বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর ‘অব্যক্ত’ আর্তনাদ ও নীরব বিদ্রোহ

স্মরণ

ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে

বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর ‘অব্যক্ত’ আর্তনাদ ও নীরব বিদ্রোহ

আলমগীর খান

বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর লেখা ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থটি ১৯২১ সালে প্রকাশের পরের বছর ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় বিজ্ঞানসাহিত্যিক চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য এটি নিয়ে ‘অব্যক্ত ও ব্যক্ত’ শিরোনামে একটি আলোচনা করেন। এ আলোচনাটি ‘অব্যক্ত’র দে’জ সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত। তিনি লিখেছিলেন, ‘বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে এই ভারতবর্ষে উঠিলেন এক সাধক, যিনি তাঁহার চিন্তাকে কল্পনার উন্মুখ রাজ্যে অবাধে প্রেরণ করিয়া আবার পরমুহূর্তে তাহাকে শাসনের অধীন আনিয়া প্রকৃতির এই বৈষম্যের মধ্যে একতার সন্ধানে ছুটিলেন, এবং জড়, উদ্ভিদ্ ও জীবের মধ্যে এক সেতু বাঁধিয়া দিলেন।’

শতবর্ষের বেশি সময় ধরে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রকে নিয়ে আলোচনার মূল সুর এখানে বিধৃত। তিনি সেই সাধক, যিনি তার চিন্তাকে কল্পনার উন্মুখ রাজ্যে অবাধে প্রেরণ করে আবার পরমুহূর্তে তাকে শাসনের অধীন এনে প্রকৃতির বৈষম্যের মধ্যে একতার সন্ধানে ছুটেছেন এবং জড়, উদ্ভিদ ও জীবের মধ্যে এক সেতু বাঁধার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যা নিয়ে আশানুরূপ আলোচনা হয়নি তা হলো: এই মহান সাধকের ভেতরে ছিল এক চাপা বিদ্রোহ–ইংরেজ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে হৃদয়ের গহিনে তীব্র ক্ষোভের ধিকিধিকি জ্বলন্ত আগুন। তার প্রকাশ দেখা যায় নানাভাবে–দাউ দাউ করে জ্বলা অগ্নিশিখায় নয়, ছাইচাপা অঙ্গার থেকে প্রকাশিত উত্তাপে। তাই নিয়ে বর্তমান আলোচনাটি।

একশ বছর পর ২০২১-এ বিজ্ঞানী ও লেখক আশরাফ আহমেদ এই একই বই সম্পর্কে লিখেছেন, ‘কঠিন বিজ্ঞানকে সহজ বাংলায় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গভীর দেশপ্রেম, বাংলা ভাষার প্রতি অবিচল নিষ্ঠা এবং ক্ষেত্র বিশেষে পশ্চিমা, বিশেষ করে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাবেরও পরিচয় পাওয়া যায়। সবকিছু ছাপিয়ে একজন শুদ্ধ মানুষের ছবিও পাঠকের মনে আঁকা হয়ে যায়। সাবেকি হলেও বইটি শুধু সুখপাঠ্যই নয়, এর রচনাশৈলী এবং অন্তর্নিহিত দর্শন ও উপলব্ধি শিক্ষণীয়ও বটে।’

ভারতবর্ষে বিজ্ঞানের অগ্রদূত ও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন জগদীশচন্দ্র বসু। জন্মেছিলেন ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর। মৃত্যুবরণ করেছেন ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর। জন্ম ভারতব্যাপী ইংরেজের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত মহাবিদ্রোহের আগুন যখন দাউ দাউ করে জ্বলছে সেই সময়ে, আর মৃত্যু হিন্দু-মুসলমানের বিরোধকে কেন্দ্র করে ভারত বিভক্তির বছর দশক আগে। অর্থাৎ, ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জীবন অতিবাহিত করেছেন তিনি। দেখেছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে নৃশংস রূপ, দেশের মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও একটি ঔপনিবেশিক দেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চায় প্রতিবন্ধকতা।

স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গৌরব জগদীশচন্দ্র বসুও। জগদীশচন্দ্র বসু মনেপ্রাণে ধারণ করতেন তার জন্মভূমি তৎকালীন পূর্ববঙ্গকে। জন্ম বাংলাদেশের ময়মনসিংহে, পড়ালেখা ফরিদপুরের একটি স্কুলে আর পৈতৃক নিবাস বিক্রমপুরে। পরে পড়ালেখা করতে কলকাতা হয়ে গেলেন ক্যামব্রিজ। পদার্থবিজ্ঞানে উচ্চতর পড়াশোনা শেষ করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষকতার চাকরি নিলেন। জীবনে এক মুহূর্তের জন্যও কি তিনি ভুলে গিয়েছিলেন মাতৃভূমি বাংলাকে এবং বিশেষ করে বিক্রমপুরকে, যা এখন মুন্সিগঞ্জ?

মাতৃভূমির প্রতি জগদীশচন্দ্রের ভালোবাসা কেমন ছিল–বোঝা যায় ১৯১১ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য-সম্মিলনীর ময়মনসিংহ অধিবেশনে প্রদত্ত সভাপতির অভিভাষণে। ‘বিজ্ঞানে সাহিত্য’ শীর্ষক এ ভাষণে তিনি বলেন, ‘মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কেহ এড়াইতে পারে না। সেই অদৃশ্য শক্তিবলে বহু বৎসর পরে আজ আমি আমার জন্মস্থানে উপনীত হইয়াছি। …এই সাহিত্য-সম্মিলন বাঙালির মনের এক ঘনীভূত চেতনাকে বাংলা দেশের এক সীমা হইতে অন্য সীমায় বহন করিয়া চলিয়াছে এবং সফলতার চেষ্টাকে সর্বত্র গভীরভাবে জাগাইয়া তুলিতেছে।’

আর ১৯১৫ সালে মাতৃক্রোড়তুল্য বিক্রমপুরে ‘বোধন’ শীর্ষক প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন, ‘এই বিক্রমপুর বিক্রমশালী সন্তানের জন্মভূমি, মনুষ্যত্বহীন দুর্বলের নহে। আমার পূজা হয়তো তিনি গ্রহণ করিয়াছেন, এই সাহসে ভর করিয়া আমি বহুদিন বিদেশে যাপন করিয়া জননীর স্নেহময় ক্রোড়ে ফিরিয়া আসিয়াছি। হে জননী, তোমারই আশীর্বাদে আমি বঙ্গভূমি এবং ভারতের সেবকরূপে গৃহীত হইয়াছি।’

মাতৃভাষা বাংলার প্রতিও তিনি ছিলেন গভীর দরদি। এদিক থেকে আজীবন বন্ধু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তার মিল লক্ষণীয়। ১৯২১-এ প্রকাশিত তার ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সে সময়ে সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের ইংরেজি স্কুলে পড়ার চল থাকলেও তার পিতা ভগবানচন্দ্র বসু তাকে বাংলা স্কুলেই ভর্তি করেছিলেন। শুধু বিজ্ঞানের সাধনাই তিনি করেননি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতির দায়িত্বও পালন করতে হয়েছে তাকে। বাংলাভাষায় পশ্চিমা বিজ্ঞানচর্চার সেই উষাপর্বে তার দুরূহ বৈজ্ঞানিক সাধনাসমূহের কথা বাংলায় লিখে দেশবাসীকে জানাতে থাকেন।

সে সময়ে সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের ইংরেজি স্কুলে পড়ার চল থাকলেও তার পিতা ভগবানচন্দ্র বসু তাকে বাংলা স্কুলেই ভর্তি করেছিলেন। শুধু বিজ্ঞানের সাধনাই তিনি করেননি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতির দায়িত্বও পালন করতে হয়েছে তাকে। বাংলাভাষায় পশ্চিমা বিজ্ঞানচর্চার সেই উষাপর্বে তার দুরূহ বৈজ্ঞানিক সাধনাসমূহের কথা বাংলায় লিখে দেশবাসীকে জানাতে থাকেন।

নিজের আবিষ্কৃত যন্ত্রপাতির নামও বাংলায় রাখতে শুরু করেছিলেন। গাছের বৃদ্ধি মাপার জন্য জগদীশচন্দ্র ক্রেস্কোগ্রাফ নামে একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। এ দিয়ে এক সেকেন্ডের সহস্রভাগের একভাগ মাপা যেত। এর মাধ্যমে তিনি পরিমাপ করেন যে, প্রতি মিনিটে গাছ এক ইঞ্চির লক্ষ ভাগের মধ্যে ৪২ ভাগ বাড়ে। ‘অব্যক্ত’ বইয়ের ‘দীক্ষা’ রচনাটিতে ‘আহতের সাড়া’ পরিচ্ছেদে তিনি জানান, তার ইচ্ছে ছিল কলটির নাম রাখেন ‘বৃদ্ধিমান’। সম্ভব হয়নি। কেন, তার মজার ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে:

“আমি প্রথম প্রথম আমার নূতন কলগুলোর সংস্কৃত নাম দিয়াছিলাম; যেমন, ‘কুঞ্চনমান’ এবং ‘শোষণমান’। স্বদেশি প্রচার করিতে যাইয়া অতিশয় বিপন্ন হইতে হইয়াছে। প্রথমত, এই সকল নাম কিম্ভূতকিমাকার হইয়াছে বলিয়া বিলাতি কাগজ উপহাস করিলেন। … বলপূর্বক যেন নাম চালাইলাম, কিন্তু ফল হইল অন্যরূপ। গতবার আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতার সময় তথাকার বিখ্যাত অধ্যাপক আমার কল ‘কাঞ্চনম্যান’ সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করিবার জন্য অনুরোধ করিলেন। প্রথমে বুঝিতে পারি নাই, শেষে বুঝিলাম ‘কুঞ্চনমান’ ‘কাঞ্চনম্যানে’ রূপান্তরিত হইয়াছে। হান্টার সাহেবের প্রণালিমতে কুঞ্চন বানান করিয়াছিলাম, হইয়া উঠিল কাঞ্চন। … হিরণ্যকশিপুকে দিয়া বরং হরিনাম উচ্চারণ করানো যাইতে পারে, কিন্তু ইংরেজকে বাঙ্গলা কিংবা সংস্কৃত বলান একবারেই অসম্ভব। এজন্যই আমাদের হরিকে হ্যারী হইতে হয়। এই সকল দেখিয়া কলের ‘বৃদ্ধিমান’ নামকরণের ইচ্ছা একেবারে চলিয়া গিয়াছে। বৃদ্ধিমান–তাহা হইতে বারডোয়ান হইত। তার চেয়ে বরং ক্রেস্কোগ্রাফই ভালো।”

প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষকতার চাকরিতে ইংরেজ শিক্ষকদের সঙ্গে তার বেতনের বৈষম্য দেখে প্রতিবাদে বৈষম্য দূর না-হওয়া পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়িয়েছিলেন তিন বছর। ইংরেজ ও পশ্চিমাদের এই অবজ্ঞার তীর তাঁকে জীবনে বহুবার বিদ্ধ করেছে। ‘হাজির’ রচনাটিতে আছে, বিলাতের এক সংবর্ধনা সভায় বৈজ্ঞানিক রামসে তাঁকে সাধুবাদ দিয়ে বলেন, ‘কাহারও কাহারও মনে হইতে পারে যে, এখন হইতে ভারতে নূতন জ্ঞান-যুগ আরম্ভ হইল; কিন্তু একটি কোকিলের ধ্বনিতে বসন্তের আগমন মনে করা যুক্তিসংগত নহে।’ জগদীশচন্দ্র স্পর্ধার সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘শীঘ্রই ভারতের বিজ্ঞানক্ষেত্রে শত কোকিল বসন্তের আবির্ভাব ঘোষণা করিবে।’

বিজ্ঞানী ও লেখক আশরাফ আহমেদ জগদীশচন্দ্রের ঔপনিবেশিক শক্তির বিরোধিতার নমুনা হিসেবে লিখেছেন: ‘স্বদেশি ও বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অপরাধে তাঁর ছাত্র মেঘনাদ সাহাকে ঢাকার কলেজিয়েট স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ধারণা করি, জগদীশচন্দ্রের পেশা ও সামাজিক অবস্থান থেকে সেই যুগের বিপ্লবীদের মতো তিনি ব্রিটিশদের বিরোধিতা করতে পারেননি। কিন্তু অন্তত একটি ক্ষেত্রে সেই মনোভাব তিনি প্রকাশ করেছেন। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ রচনাটি বলভদ্র থাপা নামে এক নেপালি বীরের ইংরেজের বিরুদ্ধে ১৮১৪ সালে কলুঙ্গা যুদ্ধের কাহিনি। তীর, ধনুক ও ভাঙা বন্দুকে সজ্জিত কলুঙ্গার ৩০০ সৈন্য ইংরেজের সুসজ্জিত ৩৫০০ সৈন্যকে মাসাধিককাল ঠেকিয়ে রেখেছিল এবং ইংরেজ সেনাপতিকে নিহত করেছিল। পরবর্তী সময়ে পরাজয় না-মেনে যুদ্ধস্থল ত্যাগ করে রণজিত সিংহের শিখ সৈন্যদলের হয়ে আফগান যুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন। শত্রুর এই বীরত্বপূর্ণ স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ইংরেজরা কলুঙ্গার সেই যুদ্ধক্ষেত্রে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করেছিল। গল্পটি ঐতিহাসিক হলেও এতে জগদীশচন্দ্রের চরিত্রের স্বদেশপ্রীতিটি খুব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। বর্ণিত প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে নেপালি নারী, পুরুষও শিশু-যোদ্ধাকে এমন উচ্চস্থানে তুলে ধরেছেন যে, তাদের প্রতি অসীম ভালোবাসা না-থাকলে তা এভাবে কলমের কালিতে প্রকাশ পেত না। এই গল্পে নেপালি যোদ্ধাদের উপরে তুলে ধরে প্রকারান্তরে আক্রমণকারী ব্রিটিশদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন বলে আমার মনে হয়েছে। এরপর ‘আহত উদ্ভিদ’ প্রবন্ধের প্রথম অনুচ্ছেদটির (প্যারাগ্রাফ) দিকে লক্ষ করুন: ‘পশ্চিমে কয় বৎসর যাবৎ আকাশ ধূমে আচ্ছন্ন ছিল। সেই অন্ধকার ভেদ করিয়া দৃষ্টি পৌঁছিত না। অপরিস্ফুট আর্তনাদ কামানের গর্জনে পরাহত। কিন্তু যেদিন হইতে শিখ ও পাঠান, গুর্খা ও বাঙালি সেই মহারণে জীবন আহুতি দিতে গিয়াছে, সেদিন হইতে আমাদের দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি হঠাৎ বাড়িয়া গিয়াছে।’ অর্থাৎ প্রথম মহাযুদ্ধে পশ্চিমাদের নিজেদের বিবাদ মেটাতে মহান ভারতীয়রা জীবন বিসর্জন দিয়েছে!”

জগদীশচন্দ্রের ‘অগ্নিপরীক্ষা’ লেখাটি পড়তে পড়তে যদি কারও মনে কল্পনা আসে যে, একাত্তরে বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের রাঢ়িখালের এই মহান বিজ্ঞানীও বৃদ্ধ কমরেড মুজফ্‌ফর আহমদের মতো আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইতেন, তবে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। বাংলা ১৩২৮-এর পহেলা বৈশাখ ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থের ‘কথারম্ভে’ জগদীশচন্দ্র লিখেছেন, ‘ভিতর ও বাহিরের উত্তেজনায় জীব কখনও কলরব কখনও আর্তনাদ করিয়া থাকে। মানুষ মাতৃক্রোড়ে যে ভাষা শিক্ষা করে সে ভাষাতেই সে আপনার সুখ-দুঃখ জ্ঞাপন করে।’

এ সম্পর্কে আশরাফ আহমেদ লিখেছেন, “প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষকতার সময় বেতনবৈষম্য এবং অনুমতি ব্যতিরেকে বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালাতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কয়েকটি মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভাবে ভারত বা কলকাতায় এ সংক্রান্ত কোনো আদালত না থাকায় আদালতটি ছিল বিলাতে। আদালতের ভাষাও ছিল ইংরেজি। জগদীশচন্দ্র বসু লিখেছেন, ‘জাতীয় জীবনের পক্ষে ইহা অপেক্ষা অপমান আর কি হইতে পারে?’”

আশরাফ আহমেদ এরপর আরও লিখেছেন, “অসীম পরিশ্রমলব্ধ এবং অধ্যবসায়ে অর্জিত বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল তিনি সর্বপ্রথমে প্রকাশ করেছিলেন বিভিন্ন প্রবন্ধে, মাতৃভাষা বাংলায়! আর সেই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলোও সর্বপ্রথমে প্রদর্শন করেছিলেন স্বদেশবাসীর সামনে, বিদেশে নয়! (‘মনন ও করণ’)। অথচ সোয়াশ বছর পর বাংলা ভাষার এত উন্নতির পরও আজকের বাংলাদেশ বা ভারতের কোনো বিজ্ঞানী ইংরেজির আগে বাংলায় তার গবেষণালব্ধ বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন কিনা, ঘোরতর সন্দেহ আছে। বাংলা ভাষা বিজ্ঞানচর্চার উপযুক্ত নয় বলে যারা অর্থ না বুঝেও বিদেশি ইংরেজি শব্দ মুখস্থ করেন, তাদের জগদীশচন্দ্রের লেখাগুলো একবার পড়ে দেখতে অনুরোধ করি। বাংলা ভাষার জন্য জীবন দানের পর প্রায় সত্তর বছর কেটে গেল। বিজ্ঞানের বিষয় তো বটেই, শিক্ষাদানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিষয়গুলোতেও ইংরেজির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়! আমাদের শিক্ষাবিদরা এতে কি অপমান বোধ করেন না?”১০

সোয়াশ বছর পর বাংলা ভাষার এত উন্নতির পরও আজকের বাংলাদেশ বা ভারতের কোনো বিজ্ঞানী ইংরেজির আগে বাংলায় তার গবেষণালব্ধ বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন কিনা, ঘোরতর সন্দেহ আছে। বাংলা ভাষা বিজ্ঞানচর্চার উপযুক্ত নয় বলে যারা অর্থ না বুঝেও বিদেশি ইংরেজি শব্দ মুখস্থ করেন, তাদের জগদীশচন্দ্রের লেখাগুলো একবার পড়ে দেখতে অনুরোধ করি।

শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক প্রায় কেউ আর অপমান বোধ করেন না। কারণ, ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর যে ‘অব্যক্ত’ আর্তনাদ ও নীরব বিদ্রোহ, তা হয়তো আর কারও মনে নেই। মহান বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর জন্ম ও মৃত্যুদিবস দুটি আমাদের জীবনে নীরবে আসে ও অব্যক্ত থেকে চলে যায়। জগদীশের বৃক্ষরা সাড়া দিলেও আমরা দিই না বললেই চলে। চলে কি?

আলমগীর খান: সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি

ই-মেইল: alamgirhkhan@gmail.com

তথ্যসূত্র

১. জগদীশচন্দ্র বসু, অব্যক্ত, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৭

২. আশরাফ আহমেদ, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর ‘অব্যক্ত’, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি (ছোটকাগজ), পৃ. ৫, ২য় বর্ষ ২য় সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি-২০২১, ঢাকা

৩. জগদীশচন্দ্র বসু, অব্যক্ত, পৃ. ৬৮, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ২০১৪, ঢাকা

৪. পূর্বোক্ত, পৃ. ৮৯

৫. পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৯

৬. পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৯

৭. আশরাফ আহমেদ, পৃ. ১৮, পূর্বোক্ত

৮. জগদীশচন্দ্র বসু, পৃ. ২১

৯. আশরাফ আহমেদ, পৃ. ১৫, পূর্বোক্ত

১০. পূর্বোক্ত

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •