পরে হতাশ এবং শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যায় প্ররোচিত হন। অবরোধের কঠোর এবং নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইনের কারণে হোমা দারাবীর মতো একজন স্বচ্ছল ও সুবিধাপ্রাপ্ত পরিবারের মানুষও কী করে চরমভাবে হতাশায় ডুবে আত্মহত্যায় প্ররোচিত হলেন তা আমরা আগে উল্লেখ করেছি। দুরবস্থাকে মেনে নিতে না পারলে বা এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারলেই হতাশা ও আত্মহত্যার প্রবণতার সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা সৌদি আরবের সমাজ ইরানের তুলনায় শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে পেছানো বলেই ওইসব দেশে অধিকাংশ নারী পর্দাপ্রথার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। তাই ওসব দেশে নারীদের মধ্যে বিষন্নতা ও আত্মহত্যার প্রবণতা ইরানের তুলনায় কম।

ইসলামি বিপ্লবের পর কঠোর অবরোধ ইরানের নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ইরানে আত্মহত্যার হার বৈশ্বিক গড়ের পাঁচগুণ এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে এর শতকরা ৮৩ জন হল নারী।

তবে ওইসব দেশেও যেসব নারীরা অবরোধের নিয়ন্ত্রিত ও গন্ডীবদ্ধ জীবনকে মেনে নিতে পারে না তারা হতাশা ও অন্যান্য মানসিক সংকটে ভোগে এবং অনেকের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত সৌদি রাজকন্যা মৃত্যুদন্ড এড়াতে পারত যদি সে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি না দিত। মৃত্যুদন্ড না হলে তাকে ফিরে যেতে হত তার স্বামীর কাছে এক অনাকাঙ্খিত অর্থহীন জীবনের চক্করে। মিশাইল তা চায় নি, এমন জীবনের চেয়ে মৃত্যু তার কাছে অধিক কাম্য মনে হয়েছে। ছেলেবেলা থেকে পরিবার ও সমাজের রীতিনীতি তাকে যে কঠোর নিয়ন্ত্রিত জীবনের অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল তার বাইরেও যে আলো আছে মুক্ত আনন্দময় জীবন আছে লেবাননে অপেক্ষাকৃত উদার সমাজে গিয়ে সে তার স্বাদ পেয়েছিল। এই মুক্ত জীবন থেকে আনন্দহীন নিয়ন্ত্রিত জীবনে ফিরে যাওয়া তার কাছে চরম কষ্টের বলে মনে হয়েছে। মিশাইলের স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বেছে নেয়ার সিদ্ধান্তও তার মানসিক সংকটজাত এক ধরণের আত্মহত্যা-প্রবণতার ফল।

পাকিস্তানে নারীদের মধ্যে হতাশা ও হতাশাজনিত মানসিক রোগ এবং অন্যান্য মানসিক রোগ বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে অনেক বেশি। পুরুষদের মধ্যে এ হার বৈশ্বিক হারের কাছাকাছি কিন্তু নারীদের প্রায় অর্ধেকের মধ্যেই বিভিন্ন মানসিক রোগের লক্ষণ বিদ্যমান।এখানে নারীদের মানসিক রোগে ভোগার সম্ভাবনা পুরুষের তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ যেখানে অন্যান্য দেশে নারী ও পুরুষের মানসিক রোগের অনুপাত ১.৫ ঃ ২ ।১০৬ আফগানিস্তানের নারীদের মধ্যে হতাশাজনিত মানসিক সংকট, আত্মবিধ্বংসী কার্যক্রম (Self-mutilation), বাড়ি থেকে পালানো, ‘জীনে আক্রান্ত’ হওয়া, অতিরিক্ত ক্রোধজনিত ধ্বংসাত্মক কাজ করার ঘটনা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি।১০৭পাকিস্তানের কাছাকাছি আর্থসামাজিক অবস্থার একটি সমাজ হলেও বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে নারীদের মানসিক সংকট অনেক কম। বাংলাদেশে ২০১৮-১৯ এর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষায় দেখা যায় বাংলাদেশে নারীপুরুষের মধ্যে মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই।১০৮ তবে স্বাস্থ্যকেন্দ্র-ভিত্তিক গবেষণায় নারীদের মধ্যে হতাশাজনিত মানসিক জটিলতা পুরুষের তুলনায় কিছুটা বেশি পাওয়া গেছে যদিও তা বৈশ্বিক গড় থেকে খুব একটা বেশি নয়।১০৯ মুসলিম দেশ হলেও বাংলাদেশে পর্দার কড়াকড়ি এবং নারীদের চলাফেরা কার্যক্রমের উপর নিয়ন্ত্রণ ইরান, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের নারীদের তুলনায় অনেক কম। সম্ভবত এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক নির্ণায়ক যার কারণে এদেশে নারীদের মানসিক সংকট ওইসব দেশের নারীদের তুলনায় অনেক কম।

পর্দার বিধিনিষেধের মাধ্যমে একদিকে আদ্যোপান্ত শরীর ঢাকার বাধ্যবাধকতা এবং অন্যদিকে চলাফেরা ও কর্মকান্ডের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ নারীর মনে বর্হিজগত সম্পর্কে গভীর সংবেদনশীলতা, ভীতি ও অদ্ভূত এক ধরণের ট্যাবু তৈরি করে।

পর্দার বিধিনিষেধের মাধ্যমে একদিকে আদ্যোপান্ত শরীর ঢাকার বাধ্যবাধকতা এবং অন্যদিকে চলাফেরা ও কর্মকান্ডের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ নারীর মনে বর্হিজগত সম্পর্কে গভীর সংবেদনশীলতা, ভীতি ও অদ্ভূত এক ধরণের ট্যাবু তৈরি করে। ছেলেবেলা থেকে কঠোরভাবে এই প্রথা চাপিয়ে দেবার ফলে অধিকাংশ মেয়েদের বহির্জগত সম্পর্কে উপযুক্ত ধারণা গড়ে উঠতে পারে না এবং তাদের সামাজিকীকরণও ব্যাহত হয়। এভাবে বেড়ে ওঠা মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের বড় ধরণের ঘাটতি থাকে। সমাজও ধরে নেয় যে পূর্ণবয়স্ক হলেও তারা আর নিজের দায়িত্ব নিতে পারবে না। যেখানে সৌদি আরবের মতো আইনের বাধ্যবাধকতা নেই সেখানেও তারা চলাফেরার সময় অঘোষিত মাহরাম নিয়েই চলেন। শৈশবে বাবা, কৈশোর ও যৌবনে ভাই বা স্বামী, বার্ধক্যে ছেলের কাঁধে চড়ে লাশের মত চলাফেরা করেন। এই প্রথা যে সমাজে যত কঠোর সে সমাজে নারীদের মানসিক কষ্ট এবং মনবৈকল্যের পরিমাণও তত বেশি। অবরোধের অন্ধকারের মধ্যে থাকা মারিয়ার মতো হাজার হাজার সম্ভবনাময় কিশোরী তাদের যন্ত্রণাময় জীবনের গন্ডী পেরোতে পারেনি। এ অন্ধকার থেকে বের হবার অক্ষম প্রচেষ্টায় নিজ পরিবারের বা কাছের মানুষের দ্বারা খুন হয়েছে আকসার মত অসংখ্য মেয়ে। স্বেচ্ছায় এই অন্ধকার কারাগারের অর্থহীন জীবন শেষ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন হোমা দারাবী ও মাইশেলের মত শত শত নারী ।

* Women and their bodies are the symbolic-cultural site upon which human societies inscript their moral order

মনিরুল ইসলাম: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, লেখক ও শিক্ষক, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ।

ইমেইল: monirul852@gmail.com  

তথ্যসূত্র:

 ৯৫. Seyla Benhabib : The Claims of Culture : Equality and Diversity In The Global Era, pp- 84 (2002).

৯৬. Ambedkar B R.  https://twitter.com/Ram_Guha/status/978094488592695297

৯৭. Atia Daud (Sindhi, Pakistani Poet) quoted in, Goodwin, Jan. (1994) : Price of Honor: Muslim Women lift veil of silence on the Islamic World ; Boston,Little, Brown and Company pp-11

৯৮. Alvi, A. (2013). Concealment and revealment: The Muslim Veil in Context; Current Anthropology, 54(2), 177-199. doi:10.1086/669732

৯৯. Goodwin, Jan. (1994) : Price of Honor: Muslim Women lift veil of silence on the Islamic World ; Boston,Little, Brown and Company pp-15

১০০. Goodwin, Jan ; ibid, pp-17

১০১.  Goodwin, Jan ; ibid, pp-115

১০২.  Goodwin, Jan ; ibid, pp-218  

১০৩. M Niaz Asadullah ,Zaki Wahhaj : Female Seclusion from Paid Work: A Social Norm or Cultural Preference?;ECARES working paper 2019-10 ,March 2019, ECARES ULB – CP  Brussels BELGIUM  www.ecares.org

১০৪. Andy Pennington et al : The health impacts of women’s low control in their living environment: A theory-based systematic review of observational studies in societies with profound gender discrimination; Health & Place 51 (2018) 1–10

১০৫.  Goodwin, Jan ; ibid, pp-121   

১০৬. Qadir F. et al : Male gender preference, female gender disadvantage as risk factors for psychological morbidity in Pakistani women of childbearing age – a life course perspective; BMC Public Health 2011, 11:745 http://www.biomedcentral.com/1471-2458/11/745

১০৭. Cardozo B L. et al : Mental Health of Women in Postwar Afghanistan; JOURNAL OF WOMEN’S HEALTH Volume 14, Number 4, 2005

১০৮. National Mental Health Survey of Bangladesh 2018-19, Provisional Fact Sheet ; NIMH,DGHS,MOHFW &WHO

১০৯. Karim E et al :  Prevalence of Mental Illness in the Community; The Journal of

Teachers Association RMC, Rajshahi, June 2006; Volume 19 Number 1

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •