সম্পাদকীয় ভূমিকা

সম্পাদকীয় ভূমিকা

গত সংখ্যা প্রকাশের পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমঝোতা ও চুক্তির মাধ্যমে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায় এবং তালিবানদের ক্ষমতা পুনর্দখল, আর দেশের ভেতর একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।  

প্রকৃতপক্ষে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে হিন্দু বৌদ্ধদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ ভাঙচুর, জমি দখল, নিপীড়ন নির্যাতন আগের কোনো সরকারের চাইতে কম হয়নি, বরং বেড়েছে। গত কয় বছরে ‘ডিজিটাল’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বহুবার সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা তৈরি করা হয়েছে। রামু, সাথিয়াসহ বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক হামলায় সরকার দলীয় লোকজনদের প্রধান ভূমিকা থাকলেও তার বিচার হয়নি। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জমি বাড়ী দখলে বরাবরই সরকার পুষ্ট ক্ষমতাবান লোকজনদের ভূমিকা কোনো অজানা বিষয় নয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির বড় সুবিধাভোগী ভারতের বিজেপি এই ইস্যু ধরে ভারতে তাদের রাজনীতির জন্য অত্যাবশ্যক সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা তৈরির চেষ্টা করেছে। সাম্প্রতিক ইস্যুতে ভারতের ত্রিপুরায় মসজিদে ও মুসলমানদের বাড়ীতে হামলা তারই একটি দৃষ্টান্ত। 

এর আগে গত ১৩ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক হিন্দু মন্দির, ঘরবাড়ী, গ্রামে আক্রমণ ভাঙচুর করা হয়েছে। প্রাণহানিও ঘটেছে মানুষের। কারা এই হামলা চালিয়েছে, দেশ বিদেশের কারা এর ইন্ধনদাতা/পৃষ্ঠপোষক তা নিয়ে নানা বক্তব্য আছে। গত ১৩ই অক্টোবর থেকে ২৫শে অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন হামলা ও সরেজমিন অনুসন্ধান নিয়ে কয়েকটি সংবাদপত্রের বিভিন্ন খবর/প্রতিবেদনের মূল অংশ এই সংখ্যায় প্রকাশ করা হলো। এছাড়া গত ১৭ অক্টোবর রংপুরের পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার সরেজমিন প্রতিবেদন যুক্ত হলো।

২০ বছর পর খুব সহজেই তালিবানরা আবারও দখলে নিয়েছে আফগানিস্তান, তবে সমঝোতার মাধ্যমে। ২০০১ সালে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামে আগ্রাসনের নতুন পর্ব শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। যে তালিবানদের তারা ক্ষমতায় বসিয়েছিল ১৯৯৫ সালে তাদের উচ্ছেদ করেই ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান দখলে নেয়, তারপর ২০০৩ সালে দখল করে ইরাক।  গত কয় বছরে তালিবানদের সাথে নানারকম সমঝোতা আলোচনা হচ্ছিলো মার্কিন প্রশাসনের। ট্রাম্প আমলে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুপক্ষের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, বাইডেন আমলে এসে তালিবানদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আফগানিস্তান ত্যাগ করে মার্কিন বাহিনী, সেই সাথে তাদের সহযোগী সরকার ইত্যাদি। এখন এই দেশে নতুন ব্যবসার জন্য মার্কিন, চীন, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত ও পাকিস্তান তাকিয়ে আছে তালিবানেরই দিকে। এই পর্যায়ে ইতিহাসের দিকে আবারও দৃষ্টি দেয়া দরকার। এই পরিপ্রেক্ষিতে আফগানিস্তান দখলের পরপর লেখা এবং ২০০২ সালে ত্রৈমাসিক পত্রিকা নতুন পাঠ-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ এখানে পুনপ্রকাশ করা হলো। এছাড়া আফগানিস্তানে সংস্কার প্রচেষ্টার প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষক ও মার্কিন ভূমিকার বিশ্লেষক কানাডার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষকের লেখার অনুবাদ প্রকাশ করা হলো। এই সাথে সাম্রাজ্যবাদ, তালিবান শাসন ও নারী প্রশ্ন নিয়ে একটি লেখা সংযোজিত হলো।  

ফেসবুক, টুইটারসহ ইন্টারনেট যোগাযোগ মাধ্যম আপাতদৃষ্টিতে মত ও তথ্য প্রকাশের উন্মুক্ত মঞ্চ মনে হলেও বিভিন্ন দেশের স্বৈরতন্ত্রী শাসক এবং ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর সংগঠিত দাপটে এই মঞ্চগুলোই এখন হয়ে উঠেছে নাগরিকদের ওপর নজরদারি এবং ভিন্নমতাবলম্বী/প্রতিবাদী মানুষদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের বাহন। বাংলাদেশ ও ভারতসহ বহু দেশে এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। এবিষয়ে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীর বয়ানে ভারতের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি লেখার অনুবাদ  থেকে আমরা একইসাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতিও বুঝতে পারি।

‘জাতীয় গৌরবের’ প্রচারণায় আচ্ছন্নতা তৈরি করে, গোপনীয়তা ও জোরজুলুম- অস্বচ্ছতার ওপর ভর করে,  বাংলাদেশে পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। রূপপুরের পর দক্ষিণাঞ্চলে আরও একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী আর এজন্যও রাশিয়ার রোসাটমের ‘সহযোগিতা’ চেয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা বাংলাদেশে ক্লিন এনার্জি বিস্তারের জন্য আরও আরও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার কথা বলেছেন। প্রকৃতপক্ষে এগুলো কি জাতীয় গৌরব না জাতীয় বিপর্যয় , এগুলো কি ক্লিন এনার্জি না ভয়ংকর বিপদের উৎস, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এরকম বিপদ ডেকে আনা অপরিহার্য কিনা সেসব প্রশ্ন বাংলাদেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে এবার দুটো প্রবন্ধ যাচ্ছে। একটি সর্বজনকথার  জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পদার্থবিজ্ঞানী এম ভি রামানা ও জিয়া মিয়া লিখিত ‘The Rooppur Nuclear Power Plant: The Long, Troubled, Costly and Dangerous Life and After-Life of a Very Old Idea’-এর বাংলা অনুবাদ। অন্যটি এই প্রকল্পের ভেতরে বাংলাদেশ-রাশিয়া-ভারতের আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ বিশ্লেষণ।

বিভিন্ন সরকারের আমলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পাটগুলো একে একে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে আর বেড়েছে বেসরকারি পাটকলের সংখ্যা। বলা হয়েছে এগুলোই কর্মসংস্থান করবে,  পাটখাতের বিকাশও এখানেই হবে। এখন সেই বেসরকারি পাটকলগুলোর কোনো কোনোটি অর্থনৈতিকভাবে বেশ শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে কেমন আছেন শ্রমিকরা? সেবিষয়েই অনুসন্ধান করে একটি লেখায় এ বিষয়ে কিছু চিত্র পাওয়া যাবে।

গত ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের ছয়তলা ভবনে আগুন লেগে মারা যান কমপক্ষে ৫৪ জন শ্রমিক, যাদের অধিকাংশই কিশোর কিশোরী। কারখানায় এরকম আগুন নতুন নয়। সরকারের তৎপরতাও গৎবাঁধা ছকের মধ্যেই, তদন্ত কমিটি গঠন এবং সেগুলোর রিপোর্ট ধামাচাপা দেয়া। সমাধানের কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয় না এবং বারবার এগুলো ঘটতে থাকে। সরকারি তদন্ত কমিটির ফলাফলও কেউ দেখতে পায় না। এই পরিপ্রেক্ষিতে অগ্নিকান্ডের কারণ ও দায়দায়িত্ব চিহ্নিত করা এবং এধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে  নাগরিকদের পক্ষ থেকে ১৯ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং এর রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় গত ৩১ আগষ্ট। এই তদন্তে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, অন্য বহু কারখানার মতো এখানেও আগুন লাগা, আগুন বাড়তে দেয়া, আগুনে আটকে নিহত হবার সব ব্যবস্থাই ছিল। মালিক ও সরকারি সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানেরই পুরো দায় এতে। এর আগে গত ৩১ জুলাই কঠোর লকডাউন চলাকালেই নিহত এবং নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে নাগরিক তদন্ত কমিটির একজন সদস্য ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলায় যান। সেখানে নিখোঁজ ব্যক্তিদের সাতটি পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। এছাড়াও তিনি কথা বলেন আগুন থেকে বেঁচে ফেরা কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে। এই লেখায় তিনি সেই আলাপের সংক্ষিপ্ত অংশ তুলে ধরেছেন।

যৌনতা অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষের জীবনেও অবিচ্ছেদ্য। তবে মানুষের সমাজে এবিষয় ঘিরে আছে নানা বিধিনিষেধ, নিয়মকানুন, বাণিজ্য ও সহিংসতা। সমাজভেদে এসবের রূপ ও মাত্রা ভিন্ন। বাংলাদেশে ঘরে বাইরে ধর্ষণসহ নানা মাত্রায় যৌন নিপীড়ন, যৌন সহিংসতা ব্যাপকভাবে থাকলেও যৌনতা বিষয়ক সুস্থ স্বাভাবিক আলোচনা তর্ক বিতর্ক করার পরিবেশ দুর্লভ। সমাজের মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে লিঙ্গীয় সহিংসতা, দমন-আগ্রাসন, নিপীড়নমূলক তৎপরতা গ্রহণ করলেও স্বতস্ফূর্ত প্রেম ভালোবাসা যৌন সম্পর্ক গ্রহণ করতে রাজী থাকেন না। তাই পর্ণোগ্রাফি, যৌনজ গালিগালাজ, যৌন চিকিৎসার নামে ভুল চটুল নানা পণ্যসামগ্রী বাণিজ্য অবাধে চললেও এ বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রকাশনা আলোচনার সুযোগ খুবই সীমিত। এরফলে শৈশব থেকেই একজনকে যৌনতা বিষয়ে ভুল, বিকৃত, আক্রমণাত্মক চিন্তার যোগান দিতে থাকে সমাজ। বিশ্বের বহু দেশ এই পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হবার নানা পথ অনুসন্ধান করছে। এর একটি হলো স্কুল পর্যায় থেকেই এবিষয়ে যথাযথ শিক্ষা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ এদিক থেকে অনেক পিছিয়ে। এই সংখ্যায় নেদারল্যান্ড ও বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে মানুষের শরীর ও যৌনতা বিষয়ে শিক্ষা নিয়ে একটি জরুরী তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে।    

চলচ্চিত্র পর্যালোচনায় এই সংখ্যায় বাছাই করা হয়েছে প্রাণপ্রকৃতি ধ্বংসকারী উন্নয়ন নামে মুনাফা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামের কাহিনী ‘লাল পিঁপড়া স্বপ্ন’ বা হিন্দিতে মাটি কে লাল। এই ছবি দেখার জন্য লিংকও দেয়া হয়েছে লেখায়।  

চট্টগ্রামের উন্মুক্ত অঞ্চল, সিআরবি নামে পরিচিত, যেখানে শহরের অসংখ্য নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ নতুন জীবনের স্বাদ পান, শরীর মন সজীব করতে পারেন, যাকে ‘প্রাকৃতিক হাসপাতাল’ বলা হয়, সেই সর্বজনের ক্ষেত্রটি রক্ষার জন্যও মানুষকে আন্দোলন করতে হচ্ছে। সুন্দরবন থেকে কক্সবাজার, তেতুলিয়া থেকে টেকনাফ নদী বন উন্মুক্ত স্থান দখল করে বাণিজ্যভূমি বানানোর উন্মাদনা চলছে। সরকার এগুলোকেই  উন্নয়ন দাবি করে। চট্টগ্রামের মানুষের সাথে সংহতি জানিয়ে এবং উন্নয়নের নামে প্রাণপ্রকৃতি বিনাশী দখলদারী তৎপরতা বন্ধের দাবিতে ঢাকার শাহবাগে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় গত ১৮ সেপ্টেম্বর। এই বিষয়ে সচিত্র প্রতিবেদন।

গত ২৪ আগস্ট ২০২১ বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’ বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া ও তার জন্য বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনা প্রস্তাব পেশের জন্য এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এখানে তার পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হলো।

এই সংখ্যায় আমরা স্মরণ করেছি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকে, ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে তাঁর ‘অব্যক্ত’ আর্তনাদ ও নীরব বিদ্রোহ নিয়ে আলোচনাসহ। এছাড়া ধারাবাহিক কয়েকটি লেখা ‘২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-২’, ‘অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের সাথে কথোপকথন-শেষ পর্ব’ এবং ‘পুরুষতান্ত্রিক ধারণা ও বৈষম্যের জৈবসামাজিক ভিত্তি-৮’ প্রকাশিত হলো। থাকছে গত কয়েক মাসের সংবাদপত্রের খবরের বিশেষ সংকলনও।

আনু মুহাম্মদ

৩০ অক্টোবর ২০২১

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •