বহুজাতিক সংহতি

অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের সাথে কথোপকথন-শেষ পর্ব

বহুজাতিক সংহতি

অনুবাদ: ফাতেমা বেগম

মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী লেখক ও অধিকার আন্দোলনে সক্রিয় ব্যক্তিত্ব অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের সাথে লেখক এ্যাক্টিভিস্ট ফ্রাংক বারাত দীর্ঘ আলাপ করেছেন, তাঁর বক্তৃতা সংকলিত করেছেন। এতে মার্কিন সমাজে বৈষম্য, বর্ণবাদী আক্রমণ, ফিলিস্তিনি জনগণ সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের লড়াই নিয়ে অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের বক্তব্য পাওয়া যায়। এই সংকলন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়, নাম: Freedom is a Constant Struggle: Ferguson, Palestine and the Foundations of a Movement|  এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে সর্বজনকথায় প্রকাশিত হচ্ছে। এবারে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে বোগাজিচি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া তাঁর বক্তৃতায় আলোচিত হয়েছে বহুজাতিক সংহতির গুরুত্ব (৯ জানুয়ারি ২০১৫)। অনুবাদ করেছেন ফাতেমা বেগম

উপনিবেশবাদ, গণহত্যা এবং বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামের এক শক্তিশালী প্রতীকের নাম র‍্যান্ট ডিঙ্ক। যারা ভেবেছিলেন তার ন্যায়বিচার, শান্তি এবং সমতার স্বপ্নকে মুছে ফেলা যাবে, তারা এতদিনে বুঝে গেছেন যে, র‍্যান্টকে সরিয়ে দেওয়ার ফলে সারা বিশ্বে অগণিত র‍্যান্ট ডিঙ্কের জন্ম হয়েছে। তারা প্রত্যেকে বলছে, ‘আমি র‍্যান্ট ডিঙ্ক’। আমরা জানি, ন্যায়বিচার ও সমতার জন্য তাঁর সংগ্রাম চলমান। একটি জনপ্রিয় বৌদ্ধিক পরিবেশ তৈরির চলমান প্রচেষ্টায় বর্ণবাদ, গণহত্যা এবং বসতি স্থাপনকারী উপনিবেশবাদের বৈশ্বিক প্রতিরোধের কেন্দ্রীয় জায়গাটিতে আর্মেনীয় গণহত্যার সমসাময়িক প্রভাব অন্বেষণ করা হচ্ছে। র‍্যান্ট ডিঙ্ক-এর চেতনা বেঁচে আছে এবং দিন দিন আরও বেশি শক্তিশালী হচ্ছে।

র‍্যান্ট ডিঙ্ককে শ্রদ্ধা জানানো বহু বিশিষ্টজনের সঙ্গে নিজের নাম যুক্ত হতে দেখে আমি খুবই আনন্দিত। বলতে বাধা নেই, আমি সেই সঙ্গে কিছুটা ভয়ও পাচ্ছি। আপনারা যারা নিয়মিত এই বক্তৃতাগুলোয় উপস্থিত থাকেন, তাদের নিশ্চয়ই অরুন্ধতী রায়, নাওমি ক্লেইন, নোয়াম চমস্কি ও লইচ ওয়াকুয়ান্ট-এর কথা শোনার সুযোগ হয়েছে। আশা করি, আমি আপনাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব।

আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই, র‍্যান্ট ডিঙ্কের জীবন ও কর্মের স্মৃতি উদযাপন আমার প্রথম তুরস্ক সফরের জন্য একটি উপলক্ষ্য প্রদান করেছে। এটা বিশ্বাস করা মুশকিল যে, এই দেশ সফর করতে আমার প্রায় কয়েক দশক সময় লেগে গেল। অথচ খুব অল্প বয়সে আমি ইস্তাম্বুলে আসার স্বপ্ন দেখেছিলাম। বিশেষ করে তুরস্কের ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিকচর্চা এবং এই বিশ্ববিদ্যালয় ও আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জেমস বল্ডুইনের প্রভাবে। আমি যখন বড় হচ্ছিলাম, তখন স্মৃতিতে এবং চিন্তায় তরুণ জীবনে ফিরে যেতাম। সেই সময় যে কোনো খাঁটি কমিউনিস্টের মতো আমিও নাজিম হিকমতের লেখা পড়ে অনুপ্রাণিত হতাম। আমি যখন কারাগারে বন্দি হলাম, তুরস্ক থেকে আমার জন্য সংহতি প্রকাশমূলক বার্তা এবং আমার সমর্থনে আয়োজিত নানা অনুষ্ঠানের বর্ণনা পড়ে অনুপ্রাণিত হতাম, উৎসাহিত হতাম। ইতঃপূর্বে বলেছি যে, তুরস্কে এটা আমার প্রথম সফর, তা যেন এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ফ্র্যাংফার্টে গ্র্যাজুয়েট স্কুলে পড়ার সময় আমার বোন তুরস্ক ভ্রমণে এসেছিল। তাকে আমার জানাতে হবে যে, অবশেষে তার ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কাছাকাছি পৌঁছাতে আমার পঞ্চাশটি বছর লেগে গেল।

তাই আমার এই প্রথম তুরস্ক সফরে তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, যারা নিজেরা বা তাদের বাবা বা তাদের পিতামহ আমার মুক্তির দাবিতে সেই সময় আন্তর্জাতিক আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। আমি একসময় এফবিআইএর শীর্ষ ১০ আসামির তালিকাভুক্ত ছিলাম, যা আজকাল বেশ প্রশংসিত হয়। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকলে অনেক কিছুই দেখা যায়, যেমন দেখা গেল ইতিহাসের এই রূপান্তর ঘটানোর ক্ষমতার। কিন্তু তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বিশাল আন্তর্জাতিক প্রচার আন্দোলনের ব্যাপারটি। যার মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করা হয়েছিল। সব প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী বাধার বিরুদ্ধে আমরা জয়লাভ করেছিলাম। ভুলে যাবেন না যে,তখন রোনাল্ড রিগ্যান ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর, রিচার্ড নিক্সন ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং জেএডগার হুভার ছিলেন এফবিআইয়ের প্রধান।

আমি একসময় এফবিআইএর শীর্ষ ১০ আসামির তালিকাভুক্ত ছিলাম, যা আজকাল বেশ প্রশংসিত হয়। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকলে অনেক কিছুই দেখা যায়, যেমন দেখা গেল ইতিহাসের এই রূপান্তর ঘটানোর ক্ষমতার। কিন্তু তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বিশাল আন্তর্জাতিক প্রচার আন্দোলনের ব্যাপারটি। যার মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করা হয়েছিল। সব প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী বাধার বিরুদ্ধে আমরা জয়লাভ করেছিলাম।

মাঝে মাঝে আমাকে প্রশ্ন করা হয়, আমি কীভাবে স্মরণীয় হতে চাই। আমার জবাব হলো, ব্যক্তি আমাকে কীভাবে স্মরণ করা হবে তা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনটি যে জয়লাভ করেছিল, তা মানুষের স্মরণে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক অনতিক্রম প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে এই বিজয় অর্জিত হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেসব শক্তি এতটাই ক্ষিপ্ত ছিল যে, আমি নিরপরাধ থাকা সত্ত্বেও আমাকে হয় গ্যাস চেম্বারে মৃত্যুবরণ করতে হতো বা আজীবন কারাগারবাসী হতে হতো। ধন্যবাদ সেই আন্দোলনকে, যার অবদানে আমি আজ আপনাদের সঙ্গে মিলিত হয়েছি।

আরেকটি সংহতি আন্দোলনের মাধ্যমে আমি তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্কিত রয়েছি। সম্প্রতি তুরস্কে এফ-টাইপ কারাগারগুলোর বিরোধিতা করে আন্দোলন চলছে, কয়েকজন বন্দি আমরণ অনশনেও যোগ দিয়েছেন। আমি তাদের সঙ্গে সংহতি প্রচেষ্টায় অবদান রাখার চেষ্টা করছি। এছাড়া আমি আবদুল্লাহ ওসালান ও পিনার সেলেকদের মতো রাজনৈতিক বন্দিদের প্রতি সংহতি আন্দোলনেও সক্রিয় আছি।

আন্তর্জাতিক সংহতির পরিপ্রেক্ষিতে তুরস্কের সঙ্গে আমার যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক, তার ভিত্তিতে আজ আমার আলোচনার শিরোনাম হলো:‘বহুজাতিক সংহতি: বর্ণবাদ, গণহত্যাএবং বসতি স্থাপনকারী উপনিবেশিকতা প্রতিরোধ’। বিশ্বের বিভিন্ন অংশে, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক এবং অধিকৃত ফিলিস্তিনে চলমান আন্দোলনের সম্ভাব্য যোগসূত্রগুলোকে সংযুক্ত করার মাধ্যমে একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ তৈরি নিয়ে আমার আলোচনা।

‘গণহত্যা’ শব্দটি সাধারণত ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্যাসিবাদী দুর্যোগের পর গণহত্যার অপরাধ প্রতিরোধ ও শাস্তি সংক্রান্ত জাতিসংঘের কনভেনশন অনুসারে সংজ্ঞায়িত। আপনারা কেউ কেউ সম্ভবত সেই সম্মেলনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু আমি তা-ও সেটা উল্লেখ করছি: ‘কোনো নির্দিষ্ট জাতি, ধর্ম, বর্ণের জনগোষ্ঠীকে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ঘটানো নিম্নলিখিত কার্যক্রম যেমন: কোনো জনগোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা, মারাত্মক শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতিসাধন, উদ্দেশ্যমূলকভাবে ওই জনগোষ্ঠীর ওপর এমন জীবনব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া যার ফলে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে সেই জনগোষ্ঠী ধ্বংস হয়ে যায়, জনগোষ্ঠীর মধ্যে জন্ম রোধ করার উদ্দেশ্যে বিধিনিষেধ আরোপ করা এবং এক জনগোষ্ঠীর শিশুদের জোরপূর্বক অন্য জনগোষ্ঠীকে হস্তান্তর করা।’

১৯৪৮ সালে এই আইন পাস হয়েছিল। কিন্তু প্রায় চল্লিশ বছর পার হওয়ার পর ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ আইন কার্যকর হয়নি। এই কনভেনশনের তিন বছর পার হওয়ার পর সিভিল রাইটস কংগ্রেস জাতিসংঘের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ গণহত্যার অভিযোগ পেশ করে। ডব্লিউইবি ডু বয়েজ-এর মতো বিশিষ্টজন, যারা সেই সময় সরকারের হুমকিতে ছিলেন তারা এই পিটিশনে স্বাক্ষর করেছিলেন। পল রবসন নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘ কার্যালয়ে এই পিটিশন জমা দিয়েছিলেন এবং প্যারিসে জাতিসংঘের কাছে জমা দিয়েছিলেন সিভিল রাইটস কংগ্রেসের প্রধান উইলিয়াম এল পিটারসন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির একজন কৃষ্ণাঙ্গ সদস্য এবং বিখ্যাত আইনজীবী ছিলেন। তিনি স্কটসবরো নাইনকে রক্ষা করেছিলেন। পিটিশন জমা দিয়ে ফিরে আসার পর তার পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। এটা সেই সময়কাল যখন কমিউনিস্ট এবং কমিউনিস্ট হিসেবে অভিযুক্ত সবাই তীব্র আক্রমণের মুখে ছিল।

১৯৪৮ সালে এই আইন পাস হয়েছিল। কিন্তু প্রায় চল্লিশ বছর পার হওয়ার পর ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ আইন কার্যকর হয়নি। এই কনভেনশনের তিন বছর পার হওয়ার পর সিভিল রাইটস কংগ্রেস জাতিসংঘের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ গণহত্যার অভিযোগ পেশ করে।

পিটিশনের ভূমিকায় লেখা হয়: আমেরিকার নগরগুলোয় কালোদের অমানবিক বস্তি ও দক্ষিণের তুলোর আবাদভূমিতে জাতিগত গণহত্যা চালানোর দালিলিক প্রমাণ রয়েছে, প্রমাণ রয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে অকালমৃত্যু, দারিদ্র্য ও রোগ ছড়ানোর পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে জীবনকে বিকৃত করার ঘটনার। এটি এমন একটি দলিল, যা জাতিসংঘের গণহত্যার অপরাধ প্রতিরোধ ও শাস্তি সংক্রান্ত কনভেনশনকে দৈনন্দিন এবং ক্রমবর্ধমানভাবে লঙ্ঘন করার একটি দৃষ্টান্ত। এই ভয়ংকর অন্যায়ের অবসানের জন্য তীব্র নিন্দা জানানো হচ্ছে। ভূমিকায় আরও বলা হয়: ‘তাই আমরা মনে করি, বিচ্ছিন্নতা, বৈষম্য ও দীর্ঘদিন ধরে চলমান সন্ত্রাসের শিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিপীড়িত নিগ্রো নাগরিকরা সরকারের প্রতিটি শাখার ধারাবাহিক, সচেতন, একীভূত নীতিমালার ফলাফল স্বরূপ গণহত্যার শিকার।’

এরপর তারা উল্লেখ করেন, কনভেনশন অনুসারে দলটির সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ তারা জমা দেবেন। ১৯৫১ সালে পুলিশ, কু ক্লাক্স ক্লান এবং অন্যান্য বর্ণবাদী গ্যাং-এর মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। হাজার হাজার মানুষের ব্যাপারে দালিলিক প্রমাণ রয়েছে যাদের ‘ডান্ডা বেড়ি পরানো অবস্থায় ও শেরিফের অফিসের পেছনের কক্ষে, কাউন্টি জেলের সেলে, আঞ্চলিক থানা এবং শহরের রাস্তাগুলোয় পিটিয়ে মারা হয়। তাদের ভুয়া আইনি কাঠামো এবং আইনি আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে ফাঁসিয়ে হত্যা করা হয়।’ তারা এটাও উল্লেখ করেন, শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিকে ‘স্যার’ বলতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য অথবা তাদের টুপি নড়াচড়া বা অন্যদিকে সরানোর অভিযোগে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গকে হত্যা করা হয়েছে।

১৯৫১ সালে পুলিশ, কু ক্লাক্স ক্লান এবং অন্যান্য বর্ণবাদী গ্যাং-এর মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। হাজার হাজার মানুষের ব্যাপারে দালিলিক প্রমাণ রয়েছে যাদের ‘ডান্ডা বেড়ি পরানো অবস্থায় ও শেরিফের অফিসের পেছনের কক্ষে, কাউন্টি জেলের সেলে, আঞ্চলিক থানা এবং শহরের রাস্তাগুলোয় পিটিয়ে মারা হয়। তাদের ভুয়া আইনি কাঠামো এবং আইনি আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে ফাঁসিয়ে হত্যা করা হয়।’ তারা এটাও উল্লেখ করেন, শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিকে ‘স্যার’ বলতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য অথবা তাদের টুপি নড়াচড়া বা অন্যদিকে সরানোর অভিযোগে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গকে হত্যা করা হয়েছে।

আমি আলোচনার শুরুতেই গণহত্যার বিরুদ্ধে এই ঐতিহাসিক পিটিশনের ব্যাপারটি উল্লেখ করছি। কারণ, আর্মেনীয়দের গণহত্যা, তাদের মৃত্যুর মিছিল এবং শিশুদের অপহরণ করে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ভুলিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে আধিপত্যবাদীদের সংস্কৃতিকে মিশিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে ঠিক একই অভিযোগ পেশ করা যেত। ফেথিয়ে সেটিন লিখিত একটি খুবই আবেদনময়ী আত্মজীবনী ‘মাই গ্র্যান্ডমাদার, অ্যান আর্মেনিয়ান টার্কিশ মেমোয়ার’ পড়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখান থেকে আমি জেনেছি, প্রায় ২০ লাখ তুর্কি মানুষের কমপক্ষে একজন আর্মেনীয় বংশোদ্ভূত পিতামহ বা মাতামহ ছিল। এবং বিদ্যমান বর্ণবাদিতার কারণে প্রচুর তুর্কিকে তাদের নিজেদের পারিবারিক ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া হয়েছিল।

প্রায় ২০ লাখ তুর্কি মানুষের কমপক্ষে একজন আর্মেনীয় বংশোদ্ভূত পিতামহ বা মাতামহ ছিল। এবং বিদ্যমান বর্ণবাদিতার কারণে প্রচুর তুর্কিকে তাদের নিজেদের পারিবারিক ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া হয়েছিল।

‘মাই গ্র্যান্ডমাদার’ বইটি পড়তে গিয়ে আমার ক্লডে মিলাসক্স নামের ফরাসি মার্কসবাদী নৃতত্ত্ববিদের কাজের কথা মনে পড়ে গেল। পূর্বপূরুষদের ব্যাপারে চাপিয়ে দেওয়া নীরবতা প্রসঙ্গে তার লেখা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল, তার দাসত্বের সংজ্ঞার মূলে রয়েছে সামাজিক মৃত্যুর ধারণা। তিনি দাসকে সামাজিকভাবে মৃত হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন: দাস হলো এমন এক ব্যক্তি, যার জন্মই হয়নি। পূর্বপুরুষের পরিচয়ে স্বীকৃত না-হতে পারার ফলে সামষ্টিকভাবে তারা গুরুতর মানসিক ক্ষতির শিকার হয়েছে। আমার বয়সি আফ্রিকার বংশোদ্ভূত যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আছেন, তারা এই অনুভূতিটার সঙ্গে পরিচিত। কারণ, তারা আমার মতোই মাতামহের পর আর পূর্বপুরুষের ঠিকুজি বের করতে পারেনা। পূর্বপুরুষ বঞ্চিত জীবন বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করে। মাই গ্র্যান্ডমাদার বইটিতে জাতিগত শুদ্ধীকরণ, মৃত্যুর মিছিল এবং জেন্ডারমাদের (ফরাসি পুলিশবাহিনী) দ্বারা হত্যাকাণ্ডের প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হচ্ছিল। সেখানে বলা হচ্ছে, তারা যখন একটি সেতু অতিক্রম করছিল, তখন মাতামহী তারনিজের দুই নাতি-নাতনিকে পানিতে ফেলে দিয়েছিলেন। শিশুরা ডুবে গিয়েছে এটা নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি নিজেও পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। আমার জন্য দৃশ্যটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রীতদাস মায়েদের ঐতিহাসিক বিবরণের সঙ্গে মিলে যায়, যারা দাসত্বের সহিংসতা থেকে রক্ষা করার জন্য নিজেদের সন্তানদের হত্যা করেছিলেন। টনি মরিসনের উপন্যাস ‘বেলাভেড’, মার্গারেট গার্নারের আখ্যানের ওপর ভিত্তি করে লেখা এমনই এক কাহিনি। উপন্যাসটির জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

আমি ১৯৫১ সালের গণহত্যার পিটিশনের কথা স্মরণ করছি। কারণ, সেই পিটিশনে বর্ণিত অনেকগুলো শর্ত আজও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যমান। এই বিশ্লেষণ আমাদের বুঝতে সাহায্য করে, গণহত্যার ইতিহাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সমসাময়িক বর্ণবাদী রাষ্ট্রীয় সহিংসতা কতটা গভীরভাবে নিহিত রয়েছে। এর মধ্যে অবশ্যই আমেরিকার আদিবাসীদের গণহত্যার উপনিবেশ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ঐতিহাসিক ক্রেইগ ওয়াইল্ডারের একটি সাম্প্রতিক বইয়ে উল্লিখিত হয়েছে–হার্ভার্ড, ইয়েল, প্রিন্সটন ইত্যাদি বিশ্বজুড়ে সর্বত্রই স্বীকৃত আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দাসত্বের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠে। তিনি আবিষ্কার করেন, তিনি একইসঙ্গে আদিবাসী আমেরিকানদের গণহত্যামূলক ঔপনিবেশীকরণের গল্প না-বলে দাসত্ব এবং মার্কিন উচ্চশিক্ষার গল্প বলতে পারেন না। আমি মনে করি, এটি তার গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক।

ঐতিহাসিক ক্রেইগ ওয়াইল্ডারের একটি সাম্প্রতিক বইয়ে উল্লিখিত হয়েছে–হার্ভার্ড, ইয়েল, প্রিন্সটন ইত্যাদি বিশ্বজুড়ে সর্বত্রই স্বীকৃত আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দাসত্বের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠে। তিনি আবিষ্কার করেন, তিনি একইসঙ্গে আদিবাসী আমেরিকানদের গণহত্যামূলক ঔপনিবেশীকরণের গল্প না-বলে দাসত্ব এবং মার্কিন উচ্চশিক্ষার গল্প বলতে পারেন না।

আমি মনে করি, এ ধরনের সত্য প্রকাশ বৃহত্তর পর্যায়ে পদ্ধতিগত জায়গায় প্রভাব ফেলে। আমাদের তাই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ইতিহাস কখনো বিচ্ছিন্নভাবে বিকশিত হয় না। অন্য গল্পগুলো না-জেনে আমরা যাকে আমাদের নিজস্ব ইতিহাস বলে মনে করি, তাকে সত্যি বলতে পারি না। কালো নারীবাদী সমাজবিজ্ঞানী জ্যাকি আলেকজান্ডারের উপদেশ হচ্ছে: ‘লার্ন ইওর সিস্টার্স স্টোরিজ’ অর্থাৎ‘আপনার বোনদের গল্প জানুন’। একটি একটি দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া, যার জন্য আমাদের গল্পগুলোকে ক্রমাগত পুনরায় বলা, তাদের পুনর্বিবেচনা করা এবং সেগুলো পুনরায় বলা এবং পুনরায় চালু করা প্রয়োজন। আমরা তাই এভাবে ভান করতে পারি না যে আমরা জাতি, শ্রেণি, জাতিগততা, জাতীয়তা, যৌনতা এবং যোগ্যতার মধ্যকার সংযোগ সম্পর্কে জানি না।

অন্য গল্পগুলো না-জেনে আমরা যাকে আমাদের নিজস্ব ইতিহাস বলে মনে করি, তাকে সত্যি বলতে পারি না। কালো নারীবাদী সমাজবিজ্ঞানী জ্যাকি আলেকজান্ডারের উপদেশ হচ্ছে: ‘লার্ন ইওর সিস্টার্স স্টোরিজ’ অর্থাৎ‘আপনার বোনদের গল্প জানুন’।

আমি এখানে আসার পর থেকে শিখেছি (আসলে এখানে আমার মাত্র আড়াই দিন), আপনাদের তুর্কি হিসেবে উল্লেখ না-করে ‘তুরস্কে বসবাসকারী’ হিসেবে উল্লেখ করা ভালো। আপনারা এই দেশের সাম্রাজ্যিক অতীতকে কীভাবে মোকাবিলা করবেন, সে বিষয়ে আমি আপনাদের নসিহত করতে পারিনা। কিন্তু র‍্যান্ট ডিঙ্ক, ফেথিয়ে সেটিন এবং অন্যদের কাছ থেকে শিখেছি, স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারতে হবে, বাক্‌স্বাধীনতার চর্চা করতে পারতে হবে। অটোমান সাম্রাজ্যের শেষে তথাকথিত জনসংখ্যা আদান-প্রদানসহ জাতিগত-শুদ্ধীকরণ প্রক্রিয়ায় অসংখ্য গ্রিক, সিরিয়ান এবং অবশ্যই আর্মেনীয়দের ওপর অগণিত ধরনের সহিংসতাকে ঐতিহাসিক রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কোনো বাস্তব সামাজিক রূপান্তর ঘটানোর আগে তো বটেই, এমনকি কল্পনা করার আগেই এই ঘটনাবলি এবং কুর্দি জনগণের ইতিহাস সম্পর্কে জনগণের মধ্যে আলাপ-আলোচনার সূত্রপাত করতে হবে।

আমি আপনাদের কাছে বলছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমরা এমন এক অসুবিধার মধ্যে রয়েছি যে, সেখানকার আদিবাসীরা কীভাবে গণহত্যার শিকার হয়েছেন, সে বিষয়ে আমরা কথা বলতে জানিনা। আমরা দাসত্বের কথা বলতে জানি না। নইলে, শুধু একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত করার কারণেই আমরা একটি বর্ণবাদ-উত্তর যুগে প্রবেশ করেছি বলে ধরে নেওয়া হতো না। আমরা স্বীকার করি না, আমরা সবাই ঔপনিবেশিত ভূমিতে বাস করি। এবং এরই মধ্যে আদিবাসী আমেরিকানরা রিজার্ভেশন বা সংরক্ষিত অঞ্চলগুলোয় দরিদ্র অবস্থায় বাস করে। তাদের কারাবরণের হার অতি উচ্চ, যা প্রকৃতপক্ষে মাথাপিছু হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্যদের সঙ্গে তুলনায় তারা অসম অনুপাতে মদ্যপান করে এবং ডায়াবেটিসের মতো রোগে ভোগে। ইতিমধ্যে, ওয়াশিংটন রেডস্কিনসের মতো ক্রীড়া দলগুলোএখনো জাতিগতভাবে অবমাননাকর নাম দিয়ে আদিবাসীদের উপহাস করে। নির্যাতক ও ভুক্তভোগীর কাঠামোর বাইরে দাসত্ব নিয়ে কথা বলতে আমরা জানিনা। আর এই কাঠামো তো শুধু মানুষের মধ্যে মেরুকরণ ঘটায় এবং দোষী সাব্যস্ত করে।

আদিবাসী আমেরিকানরা রিজার্ভেশন বা সংরক্ষিত অঞ্চলগুলোয় দরিদ্র অবস্থায় বাস করে। তাদের কারাবরণের হার অতি উচ্চ, যা প্রকৃতপক্ষে মাথাপিছু হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্যদের সঙ্গে তুলনায় তারা অসম অনুপাতে মদ্যপান করে এবং ডায়াবেটিসের মতো রোগে ভোগে।

কিন্তু আমি এটা বলতে পারি যে, ক্রমবর্ধমানভাবে, তরুণ কর্মীরা শিখছে পরস্পর সম্পর্কিত এই গল্পগুলোর সংযোগস্থলকে কীভাবে স্বীকার করতে হয়। অতএব, যখন আমরা সাম্প্রতিক সময়ে মূলত তরুণ কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বহুল শ্রুত অটল বর্ণবাদী সহিংসতার একটি বিশ্লেষণ তৈরির চেষ্টা করি, তখন আমরা এই বর্ণবাদী সহিংসতার প্রেক্ষাপটকে ভুলতে পারি না।

এখানে তুরস্কে আপনারা সবাই অবগত আছেন যে, গত শরৎ এবং গ্রীষ্মকালে ফার্গুসন, মিসৌরি, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো, পশ্চিম উপকূলসহ গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষ রাস্তায় নেমে সম্মিলিতভাবে ঘোষণা করেছিল যে, তারা বর্ণবাদী রাষ্ট্রীয় সহিংসতাকে অস্বীকার করে। মানুষ বলছিল: ‘ন্যায়বিচার নেই, শান্তি নেই, বর্ণবাদী পুলিশ নেই।’ পুলিশের নিয়মিত কার্যক্রম এবং পুলিশের সঙ্গে জেলা অ্যাটর্নিদের গোপন আঁতাতের বিপরীতে দাড়িয়ে জনগণ বলছে, কালোদের জীবন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এবং আমরা রাস্তায় নামব এবং আমাদের আওয়াজ তুলব যতক্ষণ-না আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, একটি পরিবর্তন এজেন্ডাভুক্ত হয়েছে। শরৎকালে সারা বিশ্বের মানুষের কাছ থেকে একাত্মতার বার্তায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্লাবিত হয়েছে। শুধু মিসৌরির ফার্গুসনে মাইকেল ব্রাউনকে হত্যাকারী পুলিশ অফিসারকে অভিযুক্ত করতে ব্যর্থতার ক্ষেত্রেই নয়, এরিক গার্নারের ক্ষেত্রে জুরি (নিউইয়র্ক শহরে) গ্র্যান্ডের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া হিসেবেও এই প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। আক্ষরিক অর্থে সারা বিশ্বের এই বিক্ষোভগুলো খুব স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে যে, বহুজাতিক সংহতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশাল এক সম্ভাবনা রয়েছে।

এক অর্থে এর মানে হলো, এই নব্য উদার যুগে আবদ্ধ সেই ব্যক্তিবাদ থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ হতে পারে আমাদের। নব্য উদারনৈতিক ভাবাদর্শ ব্যক্তির প্রতি, নিজের প্রতি, ব্যক্তি ভুক্তিভোগী ও ব্যক্তি নিপীড়কের দিকে আমাদের সমস্ত মনোযোগ ধাবিত করে। কিন্তু কীভাবে বর্ণবাদী রাষ্ট্রীয় সহিংসতার বৃহত্তর সমস্যার সমাধান করা সম্ভব? আমরা কি ব্যক্তি পুলিশ কর্মকর্তাদের ওপর সেই বর্ণবাদের ইতিহাসের বোঝা আরোপ করে এবং তাদের বিচার করার মাধ্যমে, তাদের প্রতি আমাদের প্রতিশোধ নেওয়ার মাধ্যমে সহিংসতা নির্মূল করার ক্ষেত্রে একরকম অগ্রগতি অর্জন করেছি বলে সন্তুষ্টি পাব? যদি কেউ মনে করেন, বিশ্ব সংহতির এই বিশাল অভিব্যক্তিগুলোর মনোযোগ কেবল ব্যক্তি পুলিশ কর্মকর্তাদের বিচার কেন হয়নি, সেই দিকে, তাহলে তা খুব সামান্যই কাজের হবে। আমি বলছি-না যে, ব্যক্তিকে জবাবদিহির আওতায় আনার কোনো দরকার নেই। বর্ণবাদ, সন্ত্রাসের এমন সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত প্রতিটি ব্যক্তিকে অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। কিন্তু আমি বলতে চাচ্ছি যে, এ ধরনের সহিংসতাকে সম্ভব করে তোলা সামাজিক-ঐতিহাসিক শর্তগুলোর বিরুদ্ধে তৈরি প্রকল্পগুলো আমাদের আঁকড়ে ধরতে হবে।

বর্ণবাদ, সন্ত্রাসের এমন সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত প্রতিটি ব্যক্তিকে অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। কিন্তু আমি বলতে চাচ্ছি যে, এ ধরনের সহিংসতাকে সম্ভব করে তোলা সামাজিক-ঐতিহাসিক শর্তগুলোর বিরুদ্ধে তৈরি প্রকল্পগুলো আমাদের আঁকড়ে ধরতে হবে।

কিছু দিন ধরে আমি শাস্তির প্রধান উপায় হিসেবে মৃত্যুদণ্ড এবং কারাদণ্ডকে বাতিল করার প্রচেষ্টায় সক্রিয় আছি। মৃত্যুদণ্ড এবং কারাদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে অশ্বেতাঙ্গদের সংখ্যা বিশাল। শুধু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কারাভোগের শিকারদের প্রতি সহানুভূতির জন্য আমার এই বিরোধী অবস্থান নয়। মূলত শাস্তির এই পদ্ধতিগুলো কাজ করে না। কারণ, অধিকাংশ কারাবন্দি সমাজের একটি ব্যর্থতাকে নির্দেশ করে। তাদের শিক্ষা বা চাকরি বা আবাসন বা স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার ছিল না। অপরাধীকরণ এবং কারাদণ্ড অন্য সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারে না।

এসবের মাধ্যমে যৌন সহিংসতার সমস্যারও সমাধান হয়না। সম্প্রতি ‘কার্সারাল ফেমিনিজম’ বা ‘কারাদণ্ডবাদী নারীবাদ’ কথাটি বেশ শোনা যাচ্ছে। লৈঙ্গিক সহিংসতায় লিপ্তদের অপরাধীকরণ এবং জেলে ঢোকানোর আহ্বান জানায় এই নারীবাদ। কার্সারাল ফেমিনিজম রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করে। কার্সারাল ফেমিনিজম বা কারাদণ্ডবাদী নারীবাদ নিশ্চিতভাবেই রাষ্ট্রের হয়ে কাজ করে, যখন তা পিতৃতান্ত্রিকতা ও যৌন সহিংসতার সমাধান হিসেবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নিপীড়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। কিন্তু যারা রাষ্ট্রের দমনমূলক কাজে সরাসরি জড়িত, তাদের জন্য এটি কাজ করে না। বর্ণবৈষম্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কেবল সাদা পুলিশ কর্মকর্তারাই অশ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়কে অপরাধী করে তোলে না। কাঠামোগত কারণে কৃষ্ণাঙ্গসহ অন্যান্য পুলিশ অফিসারও এই বর্ণবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাদের ব্যক্তিগত ধারণা থেকে নয়, কাঠামোগত বর্ণবাদিতা তাদের পুলিশি দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেয়। আমরা হিংসাত্মক কার্যক্রমের বিরোধিতা করছি। কিন্তু শুধু ব্যক্তিকে দায়ী করে অসাবধানতাবশত আমরা আসলে তার পুনরুত্পাদন করার প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে যাই।

বর্ণবৈষম্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কেবল সাদা পুলিশ কর্মকর্তারাই অশ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়কে অপরাধী করে তোলে না। কাঠামোগত কারণে কৃষ্ণাঙ্গসহ অন্যান্য পুলিশ অফিসারও এই বর্ণবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাদের ব্যক্তিগত ধারণা থেকে নয়, কাঠামোগত বর্ণবাদিতা তাদের পুলিশি দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেয়। আমরা হিংসাত্মক কার্যক্রমের বিরোধিতা করছি। কিন্তু শুধু ব্যক্তিকে দায়ী করে অসাবধানতাবশত আমরা আসলে তার পুনরুত্পাদন করার প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে যাই।

কীভাবে আমরা প্রাথমিকভাবে ব্যক্তি অপরাধীদের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করার এই কাঠামোর বাইরে যেতে পারি? মিসৌরির ফার্গুসনে মাইকেল ব্রাউনের ক্ষেত্রে, তাদের সামরিক পোশাক, সামরিক যানবাহন এবং সামরিক অস্ত্রের দৃশ্যমান চিত্রগুলোর কারণে আমরা দ্রুত পুলিশকে সামরিকীকরণের বিষয়ে জানতে পারি। নাইন-ইলেভেনের পর থেকে ইসরায়েল সারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজে জড়িত হয়েছে। ইসরায়েলি সরকারের সহায়তায় সারা দেশে পুলিশবাহিনীর আংশিক সামরিকীকরণ সম্পন্ন হয়েছে। সেইন্ট লুইস কাউন্টির টিমোথি ফিচ নামে পুলিশপ্রধানের অধীন ফার্গুসনে সহিংসতা সংঘটিত হয়েছিল। সেইন্ট লুইসের একটি ছোট্ট শহরের নাম ফার্গুসন। এই পুলিশপ্রধান টিমোথি ফিচ ইসরায়েল থেকে ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। সারা দেশ থেকে কাউন্টি শেরিফ এবং পুলিশ কর্মকর্তা, এফবিআই এজেন্ট এবং বোমার কারিগর ইসরায়েলে সন্ত্রাস দমনের প্রশিক্ষণ নিতে যাচ্ছে।

নাইন-ইলেভেনের পর থেকে ইসরায়েল সারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজে জড়িত হয়েছে। ইসরায়েলি সরকারের সহায়তায় সারা দেশে পুলিশবাহিনীর আংশিক সামরিকীকরণ সম্পন্ন হয়েছে।

আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হলো, পুলিশবাহিনীর বর্ণবাদিতা, বিশেষ করে সাদা পুলিশ কর্তৃক কালো মানুষের প্রতি সহিংসতার এক লম্বা ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস আমাদের দাসযুগের দিকে নিয়ে যাবে। কিন্তু বর্তমান বর্ণবাদিতার প্রেক্ষিত অত্যন্ত পরিষ্কার একটি ব্যাপার। আর সন্ত্রাসবাদ এবং সন্ত্রাসবাদবিরোধী তত্ত্ব ও অনুশীলনের মাধ্যমে বর্ণবাদের পুনরুৎপাদন ও জটিলকরণের উপায়গুলো খতিয়ে দেখলে, তখন এমন এক রাজনৈতিক জোটের সম্ভাবনা প্রবল হয়, যা আমাদের বহুজাতিক সংহতির দিকে পরিচালিত করে। গত গ্রীষ্মে ফার্গুসনে বিক্ষোভের সময় দারুণ একটি ব্যাপার ঘটেছিল। ফিলিস্তিনি কর্মীরা সোশ্যাল মিডিয়া এবং টেলিভিশনে বিক্ষোভের ছবিগুলো দেখে বুঝতে পারেন যে, ফার্গুসনে বিক্ষোভ দমনে একই টিয়ারগ্যাসের ক্যানিস্টারগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে, যা অধিকৃত ফিলিস্তিনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। টিয়ারগ্যাস ক্যানিস্টারের গায়ে ‘সিটিএস’ স্ট্যাম্প লাগানো ছিল। সিটিএস একটি মার্কিন কোম্পানি, যার নাম হলো ‘কম্বাইন্ড ট্যাক্টিক্যাল সিস্টেম’ (Combined Tactical System)। ফিলিস্তিনি বিদ্রোহীরা ফার্গুসনে এই একই টিয়ারগ্যাস ক্যানিস্টার দেখে ফার্গুসনের বিদ্রোহীদের টুইট করে জানিয়ে দেয় কীভাবে এই গ্যাস প্রতিহত করতে হবে। অন্যান্য পরামর্শের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল: পুলিশের থেকে বেশি দূরত্বে থেকো না। যদি তোমরা তাদের কাছে থাক, তাহলে তোমাদের গ্যাসে আক্রান্ত করতে পারবে না; বরং তারা নিজেরাই আক্রান্ত হবে। ফার্গুসনের তরুণ কর্মীরা,যারা সম্ভবত তাদের জীবনে প্রথমবারের মতো টিয়ারগ্যাসের মুখোমুখি হয়েছিল, তারা একগাদা আসলেই দারুণ সব মন্তব্য পেয়েছিল। আমাদের কিছু বয়স্ক কর্মীর মতো তাদের কাঁদানে গ্যাসের অভিজ্ঞতা ছিল না।

আমি বলার চেষ্টা করছি, বর্ণবাদী পুলিশি সহিংসতার ক্রমাগত বিস্তার এবং অধিকৃত ফিলিস্তিন, ওয়েস্ট ব্যাংক এবং বিশেষ করে গাজায় যেখানে সাম্প্রতিক গ্রীষ্মে সামরিক সহিংসতার কারণে মানুষের ওপর ক্রমাগত হামলা চলছে, এই ক্রমাগত হামলা বিশ্লেষণ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের সামরিকীকরণের সঙ্গে সংযোগ আমাদের একটি ভিন্ন দিক দেখায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত রাজনৈতিক বন্দি আসসাটা শাকুরের বিষয়টিও আলোচনায় আনতে চাই। আসসাটা ১৯৮০-র দশক থেকে কিউবায় বসবাস করছেন। কিছুদিন আগে পর্যন্ত তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর দশ জন সন্ত্রাসীর একজন ছিলেন। আমিও যেহেতু এফবিআইয়ের শীর্ষ দাগি আসামির তালিকাভুক্ত ছিলাম, তাই আমি আপনাদের ভাবতে বলব, কী কারণে তারা আসসাটা শাকুরকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। আপনারা তার ইতিহাস পড়তে পারেন। তার আত্মজীবনী অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি পাঠ। মিথ্যা, প্রতারণামূলকভাবে অপরাধের একটি লম্বা পরিসরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল। আমি সেসব উল্লেখও করব না। আপনারা তার জীবনীতে এই সম্পর্কে পড়তে পারেন। সর্বশেষ অভিযোগ বাদে প্রতিটি অভিযোগে তাকে নির্দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। আমি তার আত্মজীবনীর দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা লিখেছিলাম। আমার চেয়ে কয়েক বছরের কম বয়সি আসসাটারবয়স এখন ষাটের কোঠার শেষের দিকে। তিনি কিউবায় একটি কর্মময় জীবনযাপন করছেন। সেখানে তিনি পড়ালেখা করেছেন এবং শিক্ষকতা ও শিল্পকর্মে নিযুক্ত আছেন। তাহলে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি আকস্মিকভাবে কেন সিদ্ধান্ত নেবে যে, সে বিশ্বের দশজন শীর্ষ দাগি সন্ত্রাসীর একজন?

আমার চেয়ে কয়েক বছরের কম বয়সি আসসাটারবয়স এখন ষাটের কোঠার শেষের দিকে। তিনি কিউবায় একটি কর্মময় জীবনযাপন করছেন। সেখানে তিনি পড়ালেখা করেছেন এবং শিক্ষকতা ও শিল্পকর্মে নিযুক্ত আছেন। তাহলে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি আকস্মিকভাবে কেন সিদ্ধান্ত নেবে যে, সে বিশ্বের দশজন শীর্ষ দাগি সন্ত্রাসীর একজন?

বিংশ শতাব্দীর শেষের দিককার কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তি আন্দোলনের একজন নারী নেত্রীকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে প্রকৃতপক্ষে গোটা কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তি আন্দোলনকেই অতীতের কাজের জন্য অপরাধীকরণের চেষ্টা চালানো হয়। আর এই কাজটি এমন পদ্ধতিগতভাবে করা হয় যে, আমার কাছে এটাকে বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকে মানুষকে দূরে রাখার একটা প্রচেষ্টা বলে মনে হয়। এই কারণে আমি সবসময় ‘সন্ত্রাসী’ শব্দটি ব্যবহারে সতর্ক থাকি। আমরা অজ্ঞাত সন্ত্রাসের ইতিহাস সহ্য করেছি জেনেই আমি সবসময় এত সতর্ক থাকি। দক্ষিণের সর্বাপেক্ষা বিচ্ছিন্নকৃত শহরের একজন অধিবাসী হিসেবে আমার মনে প্রথম যে স্মৃতি ভেসে ওঠে তা হলো, রাস্তার ওপারের বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার। শুধু একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির ওই বাড়ি কেনার অপরাধে সেখানে বোমা বিস্ফোরিত হয়েছিল। বাড়ি এবং চার্চের ওপর বোমা নিক্ষেপকারী কু ক্লাক্স ক্ল্যানের মানুষকে আমরা চিনতাম। ১৯৬৩ সালে সিক্সটিনথ স্ট্রিট ব্যাপটিস্ট চার্চে বোমা হামলা হয়তো আপনাদের পরিচিত একটি ঘটনা। সেই বোমা বিস্ফোরণে আমার পরিবারের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ চার কিশোরী মারা গিয়েছিল। এটা কিন্তু কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। সবসময় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটত। কেন সেই সময়কাল একটা সন্ত্রাসের সময় হিসেবে স্বীকৃত হলো না? তাই আমি এই ‘সন্ত্রাসী’ শব্দটির ব্যবহার সম্পর্কে খুবই সতর্ক থাকি। কারণ, প্রায় সবক্ষেত্রেই এই শব্দটি ব্যবহারের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে।

১৯৬৩ সালে সিক্সটিনথ স্ট্রিট ব্যাপটিস্ট চার্চে বোমা হামলা হয়তো আপনাদের পরিচিত একটি ঘটনা। সেই বোমা বিস্ফোরণে আমার পরিবারের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ চার কিশোরী মারা গিয়েছিল। এটা কিন্তু কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। সবসময় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটত। কেন সেই সময়কাল একটা সন্ত্রাসের সময় হিসেবে স্বীকৃত হলো না? তাই আমি এই ‘সন্ত্রাসী’ শব্দটির ব্যবহার সম্পর্কে খুবই সতর্ক থাকি। কারণ, প্রায় সবক্ষেত্রেই এই শব্দটি ব্যবহারের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে।

আলোচনার শেষ পর্যায়ে আমি নারীবাদী তত্ত্ব ও বিশ্লেষণের গুরুত্ব নিয়ে কিছু বলতে চাই। আমি শুধু নারী দর্শকদের উদ্দেশ্য করে বলছি না। কারণ, আমরা যারা গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করে বিপ্লবের কাজ সংগঠিত করি, তাদের সবার জন্য নারীবাদ একটি পদ্ধতিগত নির্দেশিকা দেয়। নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সামাজিক সম্পর্কের বোঝাপড়া বিকাশের আহ্বান জানায়, যাদের সংযোগগুলো প্রায়ই প্রাথমিকভাবে অন্তর্নিহিত হয়। প্রত্যেকেই‘ব্যক্তিগত মানেই রাজনৈতিক’স্লোগানের সঙ্গে পরিচিত। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমরা যা অনুভব করি, শুধু তার ওপর গভীর রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে তা নয়, আমাদের অভ্যন্তরীণ জীবন, আমাদের আবেগময় জীবন রাজনৈতিক আদর্শ দ্বারা অনেক বেশি প্রভাবিত। আমরা নিজেরাই প্রায়ই আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে রাষ্ট্রের জন্য কাজ করি। আমরা যাকে প্রায়ই আমাদের নিজেদের এবং আমাদের আবেগময় জীবনের সঙ্গে অন্তর্নিহিত বলে অনুমান করি, তা আসলে অন্যত্র উত্পাদিত হয় এবং বর্ণবাদ ও দমনমূলক কাজ করার জন্য তাকে নিয়োগ করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, বৈশ্বিক এই পুঁজিবাদের যুগে করপোরেশনগুলো শিখেছে: কীভাবে আমাদের জীবনের বিষয়গুলোয় প্রবেশ করে আমাদের গভীরতম স্বপ্নগুলোকে ব্যাবসায়িক পণ্যে পরিণত করতে হয়। তাই আমরা বিনিময় মূল্যকে এমনভাবে আত্তীকরণ করেছি, যাপুঁজির লেখকের কাছে সম্পূর্ণ অকল্পনীয় ছিল।

আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হলো, আমরা অনেক সময় যে বিষয়গুলো বিচ্ছিন্ন মনে করি, সেগুলো যে আসলে বিভিন্ন উপায়ে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তা বৃহৎ করপোরেশনগুলো ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। এমনই একটি করপোরেশন হলো জিফোরএস (G4S)। জিফোরএস পৃথিবীর বৃহত্তম নিরাপত্তা করপোরেশন। আমি জিফোরএস-এর কথা তুলছি; কারণ, আমি নিশ্চিত, তারা ফ্রান্সের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে এমন সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে যে, তা ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম বা বিপর্যয়ের পুঁজিবাদ নিয়ে নাওমি ক্লেইনের বিশ্লেষণের কথা মনে করিয়ে দেবে। ইসরায়েলের প্যালেস্টাইন দখলে জিফোরএস একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে: কারাগার পরিচালনা, চেকপোস্টগুলোর প্রযুক্তিতে জড়িত থাকা। বৈধ কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের হত্যাকাণ্ডেও তারা জড়িত ছিল। জিমি মুবেংগার কেসটি গুরুত্বপূর্ণ। এঙ্গোলায় নির্বাসনে পাঠানোর সময় ব্রিটিশ জিফোরএস গার্ড পথিমধ্যে তাকে হত্যা করে। দক্ষিণ আফ্রিকায় জিফোরএস বেসরকারি কারাগার পরিচালনা করে। সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশে জিফোরএস একটি বৃহত্তম নিয়োগকারী করপোরেশন। এই মেগাকরপোরেশনটি মালিক হিসেবে কারাগার পরিচালনা করে, সামরিক বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করে, সংগীততারকাদের নিরাপত্তা সেবা দেয়, নির্যাতিত নারী এবং‘ঝুঁকিতে থাকা তরুণীদের’ জন্য সেবা সংস্থা পরিচালনা করে। আমি এটা উল্লেখ করছি; কারণ, তারা সংযোগগুলো যেভাবে আয়ত্ত করেছে, তা অনেক আগে আমাদের পারা উচিত ছিল।

প্রসঙ্গে যখন বলছি, শুনলাম শিক্ষার্থীরা সাফল্যের সঙ্গে স্টারবাকসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। আজ কি ক্যাম্পাসে স্টারবাকসের শেষ দিন? হালেলুয়া! বিশেষ করে যেহেতু তুর্কি কফি গুণেমানে স্টারবাকসের চেয়ে এত উন্নত যে, স্টারবাকস তা অর্জন করার আশাও করতে পারবে না।

আমার শেষ উদাহরণটিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে নেওয়া। কিন্তু তা এমন এক বৈশ্বিক মহামারি প্রসঙ্গে, যা থেকে কোনো দেশই বাদ পড়েনি। আমি যৌন সহিংসতা, যৌন হয়রানি, যৌন নিপীড়নের কথা বলছি। ব্যক্তিগত সহিংসতা আর রাষ্ট্রীয় সহিংসতা কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। কীভাবে সহিংসতার অনুশীলনে লিপ্ত হতে হয়, তা ব্যক্তিগত সহিংসতার অপরাধীরা কোথা থেকে শেখে? কে তাদের শেখায় যে সহিংস আচরণ করা ঠিক আছে? কিন্তু এটা ভিন্ন প্রশ্ন। মারিসা আলেকজান্ডার নামে একজন তরুণীর বিষয় উল্লেখ করতে চাই। আপনারা মাইকেল ব্রাউন এবং এরিক গার্নারের নাম জানেন। আমি এই তালিকায় কৃষ্ণাঙ্গ নারী মারিসা আলেকজান্ডারের নাম যোগ করতে চাই। মারিসা তার নিপীড়ক স্বামীর নির্যাতন থেকে আত্মরক্ষার জন্য চরম পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি শূন্যে গুলিবর্ষণ করেছিলেন। তাতে কিন্তু কারোর আঘাত লাগেনি। একই জুডিশিয়াল কোর্টে যেখানে ট্রাভিয়ন মার্টিনের হত্যাকারী জর্জ জিমারম্যানকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, সেই একই বিচারব্যবস্থায় যৌন নিপীড়ন থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টার জন্য মারিসা আলেকজান্ডারের বিশ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি তিনি ষাট বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের একটি আশঙ্কার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাই তিনি একটি আইনি দর-কষাকষিতে লিপ্ত হয়েছিলেন, যার অর্থ হলো–পরবর্তী সময়ের জন্য তাকে একটি ইলেকট্রনিক ব্রেসলেট পরতে হবে।

বর্ণবাদী এবং যৌন সহিংসতা এমন একটি অনুশীলন, যা শুধু সহ্যই করা হচ্ছে না, স্পষ্টভাবে অথবা স্পষ্টভাবে না-হলেও পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে। যখন সহিংসতার এই পদ্ধতিগুলো স্বীকৃত হয় এবং সেগুলো প্রায়ই লুকানো থাকে ও অদৃশ্য হয়ে যায়, তখন সেগুলো প্রায়ই কাঠামোগত বর্জন এবং বৈষম্যের সবচেয়ে নাটকীয় উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি মনে করি, এই বিশ্লেষণকে আরও বিকশিত করা গুরুত্বপূর্ণ। আমি এই বলে শেষ করতে যাচ্ছি যে, আমরা জাতীয় সীমানাজুড়ে আন্তর্জাতিক সংহতি এবং সংযোগ গড়ে তোলার চেষ্টা করার সময় আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ‘আন্তঃপরিচয়-সংযোগ’ বা ‘ইন্টারসেকশনালিটি’। নারীবাদীরা আন্তঃপরিচয়-সংযোগ তত্ত্বটি প্রাই ব্যবহার করে থাকে। পরিচয়ের আন্তঃসংযোগের চেয়ে সংগ্রামের আন্তঃসংযোগ বেশি হতে হবে।

আমরা তাহরির স্কয়ার এবং বিশ্বব্যাপী দখল আন্দোলনের কথা ভুলে যাব না। যেহেতু আমরা ইস্তাম্বুলে জমায়েত হয়েছি, সেহেতু আমরা তাকসিম গেজি পার্ক প্রতিবাদীদের ভুলে যাব না। প্রায়ই মানুষ বিতর্ক করে যে, যেহেতু সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলোয় কোনো নেতা নেই, ইশতেহার নেই, কর্মসূচি নেই, তাই আন্দোলনগুলো ব্যর্থ। আমি এখানে স্টুয়ার্ট হলের কথা তুলে ধরব, যিনি গত একবছরের কিছু আগে মারা গিয়েছেন। তিনি ফলাফল এবং প্রভাবের মধ্যে পার্থক্য অনুধাবন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। অনেক মানুষ ধরে নেয়, যেহেতু ক্যাম্পগুলো এখন আর নেই এবং বাস্তব কোনো কিছু উৎপাদিত হয়নি, কাজেই এর কোনো ফলাফল নেই। কিন্তু যখন আমরা এই কল্পনাপ্রসূত এবং উদ্ভাবনী কর্মের প্রভাব এবং এই মুহূর্তগুলো সম্পর্কে চিন্তা করি, তখন দেখতে পাই, সেখানে মানুষ শিখেছে রাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়া কীভাবে একসঙ্গে থাকতে হয় এবং তারা পুলিশকে ডাকার প্ররোচনায় না পড়ে সমস্যাগুলো নিজেরা সমাধান করতে শিখেছে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক সংহতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের তৈরি সেই মুহূর্তগুলো আমাদের জন্য সত্যিকারের অনুপ্রেরণা হবে। র‌্যান্ট ডিঙ্ক তুরস্কে, ফিলিস্তিনে, দক্ষিণ আফ্রিকায়, জার্মানিতে, কলম্বিয়ায়, ব্রাজিলে, ফিলিপাইনেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেভাবে আমাদের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার প্রসারের জন্য আহ্বান করেছিলেন, বিশ্বের জন্য আমরা কি ঠিক তেমনি কাজ করতে চাই না?

আমরা গতানুগতিক চলতে পারি না। আমরা চক্রাকারে ঘুরতে পারি না। আমরা মধ্যপন্থি হতে পারি না। আমাদের সম্মিলিত উদ্দীপনা, যৌথ বুদ্ধিবৃত্তি এবং অনেকগুলো শরীর নিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং না বলতে সক্ষম হতে হবে।

তাই যদি হয়, তাহলে তো আমাদের অসাধারণ কিছু করতে হবে: আমাদের অনেক বড় পরিসরে যেতে হবে। আমরা গতানুগতিক চলতে পারি না। আমরা চক্রাকারে ঘুরতে পারি না। আমরা মধ্যপন্থি হতে পারি না। আমাদের সম্মিলিত উদ্দীপনা, যৌথ বুদ্ধিবৃত্তি এবং অনেকগুলো শরীর নিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং না বলতে সক্ষম হতে হবে।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •