‘নারী উদ্ধারবাদী প্রকল্প’ বনাম ‘মুক্তিযোদ্ধা তালেবান’: বৈপরীত্যের বয়ানে বাদ পড়ে যাওয়া আফগান নারীর লড়াই

‘নারী উদ্ধারবাদী প্রকল্প’ বনাম ‘মুক্তিযোদ্ধা তালেবান’:

বৈপরীত্যের বয়ানে বাদ পড়ে যাওয়া আফগান নারীর লড়াই

নাসরিন খন্দকার

১.

১৬ আগস্ট ২০২১, রাজধানী কাবুলের দখল নেওয়ার মাধ্যমে আফগানিস্তানের ওপর তালেবান দ্বিতীয়বারের মতো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। নানা দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের শিরোনামে এটি একটি অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদ হিসেবে প্রচার হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সঙ্গে তালেবানের দুই দশকের এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এমনতর পলায়ন এবং এত অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে, প্রায় বিনা প্রতিরোধে তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে, তা অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু আফগান জনগোষ্ঠীর কাছে তা এতটা অপ্রত্যাশিত ছিল না, বিশেষ করে যখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র  আফগান সরকারকে বাদ দিয়ে দোহায় তালেবানের সঙ্গে ‘শান্তি’র নামে দরকষাকষি শুরু করে এবং যখন থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।

দুই দশক আগে মুসলিমবিদ্বেষী যুদ্ধবাজ প্রচারণার আগুনে ঘি ঢালতে আফগানিস্তানের নারীদের অধস্তনতার গল্প যেভাবে প্রচারিত হতো, ঠিক সেভাবে তালেবানের পুনর্দখলে আফগান নারী অধিকার সম্পূর্ণরূপে ভন্ডুল হওয়ার আতঙ্ক বিশ্বের মূলধারার সমস্ত গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছিল। সিএনএন, স্কাই নিউজ বা বিবিসির মতো বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় গণমাধ্যমে নারী অধিকারকর্মী, সাংবাদিক, চলচ্চিত্র পরিচালকদের কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখি, দেখি ন্যাটো এবং পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি তাদের আকুল আবেদন। আফগান নারীদের রক্ষার মহান ব্রত নিয়ে আমেরিকার এই দুই দশকের আধিপত্য আর আগ্রাসনের পর, আফগান সরকারের আড়ালে দোহায় তালেবানের সঙ্গে শান্তিচুক্তির নামে দরকষাকষি এবং তালেবানের হাতে আফগানিস্তান ছেড়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পলায়নকে আফগানিস্তানের নারীদের প্রতি প্রতারণা হিসেবে অনেকেই দেখেন, বিশেষ করে যারা আমেরিকার বয়ানে বিশ্বাস করেছিলেন। কেননা, দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এই পশ্চিমা দেশগুলো তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে। তাই, আফগান উইমেন’স নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা মাহবুবা সিরাজ বিশ্ব রাজনীতির নাটের গুরু পুরুষদের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দেন: ‘আমরা কি তাহলে স্রেফ দাবার ঘুঁটি মাত্র?’

আফগান নারীদের রক্ষার মহান ব্রত নিয়ে আমেরিকার এই দুই দশকের আধিপত্য আর আগ্রাসনের পর, আফগান সরকারের আড়ালে দোহায় তালেবানের সঙ্গে শান্তিচুক্তির নামে দরকষাকষি এবং তালেবানের হাতে আফগানিস্তান ছেড়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পলায়নকে আফগানিস্তানের নারীদের প্রতি প্রতারণা হিসেবে অনেকেই দেখেন, বিশেষ করে যারা আমেরিকার বয়ানে বিশ্বাস করেছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতারণা স্পষ্ট হয়ে প্রকাশ পায় যখন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দাবি করেন, আফগানিস্তানের ‘জাতিগঠন’ যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল না কখনোই। এই দাবি একভাবে সত্য এ কারণে যে, যদিও নারী অধিকারের ব্যানার দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের আগ্রাসনকে যৌক্তিক করার চেষ্টা করে গেছে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে, নারীর অবস্থার উন্নয়নে তাদের আসলে কখনোই আগ্রহ ছিল না। ফলে জো বাইডেনের বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভণ্ডামি একভাবে স্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু অন্যদিকে বাইডেনের এই দাবি স্পষ্টতই মিথ্যা। কারণ, ‘জাতিগঠনের’ নামে আফগান নারীদের মুক্তি এবং নির্ভয়ে নেইল পলিশ দিতে পারার স্বাধীনতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতির কথাই আমেরিকার ‘সভ্যকরণ প্রকল্প’ আর আফগানিস্তান আক্রমণের অন্যতম কারণ হিসেবে তৎকালীন ফার্স্ট লেডি লরা বুশ তুলে ধরেন। এমনকি সেই একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি ২০১৭ সালে জর্জ বুশ ইনস্টিটিউট থেকে ‘আমরা আফগানের নারী: আশার স্বর’ (We Are Afghan Women: Voices of Hope) নামে একটি সংকলন প্রকাশ করেন।  ফলে যারা যুক্তরাষ্ট্রের বয়ানে কিছুটা হলেও বিশ্বাস করেছিলেন, তারা তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিককালের এই দরকষাকষি এবং ‘জাতিগঠনের’ বয়ান থেকে তাদের পলায়ন প্রবণতায় স্পষ্টতই প্রতারিত হন।

বিভিন্ন পশ্চিমা গণমাধ্যম থেকে যখন খবরটা পেলাম, তার পর থেকে প্রগতিশীল এবং নারীবাদী মহলে প্রধানত দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই। অন্যান্য সময়ে তাদের অনেকের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া আমার সঙ্গে মিললেও দুঃখজনকভাবে লক্ষ করলাম, আফগানিস্তানের ওপর তালেবানের দখল প্রসঙ্গে তাদের বিশ্লেষণ বেশ সমস্যাজনক। এই লেখায় আমি এই দুই ধারার চিন্তাভাবনাকে তুলে ধরে দেখানোর চেষ্টা করব–কেন আমি তাদের যুক্তিগুলোকে সমস্যাজনক মনে করছি। প্রথম ব্যাখ্যাটি ফ্রাঁসোয়া ভারজেসের মতে সভ্যকরণ নারীবাদী (civilising feminism) ব্যাখ্যা এবং অপরটিকে বলা যায় লিঙ্গ-প্রশ্নে অন্ধ, একধরনের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং বামপন্থি ব্যাখ্যা। গত কয়েক দশকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নারীবাদী এবং ক্যু-এর তাত্ত্বিকরা পশ্চিমা ঔপনিবেশিক এবং অপশ্চিমা জাতীয়তাবাদী বয়ান থেকে প্রান্তিক লিঙ্গের বাদ পড়ে যাওয়ার সমালোচনা করে আসছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই দুই ব্যাখ্যাই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নারীবাদী এবং ক্যু-এর তাত্ত্বিকদের অত্যন্ত শক্তিশালী বিশ্লেষণকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে। এত বছর ধরে এত শক্তিশালী এবং স্বনামধন্য তাত্ত্বিকদের যুক্তি এবং বিশ্লেষণ মূলধারার গণমাধ্যম থেকে সম্পূর্ণভাবে বাদ পড়ে যাওয়া সত্যি অবিশ্বাস্য। একেই সম্ভবত উত্তর-উপনিবেশবাদী তাত্ত্বিক হামিদ দাবাশি বলেন, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সমন্বিতভাবে তড়িঘড়ি বিস্মরণ’ (politically expedited collective amnesia)।

২.

প্রথম ব্যাখ্যাটি হচ্ছে, পশ্চিমা এবং শ্বেতাঙ্গ নারীবাদের একধরনের রক্ষাকারী ধারার (White feminist saviour complex) সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধনীতির মেলবন্ধনের ফলাফলে সৃষ্ট আফগান ‘নারী-রক্ষা প্রকল্প’। নারীবাদী এবং নারী অধিকারের পক্ষের নানা গ্রুপের সদস্য হওয়ায় আমি দেখি আমার ফেসবুকে তালেবান যোদ্ধাদের এ ধরনের সহিংস খবরে ছেয়ে গেছে। সেই সঙ্গে এসব গ্রুপের অনে.ক পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গ নারী জানাচ্ছেন যে, আফগান নারীদের জন্য কাঁদতে কাঁদতে তাদের কারও কারও চোখ ফুলে ঢোল হয়ে গেছে অথবা রাতের ঘুম হারাম হয়েছে। এর পাশাপাশি আমার অনেক নারীবাদী বন্ধু এবং সহযোদ্ধারাও তাদের উদ্বেগের কথা জানাচ্ছেন এবং এই পরিস্থিতিতে কী করণীয় তার তালিকা করা থেকে শুরু করে নানা ধরনের প্রতিবাদী কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা করছেন।

আমি নিজেও আতঙ্কিত। আমি আফগান নারী এবং তাদের অধিকারের জন্য উদ্বিগ্ন। ইতিহাস বলে, ক্ষমতার এ ধরনের পালাবদল সাধারণত রক্তাক্ত হয়। উপরন্তু তালেবানের যে কুখ্যাতি, তার বিবেচনায় এটি সত্যিই অবিশ্বাস্য যে, নারীদের জীবন এবং অধিকার ক্ষমতার এই পালাবদলের বলি হবে না। কিন্তু আফগান নারীদের নিয়ে আমার এই উদ্বেগ থেকে আমি গত কয়েক দশকের হাজার হাজার মৃত্যু, আফগানিস্তানে সুদীর্ঘ উপনিবেশের ইতিহাস এবং ‘ওয়ার অন টেরর’-এর নামে চালানো ধ্বংসযজ্ঞকে আলাদা করতে পারি না। আমি দেখি যে, আফগানিস্তান, সৌদি আরব, রোহিঙ্গা কিংবা চীনের উইঘুর ক্যাম্পের মুসলমান নারী থেকে শুরু করে পশ্চিমা দেশের কালো বা বাদামি নারী অথবা প্রান্তিক লিঙ্গের নারী, প্রত্যেকেই ভয়াবহ অধস্তনতার মুখোমুখি, তাদের সংগ্রামের পাশে আমাদের দাঁড়ানো অতি জরুরি, প্রয়োজন সংহতি এবং সমর্থন। আমি যখন উইঘুর ক্যাম্পে মুসলমান নারীর ওপর নির্যাতনের বর্ণনা পড়ি তখন আমি ঘুমহীন রাত পার করলেও কেন জানি আমার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দেওয়ালে পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গ নারীদের তাদের জন্য কাঁদতে দেখিনি। সারা বিশ্বের নারীদের ওপর বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা থেকে শুধু আফগান নারীদের দুরবস্থা নিয়ে বিচলিত হওয়ার বিষয়টি যতটা নিরীহ মনে হয়, ততটা নিরীহ হয়তো নয়। কেননা, আফগান নারীদের দুরবস্থা দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী এবং মুসলিমবিদ্বেষী বর্ণবাদ ভালো বিকোয়, পশ্চিম বনাম মুসলমান এই বৈপরীত্যকে শক্তিশালী করে, এদের মধ্যকার কার্যকারণের সম্পর্ককে আড়াল করে।

আফগান নারীদের নিয়ে আমার এই উদ্বেগ থেকে আমি গত কয়েক দশকের হাজার হাজার মৃত্যু, আফগানিস্তানে সুদীর্ঘ উপনিবেশের ইতিহাস এবং ‘ওয়ার অন টেরর’-এর নামে চালানো ধ্বংসযজ্ঞকে আলাদা করতে পারি না।

আফগানিস্তানে তালেবানের এই পুনরুত্থানে অনেকেই প্রথমদিকে আশা করছিলেন যে, এবার হয়তো তালেবান আগেরবারের থেকে ভিন্ন হবে। আফগান নারীবাদী সংগঠন রাওয়ার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য অপসারণ আর তালেবানের সঙ্গে যোগসাজশকে যৌক্তিক করতে এ ধরনের আশাবাদের প্রলেপ দেওয়া হচ্ছে। আফগান নারীবাদী রাজনীতিবিদ মালালাই জয়া, যিনি আফগান সংসদে নির্বাচিত হয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের সমালোচনা করার কারণে সংসদ থেকে বহিষ্কৃত হন অথবা রাওয়ার মতো লড়াকু নারীবাদী সংগঠন যারা প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে আফগানিস্তানের ওপর সব বৈদেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছে, তাদের কাছে তালেবানের এই বিজয় নারীদের জন্য ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়ার মতো। আফগানিস্তানের বেশিরভাগ নারীর কাছেই ঐতিহাসিকভাবে তালেবানের নারীবিদ্বেষী রূপ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। ফলে নারীদের শিক্ষা এবং পেশাগত স্বাধীনতা বহাল রাখা নিয়ে তালেবানের মুখপাত্রের বারবার আশ্বাস নারীদের বিশ্বাস অর্জনে স্বাভাবিকভাবেই সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। উপরন্তু অস্থায়ীভাবে মেয়েদের মাধ্যমিক স্কুল বন্ধ করার কথা বলে ছেলেদের স্কুল খুলে দিলেও মেয়েদের স্কুল এখন পর্যন্ত বন্ধ আছে এবং তা খুলে দেওয়ার কোনো আশা এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন নারী পেশাজীবীও আর কাজে ফিরতে পারেননি। উপরন্তু নারী অধিকারকর্মী, সাংবাদিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং খেলোয়াড়রা বেশিরভাগই প্রাণনাশের ঝুঁকিতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। যদিও আইসিসের সঙ্গে তালেবানের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব রয়েছে, তথাপি এ রকম ঘটনা থেকে অনেকেই ভয় পাচ্ছেন যে, তালেবানের বর্তমান নেতৃত্বের ওপর আইসিসের যৌনদাসত্বের ধারণার প্রভাব থাকতে পারে, যার কারণে তালেবানের এই দ্বিতীয় আমল হয়তো নারী-প্রশ্নে আরও বেশি রক্ষণশীল হবে।১০ইতোমধ্যে তালেবানের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে নারীদের মুখ ঢেকে রাখার আদেশ দেওয়া হয়েছে।

আফগান নারীবাদী রাজনীতিবিদ মালালাই জয়া, যিনি আফগান সংসদে নির্বাচিত হয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের সমালোচনা করার কারণে সংসদ থেকে বহিষ্কৃত হন অথবা রাওয়ার মতো লড়াকু নারীবাদী সংগঠন যারা প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে আফগানিস্তানের ওপর সব বৈদেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছে, তাদের কাছে তালেবানের এই বিজয় নারীদের জন্য ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়ার মতো।

পশ্চিমা গণমাধ্যম যুক্তরাষ্ট্রের গত বিশ বছরের দখলকে নারীদের অধিকারের স্বর্ণযুগ হিসেবে তুলে ধরছে, যা কিনা তালেবানের বিজয়ে ধ্বংসস্তূপের সম্মুখীন। এ ধরনের চিত্রায়ণকে ভুল এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে ইতোমধ্যে বহু গবেষক প্রমাণসহ তুলে ধরেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, নৃবিজ্ঞানী লিলা আবু লুঘোদ, যিনি ২০১৩ সালে তাঁর ‘ডু মুসলিম উইমেন নিড সেভিং’১১ বইয়ে আফগান নারীদের উদ্ধার প্রকল্পের এই বয়ানকে বিশ্লেষণ করে দেখান; দীপা কুমার যার বই ‘ইসলামোফোবিয়া অ্যান্ড দ্য পলিটিকস অব এম্পায়ার’ ১২-এর দ্বিতীয় সংস্করণ এই বছরই বের হয়েছে; আনন্দ গোপালের ‘নো গুড মেন অ্যামাং দ্য লিভিং’ ১৩ যা পুলিৎজার পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হয়েছিল, সাদিয়া টুর১৪ এবং জাসবির পুয়ারের ১৫ মতো স্বনামধন্য গবেষক এবং আফগান নারীবাদীরা।

এটি সত্য যে, আফগানিস্তানে গত বিশ বছরে অনেক মেয়েই শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে, সেই সঙ্গে অনেক নারীই গত দুই দশকে পেশাগত সুযোগের দিক থেকে তাদের পূর্বসূরিদের থেকে ভিন্নভাবে বেড়ে উঠেছেন। কিন্তু শহর এবং এনজিও কার্যক্রমের বাইরে বেশিরভাগ অঞ্চলই তেমন কোনো সামাজিক উন্নয়নের মুখ দেখেনি। সোনালি কোলহাতকারের সঙ্গে আফগানের সবচেয়ে পুরোনো নারীবাদী সংগঠন রাওয়ার (Revolutionary Association of the Women of Afghanistan) প্রতিনিধি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “নারী অধিকার’, ‘গণতন্ত্র’, ‘জাতিগঠন’-এর মতো মূল্যবোধ আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর কার্যক্রমের উদ্দেশ্যের অন্তর্গত ছিল, এমন ধারণা স্রেফ মশকরা ছাড়া আর কিছু নয়! …এই মুহূর্তে তালেবানের ক্ষমতালাভে আফগানিস্তান সবার মনোযোগের কেন্দ্রে আছে; কিন্তু এ রকম অবস্থা গত বিশ বছর ধরেই চলছে, গণমাধ্যমে তা খুব কমই প্রচারিত হয়েছে।”১৬

নৃবিজ্ঞানী লিলা আবু লুঘোদ দেখান, যুক্তরাষ্ট্রের এই মুসলমান নারীদের রক্ষাকারী ইমেজ উপনিবেশবাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত, যেখানে মনে করা হয় মুসলমান নারীমাত্রই অসহায়, অক্ষম এবং মুসলমান পুরুষের হাতের পুতুল মাত্র। পশ্চিমা সমাজের শেকড় থেকে তৈরি হওয়া কাঠামোগত লিঙ্গবৈষম্যের প্রতি নির্বিকার থেকে মুসলমান নারীদের প্রতি করুণা এবং তাদের রক্ষা করার এই আগ্রহ ঔপনিবেশিক জ্ঞান থেকে জন্ম নেয়। মুসলমান নারীর রক্ষাকর্তা হওয়ার এই বয়ান ঔপনিবেশিক হেজেমনির ‘সভ্যকরণ প্রকল্পের’ (civilising mission) সঙ্গে যুক্ত। এই বয়ান পশ্চিমা নারীর পথকেই বিশ্বের ‘অপর’ নারীদের জন্য একমাত্র অনুকরণীয় পথ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। মনে করা হয়, পশ্চিমা নারী তাদের অধস্তনতা থেকে মুক্ত হয়ে গেছে, তাই বিশ্বের ‘অপর’ নারীদেরও তাদের অনুসরণ করতে হবে, তবেই তাদের মুক্তি মিলবে। বিভিন্ন সমাজে যে পিতৃতন্ত্র বিভিন্ন রূপে বহাল থাকতে পারে, এবং থাকে, তা এই বয়ান সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যায়। সেই সঙ্গে এই বয়ান শ্বেতাঙ্গ নারীবাদের ‘রক্ষক’ ভূমিকার বর্ণবাদবিরোধী এবং বি/উত্তর-উপনিবেশবাদী সমালোচনা সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যায়।

বেশ মনে আছে, আমার শৈশবেও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন এবং এর হেজেমনিক ‘সভ্যকরণ প্রকল্প’ অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য ছিল। আশপাশের অনেককেই বলতে শুনেছি, ‘আরে যত যাই হোক, ব্রিটিশ নিয়মানুবর্তিতা আর আধুনিকতার তুলনা হয় না, আমরা ওদের কাছ থেকে রেললাইন, স্কুল আর হাসপাতালের মাধ্যমে সভ্যতার ছোঁয়া পেয়েছি।’ আমার বেড়ে ওঠার সময়ে শক্তিশালী উত্তর-ঔপনিবেশিক বিশ্লেষণ এসব সভ্যকরণ প্রকল্পের সমালোচনা প্রতিষ্ঠিত হয়। এত দিনে আমাদের মতো উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজে আমরা অন্তত ‘মনের ঔপনিবেশিকতা’ ‘colonisation of the mind’ স্পষ্ট করে চিনতে শুরু করেছি। তত দিনে উপনিবেশের এই সভ্যকরণ প্রকল্পকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে গায়ত্রী স্পিভাকের জনপ্রিয় উক্তি, ‘শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের বাদামি পুরুষের হাত থেকে বাদামি নারীদের উদ্ধার’১৭ বিদ্যায়তনিক জগতে বহুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ উপনিবেশের সঙ্গে আমার যাপিত অভিজ্ঞতা না থাকলেও উত্তর-ঔপনিবেশিক সমালোচনা থেকে ৯/১১-পরবর্তী বিশ্ব এবং এর সঙ্গে আমার যাপিত জীবন দ্বারা নব্য উপনিবেশবাদের সভ্যকরণ প্রকল্পকে চিনে নিতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে আফগান নারীদের রক্ষা করার ব্রতকে সাম্রাজ্যবাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে, তা চিনতে অসুবিধা হয়নি। ঠিক একইভাবে আফগান-যুদ্ধের দুই দশকে পর, আবারও বিশ্ব মিডিয়ায় অসহায় আফগান নারীর চিত্রায়ণ এবং শ্বেতাঙ্গ নারীদের আফগান নারীর প্রতি করুণা আর অশ্রুবর্জন এই ইতিহাসকেই মনে করিয়ে দেয়।

৩.

অন্যদিকে দ্বিতীয় যে ব্যাখ্যাটিকে আমি ভীষণভাবে সমস্যাজনক মনে করছি, আশ্চর্যজনকভাবে সেটি কিন্তু এই আপাত উত্তর-ঔপনিবেশিক সমালোচনার নামেই উঠে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদকে সমালোচনা করতে গিয়ে কিছু বামপন্থি চিন্তক এবং বুদ্ধিজীবী আফগানিস্তানে তালেবানের এই পুনরুত্থানকে সাম্রাজ্যবাদের পতন এবং অধিকৃত জাতির বিজয় হিসেবে দেখছেন। আমার পরিচিত মহলে তুমুল জনপ্রিয় দার্শনিক স্লাভোয় জিজেক ইতোমধ্যেই অধস্তন জাতির সমন্বিত বিজয় হিসেবে একে দেখছেন।১৮ ইউরোপের স্বনামধন্য বামপন্থি রাজনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবী ইয়ানুস ভারোফাকিস তালেবানের এই বিজয়কে দেখছেন ‘উদারনৈতিক-রক্ষণশীল সাম্রাজ্যবাদের সার্বিক পরাজয়ের দিন’ হিসেবে।১৯ বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের কিছু বামপন্থি বুদ্ধিজীবীও একে আফগানিস্তানের ওপর দীর্ঘদিনের উপনিবেশ এবং সাম্রাজ্যবাদের পরাজয় হিসেবে দেখছেন। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, তালেবানের এই পুনরুত্থানে যারা আফগানিস্তানের বিজয় দেখছেন, তারা ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় এই সত্যকে এড়িয়ে যাচ্ছেন যে, আফগান জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশ তালেবানের বিরুদ্ধে, বিশেষত নারী এবং প্রান্তিক লিঙ্গের জনগণ। ফলে এ যদি শোষিত আফগানের জনগণের বিজয় হয়, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ আফগান জনগণ এই বুদ্ধিজীবীদের কাছে শোষিত শ্রেণি হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য নয়। তালেবানের বিরুদ্ধে আফগান জনগণের, বিশেষত নারীদের দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস এরা সম্পূর্ণভাবে অবজ্ঞা করছেন।

বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের কিছু বামপন্থি বুদ্ধিজীবীও একে আফগানিস্তানের ওপর দীর্ঘদিনের উপনিবেশ এবং সাম্রাজ্যবাদের পরাজয় হিসেবে দেখছেন। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, তালেবানের এই পুনরুত্থানে যারা আফগানিস্তানের বিজয় দেখছেন, তারা ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় এই সত্যকে এড়িয়ে যাচ্ছেন যে, আফগান জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশ তালেবানের বিরুদ্ধে, বিশেষত নারী এবং প্রান্তিক লিঙ্গের জনগণ। ফলে এ যদি শোষিত আফগানের জনগণের বিজয় হয়, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ আফগান জনগণ এই বুদ্ধিজীবীদের কাছে শোষিত শ্রেণি হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য নয়। তালেবানের বিরুদ্ধে আফগান জনগণের, বিশেষত নারীদের দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস এরা সম্পূর্ণভাবে অবজ্ঞা করছেন।

দ্বিতীয়ত, এই তাত্ত্বিকেরা ভুলে যাচ্ছেন যে, তালেবান সাম্রাজ্যবাদেরই ভয়াবহ ফলাফল এবং নব্য উপনিবেশবাদের অংশ। এরা দেখছেন না যে, উপনিবেশবাদ একটি সামাজিক, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া, যা শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলে হাওয়া হয়ে যায় না। তালেবানের পুনরুত্থানের এ ধরনের ব্যাখ্যা হয় অজ্ঞতাবশত অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে কয়েক দশকের উত্তর-ঔপনিবেশিক নারীবাদী এবং ক্যু-এর তত্ত্ব, যা শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশবাদী এবং দেশি জাতীয়তাবাদী বয়ান থেকে নারী এবং প্রান্তিক লিঙ্গের বাদ পড়ে যাওয়াকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, তা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে, বাদ দেয়। এই ব্যাখ্যা দেখে না যে, ঔপনিবেশিকতা যে কোনো গাত্রবর্ণের জনগোষ্ঠীর পক্ষেই রক্ষা করা সম্ভব। লিঙ্গ-প্রশ্নে অন্ধ এ ধরনের বামপন্থি বিশ্লেষণের উত্তরে প্রিয়ামভদা গোপাল বলেন, ‘কোনো অঞ্চলকে গ্রাস করে, ধ্বংস করে, জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ এবং রক্তাক্ত করে চলে আসা সাম্রাজ্যবাদের সমাপ্তি নয়; বরং এর একটি কৌশল।’২০ তিনি আরও যুক্তি দেন, ‘অর্থপূর্ণ বি/ঔপনিবেশিকতার জন্য শুধু ঔপনিবেশিক শক্তিই নয়, সেই সঙ্গে পিতৃতন্ত্র, ধর্মীয় উগ্রবাদ বা বর্ণ/জাতিবাদের মতো অন্তর্চ্ছেদী শোষক শক্তির সমালোচনা জরুরি।’২১ তালেবান উপনিবেশের জাতক, তারা উপনিবেশবিরোধী শক্তি নয়। সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে মূলত এই পুরুষ বুদ্ধিজীবীরা নারীর ওপর ধর্মের পিতৃতান্ত্রিক ব্যাখ্যা এবং তার উগ্রবাদী ব্যবহারের ভয়াবহ পরিণতিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেন।

তালেবান উপনিবেশের জাতক, তারা উপনিবেশবিরোধী শক্তি নয়। সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে মূলত এই পুরুষ বুদ্ধিজীবীরা নারীর ওপর ধর্মের পিতৃতান্ত্রিক ব্যাখ্যা এবং তার উগ্রবাদী ব্যবহারের ভয়াবহ পরিণতিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেন।

তৃতীয়ত, আফগানিস্তানের ক্ষমতার এই পালাবদলকে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের সমাপ্তি হিসেবে দেখা স্রেফ ভ্রান্ত আশাবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। স্পষ্টতই সাম্রাজ্যবাদ তার আগ্রাসন বন্ধ করেনি। বিশ্বজুড়ে ৮০টিরও বেশি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ৮০০-রও বেশি সেনাবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপিত আছে।২২ যুক্তরাষ্ট্র বছরে ইসরায়েলকে ৩.৮ বিলিয়ন ডলার২৩ আর মিশরের স্বৈরাচারী সরকারকে ১.৩ বিলিয়ন ডলার২৪ সেনা সহযোগিতা দেয় মধ্যপ্রাচ্যে তার নিয়ন্ত্রণ রক্ষার জন্য। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারে এই সীমাহীন যুদ্ধের কৌশল বা যুদ্ধাস্ত্রের পরিবর্তন হয়েছে মাত্র, যুদ্ধ শেষ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ প্রযুক্তির যুদ্ধাস্ত্র ড্রোন আফগানিস্তানের ওপর আরও কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করে চলেছে। আর তাই আমরা দেখি, সেনা প্রত্যাহারের পর ২৩ আগস্ট ৪৩ বছর বয়সি উন্নয়নকর্মী জেমারি আহমাদি এবং সাত শিশুসহ তার পরিবারের নয় সদস্যকে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় হত্যা করা হয়।

৪.

ধর্মান্ধ আর পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতালিপ্সু তালেবান যে উপনিবেশ আর সাম্রাজ্যবাদের জাতক, এ বিষয়ে আফগান নারীবাদী সংগঠন রাওয়া বা আফগান উইমেন’স মিশন বরাবরই দ্বিধাহীন। তারা এক মুহূর্তের জন্যও তালেবানকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেনি। আফগান নারীবাদীদের মতোই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নারীবাদীরা শ্বেতাঙ্গ নারীবাদের উদ্ধারবাদী প্রবণতা, যা সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং লিঙ্গ-প্রশ্নে অন্ধ বামপন্থি চিন্তক যারা তালেবানকে শোষিত জনগোষ্ঠীর মুক্তির দিশারি মনে করছেন, এই দুই ব্যাখ্যাকেই একইসঙ্গে বাতিল করেন। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এ ধরনের নারীবাদী স্বরকে ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করা হয়, মূলধারার গণমাধ্যমে তাদের স্থান দেওয়া হয় না।

ধর্মান্ধ আর পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতালিপ্সু তালেবান যে উপনিবেশ আর সাম্রাজ্যবাদের জাতক, এ বিষয়ে আফগান নারীবাদী সংগঠন রাওয়া বা আফগান উইমেন’স মিশন বরাবরই দ্বিধাহীন। তারা এক মুহূর্তের জন্যও তালেবানকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেনি। আফগান নারীবাদীদের মতোই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নারীবাদীরা শ্বেতাঙ্গ নারীবাদের উদ্ধারবাদী প্রবণতা, যা সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং লিঙ্গ-প্রশ্নে অন্ধ বামপন্থি চিন্তক যারা তালেবানকে শোষিত জনগোষ্ঠীর মুক্তির দিশারি মনে করছেন, এই দুই ব্যাখ্যাকেই একইসঙ্গে বাতিল করেন।

রাওয়ার মতো নারীবাদী সংগঠন তাদের ওয়েবসাইটে তালেবান, যুক্তরাষ্ট্র, নর্দান অ্যালায়েন্সসহ সব আগ্রাসি শক্তির বিরুদ্ধে একের পর এক প্রতিবাদ প্রকাশ করে আসছে নিরলসভাবে। কিন্তু মূলধারার গণমাধ্যমে তা প্রচারিত হয় না। আফগান নারীবাদীরা দুর্নীতি, যুদ্ধ, অগুনতি আফগানের হত্যা থেকে শুরু করে আফগান নারীদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা সব অনাচার এবং শোষণমূলক শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দ্বিধা করেনি কোনোদিন। নব্বইয়ের দশকে রাওয়া তাদের আর্থিক সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফেমিনিস্ট মেজরিটি ফাউন্ডেশনসহ বহির্বিশ্বের বিভিন্ন নারী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। এই সুযোগে ফেমিনিস্ট মেজরিটি ফাউন্ডেশন তাদের উদ্ধারবাদী প্রকল্পে নেমে পড়ে। ইলোরা শেহাবুদ্দিন তার ‘সিস্টারস ইন মিরর’ বইয়ে দেখান, ফেমিনিস্ট মেজরিটি ফাউন্ডেশন রাওয়ার সঙ্গে প্রাথমিকভাবে যোগাযোগ করলেও পরবর্তী সময়ে তারা রাওয়ার অবস্থানকে উপেক্ষা করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে ‘মুসলিম নারী উদ্ধারবাদী প্রকল্প’ বয়ানের জোগান দেয়।২৫ এর ফলে রাওয়া এক জোরালো প্রতিবাদলিপি পাঠায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সারির নারীবাদী পত্রিকা মিজ-এর সম্পাদককে। তারা অভিযোগ করে যে, ফেমিনিস্ট মেজরিটি ফাউন্ডেশন তাদের নিজ স্বার্থ অনুযায়ী আফগান নারীদের ইতিহাসকে বিকৃত করে দাবি করে যে, সামান্য কয়েকজন প্রবাসী আফগান নারী এবং ফেমিনিস্ট মেজরিটি ফাউন্ডেশন আফগান নারীদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে তালেবানের শোষণ থেকে মুক্ত করার মাধ্যমে, যেন তালেবানই আফগান নারীদের একমাত্র শত্রু। অথচ আফগান নারীদের জীবন বাস্তবতা এই বয়ানের সত্যতা থেকে বহু দূরে। উপরন্তু গত দুই দশকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আফগান নারীবাদী স্বরকে সম্মিলিতভাবে রুদ্ধ করে সাম্রাজ্যবাদী নারীবাদী প্রপাগান্ডা চালানো হয়েছে মূলধারার গণমাধ্যমে।

তাই এখন সময় এসেছে পশ্চিমা উদ্ধারবাদী প্রকল্পের বয়ানের বাইরে গিয়ে আফগান সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নারীবাদের লড়াইয়ের সঙ্গে কার্যকর সংহতি এবং সমর্থনের। বিশ্বের বেশিরভাগ নারীবাদীর অবস্থান এমনই, তারা সাম্রাজ্যবাদ এবং পিতৃতান্ত্রিক ধর্মান্ধ উগ্রবাদ উভয়েরই বিপরীতে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলো, তাদের স্বরকে, তাদের প্রতিবাদকে কখনোই মূলধারার বয়ানে স্থান দেওয়া হয় না। ফলে এখন আমাদের আরও জোরালোভাবে আমাদের অবস্থানকে স্পষ্ট করতে হবে, সামনে আনতে হবে। যাতে তা সাম্রাজ্যবাদী নারীবাদী এবং লিঙ্গ-প্রশ্নে অন্ধ বামপন্থিদের উভয়ের স্বরের থেকেই জোরালো হয়ে উঠতে পারে। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, যাতে আফগান নারীদের প্রতি সংহতি সাম্রাজ্যবাদের হাতে ব্যবহৃত না হয় এবং যাতে তালেবান মুক্তির দিশারি হিসেবে স্বীকৃতি না পায়।

ডঃ নাসরিন খন্দকার: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, বর্তমানে আয়ারল্যান্ডে অভিবাসিত জনগোষ্ঠীর উপরে লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা নিয়ে গবেষণা করছেন।

ইমেইল: nasrin.khandoker@gmail.com

তথ্যসূত্র:

১) Emma Graham-Harrison and Julian Borger, ‘Trump’s Afghanistan Withdrawal Announcement Takes US Officials by Surprise’, The Guardian, 8 October 2020, sec. US news, https://www.theguardian.com/us-news/2020/oct/08/donald-trump-afghanistan-us-troops-taliban.

 ২) ‘🔊 Listen Now: Afghan Women Wait To See What Their Lives Will Be Like Under The Taliban’, NPR One, accessed 26 August 2021, https://one.npr.org/i/1028368046:1028368047.

 ৩) ‘Remarks by President Biden on the Drawdown of U.S. Forces in Afghanistan’, The White House, 8 July 2021, https://www.whitehouse.gov/briefing-room/speeches-remarks/2021/07/08/remarks-by-president-biden-on-the-drawdown-of-u-s-forces-in-afghanistan/.

 ৪) ‘Washingtonpost.Com’, accessed 19 August 2021, https://www.washingtonpost.com/wp-srv/nation/specials/attacked/transcripts/laurabushtext_111701.html.

 ৫) George W. Bush Institute, We Are Afghan Women: Voices of Hope (Simon and Schuster, 2017).

 ৬) Françoise Vergès, A Decolonial Feminism (Pluto Press, 2021), https://www.plutobooks.com/9780745341125/a-decolonial-feminism.

 ৭) Hamid Dabashi, ‘Native Informers and the Making of the American Empire’, Campus Watch, accessed 28 October 2021, https://www.meforum.org/campus-watch/10542/native-informers-and-the-making-of-the-american.

৮)  Matthew Hill, David Campanale, and Joel Gunter, ‘“Their Goal Is to Destroy Everyone”: Uighur Camp Detainees Allege Systematic Rape’, BBC News, 2 February 2021, sec. China, https://www.bbc.com/news/world-asia-china-55794071.

 ৯) ‘Female Afghan Politician Malalai Joya Speaks Out’, The Guardian, 31 December 2008, sec. World news, https://www.theguardian.com/world/2008/dec/31/afghanistan-human-rights.

 ১০) Tamar Lapin, ‘Horrifying Tales of “Forced Marriages” Emerge in Taliban-Held Areas’, New York Post, 17 August 2021, https://nypost.com/2021/08/17/taliban-held-areas-see-emergence-of-forced-marriages/.

১১)  Lila Abu-Lughod, Do Muslim Women Need Saving? (Harvard University Press, 2013).

১২)  Deepa Kumar, Islamophobia and the Politics of Empire: Twenty Years after 9/11 (Verso Books, 2021).

১৩) ‘No Good Men Among the Living’, Macmillan, accessed 28 October 2021, https://us.macmillan.com/books/9781250069269/nogoodmenamongtheliving.

১৪)  Saadia Toor, ‘Imperialist Feminism Redux’, Dialectical Anthropology 36, no. 3 (1 December 2012): 147–60, https://doi.org/10.1007/s10624-012-9279-5.

১৫)  Puar, Terrorist Assemblages.

১৬)  ‘RAWA Responds to the Taliban Takeover « RAWA’, accessed 28 October 2021, http://www.rawa.org/rawa/2021/08/21/rawa-responds-to-the-taliban-takeover.html.

১৭)  Gayatri Spivak, ‘Can the Subaltern Speak?’, in Colonial Discourse and Post-Colonial Theory: A Reader, Patric Williams and Laura Chrisman (Hertfordshire: Harvester Wheatsheaf, 1994).

১৮)  Slavoj Zizek, ‘The Real Reason Why the Taliban Has Retaken Afghanistan so Quickly, Which Western Liberal Media Avoids Mentioning’, RT International, Agust 2021, https://www.rt.com/op-ed/532207-zizek-taliban-retake-afghanistan-reason/.

১৯)  ‘Yanis Varoufakis on Twitter’, Twitter, accessed 28 October 2021, https://twitter.com/yanisvaroufakis/status/1427012544523296774.

২০)  Priyamvada Gopal, ‘On the Anniversary Weekends of Independence and Partition Two Things to Remember 1. Transfer of Power Is Not Decolonisation 2. Invading, Making a Mess, Then Leaving the Natives to Bloodshed and Dispossession Is Part of the Apparatus of Empire, Not Its End.’, Tweet, @PriyamvadaGopal, 14 August 2021, https://twitter.com/PriyamvadaGopal/status/1426466156110569473.

২১)  Priyamvada Gopal, ‘On Decolonisation and the University’, Textual Practice 35, no. 6 (3 June 2021): 873–99, https://doi.org/10.1080/0950236X.2021.1929561.

২২)  ‘Where in the World Is the U.S. Military? – POLITICO Magazine’, accessed 28 October 2021, https://www.politico.com/magazine/story/2015/06/us-military-bases-around-the-world-119321/.

২৩)  ‘Israel-Gaza: How Much Money Does Israel Get from the US?’, BBC News, 24 May 2021, sec. Reality Check, https://www.bbc.com/news/57170576.

২৪) Jack Detsch Lynch Robbie Gramer, Colum, ‘After Death of U.S. Citizen, State Department Floats Slashing Egypt Aid’, Foreign Policy (blog), accessed 28 October 2021, https://foreignpolicy.com/2020/03/31/egypt-us-military-aid-middle-east-trump-sisi-congress-death-mustafa-kassem-american-citizen-detained/.

২৫) Elora Shehabuddin, Sisters in the Mirror: A History of Muslim Women and the Global Politics of Feminism (Univ of California Press, 2021)

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •